ভগৎ সিং - রাজগুরু -সুখদেব সহ সকল বিপ্লবী শহীদদের আজ বিকৃত করে পরিবেশন করার হিন্দুত্ববাদী চক্রান্ত কে চূর্ণ করুন।

বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৩, ২০১৭ 0 Comments A+ a-


আজ থেকে ৮৬ বছর আগে তিন জন বীর বিপ্লবী কে ফাঁসি কাঠে ঝোলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কারণ তাঁরা বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, ভারতবর্ষে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের রাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন এবং সাম্রাজ্যবাদ কে ধ্বংস করার লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর সাথে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। গান্ধীর ব্রিটিশ তোষণের রাজনীতির থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন কে সমাজ বদলের লড়াইয়ে বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টায় রত হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর এই তিন বিপ্লবী নেতা ছিলেন ভগৎ সিং, রাজগুরু, ও সুখদেব। ফাঁসির দড়িতে চড়ার আগে এঁরা করুণা ভিক্ষা করেননি, বিপ্লব দীর্ঘজীবি হউক বা ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান তুলে ইনারা হাসি মুখে সাম্রাজ্যবাদী হত্যাকারীদের ফাঁসির কাঠে দাঁড়ালেন।

বর্তমানে ভগৎ সিংয়ের সামগ্রিক ইতিহাস কে বদলে দেওয়া হচ্ছে। যে বিনায়ক সাভারকার ব্রিটিশ শাসক শ্রেণীর কাছে নাকে খত দিয়ে, ব্রিটিশ গুপ্তচর হওয়ার মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে হিন্দুত্বের দর্শনের প্রচার শুরু করে এবং শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী কে ধ্বংস করে সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায় দেশকে ডুবিয়ে দেওয়ার কাজ করে চলে, সেই সাভারকরের অনুপ্রেরণায় চলা আরএসএস আর বিজেপি আজ বার বার করে ভগৎ সিং ও তাঁর বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী সাথীদের রাজনৈতিক পরিচয় কে জনসাধারণের থেকে গোপন করে তাঁদের হিন্দুত্ববাদী হিসেবে পাচার করে ইতিহাসের বিকৃতি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভগৎ সিং এর মতন বাম ও গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন যুব বিপ্লবী শহীদের স্মৃতি কে কলঙ্কিত করার স্বার্থে তাঁর নামে ফ্যাসিবাদী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী খুলে উগ্র রাষ্ট্র প্রেমের প্রচার চালাচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। যে আন্তর্জাতিকতাবাদের রক্তিম ঝান্ডা কে সেলাম জানিয়ে ভগৎ সিং ও তাঁর সাথীরা বিশ্ব বিপ্লবের সাথে, আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সাথে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম কে মেলানোর প্রচেষ্টা করেছিলেন, সেই আন্তর্জাতিকতাবাদের শত্রুরা, ভারতের শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের শত্রুরা, হিন্দুত্ববাদের জিগির তোলা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও বিদেশী পুঁজির পা চাটা দালালেরা আজ ভগৎ সিং কে একটি গেরুয়া ঝান্ডাধারী ফ্যাসিস্ট হিসেবে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভগৎ সিং ও তাঁর আদর্শের প্রতি, সমাজতন্ত্র ও বিশ্ব বিপ্লবের প্রতি আস্থা রেখে চলা ভারতের বিপ্লবী বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি কে আজ ভগৎ সিং এর নাম নিয়ে দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিচ্ছে সেই শক্তি যাঁরা স্বাধীনতার সংগ্রামে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে মুজরো করতো হাফ প্যান্ট পড়ে।

বর্তমান ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত সেই ৮৬ বছর আগের ঔপনিবেশিক ভারতের চেয়ে বিশেষ আলাদা নয়। দেশের মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া কৃষকেরা আজও নিদারুন কষ্টের মধ্যে বাস করছেন, লড়াই করছেন জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসে থাকা সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে আর সেই সামন্ততান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থার সৃষ্ট ঘৃণ্য জাতি বিদ্বেষী ব্যবস্থা ও সামাজিক শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। ভগৎ সিংয়ের জীবনকালের মতনই আজ ভারতের শ্রমিক শ্রেণীর শ্রম ও শ্রমের ফলে সৃষ্ট সম্পদ কে লুঠ করে নিজেদের ভাঁড়ারে শ্রীবৃদ্ধি করাচ্ছে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তার ভারতীয় বংশোদ্ভুত দালালেরা। আজ দেশের শাসন ভার যে দলের হাতে আর যে লোকটা আজ দেশ চালাচ্ছে সস্তা চমক আর ভাঁওতা দিয়ে তাঁরা কিন্তু ভগৎ সিংয়ের চোখে সেই বাদামি সাহেবের ভূমিকা পালন করছে, যে ভূমিকা নিয়ে সেই সময়েই সতর্ক করেছিলেন এক ২৩ বছর বয়সী যুবক।

ভগৎ সিং কে আত্মসাৎ করা আজ ভগৎ সিংয়ের আদর্শ ও নীতির শত্রুদের কাছে ভীষণ প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ শাসিত ঔপনিবেশিক ভারতে হিন্দুত্ববাদের ধ্বজ্জাধারীরা এমনকি গান্ধীর কাপুরুষোচিত অহিংসক আন্দোলনেও যোগ দেয়নি, পাছে ব্রিটিশ মালিকেরা চটে যায়। যে মুহূর্তে ভগৎ সিং, চন্দ্র শেখর আজাদ, সুখদেব, ও রাজগুরু ভারতের অগণিত শোষিত ও অত্যাচারিত মানুষের স্বার্থে এক নতুন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে প্রাণ দিচ্ছিলেন ঠিক তখনই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পোষ্য হিন্দু মহাসভা,  আরএসএস, এবং মুসলিম লীগ একত্রে বসে ষড়যন্ত্র করছিল যে কি ভাবে স্বাধীনতার দাবিতে গড়ে ওঠা জঙ্গী আন্দোলনের থেকে, হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন ও অন্য সকল বাম ও বিপ্লবী শক্তির থেকে যুব সমাজ ও ভারতের গরিব খেটে খাওয়া মানুষ কে দূর করে বরং ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পাঁকে ফেলা যায়।

পাকিস্তান গড়ে তুলতে জিন্নাহ’র নেতৃত্বে মুসলিম লীগ পরবর্তী কালে সফল হয়েছিল আর অন্যদিকে উগ্র দেশপ্রেমের জিগির তুলে ব্রিটিশ শাসকদের দখল করে যাওয়া উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে যখন নেহরু সরকার নিজ আধিপত্য কায়েম করার প্রচেষ্টায় হাজার হাজার নাগা, মিজো, মনিপুরী, খাসি, ও অহমিয়া মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, কাশ্মীর কে নিয়ে পাকিস্তানের সাথে পাঞ্জা লড়া শুরু করে, আর দেশ কে ঠেলে দিতে থাকে অশেষ অন্ধকারের দিকে। আর এই অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া গরিব মানুষের কাছে লড়াই করার অনুপ্রেরণা দশকের পর দশক ধরে ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরু, চন্দ্র শেখর আজাদ, ও অন্যান্য শহীদেরা দিতে থাকেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে অসমাপ্ত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে বহ্নিশিখা জ্বলে উঠতে থাকে, তা দেশের শাসক শ্রেণী কে চরম ভাবে আতঙ্কিত করে। দেশের গরিব মানুষের মধ্যে ভাগাভাগি করাতে ও ধর্মীয় - জাতি দ্বন্ধ কে তীব্র করতে শাসক শ্রেণী কে চিরকাল সাহায্য করে এসেছে বিনায়ক সাভারকারের তত্ব।

আজ যখন সারা বিশ্ব জুড়ে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজিবাদ এতই তীব্র ভাবে সঙ্কটে নিমজ্জিত যে সাম্রাজ্যবাদের কেল্লা মার্কিন দেশেও শাসক শ্রেণী আর পুরানো কায়দায় শাসন করতে পারছে না, ঝুটো গণতন্ত্রের মুখোশ ছিঁড়ে ট্রাম্পের সরকার মার্কিন শাসক শ্রেণীর ফ্যাসিবাদী চেহারাটা জনগণের সামনে এনে ফেলেছে, যখন ব্রিটেন থেকে অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স হয়ে পোল্যান্ডে পর্যন্ত তীব্র মুসলিম ও জাতি বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদীরা আজ ক্ষমতায় আসীন, সেই বিশ্বে ভারতের শাসক শ্রেণীর কাছে দেশের সম্পদের উপর তাঁদের অধিকার কে অক্ষুন্ন রাখার এক অভিন্ন পথ হলো হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি কে ভারতের শাসন ক্ষমতায় বসিয়ে দেশ জুড়ে গরিব মানুষের মধ্যে দাঙ্গা ও পরস্পরের প্রতি ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজ শোষণ ও শাসনের একচেটিয়া অধিকার কে কায়েম রাখা। এই দাঙ্গার আর খুনোখুনির সময়ে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আদিবাসীদের থেকে জল-জঙ্গল-জমি কেড়ে নিতে, গরিব কৃষকদের বন্দুকের জোরে তাঁদের গ্রাম ও কৃষি জমির থেকে উচ্ছেদ করাতে, শ্রমিকদের ক্রীতদাসের মতন খাটাতে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন সমস্ত কর্পোরেশনগুলোর কোন অসুবিধাই হবে না, কারণ শ্রমিকে-শ্রমিকে আর কৃষকে-কৃষকে দ্বন্ধ লাগিয়ে রক্তের নদী বইয়ে দেওয়ার খেলায় সাভারকারের ছানাদের জুড়ি মেলা ভার।

ভগৎ সিং এই ভারতের কথা ভেবে চিন্তিত হতেন কারণ তিনি শ্রমিক-কৃষকের উপর নিপীড়নকারী ভারতের শাসক শ্রেণী কে নিজের লোক কখনোই ভাবতেন না বরং তাঁদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সমগোত্রীয় হিসেবে গণ্য করতেন। ভগৎ সিং-রাজগুরু-সুখদেব-চন্দ্র শেখর আজাদ-যতীন দাস সহ হাজারো শহীদদের স্বপ্নের ভারত আজও গড়ে তোলা যায়নি, আর যায়নি কারণ এই দেশের শত্রু বড় মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের, জোতদার-জমিদারদের, বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির মৌরসি পাট্টা আজও ভাঙ্গা যায়নি। যতদিন না ভারতবর্ষের থেকে এই জগদ্দল পাথরগুলিকে এবং এদের সোহাগের রাজনৈতিক পিট্টুদের উচ্ছেদ করা না হচ্ছে ততদিন ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেবদের আমরা ২৩শে মার্চ সঠিক ভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে অপারগ থাকবো।

শহীদদের প্রাণদান কে বৃথা না যেতে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে আজ আমাদের সকলের উচিত ব্যাপক হিন্দুত্ববাদী-ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামী ফ্রন্ট গড়ে তোলা এবং সামন্তবাদ, মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশ থেকে ভারত কে মুক্ত করে ভগৎ  সিং-রাজগুরু-সুখদেব-চন্দ্র শেখর আজাদ সহ হাজারো শহীদের স্বপ্নের দেশ গড়ার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের কবল থেকে আজ ভগৎ সিং - রাজগুরু -সুখদেবদের ছিনিয়ে নিতে হবে, ছিনিয়ে নিতে হবে বিপ্লবীদের ঐতিহ্য কে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক এই গেরুয়া বাহিনীর হাত থেকে আর প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাঁদের স্ব-পরিচয়ে-সমাজতন্ত্র আর আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিচয়ে।


        

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে