লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কু'র (বাস্কে) রক্তে স্নাত কামালপুর ভারতের শ্রেণী সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

বুধবার, জুন ১২, ২০১৯ 0 Comments A+ a-



আমাদের ইতিহাস চিরকালই যুদ্ধে বা শ্রেণী সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া শ্রেণীগুলি রচনা করে, নিজের মতন করে, আর সেই ভাবে তৈরি হয় মূলধারার ইতিহাস। অবশ্যই বস্তুর দুইটি দিক হয়, ইতিহাসেরও, মিথোলজিরও। এক দিকে যখন বিজিতের মূল ধারার ইতিহাস মানুষ কে এক ভাবে ঘটনার বিবৃতি দেয়, ঠিক তখনই, বিপরীত দিকে সাবল্টার্ন বা সমাজের নিম্ন শ্রেণীর ইতিহাস সেই ঘটনার অন্য মূল্যায়ন করে, অন্য কাহিনী বলে। শোষক যা কালো করে দেখায়, শোষিত তাকে সাদা করে, আর শোষক যা সাদা করে দেখায়, শোষিত তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা নোংরার রেশগুলো তুলে ধরে তাঁদের সাবল্টার্ন ইতিহাসের পাতায় পাতায়, অলিখিত বাণীতে।

ব্রিটিশ শাসনকালে যদিও ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রিটিশ-বিরোধী সকল বিদ্রোহ কে, যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহ , ইত্যাদি কে চিরকালই সবচেয়ে কুৎসিত ভাবে চিত্রিতকরা হলেও কিন্তু তৎকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের চেতনায় এই সব লড়াই ও সংগ্রামের কাহিনী অনেক সম্মানজনক স্থান গ্রহণ করে রেখেছিল। ব্রিটিশ শাসকদের রক্তচক্ষু কে কাঁচকলা দেখিয়েই তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় বিখ্যাত হয়ে ওঠে দীনবন্ধু মিত্রের নীল বিদ্রোহ নাটক। মানুষের মন থেকে নীল বিদ্রোহের চেতনা কে কোন ভাবেই ব্রিটিশ শাসকদের ঢক্কানিনাদ কিন্তু দূর করতে পারেনি।

এই মূলধারার ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের, শোষিত মানুষের সযত্নে লালন করা, রক্ষা করা ও প্রচার করা সাবল্টার্ন ইতিহাসের চরম দ্বন্দ্ব কিন্তু আজও বিদ্যমান। এর সাথে সাথে আবার শোষিত শ্রেণীর বন্ধু সেজে যে সুবিধাবাদী মেকি বিপ্লবীরা মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস কে বিকৃত করতে, চেপে যেতে বা মোছার চেষ্টা করে হতাশা ছড়াতে ও মানুষ কে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতে, তাঁদের ষড়যন্ত্রও সামিল হয়। এই সবের মাঝেও চরম হতাশার অন্ধকারে আলোর হাতছানির মতন সুস্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসে সাবল্টার্ন ইতিহাসের বীর গাঁথা, যার নায়ক সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ, কৃষক, সেই খালি পায়ে চলা, কালো চামড়ার রুক্ষ চেহারার কৃষক ও কৃষক রমণী। তাঁদের কাহিনী কে ভুলিয়ে দিতে চাইলেও সহজে ভোলা যায় না, যেমন ভোলা যায়না ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক কামালপুরের বিপ্লবী সংগ্রাম কে।

কামালপুর এক অদ্বিতীয় বিপ্লবী সংগ্রামের জন্যে চিরকাল পশ্চিমবঙ্গের ও ভারত উপমহাদেশের বিপ্লবীদের কাছে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে, যে সংগ্রামের ফলে ভারতের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লড়াই ভিয়েতনামের স্তরে উঠতে পেরেছিল, অর্থাৎ যে স্তরে একটি ক্ষুদ্র শক্তি একটি বৃহৎ শক্তি কে অচিরেই পরাজিত করতে পারে শুধু মাও সেতুঙের চিন্তাধারার উপর নির্ভর করে জনযুদ্ধের বিস্তৃতি করে, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কে যুদ্ধে সামিল করে। এই বিদ্রোহের গল্প মূলধারার কমিউনিস্ট ইতিহাস থেকে সযত্নে বাদ দেওয়া হয়ে থাকলেও বর্ধমান ও হুগলির গরিব আদিবাসী জনগণের হৃদয়ে যেহেতু এই বিদ্রোহের কাহিনী আজও প্রোথিত আছে তাই হয়তো ৪৫ বছর পরেও এর ইতিহাস কে এত সহজে গায়েব করতে অক্ষম শাসকশ্রেণী ও তাঁদের পদলেহী সংশোধনবাদীদের দল।

কী হয়েছিল এই অখ্যাত কামালপুরে? কেন কামালপুরের লড়াই কে মনে রাখা দরকার? কামালপুরের সংগ্রামের থেকে আজকের যুগে গরিব মানুষের, কৃষকের, আদিবাসীর কী শেখার থাকতে পারে? কেন কামালপুরের কথা কেউ কোনদিন আর উচ্চারণ করে না?

আসলে কামালপুরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত আছে একটি বিশেষ রাজনীতি আর সেই রাজনীতি কে মানুষের চোখের আড়ালে রাখতে শাসক শ্রেণী চিরকালই বদ্ধপরিকর আর বদ্ধপরিকর শাসকশ্রেণীর তল্পিবাহক নানা রঙের সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীরা। তবুও কামালপুরের যুদ্ধের কথা, কামালপুরের ইতিহাসের কথা, কামালপুরের ঐতিহাসিক ১২ই জুনের সংগ্রামের কথা মানুষ কে জানানো সমস্ত বিপ্লবী কমিউনিস্টদের একটি একান্ত জরুরী কর্তব্য এবং এই কর্তব্য কে পালন না করলে অনেক সমস্যা হবে আগামী প্রজন্ম কে রাজনীতির ময়দানে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে।

১৯৭৪ সালের ১২ই জুন, অর্থাৎ এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার দিনে, হুগলী ও বর্ধমানের সীমান্তে অবস্থিত কামালপুর গ্রামে  ভারত রাষ্ট্রের পুলিশ ও আধা সেনার সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন তিন বীর আদিবাসী বিপ্লবী — লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কু (বাস্কে)। এদের শহীদ হওয়ার আগে এবং পরে সমস্ত কামালপুরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন এক সত্যিকারের জনযুদ্ধ। পরাস্ত হয়েছিল ভারত রাষ্ট্র কৃষক জনগণের সশস্ত্র গণফৌজের কাছে আর তার নেতৃত্বে তখন চারু মজুমদার ও মাও সেতুঙের বিপ্লবী নীতিতে চালিত সিপিআই (এম-এল), যে দলের দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এই কামালপুর গ্রামেই, ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে।

আসলে কামালপুরের এই জনযুদ্ধের সাথে এই পার্টি কংগ্রেসের ও সিপিআই (এম-এল) দলের সম্পর্ক ভীষণ নিবিড়। ১৯৭২ সালের ২৮শে জুলাই চারু মজুমদার কলকাতা পুলিশের অত্যাচারে শহীদ হওয়ার সাথে সাথে যে নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছেদ পড়ে, সেই গল্প চিরকালই মানুষ মূলধারার ইতিহাসে, এমনকি অনেক তথাকথিত বিপ্লবীদের স্মৃতিকথায় শোনেন। নকশালবাড়ির লড়াই যে সাতের দশকের শুরুতেই শেষ হয়নি সেই সত্যের সাক্ষী হলো কামালপুর। নকশালবাড়ি’র সংগ্রাম যে ১৯৭২ সালে চারু মজুমদারের শহীদ হওয়ার সাথে শেষ হয়নি তা জানান দিল কামালপুর। ট্রাক ট্রাক সৈন্য কে হারিয়ে, সেদিন কামালপুরের সাধারণ আদিবাসী ও কৃষক জনগণ দেখিয়েছিলেন চারু মজুমদারের রাজনীতির শক্তি এবং তার সাথে সাথে একটি লাইনের বলিষ্ঠতা, যে লাইন বলে “লেগে পড়ে থাকার নাম বিজয়”, যে লাইন বলে যে মানুষ অস্ত্রের চেয়ে বড় আর জনযুদ্ধ হচ্ছে জনগণের যুদ্ধ এবং একমাত্র ব্যাপক জনগণ কে সমবেত করেই এই যুদ্ধ চালনা করা সম্ভব।

১৯৭২ সালের জুলাই মাসের ১৬ তারিখে চারু মজুমদারের ধরা পড়ার পরে সিপিআই (এম-এল) এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবস্থা তথৈবচ হয়। একদিকে চারু মজুমদার কে কলকাতা পুলিশের কবল থেকে বের করে আনার পরিকল্পনা দেবী রায়ের নেতৃত্বাধীন গোয়েন্দা বাহিনী জানতে পেরে যাওয়ায় ২০শে জুলাই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দিবসের মিছিলের মাধ্যমে লাল বাজার থেকে তাঁকে মুক্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, অন্যদিকে তার ঠিক কিছুদিন পরেই তাঁকে হত্যা করে ইন্দিরা গান্ধীর ফ্যাসিস্ট কংগ্রেস সরকার। এর পরে পার্টির নেতৃত্বে লুকিয়ে থাকা নানা রঙের সংশোধনবাদ নানা ভাবে পার্টির সংগঠনে ছোবল মারতে থাকে। নভেম্বর মাসে কানু সান্যালের বেইমানির খতিয়ান হিসেবে প্রকাশিত জেল থেকে লেখা চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে কুৎসার  দলিল ও অন্যদিকে কংগ্রেসের দালাল হয়ে যাওয়া সৌরেন বোসের বার বার করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাং শেন ও চৌ এনলাই গোষ্ঠীর দ্বারা করা চারু মজুমদারের সমালোচনা কে শিখন্ডি করে দলে দলে মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদীরা চারু মজুমদারের লাইন কে খন্ডন করে সংশোধনবাদের পঙ্কিল স্রোতে গা ভাসতে শুরু করেন।

এহেন পরিস্থিতিতে পাঞ্জাব প্রদেশে সিপিআই(এম-এল) দলের সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির অতিরিক্ত সদস্য জগজিৎ সিংহ জোহাল, ওরফে শর্মার সাথে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির চারু মজুমদার-পন্থী নেতা মহাদেব মুখার্জির দুই দূত, ভবানী রায়চৌধুরী ও গৌতম ঘোষ দেখা করেন ও চারু মজুমদারের লাইন কে ও কতৃত্ব কে রক্ষা করা সম্পর্কে মহাদেব মুখার্জির বক্তব্য ব্যক্ত করেন। তাঁরা অনেকগুলো বিষয়ে একমত হন এবং এর ফলে ১৯৭২ সালের ৫-৬ ডিসেম্বর, পাঞ্জাবের রোপার জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে সশস্ত্র কৃষকদের পাহারায় শর্মা মহাদেব মুখার্জি কে নিজ ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোঅপ্ট করেন এবং পার্টির নতুন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। মুখার্জি-শর্মা নেতৃত্বাধীন চারু মজুমদারপন্থী কেন্দ্র চারু মজুমদারের বিপ্লবী কতৃত্ব কে উর্দ্ধে তুলে ধরার শপথ নেয়, পার্টির থেকে বিশ্বাসঘাতকদের বিতাড়িত করে এবং চারু মজুমদারের পথেই বিপ্লবী সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রাখে। উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, দিল্লি, অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও অবিভক্ত বিহারের বিপ্লবীরা এই কেন্দ্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, যদিও উত্তর প্রদেশের শ্যাম চোপড়া, বাংলার সুনীতি ঘোষ, প্রভৃতি নেতারা দলের ভিতর ও বাইরের থেকে ভাঙ্গনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এদের ফাঁদে পড়ে শর্মা নিজের বিপ্লবী অবস্থান ত্যাগ করে মধ্যপন্থী ও চারু মজুমদার বিরোধী হয়ে যান।

যদিও বাকি পার্টি মহাদেব মুখার্জি কে সম্পাদক করে চালিত হতে থাকে, কিন্তু ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসের লিন পিয়াও বিরোধী কুৎসার বন্যা বইয়ে যখন চৌ এনলাই’ এর নেতৃত্বাধীন সংশোধনবাদী চক্র মাও সেতুঙ  কে ঘেরাও করে যে নবম জাতীয় কংগ্রেস কে মাও সেতুঙ নিজে বলেছিলেন “বিজয়ের ও ঐক্যের কংগ্রেস” তার সিদ্ধান্তগুলো কে নাকচ করে দেয়, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মাও সেতুঙের চিন্তাধারায় বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে যে বিশ্ব বিপ্লবের ময়দানে এক গুণগত পরিবর্তন এসেছে, লেনিনের যুগ থেকে যে মাও সেতুঙের যুগে উত্তীর্ণ হয়েছে মানব জাতি, সাম্রাজ্যবাদ, যা কে লেনিন বলেছিলেন মুর্মুর্ষু পুঁজিবাদ, সে যে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে সঙ্কটগ্রস্ত হয়েছে ও বিপ্লবের ভরকেন্দ্র যে এশিয়া-আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় সরে এসেছে, এই সব সত্য কে অস্বীকার করে, তখন কিন্তু সিপিআই(এম-এল) দলের অভ্যন্তরে এক বিরাট ভাঙ্গন ধরে। যদিও আগের ভাঙ্গনগুলো ছিল চারু মজুমদার-পন্থী ও বিরোধীদের, এই বার হয় লিন পিয়াও-পন্থী, অর্থাৎ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেসের সঠিক মাওপন্থী লাইনের পক্ষে যাঁরা দাঁড়ালেন, চারু মজুমদারের রাজনীতির পক্ষে যাঁরা দাঁড়ালেন তাঁদের সাথে চারু মজুমদারের নাম নিয়ে যাঁরা চারু মজুমদারের লিন পিয়াও, মাও সেতুঙ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেসের লাইন কে মানা নিয়ে ঘোষিত লাইনের বিরোধিতা করলেন তাঁদের ভাঙ্গন দেখা দিল।

এই সময়ে, পার্টির ভাঙ্গনের মুখে বাংলা, উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও বিহারে ভাঙ্গন ধরলেও মহাদেব মুখার্জি’র নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের প্রতি পার্টির একটি বড় অংশের সমর্থন ছিল আর তাঁদের নিয়ে অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হিসেবে মহাদেব মুখার্জি পার্টির দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেস করার সিদ্ধান্ত নেন আর এই কংগ্রেসের জন্যে বেছে নেওয়া হয় কামালপুর কে। আর এই বেছে নেওয়ার পিছনে ছিলেন তৎকালীন সংগঠক জীতেন কুন্ডু (কাবুল), যিনি কামালপুরের কৃষকদের রাজনীতি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেন কৃষি বিপ্লবে যোগ দিতে। পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় গণফৌজের অতন্দ্র পাহারায় ও এই কংগ্রেসে সিপিআই (এমএল) এর প্রথম কংগ্রেসে গৃহীত চারু মজুমদারের রাজনীতির ভিত্তিতে প্রস্তুত কর্মসূচি কে পুনঃগ্রহণ করা হয়। চীনা পার্টির লাইন কে যখন বাকি সব সিপিআই (এম-এল) দলের নেতৃত্ব চোখ বন্ধ করে মেনে নিচ্ছেন তখন মহাদেব মুখার্জির নেতৃত্বাধীন সিপিআই (এম-এল) চীন পার্টির সাথে মতাদর্শগত দুইলাইন শুরু করে। আর এই সবের মুলে ছিল কামালপুর। বিশ্বের বুকে একমাত্র সিপিআই (এম-এল) ১৯৭৩-৭৪ সালেই চীনের ভিতরে সংশোধনবাদের উথ্বান কে anticipate করে জনগণ কে সাবধান করা শুরু করে চেয়ারম্যান মাও সেতুঙের উপস্থিতি কে সম্মান জানিয়েই। আর এই কাজেও কামালপুর ওতপ্রোত ভাবে জড়িত কারণ এখানেই সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় চীনা পার্টির নতুন লাইন কে সমালোচনা করার ও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে সেই বিপ্লবী ঔদ্ধত্য দেখানোর যা তৎকালীন সময়ে blasphemous ছিল।

পার্টি কংগ্রেসের শেষেই ভারতবর্ষ ও বাংলার নানা প্রান্তের মতন কামালপুর ও কালীনগরে কৃষকের বিকল্প সরকার বিপ্লবী কমিটি গড়ার সংগ্রাম শুরু হয় এবং জোতদারদের নেতৃত্বাধীন আধা-সামন্ততান্ত্রিক শাসন কে উচ্ছেদ করে কৃষক রাজ প্রতিষ্ঠিত হয় গণ ফৌজের সহায়তায়। গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে চলতে থাকে গেরিলা সংগ্রাম। চারু মজুমদার কে হত্যা করে যে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ভীষণ আপ্লুত হয়েছিল এই ভেবে যে নকশালবাড়ি সংগ্রাম কে কবরে মাটি চাপা দেওয়া গেছে, তাঁরা যখন দেখতে পেল কামালপুরে উদ্ধত শির নিয়ে দাঁড়িয়ে রাইফেল হাতে আদিবাসী কৃষক ও আদিবাসী কৃষক রমণী, তখন বাংলার ওই ছোট ও অখ্যাত গ্রাম কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর জুতো চাটা দালাল সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কলকাতার বাড়ির অন্দরমহল থেকে শুরু করে দিল্লির উত্তর ও দক্ষিণ ব্লককে কাঁপিয়ে তুললো প্রচন্ড আতঙ্কে।

ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পাঠালো শয়ে শয়ে আধা সেনা ও রাজ্য পুলিশ কে কামালপুর ও কালীনগর দমন করতে ও এই সংগ্রামের মাথাদের, অর্থাৎ কাবুল কে হত্যা করতে। সেই আধা সেনা ও পুলিশ বেশ কিছুদিন ধরে সিজ অপারেশন চালিয়ে চতুর্দিক থেকে কামালপুর কে ঘিরে আক্রমণ চালালেও টানেল প্রযুক্তি ও আপামর জনগণ কে লড়াইয়ে সামিল করানোর রাজনীতির সাহায্যে আদিবাসী কৃষক কমিউনিস্টরা গড়ে তুললেন এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধ সংগ্রাম ও গেরিলা যুদ্ধ। আধা সেনার কার্বাইন দখল করে চললো যুদ্ধ। ট্রাক ট্রাক ভরে পুলিশ ও আধা সেনার লাশ গেল ত্রিবেণী ঘাটের শ্মশানে আর নানা হাসপাতালে। গরুর পাল কে সামনে রেখে উঁচু জাতের হিন্দু পুলিশ ও আধা সেনার ধর্মীয় গোঁড়ামির সাহায্যে এলাকার নেতৃত্ব কে ঘেরাও ভেঙে বার করে দিতে সক্ষম হলেন আদিবাসী বিপ্লবীরা।

তবে এই সংগ্রামে কামালপুর যেখানে শয়ে শয়ে শাসকশ্রেণীর ভাড়াটে সেনা কে ধরাশায়ী করেছে, ঠিক সেখানেই কিন্তু শত্রুর আক্রমণে কামালপুর হারায় তিন মহাবিপ্লবী কে। লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কু (বাস্কে) তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে কামালপুরের লড়াই কে ভিয়েতনামের স্তরে তুললেন, ক্ষুদ্র অথচ তুচ্ছ নয়, যে বিন্দু বুকে সিন্ধুর চেতনা বয়ে নিয়ে যায়, সেই বিন্দু হিসেবে জ্বলে উঠে শাসকের মনে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করলো কামালপুর। পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রের পরাজয়ের চিহ্ন সেদিন বুক ঠুকে প্রমাণ করলো চারু মজুমদারের রাজনীতি যদি সঠিক ভাবে কৃষককে দেওয়া হয়, মাও সেতুঙের চিন্তাধারা যদি তাঁদের মধ্যে রোপন করা যায়, আর লিন পিয়াও এর জনযুদ্ধের তত্ত্ব কে যদি সত্যিই মানুষ কে উদ্বুদ্ধ করে প্রয়োগ করা যায় তাহলে কোন শক্তি ভারতের কৃষকের, শোষিত মানুষের বিজয়ের পল্টন কে আটকাতে পারবে না।

কামালপুর হওয়ার কিছু সপ্তাহ পরেই যদিও পুলিশের হাতে ধরা পড়েন বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা কাবুল, রামশঙ্কর ব্যানার্জি ও মনোতোষ চক্রবর্তী। রাষ্ট্র কিন্তু বিচারের প্রহসন না করেই হুগলীর ত্রিবেণী ঘাটে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল এই তিন বিপ্লবী কে ইন্দিরা গান্ধী, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, এবং ভারতের শাসকশ্রেণীর রক্ত পিপাসা চরিতার্থ করতে, তবুও কামালপুরের চেতনা কে কিন্তু সেই শাসকের অত্যাচার, হত্যালীলা বা নৃশংস আক্রমণ শেষ করতে পারেনি। সেই চেতনা কিন্তু ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রান্তে, নানা শোষিত মানুষের মধ্যে। কামালপুর তাই শত্রুর আতঙ্কের বস্তু হয়ে আজও অনেক মানুষের হৃদয়ের গভীরে বাস করছে। কামালপুর আজও, অনেক দশক ও প্রজন্ম পরেও বিপ্লবের দিকেই পা বাড়িয়ে রেখেছে কারণ কামালপুর চায় মানবজাতির মুক্তি, শোষিত মানুষের মুক্তি ও নতুন মানুষের জন্ম এক শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থায়।

কামালপুর মরে না, কামালপুর শেষ হয় না। ঠিক যেমন নকশালবাড়ি মরেনি, বরং শ্রীকাকুলাম, মাগুরজানের মধ্যে দিয়ে তা কামালপুরে ভারতের ভিয়েতনামের স্তরে উন্নীত হলো, ঠিক তেমনি কামালপুর গড়ে তোলে ইমার্জেন্সি কে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙার সংগ্রাম, গড়ে তোলে বিহারের ঘোঘী-বরিয়ারপুরের সংগ্রাম, গড়ে তোলে অন্ধ্রের রাবিরালা। আজও বিহারের চারু মজুমদার নগর, মহাদেব মুখার্জি নগর, প্রভৃতি বিপ্লবী সরকার গড়ার সংগ্রামে কামালপুর দেয় হিম্মত, আর হিম্মত দেয় চারু মজুমদারের রাজনীতি।

আজ যখন দাঁত নখ বের করে ভারতের শাসক শ্রেণীর সবচেয়ে প্রিয় পোষ্য ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ লাফিয়ে পড়েছে বাংলা কে ছিন্ন ভিন্ন করে নিজের মালিকের লোভ ও লালসা কে চরিতার্থ করতে, যখন এই সংগঠনগুলো চূড়ান্ত ধরনের মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে গরিব হিন্দুদের, গরিব আদিবাসীদের, তাঁদের শ্রেণী মিত্র গরিব মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কাচ্ছে, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও হিংসার আগুনে হাওয়া দিচ্ছে বাংলায় হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং রাজ্য জুড়ে এক ধরণের অঘোষিত  একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে, তখন কামালপুর কে স্মরণ করা, ১২ই জুনের শপথগুলো কে স্মরণ করা ভীষণ জরুরি।

আজ যখন আদিবাসী মানুষের জল-জঙ্গল-জমির উপর নেমে আসছে কর্পোরেট আগ্রাসনের খাঁড়া, যখন হাসদেও আরোনদের ১৭০,০০০ হেক্টর জঙ্গল তুলে দেওয়া হলো আদানি গোষ্ঠীর হাতে গাছ কেটে মাটির বুক চিরে কয়লা উত্তোলন করে মুনাফার পাহাড় গড়তে, আজ যখন ঝাড়খণ্ডে ও লালগড়ে আদিবাসী জনগণ অনাহারে মরেন, যখন রাষ্ট্র ব্যাপক বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের উপর তখন কামালপুরের লাল তারার থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি হয়ে ওঠে, জরুরি হয়ে ওঠে কামালপুরের থেকে আত্মত্যাগের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার রাজনীতি শেখার ও সেই রাজনীতি কে ফুলকির মতন বারুদস্তূপে, অর্থাৎ শোষিত ও নির্যাতিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।

সেই ১২ই জুনের মহান বিপ্লবীদের স্বার্থে, সেই শহীদ হওয়া লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কু (বাস্কে), আর অন্যদিকে কাবুল, মনোতোষ চক্রবর্তী বা রামশঙ্কর ব্যানার্জি'র অপূর্ণ স্বপ্নের স্বার্থে আজ বাংলার গ্রামে গ্রামে, জনপদে জনপদে, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তুলতে হাজার হাজার কামালপুর গড়ে তুলতে হবে। তার জন্যে যে কমিউনিস্টরা কামালপুরের শহীদদের স্মরণ করে মাথা নত করেন শ্রদ্ধায়, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছুড়ে দেন আগামী কে জানান দিয়ে যে তাঁরা লড়ছেন, তাঁদের আজ পুনরায় রাজনীতি দিয়ে অসংখ্য লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কুদের (বাস্কে) তৈরি করতে হবে, তাঁদের শ্রেণী নেতৃত্বে উন্নীত করতে হবে কারণ একমাত্র সেই শোষিত, নির্যাতিত মানুষের নেতৃত্বেই কমিউনিস্ট আন্দোলন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে পারবে অসংখ্য শহীদের স্বপ্নের লাল টুকটুকে ভোরের দিকে।  

ফ্যাসিবাদের উথ্বানে কমিউনিস্টদের সঙ্কট এবং বিপ্লবীদের করণীয় কাজ

বৃহস্পতিবার, জুন ০৬, ২০১৯ 0 Comments A+ a-

ফ্যাসিবাদের উথ্বানে কমিউনিস্টদের সঙ্কট এবং বিপ্লবীদের করণীয় কাজ

কমিউনিস্টরা শেষ হয়ে যাচ্ছে, মানুষ বামপন্থার প্রতি নাকি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন এবং জনগণ নাকি সারা বিশ্বের মতন ভারতবর্ষেও দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্টদের নিজ রক্ষাকর্তা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, এই নিয়ে প্রতিনিয়ত গাদা গাদা, বা বলতে গেলে গিগাবাইট-গিগাবাইট কন্টেন্ট প্রকাশিত হচ্ছে। বামপন্থী বলতে ঠিক কাকে বোঝানো হচ্ছে সে বিষয়ে যেমন কোন স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হচ্ছে না ঠিক তেমনই সিপিএম ও সিপিআই জাতীয় উঁচু দরের চরম সংশোধনবাদী ও সোশ্যাল-ফ্যাসিস্ট বা সামাজিক-ফ্যাসিবাদী পার্টিগুলির অধঃপতন কে কেন যে সামগ্রিক ভাবে বাম ও কমিউনিস্ট শক্তির পতন হিসেবে দেখানো হচ্ছে তারও কোন জবাব নেই।

যদিও ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি'র কৃষক আন্দোলনের উপর গুলি চালিয়ে দুইটি শিশু সহ ১১ জন কমিউনিস্ট আন্দোলনকারীদের হত্যা করার মধ্যে দিয়ে সিপিএমের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে হাতেখড়ি যা পশ্চিমবঙ্গে দলটির সাড়ে তিন দশকের শাসনের শেষ প্রান্তে বারবার সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম বা লালগড়ে শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের, কৃষক ও সাধারণ জনতার রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সিপিএমকে একটি পাক্কা সামাজিক-ফ্যাসিবাদী শক্তিতে পরিণত করে, তবুও কমিউনিস্টদের হেয় করতে যেমন এককালে চরম কমিউনিস্ট-বিরোধী সংবাদমাধ্যমগুলো ক্রুশ্চেভ, ব্রেজনেভ, গর্বাচেভ প্রভৃতির কাজকর্ম কে কমিউনিস্টদের কাজকর্ম বলে প্রচার করতো, তেমনি আজ ভারতবর্ষে বারবার সিপিএম কে কমিউনিস্ট সাজিয়ে জনমানসে বিভ্রান্তি ও হতাশা ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সিপিএমের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব সেইদিন দেশের মানুষ দেখেছিলেন যখন এই দল কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়ে কলকাতা সহ সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে নকশালপন্থী বিপ্লবীদের হত্যা করা শুরু করে। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের খুন করতে কংগ্রেসের ন্যায় সিপিএমের কোনদিন হাত কাঁপেনি। আজ যখন বলা হচ্ছে যে সিপিএমের ভোট বিজেপি'র খাতায় চলে যাচ্ছে, যখন সিপিএম কে দেখিয়ে "বামের রাম হওয়া" জাতীয় কুৎসিত কমিউনিস্ট বিরোধী রটনা করে সামগ্রিক কমিউনিস্ট আন্দোলন কে বিজেপি ও হিন্দুত্বের দোসর হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তখন মানুষের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির স্বার্থে আমাদের দুইটি আশু কর্তব্য পূর্ণ করতে হবে।

প্রথমতঃ আজ বিপ্লবী কমিউনিস্টদের স্বার্থে এটা দেখানো প্রয়োজন যে সিপিএম চিরকালই শাসক শ্রেণীর সাথে ঘর করে এসেছে, যে সিপিএম কোনদিনই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের চরম বিরোধিতা করেনি বা কেরলে নিজের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখার জন্যে আরএসএস এর সাথে মারামারি করলেও কোথাও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে উৎখাত করতে লড়াই করেনি, বরং চিরকাল এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের সাথে সিপিএম গোপনে লিপ্ত থেকেছে।

যখন ১৯৮৯ সালে কংগ্রেস কে আটকাতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ জনতা সরকার গড়ার চেষ্টা করেন প্রাক্তন জনতা পার্টির নানা নেতা ও গোষ্ঠীকে এক করে, তখন কিন্তু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রাম জন্মভূমি আন্দোলনে বিজেপি পুরোদস্তুর শরিক ও নেতৃত্বের ভূমিকায় আসীন। সারা ভারত জুড়ে যখন লাল কৃষ্ণ আদবানি ও অন্যান্য বিজেপি নেতারা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির গড়ার উগ্র হিন্দুত্ববাদী জিগির তুলে দেশের মধ্যে হিংস্র ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা লাগাবার পরিকল্পনা করছে বিজেপি'র রাজনৈতিক উত্থানের স্বার্থে তখন কিন্তু জ্যোতি বোসদের বিজেপি'র অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে ব্রিগেড সভা করতে গায়ে বাঁধেনি, বিজেপি ও সিপিএমের জোট কিন্তু ওই রাম মন্দির আন্দোলনের ছায়ায় গড়ে উঠেছিল। সেই বাজপেয়ী’র সাথে জ্যোতি বোস হাত মেলায় যে বাজপেয়ী’র হাতে তখনো ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংগঠিত নেলি হত্যাকাণ্ডের রক্ত লেগে ছিল।

জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চা বা এনডিএ'র অংশ হিসেবে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খাল কেটে কুমির ঢোকানোর মতন পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তে প্রান্তে জোট সঙ্গী বিজেপি ও আরএসএস কে জায়গা করে দিচ্ছিলেন, যখন উত্তরবঙ্গের আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে আরএসএস এর প্রচারকরা একের পর এক জঙ্গি তৈরির শিবির তৈরি করে, ইস্কুল গড়ে শিশুদের  জঙ্গি তৈরি করার কারখানা শুরু করে তখন কিন্তু জ্যোতি বোস বা তাঁর উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কোন টু শব্দ করেননি। আওয়াজ তুলেছিল বিপ্লবী কমিউনিস্টরা, যার ফলে তাঁদের সিপিএম, তৃণমূল ও বিজেপির যৌথ হামলার মোকাবিলা করতে হয়েছে।

প্রায় এক দশক বাদে, যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতার মধ্যগগনে আসীন হলেন ৩৪ বছরের জনবিরোধী বাম সরকার কে উচ্ছেদ করে, তখন আর শাসকপার্টির লোক হওয়ার জন্য মানুষের নাস্তিক সাজার দরকার হলো না। শুরু হলো ধর্ম ও রাজনীতির ঘৃণ্য ব্যভিচার, তখনো কিন্তু আসল সমস্যার দিকে চোখ না ঘুরিয়ে এই সরকারি বামেরা মানুষের কাছে শুধু নিজেদের ক্ষমতায় ফেরানোর দাবি নিয়ে গেছে। বারবার বলেছে তৃণমূল আসল শত্রু এবং তৃণমূল কে সরাতে যা খুশি করা যাবে। যখন ইমাম ভাতা দেওয়ার নাম করে তৃণমূল মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব খাটাবার চেষ্টা করে, তখন কিন্তু সিপিএম কে দেখা যায়নি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে, সিপিএম কে পাওয়া গেছিল বিজেপি’র পাশে বসে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জাবর কাটতে।

আজ যারা সিপিএমের ভরাডুবির কথা বলছেন, বা সিপিএম ও বিজেপি’র অশুভ আঁতাতের কথা বলছেন তাঁরা কিন্তু ভুলে গেছেন যে সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এমন দুর্দশা সেই ২০০৮ থেকেই শুরু হয়। এখনো এমনকি কোন কলা গাছকেও যদি সিপিএমের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড় করানো হয় তাহলে সেই কলা গাছই জিতে যাবে। এর পরেও সিপিএম নেতৃত্বের দম্ভে ও মেজাজে কোন পরিবর্তন আসেনি। আসলে তাঁরা যে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন বিমান বোস, সূর্য মিশ্র বা সিপিএমের বড়, মেজ, সেজ বা ছোট কোন নেতার ব্যবহার বা আদব কায়দায় তা কখনো ফুটে ওঠেনি। অমায়িক হয়ে, দম্ভহীন হয়ে, অনুতপ্ত হয়ে এবং আত্মসমালোচনা করে জনগণের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার জায়গায় তাঁদের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে যেনতেন প্রকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে ক্ষমতাচ্যুত করার অভিলাষ। তাঁরা ক্ষমতায় ফিরতে চান, লড়াইয়ে নয় আর তাই তাঁদের কাছে শত্রুর শত্রু বিজেপি অছ্যুৎ নয়।

২০১৪ সালে বিজেপি রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে দুটি আসন ও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যখন তিনটি আসন লাভ করে ঠিক তখন থেকেই তৃণমূলের সন্ত্রাস রোখার অছিলায় তৃণমূল স্তরে বিজেপি, আরএসএস ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সাথে একধরণের গাঁট বাঁধে সিপিএমের নেতৃত্ব। ২০১১ সালে ক্ষমতার সাথে সাথে নিজের হার্মাদ বাহিনীকেও হারায় সিপিএম। যেহেতু তৃণমূল সেই হার্মাদ বাহিনীর মালিক হয়ে সিপিএমের দিকে ধেয়ে আসে, ৩৪ বছরের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনমানসে সঞ্চিত ঘৃণা ও ক্রোধের বারুদে আগুন জ্বালিয়ে সিপিএমের নেতা ও কর্মীদের উপর নামিয়ে আনে অত্যাচারের খাঁড়া, তখন ভোটের স্বার্থে গড়া ঠুনকো সংগঠন এমনিই ভেঙে যায়। এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ গড়া তো দূরের কথা কোন ভাবে নিজের সংগঠনের লোকেদের বাঁচাবার কোন ক্ষমতা সিপিএমের আর থাকে না।

সিপিএম নেতারা ২০১১ সাল নাগাদ বলতেন যে ক্ষমতা চলে যাওয়ায় তাঁদের দলের নাকি বেনোজলও চলে গেছে এবং যা পরে থাকছে তা নাকি খাঁটি সোনা। তবে তাঁরা একথা মানুষ কে জানাননি যে তাঁদের দলে যা ছিল তার সবটাই বেনোজল আর ওই বেনোজল চলে যাওয়ার পরে হাতে থাকলো পেন্সিল আর সংগঠন সরে গেল ফেসবুকের দুনিয়ায়। গ্রামে গ্রামে যে তৃণমূল বিরোধী ভোটগুলো নিজের দিকে তাও টেনে রাখতো সিপিএম তাও ধীরে ধীরে বিজেপি’র খাতায় চলে গেল কারণ বিজেপি তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়তে পেরেছে আরএসএস এর জঙ্গী বাহিনী কে ব্যবহার করে। আবার এই বিজেপিতে তৃণমূল বিরোধী হিন্দু ভোট চলে যাওয়ার ফলে এই ভোট ব্যাঙ্কের গেরুয়াকরণ ভীষণ সহজ হয়ে যায় বিজেপির কাছে। সিপিএম তখন অথৈ জলে পড়ে প্রথমে কংগ্রেসের হাত ধরে নিজের ভোট কংগ্রেসের খাতায় তুলে দেয় ও পরে আবার বিজেপি’র সাথে গোপন আঁতাত গড়ে তৃণমূল কে নির্মূল করতে।

সিপিএমের এই ভাবে বিজেপিতে বিলীন হয়ে যাওয়ার সাথে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে নির্মূল করার লক্ষ্যে তার শক্তির মূল উৎস যে আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক তাকে উচ্ছেদ করার জন্যে চালিত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কোন সম্পর্ক নেই। প্রতি পদে, প্রতি মোড়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রাম কে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে লড়তে হচ্ছে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধেও। আর এই লড়াইয়ে সিপিএম বিপ্লবী কমিউনিস্টদের ও দেশের আপামর শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের শত্রু হিসেবে আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সিপিএম ও সংশোধনবাদ কে পরাস্ত না করে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করার স্বপ্ন একটা দিবাস্বপ্ন মাত্র। যে বা যাঁরা ভাবছেন সিপিএমের সাথে বা তথাকথিত বামফ্রন্টের শরিকদের সাথে এক হয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলবেন তাঁরা যে শুধু জনতাকে বোকা বানাচ্ছেন তাই নয়, তাঁরা নিজেদেরকেও ঠকাচ্ছেন।

দ্বিতীয়তঃ আজ এটাও সত্য যে ফ্যাসিবাদের এই উত্থানের ফলে দেশজুড়ে শ্রমিক-কৃষকের লড়াইয়ে ধাক্কা লেগেছে, ধাক্কা খেয়েছে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজও। এর সাথে সিপিএমের বেইমানির চেয়ে বেশি সম্পর্ক হলো আজ বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর জেঁকে বসে থাকা নয়া-সংশোধনবাদী রাজনীতির, যা মানুষ কে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সেতুঙের চিন্তাধারার যে সফল প্রয়োগ চারু মজুমদার নকশালবাড়ি গড়ে তুলে দেখিয়ে গেছেন, সিপিআই(এম-এল) পার্টি গড়ে শিখিয়ে গেছেন, তার থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে । নানা ধরণের সংস্কারবাদী ও পরিচয় রাজনীতির গরল কে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সেতুঙের চিন্তাধারার মধ্যে মিশিয়ে এক ভেজাল রাজনীতির কারবার চালিয়ে মানুষকে ঠকাচ্ছে এক দল তথাকথিত বিপ্লবী।

অন্যদিকে, আরএসএস কর্মীরা জনগণের গভীরে মিশে যাচ্ছেন, স্বাচ্ছন্দ্যে শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে বাস করছেন, তাঁদের শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়ার অছিলায় ছোটবেলার থেকেই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের দর্শনে দীক্ষিত করছেন। অথচ তথাকথিত বিপ্লবী কমিউনিস্টদের আস্তানা হয়েছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ, নানা ধরণের আলোচনা সভা যেখানে শুধুই বুদ্ধিজীবীরা ভিড় করেন এবং নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেখানে আবার শ্রমিক ও কৃষকের দেখা মেলা ভার। যদিও বা কিছু তথাকথিত কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা, বিশেষ করে ছাত্র যুব সম্প্রদায়ের থেকে উঠে আসা নব্য বামেরা, শ্রমিকদের মধ্যে বা কৃষকদের মধ্যে সংগঠন করতে যান, তাঁরাও আবার বাড়ি ভাড়া করে থাকেন, নানা ধরণের তত্ত্ব কথা শুনিয়ে জনগণের ঘাড়ে বসে খান, নিজেরা কায়িক শ্রম দেন না, তাঁরা নিজেরা শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করা যে কী কষ্টসাধ্য তা অনুমান করতে পারেন না। ফলে কষ্টসাধ্য জীবনযাপন না করা, সাধারণ মানুষের সাথে অমায়িক হয়ে না মেলামেশা করায়, এলিটিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঁচিলের মধ্যে নিজেদের একঘরে করে রাখায় এই তথাকথিত বিপ্লবীদের সম্পর্কেও জনমানসে ঘৃণার ও তাচ্ছিল্যের আবহ তৈরি করতে সংঘ পরিবারের কর্মীদের বেশি সময় লাগে না।

যখন ফ্যাসিবাদের উত্থান হয় তখন তার পিছনে থাকে বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অবিশ্বাস, তাঁদের রাগ আর এক আমূল পরিবর্তনের আশা, যা ফ্যাসিবাদী শক্তি তাঁদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে। নরেন্দ্র মোদী কে শিখন্ডি করে বিজেপি ও আরএসএস আসলে মানুষকে একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছে। তাঁরা দেখিয়েছে যে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কে বদলে দিতে সক্ষম নরেন্দ্র মোদী। মোদী সরকারের জনপ্রিয়তা যে শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত ও শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ সে কথা মেনে চলা হবে ধৃষ্টতা। ভারতের নানা প্রান্তের গ্রামাঞ্চলেও, দরিদ্র ও মাঝারি কৃষকের মধ্যেও বিজেপির চেয়ে বেশি হলো মোদীর জনপ্রিয়তা, কারণ আরএসএস মোদী ও হিন্দুত্ববাদ কে ভাগ করেছে প্রতিটি শ্রেণী ও জাতির মানুষের চেতনার দিকে ও চাহিদার দিকে তাকিয়ে। বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজি ও তার সহচর দেশী মুৎসুদ্দি পুঁজির যেমন দরকার তেমন লাগামহীন লুঠ ও শোষণের গ্যারান্টি ফ্যাসিবাদ সেই শ্রেণীগুলোকে দেয়, বৃহৎ জোতদার ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিকে দেয় কর্পোরেট লুঠের বখরার আশ্বাস, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের দেয় চাকুরী, ব্যবসা, কর ছাড়, সহ উগ্র দেশপ্রেমের টনিক, অন্যদিকে গ্রামীণ ও শহুরে গরিব কে, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষ কে হিন্দুত্বের উগ্রতার অংশীদার করে তাঁদের মধ্যে এক ক্ষমতায়নের অনুভবের সঞ্চারণ করে, তাঁদের এক মিথ্যা আত্মসম্মানবোধ দিয়ে আচ্ছন্ন করে, তাঁদের হিন্দু ধর্মের নামে ক্ষেপিয়ে আজ আরএসএস ও বিজেপি মোদী'র প্রতি জনসমর্থন তৈরি করতে পেরেছে।

ঠিক যখন দেশজুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে, হিন্দুরা ও হিন্দুধর্ম আক্রান্ত এই জোয়ার তুলে, কমিউনিস্টদের ধর্মদ্রোহী ও মুসলিম তোষণকারী বলে চিহ্নিত করে ও দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কে পরিবর্তন করার জিগির তুলে আরএসএস ও বিজেপি মোদী'র প্রতি সমর্থনের বন্যা তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে, বিরোধী মতবাদকে পিষে দিচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে জনতা যে সংবিধান ও ব্যবস্থার চেয়ে মুক্তি চাইছে, সেই সংবিধানকে রক্ষা করার কথা বলে, যে ধর্মের প্রতি মানুষের মোহ চূড়ান্ত সেই মোহ কে শেষ না করে নানা ভাবে হিন্দু ধর্মের উপর আম্বেদকরীয় কায়দায় হামলা করে (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কায়দায় নয়) নব্য বামেরা ও তথাকথিত কিছু বিপ্লবী সাজা আঁতেল ধরণের লোকেরা জনগণ কে আরএসএসের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন।

যখন সংবিধান বদলে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের কথা জোর করে প্রচার করছে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ তখন সেই হিন্দুরাষ্ট্রের ক্ষতিকারক বিষয়গুলো জনগণের সামনে সহজ ভাষায় স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা না করে, জনগণ কে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে তাঁদের সমস্যার সমাধানের কথা না বলে, জনগণ কে এই পঁচাগলা ব্যবস্থা ও তাঁরা যে সংবিধানের উপর ক্ষিপ্ত তার বিরুদ্ধে যে কমিউনিস্টরা এক বিকল্প ব্যবস্থা, যা সম্পূর্ণ নতুন এক ব্যবস্থা হবে, গড়তে চায়, সে কথা না বলে, শুধু সংবিধান বাঁচাও ও এই ঘৃণ্য ব্যবস্থা কে বাঁচাবার কথা বলে মিছিল মিটিং করলে যে জনগণের থেকেই দূরে সরে যেতে হয়, কমিউনিস্ট আর লিবারেল গণতন্ত্রীদের মধ্যে পার্থক্যটা মুছে যায়, সে কথা তথাকথিত বিপ্লবী কমিউনিস্টদের হয়তো আজও বোধগম্য হচ্ছে না। কারুর লেজুড় না হয়ে, স্বতঃস্ফূর্ততার পিছনে ধাওয়া না করে বরং জনগণের মধ্যে রাজনীতি দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ততা সৃষ্টি করার কাজ কে আজ অনেক তথাকথিত বিপ্লবীই আর ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না।

যে মুহূর্তে সারা দেশ জুড়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর গোরক্ষক নামক হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করছে, মানুষ কে খুন করছে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যে, এবং রাষ্ট্রের মদতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে রাখার চেষ্টা করছে, ঠিক সেই সময়ে কলকাতা'র মতন কিছুটা নিরাপদ শহরে দাঁড়িয়ে বা কেরলের মতন নিরাপদ রাজ্যে দাঁড়িয়ে বিফ ফেস্টিভ্যাল করা, জনসমক্ষে পৈতে পুড়িয়ে বা হিন্দু ধর্মের তীব্র সমালোচনা করার মধ্যে দিয়ে আসল সংগ্রাম, অর্থাৎ যে সকল অঞ্চলে সংখ্যালঘু মুসলিমরা আক্রান্ত সেখানে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সেতুঙের চিন্তাধারা দিয়ে মানুষ কে জাগ্রত করা, শ্রেণী সংগ্রামের আগুনে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে জ্বালিয়ে দেওয়া ও তার শক্তির উৎস আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক কে উচ্ছেদ করার কর্তব্য কে এড়িয়ে যাওয়া আসলে চূড়ান্ত মাত্রার সুবিধাবাদী রাজনীতি। উদারনৈতিক গণতন্ত্রীদের সাথে এহেন নব্য বামেদের বা তথাকথিত কিছু বিপ্লবীর লাইনের কোন গুণগত পার্থক্য থাকছে না। এর ফলে ধর্মভীরু, রাজনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ, সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাপক শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে, শোষিত মেহনতি মানুষের মধ্যে নিজেদের হিন্দু-বিরোধী ও মুসলিমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে, কমিউনিস্টদের সম্পর্কে আরএসএস এর ছড়ানো বিষাক্ত প্রচারকেই শক্তিশালী করে তুলে শ্রেণী সংগ্রামের পিঠেই ছুরি মারছে এই তথাকথিত বিপ্লবীদের দল।

সিপিএম যে বিজেপি'র দোসর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে এবং সেই ঘটনা কমিউনিস্ট আন্দোলনের যতটা ক্ষতি করেছে তার চেয়েও ভয়ানক ক্ষতি কিন্তু বিপ্লবী সাজা একদল পাতি বুর্জোয়া আঁতেলদের দল করছে। শ্রমিক-কৃষক থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে, পরিচয় সংগ্রাম কে শ্রেণী সংগ্রামের উপরে স্থান দিয়ে, কোন ধরণের বিকল্প পরিকল্পনা ছাড়া, মানুষ কে রাজনীতি দিয়ে, শ্রেণী সংগ্রামের যুদ্ধ ক্ষেত্রে পোড় না খাইয়ে শুধু আঁতলামি করে, গ্রন্থকীটের মতন অমার্ক্সীয় তত্ত্ব আউরে শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি, জাত ব্যবস্থা ও গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে নাটক করে, মানুষের আশু সমস্যাগুলো নিয়ে লড়াই না করে, মানুষের জন্যে বিকল্প ন্যারেটিভ তৈরি না করে শুধুই আরএসএস ও বিজেপির তৈরি ন্যারেটিভের সীমারেখার মধ্যে নিজেদের বন্দি রেখে এই তথাকথিত বিপ্লবীরাও বিপ্লবের ঢের ক্ষতি করেছে।

করণীয় কী?


বর্তমানে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কর্তব্য হচ্ছে ব্যাক টু দ্য রুট, বা নিজ শিকড়ে ফিরে যাওয়া। শ্রেণী সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। জনগণের কাছে ছাত্র হিসেবে ফিরে যাওয়া, তাঁদের সৃজনশীলতার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, তাঁদের চেতনার মান বুঝে তাঁদের সম্পূর্ণ রাজনীতি দিয়ে নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষককে নেতৃত্বে উন্নীত করা যাতে তাঁরা বিপ্লবের লড়াইয়ে, নিজেদের শ্রেণীর মুক্তির সংগ্রামে তাঁদের মহান ভূমিকা পালন করতে পারেন। এর জন্যে দরকার শ্রমিক ও কৃষকের সাথে একাত্ম হওয়া। শহরের নিরাপদ জীবনযাপন ছেড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ছেড়ে, ভাল চাকরি ও ভবিষ্যতের ডাক কে উপেক্ষা করে, "আমার কী হবে?" সেই চিন্তা কে জয় করে, মূলতঃ আত্মস্বার্থকে চূর্ণ করে, সংশোধনবাদ কে নাকচ করে, জনগণের স্বার্থে আত্মত্যাগ করা। গ্রামে গিয়ে দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকের বাসায় আশ্রয় নেওয়া, তাঁদের সাথে শ্রম দেওয়া, শ্রমের মর্যাদা করা, তাঁদের রাজনীতি দেওয়া ও শ্রেণী সংগ্রামের লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করা, শ্রেণীর মাস্টার হওয়ার চেষ্টা না করে তাঁদের ভাল ছাত্র হওয়ার চেষ্টা করা, তাঁদের বিশ্বাস করা ও তাঁদের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা এবং সর্বোপরি তাঁদের উদ্ভাবনীয় সৃষ্টিশীলতার উপর ভরসা রেখে তাঁদের নেতৃত্বে উন্নীত করার চেষ্টা আজ জরুরী কাজ।

যাঁরা গ্রামে যেতে পারছেন না কোন কারণে তাঁদের আজ শ্রমিকদের এলাকায় গিয়ে প্রচার ও প্রসারের দ্বায়িত্ব পালন করা উচিত। শ্রমিকের লড়াই যে বিশ্বমুক্তির লড়াই, টাকা আনা পাইয়ের নয় বরং মর্যাদার লড়াই সে কথা আজ জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে।  বাড়ি ভাড়া না নিয়ে রাজনীতি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা শ্রমিকদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করা, কোন ধরণের কাজ জোগাড় করে শ্রমের বদলে নিজের খরচ চালানোর চেষ্টা করা, ও পদে পদে মানুষ কে পার্টির চেতনার স্তরে উন্নীত করার চেষ্টা করা আজ বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কর্তব্য।

এর সাথে সাথে সমস্ত বুর্জোয়া অভ্যাস যেমন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু এলিটিস্ট চক্রের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বাইরে বের হবার অভিপ্রায় হারানো, শুধু মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ থাকা, ইত্যাদি ত্যাগ করতে হবে। বাড়িতে গৃহ শ্রমিক না রেখে বরং নিজের কাজ নিজে করা, শ্রেণীর মানুষের সাথে অমায়িক হয়ে ব্যবহার করা, যে ভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীরা অতীতের কমিউনিস্টদের নকল করে জনগণের সাথে সহজ সরল জীবনযাত্রা আয়ত্ত করে মিশে গেছে তার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদেরও মানুষের মধ্যে যাওয়ার ও তাঁদের একজন হয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করতে হবে নিজের বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় অর্জিত ডিগ্রি বা ডক্টরেট থেকে নিজেকে গাড়ির গিয়ারের মতন নিউট্রালাইস করে, জনগণের ছাত্র হিসেবে তৈরি হয়ে।

ঐক্যবদ্ধ হতে হবেই


আজ অনেকগুলো ছোট বা মাঝারি কমিউনিস্ট পার্টি নানা ভাবে বিপ্লবের কথা বলছে ও সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলছে। কিছু দল এখনো নকশালবাড়ি’র রাজনীতির কথা, চারু মজুমদারের কথা, আজও বলেন। আজ একজন বিপ্লবী কমিউনিস্ট এই রকম অনেক দলের একটির হয়তো কর্মী বা সমর্থক হতে পারেন এবং সেই দলের রাজনীতির সাথে অন্য দলের রাজনীতির হয়তো অনেক তফাৎ। তবে যেহেতু তিনি বিপ্লব চান এবং তিনি মনে করেন তাঁর পার্টির দৃষ্টিভঙ্গী সঠিক তাই বলে তিনি অন্য দলের কর্মীদের বা সমর্থকদের যদি হেয় করেন, তাচ্ছিল্য করেন বা কথায় কথায় খোটা মারেন তাহলে বিপ্লবী ঐক্য বলে কোন কিছুই তৈরি করা সম্ভব নয়।

সিপিএমের সাথে আসন  ভাগাভাগি করার দর কষাকষি করে যে ভাবে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন সহজেই “বৃহৎ বাম ঐক্যের” কথা বলতে পারে ভোটের বাজারে কিছু প্রণামী কুড়াতে, সেই জিনিসটা হয়তো বিপ্লবী কমিউনিস্টদের ক্ষেত্রে এত সহজ নয়। তবে সহজ না হলেও অসম্ভব তো নয়। হৃদয়ের গভীর প্রসারতা কমিউনিস্টদের বড় গুণ। বিপ্লবের স্বার্থে, শ্রেণীর স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে যেহেতু তাঁরা লড়াই করেন তাই তাঁদের সঙ্কীর্ণতাবাদ থেকে মুক্ত হয়ে সমগ্র বিপ্লবী কমিউনিস্ট শক্তির সাথে ঐকবদ্ধ হওয়ার মানসিকতা রাখতেই হবে এবং তা প্রয়োগ করতেই হবে যাতে ফ্যাসিবাদের আক্রমণের মুখে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের প্রতিরোধ কে শক্তিশালী করা যায়, যাতে শ্রেণী বিভক্ত না হয়ে যায়।

করণীয় কাজগুলি সব বিপ্লবী কমিউনিস্টদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেখানেই কমিউনিস্টদের মনে হবে যে তাঁরা কঠিন সংগ্রাম না করেই সহজেই বিজয় অর্জন করে ফেলবেন সেখানেই সংশোধনবাদ যে বিপ্লবী সত্ত্বা কে ধ্বংস করার জন্যে দরজায় কড়া নাড়ছে সে কথা বুঝতে হবে। সিপিএম শুধু সিপিএমেই গন্ডিবদ্ধ নেই, সিপিএমের বিষাক্ত হাওয়ায় আজ কমবেশি অনেকগুলো কমিউনিস্ট নামধারী দল আক্রান্ত হয়েছে। বামফ্রন্টের শাসনকালে যেসব তথাকথিত বিপ্লবীরা লড়াইয়ের ময়দান থেকে দূরে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সেমিনার আর পদযাত্রা করে জীবন কাটিয়েছেন এই যুগে এসে তাঁরা যে সত্যিই প্রতিরোধে কোন ভূমিকা নেবেন সে কথা আশা করা হবে শিশুসুলভ আকাশ কুসুম কল্পনা করা।

বর্তমানে আমাদের হাতের কাছে যা আছে, আমাদের পাশে যে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের ও আমাদের আশেপাশে যে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষ আছেন তাঁদের নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে এবং একমাত্র মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাও সেতুঙের চিন্তাধারার ব্যাপক প্রচার করে, মানুষের দৈনন্দিন সমস্যায় তত্ত্ব কে প্রয়োগ করে, বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা জনগণ কে বুঝিয়েই তাঁদের মধ্যে প্রবেশ করা ফ্যাসিবাদের বিষ কে নির্মূল করা সম্ভব। তাই প্রতিটি কমিউনিস্টেরই কাজ হওয়া উচিত প্রতিটি অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও সেই প্রতিরোধে সামিল হতে শ্রেণী কে উদ্বুদ্ধ করা। আর এই শ্রেণী কে উদ্বুদ্ধ করতে তাঁদের শ্রেণীর কাছে, অর্থাৎ শিকড়ে ফিরতেই হবে, মূলটা ধরতেই হবে। এলাকা ভিত্তিক লেগে-পড়ে থেকে কাজ না করলে পঞ্চাশ বছর পরেও শুধু দিবস পালনেই তাঁরা সীমিত থেকে যাবেন এবং ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না একথা কিন্তু সবাইকেই মাথায় রাখতে হবে। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে