ভারতের অর্থনৈতিক সর্বনাশের ও লুঠের কান্ডারী মোদী সরকার

রবিবার, জুন ০৩, ২০১৮ 0 Comments A+ a-

 


বলা হচ্ছে উন্নয়ন থুড়ি “ভিকাস” নাকি শুধু দাঁড়িয়েই নেই বরং এমন দ্রুত গতিতে দৌড়োচ্ছে যে ধরার জো নেই, আর ধরার জো নেই বলেই যা কেষ্ট বা মুকুলে দেখতে পায় তা সাধারণ মানুষে দেখতে পায়না। বলা হচ্ছে যে সমালোচনা বন্ধ করুন কারণ নরেন্দ্র মোদীর কোন বিকল্প নেই আর হিন্দু রাষ্ট্র আজ ব্রাক্ষণ জাতির চাই চাই, ফলে আজ আবার আপনি গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা বা গরিবের স্বার্থের কথা বলে শিবাজী রাজার ₹৩,০০০ কোটি টাকার মূর্তি বা চীন থেকে আমদানি করা বল্লভভাই প্যাটেলের কয়েক হাজার কোটি টাকার মূর্তির মধ্যে থেকে দৃশ্যমান হওয়া উন্নয়নের রথযাত্রা কে ভঙ্গ করতে পারবেন না। বলা হচ্ছে আপনি দুর্বল কারণ জোটবদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের কোঁচড় ধরে না ঝুলে আজ আপনি বিজেপির রথ কে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার থেকে রুখতে পারবেন না। বলা হচ্ছে চুপ করুন কারণ উন্নয়ন আপনার কথায় বিরক্ত হচ্ছে। 

এই যে তুতিকোরিন শহরে যে ১৩ জন মানুষ বেদান্ত কোম্পানির লোভ ও লালসা চরিতার্থ করার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গুলি খেয়ে শহীদ হলেন, বা এই যে অলীক চক্রবর্তী বা ভাঙ্গরের গণআন্দোলনের অন্যান্য কর্মী সমর্থকদের মুক্তির দাবিতে পথে নেমে যাঁরা আজ আরাবুলের মতন গুন্ডাদের সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন, এই যে কৃষকেরা গ্রামে গ্রামে বিজেপির কর্পোরেট স্বার্থ-রক্ষাকারী চরিত্রের বিরুদ্ধে ও কৃষক-বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে আজ গর্জে উঠেছেন, এই যে কৃষকেরা মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে বিজেপির ঘৃণ্য নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, এই যে জাট সম্প্রদায়ের কৃষকেরা আখের দাম না পেয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে কেরানা উপনির্বাচনে গর্জে উঠলেন, এই যে দিকে দিকে ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বৃহৎ সংগ্রাম গড়ে উঠছে, এই যে দিকে দিকে মানুষের মধ্যে তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে এত অসন্তোষের জন্ম নিচ্ছে, এই সব কিছু কে মোদীর উন্নয়নের ধারা রুখে দিতে পারবে তো?

সহি নিয়ত - মানে হলো সঠিক ইচ্ছা, বা সঙ্কল্প। তো এই সঠিক সঙ্কল্প নিয়ে উন্নয়ন (ভিকাস) করার যে বিজ্ঞাপন আজ বিজেপি সরকার নরেন্দ্র মোদী কে শিখন্ডি করে জনগণের ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে সংবাদপত্র থেকে শুরু করে টিভি বা ইন্টারনেটে দিচ্ছে, সেই উন্নয়ন কে অনুব্রতের উন্নয়নের ন্যায় দেখতে পাওয়া যাবে তো? কেষ্ট বাবুর উন্নয়নের মতন এই উন্নয়নের বা ভিকাসের হাতেও ব্যাটাম রয়েছে নাকি? এই সকল উত্তর জানার জন্যে আপনাকে দেখতে হবে ভারতবর্ষের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতির দিকে, যার মধ্যে দিয়ে আপনি দেখতে পাবেন যে কি চরম সঙ্কটে আজ ভারতেবর্ষ ডুবে আছে। “ভিকাস” যে আসলে একটি সঙ্কটের নাম, তা আপনি বুঝতে পারবেন।  

গত আর্থিক বছরে, অর্থাৎ ২০১৭-১৮ সালে ভারতের মোট গ্রাহস্থ্য উৎপাদ ৬.৭৪ শতাংশে নেমে এসেছিল, যা নরেন্দ্র মোদী সরকার গঠনের পরবর্তী সময়কালের সবচেয়ে নিম্ন বৃদ্ধির হার। যদিও স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদেরা এই সঙ্কটের কারণ হিসেবে ২০১৬ সালের ₹৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট বাতিল করা ও জিএসটি প্রচলন করা কে চিহ্নিত করেছেন, মোদী সরকারের পেয়াদা অর্থনীতিবিদেরা তা মানতে অস্বীকার করেন। দেশীয় অর্থনীতি কে চালনা করার ক্ষেত্রে মোদী সরকারের কাজ হচ্ছে নিজের কাল্পনিক উন্নয়নের কাহিনী প্রকাশ করে জনগণ কে বোকা বানানো এবং সরকারি ব্যাঙ্কের অর্থ দিয়ে, বিভিন্ন ধরণের কর ছাড় দিয়ে ও নানা ধরণের সুযোগ সুবিধা দিয়ে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে, দেশি মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে প্রচুর পরিমাণের মুনাফা আয় করার পথ করে দেওয়া।

মোদী সরকারের বিগত চার বছরের কার্যকলাপে যদি সত্যিই কারুর লাভ হয়ে থাকে তাহলে তা হয়েছে আম্বানি, আদানি থেকে শুরু করে রামদেবের পতঞ্জলির। দেশের এক শতাংশ মানুষের কাছে আজ ভারতের ৭৫ শতাংশ অর্থ কুক্ষিত রয়েছে আর অন্যদিকে দেশের ছয়টি রাজ্যে আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলের থেকে বেশি ক্ষুদার্থ মানুষ বাস করেন। ভারতের ৬০ শতাংশ মানুষের মাথাপিছু গড় যায় দিনে $১.০০ এর চেয়ে কম এবং অপুষ্টিতে ভারতের অধিকাংশ ০ থেকে ৫ বৎসর বয়সের শিশুরা ভুগছে। ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করলেও বছরের পর বছর কৃষির জাতীয় মোট গ্রাহস্থ্য উৎপাদে অবদান কমে যাচ্ছে এবং ১০ শতাংশের নিচে মানুষ কে কর্মসংস্থান দেওয়া পরিষেবা ক্ষেত্রের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশের উপর রয়েছে, যার সিংহভাগ আসে তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের থেকে, যা জাতীয় স্বার্থে কোন সম্পদ সৃষ্টি করে না, বরং বিদেশী পুঁজির স্বার্থ রক্ষায় শ্রম ব্যয় করে। 
নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনের ইস্তাহারে জনগণ কে কথা দিয়েছিলেন যে তেলের দামের ভয়ানক কামড় থেকে তিনি জনগণ কে রক্ষা করবেন, রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে তো নয়ই, নিজের শহরে এবং গ্রামে মানুষ কিন্তু আজ তেলের ভয়ানক মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভীষণ ভাবে জর্জরিত। হিন্দু আজ সত্যিই বিপদে পড়েছে, হিন্দু সত্যিই “ক্ষত্রে মেইন হ্যায়” কারণ মোদী সরকারের তেল নিয়ে দিশাহীনতার কারণে আজ দেশের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় ভীষণ সঙ্কটে পড়েছেন। এর উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা মারার মতন ₹৯ করে ভর্তুকি-প্রাপ্ত সিলিন্ডারে এবং ₹৪২ করে ভর্তুকিহীন রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের চরম আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এবং দেশের বেশির ভাগ জনগণ সেই লোকটিকে আজ পুরস্কৃত করতে চান যিনি “হিন্দু ক্ষত্রে মেইন হ্যায়” স্লোগান প্রথম তুলেছিলেন। 

অবশ্যই বড় বড় মাড়োয়ারি-গুজরাটি বেনিয়াদের, বড় অফিসে কাজ করা, গাড়ি চাপা সাহেব ও মেমসাহেবদের, সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটিদের, ফ্লপ বাজারি সিনেমার পরিচালক ও প্রাক্তন গায়ক ও কমেডিয়ানদের এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে কোন কষ্ট হবে না। তাঁরা বলবেন, বা বলা চলে কটাক্ষ করবেন, যে আপনার যদি তেল কেনার পয়সা না থাকে তাহলে গাড়ি বা স্কুটার-মোটরসাইকেল চড়বেন না, আপনার যদি গ্যাস কেনার সাধ্য না থাকে তাহলে আপনি বাড়িতে গ্যাসে রান্না করবেন না (কেরোসিন কিন্তু বন্ধ) আর আপনার যদি মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেশি অসুবিধা হযে থাকে তাহলে আপনি পাকিস্তান চলে যান। 

অথচ যেই প্রশ্ন উঠবে যে কৃষকেরা যে ট্রাক্টর চালাবার জন্যে তেল কিনতে অপারগ হচ্ছেন বা ফসল ও সবজি গ্রাম থেকে বাজারে বা থোক বাজার থেকে খুচরা বাজারে আনতে গাড়ি ভাড়া বেশি গুনতে হচ্ছে, তেমনি মোদী ভক্ত হনুমানের দল খা খা করে তেড়ে এসে বলবে যে কৃষকেরা দেশের বোঝা কারণ তাঁরা নাকি কর দেননা এবং দেশের সকল সুবিধা ভোগ করেন যা শুধু মাত্র বড় গাড়ি ঘোড়া চড়া, বাংলো বা ফ্ল্যাটবাড়িতে বাস করা সাহেব ও মেমসাহেবদের একচেটিয়া অধিকার হওয়া উচিত।

ফিরে আসি অর্থনীতির সমীক্ষায়। দেখতে পারবো বছরের পর বছর শুধু মাত্র পরিসংখ্যান আর পরিমাপের কারচুপি করে বিজেপি দেখাতে চাইছে যে মোদী সরকারের আমলে জনগণের এত কল্যাণ হয়েছে যা নাকি বিগত ছয় দশকে হয়নি। যেমন ধরুন জনধন যোজনায় জনগণের জন্যে ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলার দাবি। যদি আপনি একটু গভীরে ঢুকে দেখেন, তাহলে দেখবেন যে প্রায় ৩০ কোটির উপর যে ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলানো হয়েছিল এই যোজনায়, তার প্রায় ৩৩ শতাংশ বা ১০ কোটি একাউন্ট এ আজ অবধি কোন লেনদেন হয়নি। নোট বাতিল অবধি, অর্থাৎ ৯ই নভেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত, এই বাকি ২০ কোটি একাউন্টগুলিতে মোট ₹৪৫,৬৩৬ কোটি জমা ছিল এবং ২৮শে ডিসেম্বর ২০১৬ তে, নোট পরিবর্তনের সময়কালে এই একাউন্টগুলির মোট পরিমাণ হয় ₹৭১,০৩৬ কোটি। আয়কর বিভাগ ঘোষণা করেছিল যে তারা নাকি অনেক এমন একাউন্ট ফ্রিজ করে দিয়েছে যেগুলিতে অসামান্য পরিমানের লেনদেন হয়েছে। তবুও প্রায় ₹৪,৪৩০ কোটি টাকা এই একাউন্টগুলির থেকে বের হয়ে গেছে যা এক বৃহৎ অঙ্ক। 

এই একাউন্টগুলি নিয়ে প্রতিটি ব্যাঙ্ক এখন চিন্তিত এবং প্রায় সমস্ত ব্যাঙ্কগুলি এই জনধন যোজনার একাউন্ট খোলা এখন বন্ধ করে দিয়েছে কারণ নানা বিধিনিষেধ সম্বলিত এই একাউন্টগুলির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মতে এই একাউন্টগুলির রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রতি বছর প্রায় ₹৭৭৪.৮৬ কোটি। এর ফলে আজ আর গরিব মানুষের ব্যাঙ্ক একাউন্ট হচ্ছে না বরং যাদের হয়েছে তাঁদের একাউন্ট এর উপর এত বিধি নিষেধ চাপানো হয়েছে যে তাঁদের পক্ষে এই একাউন্ট এ টাকা রাখা অসাধ্যকর হয়ে উঠেছে। ফলে আখেরে এই ব্যাঙ্ক একাউন্ট করে লাভ কার হলো? কারা এই ব্যাঙ্ক একাউন্ট এ জমা টাকার ফলে সুবিধা লাভ করলো?

সরকারি সমস্ত ব্যাঙ্ক থেকে প্রচুর পরিমাণের ঋণ নিয়ে আজ বসে আছে বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা আর বৃহৎ ফাটকাবাজরা। ভারতের জনগণের টাকায় চলা সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে লগ্নি করা হচ্ছে শেয়ার বাজারে, বড় রিয়েল এস্টেট প্রকল্পে বা বিদেশে ব্যবসা বৃদ্ধির কাজে। বিজয় মালিয়া থেকে নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ নীরব মোদী ও মেহুল চোকসি হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ ফেরত না দিয়ে খুব সহজেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এবং আজ আমাদের কর্পোরেট-মালিকানাধীন মূলধারার সংবাদ মাধ্যম এদের ফিরিয়ে এনে, এদের সম্পত্তি বিক্রি করে জনগণের টাকা ফেরত আনার কথা বলে না, বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা ফেরত আনার মোদীর প্রতিশ্রুতির কথা তো ভুলেই যান। যারা পালিয়েছে টাকা নিয়ে তারাই শুধু যে লাভ করেছে তাই নয়। ২০১৬ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট অনুসারে ২০১৫ সালে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি একত্রে প্রায় ₹১৩০,০০০ কোটির বকেয়া ঋণ কে “ব্যাড লোন” বা অপুনরুদ্ধারযোগ্য ঋণ হিসেবে গণ্য করে নিজ খাতা থেকে মুছে ফেলেছে। জনধন যোজনার মাধ্যমে মোদী শুধু চেষ্টা করেছে ব্যাঙ্ক এর খাতায় বেশি করে টাকা ঢুকিয়ে এই লোকসানের বহর কে কৃত্রিম ভাবে কম করতে। 

অরুণ জেটলি বাবু পৃথিবীর সেই অল্প কয়েকজন দিগ্গজদের মধ্যে একজন, যাঁরা পেশায় উকিল হয়েও ভালো অর্থনীতিবিদ সাজার প্রচেষ্টা করে। যেমন উনার আগে একসময়ে বেদান্তের চাকুরে পি চিদাম্বরম করতেন। সেই অরুণ জেটলি বারবার সরকারি ব্যাঙ্কগুলি কে মূলধনের যোগান দিয়ে (recapitalisation) চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন যাতে  বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের সরকারি ব্যাঙ্কের থেকে পুনঃ ঋণ পেতে কোন অসুবিধা না হয় এবং বেশি বেশি অর্থ “ব্যাড লোন” বা অপুনরুদ্ধারযোগ্য ঋণের খাতে দেখানো যায়। অপুনরুদ্ধারযোগ্য ঋণের খাতে কোন বৃহৎ পুঁজিপতির ঋণ চলে যেতেই সেই ঋণ মাফ হয়ে যায় এবং সেই পুঁজিপতি সেই টাকা সোজা বাংলায় পুরোপুরি মেরে দেয়। 

জেটলি বাবুর কীর্তি এই করেই থামেনি, বরং “bail in” বা ব্যাঙ্কের অপুনরুদ্ধারযোগ্য ঋণের বোঝা কম করতে সাধারণ গ্রাহকদের জমানো খাতায় ব্যাঙ্ক কতৃপক্ষ কে থাবা মারার সুযোগ করে দিয়ে আম্বানি-আদানি বা বেদান্তের আগারওয়ালদের লুটের খেসারত সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপিয়েছেন। এই ভাবে সাধারণ মানুষের ক্ষতি যখন করা হচ্ছিল তখনই মুসলিম বিদ্বেষ তীব্র ভাবে ছড়ানো হচ্ছিল, সংবাদ মাধ্যম জুড়ে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের নানা নেতার নানা সাম্প্রদায়িক বয়ানবাজি চলছিল, আর চলছিল দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কুৎসা করা। কায়দা করে এই হাঙ্গামার মধ্যে দিয়ে মোদী সরকার জনগণ কে শূলে চড়ানোর বন্দোবস্ত করে রাখলো আর সংবাদ মাধ্যমও জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিল। ফলে সাপও মরলো আর মোদীর লাঠিও ভাঙলো না।  

ফসল বীমার থেকে স্বাস্থ্য বীমার নানা যোজনা প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে বিপুল ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাজারে ছাড়া হলো, অথচ এই সকল বীমা প্রকল্পেই কিন্তু বীমা কোম্পানিগুলিকে প্রচুর মুনাফা আয় করার রাস্তা করে দেওয়া হলো আর জনগণের জন্যে হাতে রইলো শুধু পেন্সিল। বিপুল অর্থের টাকা সরকারি কোষাগার থেকে জনস্বাস্থ্য বীমার জন্যে খরচ করা হচ্ছে আর আবার জনতার থেকেও সেই বীমার জন্যে টাকা নেওয়া হচ্ছে আর এই সকল অর্থ জমা পড়বে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোমে, যাদের মালিকানা আবার অনেক ক্ষেত্রেই সেই বীমা কোম্পানিগুলির মালিক গোষ্ঠীর হাতেই রয়েছে। 

মোদী কেয়ার নামক যে স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প অরুণ জেটলি কংগ্রেস আমলের স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পকে নতুন ভাবে সাজিয়ে পেশ করেছেন, তাতে ৫০ কোটি মানুষ কে স্বাস্থ্য বীমার অধীনে আনা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার পরেই কিন্তু স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানিগুলির শেয়ারের দাম হুহু করে বেড়ে যায়। প্রতি বছর  মাথা পিছু প্রায় ₹২২০ করে খরচ করে যে বৃহৎ বীমা প্রকল্প সরকার জনগণের করের টাকা দিয়ে গড়ে তুলতে চাইছে, সেই অর্থ কে সঠিক ভাবে ব্যবহার করে যদি সরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে সক্রিয় করে তোলা যেত, যদি সেই অর্থে সরকারি হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো, সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিকাঠামো ও মেডিক্যাল কলেজগুলির পরিকাঠামো কে সঠিক ভাবে উন্নত করা যেত, তাহলে ভারতবর্ষের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বের শ্রেষ্ঠদের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারতো। 

স্বাস্থ্য খাতে মোদী সরকার প্রতি বছরের বরাদ্দে কোন বিশেষ বৃদ্ধি করেনি এবং রাজ্যে রাজ্যে এইমস গঠন করে সেরা স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার যে বন্দোবস্ত প্রাক্তন সরকার করেছিল, সেই খাতে কোন বিশেষ পদক্ষেপ মোদী সরকার নেয়নি। জনগণের স্বাস্থ্য কে বেসরকারি হাঙ্গরদের হাতে ছেড়ে দিয়ে, ওষুধ ও জরুরী পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচের উপর কোন সঠিক সিলিং না বসিয়ে, মোদী সরকার জনগণ কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। হোমিওপ্যাথি, উনানী, আয়ুর্বেদিক ও অন্যান্য বিজ্ঞান অসম্মত ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির উপর বেশি জোর দিয়ে এলোপ্যাথি চিকিৎসার উপর খাঁড়ার ঘা মারা হয়েছে মোদী সরকারের আমলে। 

চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল আরও খারাপ করতে এবার মোদী সরকার উনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের মাত্র এক বছরের ব্রিজ কোর্স করিয়ে এলোপ্যাথি চিকিৎসা করতে অনুমোদন দেবে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, এর ফলে রোগীরা ভীষণ সঙ্কটে পড়বেন, কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক ধারা থেকে এসে এলোপ্যাথি কোন ভাবেই এক বছরের মধ্যে কেউ রপ্ত করতে পারবে না এবং তৈরি হবে প্রচুর সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত হাতুড়ে ডাক্তার। যেহেতু গ্রামে গঞ্জে ও শহরের শ্রমিক মহল্লায় বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও দলিত-আদিবাসী অঞ্চলে এই চিকিৎসকদের সংখ্যা শ্রেণী ও জাতিগত কারণে বেশি তাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় এই সমস্ত শ্রেণীর ও সম্প্রদায়ের মানুষেরাই পড়বেন। 

হেঁসেলের কথা আগেই হয়ে গেছে, আর বলা হয়েছে তেলের মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে। যেটা উপরে বলিনি সেটা হলো যে ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম হতে থাকার সুফল কিন্তু জনতা কে দিতে চাননি নরেন্দ্র মোদী। বলেছিলেন যে তেলের দাম বেশি রাখা হয়েছে কারণ সরকার নাকি একটি করপাস তহবিল তৈরি করছে লাভের টাকা দিয়ে, যে অর্থ নাকি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পেলে ভর্তুকি হিসেবে ব্যবহার করে দেশের জনগণ কে তেলের দামের আগুন থেকে বাঁচাতে ব্যবহার করা হবে। 

অথচ আজ যখন আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে  $৮০ প্রতি ডলার, তখন সেই করপাস তহবিলের টাকা কোন নেপোয় মেরেছে সেই প্রশ্ন চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। অয়েল ইন্ডিয়া কর্পোরেশন এর মতন বৃহৎ তেল বিক্রির কোম্পানিগুলি কিন্তু চরম মুনাফা করছে আর মোদী সরকার তেলের উপর থেকে কোন কর কমানোর কথা কল্পনাতেও আনতে চাইছে না, কারণ সরকারের মতে যদি ₹১ কর কমানো হয় তাহলে সরকারি তহবিলে ₹১৩,০০০ বাৎসরিক ঘাটতি হবে। যে জিএসটি কে নিয়ে এত নাচ গান, এক দেশ - এক করের এত মহিমা ও গুণগান গাওয়া হলো, সেই জিএসটির অন্তর্গত কিন্তু তেল কে করা হচ্ছে না আর তার কারণ সরকার নিজের তহবিলে এক পয়সাও ঘাটতি হতে দিতে চায়না, তাতে যদি জনগণের পকেটে আগুন লাগে, তাহলে তাই হোক।

তেলের দামের উপর কর যে ভাবে চাপানো আছে তাতে তেলের দাম বাড়লে যদিও সরকারের বিদেশ থেকে আমদানি করার খাতে খরচ বেড়ে যায়, সরকারের আয়ও কিন্তু বেড়ে যায় কারণ ক্রেতা যে হারে পেট্রোল বা ডিজেল ক্রয় করেন সেই দামের ৪৯ শতাংশই আসলে কর। এই ঘাড় মটকে আদায় করা টাকা দিয়ে পুলিশ-মিলিটারি পোষা হয় জনগণের উপর লাঠি-গুলি চালানোর জন্যে, এই অর্থেই বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে চুরি করা অর্থের ঘাটতি মেটানো হয়, এই অর্থ দিয়েই বৃহৎ বীমা কর্পোরেশনগুলির মুনাফার পাহাড় বাড়ানো হয়। এই করের টাকা দিয়েই কিন্তু ভারতের বৈদ্যুতিন মাধ্যম থেকে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় মোদী সরকার নিজের দামামা বাজিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়, কোটি কোটি টাকা খরচ করে মন্ত্রী-সান্ত্রীদের রাজকীয় জীবনযাপন করায়। 

তেলের দামের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে আজ যখন এশিয়ার দেশগুলি বিপুল হারে ভর্তুকি দিয়ে একটি মূল্য-নির্ধারণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে, মোদী সরকার ও তার ভক্তরা কিন্তু কোন ভাবেই বাজারের হাত থেকে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে একটি মূল্য নির্ধারক কমিটির উপর ছেড়ে দিতে পারছে না, কারণ আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে অটল বিহারি বাজপেয়ীর সরকার এমনই এক প্রাইজ কন্ট্রোল মেকানিজম কে শেষ করে বাজারি শক্তির হাতে, অর্থাৎ বৃহৎ তেল কর্পোরেশনগুলোর হাতে, ভারতের বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার ছেড়ে দেয়। বিশ্ব ব্যাঙ্ক-আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার-বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কে চটিয়ে সেই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার মুরোদ মোদী সরকারের নেই, শুধু মোদী ভক্তদের মুরোদ আছে এই দাবি কে সমাজতন্ত্রী বলে গালাগাল করার এবং আসল ইস্যুর থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার। 

মোদী সরকার ভারতবর্ষের উপর চেপে বসা একটি জোঁক, যার মাধ্যমে ভারতের জনগণের, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে আম্বানি-আদানি-টাটা-বেদান্ত থেকে শুরু করে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি। মোদী সরকারের ঘাড়ে চেপেই কৃষকের ঘাড় মটকাচ্ছে জোতদার আর জমিদারেরা, ভারতবর্ষকে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি বানাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, জায়নবাদী ইজরায়েল ও সাম্রাজ্যবাদী-ফ্যাসিস্ট জাপানিরা। আজ ভারতের সার্বভৌমত্ব বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই, কারণ নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির স্বার্থে সার্বভৌমত্ব কে জলাঞ্জলি দিয়েছে শাসকশ্রেণী এবং ভারতবর্ষ কে পরিণত করেছে সাম্রাজ্যবাদী লুটেরাদের স্বর্গরাজ্যে। 

২০১৯ সালের নির্বাচনে মোদী হারবে কি হারবে না সেটা আজ বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন নয়। বিশেষ করে যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সাথে যুক্ত, তাঁদের ভেবে দেখতে হবে যে কোন এমন সরকার ভারতে নির্বাচনী পথে বিরোধীরা স্থাপন করতে পারবে যা মোদী সরকারের চাপানো জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতিগুলি কে খারিজ করে দেবে? আসলে এমন কোন সরকার আজ নির্বাচনী পথে সম্ভবই নয়, কারণ যে কোন সংসদীয় দলই আজ নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির, বিশ্ব ব্যাঙ্ক-আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার-বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পদলেহী দালাল। 

ভারতের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভূত উন্নয়ন দেখেছে বিগত ২৫ বছরের নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির কারণে। আজ যদি ভারতে এক প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হয় তাহলে সেই সরকার কে আসলে হতে হবে এই নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির বিরোধী, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এক সরকার যা ক্ষমতার ভরকেন্দ্র কে সরিয়ে আনবে জনগণের হাতে আর সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অর্থনীতি কে গড়ে তুলবে। কৃষকদের কৃষি সমস্যার সমাধান করবে সেই সরকার, করবে শ্রমিকদের প্রকৃত কল্যাণ, যা হলো সমস্ত বৃহৎ শিল্পের উপর সামাজিক মালিকানা স্থাপন। একমাত্র এই পথেই শুধু আমাদের দেশকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধার করা সম্ভব এবং এক উন্নত দেশে, ধর্ম নিরপেক্ষ, পরমত এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতার আদর্শ ভূমিতে পরিণত করা সম্ভব। 

এই লক্ষ্য ততদিন পুরো হতে পারবে না যতদিন আমরা আমাদের মুক্তি খুঁজবো পার্লামেন্টের আসনের গণিতে, বিভিন্ন জোটের দেওয়া-নেওয়ার হিসেবে, বিভিন্ন সংগঠনের পদ নিয়ে দর কষাকষির মধ্যে। আমাদের দেশের শত্রু হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ, যার চূড়ামণি হচ্ছে মোদী সরকার ও যার পৃষ্টপোষক হচ্ছে জোতদার-জমিদার, বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা, শহুরে উচ্চবিত্তরা ও বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি; আর এই ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করতে গেলে জনগণ কে টেনে আনতে হবে গণ সংগ্রামের রণভূমিতে। জনগণ কে শিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং তাঁদের লড়াইয়ে আগুয়ান বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তাঁরা একত্রে, ঐক্যবদ্ধ ভাবে, ক্ষেতে-খামারে-কারখানায় আর রাজপথে লড়াই করে ক্ষমতার থেকে ছুড়ে ফেলতে পারে শাসকশ্রেণী ও তার পদলেহী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের। একমাত্র জনগণের বিপ্লবী সংগ্রামই আজ দেশের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ-ধর্মীয় বিদ্বেষ ও অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্ত হওয়ার চাবি কাঠি।      

পুরুলিয়ায় বিজেপি কর্মীদের হত্যা কি সংঘ পরিবারের স্বার্থে?

রবিবার, জুন ০৩, ২০১৮ 0 Comments A+ a-



সম্প্রতি, পুরুলিয়া জেলায় দুই বিজেপি কর্মীর দেহ কিছুদিনের ব্যবধানে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে এবং তারপর থেকেই রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা অবনতির ও তৃণমূলের হিংসাত্মক রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে বিজেপি ও সংঘ পরিবার বাজার গরম করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও পুরুলিয়া পুলিশের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুসারে দ্বিতীয় মৃত ব্যক্তি, দুলাল কুমার (৩০), আত্মহত্যা করেছেন, তবুও রাজ্য সরকার এই মৃত্যুর তদন্তের ভাঁড় সিআইডি’র হাতে তুলে দিয়েছে। বিজেপির নিশানার তীর তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে আর তৃণমূলের নিশানার তীর বিজেপি থেকে মাওবাদী, প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই।  পুরুলিয়া জেলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস গো হারা হারায় মমতা বন্দোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দোপাধ্যায় জেলাকে বিরোধী শূন্য করতে চান বলে বিজেপির অভিযোগ। 

কয়েকদিনের ব্যবধানে সংগঠিত এই জোড়া মৃত্যু বাংলার জনমানসে বিজেপির পক্ষে কতটা সহানুভূতির জোয়ার এনে দেবে তা বিতর্কের বিষয়, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য যে এত সরল ভাবে সমাধান হবে তা কিন্তু যে কোন সমালোচক সাংবাদিকের পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। বিজেপির অভিযোগ নিঃশর্ত ভাবে মেনে নেওয়া অনেকটা হয়ে যাবে রাষ্ট্রের হাতে খুন হওয়া মানুষেরা এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারে মরেছে সেটা স্বীকার করে নেওয়ার মতন। 

বিজেপি এই রাজ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিদ্বন্ধি হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস কে আজ টেক্কা দিতে পারছে তার কৃতিত্ব যেমন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দ্বারা ১৯৯৮ সালে বিজেপি কে খাল কেটে বাংলায় ঢুকতে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার ঘটনায় নিহিত, ঠিক তেমনি, অধঃপতিত সংশোধনবাদী সংসদীয় বামপন্থী দলগুলির, যাদের পান্ডা হলো সিপিএম, তাদেরও চরম দেউলিয়াপনা ও অক্ষমতায় নিহিত। 

রাজনৈতিক হিংসার মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা ও বিরোধীদের নিকেশ করে দেওয়ার রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস পার্টি ১৯৫০ এর দশকে আমদানি করেছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে, শ্রমিক ও কৃষকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতা দখল করতে পারে কারণ ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পদলেহী শ্বাপদ সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সরকার যে নৃশংস তান্ডব লীলা পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭২ থেকে চালিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে নকশালপন্থীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম ও বন্দিমুক্তি সংগ্রামের লাভটা জ্যোতি বোস ও সিপিএম সেদিন নেপোয় মারে দই করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পেরেছিল বলে। ঠিক তেমনি, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালে বামফ্রন্টের সামাজিক-ফ্যাসিবাদী শাসন কে উচ্ছেদ করে এক প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদী সরকার গঠন করতে পেরেছিল কারণ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ও মাওবাদীদের সাহায্যে তৃণমূল কংগ্রেস সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে লালগড়ের নানা প্রান্তে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল এবং তার ফলে একটি চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল দল হওয়া সত্বেও তৃণমূল মানুষের কাছে নিজেদের একটি প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে সমর্থন কুড়োতে পেরেছিল। আজ বিজেপি ঠিক সেই পথেই চলে, সিপিএমের খালি করে যাওয়া ময়দানে সিপিএমের প্রাক্তন কর্মী ও সমর্থকদের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে তৃণমূলের নৃশংস সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারছে। 

এখানে বিজেপি যে শুধু হিন্দুদের সমর্থন আদায় করছে তাই নয়, ২০১৪ সালে সমগ্র বীরভূমের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে বিজেপি নিজের সংগঠন কে শক্ত করে গড়ে তোলে এবং সেই সংগঠনের উপর ভর করে দুধ কুমার মন্ডলের মতন জোতদার অনুব্রত’র (কেষ্ট) মতন সাংঘাতিক সন্ত্রাসবাদীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে জমি দখলের। এই রাজায় রাজায় যুদ্ধে যে অসংখ্য উলুখাগড়ার প্রাণ যায় তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের নয়তো আদিবাসী বা নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের গরিব মানুষ। ঠিক কেশপুরের মতন আজ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূলের ক্ষমতা ধরে রাখার ও বিজেপির ক্ষমতা দখল করার হিংসাত্মক সংঘর্ষ চলছে। এরই মধ্যে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে তীব্র হিংসা কে উপেক্ষা করেও বিজেপি যে পুরুলিয়া দখল করতে পেরেছে তার শ্রেয় কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে দিন দিন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বেড়ে চলা ক্ষোভ কে দিতে হয়। 

বীরভূম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জুড়ে আজ বিজেপি গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে আরএসএস এর সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক কে ব্যবহার করে এবং এই কাজে তৃণমূলের একটা বড় অংশই কিন্তু বিজেপি কে সাহায্য করছে রাতের আঁধারে। এই ধরুন বাঁকুড়ার তালডাংরার কথা, বিজেপি এখানে প্রবেশ করে ১৯৯৮ সালে তৃণমূলের কোলে চেপে আর আজ আরএসএস এর অসংখ্য সন্ত্রাসী শিবিরের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে বিজেপি হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদী ফৌজ খাড়া করেছে এবং তোলা আদায়, নারী পাচার থেকে বিভিন্ন বেআইনি কারবারে নিজের একচেটিয়া অধিকার কায়েম করে ফেলেছে । তৃণমূল এখানে বিজেপির সাথে রফা করে ফেলেছে আর কোথাও কোথাও অস্তিত্বের সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা সিপিএম বিজেপির সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে লুটের বখরার উপর অধিকার কায়েম করতে। 

সিপিএম আজ কংগ্রেসের লেজুড় হয়ে যেটুকু অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছিল তাও আজ বিশ বাওঁ জলে এবং এর ফলে সিপিএমের কর্মীরা দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছে প্রাণ ও জমি বাঁচাতে। বর্তমানে যদি আবার বিধানসভা নির্বাচন হয় তাহলে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রের থেকে ধুয়ে মুছে যাবে এবং বিজেপি তৃণমূলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলার ঔদ্ধত্ব দেখাবে, এই কথা বলার জন্যে কোন বড় রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দরকার পড়বে না, কারণ একথা আজ গ্রামের শিশুরা পর্যন্ত বলতে পারবে।  

এর মধ্যে যদি তৃণমূল কে নিজের ঘাঁটি ও ক্ষমতা বাঁচাতে হিংসায় জড়াতে হয়, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস কে রাতের অন্ধকার অবধি অপেক্ষা করতে হবে না, বরং দিনের আলোয়, ভাঙড়ের মতনই, যে কোন জায়গায় যে কোন ব্যক্তি কে হত্যা করার ক্ষমতা আজ মমতা বন্দোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের আছে। তৃণমূলের হিংসার সাথে সমগ্র রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরিচিত হয়েছিল ভালো ভাবেই আর তাই বিজেপির দুই চুনো পুঁটি কে দিনের আলোয় নিকেশ করতে তৃণমূলের কোন বিশেষ সমস্যা হতো না। পুরুলিয়ার মতন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাউকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক পরেই রাতের অন্ধকারে বাইকে করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করে গাছে টাঙিয়ে মৃতের জামায় হুমকি লিখে আসার মতন বেদনাদায়ক পরিশ্রম তৃণমূলের হার্মাদ বাহিনী এই মুহূর্তে করবে এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে। 

বিগত দিনে, বামফ্রন্ট আমলে, পুরুলিয়ার ওই সকল অঞ্চলে মাওবাদীদের হাতে বেশ কিছু সিপিএম নেতা ও কর্মীর প্রাণ যায়, যার সাথে কিন্তু বর্তমানের বিজেপি কর্মীদের হত্যার কোন সাদৃশ্যতা খোঁজা শিশুসুলভ আচরণ হবে। মাওবাদীরা যাঁদের আজ অবধি খুন করেছে তাঁদের মৃতদেহের পাশে তাঁরা পোস্টার লিখে নিজেদের দ্বায়িত্ব স্বীকার করেছে এবং সেই পোস্টারগুলির নিচে মাওবাদীদের সাংগঠনিক পরিচয় থাকতো। নিজেদের নামে কাউকে হত্যা করতে মাওবাদীরা কুন্ঠিত বোধ করে না কারণ তাঁদের দল অনেক দিন ধরেই নিষিদ্ধ এবং নির্বাচনের কোন বালাই মাওবাদীদের নেই। যদিও মাওবাদীরা বর্তমানে পুরুলিয়ায় ফের নিজেদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তবুও এই দুই মৃত্যুর দায় তাঁদের ঘাড়ে চাপানো যায়না, কারণ তাঁরা যদি এদের মেরেই থাকতো তাহলে সেই মৃত্যুর দায় নিয়ে প্রশাসনের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিতে পারতো মাওবাদীরা।  

যদি তৃণমূল এবং মাওবাদীরা এই দুই জন কে না মেরে থাকে তাহলে কে এদের মারতে পারে? সিপিএম আর কংগ্রেসের এখন সাইনবোর্ডটুকুও পুরুলিয়া জেলায় নেই। তৃণমূলের সন্ত্রাসে এই দলগুলির অস্তিত্ব অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। তবে যে দলের শক্তি এই মুহূর্তে পুরুলিয়ায় বেড়েছে তা হলো বিজেপির এবং এর সাথে সাথে আরএসএস এর। নিজ দলের লোক কে কোরবানির পাঁঠা বানানো বিজেপির কাছে নতুন কিছু না। হরেন পান্ড্যা থেকে গোপীনাথ মুন্ডে, দীনদয়াল উপাধ্যায় থেকে প্রমোদ মহাজন, যখন যাকে খরচের খাতায় ফেলার দরকার বিজেপি বা আরএসএস এর হয়েছে তখন সেই মরেছে কোন না কোন আততায়ীর হাতে, দোষটা অবশ্যই অন্য কারুর উপরে চাপানো হয়েছে। এত বড় বড় মহীরুহ যাঁরা কেটে ফেলতে পারে অবলীলায়, তাঁরা যে দুটি নটে গাছ মাড়িয়ে দেবে না সে কথা শিশুও বিশ্বাস করবে না। 

সম্প্রতি, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, নিজের পক্ষে সমর্থনের জোয়ার আনতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দরকার হয়ে পড়ে বিজেপির এবং তাই পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য এলাকার মতন পুরুলিয়াতেও রাম নবমীর মতন অবাঙালি, উত্তর ভারতীয় উৎসব কে ঘিরে দাঙ্গার আগুন লাগায় সংঘ পরিবার। এই কাজে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বজরং দলের জেলা নেতা ও বিজেপির যুব নেতা গৌরাব সিংহ, যে আবার প্রাক্তন এসএফআই কর্মী। তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে মানুষে মানুষে ঘৃণা ছড়াতে ওস্তাদ গৌরাব সিংহ, পুরুলিয়ার রাম নবমীর দিনে সশস্ত্র মিছিলের মাধ্যমে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গার আগুন জ্বালায় এবং এই হিংসায় এক মুসলিম যুবকের মৃত্যু হয় বজরং দলের কর্মীদের আক্রমণে। হিন্দি-ভাষী উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় আরএসএস নেতাদের ভাড়াটে গুন্ডা হিসেবে গৌরাব সিংহ ইতিমধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠেছে জমির দালালি থেকে নানা অপরাধে সামিল হয়ে। এহেন গৌরাব সিংহ গ্রেপ্তার হওয়ায় তাঁর স্বরূপ যাতে জনগণের সামনে না আসে, পুরুলিয়ার থেকে বিজেপির নারী পাচার থেকে মাদক পাচারের মতন অপরাধের হিসেব যাতে জনগণ বা দেশের মানুষ না জানতে পারেন, তাই হয়তো হঠাৎ দুটি মৃতদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। 

বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিন্তু এই ঝুলন্ত দেহ পাওয়ার পর থেকেই নিজেদের প্রচার কে তুঙ্গে নিয়ে গেছে এবং তৃণমূলের সাথে সাথে শ্রমজীবি মানুষের স্বার্থে আন্দোলন করা, দলিত ও আদিবাসী জনগণের স্বার্থে কথা বলা শক্তিগুলি কে নিজেদের আক্রমণের নিশানা বানিয়েছে। আসানসোলে মার্চ মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাবার হোতা, সুপ্রিয় বড়াল ওরফে বাবুল সুপ্রিয় কিন্তু সোজা আক্রমণ সেঁধেছে বামপন্থীদের উপর এই বলে যে বিজেপির দলিত ও আদিবাসী কর্মী হত্যার বিরুদ্ধে তাঁরা কেন প্রতিবাদ করছেন না। বিজেপি বলছে যে তাঁদের কর্মীদের উপর আক্রমণ আসলে ফ্যাসিবাদ এবং এর প্রতিবাদ সকল বাম ও গণতান্ত্রিক মানুষদের করা উচিত। 

হয়তো বাবুল সুপ্রিয়ের মনে নেই যে বিজেপি বা আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন কোন সংগঠনে যোগ দেওয়ার সাথে সাথে দলিত ও আদিবাসী সমাজের কিছু দলছুট মানুষ সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর পদাতিক বাহিনীর সদস্য হয়ে ওঠে। তাঁরা যে শুধু মুসলিম বা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আক্রমণ চালায় তাই নয়, বরং অন্যান্য দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও তাঁরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, যেমন টাটা ও বেদান্তের পয়সায় পরিচালিত হওয়া ছত্তিশগড়ের সালোয়া জুডুম এর খুনি সন্ত্রাসীরা সকলেই কিন্তু আদিবাসী সমাজ থেকে আগত আরএসএস এর সস্তা পদাতিক ছিল। তাই যে আদিবাসী বা দলিত আরএসএস সন্ত্রাসী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ঝান্ডা উত্তোলন করার জন্যে প্রাণ দেয়, তাঁদের সাথে শোষিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত দলিত ও আদিবাসীদের কোন সম্পর্ক থাকে না। ফলে সেই গেরুয়া বাহিনীর কাছে বিকিয়ে যাওয়া আদিবাসী বা দলিতের স্বার্থের সাথে সমগ্র আদিবাসী ও দলিতদের স্বার্থের কোন সম্পর্ক থাকে না এবং তাই কোন গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তি এহেন মৃতদের পক্ষে আন্দোলন করে না। 

বিজেপির পক্ষে খরচের যোগ্য যে কোন আদিবাসী বা দলিত কর্মী কে আরএসএস এর দক্ষ সন্ত্রাসবাদীদের দিয়ে খুন করিয়ে গাছে টাঙিয়ে, ভাঙা ভাঙা বাংলা বক্তব্য লিখে একটা সেনসেশন ছড়ানো সংঘ পরিবারের পক্ষে কোন বড় ব্যাপার নয়। পুরুলিয়ার সাথে, পুরুলিয়ার আদিবাসী সমাজের সাথে বিজেপির কোন প্রত্যক্ষ বা আবেগের সম্পর্ক নেই। পুরুলিয়ার দরিদ্র মানুষ কি ভাবে দিন কাটান, কি ভাবে আদিবাসী জনগণ সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন মাত্র ভাত খেয়ে বাস করেন, তা নিয়ে বিজেপির কোন মাথা ব্যাথা নেই। বিজেপির কাছে পুরুলিয়ার প্রয়োজনীয়তা হলো নকশালপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করার জন্যে, সমস্ত জোতদার ও জমিদারদের নিজের নেতৃত্বে নিয়ে আসার জন্যে এবং অসংখ্য আদিবাসী যুবকদের টাকা, মদ ও মহিলার প্রলোভন দেখিয়ে আরএসএস এর সন্ত্রাসী বানিয়ে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে পদাতিক বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে। 

বিজেপি এখন পশ্চিমবঙ্গের থেকে বামপন্থার রেশটুকু, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের রেশটুকু শেষ করে দিয়ে শুধু মাত্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে নিজের পালে জোর হাওয়া টেনে প্রধান বিরোধী দল হতে চায়। মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং কংগ্রেস পার্টিও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ভারতের যে কোন রাজ্যের মতন শুধু দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ময়দান হওয়ার পক্ষপাতী। অন্যদিকে অস্তিত্বের সঙ্কটে হতাশ সামাজিক-ফ্যাসিবাদী সিপিএম ও অন্যান্য সংসদীয় বাম দলগুলির সুবিধাবাদের পাঁকে ডুবে শেষ হয়ে যাওয়া দেখে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মধ্যেই বামপন্থা নিয়ে এক বিরূপ মনোভাবের জন্ম হয়েছে। এই সঙ্কট কালে কোন বিপ্লবী বামপন্থী শক্তির শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনতার মধ্যে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রচার আন্দোলনের অভাবে, লেগে পড়ে থেকে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণ কে, বিশেষ করে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের, আদিবাসী জনগণকে ও নমঃশূদ্র মানুষদের জাগিয়ে না তোলার ফলে আজ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি ও ইসলামিক মৌলবাদী শক্তি গ্রামাঞ্চলে প্রশ্রয় পেয়ে নিজেদের দুর্গ গড়ে তুলছে। 

আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়ার জন্যে বিজেপি ও আরএসএস অনেক রক্ত বইয়ে দিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দি-ভাষী অঞ্চলগুলোয় কি ভাবে উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খন্ড এবং বিহার থেকে গুন্ডা বাহিনী এনে দাঙ্গা লাগিয়ে মেরুকরণ চালাচ্ছে বিজেপি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আসানসোল ও রানিগঞ্জের রাম নবমীর উপলক্ষ্যে লাগানো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আজ এই ঘৃণার বীজ কে আরএসএস বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে আদিবাসী অঞ্চলে রোপন করছে এবং এখনই এদের কে প্রতিরোধ করে পরাস্ত না করতে পারলে আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে এমন বিষবৃক্ষ ফলে উঠবে যা আমাদের ভবিষ্যৎ কে বিষ বাতাসে ভরিয়ে দেবে এবং হিংসা ও মৃত্যুর ঘৃণ্য তান্ডব এই বাংলার পরিচয় উঠবে। হয় আমাদের আজ বাংলার ভবিষ্যতের জন্যে রুখে দাঁড়াতে হবে আর না হয় হিন্দি-ভাষী হিন্দুত্বের ধ্বজ্জাধারীদের পদদলিত হয়ে চিরকাল বাস করতে হবে।   

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে