টাকা কালো - টাকা সাদা - মোদী ম্যাজিকে চাপা পড়ে গেল অনেক কথা

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১০, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

কালো টাকা’র নাকি অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়েছে কারণ নরেন্দ্র মোদী ৮ নভেম্বর রাতে হঠাৎ ঘোষণা করলো যে সরকার পুরানো পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোট নাকি বাতিল করছে এবং জনগণের কাছে যে পরিমাণ নগদ টাকা আছে তা তাঁরা হয় ব্যাঙ্কে জমা করতে পারেন অথবা ব্যাঙ্কে এসে নিজের সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রতিদিন ₹ ৪০০০ পর্যন্ত বদলে নিয়ে যেতে পারেন। দয়ালু সরকার জনগণ কে ৩০শে ডিসেম্বর অবধি সময় দিয়েছে আর বলেছে “দেশের স্বার্থে একটু কষ্ট সহ্য” করতে। মোটামুটি গোটা দেশে একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে, এতই তীব্র হট্টগোল যে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এত সহজে মার্কিন নির্বাচন জিতে রাষ্ট্রপতি পদের ৪৫তম দাবিদার হয়ে গেল সে কথা কারুর মাথায় থাকলো না। সব তর্ক-বিতর্ক হঠাৎ গায়েব হয়ে গিয়ে শুধু পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটের গল্প আর মোদী সরকারের জয়ধ্বনি কানে বাজছে। কালো টাকা তোমার দিন বুঝি সত্যিই শেষ। কিন্তু এই নোট বাতিল করে কি সত্যিই কালো টাকাকে জব্দ করা যাবে ?

কালো টাকা নির্মূলের মোদীর গিমিক চাপা দিচ্ছে সত্যকে


কালো টাকা মানে হলো যে টাকা কর না দিয়ে আয় করা হয়েছে; সেই টাকার সিংহভাগের মালিক হলো বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো, গ্রামের বড় বড় জোতদার ও ধনী কৃষকরা, আর শহরে বাস করা জমি-বাড়ির দালালরা, ফোঁড়েরা, মাফিয়ারা, সিনেমা অভিনেতারা, ক্রিকেট খেলোয়াড়রা, সরকারি আমলাতন্ত্রের উঁচু সিংহাসনে বসা লোকেরা, রাজনৈতিক নেতারা, মন্ত্রী আর পুলিশ কর্তারা। এই কালো টাকার অধিকাংশই নগদের রূপে থাকে না বরং দ্রুত জমি, বাড়ি, সোনা, বা শেয়ার-স্টকে বদলে যায়। ভারতবর্ষে কালো টাকার বড় অংশটা কর্পোরেট সংস্থাগুলোর। যারা শুধু কর ফাঁকিই দেয় না বরং যাদের আবার সরকার কর ছাড় দিয়ে বেশি করে চুরি করার রাস্তা করে দেয়, আর করে দেয় এই বলে যে দেশের উন্নয়নে নাকি এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো শরিক। এই কর্পোরেটদের আর আমলা-মাফিয়া-মন্ত্রী-নেতা-অভিনেতাদের কালো টাকা নানা কায়দায় ভারত থেকে বিদেশে চলে যায়, গচ্ছিত হয়ে যায় বিদেশী ব্যাঙ্কে বা বড় বড় কর্পোরেশনের শেয়ারে বা বৃহৎ লগ্নি পুঁজির কারখানা ব্যাঙ্কগুলোর বন্ডে। আবার বিদেশ থেকে এই টাকার একাংশ যখন প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ হিসেবে ভারতে ফিরে আসে তখন এই আগমনী পুঁজি কে ভারত সরকারই আবার কর ছাড় দেয় দেশের “অর্থনৈতিক উন্নয়নের” স্বার্থে। নিজেদের মুনাফার লক্ষ লক্ষ কোটি টাকাকে আবার কর মুক্ত করে ভারতবর্ষে বিনিয়োগ করে সেই টাকার থেকে উৎপন্ন লাভের একটা বড় অংশ কে জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে নিজেদের জনপ্রিয় করে তুলতে নানা রকমের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির বা সিএসআর কার্যকলাপের মাধ্যমে এই সব কর্পোরেট সংস্থাগুলোই আবার কালো টাকার একটা বড় অংশ কে লোক দেখানো সমাজ সেবার নামে সাদা করে। তাইতো নানা ধরণের ব্যবসায়িক প্রকল্প কে চরিতার্থ করার স্বার্থে এই সকল কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দরকার জনমত সৃষ্টি ও মানুষের চৈতন্য কে দখলে নেওয়া এবং এই কাজে এদের সিএসআর আর থিঙ্ক ট্যাংক সংস্থাগুলো প্রচন্ড কাজে আসে। তাই আজ খেলাধুলো থেকে সিনেমা, পরিবেশ থেকে অর্থনীতি, সব ব্যাপারেই নীতা আম্বানি কে দেখা যায়, তাই আজ আদানি সাহেবের সমস্ত কুকীর্তি ও ছলে বলে কৌশলে জনগণের থেকে জমি-জল ও প্রাকৃতিক সম্পদ কেড়ে নেওয়ার ঘটনাগুলো কোনদিন “দেশপ্রেমিক” নরেন্দ্র মোদী সরকারের রোষানলে পড়ে না।কালো টাকার বলেই ভোটের প্রচারে হেলিকপ্টার থেকে প্রাইভেট জেট ব্যবহার করে আর পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচা করে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে। যেহেতু তেরঙ্গা ঝান্ডা নাড়িয়ে গেরুয়া বসন পড়ে যে কোন আরএসএস সমর্থকের কালো টাকা সাদা হয়ে যায় তাই এই পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিলে কি সত্যিই এই নেকড়েদের কোন রকমের ক্ষতি হতে পারে?

সারা দেশ জুড়ে যখন নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত কে নিয়ে সাধুবাদ দেওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে আর তথাকথিত “দেশভক্ত” ও “জাতীয়তাবাদী” সংবাদ মাধ্যমগুলি বারবার এই সিদ্ধান্তের ফলে কালো টাকা শেষ হয়ে যাবার মতন মিথ্যা প্রচারের বন্যা ছুটিয়ে চলেছে তখন বুঝতে হবে যে ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। ভারতবর্ষের অর্থনীতির মূল উৎপাদক শক্তি হলো কৃষক, যদিও ভারতের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দরুন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে আর দরিদ্র-ভূমিহীন ও মধ্য কৃষকদের পক্ষে চাষের খরচ মিটিয়ে ঘরে দুই পয়সা তোলা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলার কথা নতুন করে বলার কোন দরকার নেই। সেই কৃষকদের অধিকাংশের হাতে, গ্রামের খেটে খাওয়া জনগণ যাঁদের কাছে এনরেগা প্রকল্পের জব কার্ড নেই, তাঁদের হাতে, অর্থ বা তাঁদের ঘরোয়া সঞ্চয়ের অর্থ কিন্তু নগদেই থাকে আর তার মধ্যে পাঁচশো বা হাজার টাকার নোট থাকা আশ্চর্যজনক নয়। শহরের শ্রমিকদের, বিশেষ করে সমস্ত ঠিকা শ্রমিক ও দিনমজুরদের মজুরি কিন্তু আজও নগদেই হয়। বেশির ভাগ মাড়োয়ারি ফার্মে আজও নগদ টাকায় কেরানীদের বেতন দেওয়া হয়। আর ঠিক এই ৭-৮ তারিখ নাগাদ অনেক ছোট কোম্পানির কর্মীদের বেতন হয়, বেশিরভাগই নগদে। শহরে কাজ করতে আসা বেশির ভাগ দিন মজুরদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই, তাঁদের সিংহভাগ আজও  বাড়িতে টাকা পাঠান মানি অর্ডার করে না হয় নিজে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসেন। তাঁদের সঞ্চিত অর্থ মোটামুটি গ্রামের বাড়িতে বা শহরের বস্তির ঘরে জমানো থাকে কৌঁটো বা বাক্সে, বিয়ে বা চিকিৎসার জন্যে, অথবা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার থেকে বাঁচার জন্যে। পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ার ফলে এরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন কারণ এদের পক্ষে মাইলের পর মাইল হেঁটে নগদ টাকা নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে তা বদলে আবার নগদ টাকা নিয়ে গ্রামে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসা ভীষণ মুশকিল ও বিপদজনক।কলকাতা সহ অন্যান্য শহরের ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে ফুটপাতের হকারের কথা ভাবুন, অনেক মানুষের ঘর চালাবার সম্বল বোধহয় গুটিকয়েক পাঁচশো টাকার নোটেই রয়েছিল আর তাঁদের পক্ষে দুই দিন ঘরে বসে থেকে তৃতীয় দিন ব্যাঙ্কে বা পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজেদের টাকার নোট বদলিয়ে তবে বাজার করে দু মুঠো চাল-ডাল নিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে কত কষ্ট আর বেদনা আছে তা কি নরেন্দ্র মোদী সাহেব তার বাংলো বাড়িতে বসে দেশের গরিব মানুষ কে দেশের স্বার্থে কষ্ট করার ভাষণ দিয়ে বুঝতে পারবে? মোদীর গিমিকের চক্করে হয়তো ওর সাবর্ণ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ভোটব্যাঙ্ক আনন্দে আপ্লুত হবে, হয়তো কর্পোরেট সংস্থাগুলো মিটিমিটি করে হাসবে তবে জনগণ কিন্তু একেবারেই খুশি হবেন না।

জনগণের এই দুর্ভোগের সময়ে একমাত্র রেহাইয়ের পথ হলো ব্যাঙ্কে গিয়ে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বদল করা। আর নোট বদল করে এক লপ্তে শুধুমাত্র ₹৪০০০ অবধি পাওয়া যাবে আর এর ফলে গরিব মানুষের, যাঁরা নিজেরা বাড়িতে স্বল্প অর্থ সঞ্চয় করে রেখেছিলেন ভবিষ্যতের জন্যে বা যাঁদের সমস্ত মাসের খরচা তাঁদের শ্রমের বদলে পাওয়া মজুরির নগদ টাকায় চলে, তাঁদের পড়তে হবে প্রচন্ড অসুবিধায়। আর এই সুযোগে নেপোয় মারে দই করবে দেশী মুৎসুদ্দি পুঁজি ও বৃহৎ বিদেশী লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন সরকারি ব্যাঙ্কগুলো। কোটি কোটি লোকের ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলানোর মাধ্যমে এরা মালিক হয়ে উঠবে লক্ষ কোটি টাকার যা এরা কায়দা করে বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে ঋণ দেবে, যে ঋণের টাকা নির্দ্বিধায় সাফ করে বসে থাকবে আম্বানি আর আদানি গোষ্ঠী। এই কয়েক মাস আগেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত হয়েছিল যে প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার কোটি টাকার ঋণ সরকারি ব্যাঙ্কগুলো নিজেদের খাতায় বাজে ঋণ হিসেবে নথিভুক্ত করে মকুব করে দিয়েছে। এর লাভ বলা বাহুল্য বড় বড় কর্পোরেশন ও পুঁজিপতিরাই উঠিয়েছে কারণ সাধারণ কৃষকেরা ব্যাঙ্কের ঋণ আদায়কারীদের চাপে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। একদিকে যেমন এই গরিব মানুষদের টাকা জমা করে নিজেদের পুঁজির পাহাড় আরও উঁচু করবে এই ব্যাঙ্কগুলো ঠিক তেমনি আবার ছোট খাটো দালাল-ফোঁড়ে-অপরাধীদের কালো টাকা সাদা করার জন্যে বিপুল পরিমানের ঘুষের খেলাও চলবে আর নানা কায়দায় ব্যাঙ্কের বড় বড় কর্তারা সেই ঘুষের কালো টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠবে। পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল করার সাথে সাথে হঠাৎ আবার মোদী সরকার নতুন পাঁচশো টাকার নোটের সাথে সাথে একেবারে দুই হাজার টাকার নোট ছাপতে চলেছে যা কালো নগদ টাকা কে ভবিষ্যতে আরও সহজে রাখার বন্দোবস্ত করে দিল।  তাই মোদী সরকারের সিদ্ধান্তে যে বৃহৎ লগ্নি পুঁজির আর আমলাতন্ত্রের পোয়াবারো হয়েছে সে কথা আলাদা করে বলার দরকার হবে না।    
 

এত বীভৎস চিৎকার করে যে ভাবে মোদী সরকারের নোট খারিজ করার সিদ্ধান্ত কে কিছু ঘোড়েল সমর্থন করছে আর যে ভাবে ওদের যুক্তিহীন সমর্থন কে পুঁজি করে মোদী ভক্তকূল সমগ্র ইন্টারনেট ও সংবাদ মাধ্যমে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বলে যে মোদী সরকার ভারতবর্ষ থেকে কালো টাকা কে চিরতরে মুছে ফেলছে - তাতে মনে হচ্ছে যে আর কিছু হোক না হোক অন্য সমস্ত পদক্ষেপের মতন এই সরকারি সিদ্ধান্তটাও বৃহৎ আকারে বাজারজাত করবে আরএসএস ও তার গৌরী সেনেরা। ফলে যুক্তি ও তথ্যের চেয়ে উপরে স্থান পাবে প্রচন্ড আবেগ মাখানো, তেরেঙ্গায় মোড়া এই পলিটিক্যাল গিমিকটা, যা উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের আগে নিজের পোর্টফোলিও শক্তিশালী করার জন্যে খুব মাথা খাটিয়ে বিজেপি’র নেতারা বের করেছিল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে নরেন্দ্র মোদী যদিও ৮ নভেম্বর সন্ধ্যা আটটায় এই নোট বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত টিভিতে নানা ধরণের ভাঁট বকে জানান দিল, বিজেপির ছোট বড় নেতারা আর উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের টিকিটের  প্রত্যাশায় বসে থাকা আরএসএস কর্মীরা কিন্তু আধ ঘন্টার মধ্যে নিজেদের ফেসবুক ও টুইটারে মোদী সরকারের সিদ্ধান্ত কে সাধুবাদ দিয়ে পোস্ট দিল। এই পোস্টগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই গ্রাফিক্স সহ, যা মোটামুটি ফটোশপ বা ভেক্টর গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে বানাতে গেলে ১ ঘণ্টা লেগেই যায়, যদি না সেই নেতার ব্যক্তিগত কোন কর্মী এই কাজের জন্যে ঠাঁয় দিয়ে বসে না থাকে। সোজা কথায় মানে দাঁড়াচ্ছে যে আরএসএস ও বিজেপির সকল স্তরের কর্মীদের কাছে এই খবর আগেই চলে এসেছিল, যার অর্থ দাঁড়ায় যে এই আরএসএস ও বিজেপির কর্মীদের ছাড়াও এদের অনেক ঘনিষ্ঠ লোকেদের পক্ষে সরকারের এই পদক্ষেপের ব্যাপারে জেনে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া অসম্ভব ছিল না। ঠিক যেমন অসম্ভব নয় কলকাতার  বড়বাজার ও তার আশেপাশে বসা বড় বড় মাড়োয়ারি বেনিয়াদের পক্ষে এই সময়ের মধ্যে কোটি কোটি টাকা জমি, বাড়ি, দোকান, শেয়ার, বন্ড, অথবা সোনার গয়নায় বদলে ফেলা। দু-চারটে স্টক ব্রোকারের অফিসে গেলে বা দুই একটা গদিতে গেলে আপনি দেখবেন কি ভাবে প্রতিদিন নিত্য নতুন কোম্পানি তৈরি হচ্ছে, কি ভাবে সেই কোম্পানির প্রায় দশ বছরের পুরানো এন্ট্রি তৈরি হচ্ছে আর কি ভাবে সন্ধ্যে বেলার মধ্যে সেই কোম্পানি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আর শেয়ারের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা হয়ে যাচ্ছে। ইনকাম ট্যাক্সের অফিসারদের সাথে এই মাড়োয়াড়িদের ওঠা বসা সেই ১৯৬০ এর দশকের থেকে। ইনকাম ট্যাক্সের অফিসাররা দুর্গাপূজার আগে ৫০ লক্ষ থেকে দুই কোটি টাকা অবধি ঘুষ নেয় এক একটা রেইড থেকে আর তার আগে ৪০-৫০ লক্ষের মধ্যেই আটকে থাকে অঙ্কটা। মে আর জুন মাসের থেকেই সমস্ত মাড়োয়ারি কারবারীদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ইনকাম ট্যাক্স অফিসারদের জন্যে মদ-মাংস আর মেয়েমানুষের জোগাড়ের। ইনকাম ট্যাক্স ছাড়াও সেবি, সেলস ট্যাক্স ও অন্য সমস্ত বিভাগেই টাকার উপঢৌকনের অঙ্কটা স্থির থাকে। টাকা পাঠাতে থাকলে আর কোন গন্ডগোল হয়না। তাই এই সব লোকেরা, যাদের সিংহভাগের সাথে বিজেপি-আরএসএসের শুধু যে সুদৃঢ় যোগাযোগ আছে তাই নয় বরং পশ্চিমবঙ্গে এরাই গেরুয়া বাহিনীর মূল পৃষ্টপোষক, যে এই খবর সময় থাকতে পায়নি বা পেয়ে নিজেদের সিংহ ভাগ নগদ টাকা নানা কায়দায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাদা করে নেয়নি সে কথা কে হলফ করে বলতে পারবে?   



নানা ভড়ং বাজি করে সরকার আজ মানুষের, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের টোপ দেওয়ার কাজে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। কালো টাকা দমনের নামে পুরানো নোট বাতিল করে নতুন নোট চালু করার ঘটনা কিন্তু চাপা দিয়ে দিল কি ভাবে এবিভিপি’র নেতা ও কর্মীরা জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাজিব নামক ছাত্র কে গত মাসে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পরেও আজ অবধি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ দিল্লি পুলিশ তাঁকে খোঁজার কোন প্রচেষ্টা তো করেইনি বরং পুলিশ ও সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ করার দাবিতে আন্দোলনরত নাজিবের মা সহ জেএনইউ’র ছাত্র ছাত্রীদের উপর আক্রমণ করে তাঁদের গ্রেফতার করার ঘটনাকে। যে ঘটনা কে কেন্দ্র করে মোদী সরকারের নিন্দায় সরব হয়েছিলেন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। কালো টাকার নামে লোককে ঢপ দেওয়ার মোদীর এই চালে চাপা পড়ে গেল কি ভাবে এনডিটিভি কে একদিনের জন্যে নিষিদ্ধ করার প্রয়াস করে মোদী সরকার ও পরবর্তীকালে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক করতে সেই সিদ্ধান্ত কে স্থগিত করে বিজেপি ও আরএসএস।  পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিলের ঘোষণায় চাপা পড়ে গেল কি ভাবে দেশের শিল্প ও বাণিজ্যে সঙ্কটের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে সেই তথ্য, হারিয়ে গেল আলীগড় সহ উত্তরপ্রদেশের নানা প্রান্তে দাঙ্গা লাগিয়ে মানুষ মারার কাজে কি ভাবে এগিয়ে চলেছে সংঘ পরিবারের বানর সেনা সেই কাহিনী, আর চাপা পড়ে গেল কি ভাবে হিন্দুত্ব প্রীতিতে বাজি ফাটিয়ে সমগ্র দিল্লি শহর কে বিষাক্ত ধুঁয়ার কবলে ঠেলে দিয়েছিল উচ্চবিত্ত সাবর্ণ সমাজ। কালো টাকা উদ্ধারের এই ঢপের কীর্তন শুনে যদিও মোসাহেবের দল বাহবা দিচ্ছে তবুও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষেরা, গরিব ও খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণ, রাস্তায় ঘাটে ভিড়ে মিশে থাকা আমার আর আপনার মতন লোকেরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে এই সিদ্ধান্তে আপাতত গরিব মানুষের চরম ভোগান্তি বাদে,  কয়েকদিনের মজুরির ক্ষতি বাদে আর কিছুই নেই।  লোকে তবুও মোদী পূজা করবে কারণ মোদী ভারতবর্ষের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ১৬ কোটি সাবর্ণ উচ্চবিত্তদের কাছে চিরকালই একজন দেবতা হিসেবে চিহ্নিত হবে, যাকে প্রশ্ন করা যায়না, যার উদ্দেশ্য কে মন্দ বলা যায়না, যার কথা শুধু নাকি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয় ও সুবোধ বালকের ন্যায় তার গুণগান করে নিজেদের দেশভক্তির পরিচয় দিতে হয়। আজ কালো টাকা বহু সংবাদ কে ঢেকে দিল, গতকাল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক আর পাকিস্তান ঢেকে  দিয়েছিল আর আগামী কাল উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন ঢেকে দেবে অনেক অপ্রিয় সত্য কে। কিন্তু সত্যিই কি হাত দিয়ে সূর্যের আলো কে রোখা যায় ? বা শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় ?

শতবর্ষে নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষাগুলোকে সারসংকলন করে এগিয়ে চলুন

সোমবার, নভেম্বর ০৭, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মহান নভেম্বর বিপ্লব জিন্দাবাদ

নভেম্বর মানে শীতের আগমন, নভেম্বর মানে পরিবর্তন - আর এই নভেম্বর বিপ্লবের মাস। প্যারিস কমিউনের পরে বিশ্বের বুকে প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের জন্ম হয় এই ৭ই নভেম্বর ১৯১৭ সালে। সেই নভেম্বরের রাতে তীব্র শীতের আগমনী কামড় কে উপেক্ষা করে ক্ষুধিত শ্রমিকেরা বেয়নেটের শক্তিতে উচ্ছেদ করেন কেরেনস্কি'র নেতৃত্বে চলা তথাকথিত বাম সরকার কে আর জারের শীত প্রাসাদে উত্তোলিত হয় রক্তিম পতাকা। রাতে বিনিদ্র থেকে এই বিপ্লব কে নেতৃত্ব দেন লেনিন ও স্তালিন নামক দুই ব্যক্তি, যাঁদের সম্পর্কে কেউ সেই দিন পর্যন্ত বেশি কথা জানতেন না, কিন্তু এই রাতের পর থেকেই এই দুই জন পৃথিবীতে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টিই শুধু করলেন না বরং নিজেরাও শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জ্বলন্ত মশাল হয়ে রইলেন।

লেনিনের নেতৃত্বে নভেম্বর রুশ বিপ্লবের ফলে জন্ম নিয়েছিল শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব রাষ্ট্র যন্ত্র আর গঠিত হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া, তারপরের সমস্ত ঘটনাক্রম ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, শ্রমিক ও কৃষকের সৃজনশীল ক্ষমতা বিশ্ব কে দেখিয়েছে, প্রথমে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের যৌথ আগ্রাসন কে ঠেকায় আর তারপরে হিটলারের ফ্যাসিবাদী আক্রমণ কে শুধু ঠেকানোই নয় বরং একেবারে বার্লিনে ঢুকে নাজি শাসন উচ্ছেদ করে রাইখস্ট্যাগের মাথায় লাল পতাকা উত্তোলন করে স্তালিনের নেতৃত্বাধীন লাল ফৌজ। কাঠের লাঙলের দেশ রাশিয়া থেকে পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ও বিশ্বের প্রথম মহাকাশে মানুষ পাঠানো দেশে পরিণত হয় শ্রমিক-কৃষকের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন। লেনিনের আদর্শে বলীয়ান ও স্তালিনের নেতৃত্বে চলা সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, অত্যাচারিত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে হিম্মত জুটিয়েছিল এবং সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করেছিল। বিশ্ব কে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত করার শ্রেয় অজেয় লাল ফৌজের টুপিতে পালক হিসেবে শোভিত হলো। বিশ্বের ছয় ভাগের এক ভাগ কে সাম্রাজ্যবাদের দখল থেকে মুক্ত করে শ্রমিক-কৃষক রাজত্বে নিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে আসার আগেই মুক্ত হয় সমগ্র পূর্ব ইউরোপ, চীন, কোরিয়া। বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে বিদ্রোহ আর টলমল করতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পায়ের তলার জমি। তাই তো বাইরের থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কে দখল করতে অপারগ হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন নতুন করে সেজে ওঠা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের পান্ডারা হিসেবে কষে ভিতর থেকে বেইমানদের সাহায্যে দুর্গ দখল করার লড়াইয়ে নামে। শুরুতে ট্রটস্কি ও জিনোভিয়েব-কামেনেভদের মতন বেইমানদের দিয়ে যে ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন কে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা ঠিক সেই রকম ভাবেই তারা প্রচেষ্টা শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লাল পতাকা উচ্ছেদ করার আর এই কাজে এদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে স্তালিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ঘাঁপটি মেরে থাকা ক্রুশ্চেভ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।   


স্তালিনের মৃত্যুর পরে ১৯৫৬ সালে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে লেনিন ও স্তালিনের পতাকা ফেলে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা দখল করে একদল আমলাতান্ত্রিক-পুঁজিবাদপন্থী বেইমানরা, যারা নানা রকমারি স্লোগানের আড়ালে তুলে ধরে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ধ্বজ্জা ও এদের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী কালে পরিণত হয় বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে। উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশ দখলের লড়াইয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে, বিশ্বের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর সাথে সোভিয়েত শাসক শ্রেণী জোট বাঁধে বিপ্লবী আন্দোলন কে ধ্বংস করতে, চীনা কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুঙ যখন সোভিয়েত পার্টির বেইমানি ও সংশোধনবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেন তখন থেকেই চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধ চক্রান্তে কোন রাখ ঢাক না রেখেই সোভিয়েত শাসক শ্রেণী যোগ দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতর পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরেও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে শ্রমিক শ্রেণীর রাজত্ব কে ক্ষমতাচ্যুত ধনিক শ্রেণীর থেকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরলো, তুলে ধরলো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সামগ্রিক জনগণ কে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নীতি শিক্ষার কর্তব্য, তুলে ধরলো কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে ও বাইরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সংশোধনবাদী সকল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবার প্রয়োজনীয়তা, আর তুলে ধরলো রাষ্ট্র ও পার্টির ভিতর আমলাতন্ত্রকে ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তা। এই সকল নীতির সারসংকলন করে মাও সেতুঙ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা পুঁজিবাদপন্থীদের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালান যা পরবর্তীকালে এক সম্পূর্ণ বিপ্লবের রূপ নেয় - যা মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপ নেয় এবং চীনা পার্টি থেকে লিউ শাও চি ও তেঙ শিয়াও পিঙের সদর দফতর কে চূর্ন করে। মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব নভেম্বর বিপ্লব ও চীন বিপ্লবের পরে দুনিয়া কাঁপানো মহান তৃতীয় এমন এক বিপ্লব যা শুধু নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা কে নতুন সময়ে নতুন করে পুনঃপ্রতিষ্ঠাই করেনি বরং এক নতুন যুগের সূচনা করেছে - যে যুগ কে লিন  পিয়াও বলেছিলেন "মাও সেতুঙের যুগ" - যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ এগিয়ে চলেছে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে আর সমাজতন্ত্র এগিয়ে চলেছে বিশ্ববিজয়ের দিকে।


সেই মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রথম পর্বে বিজয় লাভের পরেই মাও সেতুঙ বলেছিলেন যে একটা নয় বরং দশটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব করা দরকার চীনে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঠেকাবার জন্যে। কিন্তু  সেইদিনের বিজয়ের উল্লাসে সবার দৃষ্টি সরে গেছিল মাও সেতুঙের সেই সাবধানবাণীর থেকে আর তাই ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে রহস্যজনক ভাবে মাও সেতুঙের সহযোদ্ধা ও উত্তরাধিকারী লিন পিয়াও প্রথমে নিখোঁজ হন, পরে নিহত হন ও প্রায় দুই বছর ধরে তাঁর প্রসঙ্গে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার পরে হঠাৎ গোপনে অনুষ্ঠিত চীনা পার্টির কংগ্রেসে "পুঁজিবাদপন্থী" হিসেবে নিন্দিত হন। আর যে নিন্দা করেছিল, সেই চৌ এনলাই নিজে পুঁজিবাদী পথগামী তেঙ শিয়াও পিং কে পুনরায় পার্টি ও সরকারে ফেরত আনে এবং মাও সেতুঙের বিরুদ্ধে নয়া কেন্দ্র গড়ে তোলে। অতঃপর মাও সেতুঙের মৃত্যুর একমাসের মধ্যেই পার্টি ও রাষ্ট্রে নিজের আধিপত্য কায়েম করে তেঙ শিয়াও পিং এবং চীনের দশাও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতনই হয়। দ্রুত শ্রমিক-কৃষকের একনায়কতন্ত্রের জায়গা নেয় পার্টির একনায়কতন্ত্র তথা পার্টির নেতাদের আর আমলাদের একনায়কতন্ত্র, যার থেকে সৃষ্টি হয় নয়া পুঁজিবাদী শ্রেণীর। গ্রামের কৃষক ও শহরের শ্রমিকদের উপর চলতে থাকে "বাজার সমাজতন্ত্রের" শোষণের রোলার এবং তাই প্রতি বছর চীনের বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠিত হয় প্রায় ৭০০'র উপর নন্দীগ্রাম।

বিশ্বের বুকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক দেশটা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কমিউনিস্ট আতংক পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিন বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে শোষণে আর অনাহারে ক্লিষ্ট মানুষ, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষ এই ঘৃণ্য মানুষ খেঁকো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, চিৎকার করে নিজের "আজাদী" দাবি করছে। মানুষের বিদ্রোহ আর বিক্ষোভের মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সকল দেশের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণী কে নিজের গণতান্ত্রিক আবরণ হাটের মাঝে খসাতে হচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে বিদ্রোহী মানুষ কে কমিউনিস্টদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে প্রতিদিন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ও ওয়াল স্ট্রিটের বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর ঢালা টাকায় গড়ে উঠছে একের পর এক এনজিও, ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন, বড় বড় কর্পোরেট মিডিয়া সংস্থা, ইত্যাদি। এদের সকলের কাজ হলো পুঁজিবাদীদের থেকে পয়সা নিয়ে পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদের শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানুষের ক্ষোভ কে বিপ্লবের পথ থেকে দূরে সরিয়ে নানা ধরণের কর্মকান্ডে আটকে রেখে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও শাসন কে নিশ্বাস নিতে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া। রোজ নানা ধরণের নীতি আদর্শের ব্যাখ্যা করে বিপ্লব থেকে জনগণ কে দূরে সরিয়ে রেখে বিপ্লবের প্রস্তুতি করার ছল করে নানা ধরণের কমিউনিস্ট নামধারী, মার্কস ও লেনিনের নাম ব্যবহারকারী পার্টি ও সংগঠনও গড়ে উঠছে একের পর এক। নানা ভাবে নানা কায়দায় আমাদের নানা ধরণের মার্কসবাদীরা দিস্তা দিস্তা কাগজ আর জিবি জিবি ডেটা খরচা করে বোঝাচ্ছে যে কেন এখনও বিপ্লবের সময় হয়নি, যাঁরা বিপ্লব করছেন বা বিপ্লবের কথা বলছেন তাঁরা নাকি সবাই হঠকারী ও জনবিচ্ছিন্ন। আর এই সবের মধ্যেই নভেম্বর বিপ্লব আমাদের দেখায় আজ থেকে শত বছর আগের সেই দিনটাকে, যেদিন প্রতি পদে পদে 'মার্কসবাদী' পন্ডিতেরা দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচা করে বারবার বলার চেষ্টা করেছিল যে রাশিয়ায় বিপ্লব সম্ভব নয়, লেনিন হঠকারী, বলশেভিক পার্টি জনবিচ্ছিন্ন ইত্যাদি। আর তবুও নভেম্বর বিপ্লব হয়। নভেম্বর বিপ্লব হয় কারণ একদিকে রাশিয়ার গরিব মানুষের সামনে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা ছাড়া যে পথ খোলা ছিল তা ছিল অনাহার ও দাসত্বের মাধ্যমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া আর অন্যদিকে নভেম্বর বিপ্লব হয়েছিল কারণ লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি এই বিপ্লব কে সচেতন ভাবে পরিচালিত করেছিল, কারণ শ্রমিক-কৃষক-নাবিক-সৈনিকদের সংগ্রামী ও অগ্রগামী অংশগুলোর মধ্যে সঠিক ভাবে সঙ্গতি রেখে পরিচালনা করা হয়েছিল এই মহান বিপ্লব কে।

আজ ভারতবর্ষ সহ সমগ্র বিশ্বে যে ভাবে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের উপর মার্কিন বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির দ্বারা পরিচালিত নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির শোষনের জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে, তাকে শুধুমাত্র কফির কাপে তুফান তুলে বা বোহেমিয়ান এক্টিভিজম দিয়ে উচ্ছেদ করা যাবে না। প্রতিটি দিন আর প্রতিটি মুহূর্তে জনগণের উপর এই শোষনের পাহাড়ের ওজন বেড়ে চলবে শাসক শ্রেণীর মুনাফা অর্জনের অভিলাষে। ফলে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো কে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করার স্বার্থে শাসক শ্রেণীর দরকার হবে এমন সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির যারা যেনতেন প্রকারে জনগণের ঐক্য কে খন্ডিত তো করবেই সাথে সাথে জনগণের মধ্যে বৈরিতামূলক সম্পর্ক কে স্থাপন করবে যার ফলে জনগণের একাংশ অন্য অংশ কে তীব্র ঘৃণা করবে। আর এই কাজে ভারত সহ বিশ্বের সকল আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশে জাঁকিয়ে বসছে ধর্মীয় মৌলবাদের ভিত্তিতে রাজনীতির ময়দানে নামা ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো, যাদের এই রাজনীতি কে এগিয়ে নিয়ে যেতে কোটি কোটি ডলার উপঢৌকন দিচ্ছে বিশ্বের তাবড় তাবড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো। ভারতবর্ষে মোদীর উথ্বান ও তারপর থেকেই সামগ্রিক ভাবে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণ, নিপীড়িত জাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমাজ, ও দলিত-আদিবাসীদের মতন শোষিত জনগণ কে যে ভাবে রাষ্ট্র ও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের নগ্ন আক্রমণ সইতে হচ্ছে তা প্রমাণ করছে যে শাসক শ্রেণী আর সাম্রাজ্যবাদ, দুটোই আজ ভীষণ গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত, এবং এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে তাদের শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের রক্ত চোষার নিত্যনতুন ফন্দি বের করতে হচ্ছে। যার মানে দাঁড়ালো যে শাসক শ্রেণী আর পুরানো কায়দায় শোষণ করতে পারছে না আর শোষিত শ্রেণী পুরানো কায়দায় শোষিত হতে চাইছে না। আর এই পরিস্থিতিতে শান্তি জল ছিটিয়ে যারা বলছে যে ফ্যাসিবাদের পতন হবে ভোটের বাক্সে তারা জেনেশুনে শয়তানি করে জনগণকে এই মানুষ খেঁকো ব্যবস্থার শিকার বানিয়ে রাখতে চাইছে -অর্থাৎ এরাই হলো শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাম্রাজ্যবাদ, দেশি দালাল পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের পা চাটা শ্বাপদের দল।

আজ ভারতবর্ষে যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যখন সমস্ত গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকে এক সংগ্রামী মঞ্চে আনার জন্যে লড়াই চলছে তখনই কমিউনিস্ট বিরোধী, শ্রমিক-কৃষক বিরোধী কিছু গণতন্ত্রী সেজে থাকা শক্তি নানা ভাবে চেষ্টা করছে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে বিভেদ সৃষ্টি করার। কখনো আইডেন্টিটি পলিটিক্স এর তাস খেলে, কখনো ধর্মীয় মৌলবাদের সাহায্য নিয়ে, বা কখনো শাসক শ্রেণীর প্রতি মোহ সৃষ্টি করার কাজ করে এই সমস্ত শক্তি আজ সর্ব ভারতীয় স্তরে এক বৃহৎ ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চ গড়ে তুলতে, এক সংগ্রামী যুক্ত ফ্রন্ট গড়ে তুলতে বাঁধা দিচ্ছে, শ্রমিকে-শ্রমিকে, কৃষকে-কৃষকে দাঙ্গা লাগাবার কাজে এরা সংঘ পরিবার ও প্রতিক্রিয়াশীল মুসলমান সংগঠনগুলো কে বিশাল সহযোগিতা করছে। ভারতবর্ষের শাসক শ্রেণীর কাছে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে সমাজে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দরিদ্র মানুষের ঐক্য ভেঙে নিজের রাজত্ব কে অক্সিজেন যোগান দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই বাঁচার। আর এই ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করে এক নয়া গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ গঠন করার লড়াইয়ে আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয় নভেম্বর বিপ্লব, আজও অন্ধকারে পথের হদিস দেয় নভেম্বর বিপ্লব, আর আজও ধাক্কা খাওয়ার পরে, বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পরে ভেঙে না পড়ে, হতাশাগ্রস্ত না হয়ে বরং পরবর্তী লড়াইয়ের জন্যে ভালো ভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার শিক্ষা দেয় নভেম্বর বিপ্লব। তাই আজ নভেম্বর বিপ্লবের মশাল শত বছরেও আমাদের উঠে দাঁড়াবার আর ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে, লেনিনের মশাল - স্তালিনের মশাল আমাদের পথ দেখাচ্ছে সমাজ বিপ্লবের, শোষকদের উচ্ছেদ করে শোষিত মানুষের রাজত্ব গড়ার পথ দেখাচ্ছে। যদি আজ আমরা এই পথে চলতে দ্বিধা করি, যদি আজ আমরা ইতিহাসের নবনির্মাণের ডাক শুনতে অস্বীকার করি তাহলে কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।  আসুন নভেম্বর বিপ্লবের এই মহান দিনে শপথ নিই প্রতিটি দিন কে ৭ই নভেম্বরের মতন ঐতিহাসিক দিনে পরিণত করার, প্রতিদিন বিশ্বের থেকে একটু একটু করে সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহকদের উচ্ছেদ করার। মানব সমাজের ইতিহাস প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস - জয় আমাদের হবেই। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে