“নো ভোট টু বিজেপি” স্লোগান কি আদতে বিজেপি-আরএসএস এর ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করতে সাহায্য করবে?

শুক্রবার, মার্চ ২৬, ২০২১ 0 Comments A+ a-

“নো ভোট টু বিজেপি” স্লোগান কি আদতে বিজেপি-আরএসএস এর ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করতে সাহায্য করবে?


ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যখন ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের নাকের ডগার থেকে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা সিটের মধ্যে ১৮টি ছিনিয়ে নেয়, তখন গোটা রাজ্য জুড়ে যদিও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই(এম)] এর নেতৃত্বাধীন ধুঁকতে থাকা ও রাজনৈতিক ভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া বামফ্রন্ট ও তার মালিক কংগ্রেস পার্টি নিতান্তই খুশি হয়, অনেক প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক সংগঠন ও মানুষ কিন্তু চোখে সর্ষে ফুল দেখেন। রাজ্যে বিজেপি ২০২১ এ ক্ষমতায় আসছে আর এসে ব্যাপক জনগণ কে বেনাগরিক করে দেওয়ার স্বার্থে জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জী (এনআরসি) করছে বলে একটা আতঙ্কের মহল তৈরী হয়। এর পরে করোনা ভাইরাসের নাম নিয়ে যখন রাজ্য সরকার কে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক সব অধিকার খর্ব করে দিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র সরকার, তখন কোন বিকল্প রাজনীতির সন্ধান না করে, কোন রাজনৈতিক ভাবে বলিষ্ঠ কর্মসূচী না রেখে, একদল ফ্যাসি-বিরোধী বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবরা জড় হয়ে “একটিও ভোট বিজেপি কে না” বা “নো ভোট টু বিজেপি” নামক একটি আন্দোলনের জন্ম দিলেন কলকাতা শহরে।


জন্মলগ্ন থেকেই “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকেরা বলে আসছেন যে তাঁরা চান রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী ভোট যেন ভাগ না হয় আর সকল মানুষ কে তাঁরা অনুরোধ করবেন যাতে তাঁরা তাঁদের ভোট যে কোন দল কে দিলেও বিজেপি কে যেন না দেন। এই নীতির সাথে রাজনৈতিক ভাবে সমমনোভাব প্রকাশ করে একমাত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন [সিপিএই (এম-এল) লিবারেশন] ও অন্য কিছু ভোটপন্থী প্রাক্তন নকশালপন্থীরা। “নো ভোট টু বিজেপি” বলে তাঁরা নানা ভাবে কলকাতা শহরে ও কিছু মফৎসলে প্রচার শুরু করেন। তবে যেহেতু এই রাজনৈতিক লাইনে স্পষ্ট ভাবে কোন বিশেষ দলকে ভোট দেওয়ার কথা বলা হয়নি তাই বারবার এর সুফল কুড়াবার চেষ্টা করে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। যেহেতু তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা সংগঠন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে রাজ্যে, তাই নির্দ্বিধায় এই দলের ঘাড়ে চেপেই নির্বাচনী বৈতরণী পার করার চেষ্টা করে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন সমর্থিত “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলন। আবার বিজেপি-বিরোধিতার কারণে এই আন্দোলনের উপর চরম ভাবে ক্ষেপে যায় সিপিআই (এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোট। গোটা রাজ্যে তারা বিজেপি কে হারাবার চেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস কে পরাজিত করার উপর বেশি জোর দেয়।


পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন কে পাখির চোখ করে যখন বিজেপি ও তার পিতৃপ্রতীম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) তীব্র গতিতে সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে, মুসলিম-বিদ্বেষ তীব্র করে, হিন্দু ভোটের মেরুকরণ করা শুরু করলো তৃণমূল কংগ্রেস কে অনায়েসে হারাতে, সেই সময়ে অনেক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মনে করলেন যে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলন করে বিজেপি-বিরোধী ভোটের মেরুকরণ না করলে পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া কালবৈশাখীর তাণ্ডব আটকানো যাবে না। ফলে নানা ভাবে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলনের প্রচার শুরু হল এবং শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রামে দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বও সমর্থন জানিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, যখন গোটা রাজ্যে বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া নিজের পক্ষে টেনে ও ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে রাজ্যের ক্ষমতা হাতাতে চাইছে তখন সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ কে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বললেই কি ফ্যাসিবিরোধী দায়িত্ব খালাস হয়ে যায়? শুধু বিজেপি কে ভোট না দিতে বলে অন্য যে কোন প্রার্থী কে ভোট দিতে বললে কি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে, যা এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের নানা আদিবাসী ও দলিতদের মধ্যে শক্ত ভিত গড়ে তুলেছে এনআরসি থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, রোখা সম্ভব?


তাত্ত্বিক ভাবে অনেকে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলনের নানা ব্যাখ্যা করেছেন। তবে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের কথা বলেও তাঁদের সাথে সম্পর্কহীন এই আন্দোলনের মূল কর্মপদ্ধতি হল অন্য দলের সংগঠনের ঘাড়ে চেপে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করো। যাঁদের ডাকে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলন শুরু হল, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের কোন সংগঠন কেন বিজেপি কে পরাস্ত করতে গত সাত বছরে গড়ে উঠলো না? কেন তাঁদের তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে বামফ্রন্টের মতন বিলীন হতে থাকা শক্তির সাহায্য প্রার্থী হতে হয় বিজেপি কে হারাতে? অথচ ২০১৩ সালের শেষ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কিন্তু আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে নিজের সংগঠন কে শক্তিশালী করে তুলেছে ও নানা কায়দায় বিজেপির বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করেছে? তাহলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী শিবির কেন পারেনি? সমস্যাটা কি টেকনিক্যাল বা অর্থের সমস্যা? নাকি রাজনৈতিক সমস্যা?


আদতে যে অজুহাত দিয়েই এই “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলন গড়ে তোলা হোক না কেন, এর আসল উদ্দেশ্য হল বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষ কে সক্রিয় প্রতিরোধের রাস্তা থেকে সরিয়ে, ভাত আর ইজ্জতের সংগ্রাম থেকে সরিয়ে, শুধু মাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই যে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা যায় সেই দেউলিয়া রাজনীতিতে বিশ্বাস করিয়ে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের পথে ঠেলে দেওয়া। এই পথ দোদুল্যমান অথচ আত্মস্বার্থে চিরমগ্ন শহুরে মধ্যবিত্তদের প্রিয় হবেই কারণ এতে আছে উদারনৈতিক রাজনীতির স্রোত ধারা, তবে এই পথ শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি ও শোষিত মানুষ কে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেবে না, কারণ এই পথের কোন নির্দিষ্ট কর্মসূচী নেই। বিজেপি-র বিরুদ্ধে কাকে নির্বাচিত করবেন জনগণ? আর তার নীতিগুলো কি সত্যিই বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে? এই প্রশ্নটি যতটা সাধারণ গরিব মানুষ কে নাড়া দেবে—কারণ প্রতিবার তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ঠকতে হয় আর সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হতে হয়—ততটা শহুরে মধ্যবিত্ত কে নাড়া দেবে না। কারণ শেষোক্তদের প্রতিদিন রাজনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে হয় না।


একটি নেতিবাচক স্লোগান—“নো ভোট টু বিজেপি”—কোন ইতিবাচক রাজনীতির জন্ম দিতে পারে না কারণ এই রাজনীতি একটা কাজ করতে মানা করলেও ঠিক কী করতে হবে সেই কথা বলছে না। বিজেপির বিরুদ্ধে যদি একজন তৃণমূল কংগ্রেস বা কংগ্রেস বা সিপিআই (এম) কে ভোট দেন তাহলে কী গ্যারান্টি আছে যে ভোটে জিতে সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি একটু ভাল দামের জন্যে নিজেকে বিজেপি কে বিক্রি করে দেবেন না? বা সাধারণ মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না? এই নেতিবাচক “নো ভোট টু বিজেপি” স্লোগানের জায়গায় যদি “রেজিস্ট বিজেপি” বা “ডিফিট বিজেপি” বা “ডিফিট আরএসএস” স্লোগান তুলে সংগ্রামটিকে ভোটের সমীকরণের রাজনীতির থেকে মুক্ত করে সক্রিয় রাজনৈতিক প্রতিরোধের পথে, আরএসএস ও বিজেপি কে সমূলে রাজ্য থেকে উৎখাত করতে দেওয়া হয় তাহলে কি বেশি মানুষ কে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে নাড়া দেওয়া সম্ভব হত না? সম্ভব হত না কি একটি লড়াকু সংগঠন গড়ে প্রতি এলাকায় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে প্রতিরোধ করা?


পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বেই দেখা গেল এই রাজ্যে ভোট হচ্ছে না বরং গণতন্ত্রের ঘোমটা দিয়ে খেমটা নাচ হচ্ছে। অসংখ্য কেন্দ্রে দেখা গেল ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এর গরমিল। দেখা গেল নানা অঞ্চলে আরএসএস ও বিজেপির সশস্ত্র হার্মাদ বাহিনী কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর চোখের সামনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষ কে বিজেপি কে ভোট দিতে বাধ্য করছে। দেখা গেল কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অঞ্চলের বাসিন্দারা অভিযোগ জানালেন বিজেপির দালালি করার। এই কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েই কিন্তু ধেই ধেই করে নেচেছিল বিমান বোস-সূর্যকান্ত মিশ্ররা। সিপিআই (এম) আর কংগ্রেস স্বাগত জানিয়েছিল মোদী সরকারের আধা-সামরিক বাহিনী কে। আর বিজেপির সরাসরি দালালি করা ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তো স্পষ্ট ভাবেই দেখা গেল। রাজ্যের শাসকদল যখন একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থায় তখন কী ভাবে “নো ভোট টু বিজেপি” বলে একটি প্রি-ফিক্সড (পূর্বনির্ধারিত) ম্যাচে বিজেপি কে নির্বাচনী খেলায় এমন বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীরা হারাতে চায় যাঁদের নিজেদের মাটির সাথে কোন সম্পর্ক নেই আর মানুষের মাঝে কোন সংগঠন নেই?


সিপিআই (এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের দেউলিয়াপনা দেখে থাকলেও, কংগ্রেসের সন্ত্রাস দেখে থাকলেও, তৃণমূল কংগ্রেসের লুঠতরাজ দেখে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিজেপি-আরএসএস এর ভয়ানক ফ্যাসিবাদী শাসন দেখাননি। তাই তাঁদের ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ানোর প্রক্রিয়াটা লম্বা আর তাতে নির্বাচন কোন বিকল্প না। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মানুষের পছন্দ বা বাছাই করার ভূমিকা কম থাকে বরং শাসকশ্রেণীর দ্বারা অনুমোদিত, তাদের শ্রেণীস্বার্থ কে সুদক্ষ ভাবে রক্ষা করার ক্ষমতার অধিকারী রাজনীতিবিদদের বিজয় চিরকালই সুনিশ্চিত থাকে। কোন নির্বাচনের ফলাফল কোনদিনই শাসকশ্রেণীর চাহিদার বিপরীতে যেতে পারে না কারণ বিশ্বের ইতিহাস সাক্ষী যে এই ঘটনা ঘটলেই হয় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে না হয় অন্য কোন কায়দায় সেই রকম বিজয়ী শক্তি কে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি পরাস্ত করে।


তবুও যেহেতু অনেকে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিজেপি কে তৃণমূল কংগ্রেস বা সিপিআই (এম) এর মতন দলের মাধ্যমে হারাবার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের মহৎ সেন্টিমেন্ট কে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলা উচিত যে এই মুহূর্তে এই দিবাস্বপ্নে মজে থাকলে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের চরম ক্ষতি হবে। তার চেয়ে বেশি দরকার হল সাধারণ মানুষ কে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী গণসংগ্রামে নিয়ে আসা ও তাঁদের সংগঠিত করে আরএসএস ও বিজেপি কে প্রতিরোধ করা এবং পরাস্ত করা। তার জন্যে দরকার এই প্রতিরোধের রাজনীতির সাথে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে সবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা পূর্ণ করার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বিজেপি ও আরএসএস যে অর্থনীতির শক্তিতে বলীয়ান হচ্ছে সেই অর্থনীতির পাল্টা একটি বিকল্প অর্থনৈতিক মডেল জনগণ কে দেখানো ও তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে, জনগণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার জন্যে উৎসাহিত করে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে আসা আজ ভীষণ জরুরী আর তাই বিজেপির সমস্ত দুর্বল খুঁটিতে আজ ধাক্কা দিতে হবে সজোরে। নির্বাচনী ভীরুর ক্রন্দন আজ জনগণ কে কোন ভাবেই রক্ষা করবে না।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে