শ্রীশ্রী রবিশংকর থেকে বিজয় মালয়া: টাকা আর রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে ভারতের Art of Living থেকে Art of Leaving

শনিবার, মার্চ ১২, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

Art of living এবং art of leaving এর যাত্রা পথের সাথে ভালোই পরিচয় হলো এই সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে। শ্রী শ্রী রবিশংকর যিনি স্বঘোষিত একজন দেব পুরুষ, তাঁর হঠাৎ শখ হলো যে দিল্লির মৃতপ্রায় যমুনা নদীর পাড়ে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাবেশ করে 'বিশ্ব সাংস্কৃতিক উৎসব' করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ, অভুক্ত কাঙাল ভারতবর্ষে কোটি কোটি টাকা খরচা করে শুধু যমুনা কে আরও মৃতপ্রায় করতে শুধু বিশাল মঞ্চই প্রস্তুত হলো না, দেশ বিদেশ থেকে আসা ভক্তকুলের স্বার্থে দেশের মিলিটারি নামিয়ে সেতু গড়া হলো। যে মিলিটারির জনগণের উপর করা অত্যাচার আর ধর্ষণের বিরুদ্ধে বলার জন্যে কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য সহ সমস্ত জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নেড়ির মতন খেঁকিয়ে উঠেছিল ভারতের স্বঘোষিত দেশপ্রেমী বাহিনী, তাদের আজ সেই মিলিটারি বাহিনীর এক কোটিপতি সাধু বাবার হয়ে বিনামূল্যে পরিশ্রম করা হয়তো দেব সেবা মনে হয়ে থাকতে পারে। আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো যে অরবিন্দ কেজরিবাল কথায় কথায় বিজেপির বিরুদ্ধে ভীষণ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তিনি আচমকা ভেজা বেড়ালের মতন লেজ গুটিয়ে সটান শ্রীশ্রী বাবার পদযুগল ছুঁতে বিজেপি ও আরএসএস এর কর্তাদের সাথে, এমনকি নরেন্দ্র মোদীর সাথে, হাসতে হাসতে ছুটে চলেছেন! ভারতবর্ষের এক চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ভন্ডের দিল্লির পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে কিছু না বলে অরবিন্দ কেজরিবাল ও নরেন্দ্র মোদী প্রমাণ করলেন যে রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণী কি ভাবে এই সব ধর্মের নামে ব্যবসা চালানো কে ধুপ ধুনো দিয়ে পুজো করছে। 

 শ্রীশ্রী রবিশংকর থেকে বিজয় মালয়া: টাকা আর রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে ভারতের  Art of Living থেকে Art of Leaving
"Photo Credit: --pradeep--via Compfight
দিল্লির যমুনা নদী, যা হরিয়ানা থেকে নদী হয়ে ঢুকে নর্দমা হিসেবে নিষ্কাশিত হয়, তা আইটিও সেতুর কাছে এসে বিকট দুর্গন্ধময় এক নোংরা নালার চেয়ে বেশি কিছু থাকে না। এই যমুনার পাড়গুলোয় একসময়ে কমনওয়েলথ গেমস ও যমুনা ব্যাংক মেট্রো স্টেশন তৈরি হওয়ার পরে নদীর ফ্লডপ্লেন জাতীয় বস্তু ইতিহাস হয়ে গেছে। যেটুকু গাছপালা রয়েছে তা এবার শ্রীশ্রী বাবার নর্তন কীর্তনের চাপে মায়ের ভোগে যাওয়ার পরিস্থিতি উত্পন্ন হয়েছে। ভন্ড বাবা শ্রীশ্রী রবিশংকর এ কথা মানতে নারাজ। তাঁর দৈব শক্তি মারফত তিনি জেনেছেন যে কোনও গাছপালা বা প্রকৃতির কোনো ক্ষতি তাঁর ভক্তকুল করেনি, বরং দেশের স্বার্থে অনুষ্ঠিত এই মহান বিশ্ব সাংস্কৃতিক উৎসবে আগত মানুষের ভিড়ের কথা ভেবে কিছু গাছপালার ডাল আর পাতা ছাঁটা হয়েছে মাত্র। এর মধ্যেই আবার ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনাল শ্রীশ্রী বাবার এই কর্মকাণ্ডের উপর পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা ঘোষণা করেছে। যে জরিমানা দেবেন না বরং জেল যাবেন বলে ঘোষণা করে হঠাৎ  শ্রীশ্রী বাবা  ডিগবাজি খেয়ে ঘোষণা করলেন যে তিনি কিস্তিতে টাকা শোধ করবেন। হাঁসির কথা যে দেশ-বিদেশের সকল ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূদের গুরু, বড় বড় পুঁজিপতি - কর্পোরেট গোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক গুরু, হিন্দুত্ববাদী - ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তিগুলির রাজনৈতিক চেহারা এই শ্রীশ্রী বাবার পকেটে নস্যি মাত্র পাঁচ কোটি টাকা নেই। হয়তো তিনি এখনো ঠিক করে সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের ভক্ত করে তুলতে পারেননি।

হ্যাঁ, সরকারি ব্যাংকগুলো আজ দেশি-বিদেশী কর্পোরেট সংস্থাগুলোর টাকা যোগানকারী সংস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই সরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই সেই ২০১২ সালে দেশের অন্যতম পুঁজিপতি বিজয় মালয়ার রুগ্ন হয়ে পড়া কিংফিশার এয়ারলাইন্স কে চাঙ্গা করতে সাধারণ মানুষের টাকা ওই বিলাসবহুল জীবন যাপনে ব্যস্ত,.সুন্দরী তরুণীদের কোমরে হাত জড়িয়ে ঘুরতে ব্যস্ত, দেশপ্রেমিক মালয়ার সংস্থায় ঢালে কংগ্রেস সরকার।কথা ছিল বিজয় মালয়া কিংফিশার এয়ারলাইন্স এর কর্মীদের বকেয়া বেতন মেটাবেন এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর টাকা মেটাবেন। সেইসময়ে জনগণের টাকায় এক হাঙর পুঁজিপতির স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কেন প্রশ্ন তুলে অনেক প্রতিবাদ হলেও তলে তলে সাঁট গাঁটের দৌলতে মালয়া প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে পেয়ে যান। তারপর সবই ইতিহাস, বকেয়া বেতন থাকলো বকেয়া, বরং কিছু রাজনৈতিক শক্তিকে একজোট করে রাজ্যসভার সাংসদ হন মালয়া, যেমনটি সাংসদ ছিলেন আম্বানী ও জিন্দল, ঠিক সেই রকম। শোনা যায় মার্চের প্রথম সপ্তাহে ব্যাগপত্র গুছিয়ে দেশ ছেড়ে পাখি বহুদুর উড়ে যায় এবং ৯০০০ কোটি টাকাও সেই সত্যজিত রায়ের সোনার কেল্লার মতন উবে গেল।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি রিপোর্ট অনুসারে ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ১১৪,০০০ কোটি টাকার ঋণ সরকারি ব্যাংকগুলোর খাতায় মওকুফ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো অবশ্য জানায়নি যে কত শতাংশ ঋণ ব্যবসায়িক আর কত শতাংশ ব্যক্তিগত, আর এটাও জানা যায়নি যে ব্যক্তিগত ঋণের কতটা কোটিপতি লোকেদের আর কতটা সাধারণ মানুষের। তবে একটা দৈব সত্য জানা গেছে যে যদিও ভারতের অন্নদাতা কৃষকদের মধ্যে অধিকাংশই আজও সরকারী ব্যাঙ্কগুলির থেকে ঋণ পান না এবং এর ফলে তাঁদের নির্ভর করতে হয় গ্রামের মহাজনদের উপর, যারা সুদের পাহাড় চাপিয়ে কৃষকদের জীবনকে বিষিয়ে তোলে, এমনকি যদিও বা কখনো কোনো সরকারী ব্যাঙ্ক শাসক শ্রেণীর স্বার্থে কৃষকদের ঋণ দেয় তাহলে সেই ঋণের টাকা আদায় করতে তারা কৃষকদের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই দুই ঋণদাতার চাপে দেশের কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে চলেছে ফি বছর। কিন্তু বড় বড় পুঁজিপতি, ধনী ব্যবসায়ী, দেশী - বিদেশী পুঁজির দ্বারা চালিত বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশন গুলি কোটি কোটি টাকা বকেয়া ঋণ ও সুদ মেরে চুপ চাপ দেশ থেকে সাধারণ মানুষের টাকা গায়েব করে নিজেদের লাভের পাহাড় উঁচু করে চলেছে।

নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দৌড়ে এই সমস্ত বড় বড় কর্পোরেশনগুলি হলো দেশের প্রভু। সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা এদের নুন খান এবং বিশ্বস্ত দারোয়ানের মতন এই বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের দেশী সহযোগী দালাল পুঁজিপতিদের স্বার্থ কে রক্ষা করে চলছে। সমস্ত সরকার, তা বিজেপি বা কংগ্রেসের হোক অথবা সিপিএম বা তৃণমূলের, তারা সকলেই আদা জল খেয়ে দেশের মাটি, জল, জঙ্গল, পাহাড় ও খনিজ সম্পদ আজ এই বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির কাছে পাইকারী দরে বিক্রি করে চলেছে। দেশের বৃহৎ এক অঞ্চল থেকে আদিবাসী জনগণ কে, কৃষকদের উচ্ছেদ করে পরিবেশ ধ্বংসকারী বিদেশী পুঁজির শিল্প গড়ার প্রক্রিয়া কে ত্বরান্বিত করেছে। যেহেতু আজ ভারতের অভ্যন্তরে এক বিশাল অংশে জনগণ, বিশেষ করে দেশের মুলনিবাসী ও আদিবাসী সমাজ আজ এই ভাবে দেশ বিক্রি ও কর্পোরেট শক্তির তোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, তাই আজ দেশের সরকার জনগণের করের টাকায় বিদেশী বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে দেশের আদিবাসী সমাজের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদে সোচ্চার কৃষকদের বিরুদ্ধে, এবং দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে এক খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক নাম "অপারেশন গ্রীন হান্ট" হলেও এর আসল উদ্দেশ্য হলো "রেড হান্ট" বা কমিউনিস্ট বিদ্রোহ কে খতম করা। ভারতের সেনাবাহিনী যে perception ম্যানেজমেন্ট এর doctrine তৈরি করেছে তার লক্ষ্য হচ্ছে দেশের জনগণের একটা বড় অংশের উপলব্ধি ও মতবাদের উপর প্রভাব ফেলা এবং শাসক শ্রেণীর স্বার্থ কে প্রতিষ্ঠা করা যাতে করে যুদ্ধে kinetic force বা মারণাস্ত্রের প্রয়োগ কম করতে হয়। এই doctrine দেশের সেনাবাহিনী এমনি এমনি তৈরি করেনি কারণ এই রকম doctrine বানানো কোনো অফিসে বসা লেখকের কাজ নয় বরং দেশের আর্থ-সামাজিক ও সামরিক সমস্যাগুলিকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে দেশের সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের পাকা মাথারা এই doctrine বানিয়েছেন শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের সুরক্ষার স্বার্থে। একটা বড় স্তরের perception ম্যানেজমেন্ট বলতে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে যে দেশের শহরে বাস করা কয়েক কোটি মানুষের উপর শাসক শ্রেণীর প্রভাব বিস্তার করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে যাতে তাঁদের কে, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের, দেশের প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের থেকে  সরিয়ে রাখা যায়, এবং conflict zone  এর বাইরে থাকা জনতাকে দেশের ভিতরে চলতে থাকা লুটপাটের যুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখা যায়। এই অজ্ঞ করে রাখার জন্যে কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা জনতার মতামতের উপর প্রভাব ফেলা ও তাঁদের মতামতকে শাসক শ্রেণীর স্বার্থে চালাবার জন্যে প্রচার চালানোর কাজ চালানো হচ্ছে, এর সাথেই চলছে বৃহৎ আকারে দেশের জনগণের উপর উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ কে প্রসার করার স্বার্থে হিন্দির সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।

বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তার দেশী কর্পোরেট দালালদের বিরুদ্ধে শুধুই প্রচার মাধ্যম আর সিনেমা থিয়েটার উপন্যাসের প্রচারেই যে কাজ হবে না সে কথা ভারতের শাসক শ্রেণী খুব ভালো করেই জানে এবং তাই ওদের দরকার হয় আধ্যাত্মিক শক্তির, যারা উপাসনা ও দৈব শক্তির নামে দেশের জনগণ কে বিশেষ করে conflict zone  এর বাইরে থাকা মানুষদের দেশের ভিতর চলতে থাকা লড়াইয়ের থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে, যাতে conflict zone  এর বাইরে থাকা জনগণের বড় অংশের সমর্থন শাসক শ্রেণী নিজের পক্ষে জিতে নিতে পারে। এই জন্যেই আজ শাসকশ্রেণীর দরকার শ্রীশ্রী রবিশংকর থেকে শুরু করে রামদেব, আশারাম বাপু, নিত্যানন্দ থেকে জাকির নায়েক ইত্যাদীর, যাতে এদের মাধ্যমে মানুষকে ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চিন্তার জগতে আটকে রাখা যায় এবং দেশের সম্পদ ও জমি বেহায়ার মতন বিদেশী কর্পোরেটদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া যায়।

বিশ্বজুড়ে এক বৃহৎ সংকটের ফলে শ্বাস কষ্টে ভোগা বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নিপুঁজির আজ ভারতের মতন নয়া উপনিবেশই বাঁচিয়ে রাখার অক্সিজেন যোগান দিতে পারে আর তাই ভারতের উপর রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক প্রভুত্বই নয় আজ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির দরকার ভারতের সামন্তবাদী ধ্যানধারণার উপর গড়ে ওঠা ধর্ম ও সামাজিক কুসংস্কারগুলি কে তীব্র করে জনগণের রগে রগে ঢুকিয়ে মানুষকে ধর্মভীরু এবং বিদ্রোহ - বিপ্লব বিমুখ করে তোলা যাতে এই দেশের লুটের রাস্তা সুগম হয়।

তাই কোটি কোটি টাকা খরচা করে ভারতবর্ষের মতন গরিব দেশে এক ভন্ড সাধুবাবা সাংস্কৃতিক উৎসব করতে পারে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে বিদেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনে। তাই এই দেশের সরকার এক সাধুর সপ্নে দেখা সোনা খুঁজতে কোটি কোটি টাকা খরচা করে পুরাতত্ব বিভাগ কে দিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে ভগ্নস্তূপে খোঁড়াখুঁড়ি করে সময় ও অর্থ পন্ড করতে পারে, এরা পারে না শুধু গরিবের পেটে দু বেলা ভাত দিতে, এরা পারে না গরিবের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, শিশুদের পুষ্টি ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে। এরা পারে শুধু মানুষ কে খুন করতে আর না হয় কোনো না কোনো ভাবে দাস বানিয়ে রাখতে। আজ এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গোটা দেশের খেটে খাওয়া মানুষের রুখে দাঁড়াবার সময় এসেছে, দেশ বিক্রি করে দেশপ্রেমের ভন্ডামি করা শক্তির বিরুদ্ধে গোটা দেশ কে রুখে দাঁড়াতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে দেশের জনগণের উপর শোষনের রোলার চালিয়ে বিজয় মালয়ার মতন পুঁজিপতিদের সিন্দুক ভরার বিরুদ্ধে, আর রুখে দাঁড়াতে হবে একসাথে, একজুট হয়ে, প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি রাজপথে, শক্ত হাতে পাঞ্জা কষে দেশদ্রোহী শক্তিদের পরাজিত করার জন্যে।

যতদিন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে পারবো না, লেপের তলায় তৈরি করা আরামের দুনিয়ার থেকে বেরিয়ে জনগণের স্বার্থে লড়বো না ততদিন শুধু আশাই করবো যে ভগবানের কৃপায় দৈব পুরুষ শ্রীশ্রী রবিশংকরের মঞ্চ শিলা বৃষ্টি আর ঝড় জলে ধুয়ে মুছে যাক।  আর সেই আশা হবে গুড়ে বালি।

         

কানহাইয়া কুমারের শর্তসাপেক্ষ জামিন আগামী দিনে শাসক শ্রেণীর ভয়ানক ষড়যন্ত্রের একটি আভাস মাত্র

শনিবার, মার্চ ০৫, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

অনেকেই খুশি, বিপ্লবী বামপন্থী থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের তুলসীবাটা খেয়ে যারা সকালের শৌচ কর্ম করেন, আনন্দবাজার থেকে গণশক্তি, রাহুল গান্ধী থেকে অরবিন্দ কেজরিবাল, সবাই খুশি কারণ কানহাইয়া কুমার শেষ পর্যন্ত ৬ মাসের জন্যে অন্তর্বতীকালীন জামিন পেয়েছেন। জেএনইউ এর ছাত্র-ছাত্রীরা খুশি কারণ তাঁদের ছাত্র ইউনিয়নের অধ্যক্ষ ফিরে এসেছেন এবং ফিরে এসে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন বিজেপির ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে।ইংরাজি কিছু সংবাদপত্রের উদারনৈতিক সাংবাদিকরা খুশি কারণ তাঁদের উদ্যোগ ও আরএসএস এর বিরুদ্ধে তাঁদের লেখালিখির ফলে একটা সামগ্রিক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল যার পরিনাম এই জামিনের আদেশে তাঁরা দেখছেন। মোটামুটি ভাবে বলতে গেলে উমর খালিদ ও অনির্বান ভট্টাচার্য জেলের ভিতর থাকলেও গোটা দেশ জুড়ে একটা খুশির হাওয়া উঠেছে গরিব মানুষের মাঝে কানহাইয়া কুমারের জামিনে বাইরে আসার খবর শুনে।

টিভি ও কর্পোরেট মিডিয়ার দৌলতে কানহাইয়া কুমার আজ রীতিমত একজন জঙ্গী বামপন্থী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর দেওয়া ভাষণ রীতিমত বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে আবল-বৃদ্ধ-বনিতার বুকে। গরিব মানুষের সন্তান, শোষিত জাতির সন্তান, কানহাইয়া কুমারের নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর চ্যালা চামুন্ডাদের বিরুদ্ধে গর্জন আজ শোষিত বঞ্চিত মানুষের বুকে আশা জাগাচ্ছে, প্রাক্তন পুলিশ কর্তা সঞ্জীব ভট্ট থেকে শুরু করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিবাল, বিখ্যাত লেখিকা শোভা দে থেকে সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই, সবাই একজন তরুণ তুর্কি বাম ছাত্র নেতার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় অভিভূত। জেলে যাওয়ার আগে যে আজাদীর স্লোগান কানহাইয়া কুমার দিয়েছিলেন - সামন্তবাদ, মনুবাদ, পুঁজিবাদ,সংঘবাদ থেকে ক্ষুধার থেকে আজাদীর যে স্লোগান তিনি দিয়েছিলেন, তা আজ সারা দেশে এক ভয়াবহ দাবানল হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক হিসাব করেও বলতে পারছি না যে ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাঙ্গার পরে ডাঙ্গেপন্থী সিপিআই এর থেকে এরকম কোন জন নেতার জন্ম হয়েছিল কি না। এক কালে ডাঙ্গেপন্থী সিপিআই এর ভাঁড়ারে ছিলেন হীরেন মুখুজ্যে, ইন্দ্রজিত গুপ্ত, সোমনাথ লাহিড়ির মতন সুবক্তারা। অথচ আভিজাত্য ও তাত্বিক পান্ডিত্যে ভরা এই সব রাঘব বোয়াল শোধনবাদীদের কানহাইয়া কুমারের মতন মাস আপিল ছিল না।  একমাত্র ব্যতিক্রম হলেন জ্যোতি বোস, কিন্তু তিনিও কোনো দিন আভিজাত্যের দালান থেকে নেমে সাধারণ মানুষের নেতা হওয়ার ক্ষমতা দেখাতে পারেননি। কিন্তু কানহাইয়া কুমার পারলেন, এবং পারলেন ২০১৬ সালে প্রতিক্রিয়ার স্রোতের মধ্যেই। 

কানহাইয়ার সংগ্রাম, স্লোগান ও সংঘের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই কে বিপ্লবী অভিন্দন জানানো যায়, লড়াইয়ের প্রতি কদমে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শক্তির পাশে থাকা যায়, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে খুশি হওয়ার, আত্মসন্তুষ্টির নেশায় বুঁদ হওয়ার কোন কারণ দেখি না

তবে কি কানহাইয়া কুমারের জামিন হওয়ায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী বাম শক্তিগুলির উল্লাসিত হওয়ার কিছু নেই?

না, সত্যিই কিছু নেই। কানহাইয়া কুমারের উপর থেকে ছাত্র আন্দোলনের চাপে মোকদ্দমা উঠিয়ে নেয়নি ভারতের শাসক শ্রেণী, শুধু পরিস্থিতির চাপে কানহাইয়া কুমার কে জামিন দেওয়া হয়েছে আগামী ছয় মাসের জন্যে

শাসক শ্রেণীর কারাদণ্ড বা ফাঁসির সাজা থেকে বাঁচতে জামিন নেওয়া এক ধরনের মুচলেকা দেওয়ার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কারণ এই জামিনের শর্তগুলো শাসক শ্রেণী ও তাদের তাঁবেদার আরএসএস এর তরফ থেকে চাপিয়ে দেওয়া এমন কিছু শর্ত যা বাম আন্দোলনের নয় বরং সামন্ত প্রভু, দালাল পুঁজিপতি ও  বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির সেবা করে । 

কি বলছে কানহাইয়া কুমারের জামিনের আদেশ?

আদালত আদেশ দিয়েছে যে কানহাইয়া কুমার যেন জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের অধ্যক্ষ পদের ক্ষমতাবলে যেন তেন প্রকারে জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে "দেশ বিরোধী" কার্যকলাপ বন্ধ করতে সচেষ্ট হন, এবং আদালত মনে করে যে "আজাদী" চেয়ে কানহাইয়া কুমার ও তাঁর সঙ্গীদের দেওয়া স্লোগান আদতে "দেশ বিরোধী"। শুধু এইটুকুই নয়, আদালত বিজেপি - আরএসএস এর সুরে সুর মিলিয়ে কানহাইয়া কুমার ও সমগ্র বাম ছাত্রদের এই বলে তিরস্কার করে যে এই ছাত্ররা সেনা বাহিনীর ভূমিকা কে "শ্রদ্ধা" করে না এবং সেনাবাহিনী না থাকলে নাকি ভারতে গণতন্ত্র নামক বস্তুটি থাকতো না। আদালত চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে যে সেনা বাহিনী যে কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করে সেই পরিস্থিতিতে বামপন্থী ছাত্ররা কাজ করতে পারবেন না

এই রায়কে আর যাই করা যাক না কেন, কোনও ভাবেই স্বাগত জানানো যায় না। তবুও বিধির বামের তিন ভাগ, এক ভাগ নিরামিষাশী প্রভু ভক্ত গৃহ পালিত প্রাণী, এক ভাগ ছন্ন ছাড়া ঘর আর জঙ্গলের মধ্যে বিচরণ করা প্রাণী, আর এক দল জঙ্গলে থেকে শিকার করে পেট চালানো প্রাণী, এই তিন দলের মতের মিল তো হতে পারে না, কারণ জঙ্গলের বাঘ আর গোয়ালের গরু কখনও একই পাতে একই পদ খেতে পারে না, গরু ঘাস খায় আর বাঘ খায় শিকার করা টাটকা মাংস। 

তাই দেখা গেল যে কানহাইয়া কুমারের জামিন হতেই সাথে সাথে এক শ্রেণীর নব্য ও অভিজাত বামেরা জামিনের আদেশ কে নিজেদের বিজয় ও ফ্যাসিবাদের পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত করে আনন্দ উৎসব শুরু করে দেন। কানহাইয়া কুমার জেএনইউ ক্যাম্পাসে ফিরে এক আগুনের ফুলকি ঝরানো কিন্তু গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ বক্তৃতা দিলেন। এই ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় বাম রাজনীতিতে কানহাইয়া কুমার কে বামেদের ভবিষ্যত ও এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে পেশ করা হলো। 

কিন্তু এতসবের মাঝে চাপা পড়ে গেল জামিনের শর্তগুলির উপর আলোচনা, জামিন নেওয়ার স্বীদ্ধান্তের যৌক্তিকতা। আদালতের কাজ হলো প্রমাণ ও তথ্য পরীক্ষা করে যে কোনো মামলার উপর বর্তমানে লাগু আইনের সীমার মধ্যে থেকে রায় দেওয়া।ভালো হতো যদি মহামান্য দিল্লি হাই কোর্ট এই পরিধির মধ্যে থেকে রায় দিতেন।কিন্তু আদালত আইনের গন্ডির বাইরে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা কি রাজনীতি করবেন, কোন নীতিতে বিশ্বাস করবেন, কোন নীতির বিরোধিতা করবেন, সেনা বাহিনী আর দেশ রক্ষার কথা বলে কি ইঙ্গিত দিলেন ? আমরা জানতে পারলাম যে শাসক বদলালেও শাসন বদলায় না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বানিয়ে যাওয়া উনবিংশ শতাব্দীর প্রতিক্রিয়াশীল আইনের ভিত্তিতে এক বিংশ শতাব্দীর জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা কে দাবিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ভারতের শাসক শ্রেণীর চরম প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রেরই পরিচয় আরও একবার দিল। 

যে দেশের মানুষের করের পয়সায়, আয়করের চেয়ে বেশি পরোক্ষ করের পয়সায় পোষা পুলিশ-সান্ত্রী-ফৌজ সেই দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর আক্রমণ করে তখন কি জনগণের সেই বাহিনীগুলোকে প্রশ্ন করার অধিকার থাকে না ? যখন ধরুন জনতার করের টাকায় চলা আদালতের রায় শাসক শ্রেণীর পক্ষ বার বার গ্রহণ করে তখন তাঁদের টাকায় চলা আদালতের রায়ের সমালোচনা করার অধিকার সাধারণ গরিব মানুষের থাকবে না কেন ?

এই প্রশ্নগুলো তোলাও শাসক শ্রেণীর কাছে দেশদ্রোহের সমান এবং এই সব প্রশ্ন এই শাসক শ্রেণীর শাসন করার পবিত্র অধিকারকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। তাই তো সামন্তপ্রভু, দালাল পুঁজিপতি ও বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে কাজ করা রাষ্ট্র যন্ত্রের কাছে প্রশ্ন তোলা, রাষ্ট্র যন্ত্রের মৌলিক চরিত্রের প্রশ্ন করা এক গর্হিত অপরাধ। 

আজ আদালত, সামগ্রিক রাষ্ট্র যন্ত্র এবং ভারতের শাসক শ্রেণী বামপন্থীদের উপদেশ দিচ্ছে সেনা বাহিনী কে সম্মান করার জন্যে, সেনা বাহিনীর উপাসনা করার জন্যে এবং মোটের উপর রাষ্ট্র যন্ত্রকে প্রশ্ন না করতে। বলা হচ্ছে যে ভারতের সেনাবাহিনী খুব কষ্ট করে শীত-তাপ সয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে দেশ কে রক্ষা করছে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের দেশের উচ্চ জাতির বাচ্চাদের এই কথাটা বারবার করে শিখিয়ে সামরিক বাহিনীর প্রতি জোর করে আনুগত্য সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালানো হয়।আমাদের শেখানো হয় যে সেনাবাহিনী না থাকলে আমরা বাঁচতাম না এবং আমাদের দেশে আমাদের কোনও অধিকার থাকতো না। এটাই তো যুক্তি? 

কেন আমাদের দেশের সেনাবাহিনী কে কষ্ট করে সীমান্ত ও দেশ রক্ষা করতে হয় ? কারণ দেওয়া হয় প্রতিবেশী দেশের ভারতের উপর কু দৃষ্টি। প্রশ্ন হলো প্রতিবেশী দেশ কেন ভারতের উপর কু দৃষ্টি রেখেছে ? কেন প্রতিবেশী দেশগুলি তৈরি করা হয়েছিল ভারত ভেঙ্গে ? যে দেশের শাসক শ্রেণী ও তাদের তাঁবেদাররা কথায় কথায় গান্ধীর অহিংসা ও সহনশীলতার ভাষণ দেয় তাদের হঠাৎ সেনা বাহিনী ও বন্দুক কেন দরকার হলো ?

যখন প্রশ্ন করা হয় বামপন্থীদের, বিশেষ করে বিপ্লবী বামেদের দেশপ্রেম নিয়ে, যখন বারবার উদাহরন দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর আর আধা সামরিক বাহিনীর, তখন ইচ্ছে করে জানতে যে ভারতের সেনা বাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী কি কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যেখানে মানুষ নিস্বার্থে দেশের সেবায় প্রাণ নিয়োজিত করছেন ? সেনা বাহিনীর জওয়ানদের যদি বেতন না দেওয়া হয় - সস্তা রেশন, অবসরের পরের সুযোগ সুবিধা, বাচ্চাদের জন্যে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা, চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা, যাতায়তের সুযোগ সুবিধা, কোয়ার্টার, বিদ্যুত, জল, ইত্যাদী যদি না দেওয়া হয় তাহলে কত জন প্রতিকুল পরিস্থিতে মরতে যেতে রাজি হবেন ? ওই আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার একট এর মতন অবাধে খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অধিকার না থাকলে কি এই দেশের সেনা বাহিনী কোনো জায়গায় মানুষের উপর শাসন করতে পারবে ? যে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস ও বিজেপি আজ দেশপ্রেমের ঠিকাদারী করছে তাদের কত জন দেশের মানুষের স্বার্থে নিঃশর্তে মরতে রাজি হবে ?

এই সেনা বাহিনীর নামে যারা শপথ খেয়ে নিজেদের দেশপ্রেম প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, তাঁদের প্রশ্ন করি, কেন এই দেশের মানুষ আজও সেনা ও আধা সামরিক বাহিনী কে নিজেদের ফৌজ না ভেবে শুধুই সরকারি বাহিনী হিসেবে দেখেন ? কেন সাধারণ মানুষ ট্রেনের সেনা কামরায় চড়তে ভয় পান ? সেনাবাহিনীর প্রতি সম্মান থেকে না মার খাওয়া থেকে বাঁচতে ?

সংসদীয় বামেরা হয়তো দেশের সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীর শ্রেণী বিশ্লেষণ করেন না তাঁদের আইনি ব্যবস্থায় টিকে থাকার অন্যতম শর্ত হিসেবে। কিন্তু সেনা ও আধা সেনা বাহিনীর শ্রেণী বিশ্লেষণ ভালো করেই নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে করে ফেলেছেন কাশ্মীরের জনগণ, আসামের জনগণ, মনিপুরের জনগণ, মিজোরামের জনগণ, নাগাল্যান্ডের জনগণ, ঝাড়খন্ডের জনগণ, ছত্তিসগঢ়ের জনগণ, অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানার জনগণ; শ্রেণী বিশ্লেষণ ভালো ভাবেই করেছেন দমদমের সেই ধর্ষিতা নাবালিকা যিনি ট্রেনে সামরিক কামরায় সেনা বাহিনীর কাকুদের ভরসা করে চেপে গণ ধর্ষিতা হয়েছিলেন, ভালো করেই বুঝেছিলেন ট্রাফিক সার্জেন্ট বাপি দাস, যিনি সেনা জওয়ানদের রাস্তায় চলা মহিলাদের উত্যক্ত করার বিরোধিতা করায় খুন হয়েছিলেন।  আজ দেশের মানুষের, গরিব মানুষের, শ্রমিক - কৃষক - খেটে খাওয়া মানুষের, জঙ্গলের অধিকার রক্ষার লড়াইতে সামিল আদিবাসী জনগণের সেনা প্রীতি অনেক কমে গেছে। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দৌড়ে যখন দেশের সরকারি চাকরি ও সরকারি শিল্পের পরিধি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে ঠিক সেই সময় দেশী - বিদেশী পুঁজির লুটের বিরুদ্ধে বেড়ে চলা জনগণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দমন করার স্বার্থে একমাত্র সরকারি বাহিনীগুলোই টিকে থাকবে আর তাই রাষ্ট্রের মালিক সামন্তপ্রভু, দালাল পুঁজিপতি, ও বিদেশী একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি তাদের বাহিনীর প্রতি জনগণের আনুগত্য সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাবে।

কিন্তু শ্রেণী বিভক্ত সমাজে সংখ্যালঘু শাসক শ্রেণী কোনও ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের আনুগত্য বন্দুকের নলের দ্বারা আদায় করতে পারে না। কারণ স্বাভাবিক ধর্ম হিসেবেই শোষিত মানুষ পদে পদে শোষণ - বঞ্চনা - অত্যাচারের বিরোধিতা করে আসে।একটা সময়ে সামরিক শক্তি দিয়ে সেই প্রবাহমান বিদ্রোহী ধারাকে রোখা যায় না এবং ইতিহাস পদে পদে তা প্রমাণ করেছে।

কানহাইয়া কুমারের জামিনের রায় ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণীর চিনির বুলেট।কানহাইয়া কুমার কে ছাত্র আন্দোলনের চাপে শাসক শ্রেণী নিঃশর্ত মুক্তি দেয়নি, শর্তসাপেক্ষ জামিন দিয়েছে এবং শর্তগুলি শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। সংসদীয় পথের পথিক সরকারি বামেদের কাছে এই জামিন, যা আসলে শাসক শ্রেণীর কাছে মুচলেকা দেওয়া ছাড়া বেশি কিছু নয়, হয়তো বিজয়ের দলিল হতে পারে কিন্তু সংগ্রামী বিপ্লবী বামেদের কাছে এই জামিন আগামী দিনের কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের হদিস দিচ্ছে। উমর খালিদ ও অনির্বান ভট্টাচার্য আজও শাসক শ্রেণীর কারার অন্তরালে। কানহাইয়া কুমারের মতন উমর ও অনির্বান এত চটজলদি সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করবেন বলে মনে হয় না। তাঁদের কে বিধে দিতেই শাসক শ্রেণী সরকারি নিরামিষাশী বামেদের নিজের হাতে রাখতে কানহাইয়া কুমার কে জামিনে মুক্ত করেছে।

জনগণের মুক্তি, দেশের স্বাধীনতার সম্পর্কে বলার জন্যে আজ উমর খালিদ, অনির্বান ভট্টাচার্য, প্রফেসর এস এ আর গিলানি ও প্রফেসর ডক্টর জি এন সাই বাবার উপর ফাঁস কষছে শাসক শ্রেণী। ভারতের শাসক শ্রেণী ও তাদের মুখপত্র আরএসএস ও বিজেপি ভালো করেই জানে উমর খালিদ, অনির্বান ভট্টাচার্য, প্রফেসর গিলানি বা ডক্টর সাইবাবা কোনো ভাবেই শাসকের সুরে সুর মিলিয়ে জি হুজুর বলবেন না। তাঁরা প্রতিবাদ করবেন রাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, তাঁরা আদালতের মঞ্চকে ব্যবহার করবেন সাধারণ মানুষের স্বার্থে রাজনৈতিক প্রচার চালানোর জন্যে, এবং যে শাসক শ্রেণী একদিন এই ভাবেই মাস্টারদা সূর্য সেন থেকে ভগৎ সিং কে ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়েছিল তারা চেষ্টা চালাবে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে এই বিরোধী স্বরগুলি কে রুদ্ধ করতে।

যে দেশ আজ জেলখানায় পরিণত হয়েছে সেই দেশে জেলের ভিতরে বা বাইরে থাকার মধ্যে বিশেষ কোনো ফারাক নেই।  আজ দেশের সামনে এক কঠিন পরিস্থিতি এসে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আরএসএস ও বিজেপির শ্রমিক-কৃষক বিরোধী যুদ্ধ, যা মূলত শুরু হয়েছে জেএনইউ এর ক্যাম্পাসের বামপন্থী ছাত্রদের উপর আক্রমণ করে, তা কোনও ভাবেই হালকা করে দেখলে চলবে না। জেএনইউ কান্ডের ফাঁকে বিজেপি সরকার ও ভারতের শাসক শ্রেণী দেশের কয়লা, সোনা ও লাইম স্টোন খননের অবাধ অধিকার দেশী ও বিদেশী পুঁজিতে চালিত কর্পোরেশনগুলির হাতে তুলে দিয়েছে। হরিয়ানাতে শ্রমিক সংগ্রামের উপর হিংস্র দমন পীড়ন নেমে আসছে, আদিবাসীদের অধিকারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ লড়াইয়ে সামিল সোনি সোরির উপর ঘৃণ্য হামলা হলো; ছত্তিসগঢ়, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, ইত্যাদী জায়গায় আদিবাসী প্রতিরোধ ভাঙ্গতে রোজ জোর কদমে সামরিক অভিযান চলছে। এই পরিস্থিতির থেকে মুক্তি পেতে আমাদের অবশ্যই শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ-ছাত্র-যুব-নারী-আদিবাসী-দলিত-সংখ্যালঘুদের সংগ্রামকে আজ ফ্যাসিবাদ বিরোধী মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। কানহাইয়া কুমারের মতন ব্যক্তিরা পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা নির্বাচনে সিপিআই ও সিপিএমের পক্ষ থেকে হয়তো প্রচার করতে পারেন, কিন্তু দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিপ্লবী সংগ্রামে সামিল হতে পারবেন না। নেতৃত্ব তো দুরের কথা।

কানহাইয়া কুমারের স্লোগানের প্রতি সমর্থন জানাই, কিন্তু আজ বিশেষ দরকার হলো এই আজাদীর স্লোগান কে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া, ক্যাম্পাসের বাইরে ওই খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষকদের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং তাঁদের সাথে নিয়ে দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রাম কে বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া - এটাই আজ দেশের সমস্ত বামপন্থী - প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির প্রধান ও পবিত্র কর্তব্য হওয়া উচিত।  জামিন নয়, দেশ জুড়ে যে জেলখানা গড়ে সমগ্র খেটে খাওয়া মানুষকে বন্দী বানাবার প্রচেষ্টা চলছে, সেই প্রচেষ্টাকে আসুন আমরা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিই।       

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে