উগ্র জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ পরিসরে দুর্বল হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রাম

মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৯, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


একটা সময় ছিল, ষাট-সত্তরের দশক অবধি, যখন আন্তর্জাতিকতাবাদ একটি জোরালো রাজনৈতিক প্রবণতা ছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধের অপরাধীদের আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে সাজা পাওয়ার কথা এমনি এমনি ওঠেনি। রাস্তার আন্দোলনের মধ্যে থেকে একটা সম্মিলিত চীৎকার হয়ে উঠেছিল। শুধু যুদ্ধবাজ আমেরিকার রাস্তায় জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই সে আওয়াজ ওঠেনি, আমাদের মত গরিব দেশের রাস্তা থেকেও সে আওয়াজ প্রত্যয়ের সাথে উঠেছিল। আমার নাম, তোমার নাম, ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম। এ আমরা, আশির দশকের সন্তানরা, ছোটবেলায় নানা লোকের মুখে শুনে ফেলেছি। সত্যজিৎ রায়ের "প্রতিদ্বন্দ্বী"-র ইন্টারভিউ সিনে বেকার যুবকের ভিয়েতনাম যুদ্ধের গুরুত্বকে মানুষের চাঁদে যাওয়ার ঘটনার গুরুত্বের থেকে বড় করে দেখতে শিখেয়েছিল সে এক রাজনীতি। ওই দৃশ্যটা দেখার অনেক আগে, বা প্রলেতারিয়েতের আন্তর্জাতিকতাবাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব/প্রয়োগ সম্পর্কে জেনেবুঝে ওঠার অনেক আগেই আমরা, আশির দশকের বাচ্চারা, শিখে গেছি যে আমরা এ দেশের মানুষ হওয়ার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই ভিয়েতনামের যুদ্ধ-আক্রান্ত মানুষের পক্ষে ছিলাম, আমরা চিরকাল প্যালেস্তাইনের যুদ্ধ-আক্রান্ত মানুষের পক্ষে ছিলাম। আমরা আমেরিকার ব্লকেড আক্রান্ত কিউবার পক্ষে ছিলাম। রুশ বিপ্লব কী তা জানার আগেই আমরা, তখনকার ছোটরা, সোভিয়েতকে ভালবাসতাম। বাংলা অনুবাদে সোভিয়েত লেখক আর কবিদের পড়তে পেতাম। অত দূর সোভিয়েত দেশ থেকে অমন যত্নে তৈরি করা এত ছোটদের বই কীভাবে জানি বাড়িতে পৌঁছে যেত, বইমেলায় পাওয়া যেত। আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণা মগজে ঢোকার অনেক আগেই আমরা হাতেনাতে এর সহজ, স্বাভাবিক উপস্থিতি টের পেয়ে যেতাম।


নিছক আশির দশকের নস্টালজিয়া ঢেঁকুর তোলার জন্য এটা বলা নয়। সরলীকরণ করে বলার জন্যও এটা নয়। সরলীকরণ করা ভুল হবে, কারণ এ সবের মধ্যেও স্থানীয় জাতীয়তাবাদের একটা শিকড় আগাগোড়া ছিল। তাই, ভিয়েতনাম, কিউবা, রাশিয়া, প্যালেস্তাইন সম্পর্কে এই অবস্থানগুলো থাকা সত্ত্বেও আমরা চীন ভারত যুদ্ধের সময় জেনে বুঝে অবস্থান নিতে শিখিনি। আমরা কোনদিনই কাশ্মীরের মানুষের পক্ষ নিতে শিখিনি। আমাদের কাশ্মীর সম্পর্কে স্বাভাবিক ভাবে জানা বোঝার কোনও উপায় ছিল না। মাধ্যমিক বোর্ডের দেওয়া ভারতের মানচিত্রে ম্যাপ-পয়েন্টিং করার সময় আমরা সেই মানচিত্রকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে জানতাম না। এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা মাথায় রেখেও বলা যায়, যে এক জোরালো আন্তর্জাতিকতাবাদ তখনও ছিল। প্যালেস্তাইন নিয়ে কথা বললে, "বিশ্বমানব" বলে কটাক্ষ করাটা তখন একেবারেই আনকুল ছিল।


শ্রম এবং পুঁজির দ্বন্দ্বকে রাজনীতির পরিসর থেকে যত বেশি বেশি করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তত আমার সমস্যার সমাধান যে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানের সাথে জড়িত থাকতে পারে, এবং আমার সমস্যা যে অনেক অংশে আসলে বৈশ্বিক ফাটকা পুঁজির মহাঘোঁট থেকে উদ্ভুত, এই বোধও চলে গেছে। এখনকার ‘স্বাভাবিক’ বোধটাও তাই খানিকটা এরকম। সব সমস্যাই হয় কেবল আমার, নয় কেবল আমার গোষ্ঠীর, কেবল আমার খন্ডিত আইডেনটিটির, কেবল আমার স্থানিক চারপাশের। শুধু এই বোধে বলীয়ান হয়েই দীর্ঘ ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে ফেলে ভূমিপুত্র রাজনীতি বা আইডেন্টিটির রাজনীতি আগের রাজনীতির ফাঁকফোঁকরগুলো বুজিয়ে নিটোল সমাধান এনে দেবে বলে আজকে মনে করা হচ্ছে।


এই ভাবে ভেবেই আসাম বা শিলং থেকে বংগালি খেদাও থেকে শুরু করে মুম্বাইয়ের বিহারি খেদাও। নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, শিকড় হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সবসময় অমূলক নয়। কিন্তু তার সমাধান কাঠামোগত ভাবে না খুঁজে সবচেয়ে দুর্বল অভিবাসী মানুষকে বিতারণ করে বা ভয় দেখিয়ে ‘সাইজ’ করে কোনওদিন আসেনি। আসার কথাও নয়। মজার ব্যাপার হল এর ফলে আসাম থেকে অধিকাংশ বাঙালি বা মুম্বাই থেকে অধিকাংশ বিহারিকে তাড়ানো যায়নি। কিন্তু, যেটা করা গেছে তাহল রাজনীতির পরিসর থেকে অন্যান্য কাজের কথাগুলোকে সরিয়ে ফেলা গেছে। যাতে বিহারি শ্রমিকের যেমন ক্ষতি হয়েছে, মারাঠি শ্রমিকেরও লাভ হয় নি। বাঙালি কৃষকের যেমন ক্ষতি হয়েছে, অসমিয়া কৃষকেরও লাভ হয় নি। এটা ভাষা অক্ষের রাজনীতির ক্ষেত্রে, অন্যান্য অক্ষের ক্ষেত্রেও ঠিক। তাই ইতিহাসে যাই ঘটে থাকুক না কেন, মধ্যবিত্ত কাশ্মীরি পন্ডিতদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে, পন্ডিতদের যেমন ক্ষতি হয়েছে, ততোধিক ক্ষতি হয়েছে কাশ্মীরি মুসলমানদের। এই ক্ষতগুলো দগদগে ঘা হয়ে নতুন রাজনীতি খোঁজার সম্ভাবনাকে মলিন করেছে। কোথাও সমৃদ্ধ করেনি।

এখন বাংলায় যে নব্য বাঙালি জাতীয়তাবাদি রাজনীতির আমদানি হয়েছে, সেটা আমাদের দেশের সহ গোটা বিশ্বের এই সময়ের ফসল। এখন ব্রেক্সিটের ব্রিটেন থেকে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড – সঙ্কীর্ণতম জাতীয়তাবাদ, অভিবাসী শ্রমিক বিরোধিতা ও ভূমিপুত্র রাজনীতির যুগ। ঠিক যেভাবে নব্বইয়ের দশকে আমরা বড় বাঁধ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ ও তাঁদের ঠিক করে দেওয়া ‘উন্নয়নের’ রাজনীতি-র বিরোধিতা করার বদলে, পরিবেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবার বদলে রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে জল-ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করে সবাই মরেছি। খানিকটা তেমনই আজকে যখন চাকরি ছাঁটাই মহামারী হয়ে উঠেছে। আজকে যখন মানুষের হাতের পয়সা বড় পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেছে। তখন আমরা ভাবছি এই সংকটের উত্তর হল, আমার বেঁধে দেওয়া গন্ডিটুকুর মধ্যে তার বাইরে থেকে আসা শ্রমিককে কাজ করতে দেব না। আমার ভাষাকে বাঁচাতে হলে আমাকে অন্য ভাষার শ্রমিককে তাড়াতে হবে। আমার সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হলে আমার ক্রোধের অভিমুখ হবে অন্য সংস্কৃতির ছাপোষা লোক। এই ধরনের সহজ টার্গেটের ওপর সংখ্যাগুরুর “জনরোষ”-এর একটা মাদকতা আছে বোধহয়। তাই কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলছে, করছে। কিন্তু অনেকেই চুপ করে সাপোর্ট দিচ্ছে। একই সাথে আসামে এনআরসি-র বিরোধিতা করব, আবার এখানে সেই একই যুক্তিক্রমের রাজনীতি করব, দু’টোই কিন্তু চলছে। কারণ ভূগোলের সাথে বিষয়ী পাল্টে যাচ্ছে। “এখানে তুমি সংখ্যালঘু, ওখানে তুমি জমজমাট”। কিন্তু এসবের মধ্যে যেটা সুন্দর করে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা হল শ্রম আর পুঁজির দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্র আর মানুষের দ্বন্দ্ব। এই বিষাক্ত রাজনীতি রোখার দায় ধর্মীয়, ভাষিক সংখ্যাগুরুর ওপর বেশি করে বর্তায়। সমস্যাগুলোর সমাধান সবাইকেই খুঁজতে হবে, তবে এই পথে নয়।

নোবেল চর্চা: এস্তের দুফ্লো ও অভিজিৎ ব্যানার্জি'র দৈনতার অর্থনীতি আসলে অর্থনীতির দৈন্যতা

রবিবার, অক্টোবর ২০, ২০১৯ 0 Comments A+ a-

Esther Duflo and Abhijit Banerjee won the Nobel Prize in Economic Sciences along with Michael Kremer in 2019

ম্যাসাচুটেস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'র ফরাসী-মার্কিন অর্থনীতিবিদ এস্তের দুফ্লো, তাঁর বাঙালি-মার্কিন অর্থনীতিবিদ সহকর্মী ও সাথী অভিজিৎ ব্যানার্জি, ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ক্রেমার যৌথ ভাবে ২০১৯ সালের অর্থনীতি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দারিদ্র্য মোচন করার ক্ষেত্রে তাঁদের নানা গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণে তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি ২০১১ সালে দরিদ্রের অর্থনীতি শীর্ষক তাঁদের যে অর্থনৈতিক অনুসন্ধান প্রকাশ করেন তাতে উন্নয়নমূলক অর্থনীতির সূত্র ধরে তাঁরা দেখান যে দরিদ্র মানুষের অর্থনীতি কী বস্তু। দরিদ্রের অর্থনীতি হল শ্রম বেচে তাঁরা যে জীবিকা আয় করেন শুধু শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকতে, যাতে তাঁরা শ্রম বিক্রি করতে পারেন, সেই অর্থ তাঁরা কী ভাবে খরচ করেন এবং সেই খরচের সাথে কী করে বিশ্ব একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্বার্থ কে জোড়া যায় যাতে এদের দ্বারা চালিত দেশগুলোর পঙ্গু হয়ে যাওয়া অর্থনীতি কে চাঙ্গা করা যায়।

ডেভেলপমেন্টাল ইকোনোমিক্স বা উন্নয়নশীল অর্থনীতির সূত্রগুলো ক্লাসিক কেইনেসিয়ান মাইক্রো-ইকোনোমিক তত্ত্বের খুচরো তবে আরও উন্নত অংশ বলা যেতে পারে। এটা উল্লেখ্যযোগ্য যে দুফ্লো ও ব্যানার্জি তাঁদের কাজ কে কেন্দ্রীভূত করেছেন গরীব দেশগুলোয়, যাতে তাঁরা গরীব মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম কে প্রত্যক্ষ ভাবে অধ্যয়ন করতে পারেন এবং সাথে সাথে randomised controlled trials (বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা) এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের মাইক্রো-ইকোনোমিক তত্ত্বের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করতে পারেন।

দরিদ্রের অর্থনীতি  আসলে মার্কস কর্তৃক প্রুধোঁ’র লেখা দৈন্যতার দর্শন এর সমালোচনা দর্শনের দৈন্যতা’র  মতনই অর্থনীতির দৈন্যতা বলে বেশ চালিয়ে দেওয়া সম্ভব। কী আছে দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্বে? কী ভাবে তাঁরা বর্তমান বিশ্বে হুহু করে বেড়ে চলা আর্থিক আসমাঞ্জস্য ও দৈন্যতা কে দূর করতে চান? কী ভাবে তাঁরা দরিদ্রের কষ্ট লাঘব করতে চান? বছরের পর বছর ধরে তাঁরা যে ভাবে মাটি আঁকড়ে বিশ্বের দৈন্যতার শিখন্ডে থাকা অঞ্চলে গিয়ে গবেষণা করেছেন তার নিটফল কী? যে নোবেল পুরস্কার বিশ্বের তাবড় তাবড় বিদ্বানদের, যাঁরা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, দেওয়া হয়, তা দুফ্লো ও ব্যানার্জি কে দেওয়া হল কেন? 

বিশ্ব পুঁজিবাদের বর্তমান স্তর হল সাম্রাজ্যবাদী অর্থাৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্তর। পুঁজিবাদের স্বাধীন প্রতিযোগিতার যুগের থেকে প্রবর্তিত হয়ে পুঁজির চরম কেন্দ্রিকরণের মধ্যে দিয়ে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির জন্ম। বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষের দিক থেকেই এই একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি চরম সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আসে আর্থিক উদারীকরণ, অর্থাৎ সরকার বা রাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার ও বাজারের omnipotence, বেসরকারিকরণ অর্থাৎ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে — যা জনগণের দেওয়া করের টাকায় গড়ে উঠেছে — কর্পোরেট সংস্থাগুলো কে বেচে দেওয়া, এবং বিশ্বায়ন অর্থাৎ প্রতিটি দেশের বাজার, কাঁচা মালের বা প্রাকৃতিক সম্পদের উৎসগুলো কে বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির জন্যে উদার করে খুলে দেওয়ার নীতি। এই নীতি কে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি বলা হয়।

এই নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির দুনিয়ায় একটি রাষ্ট্রযন্ত্র যত তাড়াতাড়ি আর যত বেশি করে অর্থনীতির থেকে নিজেকে সরিয়ে  নিয়েছে, যত বেশি সে বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের স্বার্থে নিজের দেশের সীমান্ত পুঁজির জন্যে আলগা করে দিয়েছে তত বেশি করে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে, ধনীর সিন্দুক যেমন একদিকে ফুলে ফেঁপে উঠছে, দরিদ্র মানুষ আরও বেশি করে শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তাঁরা দিন দিন তাঁদের বেঁচে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছেন আর এর ফলে সমাজে শ্রেণী দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠছে। 

এই শ্রেণী দ্বন্দ্ব কে নিকেশ করতে, দরিদ্র মানুষদের কিছু ছাড়, কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়ে, তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ দিয়ে টিকিয়ে রেখে তাঁদের শ্রম কে নিংড়ে নেওয়ার অর্থনীতি হল "উন্নয়নমূলক অর্থনীতি"। কী করে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে, বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জিভূত দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের ক্ষোভ কে শান্ত করা যায় কিছু অর্থের বিনিময়ে, কী করে পুঁজির মানবিক মুখোশ দেখিয়ে শোষকের ভয়াবহ রূপ কে দরিদ্র মানুষের দৃষ্টির অগোচরে রাখা যায়, কী ভাবে "পাইয়ে দেওয়ার" রাজনীতির মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষদের সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম থেকে অনেক দুরে রাখা যায়, তারই নাম "উন্নয়নমূলক অর্থনীতি" যা দুফ্লো ও ব্যানার্জি জুটির বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা'র মূল ভিত্তি। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র অর্থনৈতিক দর্শনের মূল বিষয়টাই হল যে সামগ্রিক ছবিটা না দেখে অংশটা দেখা। “প্লাম্বার রূপে অর্থনীতিবিদ” শীর্ষক তাঁর লেখায় দুফ্লো বলেছেন যে অর্থনীতিবিদদের কাজ হবে প্লাম্বারের মতন লিকেজ মেরামত করা, বৃহৎ সমস্যাটা সমাধান করতে না যাওয়া। অর্থাৎ, তাঁর মতে শুধুমাত্র পুঁজিবাদের সঙ্কটের বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে অর্থনীতিবিদদের উচিত সাহায্য করা, সামগ্রিক পুঁজিবাদের সঙ্কট কে নিয়ে গবেষণা করার বা এই ব্যবস্থা কে কী ভাবে পরিবর্তন করা যায় তা অর্থনীতিবিদদের দেখার কথা নয়।

দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার পদ্ধতি হল গরিব মানুষের মধ্যে গিয়ে থাকা, তাঁদের দৈনিক জীবনযাপন কে লক্ষ্য করা, তাঁদের খরচ ও অর্থনৈতিক বিকল্পগুলো কে যথাসম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করা ও এর ভিত্তিতে মাইক্রো-ইকোনোমিক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া, বিশেষ করে যা এই দরিদ্র মানুষদের জীবনে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। আর এই পরিবর্তনের জন্যে দুফ্লো ও ব্যানার্জি নির্ভর করেন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের উপর। এই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাঁরা চান যে দরিদ্র মানুষের হাতে কিছু অর্থ দেওয়া হোক, সে universal basic income বা সার্বজনীন মৌলিক আয় হিসেবে হোক বা সরকারি প্রকল্প অনুসারে সরাসরি দরিদ্র মানুষের ব্যাঙ্ক একাউন্ট এ ট্রান্সফার করেই হোক, যাতে সেই অর্থ দিয়ে তাঁরা বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকতে পারেন ও শ্রম বিক্রি করার পরিস্থিতিতে থাকেন। 

তবে যদিও এই ধরণের অর্থনৈতিক গবেষণা কে দারিদ্র্য দূর করার প্রয়াস হিসাবে চালানো হচ্ছে, এই ধরণের বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা কোন ভাবেই সার্বিক ভাবে দারিদ্র্য দূর করতে পারে না কারণ এই সমস্যাটা মাইক্রো-ইকোনোমিক নয়, সমস্যাটা বৃহৎ একটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা যা বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার ফসল, এবং পুঁজিবাদের, একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির, বিশ্বের উপর জেঁকে বসে থাকা রক্তচোষা ব্যবস্থার সার্বিক উচ্ছেদ না করে, সমাধান করা সম্ভব নয়। দারিদ্র্য কে অতি-দারিদ্র্যে পৌঁছানোর থেকে আটকানো আর দারিদ্র্য নির্মূল করার রাজনৈতিক-অর্থনীতির মধ্যে বিস্তর গুণগত পার্থক্য আছে।

শ্রমের শোষণ, উৎপাদনের উপকরণের উপর পুঁজির মালিকানা ও সামগ্রিক ভাবে পুঁজির চরম কেন্দ্রিকরণের ফলেই যে বিশ্বের প্রতিটি কোনে দারিদ্র্য এত চরমে উঠছে, ব্রিটেনের মতন দেশেও অনাহারে মানুষ জীবন কাটাচ্ছে, সে কথা কিন্তু দুফ্লো ও ব্যানার্জি স্বীকার করেন না বা সেই সমস্যার সমাধানে তাঁদের কোন দিক নির্দেশ নেই। মনে রাখা দরকার নিজেকে “মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদদের” থেকে অনেক দূরে সরিয়েও শুধুমাত্র “অর্থনৈতিক বৈষম্যে” পুঁজির ভূমিকা কে দেখানোর জন্যে, অসাম্যের কথা বলার জন্যে টমাস পিকেটি কিন্তু নোবেল পাননি। তাই দুফ্লো ও ব্যানার্জি যে নোবেল পেয়েছেন তার কারণ তাঁরা সাবধানে নিজেদের এক সুবিধাজনক মিস্ত্রির ভূমিকায় চিত্রিত করেছেন, সমাজ বিজ্ঞানী হিসেবে না। তাঁদের তত্ত্বে, দুফ্লো ও ব্যানার্জি দেখিয়েছেন কী ভাবে রাষ্ট্র কে ব্যবহার করে দরিদ্র মানুষ কে কিছুটা সুরাহা বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতরেই, পুঁজিবাদ কে রক্ষা করতে দেওয়া উচিত। 

এই সার্বজনীন মৌলিক আয় যদিও নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির রাষ্ট্র কে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তির থেকে দূরে রেখে বাজারের দালাল বানিয়ে রাখার পদ্ধতির থেকে আলাদা তবুও এটা কিন্তু নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির উপদেষ্টারা আসলে পছন্দ করেছেন। তাই ভারতে কংগ্রেস পার্টি বিগত লোকসভা নির্বাচনে ব্যানার্জি’র সাহায্যে একটি ন্যূনতম আয় প্রকল্প (ন্যায়) নিজের প্রতিশ্রুতিতে যুক্ত করে যার মাধ্যমে দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের মাসিক ৬,০০০ টাকা করে, বাৎসরিক ৭২,০০০ টাকা সরাসরি ট্রান্সফার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। 

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কিন্তু ন্যায়ের চরম বিরোধিতা করে এই বলে যে এর ফলে ভারতের কোষাগারের উপর চাপ পড়বে এবং চরম দুর্নীতি বাড়বে। অথচ প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি নামক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদী’র সরকার ভারতের কৃষকদের মাসে ৫০০ টাকা করে, বছরে ৬,০০০ টাকা, তিন কিস্তিতে দেওয়া শুরু করেছে। শুরুতে লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেলেও, তৃতীয় কিস্তির ক্ষেত্রে আধারের সাথে প্রকল্প কে যুক্ত করার কথা বলে সরকার অনেক কৃষককে এই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া শুরু করে। মোদী’র এই প্রকল্পের ফলে না তো গ্রামাঞ্চলে পণ্য বা পরিষেবার চাহিদা বৃদ্ধির কোন সুযোগ তৈরি হল আর না এর ফলে কৃষকের মূল সমস্যাগুলো, যেমন ফসলের ন্যায্য দাম, কৃষি ঋণ মকুব বা সেচের বন্দোবস্ত হল। 

যদিও ন্যায় প্রকল্পে সরকার কে বাৎসরিক ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হবে বলে বিজেপি চিৎকার শুরু করে ও দেশের ধনী ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, ক্ষমতায় ফিরেই যে মোদী সরকার কর্পোরেট করের উপর ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে কোষাগারের ১.৪৬ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি করে আর সরকারের আর্থিক বছরের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ যে ৩.৩% এ বেঁধে রাখার প্রস্তাব ছিল তা বকলমে উল্লঙ্ঘন করে, তার বেলায় কিন্তু কোন হট্টগোল হয় না।

বর্তমানে ভারতের অর্থনীতির উপর এক কালো ঘন মেঘ জড় হয়েছে। মোদী’র বিধ্বংসী নোটবন্দি ও জিএসটি প্রচলনের ফলে যে ব্যাপক ক্ষতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে হয় তার ফলে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হন। এর ফলে কিন্তু বাজারে চাহিদার একটা ভাটার সৃষ্টি হয় কারণ মানুষের হাতে খরচের যোগ্য অর্থ কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবে কম হতে থাকে। এর ফলে বর্তমানে গাড়ি, ক্রেতা সামগ্রী, পোশাক সহ বহু শিল্পে ব্যাপক মন্দা দেখা দেয় ও আরও অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে রাস্তায় চলে আসেন। 

এই মন্দার পরিণাম তরঙ্গের মতন বারবার করে ঘুরে ফিরে অর্থনীতি কে আঘাত করতেই থাকবে ও এর থেকে চট করে একটু স্বস্তি পাওয়ার জন্যেই দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র সার্বজনীন মৌলিক আয় কিন্তু কাজে আসতে পারতো। বিশেষ করে যখন এমএনরেগা’র মতন সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পে সরকারি খরচের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। 

বর্তমানে যদি দরিদ্র মানুষের কাছে মাসিক কিছু অর্থ আসে তাহলে তাঁরা সেই অর্থ খরচ করবেন এবং এর ফলে বাজারে পণ্যের চাহিদা ফিরবে ও তার ফলে আবার শিল্পে কর্মসংস্থান হবে। যত কর্মসংস্থান হবে তত বেশি চাহিদা সৃষ্টি হবে আর তার ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি, নতুন কোন আঘাত না পাওয়া পর্যন্ত, ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কেনিয়াতে বর্তমানে এই রকমই একটি পরীক্ষা চালাচ্ছেন দুফ্লো ও ব্যানার্জি, অথচ ভারতে এর প্রয়োজন থাকলেও সরকারের উদাসীনতায় দরিদ্র মানুষের অর্থ কষ্ট ও বেকারত্বের সমস্যা দিন-দিন বেড়েই যাবে। 

যদিও দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্ব দিয়ে বর্তমানের চাহিদার সঙ্কটের সময়ে একটি সাময়িক সুরাহা পাওয়া সম্ভব তবুও একথা বোঝা উচিত যে এই তত্ত্বের মূল লক্ষ্য কিন্তু দরিদ্র মানুষ কে রক্ষা করা নয় বরং জনগণের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি কে বাঁচিয়ে রাখা। সরকার অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প গড়ে মানুষ কে কর্মসংস্থান দিয়ে, একটি পরিকল্পিত অর্থনীতি গ্রহণ করে জনগণ কে বাজারের অনিশ্চয়তা, চলমান ও চক্রাকারে আবর্তনশীল সঙ্কট থেকে মুক্তি দিচ্ছে না, উৎপাদনের উপকরণের উপর শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কায়েম করছে না, পণ্যের ও অর্থের বন্টনে সমাজের ভূমিকা কে প্রধান করছে না, বরং সামাজিক অর্থ দিয়ে বেসরকারি ক্ষেত্র কে বৃদ্ধি পেতে ও পুঁজি কে সঙ্কট মুক্ত হতে সাহায্য করছে। এর ফলে দরিদ্রের ক্ষমতায়ন হচ্ছে না, দরিদ্র কে দিয়ে বরং ধনীর সঙ্কট মোচন করানো হচ্ছে। 

দুই দিক থেকে বস্তু কে দেখলে তার দুটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র নীতি পুঁজির একচেটিয়া শোষণ ও শাসন বজায় রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে মাইক্রো-ইকোনোমিক সমস্যার, চাহিদার সমস্যার সমাধান করার জন্যে। তবে কেইনেসিয়ান অর্থনীতির মতনই দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্ব আসলে ঠেকা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি কে চরম সঙ্কট থেকে ও গরিব মানুষের বিদ্রোহ থেকে বাঁচানো ছাড়া আর কিছুই না। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি কে আজ দ্বান্দ্বিক ভাবে বোঝাই যথেষ্ট নয়। আজ জরুরী কর্তব্য হল দরিদ্র মানুষের অর্থনীতি আসলে কী সেটা প্রতিষ্ঠা করা জনসমক্ষে। মার্কসবাদ কে বাদ দিয়ে, সমাজতন্ত্র কে বাদ দিয়ে, শ্রমিকশ্রেণীর শাসনে নতুন সমাজ না গড়ে যে দারিদ্র্য মোচন হয় না, দরিদ্র মানুষের, শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট লাঘব হয় না, অনাহার, অশিক্ষা, হিংসা ও বিদ্বেষের কোন সুরাহা হয় না তা বাংলার মানুষ কে বোঝানো একান্তই জরুরী।

গেটস ও মোদী'র স্বচ্ছ ভারতের অস্বচ্ছতা

শনিবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


বিল গেটস খুবই মহান একজন মানুষ। কর্পোরেট হয়েও কটন টি শার্ট পরেন, দেখেছ কত দান ধ্যান করেন। বিল গেটস এর দানধ্যানের পরিমাণ অনেক দেশের সরকারের বার্ষিক বাজেটের থেকেও অনেক গুণ বেশি। তা তিনি নরেন্দ্র মোদী'র মত একজনকে কি না গ্লোবাল গোলকিপার প্রাইজ দিয়েছেন! ভালো লোকেরা এতে করে খুবই আশাহত হয়েছেন। বিল গেটস কে তাঁরা চিঠি লিখেছেন যাতে বিল গেটস দুষ্টু লোক মোদীকে এই প্রাইজ দিয়ে গাছে না তোলেন। ভালো লোকেরা কথাটা একেবারেই ঠিক বলেছেন। কারণ, "স্বচ্ছ ভারত অভিযান" এর নাম করে অক্ষয় কুমারের প্রোমোশন ছাড়া আর যেটা হয়েছে সেটা প্রত্যক্ষ করলে অতি বড় ভক্তেরও ধোকলার দলা গলা দিয়ে নামতে একটু বেশি জল লাগবে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই স্বচ্ছ ভারতের নাম করে গরিব, দলিত, আদিবাসী ও মুসলমানদের ওপর মতাদর্শগত অনাচার আর ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনির খুনখারাবি অনেকাংশেই সরকারি মদতে বেড়ে চলেছে।

কী বললেন? প্রমাণ চান। আসুন কিছু নমুনা চেখে দেখুন।


নমুনা এক। রাজস্থানে গণপিটুনিতে খুন জাফর খান। বয়েস ৫৫, পেশা শ্রমিক, বাসস্থান বস্তি। অপরাধ - স্বচ্ছ ভারত কর্মচারীদের বাধা দিয়েছিলেন যাতে তারা খোলা মাঠে পায়খানা করার সময়ে মহিলাদের ছবি তুলে তাদের শেমিং না করে। এই অপরাধে জাফর খানকে পিটিয়ে মেরে ফেলে স্বচ্ছ ভারতের কর্মচারীরা। না, কেউ শাস্তি পান নি। জাফর খানের স্ত্রী (তিনিও শ্রমিক) সরকারি ক্ষতিপূরণ সরকারের মুখে ছুঁড়ে মেরেছেন।


নমুনা দুই। ম্যানহোল কর্মীরা (যারা ১০০% দলিত, না না এই পেশায় সংরক্ষণ বিরোধী বামুন-কায়েতরা চাকরির দাবিতে হইচই করেন না) বার বার পথে নেমে জানিয়েছেন যে স্বচ্ছ ভারতে প্রতি তিন দিনে একজন করে সাফাই কর্মীর ম্যানহোলে নেমে মৃত্যু হয়। এগুলি মৃত্যু নয়, হত্যা। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দলিত শ্রমিকদের হত্যা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কী করা যাবে বলুন, সরকারের চাঁদে যাওয়ার টাকা আছে কিন্তু ম্যানহোল সাফাইয়ের রোবট নেই। অগত্যা গ্লোবাল গোলকিপার মোদীজি ক্যামেরার সামনে পাঁচজন সাফাইকর্মীকে জড়সড় বসিয়ে তাদের পরিষ্কার পায়ে জল ঢালার অপমান করেন। কিন্তু ম্যানহোল শ্রমিকদের হত্যা হতেই থাকে। এই হত্যায় কারুর শাস্তি নেই, সেটা হয়তো সবাই জানে, এবং মানে।


নমুনা তিন। সম্প্রতি গোবলয়ের মধ্যপ্রদেশে এক নতুন ধরনের গণপিটুনির আমদানি হয়েছে। স্বচ্ছ ভারতের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনিরা এবার দলিত আর আদিবাসী শিশুদের মাঠে পায়খানা করার অপরাধে পিটিয়ে পিটিয়ে মারছে। গ্লোবাল উইকেটকিপার ঘোষণা করে দিয়েছে দেশ এখন এতই স্বচ্ছ, যে বাপুজির নাম রৌশন করতে সকলেই স্বচ্ছতার চৌকিদার। অতএব গতকাল ১৮ মাসের আদিবাসী শিশু ভগওয়ান সিং এই অপরাধে খুন হয়েছে। গত সপ্তাহে একই অপরাধে যাদবদের পিটুনিতে খুন হয়েছে ১০ বছরের অবিনাশ আর ১২ বছরের রোশনী।


"জীবনের ইতর শ্রেণীর মানুষ তো এরা সব
ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে।"   


অতএব গ্লোবাল গোলকিপার মোদীজির গরিবের রক্তে রাঙা হাতে গ্লোবাল মসীহা বিল গেটস কিনা প্রাইজ তুলে দিলেন।

ভালো মানুষরা হয়ত মনে রেখেছে যে বিল গেটস কয়েক দশক ধরেই ভারতের গরিব, দলিত, আদিবাসি এই তিন বর্গের মহিলাদের স্বাস্থ্যোদ্ধারের নাম করে কি লীলাখেলাই না করেছেন। ভগওয়ান সিং, রোশনী আর অবিনাশদের অতিরিক্ত ও অবাঞ্ছিত জন্মের ফলেই নাকি ওদের গরিবি - গলে পচে গন্ধ বেড়িয়ে যাওয়া এই ম্যালথুসিয় তত্ত্বের কর্পোরেট ফেরিওয়ালা বিল গেটস তার প্রবল পরাক্রমশালী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ভগওয়ান সিং, রোশনী আর অবিনাশদের মায়েদের কখনও বিপজ্জনক, প্রথম বিশ্বে বাতিল হয়ে যাওয়া কন্ট্রাসেপটিভ ট্রায়ালের গিনিপিগ বানিয়েছেন, কখনও সরকারি স্বাস্থ্যনীতিকে প্রভাবিত করে তাঁদের শরীরকে বিনামূল্যের পরীক্ষাগার বানিয়েছেন আজীবন-কাজ-করে-চলা ক্ষতিকারক হর্মোনাল কন্ট্রাসেপটিভ বেচা কোম্পানিদের জন্য। এই বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানিগুলিকে মহানুভব বিল গেটস গ্যারান্টি দিয়েছেন ২০৩০ সালের মধ্যে কত কোটি মহিলা ক্লায়েন্ট এর কাছে তাঁরা এই কন্ট্রাসেপটিভ বেচতে পারবেন, তার। কীসের জোরে তিনি আমাদের দেশের মেয়েদের নিয়ে এই গ্যারান্টি দেওয়ার ধক রাখেন? উত্তরটা এই লেখার শুরুতেই আছে।   


মহানুভব বিল গেটসরা যে স্বাস্থ্যনীতি সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের গরিব, দলিত, আদিবাসি, সংখ্যালঘু মহিলাদের ওপর চাপিয়ে দেন, তার ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি খুন হয়েছেন অসংখ্যা মহিলা। আমাদের দৃষ্টির অগোচরে আশির দশক থেকেই এই খুনগুলি হয়ে চলেছে। শুধুমাত্র বড় বড় ঘটনা ঘটলে দু'চার দিনের জন্য তা হয়তো খবরে এসেছে, আবার হারিয়ে গিয়েছে। যেমন ২০১৪ সালে ছত্তিসগড়ে 'পরিবার পরিকল্পনা'-র নাম করে স্টেরিলাইজেশন ক্যাম্পে মহিলাদের গণহত্যা সংগঠিত হয়। গেটস সাহেবের গ্লোবাল গোলকিপিং এর টার্গেট ফুলফিলমেন্ট এর চাপ থাকে, বুঝতেই পারছেন। তাই গরিব, আদিবাসি মেয়েদের হাজার টাকা করে দিয়ে ক্যাম্পে আনা হয়েছিল। ক্যাম্পে আসার পর চড় থাপ্পড় মেরে, জোর করে ঠেলে শুইয়ে বন্ধ্যাত্ব করানো হয়। বিষাক্ত ওষুধে ১৫ ওখানেই খুন, আরো ১০০ জনের অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ে। পরে অবশ্যই সেই খবর চাপা পড়ে যায়।


গ্লোবাল গোলকিপারদের মহাগুরু বিল গেটসরা ভারতে আরও অনেক গুরুতর খেলাতেই নিমজ্জিত। তা সে ডিজিটাল ভারতের নাম করে কৃষক ব্যাংক বা কৃষিঋণ নিয়ন্ত্রণ করাই হোক, বা সার-বীজ-চাষ নিয়ে খবরদারি করাই হোক। যেগুলিকে আপনি ভাবছেন মোদীজির স্কিম, সেগুলি বেশিরভাগই গেটসজি-দের স্কিম আসলে। টয়লেট বানানোর কেসটাও তাই।   


ভালো লোকদেরও অনলাইন পিটিশন ছাড়া কিছু করার নেই আসলে। ভারতের জনস্বাস্থ্য, ফার্মা কোম্পানি, কৃষিবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, স্বচ্ছ টয়লেটের ডিজাইন, ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং, আধার টাধার মিলিয়ে গরিবের রক্ত খাওয়ার গবেষণা খাতে, গেটসজি-র অনেক টাকাই ঢালা আছে। এই বিষয়ক মিডিয়ার বৃহৎ অংশেও তার টাকা কাজ করছে। অনেক সময়েই শিক্ষিত ভালো লোকদেরও এই সব ফেলোশিপের টাকায় গবেষণা, পলিসিমেকিং, সাংবাদিকতা ইত্যাদি করতে হয় বইকি।


আমাগো গুজরাতের গ্লোবাল উইকেটকিপার গেটসজি-র কাছে নস্যি।

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হলেই কি রক্ষা পাবেন হিন্দু বাঙালিরা?

শনিবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


বাংলাদেশ থেকে এসে যারা এদেশে বসবাস করছেন তাঁদের সংখ্যাটা যাই হোক না কেন তাঁরা সকলেই মূলত হিন্দু। তাঁরা নাগরিক অধিকার ও পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন লড়াই আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। 

বাংলার পরিস্থিতি আসামের বিপরীত। আসামে খেদানোর আন্দোলন হয়েছে, আর বাংলায় হয়েছে গ্রহণ করে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন। ২০০৩ সালে বড়ো আঘাত আসে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। নিঃশব্দে। নাগরিকত্ব আইন (১৯৫৫)-তে দুটি নতুন কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। মূল আইনে ২ ধারায় একটি অংশ জুড়ে দিয়ে বৈধ পাসপোর্ট ছাড়া এদেশে আসা বা বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে এসে মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও থেকে যাওয়া সকলকে “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং মূল আইনের ১৪ ধারায় ১৪(ক) ধারা যুক্ত করে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও জাতীয় পরিচিতিপত্র চালু করার কথা বলা হয়। তৎকালীন ভারতীয় জনতা পার্টি'র (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট  সরকার এই সংশোধন আনে। দেশের সমগ্র গণজন ও বিশেষ করে বাংলার উদ্বাস্তু আন্দোলনের বিরুদ্ধে এ এক নিপুন সার্জিকাল স্ট্রাইক।

এখন নতুন করে আবার নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনার কথা বলছে বিজেপি। সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট বিল ২০১৬, সংক্ষেপে ‘ক্যাব’। এই সংশোধনে তিনটি মূল কথা আছে। প্রথমত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে পালিয়ে আসা হিন্দু (এবং আরও পাঁচটি) ধর্মের মানুষকে “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে গণ্য করা থেকে নিস্কৃতি দেওয়া, দ্বিতীয়ত এরকম আশ্রয়প্রার্থী'র ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ভারতের নাগরিকত্ব দাবী করার জন্য ন্যুনতম বসবাসকাল ১১ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করা, এবং তৃতীয় ধারাটি হল ‘প্রবাসী ভারতীয় নাগরিক’ কার্ড প্রাপ্তরা কোনও ভারতীয় আইন ভঙ্গ করলেই তাঁদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দিতে পারবে সরকার। 

নতুন এই সংশোধনী প্রস্তাব ভারতের সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদের উল্লঙ্ঘন করে, কারণ নির্দিষ্ট একটি ধর্মের মানুষকে (মুসলমানদের) আইনটি এক চোখে দেখছে আর হিন্দু সহ বাকি ধর্মের মানুষকে অন্য চোখে দেখছে—এরকম সম্প্রদায়ভিত্তিক বৈষম্য ভারতীয় সংবিধান অনুমোদন করেনা। কিন্তু সে প্রশ্নে বিস্তারিত চর্চা না করে, যদি ধরেই নেওয়া যায় যে এই সংশোধনী শেষ পর্যন্ত পাস করিয়ে নেবে বিজেপি সরকার, তাহলেই বা বাংলার উদ্বাস্তুরা প্রকৃতপক্ষে কী পাবেন? 


তাঁদের আর “ইল্লিগাল ইমিগ্রান্ট” হিসেবে গণ্য করা হবেনা একথা ঠিক কিন্তু তারা কি ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়ে যাবেন? না। তাঁরা “ইমিগ্রান্ট” হিসেবেই গণ্য হবেন। ইল্লিগাল না হলেও ইমিগ্রান্ট। এমনকি ‘শরণার্থী’ বা ‘রিফিউজি’-ও নয়। কারণ, ‘শরণার্থী’ শব্দটিই এখনও ভারতের কোনও আইনে বর্ণনা করা নাই এবং শরণার্থী প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সনদেও ভারত এখনও স্বাক্ষর করেনি। 'ক্যাব' পাস হলেও তাদের প্রথম ঘোষণা করতে হবে যে তাঁরা  বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন। ঘোষণা করতে হবে যে তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের ভয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছেন।তারপর, ছয় বছর ইমিগ্রান্ট হিসেবে বসবাস করার পর তাঁরা আবেদন করতে পারবেন ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার। ‘ক্যাব’ তাদের এটুকুই এগিয়ে দেবে।

এটা কি এগিয়ে দেওয়া? নাকি উদ্বাস্তু অধিকারের আন্দোলনকে দুর্মুশ করে দেওয়া? নতুন এই সংশোধনী বিল সম্পর্কে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি (জেপিসি) ৮ জানুয়ারি ২০১৯ তাঁদের রিপোর্ট পেশ করে। সেখানে তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে এই সংশোধনী পাস হলে মোট ৩১,৩১৩ জন, যারা ইতিমধ্যেই আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন এবং লং টার্ম ভিসা গ্রান্ট করা হয়েছে, তাঁরাই উপকৃত হবেন। 

জেপিসির প্রশ্নের উত্তরে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) স্পষ্ট ভাষায় লিখে জানিয়েছে যে এই ৩১,৩১৩ জন ছাড়া “বাকি সকলকে এই ক্যাটেগরিতে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হলে তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের ফলে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ভারতে ঢোকার সময় যদি তারা একথা ঘোষণা করে না থাকেন তাহলে এখন সেরকম দাবী করাটা সহজ হবেনা। ভবিষ্যতে এরকম দাবী এলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে অবশ্যই তাকে R&AW (র) সহ বিভিন্ন সংস্থার স্ক্রুটিনির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে”। 


আই বি আরও জানায় যে যাঁরা ইতিমধ্যেই ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, ইত্যাদি পেয়ে গেছেন তাঁরা এই ‘ক্যাব’ ক্যাটেগরিতে পড়বেন না এবং তাঁদের ওইসব কার্ড অবৈধভাবে করা কি না তা খতিয়ে দেখা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয় এবং তা করার জন্য ফরেনার্স ট্রাইবুনাল আছে (জেপিসি রিপোর্ট, ২ দাগের ১৭-১৯ পয়েন্ট, পৃষ্ঠা ৩৯)।

পহেলা অক্টোবর অমিত শাহের সভাগৃহে যারা উপস্থিত হয়েছিল তারা কেউই “এনআরসি চাই” বলে গলা মেলাতে পারেনি বিজেপি সভাপতির সাথে। সভাপতি বারবার “জোরসে বোলো, জোরসে বোলো” করছিলেন বটে কিন্তু সাড়া পাননি। কিছুক্ষণের মধ্যে সভায়তন ফাঁকা হয়ে গেছিল। এই হতাশার ধাক্কায় পর দিন ঠাকুরনগরে একটি এনআরসি-বিরোধী ওয়ার্কশপে হামলা চালিয়ে উদ্বাস্তু আন্দোলনের পরিচিত মুখ তথা এনআরসি ও ক্যাবের বিরুদ্ধে মুখর ব্যক্তিত্ব শ্রী সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস এবং মতুয়া মহাসঙ্ঘের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বালা ঠাকুরের ওপর হামলা চালায় সেখানকার বিজেপি নেতৃত্ব। এই ওয়ার্কশপে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সামাজিক সংগঠনের উপস্থিতি দলিত-মুসলমান ঐক্যের যে বার্তা ছড়াচ্ছিল, তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে। 

এই হামলা থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এনআরসি ও ক্যাব নিয়ে বিজেপির অপপ্রচার বাংলার নমশুদ্র সমাজে তেমন গ্রহণযোগ্য হচ্ছেনা। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজ ও পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী ও মাহাতো সমাজকে বিজেপি নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা তো ভূমিপুত্র, তাদের নাম তো আর বাদ যাবেনা! তবে ধীরে ধীরে সকলেই বিজেপির ধোঁকাবাজী ধরে ফেলছে।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে