শিক্ষা কে পণ্যতে পরিণত করার বিরুদ্ধে জোট বাঁধা আজ ভীষণ জরুরী

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর পড়ার সময়ে আমাদের ফি দিতে হয়েছিল সেমেস্টারে ১৮০/- টাকা। সেই টাকার মধ্যে আমাদের ল্যাবরেটরি ফি-ও হয়ে যেত। আমাদের সাবসিডিয়ারি সাবজেক্ট-এর মধ্যে ছিল কেমিস্ট্রি, যে ল্যাবে আমরা যথেচ্ছ দামি কেমিক্যাল খরচা করেছি। আমাদের অনার্স সাবজেক্ট ছিল ফিজিক্স, যাতেও থিয়োরি ক্লাস ছাড়া ল্যাবও করতে হত। এত কিছু খরচা সত্ত্বেও ওই ফি-এর টাকায় আমাদের শিক্ষার ব্যবস্থা হয়ে যেত। কী ভাবে? সরকার এই খরচা বহন করত। সরকার কোথা থেকে পেত? পাবলিকের দেওয়া করের টাকা থেকে। সেই পাবলিকের মধ্যে আমরাও তো ছিলাম। সেই পাবলিকের মধ্যে ছিলেন অসংখ্য মানুষ যাদের শ্রমে চলছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোটা দুনিয়ার চাকা। একটা বিড়ি খেলেও যারা সরকারকে কর দেন। তাদের সবার দেওয়া টাকায় চলত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। তদুপরি যাদবপুরে পড়ার সময়ে প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার চল ছিল না। ফলে আমরা তিন বছরের গ্র্যাজুয়েশন করতে পেরেছিলাম ১৮০/- টাকা সেমেস্টার ফি জমা দিয়েই।

এর ফলে আমাদের লোন নিতে হয়নি। এর ফলে আমাদের বাড়ির কাছে হাত পাততে হয়নি। প্রথমটার বিপদের কথা অনেকে বলেন। দ্বিতীয়টার বিপদও খুবই মারাত্মক। বাড়ির কাছে হাত পেতে শিক্ষার খরচা নিতে হলে সেই 'শিক্ষার' নির্দিষ্ট প্রত্যাশার দাম চোকাতে চোকাতেও অনেক ছেলেমেয়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছে চিরকালের মত শেষ হয়ে যায়।

সমাজ তাহলে ছাত্রদের পেছনে খরচা করল কেন? একটা প্রত্যাশা তারও কি ছিল না? ছিল তো বটেই। সমাজ খরচাটা করেছে মানুষ তৈরির কাজে। শিক্ষিত মানুষ, শিক্ষিত নাগরিক তৈরির কাজে খরচা করেছে সমাজ। সেই মানুষ, সেই নাগরিক সমাজকে ভবিষ্যতের কাজের মধ্যে দিয়ে তার দান ফিরিয়ে দেবে, বাঁচিয়ে রাখবে, অসুখ করলে সারিয়ে তুলবে, দেখভাল করবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তর্ক তুলতে পারবে, সমালোচনা ও আত্মসমালোচনা করতে পারবে, অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসা জারি রাখবে -- এই প্রত্যাশা সমাজের রয়েছে।

তাহলে ঘুরেফিরে সেই প্রত্যাশা। কিন্তু লোন কোম্পানি বা বাপমায়ের প্রাইভেট প্রত্যাশা আর পাবলিক প্রত্যাশার মধ্যে এইখানে মূলগত ফারাক রয়েছে। প্রাইভেট প্রত্যাশা নিক্তিতে মেপে প্রাইভেট মুনাফা আদায় করে নেয়। ঠিক যে হিসেবে প্রাইভেট মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্স কোম্পানি আপনার বয়েস, পারিবারিক রোগের প্রবণতা ইত্যাদি ঝুঁকি মেপে নিয়ে সেই অনুযায়ী আপনার স্বাস্থ্য বিমায় পুঁজি বিনিয়োগ করে। ঠিক যেভাবে বেসরকারি কৃষিঋণ দেওয়ার সময়ে পুরনো বা হাল আমলের মহাজনরা হিসেব করে বুঝে নেয় কোন ফসল, কোন বীজ, কত ফলন,কৃষকের ভিটের বাজার মূল্য সবই। বিনিয়োগ করার সময় অঙ্ক কষে প্রাইভেট মুনাফার রিটার্ন বুঝে নেয়। ঠিক সেভাবেই শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রাইভেট পুঁজি বিনিয়োগ কাজ করে। সে বাপমায়ের পুঁজিই হোক বা লোন কোম্পানিরই হোক। সে ছাত্রকে একটা বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে দেখে, অতএব স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। স্বাধীন থাকতে দেয় না। স্বনির্ধারণ করতে দেয় না। তার চোখে সামাজিক ন্যায়ের কোনই মূল্য নেই, অতএব শিক্ষাব্যবস্থাকে কী করে সমতাপূর্ণ করতে হবে তা নিয়ে সে ভাবে না। সে শিক্ষার বিষয়কে বাজারের মূল্য দিয়ে মাপে, অতএব তার কাছে আজ পাবলিক সেক্টর ইকোনমিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এর দাম আছে, কাল ফ্রি মার্কেট গিগ ইকোনমিতে 'লিবারাল আর্টস' এর। পাবলিক প্রত্যাশা এই হিসেবগুলো এভাবে কষেনা। শিক্ষায় বিনিয়োগকে মুনাফা দিয়ে মাপে না।

কেউ বলছেন, কুড়ি বছরে রোলের দাম বেড়ে গেল, জামা প্যান্টের দাম বেড়ে গেল, শিক্ষার দাম বাড়লেই এত আহাউঁহু কেন বাপু। আবার সেই একই কথা বলতে হয়। রোল, জামাপ্যান্ট আর শিক্ষা এক নয়। বরং প্রশ্নর তীরটা ঘুরিয়ে দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। প্রশ্ন করুন এই ব্যবস্থায় কার লাভ, কার ক্ষতি? প্রশ্ন করুন, কেন লোকসভার বেশির ভাগ সাংসদ রোলের দোকান না খুলে আজকের যুগে শিক্ষাব্যবসায় প্রাইভেট পুঁজিনিবেশ করে বসে আছে? প্রশ্ন করুন কেন আজকের সমস্ত শিল্পপতি কর ফাঁকি দেওয়া সিএসআর এর টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলে ডবল মুনাফা কামাচ্ছে? প্রশ্ন করুন কেন আজকে গ্লোবাল ধর্মগুরুরা শিক্ষা মার্কেটে বিনিয়োগ করছে? তারাই ঠিক করে দিচ্ছে ভবিষ্যতের নাগরিকের চরিত্র - গিগ ইকোনমিতে শাটল কক হয়ে থাকা, লোনের ভারে কুঁজো, চিন্তাভাবনায় অপারগ, এক অস্থির, অবসন্ন, বশংবদ কর্মী-বাহিনি - যে শুধু হুকুম তামিল করবে, বিরুদ্ধতা করবে না।

আমেরিকায়, ইংল্যান্ডে তো এভাবেই শিক্ষে দীক্ষে হয়...এই বলে কোঁত পারছেন যারা তারা একটু খোঁজখবর নিন কীভাবে সে ব্যবস্থা আজ ধ্বসের মুখে। এরকম সারি সারি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের দেখেছি যাদের প্রমের জন্য দামী জামা কেনার, একটা লাইফস্টাইল বজায় রাখার পিয়ারপ্রেশার আছে, কিন্তু ভোর পাঁচটায় উঠে গ্যাস স্টেশনে কাজ করে, সন্ধ্যেয় রেস্তোঁরায় বাসন মেজে এবং শিক্ষান্তে কয়েক বছর বেগার খেটে সাধারণ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্সের লোন শোধ করতে হয়। তার বেশি লোন নিয়ে ফেললে প্রায় কুড়ি বছরের অবধারিত গোলামি। দূর থেকে দেখে বুঝতেই যদি হয় তো কেন লোচ-এর ছবি দেখুন। নিজের সন্তানের জন্য ওরকম ভবিষ্যত দেখা ছাড়ুন। যেখানে আন্দোলন হচ্ছে সেখানে ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। যেখানে আন্দোলন হচ্ছে না সেখানে ফি-মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার আন্দোলন গড়ে তুলুন। আর সবচেয়ে বড় কথা, আপনার সন্তানকে নিজের পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে ভাবাটা বন্ধ করুন।

লোক হাসিয়ে লুঠের থেকে নজর ঘোরাবার বিজেপি'র কৌশলে যেন আমরা জব্দ না হই

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


বেশ কিছুদিন আগে বর্ধমান জেলায় অনুষ্ঠিত ঘোষ এন্ড গাভী কল্যাণ সমিতির সভায় ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি মাননীয় দিলীপ ঘোষ তাঁর ভাঙা ভাঙা বাংলায় দেশীয় প্রজাতির গরুর দুধে সোনা থাকে বলে এবং বিদেশিনী জার্সি গাই কে গৌ মাতা (গরু মাতা — হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব অনুসারে পূজিত গরু) নয় বরং "আন্টি" বলে সম্বোধন করা নিয়ে, তাঁর নারী বিদ্বেষী বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক ও খিল্লির যে ঝড় বয়ে গেল তা অতুলনীয়। শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, সাবর্ণ হিন্দু বাঙালিদের যে অংশটা বিজেপি-বিরোধী, তাঁরা বেশ রসিয়ে উপভোগ করলেন এই খিল্লি, কিন্তু প্রশ্ন করলেন না যে এই রকম লোক-হাসানো কথা কেন বিজেপি নেতারা প্রায়শই বলে থাকেন? কেন তাঁরা খিল্লির পাত্র হন? কেন বাজারি সংবাদ মাধ্যম এইসব কথাগুলোকে চাউর করে?

বর্তমানে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক সঙ্কট এক চরম রূপ ধারণ করেছে। ২০১৬ সালের নোটবন্দি ও পরবর্তীকালে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) প্রয়োগ করায় ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো, বিভিন্ন অসংগঠিত ব্যবসা ও বাণিজ্য যার ফলে অথৈ জলে পড়েন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরা। শহরে কর্মহীন হন লক্ষ লক্ষ মানুষ। শুধু তাই নয়, আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পেপার অনুসারে ভারতে ২০১১-১২ আর্থিক বছর থেকে ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরের মধ্যে ৯০ লক্ষ কাজ কমে যায়, অর্থাৎ ৯০ লক্ষ কর্ম সংস্থানের সুযোগ শেষ হয়ে যায়। 

এই সময়েই ভারতে প্রথমবার কৃষিতে ব্যাপক কর্ম অবলুপ্তি হয় যা কিন্তু চিরাচরিত প্রথা মেনে শিল্পে, পরিষেবায় বা অন্য কোন ক্ষেত্রে যোগ হয়নি; অর্থাৎ যাঁরা কৃষি ক্ষেত্রে কর্মহীন হলেন তাঁরা কিন্তু অন্য কোথাও কাজ খুঁজে পেলেন না বরং কর্মহীন হয়ে থাকলেন। ওই পেপারের তথ্য অনুসারে, ২০১৭-১৮ সালে ৪৯.৫১ কোটি কর্মঠ মানুষ কাজের বাজারে কর্মসংস্থানের জন্যে হাজির হলেও শুধু ৪৬.৫১ কোটি মানুষের কাছেই কাজ ছিল। এর পরেই, ২০১৯-২০ সালের তথ্য অনুসারে ভারতে কর্মহীনতার মাত্রা ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছিল ৮.১% তে, যা বর্তমানে ভারতের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের অনুসারে ৭.৭% এ নেমেছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।

ভারতের অর্থনীতির এই দুর্দিনে, এই ব্যাপক কর্মহীনতার ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ব্যাপক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এমনকি যাঁদের কর্মসংস্থান আছে তাঁরাও অর্থ খরচ করতে ভীষণ রক্ষণশীল হয়ে উঠেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এর ফলে বাজারে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা চরম ভাবে হ্রাস পায় আর তার ফলে আর্থিক মন্দার, চরম আর্থিক সঙ্কটের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বাজারের নিয়মেই সমস্ত সঙ্কটগ্রস্ত শিল্প সংস্থাগুলো, বিশেষ করে গাড়ি ও উপভোক্তা পণ্যের সংস্থাগুলো উৎপাদন কমিয়ে ফেলে ও তার ফলে আরও অনেক শ্রমিক ও কর্মচারীদের কর্মহীন হতে হয়। 

চক্রাকারে এই সঙ্কট ঘনীভূত হয়েই চলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের বা বিজেপির এই সঙ্কট নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ কর্মহীনতা ও আর্থিক সঙ্কটের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে এই সরকার ও শাসক পার্টি। যে কোন ধরণের অর্থনীতি সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে এই সরকার তুলে ধরে পাকিস্তান, কাশ্মীর, রাম মন্দির ও হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের কথা যাতে অর্থনীতির করুণ দশা ও ঘনীভূত হওয়া সঙ্কট নিয়ে দেশের গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ চিন্তা না করতে পারেন।

এই চরম কর্মহীনতার স্রোত কে না রুখে বরং তাতে আরও বেগের সঞ্চার করতে মোদী সরকার রেল, ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বিএসএনএল), এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম (বিপিসিএল), প্রভৃতি সরকারি মালিকানাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর বেসরকারিকরণ করে ব্যাপক লোক ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করছে। ইতিমধ্যে রেল থেকে লোকসান কমানোর নামে হাজার হাজার কর্মচারী ছাঁটাই করার প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। বিএসএনএল এর ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক কর্মীদের জোর করে অবসর গ্রহণ করানো হচ্ছে।মার্চ ২০২০ এর মধ্যে বিক্রি করে দেওয়া হবে বিপিসিএল।

এগুলোর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রভাব পড়বে কারণ একজন চাকুরিজীবী বা শ্রমিকের উপর শুধু তাঁদের পরিবারের লোকেরাই নির্ভর করেন না এমন কী স্থানীয় অর্থনীতির চালকেরা, সে মুদির দোকানি হোক বা জামাকাপড়ের দোকানদার, দুধ বিক্রেতা, তরকারি বিক্রেতা হোক বা অন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, এরা সবাই নির্ভর করেন। কর্মহীনতা এবং ব্যাপক ছাঁটাইয়ের ফলে যে অর্থ সঙ্কট দেখা দেয় তার তরঙ্গের মতন প্রভাব এই সমস্ত শ্রেণীর মানুষের উপরেও পড়ে এবং আর্থিক সঙ্কট আরও গাঢ় রূপ ধারণ করে।

এই অবস্থায় মানুষের নজর কে অর্থনৈতিক সঙ্কটের থেকে দূরে ঘোরাতে, মানুষ কে এটা ভুলিয়ে দিতে যে তাঁদের জীবন চরম ভাবে এক অসুরক্ষিত অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, বিজেপি ও মোদী সরকার নানা ধরণের কার্যকলাপ করছে। সে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় গায়ের জোরে মন্দির প্রতিষ্ঠা হোক বা দিলীপ ঘোষ, বিপ্লব দেব প্রভৃতি লোকেদের সঙ সাজিয়ে তাঁদের দিয়ে কিছু অদ্ভুত কথা বলানোই হোক, যতক্ষণ সংবাদ মাধ্যম জনগণ কে মূল সমস্যার দিকে তাকাতে না দেওয়ার রসদ পাচ্ছে ততক্ষণ বিজেপির জন্যে মঙ্গল।

বর্তমানে যাঁরা গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও ফ্যাসিবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং মোদী সরকারের ভয়াবহ সব নীতির বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করছেন তৃণমূল স্তর থেকে, তাঁদের অবশ্যই এই সব অপচেষ্টা কে রুখে দিতে হবে। খিল্লির স্রোতে গা না ভাসিয়ে, বা ঘটনাক্রমে আতঙ্কিত না হয়ে তাঁদের জনগণ কে বোঝানো উচিত যে কী ভাবে মুষ্টিমেয় কিছু বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের জুতো চাটার স্বার্থে, কী ভাবে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া-লগ্নি পুঁজির অবাধ লুঠ ও শোষণের স্বার্থে মোদী সরকার নির্লজ্জের মতন দেশ বিক্রি করে চলেছে ও গরিব মানুষের জন্যে আর্থিক সঙ্কট কে তীব্র করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দিয়ে তাঁদের বুঁদ করে রাখার চেষ্টা করছে।

এই মুহূর্তে যদি আপামর জনগণ কে, শ্রমজীবী মানুষ কে ও সঙ্কটগ্রস্ত কৃষকের কাছে এই সত্য প্রকাশ করা না হয়, তাহলে কিন্তু আগামী দিনে ভয়ানক হয়ে উঠবে আর্থিক সঙ্কট ও তার সাথে সাথে বেড়ে যাবে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও রক্তপাত। অবিলম্বে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সংগ্রামী জোট গড়ে এলাকা ভিত্তিক প্রচারের মাধ্যমে এই ভয়ানক আর্থিক সঙ্কটের কথা মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবেই। আজ যদি এই কাজে অবহেলা হয় তাহলে আগামী দিনে তার ফল কিন্তু ফ্যাসিবিরোধী শক্তিগুলোকেই ভুগতে হবে। অতএব, সাবধান, সামনে কঠিন পথ। দিলীপ ঘোষের খিল্লিতে যেন মূল সমস্যা ভুলে না যাই আমরা।

উগ্র জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ পরিসরে দুর্বল হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রাম

মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৯, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


একটা সময় ছিল, ষাট-সত্তরের দশক অবধি, যখন আন্তর্জাতিকতাবাদ একটি জোরালো রাজনৈতিক প্রবণতা ছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধের অপরাধীদের আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে সাজা পাওয়ার কথা এমনি এমনি ওঠেনি। রাস্তার আন্দোলনের মধ্যে থেকে একটা সম্মিলিত চীৎকার হয়ে উঠেছিল। শুধু যুদ্ধবাজ আমেরিকার রাস্তায় জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই সে আওয়াজ ওঠেনি, আমাদের মত গরিব দেশের রাস্তা থেকেও সে আওয়াজ প্রত্যয়ের সাথে উঠেছিল। আমার নাম, তোমার নাম, ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম। এ আমরা, আশির দশকের সন্তানরা, ছোটবেলায় নানা লোকের মুখে শুনে ফেলেছি। সত্যজিৎ রায়ের "প্রতিদ্বন্দ্বী"-র ইন্টারভিউ সিনে বেকার যুবকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের গুরুত্বকে মানুষের চাঁদে যাওয়ার ঘটনার গুরুত্বের থেকে বড় করে দেখতে শিখেয়েছিল সে এক রাজনীতি। ওই দৃশ্যটা দেখার অনেক আগে, বা প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিকতাবাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব/প্রয়োগ সম্পর্কে জেনেবুঝে ওঠার অনেক আগেই আমরা, আশির দশকের বাচ্চারা, শিখে গেছি যে আমরা এ দেশের মানুষ হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই ভিয়েতনামের যুদ্ধ-আক্রান্ত মানুষের পক্ষে ছিলাম, আমরা চিরকাল প্যালেস্তাইনের যুদ্ধ-আক্রান্ত মানুষের পক্ষে ছিলাম। আমরা আমেরিকার ব্লকেড আক্রান্ত কিউবার পক্ষে ছিলাম। রুশ বিপ্লব কী তা জানার আগেই আমরা, তখনকার ছোটরা, সোভিয়েতকে ভালবাসতাম। বাংলা অনুবাদে সোভিয়েত লেখক আর কবিদের পড়তে পেতাম। অত দূর সোভিয়েত দেশ থেকে অমন যত্নে তৈরি করা এত ছোটদের বই কীভাবে জানি বাড়িতে পৌঁছে যেত, বইমেলায় পাওয়া যেত। আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণা মগজে ঢোকার অনেক আগেই আমরা হাতেনাতে এর সহজ, স্বাভাবিক উপস্থিতি টের পেয়ে যেতাম।


নিছক আশির দশকের নস্টালজিয়া ঢেঁকুর তোলার জন্য এটা বলা নয়। সরলীকরণ করে বলার জন্যও এটা নয়। সরলীকরণ করা ভুল হবে, কারণ এ সবের মধ্যেও স্থানীয় জাতীয়তাবাদের একটা শিকড় আগাগোড়া ছিল। তাই, ভিয়েতনাম, কিউবা, রাশিয়া, প্যালেস্তাইন সম্পর্কে এই অবস্থানগুলো থাকা সত্ত্বেও আমরা চীন ভারত যুদ্ধের সময় জেনে বুঝে অবস্থান নিতে শিখিনি। আমরা কোনদিনই কাশ্মীরের মানুষের পক্ষ নিতে শিখিনি। আমাদের কাশ্মীর সম্পর্কে স্বাভাবিক ভাবে জানা বোঝার কোনও উপায় ছিল না। মাধ্যমিক বোর্ডের দেওয়া ভারতের মানচিত্রে ম্যাপ-পয়েন্টিং করার সময় আমরা সেই মানচিত্রকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে জানতাম না। এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা মাথায় রেখেও বলা যায়, যে এক জোরালো আন্তর্জাতিকতাবাদ তখনও ছিল। প্যালেস্তাইন নিয়ে কথা বললে, "বিশ্বমানব" বলে কটাক্ষ করাটা তখন একেবারেই আনকুল ছিল।


শ্রম এবং পুঁজির দ্বন্দ্বকে রাজনীতির পরিসর থেকে যত বেশি বেশি করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তত আমার সমস্যার সমাধান যে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানের সাথে জড়িত থাকতে পারে, এবং আমার সমস্যা যে অনেক অংশে আসলে বৈশ্বিক ফাটকা পুঁজির মহাঘোঁট থেকে উদ্ভুত, এই বোধও চলে গেছে। এখনকার ‘স্বাভাবিক’ বোধটাও তাই খানিকটা এরকম। সব সমস্যাই হয় কেবল আমার, নয় কেবল আমার গোষ্ঠীর, কেবল আমার খন্ডিত আইডেনটিটির, কেবল আমার স্থানিক চারপাশের। শুধু এই বোধে বলীয়ান হয়েই দীর্ঘ ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ফেলে ভূমিপুত্র রাজনীতি বা আইডেন্টিটির রাজনীতি আগের রাজনীতির ফাঁকফোঁকরগুলো বুজিয়ে নিটোল সমাধান এনে দেবে বলে আজকে মনে করা হচ্ছে।


এই ভাবে ভেবেই আসাম বা শিলং থেকে বংগালি খেদাও থেকে শুরু করে মুম্বাইয়ের বিহারি খেদাও। নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, শিকড় হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সবসময় অমূলক নয়। কিন্তু তার সমাধান কাঠামোগত ভাবে না খুঁজে সবচেয়ে দুর্বল অভিবাসী মানুষকে বিতারণ করে বা ভয় দেখিয়ে ‘সাইজ’ করে কোনওদিন আসেনি। আসার কথাও নয়। মজার ব্যাপার হল এর ফলে আসাম থেকে অধিকাংশ বাঙালি বা মুম্বাই থেকে অধিকাংশ বিহারিকে তাড়ানো যায়নি। কিন্তু, যেটা করা গেছে তাহল রাজনীতির পরিসর থেকে অন্যান্য কাজের কথাগুলোকে সরিয়ে ফেলা গেছে। যাতে বিহারি শ্রমিকের যেমন ক্ষতি হয়েছে, মারাঠি শ্রমিকেরও লাভ হয় নি। বাঙালি কৃষকের যেমন ক্ষতি হয়েছে, অসমিয়া কৃষকেরও লাভ হয় নি। এটা ভাষা অক্ষের রাজনীতির ক্ষেত্রে, অন্যান্য অক্ষের ক্ষেত্রেও ঠিক। তাই ইতিহাসে যাই ঘটে থাকুক না কেন, মধ্যবিত্ত কাশ্মীরি পন্ডিতদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে, পন্ডিতদের যেমন ক্ষতি হয়েছে, ততোধিক ক্ষতি হয়েছে কাশ্মীরি মুসলমানদের। এই ক্ষতগুলো দগদগে ঘা হয়ে নতুন রাজনীতি খোঁজার সম্ভাবনাকে মলিন করেছে। কোথাও সমৃদ্ধ করেনি।

এখন বাংলায় যে নব্য বাঙালি জাতীয়তাবাদি রাজনীতির আমদানি হয়েছে, সেটা আমাদের দেশের সহ গোটা বিশ্বের এই সময়ের ফসল। এখন ব্রেক্সিটের ব্রিটেন থেকে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড – সঙ্কীর্ণতম জাতীয়তাবাদ, অভিবাসী শ্রমিক বিরোধিতা ও ভূমিপুত্র রাজনীতির যুগ। ঠিক যেভাবে নব্বইয়ের দশকে আমরা বড় বাঁধ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ ও তাঁদের ঠিক করে দেওয়া ‘উন্নয়নের’ রাজনীতি-র বিরোধিতা করার বদলে, পরিবেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবার বদলে রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে জল-ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করে সবাই মরেছি। খানিকটা তেমনই আজকে যখন চাকরি ছাঁটাই মহামারী হয়ে উঠেছে। আজকে যখন মানুষের হাতের পয়সা বড় পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেছে। তখন আমরা ভাবছি এই সংকটের উত্তর হল, আমার বেঁধে দেওয়া গন্ডিটুকুর মধ্যে তার বাইরে থেকে আসা শ্রমিককে কাজ করতে দেব না। আমার ভাষাকে বাঁচাতে হলে আমাকে অন্য ভাষার শ্রমিককে তাড়াতে হবে। আমার সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে আমার ক্রোধের অভিমুখ হবে অন্য সংস্কৃতির ছাপোষা লোক। এই ধরনের সহজ টার্গেটের ওপর সংখ্যাগুরুর “জনরোষ”-এর একটা মাদকতা আছে বোধহয়। তাই কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলছে, করছে। কিন্তু অনেকেই চুপ করে সাপোর্ট দিচ্ছে। একই সাথে আসামে এনআরসি-র বিরোধিতা করব, আবার এখানে সেই একই যুক্তিক্রমের রাজনীতি করব, দু’টোই কিন্তু চলছে। কারণ ভূগোলের সাথে বিষয়ী পাল্টে যাচ্ছে। “এখানে তুমি সংখ্যালঘু, ওখানে তুমি জমজমাট”। কিন্তু এসবের মধ্যে যেটা সুন্দর করে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা হল শ্রম আর পুঁজির দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্র আর মানুষের দ্বন্দ্ব। এই বিষাক্ত রাজনীতি রোখার দায় ধর্মীয়, ভাষিক সংখ্যাগুরুর ওপর বেশি করে বর্তায়। সমস্যাগুলোর সমাধান সবাইকেই খুঁজতে হবে, তবে এই পথে নয়।

নোবেল চর্চা: এস্তের দুফ্লো ও অভিজিৎ ব্যানার্জি'র দৈনতার অর্থনীতি আসলে অর্থনীতির দৈন্যতা

রবিবার, অক্টোবর ২০, ২০১৯ 0 Comments A+ a-

Esther Duflo and Abhijit Banerjee won the Nobel Prize in Economic Sciences along with Michael Kremer in 2019

ম্যাসাচুটেস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'র ফরাসী-মার্কিন অর্থনীতিবিদ এস্তের দুফ্লো, তাঁর বাঙালি-মার্কিন অর্থনীতিবিদ সহকর্মী ও সাথী অভিজিৎ ব্যানার্জি, ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ক্রেমার যৌথ ভাবে ২০১৯ সালের অর্থনীতি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দারিদ্র্য মোচন করার ক্ষেত্রে তাঁদের নানা গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণে তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি ২০১১ সালে দরিদ্রের অর্থনীতি শীর্ষক তাঁদের যে অর্থনৈতিক অনুসন্ধান প্রকাশ করেন তাতে উন্নয়নমূলক অর্থনীতির সূত্র ধরে তাঁরা দেখান যে দরিদ্র মানুষের অর্থনীতি কী বস্তু। দরিদ্রের অর্থনীতি হল শ্রম বেচে তাঁরা যে জীবিকা আয় করেন শুধু শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকতে, যাতে তাঁরা শ্রম বিক্রি করতে পারেন, সেই অর্থ তাঁরা কী ভাবে খরচ করেন এবং সেই খরচের সাথে কী করে বিশ্ব একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্বার্থ কে জোড়া যায় যাতে এদের দ্বারা চালিত দেশগুলোর পঙ্গু হয়ে যাওয়া অর্থনীতি কে চাঙ্গা করা যায়।

ডেভেলপমেন্টাল ইকোনোমিক্স বা উন্নয়নশীল অর্থনীতির সূত্রগুলো ক্লাসিক কেইনেসিয়ান মাইক্রো-ইকোনোমিক তত্ত্বের খুচরো তবে আরও উন্নত অংশ বলা যেতে পারে। এটা উল্লেখ্যযোগ্য যে দুফ্লো ও ব্যানার্জি তাঁদের কাজ কে কেন্দ্রীভূত করেছেন গরীব দেশগুলোয়, যাতে তাঁরা গরীব মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম কে প্রত্যক্ষ ভাবে অধ্যয়ন করতে পারেন এবং সাথে সাথে randomised controlled trials (বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা) এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের মাইক্রো-ইকোনোমিক তত্ত্বের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করতে পারেন।

দরিদ্রের অর্থনীতি  আসলে মার্কস কর্তৃক প্রুধোঁ’র লেখা দৈন্যতার দর্শন এর সমালোচনা দর্শনের দৈন্যতা’র  মতনই অর্থনীতির দৈন্যতা বলে বেশ চালিয়ে দেওয়া সম্ভব। কী আছে দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্বে? কী ভাবে তাঁরা বর্তমান বিশ্বে হুহু করে বেড়ে চলা আর্থিক আসমাঞ্জস্য ও দৈন্যতা কে দূর করতে চান? কী ভাবে তাঁরা দরিদ্রের কষ্ট লাঘব করতে চান? বছরের পর বছর ধরে তাঁরা যে ভাবে মাটি আঁকড়ে বিশ্বের দৈন্যতার শিখন্ডে থাকা অঞ্চলে গিয়ে গবেষণা করেছেন তার নিটফল কী? যে নোবেল পুরস্কার বিশ্বের তাবড় তাবড় বিদ্বানদের, যাঁরা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, দেওয়া হয়, তা দুফ্লো ও ব্যানার্জি কে দেওয়া হল কেন? 

বিশ্ব পুঁজিবাদের বর্তমান স্তর হল সাম্রাজ্যবাদী অর্থাৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্তর। পুঁজিবাদের স্বাধীন প্রতিযোগিতার যুগের থেকে প্রবর্তিত হয়ে পুঁজির চরম কেন্দ্রিকরণের মধ্যে দিয়ে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির জন্ম। বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষের দিক থেকেই এই একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি চরম সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আসে আর্থিক উদারীকরণ, অর্থাৎ সরকার বা রাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার ও বাজারের omnipotence, বেসরকারিকরণ অর্থাৎ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে — যা জনগণের দেওয়া করের টাকায় গড়ে উঠেছে — কর্পোরেট সংস্থাগুলো কে বেচে দেওয়া, এবং বিশ্বায়ন অর্থাৎ প্রতিটি দেশের বাজার, কাঁচা মালের বা প্রাকৃতিক সম্পদের উৎসগুলো কে বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির জন্যে উদার করে খুলে দেওয়ার নীতি। এই নীতি কে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি বলা হয়।

এই নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির দুনিয়ায় একটি রাষ্ট্রযন্ত্র যত তাড়াতাড়ি আর যত বেশি করে অর্থনীতির থেকে নিজেকে সরিয়ে  নিয়েছে, যত বেশি সে বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের স্বার্থে নিজের দেশের সীমান্ত পুঁজির জন্যে আলগা করে দিয়েছে তত বেশি করে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে, ধনীর সিন্দুক যেমন একদিকে ফুলে ফেঁপে উঠছে, দরিদ্র মানুষ আরও বেশি করে শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তাঁরা দিন দিন তাঁদের বেঁচে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছেন আর এর ফলে সমাজে শ্রেণী দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠছে। 

এই শ্রেণী দ্বন্দ্ব কে নিকেশ করতে, দরিদ্র মানুষদের কিছু ছাড়, কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়ে, তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ দিয়ে টিকিয়ে রেখে তাঁদের শ্রম কে নিংড়ে নেওয়ার অর্থনীতি হল "উন্নয়নমূলক অর্থনীতি"। কী করে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে, বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জিভূত দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের ক্ষোভ কে শান্ত করা যায় কিছু অর্থের বিনিময়ে, কী করে পুঁজির মানবিক মুখোশ দেখিয়ে শোষকের ভয়াবহ রূপ কে দরিদ্র মানুষের দৃষ্টির অগোচরে রাখা যায়, কী ভাবে "পাইয়ে দেওয়ার" রাজনীতির মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষদের সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম থেকে অনেক দুরে রাখা যায়, তারই নাম "উন্নয়নমূলক অর্থনীতি" যা দুফ্লো ও ব্যানার্জি জুটির বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা'র মূল ভিত্তি। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র অর্থনৈতিক দর্শনের মূল বিষয়টাই হল যে সামগ্রিক ছবিটা না দেখে অংশটা দেখা। “প্লাম্বার রূপে অর্থনীতিবিদ” শীর্ষক তাঁর লেখায় দুফ্লো বলেছেন যে অর্থনীতিবিদদের কাজ হবে প্লাম্বারের মতন লিকেজ মেরামত করা, বৃহৎ সমস্যাটা সমাধান করতে না যাওয়া। অর্থাৎ, তাঁর মতে শুধুমাত্র পুঁজিবাদের সঙ্কটের বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে অর্থনীতিবিদদের উচিত সাহায্য করা, সামগ্রিক পুঁজিবাদের সঙ্কট কে নিয়ে গবেষণা করার বা এই ব্যবস্থা কে কী ভাবে পরিবর্তন করা যায় তা অর্থনীতিবিদদের দেখার কথা নয়।

দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার পদ্ধতি হল গরিব মানুষের মধ্যে গিয়ে থাকা, তাঁদের দৈনিক জীবনযাপন কে লক্ষ্য করা, তাঁদের খরচ ও অর্থনৈতিক বিকল্পগুলো কে যথাসম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করা ও এর ভিত্তিতে মাইক্রো-ইকোনোমিক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া, বিশেষ করে যা এই দরিদ্র মানুষদের জীবনে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। আর এই পরিবর্তনের জন্যে দুফ্লো ও ব্যানার্জি নির্ভর করেন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের উপর। এই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাঁরা চান যে দরিদ্র মানুষের হাতে কিছু অর্থ দেওয়া হোক, সে universal basic income বা সার্বজনীন মৌলিক আয় হিসেবে হোক বা সরকারি প্রকল্প অনুসারে সরাসরি দরিদ্র মানুষের ব্যাঙ্ক একাউন্ট এ ট্রান্সফার করেই হোক, যাতে সেই অর্থ দিয়ে তাঁরা বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকতে পারেন ও শ্রম বিক্রি করার পরিস্থিতিতে থাকেন। 

তবে যদিও এই ধরণের অর্থনৈতিক গবেষণা কে দারিদ্র্য দূর করার প্রয়াস হিসাবে চালানো হচ্ছে, এই ধরণের বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা কোন ভাবেই সার্বিক ভাবে দারিদ্র্য দূর করতে পারে না কারণ এই সমস্যাটা মাইক্রো-ইকোনোমিক নয়, সমস্যাটা বৃহৎ একটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা যা বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার ফসল, এবং পুঁজিবাদের, একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির, বিশ্বের উপর জেঁকে বসে থাকা রক্তচোষা ব্যবস্থার সার্বিক উচ্ছেদ না করে, সমাধান করা সম্ভব নয়। দারিদ্র্য কে অতি-দারিদ্র্যে পৌঁছানোর থেকে আটকানো আর দারিদ্র্য নির্মূল করার রাজনৈতিক-অর্থনীতির মধ্যে বিস্তর গুণগত পার্থক্য আছে।

শ্রমের শোষণ, উৎপাদনের উপকরণের উপর পুঁজির মালিকানা ও সামগ্রিক ভাবে পুঁজির চরম কেন্দ্রিকরণের ফলেই যে বিশ্বের প্রতিটি কোনে দারিদ্র্য এত চরমে উঠছে, ব্রিটেনের মতন দেশেও অনাহারে মানুষ জীবন কাটাচ্ছে, সে কথা কিন্তু দুফ্লো ও ব্যানার্জি স্বীকার করেন না বা সেই সমস্যার সমাধানে তাঁদের কোন দিক নির্দেশ নেই। মনে রাখা দরকার নিজেকে “মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদদের” থেকে অনেক দূরে সরিয়েও শুধুমাত্র “অর্থনৈতিক বৈষম্যে” পুঁজির ভূমিকা কে দেখানোর জন্যে, অসাম্যের কথা বলার জন্যে টমাস পিকেটি কিন্তু নোবেল পাননি। তাই দুফ্লো ও ব্যানার্জি যে নোবেল পেয়েছেন তার কারণ তাঁরা সাবধানে নিজেদের এক সুবিধাজনক মিস্ত্রির ভূমিকায় চিত্রিত করেছেন, সমাজ বিজ্ঞানী হিসেবে না। তাঁদের তত্ত্বে, দুফ্লো ও ব্যানার্জি দেখিয়েছেন কী ভাবে রাষ্ট্র কে ব্যবহার করে দরিদ্র মানুষ কে কিছুটা সুরাহা বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতরেই, পুঁজিবাদ কে রক্ষা করতে দেওয়া উচিত। 

এই সার্বজনীন মৌলিক আয় যদিও নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির রাষ্ট্র কে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তির থেকে দূরে রেখে বাজারের দালাল বানিয়ে রাখার পদ্ধতির থেকে আলাদা তবুও এটা কিন্তু নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির উপদেষ্টারা আসলে পছন্দ করেছেন। তাই ভারতে কংগ্রেস পার্টি বিগত লোকসভা নির্বাচনে ব্যানার্জি’র সাহায্যে একটি ন্যূনতম আয় প্রকল্প (ন্যায়) নিজের প্রতিশ্রুতিতে যুক্ত করে যার মাধ্যমে দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের মাসিক ৬,০০০ টাকা করে, বাৎসরিক ৭২,০০০ টাকা সরাসরি ট্রান্সফার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। 

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কিন্তু ন্যায়ের চরম বিরোধিতা করে এই বলে যে এর ফলে ভারতের কোষাগারের উপর চাপ পড়বে এবং চরম দুর্নীতি বাড়বে। অথচ প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি নামক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদী’র সরকার ভারতের কৃষকদের মাসে ৫০০ টাকা করে, বছরে ৬,০০০ টাকা, তিন কিস্তিতে দেওয়া শুরু করেছে। শুরুতে লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেলেও, তৃতীয় কিস্তির ক্ষেত্রে আধারের সাথে প্রকল্প কে যুক্ত করার কথা বলে সরকার অনেক কৃষককে এই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া শুরু করে। মোদী’র এই প্রকল্পের ফলে না তো গ্রামাঞ্চলে পণ্য বা পরিষেবার চাহিদা বৃদ্ধির কোন সুযোগ তৈরি হল আর না এর ফলে কৃষকের মূল সমস্যাগুলো, যেমন ফসলের ন্যায্য দাম, কৃষি ঋণ মকুব বা সেচের বন্দোবস্ত হল। 

যদিও ন্যায় প্রকল্পে সরকার কে বাৎসরিক ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হবে বলে বিজেপি চিৎকার শুরু করে ও দেশের ধনী ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, ক্ষমতায় ফিরেই যে মোদী সরকার কর্পোরেট করের উপর ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে কোষাগারের ১.৪৬ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি করে আর সরকারের আর্থিক বছরের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ যে ৩.৩% এ বেঁধে রাখার প্রস্তাব ছিল তা বকলমে উল্লঙ্ঘন করে, তার বেলায় কিন্তু কোন হট্টগোল হয় না।

বর্তমানে ভারতের অর্থনীতির উপর এক কালো ঘন মেঘ জড় হয়েছে। মোদী’র বিধ্বংসী নোটবন্দি ও জিএসটি প্রচলনের ফলে যে ব্যাপক ক্ষতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে হয় তার ফলে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হন। এর ফলে কিন্তু বাজারে চাহিদার একটা ভাটার সৃষ্টি হয় কারণ মানুষের হাতে খরচের যোগ্য অর্থ কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবে কম হতে থাকে। এর ফলে বর্তমানে গাড়ি, ক্রেতা সামগ্রী, পোশাক সহ বহু শিল্পে ব্যাপক মন্দা দেখা দেয় ও আরও অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে রাস্তায় চলে আসেন। 

এই মন্দার পরিণাম তরঙ্গের মতন বারবার করে ঘুরে ফিরে অর্থনীতি কে আঘাত করতেই থাকবে ও এর থেকে চট করে একটু স্বস্তি পাওয়ার জন্যেই দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র সার্বজনীন মৌলিক আয় কিন্তু কাজে আসতে পারতো। বিশেষ করে যখন এমএনরেগা’র মতন সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পে সরকারি খরচের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। 

বর্তমানে যদি দরিদ্র মানুষের কাছে মাসিক কিছু অর্থ আসে তাহলে তাঁরা সেই অর্থ খরচ করবেন এবং এর ফলে বাজারে পণ্যের চাহিদা ফিরবে ও তার ফলে আবার শিল্পে কর্মসংস্থান হবে। যত কর্মসংস্থান হবে তত বেশি চাহিদা সৃষ্টি হবে আর তার ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি, নতুন কোন আঘাত না পাওয়া পর্যন্ত, ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কেনিয়াতে বর্তমানে এই রকমই একটি পরীক্ষা চালাচ্ছেন দুফ্লো ও ব্যানার্জি, অথচ ভারতে এর প্রয়োজন থাকলেও সরকারের উদাসীনতায় দরিদ্র মানুষের অর্থ কষ্ট ও বেকারত্বের সমস্যা দিন-দিন বেড়েই যাবে। 

যদিও দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্ব দিয়ে বর্তমানের চাহিদার সঙ্কটের সময়ে একটি সাময়িক সুরাহা পাওয়া সম্ভব তবুও একথা বোঝা উচিত যে এই তত্ত্বের মূল লক্ষ্য কিন্তু দরিদ্র মানুষ কে রক্ষা করা নয় বরং জনগণের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি কে বাঁচিয়ে রাখা। সরকার অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প গড়ে মানুষ কে কর্মসংস্থান দিয়ে, একটি পরিকল্পিত অর্থনীতি গ্রহণ করে জনগণ কে বাজারের অনিশ্চয়তা, চলমান ও চক্রাকারে আবর্তনশীল সঙ্কট থেকে মুক্তি দিচ্ছে না, উৎপাদনের উপকরণের উপর শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কায়েম করছে না, পণ্যের ও অর্থের বন্টনে সমাজের ভূমিকা কে প্রধান করছে না, বরং সামাজিক অর্থ দিয়ে বেসরকারি ক্ষেত্র কে বৃদ্ধি পেতে ও পুঁজি কে সঙ্কট মুক্ত হতে সাহায্য করছে। এর ফলে দরিদ্রের ক্ষমতায়ন হচ্ছে না, দরিদ্র কে দিয়ে বরং ধনীর সঙ্কট মোচন করানো হচ্ছে। 

দুই দিক থেকে বস্তু কে দেখলে তার দুটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র নীতি পুঁজির একচেটিয়া শোষণ ও শাসন বজায় রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে মাইক্রো-ইকোনোমিক সমস্যার, চাহিদার সমস্যার সমাধান করার জন্যে। তবে কেইনেসিয়ান অর্থনীতির মতনই দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্ব আসলে ঠেকা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি কে চরম সঙ্কট থেকে ও গরিব মানুষের বিদ্রোহ থেকে বাঁচানো ছাড়া আর কিছুই না। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি কে আজ দ্বান্দ্বিক ভাবে বোঝাই যথেষ্ট নয়। আজ জরুরী কর্তব্য হল দরিদ্র মানুষের অর্থনীতি আসলে কী সেটা প্রতিষ্ঠা করা জনসমক্ষে। মার্কসবাদ কে বাদ দিয়ে, সমাজতন্ত্র কে বাদ দিয়ে, শ্রমিকশ্রেণীর শাসনে নতুন সমাজ না গড়ে যে দারিদ্র্য মোচন হয় না, দরিদ্র মানুষের, শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট লাঘব হয় না, অনাহার, অশিক্ষা, হিংসা ও বিদ্বেষের কোন সুরাহা হয় না তা বাংলার মানুষ কে বোঝানো একান্তই জরুরী।

গেটস ও মোদী'র স্বচ্ছ ভারতের অস্বচ্ছতা

শনিবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


বিল গেটস খুবই মহান একজন মানুষ। কর্পোরেট হয়েও কটন টি শার্ট পরেন, দেখেছ কত দান ধ্যান করেন। বিল গেটস এর দানধ্যানের পরিমাণ অনেক দেশের সরকারের বার্ষিক বাজেটের থেকেও অনেক গুণ বেশি। তা তিনি নরেন্দ্র মোদী'র মত একজনকে কি না গ্লোবাল গোলকিপার প্রাইজ দিয়েছেন! ভালো লোকেরা এতে করে খুবই আশাহত হয়েছেন। বিল গেটস কে তাঁরা চিঠি লিখেছেন যাতে বিল গেটস দুষ্টু লোক মোদীকে এই প্রাইজ দিয়ে গাছে না তোলেন। ভালো লোকেরা কথাটা একেবারেই ঠিক বলেছেন। কারণ, "স্বচ্ছ ভারত অভিযান" এর নাম করে অক্ষয় কুমারের প্রোমোশন ছাড়া আর যেটা হয়েছে সেটা প্রত্যক্ষ করলে অতি বড় ভক্তেরও ধোকলার দলা গলা দিয়ে নামতে একটু বেশি জল লাগবে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই স্বচ্ছ ভারতের নাম করে গরিব, দলিত, আদিবাসী ও মুসলমানদের ওপর মতাদর্শগত অনাচার আর ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনির খুনখারাবি অনেকাংশেই সরকারি মদতে বেড়ে চলেছে।

কী বললেন? প্রমাণ চান। আসুন কিছু নমুনা চেখে দেখুন।


নমুনা এক। রাজস্থানে গণপিটুনিতে খুন জাফর খান। বয়েস ৫৫, পেশা শ্রমিক, বাসস্থান বস্তি। অপরাধ - স্বচ্ছ ভারত কর্মচারীদের বাধা দিয়েছিলেন যাতে তারা খোলা মাঠে পায়খানা করার সময়ে মহিলাদের ছবি তুলে তাদের শেমিং না করে। এই অপরাধে জাফর খানকে পিটিয়ে মেরে ফেলে স্বচ্ছ ভারতের কর্মচারীরা। না, কেউ শাস্তি পান নি। জাফর খানের স্ত্রী (তিনিও শ্রমিক) সরকারি ক্ষতিপূরণ সরকারের মুখে ছুঁড়ে মেরেছেন।


নমুনা দুই। ম্যানহোল কর্মীরা (যারা ১০০% দলিত, না না এই পেশায় সংরক্ষণ বিরোধী বামুন-কায়েতরা চাকরির দাবিতে হইচই করেন না) বার বার পথে নেমে জানিয়েছেন যে স্বচ্ছ ভারতে প্রতি তিন দিনে একজন করে সাফাই কর্মীর ম্যানহোলে নেমে মৃত্যু হয়। এগুলি মৃত্যু নয়, হত্যা। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দলিত শ্রমিকদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কী করা যাবে বলুন, সরকারের চাঁদে যাওয়ার টাকা আছে কিন্তু ম্যানহোল সাফাইয়ের রোবট নেই। অগত্যা গ্লোবাল গোলকিপার মোদীজি ক্যামেরার সামনে পাঁচজন সাফাইকর্মীকে জড়সড় বসিয়ে তাদের পরিষ্কার পায়ে জল ঢালার অপমান করেন। কিন্তু ম্যানহোল শ্রমিকদের হত্যা হতেই থাকে। এই হত্যায় কারুর শাস্তি নেই, সেটা হয়তো সবাই জানে, এবং মানে।


নমুনা তিন। সম্প্রতি গোবলয়ের মধ্যপ্রদেশে এক নতুন ধরনের গণপিটুনির আমদানি হয়েছে। স্বচ্ছ ভারতের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনিরা এবার দলিত আর আদিবাসী শিশুদের মাঠে পায়খানা করার অপরাধে পিটিয়ে পিটিয়ে মারছে। গ্লোবাল উইকেটকিপার ঘোষণা করে দিয়েছে দেশ এখন এতই স্বচ্ছ, যে বাপুজির নাম রৌশন করতে সকলেই স্বচ্ছতার চৌকিদার। অতএব গতকাল ১৮ মাসের আদিবাসী শিশু ভগওয়ান সিং এই অপরাধে খুন হয়েছে। গত সপ্তাহে একই অপরাধে যাদবদের পিটুনিতে খুন হয়েছে ১০ বছরের অবিনাশ আর ১২ বছরের রোশনী।


"জীবনের ইতর শ্রেণীর মানুষ তো এরা সব
ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে।"   


অতএব গ্লোবাল গোলকিপার মোদীজির গরিবের রক্তে রাঙা হাতে গ্লোবাল মসীহা বিল গেটস কিনা প্রাইজ তুলে দিলেন।

ভালো মানুষরা হয়ত মনে রেখেছে যে বিল গেটস কয়েক দশক ধরেই ভারতের গরিব, দলিত, আদিবাসি এই তিন বর্গের মহিলাদের স্বাস্থ্যোদ্ধারের নাম করে কি লীলাখেলাই না করেছেন। ভগওয়ান সিং, রোশনী আর অবিনাশদের অতিরিক্ত ও অবাঞ্ছিত জন্মের ফলেই নাকি ওদের গরিবি - গলে পচে গন্ধ বেড়িয়ে যাওয়া এই ম্যালথুসিয় তত্ত্বের কর্পোরেট ফেরিওয়ালা বিল গেটস তার প্রবল পরাক্রমশালী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ভগওয়ান সিং, রোশনী আর অবিনাশদের মায়েদের কখনও বিপজ্জনক, প্রথম বিশ্বে বাতিল হয়ে যাওয়া কন্ট্রাসেপটিভ ট্রায়ালের গিনিপিগ বানিয়েছেন, কখনও সরকারি স্বাস্থ্যনীতিকে প্রভাবিত করে তাঁদের শরীরকে বিনামূল্যের পরীক্ষাগার বানিয়েছেন আজীবন-কাজ-করে-চলা ক্ষতিকারক হর্মোনাল কন্ট্রাসেপটিভ বেচা কোম্পানিদের জন্য। এই বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানিগুলিকে মহানুভব বিল গেটস গ্যারান্টি দিয়েছেন ২০৩০ সালের মধ্যে কত কোটি মহিলা ক্লায়েন্ট এর কাছে তাঁরা এই কন্ট্রাসেপটিভ বেচতে পারবেন, তার। কীসের জোরে তিনি আমাদের দেশের মেয়েদের নিয়ে এই গ্যারান্টি দেওয়ার ধক রাখেন? উত্তরটা এই লেখার শুরুতেই আছে।   


মহানুভব বিল গেটসরা যে স্বাস্থ্যনীতি সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের গরিব, দলিত, আদিবাসি, সংখ্যালঘু মহিলাদের ওপর চাপিয়ে দেন, তার ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি খুন হয়েছেন অসংখ্যা মহিলা। আমাদের দৃষ্টির অগোচরে আশির দশক থেকেই এই খুনগুলি হয়ে চলেছে। শুধুমাত্র বড় বড় ঘটনা ঘটলে দু'চার দিনের জন্য তা হয়তো খবরে এসেছে, আবার হারিয়ে গিয়েছে। যেমন ২০১৪ সালে ছত্তিসগড়ে 'পরিবার পরিকল্পনা'-র নাম করে স্টেরিলাইজেশন ক্যাম্পে মহিলাদের গণহত্যা সংগঠিত হয়। গেটস সাহেবের গ্লোবাল গোলকিপিং এর টার্গেট ফুলফিলমেন্ট এর চাপ থাকে, বুঝতেই পারছেন। তাই গরিব, আদিবাসি মেয়েদের হাজার টাকা করে দিয়ে ক্যাম্পে আনা হয়েছিল। ক্যাম্পে আসার পর চড় থাপ্পড় মেরে, জোর করে ঠেলে শুইয়ে বন্ধ্যাত্ব করানো হয়। বিষাক্ত ওষুধে ১৫ ওখানেই খুন, আরো ১০০ জনের অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ে। পরে অবশ্যই সেই খবর চাপা পড়ে যায়।


গ্লোবাল গোলকিপারদের মহাগুরু বিল গেটসরা ভারতে আরও অনেক গুরুতর খেলাতেই নিমজ্জিত। তা সে ডিজিটাল ভারতের নাম করে কৃষক ব্যাংক বা কৃষিঋণ নিয়ন্ত্রণ করাই হোক, বা সার-বীজ-চাষ নিয়ে খবরদারি করাই হোক। যেগুলিকে আপনি ভাবছেন মোদীজির স্কিম, সেগুলি বেশিরভাগই গেটসজি-দের স্কিম আসলে। টয়লেট বানানোর কেসটাও তাই।   


ভালো লোকদেরও অনলাইন পিটিশন ছাড়া কিছু করার নেই আসলে। ভারতের জনস্বাস্থ্য, ফার্মা কোম্পানি, কৃষিবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, স্বচ্ছ টয়লেটের ডিজাইন, ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং, আধার টাধার মিলিয়ে গরিবের রক্ত খাওয়ার গবেষণা খাতে, গেটসজি-র অনেক টাকাই ঢালা আছে। এই বিষয়ক মিডিয়ার বৃহৎ অংশেও তার টাকা কাজ করছে। অনেক সময়েই শিক্ষিত ভালো লোকদেরও এই সব ফেলোশিপের টাকায় গবেষণা, পলিসিমেকিং, সাংবাদিকতা ইত্যাদি করতে হয় বইকি।


আমাগো গুজরাতের গ্লোবাল উইকেটকিপার গেটসজি-র কাছে নস্যি।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হলেই কি রক্ষা পাবেন হিন্দু বাঙালিরা?

শনিবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


বাংলাদেশ থেকে এসে যারা এদেশে বসবাস করছেন তাঁদের সংখ্যাটা যাই হোক না কেন তাঁরা সকলেই মূলত হিন্দু। তাঁরা নাগরিক অধিকার ও পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন লড়াই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। 

বাংলার পরিস্থিতি আসামের বিপরীত। আসামে খেদানোর আন্দোলন হয়েছে, আর বাংলায় হয়েছে গ্রহণ করে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন। ২০০৩ সালে বড়ো আঘাত আসে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। নিঃশব্দে। নাগরিকত্ব আইন (১৯৫৫)-তে দুটি নতুন কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। মূল আইনে ২ ধারায় একটি অংশ জুড়ে দিয়ে বৈধ পাসপোর্ট ছাড়া এদেশে আসা বা বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে এসে মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও থেকে যাওয়া সকলকে “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং মূল আইনের ১৪ ধারায় ১৪(ক) ধারা যুক্ত করে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও জাতীয় পরিচিতিপত্র চালু করার কথা বলা হয়। তৎকালীন ভারতীয় জনতা পার্টি'র (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট  সরকার এই সংশোধন আনে। দেশের সমগ্র গণজন ও বিশেষ করে বাংলার উদ্বাস্তু আন্দোলনের বিরুদ্ধে এ এক নিপুন সার্জিকাল স্ট্রাইক।

এখন নতুন করে আবার নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনার কথা বলছে বিজেপি। সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট বিল ২০১৬, সংক্ষেপে ‘ক্যাব’। এই সংশোধনে তিনটি মূল কথা আছে। প্রথমত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে পালিয়ে আসা হিন্দু (এবং আরও পাঁচটি) ধর্মের মানুষকে “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে গণ্য করা থেকে নিস্কৃতি দেওয়া, দ্বিতীয়ত এরকম আশ্রয়প্রার্থী'র ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ভারতের নাগরিকত্ব দাবী করার জন্য ন্যুনতম বসবাসকাল ১১ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করা, এবং তৃতীয় ধারাটি হল ‘প্রবাসী ভারতীয় নাগরিক’ কার্ড প্রাপ্তরা কোনও ভারতীয় আইন ভঙ্গ করলেই তাঁদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দিতে পারবে সরকার। 

নতুন এই সংশোধনী প্রস্তাব ভারতের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদের উল্লঙ্ঘন করে, কারণ নির্দিষ্ট একটি ধর্মের মানুষকে (মুসলমানদের) আইনটি এক চোখে দেখছে আর হিন্দু সহ বাকি ধর্মের মানুষকে অন্য চোখে দেখছে—এরকম সম্প্রদায়ভিত্তিক বৈষম্য ভারতীয় সংবিধান অনুমোদন করেনা। কিন্তু সে প্রশ্নে বিস্তারিত চর্চা না করে, যদি ধরেই নেওয়া যায় যে এই সংশোধনী শেষ পর্যন্ত পাস করিয়ে নেবে বিজেপি সরকার, তাহলেই বা বাংলার উদ্বাস্তুরা প্রকৃতপক্ষে কী পাবেন? 


তাঁদের আর “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে গণ্য করা হবেনা একথা ঠিক কিন্তু তারা কি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়ে যাবেন? না। তাঁরা “ইমিগ্রান্ট” হিসেবেই গণ্য হবেন। ইল্লিগাল না হলেও ইমিগ্রান্ট। এমনকি ‘শরণার্থী’ বা ‘রিফিউজি’-ও নয়। কারণ, ‘শরণার্থী’ শব্দটিই এখনও ভারতের কোনও আইনে বর্ণনা করা নাই এবং শরণার্থী প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সনদেও ভারত এখনও স্বাক্ষর করেনি। 'ক্যাব' পাস হলেও তাদের প্রথম ঘোষণা করতে হবে যে তাঁরা  বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। ঘোষণা করতে হবে যে তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের ভয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছেন।তারপর, ছয় বছর ইমিগ্রান্ট হিসেবে বসবাস করার পর তাঁরা আবেদন করতে পারবেন ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার। ‘ক্যাব’ তাদের এটুকুই এগিয়ে দেবে।

এটা কি এগিয়ে দেওয়া? নাকি উদ্বাস্তু অধিকারের আন্দোলনকে দুর্মুশ করে দেওয়া? নতুন এই সংশোধনী বিল সম্পর্কে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি (জেপিসি) ৮ জানুয়ারি ২০১৯ তাঁদের রিপোর্ট পেশ করে। সেখানে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে এই সংশোধনী পাস হলে মোট ৩১,৩১৩ জন, যারা ইতিমধ্যেই আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন এবং লং টার্ম ভিসা গ্রান্ট করা হয়েছে, তাঁরাই উপকৃত হবেন। 

জেপিসির প্রশ্নের উত্তরে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) স্পষ্ট ভাষায় লিখে জানিয়েছে যে এই ৩১,৩১৩ জন ছাড়া “বাকি সকলকে এই ক্যাটেগরিতে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হলে তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের ফলে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ভারতে ঢোকার সময় যদি তারা একথা ঘোষণা করে না থাকেন তাহলে এখন সেরকম দাবী করাটা সহজ হবেনা। ভবিষ্যতে এরকম দাবী এলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে অবশ্যই তাকে R&AW (র) সহ বিভিন্ন সংস্থার স্ক্রুটিনির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে”। 


আই বি আরও জানায় যে যাঁরা ইতিমধ্যেই ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, ইত্যাদি পেয়ে গেছেন তাঁরা এই ‘ক্যাব’ ক্যাটেগরিতে পড়বেন না এবং তাঁদের ওইসব কার্ড অবৈধভাবে করা কি না তা খতিয়ে দেখা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় এবং তা করার জন্য ফরেনার্স ট্রাইবুনাল আছে (জেপিসি রিপোর্ট, ২ দাগের ১৭-১৯ পয়েন্ট, পৃষ্ঠা ৩৯)।

পহেলা অক্টোবর অমিত শাহের সভাগৃহে যারা উপস্থিত হয়েছিল তারা কেউই “এনআরসি চাই” বলে গলা মেলাতে পারেনি বিজেপি সভাপতির সাথে। সভাপতি বারবার “জোরসে বোলো, জোরসে বোলো” করছিলেন বটে কিন্তু সাড়া পাননি। কিছুক্ষণের মধ্যে সভায়তন ফাঁকা হয়ে গেছিল। এই হতাশার ধাক্কায় পর দিন ঠাকুরনগরে একটি এনআরসি-বিরোধী ওয়ার্কশপে হামলা চালিয়ে উদ্বাস্তু আন্দোলনের পরিচিত মুখ তথা এনআরসি ও ক্যাবের বিরুদ্ধে মুখর ব্যক্তিত্ব শ্রী সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস এবং মতুয়া মহাসঙ্ঘের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বালা ঠাকুরের ওপর হামলা চালায় সেখানকার বিজেপি নেতৃত্ব। এই ওয়ার্কশপে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি দলিত-মুসলমান ঐক্যের যে বার্তা ছড়াচ্ছিল, তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে। 

এই হামলা থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এনআরসি ও ক্যাব নিয়ে বিজেপির অপপ্রচার বাংলার নমশুদ্র সমাজে তেমন গ্রহণযোগ্য হচ্ছেনা। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজ ও পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী ও মাহাতো সমাজকে বিজেপি নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা তো ভূমিপুত্র, তাদের নাম তো আর বাদ যাবেনা! তবে ধীরে ধীরে সকলেই বিজেপির ধোঁকাবাজী ধরে ফেলছে।

যাদবপুরের লড়াইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির বাইরে ছড়িয়ে প্রতিরোধ কে উৎসবে পরিণত করুন

শনিবার, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের জয়ধ্বনি দেওয়া মাড়োয়ারি-গুজরাটি মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের জুতোচাটা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-পরিচালিত তথাকথিত ছাত্র সংগঠনের ভেক ধরা অবাঙালি দাঙ্গাবাজ গুণ্ডাবাহিনীর ফ্রন্টাল সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) তীব্র তান্ডবলীলা চালিয়ে আক্রমণ করলো পড়ুয়াদের, ভাঙচুর চালালো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে, তছনছ করলো ছাত্র ইউনিয়নের অফিস ও কালি লেপে দিল লেনিন, চে গেভারা, ভগৎ সিং, প্রভৃতি বিপ্লবীর ছবিতে। 

এই আক্রমণে সামনের থেকে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী’র বশংবদ ভৃত্য ও আসানসোলের দাঙ্গাবাজ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সাংসদ সুপ্রিয় বড়াল ওরফে বাবুল সুপ্রিয়, যাঁর উপর আরএসএস ন্যস্ত করেছে বাংলার হিন্দিকরণের ও বাঙালি সাবর্ণ ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায় কে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ছাতার তলায় আনার কাজ। 

এক কালে হিন্দি গান গেয়ে বোম্বাই শহরের উচ্চবিত্তদের মধ্যে স্থান করে নেওয়া বাবুল চিরকালই হিন্দির দোসর। সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদী’র পক্ষ নিয়ে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো অভিজিৎ ভট্টাচার্যের মতনই সুযোগ বুঝে বিজেপি’তে যোগ দেওয়া বাবুল আজ পশ্চিমবঙ্গের মসনদে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বসার স্বপ্ন দেখছে। আসানসোল শহরে করা দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তাঁর স্থান রাজ্য বিজেপিতে রাজ্য অধ্যক্ষ দিলীপ ঘোষ বা তাঁর গোষ্ঠীর লকেট চাটুজ্যে ও সায়ন্তন বোসের চেয়ে অনেক উপরে করে দিয়েছে। তাই আজ বাম ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি ও শাসক শ্রেণীর চোখের বিষ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গো-বলয়ের থেকে বাংলায় পাঠানো হিন্দি-ভাষী অনুপ্রবেশকারী গুন্ডাদের নিয়ে বাবুল হিম্মত করে ঢোকার চেষ্টা করে এবং ছাত্রদের গায়ে হাত তোলে নিজের ঔদ্ধত দেখাতে। 

আশু ও তিমিরের যাদবপুর এর আগে একা একা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হিংস্র পুলিশের মোকাবিলা করে “হোক কলরব” তুলেছিল, এর আগে যাদবপুর হিন্দি আধা-পর্ণ ছবি নির্মাতা ও মোদী’র দালাল ভিবেক অগ্নিহোত্রী ও তাঁর ভাড়াটে গুন্ডাদের রুখে দিয়েছিল, আর গত ১৯শে সেপ্টেম্বর সেই ছাত্ররাই, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করে, মারের বদলে পাল্টা মার দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ঐতিহ্য কে রক্ষা করলেন গেরুয়া ফ্যাসিস্ট গুন্ডাদের থেকে এবং ব্যারিকেড গড়ে তুললেন বাবুলের বিরুদ্ধে যিনি ছাত্রদের মেরে, ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করে জোর করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঙালি এবিভিপি’র খাতা খোলার চেষ্টা করছিলেন। 

এই সংগ্রামের ফলে ধাক্কা খেয়েছে সংঘ পরিবারের ষড়যন্ত্র। বাংলার বুকে ৪২টি লোকসভা আসনের ১৮টি দখল করে বাঙালি মুসলিমদের জোর করে বিতাড়িত করে হিন্দি ও গুজরাটি-ভাষীদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়ে যাঁরা ভেবেছিল এই রাজ্যে তাঁদের টেক্কা দেওয়ার কেউ নেই, তাঁরাই ছাত্রদের হাতে মার খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বিজেপি নেতা থেকে রাজ্যপাল হওয়া জগদ্বীপ ধানকরের ছাত্র আন্দোলন কে ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করার চেষ্টা করা ও হবু মুখ্যমন্ত্রী কে রক্ষা করা দেখে কারুরই জানতে বাকি নেই যে গেরুয়া বাহিনী চোট খেয়েছে।  পুলিশ প্রশাসনের উপর সর্বাত্মক কব্জা করেও (সৌজন্যে রাজীব কুমার ও মমতা’র মোদী’র সাথে সাক্ষাৎ) আরএসএস বুঝছে যে বাংলা দখলের জন্যে আরও অনেক লড়াই চালাতে হবে, অনেক রক্ত ঝরাতে হবে। 

তাই যাদবপুর কে শায়েস্তা করতে সুদূর আসানসোল, খড়্গপুর ও ঝাড়খন্ড থেকে আনানো হচ্ছে সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনী। ছাত্রদের হিংসার হুমকি দিচ্ছে সায়ন্তনের দলবল। তাঁরা কলকাতার বুকে মিছিল করে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণে মারার, জেলে পোড়ার হুমকি দিচ্ছে। বাবুল চ্যালেঞ্জ করছে ছাত্রদের, হুমকি দিচ্ছে মানসিক চিকিৎসালয়ে হীরক রাজা’র মতন মগজ ধোলাই করিয়ে ছাত্রদের নাকি সে বাধ্য হতে শেখাবে। এই সব হুমকিতে ছাত্র-ছাত্রীরা ভয় পাননি, যাদবপুর ভয় পায়নি, ভয় পেয়েছে কিছু ধুরন্ধর সুবিধাবাদীরা, যাঁরা বাবুল কে রোখার লড়াই কে বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্যবাদী বলে পলিটিক্যালি কারেক্ট হতে চাইছে।

এদের মুখে লাথি মেরে, সহযোগিতা ও উদার গণতন্ত্রের সোনার পাথরবাটি’র স্বপ্নের মায়াজাল ছিন্ন করে ছোট ছোট অঙ্কুরগুলো, যাঁরা কাল মহীরুহে পরিণত হবে, বুঝতে পেরেছে যে মারের বদলে পাল্টা মার না দিলে, ইটের বদলে পাটকেল না দিলে শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা পদদলিত হবেন তাই নয়, সমগ্র সমাজে আরএসএস এর স্বৈরতন্ত্র কায়েম হলে মেহনতি মানুষ, শ্রমিক ও কৃষক পদদলিত হবেন, তাঁদের ইজ্জত লুন্ঠিত হবে, তাঁরা লাঞ্চিত হবেন পদে পদে। যাদবপুরের লড়াই তাই মাথা নত করে না থাকার লড়াই, যাদবপুরের লড়াই স্বপ্ন দেখার লড়াই, যাদবপুরের লড়াই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে ন্যায় সঙ্গত বিদ্রোহ। 

তবে মুশকিল হবে যদি এই প্রতিরোধ, এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, সে যে সংগঠনের কর্মীরাই করে থাকুক না কেন, যদি তা শুধু শহুরে, শিক্ষিত, প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সীমিত থেকে যায়, যদি তার পরিধি বিস্তার করে শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের মধ্যে না পৌঁছতে পারে, যদি তা শোষিত জনগণ কে সক্রিয় প্রতিরোধের সংগ্রামে সামিল করে, ফ্যাসিবাদ কে যে পরাজিত করা যায়, নিজের ভাগ্য যে নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই সত্য উপলব্ধি করিয়ে তাঁদের উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে না যেতে দেয়, তাহলে কিন্তু যাদবপুরের সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সেটা শুধু ছাত্র সংগ্রাম থেকে যাবে, জনগণের সংগ্রাম হয়ে উঠবে না। 

আজ নির্মম ভাবে সারা ভারত জুড়ে জনগণের উপর শোষণের রোলার চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন মোদী সরকার। যে ভাবে এই সরকার হাতেগোনা কিছু দেশী মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের হাতে দেশের সম্পদ ও শ্রম বেচে দিচ্ছে, যে ভাবে এই সরকার বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির কাছে ভারতের সমস্ত ক্ষেত্র কে উদার করে খুলে দিচ্ছে অবাধ আধা-ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুন্ঠনের স্বার্থে, যে ভাবে এই সরকার ভারত রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর মধ্যেই অভ্যন্তরীন দ্বন্ধ তীব্র করে দিয়েছে এ যাবৎকাল ভারসাম্য বজায় রাখার সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কে শুধু কিছু হাতেগোনা বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও তাঁদের বিদেশী মালিকদের তাঁবেদারে পরিণত করে, তা দেখে কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষ বুঝতে পারবেন যে এই ভারতীয় মেকী গণতন্ত্র, যা ব্যবহার করে আজ অবধি মানুষ কে বোকা বানিয়েছে ভারতের শাসক শ্রেণী, তার মেয়াদ কিন্তু প্রায় উত্তীর্ণ। 

আরএসএস ও মোদী সরকার কোন ভাবেই আর এই গণতন্ত্রের খোলস পড়ে থাকতে চায় না বরং জায়নবাদী ইজরায়েল, রাশিয়া বা তুর্কির চরম প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের মতন এরা এবার গণতন্ত্র কে সাম্প্রদায়ীকরণ ও নির্বাচন কে অসার একটি অনুশীলনে পরিণত করবে। এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক দল ও এক নেতার স্লোগানের আড়ালে বিরোধী দলগুলো কে নিস্তেজ করে দিয়ে, সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিগুলোতে সুড়সুড়ি দিয়ে, চরম ইসলামবিদ্বেষ ও ব্রাক্ষণত্ববাদী প্রচারের মাধ্যমে এক স্বৈরতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্র এরা গড়ে তুলতে চায় ২০২২ সালের মধ্যেই। তার জন্যেই বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাড়ু, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে বিজেপি’র একচেটিয়া শাসন ক্ষমতা চাই। কাশ্মীরে ও আসামে লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনগণের থেকে বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, তাঁদের চরম ভাবে নির্যাতন করে ভারতের নব্য শাসকশ্রেণীর পদলেহী বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে এবার তাঁরা পিছু হটবে না। 

এই অবস্থায় কি কমিউনিস্ট, বামপন্থী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ও প্রগতিশীল ছাত্র-যুবদের, যাঁদের দেশ ও ভবিষ্যৎ আজ আক্রান্ত হয়েছে হিন্দি ভাষা ও হিন্দুত্বের পদাতিক বাহিনী দ্বারা, চুপ করে বসে থাকা ও রাজনৈতিক ভাবে গুটিয়ে যাওয়া উচিত না ফেটে পড়া উচিত, বিস্ফোরিত হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগ্রামের ময়দানে? আজ যখন মোটামুটি ভাবে সকল ধরণের বামপন্থী আন্দোলনই নানা ধরণের চোরাবালিতে নাকানিচোবানি খাচ্ছে তখন কিন্তু ছাত্র-যুব শক্তি তাঁদের মেধা দিয়ে এবং দূরদৃষ্টি দিয়ে নতুনত্ব সৃষ্টি করতে পারেন যদি তাঁরা দলে দলে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষদের মধ্যে, শোষিত জনগণের মধ্যে যে ভাবে মাছ জলে মিশে থাকে সে ভাবে মিশে যেতে পারেন, একাত্ম হতে পারেন এবং তাঁদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, তাঁদের রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে নেতৃত্বে উত্তীর্ণ করতে পারেন।এলাকা-ভিত্তিক ক্ষমতার সংগ্রামই আগামীদিনের মহাসংগ্রামের ময়দানে নানা স্রোত হতে মিলিত হবে, এই কাজে বিলম্ব করা উচিত নয়। 

সময় আজ বিলাসিতা আর বিলম্ব মানেই মৃত্যু। শুধু যে ছাত্র-যুবরাই আক্রান্ত তা না, তাঁদের সাথে সাথে কলকারখানার শ্রমিকেরা, বন্ধ কারখানার বেকার শ্রমিকেরা, শহুরে অসংগঠিত শ্রমিকেরা, কৃষকেরা ও গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণীও আক্রান্ত হতে চলেছেন প্রতি পদে। তাই এখনই যাদবপুরের প্রতিরোধ কে একটা সঙ্কল্পের সাথে, একটা সচেতনতার সাথে, গণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মূল্যবোধের সাথে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়া উচিত, শ্রেণীর মধ্যে নিয়ে যাওয়া উচিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের বাইরে এনে এই প্রতিরোধ সংগ্রাম কে দূর্গা পুজোর চেয়েও বড় সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করা উচিত।

এই কাজ ছাত্র-যুবরা, তা তাঁরা যাদবপুরের হন বা অন্য কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের, কিন্তু নিশ্চয় সফল ভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন কারণ তাঁরা সকাল আট’টা বা ন’টার সূর্যের মতন প্রখর ও উজ্জ্বল। তাঁরা যদি আজ শোষিত মানুষের সাথে একাত্ম হতে পারেন তাহলে আজই ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা সম্ভব, যদি কাল পারেন তাহলে কাল সম্ভব। এই সংগ্রাম কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার নয়, এই সংগ্রাম শক্ত হাতে হাল ধরার সংগ্রাম, যা শ্রমিক ও কৃষকের সংগ্রাম এবং ছাত্র-যুব শক্তি এই সংগ্রামে বার্তাবাহকের কাজ যদি সঠিক ভাবে করতে পারেন তাহলে সুউচ্চ কেল্লার মসনদ থেকে মোদী ও তাঁর সাগরেদদের, হিন্দুত্ববাদী বদমায়েশদের, বাবুলের মতন হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের, হিন্দি আগ্রাসনের নায়কদের টেনে নামানো সম্ভব, সড়কে, মাঠে, ময়দানে সংগ্রাম করে তাঁদের পরাস্ত করাও সম্ভব। এই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়। যাদবপুরের ঐতিহ্য কে সামনে রেখে আজ বাংলার কোনে-কোনে শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামী ব্যারিকেড গড়ে তুলতে, পথে নেমে ফ্যাসিবাদ কে প্রতিহত করতে আজ ছাত্র-যুবদের এগিয়ে আসতেই হবে।

৩৭০ ধারা বিলোপ, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান নাকি আন্দোলনের নবজাগরণ?

বুধবার, আগস্ট ০৭, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


জঙ্গী হামলা হওয়ার আগাম খবর আছে, তাই নাকি ছাত্র, পর্যটক সহ সমস্ত বহিরাগতদের কাশ্মীর ছাড়ার নির্দেশ দিল নরেন্দ্র মোদী'র নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হলো হিন্দুদের পবিত্র অমরনাথ তীর্থ যাত্রা, যার উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কাশ্মীরী মানুষ। বন্দুকধারী বাহিনী আর কাঁটাতার দিয়ে আরো বেশী ছেয়ে দেওয়া হল কাশ্মীর। বন্ধ করে দেওয়া হল ফোন, মোবাইল সংযোগ, ইন্টারনেট এর মত সমস্ত যোগাযোগের মাধ্যম।  ঠগীর কাছে বোকা বনে গিয়ে নির্মল আনন্দ উপভোগ শুধুমাত্র নির্বোধ ভক্ত ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং কাশ্মীরিরা বিশ্বাস করল না কেন্দ্র সরকার’কে। তাঁরা আশংকা করল গোটা কাশ্মীর কে বন্দুকের নলের মুখে দাঁড় করিয়ে, কাঁটাতার দিয়ে বেঁধে বিলোপ ঘটানো হবে সংবিধানের ৩৭০ ধারা।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে কাশ্মীরীদের আশংকাই সঠিক প্রমাণিত হল। মিথ্যা প্রচারে সেনা আধিকারিকদের ব্যবহার করল বিজেপি সরকার, দেশের জনতাকে সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার গল্প শুনিয়ে সন্ত্রস্ত করে তাড়াতাড়ি  সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হলো । কাশ্মীরের জনগণ বা স্বাধীনতাকামী হুরিয়াত কনফারেন্স দূরে থাক, ভারতপন্থী নির্বাচিত কাশ্মীরী নেতাদের সাথেও কোনো রকম মতামত বিনিময় হল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছিলেন যে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ ফারুক আবদুল্লাহ নিজের ইচ্ছায় পার্লামেন্ট আসেননি। তারপর ফাঁস হল যে তাঁকে গৃহবন্ধী করে পার্লামেন্টে আসতে দেয়নি সরকার।  


এই  সরকারি গণ প্রতারণা প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করল যে নাগরিকদের  দ্বারা নির্বাচিত বলে দাবি করা হয় এমন সরকার আদৌ তার নাগরিকদের সম্মান করে কিনা? মধ্য যুগের রাজা জমিদারদের আমলের মতন রাষ্ট্র জনগণের ঊর্ধ্বে নাকি রাষ্ট্র হল জনগণকে সেবা করার সংস্থা? জাতিসত্তাগুলো তাদের ভাগ্য ও জীবনযাপনের সাথে জড়িয়ে থাকা সিদ্ধান্ত সমুহ নিজেরা নেবে নাকি বাইরের কোনো শক্তি তাদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে?  ভারতপন্থী বা ভারত বিরোধী সমস্ত কাশ্মীরি নেতাদের গ্রেফতারী আর সমগ্র কাশ্মীর জুড়ে কার্ফু জারি করে নাগরিকদের আটক করে রাখার মধ্যে দিয়ে কি এইটা প্রমাণ হল না যে কাশ্মীরের কোনো অংশের মধ্যেই সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে জন সমর্থন নেই? জনমত ছাড়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক আগ্রাসন ভিতরে এবং বাইরে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠন করবে না কি?  


নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো ৩৭০ ধারা বিলোপে উচ্ছ্বসিত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী উগ্রজাতীয়তাবাদীরা।  তারা প্রশ্ন করছেন কাশ্মীর কেন বিশেষ সুবিধা পাবে? কিন্তু তারা এই প্রশ্ন করছেন না যে বাকি প্রদেশগুলোও কেন ঐ সুবিধাগুলো পাবে না! ৩৭০ ধারা নিয়ে নানা মুনির নানা মত (কাশ্মীরী মানুষদের বাদে) থেকে পৃথক করে বস্তুগত ভাবে বর্তমান সংকট কে বুঝতে সংক্ষেপে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক আধুনিক কাশ্মীরের ইতিহাস ও  ৩৭০ ধারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর।         


১৮৪৬ সালে প্রথম ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে  শিখরা ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। ব্রিটিশদের দাবি মত যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় কোটি টাকার পুরোটা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় শিখেরা জম্মুর হিন্দু ডোগরা শাসক  গুলাব সিংহ কে কাশ্মীর বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। ডোগরা হিন্দু শাসকরা যেহেতু জম্মুতে বসে কাশ্মীর শাসন করতেন, তাই জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উদ্ভব। ডোগরা শাসকরা ব্রিটিশ শাসকদের সম্মানজনক নজরানা পাঠাবে এবং ব্রিটিশরা জম্মু ও কাশ্মীরের শাসক হিসেবে ডোগরা শাসকদের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তা দেবে, এই ছিল বোঝাপড়া। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার আগে এরকম ৫৬২ টা দেশীয় রাজ্য ছিল, যেগুলো সরাসরি ব্রিটিশ ভারতের প্রশাসনের আওতায় ছিল না। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর ছিল বৃহত্তম। 


১০০ বছরের ডোগরা শাসন কাশ্মীরী চাষীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। সাধারণত রাজা বা সামন্তপ্রভুরা যেমন হয় আর কি। কাশ্মীরে করের বোঝা বরাবরই মাত্রাতিরিক্ত ছিল, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক অত্যাচার। সামন্ত মহাজনরা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চবর্ণ হিন্দু আর গরিব কৃষক কারিগরেরা মুসলমান। জি এন কাউল এর রচনায়, ১৯২০ সালের কাশ্মীরী সমাজের যে বিবরণ পাওয়া যায় সেখান থেকে জানা যায় যে অন্ততঃ ৯০ শতাংশ মুসলমানের বাড়ি হিন্দু মহাজনের কাছে বন্ধক পড়ে ছিল।  ১৯৪৭ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৭৭% ছিলেন মুসলমান। আর কাশ্মীর উপত্যকার ৯৩% মানুষ ছিলেন মুসলমান। ফলে শ্রেণী শোষণে যারা পিষ্ট হচ্ছিল সেই কাশ্মীরী শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা গরিষ্ঠই কিন্তু মুসলমান ছিলেন। 


জম্মু ও কাশ্মীরে ডোগরা রাজবংশ, জায়গিরদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের এক বড় ঐতিহ্য আছে। যেটা জোরদার হতে থাকে বিংশ শতাব্দী’র তিনের দশক থেকে। শেখ আবদুল্লাহ’র নেতৃত্বে কাশ্মীরে সামন্তবাদ-বিরোধী ব্যাপক ভূমি সংস্কার তারই প্রতিফলন। ব্রিটিশ শাসকেরা যে ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছে এই খবর ১৯৪৬ সাল নাগাদই হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছিল। যেহেতু ব্রিটিশরা নজরানার বিনিময়ে রাজাকে নিরাপত্তা প্রদান করত তাই ব্রিটিশ শাসন  শেষ হওয়ার আভাস পেয়ে কাশ্মীরে শুরু হয় রাজতন্ত্র বিরোধী "কাশ্মীর ছাড়ো" আন্দোলন। পুঞ্চ অঞ্চলের কৃষকরা রাজা গুলাব সিংহ’র আমল থেকেই বিদ্রোহ করে এসেছে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, পুঞ্চ অঞ্চলের কৃষক অভ্যুত্থান সংগঠিত আকার ধারণ করে, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে রাজা হরি সিংহ’র অত্যাচার। এর আগে বার বার কাশ্মীরে হিন্দু মৌলবাদীদের সাথে জিন্নাহ পর্যন্ত রাজা হরি সিংহ কে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করে এলেও ,পুঞ্চের এই বিদ্রোহের সময় পাকিস্তান তার নীতি বদল করে। 


১৯৪৭ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের  এক বিরাট সংখ্যক “উপজাতি” জঙ্গী বাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করে। আর এই হামলাকারিদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় পুঞ্চের জনতা। পাকিস্তান’ও অঘোষিত ভাবে সেনা বাহিনী পাঠিয়ে দেয় হামলাকারী ও বিদ্রোহীদের সাথে।  রাজা বিপাকে পড়েন এবং নব্যগঠিত ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধার নেহরু ও প্যাটেলের কাছে সাহায্য চান। সাহায্যের বদলে ভারত কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি দাবি করে আর চাপে পড়ে হরি সিংহ তা মেনে নেন। ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ এ জম্মু ও কাশ্মীর এবং ভারত সরকারের মধ্যে Instrument of Accession চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মুল কথা হল এই যে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, ও যোগাযোগ, এই তিনটে ক্ষেত্রে  জম্মু ও কাশ্মীর সরকার ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নেবে। কিন্তু এই চুক্তি চূড়ান্ত হবে জম্মু ও কাশ্মীরে গণভোটের পর। 


সেই দিনই কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা পৌছলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে শেখ আবদুল্লাহ’র ন্যাশনাল কনফারেন্স এর স্বেচ্ছাসেবকরা। ১৯৪৭ সালের ২ নভেম্বর, নেহরু তার বেতার ভাষণে কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির বিষয়টি কাশ্মীরের মানুষের গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে বলে ঘোষণা করেন। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি নেহরু রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীরে গণভোটের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। নেহরুর গণভোট সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ৬ জানুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে, ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্র সংঘ কাশ্মীরে গণভোট সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তাতে ভারত এবং পাকিস্তান উভয় গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারনের বিষয়টি মেনে নিয়েছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত রাষ্ট্র সংঘ কাশ্মীরের গণভোট নিয়ে অন্তত আটটি প্রস্তাব নিয়েছে। এমনকি ১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর গণভোট সংক্রান্ত রূপরেখা তৈরি হওয়ার পর, ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। যদিও সেই গণভোট আজও করা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্র সংঘে ভারতীয় প্রতিনিধি ঘোষণাই করে দিলেন যে কোন অবস্থাতেই তার সরকার গণভোট করাতে রাজি নয়।


১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের সংবিধান সভা ভারতীয় সংবিধানের  ৩০৬-এ ধারা যুক্ত করে জম্মু ও কাশ্মীরের আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়। একই সাথে বলা হয় যে যতদিন না পর্যন্ত গণভোটের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ  তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ না করেন ততদিন পর্যন্ত বিষয়টি Interim System হিসেবে থাকবে। পরবর্তী কালে ভারতের নবগঠিত সংবিধানে এই ৩০৬এ ধারাটি নতুনভাবে ৩৭০ ধারা হিসেবে যুক্ত হয়। কিন্তু এই ৩৭০ ধারায়  গণভোটের বিষয়টি কে হাপিস করে দেওয়া হয়, ধীরে ধীরে ৩৭০ ধারাটি কে সংশোধনের মাধ্যমে প্রায় বিলুপ্তির পথে নিয়ে গিয়েছে ভারত সরকার।  


৩৭০ ধারার খসড়া দেখার পর শেখ আবদুল্লাহ অসম্ভব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কারণ এ ছিল স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা। এই সময় থেকে আবার শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের গণভোট ও কাশ্মীরের স্বাধীনতার কথা তুলতে থাকেন এবং ব্যাপক জনসমর্থন পেতে থাকেন। ১৯৫৩ সালে ভারত সরকার রাজা হরি সিংহ’র পুত্র কাশ্মীরের সদর-ই-রিয়াসত করণ সিংহ’কে দিয়ে কাশ্মীরের জননেতা শেখ আবদুল্লাহ কে গ্রেপ্তার করান। শেখ আব্দুল্লাহ’র মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কাশ্মীর, নির্মম অত্যাচারে এই আন্দোলন দমন করা হয়। পুলিশের গুলিতে অন্তত ৬০ জন কাশ্মীরী প্রাণ হারান। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৮ সালের বেশিরভাগ সময়টাতেই শেখ আবদুল্লাহ জেলে কাটান।  শেখ আব্দুল্লাহ’র সাথে তার সহকর্মী মির্জা আফজল বেগও জেলে ছিলেন। রাষ্ট্র সংঘের মানবধিকার সনদকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই দুজনকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়, কোন অপরাধেই এদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। এর পর দমনের মুখে পুরানো নেতাদের পালটি খাওয়া তাদের জনবিচ্ছিন্ন হওয়া, নতুন প্রজন্মের নেতাদের আবির্ভাব, বামপন্থী সশস্ত্র সংগ্রামী মকবুল ভাটের উত্থান, সেকুলার সশন্ত্র স্বাধীনতাকামী দল হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের উত্থান তারপর প্রচন্ড দমনের মুখে পড়ে গান্ধীবাদী স্বাধীনতাকামীতে পরিণত হওয়া, স্বাধীনতা সংগ্রামকে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত করার ভারতীয় প্রচেষ্টা বা ভারতের প্রতি ঘৃণাকে পাকিস্তানের কাজে লাগানো, পন্ডিতদের ইস্যু এই সব নিয়ে বিস্তারিত লেখার অবসর আপাতত নেই।


বলরাজ পুরি, আয়লাস্টে ল্যাম্ব প্রভৃতি সমাজবিজ্ঞানী এবং ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথমেই গণভোট হয়ে গেলে কাশ্মীর ভারতের দিকেই আসত। তার একটা বড় কারণ জননেতা শেখ আবদুল্লাহ । যিনি “বন্ধু” নেহরু’র প্রভাবে নিজের দলের নাম মুসলিম কনফারেন্স পাল্টে ন্যাশনাল কনফারেন্স করেছিলেন, ইসলামিক রাষ্ট্রের বদলে “সেকুলারিজম” এ তাঁর ঝোঁক ছিল বেশী। তা ছাড়া পাকিস্তানের সাথে বা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জনতার সাথে পাঞ্জাবী মুসলমানদের সংস্কৃতিগত মিল থাকলেও এই পাড়ের কাশ্মীর, যেখানে শেখ আব্দুল্লাহ’র প্রভাব ছিল, সেখানে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, সুফি মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত ইসলাম বিরাজ করতো। তাছাড়া নিরাপত্তার জন্য ভারতের ছত্রছায়া তাদের মেনে নিতে কোন সমস্যা ছিল না।   কিন্তু আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজি ও ভারত সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলোনা রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন যুক্তরাষ্টীয় কাঠামো। শেখ আব্দুল্লাহ’র কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী নয় কিন্তু) হওয়ার পর বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারের হাত থেকে জমি বাজেয়াপ্তকরণ ও ব্যাপক ভূমি সংস্কার আতংকিত করে শাসক শ্রেণীকে। প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা যদি রাজ্যের হাতে থাকে তবে ঐ রাজ্যে উঠতি ব্যবসায়ীদের হাতে ক্ষমতা আসার সম্ভবনা তৈরি হয়, তারা নিজেদের হাতে প্রদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে সুবিধা অনুযায়ী আইন পাস করে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল বৃহৎ পুঁজিপতিদের শোষন প্রক্রিয়ায় বাধা দান করতে পারে। অন্যান্য রাজ্যগুলোও তখন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাইবে। প্রদেশের সম্পদের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে ঐ অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রন। আঞ্চলিক পুঁজিবাদের বিকাশ হবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে  অবাধ শোষনের জন্য তৈরি নয়া উপনিবেশিক কাঠামো তথা অতি বৃহৎ পুঁজি।        


 ভারতীয় বলে কোনো জাতি হতে পারে না। ভারত বহু জাতিসত্তার দেশ। ফলে ক্ষমতাশালী কেন্দ্র সরকারের বদলে অধিক ক্ষমতাশালী রাজ্য সরকারগুলোই জাতিসত্তাগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক বিকাশ ঘটাতে পারে। উল্টো দিকে, ভারতে প্রভাবশালী পশ্চিম ভারতের গুজরাটী, মারোয়াড়ি, পারসি পুঁজিপতিদের প্রয়োজন হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত  এক-কেন্দ্রিক শক্তিশালী কেন্দ্র সরকার। অতীতে পশ্চিম ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করতেন মোহনদাস গান্ধী’র নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস নেতৃত্ব। অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাংলায় চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ চন্দ্র বসু সহ বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেস নেতৃত্ব। পরবর্তীকালে গুজরাটী-মাড়োয়ারী মুৎসুদ্দিরা গড়ে তোলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, হিন্দু মহাসভার মত দলকে যারা আভ্যন্তরীণ গোলযোগ ছাড়াই উগ্রভাবে তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করবে।   


৩৭০ ধারা বিলোপ কাশ্মীরী জনতাকে আরো বেশী ভারত সরকার  বিরোধী অবস্থানে ঠেলবে সন্দেহ নেই। দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতাকামী নেতারা শুধু নয়, ভারতপন্থী মূলধারার কাশ্মীরী নেতারাও এবার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। এই আগ্রাসন ভারতপন্থী বা নরমপন্থী কাশ্মীরী নেতাদের রাজনৈতিক ভাবে বিপন্ন করলো। কেন্দ্রীয় সরকারের এককেন্দ্রিক আগ্রাসন শুধু কাশ্মীর নয় দক্ষিণ ভারতের জাতিসত্তাগুলোর মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি করছে।  বন্দুকের নলের ডগায় ঐক্য সম্ভব নয়, ঐক্য সম্ভব বিচ্ছিন্নতার অধিকার সহ সমস্ত জাতিসত্তা'র সহমত ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে।               

জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে ভারতের জুয়া খেলা চলছে

মঙ্গলবার, আগস্ট ০৬, ২০১৯ 0 Comments A+ a-



ভারতের শাসকশ্রেণীর বিশ্বস্ত দালাল ও ফ্যাসিবাদী নরেন্দ্র মোদী’র সরকার কাশ্মীরের উপর নগ্ন সামরিক শাসন জারি করে, কাশ্মীরি জনগণ ও তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের, এমন কী ভারতের প্রতি বিশ্বস্ত সব দালাল রাজনৈতিক নেতাদেরও, গৃহ বন্দী করে ঘোষণা করল যে ভারতের সংবিধানের ধারা ৩৭০ ও ৩৫এ, যা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী একদিন কাশ্মীর কে ভাঁওতা দিয়ে অধিগ্রহণ করার সময়ে মেনে নিয়েছিল, খারিজ করা হচ্ছে। সংসদে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের পান্ডা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সংসদীয় গণসংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) নিজের সংখ্যাগত জোর খাটিয়ে এই প্রস্তাব পাশ করায়। ধারা ৩৭০ বাতিল করতে রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তি জারি করে মোদী সরকার, কারণ এ ছাড়া কোন ভাবেই ধারা ৩৭০ কে বাতিল করা সম্ভব ছিল না। অথচ ধারা ৩৭০ বিলোপ করতে রাষ্ট্রপতির প্রয়োজন ছিল জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার সেই বিষয়ে পাশ করা প্রস্তাব। তবে যেহেতু কাশ্মীরে পুতুল সরকার রাখারও সাহস বিজেপি ও মোদী সরকার বিগত এক বছর ধরে করতে পারেনি, যেহেতু নির্বাচনের নামে চূড়ান্ত সামরিক প্রহসন দিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্রের ধ্বজ্জা আর তাঁরা তুলে রাখতে পারেনি, তাই বিধানসভা কে বাদ দিয়ে মোদী’র দ্বারা প্রেরিত রাজ্যপাল তথা প্রাক্তন বিজেপি নেতা সত্যপাল মালিকের প্রস্তাবই যথেষ্ট বলে গণ্য করে রাষ্ট্রপতি’র বিজ্ঞপ্তি জারি করা হল। আর এই চূড়ান্ত রকমের অসাংবিধানিক কাজে কিন্তু উগ্র দেশপ্রেমের ও ইসলাম-বিদ্বেষের বন্যা বইয়ে সমর্থন হাসিল করলো দাঙ্গাবাজ ও খুনের আসামী থেকে দেশের গৃহ মন্ত্রী হওয়া অমিত শাহ।

যে সংবিধান কে চোখের মণির মতন শাসক শ্রেণীর দালালেরা রক্ষা করার কথা বলে, তাদের কেউই কিন্তু এর বিশেষ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করলো না, পাছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সাবর্ণ হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কে ধাক্কা লাগে। তাই দলিত রাজনীতি’র তথাকথিত প্রতীক সেজে শোষিত জাতির মানুষ কে ঠকিয়ে কার্যসিদ্ধি করা বহুজন সমাজ পার্টি হোক বা দিল্লির তথাকথিত মোদী-বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কংগ্রেসের জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া হোক বা নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দল, সবাই দল বেঁধে মোদী ও শাহের দ্বারা এভাবে দেশের সংবিধানের শ্লীলতাহানির পক্ষেই জোট বেঁধে দাঁড়াল। 

মোদী’র মোসাহেবদের দিয়ে ও তাঁর ঢোল বাদক মূল ধারার সংবাদমাধ্যমকে দিয়ে জনগণ কে বোঝানো হল যে এই সিদ্ধান্তের ফলে কাশ্মীর সমস্যা নাকি চিরকালের জন্যে মিটে গেল, কাশ্মীরের নাকি এবার শান্তি ফিরবে আর পাকিস্তানের অবস্থা নাকি কাহিল হবে। কাশ্মীর নিয়ে উগ্র ইসলামবিদ্বেষের শিকার হওয়া মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ ও অনেক গরীব, খেটে খাওয়া শোষিত জনজাতির মানুষও এই প্রচার কে চিরন্তন সত্য মেনে মোদী বন্দনায় রত হলেন। ভারতের শাসকশ্রেণীর মুসলিম-বিদ্বেষী প্রচার ও তার সাথে সাথে সংবাদমাধ্যম, সিনেমা প্রভৃতিতে কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম কে কুৎসিত ভাবে চিত্রিত করার মধ্যে দিয়ে শুধু কাশ্মীর বা পাকিস্তান নিয়ে না, ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মধ্যে মুসলিমদের সম্পর্কেও একটি ভ্রান্ত ধারণা দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করা হয়েছে। মোদী ও বিজেপি তারই ফসল। এই ঘৃণার উপর ভিত্তি করেই মোদী সরকার আজ দেশের হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল ও উচ্চবর্ণের সামন্তপ্রভু ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের এক ছাতার তলায় এনেছে। এই ঘৃণার উপর ভিত্তি করেই আজ দেশের কোনায় কোনায় সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো হচ্ছে, সংখ্যালঘু মুসলিমদের হয় গরু খাওয়ার নামে না হয় “জয় শ্রী রাম” নামক ফ্যাসিবাদী স্লোগান দেওয়ার বাহানা করে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। 

কাশ্মীর নিয়ে এই মুহূর্তে সবাই কথা বলছে। গুজরাটে কথা হচ্ছে, মহারাষ্ট্রে কথা হচ্ছে, দিল্লি-মুম্বাই-কলকাতা-চেন্নাই সব বড় শহরে আলোচনা হচ্ছে। সবাই নিজের মতামত ও পাল্টা মতামত রাখছেন শুধু কাশ্মীরি জনগণ কে বাদ দিয়ে। তাঁদের কথা বলার অধিকার নেই। তাঁদের জীবনের ব্যাপারে পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিচ্ছে একদল হিন্দি-গুজরাটি ভাষী দাঙ্গাবাজেরা অথচ সেখানে তাঁদের স্থান নেই কারণ “বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ” কাশ্মীরিদের দরজায় তালা দিয়ে সেখানে রাষ্ট্রের সান্ত্রী কে অটোমেটিক রাইফেল হাতে দাঁড় করিয়ে কাশ্মীরি জনগণের ফোন, টিভি, মোবাইল, ইন্টারনেট প্রভৃতি বন্ধ করে তাঁদের স্বার্থে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কাশ্মীরি জনগণ কাশ্মীর নিয়ে কোন কথা বলবে না এই গণতন্ত্রে এটাই দস্তুর। কাশ্মীর কী খাবে, কী পড়বে, কাকে ভালোবাসবে তা ঠিক করবে দিল্লি, মুম্বাই বা আহমেদাবাদ। এটাই গণতন্ত্রের মহত্ব।  

যে ভাবে একদিন ডাহা মিথ্যা কথা বলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সংস্থা USAID এর দেখানো পথে নোট বাতিল করা হয়েছিল দেশপ্রেমের তুলসীপাতা বাটা খাইয়ে, যেমন একদিন বেড়ে চলা বেকারত্ব ও রাফাল কেলেঙ্কারির থেকে নজর ঘোরাতে করা হয়েছিল বালাকোটের নাটক, ঠিক তেমনি আজ দেশের চরম আর্থিক দুর্দশা, যার ফলে মোদী’র একান্ত ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিরাও আজ চরম ভাবে ক্ষুব্ধ, যে ভাবে আজ বেকারত্বের পরিসংখ্যান ৪৫ বছরের সর্বাধিক, যে ভাবে কৃষি ও কৃষি ঋণের সঙ্কটে আজ জরাজীর্ণ কৃষকের আর্থিক অবস্থা, এমনকি মধ্য কৃষকরাও দলে দলে নেমে আসছে গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণীতে, যে ভাবে আজ সকল শিল্পে চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে যার ফলে উৎপাদন মে মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়েছে সমস্ত core শিল্পে ও কারখানায়, যে ভাবে গাড়ি, গৃহ নির্মাণ, ইস্পাত সহ অন্যান্য শিল্পের তীব্র সঙ্কটের ফলে কাজ হারাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, যখন রেলওয়ে ঘোষণা করেছে তিন লক্ষ কর্মী ছাঁটাইয়ের, সমস্ত বড় শিল্পে অস্থায়ী শ্রমিকদের উপর নেমে আসছে ছাঁটাইয়ের কোপ, ঠিক তখন এই কাশ্মীরের ঘটনা মোদী’র টিকে থাকার জন্যে অবশ্যম্ভাবী ছিল। 


ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জম্মু ও কাশ্মীর

ভারতের চতুর্দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন বিদ্রোহ ও বিপ্লবী সংগ্রাম ফেটে পড়ছে তখন কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে কোন বিপ্লবের সম্ভাবনা কে রোধ করতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে অস্ত্র ছিল দেশ ভাগ করার ও বিপ্লবের কেন্দ্র দুই প্রদেশ — পাঞ্জাব ও বাংলা — কে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা। দেশ ভাগের পরে বিভিন্ন রাজার অধীনে যে সব রাজ্য ছিল তাদের শাসকদের কাছে অধিকার ছিল নিজেদের রাজত্ব কে হয় নবগঠিত ভারতে অথবা পাকিস্তানে বিলীন করে দেওয়া আর নয়তো স্বাধীন থাকা। ভারতের শাসকশ্রেণী — বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও সামন্তপ্রভুরা — যাঁরা প্রত্যেকেই সাবর্ণ হিন্দু সমাজের অংশ, তাঁদের প্রতিনিধি জওহরলাল নেহরু আর বল্লভ প্যাটেল কে দিয়ে সমস্ত বৃহৎ রাজত্ব কে ছলে-বলে-কৌশলে নিজেদের শাসনের অন্তর্ভুক্ত করে এক বৃহৎ রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়ে, যেখানে শোষণ ও লুন্ঠনের অবাধ সুযোগ থাকবে।

এই সময়ে কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহ ভারত ও পাকিস্তান, দুইয়ের হাতেই তামাক খাচ্ছিলেন। একটি মুসলিম-প্রধান দেশের হিন্দু রাজা হয়ে তাঁর ভয় ছিল যে যদি জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাঁকে ছুড়ে ফেলতে চায় বা পাকিস্তানের অংশ হয়ে যেতে চায় তাহলে তাঁর রাজত্ব ও ঠাঁটবাট দুইই যাবে। তাই তিনি আরএসএস এর সাথে সমঝোতা করে মুসলিম অধ্যুষিত জম্মুতে নিজের ডোগরা সেনাদের সাহায্যে চালালেন এক অমানবিক মুসলিম গণহত্যা। সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ এর সেই গণহত্যায় বেসরকারি মতে দুই লক্ষ মুসলিম কে হত্যা করে ডোগরা ও আরএসএস বাহিনী। এর সাথে সাথে পাঞ্জাবি হিন্দু শরণার্থীদের পশ্চিম পাঞ্জাব (এখন পাকিস্তান) থেকে আনিয়ে জম্মুতে বসত করে দিয়ে জম্মুর জনসংখ্যার ব্যাপক পরিবর্তন করে হরি সিংহের সেনা। এর ফলে জম্মুতে মুসলিমেরা সংখ্যালঘু হয়ে যান এবং পাঞ্জাবি, ডোগরা ও কাশ্মীরি পন্ডিত মিলিয়ে জম্মু অঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে। 


এই মুসলিম নিধন যজ্ঞের বদলা নিতে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন থেকে দলে দলে আদিবাসী মুসলিম গেরিলারা জম্মু ও কাশ্মীরের উপর আক্রমণ করে এবং গিলগিট বাল্টিস্তান, মুজ্জাফরাবাদ সহ নানা এলাকা দখল করে ফেলে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হরি সিংহ ভারতের কাছে সাহায্য চায় আর এই সুযোগে, সামরিক সাহায্যের বদলে নেহরু চেয়ে বসে কাশ্মীরের উপর দখলদারি। হরি সিংহ ও নেহরু-প্যাটেল জুটি জানতো ভারত কে জম্মু ও কাশ্মীর দিয়ে দেওয়ার চুক্তি করলে সেটাকে মুসলিম বিরোধী বলে প্রচার করে সারা কাশ্মীরে এক বিদ্রোহ তৈরি হবে তাই তাঁরা খুব কায়দা করে অক্টোবর ১৯৪৭ এ Instrument of Accession বা অন্তর্ভুক্তি’র চুক্তি সাক্ষর করে যার শর্ত ছিল যে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসাবে না, কাশ্মীর একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে ভারতে যোগদান করবে এবং ভারতের সরকার শুধু কাশ্মীরের প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বিদেশ মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব পালন করবে, বাকি সব কাজ হবে জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান সভার থেকে। এই অন্তর্ভুক্তি’র চুক্তিতে ভারত প্রতিশ্রুতি দেয় যে ভারতের সরকার কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত করবে এবং সেই গণভোটে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ চয়ন করবেন তাঁদের ভবিষ্যৎ, তাঁরা পাকিস্তানের অংশ হবেন, ভারতের অংশ হবেন, না কি একটি স্বাধীন জাতি হবেন। 


এই চুক্তির ভিত্তিতে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা গৃহীত হয় অক্টোবর ১৯৪৯ সালে। এর এক মাস পরে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয় নভেম্বর ১৯৪৯ এ, আর ভারত কে একটি ঝুটো প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় জানুয়ারি ১৯৫০ এ। এই ধারা ৩৭০ এর মাধ্যমে ভারতের সংবিধান জম্মু ও কাশ্মীরে, যার নিজের সংবিধান, আইন, পতাকা ও শাসনতন্ত্র ছিল, সেখানে প্রয়োগ হতো এবং ভারতের শাসক শ্রেণী নানা কায়দায় বারবার এই ধারায় বদল এনে জম্মু ও কাশ্মীরের উপর নিজেদের ক্ষমতা কে কুক্ষিগত করে। গণভোটের প্রস্তাব কে ভারত নাকচ করে এই বলে যে সেই প্রতিশ্রুতি প্রজাতন্ত্র হওয়ার আগে দেওয়া হয়েছিল মাউন্টব্যাটেন সাহেব গভর্নর থাকাকালীন এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ায় সেই সকল চুক্তি নাকি খারিজ হয়ে গেছে। 


ভারতের শাসকশ্রেণী কথা রাখেনি। শেখ আব্দুল্লাহ কে দিয়ে কমিউনিস্ট নিধন করিয়ে তাঁকে প্রথমে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী করেও ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার করে জেলে বন্দী রাখা হয়। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি কে কাশ্মীরে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়, গণভোটের কথা চেপে গিয়ে সামরিক শাসন কে তীব্র করা হয়, বিশেষ করে ১৯৬২ সালে চীন-বিরোধী ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-বিরোধী যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে। জেল আর জেলের বাইরে বার বার আনাগোনা করে ১৯৬৭ সালে শেখ আব্দুল্লাহ যদিও কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি ভারতের শাসক শ্রেণীর কাছে বিক্রি করে দেয় ও ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে গত শতাব্দীর সাতের দশকে ক্ষমতায় ফেরে, কাশ্মীরের জনগণ কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন কে ভুলে যাননি। ভারতের থেকে মুক্তির শান্তিপূর্ণ সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরেই কিন্তু কাশ্মীরের জনগণ সশস্ত্র সংগ্রামে আটের  দশকের শেষের দিকে যোগ দেন এবং পাকিস্তান এই সুযোগ ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ সিদ্ধির চেষ্টা চালায়। 


নয়ের দশকের শুরুর থেকেই ভারতের শাসকশ্রেণী সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের চরম সঙ্কটের ফলে, মরুযুদ্ধের ফলে বেড়ে চলা তেলের দামের ফলে এবং বেড়ে চলা বিদেশী ঋণের বোঝার ফলে তীব্র আর্থিক সঙ্কটে জীর্ণ হয়। এই সুযোগে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার (আইএমএফ) ভারত কে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীনে আনার শর্ত হিসেবে আর্থিক উদারীকরণের নামে জনবিরোধী নীতির বন্যা বইয়ে দিয়ে ভারতের অর্থনীতির চাবিকাঠি চেয়ে বসে, যা তৎকালীন কংগ্রেস সরকার পূর্ণ করে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি কে আঁকড়ে ধরে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিণামে উথ্বান হয় হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী আরএসএস ও সংঘ পরিবারের। যেহেতু সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারি করে যে তথাকথিত প্রগতিশীলতার আর মেকি সমাজতন্ত্রের মুখোশ ভারত রাষ্ট্র নেহরু জমানা থেকে পড়ে ছিল তা আর নতুন পরিস্থিতিতে অকেজো হয়ে যায় তাই দরকার হয় এক নতুন ধরণের রাজনৈতিক শক্তির যা চরম ভাবে রক্ষণশীল হয়েও নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির সাথে, আইএমএফ ও  বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাথে আঁতাত করে ভারতের সম্পদ ও শ্রম কে বিনামূল্যে সাম্রাজ্যবাদের হাতে তুলে দেবে। 


অযোধ্যায় রাম মন্দির গঠনের নামে যে পার্টি দুইটা সাংসদের দল থেকে উত্তর প্রদেশ সহ নানা রাজ্যের রাজনীতিতে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে উঠে আসে তার পিছনে ছিল হিন্দুত্বের রাজনীতি, যার জনক ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বিনায়ক সাভারকার। চরম ইসলাম-বিদ্বেষ ছড়িয়ে সেই প্রথম বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে সাথে বিজেপি দাবি তোলে ধারা ৩৭০ বিলোপের। এই হিন্দুত্বের রাজনীতির উথ্বানে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ ও জায়নবাদী ইজরাইলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হাত ছিল। তাই নয়ের দশকের শুরুতেই বিজেপি’র চাপে ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের শর্তে কংগ্রেস সরকার কে ইজরায়েলের সাথে প্রথমবার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। সাভারকারের স্বপ্ন পূর্ণ সেইদিন থেকে হতে শুরু করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদী ইজরায়েলি সমর্থনে বলিষ্ঠ হয়ে বিজেপি ও আরএসএস ভারতে হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতি ছড়িয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করে যে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা শুরু করে তা মোদী’র সময়ে এসে সবচেয়ে বলিষ্ঠ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। 


যখন এই ঘৃণ্য রাজনীতি ভারতে চলছে, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও মেরুকরণের মধ্যে দিয়ে শাসকশ্রেণী সঙ্কট কালে বিপ্লবের পথ বন্ধ করছিল, তখন কিন্তু কাশ্মীরে চলছিল নির্বিচারে গণহত্যা। উগ্রপন্থা দমনের নামে নারীদের গণধর্ষণ থেকে শুরু করে শিশুদের গুলি করে মারা, কিছুই বাদ রাখেনি ভারতের জল্লাদ সেনাবাহিনী। লক্ষ্য তাঁদের একটাই, কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতার দাবি কে শেষ করা, কাশ্মীরের মুসলিম জনগণ কে হিন্দুত্ববাদী ভারতের শাসকশ্রেণীর পদযুগলে পোষ্য করে বেঁধে রাখা। কিন্তু স্বাধীনচেতা কাশ্মীরিরা তা মেনে নেয়নি কোনদিনই। আটের দশকের শেষে তাঁদের স্বাধীনতার দাবি তীব্র হতেই ভারতের শাসকশ্রেণীর দালালেরা গুলি করে গণহত্যা করে কাশ্মীরি পন্ডিতদের। প্রায় ৩০০’র উপর কাশ্মীরি পন্ডিত খুন হন কাশ্মীরে। এই সুযোগে কেন্দ্রের থেকে প্রেরিত রাজ্যপাল ও পরবর্তীকালে বিজেপি নেতা হওয়া জগমোহন কাশ্মীর থেকে আতঙ্কিত পন্ডিতদের জোর করে উদ্বাস্তু করে এই বলে যে মুসলিমেরা তাঁদের হত্যা করবে। কিন্তু কাশ্মীরি মুসলিমেরা কোনদিনই চাননি তাঁদের কাশ্মীরি পন্ডিত প্রতিবেশীরা চলে যান। সেই কাশ্মীরি পন্ডিতদের দুর্দশা দেখিয়ে, ভারতের হিন্দু সমাজের মধ্যে উগ্র মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়িয়ে কাশ্মীরে গণহত্যা চালাবার ছাড়পত্র বানিয়ে নেয় ভারতের শাসকশ্রেণী। কাশ্মীরের মুসলিমেরা গত তিন দশক ধরে অনুরোধ করলেও হাজার হাজার কাশ্মীরি পন্ডিত কে আর দেশে ফিরতে দেয়নি ভারতের শাসকশ্রেণী। তবে যে পন্ডিতেরা কাশ্মীরে রয়ে গেছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু এই স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছেন।


বহু অত্যাচার, গণহত্যা, গণধর্ষণ, গুমখুন ও জখমের পরেও কিন্তু কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জনগণ তাঁদের মাথা নত করেননি। জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে কাশ্মীরের মুষ্টিময় কিছু মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ও বৃহৎ বাগান-মালিকেরা বাদে সমাজের প্রতিটি শ্রেণী আজ লড়াইয়ের ময়দানে। ভারতের লক্ষ লক্ষ সশস্ত্র সেনা, যাদের সৈন্য শাসনের স্বার্থে তৈরি ঔপনিবেশিক আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার এক্ট (আফস্পা) এর অধীনে ইচ্ছা মতন খুন, অত্যাচার বা ধর্ষণ করার অধিকার আছে, যাদের নামে কোন অভিযোগ কোন থানায় গৃহীত হবে না, তাঁদের বিরুদ্ধে কিন্তু কাশ্মীরের মানুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা আজ পাথর নিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। নির্বাচন বয়কট করে তাঁরা প্যালেস্টাইনের বীর জনগণের সংগ্রামে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন এবং নিজ জীবন উৎসর্গ করতেও ভয় পাচ্ছেন না। তাঁদের দেখে মনে পড়ে চেয়ারম্যান মাও সেতুঙের কথা, মনে পড়ে ভিয়েতনামের কথা, তাঁরা যেন চিৎকার করে বলে ওঠেন “কে কাকে ভয় পায় আজ?”


ভারতের শাসকশ্রেণী কাশ্মীরের মানুষের সংগ্রাম কে পাকিস্তানের টাকায় চলা সন্ত্রাসবাদ বলে নৃশংস দমনপীড়ন করতে এবং ইসলাম-বিদ্বেষ তীব্র করতে অতীতে ভারতের নানা প্রান্তে নিজেদের লোকেদের দিয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়ে সেই দায় কাশ্মীরের ঘাড়ে এরা চাপিয়েছে। ভারতের শ্রমজীবী আন্দোলনের উপর সংশোধনবাদের প্রভাব তীব্র থাকায় এর বিরুদ্ধে, এই কুৎসিত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে, এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ ও শোষিত জনজাতির মানুষের, আদিবাসী জনগণের বৃহৎ সংহতিমূলক সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এর লাভের গুড় চেটে চেটে খেয়েছে ভারতের শাসকশ্রেণী। বিশ্বের দরবারে কাশ্মীরের গণসংগ্রাম কে সন্ত্রাসবাদ বলে হেয় করেছে আর তাই প্যালেস্টাইনের মতন কাশ্মীরের মানুষের সমর্থনে বিশ্বের দিকে দিকে আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বিপ্লবী কমিউনিস্টদের এই ব্যর্থতা যে বড় বেদনাদায়ক তা স্বীকার করতে কোন সঙ্কোচ করা আজ উচিত হবে না।



কাশ্মীর দখলের কারণ, পদ্ধতি ও লক্ষ্য



জম্মু ও কাশ্মীরের বর্তমানে ভারতের অধীনে আছে জম্মু, কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ এবং লাদাখ (যাকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তিব্বতের অংশ বলে মনে করে), এবং ভারতের পার্লামেন্টের শাসন ধারা ৩৭০ দিয়ে কাশ্মীরে প্রয়োগ হতো। অন্যদিকে ধারা ৩৫এ অনুসারে শুধু জম্মু কাশ্মীরের বিধানসভার অধিকার ছিল সেই প্রদেশের চিরস্থায়ী নাগরিক কে হবেন তা ঠিক করার। এই দুই ধারা কে বিলোপ করে নিজের হাতে জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষমতা তুলে নিয়ে, প্রদেশটিকে দুইটি কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলে পরিবর্তন করে (পূর্ণ রাজ্য থেকে এই প্রথম কোন রাজ্য কেন্দ্র শাসিত হল) ভারত সরকার আসলে Instrument of Accession কে খারিজ করলো। আর এই খারিজ করার সাথে সাথে কিন্তু আইন মোতাবেক ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জম্মু ও কাশ্মীরের শর্তের পরিসমাপ্তি ঘটে গেল এবং জম্মু ও কাশ্মীর অক্টোবর ১৯৪৭ এর পূর্ববর্তী পরিস্থিতিতে পৌঁছে গেল। এখন জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতের সেনা থাকা মানে হল সরকারি ভাবে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারি। এর ফলে ভারত কাশ্মীরের উপর থেকে চিরকালের জন্যে নিজের আইনী দাবি হারাল এবং কাশ্মীরের ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে চিহ্নিত হল।
যদিও ভারতের শাসকশ্রেণীর বিদেশী পুঁজির প্রতি যে আনুগত্য আছে, যে ভাবে ভারতের শাসক শ্রেণী, বিশেষ করে মোদী কে দিয়ে দেশের বাজার ও খনিজ সম্পদের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, রুশ সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কে, তার ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের উপর কোন চাপ পড়বে না। কূটনৈতিক ভাবেও ভারত কে জব্দ হতে হবে না। আর এই সমর্থনের আড়ালে মোদী সরকার ও ভারতের শাসকশ্রেণী কে চাপ দিয়ে আরও বেশি লুঠ তরাজের সুযোগ তৈরি করবে বিদেশী কোম্পানিগুলি। ফলে কাশ্মীরের মানুষের সংগ্রামে আন্তর্জাতিক স্তরে কোন সরকারি সমর্থন উঠবে না শুধু নিজ ভৌগলিক-রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত পাকিস্তানী শাসকদের বাদে। 
এই সময়ে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন ভারত দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে লড়ছে কেন, কেনই বা ভারতের কাশ্মীর এত দরকার? হঠাৎ কেন আজ ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হল? আরও প্রভৃতি প্রশ্ন উঠবে। 

কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বা ঐতিহাসিক কারণে ভারতের কাশ্মীর চাই না। ভারতের শাসকশ্রেণীর কাশ্মীর কে দরকার জলের সুরক্ষার জন্যে ও চীন বিরোধী যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে। ভারতের শাসক শ্রেণী চায় কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জলসম্পদের উপর একচেটিয়া অধিকার, যা বিক্রি করে তাঁরা অনেক মুনাফা আয় করতে পারবে। এতদিন কাশ্মীরের সরকারের সাহায্য নিয়ে সেখানকার সম্পদ লুঠ করতে হতো, এবার সরাসরি দখলের ফলে মোদী সরকারের মালিক গৌতম আদানি, মুকেশ আম্বানি ও তাঁদের বিদেশী একচেটিয়া-লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন বৃহৎ কর্পোরেট কর্তারা জম্মু কাশ্মীরের জমি ও সম্পদের উপর নিজেদের অধিকার কায়েম করতে পারবে। মোদী সরকারের ৩৭০ ধারা বিলোপের কিছুক্ষণের মধ্যেই গৌতম আদানি টুইটারে জানান দেয় তাঁর খুশির কথা, আহ্লাদে আপ্লুত হয় সে “উন্নয়নের” নামে বিনামূল্যে জনতার সম্পদের উপর মালিকানা পাওয়ার লোভে। আরও অনেক হায়না ও শকুন লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কাশ্মীরের দিকে, তাকে ছিন্নভিন্ন করে খাওয়ার অভিলাষ নিয়ে।  

চীনের নেতৃত্বে শোধনবাদী বেইমানরা অধীন হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা যুদ্ধ করে চীন দখল করা ছাড়া ওখানে নব্য উপনিবেশ স্থাপন করা সম্ভব নয়। এই কাজে চীনা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা ওদের পক্ষে থাকলেও চীনা জাতীয় বুর্জোয়াদের অংশটি ওদের বিরুদ্ধে চীনা পুঁজির প্রসার সারা বিশ্বে করতে চায়। তাই চীন ও রাশিয়ার বুর্জোয়ারা হাত মিলিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি কেন্দ্র তৈরি করেছে, যার লক্ষ্য বিশ্বের উপর নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করা। ভারতের শাসকশ্রেণী মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া হলেও, সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে তাঁরা কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণবাদী ভূমিকা পালন করে। চীনা বুর্জোয়াদের সাথে যুদ্ধে জেতার শক্তি এখনো ভারতের না হওয়ায় চীনের বন্ধু পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে চীন কে মার্কিন সাহায্যে ঘিরে ফেলতে চাইছে নয়া দিল্লি। এই কাজে যত বেশি সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে ভারতের শাসক শ্রেণী পৌঁছাবে তত বেশি তাঁরা মার্কিন সাহায্য পাবে এবং কাটমানি আয় করতে পারবে। 

লাদাখ অঞ্চল থেকে চীনের উপর হামলা করার সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আছে ভারত আর তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারতের সামরিক অবস্থান কে আজ সমর্থন করবে, বিশেষ করে যখন চীন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে প্রচন্ড রকমের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব চলছে। ভারতের শাসকশ্রেণী যত বেশী করে চীন বিরোধী যুদ্ধের জিগির তুলে মানুষ কে ক্ষেপিয়ে লাদাখের উপর নিজের অন্যায় কতৃত্ব কে বজায় রাখতে পারবে তত বেশি করে মার্কিন সাহায্যের নামে কোটি কোটি ডলার মোদী ও শাহ আয় করতে পারবে, তত বেশি করে আরএসএস এর সিন্দুক উপচে পড়বে। তাই আজ ওদের জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ কে দরকার চীন ও পাকিস্তান-বিরোধী যুদ্ধের কামানের খোরাক বানাবার জন্যে ও লাদাখ দরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ছোড়া রুটির টুকরো খাওয়ার জন্যে।


এর সাথে সাথে ভারতের শাসক শ্রেণী নিজের দালালদের, বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের ও প্রতিক্রিয়াশীল সাবর্ণ হিন্দু লোকেদের কাশ্মীরে স্থায়ী বসবাসের জন্য কলোনি বানিয়ে দিতে চায় যে ভাবে জায়নবাদী ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের মাটিতে ইহুদী কলোনি গড়ে দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে পরিবর্তন করে। এই সেটেলমেন্ট কলোনিগুলো পরবর্তীতে কাশ্মীরের জনসংখ্যার অনুপাত বদল করতে, কাশ্মীরি জনগণের চেয়ে বহিরাগত বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে। এই জনসংখ্যার পরিবর্তনে কাশ্মীরের মানুষ তাঁদের দেশের উপর থেকে নিজেদের অধিকার হারাবেন, নিজ দেশে সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন। এই ফাঁকে কোনদিন যদি গণভোট হয় তাহলেও ভারত জিতে যাবে সংখ্যার জোরে।

ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কাশ্মীর রণনীতি কী হওয়া উচিত?


ভারতের রাজনৈতিক ময়দানে কাশ্মীরের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার প্রথম স্বীকার করেন চারু মজুমদার ও তাঁর হাতে গড়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা সিপিআই (এম-এল), যা নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের আগুনে তপ্ত হয়ে ভারতের বিপ্লবের অগ্রবাহিনী হয়ে ওঠে। কাশ্মীর প্রসঙ্গে ও জাতীয় মুক্তির প্রসঙ্গে একটি সঠিক লেনিনবাদী লাইন গ্রহণ করে সিপিআই (এম-এল) গঠিত হওয়ার আগে ও পরে কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জানায় চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী কমিউনিস্টরা। যদিও কমিউনিস্টরা সর্বদাই বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে তবে লেনিনের শিক্ষা অনুসারে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে বৃহৎ রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে নানা জাতির, নানা বর্ণের, নানা ভাষার শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য আর সেই ঐক্য সুদৃঢ় ও ইস্পাত কঠিন ঠিক তখন হতে পারে যখন সেই ঐক্যের ভিত্তি হয় আলাদা হওয়ার, বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার বা প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার। যে ঐক্য আলাদা হওয়ার, বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার স্বীকার করে না সেই ঐক্য হয় শোষনের স্বার্থে ঐক্য, বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থে ঐক্য, জনগণের স্বার্থের ঐক্য নয়।

চারু মজুমদার দেখিয়েছিলেন যে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই স্লোগানের তাৎপর্য হলো যে এটা বুর্জোয়াদের একচেটিয়া শোষণের স্বার্থরক্ষা করে, কাশ্মীর কে বৃহৎ বুর্জোয়ার শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট করে। তাই তিনি স্লোগান দেন: “জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কে স্বীকার করো; ভারতবর্ষ কে ঐক্যবদ্ধ করো।” ভারতের বিপ্লবী রাজনীতিতে নকশালবাড়ি আজ থেকে ৫২ বছর আগে কাশ্মীরের মুক্তির দাবি তুলেছে এবং ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের অধীনে পরাধীন সকল জাতির মুক্তির দাবি তুলেছে। চারু মজুমদারের রাজনীতি আমাদের শিখিয়েছে যে ইন্ডিয়া নামক যে রাজনৈতিক সত্ত্বায় আমরা বাস করি তা নানা জাতির ও নানা ভাষার মানুষের সমন্বয়ে তৈরি আর এই বিবিধ মানুষের ঐক্য হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ঔপনিবেশিক শাসনের পরবর্তীকালে ভারত যখন একটি আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়, তখন ভারতের শাসকশ্রেণীর কাছে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার দুইটি প্রধান অস্ত্র হয় হিন্দি ভাষা ও হিন্দু ধর্ম। এই ঐক্য তাঁদের কাছে অতিপ্রয়োজনীয় যাতে তাঁদের একচেটিয়া শাসন সারা ভারতে বলবৎ থাকে এবং শোষণ ও লুন্ঠন করতে সুবিধা হয়। পাকিস্তানের নামে দেশ ভাগ হওয়ার ক্ষত কে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এই শাসক শ্রেণী দশকের পর দশক জাগিয়ে রেখেছে নিজের শোষণের স্বার্থে জনগণ কে ভাগ করে দেশের নামে ভূখণ্ড কে একত্রিত রাখতে।


কমিউনিস্টদের কাছে দেশ মানে পাহাড়, নদী, মাটি আর সম্পদ নয়, তাঁদের কাছে দেশ মানে হল সেই দেশের মানুষ, যে মানুষ নিজের শ্রমে দেশ গড়ে তোলে। তাই মাটির ঐক্যের স্বার্থে জনগণ কে ভাগ করার, এক ধর্মের বা জাতির মানুষ কে অন্য ধর্ম বা জাতির উপর, বিশেষ করে একটি সমাজের বা রাজ্যের সংখ্যালঘু, দুর্বল ও শোষিত জাতি, ধর্ম বা বর্ণের মানুষের উপর আক্রমণ করতে উস্কে দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা চিরকাল লড়াই করে মানুষ কে শ্রেণী স্বার্থের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে, তাঁদের শোষিত শ্রেণী’র মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করিয়ে। চারু মজুমদারের শিক্ষা হলো কমিউনিস্টরা জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম করবেন না, শুধু শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তুলবেন আর শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম কে তাঁরা অবশ্যই সমর্থন করবেন বৃহৎ জাতির ঔদ্ধত্ব না দেখিয়ে।


তাই আজ যখন দেশের ভিতর ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে মোদী দেখিয়ে দিল যে সংবিধান ব্যবহার করে সংবিধান কে ধ্বংস করে এই মেকি গণতন্ত্রের মুখোশ ছিঁড়তে তাঁর বেশি সময় লাগবে না, যখন দেশের কোন রাজনৈতিক দল খোলাখুলি কাশ্মীরের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে দাঁড়িয়ে আগ্রাসী ভারতের শাসকশ্রেণীর মুখোমুখি বিরোধিতা করতে ভয় পাচ্ছে তখন কমিউনিস্টদের চিৎকার করে বলা উচিত “বিদ্রোহ ন্যায় সঙ্গত” ও “ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ কাশ্মীর থেকে দূর হঠো।


আজ দুনিয়ার বুকে কোন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই যা কাশ্মীরিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে অবস্থান নেবে, তাঁদের সাথে দাঁত ও মাড়ির সম্পর্ক গড়ে তুলবে। যদিও পাকিস্তান চেষ্টা করবে তবে তা নিজ স্বার্থে, কাশ্মীর দখল করতে, কাশ্মীর কে স্বাধীন করতে নয়। এমতাবস্থায় কাশ্মীরের মানুষদের নিজেদের মুক্তির সংগ্রাম নিজেদেরই লড়তে হবে, নিজেদের শক্তির উপর ভর করে এবং তাঁরা যদি ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়িয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেন তবে তাঁরা অবশ্যই ভারতের শাসক শ্রেণী কে পরাজিত করতে পারবেন। তাঁদের পাশে তাঁরা সংহতিমূলক লড়াইয়ে পাবেন ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের, শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী সংগ্রাম কে। একদিন চারু মজুমদার বলেছিলেন যে “আজ যদি পশ্চিমবাংলার প্রতিটি কমরেড রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকেন তাহলে ঠেকাতে পারবে কি ওরা কোরাপুট কে?” সেই প্রশ্ন আজ কাশ্মীরের জনগণের পক্ষ থেকে উঠে এসেছে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কাছে। আমাদের সংগ্রাম ঠেকাতে পারবে কি আজ কাশ্মীরের গণহত্যা কে? আমাদের শ্রেণী সংগ্রাম রুখে দিতে পারবে কি ফ্যাসিবাদের রথের চাকা কে? বিপ্লবী যুদ্ধ কি প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ কে রুখে দিতে পারবে? এর উত্তর দিতে হবে আমাদের সংগ্রামের ময়দানে, হাতেনাতে লড়াই করে। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে