শুধু বুদ্ধিজীবিদের নয় চাই সামগ্রিক ভাবে খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ - প্রতিরোধ সংগ্রাম

সোমবার, নভেম্বর ০২, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

বিজেপি সরকারের ভাগ করো - শাসন করো নীতির বিরোধিতায় আজ গলা মিলিয়েছেন দেশের সাহ্যিতিক, চলচ্চিত্র শিল্পী ও নির্দেশকরা, বিজ্ঞানীরা, এবং সর্বপরি দেশের সেই শিল্পপতিদের একটি ক্ষুদ্র অংশ যাদের জুতো চেটে তোয়াজ করা এই নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতিতে সরকারের প্রধান কর্মকান্ড। এই ক্রমাগত বিরোধিতা বুদ্ধিজীবি মহল কে অনেক বছর পর রাজনৈতিক ভাবে একটু সতেজ করে তুলেছে, তাঁরা সম্মিলিত ভাবে ভয় কাটিয়ে আসতে আসতে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস পাচ্ছেন। নিছক গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে যেদিন দাদরির এক সাধারণ মুসলমান মানুষকে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়েছিল সংঘ পরিবারের গৌ বাহিনীর হাতে, সেদিন হতভাগ্য মোহাম্মদ আখলাক ভাবতেও পারেননি যে এই দেশে তাঁর মৃত্যু কি ভীষন আলোড়ন তৈরি করবে। বুদ্ধিজীবি, লেখক, নির্দেশক, বিজ্ঞানীদের সাথে যুক্ত হয়েছে উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার খাতে নন নেট ছাত্র -ছাত্রীদের স্বার্থে ইউজিসির প্রদত্ত বৃত্তি বন্ধ করার স্বিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশ জোড়া ছাত্র সংগ্রাম। ১৩৯ দিন ধরে সংগ্রাম চালিয়ে এফটিআইআই এর ছাত্ররা ধর্মঘট তুলে নিয়েও জারি রাখলেন গজেন্দ্র চৌহানের বিরুদ্ধে আন্দোলন। অন্যদিকে বিহারের নির্বাচনে লেজে গোবরে অবস্থা হওয়া সত্বেও টাকা দিয়ে ভোট কিনে ও অন্যান্য দলের কর্মীদের ঘুষ দিয়ে ভোটে জেতার প্রচেষ্টা করেও আজ মোদী ও অমিত শাহের বিজেপি নিশ্চিত হতে পারছে না, তাই অমিত শাহ কে ঘোষণা করতে হচ্ছে যে বিজেপির হার মানে পাকিস্তানের বিজয় (প্রকারন্তরে দেশের মুসলমানরা পাকিস্তানি) এই ঘৃণ্য তত্ব।

এত দেশ জোড়া বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মধ্যে হঠাত আরএসএস এর আদেশে বিজেপির একমাত্র শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি সাজা অরুণ জেটলি লিখলেন যে দেশে অসহিংসুতা নেই, বরং বাম ও উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবিরা নাকি চিরকাল অসহিংসু, তাঁরা নাকি চিরকাল মোদী কে ঘৃণা করে এসেছেন এবং তাঁরা মোদী বাবুকে আর প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখতে চাইছেন না , এর ফলে নাকি মোদী বাবু নিজেই অসহিংসুতার শিকার।  প্রথমবার জীবনে শুনতে হলো যে এক দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি নিজেই আক্রান্ত।  অরুণ জেটলির লেখায় যুক্তির চেয়ে বেশি ছিল কলমের খোঁচা মেরে চোখ থেকে জল ঝরিয়ে - ওই খুকি কাঁদছে বলে হাত তালি দেওয়ার ন্যাকামির প্রয়াস। গল্পের গরুকে শুধু গাছে তোলেননি জেটলি, গাছে তুলে মইটা তুলে ছুট লাগিয়েছেন। আপামর জনগণ কে বোকা বানাবার স্বার্থে যদিও অরুণবাবুকে একটু ভালো গল্প লিখতে শিখতে হবে। হয়তো বা দুর্দিনে তাঁর সমর্থন পাওয়ায় খুশি হয়ে আরএসএস এই কাজটি চেতন ভগত কে সঁপে দিতে পারে আর আমরা পাব এক  ইংলিশ এ লেখা নতুন উপন্যাস - দেড়খানা  প্রধানমন্ত্রী।

অরুণ বাবু দু:খ করে লিখেছেন যে বাম ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবিরা বড়ই অসহিংসু, তাঁরা বিরোধী মতকে (পড়ুন গেরুয়া ফ্যাসিস্ট)সমর্থন তো করেনই না, সেই মতামতকে নিজ গুণে বাড়তেও দেন না।  জেটলির আক্ষেপ বামদের মৌরসী পাট্টায় যে সকল প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে তাঁরা কোনও ভাবেই বিরোধীদের (পড়ুন সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্টদের) টিকে থাকতে দিতে চান না, তাঁরা বহুত্ববাদ কে ঘৃণা করেন বলেই তো বেচারা এবিভিপি জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, ও অন্যান্য নামী প্রতিষ্ঠানের ছাত্র - ছাত্রীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে অপারগ।  সেই জায়গায় বেচারা গৌ সেবকরা দুটো তিনটে বজ্জাত গরু খেঁকো কে মেরেছে তার জন্যে বেচারা প্রধানমন্ত্রী কে নিয়ে টানাটানি!

সমস্যাটা হচ্ছে অরুণ বাবু এবং তাঁর নাগপুরে বসা প্রভুরা এটা মেনে নিতে এখনো কষ্ট পায় যে শত চেষ্টা করেও গেরুয়া শিবিরে কিছু বাজারী অভিনেতা - অভিনেত্রী, পুরানো দিনের গাইয়ে - বাজিয়েরা ছাড়া বিশেষ করে বুদ্ধিজীবিরা ঘেঁষে না, রাম মন্দির আর রাম রাজত্ব থুড়ি ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট শাসনের পক্ষে এমনকি বহু দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবিরাও নাক সিঁটকে থাকেন।  এ ছাড়া দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্র - ছাত্রীরা চিরকালই এবিভিপি কে 'ছোট লোকের' পর্যায়ে গণ্য করে এবং একমাত্র তাদের শাসনাধীন রাজ্য ছাড়া কোথাও গেরুয়া শিবিরে ছাত্র-ছাত্রীরা বা এমনকি সুযোগ সন্ধানিরাও বেশি ঘেঁষে না। কিন্তু বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজির সেবা দাস বিজেপির দরকার দেশের যুব ছাত্রদের উপর ব্যাপক প্রভাব, যাতে তারা উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত উঁচু জাতের হিন্দুদের নিজেদের পক্ষে টেনে রাখতে পারে এবং তাঁদের দিয়ে কর্পোরেট পুঁজির লোভ লালসা চরিতার্থ করার প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু উঁচু জাতির হিন্দু ছাত্র যুব সমাজে ওই উত্তর প্রদেশ - গুজরাট - মধ্য প্রদেশ - রাজস্থান - হরিয়ানা ও দিল্লির গো বলয় বাদ দিয়ে দিলে আর কোথাও এবিভিপির কোনও প্রতিপত্তি নাই।  এই দুঃখে কাতর জেটলির কাছে প্রলাপ বকা ছাড়া আর কি করনীয় ?

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রাহ্মণ্যবাদকে চিরকালই শাসক শ্রেণী ভীষন ভাবে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। হিন্দু শাসকদের আমলে আজকের ভারত ছিল না, এবং নানা রাজত্বে বিভক্ত ভারতের নানা জাতির হিন্দুদের নানা ধরণের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র চিরকালই ভারতের এক অন্যন্য আকর্ষন ছিল। মুঘল বা তার আগের দিল্লির মুসলমান বাদশাহীর যুগেও মুসলমান শাসকরা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা তো করেননি বরং নিজ শাসন ও শোষনের স্বার্থে তাকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন চিরকাল।  ইংরেজদের ভারতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন কালে ধূর্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পথিকৃতগণ ব্রাহ্মণ্যবাদ কে চরম ভাবে তোয়াজ করে চলেছিল।ভারতবর্ষই সেই সময়ে একমাত্র দেশ ছিল যেখানে জাতি বৈষম্য শুধুমাত্র হিন্দুদের মধ্যেই নয় বরং মুসলমানদেরও ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে। এই দেশের যে সব নিচু জাতির শোষিত মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদকে পরাস্ত করতে মুসলমান বা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেন তাঁরাও অচিরেই বুঝেছিলেন যে জাতির শাসন এই দেশে কোনও ধর্মেই শেষ হবে না বরং নতুন রূপে আবির্ভূত হবে।

বর্তমানে বর্ণ শ্রমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা আরএসএস এর কাছে ভীষন প্রয়োজন কারণ একমাত্র এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই দেশব্যাপী সামন্তবাদ বিরোধী, কর্পোরেট পুঁজির শোষণ বিরোধী সংগ্রাম কে কন্ঠরুদ্ধ করে মারা সম্ভব হবে। মানুষকে মালিকের দাস বানিয়ে নির্বিবাদে গাধার মতন খাটিয়ে মারার ব্রাহ্মণ্যবাদের চেয়ে বেশি কার্যকরী নীতি আর কি বা হতে পারে ? বিনা মূল্যে শ্রম দেওয়ার যে রীতি আজও বিহার - উত্তর প্রদেশ - হরিয়ানা ও মধ্য প্রদেশের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে টিকে আছে তাকে আজ এক সর্ব ভারতীয় রূপ দিয়ে সামন্তবাদ ও বিদেশী এক চেটিয়া পুঁজির ভারতে ভিত শক্ত করে গড়ে তোলার কর্মকান্ডে আজ আরএসএস এক অগ্রদূত।

এই সময়ে আরএসএস ও বিজেপির বিরুদ্ধে দেশ জোড়া যে বিক্ষোভের আঁচে বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ হাওয়া দিচ্ছেন তার সব ভালোর মধ্যে মন্দটা হলো যে এই লড়াই শুধুমাত্র সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চ শ্রেনীর মানুষের মধ্যেই আজ সীমাবদ্ধ। আপামর খেটে খাওয়া গরিব মানুষের মধ্যে এই লড়াই কে ছড়িয়ে দিয়ে, তাঁদের ন্যায্য সংগ্রামের সাথে, সামন্তবাদ ও কর্পোরেট পুঁজির নির্মম শোষণ - অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁদের রোজকার বেঁচে থাকার সংগ্রামের সাথে তাঁদের লড়াইকে মিলিয়ে দিতে বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ আজ অপারগ, বা বলা ভালো তাঁরা সেই কাজটি করতে চান না, কারণ তাঁরা একটি এলিটিস্ট সিনড্রোমে ভোগেন। তাঁদের কাছে গরিবদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইগুলি ভীষণ তীক্ষ ও উগ্র, তাই তাঁদের পক্ষে শ্রমিক কৃষকের লড়াইয়ের সাথে একাত্ম হওয়া আজ মহা কষ্টকর কাজ।

আমরা যদি গভীর ভাবে ইতিহাসকে খতিয়ে দেখি তাহলে বুঝতে পারবো যে দেশের আপামর শ্রমিক ও কৃষকের সংগ্রাম, বিশেষ করে ঐক্যবদ্ধ ও সংহতি মূলক লড়াই ছাড়া ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা অসম্ভব।  বুদ্ধিজীবিদের লড়াইতে অনেক তাত্বিক মার প্যাঁচ, বড় বড় ভাষণ, গান, থিয়েটার, ও মনোরঞ্জনের নানা উপাদান হয়তো থাকতে পারে, তা হয়তো শ্রমিক কৃষকের সংগ্রামের মতন অত রুক্ষ ও সোজা সাপ্টা হয় না।  কিন্তু আর্থ -সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে বোঝা যাবে যে এই শ্রমিক কৃষকের সংগ্রামের থেকে বিছিন্ন সংগ্রাম বুদ্ধিজীবিদের হয়তো সাময়িক ভাবে তুঙ্গে তুলবে কিন্তু পরবর্তী কালে এই লড়াই কোনও রসদ না পাওয়ার কারণে এবং বিচ্ছিন্নতার কারণে অচিরেই কানা গলিতে চক্কর খাবে। যতদিন বুদ্ধিজীবিরা নিজেদের ক্ষুদ্র গন্ডি পের হয়ে শ্রমিক ও কৃষকের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মানসিকতা না অর্জন করতে পারছেন ততদিন তাঁদের অনুপস্থিতিতে ওই অমিত শাহ আর মোদী বাবু শ্রমিক - কৃষকের মধ্যে জাত ও ধর্মের ভিত্তিতে দেওয়াল তুলে তাঁদের সামন্তবাদ ও কর্পোরেট লুটের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে চোরাগলিতে টেনে নিয়ে শেষ করতে চাইবে। এই কারণেই তো বিজেপি আজ দেশী - বিদেশি পুঁজির সর্বশ্রেষ্ঠ দালাল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।

        

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে