ভাঙড়ের লড়াই আর বহিরাগতের গল্প

বুধবার, জানুয়ারী ২৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

ভাঙড়ের গণআন্দোলনের উপর পুলিশি নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে কলকাতায় প্রতিবাদ মিছিল


ভাঙড়ের কৃষিজীবি মানুষের জমিরক্ষা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে এবং তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের মাফিয়ারাজের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে গণআন্দোলনের কর্মী শর্মিষ্ঠা কে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বীর পুঙ্গব পুলিশ বাহিনী আরাবুলের হার্মাদদের সাহায্যে গ্রেফতার করেছে।

শর্মিষ্ঠা আজ পশ্চিমবঙ্গের জন্যে, ভাঙড়ের জনগণের জন্যে নাকি ভয়ানক বিপদজনক “সন্ত্রাসবাদী” - ভারতের তথাকথিত প্রজাতন্ত্রের ৬৭তম বার্ষিক প্রতিষ্ঠা উৎসবের আগে এই ছিল রাজ্যের গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের “মা-মাটি-মানুষের” সরকারের জনগণ কে দেওয়া উপহার। হয়তো বা নিন্দুকেরা বলবেন আরাবুলকে ওর দিদির দেওয়া উপহার !

শুরুটা বোঝাই গেছিল যখন হঠাৎ করে নিউটাউনের বিধায়ক ও বর্তমান রাজারহাটের সিন্ডিকেটবাজদের পাণ্ডা, সব্যসাচী দত্ত, আরাবুল ইসলামের প্রক্সি মেরে ভাঙড়ে পুলিশ ও তৃণমূলের সশস্ত্র হার্মাদ বাহিনী নিয়ে ঢুকে গ্রামের রাস্তার থেকে অবরোধ ওঠানোর কাজ শুরু করে তৃণমূল নেত্রী ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নির্দেশে।

প্রতিটা রাস্তা থেকে বন্দুকধারী পুলিশ, আরাবুলের সশস্ত্র পদাতিক বাহিনী এবং নিউটাউনের দুষ্কৃতীদের নিয়ে গাছের গুঁড়ি, পাথর ইত্যাদী সরাতে থাকে সব্যসাচী আর সাথে ছিল বাজারী সংবাদ মাধ্যমের ও জাগো বাংলার ফটোগ্রাফারদের বিশাল বাহিনী, মুহূর্তে মুহূর্তে পোজ দিয়ে রীতিমত “নায়কসুলভ” কাজ করতে দেখানো হলো সিন্ডিকেটবাজের পান্ডাকে। বোঝাই যাচ্ছিল যে রাস্তা সাফ অভিযান চলছে পুলিশের সাহায্যে গ্রামে গ্রামে তৃণমূলী হার্মাদ বাহিনী ঢুকিয়ে অত্যাচার শুরু করার লক্ষ্যে।

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার কে হঠাৎ পুলিশী পাহারায় হার্মাদ বাহিনী পাঠিয়ে একেবারে সিপিএমের “সূর্যোদয়” অপারেশনের মতন এলাকা দখল করতে হলো কারণ সমগ্র ভাঙড় অঞ্চলে আজ তৃণমূলের কোন শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। মমতার পেয়াদারা আর আরাবুলের হার্মাদদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ভাঙড়ের জনগণ এলাকাকে দুষ্কৃতীদের থেকে মুক্ত করেছেন। আর এতেই মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ভিতে একটা গভীর কামড় লেগেছে। ভাঙড় যেন সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামের মতন জনগণের কাছে আদর্শ না হয়ে উঠতে পারে, যেন ভাঙড়ের অনুকরণে দিকে দিকে ভাঙড় না গড়ে উঠতে পারে তার জন্যে মমতা বন্দোপাধ্যায় আজ অন্ধকারে হাত পা ছুড়ছে আর বার বার সিপিএমের নন্দীগ্রাম পর্বের সাথে তৃণমূলের ভাঙড় পর্বের সাদৃশ্যতা জনগণের সামনে প্রকাশ করছে।

এই ধরুন বারবার করে এলাকার মানুষের স্বার্থে পাওয়ার গ্রিডের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া  জমি-জীবিকা-পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা কমিটি মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারের কাছে দাবি তুলেছে যে সরকার যেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরকারি ভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করে পাওয়ার গ্রিডের প্রকল্প বাতিলের কথা ঘোষণা করে। কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায় আজ ঘর পোড়া গরুর মতন ঈশান কোনে সিঙ্গুরে মেঘ দেখে আতংকিত হয়েছে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় আলোচনা করবে না কারণ আলোচনার কথায় মমতার অহঙ্কারে আঘাত লাগবে, কারণ তাকে বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতিনিধিত্ব কেউ করতে পারে বলে সে মনে করে  না। আর ভাঙড়ের আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসা মানে মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সামনে, গণ আন্দোলনের সামনে মাথা ঝোঁকাচ্ছে। তা তো আলবাত হবে না!

আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দমন পীড়নের স্বার্থে মমতা বন্দোপাধ্যায়, মোদীর ঘনিষ্ঠ মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স জিও, ও পশ্চিমবঙ্গের কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম হাতে হাত মিলিয়ে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বলছে যে আন্দোলন নাকি মাওবাদীরা করছে আর এই অভিযোগে গ্রামবাসীদের আন্দোলনে যোগ দিতে দূর দূর থেকে আসা গণ আন্দোলনের কর্মীদের পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, শর্মিষ্ঠার মতন রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে আন্দোলন নাকি বহিরাগতরা নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তাই বহিরাগতদের প্রভাব থেকে জোর করে এলাকার মানুষ কে বের করতে হবে।

আহারে! এই তৎপরতা যদি মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূলের সরকার ধুলাগড়, হাজীনগর, চন্দননগর বা খড়্গপুরে দেখাতো তাহলে সেখানে সাম্প্রদায়িক অশান্তির আগুন জ্বালাবার সাহস সংঘ পরিবারের “বহিরাগত” আবাঙালি কর্মীদের হতো না। চরম ব্রাক্ষণত্ববাদী এই তৃণমূল নেত্রীর কাছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু আর মুসলমানদের মেরুকরণ করাটা অন্যায় নয়, অন্যায় হলো অত্যাচার ও লুঠের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আর স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানো।

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার আজ যখন নিজের ব্রাক্ষণত্ববাদী চরম ঘৃণ্য চেহারাকে ধুলাগড়ের পরে আর লুকোতে পারছে না আর শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকার মতন ভাঙড়ের মাটিতে তৃণমূলের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানুষদের পিষতে পারছে না, ঠিক সেই সময়ে নিজের দলের আর সরকারের মুখরক্ষার জন্যে বারবার করে “বহিরাগত” লোকের তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি কিছু প্রশ্ন করা আজ পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র প্রেমী মানুষের পক্ষে আবশ্যিক হয়ে উঠছে।

প্রশ্নগুলো সরাসরি মমতা বন্দোপাধ্যায় কে করা এবং এই প্রশ্নের মধ্যেই আপনি চেষ্টা করলে উত্তর খুঁজে পেতে পারেন:

১) পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কি তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া আর কোন দল করার অধিকার নেই ?
২) যদি অধিকার না থেকে থাকে তাহলে জনগণ কে জানানো হোক কোন আইনের অধীনে জনগণের নিজস্ব পছন্দের রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও কর্মী হওয়া আটকানো হচ্ছে ?

৩) যদি জনগণের অধিকার থেকেই থাকে ইচ্ছে মতন রাজনৈতিক দলে বা গণসংগঠনে যোগ দেওয়ার, তাহলে কি তাঁরা এক এলাকার থেকে অন্য এলাকার মানুষের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সাথে একাত্ম হতে পারেন না? পশ্চিমবঙ্গের ভিতরে তৃণমূল কংগ্রেস বাদে অন্যান্য দল ও গণ সংগঠনের কর্মীদের কি এক জায়গার থেকে আর এক জায়গায় রাজনীতি করতে যেতে হলে তৃণমূল কংগ্রেসের অনুমতি প্রয়োজন ?

৪) যদি “বহিরাগতদের” নিজের পাড়া বা এলাকার বাইরে গিয়ে অন্য জায়গায় রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেওয়া এতই খারাপ কাজ হয়, তাহলে এক দশক আগে সিঙ্গুরে বা নন্দীগ্রামে যাঁরা কলকাতা সহ বিভিন্ন জায়গার থেকে গিয়ে আন্দোলন শুরু করেন তাঁরাও খারাপ কাজ করেছিলেন ? দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে মঞ্চটাও বহিরাগতরাই নাকি করেছিল বলে সিপিএমের হুগলি জেলা কমিটির নেতারা বলতো। আর বলতো সিঙ্গুরের মানুষের উন্নয়নের পক্ষে সমর্থনের গল্প। মনে পড়ে ?

৫) “বহিরাগত” শক্তির নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তোলা যেমন খারাপ তেমনই নিশ্চয় বহিরাগতদের নিয়ে এলাকার ভিতরে ঢুকে আন্দোলন ভাঙ্গার কাজও খারাপ ? সব্যসাচী দত্ত কি ভাঙড়ের “ঘরের ছেলে”? সব্যসাচীর সাথে যে সমস্ত তৃণমূলী গুন্ডারা রাজারহাট থেকে ঢুকেছিল তারা কি ভাঙড়েই হামাগুড়ি দিয়ে বড় হয়েছিল?

৬) আশা করা যায় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অবাঙালি পুঁজিপতি আর আড়ৎদারদের মদতে যেভাবে ভিন রাজ্য থেকে এসে আরএসএস কর্মীরা যেভাবে ঘাঁটি গেড়ে জঙ্গলমহল সহ সমস্ত রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় দাঙ্গার আগুন লাগাবার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও একই ভাবে রাজ্য পুলিশ, সব্যসাচীর “কমরেডগণ” ও বজ্র বাহিনীর জওয়ান নিয়ে আক্রমণ করা হবে ? আইন রক্ষকরা নিশ্চয় ভেদাভেদ করবে না ?

৭) যাঁরা মানুষের জমি, জীবিকা, ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষার কথা বলেন তাঁরা কি মাওবাদী? তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস যখন একই ভাবে “মা, মাটি, মানুষের”  স্বার্থের কথা বলে নন্দীগ্রামে বা লালগড়ের মানুষের সিপিএমের হার্মাদদের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল তখন ওদের সাথে মাওবাদীদের গোপন যোগসাজেশ ছিল?

৮) বুদ্ধদেব  ভট্টাচার্য আর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের, বিমান বোস আর মুকুল রায়ের মধ্যে আন্দোলনের বিরোধিতা করার ধরণের মধ্যে পার্থক্য কি ?


আসলে সত্যি বলতে কি আজ যাঁদের বয়স তিরিশের কোঠায় তাঁরা সবাই মমতার কীর্তি দেখে, তৃণমূলের ঘৃণ্য রাজনৈতিক ব্যাভিচার দেখে, জনগণের বিরুদ্ধে বেইমানি দেখে, বুঝতে পারছেন যে সেদিনের নন্দীগ্রাম আর আজকের ভাঙড়ের মধ্যে বেশি পার্থক্য নেই, সেদিনের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে শাসকেরা যে ভাবে সদর্পে কৃষকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ছিল তার সাথে বর্তমানে শাসক দলের বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভাঙড়ের লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বুদ্ধদেবের সরকার যেমন নির্বিচারে কৃষি জমি রক্ষার আন্দোলনে সামিল হওয়া সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিকে হয় মাওবাদী না হয় প্রতিক্রিয়াশীল বলে আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল তার সাথে এইভাবে শর্মিষ্ঠা কে গ্রেফতার করার মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মমতা বন্দোপাধ্যায় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে না কারণ অহংকার ও দর্প মানুষ কে অন্ধ করে দেয় এবং নিজের দলের পেশিশক্তির উপর নির্ভর করে যেভাবে মমতা বন্দোপাধ্যায় বারবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে তা কিন্তু নিমেষে ভঙ্গ হতে পারে, কারণ সিপিএম ৩০ বছর শাসন করার পরে নন্দীগ্রামের মুখোমুখি হয়, মমতার তো সবে ছয়।

দেড় মাস পরেই মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূলের নেতারা ১৪ই মার্চ নন্দীগ্রামের সংগ্রামী কৃষক শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠান করে ন্যাকা কান্না কেঁদে মানুষ কে যখন বোকা বানাবার চেষ্টা করবে তখন যদি নন্দীগ্রামের মানুষ মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে আওয়াজ তোলেন বহিরাগত মমতা দূর হঠো ! তাহলে কি বলবে তৃণমূল?   

ভাঙড় ঘিরে আনন্দবাজারের আতঙ্কের কারণ কি ?

বুধবার, জানুয়ারী ২৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

কেন আনন্দবাজার পত্রিকা ভাঙড়ে নকশাল আর মাওবাদী ভূত শুঁকে বেড়িয়ে পুলিশ লেলিয়ে দিতে চাইছে ?


আনন্দবাজার পত্রিকা ক্রমাগত একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা করছে বাঙালি পাঠকদের মননে যে ভাঙড়ের জমি ও জীবিকা রক্ষার জন্যে যে মানুষগুলো পথে নেমেছিলেন তাঁরা নাকি “নকশালপন্থীদের” বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক প্রচারের শিকার হয়েছেন, অলীক এবং শর্মিষ্ঠা সহ সিপিআই (এম-এল) রেডস্টার গোষ্ঠীর অন্যান্য কর্মী সমর্থকেরা নাকি ভাঙড়ে “মুক্তাঞ্চল” গড়ে তুলছে এবং এলাকার সমাজবিরোধীরা নাকি তাঁদের অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে।

গোয়েবেলস এর তত্ব অনুসারে একটি মিথ্যা কথা কে বার বার বললে মানুষ সত্য হিসেবে মেনে নেবে। বনেদি বাজারী কাগজ আনন্দবাজার পত্রিকা এই শিক্ষা খুব ভাল ভাবেই রপ্ত করেছে, আর বিগত আট দশক ধরে বার বার প্রয়োগ করেছে মালিক মুৎসুদ্দি বেনিয়া পুঁজিপতিদের, সাম্রাজ্যবাদী পিতৃদেবদের সেবায়। সেই ৫০ বছর আগে যখন নকশালবাড়ি আন্দোলন হয়েছিল আর বছর আটেক আগে যখন লালগড়ে গণ অভুথ্যান ও তাকে ঘিরে রকমারি নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন দেখেছিলাম, সেই সময়ে আনন্দবাজার বার বার করে গণতন্ত্র রক্ষা করার আর “নকশাল” দমনের পক্ষে ওকালতি করেছে।  আজ ভাঙড়েও সেই একই উপাখ্যান পুনরায় দেখা যাচ্ছে।


শুভাশিস ঘটক, সামসুল হুদা থেকে সুরবেক বিশ্বাস, রকমারি নামের আড়ালে আনন্দবাজারের ঠাণ্ডা ঘর থেকে মিথ্যার বেসাতি উপচে পড়ছে। একবার বলা হচ্ছে যে ভাঙড়ের কাণ্ডে “মাওবাদীরা” জড়িত, আর এক বার বলা হচ্ছে “নকশালপন্থীরা” জড়িত। এই ধরুন ২২শে জানুয়ারি কলকাতা থেকে সুরবেক বিশ্বাসের নামে একটা রিপোর্টে লেখা আছে যে মাওবাদীদের গণসংগঠন গড়ে আন্দোলন করার ফল হলো ভাঙড় আর অন্যদিকে সেইদিনই শুভাশিস ঘটক, ভাঙড় থেকে সামসুল হুদার থেকে সাহায্য নিয়ে রিপোর্টে লিখছে যে ভাঙড় আন্দোলনের পিছনে আছে সিপিআই(এম-এল) রেডস্টার নামক সংগঠন। সিপিআই (মাওবাদী) আর সিপিআই (এম-এল) রেডস্টারের রাজনৈতিক লাইন কিন্তু একে অপরের থেকে ১৮০ ডিগ্রী উল্টো, দুই দল যে একে অপরের চরম বিরোধী সে কথা কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা আপনাকে বা আমাকে জানতে দেবে না। কারণ মানুষের মধ্যে “নকশাল” ভীতি সৃষ্টি করেই তো প্রভুদের থেকে চরণামৃত পাওয়া যায় !


সিপিআই (মাওবাদী) সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবে, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার রাজনীতিতে তত্বে ও প্রয়োগে বিশ্বাস করে এবং এই নীতি মেনে এই দলটি বহুদিন ধরে সশস্ত্র লড়াই করছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। কোথাও আদিবাসীদের উপর কর্পোরেট নিপীড়ণের প্রতিরোধ গড়তে, কোথাও আবার শাসক পার্টির বিরোধী পার্টিকে সশস্ত্র সহযোগিতা করে নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করার মতন কাজে এই দলটি লিপ্ত, এবং এই দলের বহু কর্মী ও সমর্থক বিপ্লবের স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন। যদিও জঙ্গলে আর পাহাড়ে লুকিয়ে থেকে গ্রামাঞ্চলের জনগণের সংগ্রাম থেকে, শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কি ভাবে বিপ্লবের লাভ হচ্ছে তা নিয়ে বহুদিন ধরে তর্ক-বিতর্ক চলছে।


সিপিআই (এম-এল) রেডস্টার দলটির  আবার সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি এলার্জি আছে আর কানু স্যানালের মতন এরাও বিশ্বাস করে যে ভারতের মাটিতে বিপ্লব করার মতন সময় যেহেতু আসেনি অতএব ভোটের ময়দানে কুস্তি লড়ে ততদিন নাকি “লেনিনীয়” শিক্ষায় প্রস্তুতি নিতে হবে। যে কথা ষাটের দশকে প্রমোদ দাসগুপ্ত আর আশির দশকে বিনোদ মিশ্র বা অসীম চাটুজ্যের মতন লোকেরা বলতো। যাই হোক সেই কুস্তি লড়তে এরা নানা ধরণের “সরকারি” ভাবে আইনসিদ্ধ “নকশালপন্থীদের” মতন রীতিমত অফিস খুলে বসে প্রতি নির্বাচনে যেখানে পারে প্রার্থী দেয় আর কুস্তি হেরে আবার আখড়ায় ফিরে যায়। এহেন দলের রাজনৈতিক লাইন হিসেবেই সশস্ত্র বিপ্লব যখন দূরবীন দিয়ে খোঁজার বস্তু তখন সেই দলের সাথে পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে “শ্রেণী শত্রু” বাদ দিয়ে “পুলিশের চর” বলে গ্রামবাসীদের  মারা মাওবাদীদের একই গন্ডিতে তো রাজনীতির অ, আ, ক, খ শেখা ছাত্র-ছাত্রীরাও ফেলবে না, ফেলবে শুধু আনন্দবাজারের উচ্চ বেতন প্রাপ্ত, ঠাণ্ডা ঘরে বসে নানা জায়গার খবরের ভিত্তিতে শাসক শ্রেণীর স্বার্থ পূরণের জন্যে “সংবাদ লেখকেরা”, যারা আজ দেশ জুড়ে ভারতের শাসক শ্রেণীর হয়ে পার্সেপশন ম্যানেজমেন্ট এর কাজ করছে।


আনন্দবাজার পত্রিকা ধুরন্ধর, তাই ওরা বাকি ভাঁড়দের মতন খোলাখুলি ভাঙড় কাণ্ডের বাপান্ত করবে না। করবে বেশ কায়দা করে, যাতে সাপও মরে আর পৈতৃক সম্পত্তি বাঁশের লাঠিটাও পরের পশ্চাৎদেশে বেদনা দেওয়ার জন্যে অক্ষত থাকে। ফলে বারবার আনন্দবাজার জোর দিচ্ছে উন্নয়নের প্রশ্নে, তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্ধের ঘটনায় আর পুলিশকে মনোবল দিচ্ছে ভাঙড়ে তৃণমূলের সন্ত্রাসী নেতা ও ভূ-মাফিয়া আরাবুল ইসলামের দলবলের বিরুদ্ধে স্পর্ধা দেখানোর জন্যে নেতৃত্ব দেওয়া  গণআন্দোলনের কর্মীদের “মাওবাদী” ও জঙ্গী আখ্যা দিয়ে যাতে গ্রেফতার করা যায়। কারণ কানহাইয়া কুমারের চেয়ে বেশি বাম হলেই তো আবার আনন্দবাজারের গ্যাস্ট্রিক সমস্যাটা বাড়ে।


ভাঙড়ের জমি আন্দোলনের লক্ষ্য কোন সমাজ বিপ্লব নয়; ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার শিক্ষার থেকে বলা যায় যে এই আন্দোলন দীর্ঘ সময় ধরে চলবে না বা এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা দখলের লড়াইতে পরিণত হবে না। ভাঙড় ভারতের ইয়েনান হবে না বা ভাঙড়ের পথ ভারতের পথও হবে না। তবুও এই লড়াইকে ভয় পেয়ে হঠাৎ করে আনন্দবাজার এত প্রচার কেন চালাতে শুরু করেছে আর কেন পুলিশ কে বারবার নিপীড়ন করে এই লড়াইকে ধ্বংস করতে উস্কানি দিচ্ছে? কেন বারবার অলীক আর শর্মিষ্ঠার মতন গণআন্দোলনের নেতা-নেত্রীদের “মাওবাদী” আর সহিংস বিপ্লবে বিশ্বাসী “নকশাল” সাজিয়ে গ্রেফতার করার জন্যে পুলিশকে বলা হচ্ছে ?


তার কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের আকাশে লাল মেঘ দেখিয়েছে ভাঙড়, গড়ে তুলেছে সমাজ-বিরোধী, খুনি, ধর্ষক, লম্পট আর জমি দখলকারী শাসক দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সত্যিকারের গণআন্দোলন। লাল মেঘ দেখলে তো ঘর পোড়া গরু ভয় পায়ই, তায় আবার সরকার পরিবারের মালিকানা থেকে বেরিয়ে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন হয়ে একেবারে জার্সি গাঁই হওয়া আনন্দবাজার বলে কথা। যে আনন্দবাজার দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কে দুই মেরুতে বাঁধতে, যে দুই দিকে থাকবে শাসক শ্রেণীর দুই প্রধান চ্যালা তৃণমূল আর বামফ্রন্ট, সঙ্গে নন্দী ভৃঙ্গী সেজে কংগ্রেস ও বিজেপি নিজেদের জমি শক্ত করে উঠে আসবে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে।


কিন্তু এই সমস্ত গণ আন্দোলনগুলো, যা সাধারণ মানুষ কে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্থানীয় স্তরে ঐক্যবদ্ধ ভাবে, বিনা কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে বৃহৎ সংগ্রাম করার হিম্মত দেয়, তা আনন্দবাজারের সাজানো বাগান বুনো ষাঁড়ের মতন তছনছ করে দেয়।  কারণ মানুষ বোঝেন যে সিপিএম, কংগ্রেস, বা দাঙ্গাবাজ বিজেপি কে বাদ দিয়েও তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে শুধু লড়াই করা যায় তাই নয়, তৃণমূলের সন্ত্রাস কে পরাস্ত করা যায় গণসংগ্রামের ঢেউতে। এই শিক্ষাটা, এই উপলব্ধিটা আপনার মস্তিষ্কে যাতে না ঢোকে তাই লগ্নিকারীরা কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে আনন্দবাজার আর ওদের মতনই বাজারী সংবাদ মাধ্যম কে।


মিথ্যা প্রচার ও কুৎসার বন্যা ছুটিয়ে আনন্দবাজার যে ভাবে ভাঙড়ের সাধারণ মানুষের তৃণমূলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কে কলমের প্যাঁচে হেয় করতে চেয়েছে, সেই লড়াইয়ের ফলে কিন্তু সমগ্র বাংলা জুড়ে এত ছোট-বড় তৃণমূল বিরোধী লড়াই গড়ে উঠবে যে আনন্দবাজারের কাগজ ছেঁড়া পাতার মতন উড়ে যাবে। তৃণমূলের অপশাসনের উল্টো রথ এখনো বের হয়নি ঠিকই, কিন্তু ভাঙড়ের লড়াই মন্দিরের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে। তাই তো শাসক শিবিরে এত আর্তনাদ। শোষকের আর্তনাদ শুনলে শোষিতের ঘুম ভালো হয়, অতঃপর সাব্বা খেয়র।

মমতার নন্দীগ্রাম: তৃণমূল শাসনের ভাঙ্গন ভাঙড় থেকে শুরু

বৃহস্পতিবার, জানুয়ারী ১৯, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

ভাঙড়ে ১০ই জানুয়ারির প্রতিবাদ সভার ছবি। Credit: sanhati.com
ভাঙড়ে ১০ই জানুয়ারির প্রতিবাদ সভার ছবি। Credit: sanhati.com  

ভাঙড়ে ভাঙ্গন শুরু তৃণমূল রাজত্বের  

ভাঙড়ে ভাঙলো তৃণমূল আর মমতার কৃষক দরদী ভাবমূর্তি আর প্রকাশিত হলো বুদ্ধদেবের বামফ্রন্টের সাথে “মা-মাটি-মানুষের” সরকারের সাদৃশ্য। পুলিশের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের হার্মাদ বাহিনী নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঢুকে মানুষকে খুন করে, গুম করে, মেয়েদের শ্লীলতাহানি করে লক্ষণ শেঠের ভূমিকাটা ভাল ভাবে পালন করলো আরাবুল ইসলাম। মঙ্গলবার ১৭ই জানুয়ারি যখন পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরত মফিজুল খান আর আলমগীর শেখ যখন লুটিয়ে পড়লেন তখনও নন্দীগ্রামের দশ বছর হতে প্রায় দুই মাস বাকি, সেই নন্দীগ্রাম যেখান থেকে বামফ্রন্টের পতনের আর মমতার উথ্বানের শুরু।

ভাঙড় মানেই তৃণমূলের একাধিপত্য, আরাবুল ইসলামের খাস তালুক, যেখানে আরাবুলের সামনে মাথা নত না করলে সেই মাথা কেটে নেয় দিদির দুষ্টু ভাইয়েরা। ভাঙড়ের আরাবুল বাম জমানার মজিদ মাস্টার বা হলদিয়ার লক্ষণ শেঠের তৃণমূলী সংস্করণ। যার এমন দাপট যে তাকে একবার দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েও ভোট ব্যাঙ্ক (রিগিং ব্যাঙ্ক) ধরে রাখতে ঠিক ভোটের মুখেই আবার দলে ফিরিয়ে আনতে হয় মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মতন ব্রাক্ষণত্ববাদী নেত্রী কে। সেই ভাঙড়ে কিন্তু এবার ভাঙ্গন ধরলো তৃণমূলের সমর্থন ভিত্তিতে। আরবুলের পিস্তল-বোমা আর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে এলাকার গরিব মানুষ রুখে দাঁড়ালেন নিজেদের জমি ও জীবিকা রক্ষার স্বার্থে, পরিবেশ কে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে।

ভাঙড়ের কৃষক সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ও ঘটনাক্রম 


ভাঙরের  কৃষকেরা দীর্ঘদিন আগেই তৃণমূলের চাপে ভয়ে ভয়ে নিজেদের জমি দিয়ে দিয়েছিলেন আরাবুলের বাহিনীকে, বলা হয়েছিল যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়া হবে এবং প্রচুর সাধারণ মানুষ চাকরি পাবেন।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল পুরোটাই গল্প, বরং নামমাত্র মূল্যে বন্দুক আর বোমার জোরে জমি কেড়ে নিয়ে আরাবুল ইসলাম আর তৃণমূল কংগ্রেস সেই জমি চড়া দামে বিক্রি করবে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন কে যারা ভাঙ্গরে গড়ে তুলবে পাওয়ার গ্রিড বা বিদ্যুৎ গ্রিড। ফলে সেই প্রকল্পে চাকরি হবে হাতেগোনা কিছু তৃণমূল কর্মীদের আর বাকিদের পক্ষে রইলো কাঁচকলা। পাওয়ার গ্রিডের হাই টেনশন তারের ফলে আবার প্রকৃতি ও মানুষের জীবন জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে দূষণের ফলে বিদ্যাধরী নদীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং মাছের ভেড়ি থেকে মাছ ধরে রোজগারও বন্ধ হয়ে যেতে থাকে।

এই পরিস্থিতিতে ভাঙড়ের সাধারণ জনগণ শুরু করেন নিজেদের প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতে; আরাবুলের বাহিনীর বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এই লড়াইয়ে প্রথমে তৃণমূলের রেজ্জাক শিবিরের মদত থাকলেও পরবর্তী কালে এই লড়াইয়ের জঙ্গিরূপ দেখে রেজ্জাক সাহেবেরও পিলে চমকে ওঠে। গ্রামে গ্রামে প্রতিবাদীরা সংগঠিত হন এবং বিদ্যুৎ গ্রিডের বিপদ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য মানুষকে সহজ ভাষায় বোঝাতে অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা এই এলাকায় যান। গড়ে ওঠে জমি-জীবিকা-পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা কমিটি। যে কমিটির নেতৃত্বে সমগ্র ভাঙরে তৃণমূলের স্বেচ্ছাচারী সরকারের বিরুদ্ধে, আরাবুল ও তার চেলাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে সংগ্রাম।

২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে লড়াই তুঙ্গে ওঠে পাওয়ার গ্রিডের নির্মাণ কার্যের  বিরুদ্ধে।  অবস্থা বেগতিক থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার ২৮শে ডিসেম্বর খামারাইট এর ১.৫কিঃমিঃ ব্যাসার্ধ জুড়ে  জারি করে ১৪৪ ধারা। গ্রামবাসীদের সমাবেত হওয়ার থেকে বিরত করতে এবং আন্দোলন কে ভাঙতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভাঙড় দুই নম্বর ব্লকে। সাথে সাথে এই  সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং  বিদ্যুৎ গ্রিডের প্রকল্প বাতিল করার দাবিতে সেই ২৮শে ডিসেম্বরেই মাছিভাঙ্গার খালপাড়ে বিশাল সমাবেশ করেন এলাকার জনগণ। সেই মিছিলে দূর দূরান্ত থেকে আসা মানুষকে ঠেকাতে নিজের ভাড়াটে হার্মাদদের রাস্তায় নামায় আরাবুল আর সাথে থাকে পুলিশ। তবুও জনজোয়ার ঠেকাতে আরাবুল অপারগ হয়। জয় হয় ভাঙড়ের জনগণেরই।  

জানুয়ারি ২০১৭ থেকে গণ আন্দোলনের ঢেউ এত তীব্র হতে শুরু করে যে আরাবুলের নিজের গ্রাম গাজীপুরে তার স্বৈরতন্ত্র কে উচ্ছেদ করতে গ্রামবাসীরা এগিয়ে আসেন। আরাবুলের বোমা-পিস্তল-ভোজালি দেখে মানুষ ভয় পাওয়া বন্ধ করতেই আরাবুল নবান্নের শরণাপন্ন হয় নিজের দাপট ও খাস তালুক রক্ষা করতে। আরাবুলের সংকটের সুযোগ নিয়ে যদিও রেজ্জাক এলাকায় নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করার চেষ্টা করে তবু গণ জোয়ারের সামনে ওর সিপিএম থেকে পাল্টি খাওয়া তৃণমূলী গুন্ডারা খড় কুটোর মতন ভেসে যায়।

নবান্ন ভাঙড়ে তৃণমূলের আধিপত্য কায়েম রাখতে  পুলিশি সন্ত্রাস বাড়িয়ে দেয় এবং ঠিক সেই নন্দীগ্রামের কায়দায় পুলিশের সাথে পুলিশের জ্যাকেট পড়ে, মুখে মাফলার বেঁধে আরাবুলের গুন্ডারা দফায় দফায় আক্রমণ শুরু করে কিন্তু প্রায় ২০০০ মানুষের ঐকবদ্ধ প্রতিরোধ আরাবুল কে তার দলবল সহ গাজীপুর এলাকার থেকে তাড়িয়ে দেয় জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই।

সোমবার ১৫ই জানুয়ারি আধা-সামরিক বাহিনীর সমর্থনে পুলিশ হামলা শুরু করে নতুনহাট আর খামারাইট এলাকায়। গ্রামবাসীদের বাড়িতে ঢুকে বেধড়ক পেটানো হয় পুরুষদের, নারীদের শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করে রাজ্য পুলিশ ও অবাঙালি আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা। অনেক দোকানপাটে পুলিশ লুঠপাট আর ভাঙ্গচুর চালায়। এলাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে থাকে আর তখনই গাজীপুর থেকে গণ আন্দোলনের কর্মী কালু শেখ কে পুলিশ গ্রেফতার করে। সমগ্র গাজীপুর সহ ভাঙড় দুই ব্লক গর্জে ওঠে প্রতিবাদে আর গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। গণ আক্রোশের চাপে পড়ে পুলিশ কে কালু শেখ কে ছেড়ে দিতে হয়।

আরাবুল পুলিশের কর্তাদের সাথে মিলে গাজীপুর, নতুনহাট, মাছিভাঙ্গা, শ্যামনগর ইত্যাদি অঞ্চলে মঙ্গলবার ১৭ই জানুয়ারি সকাল থেকে আক্রমণ শুরু করে। প্রতিটি আক্রমণে পুলিশের সাথে আরাবুলের হার্মাদ বাহিনী ছিল এবং সমস্ত গ্রামবাসীদের সাথে এদের তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয় যাতে ক্ষিপ্ত  পুলিশ কর্মীরা আরাবুলের তৃণমূলী হার্মাদ বাহিনীর নির্দেশে খুব কাছ থেকে গুলি করে আলমগীর ও মফিজুল কে হত্যা করে। ক্ষিপ্ত জনগণ পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই পইপই করে ছুটে পালায় তৃণমূলী হার্মাদ বাহিনী ও পুলিশ।

দুই যুবকের মৃত্যুর সাথে প্রায় ১৬ জন আন্দোলনকারীর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ নন্দীগ্রামের সংগ্রামী গ্রামবাসীদের গুম করে খুন করে মৃতদেহ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনার সাথে ভাঙড়ের এই ঘটনার তুলনা করছেন। লক্ষণ শেঠের চেয়েও নিপুণ ভাবে আরাবুল এই কাজ সেরেছে বলে অভিযোগ। ঘটনার সত্যতা নিয়ে পুলিশ এখনো সংবাদ মাধ্যমের সামনে কোন বিবৃতি দেয়নি। মমতা বন্দোপাধ্যায় বা তৃণমূলের নেতৃত্বও এই নিয়ে টু শব্দ করেনি।

গণ আন্দোলনের ফলে ভয় পেয়ে যদিও মমতা বন্দোপাধ্যায় পাওয়ার গ্রিড প্রকল্প কে বাতিল করার কথা ঘোষণা করে, ঠিক যেমন নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণের নোটিস পরে ফেরত নেয় বামফ্রন্ট সরকার, তবুও আন্দোলনরত কৃষকদের এই নাটকে ভোলানো যায়নি। ক্ষিপ্ত হয়ে মমতা “বহিরাগত নকশাল” ধরার আদেশ দিয়ে পুলিশ কে বকলমে সন্ত্রাস তীব্র করার অনুমতি দিচ্ছে আর তার ফলে ভাঙড়ের মাটিতে তাড়া খেয়ে মুকুল আর রেজ্জাক কে পালিয়ে ফিরতে হচ্ছে কলকাতায়।

 ভাঙড়ে মমতার নন্দীগ্রাম পর্ব শুরু 


ভাঙড়ের গ্রামবাসীদের উপর পুলিশি সন্ত্রাস ও আরাবুলের নৃশংস অত্যাচারই শুধু যে নন্দীগ্রাম পর্বের বামফ্রন্ট সরকারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে তা কিন্তু নয়, বরং সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আস্ফালন, তৃণমূল কংগ্রেসের মেজাজ, এবং সরকারি যন্ত্রের প্রচারের ধরন দেখেও বুদ্ধের সরকারের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীদের জাগ্রত চেতনা কে, আরাবুলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কে মমতা বন্দোপাধ্যায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কারণ ভাঙড়ের জনগণের জাগ্রত চেতনা মানেই তো তৃণমূলের সিন্ডিকেটবাজির সন্ত্রাসের অন্তর্জলি যাত্রা শুরু, আরাবুলের পতনের শুরু, সামগ্রিক ভাবে মুসলমান সমাজ কে টুপি-বোরখা পড়িয়ে মোল্লা শাসনে রাখার চক্রান্তের পতন, ও সর্বোপরি মমতার অহংকারের বিরুদ্ধে জনগণের বিজয় যাত্রার সূচনার ডঙ্কা বেজে ওঠা।

তাই বুদ্ধের পথ ধরে মমতা আজ আবার “মাওবাদী” আর নকশাল ভূতের গন্ধ শোঁকা শুরু করেছে। ভোটপন্থী নিরামিষাশী সিপিআই (এম-এল) রেডস্টার কে ভাঙড়ের আন্দোলনে পেয়ে ওই দলের কর্মী সমর্থকদের উপর অকথ্য অত্যাচার করার জন্যে পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছে। জনগণের ক্ষোভ ও তৃণমূলের প্রতি তীব্র ঘৃণা কে “বহিরাগতদের উস্কানি” বলে মমতা আর তৃণমূল চেপে দিচ্ছে আর তার সাথে ছাত্র-ছাত্রী এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের গ্রামবাসীদের সাথে একাত্ম হয়ে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার কাজে বাঁধা দিতে সমস্ত গোয়েন্দা দফতর কে হুকুম দেওয়া হচ্ছে। ২০০৭ সালে বুদ্ধ আর বিমানের কর্ম পদ্ধতিও একই রকমের ছিল বলে তো মনে পড়ছে।

বোঝাই যাচ্ছে যে এই ভাবে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার ঝুটো কেস দিয়ে গ্রামবাসীদের রাজনৈতিক ভাবে সক্ষম করে তুলতে যে সব রাজনৈতিক কর্মীরা কাজ করছেন, তাঁদের উপর পুলিশি নিপীড়ন চালাবে।  আর এর সাথেই কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায় ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি  দিতে তৃণমূলের ছত্রছায়ায় লালিত পালিত এবং সরকারি কোষাগার থেকে ভাতা প্রাপ্ত ইমাম ও মোল্লাদের এবার ভাঙড়ের গ্রামবাসীদের ভাগ করতে পাঠাবে। যারা অবশ্যই ভাঙড়ের সংগ্রামী মুসলমান গ্রামবাসীদের “বহিরাগত” কাফেরদের থেকে মুক্ত হয়ে  ‘মুমিন ভাই’ আরাবুল কে আপন করে নিতে চাপ দেবে কাল্পনিক সব হাদিস শুনিয়ে।

ইতিহাসের পাতায় এক দশক আগে সিপিএম এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট  সরকার এই সকল চালগুলোই চেলেছিল জনগণ কে লড়াইয়ের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে। কিন্তু সেই ইতিহাসই আজ সাক্ষী দেবে যে সেই প্রচেষ্টার কি ফল বামফ্রন্ট পেয়েছিল আর আজ ইতিহাসের কোন আস্তাকুঁড়েতে বুদ্ধ আর বিমান নিক্ষেপিত হয়েছে। সেদিন যে মহিলা একা স্বল্প শক্তি নিয়ে তেড়েফুঁড়ে বামফ্রন্টের রোলার সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রামে থামিয়েছিল সেই মহিলা আজ ওই রোলারের ড্রাইভারের আসনে বসে, তাই হিসেবটা একটু উল্টো পাল্টা হয়ে গেল। তবে যেহেতু ইতিহাসের রসিকতা বড়ই নিষ্ঠুর তাই মমতার বর্তমান অবস্থা দেখে তার তীব্র প্রতিদ্বন্ধীরও ভীষণ মায়া হবে।

মমতার “মা-মাটি-মানুষের সরকার” আজ সেই বামফ্রন্টের পথে চলে নিজের কবর খোঁড়ার বন্দোবস্ত করছে। তৃণমূল ছাড়ার সময়ে সোমেন মিত্র বলেছিল যে মমতার শাসন কালে মা ধর্ষিতা, মাটি লুন্ঠিত, আর মানুষ প্রতারিত, শোষিত, অত্যাচারিত। সোমেন মিত্রের কথার সাথে বাস্তবের মিল পশ্চিমবঙ্গের জনগণ প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছেন।  ভাঙড় আজ চোখে আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছে যে কৃষকের জমি না কাড়ার, কৃষি জমির থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করে শিল্প না করার মমতার প্রতিশ্রুতি কতই ভঙ্গুর।  ফলে দলে দলে মানুষ আজ মমতার বিরুদ্ধে, তৃণমূলের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে, আরাবুল আর রেজ্জাকদের মতন ভূ-মাফিয়াদের সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে পথে নামছেন, এমনকি মৃত্যু ভয় কে জয় করেও।

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের জেনে রাখা উচিত যে জনগণ তাকে ও তার পার্টিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে সেই জনগণ কিন্তু রাস্তায় নেমে তার সরকার কে সিংহাসন থেকে টেনে নামাতেও সক্ষম। তাই মমতা বন্দোপাধ্যায় যদি জনগণ কে ভীতু এবং রাজনৈতিক ভাবে অন্ধ ভেবে নিজের স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় চলে পুলিশি সন্ত্রাসের সাহায্যে গণ আন্দোলন কে পরাস্ত করতে চায় তাহলে ভাঙড় থেকে যে ফুলকি গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে তা এক এমন গণরোষের  সৃষ্টি করবে যার সামনে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দাপট আর আরাবুলের দাদাগিরি নিমেষে উড়ে যাবে। মমতা বন্দোপাধ্যায় ভালো করেই জানে যে জনগণের রোষের সামনে পড়ে বড় বড় দাপুটে রাজনৈতিক নেতারা আজ কি ভাবে অস্ত গেছে পশ্চিমের আকাশে। মমতা বন্দোপাধ্যায় বা তৃণমূল কংগ্রেসের শত চেষ্টা সত্বেও, বিজেপির সাথে মিলেমিশে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কে নষ্ট করার শত প্রচেষ্টা সত্বেও, জাগ্রত কৃষকের - জাগ্রত শ্রমিকের রোষানলে তৃণমূলের সরকার খুব শীঘ্রই পতিত হবে পাথুরে জমিতে। ভাঙড় থেকে তৃণমূলের ডাঙায় ভাঙ্গন ধরার শুরু হলো, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে যার ফল তৃণমূল হাতেনাতে পাবে।

মার্কিন সরকারের চাপেই নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত

রবিবার, জানুয়ারী ১৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

মার্কিন সরকারের চাপেই নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত

এই কয়েকদিন আগে গ্লোবাল রিসার্চ পোর্টালে নর্বার্ট হেরিং এর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে উনি তথ্যের উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে কি ভাবে মার্কিন সরকারের সংস্থা ইউএসএইড  এর নির্দেশে মার্কিন সরকার ও তার সংস্থাদের সাথে মিলেমিশে মোদী সরকারের অর্থ মন্ত্রক ভারতের সাধারণ মানুষের কাঁধে এই নোট বাতিলের মতন অর্থনৈতিক ভাবে মারাত্মক একটি সিদ্ধান্ত কে ভেজাল দেশপ্রেমের মোড়কে মুড়ে চাপিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদীর সরকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পরবর্তী কাল থেকেই নানা দিক থেকে বিরোধীদের আক্রমণে তীরবিদ্ধ হয়েছে। কোটি কোটি গরিব মানুষ কে কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অছিলায় কাজ কর্মের থেকে বিরত করে ব্যাঙ্ক ও এটিএম মেশিনের সামনে সারিবদ্ধ করে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে নরেন্দ্র মোদী বলছে যে তার সিদ্ধান্তের সাথে জনগণ সহমত ছিল বলেই এত দিন লাইনে দাঁড়িয়েছেন লোকে আর অরুণ জেটলি বলছে যে যেহেতু আর ব্যাঙ্কের সামনে লাইন নেই তাই আর জনগণের কোন কষ্ট নেই।

তবে এরা কেউ একথা বলছে না যে শান্তিপূর্ণ ভাবে ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের কষ্টে অর্জিত টাকা জমা করা বা বদলানো ছাড়া শ্রমজীবি জনতার কাছে আর কোন পথ তো খোলা ছিল না, আর যেহেতু কোন ব্যাঙ্কে আর পুরানো নোট জমা হবে না তাই জনগণ আর ব্যাঙ্কের বাইরে দাঁড়িয়ে নেই। আর এই সমস্ত কর্মে সামিল হয়ে যাঁদের রুটি রুজি মারা গেল, যে কৃষকের মাঠে বীজ পোঁতা হলো না, যে শ্রমজীবি মানুষকে ভিন রাজ্যে কাজকর্ম হারিয়ে কর্পদকশূন্য হয়ে গ্রামে ফিরতে হলো আর যাঁদের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রাণ গেল, তাঁরা কেউ নরেন্দ্র মোদী বা সংঘ পরিবারের জালি দেশপ্রেম কে শ্রদ্ধা করেন না।

সীমান্তে সেনা মারা যাচ্ছে বলে যারা জনগণ কে চুপচাপ নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের সাথে সহমত হয়ে মোদী সরকারের আদেশ মানতে বাধ্য করেছিল, তারা কিন্তু এই কথাটা চেপে যাচ্ছে যে যেহেতু নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত এপ্রিল মাস নাগাদই কালো টাকার মালিকেরা টের পেয়ে গেছিল অতএব এই সিদ্ধান্তে কালো টাকার মালিকদের কোন ভোগান্তি হয়নি বটে তবে জনগণের চূড়ান্ত অসুবিধা হয়েছে এবং এই অসুবিধাটি ইচ্ছাকৃত ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে ইউএসএইড এর তৈরি ক্যাটালিস্ট নামক একটি সংস্থা ভারতের উপর নগদ নির্ভর অর্থনীতির নগদহীন বা ক্যাশলেস অর্থনীতি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার পূর্ণ প্রয়োগ করতে পারে।

ক্যাটালিস্ট সংস্থাটি বৃহৎ মার্কিন ও বহুজাতিক লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন ব্যাঙ্ক ও পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর স্বার্থে এশিয়া - আফ্রিকা - দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর অর্থনীতির থেকে নগদের ভূমিকা আচমকা শেষ করে ক্যাশলেস অর্থনীতি গড়ে তুলে ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে চরম মুনাফা আয় করার পথ প্রশস্ত করার কাজ করছে।

ইউএসএইডের দ্বারা সৃষ্ট এই ক্যাটালিস্ট সংস্থার কর্ণধারদের অন্যতম হলো অলোক গুপ্তা, যে ভারত সরকারের আঙুলের ছাপের ভিত্তিতে গড়ে তোলা পরিচয় ব্যবস্থার প্রকল্প আধারের দ্বায়িত্বে ছিল। এই লোকটা মার্কিন দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকেছে যাদের কার্যকলাপে ইউএসএইড দু হাত ভরে ডলার ঢেলেছিল।  সম্প্রতি মার্কিন সরকারের কাছে বৃহৎ লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন ব্যাঙ্ক ও পেমেন্ট গেটওয়ে ও ই-ওয়ালেট কোম্পানিগুলোর স্বার্থে কোন প্রকল্প গ্রহণ করা ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছিল।  এর ফলে ঠিক মোদী সরকারের কালো টাকার বিরুদ্ধে তথাকথিত যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক মাস আগেই ক্যাটালিস্ট সংস্থাটি আত্মপ্রকাশ করে ভারতের অর্থমন্ত্রকের সাথে হাত মিলিয়ে ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে ভারত কে নিয়ে যেতে।

নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পরে যখন জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন প্রতিনিয়ত নরেন্দ্র মোদী সরকার জনগণ কে ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার বাণী শুনিয়েছিল। মোরাদাবাদের জনসভায় তো নরেন্দ্র মোদী নিজের ভাষণে নিজের প্রশংসা করতে করতে যখন হাঁফিয়ে উঠলো তখন হোয়াটস্যাপ মেসেঞ্জার এর মারফত পাওয়া একটি ভিখারির দ্বারা পিওএস মেশিনে ডেবিট কার্ড সোয়াইপ করার গল্প শুনিয়ে মানুষকে ভারতের ক্যাশলেস অর্থনীতি হয়ে ওঠার অলীক কল্পকথায় মুগ্ধ করার চেষ্টা চালালো।

৮ই নভেম্বরে নরেন্দ্র মোদী যখন হম্বিতম্বি করে ₹৫০০ ও ₹১০০০ এর নোট বাতিলের ঘোষণা করলো তার ঠিক পরদিন সকালেই খবরের কাগজের সামনের পাতায় বিশাল বড় পেটিএমের বিজ্ঞাপন দেখেই বোঝা গেছিল যে কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইটা তো আসলে বাহানা, মোদ্দা কর্মটি হলো ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে টাকার পাহাড় জমানো ও অনলাইন লেনদেনের বহর বাড়িয়ে তার মাধ্যমে পেমেন্ট গেটওয়ে ও  ই-ওয়ালেট কোম্পানিগুলোর মুনাফা বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া। যার জন্যে জনগণের রক্ত আর ঘামে মেশা পরোক্ষ করের টাকায় মোদী সরকার মোচ্ছব করে ইলেক্ট্রনিক লেনদেনের মেলা লাগাচ্ছে আর ই পেমেন্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে জনতা কে চাপ দিচ্ছে।

গ্লোবাল রিসার্চের পোর্টালে যে প্রবন্ধটি নর্বার্ট হেরিং লিখেছেন তাতে দেখানো হয়েছে যে অনেকদিন ধরে ইউএসএইড এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ক্যাশলেস অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করিয়ে ইলেকট্রনিক পেমেন্ট গেটওয়ে ও ই-ওয়ালেট কোম্পানিগুলোর প্রভূত মুনাফা কামাবার পথ প্রশস্ত করার প্রচেষ্টায় মগ্ন ছিল।

এই রকম ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্যে জরুরী ছিল একটা বাস্তব প্রয়োগ স্থল, অর্থাৎ একটি এমন স্থানীয় অর্থনীতি যাকে জোর করে নগদহীন করে তুলে সেই জায়গায় ইলেকট্রনিক পেমেন্ট ব্যবস্থা কে চাপিয়ে দেওয়া। অর্থনীতির মাপে ও বহরে ভারতের মান উপরের দিকে হওয়ার ফলে ইউএসএইড ভারতের অর্থনীতিকে এই গবেষণার জন্যে চিহ্নিত করে এবং ভারতের অর্থমন্ত্রকের সাথে হাত মিলিয়ে ক্যাটালিস্ট নামক সংস্থার পত্তন করে।

মার্কিন সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের পিছনে মার্কিন পুঁজির মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো কে বিশাল লাভের পাহাড় তৈরি করে দেওয়ার লক্ষ্য ছিল এবং মালিকের সিদ্ধান্ত কে মাথা পেতে মেনে নেয় নরেন্দ্র মোদী সরকার এবং ভারতের মতন দেশে, যে দেশের ব্যাপক জনগণ কে শৌচালয়ের ব্যবহার শেখাতে সরকারের আরও তিন বছরের উপর সময় লাগবে, অর্থনীতিকে নগদহীন করে মার্কিন লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর মুনাফা কামানোর পথ প্রশস্ত করে দিল।

দেশপ্রেমের বচনবাগীশতা করা মোদী সরকারের কাছে এহেন এক হঠকারী সিদ্ধান্তকে প্রয়োগ করার জন্যে কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাদে আর কোন “দেশপ্রেমে” হাবুডুবু খাওয়া ইস্যু ছিল না, ফলে শুরু হয়েছিল কালো টাকার মারা যাওয়ার উল্লাসে খোল কর্তাল বাজিয়ে মোদী ও তার সাগরেদদের বিকট সুরে কীর্তন।

দেশের গরিব ও শোষিত মানুষদের লম্বা সারিতে দাঁড় করিয়ে তাঁদের নিজের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে বের করা বা খরচা করার উপর বিধিনিষেধ চাপিয়ে আদানি আর আম্বানিদের কোলে চেপে নরেন্দ্র মোদী যখন জনগণ কে “দেশের স্বার্থে একটু কষ্ট সহ্য” করার উপদেশ দিচ্ছিল তখন বোধহয় সবার অলক্ষ্যে বসে ইউএসএইড ও ক্যাটালিস্টের কর্ণধারেরা এবং বড় বড় ব্যাঙ্কের শেয়ার হোল্ডাররা ফিক ফিক করে হাসছিল।

ভারতবর্ষের কোন সংসদীয় রাজনৈতিক দল বা কর্পোরেট মালিকানাধীন বাজারজাত সংবাদ মাধ্যম কিন্তু জেনে শুনে এই গভীর চক্রান্তের কথা বেমালুম চেপে গেছে। ইউএসএইড, যার পিছনে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ ও বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর হাত আছে তার সাথে যৌথ ভাবে ক্যাটালিস্ট সংস্থা স্থাপন করার এক মাস পরেই হঠাৎ করে দীর্ঘদিন ধরে যে নোট বাতিলের গুজব কালো টাকার মালিকদের মধ্যে চলছিল তা প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে মার্কিন শাসক গোষ্ঠী কতটা কলকাঠি নেড়েছে তা এই মুহূর্তে রাহুল গান্ধী, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, বা মমতা ব্যানার্জী করবে না, কারণ নানা প্রান্ত ঘুরে এদের সকলের টিকিটা তো ওয়াশিংটন আর নিউ ইয়র্ক শহরের ওয়াল স্ট্রিটে বাঁধা।

গ্লোবাল রিসার্চ ওয়েবসাইটে গভীর অনুসন্ধান আর বিশ্লেষণের পরেই তথ্য সম্মত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং মোদী সরকারের নোট বাতিল সিদ্ধান্তের পিছনে মার্কিন প্রভাবের উপর তথ্য দিয়ে ভরা নর্বার্ট হেরিং এর প্রবন্ধটা প্রকাশ হওয়ার সময়েই হঠাৎ করে ইউএসএইড তাদের ওয়েবসাইট থেকে ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের সাথে চুক্তি করে ক্যাশলেস অর্থনীতি চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার উপর প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি মুছে দেয়। প্রাণপণ চেষ্টা করা হয় মার্কিন সরকার ও মোদী সরকারের তরফ থেকে সারা বিশ্বের থেকে এই খবরকে গোপন করার। তবুও সত্য চিরকাল চাপা থাকে না।এক সময়ে ঝুলির থেকে বেড়াল লাফ দিয়ে বের হয় যেমনটি নর্বার্ট হেরিং এর প্রবন্ধ প্রকাশের প্রিয় হলো।

দেশের মাটি, জল, খনিজ সম্পদ, এবং সর্বোপরি দেশের জনগণের শ্রম কে সস্তায় বিদেশী পুঁজির কাছে বিক্রি করার খেলায় মোদী সরকারের এবং বিজেপির জুড়ি মেলা ভার। এমনকি ৬০ বছর ধরে যে কংগ্রেস দেশ কে বিদেশী পুঁজির কাছে বিক্রি করেছে তাদেরও লজ্জায় মাথা নত হয়ে যাবে বিজেপির নির্লজ্জতা দেখে। ভারতের সার্বভৌমত্বের পক্ষে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে এবং ভারতের খেটে খাওয়া মানুষের এক নম্বর শত্রু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

নরেন্দ্র মোদী ভালো ভাবেই জানে যে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন যদিও সে প্রবল কংগ্রেস বিরোধী ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী স্রোতের ফলে উৎরে গেছিল, কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে অনেক শক্ত পরীক্ষার সামনে পড়তে হবে তাকে। এর ফলে মোদী ও সমগ্র সংঘ পরিবার নাওয়া খাওয়া ভুলে মাঠে নেমে একদিকে যেমন জনগণের চোখে, বিশেষ করে উচ্চ জাতির হিন্দু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের চোখে উগ্র দেশপ্রেমের ঠুলি পড়িয়ে মার্কিন ও বিদেশী পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী, কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষাকারী নিজেদের সিদ্ধান্তগুলোর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে চাইছে, ঠিক তেমনি উল্টোদিকে সামগ্রিক ভাবে ভারতের ব্রাক্ষণত্ববাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ খোলসটা  খুলিয়ে আমলাতন্ত্রের চরম আনুগত্য কুক্ষিগত করে মোদী সরকার ভারতের বুকে ইন্দিরার কায়দায় আরও ভয়াবহ আকারে নিজের স্বৈরতান্ত্রিক রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে।

নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সমস্ত পদক্ষেপের পিছনে যে ভাবে কর্পোরেট জগৎ ও বিদেশী বহুজাতিক পুঁজির মালিকেরা দু হাত ভরে চাঁদা দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে না যে মোদী সরকার কে শীঘ্রই দূর করার কোন অভিলাষ ভারতের শাসক শ্রেণী পোষণ করে। মোদীর মতন নির্লজ্জ ভাবে এবং বেহায়া সেজে ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের আর বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ আর কেউ বর্তমানে রক্ষা করতে সক্ষম নয়। তাই মমতা ব্যানার্জী বা রাহুল গান্ধী প্রচুর হুঙ্কার ছাড়লেও আসল ঘটনাগুলো কে, মোদী সরকারের বিদেশী পুঁজির কাছে দেশ কে বিক্রি করে দেওয়ার চক্রান্ত কে আড়াল করে আসলে সেই শাসক শ্রেণীরই স্বার্থ রক্ষা করছে যে শাসক শ্রেণী এখন বুক দিয়ে মোদী সরকারকে আগলে রেখেছে।

দেশ বিরোধী, জন-বিরোধী, ও ভারতের মাটির শত্রু সংঘ পরিবার ও নরেন্দ্র মোদীর সরকারের পক্ষে ভারতের জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে চুপচাপ দেশ বিক্রির কার্য চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন ভাল রাস্তা নেই আর এই রাস্তা বন্ধ করার দায়িত্ব আজ ভারতের খেটে খাওয়া মানুষকেই নিতে হবে। একমাত্র দেশের খেটে খাওয়া মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের লড়াই পারে গেরুয়া রাজার বিজয় রথ কে আটকে দিয়ে দেশের মাটি, জল, জঙ্গল, সম্পদ ও জনগণের শ্রমের লুঠ কে ঠেকাতে। তাই এই সময়ে পথে এবার নামো সাথী গানটা ভীষণ মনে পড়ে, কারণ পথে না নামলে রাজার পথ কাটা যাবে না যে আর। গণতন্ত্রের জন্যে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের জন্যে, দেশের সার্বভৌমত্বের জন্যে আজ পথে নামা ভীষণ দরকার, পরিবর্তন ক্যাশলেস অর্থনীতি না - আনবেন সাধারণ মানুষ।

    

মোদীর প্রতিশ্রুতির বন্যা ছুটলেও নোট বাতিলের ভোগান্তি কমবে না

মঙ্গলবার, জানুয়ারী ০৩, ২০১৭ 0 Comments A+ a-



নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর ভক্তদের উবাচ বহুদিন ধরে শোনার পরে যখন জনতার পেটে আমাশা হওয়ার উপক্রম ঠিক তখনই আমরা সেই  ৩০শে ডিসেম্বর পার করলাম, পেরিয়ে এলাম ২০১৬। সেই মহৎ সন্ধিক্ষণ যখন নরেন্দ্রীয় প্যাঁচে চিরকালের জন্যে নাকি কুপোকাৎ হয়েছে  কালো টাকা (টাকার বর্ণ বিদ্বেষটা প্রচন্ড বেশি), আর আমরা, অর্থাৎ জনতা জনার্দন, প্রবেশ করলাম নাকি এমন এক নতুন যুগে যে যুগে নগদ নাকি ঘোর অলক্ষুণে জিনিস হিসেবে গণ্য হবে আর টাকার হিসেব হবে পিওএস মেশিন আর পেটিএম অ্যাপ দিয়ে। স্বদেশী আর মেক ইন ইন্ডিয়া’র স্লোগান তুলে আর চীন বিরোধী জিগির তুলে বাজার গরম করা সংঘ পরিবার আজ চীনা বৃহৎ পুঁজির চেয়ারম্যান পেটিএম কে নিজেদের গাইডিং ম্যান মেনে নিয়েছে।

তবে সেই ৫০ দিনের সীমানা পার করেও আমাদের হাতে থাকলো পেন্সিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতির প্রতি ভাষণ দেওয়ার সময় একবারের জন্যেও জানালো না যে কত টাকা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় ১১ই নভেম্বর থেকে ৩০শে ডিসেম্বর অবধি জমা পড়েছে। শেষ পাওয়া হিসেবে অনুযায়ী প্রায় ₹১৫ লক্ষ কোটি টাকার অচল ₹৫০০ আর ₹১০০০ টাকার মধ্যে ₹১৩ লক্ষ কোটি টাকা জমা পড়েছিল, অর্থাৎ নগদে কালো টাকার অঙ্কটা নেহাতই নস্যি আর তাই নরেন্দ্র মোদীর মাছি মারতে কামান দাগার পিছনে যে অন্য মতলব নেই সে কথা বিজেপি ও আরএসএস বাদে আর কেউ মানতে নারাজ।

এই গোলযোগের ৫০ দিনে আমরা কিন্তু অনেক কিছুই এমন দেখলাম যা দেখে আমরা থ নয় বরং থতমত খেয়ে গেলাম। প্রথম যেদিন ঘোষণা হলো যে কালো টাকা রোধ করতে বিজেপি সরকার রাজার নাক কেটে মাছি মারার মতন ₹৫০০ আর ₹১০০০ এর নোট বন্ধ করে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেদিন সন্দেহ তো হয়েছিলই, কিন্তু একটু খোঁজ খবর করেই বোঝা গেল যে কালো টাকা উচ্ছেদ করার নামে মোদী সরকার কি ভাবে গরিবের পেটে লাথি মেরে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর লাভের পাহাড় বাড়াবার বন্দোবস্ত করে গেল।

আমাদের ৮ই নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী জানায় যে তার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত আসলে ভারতের অর্থনীতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা নগদ কালো টাকার থোকের উপর একেবারে ড্রোন হামলা না হলেও কার্পেট বোমাবর্ষণ তো বটেই। সমস্ত বাজারি হিন্দুত্ববাদী সংবাদ মাধ্যম আমাদের জানিয়েছিল যে মোদীর এই রকমের একটা “সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের” আঘাতে কালো টাকার মালিক, বড় বড় ধন কুবেররা নাকি কুপোকাৎ হয়ে গেছে।

অথচ যে বা যারা অর্থনীতির হাল হকিকৎ জানেন তাঁরা চোখ বুঁজে বলতে পারেন যে ₹৫০০ আর ₹১০০০ নোট বাতিল হওয়ার কথাটা কানাকানি আর ফিসফিসানির মধ্যে দিয়ে প্রায় আট নয় মাস ধরেই সমগ্র ভারতের অর্থ বাজারের পান্ডারা জেনে রেখেছিল। এই ধরুন রাজস্থানের কোটার বিজেপি বিধায়ক ভবানী সিংহ যেমন স্পষ্ট জানান দিল যে আদানি আর আম্বানিরা বহুদিন আগে থেকেই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানতো আর তাই নিজেদের প্রস্তুত করতে তারা সক্ষম হয়েছে।

নামটা দুটোই নয়, কারণ আম্বানি আর আদানি মানে ভারতের সেই নব্য মুৎসুদ্দি “ক্রোনি” পুঁজিপতিদের দল যারা সমস্ত সরকারকে নির্লজ্জ ভাবে পকেটে পুরে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করে।  আর এই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা একবার ফলাও করে বাজারি সংবাদ মাধ্যমের মধ্যমণি টাইমস অফ ইন্ডিয়া একবার ছেপেছিল।

টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় ৮ই এপ্রিল ২০১৬ তে মুম্বাই শহর থেকে ময়ূখ শেট্টি ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ সৌম্য কান্তি ঘোষের রিপোর্ট উল্লেখ করে লিখেছিলেন যে সেই সময়ে নির্বাচনের কারণে জনগণের মধ্যে নগদের যোগান বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা নানা মহল থেকে প্রকাশ পাচ্ছিল, বিশেষ করে যে যুক্তি নগদের যোগান বাড়তে দেখে তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রাজন প্রকাশ করেছিলেন,  তা ভুল, কারণ সেই সময়ে নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা বড় অঙ্কের নোট বাতিল হওয়ার ঘোষণার একটা খবর চাউর হয়েছিল ফলে অনেকেই নিজেদের চেপে রাখা নগদ কালো টাকা নানা খাতে লগ্নি করা শুরু করে।  আর স্টেট ব্যাঙ্কের কর্ণধারিনী অরুন্ধতী ভট্টাচার্য’ও  এই রকমের একটা “গুজবের” অস্তিত্ব নাকি সেই সময়ে মেনে নিয়েছিলেন।

ফলে মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা গোপন ছিল আর কেউ জানতো না সে কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং শুরুর থেকেই এই কথা সমস্ত কালো টাকার মালিকেরা বিজেপির থেকে জানতে পারে। আর পরবর্তী কালে যে বিজেপির নেতারা নানা জায়গায় নানা ভাবে জমি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে লগ্নি করে নিজেদের নগদ কালো টাকা সাদা করে ফেলে সে কথা এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।  আবার দেখা গেল এই গত ৫০ দিনে যখন জনগণ, বিশেষ করে শ্রমজীবি মানুষ, লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে সারাদিন কষ্ট করে হয় এটিএম থেকে ₹২৫০০ বা ব্যাঙ্ক থেকে ₹৪০০০ বা ₹৫০০০ টাকা তুলতে পারছিল, ঠিক সেই সময়ে কর্ণাটক, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, প্রভৃতি বিজেপি বিরোধী শাসিত রাজ্যে হঠাৎ একের পর এক তথাকথিত “দেশপ্রেমিক” বিজেপি কর্মী ও নেতারা কোটি কোটি টাকার নতুন নোট পাচার করার সময় ধরা পড়ে যাওয়ায় অনেকটা অস্বস্তি শুরু হলো “জাতীয়তাবাদের” ধ্বজ্জাধারী সংবাদ মাধ্যমগুলো।

প্রথমতঃ কর্পোরেট বাজারজাত সংবাদপত্রগুলো এবং বিশেষ করে তথাকথিত “দেশপ্রেমের” ন্যাপি পড়া সংবাদমাধ্যম মোদীর নোট বাতিলের  ঘোষণাটা এমন ভাবে পরিবেশন করেছিল যাতে আমাদের মতন ট্রেনে- বাসে-অটোয় ঝুলে যাতায়ত করা সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল এমন একটা গেরিলা আক্রমণে বড় বড় পুঁজিপতিগুলো নাই ফাঁসলো অন্তত পাড়ার মোড়ে দাদাগিরি করে সিন্ডিকেটবাজির টাকায় পাহাড় তৈরি করা তৃণমূলী মালগুলো তো ডুববেই।  কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখি ও হরি ! ফাঁসলো তো রামা কৈবর্ত্য আর হাসিম শেখের মতন গরিব মানুষগুলো।  

দ্বিতীয়তঃ তৃণমূলের মদন থেকে বিজেপির দিলীপ, সিপিএমের রবিন থেকে কংগ্রেসের অধীর, এরা কবে কোথায় আর কত টাকা নগদে জমা করলো সে তথ্য তো জানা দূর অস্ত, এই কিছুদিন আগেই যে লোকটা ৫৬ ইঞ্চির বুক বাজিয়ে বলছিলো যে ওর কলমের খোঁচায় নাকি বড়লোকেরা, রাজনৈতিক নেতারা, কালোবাজারির কারবারিরা, ফোঁড়েরা সবাই মুশকিলে পড়েছে সেই লোকটাই ঘোমটা ঢেকে খ্যামটা নাচার মতন হঠাৎ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর (সংসদীয় ব্যবস্থায় নথিভুক্ত) নিজেদের নগদ টাকা ব্যাঙ্কে বিনা প্রশ্নে জমা দেওয়ার স্বাধীনতা দিল।

রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধা হলো এই যে সব নগদ টাকাকেই এরা নির্বাচন কমিশনের দ্বারা নির্দ্ধারিত ₹২০,০০০ এর নিচের চাঁদা হিসেবে দেখিয়ে চাঁদা দাতার পরিচয় গোপন রাখার সুযোগ পাবে। আর নগদের উৎস নিয়েও কর বাবুরা বা নির্বাচন কমিশন কোন উচ্চবাচ্য করবে না কারণ সেখানে নরেন্দ্রের কড়া নিষেধ রয়েছে।

নরেন্দ্রীয় সমীকরণের ৫০ দিন পূরণ হওয়ার আগেই অরুণ জেটলি বলে বসলো যে ৫০ দিনের সময় সীমার পরে ভারতের জনগণ ₹৫০০ আর ₹১০০০ এর নোট বাতিলের ফলে সৃষ্ট হওয়া “worst condition” বা চরম মন্দ অবস্থার থেকে বের হয়ে আসবে, যার সোজা মানে করলে দাঁড়ায় যে আমার আর আপনার মতন খেটে খাওয়া মানুষেরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে আর নগদের যোগান বাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।


এত সত্বেও বার বার উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী আর বিজেপির তাবড় তাবড় নেতারা শুধু বলে যাচ্ছে যে বিজেপি নাকি গরিবের কল্যাণ করতে চলেছে। ৩১শে ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিল আর যে সমস্ত ঘুরিয়ে নাক ধরার মতন প্রকল্প ও গরিব কল্যাণের কথা ঘোষণা করলো তা যে কোন বাজেট ভাষণে কোন অর্থমন্ত্রী করলে খবরের কাগজের সাতের পাতার পাশের কলমে চার লাইনে ছাপা হতো।  

সরকারে আসার পর থেকে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার বারবার তেলের দাম বাড়িয়ে, রেলের ভাড়া ও মাশুল বাড়িয়ে, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ ছাঁটাই করে, শ্রম আইন শিথিল করে, জমি অধিগ্রহনের গোপন পরিকল্পনা করে যে ভাবে প্রতিদিন গরিব হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে চলেছে তার সামনে এই গরিব ও নিম্নবিত্ত জনগণ কে ব্যাঙ্কের ঋণ ও সুদের নাগপাশে বেঁধে সুদে ছাড়  বা অনলাইন কেনা বেচার উপর কর ছাড় দেওয়া আসলে জনগণ কে বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কের ফাঁদে ফেলার উপক্রম।

২০১৭ সালে দেশের অর্থনীতির উপর নোট বাতিলের ধাক্কার রেশ চলতেই থাকবে। যে ভাবে ৮৬ শতাংশ নগদ সরিয়ে নিয়ে প্রয়োজনের মাত্র ২৫ শতাংশ নগদ অর্থনীতিতে ঢালা হয়েছে, তার ফলে আগামী দিনগুলো খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে যে সুখকর হবে না সে কথা হলফ করে বলতে গেলে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স থেকে ডক্টরেট করতে হয় না।

হয়তো নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের সময়েও অনেক মানুষকে বোকা বানাতে পারবে, তবে বৃহৎ ব্যাঙ্কের স্বার্থে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত যে অচিরেই বিজেপি কে হুল ফোটাবে তা হয়তো সঙ্ঘ পরিবারের নেতৃত্ব বুঝতে পারছে আর তাই তারা নানা রকমের ছেলে ভোলানো পরিকল্পনার মারফৎ মানুষকে বাগে আনার চেষ্টা করছে। তবুও ক্ষিদের আঁচে বড় বড় সরকার কুপোকাৎ হয়েছে আর এই যুগের তুঘলক যে বেশিদিন সিংহাসনে বসে থাকতে পারবে না সে কথা রাজপথে দাঁড়িয়ে টাকার অপেক্ষায় থাকা মানুষের ক্ষোভ বলে দিচ্ছে।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে