২রা সেপ্টেম্বরের দেশজোড়া শ্রমিক - কর্মচারীদের ধর্মঘট কে জিততেই হবে

সোমবার, আগস্ট ৩১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

২রা সেপ্টেম্বরের দেশ জোড়া শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট কে ভাঙ্গার কথা প্রকাশ্যে ঘোষনা করে মমতা ব্যানার্জী সরাসরি মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের প্রতি তার নৈতিক সমর্থনের ইঙ্গিত দিলেন, তার সাথে তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে তাতিয়ে তুললেন তার ছাত্র পরিষদ কর্মী সমর্থক থুড়ি গুন্ডা বাহিনী কে যাতে তারা ৬০-৭০ এর দশকের যুব কংগ্রেস - ছাত্র পরিষদের মত সরাসরি বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের উপর হামলা করে ধর্মঘট ভাঙ্গার কাজ করতে পারে। এই আস্ফালনের প্রেক্ষাপট হলো মমতার পুলিশের দ্বারা ২৭শে অগাস্ট নির্মম ভাবে নবান্ন অভিযানে সামিল কৃষকদের মিছিলের উপর দমন পীড়ন। একদিন মিছিল আটকে মমতা ও তৃণমূলী সরকারের স্থির বিশ্বাস হয়েছে যে তারা শ্রমিক ও কৃষকদের যে কোনও লড়াই ভাঙ্গতে পারবে তাদের দলদাস প্রশাসনকে লেলিয়ে দিয়ে।   

২রা সেপ্টেম্বরের দেশ জোড়া শ্রমিক - কর্মচারীদের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ডান - বাম মিলিয়ে ১১ টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, কিন্তু ধর্মঘট থেকে শেষ মুহুর্তে আরএসএস এর চাপে পিছু হটে সংঘ পরিবারের শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সংঘ। এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে মোদী সরকারের জন বিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে। গত এক বছর ধরে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার তার পূর্বসূরী কংগ্রেস সরকারের পথ ধরে চলে বড় বড় কর্পোরেটগুলির, বিদেশী বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি ও তার দেশী দালাল পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করার জন্যে জনগণের ঘাড়ে নামিয়ে আনছে একের পর এক ভয়ানক কোপ।  যেমন শ্রম আইন সংস্কার করে দেশের শিল্প ক্ষেত্রে কর্মরত এক বিরাট অংশের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। ন্যুনতম মজুরি বাড়ানোর যে সংগ্রাম সারা দেশব্যাপী মূল্য বৃদ্ধির বাজারে শ্রমিক শ্রেণী চালিয়ে আসছে তার প্রতি নির্মম পরিহাস করে লোক দেখানো ভঙ্গিতে যত সামান্য বাড়ানো হলো মজুরি, অন্যদিকে কর ছাড় সহ নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে মালিক শ্রেণীকে দেওয়া হচ্ছে অঢেল লাভ কামাবার উপায়।  ৮ ঘন্টার কর্মদিবস আউটসোর্সিং ও এসইজেড এর দৌলতে আগেই শ্রম দুনিয়া থেকে চলে গেছে অতীতের রক্ষনাগারে, এবার ১০-১২ ঘন্টার নিয়মিত কর্ম দিবস করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীকে ক্রীতদাসের মতন ব্যবহার করার স্বার্থে। ওভারটাইমের জায়গায় এখন নিয়মিত কর্মদিবসেই শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেশি বেশি খাটিয়ে প্রচুর মুনাফা কামাবার লালসায় বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজিপতিরা, তাদের ভারতীয় দালাল পুজিপতি ও তাদের পেটোয়া বাজারী সংবাদ মাধ্যমগুলি এই তথা কথিত শ্রম আইন সংস্কারের নামে শ্রমিকদের উপর শোষনের বোঝা ভারী করার ষড়যন্ত্র কে 'সাহসী পদক্ষেপ', 'বলিষ্ঠ পদক্ষেপ', ইত্যাদী বলে সাধুবাদ দিছে। 

দেশের বেসরকারী ক্ষেত্রে কর্মরত কর্মচারীদের অবস্থাও শ্রমিকদের মতনই অসহনীয় পর্যায় নেমে গেছে।  বিপুল মূল্যবৃদ্ধির বাজারে বিদেশী বৃহত একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের তল্পিবাহকদের প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিম্ন পদে কাজ করা কর্মচারীদের বেতন বাড়ছে যত সামান্য, অন্যদিকে ম্যানেজমেন্ট এর বেতন বাড়ছে হুহু করে। সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে, শূন্যপদে লোক নিয়োগ বন্ধ রেখে ঠিকা কর্মচারীদের দিয়ে পূর্ণ কর্মচারীদের বেতনের ১/১০ অংশ দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, বেসরকারী ক্ষেত্রের মতন কোনও সুযোগ সুবিধা কর্মচারীদের দেওয়া হচ্ছে না। তার উপর শ্রমিক - কর্মচারীদের  সারা জীবন ধরে সঞ্চিত প্রভিডেন্ট ফান্ড এর টাকা এবার সরকারের পক্ষ থেকে বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি কে ভেট হিসাবে দান করা হচ্ছে শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলার জন্যে। এর ফলে অবসরের পরে পথে নামবেন বহু শ্রমিক ও কর্মচারীরা, আর তাঁদের টাকা মেরে দিয়ে লালে লাল হবে এক শ্রেনীর ফাটকাবাজ পুঁজিপতি।      

এই পরিস্থিতিতে একদিকে মমতা যখন বৃহত এক চেটিয়া পুঁজির চাপে ও সারদা কেলেঙ্কারির ঠেলায় তার পুরানো মিত্র বিজেপির সাথে সন্ধি করেছেন গোপনে - ধরি মাছ না ছুই পানি - নীতি অবলম্বন করে এবং আক্রমণের তীর ঘুরিয়েছেন শ্রমিক কৃষকদের সংগ্রামের দিকে তখন স্পষ্টতই তার মন্তব্যের ও হুমকির মধ্যে দিয়ে এটা পরিস্কার হচ্ছে যে তিনি কাদের স্বার্থ রক্ষা করতে চান।  কেন তিনি শ্রমিক - কৃষক বিরোধী মোদী সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলির আর খোলাখুলি বিরোধিতা করতে পারছেন না সে কথা তিনি স্পস্ট করে  বাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের জানাতে দ্বিধা বোধ করছেন কেন ? তার ধর্মঘট বিরোধিতার অর্থই হলো যে তিনি খোলাখুলি ভাবে মোদী সরকারের কর্পোরেট তোষণ রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ালেন, যেমন দাঁড়িয়েছিলেন বাজপেয়ীর সরকারের বিলগ্নীকরণ ও উদারীকরণের নীতির পক্ষে সেই ২০০০-২০০৪ সালে। কিন্তু শুধু মাত্র মুসলমান ভোট খুয়ে যাবার আতঙ্কে উনি এখনো সর্ব সমক্ষে বিজেপির সাথে হাত মেলাচ্ছেন না।  

মমতার সরকার কিছুদিন মুখে মুখে বিজেপির বিরোধিতা করলেও সংসদে অন্যান্য বিরোধীদের থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখে দর কষাকষি চালিয়ে যায় বিজেপির বিরুদ্ধে।  তাই পেঁয়াজ সহ সমস্ত তরী তরকারী, চাল, ডাল, তেল সহ খাদ্য বস্তু ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চরম মূল্যবৃদ্ধি সত্তেও তারা কোনও কেন্দ্র বিরোধী লড়াইয়ে জোট বাঁধেনি। রাজ্যের কোনও জায়গায় পেঁয়াজের কালোবাজারী রুখতে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারী উদ্যোগে সঠিক দামে পেঁয়াজ বন্টনের ব্যবস্থাও মমতা ব্যানার্জীর সরকার করেনি। এরা ভাত দেওয়ার মুরোদ রাখেনা, কিন্তু কিল মারার গোঁসাইয়ের ভূমিকায় ভালো ভাবেই উত্তীর্ণ হয়।    
পশ্চিম বাংলায় একদিকে যখন আজ মূল্যবৃদ্ধির সূচক বেড়ে চলেছে, গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের হেঁসেল থেকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়েছে মাছ, মাংস, ডাল, ও সবুজ তরী তরকারী, কর্ম সংস্থানের সুযোগ কমায় লোটা কম্বল নিয়ে প্রবাসে যেতে বাধ্য হচ্ছে অসংখ্য তরুণ - তরুণী, অন্যদিকে যখন এই রাজ্যে অবস্থিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি, কর্পোরেট সংস্থাগুলি কলকাতা ও পশ্চিম বাংলাকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে 'কম খরচের জায়গার' নাম দিয়ে অন্যান্য রাজ্য ও শহরের তুলনায় প্রচুর কম বেতনে কর্মচারীদের দিয়ে একই রকমের কাজ করায় (যদিও দিল্লি ও কলকাতায় জীবন যাপন করার খরচায় কোনও তারতম্য নজরে পরেনি ডালহাউসি তে রাস্তায় সস্তার ভাত মাছ ছাড়া) তখন কিন্তু আমরা মমতার গর্জন শুনি না ওই বিদেশী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে, তাদের দেশীয় মারোয়ারী - গুজরাটি - বাঙালি পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে। সমস্ত গর্জন আর হুমকি তিনি লুকিয়ে রাখেন শ্রমিক ও কৃষকদের, কর্মচারী ও ছাত্র যুবদের বিরুদ্ধে। তার কারণ, মমতার শ্রেণী স্বার্থ বিজেপির থেকে অভিন্ন, তার শ্রেণী স্বার্থ জড়িয়ে আছে জোতদার - জমিদার বিদেশী ও দেশী পুঁজিপতিদের সাথে।তাই শুনি প্রতিবার ধর্মঘট ভাঙ্গার হুমকি, শ্রমিক -কৃষক-ছাত্র-যুব-মহিলাদের সংগ্রাম দমনের হুঙ্কার।            

ধর্মঘট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনীর এক অবিচ্ছেদ্য অধিকার, তাঁর গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের হাতিয়ার। এই অধিকার তাঁর থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না এবং কারুর চাপে সে নিজে থেকে এই হাতিয়ার সমর্পণ করবে না। আগামী ২রা সেপ্টেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘট সংগ্রামে বিপুল ভাবে শ্রমিক ও কর্মচারীরা অংশ গ্রহণ করে মোদী সরকারের কর্পোরেট তোষণের নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নিজেদের দাবি জানাবেন এবং নিজেদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার লড়াইতে তীব্র গতিতে এগিয়ে যাবেন।  মমতার পুলিশ, যুব তৃণমূল, তৃণমূলী ছাত্র পরিষদ, গুন্ডা বাহিনী, বোমা-গুলি-লাঠি কোনও কিছুই শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির এই লড়াইকে রুখতে পারবে না। 

সেই ১৯৫৯ সালের ৩১শে অগাস্ট বিধান রায়ের কংগ্রেসী পুলিশ নির্মম ভাবে কলকাতার রাজপথে পিটিয়ে পিটিয়ে খুন করেছিল ৮৯ জন নিরীহ - ক্ষুদায় কাতর কৃষকদের, ২০১৫ সালের ২৭শে অগাস্ট মমতার তৃণমূলী পুলিশ পিটিয়ে আহত করলো নিরস্ত্র কৃষকদের, আর ২রা সেপ্টেম্বর লড়াই হবে শ্রমিকের আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে মমতার বৃহত পুঁজির স্বার্থে শ্রমিকদের উপর ফ্যাসিস্ট দমন পীড়ন নামিয়ে আনার ষড়যন্ত্রের। এ হবে রাজপথে খোলাখুলি দুই শ্রেনীর, শোষিত ও শোষকের শ্রেণী যুদ্ধ, এবং এই লড়াইতে শ্রমিকশ্রেণী কে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করে জিততে হবেই।              


প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের সংগ্রামে ভীত আনন্দবাজার থেকে রাজ্যপাল

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২৭, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

গত কয়েকদিন ধরে কর্পোরেট সংস্থার মালিকানাধীন সমস্ত বাজারী কাগজগুলো প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের বিক্ষোভ আন্দোলনকে সমালোচনা করে পাতার পর পাতা নষ্ট করে চলেছে। আজ বাংলার সর্ব প্রাচীন কর্পোরেট মালিকানাধীন আনন্দবাজার রাজ্যপালের বিবৃতি প্রকাশ করেছে যাতে রাজ্যপাল মহাশয় ছাত্রদের আন্দোলনের সমালোচনা করেছে 'ক্রাইম' বা অপরাধ বলে।  হঠাত করে আনন্দবাজার হাত ধুয়ে প্রেসিডেন্সির ছাত্র আন্দোলনের পিছনে কেন লাগা শুরু করলো ? এই পিছনে লাগা আর সমালোচনা কি শুধুই প্রেসিডেন্সির ছাত্র - ছাত্রীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জঙ্গি রূপের সমালোচনা না কি এর পিছনে আনন্দবাজারীয় কোনও গভীর ষড়যন্ত্র আছে ?

প্রেসিডেন্সির ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপক-গবেষেকগণ  দীর্ঘদিন ধরে নবান্নের দলদাস ভিসি অনুরাধা লোহিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। তাঁদের সংগ্রামের মূল কারণ যে ডিমড বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্সির পরিকাঠামোয় কোনও উন্নয়ন আজ অবধি করে উঠতে পারেননি লোহিয়া। তার আমলের অব্যবস্থার জন্যে অধ্যাপক ও গবেষকরা প্রেসিডেন্সি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্সির প্রবেশিকা ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে গ্রাম বাংলার ছাত্র-ছাত্রীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তাও বিসর্জন দিতে তৈরি হলেন লোহিয়া। স্বায়ত্ব শাসন শুধু মাত্র কাগজ কলমে রেখে তৃণমূলের রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির পিছনেই বেশি করে লেগে রইলেন ভিসি। এ যেন একেবারে যাদবপুরের প্রাক্তন ভিসি অভিজিতের নব রূপে আত্মপ্রকাশ। তাই সেই যাদবপুরের সংগ্রামে পোড় খাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভিসির বিরুদ্ধে সংগ্রামে। যাতে আরও আগুন লাগলো যখন প্রথমবারের সফরে সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কনভয় ঢুকলো। প্রেসিডেন্সির ছাত্র সংগ্রামের ঐতিহ্য বজায় রেখে ছাত্র ছাত্রীরা রুখে দাঁড়ালেন, প্রতিবাদ করলেন মমতার পুলিশের হাতে সুদীপ্ত গুপ্ত নামক বামপন্থী ছাত্র কর্মীর নির্মম হত্যার, প্রতিবাদ করলেন তৃণমূলী ছাত্র পরিষদের লুম্পেনদের দ্বারা প্রেসিডেন্সি প্রাঙ্গনে আক্রমণের। তাতেই ভীত হলো মমতা ও তৃণমূল, যারা সাথে সাথে টিএমসিপির ভাড়াটে বাহিনী এনে তান্ডব চালালো গোটা কলেজ স্ট্রিট জুড়ে।

একথা সুবিদিত যে তৃণমূলী ছাত্র পরিষদে শুধু মাত্র মধ্য মেধার, উচ্চাকাঙ্খী, কংগ্রেসী পরিবারের, বা সরকারী সুযোগ সুবিধা খোঁজা এক শ্রেনীর লুম্পেন ছাত্র - ছাত্রীরাই যোগ দেয়। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ে এদের না কোনও চেতনা আছে না কোনও রাজনৈতিক দিকনির্দেশ আছে।  শুধু কলেজে কলেজে ক্যাম্প করে ছাত্র ভর্তির সময় পয়সা কামাই, রাস্তায় নেমে মারামারি, কলেজ সংসদ নির্বাচনে সন্ত্রাস ছড়ানো এবং দিদির ডাকে ট্রেনে বাসে চেপে ভিড় বাড়ানোর মিছিলে সামিল হওয়া ছাড়া এদের আর কোনও ভূমিকা নাই।  তাই উচ্চ মেধা, চেতনা, সংগ্রামের পীঠস্থান প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, ইত্যাদী জায়গায় এদের দাঁত ফোটানো হয়ে ওঠে না। ফলে এরা এই সব প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের চরম ভাবে ঈর্ষা করে, তাই তো দেখা যায় যাদবপুরের ছাত্র মিছিলের প্রতিবাদে মমতার নির্দেশে শঙ্কু পান্ডার নেতৃত্বে মিছিল করতে সারা রাজ্য থেকে কলেজ তো কলেজ মায় স্কুলের ছাত্র ছাত্রিদেরও নিয়ে এসে ভিড় বাড়িয়ে এরা আস্ফালন করে, প্রেসিডেন্সির ছাত্র রাজনীতিতে নিজেদের কোনও জায়গা তৈরি করার অপরাগতার থেকে এরা বিষাদগ্রস্ত হয়ে সেই প্রতিষ্ঠানে হামলা করে। এটাই দক্ষিনপন্থী কংগ্রেসী রাজনীতির পরিচয়, যার আর একটা প্রতিবিম্ব বিজেপি -আরএসএস এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপি'র কর্মকান্ডে দেখা যায়।

আনন্দবাজার তার বাজারমুখী কায়দায় যাদবপুরের ছাত্র সংগ্রাম নিয়ে একটা প্রচার চালিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন এরা ছাত্র আন্দোলনের কত বড় সমর্থক। আজ সেই আনন্দবাজার হঠাত করে প্রেসিডেন্সির ছাত্র বিক্ষোভের বিরোধিতা কেন করছে ? নিজেদের বিনোদনের পাতায় বিকিনি পরিহিত নারীর ছবি প্রদর্শনকারী, উত্তেজক যৌন উপাদানে ভরা মশলা খবরের বাজার দখল করার লড়াইয়ে  যে আনন্দ গ্রুপ টাইমস গ্রুপ কে টেক্কা দিচ্ছে সে হঠাত করে কেন ছাত্রদের আন্দোলন কে অশালীন বলছে ? কি ভাবে তারা শালীনতা - অশালীনতার মাত্রা ঠিক করছে এবং কেন আপামর ছাত্র - ছাত্রীরা তাদের এই শালীনতার মাত্রা কে স্বীকার করবেন বলে তারা ভাবছে?

এর পিছনে আছে এক গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। গত কয়েক বছর ধরে মার্কিণ মুলুকের নেতৃত্বাধীন বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির চোখে হিন্দু ফ্যাসিবাদের প্রবক্তা বিজেপি - আরএসএস ও তাদের নেতা মোদী ভীষন প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। যার ফলে গত বছরের সাধারণ নির্বাচনে মোদীর নির্বাচনী প্রচার থেকে ভোটে জেতার পিছনে ছিল বিদেশী ও দেশী বৃহত একচেটিয়া পুঁজির লগ্নি, যার জোয়ারে দেশে 'হর হর মোদীর' স্ত্রোত পাঠ শুরু হয়।  এই জোয়ারে আমাদের বাজারী আনন্দবাজার, যার সাথে আবার রুপার্ট মুরডকের নিউজ কর্পোরেশনের খুব ভালই যোগাযোগ আছে, সে কি করে গা না ভাসিয়ে থাকতে পারত ? তাই হরহর মোদী ভজনা শুরু হলো আমাদের বাজারমুখী আনন্দবাজারে, তবে অন্যদের মতন গাড়ল হিসাবে নয়, নিজস্ব বনেদী কায়দায় তারা শুরু করলো মোদী ভজনা, অনেক সুক্ষ ভাবে যাতে বাংলার তপ্ত রাজনৈতিক মঞ্চে তাদের জলে নেমেও বেণী না ভেজে।  আনন্দবাজার বিদেশী পুঁজির একচ্ছত্র আধিপত্যের পক্ষে ওকালতি বহু বছর ধরে চালিয়েছে, তারা খোলাখুলি ভাবে দক্ষিণপন্থা ও ফ্যাসিবাদের পক্ষে বারবার দাঁড়িয়েছে, যেমন এককালে হিটলারের শাসনকালে জার্মানির তথা কথিত প্রগতির পক্ষে তারা ওকালতি করেছিল সেই ব্রিটিশ শাসনকালে। উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচার মাধ্যম হিসাবে ৫০'র দশক থেকেই নাম কামায় আনন্দবাজার। এই আনন্দবাজার পশ্চিমবঙ্গে মমতার নেতৃত্বে তথাকথিত পরিবর্তনের সরকার গঠন করার অন্যতম কারিগর। কারণ তখন এদের খুঁটি যেখানে বাঁধা সেই মার্কিণ মুলুক থেকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মনমোহন সরকারকে সমর্থন করার নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু দেশের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে মোদীর অর্থনৈতিক সংস্কারের বাঙালি উকিল আনন্দবাজার মমতার বিরুদ্ধে কলম চালায় তার মোদীর সাথে চলমান ক্ষমতার দ্বন্ধের কারণে। সেই কারণেই যখন মমতা - মোদী দ্বন্ধ চরমে তখন যাদবপুরের লড়াইকে সমর্থন করা আনন্দবাজারের দায় হয়ে দাঁড়ায়।  কিন্তু এই বছর থেকে বাজার ও বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির চাপে মমতাকে মোদীর সাথে সন্ধি করতে হয়। এর ফলে মমতার দল তৃণমূলের সংসদে মোদী ও বিজেপির বিরুদ্ধে রনাং দেহি মূর্তি মিলিয়ে গেল বাতাসে। দেখা গেল যে এফটি আই আই এর সংগ্রামরত ছাত্র-ছাত্রীদের বিজেপি-আরএসএস দ্বারা গজেন্দ্র চৌহান কে অধিকর্তার স্থলে অভিষিক্ত করার বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রাম কে সমর্থন করতে যাওয়ার তৃণমূলী যাত্রাও স্থগিত হয়ে গেল কোনো অজ্ঞাত কারণে। তাই মমতার বিরুদ্ধে ছাত্রদের সংগ্রাম তো আনন্দবাজারের চোখের কাঁটা হবেই। অতএব শালীনতার প্রশ্ন তুলে চললো দেশের এক নামী প্রতিষ্ঠানের ছাত্র - ছাত্রীদের লড়াইয়ের বিরোধিতা।                             

বিশ্বের দেশে দেশে বৃহত কর্পোরেট এক চেটিয়া পুঁজি চায় যে ছাত্র ছাত্রীরা তাদের বশংবদ দাস হয়ে থাকবে, আন্দোলন সংগ্রাম পরিত্যাগ করে শুধু ক্যারিয়ার গড়ার জন্যে ইঁদুর দৌড়ে ছুটবে, কে কত বড় কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী হবে তার জন্যে প্রতিযোগিতা করবে। এবং বর্তমান কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমের দরুন অনেকাংশে এই কার্য বৃহত একচেটিয়া পুঁজি ভারতের মতন নয়া ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে সফল ভাবে প্রয়োগ করেছে। শহুরে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে ক্যারিয়ার গড়ার প্রতিযোগিতার বাজার বসিয়ে মার্কিণ মুলুকে বসা বৃহত লগ্নি পুঁজি হাততালি দিছে। আর ভারতে ছাত্র -ছাত্রীরা যদি তাদের বেঁধে দেওয়া ছক ভেঙ্গে রাজনৈতিক সংগ্রামে যোগদান করে তাহলে আনন্দবাজার ও রাজ্যপালদের মাধ্যমে তাঁদের উপর চোখ রাঙাতে থাকে। 

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের রেখে যাওয়া বর্তমান প্রতীকগুলির অন্যতম হলো রাজ্যপালের দফতর।  জনগণের করের টাকায় আয়েশে রাজনৈতিক জীবনের অবসর কাল কাটাবার শ্রেষ্ঠ জায়গা হলো রাজভবন।  এই ভবন আলোকিত করে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রাক্তন নেতারা। তাই উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা কেশরী নাথ ত্রিপাঠির মতন উচ্চ জাতির এক প্রাক্তন আরএসএস কর্মীর পশ্চিমবঙ্গে আগমন হয়, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির নেতা ও মুসলমান বিদ্বেষী তথাগত রায় ত্রিপুরার রাজভবনে বসে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে টুইট করতে থাকে।  রাজ্যপাল কেশরিনাথ ত্রিপাঠি চিরকাল প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি করেছে, সে উত্তর প্রদেশের বিজেপি নেতা থাকার সময় থেকেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে উস্কানি দিয়ে এসেছে, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় তারা একযোগে দেশ জোড়া দাঙ্গার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। সাবেক আদবানি - মুরলী মনোহর জোশী শিবিরের নেতা হওয়ায় তাকে মোদী শিবির বানপ্রস্থে পাঠায়, এর ফলে সে আসে পশ্চিম বাংলায়। কিন্তু পশ্চিম বাংলার রাজনীতি, বিশেষত: ছাত্র যুবদের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রাম এই পোড় খাওয়া আরএসএস কর্মীর দ্বারা হজম করা সম্ভব হয় না। যে লোক সারা জীবন জাতপাত আর ধর্মের মেরুকরণের রাজনীতির মধ্যে জীবন কাটিয়েছে সে কি করে মানবে যে জাতপাত ধর্ম নির্বিশেষে ছাত্র - যুব - শ্রমিক - কৃষকরা রাজনৈতিক দাবি নিয়ে গণতান্ত্রিক লড়াই করছেন। তাই যাদবপুর নিয়ে কটুক্তি, ডিগ্রী নিতে অস্বীকার করা ছাত্রীকে ধমক দিয়ে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেওয়া আর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের 'অরাজনৈতিক' ছাত্র ইউনিয়ন' এর প্রশংসা, এই সব নিদর্শন থেকে বোঝা যায় কি রকম ফ্যাসিস্ট মানসিকতার মানুষ আজ বিপ্লব - বিদ্রোহ ও প্রগতিশীল চেতনার জন্মভূমি বাংলার রাজ্যপাল আজ। 

আজ যে ছাত্র যুব আন্দোলনের জুজু দেখছে আনন্দবাজার থেকে তৃণমূল - বিজেপি থেকে রাজ্যপাল - প্রধানমন্ত্রী হয়ে মার্কিণ দেশের ওয়াল স্ট্রিট, সেই সংগ্রাম শীঘ্রই দাবানল হয়ে জ্বালিয়ে দেবে ফ্যাসিবাদ ও বৃহত এক চেটিয়া পুঁজির সাধের সাজানো বাগান। তাই তো দেখা যায় এরা সম্মিলিত ভাবে আজ আন্দোলনের ফুলকি গুলো নেভাবার সংগ্রামে কি ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।  

            


আবার মাতৃভূমি - আবার পুরুষদের হিংসাত্মক আক্রমণের শিকার মহিলা যাত্রীরা

মঙ্গলবার, আগস্ট ২৫, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

আবার মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে তুলকালাম কান্ড হল ২৪শে অগাস্ট সকালবেলা। প্রায় ৬ ঘন্টা অবরোধ চললো বনগাঁও - শিয়ালদহ সেকশনে এবং যথারীতি প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকলো। রেলের - আরপিএফ আর রাজ্য সরকারের জিআরপি'র চূড়ান্ত সমন্বয়ের অভাবে শুধু ভুক্তভোগীই হলেন না অসংখ্য অফিস যাত্রী, নির্মম ভাবে দুর্বৃত্তদের হাতে মার খেলেন অসংখ্য মহিলা। হাবরা, গোবরডাঙ্গা, প্রভৃতি জায়গায় বিজেপির মদতপুষ্ট দুষ্কৃতি বাহিনী এই অবরোধে নেতৃত্ব দেয় এবং পুরুষতন্ত্রের উগ্র জিগির তুলে মহিলাদের বিরুদ্ধে পুরুষ যাত্রীদের ক্ষেপিয়ে তুলে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালাবার প্রস্তুতি চালায়।

এর আগে আমি "মাতৃভূমি তুমি কার ?" প্রবন্ধে লিখেছিলাম যে হঠাত করে রেল কোম্পানির মাতৃভূমি লোকালে পুরুষ প্রবেশ শুরু করালো কোন উদ্দেশ্যে ? এর পিছনে আমি লিখেছিলাম যে বিজেপির হিন্দু ফ্যাসিবাদী রাজনীতির পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার সুক্ষ প্রয়াস কাজ করছিল। গত সপ্তাহে কলকাতায় মমতা ব্যানার্জীর সাথে বৈঠকের পরে রেল মন্ত্রী সুরেশ প্রভুর দ্বারা রেলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার পরেও যে অশান্তির প্রচেষ্টা চলছিল তা অনেক নিত্য যাত্রীরা আঁচ করতে পারলেও রেল কতৃপক্ষ এই নিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে উদাসীন ছিল। গত সপ্তাহের শেষ দিক থেকেই বিজেপি সমর্থক কিছু দুষ্কৃতি রেল অবরোধের সাথে সাথে মহিলা নিত্য যাত্রীদের উপর যে আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল তা রেল কোম্পানি জেনেও না জানার ভান করে ছিল।

সোমবার যখন রেল অবরোধ শুরু হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় রড, পাথর, লাঠি নিয়ে ট্রেনের উপর আক্রমণ চালানো হয় পরিকল্পিত ভাবে, তখনও এর পিছনে রেল কোম্পানি বা স্থানীয় প্রশাসন রাজনৈতিক শক্তিগুলির হাত দেখেনি। হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি পরে কিছু লোক স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেনে পাথর ছুড়ছে, মহিলাদের শ্লীলতাহানি করছে এবং একের পর এক স্টেশনে পরিকল্পিত ভাবে সমন্বয় সাধন করে উত্পাত করছে তখন কি ভাবা চলে যে এই দাঙ্গা হাঙ্গামা একেবারে স্বতস্ফুর্ত। আপিস যাবার তাড়া যখন সোমবার সকালে সাধারণ কর্মচারী - খেটে খাওয়া মানুষদের তাড়া করে তখন রেল অবরোধ করে, দাঙ্গা হাঙ্গামা করে সময় কাটানো কি সেই মানুষগুলির পক্ষে সম্ভব ? নাকি একমাত্র এক শ্রেনীর দুর্বৃত্ত, যাদের পিছনে গৈরিক বাহিনীর মদত আছে শুধু মাত্র তারাই পারে ব্যস্ততার সময়ে রেল অবরোধ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই করার নামে মহিলাদের উপর অকথ্য অত্যাচার এবং শ্লীলতাহানি করার স্পর্ধা দেখাবার।

এই আক্রমণ ও অবরোধ করা হয়েছে মহিলাদের প্রতি পুরুষের হিংসাত্মক মনোভাব কে চাগিয়ে তুলে বিজেপি - আরএসএস এর নেতৃত্বে হিন্দু ফ্যাসিবাদী ব্রাক্ষণবাদী পুরুষতন্ত্র কে রাজনৈতিক ভাবে প্রসার করার স্বার্থে। যাতে পুরুষ ও নারীদের ট্রেনের অপ্রতুলতার নামে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে, রেলের প্রধান দুরবস্থাকে আড়াল করে, লিঙ্গ ঘৃণার আবহাওয়া সৃষ্টি করতে।  এই অপচেষ্টার বড় শরিক হলো সুরেশ প্রভুর রেল। একদিকে যখন রেল কোম্পানি শিয়ালদহ ডিভিশনে সঠিক ভাবে ট্রেন চালাতে ব্যর্থ উপযুক্ত পরিকাঠামো ও রোলিং স্টকের অভাবে। প্রতিদিন নাকাল হতে হয় অজস্র নিত্য যাত্রীদের, ট্রেনের ভিতর বসা তো দূর দু পায়ে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া দুস্কর হয়ে যায়। এই অবস্থায় যদি কোনও নারী সাধারণ কামরায় প্রবেশ করেন তাহলে তাঁকে চ্যাংরা ও ভদ্রবেশী পুরুষদের কাছে হয় শুনতে হয় যৌনতাযুক্ত ব্যঙ্গ না হয় তাঁদের নিগৃহিত হতে হয় চুপচাপ ভিড়ের মধ্যে কারুর কামনার শিকার হয়ে। যে সমস্ত পুরুষরা আজ মহিলা ট্রেন তুলে দেওয়ার বিজেপির রাজনৈতিক দাবির পক্ষে সাওয়াল করছেন তারা আবার নিজেদের বাড়ির মেয়ে - বউদের ট্রেনে তোলার সময় সবসময় মহিলা কামরায় তুলে দেন। কারণ তারা জানেন যে ওই দেশলাই খোপের মতন মহিলা কামরা ছাড়া নারীদের জন্যে গোটা ট্রেন সুরক্ষিত নয়।

অনেক পুরুষ যাত্রী বা তথাকথিত ট্রেনের কামরার সবজান্তা আঁতেলরা প্রশ্ন করেন মহিলাদের জন্যে এত সুবিধা দেওয়ার কারণ কি , কেউ কেউ আবার বলেন যে বিদেশে নারীদের জন্যে এত কিছু দেওয়া হয় না।  এই প্রশ্নের জবাবে উল্টো প্রশ্নই হতে পারে - যে এই দেশে মহিলাদের আসলে কি সুবিধা দেওয়া হয়েছে ? গুটিকয়েক শহরবাসী মহিলা বাদে কোথায় নারীদের মধ্যে সাক্ষরতা? কোথায় তাঁদের জন্যে কর্ম সংস্থান ? কোথায় তাঁদের জন্যে সামাজিক নিরাপত্তা ? যে দেশে নারীর উপর নিগ্রহের দায় সেই নারীর উপর চাপিয়ে দিতে সমাজ ওস্তাদ, যেখানে মহিলাদের শুধু বাড়িতে বসে রান্না করা, বাচ্চা উত্পাদন করা, এবং পুরুষের যৌন দাসী হয়ে থাকার কথা সমাজ শেখায় - সেই সমাজে মহিলাদের জন্যে একটি ট্রেন আপনাদের চোখে কাঁটার মতন বিধতে থাকে ?
পশ্চিমী দেশে মহিলাদের জন্যে আলাদা ট্রেন বা কামরা থাকে না কারণ সেখানে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতায় সিদ্ধ পুরুষতন্ত্রের নেশায় বুঁদ হয়ে পুরুষ মানুষ মহিলাদের সাথে অভব্যতা করার সাহস করে না। পশ্চিমী উন্নত দেশে মহিলাদের চাকরি করা বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে পুরুষরা বিদ্বেষের চোখে দেখেন না।  তাই ওখানে মেয়েদের জন্যে আলাদা কামরার দরকার হয় না। এ দেশে ততদিন মেয়েদের আলাদা কামরার দরকার পরবে যতদিন এখানে পুরুষ মানুষের চেতনার বিকাশ হবে না। 

মাতৃভূমি লোকাল কে নিয়ে চলমান তুলকালাম আসলে এক গূঢ় রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে পরিচালিত লিঙ্গ বৈষম্যর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা হিংসাত্মক লড়াই, যার চরিত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে চরম প্রতিক্রিয়াশীল। এই হিংসাত্মক লড়াই বাঁধানো হয়েছিল সমাজে মেয়েদের প্রতি পুরুষের ঘৃণা, ঈর্ষা ও লালসার চরিত্র কে চাগিয়ে তুলে লিঙ্গের ভিত্তিতে সামাজিক মেরুকরণ গড়ার প্রয়াস নিয়ে। সঠিক ভাবে যদি রাজ্য সরকার এই ঘটনার তদন্ত করায় তাহলে অনেক লুকোনো তথ্য সামনে আসবে।                         

পেঁয়াজের পেঁয়াজি ডালের তরকা - মূল্যবৃদ্ধির সংকট কাটানোর নেই কোনও সদিচ্ছা

সোমবার, আগস্ট ২৪, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

এই সকাল সকাল বৃষ্টির জল কাদা পেরিয়ে ছাতা মাথায় বাজার গিয়ে মাথায় বজ্রাঘাত হচ্ছে জিনিসের দাম শুনে। যেমন ধরুন সবচেয়ে বেশি কাঁদিয়ে চলেছে পেঁয়াজ যা এখন ৭০-৮০ টাকা কিলোর নিচে নামতে রাজি নয়, এ ছাড়াও বিভিন্ন তরি তরকারি যেমন ঝিঙে, উচ্ছে, বেগুন, করলা, বিন্স, বরবটি, ইত্যাদীর মধ্যে কোনও কিছুই ৪০-৫০ টাকার নিচে নাই। চালের বাজারে আগুন, কোনও ভালো চাল ৩৫টাকার নিচে নেই, আর একটু মোটা চাল কিনে যে সংসারের হাঁড়ি টানবো তারও জো নেই কারণ মোটা চালও এখন আর ২২-২৩ টাকার নিচে নাই। 

গরিবের ডাল ভাত আলুসিদ্ধ পেঁয়াজ ও লঙ্কা খাদ্য বলে জেনে এসেছি এবং শৈশব থেকে খেয়ে এসেছি। কিন্তু আজ তো বাজারে ১০০ টাকার নিচে কোনও ডাল নাই, শুনছি নাকি কিছুদিনের মধ্যে আমার প্রিয় মুসুরির ডাল ১৩০ এ পৌঁছবে। এর আগে একটা হিন্দি প্রবাদ শুনেছিলাম "ঘর কি মুরগি ডাল বরাবর !", এবার দেখি এই প্রবাদ বাজারে সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। কারণ আর কিছুটা বাড়লেই ডাল আর মুরগির দামে কোনও ফারাক থাকবে না। কর্পোরেট সংস্থাগুলির মালিকানাধীন বাজারী সংবাদপত্রগুলি বলছে খরিফ শস্য উত্পাদন প্রাকৃতিক কারণে হ্রাস পাওয়ায় এবার এই পেঁয়াজের সংকট। টিভি চ্যানেলগুলিতে চলছে বিশেষজ্ঞদের চুল চেরা বিশ্লেষন এবং যারা করছে বলে দেখছি, মনে হয় না তাঁরা জীবনে কোনদিন ক্ষেতে নেমেছেন বা শস্য চাষ হওয়ার থেকে বাজারজাত হতে দেখেছেন। বারবার তাঁরা বলছেন সরকার যেন বেশি বেশি করে খাদ্য শস্য দেশে আমদানি করে যোগান বৃদ্ধি করে, এবং একমাত্র আমদানি করার পথেই মূল্যবৃদ্ধির সমস্যার সমাধান হবে বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। 

খাদ্য শস্যের যে পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে তার কারণ সর্বত্র অনাবৃষ্টির দরুণ খরিফ শস্যের কম উত্পাদন নয়। এটা সঠিক যে সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রচলনে দেশের মধ্যে তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে নগরপত্তনের কাজ এবং এই সুযোগে রিয়েল এস্টেট শিল্পের বারবৃদ্ধির কথা সাধারণ মানুষের অজানা নয়। ক্রমাগত জমি অধিগ্রহণ করতে করতে আমাদের দেশের শহর ও মফত্সল পার হয়ে এখন রিয়েল এস্টেট হাঙ্গররা গত ১৫ বছর ধরে হানা দিচ্ছে গ্রামাঞ্চলের উর্বর ক্ষেতগুলির দিকে, একের পর এক গ্রামকে গ্রাস করে, বহু ফসলি জমি দখল করে চলছে উপনগরী গড়ার কাজ, যেখানে ক্ষেত থেকে উত্খাত হওয়া গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের আজ দিন মজুরি করে পেট চালাতে হয়। এই ক্রমবর্ধমান জমি অধিগ্রহণে দেশের কৃষি উত্পাদনে এক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, যার ফলে কৃষি উত্পাদন দেশের জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় কমছে।  কিন্তু এই রিয়েল এস্টেট এর আগ্রাসন কে রোধ করার কোনও প্রচেষ্টা কোনও সংসদীয় রাজনৈতিক দল করবে না, এর বিরুদ্ধে কোনও দেশজোড়া আন্দোলন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি করবে না, তার কারণ এই রিয়েল এস্টেট ব্যবসার থেকে এক বিশাল কাট মানি এই রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে জমা হয়, ভোট যুদ্ধে এই সব প্রমোটার ও তাদের বাহিনী রাজনৈতিক দলগুলির জন্যে বেগার খেটেও দেয়।  তাই তো আজ দেশের কৃষকদের তীব্র প্রতিবাদ সত্তেও মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কৃষক ও কৃষি বিরোধী জমি অধিগ্রহন আইন কে জোর করে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টায় রত। 

কৃষি জমি অধিগ্রহন ছাড়াও খাদ্যশস্যের চূড়ান্ত রকমের উর্দ্ধগামী মূল্যবৃদ্ধির পিছনে রয়েছে আরও অনেকগুলি কারণ যার মধ্যে ভারতের সাম্প্রতিক সরকারগুলির বিগত ১৫ বছর ধরে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি প্রয়োগের প্রচেষ্টার ফলগুলিই মূল।  যেমন খাদ্যশস্য সুষম বন্টন করার জন্যে যে গণবন্টন ব্যবস্থা স্বাধীনতাউত্তর ভারতে গড়ে ওঠে, সেই রেশন ব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে সমস্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি ধ্বংস করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর হোতা হল বাজপায়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার, যারা নির্লজ্জ ভাবে রেশন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্যে ওকালতি করে, অন্তোদয় যোজনার নামে শুধু বিপিএল গ্রাহকদের জন্যে চাল ও গম বন্টন রেখে রেশন ব্যবস্থা থেকে বেশির ভাগ পণ্য কে সরিয়ে নেওয়া হয় এক আশ্চর্য কারচুপি করে।  যদিও প্রকৃত ভাবে দরিদ্র সীমার নিচে বাস করা মানুষেরা এই সব প্রকল্পের সুফল আমলাতন্ত্রের মহিমায় খুবই কম উপভোগ করতে পেরেছেন। 

কর্পোরেট সংস্থাগুলির মালিকানাধীন বাজারী সংবাদ মাধ্যমগুলিতে বাজপায়ী শাসনকাল থেকে খাদ্য দ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলি, তেল, গ্যাস ইত্যাদীর থেকে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার ওকালতি শুরু করে দেশের ধনিক শ্রেণী।এর সাথে যুক্ত হয় খুচরো বিপণন ব্যবস্থায় বৃহত একচেটিয়া পুঁজির বিনিয়োগ, যার ফলে গড়ে ওঠে একের পর এক শপিং মল ও তার মধ্যে বিগ বাজার - রিলায়েন্স ফ্রেশ এর মতন খুচরো বিপননের দোকান। যেখানে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের দৈনিক আনাগোনা বেড়েই চলে।  রেশন ব্যবস্থায় খাদ্য শস্য অমিল হওয়ার সাথে সাথে বাজপায়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার খুলে দেয় ফিউচার ট্রেডিং এর দরজা, যার মাধ্যমে দালাল পুঁজিপতি - জোতদার জমিদারদের যোগ সাজেশে খাদ্য শস্য ও শাঁক সবজির উপর ব্যাপক হারে ফাটকা খেলা শুরু হয়।  আলু, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে সোয়াবিন, রান্নার তেল, মশলাপাতির উপর চলতে থাকে ফাটকা খেলা। ব্যাপক হারে বেড়ে চলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, খাদ্যদ্রব্য মজুতদারী। যাতে বৃদ্ধি পায় কৃত্রিম সংকট এবং সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কৃষি জাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটায় ফাটকাবাজরা।  সরকারী সহায়তায় এইরূপ কালোবাজারী ভারতের ইতিহাসে বিরল।  

চাষের কাজে যুক্ত কৃষকদের সঙ্গে এই একই সময়ে শুরু হয় এক নির্মম রসিকতা। সরকারী ভাবে শস্য কেনার কাজে নিযুক্ত আমলারা চিরকালই জোতদার - জমিদার - ধনী কৃষকদের থেকে ঘুষ খেয়ে সরকারী ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের বেশি দিয়ে যখন একদিকে তাদের শস্য গুদামজাত করে, অন্যদিকে সেই একই সময়ে গরিব ও মধ্য কৃষকদের সারা দেশেই ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। একদিকে যেমন নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ফলে কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে চরম হারে, সারের উপর ইচ্ছাকৃত ভাবে ভর্তুকি হ্রাসের ফলে দাম বেড়েছে বহুগুন, এবং সর্বপরি ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুত সংকট ও হিমঘরের ভাড়া বৃদ্ধির কারণে চাষের বিনিয়োগের খরচা যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারী কৃষি ঋণ অমিল হওয়ার কারণে মহাজনেদের চড়া সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবসারও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।  

এর ফলে কৃষকরা পরেছেন এক দানবীয় জাঁতাকলে। একদিকে তাঁদের কৃষিতে নিবেশ যেমন বেড়ে গেছে অন্যদিকে উত্পাদিত শস্যের সঠিক মূল্য না পাওয়ায় ও সঠিক ভাবে কম পয়সায় তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকদের প্রায়ই সস্তায়, নামমাত্র মূল্যে, কৃষি পণ্য ফোঁড়েদের বিক্রি করে দিতে হয়। এই ফোঁড়েদের দলের এক বিরাট জাল সারা দেশব্যাপী ছড়ানো। আজ যে সিন্ডিকেট ও কার্টেলের কথা রিয়েল এস্টেট শিল্পে বাংলার মানুষ শুনছেন, তার এক আদি ও শক্তিশালী রূপ যে কৃষিজাত পণ্য বিপণনে বহু বত্সর ধরে বর্তমান সে কথা অনেক শহুরে মধ্যবিত্ত জানে না।  এই সিন্ডিকেটের সাথে ওতপ্রত ভাবে জড়িত আছে খাদ্য শস্যের ফাটকা ব্যবসা। তাই কৃষকের থেকে সস্তায় কুইন্টাল - কুইন্টাল মাল তোলার পরেই তা চলে যায় কালোবাজারী আর মজুতদারদের আড়তে।  যেখান থেকে মাল পাইকারী বাজারে যায় কৃত্রিম যোগানের সঙ্কট সৃষ্টি করার পর। এবং পাইকারী ব্যবসায়ীদের এই খাদ্যশস্য অনেক চড়া দামে কিনতে হয় এবং তাদের থেকে কিনে যখন খুচরো ব্যবসায়ীরা এই পণ্য সাধারণ মানুষের কাছে বেচেন তখন এর দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়। 

এই সম্পুর্ন খাদ্য সংকট থেকে বের হওয়ার রাস্তা নেই তা নয়। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই তা সম্ভব হত। দরকার শুধু কড়া হাতে মজুতদারী দমন করা, কালোবাজারীদের গ্রেপ্তার করা (এক কালে খাঁটি গান্ধীবাদী বলে প্রখ্যাত জহরলাল নেহেরু আহ্বান দিয়েছিল কালোবাজারীদের ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে মারতে) ও শাস্তি দেওয়া, অবিলম্বে খাদ্য শস্যের উপর ফাটকাবাজির ব্যবসা বন্ধ করা - ফিউচার ট্রেডিং কে নিষিদ্ধ করা, রিয়েল এস্টেট ও অন্যান্য ব্যাবসার দ্বারা কৃষি জমি অধিগ্রহণ বন্ধ করানো, কৃষকের কাছে সল্প সুদে সরকারী কৃষি ঋণ পৌঁছে দেওয়া এবং সরকারী গণ বন্টন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে রেশনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে সুলভে খাদ্য দ্রব্য পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের মূল্যবৃদ্ধির উপর লাগাম পরানো সম্ভব। কিন্তু এই সদিচ্ছার অভাবে ভারতের কোনও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলি এই সংকটের থেকে মানুষ কে পরিত্রাণ দিতে কোনও রকম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়নি। কারণ এই সব বড় বড় পুঁজিপতি - ফাটকাবাজ - মজুতদার - কালোবাজারীদের চাঁদায় নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া যায়। দেশের সমস্ত দক্ষিণপন্থী দলের মাথায় আছে আড়তদার - জোতদারদের প্রতিনিধিরা, যারা কোনো ভাবেই তাদের শ্রেনীর স্বার্থ বিঘ্নিত হতে দেবে না।  
                           
তাই একদিকে যেমন এই ব্যবস্থায় কৃষক মার খাচ্ছে, যাদের কম দামে শস্য বেচে দিতে হচ্ছে চাপে পড়ে, এবং মহাজনের সুদের -আসলের চাপে অনেক কৃষক সারা দেশে আত্মহত্যা করছেন, তেমনি সাধারণ মানুষদের আজ পড়তে হচ্ছে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে, তাঁদের সীমিত আয়ের মধ্যে বাড়ির সবার পেট ভরানো আজ বিশাল দায় হয়ে উঠছে। শ্রমিক - কৃষক - মেহনতি মানুষদের নেতৃত্বে পরিচালিত গত শতাব্দীর খাদ্য আন্দোলনে একদিন যেমন দমদম দাওয়াই দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি কে ঠেকানো হয়েছিল, আজ তেমনি সরকারী উদাসীনতায় ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বেড়ে চলা কালোবাজারী ও ফাটকাবাজি রোধ করতে দরকার দেশব্যাপী সেইরকম এক জঙ্গি গণ আন্দোলন। কারণ একমাত্র গণ সংগ্রামেই ভীত হয় এই কালোবাজারী-মজুতদারী-জোতদারি চক্র এবং এই আন্দোলনের মাধ্যমেই ভাঙ্গা সম্ভব এদের পেঁয়াজ নিয়ে পেঁয়াজি আর ডালে মূল্যবৃদ্ধির তরকা মারার ষড়যন্ত্রগুলি।      

বীরভূমের কাহিনী - গণতন্ত্র'র স্বরূপের নমুনা

শুক্রবার, আগস্ট ২১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

গণতন্ত্রের ধ্বজ্জাধারী তৃণমূল ও বিজেপির চোখ এখন বীরভুম জেলায় আবদ্ধ। সেখানে চলছে এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের এক প্রধান কর্মযজ্ঞ, দল বদলের খেলা। জামা পাল্টাবার মতন করে সমস্ত মাথারা হঠাত দল ত্যাগ করতে শুরু করলো এবং এখানে এগিয়ে চলেছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের গোলের সংখ্যা বেশি কারণ ফরওয়ার্ড পজিশনে ফুর্তিতে খেলছে অনুব্রত ওরফে দিদির কেষ্ট।  

বীরভুম দখল করার তাগিদ বেশি কারণ এই জেলায় বিজেপি দাঁত ফুটিয়েছিল এবং আশ্চর্যজনক ভাবে মুসলমানদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তুলে।  মুসলমানদের পরিত্রাতা হিসাবে নিজেদের দাবি করা তৃণমূলের পক্ষে এই ঘটনা তীব্র যন্ত্রনাদায়ক ছিল। তাই বীরভুম কে দখল করার জন্যে জরুরি হল সংগ্রাম, মানে এলাকা দখলের জন্যে ভ্রাতৃঘাতী  দাঙ্গা।  এর পর চললো গুলি আর পেটোর খেলা, যা ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থার বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার রাজনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। 

হৃদয় ঘোষের হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে সম্প্রতি। সাগর ঘোষের হত্যার কেস তুলে দিয়ে সে এখন মমতা বাড়ুজ্যের মমতা ও করুণার আঁচলের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে কেষ্টের সহায়তায়। কেষ্ট আবার দিদির নির্দেশে মাথা গরম না করে, আইন কানুন কে শ্রদ্ধা করে বুকে টেনে নিয়েছে তার বিচ্ছিন হৃদয়কে, যে এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত কেষ্টকে তার বাবার খুনি বলে গাল পাড়ছিল। বীরভূম জুড়ে বীর কেষ্টের জয় জয়কার শুরু হয়েছে, রাম ভক্ত হনুমানদের দলে ফাটল ধরেছে, দুধকুমার লেঙ্গি মেরে খাল টপকে ও পাড়ে, বাকি ঠেলে ঠুলে যারা গেরুয়া ঝান্ডা তুলে রেখেছে তাদের এখন ভয়ানক কৌষ্ট কাঠিন্যের দৌলতে ভুগতে হচ্ছে।  এক এক করে সব তালপাতার সেপাই শিবির ত্যাগ করে দিদির নীড়ে আশ্রয় নিচ্ছে কিছু ভালো খাওয়া পড়া জোটার আশায়।  সবাই আশা করে রেখেছে যে পারুইয়ের সেই গৃহবধুও এবার দিদির কাছে ছুটবেন এবং পুলিশের বিরুদ্ধে করা অভিযোগকে সিপিএমের বিরুদ্ধে বদলে দেবেন, ঠিক যেমন হৃদয় ঘোষ নিজের পিতার হত্যায় অভিযুক্ত অনুব্রতর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেওয়ার পর হঠাত আবিষ্কার করে যে তার বাবার মৃত্যুর জন্যে দায়ি একমাত্র সিপিএম।

বীরভুম এমন এক রণাঙ্গন, যেখানে একদিকে দিদির ভক্ত বাহিনী, যার সেনাপতি খোদ কেষ্ট, অন্যদিকে ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দারের পঙ্গপাল বাহিনী। দুইয়ের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলেও যে তা হাস্যকর হবে সে কথা আজ বীরভূমের শিশুরাও স্পস্ট করে বুঝিয়ে দিতে পারবে। তাই গেরুয়া শিবিরের 'আচ্ছে দিন' এর সূর্যাস্ত  হয়ে গেছে বীরভূমের মাটিতে, সেথায় শুধু কেষ্টের জয়জয়কার। বীরভুম থেকে হাওয়া বদলের স্বপ্ন চূর্ণ হয়েছে গৈরিক বাহিনীর, এখন তারা যেন তেন প্রকারে মুখ রক্ষার প্রয়াসে ব্যস্ত।

বীরভুম এর সাম্প্রতিক তৃণমূল - বিজেপির সশস্ত্র সংঘাত আমাদের পশ্চিম বাংলার কেশপুরের ২০০০ সালের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে এলাকা দখলের কোন্দলে ব্যস্ত সিপিএম ও তৃণমূল তাদের সংসদীয় গণতান্ত্রিক পথের পাঁচালি পড়া ছেড়ে নেমে এসেছিল খোলা খুলি মাস্কেট আর ওয়ান শাটার এর লড়াইয়ের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কায়েম করতে।  আজ সংসদীয় গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে বিজেপি ও তৃণমূলের মতন দুই অতি দক্ষিনপন্থী দলগুলিও সেই সশস্ত্র সংগ্রাম কেই ক্ষমতা দখলের এক মাত্র পথ বলে গন্য করলো।  ভাবতে অবাক লাগে যে কমিউনিস্টদের একটি অংশের সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের রাজনীতি কে এরা এই বলে ভার্ত্সনা করে যে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে হিংসার কোনও স্থান নাই।  কিন্তু এদের কার্যকলাপ কি আমাদের মতন সাধারণ মানুষকে ভগবান বুদ্ধদেবের কথা মনে করায়? এই বিজেপির নেতারা কি স্বীকার করেনি যে তৃণমূলের আক্রমণ প্রতিহত করতে বীরভূমে এদেরও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। আজ হঠাত রুপা গাঙ্গুলিকে কেন দুধ কুমার কে বাসায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে সোচ্চার হতে হচ্ছে ? তার কারণ বিজেপির অন্দরে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়েছে যে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বীরভূমে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে জমি দখল করতে গেলে ওই রকম পোড় খাওয়া সংঘ নেতাদের দরকার যারা হিন্দু মুসলমানে, বা হিন্দুতে হিন্দুতে, বা মুসলমানে মুসলমানে দাঙ্গা বাঁধাতে ওস্তাদ। 

আজ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দক্ষিনপন্থী ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলির, যারা একদিকে হিন্দু ফ্যাসিবাদ আর অন্যদিকে মুসলিম মৌলবাদ কে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে, তাদের এই উথ্বান দেখে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ আজ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু একটু পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে যে এদের এই উথ্বানের কারণ হল ৩৪ বছর ধরে মেকি 'বামেদের' অপশাসন। যা এই রাজ্য থেকে ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ বিশ্বাস, ও ভ্রাতৃঘাতী হিংসার রাজনীতিকে নির্মূল করার কোনও প্রচেষ্টা তো করেইনি, বরং এই সমস্ত কাজে বেশি বেশি করে ইন্ধন দিয়ে গেছে খিড়কির দরজা দিয়ে। জন সমক্ষে যখন জ্যোতি বোস - বুদ্ধদেবরা বড় গলায় মানুষের চেতনা বৃদ্ধি হওয়ার দাবি করছিল, ঠিক তখনই অন্যদিকে পাড়ায় পাড়ায় শনি পুজো থেকে নানা গুরুদেবের ভজনা বৃদ্ধি পেল, বটতলায় সিঁদুর মাখানো পাথরে মানুষের মাথা ঠোকা বাড়লো, জুম্মাবারের নামাজে নামাজিদের সংখ্যা বাড়লো, পীরের দরগায় গিয়ে মাথা ঠোকা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক বিভেদ রেখা আরও স্পস্ট হয়ে উঠলো।  যে বামপন্থীদের কাজ ছিল মানুষের চেতনা বৃদ্ধি করা, তাদের প্রগতিশীল চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ করে তোলা, রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে তোলা, তারা শুধু প্রোমোটার আর জোতদারদের সাথে রফা করে চলে গুন্ডা বদমাইশদের সাহায্যে দল ভারী করেছিল আর রিগিং করে জেতার জন্যে এক বিরাট 'সম্পদ' বাহিনী গড়ে তুলেছিল। তাদের ৩৪ বছরের রাজনৈতিক শাসনে তারা পশ্চিমবাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের, শ্রমিক ও কৃষকদের, মেহনতী মধ্যবিত্ত ও ছাত্র - যুবদের শুধুই প্রতিক্রিয়ার শিবিরের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। 

এই অবস্থায় আজ পশ্চিম বাংলার মসনদে যে দলই আসীন হোক, তার পক্ষে হিংসা - বিদ্বেষ - সন্ত্রাস না ছড়িয়ে কোনও ভাবে রাজ্য শাসন করা সম্ভব না। পেটো আর ওয়ান শাটার - মাস্কেট - ৯ মিমি পিস্তল দিয়েই এই রাজ্যের মসনদে আসা যায় ও টিকে থাকা যায় এই সত্যটি আজ শিশু মাত্র বোঝে। বীরভুম তার থেকে আলাদা নয়। হয় কেষ্ট নয় দুধকুমার এই দুইয়ের মধ্যে যে এই জেলায় নিজ দলের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে চাইবে তাকেই এখানে পেটোর শাসন কায়েম করতে হবে। রাজনীতির মঞ্চে দাড়িয়ে মমতা - রাহুল - অধীর - বুদ্ধ সবাই এক যোগে হিংসার রাজনীতির বিরোধিতা করবে, একযোগে বলবে তারা সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে বিশ্বাস করে, আর রাত পোহালেই রাস্তায় গুলিবিদ্ধ লাশ পরে থাকবে সেই সংসদীয় দলের পদাতিক বাহিনীর এবং দোষ হবে বিরোধী সংসদীয় দলের।  

বাম জমানার হুগলি - মেদিনীপুর - ২৪ পরগণার জায়গায় আজ তৃণমূল যুগের বীরভুম, এই রাজ্যের পট পরিবর্তনের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রের রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং এই খুন - পাল্টা খুন, বাড়ি জ্বালানো, ধর্ষণ, হিংসার মাধ্যমেই আমরা শুনবো যে ভবিষ্যতে এক উন্নত রাজ্যে আমরা নাকি পৌঁছাবো, আমাদের রাজ্যে নাকি উন্নয়নের ধারা বয়ে যাবে এবং লক্ষ লক্ষ ছেলে - মেয়েরা যারা বাইরে পেটের টানে গেছেন তাঁরা সব বাড়ি ফিরে আসবেন কারণ কর্মসংস্থান নাকি এখানেই হবে। তাই পেটো ফাটবে, দানা চলবে, আর গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রার মধ্যে দিয়ে বাঙালি দুয়ারে বসে থাকবে 'আচ্ছে দিনের' অপেক্ষায়। 

    

মাতৃভূমি তুমি কার ?

শুক্রবার, আগস্ট ২১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

শিয়ালদহ উত্তর ডিভিশনের বনগাঁও ও মেইন লাইনে মাতৃভূমি লোকাল ট্রেনের তিনটি কামরায় পুরুষ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে মহিলা ও পুরুষ যাত্রীরা দফায় দফায় ১৯ অগাস্ট বুধবার ট্রেন অবরোধ করেন বামুনগাছি - নিউ ব্যারাকপুর - বিরাটি ইত্যাদী স্টেশনে। ছোড়া হয় ইঁট পাটকেল, পুলিশ এসে লাঠি চালায় এবং অনেক যাত্রী আহত হন, যার মধ্যে কল্যানী দত্ত নামক এক মহিলা যাত্রীর মাথা ফেটে যায় পুরুষ যাত্রীদের ছোড়া পাথরের আঘাতে। 

এই ঘটনার পর তীব্র বিতর্ক শুরু হয় মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে যা পরবর্তিতে পৌঁছে যায় পুরুষ বনাম মহিলাদের নিয়ে বিতর্কে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভারত, যেখানে আজও আধা সামন্ততান্ত্রিক উত্পাদন সম্পর্ক উপস্থিত এবং মানুষের চেতনার মান পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে, সেই দেশে পুরুষদের মধ্যে নারী বিদ্বেষ যে চরমে থাকবে সে কথা যে কেউ হলফ করে বলতে পারবে, এবং এর সাথে যুক্ত হয় পুরুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার ধর্মীয় চেতনা যা পুরুষদের নারী কে শুধু মাত্র একটি যৌন সুখ দায়ক যন্ত্র এবং সন্তান উত্পাদনের যন্ত্র হিসেবে গন্য করতে শেখায় তাদের ছেলেবেলার থেকে। তাই এই দেশে নারীদের জন্যে একটি স্পেশাল ট্রেন অবশ্যই পুরুষদের চোখ কপালে সিটকে তোলে, এবং তাদের বিদ্বেষ বৃদ্ধি করায়।  

যে কোনো শুভ চেতনা সম্পন্ন মানুষ নিশ্চয় বাসে - ট্রামে - ট্রেনে - মেট্রোয় যাত্রা করার সময়ে বা আপিসের টিফিন টাইমে এই রকম আলোচনা শুনেই থেকেছেন, যেখানে একদল পুরুষ এর মধ্যে নারীদের বেশি স্বাধীন হওয়া নিয়ে খেদ প্রকাশ বা তাঁদের জন্যে কোনও সরকারী প্রকল্প নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ পায়, কিংবা চলে আসে বিকৃত যৌন আবেদনে ভরা কটুক্তি। ঠিক তেমনি মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে মহিলাদের আন্দোলন কে ঘিরে তৈরি হলো দুই বিপরীত মত, একদিকে নারীদের পক্ষে নারী সমাজ ও প্রগতিশীল পুরুষ সমাজ এবং অন্যদিকে পুরুষদের পক্ষে প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিরা। বিক্ষোভ ও অবরোধে সামিল খেটে খাওয়া মহিলাদের উপর এই পুরুষতন্ত্রের গান গাওয়া বীর পুঙ্গবরা শুধু মাত্র পাথর দিয়ে আক্রমণ করলো তাই নয়, নিজেদের সামাজিক - রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কায়েম করতে তারা ট্রেনের মহিলা কামরায় ঢুকে শুরু করলো মহিলা যাত্রীদের যৌন হেনস্থা। কোনো মহিলা যাত্রীর ওরনা টেনে বা কারুর গায়ে হাত দিয়ে, বা কারুর শ্লীলতাহানি করে এরা প্রমাণ করার চেষ্টা করলো যে পুরুষ জাত শ্রেষ্ঠ।     

এই সমস্ত অত্যাচার লুণ্ঠনের সময়ে মহিলাদের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা, সাধারণ মানুষের করের টাকায় বেতন প্রাপ্ত রেল ও সাধারণ পুলিশ ত্রিসীমানায় ছিল না, এবং তারা এসেও মহিলাদের সম্মান রক্ষার্থে কোনও পদক্ষেপ তো করলোই না বরং বিক্ষোভরত নারীদের উপর লাঠি চালিয়ে এবার নিজেদের বীরপুঙ্গব সাজার অভিলাষ পূর্ণ করার প্রচেষ্টায় মজে উঠলো। মহিলাদের চোখের সামনে স্পস্ট হয়ে উঠলো যে এই রাষ্ট্র মহিলাদের স্বাধীন হতে দেবে না, সে মহিলাদের পুরুষের শাসনের অধীনে রাখার এবং গন্ডিবদ্ধ জীবন কাটাবার জন্যে বাধ্য করবে।  
    

মাতৃভূমি লোকাল মমতা ব্যানার্জির রেল মন্ত্রী থাকাকালীন শুরু হওয়া এক মহিলা স্পেশাল ট্রেন যা নানা রাজ্যের শহরতলির থেকে শহরে কার্য ক্ষেত্রে আসা মহিলাদের জন্যে এক সুবিধাজনক পরিবহণ মাধ্যম, কারণ সাধারণ ইএমইউ ও মেমু ট্রেনে মাত্র দুইটি কম্পার্টমেন্ট মহিলাদের জন্যে হওয়ায় তাঁদের প্রচন্ড কষ্ট করে সেই কামরাগুলিতে যেতে হয় আর নয়তো সাধারণ কামরায় পুরুষদের ভিড়ে পিষ্ট হয়ে যেতে হয়, যে সুযোগে তাঁদের সাথে নানাবিধ দুষ্কর্ম বা যৌন উত্পীড়ন করে কিছু সংখ্যার বিকৃত মানসিকতার পুরুষ যাত্রীরা। তাই মাতৃভূমি লোকাল ট্রেন হওয়ায় অসংখ্য মহিলা উপকৃত হয়েছিলেন এবং তাঁরা এই  ট্রেনে নিরুদ্বেগ হয়ে  যাতায়ত করতে পারতেন।  কিন্তু হঠাত হওয়া রেলের এই সিদ্ধান্তে তাঁদের উপর আবার নেমে আসছে সেই কষ্টকর যাতায়তের খাঁড়া।  কারণ নয়টি কামরার মধ্যে যদি তিনটি কামরা পুরুষদের জন্যে করে দেওয়া হয় তাহলে ছয়টি কামরায় তাঁদের পক্ষে আবার যাতায়ত করা মুশকিল হয়ে যাবে।  এর ফলে মহিলা যাত্রীরা আন্দোলন শুরু করেন রেলের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে এবং তাঁরা দাবি করেন যে একান্তই যদি রেল কোম্পানি এই নির্দেশ লাগু করতে চায় তাহলে মাতৃভূমি লোকালের কোচের সংখ্যা বারো করে দেওয়া হোক, যাতে অফিস টাইমে পুরুষ ও মহিলা সব যাত্রীরাই একটু স্বাচ্ছন্দে যাতায়ত করতে পারেন।  মহিলা যাত্রীদের এই ন্যায্য দাবিটি পর্যন্ত রেল কোম্পানি নাকচ করে দেয় এই বলে যে সমস্ত স্টেশনে বারো কোচের অনুসারে লম্বা প্ল্যাটফর্ম নেই, অতএব মাতৃভূমি লোকাল কে কোনও ভাবেই বারো কোচের করা চলবে না। 

প্রশ্ন হলো শিয়ালদহ উত্তর ডিভিশনে কি  বারো কোচের ট্রেন চলে না একান্তই ? নিত্য যাত্রীরা কিন্তু মেইন লাইন ও বনগাঁও - বারাসাত লাইনে বারো কোচের ট্রেন নিয়মিত একটা দুটো দেখে থাকেন, যা আশ্চর্যজনক ভাবে অফিস টাইমে কম চলে এবং খালি সময়ে বেশি চলতে দেখা যায়, এবং রেকে কোচের সংখ্যা বৃদ্ধি করে মাতৃভূমি লোকাল কে বারো কোচের করে তুলতে রেল কোম্পানির বিশেষ অসুবিধার কিছু চোখে পরে না, কারণ কয়েকটি মাত্র ট্রেনের জন্যে বাড়তি কিছু কোচ তো তাদের রোলিং স্টকে না পাওয়ার জিনিস নয়।  তবু যখন রেল কোম্পানি এই নিয়ে নাছোরবান্দা, তখন সন্দেহ হয় এই নির্দেশের রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে। 

বর্তমানে রেল কোম্পানি বিজেপি পার্টির সুরেশ প্রভুর অন্তর্গত এবং স্বাভাবিক ভাবে বিজেপি এই কোম্পানির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়াবার সুযোগ খুঁজবে। বিজেপি হল আরএসএস এর গণসংগঠন এবং এর কাজ হলো বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ কে ভারতের মাটিতে রক্ষা করার স্বার্থে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাহায্যে ব্রাক্ষণ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলা, সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি, যেমন মুসলমান - খ্রিস্টান প্রভৃতিকে ভীত সন্ত্রস্ত করা, এবং শোষিত জাতি ও আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের মাত্রা তীব্র করা।  এর সাথে সাথে বিজেপি চরম ভাবে আরএসএস এর নারী বিদ্বেষী ও পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা কে সমর্থন করে। তারা দেশের সর্ব প্রান্তে যেমন একদিকে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এক বিশাল বিভেদ আনতে পেরেছে তেমনি তারা এবার ভারতের পুরুষ সমাজকে পুরুষতন্ত্রের বিষাক্ত চিন্তাধারা দিয়ে উত্তেজিত করে নারীদের উপর নিজ কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করছে। সম্প্রতি বিজেপির সাধু সন্ত নেতারা হিন্দু মহিলাদের মুসলমানদের পরাস্ত করতে দশটি করে বাচ্চা প্রসব করার ডাক দেয়। এই দশ বাচ্চার তত্ব হয়তো বিজেপির পক্ষে উত্তর ভারতের গো বলয়ের গ্রামে গ্রামে উচ্চ হিন্দু জাতিগুলিকে প্রভাবিত করে করা সম্ভব কিন্তু শহর ও শহরতলীতে বসবাসকারী মহিলারা এই দাবি কোনও দিন মানতে চাইবেন না। কারণ চাকরিরত বা ব্যবসায়ী নারীরা সর্বদাই চেষ্টা করেন তাঁরা সমাজে পুরুষের সমান মর্যাদা পান, যা তাঁদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দিতে চায় না।  তাই এই মহিলাদের বাগে আনতে গেলে পুরুষদের উত্তপ্ত করা দরকার ব্রাক্ষণ ফ্যাসিবাদী চিন্তায় এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দেওয়া জরুরী। 

তাই রেল কোম্পানির এই সিদ্ধান্ত, তার ফলে ঘটে চলা একের পর এক বিক্ষোভ অবরোধ কে ঘিরে মহিলাদের উপর অত্যাচার যে কোনও কারণ ছাড়াই হচ্ছে এই কথা বিশ্বাস করা কঠিন। হয়তো নিরপেক্ষ তদন্ত হলে স্পস্ট হতো যে যারা মহিলাদের উপর আক্রমণের হোতা  তারা হয় বিজেপি বা তৃণমূলের আড়ে লুকিয়ে থাকা আরএসএস এর জঙ্গি সমর্থক। অথবা তাদের হয়তো ইচ্ছে করেই পয়সা দিয়ে ঝামেলা করতে পাঠিয়েছিল সেই সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি যারা এই দেশে যেনতেন প্রকারে ব্রাক্ষণ ফ্যাসিবাদ কে শক্তিশালী করে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির কারবারকে আরও মজবুত করে দেওয়ার তাগিদে চলছে। হয়তো এই কারণেই যখন মহিলাদের উপর পাথর ছোড়া হচ্ছে বা তাঁদের শ্লীলতাহানি করছে একদল লম্পট লুম্পেন, সেই সময় রাষ্ট্রের বাহিনীর সন্দেহজনক অনুপস্থিতি।  

সমাজের শুভ চেতনাসম্পন্ন পুরুষ ও মহিলাদের আজ এটা উপলব্ধি করা দরকার যে ভারতীয় সমাজের পরিপ্রক্ষিত অনুসারে নারী এ দেশে পরাধীন ও শোষিত। তাঁর স্থান এই সমাজের রীতি -নীতির হিসেবে শুধু মাত্র একটি যৌন দাসীর এবং তাঁর সমগ্র জীবন অন্যের গোলামী করে কাটে।  তাই নারী স্বার্থ কে রক্ষা করা এই দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মানুষের কর্তব্য। যে কোনও ঘটনা যা নারীকে আক্রমণ করে, তাঁর সম্মান হানি করায় বা তাঁর উদ্দ্যেশে এমন কটুক্তি করায় যা তাঁর মর্যাদাকে আঘাত করে, তা অন্যায়, এবং তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের রাস্তায় চলা আজ আমাদের জরুরী কর্তব্য।  

মাতৃভূমি লোকাল নিয়ে রেলে হিংসার ঘটনা আমাদের চোখের সামনে তুলে আনলো যে নারী এই সমাজে কি ভাবে নিজ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং পদে পদে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্ষকদের হাতে আক্রান্ত হয়। 
মাতৃভূমি কার ? সে কি নারীর না পুরুষের ? সে কি আমার না তোমার ? মাতৃভূমি তো মা থেকেই এসেছে, যে মা নারীত্বের প্রতীক। সেই মা কে যে অসম্মান করে সে কি কোনও ভাবে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য ? তাই আজ সোচ্চার হয়ে বলিষ্ঠ ভাবে ঘোষণা করতে হবে যে এই মাতৃভূমি, যা প্রজনন করে জীবন কে, তা নারীর একান্ত আপন।  সে ভাগ করে নেয় পুরুষের সাথে তাঁর আকাশ এবং ওই অর্ধেক আকাশের অধিকারিনী হয়ে তাঁকে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে দিতে হবে, তাঁর উপর পুরুষের আধিপত্য কে ধ্বংস করতে হবে, তাঁর মুক্তির জন্যে চলমান সংগ্রামে তাঁকে সব রকম ভাবে সহযোগিতা করতে হবে। কারণ যতদিন নারী স্বাধীন হবে না ততদিন সমাজ মুক্ত হবে না। 



         

         

     

বাংলাদেশের ব্লগারদের উপর হামলা - ধর্মীয় মৌলবাদকে রোখার একমাত্র পথ হলো সমাজ বদল

সোমবার, আগস্ট ১৭, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

সম্প্রতি বাংলাদেশে নিজের বাড়ির ভিতর ইসলামী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হলেন প্রগতিশীল ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, যিনি  'নীলয় নীল' নামে ব্লগ দুনিয়ায় পরিচিত ছিলেন।  এই বছরের  শুরুর থেকে এই নিয়ে ৪ জন ব্লগার প্রাণ হারালেন ইসলামী ফ্যাসিস্টদের হাতে।সর্বপ্রথম এই বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকে ঢাকা বই মেলা প্রাঙ্গনের বাইরে ইসলামী সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও যুক্তিবাদী অভিজিত রায়কে, তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর ভাবে আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।এর পরে সমগ্র বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক মহলে বিশাল প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায় মৌলবাদের সাথে আপসকামী আওয়ামি লিগ সরকারের বিরুদ্ধে এবং ক্ষোভ ফেটে পরে মৌলবাদী সন্ত্রাসী ও তাদের পৃষ্টপোষক সৌদি দালাল জামাত বাহিনীর বিরুদ্ধে।

অভিজিতের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই ইসলামী ফ্যাসিস্টরা খুন করে ওয়াশিকুর রহমান 'বাবু' নামক তরুণ ব্লগারকে।  তাঁর পর অনন্ত বিজয় দাস এবং সর্বশেষ সংযোজন হল নীলয় নীল।  এক একটি হত্যা একদিকে যেমন প্রগতিশীল চেতনা সম্পন্ন মানুষকে আঘাত করছে, তাঁদের মধ্যে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে তেমনি উল্টোদিকে এই সন্ত্রাস ইসলামী মৌলবাদীদের আরও বলিষ্ট করে তুলছে। তারা খোলাখুলি ফেসবুকের মতন সামাজিক মাধ্যমগুলিতে উল্লাস প্রকাশ করছে এবং নাস্তিক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক চেতনাসম্পন্ন মানুষদের হুমকি দিচ্ছে।  এত সব দেখেও বাংলাদেশের সরকার হাতে হাত দিয়ে বসে আছে, তারা হত্যাকারীদের ওকালতি করছে এই বলে যে মানুষের "ধর্মীয় অনুভূতিতে" আঘাত করা অনুচিত।  কিন্তু মানুষ খুন করা যে অনুচিত সে কথা সরকার বা মোল্লাতন্ত্র কারুর বিবৃতিতে শোনা গেলনা  না।


বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জামাত এ ইসলামী ভারতবর্ষের আরএসএস - বজরং দল ও বিজেপির মতন ফ্যাসিস্ট ধর্মীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়। এদের মুক্তহস্তে দান ধ্যান করে সাহায্য করছে সৌদি আরব সহ আরব দুনিয়ার চরম প্রতিক্রিয়াশীল রাজতান্ত্রিক মৌলবাদী শক্তিগুলি, যারা মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে আরব দুনিয়ায় বৈশ্যাবৃত্তি করে একদিকে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রেখেছে, আরবের জনগণের প্রগতিশীল - গণতান্ত্রিক দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলিকে দমন করছে মার্কিণ সাহায্যে বলিয়ান হয়ে, আর ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেদের ওয়াহাবী - সালাফি প্রভাব পৃথিবীর কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দিচ্ছে মুঠো মুঠো অর্থ (পেট্রো ডলার) খরচা করে। সৌদি আরবের হাতে ইসলামের রাশ তুলে দিয়ে মার্কিণ একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি ও তার তল্পিবাহকরা পৃথিবীতে দাঙ্গা - হাঙ্গামা - সন্ত্রাসবাদের আগুন জ্বালিয়ে নিজেদের শাসন - শোষণ ও লুণ্ঠনের ব্যবস্থাকে পাকা পোক্ত করছে।  তাই তারা সৃষ্টি করলো এক সময় আল কায়েদা গোষ্ঠিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়াকে সরিয়ে নিজেদের দাপট প্রতিষ্ঠা করতে।  পরবর্তীতে সেই আল কায়েদা ও তার বিভিন্ন উপদলগুলি মার্কিণ একচেটিয়া পুঁজিকে সাহায্য করলো আফগানিস্তান ও ইরাক দখলের যুদ্ধের জমি প্রস্তুত করিয়ে।  

এই ভাবেই সৃষ্ট হল ইসলামিক স্টেট নামক উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী শক্তির।  যার অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত হল একদা মার্কিণ বন্দী পরবর্তীতে মার্কিণ গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এর চর - 'আল বাগদাদী' নামক এক দালাল।  এদের মার্কিণ - সৌদি জোট সৃষ্টি করলো সিরিয়া থেকে আসাদের নেতৃত্বাধীন বাথ সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উচ্ছেদ করে নিজেদের পেটোয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করতে এবং বিপুল অর্থ, অস্ত্র শস্ত্র ও নিজেদের দালাল প্রচার মাধ্যমগুলি দ্বারা এদের প্রচার চালালো - 'সিরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী' বলে। কিন্তু সিরিয়ার বিশাল অংশে কোত্কা খেয়ে এই 'স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নিজেদের স্বরূপ ধারণ করে  করলো ইরাক জুড়ে তান্ডব। এদের বারবৃদ্ধির পিছনে মার্কিণ ও সৌদি আরবের ইরানের পিছনে কাঠি করার তাগিদ ছিল বেশি।  তাই তো আজও দেখা যাচ্ছে যে মার্কিণ - সৌদি জোট শুধু মাত্র মুখেই আই এস এর সন্ত্রাসের বিরোধিতা করছে এবং একমাত্র কুর্দিশ বাহিনী ওয়াই পি জি, সিরিয়ার জাতীয় সেনা, ইরানের মদতপুষ্ট মিলিশিয়া বাহিনী আই এস এর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।  

আজ বাংলাদেশের আরবিকরণের প্রচেষ্টায় রত সৌদি আরবের পোষা দালাল হাসিনা - খালেদা জুটি। এই উপমহাদেশের মুসলমান সম্প্রদায় যতদিন অবধি ওয়াহাবী - সালাফি মার্কা ইসলামের পাল্লায় পড়েননি ততদিন মুসলমানদের মধ্যে ফার্সি - উর্দু প্রভাবটা তীব্র ছিল, যা একদিক থেকে ছিল আজকের ইসলামের চেয়ে ঢের বেশি উদার, মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই বহু বিদ্বান - প্রগতিশীল মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বেড়িয়ে এসেছেন, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, শিল্পে, রাজনীতিতে  যারা বিরাট অবদান রেখেছিলেন।  কিন্তু ৬০-৭০ এর দশকের তীব্র বামপন্থী আন্দোলনের বৃদ্ধির ফলে আতঙ্কিত মার্কিণ তল্পিবাহক শিবির টেনে আনে তাদের দালাল সৌদি রাজতন্ত্র কে নিজেদের রক্ষা স্বার্থে। যদিও প্রায় দু শতাব্দী ধরে ওয়াহাবী সংস্কৃতি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে, কিন্তু তার তীব্রতা বাড়ে বাংলাদেশ গঠন থেকে শুরু করে আফগান যুদ্ধের সময় থেকে।  

ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ও ভারতের মুসলমানদের আরবিকরণ চলতে থাকে, মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়তে থাকে, গরিব নিরীহ মুসলমানদের সেখানে মগজ ধোলাই করে ১৪০০ বছর পুরানো ধর্মীয় চোলাই খাইয়ে মৌলবাদের সমর্থনে এক বিশাল ধর্মীয় মাতাল শ্রেণী গড়ে তোলার কাজ চলতে থাকে।  বাংলাদেশে যখন বেড়ে চলে জামাত - রাজাকার - মৌলবাদী ফ্যাসিস্টদের শক্তি, তখনই ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিন প্রান্তে হিন্দু ফ্যাসিবাদ শক্তিবৃদ্ধি শুরু করে সেই একই মালিকের প্রশ্রয়ে। এই আরবিকরণের ফলে ধীরে ধীরে একটি বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতি বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতিকে খুবই বিপদজনক ভাবে প্রভাবিত করতে থাকে।  ইংরেজদের শাসনকালেও বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি ও ভাষার এই রূপ ক্ষতি হয়নি যতটা ৩৫ বছরের আরবিকরণের মাধ্যমে আজ হয়েছে।  বাঙালির খোদা হয় গেল আরবীয় আল্লা, মানুষ তাই আর খোদা হাফিজ না বলে বলতে থাকে 'আল্লা হাফিজ', আর নামাজ হলো গিয়ে সালাত। ঘোমটা দিয়ে হিজাব করা বাঙালি মুসলমানের মেয়েরা হঠাত পড়তে শুরু করল আরবীয় বোরখা আর বাঙালি মুসলমান পুরুষদের মধ্যে হঠাত সুন্নত পালন করার ধুম পরে গেল।   

বাঙালি মুসলমানের এই পরিণতির মূল দায় অবশ্যই অর্থনীতির, যা যে কোনও সমাজের মূল ভিত্তি। এক বিকাশহীন পিছিয়ে পড়া আধা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের জীবনযাপন করা দিন দিন দু:সাধ্য করে তোলে, এবং এর ফলে অসংখ্য মানুষকে রুটি রুজির খোঁজে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়।  এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের অসংখ্য মুসলমান মানুষ কাজের খোঁজে পাড়ি দেয় সৌদি আরব সহ মধ্য পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে সস্তায় শ্রম বিক্রি করতে।  এই সব দেশেই এই গরিব মানুষগুলিকে তাঁদের উপর চলতে থাকা শোষণ অত্যাচারের থেকে নজর ঘোরাতে শাসক শ্রেণী শরণ নেয় ধর্মের, এবং ধর্মীয় আচার আচরণ শেখাবার নামে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের এরা নিজ সংস্কৃতি ত্যাগ করে 'বিশুদ্ধ' আরবীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে শেখায় ইসলামের নিয়ম হিসাবে।  উদার বাঙালি মুসলমানকে পরিণত করে কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদীতে।  

তাই আজ দেখা যায় ভারতের পশ্চিম বাংলায়, আর বাংলাদেশের জেলায় জেলায় মাদ্রাসা শিক্ষার নামে বাঙালি শিশুদের দেওয়া হচ্ছে আরবিতে তালিম।  এই আরবি শিক্ষা এই গরিব মানুষের সন্তানদের কর্মসংস্থানে বা ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনও সাহায্য করবে না। যেমন বিজেপি - আরএসএস কতৃক ভারতীয়দের সংস্কৃত শিক্ষার জিগির তোলা হয়, তেমনি জামাতিদের প্রশ্রয়ে বেড়ে চলে আরবি শেখার চল।  এর ফলে ধীরে ধীরে বাঙালি মুসলমান তাঁর নিজের সংস্কৃতি ও বৈশিষ্টগুলি আরবীয় সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের কাছে বিসর্জন দিয়ে আরবের জনজাতিগুলির একজন হিসেবে নিজেকে গণ্য করতে থাকে। বাংলাদেশের আওয়ামী লিগ বা জাতীয় পার্টি এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত।  এদের যৌথ মদতেই ভারত ও বাংলাদেশে মার্কিণ পুঁজির এক চেটিয়া শোষণ শাসনের ধারা বজায় রাখতে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তিগুলি আজ পথে নেমেছে।  

বাংলাদেশের যুক্তিবাদী নাস্তিকদের আন্দোলন একটি মধ্যবিত্ত সুলভ আন্দোলন যা সমাজের আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিচার না করেই ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চায়।  তাঁরা এইটা বিশ্বাস করে না যে ধর্ম সহ সমাজের সমস্ত উপরি কাঠামো আসলে অর্থনীতির ভিতের উপর দাঁড়িয়ে।  যতদিন অর্থনৈতিক ভিত বদলাবে না তত দিন মানুষের মন থেকে পুরানো চিন্তা, কু সংস্কার কে শেষ করা যাবে না।  তাই তাঁদের আন্দোলন সমাজ বদলাবার সংগ্রামের থেকে বিছিন্ন হয়ে রয়েছে।  তবুও তাঁরা একটি প্রগতিশীল শক্তি, যাদের আজ বেশি করে সমাজের মূলটা বদলাবার সংগ্রামের সাথে নিজেদের যুক্ত করতে হবে।  

কি ভাবে লড়াই করা যাবে মৌলবাদের সাথে ? কি ভাবে পরাস্ত করা যাবে ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলিকে? আমরা দেখেছি যে ভারত - পাকিস্তান - বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি মৌলবাদী ফ্যাসিস্টদের আক্রমণের বিরোধিতা করে মোমবাতি হাতে রাস্তায় মিছিল করেন, ফেসবুক - টুইটার প্রভৃতিতে লিখে লিখে বন্যা বইয়ে দেন।  কিন্তু এই সব করে কি কোনও ভাবে ফ্যাসিবাদ কে রোখা যায় ? না, যায় না।  

ফ্যাসিবাদীরা এটা জেনে আরও বেপরোয়া হয়ে যায় যে সরকার যেমন তাদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না, তেমনি প্রতিবাদী প্রগতিশীল শক্তিগুলি শুধুমাত্র গান্ধীবাদী আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের প্রতিবাদ সীমিত রেখে তাদের খোলা মাঠে গোল মারার সুযোগ করে দেবে।  তাই তারা বুক ফুলিয়ে একের পর এক খুন করে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অকথ্য অত্যাচার করে, এবং মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে।  

গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলির প্রয়োজন আজ তীব্র গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলা ফ্যাসিবাদী মৌলবাদের বিরুদ্ধে।  এই প্রতিরোধ শুধু মাত্র খেটে খাওয়া মানুষদের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে, এবং রাজনৈতিক ভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে এই লড়াইয়ে সামিল করিয়েই একমাত্র সম্ভব ফ্যাসিবাদ কে সন্ত্রাসিত করা।  বাংলাদেশের যেখানেই ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা হানা দেওয়ার কথা ভাববে সেখানেই তাদের সামনে শ্রমিক - কৃষক - মেহনতি মানুষের জঙ্গি প্রতিরোধ দেখা দেবে, ইঁটের বদলে পাটকেল খাওয়ার ভয়ে ফ্যাসিস্টদের নিজেদের গুটিয়ে নিতে হবে, কারণ জন প্রতিরোধ কে কি করে ভাঙ্গতে হয় তা ফ্যাসিস্টদের মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব স্থিত বাবারাও জানে না।  

বাংলাদেশের সরকারের কাছে বিচার ভিক্ষা করা এক অপরাধ। কারণ, খুনির কাছে কখনো খুনের ন্যায় বিচার চাইতে নেই।  তাই আমাদের বাংলাদেশী বন্ধুরা, যারা আজ বিজ্ঞান, যুক্তি,  প্রগতির কথা বলছেন তাঁদের আজ ঠিক করতে হবে যে তাঁরা কি শুধুই কথায় বাঘ মারার সংস্কারী চিন্তাভাবনা নিয়ে মৌলবাদী ফ্যাসিস্টদের সাথে ফেসবুকে তর্ক - গালাগাল করে জীবন কাটাবেন, না কি কঠিন বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ করে সমস্যার মূলটা নিকেশ করার দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে অংশ নেবেন। সমাজের আমূল রূপান্তরণ না হলে সমস্ত মৌলিক সমস্যাগুলির মতন ধর্মীয় মৌলবাদ ও ফ্যাসিবাদের সমস্যার সমাধান হবে না।  এই সত্যটি আজ বিশেষ করে উপলব্ধি করতে হবে বাংলাদেশের নবীন প্রগতিশীল সমাজ কে।  তাঁদের মনে রাখতে হবে যে তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের ভবিষ্যত।  তাঁরা যদি গাফিলতি করেন তাহলে ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না।     

                

আব্দুল কলাম কে এবং কেন তাকে নিয়ে এত কান্নাকাটি

সোমবার, আগস্ট ০৩, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি যে আবদুল কালাম এর মৃত্যুর পর থেকেই তাকে মহাপুরুষ বানিয়ে কর্পোরেট মিডিয়াগুলির দ্বারা ক্রমাগত প্রচার  চালানো হচ্ছে যে সে ছিলো দেশের এক মূল্যবান বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সততার প্রতীক ইত্যাদী।  তাকে মোটমুটি ভারতের আইনস্টাইন বানানোর প্রক্রিয়া চলছে,  গভীরে গেলে দেখা যাবে যে এই প্রক্রিয়া মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের "মেক ইন ইন্ডিয়া" নীতিরই গূঢ় প্রচার। কারণ ভারতের শাসক শ্রেণী যেনতেন ভাবে এটা দেখাতে বদ্ধপরিকর হয়েছে যে ভারত বৈজ্ঞানিক গবেষনায় অনেক আগে অগ্রসর হয়েছে, এবং সম্পুর্ন ভাবে স্বনির্ভরতায় ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে উঠেছে। 

একথা সুবিদিত যে ভারত আজ অবধি নিজ মেধা ও সম্পদ কাজে লাগিয়ে কোনও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করতে পারে না। কারণ আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সকল ধরনের অস্ত্রশস্ত্র বিদেশী পুঁজির লগ্নি ও প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। ভারতের মেধা কে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি দীর্ঘ সময় ধরে ক্রয় করে নিজের স্বার্থপূরণের ক্রীতদাস বানিয়ে রাখে।  এই পরিস্থিতিতে কোনও ভাবেই সরকারী চাকুরে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার এর পক্ষে স্বাধীন নীতি প্রয়োগ করে  দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষেপণাস্ত্র বানানো সম্ভব নয়।  কারণ ভারতের শিল্প বিকাশ সেই স্তরে বিকশিত হয়নি যে আমাদের দেশের প্রযুক্তি ও কাঁচামাল ব্যবহার করে আমরা স্বাধীন বিকাশের পথে যেতে পারি। 

আবদুল কালামের কোনো গবেষণার ভিত্তিতে ডক্টরেট খেতাব জোটেনি, দেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞান শিক্ষা সংস্থা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স তাকে মেধার কারণে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে এবং শেষ পর্যন্ত বিজেপির দাক্ষিণ্য পেয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অনেক পরে ব্রিটিশদের এক বিশ্ব বিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট উপাধি সাম্মানিক ভাবে দান করে।  তবুও এই সততার প্রতীক রাষ্ট্রপতি হওয়ার অনেক আগে থেকেই নামের আগে ডক্টর উপাধি ব্যবহার করার থেকে ক্ষান্ত হয়নি। এই দেশের কর্পোরেট মিডিয়াগুলি এই ব্যাপারে কোনদিন কোনো প্রশ্ন তোলেনি,  তার কারণ এতে অনেক বেড়ালের ঝুলি থেকে বেড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো।

প্রথমত, কালামকে বলা হয় একজন ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানী ও পরমাণু পদার্থবিদ।  ঐ দুটোই মিথ্যা. তার কারণ কালাম ছিলো একজন এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার এবং পরমাণু পদার্থবিদ্যায় তার কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলো না। ক্ষেপনাস্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে সে একজন টেক্নোক্র্যট ছিল এবং কালাম ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গনাইজেশন বা ডিআরডিও এর শীর্ষ কর্তার পদে সরকারি চাকুরে হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলো।  সেই পদে থাকাকালীন স্বাভাবিক ভাবেই সে প্রতিরক্ষা গবেষণার উপর তদারকী করে এবং সব জায়গায় রাজনৈতিক লিংক কাজে লাগিয়ে কৃতিত্ব হাসিল করে।

কালামের সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা মনে করেন কালামের কৃতিত্ব ছিল যে কোনও সাদামাটা কাজকে তেরঙ্গায় মুড়ে দেশের শাসক কূলের কাছে এমন ভাবে পরিবেশন করা যেন তা আহামরি কিছু।  তার কাজ নিয়ে সমালোচনা করেছেন অনেক সরকারী বিজ্ঞানী যেমন ডিআরডিও'র ক শান্তানাম, ভাবা পরমাণু গবেষনা কেন্দ্রের পি কে আইয়াঙ্গার, পরমাণু শক্তি কমিশনের এইচ এন সেঠনা, প্রমুখরা কালামের কৃতিত্ব নিয়ে বারেবারে প্রশ্ন তুলেছেন কিন্তু সরকারী প্রশ্রয় ও শাসকের প্রীতির ছায়ায় বাস করা কালামের কৃতিত্ব রক্ষা করেছে কংগ্রেস - বিজেপি ও কর্পোরেট মিডিয়া, যারা তার মৃত্যুর পরেই তাকে মহর্ষি বানাতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে।

কালামের মতন একজন "জি হুজুর" রাষ্ট্রপতি দরকার ছিল বিজেপির, কারণ তার পূর্বসুরী কে আর নারায়নন  বারেবারে অটল বিহারীর বিজেপি সরকারকে নিজের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে বিধেছিলেন, বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির প্রশ্রয়ে যখন আরএসএস - বজরং দলের নেতৃত্বে গুজরাট জুড়ে ২০০২ এ মুসলমান হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় তখন কিন্তু নারায়নন রায়সিনা হিলস থেকে প্রতিবাদ করেছিলেন, যা বাজপায়ী ও আডবানীর আঁতে ঘা দেয়।  তাই তারা সাত তাড়াতাড়ি কালামকে উঠিয়ে আনে রাষ্ট্রপতি পদে এবং তার সমর্থনে ও প্রশংসায় কর্পোরেট মিডিয়াগুলিকে দিয়ে কালামের স্তুতি গাইয়ে সারা দেশে তার এক উজ্জ্বল ও সৎ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করে।

বিজেপির মতন কংগ্রেসও কালামের পক্ষে স্তুতি গায় কারণ কালামের চরিত্র ছিল ক্ষমতাশালীদের সাথে দ্বন্ধে না গিয়ে, তাদের অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ না করে, শুধু তাদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের কথা মাফিক কাজ করা।  রাজনৈতিক অভিলাষ তার ছিলই এবং একবার রাষ্ট্রপতি পদে থাকার পরেও সে পুনরায় আবার রাষ্ট্রপতি হতে রাজি হয় জেতার গ্যারান্টির বিনিময়ে।  সেই যাত্রায় অবশ্য তার ভাগ্য শিকেয় ছেঁড়েনি।

যাই হোক, আজ এই দেশে কালামকে নিয়ে এত মাতামাতি ও তার মিথ্যা স্তুতি ও বন্দনার পিছনে একটাই কারণ তা হল এই দেশে শাসক শ্রেনীর শিবিরে পরিচ্ছন ভাবমূর্তির নেতার খুবই অভাব, তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত আজ কালামকে সামনে রেখে দেশের যুবদের সামনে একটি আদর্শ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে শাসক শ্রেণী।  সেই আদর্শ পুরুষ যে ভিতর থেকে ঠুটো,  যার সাহস ছিলনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, যে শুধু মাত্র শাসকশ্রেনীর ভজনা করে নিজ নাম - যশ -প্রতিষ্ঠা আদায়ের প্রচেষ্টায় সারা জীবন লিপ্ত ছিল।  এই আদর্শেই আজ বিজেপি-আরএসএস এবং তাদের প্রভু বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ভারতের যুব সমাজকে গড়ে তুলতে চায়।  তাইতো দেখি এত অতি মাত্রায় কালাম ভজনা।         


        

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে