ধর্ষণের বিরুদ্ধে সুজেট জর্ডানের লড়াই নির্যাতিত নারীর কাছে এক প্রেরণা

রবিবার, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হলো যে সুজেট জর্ডান ধর্ষিত হয়েছিলেন এবং মমতার লাগনো "সাজানো ঘটনার" যে সাইন বোর্ডটি কাকলী ও মদনের মতন মো সাহেবরা জি হুজুর রব তুলে পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণকারীদের রক্ষার স্বার্থে সুজেটের উপর লাগিয়েছিলেন তা কুত্সা ছাড়া আর কিছুই নয়. একটা মিথ্যা কে সত্যি বলে চালাতে গেলে কাউকে যে কত নিচে নামতে হয় তার উদাহরণ ২০১২ তে ঘটিত এই ঘৃণ্য পাশবিক ধর্ষণ কাণ্ড.

সাজা আর আদালতের রায় নিয়ে মমতা ব্যানার্জী যে নিজের থুতু নিজে চেটে ক্ষমা চাইবেন সে আশা গুড়ে বালি. হয়তো নজিরবিহীন কাণ্ড হবে যে সরকার পক্ষ নিজ থেকে সাজার বিরুদ্ধে আপিল করে বসলে.  অথবা নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে ১৮০ ডিগ্রী ডিগবাজি খেয়ে এ কথাও বলতে পারেন যে তিনি চিরকালই সুজেট জর্ডানের জন্যে ন্যায়ের লড়াই লড়েছেন.

এই সকল রাজনৈতিক নোংরামি ছাড়া যে জিনিসটা সব চেয়ে বেশি তীক্ষ ভাবে বিঁধেছে তা হলো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক অর্ধ সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এক ধর্ষিত নির্যাতিত নারীর উপর আসল পাশবিক অত্যাচার তো ওই ধর্ষণের খবর বের হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়. প্রগতিশীলতার চাদর গায়ে দেওয়া বাঙালী মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজে অধিষ্টিত ভদ্র লোকেরা, যাঁরা মঙ্গল চণ্ডীর উপস করেন আবার নারী শক্তির প্রতীক দুর্গা পুজোয় ধুতির কোঁচা ধরে ধুনুচি নাচেন, তাঁরাই আবার সুজেট জর্ডানের ধর্ষণের ঘটনার উপর মন্তব্য করেন নাক সিঁটকে. কাকলী -মদনের শেখানো নারী বিদ্বেষী মনোভাব থেকে তাঁরা জানতে চান কেন সুজেট মধ্য রাতে ওই পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলের পান শালায় গেছিলেন? গণ ধর্ষণ তিনি সহ্য করলেন কি ভাবে? তিনি কোন ধরণের পোষাক পড়েছিলেন? তিনি কি মদ খেয়েছিলেন ? ইত্যাদী. মোদ্দা কথা হলো যে প্রমাণ করুন আপনি ধর্ষিত হয়েছেন. স্বেচ্ছায় শয্যা সঙ্গিনী হননি.

অথচ এই লোকগুলো যখন দিল্লীর ঘৃণ্য গণ ধর্ষণের খবর সেই একই বছর শুনলো তখন সেই খবরে তাঁদের বীরত্ব জাগিয়ে দিলে. ধর্ষণ বিরোধী, নারী দরদী সেজে গেলেন তাঁরা রাতারাতি. তর্ক-বিতর্কে চায়ের পেয়ালা উল্টে গেল, নারী সুরক্ষা নিয়ে সবাই গলা চড়াতে থাকলেন. সুজেট কে নিয়ে  নয়. কারণ মধ্যবিত্ত পুরুষতন্ত্রের চশমা পড়ে দেখলে তো সুজেট জর্ডান এক নষ্ট মেয়ে. ঠিক যেমন সিনেমায় দেখা যায়. সুজেট মদ খেতেন, সিগারেট ধরিয়ে ধুঁয়া ছাড়তেন প্রকাশ্যে, রাত বিরেতে পার্টিতে যেতেন, ছেলেদের সাথে মিশতে দ্বিধা করতেন না, আর তার উপর মেয়েটার ডিভোর্স হয়েছে - নিশ্চয় চরিত্রের দোষ দেখে স্বামী ছেড়ে দিয়েছে! একটু মাসিমা গোছের ভদ্র মহিলা বলবেন, অ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ানদের তো চরিত্র জন্মগত ভাবে নষ্ট গোছের.

আর সুজেট এই সব কিছুর উপরে হাতুড়ি মারলেন মুখ খুলে প্রকাশ্যে এসে. বললেন ধর্ষিতা নারী কেন লজ্জায় মুখ ঢাকবে ? লজ্জায় মুখ ঢাকা উচিত ধর্ষকদের, কারণ অপরাধ তারা করেছে. পুরুষতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কিন্তু সর্বদা ধর্ষিতার মুখ ঢেকে এসেছে, আমাদের হাড়ে মজ্জায় এই চেতনা ঢুকিয়েছে যে ধর্ষণ হওয়া নারীর আর সন্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার নেই, যদি কোন পুরুষ দয়া করে তাঁদের হাত ধরেন তাহলে তাঁরা রক্ষা পান. আমদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এঁটো কাটা মানার প্রবণতা তো নারীর উপরেও প্রয়োগ হয়, এঁটো হওয়া মেয়েমানুষ তো পুরুষদের কাছে গ্রহণ যোগ্য নয়.

তাই ধর্ষিতা নারীর প্রতি সহমর্মিত পুরুষতন্ত্র তাঁদের 'নির্ভয়া' নামে ডাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, কারণ সেখানে তো ধর্ষিতা পুরুষের সামনে, ধর্ষকের আক্রমণে শত ছিন্ন হয়ে, এক করুণার প্রার্থী হয়ে প্রকাশিত হয় পর্দার আড়াল থেকে. কিন্তু সেই ধর্ষিতা যদি পাল্টা আক্রমণ করে ধর্ষকদের, যদি পুরুষতন্ত্রের চাপানো বাঁধ ভেঙে মুখ আর পরিচয় লুকিয়ে থাকতে অস্বীকার করে আর প্রকাশ্যে এসে ধর্ষণের বিরুদ্ধে মুখ খোলে তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেই নারীর বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা সুজেট জর্ডানের ক্ষেত্রে সমাজের রক্ষাকারীরা শুরু করে.

আজ সময় এসেছে এই কথাটি আরো শক্তিশালী ভাবে বলার যে ধর্ষণ নারীর দোষে নয় পুরুষের দোষে হয়. পুরুষগণ ধর্ষণ করে তাদের বিকৃত কামনাকে চরিতার্থ করার জন্যে, নারীর উপর নিজের প্রভুত্ব কায়েম করার স্বার্থে. নারীর সমান অধিকার আছে যেখানে খুশি যখন ইচ্ছে যাওয়ার, মদ খাওয়ার, সিগারেট টানার, নিজের পছন্দের পোশাক পড়ার. আর ধর্ষণ হয় কারণ পুরুষগণ নিজের সমকক্ষ হিসেবে নারীকে দেখতে পারে না. সেই নারীকে শিক্ষা দেওয়ার পাশবিক পদ্ধতি হলো ধর্ষণ. আর নারীকে বোরখা পড়িয়ে, মুখ ঢাকিয়ে এই ধর্ষকদের থেকে বাঁচানো যাবে না. ধর্ষণ থেকে বাঁচার স্বার্থে দরকার এক শক্তিশালী পাল্টা মারের সংগ্রাম. নারীর নিজ সত্বা কে রক্ষা করার স্বার্থে আজ সুজেট জর্ডানের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে তাঁদের লড়তে হবে পুরুষতন্ত্র ও ধর্ষণতন্ত্রের বিরুদ্ধে.

মৃত্যুতে সুজেট জর্ডানের শরীরের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে কিন্তু যে যুদ্ধ তিনি শুরু করেছিলেন তা আজ আরো বেশি করে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে, আর ধর্ষণকারী সমাজের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছে. তাই সুজেট  জর্ডান হয়তো পুরুষতন্ত্রের ঘৃণা উপচে পড়ছে কিন্তু শোষিত নির্যাতিত নারীর কাছে তিনি এক সংগ্রামী প্রতীক হয়ে থাকবেন. 

শুধু বুদ্ধিজীবিদের নয় চাই সামগ্রিক ভাবে খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ - প্রতিরোধ সংগ্রাম

সোমবার, নভেম্বর ০২, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

বিজেপি সরকারের ভাগ করো - শাসন করো নীতির বিরোধিতায় আজ গলা মিলিয়েছেন দেশের সাহ্যিতিক, চলচ্চিত্র শিল্পী ও নির্দেশকরা, বিজ্ঞানীরা, এবং সর্বপরি দেশের সেই শিল্পপতিদের একটি ক্ষুদ্র অংশ যাদের জুতো চেটে তোয়াজ করা এই নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতিতে সরকারের প্রধান কর্মকান্ড। এই ক্রমাগত বিরোধিতা বুদ্ধিজীবি মহল কে অনেক বছর পর রাজনৈতিক ভাবে একটু সতেজ করে তুলেছে, তাঁরা সম্মিলিত ভাবে ভয় কাটিয়ে আসতে আসতে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস পাচ্ছেন। নিছক গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে যেদিন দাদরির এক সাধারণ মুসলমান মানুষকে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়েছিল সংঘ পরিবারের গৌ বাহিনীর হাতে, সেদিন হতভাগ্য মোহাম্মদ আখলাক ভাবতেও পারেননি যে এই দেশে তাঁর মৃত্যু কি ভীষন আলোড়ন তৈরি করবে। বুদ্ধিজীবি, লেখক, নির্দেশক, বিজ্ঞানীদের সাথে যুক্ত হয়েছে উচ্চ শিক্ষায় গবেষণার খাতে নন নেট ছাত্র -ছাত্রীদের স্বার্থে ইউজিসির প্রদত্ত বৃত্তি বন্ধ করার স্বিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশ জোড়া ছাত্র সংগ্রাম। ১৩৯ দিন ধরে সংগ্রাম চালিয়ে এফটিআইআই এর ছাত্ররা ধর্মঘট তুলে নিয়েও জারি রাখলেন গজেন্দ্র চৌহানের বিরুদ্ধে আন্দোলন। অন্যদিকে বিহারের নির্বাচনে লেজে গোবরে অবস্থা হওয়া সত্বেও টাকা দিয়ে ভোট কিনে ও অন্যান্য দলের কর্মীদের ঘুষ দিয়ে ভোটে জেতার প্রচেষ্টা করেও আজ মোদী ও অমিত শাহের বিজেপি নিশ্চিত হতে পারছে না, তাই অমিত শাহ কে ঘোষণা করতে হচ্ছে যে বিজেপির হার মানে পাকিস্তানের বিজয় (প্রকারন্তরে দেশের মুসলমানরা পাকিস্তানি) এই ঘৃণ্য তত্ব।

এত দেশ জোড়া বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মধ্যে হঠাত আরএসএস এর আদেশে বিজেপির একমাত্র শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি সাজা অরুণ জেটলি লিখলেন যে দেশে অসহিংসুতা নেই, বরং বাম ও উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবিরা নাকি চিরকাল অসহিংসু, তাঁরা নাকি চিরকাল মোদী কে ঘৃণা করে এসেছেন এবং তাঁরা মোদী বাবুকে আর প্রধানমন্ত্রীর পদে দেখতে চাইছেন না , এর ফলে নাকি মোদী বাবু নিজেই অসহিংসুতার শিকার।  প্রথমবার জীবনে শুনতে হলো যে এক দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি নিজেই আক্রান্ত।  অরুণ জেটলির লেখায় যুক্তির চেয়ে বেশি ছিল কলমের খোঁচা মেরে চোখ থেকে জল ঝরিয়ে - ওই খুকি কাঁদছে বলে হাত তালি দেওয়ার ন্যাকামির প্রয়াস। গল্পের গরুকে শুধু গাছে তোলেননি জেটলি, গাছে তুলে মইটা তুলে ছুট লাগিয়েছেন। আপামর জনগণ কে বোকা বানাবার স্বার্থে যদিও অরুণবাবুকে একটু ভালো গল্প লিখতে শিখতে হবে। হয়তো বা দুর্দিনে তাঁর সমর্থন পাওয়ায় খুশি হয়ে আরএসএস এই কাজটি চেতন ভগত কে সঁপে দিতে পারে আর আমরা পাব এক  ইংলিশ এ লেখা নতুন উপন্যাস - দেড়খানা  প্রধানমন্ত্রী।

অরুণ বাবু দু:খ করে লিখেছেন যে বাম ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবিরা বড়ই অসহিংসু, তাঁরা বিরোধী মতকে (পড়ুন গেরুয়া ফ্যাসিস্ট)সমর্থন তো করেনই না, সেই মতামতকে নিজ গুণে বাড়তেও দেন না।  জেটলির আক্ষেপ বামদের মৌরসী পাট্টায় যে সকল প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে তাঁরা কোনও ভাবেই বিরোধীদের (পড়ুন সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্টদের) টিকে থাকতে দিতে চান না, তাঁরা বহুত্ববাদ কে ঘৃণা করেন বলেই তো বেচারা এবিভিপি জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, ও অন্যান্য নামী প্রতিষ্ঠানের ছাত্র - ছাত্রীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে অপারগ।  সেই জায়গায় বেচারা গৌ সেবকরা দুটো তিনটে বজ্জাত গরু খেঁকো কে মেরেছে তার জন্যে বেচারা প্রধানমন্ত্রী কে নিয়ে টানাটানি!

সমস্যাটা হচ্ছে অরুণ বাবু এবং তাঁর নাগপুরে বসা প্রভুরা এটা মেনে নিতে এখনো কষ্ট পায় যে শত চেষ্টা করেও গেরুয়া শিবিরে কিছু বাজারী অভিনেতা - অভিনেত্রী, পুরানো দিনের গাইয়ে - বাজিয়েরা ছাড়া বিশেষ করে বুদ্ধিজীবিরা ঘেঁষে না, রাম মন্দির আর রাম রাজত্ব থুড়ি ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট শাসনের পক্ষে এমনকি বহু দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবিরাও নাক সিঁটকে থাকেন।  এ ছাড়া দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্র - ছাত্রীরা চিরকালই এবিভিপি কে 'ছোট লোকের' পর্যায়ে গণ্য করে এবং একমাত্র তাদের শাসনাধীন রাজ্য ছাড়া কোথাও গেরুয়া শিবিরে ছাত্র-ছাত্রীরা বা এমনকি সুযোগ সন্ধানিরাও বেশি ঘেঁষে না। কিন্তু বর্তমানে কর্পোরেট পুঁজির সেবা দাস বিজেপির দরকার দেশের যুব ছাত্রদের উপর ব্যাপক প্রভাব, যাতে তারা উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত উঁচু জাতের হিন্দুদের নিজেদের পক্ষে টেনে রাখতে পারে এবং তাঁদের দিয়ে কর্পোরেট পুঁজির লোভ লালসা চরিতার্থ করার প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু উঁচু জাতির হিন্দু ছাত্র যুব সমাজে ওই উত্তর প্রদেশ - গুজরাট - মধ্য প্রদেশ - রাজস্থান - হরিয়ানা ও দিল্লির গো বলয় বাদ দিয়ে দিলে আর কোথাও এবিভিপির কোনও প্রতিপত্তি নাই।  এই দুঃখে কাতর জেটলির কাছে প্রলাপ বকা ছাড়া আর কি করনীয় ?

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ব্রাহ্মণ্যবাদকে চিরকালই শাসক শ্রেণী ভীষন ভাবে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। হিন্দু শাসকদের আমলে আজকের ভারত ছিল না, এবং নানা রাজত্বে বিভক্ত ভারতের নানা জাতির হিন্দুদের নানা ধরণের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র চিরকালই ভারতের এক অন্যন্য আকর্ষন ছিল। মুঘল বা তার আগের দিল্লির মুসলমান বাদশাহীর যুগেও মুসলমান শাসকরা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা তো করেননি বরং নিজ শাসন ও শোষনের স্বার্থে তাকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন চিরকাল।  ইংরেজদের ভারতে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন কালে ধূর্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পথিকৃতগণ ব্রাহ্মণ্যবাদ কে চরম ভাবে তোয়াজ করে চলেছিল।ভারতবর্ষই সেই সময়ে একমাত্র দেশ ছিল যেখানে জাতি বৈষম্য শুধুমাত্র হিন্দুদের মধ্যেই নয় বরং মুসলমানদেরও ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে। এই দেশের যে সব নিচু জাতির শোষিত মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদকে পরাস্ত করতে মুসলমান বা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেন তাঁরাও অচিরেই বুঝেছিলেন যে জাতির শাসন এই দেশে কোনও ধর্মেই শেষ হবে না বরং নতুন রূপে আবির্ভূত হবে।

বর্তমানে বর্ণ শ্রমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা আরএসএস এর কাছে ভীষন প্রয়োজন কারণ একমাত্র এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই দেশব্যাপী সামন্তবাদ বিরোধী, কর্পোরেট পুঁজির শোষণ বিরোধী সংগ্রাম কে কন্ঠরুদ্ধ করে মারা সম্ভব হবে। মানুষকে মালিকের দাস বানিয়ে নির্বিবাদে গাধার মতন খাটিয়ে মারার ব্রাহ্মণ্যবাদের চেয়ে বেশি কার্যকরী নীতি আর কি বা হতে পারে ? বিনা মূল্যে শ্রম দেওয়ার যে রীতি আজও বিহার - উত্তর প্রদেশ - হরিয়ানা ও মধ্য প্রদেশের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে টিকে আছে তাকে আজ এক সর্ব ভারতীয় রূপ দিয়ে সামন্তবাদ ও বিদেশী এক চেটিয়া পুঁজির ভারতে ভিত শক্ত করে গড়ে তোলার কর্মকান্ডে আজ আরএসএস এক অগ্রদূত।

এই সময়ে আরএসএস ও বিজেপির বিরুদ্ধে দেশ জোড়া যে বিক্ষোভের আঁচে বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ হাওয়া দিচ্ছেন তার সব ভালোর মধ্যে মন্দটা হলো যে এই লড়াই শুধুমাত্র সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চ শ্রেনীর মানুষের মধ্যেই আজ সীমাবদ্ধ। আপামর খেটে খাওয়া গরিব মানুষের মধ্যে এই লড়াই কে ছড়িয়ে দিয়ে, তাঁদের ন্যায্য সংগ্রামের সাথে, সামন্তবাদ ও কর্পোরেট পুঁজির নির্মম শোষণ - অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁদের রোজকার বেঁচে থাকার সংগ্রামের সাথে তাঁদের লড়াইকে মিলিয়ে দিতে বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ আজ অপারগ, বা বলা ভালো তাঁরা সেই কাজটি করতে চান না, কারণ তাঁরা একটি এলিটিস্ট সিনড্রোমে ভোগেন। তাঁদের কাছে গরিবদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইগুলি ভীষণ তীক্ষ ও উগ্র, তাই তাঁদের পক্ষে শ্রমিক কৃষকের লড়াইয়ের সাথে একাত্ম হওয়া আজ মহা কষ্টকর কাজ।

আমরা যদি গভীর ভাবে ইতিহাসকে খতিয়ে দেখি তাহলে বুঝতে পারবো যে দেশের আপামর শ্রমিক ও কৃষকের সংগ্রাম, বিশেষ করে ঐক্যবদ্ধ ও সংহতি মূলক লড়াই ছাড়া ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা অসম্ভব।  বুদ্ধিজীবিদের লড়াইতে অনেক তাত্বিক মার প্যাঁচ, বড় বড় ভাষণ, গান, থিয়েটার, ও মনোরঞ্জনের নানা উপাদান হয়তো থাকতে পারে, তা হয়তো শ্রমিক কৃষকের সংগ্রামের মতন অত রুক্ষ ও সোজা সাপ্টা হয় না।  কিন্তু আর্থ -সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে বোঝা যাবে যে এই শ্রমিক কৃষকের সংগ্রামের থেকে বিছিন্ন সংগ্রাম বুদ্ধিজীবিদের হয়তো সাময়িক ভাবে তুঙ্গে তুলবে কিন্তু পরবর্তী কালে এই লড়াই কোনও রসদ না পাওয়ার কারণে এবং বিচ্ছিন্নতার কারণে অচিরেই কানা গলিতে চক্কর খাবে। যতদিন বুদ্ধিজীবিরা নিজেদের ক্ষুদ্র গন্ডি পের হয়ে শ্রমিক ও কৃষকের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মানসিকতা না অর্জন করতে পারছেন ততদিন তাঁদের অনুপস্থিতিতে ওই অমিত শাহ আর মোদী বাবু শ্রমিক - কৃষকের মধ্যে জাত ও ধর্মের ভিত্তিতে দেওয়াল তুলে তাঁদের সামন্তবাদ ও কর্পোরেট লুটের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে চোরাগলিতে টেনে নিয়ে শেষ করতে চাইবে। এই কারণেই তো বিজেপি আজ দেশী - বিদেশি পুঁজির সর্বশ্রেষ্ঠ দালাল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।

        

সিরিয়াতে রুশ বিমান হানা মুক্তির চিহ্ন নয় - সাম্রাজ্যবাদের লুঠের মালের বখরার লড়াইয়ের চিহ্ন

শুক্রবার, অক্টোবর ৩০, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

বেশ কিছুদিন ধরে ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু তথাকথিত বামপন্থী বন্ধুগণ দেখলাম সিরিয়াতে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও সৌদি - ইস্রায়েল দুষ্ট চক্র দ্বারা প্রযোজিত ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিমান হানা নিয়ে ভীষন ভাবে মেতে উঠেছেন। এই রুশ বিমান হানার মধ্যে অনেক তথাকথিত বাম ও কমিউনিস্টরা খুঁজে পাচ্ছেন সোভিয়েতের গন্ধ, তাঁদের মনে আশা যোগাচ্ছে পুতিনের রুশ, যেন এই রাশিয়া মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীদের ধ্বংস করে দেবে এবং এই যুদ্ধের মধ্যে তাঁরা সমাজতন্ত্রের উপকরণ খুঁজছেন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা। এদের এই কর্মকান্ড দেখে হাঁসি পায় আবার খুব মায়াও হওয়া স্বাভাবিক। বহুদিন সোভিয়েত এর গুনগান গেয়ে সকালের ইয়ে করা থেকে রাতের আহারের পর সেই ঢেকুর তোলা হয়নি যে, তাই আজ সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ধুয়ো তুলে রুশ যুদ্ধ বিমান ওড়া দেখে হাততালি না দিয়ে থাকা যায় নাকি ?

রাশিয়া কি সত্যি সত্যি ইসলামিক স্টেট ও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে ? পুতিন কি মার্কিণ দখলদারি থেকে বিশ্ব কে মুক্ত করার ব্রত নিয়েছেন ? আসাদ এর সরকার কি বিপ্লবী বিক্রমে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ধ্বংস করতে সত্যিই উদ্যোগী ? আমরা এই সমস্ত প্রশ্নের উপর গভীর অনুসন্ধান ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত কে বিশ্লেষণ করেই সঠিক উত্তর পেতে পারি।  

১৯৫৬ সালে, স্তালিনের মৃত্যুর ৩ বছর পর, আনুষ্ঠানিক ভাবে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে খ্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সংশোধনবাদীরা ক্ষমতা দখল করে বিশ্বের প্রথম ও সর্ব বৃহত শ্রমিক শ্রেনীর রাষ্ট্রের এবং সেখানে পুঁজিবাদ কে পুন: প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজির শাসন রূপে। সেই পুঁজিবাদ অল্প কিছু বছরের মধ্যেই পররাষ্ট্রগ্রাসি ও উপনিবেশ - আধা উপনিবেশে পুঁজি রপ্তানিকারী এক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মাও জেদং এর নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এর তীব্র বিরোধিতা করে এবং এই সমাজতন্ত্রের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রসার করানো সোভিয়েত রাষ্ট্র ও তার নেতৃত্ব কে খোলাখুলি সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ হিসাবে চিন্তিত করেন।  বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুইটি শিবিরের জন্ম হয়, একদিকে সোভিয়েতপন্থী সংশোধনবাদীদের, যারা খোলাখুলি মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের নীতির পক্ষে ওকালতি করে ও পুঁজিবাদ থেকে শান্তিপূর্ণ (পড়ুন সংসদীয় কায়দায়) সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ঘৃণ্য মার্কসবাদ - লেনিনবাদ বিরোধী লাইন আমদানি করে। অন্যদিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও মাও জেদং এর নেতৃত্বে বিশ্বের বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন ঘনীভূত হয় এবং বিপ্লবের মাধ্যমে, এশিয়া -আফ্রিকা- দক্ষিণ আমেরিকার গ্রামাঞ্চল দিয়ে পৃথিবীর শহরাঞ্চল - ইউরোপ ও আমেরিকা কে জনযুদ্ধের মাধ্যমে দখল করার বিপ্লবী লাইনের পক্ষ অবলম্বন করে। দেশে দেশে জ্বলে ওঠে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জনযুদ্ধের আগুন।  ঠিক এমন সময়ে ১৯৬৯ সালে লিন বিয়াও কতৃক মাও জেদং এর চিন্তাধারার ভিত্তিতে যে রাজনৈতিক প্রস্তাব চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেসে গৃহীত হয় তার সারমর্মে বিশ্বের প্রধান চারটি দ্বন্ধ দেখানো হয় -: প্রথম দ্বন্ধ দুনিয়ার নিপীড়িত জনগণের সাথে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্ধ, পুঁজিবাদী ও সংশোধনবাদী দেশে পুঁজিবাদ ও শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যেকার দ্বন্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বাজার দখলের স্বার্থে দ্বন্ধ, এবং সমাজতান্ত্রিক দেশের সাথে সাম্রাজ্যবাদী ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বন্ধ। এই দ্বন্ধগুলির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে যে বাজার দখলের দ্বন্ধ ছিল তার ফলেই ঠান্ডা যুদ্ধ চরম রূপ ধারণ করে এবং এই দ্বন্ধে বেশিদিন নিজের মুখোস না ধরে রাখতে পারায় এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে দেশের তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক উপরিকাঠামোর দ্বন্ধের ফলে ৮০'র দশকের শেষ পর্ব থেকে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মসনদে ধস নামতে থাকে এবং শোধনবাদের তীব্র সংকটের মধ্যে দিয়ে ১৯৯১ এর শেষ লগ্নে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়, যে ঘটনা কে অতিরঞ্জিত করে বুর্জোয়া সাংবাদিকরা আজ পর্যন্ত কমিউনিজমের সংকটের ঝাল খায়।  

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ায় এবং য়েলত্সীন শাসনকালে রাশিয়ার ক্রমাগত দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ও একের পর এক উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশ হারানোর মধ্যে দিয়ে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ নিজের শক্তির পরিধি বাড়িয়ে ফেলে এবং রাশিয়ার সকল প্রাক্তন উপনিবেশ ও অর্ধ উপনিবেশে নিজের শাসন জারি করে।  এই সময়েই পৃথিবীতে মুক্ত বাণিজ্য, উদারনৈতিক অর্থনীতির বাড়বাড়ন্ত বাড়ে তীব্র গতিতে এবং মার্কিণ বহুজাতিক পুঁজি তার সর্বগ্রাসী রূপে অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে মুক্ত হতে পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় নিজের উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে থাকে।  রাশিয়া ধীরে ধীরে য়েলত্সীনের শাসন কালে এক বিধ্বস্ত দেশে রুপান্তরিত হয়, অর্থনীতিতে দেউলিয়া, রাজনীতিতে  বৈশ্যাবৃত্তির শিকার এক অবসাদের দেশে পরিণত হয়।  এই সময়ে প্রাক্তন কেজিবি অফিসার ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উঠে আসে য়েলত্সীন কে চাপ দিয়ে এবং চেচেন গৃহযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে নিজেকে রাশিয়ার মানুষের রক্ষা কর্তা হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাতে থাকে। পুতিন সেই কেজিবি অফিসারদের অন্যতম যারা গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত - পেরেস্ত্রোইকা নীতির সমর্থন তো করতো কিন্তু সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের এক ইঞ্চি জমিও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ কে ছাড়তে তৈরি ছিল না। সোভিয়েত রাশিয়ায় তাঁরা নিজেদের ক্ষমতা এক ফোটা খর্ব হতে দিতে তৈরি ছিল না, কিন্তু মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও গর্বাচেভের বিরোধী শিবিরের য়েলত্সীন নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং গর্বাচেভের পতনের রাস্তা সাফ করে দেয়, কেজিবি ভেঙ্গে পড়ায় পুতিনকে কর্মচ্যুত হয়ে প্রশাসনের চাকরিতে ঢুকতে হয়। 

রুশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর পুতিন গ্যাস্প্রম নামক এক সংস্থা কে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তলে, গ্যাস্প্রম এর সমস্ত পরিচালকবর্গ হয় প্রাক্তন কেজিবি এজেন্ট বা পুতিনের ঘনিষ্ট বুর্জোয়া। পুতিন বিরোধী মার্কিণ একচেটিয়া পুঁজির দালাল যেসব পুঁজিপতিরা রুশ দেশে য়েলত্সীনের আমলে অতি মাত্রায় ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, পুতিন তাঁদের গারদে পোরে নিজ পছন্দের রুশ একচেটিয়া পুঁজিকে অগ্রাধিকার দিতে। বিশ্ব জুড়ে জ্বালানি ব্যবসায় গ্যাস্প্রম  ক্রমাগত ভাবে নিজ পরিধি বিস্তার করতে থাকে এবং জর্জ বুশ শাসনকাল থেকেই মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ পুতিনের রুশ সাম্রাজ্যবাদের বারবৃদ্ধি রোখার জন্যে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি বানাবার প্রচেষ্টায় রত হয়।  এর ফলে পোল্যান্ড এর মাটিতে মার্কিণ ক্ষেপণাস্ত্র তাক করে রাখা হয় মস্কো কে নিশানা করে এবং বদলায় পুতিন তাঁর বিমান বাহিনীকে মার্কিণ নৌবহর কে চমকে দিতে ব্যবহার করে।  এই নয়া শীত যুদ্ধে একদিকে বিশ্বের সর্ব বৃহত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা তার অফুরন্ত উপনিবেশ ও অর্ধ উপনিবেশের উপর নির্ভর করে রুশ সাম্রাজ্যবাদ কে মাত দিতে থাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে।  পুতিন নিজের সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ কে গোপন করার পন্থা হিসেবে বেছে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্তালিন কে। খ্রুশ্চেভ আমলে যে স্তালিন কে রুশ শোধনবাদীরা রুশ জনগণের সামনে খলনায়ক সাজাবার প্রচেষ্টা করেছিল সেই স্তালিন কে রুশ দেশের 'জাতীয় নায়ক' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো পুতিন আমলে।  সোভিয়েত স্মৃতি উস্কে দিতে শুরু হলো বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ, লাল ফৌজের মহিমা প্রচার করে রুশ জনগণ কে ধোকা দিয়ে নয়া জার সাম্রাজ্যের প্রসার করার কাজ এগোতে থাকলো পুরোদস্তুর। 

সিরিয়া সেই খ্রুশ্চেভ পরবর্তী আমল থেকেই সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের এক আধা উপনিবেশ ছিল। বশর আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ এর শাসনকাল থেকেই সেখানে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সোভিয়েত একচেটিয়া পুঁজির বিনিয়োগের এক লোভনীয় গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে। মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের কাছে ইরাক - সিরিয়া ও ইরান এই তিনটি দেশ কে মার্কিণ একচেটিয়া পুঁজির নয়া উপনিবেশে পরিণত করা ভীষন দরকারী হয়ে ওঠে জ্বালানি সুরক্ষার জন্যে, এই লক্ষ্যে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এক যোগে ২০০৩ এ ইরাক আক্রমণ করে নিজস্ব পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং নজর দেয় ইরান ও সিরিয়ার উপর। ইরাক যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে মার্কিণ একচেটিয়া পুঁজি নিজের বিরুদ্ধে শুধু আরবদেরই নয় বরং প্রগতিশীল শান্তিকামী মার্কিণ নাগরিক সমাজের ক্ষোভও উস্কে দেয়।  প্রবল যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের ফলে বুশ কে গদি হারাতে হয় এবং শান্তির দূত সেজে ওবামা রাষ্ট্রপতি হয়।  ওবামার প্রশাসন মার্কিণ জ্বালানি সংকট থেকে বাঁচতে ও মার্কিণ একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির স্বার্থে সরাসরি যুদ্ধের জায়গায় রোনাল্ড রেগানের কায়দায় ছায়া যুদ্ধে নামে। সিরিয়াতে কোটি কোটি ডলার ঢেলে তৈরি করে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদীদের, যাদের মার্কিণ বাহিনী স্বাধীনতা সেনানী রূপে সহযোগিতা করার প্রকাশ্য ঘোষণা করে। এই কার্যকলাপে ফরাসী, ব্রিটিশ, জার্মান একচেটিয়া পুঁজি সমান ভাবে যোগদান করে এবং মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের নয়া উপনিবেশ তুর্কির সীমানা দিয়ে নিয়মিত সন্ত্রাসবাদীদের অস্ত্র ও রসদ যোগানোর কাজ চলতে থাকে আসাদের সরকারকে উত্খাত করার স্বার্থে।  

এর মধ্যেই এই তথাকথিত স্বাধীনতা সেনানীদের একটা বড় অংশ আল কায়দার সিরিয়ান সংস্করণ আল নুসরা কে শক্তিশালী করে তোলে। অন্যদিকে সিআইএ এর গুপ্তচর আল বাগদাদী গড়ে তোলে নব্য তালিবানী ইসলামিক স্টেট নামক চরম সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী যার প্রাথমিক কার্য হলো সিরিয়া দখল করা এবং অ-মুসলমান ও শিয়া মুসলমানদের নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ছড়ানো। মার্কিণ গুপ্তচর সিআইএ এর কিছু নথি থেকে এই কথাটা স্পস্ট হয়েছে যে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ নিজ স্বার্থেই তালিবানের কায়দায় এই ইসলামিক স্টেট কে তৈরি করেছে, যেমন তারা একদা সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ কে হারাতে তৈরি করেছিল লাদেনের আল কায়দা ও তালিবান কে।  

মার্কিণ ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের টাকায় ও অস্ত্রে বলিয়ান হয়ে এবং তুর্কির এরদোগানের সরকারের খোলাখুলি সমর্থনে ইসলামিক স্টেট সিরিয়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং জনগণের উপর নামিয়ে আনে অকথ্য অত্যাচার।  সিরিয়ার সরকারী ফৌজকে বহু জায়গায় ইসলামিক স্টেটের জঙ্গীদের কাছে পরাস্ত হতে হয় এবং এর সাথে যুক্ত হয় ইসলামিক স্টেট এর বিরুদ্ধে লড়াকু কুর্দিশ জনতার ফৌজ ওয়াইপিজি ও রোজাভার উপর তুর্কির গোলা বর্ষণ। মার্কিণ ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামিক স্টেট কে পরাস্ত করার নামে বিমান হানা চালিয়ে ইসলামিক স্টেট এর চেয়ে বেশি আসাদের সেনাবাহিনীকে নিশানা বানায়। এই ভাবে সিরিয়াকে ক্রমাগত ভাবে গিলে ফেলতে আগ্রাসী হয় মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য কাঠপুতুল সেনা। 

এই সংকট কালে দেশের জনগণ কে সশস্ত্র করে, ইসলামিক স্টেট ও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের বিপদের বিরুদ্ধে জাগ্রত করে দেশ ব্যাপী এক প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলার জায়গায় সিরিয়ার বশর আল আসাদ মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে দর কষা শুরু করে, এবং এই প্রচেষ্টায় রাশিয়ার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। রুশ তার সৈন্য বাহিনীকে সিরিয়াতে পাঠায় এবং মহা ধুমধাম করে ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য মার্কিণ কাঠপুতুল সেনার বিরুদ্ধে বিমান হামলা করা শুরু করে। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পেটোয়া সংবাদ মাধ্যম গেল গেল রব তোলে এবং ক্রমাগত রুশ বিরোধী প্রচার চালায়। রুশ অন্যদিকে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ কে সন্ধির বার্তা দেয়, আসাদ ঘোষণা করেন যে তিনি দেশের গৃহযুদ্ধ শেষ হলে সরে দাঁড়াতে তৈরি এবং পুতিন নিজের সাম্রাজ্যে বিন্দুমাত্র ঘাটতি না সয়েও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ কে এই বার্তা দেয় যে গৃহযুদ্ধ শেষে সিরিয়ার বাজার কে বন্টন করতে রুশ তৈরি যদি আমেরিকা তাদের শর্ত মানতে প্রস্তুত হয়।  আশ্চর্যজনক ভাবে মার্কিণ দোসর জার্মানি এই প্রস্তাবে সারা দেয় এবং ঘোষণা করে যে সিরিয়ার সংকট যুদ্ধ দ্বারা নয় বরং রাজনৈতিক ভাবে সমাধান করতে হবে।  মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ চাপে পড়ে সিরিয়া নিয়ে আলোচনায় রাজি হয় এবং আলোচনায় নিজের পাল্লা ভারী রাখতে রুশ চাপ দিয়ে ইরানকেও শরিক করে।  এর ফলে সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গি নিধন শেষ করে এবং আসাদের বিরুদ্ধে লড়াকু সমস্ত মার্কিণ কাঠপুতুল সেনা কে পরাস্ত করে রুশ সিরিয়াকে স্বাধীন ভাবে চলতে দেবে না বরং সে নিজ একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে সিরিয়াতে নিজের প্রতিপত্তি বাড়াবে এবং মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে সিরিয়ার ক্ষমতা ও বাজার মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভাগ করে নেবে।  

এই সমঝোতা করার ইচ্ছের সাথে শক্তি প্রদর্শন করে নিজের দাপট বজায় রাখার তাগিদ এখন রুশ ও মার্কিণ দুই পক্ষেই প্রবল রূপ ধারণ করেছে। মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ শক্তিশালী, সংকটে জরাজীর্ণ হলেও তার আছে প্রচুর আধা ও নয়া উপনিবেশ, বিশ্ব কে লুঠ করে সে যত ধন ঘরে তোলে প্রতি বছর তা কোনও কালে অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কল্পনাও করতে পারেনি।  অন্যদিকে জ্বালানির বাজারে মন্দার ছোঁয়া লাগায় রুশ সাম্রাজ্যবাদের অর্থনীতি ঘোর সংকটে, রাশিয়ার অর্থনীতি সংকটের মুখে এবং রুশের তেমন কোনও নয়া ও আধা উপনিবেশের ভান্ডার নেই যা দিয়ে সে এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করবে।  মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের পান্ডারা তাই রুশ কে নিয়ে চিন্তিত নয় অতটা, কারণ রাশিয়ার অর্থনীতি এখন বিশ্বের ১৫তম, সে দিক থেকে দেখলে স্পেনের পিছনে রাশিয়ার স্থান। কিন্তু মার্কিণ দুশ্চিন্তা হলো এই যে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে পুতিন চেষ্টা করবেন যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢেলে সিরিয়ার সংকট কে বেশিদিন জিইয়ে রাখতে এবং এর ফলে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ চটজলদি সিরিয়ার তেল ও গ্যাসের সম্পদে হাত দিতে পারবে না।    

আসাদ ক্রমাগত তাঁর রাজনৈতিক সত্তা ও স্বাধীনতা হারিয়েছেন, তিনি এখন শুধু মাত্র রাশিয়ার এক গুটি ছাড়া কিছুই নন, এবং যে কোনও দিন নিজের সাম্রাজ্য ও পুঁজির স্বার্থে পুতিন সরকার আসাদকে উত্সর্গ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। সিরিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এ এক বিশাল বিপদ, যা কোনও ভাবেই ইসলামিক স্টেট এর বিপদের চেয়ে কম নয়।  সিরিয়া নিয়ে ফাটকা খেলা মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ২০১১ তে শুরু করলেও এখন বাজারদরে রাশিয়া অনেক এগিয়ে। লেনিনের ভাষায় এদের দ্বন্ধ এখন বাজার ও কাঁচামাল দখলের দ্বন্ধ, লুঠের মাল বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্ধ।  এবং এই দ্বন্ধের ফলে জনগণ কে গোলাম বানাবে বিজয়ী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠির।  

সিরিয়ার মানুষ কে নিয়ে এই আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের জুয়া খেলার সময়ে বিশ্বের বিপ্লবী মার্কসবাদী শক্তির ভূমিকা কি হওয়া উচিত?

প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে যে এই মুহুর্তে সিরিয়াতে প্রধান শত্রু কে ? সিরিয়ার পরিস্থিতি ও মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক পট ভূমিকায় এই শত্রু নিশ্চিত ভাবে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসর অন্যান্য পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি। এই প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে এই মুহুর্তে কোন শক্তি প্রবল ভাবে লড়ছে? এই প্রশ্নের জবাবে মেকি মার্কসবাদীরা অবশ্যই রুশ কে দেখাবেন।  কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি যে আসলে রুশ মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ বা ইসলামিক স্টেট এর জঙ্গীদের সাথে লড়ছে না বরং শক্তি প্রদর্শন করে নিজের দর কষাকষির জায়গা তৈরি করছে। সিরিয়ার সেনা ও সরকার এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিজ শক্তির ভিত্তিতে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের বিরুদ্ধে লড়ছিল কিন্তু তারা আজ রাশিয়ার শরণার্থী এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে দর কষাকষি করে নিজেদের দেশের সম্পদ মার্কিণ ও রুশ দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে লুঠতে দিতে তৈরি।

অন্যদিকে কুর্দিশ জনতার ফৌজগুলি কুর্দ স্বাধীনতার স্বার্থে তুর্কি ও সিরিয়ার সরকার এবং ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য জঙ্গীদের সাথে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করছেন। আজ সিরিয়ার বিপ্লবী দেশপ্রেমিক শক্তির উচিত মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে রুশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্ধের সুযোগ গ্রহণ করা, কুর্দিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহযোগিতা করা এবং দেশব্যাপী মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের বাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা। এই লড়াই কে এই মুহুর্তে মার্কিণ - রুশ দ্বন্ধ যদিও অনেক সাহায্য করবে কিন্তু পরবর্তীকালে নিজ একচেটিয়া পুঁজির শোষণ লুণ্ঠনের অধিকারের স্বার্থে সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবে। সিরিয়াতে এক বিপ্লবী শক্তির উঠে দাঁড়ানো দরকার যা শ্রমিক - কৃষক ও মেহনতি মানুষের স্বার্থে সংগ্রাম করবে, কুর্দিশ স্বাধীনতার দাবিকে স্বীকার করবে এবং ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য মার্কিণ পদলেহী কুকুরদের বিরুদ্ধে লড়াইতে যুক্ত ভাবে সামিল হতে সিরিয়ার সরকারের উপর চাপ দেবে। রুশ বিমান হানার এইটুকু সুযোগ একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যেই সিরিয়ার বিপ্লবী দেশপ্রেমিক শক্তিগুলি নিতে পারে এবং তাকে ব্যবহার করে মার্কিণ পদলেহী ইসলামিক স্টেট, আল নুসরা ও অন্যান্য পেটোয়া বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারে। একই সাথে এই শক্তিকে দেশের মানুষ কে রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হবে সাম্রাজ্যবাদীদের জুয়া খেলার বিরুদ্ধে ও আসাদের দুর্বল নেতৃত্বের ব্যাপারে এবং তাঁদের নেতৃত্ব দেবে দেশ কে সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে।  

রুশ বিমান হানা দেখে উল্লাসিত সিরিয়া থেকে হাজারো মাইল দুরে বসা মেকি বামপন্থীরা কঠিন শ্রম দিয়ে মুক্তি সংগ্রামে খেটে খাওয়া মানুষকে সামিল করা কাকে বলে তা জানেন না।  যেহেতু রুশ বিমান হানা চালাচ্ছে তাই নাকি স্বতস্ফুর্ত ভাবে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহক ইসলামিক স্টেট ও আল নুসরা সহ অন্যান্য জঙ্গীদের পতন ঘটবে, এই বালখিল্য চিন্তা আজ মস্কো কে মুক্তির কেন্দ্র বানিয়ে নিজ দুর্বলতা ঢাকার এক জঘন্য প্রয়াসে পরিণত হয়েছে। বিপ্লবী বামপন্থী ও মার্কসবাদীদের এটা মনে রাখতে হবে যে রাশিয়া যুদ্ধে নেমেছে নিজ একচেটিয়া পুঁজির রক্ষা ও শক্তিবৃদ্ধির স্বার্থে, নিজ দেশের সংকট থেকে মানুষের চোখ ঘোরাবার স্বার্থে, কোনও ভাবেই মানব মুক্তির স্বার্থে না।  কারণ সাম্রাজ্যবাদ নিজেই মানবমুক্তির সব চেয়ে বড় শত্রু এবং সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস ব্যতিরেকে মানব জাতির সত্যিকারের কোনও কল্যাণ সম্ভব নয়।

                                              

মানুষ খেঁকো গরু ও ভারতের রাজনীতি

সোমবার, অক্টোবর ১৯, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

ছোটবেলায় ইস্কুলে গরুর উপর রচনা আমরা প্রায় সকলেই লিখেছি। পেন্সিলের ডগা চিবিয়ে খাতায় লিখতাম গরু একটি গৃহপালিত পশু, গরুর চারটি পা, দুইটি শিং, গরু ঘাস খায়, ইত্যাদী। ছোটবেলা থেকেই জানতাম গরু শান্তশিষ্ট স্বভাবের পশু, এর কোনো আক্রোশ নাই, এবং মূলত গরু তৃণভোজী প্রাণী।  কিন্তু আজ আমার চোখের সামনে সেই তৃণভোজী গরু ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে সাংঘাতিক এক মানুষ খেঁকো প্রাণী, অক্টোবরের শুরু থেকে আজ অবধি প্রায় তিনটি মানুষ কে গরু খেয়ে ফেলেছে, শুধু তাই নয় সারা দেশ জুড়ে মানুষ খেঁকো গরু এক আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। 

মহাম্মদ আখলাক নামক উত্তর প্রদেশের দাদরি জেলার এক বাসিন্দা কে গরু মাতার সন্তানেরা দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে প্রথমে। তাঁর দোষ ছিল যে তিনি নাকি গরু মাতার মাংস ভক্ষণ করেছিলেন, যাই হোক যদিও পরবর্তী কালে প্রমাণিত হয় যে তাঁর ফ্রিজে রাখা মাংস গরুর না বরং পাঁঠার, তবুও তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়। উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর জেলার এক যুবক নোমান কে শিমলার কাছে গরু ছানারা পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে গরু পাচারের অভিযোগের ভিত্তিতে, তাও আবার পুলিশের চোখের সামনে। বিজেপি শাসিত রাজ্যের গরু ভক্ত পুলিশ বীর বিক্রমে নোমানের সাথীদের গ্রেফতার করে জেলে পোরে, যদিও হত্যাকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কারণ তারা বানর সেনার (ওই বজরং দল আর কি) সদস্য। এই খুনের রেশ মিটতে না মিটতেই ফের ১০ দিন ধরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে হার মানেন কাশ্মীরি যুবক জাহিদ, যার ট্রাকে করে গরু পাচার হচ্ছে বলে গাড়িতে পেট্রল বোমা ছোড়ে জাতীয়তাবাদী নিরামিষাশী সন্ত্রাসবাদী ওরফে সংঘ সমর্থকরা।  

এই সকল হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে দেশজোড়া প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদে সামিল হলেও, মোদী জমানায় বিজেপি ও তার পিতৃদেব আরএসএস এর তাতে বয়েই গেল। বুক ফুলিয়ে আরএসএস মুখপত্র পাপী গো মাংস ভক্ষণকারীদের মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করার বিধান দেয় তার অনুগত নন্দী ভৃঙ্গীদের। কুত্সিত চিত্কার করে পথে নামে গেরুয়া বসনধারী গো সন্তানেরা। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী আদেশ দেন যে গো মাংস ভক্ষণ ত্যাগ করলে তবেই মুসলমানরা ভারতে বাস করবে। যদিও তিনি উত্তর পূর্ব ভারত, কেরল ও গোয়া সহ বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গো মাংস ভক্ষণকারী হিন্দু ও খ্রিস্টানরা কি করে ভারতে থাকার লাইসেন্স পাবেন তা নিয়ে মৌন ব্রত ধারণ করেন। এই সুযোগে উচ্চ বর্ণের হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হিমাচল প্রদেশের হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে সমগ্র দেশে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করে গরুর রক্ষনাবেক্ষণ হেতু গৌ শালা তৈরি করার আদেশ দেয়।  ঠিক যেমন জম্মু কাশ্মীরের আদালত হঠাত হিন্দু ধর্মের অনুভূতির সুরসুরি দিয়ে কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রের আইন দ্বারা গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করে। 

সারা দেশের মানুষকে হঠাত এই গরু চক্রে বেঁধে বিজেপির কি লাভ হচ্ছে ? প্রাথমিক ভাবে এটা স্পষ্ট যে সারা দেশের ৩১% ভোট পেয়ে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গত বছর দেশে ক্ষমতা দখল করেছে। বিজেপি নিশ্চিত ভাবে জানে যে তাদের কোনো মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক নাই ফলে যত বেশি করে হিন্দুদের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের পাঁকে ফেলা যাবে তত বেশি করে তারা দেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার চালাতে পারবে। তাই আজ ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণ ভেদের সমর্থক আরএসএস হঠাত করে শোষিত দলিত ও আদিবাসী সমাজকে তাদের দিকে টানার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একের পর এক প্রচার কার্য চালাচ্ছে। দলিত ও আদিবাসীদের একটা বড় অংশ কে টেনে আনতে পারলে বিজেপির হিন্দু ভোটের সমীকরণের রাজনীতির ষোলো আনায় আঠারো আনা আদায় হবে এবং কর্পোরেট পুঁজির কাছে আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড় - জঙ্গল - নদী জলের দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে। 

দ্বিতীয়ত: বিজেপির সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতা আজ দেশের আপামর জনগণের সামনে প্রকাশ্য হচ্ছে। নির্বাচনের পূর্বে মোদীর বড় বড় ভাষণের ফানুস  আজ মানুষের সামনে ফেটে পড়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের লাগাম ছাড়া মূল্য বৃদ্ধি, গণ বন্টন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রয়াস, সামাজিক প্রকল্পের খাতে ব্যাপক ব্যয় সংকোচ, খেটে খাওয়া মানুষের উপর শোষনের রোলার চালানো, বিদেশী পুঁজির কাছে ভারতবর্ষের সম্পদকে পাইকারী মূল্যে বেচে দেওয়া, ইত্যাদি যখন সরকারের উপর মানুষের আক্রোশ বাড়ছে, বিশেষ করে ২রা সেপ্টেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘটে ব্যাপক হারে শ্রমিক শ্রেনীর সামিল হওয়ায় কর্পোরেট পুঁজি ও তাদের রক্ষিতা বিজেপির শ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগার ঠিক তখন সরকারের কাছে হয় যুদ্ধ লাগানো না হয় দাঙ্গা লাগিয়ে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিজেদের শোষণ শাসনের নীতি প্রণয়ন করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নাই। 

এই উপরোক্ত কারণগুলির জন্যে আজ সারা দেশ জুড়ে গরুকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার আবরণ হিসাবে ব্যবহার করছে বিজেপি ও তার পিতা আরএসএস। যত বেশি করে মানুষের উপর শোষণ ও অত্যাচারের বোঝা বাড়বে তত বেশি করে এদের এই প্রচেষ্টায় ঘি ঢালবে গেরুয়াধারীদের চাঁদা যোগানকারী বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি, দেশী জোতদার -জমিদার ও মুত্সুদ্দি পুঁজিপতিরা। মুসলমান নিধন ধর্মের চেয়ে বেশি কর্মের তাড়না এই সত্যটি মানুষের কাছে অবশ্য বেশি দিন গোপন থাকবে না। কারণ গরুর আবরণ চিরকাল মানুষের দৃষ্টি থেকে আরএসএস এর কুকর্ম কে আড়াল করবে না। তৃণ ভোজী গরু যখন গণ আন্দোলনের ঠেলায় ক্ষিপ্ত হয়ে শিং বাগিয়ে আরএসএস - বিজেপি ও তাদের বানর সেনার পিছনে ছুটবে তখন কিন্তু গেরুয়া বসনধারী মেকি সন্ন্যাসী ও সাধুদের বাঁচাতে স্বর্গ থেকে কোনও দেবদূত বা অবতার আসবে না।  এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।   
                         

দুর্গাপুজোর চাঁদা, পুজোর নামে মোচ্ছব, ক্লাব কাহিনী ও অন্যান্য

শুক্রবার, অক্টোবর ১৬, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

দূর্গা পুজো যাকে আমরা মূলত শারদ উত্সব হিসেবে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের প্রধান জাতীয় উত্সব হিসেবে জানি, তা আজ বানিজ্যকরণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের এক অস্ত্র হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেছে। মূলত হিন্দু সমাজের উচ্চ জাতির সামন্ত প্রভুদের এই উত্সব বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশক অবধি মূলত জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানে অনুষ্ঠিত হত, এবং চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষ বোসের প্রচেষ্টায় মূলত একটি বারোয়ারি পুজো হিসেবে কলকাতার মধ্যবিত্তদের পাড়ার গলিতে প্রবেশ করে। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে বারোয়ারি দুর্গাপূজার হিরিক বাড়ে প্রথম যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের আমল থেকে, মানে সেই ১৯৬৭ সাল থেকে যখন জ্যোতি বোস প্রথম গৃহ মন্ত্রী হয়ে পুলিশ দিয়ে শ্রমিক - কৃষক আন্দোলন দমন করা শুরু করে। ১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই বারোয়ারি পুজোর ব্যাপ্তি শহর ছাড়িয়ে মফত্সল ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, সরকারী দান ধ্যানে ও সিপিএম এর লোকাল কমিটির নেতাদের বদনত্যায় ব্যাঙের ছাতার ন্যায় বহু ক্লাব ঘর গজিয়ে ওঠে এবং দূর্গা পুজোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বলা বাহুল্য এই সকল ক্লাবের রাজনৈতিক সমীকরণের বদল হয় মমতাময়ী মা - মাটি - মানুষ সরকারের আমলে। পাড়ার কাউন্সিলর থেকে তৃণমূলী নেতারা পুজো কমিটির মাথায় বসে, এবং তথাকথিত বামপন্থীদের নাস্তিক সাজা ন্যাকামি বাদ দিয়ে এই দক্ষিণপন্থীদের নেতৃত্বে পুজো কমিটিগুলি হয়ে ওঠে অতি মাত্রায় আগ্রাসী ও পুজোর ব্যয় বেড়ে চলে হুহু করে সাথে চলে ক্লাবের দাদাদের মোচ্ছব। 

চাঁদা না তুললে দূর্গা পূজা বারোয়ারি ভাবে হয় না।  চাঁদা না দিলে দাদাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুরসুরি লাগে এবং তারা তখন বাড়ির দরজার সামনে ছিল চিত্কার জুড়ে দেন, কখনো দিদির দুষ্টু ভাইদের ন্যায় চাঁদা দিতে অপারগ প্রতিবেশীর দেওয়ালে বা গ্রিলের সামনে হিসি করে দিয়ে পালিয়ে যায়, বা বাজারে ও গলিতে অশ্রাব্য শ্লোক পাঠ শুরু করে গৃহ কর্তা কে দেখে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিজেপির মোদী সরকারের যোগ করা হিন্দু ধর্মের আগ্রাসী ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট দর্শন, যার ফলে এখন চাঁদা চাওয়াটা এক রকম সংবিধানিক অধিকারে দাঁড়িয়েছে।  চাঁদা তো দাদা হিন্দু ধর্মের স্বার্থে, না দিলে আপনি দেশদ্রোহী, দিলে অবশ্যই দেশ প্রেমী। 

ধরুন আপনি অ-হিন্দু এক মুসলমান বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ এবং পাড়ার দাদারা আপনার দরজায় রসিদ নিয়ে হাজির। আপনি বললেন যে আপনি হিন্দু নন, তাহলে কি? মা তো সবার, টাকা ছাড়া কি চলবে বন্ধু ধর্ম তো সব এক! তখন আপনি জানতে চাইলেন যে ধরুন আমি পাড়ায় একটি মিলাদ শরিফ বা খ্রিস্টমাস উদযাপন করতে চাই এবং এর জন্যে যদি ঘর প্রতি এক শত টাকা চাঁদা তুলি? তখন আপনাকে জানানো হবে যে আপনার ধর্মটি এই দেশের বা এই রাজ্যের ধর্ম নয় এবং ওই সব উত্সবের খরচা কোনও ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ গর্বিত হিন্দুরা দিতে রাজি নয়। আপনি বললেন যে তাহলে আমি কেন অন্য ধর্মের উত্সবে চাঁদা দিতে বাধ্য ? তখনই ঝুলি থেকে বেড়াল বেড়িয়ে আসবে, সংখ্যালঘু প্রীতি দেখানো দিদির ভাইরা আপনাকে আরএসএস এর কায়দায় চোখ রাঙিয়ে জানিয়ে দেবে, এই দেশ হিন্দু দেশ এবং এখানে থাকতে গেলে আপনাকে অবশ্যই হিন্দু ধর্মের (তথাকথিত শ্রেষ্ঠতার দর্শনের) স্বার্থে দাদাদের মদ মাংসের টাকা যোগাতে হবেই।      

চাঁদার রসিদ মোটামুটি পাঁচশো টাকার আসেপাশে ঘোরাঘুরি করছে, যার ফলে সাধারণ গরিব শ্রমজীবি মানুষ, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ নিদারুণ সংকটে পড়ছেন। চাঁদা না দিলে পাড়ায় থাকা যাবে না, চলতে বসতে আপনাকে অপমানিত হতে হবে, তাই ছেলের দ্বিতীয় জামার বদলে ওই ক্লাবের ছেলেদের চাঁদার নামে তোলা দেওয়ায় শ্রেষ্ঠ পন্থা হয়ে ওঠে। এই অত্যাচারে একপ্রকার সকলেই অতিষ্ঠ, তবুও মানুষ আগ্রাসী তৃণমূলী সন্ত্রাসের ভয়ে, নিজের পাড়ায় এক ঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে, বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্ত্রাসের ভয়ে চুপচাপ ফুলে ছাপের মতনই নীরব থাকা শ্রেষ্ঠ মনে করেন।  

পুজোর নামে এই সন্ত্রাসী আক্রমণ চলবে দূর্গা থেকে সরস্বতী পুজো অবধি, প্রতি মাসে আপনাকে গুনতে হবে অসংখ্য টাকা শুধু পাড়ার ছেলেদের মদ - মাংস খাওয়ানোর টাকা যোগাতে। কেন দিতেই হবে পুজোর চাঁদা ? এতে সাধারণ গরিব মানুষের কি লাভ ? যে গরিব কৃষকের ফসল মারা গেল, যে বন্ধ কারখানার শ্রমিক পেট চালাতে দিন মজুরের কাজ করছে তাঁর এই পুজোর মোচ্ছবে কি লাভ হচ্ছে ? পুজোয় শুধু লাভের মুখ দেখে একের পর এক পুজো কমিটি যারা পুজোর চাঁদার টাকার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করছে, লাভ তোলে কংগ্রেসী (তৃণমূলী সহ) ও গৈরিক বাহিনীর নেতারা যাদের বদন্যতায় পুজো কমিটিগুলি মোচ্ছব করতে পারে লোকের টাকায়। এই ক্লাবগুলি থেকে বেড়িয়ে আসে ভোটের পদাতিক বাহিনী যারা আপনাকে বুথে কোন বোতাম টিপতে হবে তা জানিয়ে দেয়।  এই কারণেই এদের তোয়াজ করে চলে সমস্ত ভোট বাদী দলের নেতৃত্ব এবং সেই সমর্থনের ছাতার তলায় এই সব ক্লাব মানুষের ওপর শোষণ অত্যাচারের রোলার চালিয়ে বারোয়ারি পুজোর নামে মোচ্ছব করার টাকা তোলে।  

যত দিন এই আধা সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও তার অনুষাঙ্গিক পঁচা সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকবে ততদিন চলবে ধর্মের নামে এই শোষণ ও অত্যাচারের রোলার, যার সাথে সত্যিই মিলিয়ে দেখলে ওই দাদরীতে গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে ঘটিত হত্যাকান্ডের কোনও ফারাক নাই। আজকের নতুন প্রজন্মের যুব সমাজের উচিত মানুষের টাকায় এই ভাবে শহর ও রাজ্য জুড়ে চলতে থাকা বাত্সরিক মোচ্ছব উত্সবের তীব্র বিরোধিতা করা এবং মানুষকে সংঘবদ্ধ করে এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এ না হলে সারাজীবন শুধু কষ্টে অর্জিত টাকা তথাকথিত ধর্মীয় আবেগের সুরসুরি মেটাতে চলে যাবে, আর ফুলে ফেঁপে উঠবে কিছু মদন মিত্তির।        

           

ব্যাপক শ্রমিক ঐক্যের স্বার্থে আজ প্রয়োজন শ্রমিক-কর্মচারীদের মঞ্চ

বুধবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

শ্রমিক সংঘ গুলির মধ্যে এক ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তোলা ও তার মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেনীর সংহতিমূলক সংগ্রাম গড়ে তোলা আজ এক জরুরি কর্তব্য রূপে দেখা দিচ্ছে।  ৮০'র দশকে সিপিআই (এম-এল) নেতা মহাদেব মুখার্জী শ্রমিক ঐক্য কেন্দ্র নামে একটি মঞ্চ গঠন করেন, যার কর্মসূচি ছিল শ্রমিকদের, বিশেষ করে চটকল শ্রমিকদের বিভিন্ন ইউনিয়নে ভাগ হয়ে থাকা শ্রমিকদের একটি ঐক্যের জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাতে করে তাঁরা তাঁদের ইউনিয়ন করতে করতে অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে  বাঁধায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন।  গোঁড়াতে এই মডেল এ সাফল্য পাওয়া গেলেও পরবর্তীকালে শ্রমিক ঐক্য কেন্দ্র এক ধরণের বিলুপ্তির শিকার হয়।  অথচ আজকের পরিস্থিতিতে যখন শ্রমিক শ্রেনীর সংগ্রামগুলি বিভিন্ন বাম ও দক্ষিণপন্থী ইউনিয়নের পতাকাতলে বিভাজিত হয়ে রয়েছে, সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্র ছাড়া শ্রমিকদের স্থানীয় সংগ্রামে ইউনিয়নগুলির কোনো ঐক্যই যখন চোখে পড়ে না এবং যখন নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতির চোলাই জোর করে শ্রমিকদের খাওয়ানো হচ্ছে, তখন এই রূপ একটি মঞ্চ বড় বেশি জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। 

শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম পারে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক - ফ্যাসিবাদী রাজনীতির মোকাবিলা করতে। আজ একের পর এক শ্রমিক বিরোধী নীতি ও প্রস্তাব গ্রহণ করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার যখন তার মালিক মার্কিন বৃহত পুঁজির কাছে দেশের স্বার্থ কে অর্পণ করছে, তখন শ্রমিকদের দেশব্যাপী সংগ্রাম গড়ে তোলা আজ এক জরুরি কর্তব্য। প্রধানত শ্রমিকদের আজ লড়তে হবে সারা দেশে সমান হারে ন্যুনতম বেতনের দাবিকে উর্দ্ধে তুলে। একদিকে যখন বিজেপি সরকার প্রাক্তন সেনাদের জন্যে এক পদ এক পেনশন নীতি সমর্থন করছে ও সেই নীতি নানা কায়দায় প্রণয়ন করার নাম করে প্রাক্তন সেনাদের লবিকে তোয়াজ করছে, যখন তারা রাজ্যে - রাজ্যে কর বৈষম্য তুলে দিয়ে কর্পোরেট ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলির স্বার্থ রক্ষায় অভিন্ন পণ্য ও পরিষেবা করের ব্যবস্থা প্রণয়ন করার প্রস্তাব সংসদে রাখছে এবং সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিকে এই বিষয়ে আলোচনায় বসার ডাক দিচ্ছে তখন শ্রমিকদের স্বার্থে সারা দেশে অভিন্ন ন্যুনতম মজুরি আইন পাশ করাতে বিজেপির সামনে বাঁধা কি ? কোন রাজনৈতিক দল খোলাখুলি এমন কোনো আইনের বিরোধিতা করে তা লোকসভায় বা রাজ্যসভায় রুখে দেওয়ার চেষ্টা করবে? তাহলে শ্রমিকদের স্বার্থে এমন আইন আনতে বাঁধা কোথায় ?


বাঁধা হল মোদী সরকারের শ্রেণী স্বার্থ।যে শ্রেনীর স্বার্থ রক্ষা করার ব্রতী হয়েছে মোদী সরকার, সেই শ্রেনিগুলির স্বার্থ রক্ষা হয় একমাত্র চরম নগ্ন ভাবে শ্রমিকদের শ্রম কে শোষণ করে এবং তাঁদের ন্যায্য অধিকার হরণ করে। তাই দেখা যায় যখন দেশের জনগণের উপর নানা ভাবে পরোক্ষ করের বোঝা বাড়িয়ে চলেছে অরুণ জেটলি ঠিক সেই সময় কারণে অকারণে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি কে উদারতার সাথে কর ছাড়ের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হচ্ছে, এমন কি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কালেও যেটুকু অধিকার শ্রমিক শ্রেণী উপভোগ করতে পারতো তাও আজ বিজেপি সরকারের খাঁড়ার কোপে পড়ছে।  বাজারী সংবাদ মাধ্যমগুলি তারস্বরে চিত্কার করে এই সমস্ত শ্রমিক মারা নয়া উদারনৈতিক নীতিগুলিকে দু হাত তুলে সমর্থন করছে, তারা মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করছে যে এই রকম ভাবে মালিক স্বার্থ রক্ষাকারী আইন কানুন থাকলে দেশে বিনিয়োগের আবহাওয়া তৈরি হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে।  কিন্তু একটি সত্য তারা কেউ বলে না যে, এই সমস্ত নয়া উদারনৈতিক নীতি প্রণয়ন করার পর থেকে ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম ভাবে বেড়েছে, বেকার সংখ্যা ক্রমাগত উর্ধ্বমুখী হয়েছে এবং মালিক পক্ষের তরফ থেকে কল কারখানা বন্ধ করে শ্রমিক কর্মচারীদের পেটে লাথি মারার ঘটনাও বেড়েছে চরম ভাবে। 


আমরা দেখেছি কি ভাবে সংবাদ মাধ্যম ও উচ্চবিত্তদের বড় অংশ ইন্টারনেট সহ প্রচার মাধ্যমের সকল জায়গায় প্রাক্তন সেনা কর্মীদের জন্যে এক পদে এক পেনশন ব্যবস্থা প্রণয়নের আন্দোলনকে সমর্থন করে এসেছে। এই সমর্থনের কারণ দেশের বিশাল সেনা বাহিনীকে নিজেদের পক্ষে রাখার প্রচেষ্টা। অথচ যে মুহুর্তে ট্রেড ইউনিয়নগুলি জোট বেঁধে শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরী মাস প্রতি ১৫০০০ টাকা করার দাবি তুলছে তখন ক্ষিপ্ত হয়ে হায়নার মত শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবির উপর বিজেপি ও তার দালাল পেটোয়া প্রচার মাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ছে।  যদিও শ্রমিকদের এই মজুরী কেন্দ্র সরকার বা রাজ্য সরকার কে নয়, দিতে হবে সেই সব বৃহত মুত্সুদ্দি পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে, তবুও এই ক্রোধ ও বিদ্বেষ প্রমান করে যে শ্রমিকদের তাঁদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য দিতে আজ এই সব কর্পোরেটদের বুক কাঁপছে।  এই সমস্ত কর্পোরেট সংস্থাগুলি চায় একমাত্র নগ্ন শ্রমিক ও সম্পদ শোষণ ও লুণ্ঠনের অধিকার, যে দল বা যে সরকার এদের এই ঘৃণ্য অভিলাষা পূর্ণ করতে সক্ষম হবে তার পক্ষে এরা প্রচার করবে এবং সেই দল কে ভোটে জিতিয়ে আনতে কোটি কোটি টাকা খরচা করবে।  

আজ বিজেপি - আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এই সমস্ত কর্পোরেটদের নয়নতারা হয়েছে এই কারণেই যে এরা দাঙ্গা হাঙ্গামা - জাতি ও ধর্ম বিদ্বেষের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির মাধ্যমে প্রথমত শ্রমিক ঐক্য ভাঙ্গতে ওস্তাদ, অন্যদিকে এরা খোলাখুলি রাখঢাক ছাড়া শ্রমিক বিরোধী মালিক তোষণকারী নীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম, যা ভারতের বেশির ভাগ ভোটবাজ পার্টি পারে না। তাই আজ মোদী সরকারকে দেশের শাসক শ্রেণী নিজেদের কাঁধে তুলে নাচছে।  

শ্রমিক মারা এই নীতিগুলির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বর্তমান সংগ্রাম বড়ই বিছিন্ন ও অনৈক্যে ভরা।  তার কারণ দেশের মধ্যে সমস্ত শ্রমিক সংগঠনগুলি, ট্রেড ইউনিয়নগুলি আজ নিজেদের অভিভাবক পার্টির নীতি গ্রহণ করে শ্রমিক সংগ্রামে আগুয়ান হতে ব্যর্থ। যদি এক জায়গায় বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন আন্দোলন করে মালিকের বিরুদ্ধে তবে সেখানে নিজেদের সুবিধাবাদী অবস্থান বজায় রেখে বিরোধী ইউনিয়ন মালিকের পক্ষ নেবে। সর্ব ভারতীয় শ্রমিক ধর্মঘটেও  এই ভাগাভাগি প্রকট হয়েছিল এবং ২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটের সাফল্য অর্জনের পর শ্রমিক ইউনিয়ন এর নেতারা আর কোনও বৃহত আন্দোলনের পথে না নেমে শুধু অপেক্ষা করার নীতি গ্রহণ করে বসে থাকলো।  এই ভাবে ইউনিয়নগুলির ভেদাভেদের ফলে মার খাচ্ছে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তোলার কাজ, এবং এইরূপ অবস্থায় শ্রমিকদের ঐক্য অর্জনের জন্যে একটি যৌথ মঞ্চ গঠন করা খুব জরুরি।  

নীতিগত ভাবে এই মঞ্চে যে কোনও ইউনিয়নের শ্রমিকরা যোগ দিতে পারবেন ও ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংগ্রাম করতে পারবেন কর্পোরেট সংস্থা ও মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে সেই ব্যবস্থা গড়ে তোলা আজ শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে কাজ করা সংগঠকদের এক অবশ্য কর্তব্য। নিত্য নতুন নতুন কারখানায় - অফিস কাছারীতে শ্রমিক ও কর্মচারীদের উপর আক্রমণ বাড়ছে এবং এই অবস্থায় শ্রমিক - কর্মচারীদের একটি ঐক্যের মঞ্চে এনে এবং ইউনিয়নগুলির সংকীর্ণ গন্ডির থেকে বের করে নতুন ভাবে রাজনীতিতে শিক্ষিত করে তোলার জন্যে এই রকম একটি মঞ্চ আজ বিশেষ ভাবে গড়ে তোলা দরকার। 

কি রকম হবে এই মঞ্চ ?

যে কোনো ইউনিয়নের শ্রমিক সভ্য বা তার বাইরের শ্রমিকরাও এই মঞ্চে যোগদান করতে পারবেন।ইউনিয়নগুলির ঝান্ডা ছাড়াই এই মঞ্চে তাঁরা সামিল হলে একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে ঘোষিত শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে তাঁদের ইউনিয়ন থেকে বহিস্কৃত করতে পারবে না সেখানকার নেতৃবৃন্দ আবার ইউনিয়নগুলির থেকে স্বাধীন মঞ্চ হওয়ার কারণে এই মঞ্চে ইউনিয়নের নীতি মেনে কারুর সাথে হাত মেলানো বা না মেলানোর কোনও বাঁধা থাকবে না। আধুনিক কলকারখানা ও অফিস কর্মচারীগণ, যাদের ইউনিয়ন করার অধিকার মালিকপক্ষ ও সরকার কেড়ে নিয়েছে, তাঁরাও এই মঞ্চে যোগ দিয়ে বৃহত সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এই ভাবে একই মঞ্চে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ইউনিয়নগুলির বাইরে যে সমস্ত শ্রমিক ও কর্মচারীগণ আছেন তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন। 

আন্দোলনের দিশা নির্দেশ 

প্রতিটি রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই শ্রমিক ও কর্মচারীদের শিক্ষিত করে তোলা যেমন এই মঞ্চের প্রধান কাজ হবে, যাতে তাঁদের চেতনার মান উন্নত হয় এবং তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে অগ্রগামী হন, তেমনি সেই সমস্ত শ্রমিক কর্মচারীদের স্বার্থে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে তাঁদের সামিল করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ও আন্দোলনের দিশা নির্দেশ ঠিক করা এই মঞ্চের কাজ হবে।  নেতৃত্ব সবসময় শ্রমিক ও কর্মচারীদের হাতেই রাখতে হবে যাতে তাঁরা স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন এবং সেই সিদ্ধান্ত কে কার্যকরী করার জন্যে যাবতীয় নীতি ও কৌশল গ্রহণ করতে পারে। এই মঞ্চ কে রাজনৈতিক ভাবে সক্ষম ও উন্নত করে তোলা ছাড়া এই মঞ্চের কর্মকান্ডে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ শ্রমিক সংগঠক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ কে করতে দেওয়া উচিত হবে না। বরং যত বেশি শ্রমিকরা রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত হয়ে নিজেরা সংগ্রামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন তত বেশি করে তাঁদের চেতনার মান এবং লড়াই করার ক্ষমতার উন্নতি হবে।  
  

            
        

ঔরঙ্গজেব - কেন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীদের কাছে একটি ঘৃণ্য নাম ?

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

ঔরঙ্গজেব কেন হিন্দুত্ববাদীদের কাছে একটি ঘৃণ্য নাম?


কিছুদিন ধরে কানে আসছিল যে আরএসএস নাকি এখন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব কে নিয়ে নানা ধরণের প্রচার চালাচ্ছে, যা একপ্রকারে আমরা ছোটবেলার থেকে ভারতের স্কুল শিক্ষা ও হিন্দু পারিবারিক শিক্ষায় যা শিখে এবং শুনে আসছি তারই নামান্তর। ঔরঙ্গজেব নাকি ভীষন অত্যাচারী সম্রাট ছিল এবং হিন্দুদের সে নাকি দু চক্ষে দেখতে পারত না, তাঁর শাসনকালে নাকি লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের ধরে ধরে মুসলমান বানানো হয়েছে এবং সে নাকি ভারতের বহু হিন্দু মন্দির ধবংস করেছে। ঔরঙ্গজেব মানেই খুন খারাপ, অত্যাচার, লুন্ঠন ও হিন্দুদের মুসলমানে ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা। এই শিক্ষাটি আমাদের শিরায় শিরায় আরএসএস এর জন্মদাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দুই শত বছর ধরে ঢুকিয়ে আসছে যাতে ভারতীয়রা তাঁদের স্বাধীন মুঘল সাম্রাজ্যকাল থেকে ব্রিটিশদের পদদলিত হয়ে দাসের জীবন বাঁচা কে শ্রেয় মনে করে।  

আবুল মুজ্জাফার মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ ঔরঙ্গজেব স্বাধীন ভারতের শেষ শক্তিশালী মুঘল সম্রাট ছিলেন। তাঁর শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের ভূখন্ডে দক্ষিন ও মধ্য পশ্চিম ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে যুদ্ধ চালায়। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের দক্ষিন অঞ্চলের দুই মুসলমান শাসিত রাজ্য, আদিল শাহীর বিজাপুর ও কুতুবশাহীর গোলকন্ডা ভারতের মুঘল সাম্রাজ্য যুদ্ধ করে দখল করে।  বিদারের যুদ্ধে সিরি মারজান কে পরাস্ত করতে ভারতের মুঘল ফৌজ প্রথমবার রকেট ও গ্রেনেড ব্যবহার করে যা আমাদের দেশের সেই সময়ে ভাঙ্গন ধরা সামন্তবাদী ব্যবস্থা ও উদীয়মান দেশী পুঁজিবাদের একটি লক্ষণ ছিল।  ১৬৬৩ তে ঔরঙ্গজেবের নেতৃত্বে ভারতের মুঘল সরকার লেহ ও লাদাখে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে।    


যে কোনও জাতি, ব্যক্তি, ধর্ম, ঘটনার বিশ্লেষণ বা বিচারের আগে আমাদের প্রয়োজন সেই সব ব্যক্তি, জাতি, ধর্ম বা ঘটনার সময়কালের পারিপার্শ্বিক দুনিয়াকে জানা এবং সেই পরিবেশের, চেতনার মানের, পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা। ঔরঙ্গজেব একজন অত্যাচারী সম্রাট ছিলেন, প্রশ্ন হলো সম্রাট মাত্রেই কি অত্যাচারী হতেন না ? কিছু ব্যতিক্রম ছিলেন যাদের নিয়ে আজও বহু আলোচনা হয় আর বাকিদের ব্যাপারে সভা কবিদের বন্দনা ভজনা কে মনে রেখে কেউ কেউ তাঁদের বীরত্বের গাথা আজও গান আর কেউ কেউ কোনও রাজা - বাদশার নাম শুনলেই গালাগাল দেন। ঔরঙ্গজেব অন্যান্য রাজা - বাদশাদের থেকে কোনও ভাবেই আলাদা ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল মুঘল সাম্রাজ্য কে বাঁচিয়ে রাখা এবং তার পরিধি বৃদ্ধি করা। সেই লক্ষেই ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজত্ব চালিয়েছিলেন যা তাঁর পিতা শাহজাহানের থেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।  কিন্তু ষোড়শ শতকে যখন ঔরঙ্গজেব রাজত্ব করছিলেন তখন ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার বলে কিছু হত না, কারণ মানব সভ্যতা তখনও সেই স্তরে উন্নত হয়নি যে গণতন্ত্র - প্রজাতন্ত্র ইত্যাদী মানুষের চেতনায় জায়গা নেবে।  জনগণ সেই সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা, উত্পাদনের প্রক্রিয়া ও সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থেকে ধীরে ধীরে সামন্তবাদের ধ্বংসের দিকে যাচ্ছিলেন।  যে ব্রাক্ষন্যবাদ শত শত বছর ধরে ভারতের জনগণের উপর জগদ্দলের মতন চেপে বসে ছিল সেই পাথরকে ইসলামে দীক্ষিত মুঘল সম্রাটরাও সরাবার চেষ্টা করেনি তাঁদের রাজত্ব বাঁচাবার ও সাম্রাজ্য বাড়াবার তাগিদে।


ঔরঙ্গজেব ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। ইতিহাসে কোনও রাজা সম্রাট ধর্ম নিরপেক্ষ ছিলেন না কারণ তাঁদের নিজেদের সভার ধর্মগুরুদের মতামত নিয়ে স্বিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হত।  কিন্তু ঔরঙ্গজেব কি অন্য ধর্মের প্রতি অত্যাচার করা কে তাঁর রাজনীতি বানিয়েছিলেন? বা এমন কোনো মুঘল বাদশাহ ছিলেন কি যিনি অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার করে গেছেন? ঔরঙ্গজেব ইসলামিক শারিয়া আইন চালু করে সেই সময়কার উত্তর ভারতে মদ্যপান, জুয়া ও বৈশ্যাবৃত্তি নিষিদ্ধ করেন।  তাঁর রাজত্ব কালে রাজপুত জয় সিংহ তাঁর সেনাপতি হিসাবে বিখ্যাত হন, রাজপুতদের তিনি মনসাব্দারী দেন এবং মধ্য ও দক্ষিন ভারতে যুদ্ধ চালাবার সময়ে মুঘলদের সৈন্যদের হাতে কোনো মন্দির ভাঙ্গা হয়নি, যদিও সেই সময় তাঁরা ঔরঙ্গজেব এর বিরোধী ব্রাক্ষণ গোষ্টির নেতৃত্বে চলা উত্তর ভারতের বহু মন্দির ভেঙ্গে দেন।  ১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ভারতে সতী প্রথা নিষিদ্ধ করেন, যা আকবরের আমলে প্রথম নিষিদ্ধ হওয়ার পর আবার পুরোদমে চালু হয়ে যায়। ঔরঙ্গজেব শাহজাহান বা জাহাঙ্গীরের মতন সরকারী অর্থে মোচ্ছব পালন করা, মহল ও প্রাসাদ তৈরি থেকে দুরে থাকেন ও হিন্দুদের উপর ৫% হারে জিজিয়া কর চাপান ও মুসলমানদের উপর ২.৫% জাকাত কর চাপান।  এর ফলে তিনি ব্রাক্ষণদের বিরাগভাজন হন।


শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের সাথে ঔরঙ্গজেবের লড়াই বহুদিন চলে এবং এই লড়াইতে উস্কানি দেন পাহাড়ি রাজ্যের হিন্দু রাজারা, যারা মুঘল সম্রাটের কাছে শিখ গুরুকে পরাস্ত করার আবেদন জানান। কিন্তু শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের সাথে ছিলেন বহু মুসলমান এবং মুঘল সম্রাটের পক্ষে ছিলেন বহু হিন্দু এবং একজন পৌত্তলিকা পুজারী না হয়ে তিনি অন্য একজন পৌত্তলিকা পূজা বিরোধীকে কেন পৌত্তলিকা পূজারীদের কথা শুনে মারতে চাইছেন - এই প্রশ্ন তুলে গুরু গোবিন্দ সিংহ ঔরঙ্গজেব কে ভর্ত্সনা করেন।  এ ছাড়াও মহারাষ্ট্রে শিবাজীর বিরুদ্ধে মুঘল সম্রাট তাঁর সামরিক অভিযান চালান এবং পরবর্তীকালে শিবাজীর পুত্র কে হত্যা করেন।  হয়তো বা এই সব নিদর্শন তুলে আমাদের দেশের হিন্দু ফ্যাসিবাদী শক্তি ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে চায় তাদের সাধের হিন্দু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বার্থে ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করতে।  কিন্তু তারা কেউ এ কথা বলে না যে ঔরঙ্গজেবের সমস্ত সামরিক কর্মকান্ড ছিল রাজনৈতিক এবং এর সাথে ধর্মের প্রচারের চেয়ে বেশি জরুরি ছিল তাঁর সাম্রাজ্য বাড়াবার তাগিদ। যে তাগিদ সেই সময়ের সমস্ত রাজার মধ্যেই ছিল কারণ সকলেই তাঁদের সাম্রাজ্য কে বিস্তারিত করতে চাইতেন।


তবে ঔরঙ্গজেব যে কারণে ইতিহাসে ঘৃণিত হয়েছেন তার কারণ এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যখন তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তখন থেকেই ইতিহাস কে বিকৃত করে পরিবেশন করে সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়ানো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের ঔরসজাত আধুনিক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের মজ্জাগত হয়ে গেছে।   স্বাধীন মুঘল ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রথম বড়সর ধরনের পরাজয় স্বীকার করতে হয় ১৬৮৬-১৬৯০ অবধি চলা চাইল্ড যুদ্ধে। বোম্বাই ও মাদ্রাসে ব্রিটিশ ফৌজ ঘেরাবন্দী হয়।  সিদ্দী ইয়াকুব এর নেতৃত্বাধীন নৌ বহর এবং তার সাথে হাবিশ ফৌজের আক্রমণে ব্রিটিশ ফৌজরা ধরাশয়ী হয়।  সমঝোতা করতে যখন ব্রিটিশরা মুঘল সাম্রাজ্যের পায়ে পড়ে তখন মুঘল সম্রাটের দরবারে তাদের বিশাল অঙ্কের অর্থ ক্ষতিপূরণ দিতে হয় এবং মুঘল সম্রাটের সামনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মাথানত করে গড় করতে হয়, যার ফলে তারা ছাড়া পায়। এর পরে হেনরি এভরি নামক জলদস্যু যখন হজযাত্রীদের জাহাজ আক্রমন করে তখন ঔরঙ্গজেব ব্রিটিশদের উপর আবার আক্রমণ নামিয়ে আনেন এবং ব্রিটিশদের সমস্ত কারখানা ও ব্যবসা বন্ধ করিয়ে দেন।  এর ফলে ব্রিটিশরা সেই সময়ে ৬ লক্ষ পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিয়ে শাস্তির হাত থেকে বাঁচে এবং পৃথিবীতে প্রথমবার বিশ্বজুড়ে একজন অপরাধী কে ধরতে অভিযান শুরু হয়।  যদিও সেই সময় হেনরি এভরি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।


ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঔরঙ্গজেবের এই যুদ্ধগুলি, ব্রিটিশদের পরাজয়, এবং মাটিতে নাক খত দেওয়ার কাহিনী আজও আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষার ঔরসজাত আধা ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাত্র - ছাত্রীদের জানতে দিতে চায় না। কারণ এই যুদ্ধগুলি ছিল স্বাধীন ভারতের দ্বারা তত্কালীন বিশ্বের সর্ব শক্তিমান রাষ্ট্রের বাহিনীকে পরাস্ত করার ঘটনা।  যা হয়তো আমাদের দেশের যুব ছাত্ররা জানলে তাঁদের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে গর্ব বোধ হবে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি হবে।  


ব্রিটিশরা কোনো কালেই এই অপমান হজম করতে পারেনি এবং এর ফলে তারা মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে বিকৃত করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার ঘৃণ্য কৌশল গ্রহণ করে। যার ফলে আজও শৈশব থেকে ইতিহাসের পাতায় ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট নেতিবাচক শিক্ষাই দেওয়া হয় এবং কোনও ঐতিহাসিক এই নিয়ে বিশেষ উত্সাহ নিয়ে স্বাধীন গবেষণা করেন না। ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা তকে পাশ করে এই দেশের ছাত্র -ছাত্রীদের মধ্যে ব্রিটিশ ও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি এক বিশেষ ধরণের দুর্বলতা জন্মায়। তাঁরা ভাবে যে ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা ভারতীয়দের থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ এবং আমরা আজও অসভ্য। আমরা ট্রেনে - বাসে -ট্রামে - অফিসে এই আলোচনা অনেক শুনেছি যে ব্রিটিশরা থাকলে নাকি দেশের অনেক উন্নতি হত ! এবং এই কথা বলেন এ দেশের তথা কথিত শিক্ষিত মধ্য বিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষেরা !

ঔরঙ্গজেব সম্রাট ছিলেন স্বাধীন ভারতের, যে ভারতের মানুষ কে বিদেশীদের গোলামী করতে হতো না, যে ভারতে মানুষকে অন্য দেশের পুঁজির স্বার্থে নিজের শ্রম, জল, জঙ্গল, জমি, জীবিকা উত্সর্গ করতে হত না।  তাঁরা বাঁচতেন স্বাধীন ভারতের মাটিতে, যে মাটিতে আমরা প্রায় ৩০০ বছর ধরে বিদেশী পুঁজির গোলামী করছি প্রাণ ও মান খুইয়ে। সত্যিকারের কোনো দেশপ্রেম থাকলে তা অবশ্যই বিদেশী পুঁজির গোলামী কে ঘৃণা করবে এবং দেশের স্বাধীন বিকাশের ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করবে। যারা এর উল্টোটা করে তারা মেকি ও ভন্ড দেশ প্রেমিক এবং এদের অবিলম্বে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হোক।                    
     









প্রতিবাদে - প্রতিরোধে সামিল হলেন কোটি কোটি শ্রমিক - কর্মচারী এবং স্তব্ধ হলো ভারত

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

প্রতিবাদে - প্রতিরোধে সামিল হলেন কোটি কোটি শ্রমিক - কর্মচারী এবং স্তব্ধ হলো ভারত। বাজারী সংবাদ মাধ্যম ও কাগজগুলির ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বিটকেল চিত্কার, ধর্মঘটকে ওদের 'উন্নয়ন বিরোধী' বলে গাল দেওয়া সত্তেও দেশের ১৫ কোটি সংগঠিত শ্রমজীবি মানুষ ও কোটি কোটি অসংগঠিত শ্রমিক - কর্মচারীগণ যৌথ লড়াইয়ের মাধ্যমে ২রা সেপ্টেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘট সফল করলেন। 

বাংলা - ত্রিপুরা - কেরালা তো স্তব্ধ হলোই, সাথে সাথে যুক্ত হলো মুম্বাই সহ মহারাষ্ট্র, বিহার, উত্তর প্রদেশ, ওডিশা, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, উত্তরাখন্ড, দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব,  তামিল নাডু, গোয়া, কর্নাটক,  তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশ। মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ধর্মঘটে সামিল হলেন হাজারো কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী, ব্যাঙ্ক কর্মচারীগণ, এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। সরকার কে হজম করতেই হলো বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। আরএসএস আশা করেছিল যে তাদের শ্রমিক সংঘ - বিএমএস কে ধর্মঘট থেকে সরিয়ে নিয়ে হয়তো তারা ধর্মঘটকে ধাক্কা দিতে পারবে কিন্তু সে আশা যে গুড়ে বালি তা ২রা সেপ্টেম্বর প্রমাণ হলো উত্তর ও মধ্য ভারতে যেখানে বিএমএস এর শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রভাব বেশি।  

কেন্দ্রীয় সরকারের জন বিরোধী ও শ্রমিক বিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে, বিদেশী বৃহত এক চেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির তোষণের বিরুদ্ধে এই ধর্মঘটে সামিল হয়ে নিজেদের প্রতিবাদ বধির রাষ্ট্র ও তার মালিক শ্রেণীগুলি কে ধাক্কা দিয়ে জানানো ছাড়া আর কোনো পথই শ্রমিক - কর্মচারী, মেহনতী জনগণের কাছে খোলা নেই।  এবার সময় হয়েছে এই লড়াই কে আরও তীব্র করে তোলা, যাতে বিদেশী বৃহত একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে শ্রমিক-কৃষক- খেটে খাওয়া মানুষের উপর শোষণ অত্যাচারের রোলার চালানোর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, এবং এই কাজে আজ শ্রমিক শ্রেণীকে বিশেষ করে অংশ গ্রহণ করতে হবে। 

সারা দেশে ধর্মঘটের সময়ে বিছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া বড় হিংসার কোনও খবর না থাকলেও পশ্চিম বাংলা কিন্তু এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো। যেমন আশংকা গত কয়েকদিন যাবত করা হচ্ছিল সেই ভাবনার সাথে তাল রেখেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বদন্যতায় তার দলীয় গুন্ডা বাহিনী দিকে দিকে পুলিশের সাথে সাথে ধর্মঘটকারীদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে। তাদের হিংসাত্মক আক্রমণের শিকার হন বহু শ্রমজীবি ধর্মঘট সমর্থনকারী, এবং বামপন্থী ধর্মঘট সমর্থনকারীদের অভিযোগ যে পুলিশের সাথে সাথে এই লুম্পেন বাহিনীকে সরাসরি পরিচালনা করা হয়েছে নবান্ন থেকে। 

প্রশ্ন হলো যেখানে বিজেপি শাসিত রাজ্যেও আরএসএস বা বিজেপি কর্মীরা অস্ত্র হাতে ধর্মঘট সমর্থনকারীদের উপর ঝাঁপালো না, সেখানে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও তার সাগরেদরা বাড়িয়ে কেন ধর্মঘট সমর্থনকারীদের আক্রমন করছে ? তাও আবার যখন ধর্মঘট রাজ্য সরকার বা তৃণমূলের কোনো নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়নি ? 

এর তিনটি মূল কারণ আছে। প্রথমত: মমতা ব্যানার্জী তার নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী সরকারের শেষ বছরে বিদেশী বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি, ও তার দেশীয় দালালদের ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তার সরকার ও পার্টি পুঁজির উলঙ্গ শোষনের পক্ষে যথাযত প্রয়াস চালাবে আগামী পর্বে জিতলে। দেশী ও বিদেশী পুঁজির প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে জ্যোতি বোসের কায়দায় তার সরকারও পিছপা হবে না সেটা জানান দেওয়া ছিল তৃণমূলী গুন্ডাদের দ্বারা ধর্মঘটে সামিল শ্রমিক ও কর্মচারীদের উপর হামলার প্রধান কারণ।  
দ্বিতীয় কারণ : মোদী সরকারের প্রতি তার মৈত্রী বার্তা পাঠালো মমতা সরকার, যাতে বিজেপি মমতার সাথে কৌশলগত ভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার রাস্তা খোলা রাখে, সারদা কেলেঙ্কারী কান্ডে মদনের থেকে আগে না আসে, এবং ফিরতি হিসাবে সংসদের অধিবেশনে মমতার গোমস্তাদের বিজেপির সমস্ত বিল পাশে সমর্থনের প্রতিশ্রুতিও থাকলো এই শ্রমিক আন্দোলন দমনের নামে।  
তৃতীয় কারণ : রাজ্যে আগামী বছরের নির্বাচনে সরকারী বামেদের বিকল্প হিসাবে শক্তিবৃদ্ধিতে নেহাতই আতঙ্কে মমতার সরকার ও পার্টি, তার শুকনো কথায় যে চিড়ে ভেজেনি গোটা বাংলা তার সাক্ষী দিচ্ছে।  কৃষকের আত্মহত্যা বাড়ছে তীব্র ভাবে, চাষের সংকট গভীর হচ্ছে, সেচ উন্নয়ন না হওয়ায় এবং সরকারী উদাসীনতায় ফি বছর শস্য হয় খরায় না হয় বন্যায় নষ্ট হচ্ছে, শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন, লক আউট হচ্ছে বেশি বেশি, শিক্ষিত বেকারদের জন্যে চাকরীর সুযোগ অনেক কম, বাকি দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বেতন মান কম, এবং সর্বোপরি রিয়েল এস্টেট, সিন্ডিকেট, ও তেলে ভাজা বাদে এই রাজ্যে নতুন কোনও শিল্প গড়ে ওঠেনি, কর্ম সংস্থান তো দুরের কথা।  তাই ধর্মঘট সমর্থনকারীদের পিটিয়ে শুধু গায়ের ঝাল মেটানো নয়, সাথে সাথে আগামী বছরের নির্বাচনের আগে একটা ভীতি ও সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করাও এই আক্রমণের অন্যতম কারণ। 

শত বাঁধা সত্তেও, বাজারী আনন্দবাজারের বিলাপ সত্তেও এই রাজ্যের শ্রমিকরা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই করে যে ভাবে ২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটকে বাংলায় সফল করেছেন তার জন্যে তাঁদের জানাতেই হচ্ছে অশেষ অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। এই লড়াই করে তাঁরা প্রমাণ করলেন আবার কবি সুকান্তের সেই কবিতা আজও কত প্রাসঙ্গিক - 

বন্ধু, তোমার ছাড়ো-উদ্বেগ, সুতীক্ষ করো চিত্ত,

বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।

মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন,
একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন।

ঘরে তোলো ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখো কাস্তে,
গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে।

আজ দৃঢ় দাঁতে পুঞ্জিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত,
প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুত আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত।

আজকে মজুর হাতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত,
আসে সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত।

ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য,
বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য!

সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পূব দরজায়,
ফেনী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষিপ্ত জনতা গর্জায়।

বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ম করো চিত্ত,
                                      বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।                                     

বাজারী খবরের ঝোলায় স্থান নেই কালবুর্গির

মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

বাজারী সংবাদপত্রগুলিতে খুললেই পড়তে পারবেন মুম্বাই শহরের শিনা বরা হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে দুর্গাপুরের সুচেতা - দীপাঞ্জনা হত্যাকান্ডের খবর, এবং এই হত্যাকান্ডগুলি নিয়ে নানা ধরণের গবেষণা বিশ্লেষণ। পরকীয়া, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, লোভ, লালসা, যৌনতা মেশানো এই সব গল্পের মাধ্যমে আমাদের বোঝানো হচ্ছে যে মানুষ আজ কত অমানবিক হয়ে উঠেছে, কেউ নিজের মেয়েকে নিজের প্রাক্তন স্বামীর সাথে মিলে হত্যা করছে তো কেউ শিশু কন্যা সহ এক মহিলাকে হত্যা করে ইলেকট্রিক কাটার দিয়ে টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভরে নদীতে বইয়ে দিচ্ছে। সত্যি ! ঘটনাগুলি বড় অমানবিক। কিন্তু অবাক হই যখন বাজারী কাগজগুলির প্রথম পাতায়, আর ভিতরের পাতায় শুধুই পড়ি ইন্দ্রানী মুখার্জীর পরকীয়ার কাহিনী, একের পর এক পুরুষ সঙ্গী বদল করে আরও ধনী হওয়ার প্রয়াস। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার সমরেশ কি খেল, লক আপে কি ভাবে ঘুমুলো তার গল্প তাড়া করে হারাতে চাইছে কোটিপতি ইন্দ্রানীর গল্পকে। আর এই সব খবরের মাঝে ছোট হয়ে গেল কর্ণাটকের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও লিঙ্গায়ত জাতির উপর বিশিস্ট গবেষক এম.এম কালবুরগির হত্যাকান্ড। যে হত্যাকান্ড মহারাষ্ট্রের দাভলকার, গোবিন্দ পানসারে হত্যাকান্ডের সাথে যুক্ত করলো বিশিস্ট শিক্ষাবিদের নাম।  

এম.এম কালবুরগি ছিলেন একজন মুক্তমনা গবেষক ও শিক্ষাবিদ, এক কালে তিনি কন্নাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন, এবং লিঙ্গায়ত জাতি, যা উত্তর কর্ণাটকের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি এবং বিজেপি - আরএসএস এর প্রধান সমর্থক ভিত্তি, সেই জাতির ইতিহাসের উপর গবেষণা করে তিনি এক সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে সামন্তবাদী ধার্মিক রীতি নীতি ও অন্ধবিশ্বাসের প্রবল সমালোচনা করেন। বিশেষত যে বাসব কে লিঙ্গায়াত জাতি তাদের জাতির প্রতিষ্ঠা পুরুষ হিসাবে গন্য করেন, সেই বাসবের জীবনের এক দ্বান্ধিক বিশ্লেষণ তিনি করেন ১৯৮৯ সালে যা লিঙ্গায়াতদের মৌলবাদীদের ভীষন ভাবে ক্ষুন্ন করে।  এই গবেষণার ফলে কালবুর্গির জীবনের উপর নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। তাঁর বিরুদ্ধে তত্কালীন সময়ের হিন্দুত্ববাদীরা চড়াও হয়, তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা পর্যন্ত বের হয় এবং তাঁকে বাধ্য হয়ে পুলিশের সুরক্ষা নিতে হয়। তাঁর পরিবার ও তাঁর জীবন সংকট হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে রফা সূত্র বের করতে হয় নিজের গবেষণা থেকে বাসবের উপর লেখা অনেকাংশ বাদ দিয়ে, যা পরবর্তীকালে তিনি তাঁর মধ্যেকার 'বুদ্ধিজীবি সত্তার আত্মহত্যা' বলে অভিহিত করেন।  

কালবুর্গির হত্যা হয় তাঁর বাড়ির ভিতর, বসার ঘরে। দুইজন আততায়ী ৩০শে অগাস্ট সকালবেলায় তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে হত্যা করে খুব সহজে পালিয়ে যায় এবং এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। এই বিশিস্ট মুক্তমনা বুদ্ধিজীবির হত্যাকান্ড নিয়ে বাজারী সংবাদ মাধ্যম বেশি মাথা ঘামাতে রাজি নয় কারণ এই খবরে যৌন আবেদন নেই, বিকৃত মানসিকতার বহি:প্রকাশ নেই, নেই সাসপেন্স ও থ্রিলার, তাই বাজারে এক প্রবীন বুদ্ধিজীবির হত্যার খবর খাবে না, তার উপর কালবুর্গির হত্যার অভিযোগের তীর যখন ঘুরছে গেরুয়া সন্ত্রাসীদের দিকে তখন তো সেই বিষয়ে লেখা নৈব নৈব চ।  বাজার চায় বিকৃত মানসিকতা, বাজার চায় যৌন অনুভূতিতে সুরসুরি দেওয়া খবর এবং বাজারী চাটুকার সংবাদ মাধ্যম ও তার সাংবাদিকরা তাই কাঠি নিয়ে সেই সুরসুরি দেওয়ার সুযোগ খুঁজছে গোটা দেশজুড়ে।  তাই দেশের সব খবর থাক ভিতরে - প্রধান খবর ইন্দ্রানী মুখার্জীর কেচ্ছা কাহিনী আর সমরেশের মানসিক বিকৃতি। 

                     

২রা সেপ্টেম্বরের দেশজোড়া শ্রমিক - কর্মচারীদের ধর্মঘট কে জিততেই হবে

সোমবার, আগস্ট ৩১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

২রা সেপ্টেম্বরের দেশ জোড়া শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট কে ভাঙ্গার কথা প্রকাশ্যে ঘোষনা করে মমতা ব্যানার্জী সরাসরি মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের প্রতি তার নৈতিক সমর্থনের ইঙ্গিত দিলেন, তার সাথে তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে তাতিয়ে তুললেন তার ছাত্র পরিষদ কর্মী সমর্থক থুড়ি গুন্ডা বাহিনী কে যাতে তারা ৬০-৭০ এর দশকের যুব কংগ্রেস - ছাত্র পরিষদের মত সরাসরি বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের উপর হামলা করে ধর্মঘট ভাঙ্গার কাজ করতে পারে। এই আস্ফালনের প্রেক্ষাপট হলো মমতার পুলিশের দ্বারা ২৭শে অগাস্ট নির্মম ভাবে নবান্ন অভিযানে সামিল কৃষকদের মিছিলের উপর দমন পীড়ন। একদিন মিছিল আটকে মমতা ও তৃণমূলী সরকারের স্থির বিশ্বাস হয়েছে যে তারা শ্রমিক ও কৃষকদের যে কোনও লড়াই ভাঙ্গতে পারবে তাদের দলদাস প্রশাসনকে লেলিয়ে দিয়ে।   

২রা সেপ্টেম্বরের দেশ জোড়া শ্রমিক - কর্মচারীদের ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ডান - বাম মিলিয়ে ১১ টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন, কিন্তু ধর্মঘট থেকে শেষ মুহুর্তে আরএসএস এর চাপে পিছু হটে সংঘ পরিবারের শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সংঘ। এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে মোদী সরকারের জন বিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে। গত এক বছর ধরে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার তার পূর্বসূরী কংগ্রেস সরকারের পথ ধরে চলে বড় বড় কর্পোরেটগুলির, বিদেশী বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি ও তার দেশী দালাল পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করার জন্যে জনগণের ঘাড়ে নামিয়ে আনছে একের পর এক ভয়ানক কোপ।  যেমন শ্রম আইন সংস্কার করে দেশের শিল্প ক্ষেত্রে কর্মরত এক বিরাট অংশের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো। ন্যুনতম মজুরি বাড়ানোর যে সংগ্রাম সারা দেশব্যাপী মূল্য বৃদ্ধির বাজারে শ্রমিক শ্রেণী চালিয়ে আসছে তার প্রতি নির্মম পরিহাস করে লোক দেখানো ভঙ্গিতে যত সামান্য বাড়ানো হলো মজুরি, অন্যদিকে কর ছাড় সহ নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে মালিক শ্রেণীকে দেওয়া হচ্ছে অঢেল লাভ কামাবার উপায়।  ৮ ঘন্টার কর্মদিবস আউটসোর্সিং ও এসইজেড এর দৌলতে আগেই শ্রম দুনিয়া থেকে চলে গেছে অতীতের রক্ষনাগারে, এবার ১০-১২ ঘন্টার নিয়মিত কর্ম দিবস করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীকে ক্রীতদাসের মতন ব্যবহার করার স্বার্থে। ওভারটাইমের জায়গায় এখন নিয়মিত কর্মদিবসেই শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেশি বেশি খাটিয়ে প্রচুর মুনাফা কামাবার লালসায় বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজিপতিরা, তাদের ভারতীয় দালাল পুজিপতি ও তাদের পেটোয়া বাজারী সংবাদ মাধ্যমগুলি এই তথা কথিত শ্রম আইন সংস্কারের নামে শ্রমিকদের উপর শোষনের বোঝা ভারী করার ষড়যন্ত্র কে 'সাহসী পদক্ষেপ', 'বলিষ্ঠ পদক্ষেপ', ইত্যাদী বলে সাধুবাদ দিছে। 

দেশের বেসরকারী ক্ষেত্রে কর্মরত কর্মচারীদের অবস্থাও শ্রমিকদের মতনই অসহনীয় পর্যায় নেমে গেছে।  বিপুল মূল্যবৃদ্ধির বাজারে বিদেশী বৃহত একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের তল্পিবাহকদের প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিম্ন পদে কাজ করা কর্মচারীদের বেতন বাড়ছে যত সামান্য, অন্যদিকে ম্যানেজমেন্ট এর বেতন বাড়ছে হুহু করে। সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে, শূন্যপদে লোক নিয়োগ বন্ধ রেখে ঠিকা কর্মচারীদের দিয়ে পূর্ণ কর্মচারীদের বেতনের ১/১০ অংশ দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, বেসরকারী ক্ষেত্রের মতন কোনও সুযোগ সুবিধা কর্মচারীদের দেওয়া হচ্ছে না। তার উপর শ্রমিক - কর্মচারীদের  সারা জীবন ধরে সঞ্চিত প্রভিডেন্ট ফান্ড এর টাকা এবার সরকারের পক্ষ থেকে বৃহত একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি কে ভেট হিসাবে দান করা হচ্ছে শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলার জন্যে। এর ফলে অবসরের পরে পথে নামবেন বহু শ্রমিক ও কর্মচারীরা, আর তাঁদের টাকা মেরে দিয়ে লালে লাল হবে এক শ্রেনীর ফাটকাবাজ পুঁজিপতি।      

এই পরিস্থিতিতে একদিকে মমতা যখন বৃহত এক চেটিয়া পুঁজির চাপে ও সারদা কেলেঙ্কারির ঠেলায় তার পুরানো মিত্র বিজেপির সাথে সন্ধি করেছেন গোপনে - ধরি মাছ না ছুই পানি - নীতি অবলম্বন করে এবং আক্রমণের তীর ঘুরিয়েছেন শ্রমিক কৃষকদের সংগ্রামের দিকে তখন স্পষ্টতই তার মন্তব্যের ও হুমকির মধ্যে দিয়ে এটা পরিস্কার হচ্ছে যে তিনি কাদের স্বার্থ রক্ষা করতে চান।  কেন তিনি শ্রমিক - কৃষক বিরোধী মোদী সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলির আর খোলাখুলি বিরোধিতা করতে পারছেন না সে কথা তিনি স্পস্ট করে  বাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের জানাতে দ্বিধা বোধ করছেন কেন ? তার ধর্মঘট বিরোধিতার অর্থই হলো যে তিনি খোলাখুলি ভাবে মোদী সরকারের কর্পোরেট তোষণ রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ালেন, যেমন দাঁড়িয়েছিলেন বাজপেয়ীর সরকারের বিলগ্নীকরণ ও উদারীকরণের নীতির পক্ষে সেই ২০০০-২০০৪ সালে। কিন্তু শুধু মাত্র মুসলমান ভোট খুয়ে যাবার আতঙ্কে উনি এখনো সর্ব সমক্ষে বিজেপির সাথে হাত মেলাচ্ছেন না।  

মমতার সরকার কিছুদিন মুখে মুখে বিজেপির বিরোধিতা করলেও সংসদে অন্যান্য বিরোধীদের থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখে দর কষাকষি চালিয়ে যায় বিজেপির বিরুদ্ধে।  তাই পেঁয়াজ সহ সমস্ত তরী তরকারী, চাল, ডাল, তেল সহ খাদ্য বস্তু ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চরম মূল্যবৃদ্ধি সত্তেও তারা কোনও কেন্দ্র বিরোধী লড়াইয়ে জোট বাঁধেনি। রাজ্যের কোনও জায়গায় পেঁয়াজের কালোবাজারী রুখতে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারী উদ্যোগে সঠিক দামে পেঁয়াজ বন্টনের ব্যবস্থাও মমতা ব্যানার্জীর সরকার করেনি। এরা ভাত দেওয়ার মুরোদ রাখেনা, কিন্তু কিল মারার গোঁসাইয়ের ভূমিকায় ভালো ভাবেই উত্তীর্ণ হয়।    
পশ্চিম বাংলায় একদিকে যখন আজ মূল্যবৃদ্ধির সূচক বেড়ে চলেছে, গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের হেঁসেল থেকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়েছে মাছ, মাংস, ডাল, ও সবুজ তরী তরকারী, কর্ম সংস্থানের সুযোগ কমায় লোটা কম্বল নিয়ে প্রবাসে যেতে বাধ্য হচ্ছে অসংখ্য তরুণ - তরুণী, অন্যদিকে যখন এই রাজ্যে অবস্থিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি, কর্পোরেট সংস্থাগুলি কলকাতা ও পশ্চিম বাংলাকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে 'কম খরচের জায়গার' নাম দিয়ে অন্যান্য রাজ্য ও শহরের তুলনায় প্রচুর কম বেতনে কর্মচারীদের দিয়ে একই রকমের কাজ করায় (যদিও দিল্লি ও কলকাতায় জীবন যাপন করার খরচায় কোনও তারতম্য নজরে পরেনি ডালহাউসি তে রাস্তায় সস্তার ভাত মাছ ছাড়া) তখন কিন্তু আমরা মমতার গর্জন শুনি না ওই বিদেশী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে, তাদের দেশীয় মারোয়ারী - গুজরাটি - বাঙালি পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে। সমস্ত গর্জন আর হুমকি তিনি লুকিয়ে রাখেন শ্রমিক ও কৃষকদের, কর্মচারী ও ছাত্র যুবদের বিরুদ্ধে। তার কারণ, মমতার শ্রেণী স্বার্থ বিজেপির থেকে অভিন্ন, তার শ্রেণী স্বার্থ জড়িয়ে আছে জোতদার - জমিদার বিদেশী ও দেশী পুঁজিপতিদের সাথে।তাই শুনি প্রতিবার ধর্মঘট ভাঙ্গার হুমকি, শ্রমিক -কৃষক-ছাত্র-যুব-মহিলাদের সংগ্রাম দমনের হুঙ্কার।            

ধর্মঘট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনীর এক অবিচ্ছেদ্য অধিকার, তাঁর গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের হাতিয়ার। এই অধিকার তাঁর থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না এবং কারুর চাপে সে নিজে থেকে এই হাতিয়ার সমর্পণ করবে না। আগামী ২রা সেপ্টেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘট সংগ্রামে বিপুল ভাবে শ্রমিক ও কর্মচারীরা অংশ গ্রহণ করে মোদী সরকারের কর্পোরেট তোষণের নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নিজেদের দাবি জানাবেন এবং নিজেদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার লড়াইতে তীব্র গতিতে এগিয়ে যাবেন।  মমতার পুলিশ, যুব তৃণমূল, তৃণমূলী ছাত্র পরিষদ, গুন্ডা বাহিনী, বোমা-গুলি-লাঠি কোনও কিছুই শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির এই লড়াইকে রুখতে পারবে না। 

সেই ১৯৫৯ সালের ৩১শে অগাস্ট বিধান রায়ের কংগ্রেসী পুলিশ নির্মম ভাবে কলকাতার রাজপথে পিটিয়ে পিটিয়ে খুন করেছিল ৮৯ জন নিরীহ - ক্ষুদায় কাতর কৃষকদের, ২০১৫ সালের ২৭শে অগাস্ট মমতার তৃণমূলী পুলিশ পিটিয়ে আহত করলো নিরস্ত্র কৃষকদের, আর ২রা সেপ্টেম্বর লড়াই হবে শ্রমিকের আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে মমতার বৃহত পুঁজির স্বার্থে শ্রমিকদের উপর ফ্যাসিস্ট দমন পীড়ন নামিয়ে আনার ষড়যন্ত্রের। এ হবে রাজপথে খোলাখুলি দুই শ্রেনীর, শোষিত ও শোষকের শ্রেণী যুদ্ধ, এবং এই লড়াইতে শ্রমিকশ্রেণী কে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করে জিততে হবেই।              


এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে