চীনা কমিউনিস্ট পার্টি'র শি জিনপিং চিন্তাধারার তত্ব মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে ঢেকে দিতে পারবে না

শনিবার, অক্টোবর ২৮, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

চীনের সঙ্কট: মাও বনাম শি


বর্তমান চীনের সাথে কমিউনিস্টদের সম্পর্কটা বর্তমানের শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্তের সাথে ঘোড়ার সম্পর্কের মতন, পাহাড়ে বা সমুদ্র সৈকতে ছুটি কাটাতে গেলে কেউ কেউ কখনো চড়ে ফেলেন, কেউ না চড়ে দেখেন আর কেউ দেখেও দেখেন না। সেই চেয়ারম্যান মাও জেদং ও নেই আর সেই বিপ্লবের গান’ও নেই, শুধু চীনে পড়ে আছে একটা ফিকে হয়ে যাওয়া লাল আস্তরণ যা দেখিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব একটি পার্টি কংগ্রেস করেন এবং সেই কংগ্রেসে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের গাঁজাখুরি তত্ব কে গালভারী নাম দিয়ে পার্টির পথনির্দেশক তাত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সেই তত্বের জয়গান করে আকাশ পাতাল ভরিয়ে দেয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক তথা দেশের রাষ্ট্রপতির মোসাহেবের দল। আবার দুই বার পর পর সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরেই বিদায় নিতে হয় একজন  নেতা কে আর তাঁর স্থানে অভিষেক হয় কোন নতুন নেতার। বর্তমান চীনের কমিউনিস্ট নামধারী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিং পাঁচ বছর অতিক্রমণ করে ফেললেন এবং সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশতম জাতীয় কংগ্রেসে তাঁর রাজনৈতিক লাইন, যার গালভারী নাম হলো - নয়া যুগের চীনা বৈশিষ্ট সম্পন্ন সমাজতন্ত্রের উপর শি জিনপিং এর চিন্তাধারা, পার্টির পথনির্দেশক তাত্বিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হলো। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পূর্ণ পথনির্দেশক তাত্বিক ভিত্তি হলো - মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাও জেদং চিন্তাধারা, দেঙ জিয়াওপিং তত্ব, তিন প্রতিনিধিত্বের তত্ব (জিয়াং জেমিন), বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন তত্ব (হু জিনতাও), নয়া যুগের চীনা বৈশিষ্ট সম্পন্ন সমাজতন্ত্রের উপর শি জিনপিং এর চিন্তাধারা। এর মধ্যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হিসেবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হলো বিশ্বের চলমান দ্বন্ধ কে বোঝার বৈজ্ঞানিক উপায় এবং মাও জেদং চিন্তাধারা হলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম প্রজন্মের নেতৃত্বের, যাঁর মধ্যমণি ছিলেন মাও জেদং, যৌথ প্রয়াস দ্বারা সৃষ্ট চীনের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বাস্তব প্রয়োগ। ফলে দেখতে গেলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি’র নেতৃত্ব মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও জেদং এর  চিন্তাধারার ধারালো তলোয়ার ফেলে তার জায়গায় নকল রাংতার তলোয়ার বানিয়ে হাতে ধরে বসে আছে এবং সেই অস্ত্রকেও আবার ব্যবহার করতে ভয় পাচ্ছে, যদি বা রাংতার আঘাতেই শত্রুর শরীরে ঘা লেগে যায়। যেমন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশতম জাতীয় কংগ্রেসের প্রস্তাবে এই বছরে কার্ল মার্কসের পুঁজি প্রকাশের ১৫০ বছরের কথা বলা থাকলেও কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার কথা খুব সন্তর্পণে আড়াল করা হলো, সে বাদ যাওয়া নিছক বাদ যাওয়া নয় বরং বেশ হিসেবে কষেই বাদ দেওয়ার ঘটনা, কারণ নভেম্বর বিপ্লব কে বাদ দিয়ে দিলে তো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তাত্বিক ভিত্তির লেনিনবাদের উৎসটা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে, প্রশ্ন ওঠে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র কে নিয়ে এবং সমাজতন্ত্র কে নিয়েও।  

এই চীনা বৈশিষ্ট সম্পন্ন সমাজতন্ত্র, যাকে বাজার সমাজতন্ত্র বা আদতে সমাজতন্ত্রের মোড়কে উদ্দাম পুঁজিবাদী নগ্ন শোষণ শাসনের ব্যবস্থা বলা যায়, তা হলো মাও জেদং বেঁচে থাকার সময় থেকেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বার বার করে পরিস্ফুটিত হতে থাকা একটি লাইন যার বিরুদ্ধে মাও জেদং কে নিজেকে বহুবার লড়তে হয়েছে এবং দমন করতে হয়েছে এই ঘৃণ্য পুঁজিবাদী দর্শনের পথিকদের, যাদের অন্যতম ছিল লিউ শাওকি এবং তাঁর দোসর দেঙ জিয়াওপিং। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের কাছে বর্তমানে ভীষণ প্রিয় এই বাজার সমাজতন্ত্রের লাইন আসলে মেকি কমিউনিস্ট পার্টির ভন্ড শোধনবাদী নেতাদের দেয় চীনের শ্রমজীবি মানুষের রক্ত ঘামে সৃষ্ট সম্পদ কে জলের দরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবির কে বিক্রি করার অবাধ অধিকার এবং সাথে সাথে এক দলীয় শাসনের মাধ্যমে, জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের নামে, শ্রমিক ও কৃষকদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে পদদলিত করে রাখার জন্যে সীমাহীন সামরিক ক্ষমতা। মাও জেদং এর মৃত্যুর পরেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরের শোধনবাদীদের দ্বারা চীনের রঙ পাল্টানোর কাজ তীব্র গতিতে শুরু হয় এবং আজ থেকে ৩৫ বছর আগে, ১৯৮২ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাদশ জাতীয় কংগ্রেসে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ মোটামুটি সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে যেহেতু চীনের মাটিতে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ অবধি মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের তীব্র আগুন জ্বলে উঠেছিল এবং বিরাট বিরাট সংগ্রাম করে চীনা শ্রমিক-কৃষক ও সৈনিকরা পুঁজিবাদী পথগামীদের ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র কে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মতন চীনের মাটি থেকে দ্রুত গতিতে লাল ঝান্ডা ফেলে দেওয়ার ও মাও জেদং এর বিরুদ্ধে, মাও জেদং এর চিন্তাধারার বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধে নামার হিম্মত চীনা সংশোধনবাদী নেতৃত্বের হয়নি। এদের তাই কাজ করতে হয়েছে মাও জেদং কে মাথায় তুলেই, মাও কে মহান বলে তারপরেই এরা মাও এর পথের ও তাঁর চিন্তাধারার তীব্র বিরোধিতা করেছে। ১৯৬৯ সালেই মাও জেদং এর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম জাতীয় কংগ্রেসে মাও জেদং এর উত্তরাধিকারী হিসেবে উঠে আসা লিন বিয়াও বলেছিলেন যে - যে কোন শক্তি যদি চীনের মাটিতে দাঁড়িয়ে মাও জেদং এর চিন্তাধারার বিরোধিতা করে বা তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাহলে সমগ্র চীনের জনগণ তার নিন্দা করবে এবং তাকে দন্ডিত করবে। এই দণ্ডিত হওয়ার আতঙ্কে জরাগ্রস্ত হয়ে চলা চীনা সংশোধনবাদীদের পান্ডা দেঙ জিয়াওপিং নিজে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় ১৯৮৯ সালে সমগ্র চীন জুড়ে শুরু হওয়া সংশোধনবাদ-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেখে। সেই আন্দোলন কে পরবর্তী কালে মার্কিন মদতপুষ্ট দুষ্ট শক্তির সাহায্যপুষ্ট বলে  চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দেঙ চক্র দমন করে, তবে দ্বিতীয় মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগুনের আতংক কিন্তু চীনা সংশোধনবাদীদের, দেঙ জিয়াওপিং এর ছানাদের আজও তাড়া  করে বেড়াচ্ছে, এমন তাড়া করছে যে ফি বছরেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কোন না কোন তাবড় নেতা চীনা ইতিহাস ও সমাজের দোহাই দিয়ে জনগণ কে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষা কে খন্ডন করার আহবান জানিয়ে থাকে, মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব কে বিভীষিকা ও চরম নৈরাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ কে, চীনা গণমুক্তি ফৌজের সৈনিকদের  মাও জেদং এর চিন্তাধারার দিকে আকৃষ্ট না হয়ে বরং আত্মোন্নতির পথে চলে পুঁজিবাদের ভাল দোসর হওয়ার জন্যে আবেদন করে থাকে।

বর্তমানে শি জিনপিং এর আমলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব ও চীনা পুঁজিবাদ প্রচন্ড সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে যে চীনা বাজার সমাজতন্ত্রের নামে প্রতিষ্ঠিত এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রাথমিক ভাবে দেঙ জিয়াওপিং আমলাতান্ত্রিক পুঁজির উপর নির্ভরশীল হয়ে গড়ে তুললেও এর পরিচালনার মূল শক্তি ছিল বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির দ্বারা চীনের মাটিতে পশ্চিমী প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা কারখানাগুলো। চীনা পুঁজিবাদীরা মূলতঃ আমলাতান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি এবং এর ফলে চীনা পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিতে বিকশিত হতে পারেনি বরং স্বদেশে বিদেশী পুঁজি কে ব্যবসা করতে দেওয়ার বদলে কমিশন কামিয়ে নিজেদের পুঁজির পাহাড় বৃদ্ধি করে সেই পুঁজি পরবর্তী কালে লগ্নি করে নিজের দেশে ও অন্যের দেশে সস্তায় ব্যাপক উৎপাদনের ফর্মুলা কে কাজে লাগিয়ে মুনাফা কামিয়ে চীনা পুঁজির বিকাশ হয়েছে। তাই চীনের পুঁজিবাদীরা তীব্র ভাবে বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্য ও বিদেশী লগ্নির উপর নির্ভরশীল আর যেহেতু চীনের মাটিতে আগত বিদেশী পুঁজি চীনের শ্রমজীবি জনগণ কে শুধু যে শোষণ করবে তাই নয় বরং তাঁদের দেশের সম্পদ ও রসদ কে লুঠ করে নিয়ে চলে যাবে, তাই এর ফলে চীনা জনগণের মধ্যে যে তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঘৃণার ঝড় উঠতে পারে সেই ঝড় কে ঠেকা দিতে চীনা শাসক শ্রেণী আজ শ্রমিক ও কৃষক ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গড়ে তুলে দেশের প্রান্তে প্রান্তে প্রতি বছর অন্ততঃ পক্ষে সাত থেকে আট হাজার বৃহৎ গণসংগ্রাম কে দমন করে চলেছে। যত বেশি করে চীনের মাটিতে বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি ঘাঁটি গেড়ে বসছে, যত বেশি করে কৃষকেরা জমি হারাচ্ছেন এবং শ্রমিকেরা কাজ ও কাজের অধিকার হারাচ্ছেন তত বেশি চীনের মাটিতে শ্রমিক শ্রেণী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্ধ, চীনা জনগণ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার দ্বন্ধ তীব্র হচ্ছে।  এই দ্বন্ধ যত তীব্র হচ্ছে তত বেশি করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সকল কে নিয়ে চলার, সামগ্রিক উন্নয়নের, জনগণের আশা আকঙ্ক্ষা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একের পর এক প্রস্তাব গ্রহণ করে চলেছে এবং জনগণ কে বুঝিয়ে চলেছে যে চীনে প্রধান দ্বন্ধ এখন অসম ও অপরিপূর্ণ উন্নয়নের সাথে জনগণের চিরন্তন বেড়ে চলা এক উন্নত জীবন যাপনের অভিলাষের দ্বন্ধ। চীনের প্রধান দ্বন্ধ কে উন্নয়নের সাথে জনগণের উচ্চ অভিলাষের দ্বন্ধ বলে আসলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পুঁজিবাদ কে শক্তিশালী করে তোলা ও চীনের উপর চীনা আমলাতান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের একচেটিয়া শাসন কে বলিষ্ঠ করতে চাইছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ভাবে সংকটগ্রস্ত সাম্রাজ্যবাদের বেঁচে থাকার রসদ যোগাচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেইমান সংশোধনবাদী নেতৃত্ব, সাম্রাজ্যবাদের কাছে চীনের মাটি, শ্রম ও সম্পদ কে উপঢৌকন দিয়ে।  চীনের সমাজের প্রধান দ্বন্ধ যে ক্ষমতার আলিন্দে বসা বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে চীনা সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন জনগণের দ্বন্ধ, সে কথা কে আড়াল করতে, মাও জেদং এর চিন্তাধারার  আলোর থেকে জনগণ কে দূরে সরিয়ে রেখে সময়ে অসময়ে একটি দুটি “মার্কসবাদী” তত্ব কথা আওড়ে নিজেদের শাসন কে যথাসম্ভব শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা তীব্র ভাবে করে চলেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব। কিন্তু ওদের সব আশায় গুড়ে বালি হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদের সংকট কাটছে না বরং বেড়ে চলেছে আর অন্যদিকে দেশের মধ্যে চীনা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তীব্র ভাবে বেড়ে চলেছে শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে।   

যেহেতু চীনের বুকে সাম্রাজ্যবাদ ও চীনা পুঁজির শোষণ ও শাসনে অতীষ্ট শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণের সাথে দেশের শাসক শ্রেণী দেশি আমলাতান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্ধ আজ তীব্র আকার ধারণ করে চীনের প্রধান দ্বন্ধ রূপে উঠে আসছে তাই সেই দ্বন্ধ কে চাপা দেওয়ার জন্যে এবং সেই তীব্র দ্বন্ধের থেকে জনগণের দৃষ্টি কে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে আজ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের দরকার হচ্ছে একের পর এক পঁচা গলা অ-মার্কসীয় তত্বের। তাই মাও জেদং আর দেঙ জিয়াওপিং এর পরে আজ শি জিনপিং এর পুঁজিবাদী তত্ব কে তাঁর নামে পার্টির সংবিধানে লেখা হচ্ছে, মাও জেদং এর মতন উচ্চ স্থানে শি জিনপিং এর মতন বামন কে আজ বাঁশ দিয়ে ঠেলে তুলে নিজেদের সঙ্কট থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে চীনের শাসক শ্রেণী। তাই তো আজ দীর্ঘ ৪০ বছর পরে, হুয়া গুওফেং এর পতনের পরে, শি জিনপিং কে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি করে পার্টির চিরকালীন নেতা করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, যা দেখে আবার হিংসায় মুখ গুমরে যাচ্ছে জিয়াং জেমিন ও  হু জিনতাও এর মতন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন হয়ে যাওয়া সাধারণ সম্পাদকদের, যাঁদের মাত্র দুইটি পাঁচ বছরের পর্বের পরেই পার্টির পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে গদি ত্যাগ করতে হয়েছিল। চীনা সমাজে বেড়ে চলা শ্রেণী দ্বন্ধ, ক্ষমতায় আসীন চীনা বুর্জোয়া শ্রেণী ও তার বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী মালিকদের সাথে প্রতিদিন বৃদ্ধি পাওয়া চীনা শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের দ্বন্ধ কে চাপা দিতে তাই আজ শি জিনপিং কে মাও জেদং এর মতন এক জননেতা সাজিয়ে দেখানো হচ্ছে, বলা হচ্ছে শি জিনপিং নাকি জনগণের কাছে উন্নয়নের সুফল ছড়িয়ে দিতে ও চীন কে এক বিশ্ব শক্তিতে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্কটগ্রস্ত নেতারা চীনা সমাজের মধ্যে বেড়ে চলতে থাকা বিদ্রোহের উপাদান কে ঠেকাতে আজ শি জিনপিং কে এক শিখন্ডি বানিয়ে তুলেছে। তবে হাত দিয়ে চাইলেই সূর্যের আলো থেকে পৃথিবীকে ঢেকে দেওয়া যায় না। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও জেদং এর  চিন্তাধারা আসলে সমাজ কে বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে বলেই সেই ব্যাখ্যায় ভুল থাকতে পারে না, আর যেহেতু সংশোধনবাদী শক্তিগুলি সমাজ কে বিকৃত ভাবে ব্যাখ্যা করে তাই ওদের ব্যাখ্যায় এবং প্রয়োগে জনগণের লড়াই কে দীর্ঘদিন চাপা দেওয়া যায় না, বরং জনগণের লড়াই তীব্র হয়ে ওঠে, শ্রেণী সংগ্রাম ফেটে পড়েই। সেই দ্বন্ধ কে ঢাকা দেওয়ার বা শ্রমিক - কৃষক ও মেহনতি জনগণের পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াই কে নিরস্ত করার কোন ক্ষমতাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের নেই, দুনিয়ার কোন সংশোধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নেই।

স্তালিনের মৃত্যুর পরে মাও জেদং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কে উত্তরাধিকারী সূত্রে লাভ করেন, রক্ষা করেন ও এক নতুন স্তরে, মাও জেদং এর চিন্তাধারার স্তরে তাকে উন্নত করেন। মাও জেদং এর চিন্তাধারা হলো এমন এক যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ এগিয়ে চলেছে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে এবং সমাজতন্ত্র এগিয়ে চলেছে বিশ্ব বিজয়ের দিকে। মাও জেদং এর যুগ লেনিনের যুগের চেয়ে, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের চেয়ে,এক গুণগত ভাবে আলাদা যুগ এবং এই যুগে বিপ্লবই প্রধান প্রবণতা এবং সংশোধনবাদ হলো প্রধান বিপদ। মাও জেদং এর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম জাতীয় কংগ্রেসে তাঁর উত্তরাধিকারী রূপে প্রতিষ্ঠিত - লিন বিয়াও মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে এক নতুন যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ রূপে এবং সমগ্র বিশ্বের বিপ্লবের রণাঙ্গনের এক জরুরী রণনৈতিক ও মতাদর্শগত হাতিয়ার রূপে প্রতিষ্ঠিত করে যান। মাও জেদং এর চিন্তাধারা আমাদের শেখায় যে একটি সমাজে বিপ্লবের পরেও, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণী সহজেই ক্ষমতা দখল করতে পারে, এবং তাকে একমাত্র ঠেকানো যেতে পারে শ্রেণী সংগ্রাম কে অগ্রাধিকার দিয়ে, বুর্জোয়া চিন্তাধারার বিরুদ্ধে সর্বহারা চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে এবং সব কিছুর উপর বিপ্লবের স্বার্থ কে অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র কে শক্তিশালী করার লড়াই চালিয়ে। ১৯৬৯ সালে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে মাও জেদং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীদের সাবধান করেছিলেন যে একটি সাংষ্কৃতিক বিপ্লবে নয় বরং চীনের ভিতর পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা রুখতে কম করে দশটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব করা দরকার। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সজাগতার অভাব থেকেই ঝৌ এনলাই ও দেঙ জিয়াওপিং চক্র ষড়যন্ত্র করে লিন বিয়াও কে হত্যা করে, দশম জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে নতুন যুগের থেকে বিচ্ছিন্ন করে লেনিনের যুগেরই একটি ছোট বৃদ্ধি হিসেবে দেখায় ও তারপর ধীরে ধীরে সারা চীন জুড়ে পুঁজিবাদী শক্তিগুলি কে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ এর মধ্যে ক্ষমতার উচ্চ আসনে ফিরিয়ে আনে এবং মাও জেদং এর মৃত্যুর পরেই পুঁজিবাদ কে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। মাও জেদং এর শিক্ষার আলোক থেকে জনগণ কে দূরে সরিয়ে রাখতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাদশ জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় যে চীন একটি প্রাথমিক স্তরের সমাজতান্ত্রিক সমাজ এবং এই সমাজে ক্ষমতাচ্যুত বুর্জোয়া

তবুও, এত কথা লিখে, বলে ও প্রচার করেও কিন্তু দেঙ জিয়াওপিং বা তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা, শি জিনপিং এর মতন তাঁর ভক্তরা কিন্তু জনগণের মধ্যে থেকে মাও জেদং এর চিন্তাধারার আলোটা দূর করতে পারছে না, তাঁরা পারছে না মাও জেদং এর নাম ও চিন্তাধারা কে জনগণ থেকে বিছিন্ন করতে। মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষা কিন্তু জনগণের মধ্যে থেকেই  গেছে। তাঁরা, অর্থাৎ চীনের ব্যাপক শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ  কিন্তু প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে মাও জেদং  এর কাছে শিখেছেন যে একেবারে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেলেও সংগ্রাম করে ক্ষমতায় ফেরা যায় শুধু মাত্র সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক লাইন কে অনুসরণ করে এবং জনগণের সেবা করার লাইন কে গ্রহণ করে। চীনের শ্রমিক ও কৃষকদের এক প্রজন্ম তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম কে মাও এর চিন্তাধারা উত্তরাধিকারী সূত্রে দিয়ে যাচ্ছেন এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কার শিক্ষা ও চেতনার কথাও বলে যাচ্ছেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব যখন বিগত চার দশক ধরে মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে খন্ডন করতে ও মাও জেদং ও লিন বিয়াও এর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষা কে নেতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করে মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ঠিক তখনই চীনের প্রান্তে প্রান্তে বেড়ে চলা মাও এর জনপ্রিয়তা এবং সেই জনপ্রিয়তা কে খন্ডন করতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেইমান নেতৃত্বের নতুন নতুন তত্ব দাঁড় করিয়ে তীব্র সংকট থেকে চীনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কে বাঁচানোর প্রচেষ্টা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে মাও জেদং কতই সঠিক ভাবে সেই ১৯৬০ এর দশকের শেষে বলেছিলেন যে চীনে সমাজতন্ত্র জিতবে না পুঁজিবাদ তা এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ঠিক হবে এবং সেই সংগ্রাম আজ ইতিহাসে সবচেয়ে তীব্র রূপ ধারণ করছে বলেই শি জিনপিং এর মতন এক পুঁজিবাদের পদলেহী বরাহ নন্দন কে শিখন্ডি করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেইমান সংশোধনবাদী নেতৃত্ব কে ও চীনা আমলাতান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ কে আজ নিজেকে ও নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হচ্ছে। বৃহৎ উঁচু মাও জেদং এর মূর্তি গড়ে মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাতে হচ্ছে।  মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে তবুও এই ঘোড়ার বেশে ঘাস খাওয়া গাধার দল কিন্তু পরাস্ত করতে পারছে না, চারদিকে এরা কেমন যেন নগ্ন হয়ে যাচ্ছে, আর তাই জনগণ এদের, এই নব্য সম্রাটদের ঘোড়া থেকে টেনে নামাতে উঠে পড়ে লেগেছেন, নিজেদের শরীরের সমস্ত ক্ষত কে উপেক্ষা করেই। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাও জেদং এর চিন্তাধারা আগামী দিনে  চীনের জনগণ কে বিপ্লবের পথে, বৃহৎ সংগ্রামের পথে নিয়ে আসবেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে মাও জেদং যে মহান শিক্ষা চীনা জনগণের ও বিশ্বের জনগণের জন্যে রেখে গেছেন সেই অস্ত্র কে ব্যবহার করে চীনের জনগণ, বিশ্বের বিপ্লবীদের সাথে আন্তর্জাতিক বিপ্লবী জোট গড়ে তুলে চীনের বুকে সমাজতন্ত্রের, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের পতাকা কে আবার বলিষ্ট ভাবে প্রতিষ্ঠা করবেনই। এটাই ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম এবং ইতিহাসের চাকা প্রগতির চাকা, তা ক্রমশই সামনে এগিয়ে যায়, প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদের ধ্বজ্জাধারী সংশোধনবাদীরা বেশিদিন সেই চাকাকে পিছনে ঘোরাবার প্রচেষ্টা চালাতে পারবে না, বরং সেই চাকার নিচেই ইতিহাসের নিয়মে তাঁদের পিষ্ট হয়ে যেতেই হবে এক নতুন শোষণহীন সমাজের স্বার্থে।  চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেইমান সংশোধনবাদী পুঁজিবাদী নেতারা সাবধান হয়ে যাও, জনগণ জাগছেন, মাও জেদং তাঁদের সূর্যের মতন আলো দেখছেন তাঁর দুর্জয় চিন্তাধারার মাধ্যমে।  


মোদী রাজত্বে ক্রোনি কর্পোরেট শাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ হোক বিকল্প গণমাধ্যম

বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

নরেন্দ্র মোদী ও গৌতম আদানি ক্রোনি পুঁজিবাদ


বেশ কিছুদিন ধরে  ভারতের হিন্দি ও ইংরাজী ভাষার টিভি চ্যানেলগুলো ও পত্রপত্রিকাগুলো বেশ ঘটা করে গুরমিত রাম রহিম ইনসান নামক ভন্ড বাবাজির তথাকথিত পালিতা কন্যা এবং আদতে গুপ্ত গার্লফ্রেন্ড হানিপ্রীত ইনসান কে নিয়ে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী সংবাদ মাধ্যম হয় শারদোৎসব আর না হয় মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচারে ব্যস্ত। কেউ নরেন্দ্র মোদী কে মেপে মেপে সমালোচনা করছে তো কেউ বলছে নরেন্দ্র মোদীর উচিত আরও জোরে তাঁর তথাকথিত সংস্কারের রথ চালানো।
এরই মধ্যে  একটা ভীষণ চাঞ্চল্যজনক ঘটনা ঘটে গেল, যার নৈপথ্যে কিন্তু আবার একটি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় পুঁজির মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যম। অস্ট্রেলিয়ার সরকারি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যম এবিসি’র ফোর্থ কর্নার অনুষ্ঠানে সম্প্রতি প্রসারিত হলো একটি অনবদ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দ্বারা উত্তোলিত তথ্যে পরিপূর্ণ তথ্যচিত্র, যাঁর মূল বিষয় ছিল ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি গৌতম আদানি’র দুর্নীতিপূর্ণ ব্যবসা এবং আদানি গোষ্ঠীর দ্বারা দেশে বিদেশে কালো টাকার চোরাকারবার। উল্লেখনীয় ব্যাপার হলো যে নরেন্দ্র মোদী, তাঁর পার্টি বিজেপি ও তার ভাবাদর্শের উৎস, আরএসএস, কিন্তু আদানি গোষ্ঠীর নিমক খেয়ে তার সেবা করে এবং সমস্ত রকম প্রচলিত আইনের হাত থেকে আদানি গোষ্ঠী’র স্বার্থ কে রক্ষা করে। এহেন মোদী-শাসিত ভারতবর্ষের বুকে আদানি গোষ্ঠীর সমালোচনা করা বা নিন্দা করা বেসরকারি ভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হঠাৎ সমালোচক কে দিনের আলোয় আততায়ীর হাতে গুলি খেতে হতে পারে বা হঠাৎ আদানির উকিল কোটি কোটি টাকার মানহানির মামলা করার ভয় দেখিয়ে চিঠি পাঠাতে পারে সমালোচনাকারী সংবাদ মাধ্যমের দফতরে। ঠিক যেমন প্রখ্যাত পত্রিকা ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলি কে ধমকানো হয়, যার ফলে চাকরি হারান আদানি গোষ্ঠীর নানা দুর্নীতির তদন্তকারী ও কট্টর সমালোচক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা। এবিসি ভারতে অবস্থিত নয় এবং ভারতের থেকে তাঁদের আয় প্রায় নগন্য ফলে তাঁদের পক্ষে যে ভাবে সাহসিকতার সাথে গৌতম আদানি ও তাঁর আপাদমস্তক দুর্নীতি ও কালো কারবারে ডুবে থাকা আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে একটি দুর্দান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা সম্ভব হলো, আদানির বিজ্ঞাপনের থেকে টাকা আয় করা এবং গৌতম আদানির জুতো চাটা দেশি দালাল সংবাদ মাধ্যমগুলোর সেই সাধ্য হতো না।

আদানি গোষ্ঠীর উৎপত্তি গৌতম আদানি ও তাঁর সিঙ্গাপুর স্থিত ভাইয়ের হাত ধরে। আম্বানি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানির মতনই গৌতম আদানি নিরামিষাশী এক গুজরাটি বেনিয়া, যাঁর উত্থান শুরু হয় গুজরাটে বিজেপি শাসন শুরুর সাথে সাথে। কলেজ-ছুট এক বেনিয়া গুজরাটি তাঁর শেষ সম্বল দিয়ে ফাটকা খেলা শুরু করে হিরের ব্যবসায় ও পরবর্তী কালে নয়া-উদার অর্থনৈতিক হাওয়ায় ভেসে প্রবেশ করে গুজরাটের ক্রোনি পুঁজিবাদের শিবিরে। ক্রোনি পুঁজিবাদ আসলে মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের দেশ ভারতের একটি বহুল প্রচলিত ব্যবস্থা যার মূল হলো শাসক রাজনৈতিক দলগুলি ও প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র কে পকেটস্থ করে নিজের ব্যবসা কে প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি লাভজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা। গৌতম আদানির বন্দর, তাপ বিদ্যুৎ, খনিজ সম্পদ উত্তোলন, বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসাগুলো বিগত দুই দশকে তীব্র গতিতে বেড়ে দেশের প্রথম সারিতে চলে আসে দুইটি প্রধান কারণে। প্রথমতঃ গৌতম আদানি ঘুষ দিতে কার্পণ্য করেনি আর দ্বিতীয়তঃ নরেন্দ্র মোদী’র মতন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর অকৃত্রিম অনুচর ও তল্পিবাহক হয়ে ওঠে। মোদীর শাসনকালে, গৌতম আদানির ব্যবসা যেমন ফুলে ফেঁপে ওঠে, তেমনি সমস্ত রকমের আইন কে জুতোয় পিষে সমগ্র গুজরাটে বিশাল আয়তনের জমি দখল করা আদানির পক্ষে জলভাত হয়ে যায়। আদানি গোষ্ঠী যত না তাঁদের বাণিজ্যের দ্বারা অর্থ আয় করেছে তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি করেছে দেশের কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করে। দেশের যে দালাল সংবাদ মাধ্যমগুলো নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট বাতিলের স্বিদ্ধান্তে “কালো টাকা ধ্বংস হলো” বলে বিশ্রী রবে শিয়াল-চিৎকার জুড়েছিল তাদের কেউই কিন্তু আদানির দ্বারা কর ফাঁকি দিয়ে কেইম্যান আইল্যান্ড বা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড এর মতন কর-হীন দেশে নিজেদের জাল কোম্পানির একাউন্টে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা নিয়ে কিন্তু টু শব্দটি করেনি।

ভারতের মতন দেশে গৌতম আদানির আদানি গোষ্ঠী বা ধীরুভাই আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠী (এখন দুই ভাগে বিভক্ত) ইত্যাদির পক্ষে বৃহৎ পুঁজির কারবারি হয়ে ওঠার পিছনে লুকিয়ে থাকে চূড়ান্ত দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর (সকল রঙের) চরম কর্পোরেট দালালি। শুধু মোটা অঙ্কের ঘুষ রাজনৈতিক পার্টিগুলিকে ও আমলাতন্ত্র কে দিয়ে এই ক্রোনি পুঁজিবাদীরা শুধু যে নিজেদের জন্যে সমস্ত আইন শিথিল করিয়ে ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধি এনেছে তাই নয়, এদের বিরামহীন ব্যবসায়িক অভিযানে, বড় তাপ বিদ্যুৎ, পেট্রো-কেমিকেল বা বন্দরের ব্যবসায় দেশের পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও জনগণের, গরিব খেটে খাওয়া জনগণের ব্যাপক আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ঘুষে কুকুর কেও বাপ বলায়। তাই হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েও আদানি গোষ্ঠী ভারতে কলার তুলে ব্যবসা করতে পারে কারণ আরএসএস ও সমগ্র হিন্দুত্ব শিবির এই নিরামিষাশী গুজরাটি মুৎসুদ্দি বেনিয়ার স্বার্থ কে রক্ষা করার পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে। আজ যে গুজরাটের ভুঁয়ো উন্নয়নের ছেলে ভোলানো গল্প শুনিয়ে নরেন্দ্র মোদী কে হিরো সাজানোর চেষ্টা চালায় ভারতের কর্পোরেট টাকায় চলা মূলধারার সংবাদ মাধ্যম, সেই গুজরাটের সিংহভাগ বন্দর ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কিন্তু আদানির, আর আদানি টাকা তুলেছে শেয়ার মার্কেট থেকে, সেই শেয়ার মার্কেটে টাকা এসেছে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির পুতুল লগ্নিকারী বা এফআইআই’র মাধ্যমে এবং এই সকল প্রকল্পগুলো গড়ে উঠেছে পরিবেশ কে ধ্বংস করে এবং গরিব জনগণের জীবন ও জীবিকা কে লাথি মেরে। এক একটা জায়গায় আদানি গোষ্ঠী ব্যবসা করার ফলে সৃষ্ট হয়েছে অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক সঙ্কট। এবিসির অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা গেল যে কি ভাবে বিজেপি’র সমর্থনে বলীয়ান হয়ে সমস্ত রকমের পরিবেশ সম্পর্কিত আইন কে কাঁচকলা দেখিয়ে এবং বিভিন্ন ধরণের সামাজিক প্রতিরক্ষার আইন উল্লঙ্ঘন করে গৌতম আদানি তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। দেখা গেল গোয়ার ভাস্কো দা গামায় কয়লা উত্তোলনের নামে কি ভাবে পরিবেশ ও জনসাধারণের ক্ষতি করেছে আদানি গোষ্ঠী, দেখা গেলো কর্ণাটকে কি ভাবে লাভের টাকা চুষে নিয়ে একটি এলাকার পরিবেশ ও অর্থনীতি কে বিশ বাঁও পানিতে ফেলে উধাও হয়ে গেল আদানি গোষ্ঠী, দেখানো হলো কি ভাবে গৌতম আদানির পাহারাদার সেজে ক্রাইম ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসাররা নেড়ির মতন তেড়ে এলো অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকদের গুজরাট থেকে তাড়িয়ে দিতে, রীতিমত খুনের হুমকি দিয়ে। যে রাজ্যের প্রাক্তন গৃহমন্ত্রী দলীয় কোন্দলে খুন হয়ে যান আর অন্য এক প্রাক্তন গৃহমন্ত্রী একের পর এক ভুঁয়ো এনকাউন্টারে মুসলমানদের নিজ স্বার্থে ও বিজেপিকে ভোটে জেতানোর স্বার্থে খুন করিয়েও আইন কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহাল তবিয়তে দেশের শাসক দলের প্রধান হয়ে জনগণের করের টাকায় সরকারি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করে, সেই রাজ্যে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের লোকেদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যে আদানি কে বাঁচাতে হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তা বলার জন্যে বিশেষ কোন গবেষণা করার দরকার পরে না। সাহেবের রাজ্যে আদানি’র সাম্রাজ্য অক্ষত রাখতে সদা প্রস্তুত হিন্দুত্ববাদী শিবির ও তার রাষ্ট্র যন্ত্র।

অস্ট্রেলিয়া থেকে এবিসি হঠাৎ এমনি এমনি আদানি গোষ্ঠীর কালো ইতিহাস কে খুঁড়ে বের করতে আসেনি, বরং অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সমস্ত বড় রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় পুঁজিপতিদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে গৌতম আদানি যে বৃহৎ এলাকা জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় কয়লা খনি গড়ে কয়লা উত্তোলন করতে চায় এবং সমস্ত অঞ্চলের ভূ গর্ভস্থ পানি চুষে এলাকাটি কে মানুষ, পশু পাখির বাসের অযোগ্য মরুভূমিতে পরিণত করতে চায় তার বিরুদ্ধে সমগ্র অস্ট্রেলিয়া জুড়ে গড়ে উঠেছে তীব্র গণআন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের চাপে পড়ে (মনে রাখতে হবে অস্ট্রেলিয়া সাদা চামড়ার মানুষের দেশ, কালো চামড়ার মানুষের নয়) বড় বড় ব্যাঙ্কগুলি আদানির প্রকল্পে অর্থ লগ্নি করার থেকে পিছু হঠে এবং এর ফলে অস্ট্রেলিয়া’র আদানি দালাল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভীষণ মুশকিলে পড়ে। কারণ তাঁরা এর মধ্যেই কোটি কোটি ডলার উপঢৌকন পেয়েছে গৌতম আদানির থেকে, সেই জন্যে তাঁরা খনন কার্য শুরু হলে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে বলে জনগণের করের টাকা দিয়ে আদানির জন্যে পরিকাঠামো বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে, এটা জেনেও যে তাঁদের এই কর্মকান্ডে অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশ ও জনগণের জীবন ও জীবিকার অভূতপূর্ব ও অপূরণীয় ক্ষতি হবে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ওয়ানগান ও জাগলিংও জনগণ এই খনির বিরুদ্ধে তাঁদের মত দিয়েছেন এবং জমি দিতে অস্বীকার করেছেন, তবে আদানির থেকে কোটি কোটি ডলার ঘুষ খাওয়া রাজনৈতিক নেতারা সেই জমি কেড়ে নিতে আজ বদ্ধপরিকর। #Stop Adani নামক এই সংগ্রামের সাথী হয়ে জনগণের শত্রু আদানি গোষ্ঠীর স্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপক মানুষের সামনে তুলে ধরতে এবিসি কর্পোরেশনের মতন রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে চলা সংবাদ সংস্থা আদানির বিরুদ্ধে কোমর কষে নেমেছে এবং এক তথ্যসম্পূর্ণ রিপোর্ট জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে চলা এই সংবাদ মাধ্যমের এই সমালোচনামূলক রিপোর্টিং সম্ভব হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার শাসক শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্ধের কারণেই। এক মিনিটের জন্যে ভাবুন পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ ধ্বংসকারী ভাঙ্গর প্রকল্প, কৃষি-বিরোধী ন্যানো কারখানা বা নন্দীগ্রামের অদূরে সালেম গোষ্ঠীর প্রকল্পের বিরুদ্ধে কি আনন্দবাজার গোষ্ঠী (যারা একদিকে মোদী বিরোধিতার সুর চড়ায় আনন্দবাজার পত্রিকা বা দি টেলিগ্রাফে আর অন্যদিকে কাঞ্চন গুপ্ত বা জয়ন্ত ঘোষালের মতন হিন্দুত্বের ধ্বজ্জাধারী ইজরায়েলি দালালদের চাকরিতে রাখে) কোনদিন মুখ খুলতে পারতো? আরে আনন্দবাজার বা অন্য বাজারি কাগজ তো দূরের কথা আমাদের সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তির ২০০৭-০৮ এর সংখ্যাগুলো যদি পড়েন তাহলে দেখবেন মনে হবে টাটা বা সালেমের মুখপত্র পড়ছেন। শুধু বিজেপির বিরুদ্ধে কামান দেগে তেমন লাভ হবে না, কারণ বিজেপি বর্তমানে যা করছে তার পিছনে যদি সিপিএম বা কংগ্রেসের মতন দলগুলোর সুপ্ত সমর্থন না থাকতো তাহলে ভারতবর্ষ কর্পোরেট লুঠের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতে পারতো না। ভারতের রাজনীতি ও সংবাদ মাধ্যমের দুনিয়ার তাবড় সব খেলোয়াড় বর্তমানে আদানি আর আম্বানিদের হয়ে খেপ খেলছে এবং তাই আপনি এদের আক্রমণের নিশানায় কখনো কর্পোরেট পুঁজি কে পড়তে দেখবেন না, বরং এদের কাছে শুনবেন আদানি বা আম্বানিদের স্তুতি, তাঁদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি  (সিএসআর) প্রকল্পগুলি কি ভাবে সমাজের উন্নয়ন (বা সমাজের উন্নয়নের নামে কর ফাঁকি দেওয়ার ভাঁওতাবাজি) করছে, তার ফিরিস্তি। স্বাধীন দেশের বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যম ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশের বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে এই হলো ফারাক।

ভারতের সমস্যার দুটো বড় দিক হলো, এক, এই দেশে কখনো পুঁজিবাদী বিপ্লব সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসন কে উৎখাত করেনি, এবং দুই, এই দেশের বৃহৎ পুঁজির মালিকদের কেউই জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি নন, বরং মুৎসুদ্দি বেনিয়া সম্প্রদায়ের লোক যাঁরা বিদেশী পুঁজির কাছে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা রেখেছে নিজেদের, কখনো পুঁজির জন্যে তো কখনো প্রযুক্তির জন্যে। বিদেশী পুঁজি কে পরাস্ত করে নিজের শক্তিতে একটি শক্তিশালী বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তি হয়ে ওঠার কোন প্রবণতা ভারতের পুঁজিপতিরা দেখায়নি, বরং উদার অর্থনীতির সাহায্যে, বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ও বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নিকারীদের অর্থে বলীয়ান হয়ে নিজেদের কর্পোরেট সংস্থাগুলোর বিদেশে সম্প্রসারণ ঘটানো শুরু করে টাটা-আম্বানি-আদানি জাতীয় সকল মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিকেরা। এরা চরম ভাবে বিদেশী পুঁজির দালাল এবং এরা কোন ভাবেই বিশ্বের কোথাও নিজেদের অস্তিত্ব বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সাহায্য বাদে টিকিয়ে রাখতে পারবে না, এবং মূলত বেনিয়া পুঁজির মালিক এই সংস্থাগুলো ভারতকে শিল্পে স্বনির্ভর করে তুলতে চিরকালই অপারগ থাকবে। ভারতের এই বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিকদের ঢাল করে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকেরা প্রায় দেশের সকল ক্ষেত্রে বিপুল পরিমানের অর্থ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লগ্নি করেছে এবং কোটি কোটি ডলার প্রতিদিন দেশের মাটির থেকে শুষে নিংড়ে নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। আদানি আর আম্বানির মতন দালাল পুঁজির মালিকেরা নিজেদের কমিশন কামিয়ে অট্টালিকা বানিয়ে নিজেদের ধন বৃদ্ধি জাহির করছে এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের একটি সামান্য আলপিন থেকে সিংহাসনে আসীন মহারাজ কে কিনে পকেটে ভরে রেখেছে। যেহেতু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল থেকে ভারতের সংবাদ মাধ্যমের উপর একচেটিয়া মালিকানা কায়েম করেছে এই মুৎসুদ্দি বেনিয়া পুঁজিপতিরা এবং যেহেতু এদের পুঁজি ও রাষ্ট্রের সাথে দহরম মহরমের ফলে এরা ছোট এবং মাঝারি সংবাদ মাধ্যমগুলো কে গ্রাস করে ফেলে, তাই এই দেশে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতার লেশমাত্র উপস্থিত, এই কল্পনা করাও ঘোর অন্যায় হবে। বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি আজ আম্বানি বা আদানিদের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে ভারতের শ্রম, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুঠ করছে এবং তার সাথে সাথে এই দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশ কে কিনে নিয়ে নিজেদের কর্মকান্ড কে সাধুবাদ দিয়ে জনগণ কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই আম্বানি-আদানিরা আবার বিশাল টাকা দিয়ে, ব্যক্তিগত বিমান দিয়ে, জমি আর শেয়ার দিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও আরএসএস এর মতন ঘৃণ্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের নিজেদের দারোয়ান হিসেবে পুষছে, তাদের দিয়ে দেশের কোনায় কোনায় জনগণের ঐক্য ভাঙতে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার আগুন জ্বালাচ্ছে।  এই চরম ঘৃণ্য ব্যবস্থার স্বরূপটি জনগণের চোখের সামনে তুলে ধরতে আমাদের দেশের তথাকথিত স্বাধীন মিডিয়া অপারগ, কারণ বিজ্ঞাপনের বড় বালাই। তাই তারা মেতে আছে হানিপ্রীত সিংহে ও যৌবন ধরে রাখার টিপস দেওয়ায়।  

এখন আর খবরের উপর ভিত্তি করে সংবাদপত্র বিক্রি হয় না, বরং কাগজ ছাপার খরচ থেকে লাভের টাকা সবটাই আসে শুধু মাত্র বিজ্ঞাপন থেকে অর্জিত অর্থ থেকে। সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলগুলো এখন শুধু বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে এবং তার সাথে বিজ্ঞাপনদাতার স্বার্থ বিঘ্নিত হয়না এমন নিরীহ কাঁচি চালানো খবর বিনামূল্যে পাঠক বা দর্শকদের কাছে পরিবেশিত করে। তাই এই মূলধারার কর্পোরেট-মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলি ভারতের মানুষের কোন কল্যাণে আর আসতে পারবে না, ফলে আজ জনগণের কাছে সত্য সংবাদ ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারে শুধু মাত্র গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বিকল্প সংবাদ মাধ্যমগুলি, যেগুলি জনগণের চাঁদার টাকায় বা ছোট ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপনের টাকায় নিজেদের প্রকাশনা চালায়। বিকল্প গণমাধ্যমআজ ভারতের দরকার, এই কঠিন পরিস্থিতিতে জনগণের একটি বিশেষ প্রয়োজন। শুধু আদানির মতন দেশের অর্থ বিদেশে পাচারকারী মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের বিরুদ্ধেই নয়, বরং সামগ্রিক ভাবে ভারতের সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের ঘৃণ্য শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের অংশীদার হিসেবে আজ বিকল্প মিডিয়ার প্রয়োজন প্রচন্ড। সকল ধরণের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল জনগণ কে ঐক্যবদ্ধ করে, বিদেশী পুঁজি ও দেশি মুৎসুদ্দি পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক বিরাট দেশপ্রেমী প্রচার মাধ্যম গড়ে তোলার জন্যে আজ সমস্ত ফ্যাসিবিরোধী ও গণতান্ত্রিক সাংবাদিকদের আজ একসাথে আসতে হবে, শুধু পয়সা রোজগারের আকঙ্ক্ষা থেকে নয়, বরং দেশের জনগণের সামনে দেশের আসল শত্রু, আদানি-আম্বানি-টাটা ইত্যাদির, মোদী আর আরএসএস এর মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্যে। আজ সময় হয়েছে আমাদের কলমগুলিকে তলোয়ারের ন্যায় ব্যবহার করার, মূলধারার কর্পোরেট-মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বিকল্প গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার এবং এই সংগ্রামে আমরা যদি পিছিয়ে পড়ি, তাহলে ইতিহাস আমাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না।
 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে