সরোজ দত্ত : অমরত্বের ৫০ বছরেও যার কলম কে ভয় করে শাসকশ্রেণী

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ০৫, ২০২১ 0 Comments A+ a-


সেই মধ্যরাতে কোন গগনভেদী চিৎকার কেউই শুনতে পায়নি, কারণ তিনি ক্রন্দনরত অবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেননি। নেতা ছিলেন, তাই নেতার মতন মৃত্যু বরণ করেছিলেন। মাথা উঁচু করে জীবন দান করেন তাঁর স্বপ্নের সুন্দর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। তাই তাঁর উদ্ধত শির কেটে নিয়ে গেছিল রাষ্ট্রীয় ঘাতক বাহিনী আর সেই মাথা বিগত ৫০ বছরে খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাঁকেও পাওয়া যায়নি, রাষ্ট্রের হাতে খুন হলেও তিনি রাষ্ট্রের খাতায় নিখোঁজ। তিনি সরোজ দত্ত, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) [সিপিআই(এম-এল)] এর প্রতিষ্ঠাতা ও নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের জন্মদাতা চারু মজুমদারের প্রধান সেনাপতি। আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ৪ঠা/৫ই আগস্ট মধ্যরাতে, ভারতের শাসকশ্রেণী তাঁকে হত্যা করে।

ভারতের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তাত্ত্বিক যে বুনিয়াদ চারু মজুমদার সৃষ্টি করেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাও জেদং চিন্তাধারার ভারতের মাটিতে সফল প্রয়োগ করে, এই মাটির বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ করে, তাকে বিশ্বজনীন করার এবং সমস্ত ধরণের সংশোধনবাদী আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যে ভূমিকা সরোজ দত্ত পালন করেন, তা ঐতিহাসিক ও অনবদ্য। 

সরোজ দত্তের হত্যার খবর শুনে চারু মজুমদার লিখলেন, “কমরেড সরোজ দত্ত পার্টির নেতা ছিলেন এবং নেতার মতোই তিনি বীরের মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর বিপ্লবী নিষ্ঠা এক আদর্শ হিসেবে তরুণদের গ্রহণ করতে হবে, সমস্ত দুর্বলতা কাটিয়ে আরও দৃঢ়ভাবে বিপ্লবের পথ গ্রহণ করতে হবে। শ্রমিক এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হয়ে এই হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে হবে।” 

পূর্ব বঙ্গের নড়াল জেলায় ১৯১৪ সালের ১৩ই মার্চ সরোজ দত্ত জন্ম গ্রহণ করেন। নড়াল ভিক্টোরিয়া কলিজিয়েট স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন আর তারপরে সেখান থেকেই আইএ পাশ করে তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন ১৯৩৩ সালে। ছাত্র অবস্থায় সরোজ দত্ত রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। এর পরে তিনি ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ অবধি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজীতে এমএ পড়েন ও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তারপরে তিনি ১৯৩৯ সালে যদিও বা অমৃতবাজার পত্রিকায় সহ সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন, কিন্তু কর্মচারী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁর চাকরী চলে যায়। 

অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে সরোজ দত্তের যোগাযোগ ছিল এবং তিনি যুদ্ধের সময়ে স্বাধীনতা পত্রিকায় যোগদান করেন। বেলা দত্তের সাথে যখন তাঁর বিয়ে হয় তখন তাঁর স্ত্রী একজন দলীয় সদস্য হলেও তিনি তা ছিলেন না এবং সেই নিয়েও তিনি গর্ব করতেন। তেভাগা ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কে উচ্ছেদ করার সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের অনীহা প্রভৃতি তাঁকে প্রভাবিত করে। 

ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলনে সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রাম তীব্র হওয়ায়, বিশেষ করে জওহরলাল নেহেরু ১৯৬২ সালে চীন আক্রমণ করায় তিনি প্রতিবিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন।  ১৯৬৩ সাল থেকে তিনি সাপ্তাহিক ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। এই পত্রিকায় থাকাকালীন সরোজ দত্ত সিপিআই-র শোধনবাদী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি কে অনুধাবন করে মাও জেদং চিন্তাধারা প্রয়োগের পক্ষ নেন। এই নিয়ে পরবর্তীতে গঠিত সিপিআই (মার্কসবাদী) নেতৃত্বের সাথে তাঁর মতভেদ তীব্র হয়। 

এই মতাদর্শগত সংগ্রাম চলাকালীন, ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের সূচনা করেন চারু মজুমদার আর সরোজ দত্ত এই সংগ্রাম কে দুই হাত তুলে সমর্থন জানান আর গড়ে তোলেন দেশব্রতী পত্রিকা, যা বাংলা ভাষায় বিপ্লবী সাংবাদিকতার এক নতুন নিদর্শন হয়ে ওঠে। এর পরে সরোজ দত্ত হয়ে ওঠেন শাসক শ্রেণীর কাছে এক আতঙ্কের বস্তু।

তাঁর তীক্ষ লেখনী দিয়ে সরোজ দত্ত বিপ্লবী সাংবাদিকতার সাথে যে দুইটি বিশেষ সংগ্রাম চালিয়েছেন তা হল চারু মজুমদারের কতৃত্ব কে ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম আর শাসক শ্রেণীর তৈরী করা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও মনীষীদের স্বরূপ তিনি বিপ্লবী যুব সমাজের সামনে উন্মোচন করেন, নেতৃত্ব দেন মূর্তি ভাঙার সংগ্রামে, পুরানো কে ভেঙে নতুন কে প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় নিয়ে।

চারু মজুমদারের কতৃত্ব কে বারবার আক্রমণ সহ্য করতে হয় দক্ষিণপন্থী ও অতি বাম সুবিধাবাদের থেকে। এই লড়াইয়ে সরোজ দত্ত হয়ে ওঠেন তাঁর তাত্ত্বিক সেনাপতি। সিপিআই (এম–এল) দলের ভিতরে তিনি চারু মজুমদারের কতৃত্বের প্রশ্নে দুই লাইনের সংগ্রাম চালান, ও যে ভাবে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টিতে লিন বিয়াও সংগ্রাম চালান মাও জেদং কে রক্ষা করার, সেই রকম সংগ্রাম তিনি ভারতের মাটিতে চালান। নানা রঙের সংশোধনবাদী ধারার নির্লজ্জ আক্রমণ থেকে চারু মজুমদার কে শুধু তিনি রক্ষা করেননি, বরং যে ভাবে ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস কার্ল মার্কসের কতৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে ভাবে য়োসিফ স্তালিন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের কতৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে ভাবে লিন বিয়াও মাও জেদং-র কতৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঠিক তেমনি সরোজ দত্ত সেইদিন চারু মজুমদারের বিপ্লবী কতৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করেন। 

তাই যে এঙ্গেলস এর শহীদ দিবসের সাথে তাঁর শহীদ দিবস মিলে মিশে একাকার হল, সেই এঙ্গেলসের পথে চলেই, এঙ্গেলসের “কতৃত্ব প্রসঙ্গে”-র মতন সরোজ দত্ত লিখলেন “বিপ্লবী কতৃত্ব প্রসঙ্গে”, ও সিপিআই (এম-এল) দলের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা রঙ বেরঙের সংশোধনবাদী ধারার মুখোশ তিনি ছিড়ে ফেলেন তাঁর ধারালো শব্দ, যুক্তি ও তথ্য দিয়ে। 

“শশাঙ্ক” নামে কলম ধরেন সিপিআই (এম-এল) বাংলা মুখপত্র দেশব্রতী পত্রিকায়। শুধু মার্কসবাদী তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়, “পত্রিকার দুনিয়ায়” নামক কলামে নিয়মিত বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যম ও শোধনবাদী পত্র-পত্রিকার ঝানু সাংবাদিকতার সমস্ত নিদর্শন কে তিনি কাটা ছেঁড়া করে দেখাতেন রাইফেল হাতে উদ্ধত ভারতের দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষককে দেখে কী চরম ভয়ই না পেয়েছে দেশী-বিদেশী শাসক শ্রেণী। এ ছাড়াও, চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রভাব ভারতের কৃষি বিপ্লবে ১৯৬৯-৭০ সালে পড়ার কারণে, নতুন আলোকে, মাও জেদং-র চিন্তাধারার আলোকে নতুন করে যখন ভারতের উপরিকাঠামো কে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও দর্শন কে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম চিনতে শিখলো, তখন ভারতের শাসক শ্রেণীর দ্বারা মানুষের উপর মানুষের শোষণ কে বজায় রাখার কাজ যে তথাকথিত মনীষীরা আর তাঁদের দর্শন করেছিল, তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন এই তরুণ প্রজন্মের অগ্রগামী অংশ।

অকাট্য তথ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে সুভাষ বসু, ‘বিদ্যাসাগর’ থেকে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রামমোহন রায় থেকে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের সাধের মনীষীদের স্বরূপ তিনি উন্মোচন করেন, তাঁদের চিহ্নিত করেন সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে ও বিধান দেন এদের মূর্তি ভেঙে যুব সমাজ ঠিক কাজই করছে। সরোজ দত্ত লেখেন পুরানো কে ভাঙা হচ্ছে নতুন গড়তে। বললেন “পুরানো কে না ভাঙলে নতুন গড়া যায় না”, তাই তিনি উপরিকাঠামোর ক্ষেত্রে বিপ্লবের চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষা কে ব্যবহার করলেন ভারতের বিশেষ পরিস্থিতির সাথে।

সরোজ দত্তের তথ্যবহুল লেখায় সিপিআই (এম-এল) এর কর্মী ও সমর্থকেরা যেমন একদিকে চিনতে শিখলেন শাসকশ্রেণীর, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পদলেহী, সামন্তবাদী ও মুৎসুদ্দী বেনিয়া পুঁজিপতিদের দালাল মনীষীদের স্বরূপ, স্বাধীনতা আন্দোলনের নামে ভারতের বৃহৎ জোতদার-জমিদার আর মুৎসুদ্দী পুঁজিপতিদের ব্রিটিশ শাসকদের সাথে রক্ষিতার মতন দর কষাকষির অঙ্ক, তেমনি তাঁরা শিখলেন কী ভাবে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মাথায় চড়ে বসে, বেইমান নেতৃত্ব এই শাসকশ্রেণীর লেজুড়বৃত্তি করেছে। “পত্রিকার দুনিয়ায়” কলামে “শশাঙ্ক” যেমন বনেদি বুর্জোয়া কাগজগুলোর, আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্যা স্টেটসম্যান, যুগান্তর ও অমৃতবাজার পত্রিকার, ধূর্ত সাংবাদিকতার স্বরূপ জনতার সামনে তুলে ধরলেন, ঠিক তেমনি, কী ভাবে গণশক্তি, কালান্তর, দেশহিতৈষী, প্রভৃতি রঙ বেরঙের আধুনিক সংশোধনবাদের মুখপত্র গুলো মানুষ কে বিষাক্ত রাজনীতি দিয়ে বশ করতে চাইছে, তাও তিনি প্রকাশ্যে আনলেন। 

পি সুন্দারাইয়া থেকে বিটি রনদিভে, জ্যোতি বোস থেকে প্রমোদ দাশগুপ্ত, নাগী রেড্ডি থেকে উৎপল দত্ত, বা ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার সমর সেন, কাউকেই রেয়াত করেনি তাঁর কলম। বর্তমান সময়ে একটি দেশের বিপ্লবী সংগ্রাম যে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম না করে এক পাও এগোতে পারবে না, সেই কথা কিন্তু সরোজ দত্ত বারবার তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করেছেন। যে কোন মতাদর্শগত সংগ্রামে দুইটি মূল পক্ষ হয়, আর তাই, চারু মজুমদারের কতৃত্ব কে নিঃশর্ত ভাবে মেনে নিয়ে, সরোজ দত্ত বলতেন “আমি চারু মজুমদারের পক্ষ”, যা তাঁকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে মাও জেদং এর উত্তরাধিকারী হিসাবে গণ্য হওয়া লিন বিয়াও-র সমকক্ষ করে তোলে। 

তাই অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায় তাঁর আর লিন বিয়াও-র মৃত্যুর মধ্যে। সরোজ দত্ত কে হত্যা করা হয় চারু মজুমদারের আগে, আর লিন বিয়াও কে ঠিক তার এক মাস পরে হত্যা করা হয়। আবার চারু মজুমদার জীবিত থাকা অবধি চীন থেকে লিন বিয়াও-র মৃত্যুর কথা ঘোষণা করা হয়নি। আর চারু মজুমদার কে হত্যা করার পরেই আন্তর্জাতিক  সংশোধনবাদীরা, ঝৌ এনলাই আর দেঙ শিয়াওপিং এর নেতৃত্বে, মাও জেদং কে ঘেরাও করে চীনের রঙ পাল্টে, পুঁজিবাদ পুনঃস্থাপন করা শুরু করে, যার বিরুদ্ধে বিশ্বে প্রথম আওয়াজ ওঠে বর্ধমানের কামালপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত সিপিআই (এম-এল) এর দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে, ১৯৭৩ সালে। 

সংশোধনবাদী লাইনের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামে, লিন বিয়াও আর সরোজ দত্ত বিপ্লবী কতৃত্ব রক্ষার সংগ্রামে একাকার হয়ে গেছেন, আর তাই তাঁকে মানার ভান করেও তাঁর রাজনৈতিক লাইনের, চারু মজুমদার, লিন বিয়াও ও মাও জেদং এর প্রতি তাঁর নিঃশর্ত বিশ্বাস কে ব্যঙ্গ করে অনেকেই আজ তাঁকে “একপেশে” বলেন। আর এই “একপেশে” বলে সরোজ দত্ত কে আক্রমণ করে আসলে আক্রমণ করা হয় চারু মজুমদার কে, যিনি সরোজ দত্ত কে পার্টির নেতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ও সমগ্র যুব-ছাত্র সমাজ কে তাঁর দৃষ্টান্ত মেনে কাজ করতে বলেছেন। সরোজ দত্ত “একপেশে” হলে চারু মজুমদার কি তাঁর পক্ষ ধারণ করতেন? সরোজ দত্ত যা লিখেছেন তাতে কি শাসকশ্রেণীর গাতৃদাহ হয়েছে না শোষিত মানুষের? লড়াইটা যখন দুইটি শ্রেণীর, দুইটি শিবিরের তখন তো একটি পক্ষই ধারণ করা উচিত। সেই সময়ে অন্য পক্ষকেও গুরুত্ব দেওয়ার কথা যাঁরা বলেন তাঁদের উদ্দেশেই সরোজ দত্ত বলেন যে “মনে হয় লাথি মেরে শালাদের দাঁতের পাটি খসিয়ে দিই!”

বর্তমানে যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদী-র সরকার কে সমালোচনা করা হচ্ছে এই বলে যে এই সরকার তার বিরুদ্ধে লেখার সাহস দেখানো সব সাংবাদিকদের উপর নজরদারি করছে বা জেলে পুড়ছে, প্রতিক্রিয়াশীল ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের মতন, তখন সরোজ দত্ত তাঁর শাহাদাতের ৫০ বছর পরে ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন। সরোজ দত্ত শুধু সরকারের বিরুদ্ধে লেখেননি, তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সক্রিয় ভাবে নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে যেখানে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার অভিযোগ করা হচ্ছে মোদীর বিরুদ্ধে, তার ৫০ বছর আগে সরোজ দত্তের উদ্ধত শির কেটে ফেলে আতঙ্কিত শাসক কারণ তিনি এক শাসক বদলে অন্য শাসক, এক শোষণের বদলে অন্য শোষণের কথা বলেননি, বলেছিলেন শোষণহীন সমাজের কথা, লিখেছিলেন ব্যবস্থা বদলের কথা, এক শ্রেণীর দ্বারা অন্য শ্রেণী কে উৎখাত করে নতুন রাষ্ট্র গড়ার কথা। 

যদিও বর্তমানে অনেকেই সরোজ দত্তের বিপ্লবী সত্তা বাদ দিয়ে তাঁকে শুধুই একজন “কবি” বা “সাংবাদিক” হিসাবে তুলে ধরেন, এই রকম কোন পরিচয়ে সরোজ দত্ত নিজেকে পরিচিত করাননি কোনদিনই। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন একজন “বিপ্লবী” হিসাবে আর তাই তিনি নিজ প্রাণ দিতে কোনদিন পিছপা হননি। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্লোগান “fight self, combat revisionism” (আত্মস্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করুন, সংশোধনবাদ কে নাকচ করুন) এর তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন তাঁর কমরেডদের, যে একটা for (জন্যে) যদি এই স্লোগানে ঢোকানো হয়, “fight for self” যদি হয়ে যায়, সেটা কিন্তু গোটা রাজনীতি কে বদলে দিতে পারে। তাই সরোজ দত্ত নিজের সংগ্রামে একটিও ভেজাল শব্দ ঢোকাননি, নির্ভীক চিত্তে আত্মস্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করেন ও প্রাণ দেন। 

পার্টির নেতা হিসাবে, চারু মজুমদারের উত্তরাধিকারী হিসাবে সরোজ দত্ত কোন বিশেষ সুবিধা চাননি। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে বহু যোজন দূরে বসে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী-সুলভ কায়দায় তিনি বিপ্লব নিয়ে থিসিস লেখেননি। লড়াইয়ের ময়দানে, গ্রামে গঞ্জে, তিনি চারু মজুমদারের সহযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধে যোগ দেন। স্মৃতি কথায় বলা হয় যে যখন তাঁর জীবনসঙ্গিনী বেলা দত্ত তাঁর কাছে জানতে চান যে তিনি কেন নিজে লড়াইয়ে জড়াচ্ছেন, তখন সরোজ দত্ত বলেন “এইডা কি কইলা বেলা! যুদ্ধে কি শুধু বাহিনী মরব! আরে দুই একডা সেনাপতিরও তো জান যাইব!” 

তিনি জানতেন রাষ্ট্র পেলে তাঁকে ছিঁড়ে খাবে কারণ তিনি কানু স্যানাল নন, সন্তোষ রানা বা অসীম চ্যাটার্জি নন, তিনি সরোজ দত্ত, সিপিআই (এম-এল) এর রণনীতি ও রণকৌশল পরিচালক চারু মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। তবুও ভীত হননি, শাসকের কাছে তাঁর জীবন ভিক্ষা করেননি, সংবিধান বা আইনের দোহাই দেননি। যে রাষ্ট্র তাঁর কাছে বেআইনি, যে রাষ্ট্র কে তাঁর দল সিপিআই (এম-এল) শত্রু ঘোষণা করেছিল, সেই রাষ্ট্রের কাছে কোন আশা আজকের দিনের স্বঘোষিত মধ্যবিত্ত বিপ্লবীদের মতন তিনি পোষেননি। 

ফলে আজ যাঁরা সরোজ দত্তের মৃত্যুর তদন্তের দাবি তোলেন, যাঁরা তাঁর হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি তোলে সেই শাসকের কাছে যে সরোজ দত্ত কে হত্যা করেছিল, তাঁদের চেয়ে বড় সরোজ দত্তের নাম নিয়ে সরোজ দত্ত বিরোধিতা কে করে? যে সরোজ দত্ত বিপ্লবীদের জেলে “রাজবন্দী” হওয়ার আন্দোলন না করে জেল ভাঙার লড়াই করতে বলেন চারু মজুমদারের শিক্ষা অনুসারে, যে সরোজ দত্ত কংগ্রেস সরকার দেশব্রতী ও লিবারেশন এর অফিস হানা দেওয়ার পরে আইনী লড়াইয়ের প্যাঁচে না পড়ে বরং বেআইনী ভাবে পত্রিকা ছাপানোর পদ্ধতি গ্রহণ করেন, সেই সরোজ দত্তের কথা বলে রাষ্ট্রের কাছে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা কি ধৃষ্টতা নয়?

সরোজ দত্ত কে মেরে খুনী শাসকশ্রেণী ভেবেছিল চারু মজুমদারের বিপ্লবী কতৃত্ব কে শেষ করে দেওয়া যাবে, কিন্তু গত ৫০ বছর ধরে উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির মতন জেগে থাকা সরোজ দত্ত তাঁর লেখনী ও তাঁর নিষ্ঠার সাথে যে হাজারো মানুষ কে বিপ্লবের পথে চলার অনুপ্রেরণা দেবেন, সেই হিসাব তারা করতে পারেনি। ফলে, সরোজ দত্ত আজও তাঁদের কাছে এক আতঙ্কের বস্তু। 

সরোজ দত্ত কে আজকের দিনে স্মরণ করে, তাঁর স্মৃতিতে সেই পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে চিরকালের মতন স্লোগান দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া হবে সরোজ দত্তের সাথে বেইমানি করা। সরোজ দত্তের কোন বাড়ি নেই, সরোজ দত্ত কোথাও ফিরে যেতে চাননি, শুধু এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি মুহূর্তে যেহেতু সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি, সব কিছুর মধ্যেই পরিবর্তন হচ্ছে, তাই কী হলে কী হতে পারতো অতীতে সেই আলোচনায় আটকে না থেকে, চারু মজুমদারের যে রাজনীতি কে প্রয়োগ করতে গিয়ে সরোজ দত্ত প্রাণ দিলেন, যে রাজনীতি ভারতীয় উপমহাদেশে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাও জেদং এর চিন্তাধারার সঠিক প্রয়োগের ফসল, সেই রাজনীতি কে, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বৃহৎ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার জন্যে, উন্নীত করা, সমাজের দ্বন্দ্বগুলোর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে তাদের সমাধানের পথ খোঁজা, এই হল সরোজ দত্ত কে স্মরণ করার একমাত্র পথ। সেই পথে চলা এবং সরোজ দত্তের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সাহসের সাথে সমাজ বিপ্লবের সংগ্রামে ঝাঁপ দেওয়াই হবে সরোজ দত্ত কে সঠিক ভাবে সম্মান জানানো। চারু মজুমদারের ভাষায় যা শ্রমিক এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হওয়ার সংগ্রাম করা।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে