কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রাম ভারতের সেনার পেশী শক্তিতে ভীত সন্ত্রস্ত নয়

মঙ্গলবার, মে ৩০, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

কাশ্মীরের মাটিতে ভারতের সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে পাথর যুদ্ধে রত কিশোরী

কাশ্মীরের মাটিতে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ বিপুল ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে আর কাশ্মীরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ছোড়া প্রতিটি পাথর বিজেপি ও আরএসএস এর সেই “নোটবন্দি হওয়ায় পাথর ছোড়া বন্ধ হয়ে গেছে” গোছের দাবিকে চূর্ণ বিচূর্ণ করছে। আর এই জনজাগরণের বিরুদ্ধে ভারতে উঁচু জাতের হিন্দু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা রোজ গলা চড়িয়ে সেনাবাহিনী কে গণহত্যা করার জন্যে দাবি জানানো সত্বেও এবং মোদী সরকারের দ্বারা কট্টর ব্রাক্ষণত্ববাদী বিপিন রাওয়াত কে কাশ্মীরিদের উপর অকথ্য অত্যাচার করে এই গণ সংগ্রাম বন্ধ করার দ্বায়িত্ব ন্যস্ত করা সত্বেও কাশ্মীরের মাটিতে সরকারি সন্ত্রাস ডাহা ফেল করছে। কাশ্মীরের জনগণ মাথা উঁচু করে সংগ্রাম করছেন।

যদিও ভারতীয় সেনা বাহিনীর জেনারেল বিপিন রাওয়াত, নিজ সামন্ততান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে একবিংশ শতাব্দীতেও ঘোষণা করে চলেছে যে আধিপত্য বজায় রাখতে হলে ভারতীয় সেনা কে জনগণের মধ্যে নিজ-সম্পর্কে ভীতি সঞ্চার করতেই হবে, তবুও কার্যক্ষেত্রে এই সামন্ততান্ত্রিক চেতনা দিয়ে গড়ে তোলা - নয়া ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা কে রক্ষা করার বাহিনী - ভারতীয় সেনা কিন্তু আজ রোজ অসংখ্য মানুষ কে গুলি করে মেরেও ভারত কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে পারছে না, আর যেহেতু ভারতের সেনা বাহিনী জনগণের মধ্যে নিজের শক্তি সম্পর্কে ভীতি জাগ্রত করেই নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করতে সক্ষম হয় তাই সেই কাজে অক্ষম হয়ে এই বাহিনী কাশ্মীরের মাটিতে হেরো বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।

লিতুল গগৈ এর মতন এক ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী কে ভারতীয় সেনার দ্বারা মেডেল দেওয়া কোন বড় ব্যাপার নয় কারণ লিতুল গগৈ’র আগে ভারতের শাসক শ্রেণীর, টাটা-আম্বানি-আদানি ও জোতদার-জমিদারদের স্বার্থ রক্ষাকারী সেনা বাহিনী ও আধা সেনা বাহিনী সেই সমস্ত অফিসার ও সৈনিকদের পুরস্কৃত করেছে যারা নানা ভাবে জনগণের উপর অত্যাচার করে বা সন্ত্রাস ছড়িয়ে শাসক শ্রেণীর প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করতে সাহায্য করেছে। তাই কুনান পোশপারায় গণধর্ষণ থেকে শুরু করে কাশ্মীরের অসংখ্য গণহত্যা ও গুমখুনের হোতা সেনা জওয়ানদের দেওয়া হয় বড় বড় পুরস্কার ও প্রচুর অর্থ ও সুযোগ সুবিধা। সেই খুনি ও ধর্ষকদের বিরুদ্ধে পাথর ধেয়ে আসলেই বলা হয় “গরিবের ছেলেটা কে মারছে” আর সেই মধ্যবিত্তরা, যারা দিল্লিতে একটি ছাত্রীর গণধর্ষণের পরে সারা দেশ জুড়ে আন্দোলনের পথে নেমেছিল, তারাই কুনান পোশপারায় ৯ বছর থেকে ৭০ বছরের নারীদের গণধর্ষণকারী জওয়ানদের বাহবা দেয় দেশ প্রেমের মূর্ত স্বরূপ বলে।

ভারতের মাটিতে কাশ্মীর কে কেন্দ্র করে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ সাবর্ণ হিন্দু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কে ভারতের শাসক শ্রেণী এক ছাতার তলে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং কাশ্মীরের উপর ভারতীয় অধিগ্রহণ কে বজায় রাখার সামাজিক স্তম্ভ রূপে এই সমর্থন কে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে, তাই নরেন্দ্র মোদীর সরকারের পক্ষে ভারতের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের কাছে কাশ্মীরের জনগণের উপর অকথ্য সামরিক দমনপীড়ন ও অত্যাচার চালানোর জন্যে কোন অনুশোচনা করতে যেমন হচ্ছে না, তেমনি কোন রকমের জবাবদিহিও করতে হচ্ছে না। জনগণের করের টাকায় কাশ্মীরের মানুষ মারার জন্যে বেশি বেশি করে সৈন্যবল কে পাঠানো হচ্ছে জনগণের রক্তে হোলি খেলার জন্যে ও ভারতের ঔপনিবেশিক শাসন ও আগ্রাসন কে বজায় রাখার জন্যে। মনিপুর, নাগাল্যান্ড থেকে কাশ্মীরে তাই নির্বিচারে গণহত্যা করা আজ একেবারে জলভাত হয়ে গেছে। আর সাবর্ণ মধ্যবিত্তদের ও উচ্চবিত্তদের কাছে এই রক্তপাত আজ স্বস্তিদায়ক, তাঁদের মুসলিম বিদ্বেষী আত্মা আজ পরিতৃপ্ত।  

বর্তমানে অনেক বিরোধী দল ও শক্তি নরেন্দ্র মোদীর সরকার ও আরএসএস এর দিকে কাশ্মীর সমস্যাকে বেড়ে যেতে দেওয়ার অভিযোগ করে তর্জনী তুলেছে। ব্যাপারটা এমন ভাবে পেশ করা হচ্ছে কিছু কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমে, যেন কাশ্মীরের সমস্যা কে খুব সহজেই সমাধান করা যেত, কিন্তু যেহেতু নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীরের মাটিতে হিংসার আবহাওয়া কে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক ভাবে হিন্দুত্বের ঝান্ডা কে বলিষ্ঠ ভাবে ভারতীয় সাবর্ণ হিন্দু উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে গেড়ে দিয়ে নিজের প্রতিপত্তিকে শক্তিশালী করতে উদগ্রীব, তাই এই সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না। আর মূলধারার প্রচার মাধ্যমের তথাকথিত সরকার-বিরোধী পক্ষের এই যুক্তি মোদী ও হিন্দুত্ববাদ-বিরোধী ভারতের বেশির ভাগ মানুষই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানের পথ বাতলানো হচ্ছে আলোচনার টেবিলের মাধ্যমে, যদিও সেইরকম হাজারো আলোচনা অতীতে ভেস্তে গেছে ও কোন ধরণের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করেনি।  

তবে আমাদের কাছে আজ সমস্যাটা নরেন্দ্র মোদীর অপশাসনের নয় বরং কাশ্মীর নিয়ে ভারতের শাসকশ্রেণীর দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা নীতির প্রশ্ন। কাশ্মীর কি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ? কাশ্মীরের জনগণ কি নিজেদের ভারতের নাগরিক হিসেবে মনে করেন? ভারতের সেনা কে কি কাশ্মীরের জনগণ ডেকে নিয়ে গেছিলেন উপত্যকায়? কাশ্মীরের বিক্ষোভকারীরা কি জনগণের একটা ছোট অংশমাত্র?

উপরোক্ত প্রশ্নগুলির জবাব আপনি নানা শিবিরে নানা রকমের শুনবেন। যদি আপনি বিজেপির শিবিরে যান বা অর্ণব গোস্বামীর মতন ঝানু হিন্দুত্ববাদী সাংবাদিকের বাচালি শোনেন, অথবা যদি আপনি বলিউডের “দেশপ্রেমিক” মশলা মেশানো সিনেমা দেখেন তাহলে আপনার মনে হবে কাশ্মীরের মানুষ ভারত কে নাকি ভালোবাসেন এবং কাশ্মীর নাকি ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, বা কাশ্মীরের মাটিতে সেনাবাহিনী সঠিক কাজই করছে, ইত্যাদী। অথচ, যদি আপনি সেই একই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে দক্ষিণ থেকে উত্তর সমগ্র কাশ্মীর চষে বেড়ান তাহলে শুনবেন একটাই কথা, কাশ্মীর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্যালেস্তাইন বা উত্তর আয়ারল্যান্ড আর ভারতের ভূমিকা এখানে জায়নবাদী ইস্রায়েল বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে কম নয়।

কাশ্মীরের মানুষ আপনাকে শোনাবেন যে তাঁরা চান স্বাধীনতা, নিজেদের ভাগ্য নিজে নির্ধারণ করতে চান তাঁরা। কাশ্মীরের জনগণের কাছে ভারতের ফৌজ এক বিদেশী আগ্রাসী বাহিনী বাদে কিছুই নয় এবং এই ফৌজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা কে তাঁরা নিজেদের পবিত্র কর্তব্য হিসেবে গণ্য করেন।  তাঁরা অনেকদিন শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচনের পথে অংশগ্রহণ করেছিলেন কারণ বিএসএফ বা রাজপুতানা রাইফেল তাঁদের মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে তাঁদের ভোটদানে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল বলে। যে অল্প কয়েকজন মানুষ স্বেচ্ছায় ভোট দেন, তাঁরা ভোট দেন অনেক সময় জলের কল, রাস্তার পিচ, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য পরিষেবার জন্যে, তাঁরা কাশ্মীরের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে ভোট দেননা।  

ভোটের চেয়ে কার্যকরী কাশ্মীরের জনগণ আন্দোলন ও সংগ্রামের পথ কে মনে করেন আর তাই তাঁরা কাশ্মীরের রাস্তায় আজ অবলীলায় নেমে আসছেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, এবং নিজেদের মধ্যে ঢুকে থাকা সালাফিবাদী জাকির মুসার মতন বেইমানদের ছুড়ে ফেলছেন কারণ তাঁরা বুঝেছেন যে বিরাট গণ আন্দোলন বা সংগ্রাম ছাড়া ভারতের থেকে তাঁদের স্বাধীন হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। তাঁদের আন্দোলন ইন্টারনেট ব্যান, বিচ্ছিন্ন টেলিফোন ও প্রচার মাধ্যমের কারণে সর্বদা বাইরে আসতে সক্ষম নয়, তাঁদের ছোট ছোট বিজয়গুলোর খবর ভারতের সংগ্রামী জনগণ সবসময়ে জানতে পারেন না, তবুও প্যালেস্তাইনের থেকে দৃঢ় হয়ে আর আয়ারল্যান্ডের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাশ্মীরের মানুষ আজ লড়ছেন।  

আন্তর্জাতিক ভাবে যেহেতু ভারত বিশ্বের উপর প্রভুত্ব কায়েম করা মার্কিন একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি কে লোভনীয় বাজার, সস্তা কাঁচামালের উৎস, ও সস্তা শ্রমের যোগান দেয়, এবং যেহেতু এখানকার শাসকশ্রেণী বিনা দ্বিধায় পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের সেবা করে তাই ভারতের  শাসক শ্রেণী কাশ্মীরে জঘন্য গণহত্যা করা সত্বেও কাশ্মীরের জনগণের জন্যে রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে কান্নাকাটি হয় না আর ভারত সরকার কে কড়া ভাষায় মার্কিন সরকার ভৎসনা করে না। ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট ভারতের পক্ষে কাশ্মীরের মানুষের থেকে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো কেড়ে নিয়ে তাঁদের উপর নির্মম অত্যাচার চালানো কোন রকম ভাবেই কষ্টকর হয় না আর ভারতের সেনা বাহিনী বরং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ও জায়নবাদী ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্বন্ধ গড়ে তোলে এই অছিলায়।

তবুও কাশ্মীরের জনগণ কে দমিয়ে রাখতে অপারগ হয় ভারতের শাসক শ্রেণী ও তার খুনি বাহিনী। হাজারো মানুষ কে খুন করে, নারীদের ধর্ষণ করে, বাচ্চাদের চোখে ছররা চালিয়ে অন্ধ করেও, বন্দুকের নল থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেও, কাশ্মীরের জনগণ কে এবং তাঁদের চেতনা কে পদদলিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে ভারত সরকার। সারা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ ও বৃহৎ দেশী পুঁজির সাহায্যে ও সমর্থনে বলীয়ান নরেন্দ্র মোদীর সরকার, অর্ণব গোস্বামী, সুধীর চৌধুরী, স্বপন দাসগুপ্ত, বা কাঞ্চন গুপ্তর মতন পেটোয়া সাংবাদিকদের নিরন্তর প্রচার সত্বেও আজ কোন ভাবেই কাশ্মীরের মাটিতে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারছে না। এমনকি গণহত্যার রক্তের স্রোতে রাস্তা ঘাট ভাসিয়ে দিয়েও তারা কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতার আকঙ্ক্ষা কে পর্যদুস্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

কাশ্মীরের সমস্যাটা নরেন্দ্র মোদীর শাসনের সমস্যা নয়, কাশ্মীরের সমস্যা আরএসএস এর দ্বারা মিলিটারি কে পরিচালনা করার সমস্যা নয়, বরং কাশ্মীরের সমস্যা হলো জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সমস্যা, স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান ভারতের সরকারে একের বদলে অন্য পার্টি এনে হবে না, এই সমস্যার সমাধান হবে কাশ্মীরের জনগণের ন্যায্য স্বাধীনতার দাবিকে নতমস্তকে মেনে নিয়ে তাঁদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অত্যাচার ও অবিচারের জন্যে ক্ষমা চেয়ে। আর নরেন্দ্র মোদী বা আরএসএস যে বিনা লড়াইয়ে এক সুচাগ্র মেদিনীও দেবে না সেকথা কাশ্মীরের ছোট ছোট বাচ্চারা জানে বলেই তাঁরা পাথর ছুড়ছেন।

ভারত ও তার শাসক শ্রেণী এবং বিদেশী লগ্নিকারী সংস্থাগুলো যে কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি শান্তিপূর্ণ ভাবে মেনে নেবে, সেই রকমের  অলীক কল্পনা আমাদের করা উচিত নয়। ভারত একটি গায়ের জোরে গঠিত জাতি-রাষ্ট্র, যাকে এক করে রেখেছে সেনাবাহিনীর বজ্র আঁটুনি। বকলমে সামরিক শাসন ও জনগণের মধ্যে সেনা সম্পর্কে গভীর ভীতির সঞ্চার করিয়ে নিজ শাসন কে গণতান্ত্রিক বলে কি ভাবে পরিচালনা করতে হয় তা ভারতের শাসক শ্রেণীর চেয়ে বেশি ভাল কেউ করে দেখাতে পারেনি আর তাই এই শাসনব্যবস্থার পক্ষে কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি স্বীকার করে নেওয়া মানে হলো নিজ শাসনের গোঁড়ায় কুড়োল মারা। কারণ কাশ্মীর মুক্ত হলে মনিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় রাজ্যগুলিও  দ্রাবিড়নাডুর দাবি তীব্র করবে।

কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতার একমাত্র পথ হলো গণ সংগ্রাম ও মুক্তির লক্ষ্যে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো কে একত্রিত করে আপোষহীন সংগ্রাম করা। কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে এখন অনেকেই পথে নেমেছেন আর অনেক সংগঠন বিভিন্ন লক্ষ্যে তাঁদের পরিচালনা করছে। আজ কাশ্মীরের জনগণের দরকার একটি আগুয়ান বিপ্লবী কেন্দ্র ও রাজনৈতিক সংগঠন যা তাঁদের কে শুধুই ভারতের সামরিক শাসনের থেকে মুক্ত করার লড়াইয়েরই নেতৃত্ব দেবে না, বরং মুক্ত কাশ্মীরের জনগণের আর্থিক বৈষম্য দূর করতে এবং সামন্ততন্ত্র কে নিঃশেষ করে একটি নয়া গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সমাজ গড়ে তোলার লড়াইয়েরও নেতৃত্ব দেবে। যতদিন না এমন একটি সংগঠন, যা একটি বাস্তব ভিত্তিক তত্ব দ্বারা ও একটি ঐক্যবদ্ধ ও দূরদর্শী কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত, কাশ্মীরের জনগণের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে উঠে না আসছে, ততদিন পর্যন্ত কাশ্মীরের উপর থেকে ভারতের শাসকশ্রেণীর শাসনের অবলুপ্তি ঘটানো সম্ভব হয়ে উঠবে না।

কাশ্মীরের মাটি থেকে ভারতের আগ্রাসী বাহিনী কে দূর করে দিতে এই রকমই একটি সংগঠনের আজ ভীষণ বেশি প্রয়োজন হয়ে উঠেছে এবং এই প্রয়োজন কে পূর্ণ করার দ্বায়িত্ব নেওয়ার থেকে, কাশ্মীরের মানুষ কে তাঁদের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে সহযোগিতা করার দ্বায়িত্ব থেকে যদি আজ সমস্ত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তি নিজ হাত গুটিয়ে নেয় তাহলে, জনগণ কে বশ মানাতে ডাহা ফেল করেও, কাশ্মীরের মাটিতে ভারতের সম্প্রসারণবাদী শাসকশ্রেণী নিজ আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

আসুন কাশ্মীরের পাশে দাঁড়াই ও ভারতের শাসক শ্রেণীর ও তার মিলিটারির দ্বারা কাশ্মীরের জনগণ কে ভীতি প্রদর্শন করে বা অকথ্য অত্যাচার করে নিজ ক্রীতদাসে পরিণত করার চক্রান্ত কে চূর্ণ করতে আমরা সকলে, এক গণতান্ত্রিক - স্বাধীন - প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ কাশ্মীরের জন্যে কাশ্মীরের জনগণের সংগ্রাম কে সঠিক রূপ দান করতে সহযোগিতা করি।  

পশ্চিমবঙ্গের ইস্কুলে বাংলা বাধ্যতামূলক হওয়ায় অল্প হলেও ধাক্কা খেল মোদীর হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের স্বপ্ন

মঙ্গলবার, মে ১৬, ২০১৭ 0 Comments A+ a-


পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চাটুজ্যের জন্যে বড় বেশি পিরিত হচ্ছে মনে, এত ভাল লাগছে লোকটার সিদ্ধান্ত কে যে ইচ্ছা হচ্ছে ধেইধেই করে নাচি। পশ্চিমবঙ্গে বাস করা শিশু কে যে স্কুলেই পড়ান না কেন তাঁকে বাংলা অবশ্যই শিখতে হবে। বলা যেতে পারে যে তলে তলে যতই তালমিল করে চলা হোক না কেন এই সিদ্ধান্ত তৃণমূল সরকারের তরফ থেকে দেশের সব ভাষাভাষীর মানুষের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কাজ করে চলা মোদী সরকারের, আর সেই সরকারের পিতৃদেব আরএসএস এর গালে একটি বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়।  

বাংলা লেখাপড়া শিখিয়ে ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করার কাজে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ভীষণ অনীহা। সেই ব্রিটিশ যুগ  থেকেই চলছে সাবর্ণ ভদ্রলোক সমাজের ইংরাজীর সামনে নাকে খত  দেওয়া। যদিও বা ভারতের ও বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইংরাজীর এই জরুরী ভূমিকার কথা মেনেও নেওয়া যায় তাহলেও কিন্তু বাঙালি বা তামিল ভাষী ছাত্র-ছাত্রীদের জোর করে হিন্দি শেখানোর যে নির্দেশিকা কেন্দ্রীয় সরকার চাপিয়ে দিয়েছে দেশের শৈশবের উপর তার আসল কারণ হলো হিন্দির দ্বারা সমস্ত অন্যান্য ভাষা কে পদদলিত করা ও গোলাম জাতি তৈরি করা। এবং এই সিদ্ধান্ত কে পশ্চিম পাকিস্তান কতৃক পূর্ব পাকিস্তানের উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার মতনই মেনে নেওয়া যায়না।

১৯৬০ এর দশকে দ্রাবিড় আন্দোলনের ফলে, শিলচরের বাঙালির আত্মত্যাগের ফলে নেহরু সরকারকে ভারতের জনগণের উপর সংস্কৃতায়ন করা হিন্দি ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের থেকে পিছু হটতে হয়। তবে সেই সময়ের থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে ভাবে সিনেমা, সংস্কৃতি, সংগীত ও সরকারি কার্যকলাপের মাধ্যমে সারা ভারতে হিন্দি ভাষা দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার ফলে বর্তমানে হিন্দুত্ববাদের ধ্বজ্জাধারী আরএসএস ও বিজেপির পক্ষে দেশের বেশির ভাগ অ-হিন্দি ভাষী সমাজের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া ও দেশটিকে একটি হিন্দি ভাষী হিন্দু দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।

বাঙালি, উড়িয়া, অহমীয়, মনিপুরী, তামিল, নাগা প্রভৃতি জাতির উপর, গোন্দ, গিরিজন, ডোঙ্গরিয়া কোন্ধ, সাঁওতাল, ওরাওঁ, ভীল, মুন্ডা, প্রভৃতি আদিবাসী সমাজের উপর আজ হিন্দির আগ্রাসন তীব্র গতিতে বাড়ছে। এমনকি হিন্দি বলয়ের অবধি, মৈথিলি, ভোজপুরি, পূর্বাঞ্চলীয় ভাষাগুলি ধীরে ধীরে হিন্দির উপাঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে নিজ বৈশিষ্ট্য ও নিজ স্বতন্ত্রতা আজ হারিয়ে ফেলেছে। তামিল, মালয়ালম, কন্নড় ও তেলেগু ভাষী মানুষের উপর আজ উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্বের আগ্রাসনের ফলে, ব্যাঙের ছাতার মতন বেড়ে চলা আরএসএস ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের শাখার ফলে, হিন্দির প্রভাব বেড়ে গেছে। শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের একটি বড় অংশ কে আজ নানা কায়দায়, নানা জায়গায় হিন্দি বলতে বাধ্য করা হচ্ছে।


এইরকম পরিস্থিতিতে শ্রমজীবি মানুষের একটা বড় অংশই ধীরে ধীরে হিন্দি ভাষার ও সংস্কৃতির দাসে পরিণত হচ্ছেন, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে। এই শ্রমজীবি জনগণের মধ্যে পরবর্তী কালে তাই জাতি ও ধর্মীয় বিদ্বেষের নবীনতম সংস্করণগুলো, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিন্দি ভাষী সংঘ কর্মীরা হিন্দি ভাষায় সৃষ্টি করে থাকে, তার প্রচার অনেক সহজ হয়ে যায়, আর আরও সহজ হয়ে যায় কিছু কাঁচা টাকার লোভ দেখিয়ে এই শ্রমজীবি মানুষের বাড়ির ছেলে মেয়েদের সংঘের শাখায় ভর্তি করিয়ে তাঁদের দিয়ে মুসলমান ও খ্রিষ্টান হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত করা। এই হিন্দি ও হিন্দুত্বের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শোষিত ও পদদলিত জাতিগুলি, বাংলার মতন বিপন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিগুলি আজ রুখে দাঁড়াতে পারছে না নিজ জাতির শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে ভাষার অধিকারের স্বার্থে  গড়ে ওঠা লড়াইয়ের অভাবে।

দীর্ঘদিন ধরে সমস্ত স্তরে পরিকল্পিত ভাবে হিন্দির ব্যবহার বাড়িয়ে তুলে ও দেশের মধ্যে তীব্র আঞ্চলিক বঞ্চনা কে হাতিয়ার করে  ভারতের শাসক শ্রেণী, অর্থাৎ হিন্দি-মরাঠি ও গুজরাটি ভাষী বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা ও বড় বড় জোতদার-সামন্তপ্রভুরা দেশের শ্রমজীবি মানুষ কে বাধ্য করেছে নিজেদের প্রদেশ ছেড়ে হিন্দি-মরাঠি বা গুজরাটি ভাষী প্রদেশে বাস করতে এবং হিন্দি ভাষায় একে অপরের সাথে কথা বলতে। এই ভাবে দেশের শ্রমজীবি মানুষের থেকে এই বড় বড় পুঁজিপতি ও জোতদারেরা কেড়ে নিয়েছে তাঁদের নিজের ভাষায় কথা বলার ও নিজের রাজ্যে বাস করে দু বেলা পেট ভরে খেয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। নিজ শিকড় থেকে ছিন্ন হয়ে বাধ্য হয়েই এই সমস্ত শ্রমজীবি মানুষ অন্য প্রদেশে বাস করা শুরু করেন এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলা ও বাঙালি জীবনের থেকে সম্পূর্ণ রূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর এই ভাবেই একটি জাতি কে খুবই ঘৃণ্য কূটনীতির দ্বারা ব্রাক্ষণত্ববাদী উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় শাসক শ্রেণী নিজেদের গোলামে পরিণত করে।  

পশ্চিমবঙ্গ কে দীর্ঘদিন ধরে চক্রান্ত করে দেশের মধ্যে এক ঘরে করে রেখেছে এই দেশের হিন্দুত্ববাদী শাসক শ্রেণী ও তাঁদের দালাল সরকারগুলো। ফলে বাংলার মাটি ত্যাগ করে প্রতি বছর নানা ধরনের শিল্পে কাজ করতে, দিন মজুর বা কুলির কাজ করতে লক্ষ লক্ষ মানুষ দিল্লি, বোম্বাই, সুরাট, বারোদা প্রভৃতি জায়গায় যান এবং সেই সব রাজ্যের অধিবাসী হয়ে যান। এদের বেশির ভাগকেই শীঘ্রই নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে শুধুমাত্র শাসকশ্রেণীর স্বার্থে গোলামের মতন খেটে যেতে হয় এবং শাসক শ্রেণীর ভাষায় কথা বলতে হয়, শাসক শ্রেণীর আদব কায়দায় জীবন যাপন করতে হয়। এই সকল রাজ্যে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বাঙালি জাতি ও সেই জাতির অস্তিত্ব নিয়ে এতই অপপ্রচার করা হয় যে বেশির ভাগ স্বল্প চেতনার মানুষ সেই অপপ্রচার কে বিশ্বাস করে ফেলেন ও নিজ জাতির উপর ও ভাষার উপর তাঁদের বিতৃষ্ণা জাগে।

পশ্চিমবঙ্গে বাস করা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সাবর্ণ বাঙালি ভদ্রলোকদের বেশির ভাগই আর ছেলে মেয়েদের বাংলা শিখতে দেননা আর বাংলা নিয়ে কটা রবীন্দ্র জয়ন্তী বাদে আর কোন চর্চা করতে দেননা। বিশেষ করে ইন্টারনেটের যুগে এগিয়ে থাকতে ছেলে মেয়েদের জোর করে ইংরাজী মিডিয়াম ইস্কুলে ভর্তি করেন এবং নিজ ভাষা কে বাদ দিয়ে অন্য ভাষা কে শ্রদ্ধা করতে শেখান। যে ছেলে মেয়েরা বাংলা মাধ্যম ইস্কুল থেকে পাশ করেন তাঁদের এই সাবর্ণ, wannabe, ভদ্রলোকের ছানারা হেয় চোখে দেখে এবং কোন মর্যাদা দেয় না। যেহেতু সকল চাকরির ইন্টারভিউ ইংরাজী ভাষায় হয় এবং নানাবিধ প্রযুক্তির পরিচালনা ইংরাজী ভাষায় হয় তাই বাংলা মাধ্যম থেকে পাশ করা বহু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের ইংরাজী মাধ্যম থেকে লেখাপড়া শেখা ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় দুর্বল ভেবে নেন এবং জীবনে একটি হীনমন্যতার শিকার হন। মনে রাখবেন যে এসইউসিআই এর ডাকা প্রাথমিক থেকে ইংরাজী শিক্ষার দাবিতে বাংলা বনধ সেই নব্বইয়ের শেষদিকে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল এই কারণেই।

ইংরাজী যেমন ভারতের ভাষা নয় আর হিন্দি যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের ভাষা নয় তাই এই দুটি না জানা থাকলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কোন ক্ষতি যেমন নেই, ঠিক তেমনিই এই ভাষাগুলো না জানা কোন লজ্জার বিষয় নয়। ফ্রান্সে বা জার্মানিতে সেখানকার মানুষ ইংরাজী জানা থাকলেও অনেক সময়ে ইংরাজী ভাষায় জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের উত্তর দেননা ইংরাজী জানা নেই বলে অজুহাত দিয়ে। আসল কথা হলো সেই দেশের মানুষের দাবি হলো যে তাঁদের দেশে আসা প্রতিটি জাতির মানুষ যেন তাঁদের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করেন এবং ভাঙা ভাঙা হলেও সেই ভাষায় তাঁদের সাথে কথা বলেন।    

যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার বহু বছর পরে আবার বাংলা শিক্ষা কে বাধ্যতামূলক করলো, তাই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সকল ধরণের ইস্কুল কে এখন থেকে ছাত্রছাত্রীদের তাঁদের মাতৃভাষা ছাড়াও বাংলা শেখাতে হবে এবং এর ফলে বাংলার বিরুদ্ধে হিন্দি ও গুজরাটি ভাষী উচ্চ জাতির হিন্দুদের ঘৃণা বেড়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে বাস করা হিন্দি ও গুজরাটি ভাষী উচ্চ জাতির লোকেরা প্রধানতঃ বৃহৎ মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণীর লোক এবং এই রাজ্যে এরাই মূলত আরএসএস কে জমি করে দিচ্ছে। ফলে যে মুহূর্তে এদের বাড়ির ছেলে মেয়েরা সহজপাঠ পড়বে বা রবি ঠাকুর আর নজরুল পড়বে, তখনই এদের ব্রাক্ষণত্ববাদী মাড়োয়ারি-গুজরাটি হৃদয় বেদনায় কাতরে উঠবে, এবং যুগ যুগ ধরে এদের পুঁজির ক্রীতদাস হয়ে বাস করা বাঙালির কাছে সেটা হবে হয়তো একটা ছোট আনন্দের ক্ষণ।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করলেও বাংলা কে কোন রকমেই শোষিত জনজাতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস কে সমর্থন করা যায় না। সাঁওতালি, নেপালি, রাজবংশী সহ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা, গান গাওয়া ও নিজ কর্ম ক্ষেত্রে কাজ করা মানুষের অবিচ্ছিন্ন অধিকার। বাংলা কে পশ্চিমবঙ্গের শোষিত জনজাতি ও আদিবাসী মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে ঠিক হিন্দি কে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নামান্তর। বাংলা কে শুধুমাত্র তাঁদের জন্যে আবশ্যিক করা উচিত, যাঁরা শোষিত জনজাতি বা আদিবাসী সমাজের মানুষ নন, যাঁদের নিজস্ব স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই এবং যাঁরা বাংলার শোষকশ্রেণী হিসেবে পরিচিত, যেমন মাড়োয়ারি, গুজরাটি, ইত্যাদী সমাজের লোকেদের জন্যে বাংলা কে আবশ্যিক করা অবশ্যই সমর্থন যোগ্য। কিন্তু সাঁওতালি, রাজবংশী, ইত্যাদী ভাষার মানুষ কে জোর করে বাংলা শেখানো অনুচিত, বরং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত এই সকল জনজাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়কে তাঁদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি কে রক্ষা করতে সাহায্য করা এবং সমস্ত আদিবাসী ভাষা কে সরকারি ভাষার সম মর্যাদা দেওয়া, সেই সব ভাষার লিপি পুনরুদ্ধার করা বা নতুন করে তৈরি করা এবং সেই ভাষার ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা।

তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন সমাজবাদী সরকারের মতনই অস্তগামী কারণ বছরে প্রায় ₹৩০০০ কোটি খরচ করে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের বুকে নিজের রাজত্ব কায়েম করার লক্ষ্যে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে। উচ্চ জাতির অবাঙালি হিন্দুদের ও সাবর্ণ বাঙালি ভদ্রলোকদের একটা বড় অংশের উপর এদের আজ একচেটিয়া রাজনৈতিক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর এর ফলেই তৃণমূলের অবস্থা একেবারে ঘাটের মড়ার মতন হয়েছে। ফলে এই সরকারের দ্বারা ইস্কুলে বাংলা ভাষা আবশ্যিক করার সিদ্ধান্ত বিজেপির উপর একটা বড় ধাক্কা হলেও এর ফলে বিজেপি ও আরএসএস আরও বেশি করে অবাঙালি উচ্চ জাতির বেনিয়াদের ও অবাঙালি হতে চাওয়া বাঙালি সাবর্ণদের তাতিয়ে তুলবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আর তার ফলে বাঙালি ও অবাঙালি বেনিয়াদের মধ্যে দ্বন্ধটা খোলাখুলি প্রকাশ পাবে, যা হয়তো বাঙালির আত্মসম্মানের ও স্বাধিকারের দাবিতে লড়াই কে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলবে আগামী দিনে। আপাততঃ ইস্কুলের বাচ্চারা বাংলায় পড়ুক নজরুলের কবিতা আর রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প।  

  

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে