কাশ্মীর নিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে

সোমবার, জুলাই ২৫, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

চারিদিকে রক্তের বন্যা বইছে, গলির ভেতর থেকে ছুটে আসছে একটি একটি করে ছোট ছোট কিশোর, তাঁদের ছোট ছোট মুষ্টিতে ধরা রয়েছে পাথর, সেই পাথর তাঁরা সজোরে ছুড়ছে একরাশ ঘৃণার সাথে। লক্ষ্যবস্তু হলো বিশ্বের তথাকথিত দ্বিতীয় বৃহৎ গণতন্ত্রের স্বয়ংক্রিয় রাইফেলধারী ফৌজি, যে ফৌজি ওই কিশোরদের গুলি করে গর্বিত বোধ করে, হাজার হাজার মাইল দূরে নিজের গ্রামে বা শহরের উচ্চবিত্তদের কাছে দেশপ্রেমের শংসাপত্র পায়। কখনো কখনো লিবিডোর তাড়নায় নচ্ছার কিশোরগুলোর মা ও বোনেদের গণধর্ষণ করে দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্রের ছত্রে ছত্রে ধ্বনিত পুরুষতন্ত্রের পাঠ পড়াবার কাজও এই গণতন্ত্র ও শান্তির রাইফেলধারী ফৌজিরা করে। এলাকার নাম কাশ্মীর। মাটিতে এখানে রক্তের গন্ধ।

Protest against massacre of Kashmiri people by Indian forces
Photo Credit: Kafila.org



কাশ্মীরের কথা আলোচনা করলেই ভারতবাসীর, বিশেষ করে সাবর্ণ উচ্চবিত্ত মানুষদের মধ্যে সেঁধে থাকা সুপ্ত ব্রাহ্মণত্ববাদ হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আর সজোরে চিৎকার করে কাশ্মীরি মানুষদের, ম্লেচ্ছ মুসলমান মানুষদের, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলকে গুলি আর বোমা দিয়ে মেরে শিক্ষা দেওয়ার, ভারতীয়ত্ব প্রকাশ করার ওকালতি করে। এই ধরুন সকালের চায়ের দোকানের আড্ডায় পল্টু, বুবাই, বিট্টু, কিংবা ধরুন ব্যানার্জি বাবু, সেনগুপ্ত বাবু, গাঙ্গুলিদা, মুখার্জিদাদের আলোচনা যদি শোনেন তাহলে শহর, পাড়া, আর রাজনৈতিক ঝান্ডা নির্বিশেষে শুনবেন কাশ্মীর নিয়ে সেই এক রা, কাশ্মীর কে দখলে রাখতেই হবে, যদি তার জন্যে সমস্ত কাশ্মীরী জনতাকে প্রাণে মারতে হয় তাহলে তাই সই, মানুষের চেয়ে ভূখণ্ডের দাম বেশি।

গত ৮ই জুলাই বুরহান ওয়ানি নামক ২২ বছরের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী। ওয়ানি ১৬ বছর বয়সে ঘর বাড়ি ছেড়ে কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইয়ে সামিল হয় এবং বেশ কিছু দিন ধরে সে কাশ্মীরের যুব সমাজের কাছে এক নিদর্শন হয়ে ওঠে। কাশ্মীরের জনতার কাছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে রোজ রোজ লাথি জুতো খেয়ে বেঁচে থাকার গ্লানি মুছে দেওয়ার এক নাম হয়ে ওঠে ওয়ানি। ভারত সরকার স্বভাবতই তাঁকে মেরে ফেলতে চাইছিল, আর মুসলমানদের উৎসব ঈদের সময় ওয়ানিকে বুলেট বিদ্ধ করে সেই কাজ সমাপ্ত করে ভারতীয় বাহিনী।

ওয়ানির মৃত্যুর বিরোধিতা করে সমগ্র কাশ্মীর রাস্তায় নেমে আসে, প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতির বিরুদ্ধে। ৫০,০০০ এর উপর মানুষ বুরহান ওয়ানির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সমবেত ভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের বুকে জমে থাকা ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ করেন। ভারতীয় বাহিনী গণতন্ত্র রক্ষার দোহাই দিয়ে শুরু করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা। বেসরকারি সূত্রে প্রায় ৫০ জন কাশ্মীরি, যাদের গড় বয়স ১৫ থেকে ২৩ এর মধ্যে, তাঁরা এই গুলি চালনায় নিহত হন। গুলির সাথে সাথে ছররা চালানো হয় প্রতিবাদীদের চোখ লক্ষ্য করে এবং এর ফলে ৬০০ জন প্রতিবাদী কাশ্মীরি মানুষ চিরকালের মত দৃষ্টিহীন হয়ে যান, যার মধ্যে একটি পাঁচ বছরের বাচ্চাও আছে। ভারতের উচ্চ জাতির হিন্দু সমাজের কাছে এই আক্রমণ যথার্থ ভাবে “ভারতীয় স্বার্থ”  বা সোজা কথায় ব্রাহ্মণত্ববাদী একনায়কতন্ত্র রক্ষা করার সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায়। তাঁদের কাছে রক্তে ভেজা শিশুর মৃতদেহ আসলে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় গণতন্ত্রের জয় ধবজ্জার স্বরূপ। সমগ্র দেশেই কাশ্মীরের জনতার বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণত্ববাদী শাসকশ্রেণীর এই ঘৃণা ফেটে পড়ছে।

ব্রাক্ষণত্ববাদী ভারতের শাসকশ্রেণী শুধু কাশ্মীরি জনগণ কেই হত্যা করেনি, বরং অহমীয়, মিজো, মণিপুরী, নাগা, খাসি, গারো, প্রভৃতি জনজাতির জনতার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে পরিচালিত সংগ্রামগুলো দমন করতে বিভিন্ন সময়ে চরম হিংস্র ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, খুন করেছে অসংখ্য মানুষকে। সেনা বাহিনীকে খুন ধর্ষণ করার ছাড়পত্র দিয়ে মণিপুরে সন্ত্রাসী রাজ কায়েম করেছে, মিজো জনতার উপর বিমান হানার মাধ্যমে বোমাবর্ষণ করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, নাগা জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, খাসি ও গারো মহিলাদের গণধর্ষণ করে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী। আর প্রতিবারের হত্যার সময়ে ভারতের শাসকশ্রেণী দেশপ্রেমের আর হিন্দি-হিন্দু রাষ্ট্রের জিগির তুলে দেশের উচ্চ জাতির উচ্চবিত্তদের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে ওঠে। কাশ্মীরের মানুষ মুসলমান হওয়ায় এবং পাকিস্তানের নিকটবর্তী হওয়ার ফলে উপত্যকায় হত্যা ও ধর্ষণের সংখ্যা বাড়িয়ে কাশ্মীরের বিদ্রোহী মানুষকে বাগে আনার প্রচেষ্টায় দেশ জুড়ে হিন্দুত্ববাদের জোয়ার তোলার কাজে ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসকশ্রেণীর বেশি অসুবিধে হয়নি। এই কাজে দেশের সিনেমা, সাহিত্য, ও সংবাদ মাধ্যম পুরোপুরি ভাবে রাষ্ট্র যন্ত্রের পক্ষের গল্পকে উচ্চ জাতির হিন্দুদের, মধ্যবিত্তদের গুলিয়ে খাওয়াতে উঠে পড়ে লাগে। এর ফলে কাশ্মীর থেকে সহস্র মাইল দূরে বসে বোম্বাই, মাদ্রাজ, কলকাতা, বা দিল্লির মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষেরা রায় দিতে থাকে যে কি ভাবে কাশ্মীরের মানুষকে বাগে রাখা উচিত এবং কেন কাশ্মীরের মানুষের স্বার্থ ভারতের সাথেই সুরক্ষিত থাকবে। ব্রাক্ষণত্ববাদের কাছে ষোলো আনায় আঠারো আনা লাভ।

কাশ্মীরের সংবাদ পরিবেশনের সময়ে ভারতের কর্পোরেট ও ব্রাক্ষণত্ববাদী প্রচার মাধ্যম চরম ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদ প্রচারের রাস্তায় নামে, কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি তোলাকে পাকিস্তানের দালালি করা বলে, মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম কে পাকিস্তানের টাকায় চলা আন্দোলন বলে, আর বিক্ষুব্ধ মানুষদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেয়। ১৯৯০ এর দশকে যখন ভারতীয় গণতান্ত্রিক মডেলের ভাঁওতাবাজি আর বন্দুকের জোরে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে হাতে হাতিয়ার তুলে নিয়ে দলে দলে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করে ঠিক সেই সময়ের থেকে ভারতের কর্পোরেট মিডিয়ায় এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারীদের জঙ্গী বা উগ্রপন্থী বলা হতো। কিন্তু এই শতাব্দীর শুরুতে যখন বাজপেয়ির নেতৃত্বে প্রথম বিজেপি সরকার কায়েম হয় আর ব্রজেশ মিশ্র ও কাঞ্চন গুপ্তদের মতন হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডা বাহকদের মদতে আরএসএস ইসরায়েলের সাথে সরকারি ভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কে শক্তিশালী করার কাজে আঁচ দেয় ঠিক তখন থেকেই আদবানি সাহেবের নির্দেশ অনুসারে ও বিশ্ব জুড়ে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাশ্মীরের আন্দোলনকারী উগ্রপন্থীদের হঠাৎ করে সন্ত্রাসবাদী তকমা দেওয়া শুরু হলো হোয়াইট হাউসের দয়া ও দক্ষিণা লাভ করে কাশ্মীরের উপর ভারতীয় প্রভুত্ব কে প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে। বিজেপির পরে যখন মনমোহনের কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসে তখনও ওই ইসরাইলি কায়দায় কাশ্মীর কে দখলে রাখা ও কাশ্মীরি জঙ্গী বা প্রতিবাদী মানুষদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে হত্যাকান্ড চালাবার প্রক্রিয়া জারি থাকে। হাতে গোনা কয়েকটা প্রচার মাধ্যমে যদিও এই সন্ত্রাসবাদীর জায়গায় জঙ্গী বা উগ্রপন্থী কথাটা শোনা যেত তাও নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতা দখল করার পর থেকে আচমকা কেমন উবে গেছে।

কাশ্মীরি জনতাকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে সমগ্র কাশ্মীরের মানুষের স্বাধীনতার দাবিতে চলতে থাকা সাত দশকের সংগ্রাম কে কালিমালিপ্ত করে যেমন ভারতের ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসকশ্রেণী একদিকে উচ্চ জাতির হিন্দুদের মধ্যে উগ্র দেশপ্রেমের জিগির তুলে নিজেদের পাপ কে পুণ্য হিসেবে চোলাই করার প্রচেষ্টা করছে অন্যদিকে ঠিক তেমনি করেই ভারতের শাসকশ্রেণী দেশের ভিতরে ও বাইরে কাশ্মীরের জনগণের জাতি সংঘের নিয়ম নীতি অনুসারে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবির সমর্থনে কোনো প্রকারের আলোচনা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কে জায়গা দিচ্ছে না। মেকি গণতন্ত্র কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা করতে চায় না কারণ কাশ্মীরের মাটিতে ভারতের শাসক শ্রেণী মাও সেতুঙের বিখ্যাত  “বন্দুকের নল থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে” উদ্ধৃতির স্বরূপ চিনিয়েছে জগৎ কে। ভারতের শাসকশ্রেণী অহমীয়, মিজো, মণিপুরী, নাগা, কুকি, প্রভৃতি জাতিসত্তার আন্দোলন কে হিংস্র ভাবে দমন করতে যে পন্থা অবলম্বন করেছিল ইতিহাসে বারংবার, তার চেয়ে সবচেয়ে হিংসাত্মক পথ কাশ্মীরে চলা শুরু করেছে। একের পর এক প্রজন্মের মনে হীনতা ও গ্লানিকে চরম ভাবে ইঁট পাথর দিয়ে গেঁথে নিজের হিন্দুত্ববাদী দর্শনের বিজয় পতাকা ওড়াতে চাইছে। কাশ্মীরের মানুষের বেশিরভাগই মুসলমান, আর ১৯৪৭ থেকেই কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে চরম ভাবে প্রোথিত করে ভারতের শাসকশ্রেণী। প্রথমে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় জম্মু অঞ্চলে হাজারো হাজারো মুসলমান মানুষদের হত্যা করে এবং তাঁদের বাড়ি ঘর দখল করে আর তারপর ১৯৮৫ সালের পর থেকে পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর সাথে তালমিল ঠিক রেখে হাজার হাজার কাশ্মীরি পন্ডিতদের ঘরছাড়া করিয়ে। জম্মুর মুসলমানরা কোনোদিন ফেরত আসার জন্য কোনো আমন্ত্রণ পাননি কারণ জম্মুতে আগত পাঞ্জাবি হিন্দু ও শিখেদের তাড়নায় তাঁদের পাকিস্তানে পালাতে হয় এবং পাকিস্তানের কাশ্মীর দখল অভিযান শুরু করার পিছনে এই পলায়ন একটি অন্যতম কারণ ছিল। কিন্তু কাশ্মীরি পন্ডিতদের দলে দলে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসার আবেদন জানান কাশ্মীরের মানুষেরা, এমনকি মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগেই বুরহান ওয়ানি নামক মৃত জঙ্গী কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপত্যকায় ফিরে আসার আবেদন জানায় আর অমরনাথ যাত্রায় হিন্দুদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়। তবুও নিজেদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি সার্থক করতে এবং ইসরায়েলের কায়দায় কাশ্মীরে ভারতীয় কলোনি গড়ে তুলে উপনিবেশিকরণের পথ প্রশস্ত করার স্বার্থে ভারতীয় শাসকশ্রেণী আজ অবধি কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপত্যকায় ফেরার কোনো বন্দোবস্ত তো করেইনি বরং কিছু কাশ্মীরি পন্ডিতদের নিজেদের দালাল বানিয়ে সমগ্র সম্প্রদায় কে উদ্বাস্তু হিসেবে দিল্লি, জম্মু, ও অন্যান্য শহরে এক অভাবনীয় সঙ্কটের জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছে। কাশ্মীরি পন্ডিতের জীবন কে দুর্বিষহ করে তুলে কাশ্মীরের মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু ক্ষোভ জিইয়ে রাখার পন্থাই শ্রেষ্ঠ পন্থা হয়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র যন্ত্রের কাছে।

কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে সামগ্রিক ভাবে যে সময়ে কাশ্মীরের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন, সেই ১৯৮০-৯০ এর দশকে, তখন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ কে বামপন্থার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধর্মীয় মৌলবাদকে ব্যবহার করার আফগানিস্তানের সিআইএ এর লাইন কে কাশ্মীরে প্রয়োগ করে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। উদ্দেশ্য ছিল ভারতের শাসকশ্রেণী কে ল্যাং মেরে পাকিস্তানের ভিতরে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তি। এই চালে কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইয়ে বিভেদের সৃষ্টি হয় এবং পাকিস্তানের জুজু দেখিয়ে কাশ্মীরে নির্বিচারে গণ হত্যা করার সমর্থন ভারতের শাসকশ্রেণী আদায় করে। দীর্ঘ ২৬ বছর পরেও কাশ্মীরের সংগ্রাম নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে কানাগলিতে ঘোরাঘুরি করছে। একদিকে আছে পাকিস্তানের সমর্থনে চলা ইসলামিক উগ্রপন্থী আন্দোলন আর অন্যদিকে আছে আপোষপন্থী দালালদের আশ্বাসের রাজনীতি। কাশ্মীরের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা কে বাস্তবায়িত করতে কোনো বিপ্লবী কর্মসূচি নিয়ে কোনো সচেতন লড়াই উপত্যকায় গড়ে ওঠেনি এবং এর একটা বড় দায় কিন্তু ভারতের বিভিন্ন বামপন্থী বিপ্লবী সংগঠনগুলির থেকে যায় যারা কাশ্মীরে ভারতীয় ফৌজের খুন, ধর্ষণ, অত্যাচার নিয়ে সোচ্চার হয়, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে, বা আলোচনা চক্রে যোগ দেয়। এই সংগঠনগুলো কিন্তু মূল উপত্যকায় রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ থেকে নিজেদের অনেক দূরে সরিয়ে রেখে আসলে কাশ্মীরের মানুষকে ভারত ও পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর জুতোর তলায় পিষ্ট হওয়ার জন্য ছেড়ে রাখে। স্বতঃস্ফূর্ত গণ সংগ্রামের লেজুড়বৃত্তি করা ছাড়া ভারতের বাম আন্দোলনে যুক্ত শক্তিগুলো অন্য কোনো ভাবে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইয়ে সহযোগিতা করেনি। ১৯৭০ সালে নকশালবাড়ি আন্দোলনের পৃথিকৃত চারু মজুমদার কাশ্মীরের মাটিতে সামন্ততন্ত্র বিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ার রাজনীতির লাইন রাখলেও শরাফ সহ অন্যান্য সুবিধাবাদী বামপন্থীরা কাশ্মীরের সমস্যায় সামন্ততন্ত্রের যোগ নেই বলে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলতে অস্বীকার করে। এর পর আর কোনো বিপ্লবী আন্দোলনের রাজনীতির প্রভাব প্রবল ভাবে কাশ্মীরে না পৌঁছনোর ফলে এবং সংসদীয় বামেদের চরম আপোষপন্থী নীতির ফলে কাশ্মীরের জনতা ধীরে ধীরে বাম আন্দোলনের থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন।
মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ যখন আফগানিস্তানের মাটিতে ইসলামিক জেহাদের কারখানা খুলছিল সেই সময়ে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারের তরঙ্গ কাশ্মীরের মাটিতেও এসে পৌঁছোয় এবং এতে এক সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর ভীষণ উপকার হয়।

আজ কাশ্মীরের উপর কব্জা ভারতের কাছে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি প্রয়োজন কারণ ১৯৬০-১৯৭০ এর দশকের বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায় ভারতের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে কম ছিল এবং পাকিস্তান ওয়াশিংটনের কাছে সব চেয়ে প্রিয় পোষ্য ছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালে যখন ভারতীয় শাসকশ্রেণী নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির স্রোতে ন্যাংটো হয়ে গা ভাসায় আর পরবর্তীকালে অটল বিহারীর জমানায় যখন প্রবল ভাবে দেশের মাটির এক এক ইঞ্চি বিদেশি পুঁজির কাছে বিক্রি করা শুরু হয় তখন থেকে ভারতের শাসকশ্রেণী মার্কিন বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির শ্রেষ্ঠ দাসে পরিণত হয়। উদার ভারতীয় বাজার, সস্তা কাঁচা মাল আর একেবারে মাগনায় পাওয়া ভারতের শ্রম, এই দেশের সরকার কে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি প্রিয় করে তোলে আমেরিকার কাছে। ফলে আজ চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘুঁটি সাজাতে ভারতের হাতে কাশ্মীরের সামগ্রিক মালিকানা তুলে দিতে মার্কিন বৃহৎ পুঁজির কোন আপত্তি নেই যা পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী কে চাপে রেখেছে। ভারতের শাসকশ্রেণীর কাছে কাশ্মীরের প্রয়োজন শুধু দেশের জনতার নজর সরকারের অপদার্থতার থেকে সরিয়ে রাখার জন্য এবং চীন বিরোধী যুদ্ধে এক মুখ্য রণনৈতিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই এবং এর ফলে ভারত সরকার ক্রমাগত ভাবে সেনা শক্তি বৃদ্ধি করিয়ে কাশ্মীরের উপর নিজের প্রতিপত্তি বজায় রাখতে চাইবে যতই রক্ত ঝরুক না কেন। আর এই দখলদারির বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনতার প্রতিরোধ সংগ্রাম ততদিন পর্যন্ত চোরাবালিতে ঘুরপাক খাবে যতদিন না উগ্রপন্থা ও মৌলবাদের কব্জা থেকে, আপোষপন্থা ও সুবিধাবাদের খপ্পর থেকে বের করে একটা বৈজ্ঞানিক নীতির ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম গড়ে উঠবে। পথে পথে মৃতদেহের সারি বেড়ে চলবে, নালা দিয়ে বয়ে চলবে রক্তের প্রবাহ, ঘরে ঘরে আক্রান্ত হবে নারীর আত্মসম্মান। যদি আমরা সত্যিই এভাবে মানবতার হত্যা হওয়া আর দেখতে না চাই তাহলে বলতেই হয় যে আজ সময় এসেছে কাশ্মীর নিয়ে স্বিদ্ধান্ত নেওয়ার আর কাশ্মীরের মানুষের সাথে একাত্ম হওয়ার, তাঁদের সংগ্রাম কে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যে মানুষকে রাজনীতি দিয়ে শিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করার। এই কাজে আজ সমস্ত গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষ ও সংগঠনকে এগিয়ে আসতেই হবে।

সালাফি ইসলামের জঙ্গীবাদ থেকে বাংলাদেশের মুক্তির পথ কি?

শুক্রবার, জুলাই ০৮, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

বাংলাদেশের ব্যাপার নিয়ে আমি ততদিন বেশি মাথা ঘামাতাম না যতদিন না মৌলবাদীরা একে একে হুমায়ুন, রাজীব, অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, নীলয় নীল, প্রভৃতি মুক্তমনাদের চাপাতির কোপ মারা শুরু করলো। শাহবাগের লড়াইকে পরাস্ত করতে আক্রমণ শুরু হল আর যখন পেট্রোল বোমা বর্ষণ করে সাধারণ মানুষ মারা শুরু হলো।  ২০১৫ থেকে রক্ত ঝড়ানো বেড়ে গেছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৌলবাদীদের উল্লাস। দাড়ি, টুপি, ছহি ইসলামের দোহাই মাড়িয়ে বহুদিন ধরে প্রচেষ্টা চলছে বাংলাদেশের আরবীকরণ করার। আশির দশক থেকেই এই প্রচেষ্টা উপমহাদেশে শুরু হয় আর বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়ার থেকে কোনো ভাবেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। যতদিন গেছে তত বেশি করে ইসলাম ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা করেছে এবং এই কাজে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের চোলা গায়ে চাপিয়ে মার্কিন বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজি ইন্ধন জুগিয়ে গেছে।

যত দোষ নন্দ ঘোষ মার্কা রাজনীতি করে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী জনগণের মধ্যে একটা ধারণা গড়ে তুলতে চাইছে যে সকল সমস্যার জন্যে দায়ী খালেদা জিয়া, যে খোলাখুলি জামাতিদের খুনি বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশে তালিবানি শাসন কায়েম করে দেশটাকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রীর চামচা তৌফিক ইমাম তো ইন্ডিয়ান মিডিয়া কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জামাতি বাহিনীর সাথে সাথে আবার “বামপন্থী জঙ্গীদের” এই চক্রের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলে। অথচ এই দোষারোপের খেলায় খুব আশ্চর্যজনক ভাবে আড়াল হয়ে যায় ইসলামী মৌলবাদের প্রতি আওয়ামী লীগ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপ্ত সমর্থনের কথা।

যখন বাংলাদেশ জুড়ে ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক ও যুক্তিবাদীদের কাঠ মোল্লারা চপার দিয়ে কোপাচ্ছিল তখন অপরাধীদের গ্রেফতার করা তো দূর অস্ত, বরং ধর্মীয় অনুভূতি আহত হচ্ছে বলে অনেক বার প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রকাশ্যেই মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যাকারীদের পক্ষে সওয়াল করেছে। জামাতি আর বিএনপির থেকে কট্টর মোল্লা ভোট নিজের পালে টানতে আওয়ামী লীগ বরাবর নিজেদের বেশি বড় ইসলাম সমর্থক হিসেবে দেখাতে চায়। আর মধ্য প্রাচ্যের সাথে সখ্যতা গড়তে জরুরী হয়ে ওঠে বাংলাদেশ কে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার তাগিদ। এই “ধর্মনিরপেক্ষ” ইসলামিক রাষ্ট্র যে কত বড় বাঁশ তা এক দশক আগেও এত চরম ভাবে টের পাওয়া যায়নি। কথায় কথায় ধর্মীয় অনুভূতির গুঁতো মেরে বাংলাদেশে ইসলামিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত আওয়াজ কে ক্রমাগত দাবিয়ে দেয় হাসিনার সরকার। এর ফলে আরও বেশি উদ্দীপিত হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামী সন্ত্রাস জমি পেয়েছে এবং নিজের পরিধি বিস্তৃত করার সুযোগ পেয়েছে। অবাধে খুন করেছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ , আহমদিয়া, ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ কে। ওয়াহাবি-সালাফি ইসলামের যে কালো ছায়া বাঙালি মুসলমানের জীবনকে গ্রাস করছিল তার বিরুদ্ধে হাসিনার সরকার কোনদিন মুখ খোলেনি পেট্রো ডলার এর সাপ্লাই বন্ধ হওয়ার ভয়ে।

ঢাকার গুলশানে এক রেস্তোরাঁতে হঠাৎ রাতের  আঁধারে যে কয়েকজন সন্ত্রাসী হামলা চালালো তাদের গল্প নিয়ে এখন দুই বাংলার পত্র পত্রিকার পাতা ভরে গেছে আর টিভির পর্দা ছয়লাপ। এই হামলার পিছনে আইএস আছে না আল কায়েদা না জামাতি-আইএসআই যোগ তা নিয়ে তথাকথিত ওস্তাদরা বাজি লড়ছে, তর্ক-বিতর্ক করছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সেই তসলিমা নাসরিনের নির্বাসনের সময় থেকে যে ভাবে ইসলামিক মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তার সবচেয়ে বিষাক্ত অভিব্যক্তি দেখা গেল। এই বিগত কিছুদিন অবধি নিজেদের “বন্দুক যুদ্ধে” জঙ্গী মারা বাঘ প্রতিপন্ন করা রেব ও পুলিশ বাহিনীর আসল ক্ষমতা (পড়ুন অক্ষমতা) সামনে এল আর আরও স্পষ্ট হলো যে কিভাবে মিথ্যা আর প্রতারণার গল্প করে নিরীহ গরিব মানুষকে হত্যা করে আজ অবধি ইসলামিক জঙ্গী সমস্যার ধারে কাছে যেতে পারেনি এই সরকারি বাহিনী।

কিন্তু এই ঘটনার মর্মে যদি ঢোকা যায় তাহলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশের ভিতর দেশি সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই যেমন হয়তো আফগানিস্তানে বা ইরাকে মার্কিন হানার ফলে তৈরি হয়েছে, সিরিয়ায় মার্কিন মদতে তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ভক্ত; বাংলাদেশের কাঁচা মাল, শ্রম, ও বাজার সস্তায় বৃহৎ বিদেশি পুঁজির কাছে উপঢৌকন দেওয়া সরকারকে উৎখাত করার জন্যে কোনদিনই ক্রুজ মিসাইল ছোড়া হয় না, ড্রোনের হামলাও হয় না। ফলে প্রতিশোধের স্পৃহার থেকে বাংলাদেশের ভেতো বাঙালি মুসলমানদের একটা অংশ যে সালাফিবাদে বিশ্বাস নিয়ে আত্মঘাতী জঙ্গী হচ্ছে সে কথা অমূলক। তাহলে কি ইসলামী দীনের আন্তর্জাতিকতাবাদের দোহাই দিয়ে সালাফি ইসলামের প্রবক্তারা বাংলাদেশের মুসলমান যুবকদের জঙ্গী হওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছে? ঘটনা প্রবাহ ও তথ্যগুলো কিন্তু এই দিকেই আঙুল দেখাচ্ছে।

যে ছেলেগুলো সেই রাতে গুলশানের হোলেই এত্তেরি বেকারিতে হামলা করেছিল তারা প্রত্যেকেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা প্রত্যেক তরুণের মতনই জীবন কাটাচ্ছিল, আনন্দ আর হৈ হুল্লোড় করে। আচমকা তারা এক এক করে নিরুদ্দেশ হলো আর তাদের পুনরায় আবির্ভাব হলো সেই অভিশপ্ত রাতের ইশার নামাজের আজানের পর। মুসলমান না মুসলমান নয় এই প্রশ্ন তুলে তারা একের পর এক মানুষকে খুন করলো কুপিয়ে আর গুলি করে। ছহি ইসলামের হুজুরদের ভাষণবাজির মতন সত্যিই নর আর নারীতে আল্লার এই পেয়াদারা কোনো বিভেদ রাখেনি, একত্রে কুপিয়ে মানুষ মেরে এরা সেই মধ্যযুগীয় উল্লাসে মত্ত হয়েছিল। কারণ এদের বদ্ধমূল ধারণা যে কাফের মেরে মরলে এদের কপালে জুটবে ৭২টি সুন্দরী কুমারী, দুধ, সূরা, আর মধুর ঝর্ণা। এদের কাছে জীবনে খেটে খাওয়ার চেয়ে কাল্পনিক পরজীবনের সুখের জীবন বেশি কাঙ্খিত। ছোটবেলার থেকেই পরিবার ও মসজিদে এই বাচ্চারা পরজীবনের নামের এই কাল্পনিক কথাগুলো শিখেছে এবং প্রশ্ন করার সুযোগ না থাকায়, বড়রা যা বলেন, হুজুররা যা বলেন, তা করতে হয় বলে বাকি সমস্ত ধর্মীয় চেতনার মতনই এই ছহি ইসলাম এই সমস্ত বাচ্চাদের গ্রাস করে ফেলে। খেলাধুলো আর লেখাপড়ার চেয়ে বেশি এরা নামাজ পড়া, রোজা রাখা, প্রভৃতি কাজে বেশি মগ্ন হয়ে ওঠে। আর এই সুযোগেই সেই পরকালের স্বপ্নে বিভোর মানুষদের অমানুষ বানাবার কার্যে রত সালাফিরা এদের জঙ্গী বানাতে সক্ষম হয়। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং গোটা বিশ্বেই হচ্ছে। মদতদাতা অবশ্যই সৌদি আরবের রাজ বংশ ও শাসক শ্রেণী যারা নিজেদের একদিকে ইসলামের প্রধান কর্তা হিসেবে দেখতে চায় ও নিজেদের অর্থে নিজেদের ইসলামকে সেই বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকেই পৃথিবীতে রপ্তানি করছে তেলের সাথে, অন্যদিকে এরাই আবার নাটক করে ইসলামিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা ঘোষণা করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পা চাটা এই নেড়ি শেখদের দল গোটা বিশ্বের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার রাস্তা থেকে হুজুরি বাণী শুনিয়ে বিভ্রান্ত করে সরিয়ে আনছে মৌলবাদী সন্ত্রাসের পথে। তাই তো প্যালেস্টাইনে যখন ইসরাইলি বাহিনী নির্মম ভাবে আবাল বৃদ্ধ বনিতাদের হত্যা করছে, মার্কিন বোমা সিরিয়ার মানুষকে ছিন্ন ভিন্ন করছে, তখন কোথাও এই দুই রাষ্ট্র যন্ত্র বা শাসক শ্রেণীর উপর আক্রমণ না করে সাধারণ মানুষ, স্বাস্থ্য কর্মী, রেস্তোরাঁতে বসে থাকা মানুষদের গলা কেটে এই ক্লীব সালাফি ছহি মুসলিমরা আজ বীরত্ব দেখাচ্ছে। আসল জায়গায় হামলা করার মুরোদ নেই কারণ হুজুরেরা বলবে যে কোনো কাফের মেরে দিলেই চলবে ওই ১৪০০ বছর পুরানো বইতে লেখা আছে যে! তাই কে আর আমেরিকা বা ইজরাইলের সাথে লড়তে চাইবে? রাস্তায় একখানা হিন্দুরে কুপিয়ে বীরত্ব প্রদর্শন হয়ে যাবে আর জান্নাতে ৭২টি হুরের সাথে বুকিং তো পাক্কা।

সালাফি ইসলামের প্রচার কারকরা বাংলাদেশ সহ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে পঙ্গপালের মতন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কারণ হলো এই উপমহাদেশের আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের কারণে এক বিশাল সংখ্যার পিছিয়ে থাকা চেতনার মানুষের যোগান পায়। শুধু যে গ্রামের মাদ্রাসায় তাই নয়, এমনকি শহরের তথাকথিত অভিজাত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বড় বড় বহুজাতিক করপোরেশনের কর্মীদের মধ্যে, এবং অন্য অনেক জায়গায়। ঠিক যেমন ভারতের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি রিক্রুটমেন্ট চালায় ভুলভাল তথ্য আর আপামর মিথ্যার সাহায্যে মানুষের মধ্যে জাতি ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা গড়ে তুলতে, তেমনি করে বাংলাদেশের ছহি ইসলামের হুজুরেরা কখনো কেঁদে, কখনো হেঁসে, কখনো চাঁদা নিয়ে, কখনো চাঁদা দিয়ে, গড়ে তোলে উগ্রপন্থীদের বাহিনী যাদের প্রতি পদে কাফের মারার শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করা হয়, ধর্মের জন্যে বাঁচা ও মরা কে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে দেওয়া হয়। আর ওই সমস্তের মূলে আছে এই আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ফলে উৎপন্ন আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পশ্চাৎপদ অবস্থা।

ইসলামিক সন্ত্রাস নিয়ে যারা গলা ফাটায়, যারা এই সুযোগে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অস্পৃশ্যতা সৃষ্টি করে, তারা কিন্তু সৌদি আরবের প্রশ্নে চুপ থাকে। কারণ বড় কর্তা মার্কিনদের হাত তো সৌদি রাজার মাথায়। ধরুন আমাদের ভারতের হিন্দুত্ব মৌলবাদীরা, যারা একদিকে মুসলিম-খ্রিস্টান বিরোধী হাওয়া তোলে আর অন্যদিকে দলিত ও আদিবাসীদের দমন করে, তারা কিন্তু কোনো কারণেই সৌদি আরবের রাজতন্ত্র কে উৎখাত করার বিরোধী। এই ধরুন আমাদের নরেন্দ্র মোদী, লোকটা হাজারো মুসলমানকে জীবন্ত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে, মুসলমান মহিলাদের শুধু ধর্ষণই করায়নি বরং ওদের গর্ভ কেটে ভ্রুণ বের করে আগুনে জ্বালিয়েছে; সেই নরেন্দ্র কে ইসলামের তথাকথিত কান্ডারী ও সালাফি ইসলামের প্রবক্তা ওই সৌদি রাজতন্ত্র অর্ডার অফ সৌদি আরব বা ওএসএ পুরস্কার, যা সৌদি রাজতন্ত্রের অসামরিক পুরস্কারের মধ্যে অন্যতম, তা প্রদান করেছে। সেই সৌদি রাজতন্ত্র আবার অন্যদিকে সালাফি ইসলামের প্রচারক জাকির নায়েক কে পুরস্কার দেয়। অথচ বড় বড় হুজুরেরা আর হিন্দু ধর্মের পান্ডারা কিন্তু এই যোগসূত্র কে আড়াল করে রাখে, মানুষ কে জানতে দিতে চায়না যে কি ভাবে পৃথিবীর সমস্ত মৌলবাদের একে অপরের সাথে যোগাযোগ মার্কিন মদতে শক্তিশালী হচ্ছে।

ইসলামিক জঙ্গী সমস্যার মূল দুইটি কেন্দ্র, প্রথমতঃ বাংলাদেশ সহ এশিয়া-আফ্রিকার বিস্তীর্ন অঞ্চলে আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, এবং দ্বিতীয়তঃ সৌদি আরব ও তার রাজতন্ত্র। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় যতদিন আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা টিকে থাকবে ধর্মীয় মৌলবাদ তার মানুষের যোগান পেতেই থাকবে। অন্যদিকে যতদিন না আরব থেকে সৌদি রাজের অবসান হবে ততদিন ওই প্রতিক্রিয়াশীল মার্কিন দালাল রাজবংশের লোকেরা গোটা বিশ্ব জুড়ে ওদের ঘৃণ্য সংস্করণের ইসলামের রফতানি করবে মৌলবী আর পেট্রো ডলারের সাথে সাথে। সমস্ত সরকার মাথা ঝুঁকিয়ে এই রাজবংশের দান খয়রাতের, যা আসলে বকলমে মার্কিন ব্যবসায়িক লগ্নি, সেই অর্থের জন্যে লালায়িত হবে।

বাংলাদেশের পত্তন পাকিস্তানি মৌলবাদী ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করে কোনো গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে হয়নি, বরং চরম কমিউনিস্ট বিরোধী ভারতীয় ও সোভিয়েত দালাল শেখ মুজিব ইন্দিরার ট্যাঙ্কের নলে চেপে পাকিস্তানি শাসন শেষ করে ভারতীয় নয়া ঔপনিবেশিক শাসন বাংলাদেশে কায়েম করেছিল এবং এর ফলে ভূমি সংস্কার কোনোদিন সম্ভব হয়নি, বরং গরিব আরো গরিব হয়েছে আর জোতদার জমিদাররা মসজিদের ইমামদের দালালির দৌলতে আজ বাংলার গ্রামে গ্রামে নিজেদের খুঁটি আরো শক্ত করেছে। ধর্মপ্রাণ ছহি মুসলিমের কাছে গরিব হিন্দু পুরুত কাটা সুন্নত, মুসলিম জোতদারের থেকে জমি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কাড়া চরম হারাম, এই শিক্ষাই আজ অজ পাড়া গাঁয়ের মসজিদে চোস্ত আরবি ও উর্দু বলতে পারা ইমামরা গরিব কৃষকের মাথায় ঢোকাচ্ছে।

ইসলামিক জঙ্গীবাদের শুরু হয়েছিল মার্কিন পুঁজির কমিউনিস্ট বিরোধী যুদ্ধের এক অভিন্ন অংশ হিসেবে। আরব দুনিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি বিংশ শতাব্দীর ষাটের ও সত্তরের দশকে যে আকর্ষণের সৃষ্টি হয় শ্রমিক-কৃষক-যুব ও নারী মহলে তার থেকে জনতাকে বের করে আনার স্বার্থে সেই সময়ে সালাফি ইসলামের প্রভাব বিস্তার শুরু হয় মূলতঃ কৃষক জনতা ও শ্রমিকদের মধ্যে পিছিয়ে থাকা অংশকে সাম্রাজ্যবাদের পদাতিক বাহিনীতে পরিণত করে, দুনিয়ার থেকে ক্রমেই হ্রাস হয়ে যেতে থাকা উগ্র ইসলামিক ফ্যাসিবাদ কে প্রতিষ্ঠিত করতে।

এই ইসলামিক জঙ্গীবাদের শেষটাও তাই হতে হবে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতা-নারী-যুব-ছাত্রদের বিপ্লবী সংগ্রামের আগুনে সালাফি ছহি ইসলামের চিতা জ্বালিয়ে, আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে উৎখাত করেই এই ধর্মীয় মৌলবাদের উৎপাদন শেষ করা সম্ভব। বাকি সব পথ ও মত ততটাই অলীক যতটা জান্নাতে বয়ে চলা দুধ, সূরা, ও মধুর বন্যা, বা যৌন সংসর্গের জন্যে প্রস্তুত ৭২টি কুমারী রূপসী হুর। তাই সঠিক আর বেঠিকের বিচার করে এই হত্যাকারী ব্যবস্থার থেকে নিষ্কৃতি পেতে বাংলাদেশের মানুষকে আজ অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ ধরতেই হবে।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে