নকশালবাড়ির মূর্তিগুলো: মহাদেবের মানিক কথা

বুধবার, মে ২৫, ২০২২ 0 Comments A+ a-

১৯৮২ সাল, নকশালবাড়ি কৃষক উত্থানের ১৫ বছর পরে নকশালবাড়ি তখন সিপিআই (এম) দৌরাত্ম্যে, আন্দোলনের মুখ হিসাবে বাজার দখল করে রয়েছে সিপিআই (এম - এল) থেকে বিতাড়িত, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কানু স্যানাল আর আন্দোলনের একদা পুরোধা জঙ্গল সাওতাল। নকশালবাড়ি অঞ্চলে পুনরায় ঢোকার ও উত্তর বঙ্গের নেপাল, ভুটান ও চীন/তিব্বত সীমান্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে বিহার ও বাংলাদেশ সীমান্ত অবধি বিস্তৃত অঞ্চলে আবার কাজ শুরু করার জন্যে সিপিআই (এম - এল) মুখিয়ে ছিল। আরও মুখিয়ে ছিল চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত চলা কুৎসার বান রুখতে, মানুষ কে বোঝাতে যে নকশালবাড়ি কানু, জঙ্গল, সৌরেন বোস, খোকন মজুমদারের যৌথ নেতৃত্বের ফসল না, এটা চারু মজুমদারের নিজের সৃষ্টি, ভারতের তৎকালীন বিশেষ পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ - লেনিনবাদ, মাও সেতুং এর চিন্তাধারার প্রথম সঠিক প্রয়োগ ও লিন পিয়াও-র জনযুদ্ধের তত্ত্বের ভিত্তিতে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের প্রথমবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল (এলাকা ভিত্তিক) ও পাল্টা সরকার গড়ার লড়াই। এই পরিস্থিতিতে, কাজে এল একটি মূর্তি। চারু মজুমদারের মূর্তি।
কলকাতার থেকে মূর্তি বানিয়ে ট্রেনে করে সিপিআই (এম - এল) নেতা মহাদেব মুখার্জী শিলিগুড়ি হয়ে নকশালবাড়ি আসলেন। নকশালবাড়ির শহীদদের রক্তে ভেজা প্রসাদজোতের থেকে অদূরে ব্যাঙাইজোতে প্রতিষ্ঠিত শহীদ বেদীর পাশেই বসলো চারু মজুমদারের মূর্তি। সেই মূর্তির মাধ্যমে হল নতুন যোগাযোগ স্থাপন, গড়ে উঠলো নতুন উত্তর বঙ্গ আঞ্চলিক কমিটি।

দশ বছর পর, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙছে, লেনিনের মূর্তি উপড়ে ফেলছে লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, ইউক্রেন বা আজারবাইজানের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, যখন কমিউনিস্ট বিপ্লবের আঁতুড় ঘরে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হলো লেনিন আর স্তালিনের আবক্ষ মূর্তি। এর পরে এল মাও এর মূর্তি, সালটা ২০০৬ বোধহয়। তারপরে এল সরোজ দত্ত, লিন পিয়াও আর মহাদেব মুখার্জীর মূর্তি, এক এক সময়, এক এক পরিপ্রেক্ষিতে। 

সেই উত্তর বঙ্গ আঞ্চলিক কমিটির নেতৃত্বে যখন তিস্তার চর অঞ্চলে জোর জমির আর ক্ষমতার লড়াই হচ্ছে সিপিআইএমের সাথে, ২০০১-০৪ সালে, তখন এক ভূমিহীন দলিত কৃষক, পার্টির সংস্পর্শে আসেন। নানা শ্রেণী সংগ্রামে অংশ নেন। কেন্দ্রে অটল বাজপেয়ীর আমলে উত্তর বঙ্গের তিস্তার চর অঞ্চলে আরএসএস এর দল হিন্দুত্বের রাজনীতি ছড়াতে আসে। এখানে বাস করা উদ্বাস্তু (ভাটিয়া) আর আদিবাসীদের দ্বন্দ্ব কে কাজে লাগিয়ে সংগঠন তৈরি শুরু করে। রুখে দাঁড়ান সেই ভূমিহীন কৃষক ও তাঁর দ্বারা গড়ে ওঠা স্থানীয় কৃষকদের সংগঠন। আঞ্চলিক কমিটির নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে তীব্র সংগ্রাম, তার ফলে ধাক্কা খায় আরএসএস। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তাদের সংগঠন, কিন্তু পুলিশী সন্ত্রাসের কারণে, মনে রাখবেন তখন কিন্তু "বাম শাসন", আরএসএস এর সাথে লড়াই করা কমিউনিস্টদের, বিশেষ করে সেই ভূমিহীন কৃষক কে আত্মগোপন করতে হয়।

আরও একজন কৃষকের সাথে তিনি আত্মগোপন করে আছেন জলপাইগুড়ির জঙ্গলে, পার্টির আঞ্চলিক কমিটির নেতা "রতন" (অনেকে তাঁকে রতন দে বলেন) তাঁদের সাথে যোগাযোগ করেননি। পার্টির স্থানীয় কমরেডরাও নেই কাছে পিঠে। কোথায় যাবেন, কী করবেন, কোনো ঠিক নেই। বাইরে হায়নার মতন হিংস্র রাষ্ট্র তাঁদের মারতে খুঁজছে। এমন অবস্থায়, তাঁরা প্রায় অনাহারে মরতে বসেন। এমন সময় তাঁরা দেখেন জঙ্গলের জলাভূমির কাছে আছে শাঁক। সেই শাঁক তুলে, তাঁদের সাথে আনা সাইকেলে করে পাশের কোনো গ্রামের হাটে গিয়ে বিক্রি করে তাই দিয়ে কিছু খেয়ে থাকা শুরু হল। হঠাৎ অচেনা মানুষ দেখে সেই গ্রামের মানুষের সন্দেহ হল যে তাঁরা কারা। একদিন তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন এই দুই জন কে যে তাঁরা কারা, কোথায় থাকেন আর কী করেন। 

মিথ্যা না বলে তাঁরা দুই জন জানান তাঁরা কী রাজনীতি করেন আর কী জন্যে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের কথা শুনে সেই গ্রামেই তাঁরা শেল্টার পান। সেই ভূমিহীন কৃষক তখন আবার সংগঠন গড়ে তোলেন তখন জঙ্গলের রেঞ্জার বাহিনীর সাথে আদিবাসী জনতার ঝামেলা তুঙ্গে জঙ্গল থেকে কাঠ তোলা কে কেন্দ্র করে। এরই মধ্যে রেঞ্জারের গুলিতে এক আদিবাসী যুবকের মৃত্যু হলে অঞ্চলের মানুষ ক্ষিপ্ত হন। দোষীদের শাস্তি আর ক্ষতিপূরণের দাবিতে গড়ে ওঠে আন্দোলন। সেই আন্দোলনের মধ্যমণি সেই ভূমিহীন কৃষক নেতা। লাশ নিয়ে বন বিভাগের দফতর যাওয়া হয়, সেখানে কার্যত কর্তাদের ঘেরাও করে লিখিত প্রতিশ্রুতি পেয়ে আন্দোলন জয়ী হয়। এর ফলে তাঁরাও যে লড়ে জিততে পারেন সেই কথা আদিবাসীরা বিশ্বাস করা শুরু করেন। দলে দলে তাঁরা সেই সিপিআই (এম - এল) দলে যোগ দেন।

তারপরে তিস্তা দিয়ে অনেক পানি বয়ে যায়। তাঁর কাজের মাধ্যমে অঞ্চলেই শুধু জনপ্রিয় ও অধরা নেতা হয়ে ওঠেন না সেই ভূমিহীন কৃষক নেতা। প্রতি বার তাঁর কর্মকাণ্ডে আনন্দিত হন মহাদেব মুখার্জী। দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর মত যে সিপিআই (এম - এল) পার্টির নেতৃত্ব যতদিন না চারু মজুমদারের কথা মতন "ভদ্রলোক" সম্প্রদায়ের, মধ্যবিত্ত "তাত্ত্বিক" পণ্ডিতদের থেকে মুক্ত হয়ে গরিব, শোষিত, দলিত মানুষের, শ্রেণীর হাতে যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত কোনো উন্নতি হবে না। এই ভূমিহীন কৃষকের আগে তিনি একদা ভরসা করেছিলেন প্রথম (অষ্টম) কংগ্রেস ও দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেসের প্রতিনিধি অচিন মালের উপর, কিন্তু বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে মাল সেই ভরসার পাত্র থাকতে পারেননি। এই ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে মুখার্জী দেখলেন অসীম সম্ভাবনা। নিজের হাতে তাঁকে দিলেন পার্টির সদস্যপদ, নিজের হাতে মেম্বারশিপ কার্ডে তাঁর নতুন নাম দিলেন "মানিক"। সেটা ২০০৮ সাল।

তারপরে মানিক কে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করার জন্যে উঠে পড়ে লাগেন মুখার্জী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ। তবুও সবার বিরোধিতা (ভূমিহীন, লেখা পড়া না জানা মূর্খ চাষী কেন্দ্রীয় কমিটির মেম্বার কী ভাবে হবে? গোছের প্রশ্ন) সত্ত্বেও নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকের উত্থানে বিব্রত তাঁর "নেতা" হওয়া রতন নিজের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে। দাবি করে পদোন্নতির। কিন্তু মুখার্জী তাঁকে কোনো পাত্তাই দেন না। দলের মধ্যে উলঙ্গ হওয়া রতনের তখন দল ত্যাগ ছাড়া গতি ছিল না। মুখার্জী একটি চিঠি লিখলেন, বললেন মজুমদারের অমোঘ বাণীর কথা – শ্রেণীকে নেতৃত্বে উন্নীত না করতে পারলে যত বড় সম্ভাবনাই থাক তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

তাঁর পরে, ২০০৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি মহাদেব মুখার্জী প্রয়াত হন। চারু মজুমদারের শাহাদতের পরে, ৫-৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ এর পাঞ্জাবের রোপারে সংগঠিত নতুন কেন্দ্রের সময়ের থেকে যে পার্টির হাল তিনি ধরেছিলেন ও যাবতীয় অতি দক্ষিণ ও অতি বাম আক্রমণ সামলে তিনি পার্টি কে বাঁচিয়েছিলেন, তাঁর পরে সেই লড়াইয়ের ভার পড়লো মানিকের ঘাড়ে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে উত্তর বঙ্গের একটি অ্যাকশন এর ঘটনায় তাঁকে আবার গা ঢাকা দিতে হয়, ধরা পড়েন কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সদস্য ও দেশব্রতী পত্রিকার তৎকালীন সদস্য গোপাল ওরফে রজত দেব ও অন্য কমরেডরা। সেই সূত্রে আবার আত্মগোপন করে থাকেন মানিক। কিন্তু তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক করার প্রস্তাব নিয়ে তখন পার্টিতে তীব্র দ্বন্দ্ব।

এর পরে, ২০১০ সালে, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভার থেকে যে দুই লাইনের সংগ্রাম শুরু হয় তার ফলে মানিক বিরোধী "কমল", "গোপাল" ও রতনের কনিষ্ঠ ভাই চঞ্চল ওরফে বাপি ওরফে "কচি" পার্টির থেকে বিতাড়িত হয় নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমান জেলার তাঁদের কিছু সাগরেদদের সাথে। বাংলা, অবিভক্ত অন্ধ্র আর বিহার দাঁড়ায় মানিকের পক্ষে আর ২০১০ সালেই, দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে তিনি সিপিআই (এম - এল) এর তৃতীয় সাধারণ সম্পাদক হন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে বুদ্ধিজীবী তাত্ত্বিকদের প্রভাব শেষ হয়, দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষক ও শ্রমিকেরা নেতৃত্বে উঠে আসেন।

এর পরে মুঙ্গের জেলার ঐতিহাসিক চারু মজুমদার নগর আর মহাদেব মুখার্জী নগর গড়ার সংগ্রাম চলে ২০১৩ থেকে ২০১৮ অবধি। মুক্তি পায় অসংখ্য গ্রাম। কিন্তু আবার ধাক্কাও খায় সংগ্রাম। তেলেঙ্গানার সংগ্রাম তীব্র হয়। আর উত্তর বঙ্গের তরাই উপত্যকার কোনায় কোনায় ২০২২ সালে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন।

এরই মধ্যে কার্ল মার্কস এর মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় নকশালবাড়ি তে, যা অনেক দিন ধরেই বাকি ছিল। বলা হচ্ছে শীঘ্রই এঙ্গেলস এর মূর্তি প্রতিষ্ঠা হলে সম্পূর্ণ হবে সেখানে চারু মজুমদারের মূর্তি বসানোর থেকে শুরু প্রক্রিয়া। প্রতি বছর অনেকেই মালা দিতে যান সেখানে। সেই মালা নিয়ে রাজনীতিও হয়। মুখার্জী বলতেন লোক বেছে বেছে মালা দেয়। কাউকে দেয়, কাউকে দেয় না। এখনো তাই। তবুও মাঝে মধ্যে ভিড় বাড়লে তাঁরা সবাই কেই মালা দিয়ে যান, কে কে তা না বুঝেই। যেমন ২০১৭ সালে নকশালবাড়ি ৫০ বছর প্রাক্কালে লিবারেশন আর নয়া গণতন্ত্রের লোকেরা লিন পিয়াও আর মহাদেব মুখার্জীর মূর্তির গলায় মালা দিয়ে গেছিল কিছু না বুঝেই। তবে তাঁরা যাতে সেখানে আরএসএস এর শক্তি বৃদ্ধি সত্ত্বেও মালা দিতে পারেন, মিটিং করতে পারেন, ভাষণ দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে দিন রাত যাঁরা লড়েন, সেই লোকেদের আর তাঁদের ভূমিহীন "চাষা" নেতা কে কলকাতার ভদ্রলোকের বাড়ির খেতে পরতে পাওয়া শখের নকশালরা চেনেও না, চিনতে চায়ও না। অন্ধকার ঘনালে মূর্তিগুলো মিটিমিটি হাসে, অনেক দূরে, পাহাড়ের উপর, ঘরগুলোয় বিজলী বাতি জ্বলে ওঠে।



এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে