মার্কিন নির্বাচনের চাপেই মোদী'র "সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের" গল্পে বাজার গরম করার প্রচেষ্টা

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মোদীর মুখে শান্তি বাণী  সত্বেও উরি বা অন্য কোনো ঘটনা নিয়ে মার্কিন সমর্থনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হতে পারে




অনেক বছর আগে যখন নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিল আর মনমোহন সিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিল, তখন প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তানের সাথে সীমানায় সংঘর্ষ ও উগ্রপন্থী হানা নিয়ে কড়া কড়া ভাষণ দিত নরেন্দ্র মোদী। সেই সময়ে নরেন্দ্র মোদী দাবি করতো যে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলে পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেবে বিজেপির সরকার। প্রধানমন্ত্রী পদে বসার দুই বছরের মধ্যে মোদীর রাজত্বে ঘটেছে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর, পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে হামলা, এবং সর্বশেষ হলো উরি সেনা ছাউনিতে হামলা। এই হামলার পরেই তথাকথিত “জাতীয়তাবাদী” মিডিয়া একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়ে, ভারী ভারী শব্দ বাণ ছুড়ে টিভির পর্দা আলো করে স্টুডিওর শীত তাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে পাকিস্তান কে সীমিত ও পূর্ণ যুদ্ধ দ্বারা একেবারে কাবু করার নানা ফন্দি দর্শকদের জানালো টিভি সামরিক বিশেষজ্ঞরা, এছাড়াও সমস্ত অন্তর্জাল জুড়ে ভাসতে থাকলো মোদী ভক্তদের যুদ্ধের হুঙ্কার, কেউ কেউ হিসেব কষে বলে দিল যে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র কে সাথে নিয়ে পাকিস্তানকে কি ভাবে বিচ্ছিন্ন করে কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া যায় এবং পাকিস্তানের ভূ খন্ডকে দখল করা যায়। এরই মধ্যে একাংশ আবার পাকিস্তান ও চীন দুই দেশকেই জব্দ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাথে অন্যান্য সামরিক শক্তির মদত চাওয়ার বুদ্ধিও দিল। এত শতের মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস চুপ থাকে কি করে? আরএসএস নেতা ও কাশ্মীরের উপর ভারতীয় খবরদারি ও দখলদারি বজায় রাখার কৌশল ও রণনীতি পরিকল্পনা করার মূল হোতা রাম মাধব বললো যে দাঁতের বদলে পাকিস্তানের চোয়াল ভেঙে দিতে হবে। আরএসএস ময়দানে নামতেই অনেকে আশা করেছিল যে মোদী যুদ্ধ বা সীমিত যুদ্ধের পরিকল্পনা তো করবেই। রিলায়েন্স গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ কুইন্ট নামক ওয়েবসাইটটি তো “গোপন সূত্রের” খবর পাওয়ার ভিত্তিতে একেবারে জানান দিয়ে দিল যে ভারতীয় সেনা নাকি একেবারে সানি দেওলের সিনেমার মতন হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তানে ঢুকে ব্যাপক যুদ্ধ করে ২০ জন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী সহ ২০০ জন কে মেরেছে। চাটুকারিতার এহেন নিদর্শনে তাজ্জব হয়ে গেল সেনাবাহিনীই। ভারতের সৈন্য বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা খোলাখুলি অস্বীকার করলো এই রকম কোনো অভিযানের কথা। ফলে কুইন্টের ঢপের কীর্তন শুনে যে ভক্তকূল উল্লাস করছিল তাদের উপর যেন একেবারে পাহাড় ভেঙে পড়লো।

বেশ কিছুদিন পরে আবার ২৮শে সেপ্টেম্বর সার্জিকাল স্ট্রাইক করে ৩৫ জন জঙ্গী খতমের দাবি করে ভারতের সেনাবাহিনীর ডিজিএমও রণবীর সিংহ। দাবি করা হয় যে ভারতের বাহিনী নাকি বলিউডি কায়দায় পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে নানা জঙ্গী ঘাঁটিতে হামলা করেছে আর এই ঘটনার ফলে নাকি পাকিস্তানের সাথে ভারতের সেনার গোলাগুলি হয়েছে। খবরের সততা অবশ্য পাকিস্তান অস্বীকার করেছে আর দাবি করেছে ভারত শুধু গোলাবর্ষণ করেছে যার ফলে দুই পাকিস্তান সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আগু পিছু কিছুই বিচার না করে ভারতের সেনা কর্তার বক্তব্য কে বেদ বাক্য মেনে ভারতের কর্পোরেট মিডিয়া অক্ষরে অক্ষরে প্রচার করে জানান দিতে থাকলো যে ভারত উরির ঘটনার বদলা নিয়ে নিয়েছে এবং মোদী নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। যদিও মোদীর উপর ভক্তকূলের আশা ছিল ইন্দিরা বা লাল বাহাদুরের কায়দায় এক সম্পূর্ণ যুদ্ধ করার তবে কোঝিকোডের মোদী উবাচের প্রিয় তার ঢাক বাজানো বন্ধ হয়েছে মাত্র কিছু দিন আগে। আর ঠিক কি হয়েছিল কোঝিকোডে?  

মোদী ভক্ত ও কর্পোরেট মিডিয়ার শেষ আশা ছিল যে মোদী উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে দলীয় কর্মীদের তাঁতিয়ে তুলতে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সাথে সাথে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট,ও পাঞ্জাবের নির্বাচনের প্রাক্কালে উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ার ছড়িয়ে হিন্দুত্ববাদ কে জেতাতে নিশ্চয় কোনো জঙ্গী পদক্ষেপ নেবে। দেশজোড়া সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো কেরলের কোঝিকোডে বিজেপির সমাবেশে। কেরলে মোদী মুখ খুললো বটে তবে সেই মুখ খোলা ছিল ধূর্ততায় ভরা। একদিকে মোদী পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একঘরে করার, সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ঘোষণা করার কথা বললো, অন্যদিকে বেকারি, দারিদ্র্, অশিক্ষা ইত্যাদির বিরুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান কে একসাথে যুদ্ধ করে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার কথা বললো। কানহাইয়া কুমারের ঐতিহাসিক “আজাদী” স্লোগানের কয়েকটা বিষয়কে কাটছাঁট করে, বিশেষ করে আরএসএস এর কাছে নিষিদ্ধ “আজাদী” শব্দটা বাদ দিয়ে কিছু ভেজাল নেহরুবাদী ভাষণ দিল মোদী।

ভক্তকূল যে যুদ্ধের আশায় দিনরাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি, সেই যুদ্ধ তাদের কল্পনাতেই থেকে গেল। যুদ্ধের লাইভ কভারেজের জন্যে যে সমস্ত কর্পোরেট মিডিয়া গোষ্ঠী স্পন্সর খুঁজছিল, তারাও কেমন ম্রিয়মান হয়ে গেল আর যুদ্ধ না শান্তি নিয়ে বিতর্ক সভা করার জন্যে স্পন্সর খোঁজা শুরু করলো1। আর ২৮শে সেপ্টেম্বরের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর আবার যুদ্ধের খিদেতে কাতর হয়ে রক্তের জন্যে হাহাকার করা সেই কর্পোরেট মিডিয়া ও হিন্দুত্ববাদী এজেন্টদের জন্যে অক্সিজেন নিয়ে আসলো। সবার আগে মোদীর সমর্থক ভারতীয় মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা ও তাদের পোষা বড় কর্তারা চিৎকার করে সমর্থন জানান দিল আর সেই আওয়াজ শুনে পদলেহী মিডিয়ার কেষ্ট বিস্টুরা সব তর্ক-বিতর্ক সরিয়ে রেখে মিনিটে মিনিটে প্রচার করতে থাকলো ভারতের বদলার, দেখে মনে হচ্ছে কর্পোরেট মিডিয়ার ন্যাংটো হয়ে বাজারে এসে নিজেকে সরকারের প্রচার মন্ত্রকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করার দিন খুব বেশি দূরে নয়। কোন সাংবাদিক প্রশ্ন করলো না যে কেমন করে এই হামলা করা হয়, যে তিনটি সেক্টরের কথা ভারতীয় সেনা বলছে সেখানে যে জঙ্গী ঘাঁটির উপর আক্রমণের কথা বলা হলো সেগুলো কাদের, কি করে জানা গেল সেগুলো জঙ্গী ঘাঁটি তা নিয়ে কোনো উচ্চ বাচ্য ভারতের সেনা বাহিনীর নেই।কর্পোরেট মিডিয়াও জনগণের চোখে ঠুলি পড়াতে পেরে খুশি আর ভারতীয় সেনা কর্তারাও মোদী ও বিজেপির মুখ রক্ষা করতে পারার জন্যে খুশি। আর কোনো প্রশ্নই উঠলো না যে যদি এক রাতের হামলায় ভারতীয় সেনা এত জঙ্গী কে মারতে পারে তাহলে আবার ভবিষ্যতে এই রকম অভিযান আর হবে না ঘোষণা করে রণবীর সিংহ কাকে বার্তা দিতে চাইলো? ঘটনাগুলো অনেকটা নাটুকে হয়ে গেল না ?


মোদীর খোলাখুলি যুদ্ধে না যাওয়ার স্বিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই পরিণত রাজনীতির পরিচয় বলে মনে হয়েছে, অনেক তথাকথিত বামপন্থী লোকেরাও মোদী সাহেবের কোঝিকোডে দেওয়া দারিদ্র মোচন ও অশিক্ষা দূর করার আহ্বান কে সাধুবাদ জানালো, চারিদিকে যখন মোদীর ভক্তকূল যুদ্ধং দেহি ফানুস ফেটে যাওয়ায় হা হুতাশ করছিল ঠিক তখন দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের অনেকেই মোদীর এই নয়া নাটকের শিকার হয়ে গেলেন। যুদ্ধ হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আরএসএস বা বিজেপি জঙ্গী হিন্দুত্ববাদ আর যুদ্ধের পক্ষে জনমত কে উগ্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলার রাজনীতি থেকে সরে শান্তি আর প্রগতির রাজনীতি গ্রহণ করেছে। আরএসএস আর বিজেপি কে উত্তর প্রদেশ, গুজরাট আর পাঞ্জাবে কোনঠাসা অবস্থা থেকে উঠে এসে রাজ্যের মসনদে বসতে যুদ্ধ না হোক তো অন্তত পক্ষে যুদ্ধ যুদ্ধ জঙ্গীপনার আবহাওয়া কে জিইয়ে রাখতে হবে ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার কে জাগিয়ে তুলতে হবে প্রতি কয়েক সপ্তাহ অন্তর। বর্তমানে ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে সরকারী ভাবে যুদ্ধ বা সীমিত সামরিক হঠকারিতার পিছনে মার্কিন সমর্থন ভীষণ প্রয়োজন, বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন পাকিস্তানের সাথে ভারতের পুরানো প্রভু রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আর চীনের সাথেও ইসলামাবাদের দোস্তি সুদৃঢ় অন্যদিকে ভারতের সরকারও পাকিস্তানের আব্বা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সাথে শুধু সামরিক ও পারমানবিক সমঝোতায় নয় বরং একে অপরের ঘাঁটি ব্যবহার করার মতন লিমোয়া চুক্তির নাগপাশে বাঁধা পড়েছে। মার্কিন দেশে এই সময়ে নির্বাচনের হাওয়া, মুসলমান বিদ্বেষ, এশীয় জনজাতির প্রতি বিদ্বেষ ও অন্যন্য প্রকারের বর্ণ বিদ্বেষ ছড়িয়ে রিপাব্লিকান পার্টির  ডোনাল্ড ট্রাম্প যে প্রচারের ঝড় তুলে সাদা চামড়ার ভোটের মেরুকরণ করছে তাকে রুখতে ডেমোক্রাট হিলারি ক্লিন্টনের পক্ষে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভত মার্কিন ভোটারদের নিজের পক্ষে ধরে রাখা ভীষণ দরকার, আর তাই এই মুহূর্তে কোনো রকম যুদ্ধ অভিযানে মার্কিন আশীর্বাদ জুটবে না। তাই মোদী ৫৬ ইঞ্চির ছাতি ফুলিয়ে পাকিস্তান ধ্বংস করার কথা না বলে সেই পুরানো বামপন্থী বুলিগুলো কে নতুন সংঘ পরিবারের বোতলে করে চোলাই করে সময় কাটাচ্ছে। বড় মাত্রার যুদ্ধের জন্যে অন্তত নভেম্বর অবধি অপেক্ষা করতে হবে। ততদিন রণবীর ও মনোহর পরিক্করেরা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্প শুনিয়ে বাজার গরম করে রাখবে।

মোদী যখন ক্ষমতায় এসেছিল সেই সময় দেশজোড়া একটা কংগ্রেস বিরোধী রোষানলের লাভা বয়ে চলেছিল। ব্র্যান্ড মোদীর পক্ষে নির্বাচনে প্রায় ১৬ কোটি ভোট পাওয়া সম্ভব হয়েছিল কারণ জাতীয় স্তরে বিজেপি ছাড়া কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে কেউ উঠে আসতে পারেনি। দুই বছরের মোদী শাসনকালে জনগণের দুর্দশা মনমোহন সিংহের কংগ্রেসী আমলের চেয়েও বেশি হয়েছে, খাদ্যবস্তু ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়েছে, জনকল্যাণ প্রকল্পগুলোর খাতে খরচা কমানো হয়েছে বার বার, কৃষি সংকট তীব্র হয়েছে - ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বিতরণ তো দূর অস্ত, বরং যাদের হাতে স্বল্প জমি আছে তাঁদেরও জমির উপর কর্পোরেট আগ্রাসনের জূজূ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি বিদেশ ভ্রমণেই মোদী ভারত কে “হার্ড সেল” করার চেষ্টা করে, বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যের জমি-জল-জঙ্গল বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের ভারতীয় দালাল আদানি-আম্বানি গোষ্ঠী কে বেচার জন্যে মৌ এর পর মৌ সই করেছে কেন্দ্র ও সেই সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। সম্প্রতি বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস এই সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে মুম্বাই শহরে  “মোমেন্টাম ঝাড়খন্ড গ্লোবাল ইনভেস্টর্স সামিট ২০১৭” অনুষ্ঠানে খনিজ সমৃদ্ধ ঝাড়খন্ডকে “মেক ইন ইন্ডিয়া” অভিযানের গেটওয়ে হিসেবে তুলে ধরে প্রায় ১৯৫০ কোটি টাকার মৌ সই করেছে। ঠিক উরি সেনা ছাউনির উপর আক্রমণের দুই দিনের মাথায়। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ, যখন দেশের রাজনীতি জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উত্তাল ছিল তখনই চুপচাপ কুখ্যাত আদানি গোষ্ঠী ও বেদান্ত গোষ্ঠীর সাথে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকার মৌ চুক্তি সই করে তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ইস্পাত প্রকল্পের নামে। এই সমস্ত প্রকল্প রূপায়ন করতে ঝাড়খণ্ডে ব্যাপক হারে আদিবাসী উচ্ছেদ অভিযান চলবে, অপারেশন গ্রিন হান্টের নামে চলবে আদিবাসীদের উপর দমন পীড়ন। কেন্দ্রের মোদী সরকার ও বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির সরকার একের পর এক প্রকল্প নিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর উন্নয়ন করার জন্যে যখন লেগে পড়ে রয়েছে তখন জনতা কে শুধু “সুদিন” বা “আচ্ছে দিন” আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের বাক্সের দিকে টেনে আনা যে খুবই কঠিন তা নাগপুরের জানা আছে। এর সাথেই মাথায় রাখুন সমগ্র গুজরাটের দলিতদের মাথা তুলে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, সমগ্র উত্তর প্রদেশের দলিত জনতার মধ্যে বিজেপি বিরোধী হাওয়ার প্রবলতর হওয়ার কথা, পাতিদার আন্দোলনের ফলে বিজেপির আর মোদীর হিন্দুত্ববাদের গবেষণাগার গুজরাটে ব্যাকফুটে যাওয়ার ঘটনা, যে ঘটনাগুলো তীক্ষ ইঙ্গিত করছে বিজেপির অতি কষ্টে সাজানো হিন্দুত্ববাদের মেরুকরণের তাসের ঘরের ভেঙে পড়ার সম্ভাবনার দিকে। ফলে নতুন করে সেই পুরানো ফর্মুলায় মেরুকরণ করা অসম্ভব হওয়ায় এবং তিন রাজ্যে নির্বাচনের মুখে জনগণের দৃষ্টি মূল্যবৃদ্ধি, ঘনীভূত হওয়া অর্থনৈতিক সংকট, ও সামগ্রিক ভাবে মোদী সরকারের ব্যর্থতা থেকে সরাতে যুদ্ধের ডংকা বাজানো ছাড়া আরএসএস ও বিজেপির সামনে অন্য কোন রাস্তা নেই আর নওয়াজ শরীফের কাছেও শাপে বরদানের মতই ভারতের সাথে যুদ্ধ পাকিস্তানের আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে এবং তীব্র ইসলামিক মেরুকরণ করার কাজে মদত করবে। আর যুদ্ধ না হওয়া অবধি নওয়াজ শরীফ ও মুসলিম লীগ ভারত বিরোধী ও হিন্দু বিরোধী বিষাক্ত আবহাওয়া সৃষ্টি করে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা জনগণের স্বর কে, গণ আন্দোলনগুলোকে শক্ত হাতে দেশপ্রেমের নামে দমন করতে পারবে।

তাই বন্ধু, যুদ্ধ যে হবে না তা নয়, হয়তো সম্পূর্ণ যুদ্ধ  না হয়ে একটা সীমিত লড়াই হতে পারে যাতে বেশ কিছু সৈনিক কে দুই দেশের সরকার ও শাসকেরা  কোরবানির পাঁঠা বানিয়ে একদিকে নির্বাচনের জন্যে ইস্যু সৃষ্টি করতে পারবে আর অন্য দিকে নানা রকমের অস্ত্র, গোলাগুলি, কফিন বা অন্য সামরিক চুক্তি বা কেনা বেচার কাজে প্রচুর কমিশন আয় করতে পারবে। ঠিক যেমন একদিন বাজপেয়ীর আমলে একদিকে কার্গিল যুদ্ধ কে ব্যবহার করে মূল্য বৃদ্ধি ও বিলগ্নিকরণের ফলে নাজেহাল হওয়া জনতার দৃষ্টি ঘুরিয়ে উগ্র দেশপ্রেমের হাওয়া তুলে ভোট কুক্ষিগত করেছিল বিজেপি আর অন্যদিকে সেই কার্গিলে মৃত সৈন্যদের দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়ার জন্যে কফিন কেনার অছিলায় কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করেছিল বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আমলা ও সেনা কর্তারা। ভুলে গেলে চলবে না যে সৈন্য বাহিনীর নামে দেশপ্রেমের শপথ নেয় যে বিজেপি সেই বিজেপিই কিন্তু বঙ্গারু লক্ষণের মতন লোকেদের পুষে রাখে। আর যদি তাও করা সম্ভব না হয় নভেম্বরের পরে তাহলে দেশজুড়ে সাবর্ণ হিন্দুদের তাঁতিয়ে তুলতে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতন কাহিনী জনগণের কানে যুদ্ধবাজ কর্পোরেট মিডিয়া ঠুসে ঠুসে ভরবে।

যদি সংকট ঘনীভূত হয় আর মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে হয় তাহলে হয়তো নভেম্বরের পরে আর উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও গুজরাট নির্বাচনের আগেই পুরো মাত্রার যুদ্ধ হতে পারে, যার ফলে আবার দেশপ্রেমের জিগির তুলে নির্বাচনের মাঠে গোল দেওয়ার চেষ্টা করবে বিজেপি এবং জনগণের ঘাড়ে অসম্ভব মাত্রার করের বোঝা চাপবে। জনতার থেকে আদায় করা করের টাকায় যেমন মার্কিন সামরিক শিল্প ও আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রী-আমলারা ফুলে ফেঁপে উঠবে অন্যদিকে তেমনি ব্যাপক হারে কালোবাজারি করে বিজেপির আসল ভোটার মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা লাভ করবে। মৃত্যু আর ধ্বংসের দৃশ্য দেখিয়ে যখন কর্পোরেট মিডিয়া কোটি কোটি টাকা রোজগার করবে ঠিক তখনই দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণ কে সামরিক শক্তির দমে তাঁদের জমি-জল-জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করবে, তাঁদের প্রতিরোধ কে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করবে গুলি আর বোমা মেরে। সেই আদিবাসী জনগণ যদি তাঁদের জঙ্গল আর জমি রক্ষার সংগ্রামে কর্পোরেট-রাষ্ট্র যন্ত্রের এই চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তখন এই আদিবাসীদের উগ্রপন্থী আর মাওবাদী আখ্যা দিয়ে ব্রাক্ষণত্ববাদী সরকার হত্যা করবে। এই যুদ্ধই আবার মোদী আর ভারতের শাসক শ্রেণী কে সুযোগ দেবে দেশের জনগণের, বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষকের রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অধিকার কেড়ে নিতে, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো খর্ব করে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার তুলে ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদ কে প্রতিষ্ঠা করতে। ভারতের শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে নিজেদের স্বার্থে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো যে কয়েকটি হাতে গোনা সাংবিধানিক অধিকার আদায় করতে পেরেছিলেন তা কিন্তু যুদ্ধের নামে, রাষ্ট্র রক্ষার নামে মোদীর নেতৃত্বে ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী খর্ব করবে, কেড়ে নেবে, এবং যুদ্ধের দোহাই দিয়ে সমগ্র দেশকে একটা রাজনৈতিক জেলখানায় পরিণত করবে।


আমাদের মধ্যে যে সকল মানুষ প্রগতিশীল রাজনীতির কথা ভাবেন, খেটে খাওয়া মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে লড়াই করেন তাঁদের আজ সাবধানে পা ফেলতে হবে। শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোদী বা আরএসএস-বিজেপির যুদ্ধ বিরোধী রূপে যেন আমরা বশ না হয়ে যাই। জনগণ কে যেন আমরা এই নেকড়ের দলের কন্ঠে কোকিলের স্বরে ভুলে যেতে না দিই যে এই সুন্দর সুর আসলে ভবিষ্যতের হিংস্রতা কে আড়াল করার ছল। নেকড়ের ফাঁদে পড়বেন না, নেকড়ের লক্ষ্য মানুষের বুক চিরে রক্ত মাংস খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করা।নেকড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আমাদের তৈরি হতে হবে, মানুষকে নেকড়ের থাবা থেকে বাঁচাতে আমাদের মাঠে নামতেই হবে।       


  1. সম্প্রতি ২৮শে সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার গোষ্ঠী ঠিক এই রকমই এক বিতর্ক সভার আয়োজন একেবারে খাস “দা পার্কে” করেছিল, যেখানে জনতার টাকায় মোটা পেনশন আয় করা প্রাক্তন সেনা কর্তা ও আধা সামরিক বাহিনীর কর্তারা শুনিয়ে গেল জনতার ঘাড়ে করের বাড়তি বোঝা চাপিয়ে কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। সেই বিতর্ক সভায় সবচেয়ে ভালো ভাবে যুদ্ধের উন্মাদনার বেলুন চুপসে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী  দেবলীনা, যাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তথাকথিত সামরিক বিশারদদের কপালে ওই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও ঘামের বিন্দু এনে দিয়েছিল।


ঢোলাহাট থেকে তারক বিশ্বাস পর্ব - মোদী ও মমতার সখ্যতা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৬ 0 Comments A+ a-


লোকমুখে ও ইন্টারনেটে মমতাকে আরএসএস ও বিজেপি মুসলমান তোষণকারী ও হিন্দু বিরোধী বলে প্রচার করছে এবং কলকাতা সহ সমস্ত শহরতলীতে একটা চাপা প্রচার চালাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা নাকি খুবই দুর্বল এবং বাংলাদেশ থেকে নাকি ভোট ব্যাঙ্ক গড়তে প্রচুর পরিমানে মুসলমান অনুপ্রবেশকারী কে ঢুকিয়ে এই রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করাচ্ছে তৃণমূল। বিজেপি ও তার পিতৃপ্রতিম সংস্থা আরএসএস এর সাথে সংযুক্ত হিন্দুত্ববাদী সংবাদসংস্থাগুলো এই আষাঢ়ে গল্পের গরু কে শুধু মই দিয়ে গাছে চড়িয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, মইটাকে চুরি করে পালিয়েও যাচ্ছে।তৃণমূলের নেতৃত্বের কাছে বা খাস মমতার কাছে এই প্রচারের কথা অজানা নয়, তবুও মমতা চুপ করে থেকে এই প্রচার কে সত্য হিসেবে প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছে। যে বা যারা সাচার কমিটির রিপোর্ট পড়েছেন (সম্প্রতি বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সাচার কমিটির রিপোর্ট কে আস্তাকুঁড়েতে ছুড়ে ফেলেছে) তাঁরা জানেন যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের দুর্দশার আসল ছবিটা কি আর সেই দুর্দশা দূর করতে যেহেতু বামফ্রন্ট সরকার কিছুই করেনি তাই মুসলমান সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়ে ভোটে জিতেছিল মমতা বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু আদতে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্যে ইমাম ভাতা আর ঈদের দিনে মদন আর ববি কে টুপি পড়িয়ে বাজারে ছেড়ে বা কখনো কখনো নিজের মাথায় হিজাব পড়ে দোয়া করা ছাড়া মমতা বা তৃণমূল কোনোদিন কিছুই করেনি বরং বারবার চেষ্টা করে এসেছে যাতে মুসলমান সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমান যুব সমাজ ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুপমুণ্ডুকতার বাইরে বের হয়ে জীবনযাপন না করতে পারে, আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল না হতে পারে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তির সমকক্ষ না হতে পারে।তাই দেখুন আজও মুসলমান সম্প্রদায় ব্রাক্ষণত্ববাদী ভদ্রলোকদের তুলনায় শিক্ষা, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কত পিছিয়ে। সকাল সন্ধ্যে মুসলমান সম্প্রদায় যাতে খালি পেটে আর খালি পকেটে শুধু আল্লা আল্লা করে শান্ত থাকে তার বন্দোবস্ত করা ছাড়া বাস্তবে মমতার সরকার আর কি করেছে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্যে? বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের জন্যে - যাঁদের অধিকাংশ কে আজ কলকাতা শহর থেকে খেঁদিয়ে দেওয়া হয়েছে?


মমতা বন্দোপাধ্যায় বা তৃণমূল কংগ্রেস তাদের মাতৃসম পার্টি কংগ্রেসের মতনই তীব্র হিন্দুত্ববাদী - গোঁড়া ব্রাক্ষণত্ববাদী পার্টি যারা মুসলমানদের শুধু ধর্মীয় কুপমুণ্ডুক আর মৌলবাদের ঘেরাটপে বন্দী করে রাখতে চায়, ইমাম-মুফতি-মৌলানাদের হাত করে সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়কে অন্ধকারে ঠেলে রেখে ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতিগুলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুড় খেতে দেয়। এই মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তার পার্টি সেই নেহরু কে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয় যার প্রচ্ছন্ন মদতে ভারত ভাগ হয় আর লক্ষ লক্ষ মুসলমান কে পাঞ্জাব, বাংলা, জম্মু ও হায়দ্রাবাদে হত্যা করা হয়। সেই নেহরুর কাছে মুসলমান উন্নয়নের রাজনীতির মূলমন্ত্র ছিল গোঁড়া ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী মৌলানা আজাদের মতন লোককে মুসলমান সমাজের নেতা বানানো, যে লোকটা মুসলমান মহিলাদের স্বাধীনতার ও স্বাবলম্বী হওয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিল, যাতে মুসলমান সম্প্রদায় কোনো দিন আধুনিকতার আলো না দেখতে পায়। যে নেহরু সরকার আরএসএস এর মতন সংগঠন কে ভারতে বিস্তৃত হওয়ার বকলমে সুযোগ করে দিয়েছিল, মুখে বিরোধিতা করেও। এরা সেই ইন্দিরা গান্ধীর মূর্তিতে মালা দেয় যে ইন্দিরা গান্ধীর শাসন কালে জরুরী অবস্থা জারি হয় আর অসংখ্য মুসলমান মানুষকে সঞ্জয় গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার হত্যা করে দিল্লির তুর্কমেন গেট এলাকায়। এই তৃণমূল কংগ্রেস রাজীব গান্ধী কে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়, যে রাজীব গান্ধী নিজে হাতে বাবরি মসজিদের ভিতর রামলালা মন্দিরের তালা খুলে পুজো দিয়ে আরএসএস ও বিজেপি কে রাম মন্দির আন্দোলনের ঝড় তোলার কাজে সহযোগিতা করেছিল, যার পরিণাম হয় বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং মুসলমান নিধন যজ্ঞ। এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মমতা বন্দোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে খাল কেটে কুমির ঢোকানোর মতনই ১১৯৮ সাল থেকে বিজেপি আর তার হিন্দুত্ববাদী সহযোগীদের রাজ্যে ঘাঁটি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকারে মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে।১৯৯৯ সালে যখন দারা সিংহ ও অন্য্ সব বজরং দল কর্মীরা মিশনারি গ্রাহাম স্টেইন কে তাঁর দুই নাবালক পুত্র সহ পুড়িয়ে হত্যা করেছিল বা ২০০২ সালে যখন নরেন্দ্র মোদী হাজার হাজার মুসলমানের শব দেহের উপর চলে গুজরাটের ভোটে বিজেপিকে জিতিয়েছিল তখন ধর্মনিরপেক্ষ ও মুসলমান - সংখ্যালঘু দরদী মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু বিজেপির সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, ফুলের তোড়া দিয়ে নরেন্দ্র মোদী কে অভিনন্দন জানিয়েছিল মমতা সেই সময়ে যখন মোদীর কব্জি দিয়ে চুইয়ে পড়ছিল মুসলমানের রক্ত।           
  
মোদী আর মমতার ফুলের তোড়ার যুদ্ধের আড়ালে পুরানো বন্ধুত্ব পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন কে ধ্বংস করার কাজে বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজি ও জোতদার-সামন্তপ্রভুদের একান্ত প্রয়োজনীয়। দুই জনের রাজনীতিই ব্রাক্ষণত্ববাদ কে সমর্থন করে, দলিত-আদিবাসী ও মুসলমান সম্প্রদায় সহ সকল সংখ্যালঘুদের স্বার্থের বিরুদ্ধে শুধু মাত্র অভিজাত হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করে। আজ যে বিজেপি নেতা ও কর্মীরা, যে আরএসএস কর্মীরা মমতা কে প্রকাশ্যে গালিগালাজ করছে, মুসলমান সম্প্রদায়ের দালাল বলছে, তলে তলে তারা সবাই মমতা ও তৃণমূলের প্রশ্রয়ে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের জমি শক্ত করতে পারছে। মমতার পুলিশ আর প্রশাসন রাজ্য জুড়ে বেড়ে চলা হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদের চাঁইদের বকলমে তোষণ করছে আর তার সাথে সাথেই তোষণ করছে একদল চরম ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লা শ্রেণীর মুসলমানদের, যারা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ও উর্দু ভাষী মুসলমান সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দেউড়িতে গন্ডিবদ্ধ করে তাদের দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক অভিলাষা চরিতার্থ করার চক্রান্ত সফল করার কাজ করছে।আর তৃণমূলের রাজনৈতিক লক্ষ্যবস্তু হলো ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কে পিছনের দরজা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করানো, বিদেশী পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সাহায্যে মোদী সরকারের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করা এবং দাঙ্গার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে শ্রমিক-কৃষক-খেটে খাওয়া জনতা-দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সমাজ কখনোই এক হয়ে মাটি-জল-বাতাস লুঠের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে না পারে, যাতে শ্রমিক-কৃষকের লড়াই গড়ে উঠতে না পারে, আর পশ্চিমবঙ্গকেও গুজরাটের মতন হিন্দুত্ববাদীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এই কারণেই আমরা দেখতে পাই তৃণমূলের নেতৃত্বে কালিয়াচক - ঢোলাহাট কান্ড থেকে তারক বিশ্বাস নামক ব্লগারের গ্রেফতারি, সবই খোরাক যোগাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী শক্তির পেশী শক্তি বাড়ানোর প্রক্রিয়ায়।     

ঢোলাহাট নিয়ে তুলকালাম - পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় দাঙ্গা করার পরিকল্পনা করছে আরএসএস - বিজেপি



দক্ষিণ ২৪ পরগণার  ঢোলাহাটের ঘটনাই ধরুন। গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর একজন গরু ব্যবসায়ী রউফ লস্কর (২৮) হাট থেকে বাড়ি ফেরার ঠিক পরেই তাঁর মোবাইল ফোনে একটা কল আসে যে সস্তায় অনেক গরু পাওয়া যাচ্ছে, ঈদের মরশুমে যে খবরটা শুনে যে কোনো গরু ব্যবসায়ীর চোখ লোভে চক চক করে উঠবে। সেই ফোনে কথা বলেই রউফ লস্কর বাড়ি ছেড়ে গেলেন আর ফিরলেন লাশ হয়ে, তাঁর মৃতদেহ ভেসে ওঠে লক্ষীনারায়নপুরের পুকুরে, ডান চোখ উপড়ানো, ঠোঁট আর কান দুটো কেউ খাবলে নিয়েছে। রউফ লস্করের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল যে পুকুরে সেটা তাঁর বাড়ির থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ভাজনা গ্রামের কাছে। সেই ভাজনা গ্রামে বিগত কয়েক বছর ধরে তৃণমূলের প্রচ্ছন্ন মদতে ঘাঁটি গেড়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করছে আরএসএস ও তার বিভিন্ন সহায়ক সংগঠন। ভাজনা গ্রামের উঁচু জাতের ব্রাক্ষণত্ববাদী যুবদের নিয়ে যথারীতি গো-রক্ষা সমিতি গড়া হয়েছে এবং এই এলাকায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তপন ঘোষের হিন্দু সংহতির মতন মার্কিন মদত প্রাপ্ত দাঙ্গাবাজ সংগঠন নিজেদের ষড়যন্ত্রমূলক কাজকর্ম শুরু করেছে। গ্রামবাসীরা পুলিশের কাছে গো-রক্ষক ও আরএসএস এর বিরুদ্ধে রউফ লস্কর কে খুন করার অভিযোগ করলেও পুলিশ সেই অভিযোগ নথিভুক্ত করতে চায়নি। জনগণ পুলিশের এহেন আচরণ দেখে ক্ষিপ্ত হন এবং তীব্র প্রতিবাদ করেন, অনেকে ইঁট পাটকেল ছুড়ে পুলিশ কে দেহ নেওয়ার থেকে আটকান। পরে পুলিশের বড় কর্তারা স্থানীয় জনগণ কে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের সাথে নিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ঢোলাহাট থানায় দেখা করতে বলে এবং তাঁদের কথামত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেহ নিয়ে যায়। ১১ সেপ্টেম্বর দলে দলে মানুষ থানায় গিয়ে জানতে পারেন যে পুলিশের বড় কর্তারা কেউ নেই আর কোনো মিটিং হবে না। ফলে স্পষ্টতঃ এলাকার মুসলমান জনগণ দেখলেন যে বকলমে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের পক্ষপাতিত্ব করছে “মুসলমান-দরদী” সাজা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ব্রাক্ষণত্ববাদী প্রশাসন। ফলে জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়েন ও পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করেন।  সরকারের বিরুদ্ধে জনমত যাচ্ছে দেখেই এলাকার তৃণমূলের মৌলবাদী নেতারা গুন্ডা বাহিনী এনে জনতার শান্তিপূর্ণ লড়াইকে বানচাল করতে শুরু করে বোমা বর্ষণ আর আগুন লাগানো, ঠিক কালিয়াচকের কায়দায়, আর এই সুযোগে পুলিশ সরাসরি জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া শুরু করে, ঈদের দুইদিন আগেই এই হট্টগোল থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ  যখন পালাতে থাকেন ঠিক তখন পুলিশ গুলি করে সালেম লস্কর কে।তাঁর পিঠে গুলি লাগে, যে গুলি নাকি পুলিশ আত্মরক্ষার জন্যে চালিয়েছিল। গুলিতে সালেম লস্করের মৃত্যু হয় এবং পুলিশ কেস দিয়ে ৪৯ জন কে জেলে পোরার চেষ্টায় রত। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে প্রশাসন গো-রক্ষক দল সম্পর্কে একেবারে চুপ। শুধু প্রেস কনফারেন্স চলাকালীন মমতা সেই পুরানো কায়দায় “আমি বরদাস্ত করবো না” বলে গো-রক্ষকদের শাসানি দিলেও তা যে একেবারে কোনো কাজের নয় তা গো-রক্ষকদের চেয়ে বেশি মমতার জানা আছে।     


কাকদ্বীপের নিকটবর্তী এই সকল অঞ্চলে এক কালে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী থাকায় জোতদারদের এলাকায় পসার সাজিয়ে বসতে অসুবিধা ছিল। নিচু জাতির ও নমঃশূদ্র দলিত হিন্দু এবং মুসলমান কৃষকেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জমি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে লড়াই করেছিলেন। পরবর্তীকালে সিপিএমের রাজত্বকালে ধীরে ধীরে কৃষকদের জঙ্গী আন্দোলন কে পিছন থেকে ছুরি মেরে মেরে ধ্বংস করা হয় এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের এই এলাকায় খালি মাঠে গোল করার সুযোগ করে দেয় জ্যোতি বোস ও বুদ্ধ ভট্টাচার্যের সরকার। তৃণমূল শাসন কালে এই এলাকায় ধর্মীয় মৌলবাদ আরও গভীর ভাবে প্রবেশ করতে থাকে, ধর্মের নামে কাঠি মেরে নমঃশূদ্র দলিতদের ব্রাক্ষণত্ববাদী উঁচু জাতের হিন্দুদের পতাকাতলে এনে ধর্মীয় মেরুকরণের কাজ চালায় আরএসএস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। বেশ কয়েক মাস ধরে, বিশেষ করে বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই ঢোলাহাট অঞ্চলে গরু কে কেন্দ্র করে চক্রান্তের ফাঁদ পাতে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। যদিও কুলপি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটে জেতে তৃণমূলের যোগরঞ্জন হালদার, কিন্তু বিজেপি এই কেন্দ্রে যে দাঁত কাটতে শুরু করেছে বিগত পাঁচ বছরে তা নির্বাচনের পরিণাম দেখে বোঝা যায়। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী এই কুলপি কেন্দ্রে ৩৬২৪টি ভোট পেয়েছিল আর ঠিক মমতার শাসনের পাঁচ বছর পরেই সংখ্যাটা হয়ে দাঁড়ালো ৮৪৩৪! ২০১৪ সালের “মোদী হাওয়ায়” সমগ্র মথুরাপুরের দলিতদের জন্যে সংরক্ষিত আসনেও বিজেপি তিন নম্বরে উঠতে সক্ষম হয়েছিল, আর তার পর থেকেই এই সমগ্র এলাকায় মুসলমান বিরোধী বিদ্বেষ বেশি বেশি করে ছড়ানো হয় তৃণমূলের সহায়তায়। কখনো গরুর অছিলায় আর কখনো হিন্দু মেয়ে কে মুসলমান ছেলে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই অছিলায় এই এলাকা সহ সমগ্র দক্ষিণ ২৪ পরগণায় দাঙ্গা করার চেষ্টা করে আরএসএস ও তাদের সহযোগী হিন্দু সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি।


তৃণমূল কংগ্রেস যে ভাবে এই গ্রামবাসীদের ন্যায়সঙ্গত লড়াইকে ভেস্তে দিতে যথেচ্ছ গুলি ও বোমা ব্যবহার করে দোষ মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দিতে পারলো তা কিন্তু বিজেপি বা আরএসএস’র দ্বারাও সম্ভব হতো না, আর এভাবেই তো হিন্দুত্ববাদী শক্তির রক্ষায় এগিয়ে এসেছে মোদীর দোসর মমতা আর তার তৃণমূল কংগ্রেস।ঢোলাহাটের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে তেমন প্রভাব ফেলতে না পারলেও সমগ্র ভারতের কর্পোরেট মিডিয়া ঘটনাটিকে মুসলমান মৌলবাদীদের তাণ্ডব বলে চিত্রিত করে হিন্দুত্ববাদীদের পয়েন্ট বাড়াতে সাহায্য করেছে আর আতংকিত করেছে সমস্ত মথুরাপুর সংসদীয় এলাকার নমঃশূদ্র দলিত সম্প্রদায় কে, যার ফলে আরএসএস ও তপন ঘোষের হিন্দু সংহতির সুবিধা হয়ে গেল এই এলাকার দলিত নমঃশূদ্রদের মুসলমানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার থেকে আটকে ব্রাক্ষণত্ববাদের পতাকাতলে সামিল করতে। এই ঘটনার রেশ মিটতে না মিটতেই আবার তৃণমূল এগিয়ে এলো হিন্দুত্ববাদী শক্তির সমর্থনে। এবার আবার সরাসরি তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের এক জেলা স্তরের নেতা সানাউল্লাহ খান সরকারি ভাবেই বিদ্বেষ সৃষ্টির খোরাক যোগান দিল।
    

নাস্তিক ব্লগার তারক বিশ্বাসের গ্রেফতারে নতুন অস্ত্র খুঁজে পেল হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী শক্তি



কালিয়াচকের দাঙ্গার আসল কারণ এবং ঘটনাবলী আমরা আগেও পড়েছি, সম্প্রতি মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতির নামে তৃণমূল কংগ্রেস আবার বাক স্বাধীনতায় হামলা করলো কেন্দ্রীয় মোদী সরকার বা পড়শি পাকিস্তান-বাংলাদেশ সরকারের মতন। তারক বিশ্বাস নামে এক ব্লগার ইন্টারনেটে বহুদিন ধরে নানা ধর্মের সমালোচনা করে আসছিলেন জঙ্গী নয়া-নাস্তিক আন্দোলনের কায়দায়। যে আন্দোলন ধর্মের সাথে সমাজের আর্থিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রগতির স্তরের সম্পর্ক কে বাদ দিয়ে, উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্ক কে বাদ দিয়ে, শুধু ধর্মকে সমালোচনা করে, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম কে, সেই আন্দোলনের এক অংশগ্রহণকারী হলেন তারক বিশ্বাস। এই তারক বিশ্বাসের লেখায় হঠাৎ তৃণমূলের নেতা সানাউল্লাহ খানের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতিতে এমন আঘাত লাগলো যে সে পুলিশে মামলা করলো আর তৃণমূলের নেতার মামলার চোটে হঠাৎ কল্যাণী থেকে না বলে কয়ে জোর করে পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে যায় তারক বিশ্বাস কে এবং ভারতীয় দন্ডবিধির ২৯৫ এ ও ২৯৮ ধারা সহ তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৬৬, ৬৭, ও ৬৭ এ’র মতন সব ভয়ঙ্কর ধারার মামলা পুলিশ এই ব্লগারের নামে করেছে। এর পিছনে তৃণমূলের ভূমিকাটা স্পষ্ট আর এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের খেলায় একেবারে ফাউতে পেনাল্টি শট পেয়ে গেল সংঘ পরিবার। অন্তত ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তো বটেই। যে সানাউল্লাহ খান তারক বিশ্বাসের নামে পুলিশে অভিযোগ করেছিল সে নিজে ফেসবুকে নিজেকে ধর্ম প্রচারক তৃণমূল নেতা হিসেবে প্রতিপন্ন করে থাকে। সে তার তৃণমূলী প্রতিপত্তি ব্যবহার করে তারক বিশ্বাস কে গ্রেফতার করিয়েছে কারণ পিছনে ছিল মমতা আর শুভেন্দু অধিকারীদের মতন মন্ত্রীদের সমর্থন। এই গ্রেফতারির ফলে একদিকে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীদের কাছে ইসলাম ধর্মালম্বীদের কে বাঁধাধরা “মৌলবাদী” ও “ধর্মান্ধ” গোত্রে ফেলে চরম বিদ্বেষমূলক প্রচার আরও সহজ হয়ে গেল। ইন্টারনেট জুড়ে আরএসএস এর ভাড়াটে বাহিনী একজন নাস্তিক আন্দোলনে জড়িতের নাম কে “অত্যাচারিত হিন্দু” ও “মমতার মুসলমান তোষণের” সাথে জুড়ে নিজেদের রাজনৈতিক প্রচার কে তুঙ্গে তুলে দিল। এর ফলে চাপা থেকে গেল যে কি ভাবে রাজ্যের গ্রামে গ্রামে হিন্দুত্ববাদী জঙ্গীরা গরু রক্ষা আন্দোলনের নামে বিষিয়ে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক আবহাওয়াকে। শুধু চারদিকে মুসলমান সম্প্রদায় মুক্ত আলোচনা ও বাক স্বাধীনতার শত্রু এই বলে সমগ্র সম্প্রদায় কে আক্রমণ করার এক ভালো সুযোগ পেয়ে গেল হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি, আর এদের সমর্থনে আলতো আলতো করে পা ফেলে এগোতে থাকলো সানাউল্লাহ খানের মতন “মুমিনেরা”। এপিডিআর এর মতন সামাজিক সংগঠন যদিও তারক বিশ্বাসের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে এবং পুলিশি হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছে তবুও ভোটপন্থী বামেদের এখনো এই দাবি সরাসরি তুলতে দেখা যায়নি।  


পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র প্রগতিশীল মানুষকে এই সমস্ত চক্রান্ত কে আজ খুঁটিয়ে দেখতে হবে এবং বস্তুগত বিশ্লেষণ করতে হবে। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যে ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তি কায়দা করে মুসলমান সম্প্রদায় কে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ভাবে পিছিয়ে রেখেছে তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও তথাকথিত বামপন্থীদের ৩৪ বছরের শাসনের পরেও এই রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের চেতনার মান অনেক নিম্নে। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা সহ সকল ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার মুসলমান সমাজের পক্ষে বর্তমান শাসন ব্যবস্থা ও শাসক শ্রেণীর অধীনে নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়ন আশা করাও হাস্যকর হবে। এহেন পিছিয়ে থাকা মুসলমান সম্প্রদায় কে, দলিত ও আদিবাসীদের সাথে নিয়ে ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জমি-জল-জঙ্গল ও আর্থিক-রাজনৈতিক-সামাজিক স্বাধীনতার দাবিতে গড়ে ওঠা লড়াইয়ে সামিল করাতে হবে এবং তার জন্যে সমস্ত শোষিত জাতি ও সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক চেতনা কে আজ জাগ্রত করার ভীষণ দরকার, কারণ এই চেতনা জাগ্রত না হলে, উচ্চ স্তরে না উঠলে জঙ্গী হিন্দুত্ববাদের পতাকাবাহী ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তি কে পরাস্ত করা যাবে না, এমন কি ব্রাক্ষণত্ববাদের বিরুদ্ধে, হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও সানাউল্লাহ আর মমতার মিমিঃকিরির ফলে নেপোয় মারে দই হয়ে যাবে।


সাধু সাবধান ! পর্বতে ধোঁয়া দেখা দিয়েছে, আর দেশলাই হাতে মমতা-দিলীপ-তপন ঘোষেদের ঘুরতে দেখা গেছে।  


   

মানসের তৃণমূলে ডিগবাজি কংগ্রেসী রাজনীতির দেউলিয়াপনা কে আরও একবার প্রকাশ্যে আনলো

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

অবশেষে মানসের উইকেট পড়ে গেল, অভিষেক বাঁড়ুজ্যের বলে কংগ্রেসের আরও এক বিধায়ক ডিগবাজি খেয়ে তৃণমূলের কোলে আশ্রয় নিল, আর এই বিধায়ক যে সে বিধায়ক নয়, একেবারে খাস মানস ভুঁইয়া, যে মানস ভূইঁয়া এই নির্বাচনের কিছুদিন আগে পর্যন্ত তৃণমূলের বিরুদ্ধে গর্জন করছিল, সূর্যের উদয়ের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের মসনদে গদির চামড়া খাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। নির্বাচনে জোট জেতেনি সেটা কোন ব্যাপারই নয়, যুদ্ধ - প্রেম ও সংসদীয় রাজনীতিতে কোনো কিছুই কিন্তু অন্যায্য নয়। ফলে আব্দুল মান্নান চেঁচামিচি করতে থাকলো আর তার দলের নেতা ও পুরানো খেলোয়াড় মানস ভূইঁয়া পিএসি সভাপতির দাবি ছেড়ে একেবারে মন্ত্রিসভায় সিঁধ কেটে ঢুকতে তৃণমূলে যোগ দিল। তার সাথে সাথে আবার পিতৃ দেবের দোহাই দিয়ে জানান দিল যে সে তার স্বর্গীয় পিতৃদেবের কথা শুনে কংগ্রেসী ঘরানার রাজনীতিতেই আছে, সে জাতীয় না হয়ে যদিও তৃণমূল কংগ্রেস। প্রকারন্তরে মানস ভূইঁয়া রাজ্যের মানুষ কে জানান দিল যে চাইলেই সে বিজেপির ঝুলিতেও যেতে পারতো তবুও ওই পিতৃদেব কে কথা দিয়ে রাখার জন্যে এখনই সেদিকে পা বাড়াচ্ছে না। হয়তো যদি বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকতো তাহলে মানস বাবুর মনে হতো যে আসল কংগ্রেস এখন বিজেপিই বাকি সব ধাপ্পা !

কংগ্রেসী রাজনীতি করে পরিচিতি পাওয়া মানস ভূইঁয়া তারকাহীন প্রদেশ কংগ্রেসের পরিচিত নেতা ও প্রদেশ সভাপতির জৌলুসহীন সিংহাসনেও একবার বসেছিল। কংগ্রেসের ভাঙনে অনেকদিন তাকে টলাতে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেস বরং বহু বছর ধরে অধীর-দীপা গোষ্ঠীর সাথে মধুর সম্পর্ক রেখে কংগ্রেস অফিসে বসে মানস ভূইঁয়া তৃণমূলের বিরুদ্ধে একের পর এক শব্দবাণ নিক্ষেপ করেছিল। কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি সবং এর মুকুটহীন বাদশা মানস ভূইঁয়া ওই সবং কলেজে তৃণমূলী ছাত্র পরিষদের হাতে কংগ্রেসী ছাত্র পরিষদ কর্মী খুন হওয়ার ঘটনা কে নিয়ে রাজ্য রাজনীতি গরম করে ফেলেছিল। মূলত সিপিএম কংগ্রেসের জোট সেই সময়ের থেকেই বাস্তবায়ন শুরু হয়। সিপিএমের যা ছিল গৌতম দেব, কংগ্রেসের তাই হলো মানস ভূইঁয়া। ফলে এই উইকেট তুলে নিয়ে যথার্থ ভাবে মমতার ভাইপো অধিকারী পরিবার কে টেক্কা দিল।

এই সমস্ত আয়ারাম ও গয়ারাম রাজনীতির মাঝে যে প্রশ্নটা চোখে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে চলেছে তা হলো জনগণ কে কি মনে করে এই দক্ষিণপন্থী সহ সমগ্র সংসদীয় দলের কর্তা ব্যক্তিরা? যে দল বা সরকারের বিরুদ্ধে একটা লোক ভোট পেল, সেই লোকটা যদি ভোটে জিতে ভল্ট খেয়ে একেবারে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে সেই দল বা সরকারে যোগ দেয় তাহলে কি সেই কীর্তিকে জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলা উচিত নয়? আবার তৃণমূল যখন মানস ভূইঁয়া কে দলে সামিল করলো তখন কি সবং এর মাটিতে যে তৃণমূল কর্মীরা তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে নির্বাচনে পরিশ্রম করেছিল তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলো না? আবার মনে প্রশ্ন জাগে যে সবং বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন তৃণমূল মানস ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে যা যা প্রচার করেছিল তা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেরত নিয়েছে? আরো জানতে ইচ্ছে করে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে এই সেইদিন, পিএসি সভাপতির পদ নিয়ে দ্বন্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত, যে সকল অভিযোগ মানস ভূঁইয়া করতো তাও কি সে ফেরত নিয়ে নিয়েছে?

সমস্যা হলো যে এত কথা জানতে চাইলেই তৃণমূলী চোখ লাল হয়ে যায়, কিন্তু উত্তরগুলো আজ ভীষণ দরকার। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে তৃণমূলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে জনগণ অনেকগুলো মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে, সেই মানস ও সূর্যের পরিবর্তনের পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি শুনে বিরোধীদের ভোট দিয়েছিলেন, এই তথাকথিত গণতন্ত্রে যখন তাঁদেরই "মূল্যবান" ভোটে জয়ী প্রার্থী শিবির বদলে সেই দলে যোগ দেয় যে দলের বিরুদ্ধে লড়ে সে ভোটে জিতেছিল, তখন কি সেই জনগণের সাথে বেইমানি হয় না? যদি কেউ নীতিগত কারণে বা নিজ দলের সাথে মনমালিন্যর কারণে অন্য দলে যোগ দেয় তাহলে তার কি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পদ থেকে পদত্যাগ করে আবার নির্বাচনে জিতে আসা নৈতিক ভাবে জরুরী নয়? ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একটা সামন্ততান্ত্রিক প্রথা রয়েছে যার ফলে জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের জনতার চাকর না ভেবে শাহেনশাহ ভাবে আর নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্র কে খাস তালুক, তারা মনে করে লোকে তাদের দেখে ভোট দিয়েছে ফলে তারা কোন পার্টিতে যাবে বা কার সাথে হাত মেলাবে তার সাথে নির্বাচনী ফলাফলের কোন যোগ নেই। এই চিন্তাধারাই এই সকল সংসদীয় রাজনীতিবিদদের চরম ভাবে জন বিরোধী করে তোলে। মানস ভূঁইয়াও এর চেয়ে কম নয়।

বেশ কিছুদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গে মমতার বিরোধী জন প্রতিনিধিদের ভাঙ্গিয়ে তৃণমূলের দখলে পৌরসভা আর জেলা পরিষদ থেকে শুরু করে একেবারে গ্রাম পঞ্চায়েত আনার ঘৃণ্য রাজনীতি প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে বহু সমালোচনার ঝড় উঠেছিল এবং সেই সমালোচনাগুলোকে নির্দ্বিধায় মমতা পাশ কাটিয়ে শুভেন্দু আর অভিষেকের ঘাড়ে চেপে রাজ্য বিরোধী শূন্য করার খেলায় মেতে থাকায় স্পষ্ট বোঝা যায় যে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র কে চরম ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তৃণমূল। অথচ আজ যখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানে ঠুনকো গণতন্ত্রের চুনকাম উঠে যাচ্ছে তখন কিন্তু সেই বিদ্বজন, বিক্ষুব্ধ গণতন্ত্র প্রেমীদের, শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবিদের আর পথে নেমে প্রতিবাদ করতে দেখি না, দেখি না কাউকেই এই অনৈতিক এবং অত্যন্ত জঘন্য রাজনীতির বিরোধিতা করতে। এত নগ্ন ভাবে তৃণমূল যখন বিরোধীদের ভাঙাচ্ছে তখন কেন রাজ্যের রাজপথ উত্তপ্ত হচ্ছে না? তাহলে কি বুঝতে হবে যে সমস্ত আঁতেল সমাজের রন্ধে রন্ধে আজ শাসক দলের দালালি করার জীবাণু ছুটে চলেছে?

মানস ভূঁইয়ার তৃণমূলে ডিগবাজি দিয়ে ঢোকাটা যেমন কংগ্রেসী রাজনীতির চরম দেউলিয়াপনা দেখালো, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উত্তর ভারতের রাজনীতির ঘোড়া কেনা বেচা দেখালো, ঠিক তেমনি এই তথাকথিত গণতন্ত্রের স্বরূপ জনগণের সামনে তুলে ধরলো। আরো একবার প্রকাশ্যে আসলো যে রাজনীতিকে ধান্দাবাজি হিসেবে গণ্য করে কি নির্লজ্জ্ব ভাবে সংসদীয় দলের নেতারা জনতাকে ধাপ্পা দেয়, জনতার রায় কে উল্টে দেয় একটু বেশি পয়সা রোজগারের আশায় বা একটা ক্যাবিনেট বার্থ পাওয়ার আশায়। আর এই ঘৃণ্য রাজনীতিকে আজ বদল করার যে সময় এসেছে তা আর চিৎকার করে বলতে হবে না। এবার সময় হয়েছে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনতার পথে নামার ও এই ব্যবস্থা কে আমূল পরিবর্তন করার। এই লড়াইতে আপনি যোগ না দিলে কিন্তু আপনি মানসের পক্ষে থাকবেন।


উরির সেনা ছাউনিতে জঙ্গী হামলা ভারতের শাসক শ্রেণীর কাছে শাপে বর

মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

Attack on Uri camp is beneficial for Indian ruling classes


উরির সেনা ছাউনিতে জঙ্গী হামলার পর থেকেই সারা দেশজুড়ে আবার হিংস্র দেশপ্রেমের ফোয়ারা ছুটছে, উঁচু জাতের স্বচ্ছল মানুষের সমবেত ডাক হলো যে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে যাক ভারত সরকার। এমনকি সে যুদ্ধ যদি পারমাণবিক যুদ্ধ হয় তবুও যাক। বিজেপির মেজ-সেজ-ছোট সমস্ত শেয়ালরা এক রা ধরলো – যে করেই হোক পাকিস্তান কে শায়েস্তা করতে হবে । আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের দেশের কর্পোরেট মিডিয়াগুলো এই “রক্ত চাই, রক্ত চাই” স্লোগানে গলা মেলালো, পাকিস্তানের উপর বোমা বর্ষণ করার থেকে শুরু করে মার্কিন কায়দায় পাকিস্তানের  ভিতরে ঢুকে তথাকথিত সার্জিকাল স্ট্রাইক চালাবার উপদেশও দিল অনেক বড় বড় সামরিক ও সুরক্ষা বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করা টেলিভিশন সেলিব্রিটিগণ । কাশ্মীর প্রসঙ্গে দেশে ও বাইরে মুখ পুড়িয়ে মোদী সরকার যেন ঠিক এই রকমই একটা ঘটনার অপেক্ষায় ছিল, যে ঘটনা কে ব্যবহার করে দেশের উঁচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে উগ্র দেশপ্রেম কে পিনের খোঁচায় জাগানো যায়, আর যেহেতু বর্তমান ভারতবর্ষে দেশপ্রেম মানেই হলো পাকিস্তানের প্রতি অতিশয় ঘৃণা তাই এই আবহাওয়াকে ব্যবহার করে নিজের সকল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতা থেকে জনতার দৃষ্টি ঘোরাতে সচেষ্ট হলো মোদী সরকার । এটা রাজনৈতিক মহলে সকলের জানা যে মার্কিন একচেটিয়া পুঁজির সমর্থন ছাড়া ভারত বা পাকিস্তানের সরকার বা শাসকশ্রেণী এক পাও আগে চলতে পারবে না, বিশেষ করে আজকের পরিস্থিতিতে যদি মার্কিন সমর্থন না থাকে তাহলে তো মোদী হোক বা নওয়াজ শরিফ, মুখ তো কেউই খুলবেই না, হাত পা চালানো দূর অস্ত। তাই মেপে মেপে মোদী সরকার নানা সময়ে বাজানো  সেই পাকিস্তান ও সন্ত্রাসবাদের ফাটা রেকর্ড কে আঠা দিয়ে জুড়ে আবার বাজালো - পাকিস্তান কে আন্তর্জাতিক মহলে এক ঘরে করে দেওয়া হবে, পাকিস্তান কে একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ঘোষনা করা হবে, ইত্যাদী সব পরিচিত হুমকি আবার শোনালো। এখনই যুদ্ধে যাওয়ার মার্কিন সবুজ সংকেত আসেনি সে কথা স্পষ্ট করে বোঝা গেল। আর বোঝা গেল যে তলে তলে বিরিয়ানির পাতের বন্ধুত্ব কে নওয়াজ আর নরেন্দ্র সেই অটল বিহারী বাজপেয়ীর জমানার মতন করেই গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে । মনে পড়ে ১৯৯৯ সালে সেই ঘরে বাইরে ভয়ানক মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে ভারতবর্ষে কয়েক ভোটে অনাস্থা প্রস্তাব হেরে যাওয়া অটল বিহারীর বিজেপি সরকারের যখন কোনো ভাবেই ভোটে জিতে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না ঠিক সেই সময়ে নিজের লস্কর বাহিনী পাঠিয়ে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলে আর পাঁচ শত ভারতীয় সেনা কে গুলি মেরে ওই সংঘ পরিবারের পুরানো বন্ধু - মুসলিম লীগের নওয়াজ সাহেব আবার অটল বিহারীকে ভোটে জেতার সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল ? সেই অটল-নওয়াজ পিরীতের মতনই এবার নওয়াজ-নরেন্দ্র পিরীত এগিয়ে চলেছে এক সুন্দর মধুচন্দ্রিমার দিকে, যেখানে লক্ষ হলো একে অপরের স্বার্থে, মিলে মিশে মার্কিন আদেশ অনুসারে কাজ করা ।
ভারতবর্ষে যখনই কোন না কোন জঙ্গী হামলা হয় বা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয় তখনই হঠাৎ কোনো তথ্য বা প্রমাণের অভাব সত্বেও আমাদের কর্পোরেট মিডিয়া সরাসরি সরকারি ভাষা ও প্রেস বিজ্ঞপ্তির প্রতিধ্বনি শোনায়। সরকারের বয়ান কে একেবারে বৈদিক সত্য মেনে নিয়ে সেই বক্তব্য কে বার বার নানা কায়দায় প্রচার করে মানুষের মধ্যে সরকারের বক্তব্যকে, শাসক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী কে সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করাই আজ মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো মিডিয়া গোষ্ঠী এই প্রশ্নটা তুললো না যে বারামুল্লা জেলার সীমান্তের নিকটে উরির সামরিক ছাউনিতে যে চার জন জঙ্গী হামলা করে ১৭ জন সৈনিক কে মারলো তাঁরা পাকিস্তানি না আফগান না কাশ্মীরি সে কথা লড়াই চলাকালীন সময়ে কি ভাবে ভারত সরকার বা দেশের শাসক গোষ্ঠী আর সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা জানতে পারলো? কোনো সংবাদ মাধ্যমের চাকুরে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন তুললেন না যে পাকিস্তান কে দোষ দেওয়ার পিছনে কি সত্যিই কোনো বস্তুগত প্রমাণ বা নথি রয়েছে? জঙ্গীরা কাশ্মীরেরই বিক্ষুব্ধ যুবক নন সে কথা এতো শীঘ্র দেশের সেনা বাহিনী ও মোদী সরকার কি করে জানতে পারলো ? পাকিস্তান যদি কাউকে ভারতের সেনা ছাউনিতে আক্রমণ করতে পাঠায় তাহলে তাদের অস্ত্র ও মালপত্রে নিজের দেশের সিলমোহর মেরে দুনিয়া কে কেন জানান দিতে যাবে যে এই জঙ্গীরা পাকিস্তানের পোষ্য? কোনো দেশের পেশাদার গোয়েন্দা সংস্থা তো দূরের কথা আমাদের কলকাতার পকেটমারদের দলও কোথাও নিজের অপরাধে কোন এমন সূত্র ছেড়ে আসবে না যার মাধ্যমে পুলিশ ওদের নামে কেস দিতে সক্ষম হয়।ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’ পাকিস্তানের যে সব জঙ্গীদল কে সমর্থন করে তাদের হাতে কি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের ছাপ মারা রাইফেল তুলে দেয়?    
ভারত সরকারের মতনই এই দেশের কর্পোরেট সংবাদ সংস্থাগুলোর একটি অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে বিনা তথ্য ও প্রমাণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার সৃষ্টি করা। আর যেহেতু সমালোচনায় নিস্পৃহ ভারতের উচ্চ জাতের লোকেরা নিঃশর্ত বিশ্বাস নিয়ে ভারতের কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচারে বিশ্বাস করে, সরকার আর তার ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ অফিসারদের বয়ান কে ঘোর সত্য বলে মনে করে, তাই তারা যে এই প্রচারের সততা নিয়ে কোনোদিন প্রশ্ন তুলবে না তা বলা বাহুল্য।

উরি সেনা ছাউনির উপর আক্রমণের কয়েক মাস আগে, ঠিক ২০১৬ সালের শুরুর দিকে পাঞ্জাবের পাঠানকোটের বায়ু সেনার ঘাঁটিতে হঠাৎ হামলা চালায় কিছু জঙ্গী। হামলা চলাকালীন আমাদের সবজান্তা সংবাদ মাধ্যমগুলো ঘোষণা করে দিলে যে এই কাজ পাকিস্তান থেকে আসা কিছু জঙ্গীর কাজ।  জঙ্গীরা নাকি মোদী সরকারের উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত আর তাই ওরা পাঠানকোটে হামলা করে। সুক্ষ ভাবে মিডিয়া বোঝাতে চেয়েছিল এই দেশের অভিজাত ব্রাক্ষণত্ববাদীদের যে মোদী সরকারের উপর যে বা যারা ক্ষিপ্ত তাঁরা এই জঙ্গীদের মতনই “দেশ-বিরোধী শক্তি”। রীতিমত এই পাকিস্তান আর আইএসআই এর যুক্ত থাকার অভিযোগের গুলি আমাদের জলে গুলে জোর করে গেলানো হয়েছিল প্রতিবারের মতন। ঠিক যেমন বালুচিস্তানে কোন হামলা হলে পাকিস্তানের সরকার আর কর্পোরেট মিডিয়া তার পিছনে ভারতীয় হাত খোঁজে ঠিক তেমনি করে ভারতীয় উচ্চ জাতের হিন্দুদের মধ্যে, অভিজাত শহরবাসী পলিসি মেকারদের বার বার করে পাকিস্তানের হাত খুঁজতে বলা হয় প্রতিটি ঘটনায়। চোখের সামনে বৃহৎ করে দেখানো হয় ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যেকার দ্বন্ধ কে আর সাথে সাথে খুবই ধূর্ততার সাথে পাকিস্তান বিরোধিতার সুরটা  মুসলমান বিরোধী সুর হয়ে যায় আর আদিত্যনাথ বা সাক্ষী মহারাজদের গলার পারদ চড়ে যায়, পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী চলে যায় অন্তরালে আর আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু হয় ছা পোষা খেটে খাওয়া সাধারণ মুসলমান জনগণ।এই ভাবেই রাষ্ট্র যন্ত্রের সরাসরি প্ররোচনায় সৃষ্টি হয় অসংখ্য  গুজরাটের, মুজ্জাফরনগরের, দাদরির, মেওয়াতের, বা বিজনোরের।হিন্দুত্ববাদের ত্রিশূলের আঘাতে প্রাণ যায় গরিব মুসলমানের আর মসনদের গদির চামড়া নিয়ে কামড়া কামড়ি করতে থাকা নরেন্দ্র মোদী বা রাহুল গান্ধীরা এই হত্যালীলার তপ্ত উনুনে নিজেদের ভোগের খিচুড়ি  রান্না করে। ভারতের সংবাদ মাধ্যমের একটা অংশকে  কে যদিও বিজেপি ও আরএসএস এর নেতারা বৈশ্যা বলে ডাকলেও শেষ দৃষ্টিতে দেখতে গেলে ব্রাক্ষণত্ববাদী সংবাদ মাধ্যম কিন্তু নানা ছল-কপট-কায়দার সাহায্যে হিন্দুত্ববাদী শক্তিরই সাহায্য করে থাকে।          

ভারতের শাসক শ্রেণীর বা ওদের প্রতিনিধি সরকারের কোনো সর্বাঙ্গীণ জাতীয় সুরক্ষা নীতি নেই। এই নীতি না থাকার পিছনে রয়েছে ভারতের শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ ও সারা বিশ্বে মার্কিন আধিপত্য কায়েমের রণনীতি। যে সুরক্ষা নীতিকে আজ আঁকড়ে ধরে মোদী থেকে অজিত দোভাল সকলেই দেশপ্রেম আর জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার কথা বলছে সেই নীতি ভারতের স্বার্থে ভারতে রচিত নয়, বরং সুদূর মার্কিন মুলুকের পেন্টাগনের পন্ডিতেরা বসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তির স্বার্থ রক্ষার জন্যে ভারতের জাতীয় সুরক্ষা নীতির রচনা করেছে বিগত দেড় দশক ধরে। এই নীতির মূল কাজ হলো সামরিক ভাবে চীন কে টেক্কা দেওয়া আর যে করেই হোক দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে মার্কিন স্বার্থ বিরোধী শক্তি কে বিনাশ করতে ভারতীয় সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করা। গুরগাঁও বা বেঙ্গালুরু শহরে আউটসোর্সিং এর কাজ শুরু হওয়ার ঢের আগে থেকেই কিন্তু মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ আর মার্কিন ফৌজ নিজেদের কাজকর্ম ভারতের মতন নয়া ঔপনিবেশিক দেশগুলোর সরকারকে আউটসোর্স করেছিল। আজ ভারতের শাসক শ্রেণী মার্কিন-ইজরাইলি জোটের সাথে হাত মিলিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নিজের আধিপত্য কায়েম করতে, এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক, খনিজ, ও সামুদ্রিক সম্পদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তিগুলো কে লুঠ করতে সাহায্য করাও ভারতের শাসক শ্রেণীর কমিশন কামানোর একটা গুরুত্বপূর্ণ পথ। মার্কিন সেনাকে ভারতের জমি, জল, ও বায়ু পথ ব্যবহার করার যথেচ্ছ ছাড়পত্র দিতে মোদী সরকার এলইএমওএ, বা লজিস্টিক্স এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর করেছে এবং বেশ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই চুক্তি কার্যকর করা শুরু হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে বকলমে ভারত মার্কিন সেনার ঘাঁটি হয়ে উঠবে এবং মধ্য প্রাচ্যে চলা মার্কিন সৈন্য অভিযানে টাকার বিনিময়ে নানা প্রকারের পরিষেবা প্রদান করবে।  

ভারতের বিশাল বাজার, বিশাল খনিজ সম্পদ, সস্তা শ্রম ও নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির গড্ডালিকায় গা ভাসানো সরকারি নীতির ফলে ভারত মার্কিন পুঁজির ও মার্কিন সরকারের কাছে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি প্রিয়। ফলে ১২৩ পারমাণবিক চুক্তি, মার্কিন-ভারত সৈন্য চুক্তি, এলইএমওএ, ইত্যাদি বন্ধনে ভারতকে বাঁধতে বেশি উদগ্রীব ওয়াশিংটন ডিসি ও পেন্টাগন। এর ফলে ভারতের শাসক শ্রেণী মার্কিন পুঁজির শ্রেষ্ঠ দালাল হিসেবে উঠে আসায়, সাত দশক ধরে মার্কিন দালালি করা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীরও গায়ে জ্বালা ধরছে। এ যেন বৈশালয়ে চেনা খদ্দেরের অন্য ঘরে চলে যাবার মতন ব্যাপার।তাই পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীও চাইছে যে ভারতের শাসক শ্রেণীর মতন তাদেরও কোলে দোল খাওয়াক মার্কিন বাবারা।  কিন্তু সমস্যা হলো ওই মার্কিন নির্দেশে ১৯৮০’র দশকে যে ইসলামিক মৌলবাদের পথ ধরেছিল পাকিস্তান বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির কন্ঠরোধ করতে, সেই মৌলবাদ আজ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এমন আগুন লাগিয়েছে যে পাকিস্তানের বাজার আর নয়া উদারনৈতিক বাণিজ্য বা কাঁচা মাল লুঠ করার জন্যে খুব একটা সুরক্ষিত নয়। তাই তো তালিবানের হাতে গুলি খাওয়া মালালা ইউসুফজাই সারা বিশ্বে নারী ও শিশুর অধিকারের লড়াইয়ের চেহারা হয় আর কাঁচা মাল ও খনিজ সম্পদ লুঠের স্বর্গ রাজ্য ভারতের বুকে অসংখ্য সুরেখা ভোতমাঙ্গে তাঁর কন্যা প্রিয়াঙ্কা ভোতমাঙ্গে সহ ধর্ষিত আর খুন হন আর কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর নাম ওঠে না, কোনো কর্পোরেট সংস্থা মহারাষ্ট্র থেকে দলিত নিপীড়ন মোছার অঙ্গীকার করে না, কেউ মোমবাতি নিয়ে সুরেখা ভোতমাঙ্গের জন্যে মিছিল করে না, সুরেখা-প্রিয়াঙ্কার জন্যে কেউ ন্যায় চায় না। আফস্পা যেমন সৈন্য বাহিনীকে বেপরোয়া হয়ে খুন ধর্ষণ করার অধিকার দেয় ঠিক তেমনি ব্রাক্ষণত্ববাদ সাবর্ণ সমাজ কে দলিত-আদিবাসী-মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের হত্যা ও ধর্ষণ করার অবাধ অধিকার দিয়েছে।    

ভারতের সাথে পাকিস্তানের দ্বন্ধ যে কাশ্মীর নিয়ে চলছে সেই কাশ্মীরের মানুষের উপর আরও বেশি করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে, আরও বেশি করে কাশ্মীরের নিরীহ জনতা কে গুলি আর ছররা মেরে হত্যা করতে, আরও বেশি করে মানসিক ভাবে কাশ্মীরিদের ভারতীয় শাসক শ্রেণীর সামনে হীন মনস্ক করে তুলতে, উরি আর পাঠানকোটের মতন হামলা ভারতের শাসক শ্রেণী কে সাহায্য করে। যখন দেশ জোড়া আন্দোলনের ফলে পোটার মতন জনবিরোধী কালা কানুন কে ভারতের শাসক শ্রেণী বাধ্য হয়ে ফিরিয়ে নেয় ঠিক তখনই কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসবাদী হামলা হয় আর সেই ঘটনা ও ব্যাপক হারে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা কে ব্যবহার করে ভারতের শাসক শ্রেণী আবার নতুন কালা কানুন বানিয়ে জনতার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাই কাশ্মীরি জনতার উপর বর্বর হামলা করার পরে গোটা দেশ ও বিশ্বে ব্যাকফুটে পৌঁছে যাওয়া ভারত সরকারের কাছে অবশ্য কর্তব্য হয়ে উঠেছিল নিজের পক্ষে পরিস্থিতি কে শক্ত করে তোলা আর সেই কাজে খুব নিপুন ভাবে কাজে লাগলো উরি সেনা ছাউনির উপর আক্রমণ। এই আক্রমণ আইএসআই করিয়েছে না ভারতের গুপ্তচর সংস্থা র’ নিজেই করিয়েছে সে প্রশ্ন অবান্তর, কারণ এখানে মূল বিষয় হলো যে এই আক্রমণের ফলে কোন শক্তির উপকার হলো। একটু গভীরে ঢুকলেই দেখা যাবে যে এই ঘটনার পরে পাকিস্তানের চেয়ে বেশি লাভজনক পরিস্থিতিতে রয়েছে ভারতের শাসক শ্রেণী আর তার প্রতিনিধিদের সর্দার নরেন্দ্র মোদী।

এই মোদীর খাস লোক আর সংঘ পরিবারের কাশ্মীর বিষয়ক পন্ডিত রাম মাধব এই কিছুদিন আগেই আরএসএস এর সংস্থা ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন ও মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের সংগঠন ফিকির যৌথ উদ্যোগে জাতীয় সুরক্ষার উপর একটা অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়েছিল। সেখানে রাম মাধব বলেছিলো যে যেহেতু ভারতীয়রা (আরএসএস এর অভিধান হিসেবে পড়ুন হিন্দুরা) ভীষণ সহিষ্ণু ও উদার তাই চীনের রাজারা চীনের সুরক্ষার জন্যে প্রাচীর গড়লেও ভারতীয় শাসকেরা কোনোদিন খাইবার পাসের কাছে পর্বতের পথে কোনো বাঁধ তৈরি করেননি। রাম মাধব আরও বলেছিল যে ভারতের উচিত একটি এমন সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা যা জাতীয় শত্রুদের নিমেষে নিকেশ করে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করবে। এই কথা বলে রাম মাধব আবার কায়দা করে সেই বস্তা পঁচা বহিরাগত মুসলমানদের তত্ব কে হাজির করার চেষ্টা করেছিল, যে তত্ব কে ভাঙ্গিয়ে আর উঁচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে লালিত পালিত মুসলমান বিরোধী বিদ্বেষ কে কাজে লাগিয়ে আজ সারা ভারতে আরএসএস প্রসারিত হচ্ছে।রাম মাধবের বক্তব্যের উপর চোখ বোলালে বোঝা যায় যে আরএসএস এই মুহূর্তে কাশ্মীরের উপর সামরিক শাসনের বেড়িকে আরও কষে বাঁধতে চায় এবং এই কাজের জন্যে ভারতের মধ্যে সরকার বিরোধী, মোদী বিরোধী, ও ভারতের সম্প্রসারণবাদী নীতি বিরোধী শক্তিগুলোকে চিরতরে চুপ করানো একান্তই প্রয়োজন। আর এই ব্যাপক হারে বিরোধীদের (সংসদীয় নয়) চুপ করাবার কাজে সাহায্য করতে পারে সন্ত্রাসবাদের ভূত, যা ভারতের সরকার মার্কিন দেশ থেকে সেই অটল বিহারি আর লাল কৃষ্ণ আডবানির যুগে শিখেছিল।  

সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে ভারতের শাসকশ্রেণী মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের নিজের কব্জায় রাখতে পারে। এর অন্যতম কারণ হলো যে দেশের শহুরে মধ্যবিত্তদের সিংহভাগ হলো উঁচু জাতের হিন্দু, যাদের মধ্যে জাতি ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রবল এবং মূলতঃ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার ফেলে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থায় লেখাপড়া শেখার কারণে এদের দ্বান্ধিক ভাবে বস্তুর বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই। ফলে এই শ্রেণীর সিংহভাগ লোকই চিরকাল নিজেদের বিশ্বাস কে চিরন্তন সত্য হিসেবে গণ্য করে এবং এই ভাবে শাসক শ্রেণীর নীতির প্রতি ধীরে ধীরে আনুগত্য দেখায়, ততদিন দেখায় যতদিন না সেই নীতিগুলি এদের পেটে লাথি না মারে। মুসলমানদের প্রতি যে অবিশ্বাস ও ঘৃণা এবং দলিত ও আদিবাসীদের তুলনায় জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের যে চেতনা সাবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে শৈশব থেকে ঢোকানো হয় তার ফলে  ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত যে সব আষাঢ়ে গল্প ভারতের ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসকশ্রেণী শোনায়, তাতে নিঃশর্ত বিশ্বাস করা শুরু করে এই স্বচ্ছল শ্রেণী। মধ্যবিত্তদের রাজনৈতিক চেতনা যেহেতু শ্রমিক ও খেটে খাওয়া জনগণকে চরম ভাবে প্রভাবিত করে তাই এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে রাজনৈতিক ভাবে নিজের দিকে টেনে আনলেই ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসকশ্রেণীর পক্ষে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হয়ে যায়। তখন উরি হামলার মতন ঘটনা কে ব্যবহার করে, মন্ত্রী, ডিজিএমও, মিডিয়া প্রভৃতি ব্যবহার করে ভারতের শাসকশ্রেণী শুধুই মধ্যবিত্তদের নয় বরং শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনতাকেও উগ্র দেশপ্রেমের নামে ক্ষেপিয়ে তুলতে সক্ষম হয়।

আধুনিক কালে আবিষ্কৃত সন্ত্রাসবাদ চিরকালই শাসকশ্রেণীকে মদত করে নিজ অভীষ্ট লক্ষকে ঘুরিয়ে অর্জন করতে। ভারতের শাসকশ্রেণী মার্কিন শাসক শ্রেণীর মতন চতুরতার সাথে সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি এক অদৃশ্য সন্ত্রাসবাদী শক্তির দিকে ঘুরিয়ে রাখে।কেউ দেখেনি, কেউ চেনেনি এমন এক একটি কাল্পনিক দল কে শাসক শ্রেণীর গোয়েন্দা দফতর দেশের শত্রু, হিন্দু সাবর্ণ সমাজের শত্রু, দেশের তথাকথিত অখণ্ডতার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং নিজেদের তত্বকে ওজনদার করতে মাঝে মধ্যেই বেশ কিছু মুসলমান যুবক ও যুবতীদের ধরে জেলে ঢোকায় সন্ত্রাসবাদী হিসেবে। ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতির হিন্দুরা তখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়, তারা বিশ্বাস করে যে সত্যিই ভারতবর্ষ কোনো ইসলামিক জঙ্গী গোষ্ঠীর নিশানায়, সত্যিই পুলিশ আর গোয়েন্দারা একেবারে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মতন সদা সত্যি কথা বলে। যদিও অশ্বথামা হত’র পরে ইতি গজ কোনোদিন আমাদের ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতির লোকেরা শুনতে পায়না অথবা শুনতে চায় না। যখন ১১ বা ১২ বছর সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে একজন মুসলমান জেল খাটার পরে বেকসুর হয়ে ছাড়া পায় তখন সেই গোয়েন্দা আর পুলিশের নিন্দা কেউ করে না, তখন একটা মানুষের জীবনের অনেকগুলো অমূল্য দিন, তার যৌবন, তার স্বপ্ন কে ধ্বংস করার জন্যে  সেই সরকারের কাছে কেউ ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে না যে সরকার বিনা প্রমাণে নিরীহ লোকেদের শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে গ্রেফতার করে জেলে বন্দি করছে।জাতীয় সুরক্ষা লঙ্ঘন করা হবে যে ! বেঙ্গালুরু শহরে ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২০১২ থেকে জেলে বন্দি ১৩ জন মুসলমান যুবকেরা জজ সাহেবের সামনে এই জন্যে নিজেদের দোষী হিসেবে স্বীকার করে নেয় যে এর ফলে তাঁদের আর মাত্র এক বছর জেল খাটতে হবে কারণ আইন অনুযায়ী শাস্তি হবে পাঁচ বছর যার মধ্যে চার বছর তাদের জেল খাটা হয়ে গেছে। তাঁরা জানতেন যে যদি তাঁরা দোষ স্বীকার করে না নেন তাহলে ভারতের আইন ব্যবস্থায় হয়তো তাঁদের দুই দশকের বেশি সময় ধরে জেলে থাকতে হবে, কারণ তাঁরা যে মুসলমান।

উরির সেনা ছাউনিতে জঙ্গী হানার ঘটনা কে কেন্দ্র করে এখন আবার দেশ জুড়ে সংঘ পরিবার হিন্দু সাবর্ণ ও দলিতদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে মেরুকরণের মাধ্যমে নিজেদের শিবিরে টেনে আনতে চাইবে এবং উগ্র দেশপ্রেমের নামে হিংসাত্মক প্ররোচনা দেবে এবং সব চেয়ে বেশি চেষ্টা করবে কাশ্মীরের জনগণের উপর নৃশংস দমন পীড়নের পক্ষে ব্রাক্ষণত্ববাদী সাবর্ণদের সমর্থন কে সুনিশ্চিত করার। যাতে আগামী দিনে আরও বেশি করে কাশ্মীরি জনতা কে হত্যা করা যায়, পেলেট ছুড়ে অন্ধ করা যায় আর দেশের নানা প্রান্তে যে সমস্ত বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তি এই নৃশংস দমন পীড়ন ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে উচ্চ জাতির হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তুলে পুলিশি দমন পীড়ন নামিয়ে আনা যায়। আমরা যে জরুরী অবস্থার মধ্যে বাস করছি, বকলমে একটি ফ্যাসিস্ট পুলিশ রাষ্ট্রে বাস করছি সেই সত্যটা এই রাষ্ট্র যন্ত্র ও তার শাসক শ্রেণী আমাদের প্রতিদিন জানান দেবে। যদি এই অপপ্রচার, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, জাতি বিদ্বেষ, মুসলমান সহ সংখ্যালঘুদের প্রতি তীব্র ঘৃণার প্রসারণ, ইত্যাদীর আড়ালে দেশের জনগণকে মার্কিন সেনার কামানের খোরাক বানানোর, দেশের খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ কে লুঠ করতে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র ভারতের ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রতিনিধি আরএসএস ও বিজেপির নেতৃত্বে চলা ফ্যাসিবাদী নরেন্দ্র মোদীর সরকার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে গরিব কৃষক, শ্রমিক, দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সমাজ কে ঐক্যবদ্ধ করে যদি এক ব্যাপক গণ ফ্রন্ট, যুক্ত ফ্রন্ট না গড়া যায়, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি এই উগ্র স্বদেশ প্রেমের নামে ভারত সরকার এক যুদ্ধে সামিল হবে মার্কিন পুঁজির স্বার্থে ও তার খরচের বোঝা এই দেশের গরিব মানুষের কাঁধে চাপবে। স্বদেশ কে রক্ষা করতে আজ আমাদের দেশের সকল শোষিত, নিপীড়িত ও দেশপ্রেমী শক্তিকে লড়তে হবে ব্রাক্ষণত্ববাদী সামন্ত প্রভু, দালাল পুঁজিপতি ও বিদেশী পুঁজির পা চাটা দালাল সংঘ পরিবারের সাবর্ণ ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে, এক নতুন গণতান্ত্রিক ও শোষণ মুক্ত ভারতবর্ষ গড়ার লক্ষ্যে।লড়াই ছাড়া, সংগ্রাম ছাড়া আজ দেশের শোষিত ও অত্যাচারিত জনতার সামনে আর কোনো রাস্তা নেই নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার কে সুরক্ষিত করার ও এক ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যবস্থা গড়ে তোলার। তাই আপনি যদি গণতন্ত্রের পক্ষে হন, আপনি যদি ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে হন, আপনি যদি গরিব মানুষের প্রগতি ও আর্থিক উন্নয়নের পক্ষে হন, আপনি যদি স্বদেশের সমৃদ্ধির পক্ষে হন তাহলে আজ আপনাকে এই বৃহত্তর ফ্যাসি বিরোধী সংগ্রামে যোগ দিতেই হবে। কারণ মানব ইতিহাস সত্যিই আমাদের কোনো সহজ বিজয়ের পথ দেখায়নি।       

পশু প্রেমের নামে কোরবানি ঈদের বিরোধিতার পিছনে রয়েছে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তির ষড়যন্ত্র

মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৬ 0 Comments A+ a-


খুশির ঈদ বলা হলেও আদতে ঈদ অন্যান্য সকল ধর্মের উৎসবের মতনই ধনী মানুষের উৎসব। ঈদ উল ফিতর করার কোনো বাণী কোরানের পাতায় নেই, বরং সত্যি বলতে ঈদ শব্দটি যীশুর শেষ আহারের ঘটনা বাদে কোরানে আর কোথাও উচ্চারিত হয়নি। মোহাম্মদের সময়ে এবং পরবর্তীকালে আরবদের নানা আদি উৎসব ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করে, ঠিক যেমন রোমানদের নানা উৎসব ক্যাথলিক ধর্মে প্রবেশ করে সরকারি মর্যাদা পায়, ঠিক সেই ভাবেই ঈদ উল ফিতর ও ইহুদিদের কোরবানির উৎসব ঈদ হিসেবে আরব ইসলামে প্রবেশ করে। যাই হোক ভারতীয় উপমহাদেশে কোরবানির ঈদ চিরকাল ধনী আর উচ্চ মধ্যবিত্তদের ধনের জৌলুস দেখানোর একটি বিশেষ দিন, কে কটা গরু, ছাগল, উট, ভেড়া কাটতে পারে তার দিন। কোরবানির সাথে জুড়ুন হিন্দুদের পাঁঠা আর মোষ বলি, যা বোধহয় প্রতি সপ্তাহে হয় আর অজস্র জানোয়ার হাঁড়ি কাঠে কাটা পড়ে ধর্মের দোহাইতে। মুসলমানের আল্লাহ আর হিন্দুর মা কালি নাকি জানোয়ারের রক্তে প্রসন্ন হন, মানুষের ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ও ভালোবাসার নিদর্শন হলো পশু বলি বা কোরবানি।


বিগত দুই দশক ধরে হিন্দুত্ববাদী শক্তির শকুনের নজর গিয়ে পড়েছে কোরবানির ঈদে, নৈপথে প্রথমে ছিল গো রক্ষা আর এবার জুটেছে নৃশংসতার প্রশ্ন। হিন্দুত্ববাদের ধবজ্জাধারী আরএসএস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা অনেকদিন ধরে হিন্দু ধর্মের উত্তর ভারতীয়করণ করার প্রচেষ্টায় জড়িত। উত্তর ভারতীয় উচ্চ জাতির ব্রাক্ষণ ও বৈশ্য জাতির মানুষেরা নিরামিষাশী হয় জৈন ধর্মের প্রভাবে পড়ে। সেই নিরামিষাশী হিন্দুত্ব কে আজ সারা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আরএসএস এর শাখাগুলোর মাধ্যমে। আরএসএস ও বিজেপির কাছে চ্যালেঞ্জের রাজ্য হলো কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা, মনিপুর, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, ও গোয়ার মতন রাজ্য যেখানে হিন্দুদের মধ্যে মাংস খাওয়ার প্রবণতা চালু আছে। কেরলে হিন্দুদের একটা বড় অংশ গো মাংস ভক্ষণ করে, কলকাতা শহরেও অনেক হিন্দু বাঙালি হাপুস হুপুস করে গরুর বিরিয়ানি খান। কিন্তু এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্মের ভিত্তিতে যে হিন্দু রাষ্ট্র আরএসএস হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান স্লোগানের আড়ালে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেখানে ইসলামের ওয়াহাবি-সালাফি ধারার মতনই হিন্দু ধর্ম ও তার রীতিনীতি সারা দেশজুড়ে একই হবে। মোদ্দা কথা হলো দেশের মানুষ নিরামিষাশী হবে, বড় জোর মাছ আর মুরগি খাবে, আর বাকি সমস্ত পশু বিদেশে রফতানি হবে বিদেশি মুদ্রা কামাবার জন্যে। ব্রাক্ষণত্ববাদের এই নিশানায় বাঁধা সেঁধেছে অহিন্দি ভাষী হিন্দুরা আর দলিত ও আদিবাসী সমাজ, যাঁদের উপর প্রায় জোর করে উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান ও গুজরাটে ব্রাক্ষণত্ববাদের নয়া নিরামিষবাদ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিগত তিন দশক ধরে সারা দেশে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার নামেও খাদ্য অভ্যাস কে অন্যের ঘাড়ে হয় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা বাড়ি ভাড়া বা ক্রয়-বিক্রয় করার ক্ষেত্রে ভেদাভেদ করা হচ্ছে।

মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় দোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাংস খাওয়ার অভ্যাস। ভারতবর্ষে যেন পশু হত্যা করে খাওয়া ঘৃণ্য অপরাধ হয়ে গেছে, বিজেপি শাসিত বেশির ভাগ রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোয়, মহারাষ্ট্র, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড়, ইত্যাদি রাজ্যে গরুর মাংস খাওয়া ও বিক্রি করায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, মুসলিম প্রধান কাশ্মীর উপত্যকায় রণবীর পেনাল কোডের মাধ্যমে গরুর মাংস নিষিদ্ধ হয়েছে, আর এবার সারা দেশ জুড়ে চলছে পাঁঠা, মোষ, ভেড়া ইত্যাদি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। মাংস খাওয়া কে রোখার জন্যে ধর্ম আর আইনের বোঝা জনগণের ঘাড়ে, বিশেষ করে মুসলমান-খ্রিষ্টান-আদিবাসী ও দলিতদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।   


পশ্চিমবঙ্গে আর অসমে যখন পুজোর নামে সারা বছর জুড়ে পশু বলি চলে, ঠিক তখনই বছরে একবার ঈদের দিন ধর্মের নামে জানোয়ার কাটার জন্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ চলছে। শহরাঞ্চলে এর প্রভাব তীক্ষ ভাবে টের পাওয়া যায়, গ্রামাঞ্চলে (দক্ষিণবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি, বর্ধমান এবং উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, কুচবিহার বাদে) দীর্ঘদিন ধরে গরিব হিন্দু আর গরিব মুসলমান একসাথে মিলেজুলে বাস করার ফলে দ্বন্ধ ও ঘৃণা এত তীব্র হয়নি। কোরবানির ঈদের চাঁদ আকাশে দেখার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সহ সারা ভারতে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তিগুলো প্রচার শুরু করে পশু হত্যার বিরোধিতা করার নামে। মুসলমানদের নামে তীব্র অপপ্রচার চালানো হয় এবং বিশেষতঃ উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাটের বিভিন্ন প্রান্তে গরু কাটার গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা লাগাবার চেষ্টা করে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ,  বজরং দল ও এদের রাজনৈতিক গণসংগঠন বিজেপি। গত বছর উত্তর প্রদেশের দাদরি জেলার বিদাসা গ্রামে কোরবানি ঈদের ঠিক পরেই গরু কাটার অভিযোগে একদল বিজেপি ও আরএসএসের লোকেরা পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মোহাম্মদ আখলাক নামক এক প্রৌঢ় কে। এই বছর হরিয়ানার মেওয়াত এলাকায় গরু খাওয়ার অভিযোগ তুলে কোরবানি ঈদের ঠিক আগেই হঠাৎ পুলিশি অভিযান শুরু হয় আর একটি মুসলমান পরিবারের দুই সদস্যকে হত্যা করে দুই জন মহিলাকে, যার মধ্যে একজন নাবালিকা,  গণধর্ষণ করে চার জন দুষ্কৃতী যারা নিজেদের গো রক্ষক হিসেবে পরিচয় দিয়ে ধর্ষণ পীড়িতদের বলে যে এই খুন আর ধর্ষণ গরু খাওয়ার শাস্তি। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে এই অপরাধ করার জন্যে একদল মানুষ কে কি ভাবে তাঁতিয়ে তোলা হচ্ছে। আর যারা তাঁতিয়ে তুলছে তাদের সাথে প্রকাশ্যে হাত মিলিয়ে হরিয়ানায় গরু প্রেমী খাট্টার সরকার সমস্ত রকম ভাবে গরু নিয়ে, ছাগল কাটা নিয়ে বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি করে জাঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে।
উত্তরপ্রদেশেও নিরামিষ খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কোরবানির ঈদের বিরোধিতা করা হচ্ছে প্রবল ভাবে, গ্রামে গ্রামে উঁচু জাতের জোতদাররা চেষ্টা করছে দলিত ও নিম্ন জাতির হিন্দু কৃষকদের গরুর নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে যাতে গুজরাটের উনার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা দলিত সম্প্রদায়ের ব্রাক্ষণত্ববাদ বিরোধী ঘৃণার স্রোত কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বইয়ে দিয়ে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই মেরুকরণের কাজ সম্পন্ন করা যায়।


আমাদের দেশে বৈচিত্র কে মিটিয়ে মানুষকে ভেড়ার মতন এক শ্রেণীতে ফেলার আরএসএসের পরিকল্পনা যদিও সহজ নয়, তবুও মনে রাখতে হবে যে দীর্ঘদিন ধরে আরএসএস সিনেমা, টেলিভিশন, সংবাদ মাধ্যম ও প্রচারের নানা মাধ্যমে নিজের একচেটিয়া কতৃত্বের মারফৎ সারা দেশে উত্তর ভারতের হিন্দুত্ববাদ কে সারা ভারতে পাচার করেছে। প্রায় ১৭-১৮ বছর আগে শুরু হওয়া স্টার টিভির "কিউঁকি সাঁস ভি কভি বহু থি", "কাহানি ঘর ঘর কি" ইত্যাদি সোপের কথা মনে পড়ে? এই ধারাবাহিকগুলোয় বারবার করে উত্তর ভারতের উঁচু জাতের হিন্দুদের জীবন যাত্রা কে সমগ্র দেশের জন্য অনুসরণ যোগ্য এক আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়। মহিলাদের স্বামী ও সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনের সনাতন জ্ঞান দেয় স্মৃতি ইরানি ও সাক্ষী তানবার। এই ধারাবাহিকগুলোর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত উত্তর ভারতের হিন্দুদের নানা অনুষ্ঠান ও পার্বন পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। দেখতে পাবেন করবাচৌত, মেহেন্দি, বিয়ের মন্ডপে উদ্দাম নাচ, ইত্যাদি বাঙালি হিন্দুর জীবনে হুহু করে প্রবেশ করেছে। ঠিক যেমন বাঙালি মুসলমানের জীবনে প্রবেশ করেছে দাড়ি-টুপি-বোরখার মতন জিনিস।


আজ আরএসএস সমগ্র দেশের বৈচিত্রময় নানা জাতির নিজস্ব জীবনশৈলী কে শেষ করে দিতে চায় হিন্দুত্বের নেশন স্টেট তৈরি করার বাসনায়। কোরবানির ঈদের নামে পশু হত্যার বিরুদ্ধে যে আরএসএস বলবে সেই আরএসএস কিন্তু কালীঘাটে বা কামাখ্যা মন্দিরে খাঁড়ার আঘাতে দ্বিখন্ডিত হওয়া পশুর প্রতি সহমর্মিতা দেখাবে না। কারণ ঈশ্বরের সাথে সাথে মনে হয় পশু হত্যায় পাপের ভার হালকা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এক সম্পূর্ণ বৈচিত্রময় ও বিবিধ ভারত আরএসএস ও বিজেপির হিন্দু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ার পথে এক বিশাল বাঁধা, বিশেষ করে এই দেশের দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব জীবন শৈলী সংঘ পরিবারের কাছে এক চ্যালেঞ্জের বস্তু। তাকে রক্ষা করা ও নানা নিপীড়িত জাতির ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিজস্ব পরম্পরা ও উৎসব পার্বন কে পালন করার স্বাধীনতা কে রক্ষা করা বর্তমান সময়ে এক বড় দ্বায়িত্ব। এই দ্বায়িত্ব পালন করা আজ সমস্ত গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষের সবচেয়ে জরুরী কর্তব্য।  বলি বা কোরবানির থেকে ধীরে ধীরে শিক্ষিত করে মানুষ কে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস অবশ্যই চালাতে হবে বৈজ্ঞানিক বিচারধারা কে প্রতিষ্ঠা করতে, কিন্তু কারুর উপর কিছু চাপিয়ে না দিয়েই এই কাজ করতে হবে জনতার মুক্তি সংগ্রামের সাথে সাথে।

সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল কে কেন বুড়ো আঙ্গুল দেখালেন কাশ্মীরের জনতা ?

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৬ 0 Comments A+ a-


The future of Kashmir on the curfewed streets
কার্ফুর মধ্যে হেঁটে চলেছে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ 

বহুদিন ধরে ভূস্বর্গে আগুন জ্বলছে। সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে রক্ত,  স্বজন হারানোর বিষাদ, আর স্বাধীনতার দাবি।কাশ্মীর জুড়ে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ পথে নেমেছে, লাঠি-গুলি-ছররা বন্দুক কে তোয়াক্কা না করে ঐক্যবদ্ধ ভাবে স্লোগান দিচ্ছে - ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ দূর হট - ঠিক সেই সময়ে ভারতের ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ দালাল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আরএসএস - বিজেপির নেতৃত্বে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল নিয়ে উত্তর প্রদেশের ক্ষত্রিয় জোতদার পুত্র রাজনাথ সিংহ হঠাৎ কাশ্মীর ভ্রমণে গেল। ইস্যু ছিল কাশ্মীরের জনগণের কথা শোনা। তা জনতা বাহাদুর তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রেখে যাওয়া কার্ফু আর দেশদ্রোহের আইনে হয় বাড়িতে না হয় জেলে বন্দি আর ভারতের থেকে আসা সংসদীয় প্রতিনিধিদলের লোকেদের সাথে দেখা করার কোনো ইচ্ছা যে কাশ্মীরের জনগণের নেই সে কথা বলতে তো আর "সমগ্র" রাজনৈতিক বিজ্ঞানে ডিগ্রির দরকার পড়ে না। তাই যখন দেখা গেল যে কৃষির সমস্যা নিয়ে কথা বলতে আসা কিছু জোতদার আর বাগান মালিক ছাড়া রাজনাথের দরবারে কেউ আসেনি, তখন সরকার বাহাদুরের আক্কেল গুড়ুম হলো। এই না আসার সোজা মানে ছিল ভারতের সম্প্রাসারণবাদীদের সাথে কাশ্মীরের জনগণ কোনো আলোচনা করবেন না যতদিন না ভারত সরকার কাশ্মীর থেকে সেনা প্রত্যাহার না করছে, আফস্পা প্রত্যাহার না করছে, সাধারণ মানুষের হত্যাকারী সেনা ও আধা সেনার অফিসার ও সৈন্যদের শাস্তি না দিচ্ছে ও সর্বোপরি কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কে স্বীকার করে না নিচ্ছে।

গোটা দেশের কর্পোরেট মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলে গেল গেল রব পড়তেই রাজনাথের অনুমতি নিয়ে সিপিএম নেতা ইয়েচুরি, সিপিআই নেতা ডি রাজা, আর জেডিইউ নেতা শরদ যাদব কে সাথে রওনা দিলে কাশ্মীরের রাজধানী চষে এমন নেতাদের বের করতে যাঁরা এদের কথা শুনবে, ভারতের শাসক শ্রেণীর ফরমানে জি হুজুর বলবে।আশা ছিল যে হুরিয়াত কনফারেন্সের নেতৃত্ব অন্তত গায়ে বাম বাম গন্ধওয়ালা নেতাদের সাথে চায়ের কাপে আলোচনা আর তর্কের ঝড় তুলবে। হুরিয়াত কনফারেন্স একটি মধ্যপন্থী ও সুবিধাবাদী মঞ্চ যেখানে কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে রাজনীতি করা বিভিন্ন শাসক শ্রেণীর লোকেরা একজোট হয়ে শলা পরামর্শ করে আর সাংবাদিক সম্মেলন করে। এই দলের নেতারা ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের থালা চেটে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করে এবং কাশ্মীরের মানুষের মুক্তি নিয়ে এদের আসলে কোনো মাথাব্যথা নেই। এদের পাণ্ডা সৈয়দ গিলানি সাহেব আবার ভীষণ বিপ্লবী সেজে বসে থাকা কাশ্মীরের জ্যোতি বোস না হলেও বিনোদ মিশ্রের কিছু কম না। মুখে গরম বুলি, স্বাধীনতার দাবিতে আস্ফালন আর সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন সরকারের নির্দেশ মেনে ভারত আর পাকিস্তান উভয়ের শাসক শ্রেণীর সাথে হাত মিলিয়ে কাশ্মীরের জাতীয় সংগ্রাম কে একটি পরিকল্পিত ও ব্যাপক গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পথ থেকে সরিয়ে উগ্র জঙ্গীবাদ ও ইসলামিক মৌলবাদের বিভ্রান্তিকর পথে আটকে রাখার পক্ষে ওকালতি করে এই হুরিয়াত কনফারেন্স। এদের তুলনা ভারতের ঔপনিবেশিক কালের লাল-বাল-পাল চক্রের থেকে বেশি কারুর সাথে করা চলে না। তবুও আজ জনগণের বিদ্রোহী মেজাজ ও ব্যাপক ক্ষোভের বহ্নিশিখা দেখে এই হুরিয়াত নেতারাও ভীত ও সন্ত্রস্ত। তাই বাড়ির দুয়ারে আসা ইয়েচুরি, রাজা, যাদবদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের রাজনৈতিক পশ্চাৎদেশ রক্ষা করতে হচ্ছে গিলানির মতন দালালি করা নেতাদের। অন্যদিকে আরএসএস এর মুসলমান প্রতিবিম্ব এমআইএম নেতা আসাউদ্দিন ওয়াইসি কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে জেলের মধ্যে বন্দি মীরওয়াইজ ওমর ফারুকের সাথে দেখা করে তাঁকে ভারত রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর উপদেশ আর বার্তা দিয়ে এসেছে। এই সর্বদলীয় প্রতিনিধি দলের আসল কাজ ছিল কাশ্মীরে ঘুরে সেনা ও আধা সেনার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট প্রদান করা ও কাশ্মীরি জনতা কে ভয় দেখানো, কিন্তু হালে পানি না পেয়ে এই নেতারা রাজনাথের কোলে বসে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেট মিডিয়ার কাছে নালিশ ঠোকে কাশ্মীরের মানুষের বিরুদ্ধে। দিল্লির হত্যাকারী সরকারের প্রতিনিধিদের গোঁসা হয়েছে যে কাশ্মীরে শান্তির আলোচনা আর শান্তি জল ছেটাতে এসেও এদের কেউ ভালো চোখে দেখছে না।
 
রাজনাথ সিংহ আর ওর প্রতিনিধি দলের আসল উদ্দেশ্য বিফলে যাওয়ায় আর খুব ধুমধাম করে হওয়া কাশ্মীর যাত্রার ফানুস ফেটে যাওয়ায় বিদেশী কর্পোরেট মিডিয়ার কাছে শেয়ালের মতন চিৎকার করে সমস্ত নেতারা যখন গলা ফাটাচ্ছিল কাশ্মীরের জনগণ কিন্তু ঠিক সেই সময়ে একটা নতুন রাজনীতির আভাস দিচ্ছিলেন। প্রায় ২৬ বছর আগে যখন কাশ্মীরের বহু ছেলে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, অনেকে আবার পাকিস্তানের কাছে ট্রেনিং নিতে গেছিল, সেই সময়ে অনেক প্রবীণরা তবুও আশা রেখেছিলেন যে আলোচনার মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি পেশ করা দরকার। ভারতের সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীর দ্বারা গণ হত্যা, গণ ধর্ষণ, লুট আর গ্রামে আগুন লাগানোর মতন ঘটনাগুলো সমগ্র নব্বই এর দশক জুড়ে উত্তাল করে রেখেছিল কাশ্মীরের জমিকে। ব্যাপক হারে যে জনতা স্বাধীনতার দাবিতে, ন্যূনতম মানব অধিকারের জন্যে লড়তে আসেন, তাঁরা কাশ্মীরের নানা সংগঠনের পরস্পর বিরোধী ও দিশাহীন নীতির দরুণ অস্থির হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানের চরমপন্থী জঙ্গীদের দাপটে আর কাশ্মীরের মধ্যে উগ্রপন্থার দিশাহীনতায় বহু মানুষের মনে হয়েছিল যে আলোচনার পথই শ্রেষ্ঠ পথ। কিন্তু ২০০৩ সাল থেকে বহু প্রচেষ্টা করেও কাশ্মীরের জনতা নয়া দিল্লি কে নিজের স্বাধীন হওয়ার আকঙ্খা বোঝাতে পারেননি। যতবার চেষ্টা হয়েছে ততবার গুলি আর ছররা তেড়ে এসেছে, বিদ্ধ করেছে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কে। স্বাধীনতার দাবিতে নয়, বরং দুর্নীতির বিরোধিতা করে, সাধারণ গণ আন্দোলনে সামিল হওয়া জনতাকে, লোডশেডিং আর নিত্য জীবনের বিভিন্ন সমস্যার বিরুদ্ধে পথে নামা মানুষকে গুলি মেরে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিল ২০০৮, ২০১০ সালে, তা জনগণের সামনে স্পষ্ট করে যে ভারতের সরকার চিরকাল ঔপনিবেশিক জনতার উপর চরম অত্যাচার করবে। নয়া দিল্লির পুরানো দালাল আব্দুল্লাহ পরিবারের উপর তিতি বিরক্ত হয়ে কাশ্মীরের জনগণ চেয়েছিলেন পরিবর্তন আর তাই ২০১৪ সালের নির্বাচন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বয়কট করলেও কাশ্মীরে  ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা পিডিপি। কিন্তু কাশ্মীরের মানুষের মুখ্য ধারার মুখপত্র হিসেবে বুক বাজানো পিডিপি শুধু রাজ্যের মসনদে বসার তাগিদে হিন্দুত্ববাদের ধবজ্জা তুলে কাশ্মীরের উপর ভারতের ব্রাহ্মণত্ববাদী শাসক শ্রেণীর শাসনকে সুদৃঢ় করতে চাওয়া বিজেপির হাত মেলানোয় কাশ্মীরের জনতার সামনে বেইমান হিসেবে চিহ্নিত হয়। সাথে সাথে কাশ্মীরে হিন্দুত্ববাদের প্রচার তীব্র করতে পিডিপির গোপন সমর্থন, বিজেপি কে উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ দেওয়া, আরএসএস কে কাশ্মীর
           

মাদার টেরেসার উপর ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তির আক্রমণ সংঘ পরিবারের সংখ্যালঘুদের উপর ঘৃণার প্রতিফলন

রবিবার, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৬ 0 Comments A+ a-


মাদার টেরেসা শেষ পর্যন্ত ভ্যাটিকান শহরে সন্ত উপাধিতে ভূষিত হলেন মৃত্যুর পরে চমৎকার করে দুই জন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য। সেন্ট টেরেসা অফ ক্যালকাটা হলেন মাদার টেরেসা, মৃত্যুর ১৯ বছর পরে। সুষমা স্বরাজ মোদী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভ্যাটিকান শহরে যেমন উপস্থিত ঠিক তেমনি উপস্থিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিজের গাইয়ে নাচিয়ে সাংসদদের প্রতিনিধি দল নিয়ে। নানা ভড়ং বাজির শেষে পোপ ফ্রান্সিস মাদার কে সন্ত ঘোষণা করেন এবং সাথে সাথে কলকাতা সহ ভারতবর্ষ জুড়ে শুরু হয় উচ্ছাস আর কুৎসার বন্যা, আনন্দ আর ঘৃণার বর্ষা।

আগ্নেস ওরফে টেরেসা, সিস্টার হিসেবে সেই ১৯৩৭ সালের আশে পাশে কলকাতায় আসেন এবং লরেটো কনভেন্টে শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হন। তারপর তিনি ক্যাথলিক চার্চের নির্দেশে কলকাতার গৃহহীন, হতদরিদ্র, কুষ্ঠ রোগী, অনাথ শিশুদের সেবার কাজে নিয়োজিত হন এবং প্রতিষ্ঠা করেন মিশনারিজ অফ চ্যারিটি। নিজের কর্মের ক্ষেত্রে টেরেসা চিরকাল ধর্মকে প্রাধান্য দিয়েছেন, কিন্তু ধার্মিক মৌলবাদের প্রচার করেননি, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল ধর্মের, সকল জাতের মানুষের সমানভাবে সেবা করেছেন। টেরেসা ভাববাদে বিশ্বাসী ছিলেন, বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির থেকে করতেন, ডাক্তারি চিকিৎসার থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি প্রার্থনা ও আশীর্বাদের মাধ্যমে অলৌকিক উপায়ে রোগ নিরাময়ের প্রথায় বিশ্বাস করতেন। টেরেসার চিকিৎসার তত্ব ছিল যন্ত্রণার তত্ব, যন্ত্রণাকে, বেদনাকে আপন করে নেওয়ার তত্ব। যীশু খ্রিষ্ট যেরকম ভাবে ক্রুশ বিদ্ধ হয়েও বেদনাতে ভীত হননি বরং বেদনায় মুক্তি খুঁজেছিলেন, বেদনাকে ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার রাস্তা হিসেবে দেখেছিলেন, ঠিক তেমনি ক্যাথলিক বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের কাছে যন্ত্রণা কে মুক্তি হিসেবে দেখাবার একটা ধারা বহুকাল ধরে ভীষণ তীব্র আছে, টেরেসার বিশ্বাসও তাতেই ছিল। বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি বাদ দিয়ে মুমূর্ষু রোগীদের টেরেসা ঈশ্বরের বাণী শোনাতেন, খ্রিষ্ট কে স্মরণ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে বলতেন। কারুর সঠিক চিকিৎসা টেরেসা করেননি ডাক্তার দিয়ে, কারণ তাতে তিনি ঈশ্বর বিরোধিতা দেখতেন।

মাদার টেরেসা গর্ভপাত বিরোধী ছিলেন, ১৯৭১ সালে খান সেনাদের আর রাজাকার বাহিনীর হাতে ধর্ষিত নারীদের তিনি গর্ভপাতের বিরুদ্ধে গিয়ে সন্তান জন্ম দিতে বলেন। উনি চিরকাল নারীমুক্তি আন্দোলনের বিরোধিতা করতেন, এবং নারীর শরীরের ওপর নারীর অধিকার মানতে অস্বীকার করতেন ক্যাথলিক শাস্ত্র অনুসারে। পূর্ব ইউরোপের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও টেরেসা ছিলেন পোপ জন পলের মতনই তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী। তিনি চরম ভাবে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন, নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলন সহ যে কোনো কৃষক বিদ্রোহকে তিনি ভ্যাটিকানের হুকুম শুনে বিরোধিতা করে এসেছিলেন। তিনি নাস্তিকদের নরকবাসী ভাবতেন এবং নিজের পেশা অনুসারে তিনি গরিব মানুষের মুক্তির পথ হিসেবে খ্রিষ্ট ধর্মকে তুলে ধরতেন, অভাব, শোষণ আর অনাহারক্লিষ্ট জনতাকে টেরেসা প্রার্থনায় ডুবে থাকতে বলতেন। এইরূপ মত টেরেসা দিতেন কারণ তিনি নিজের ধর্মবিশ্বাস অনুসারে এইসব অবৈজ্ঞানিক তত্বে বিশ্বাস করতেন। এর ফলেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর তার দালালদের প্রিয় পাত্রী হিসেবে তিনি ২৯,০০০ মানুষকে যন্ত্রণাময় মৃত্যু দেওয়ার কারণে নোবেল পুরস্কার পান। ম্যাকনামারার মতন ব্যক্তিরা তাঁর নাম নোবেলের জন্যে সুপারিশ করে। আর্থিক অনুদান নেওয়ার ক্ষেত্রেও টেরেসা ও আশা রাম বা সত্য সাঁই বাবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। চোর, ডাকাত, খুনি, স্মাগলার, সবার থেকে টেরেসাও কোটি কোটি টাকা নিয়ে দান করেছে ভ্যাটিকানে।

রোমান ক্যাথলিক চার্চ দীর্ঘ দুই শতাব্দী ধরে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজেকে পরিবর্তন করেছে, আর বিশ্ব পুঁজিবাদের বৃহৎ সমর্থনকারী শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের থেকেই ধর্মে বিশ্বাস মানুষের কমতে থাকে আর প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মালম্বীদের বিভিন্ন ধারার উৎপত্তি ও শক্তিবৃদ্ধির কারণে ক্যাথলিক চার্চ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে আর জনগণের জীবনের উপর ক্যাথলিক চার্চের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে শুরু হয়। তার অনেক আগের থেকেই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের থেকেই, বিশেষ করে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে সারা দুনিয়ার ভীত-সন্ত্রস্ত-দুর্বল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের আধ্যাত্মিক রক্ষা কর্তা হিসেবে ক্যাথলিক চার্চ এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার পথে নামে। দেশে দেশে গরিব মানুষের মধ্যে দান খয়রাত ও সেবা দ্বারা সরকার বা শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ঘৃণা কে বিলীন করে শোষিত মানুষদের বিপ্লব-বিদ্রোহ বিমুখ করার কাজ শুরু করে ভ্যাটিকান। সাধে তো কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার লেখার শুরুতেই মার্কস আর এঙ্গেলস পোপ কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেননি।

টেরেসার ধর্ম ও কুসংস্কার ভর্তি দৃষ্টিভঙ্গী সত্বেও তিনি যে ভাবে আর্তের সেবা করেছেন তা আমাদের ভদ্রলোকেরা পারেনি। টেরেসা মাদার হিসেবে জনতার কাছে চিহ্নিত হয়েছেন নিজের সেবার জন্যে, প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার জন্যে নয়। আমাদের অবশ্যই তাঁর দুই ভাগ করে ভালো আর মন্দকে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। মাদার টেরেসা যে ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী গোঁড়া হিন্দু সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন যে কুষ্ঠ রোগ ছোঁয়াচে নয়, পূর্ব জন্মের পাপ নয়, বরং একটি অসুখ যাতে চিকিৎসা সেবা আর ভালবাসার দরকার, তা কিন্তু অনেক নাম করা হিন্দু পন্ডিতেরা বা গুরুদেবেরা করেনি। মাদার টেরেসা যে ভাবে ১৩ জন সিস্টারদের নিয়ে পথে পথে ঘুরে গরিব মানুষের সেবা করেছেন, তাঁদের তুলে এনেছিলেন কালীঘাটের নির্মল হৃদয়ে, যে ভাবে তিনি গরিবদের স্বার্থে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন নিজে ঘুরে ঘুরে, তা তো কোনো কর্পোরেট গুরুদের করতে দেখা যায়না। যদিও গরিবের প্রতি প্রেম বা দরদ থেকে নয়, টেরেসা এ সব করতেন স্বর্গে নিজের স্থান পাকা করার জন্যে। কিন্তু যেটা তিনি আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গার থেকে করতেন তা অন্য কেউ করে উঠতে পারেনি। তিনি সেবা ধর্মে যে ভাবে বিনা বাছ বিচার করে সকল ধর্মের মানুষ কে সমান ভাবে দেখার কথা বলেছিলেন তা কোনো ধর্মগুরু আজ করে না। 

যারা আজ টেরেসার নামে কুৎসা করছে তারা কিন্তু টেরেসার প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাভাবনা, রোমান ক্যাথলিক চার্চের বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির সাথে দহরম মহরম দেখে ক্ষেপে যায়নি। তারা ক্ষেপেছে কারণ টেরেসা নিচু জাতের হিন্দু ও দলিতদের খ্রিষ্ট ধর্মে ব্যাপটাইজ করেছেন। টেরেসা একটি ধার্মিক সংস্থার পক্ষ থেকে কাজ করতে এসেছিলেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ড কখনোই ক্যাথলিক চার্চের গন্ডির বাইরে যেতে পারতো না। ধর্ম প্রচার করা ও ব্যাপটাইজ করা রোমান ক্যাথলিক চার্চের ইভাঞ্জেলিস্টদের প্রধান কাজ, টেরেসা ব্যতিক্রম ছিলেন না। আরএসএস পরিচালিত বনবাসী কল্যাণ নামক সংস্থাটিও নিত্য আদিবাসী জনগণ কে হিন্দু বানায়, তাও আবার অর্থের ভিত্তিতে দ্বিজ বা ব্রাক্ষণও হয় কেউ কেউ, যা হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে চরম ভেজাল কারবার। যাই হোক টেরেসা সব কিছুই চার্চের নির্দেশে করেছেন, রোমের নির্দেশে করেছেন, এবং তিনি এই সকল বুজরুকিতে এই জন্যে বিশ্বাস করতেন যে তিনি নিজে একজন ঘোর ক্যাথলিক ছিলেন, তাঁর গোঁড়া ধর্মবিশ্বাস তাঁর চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আর এর ফলে সে কোনোদিন ধর্মের গন্ডির বাইরে চিন্তা করতে পারেনি। 


আজ যখন টেরেসার এই সেন্ট উপাধি প্রাপ্তিতে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের উল্লাসিত হওয়ার সত্যিই কোনো কারণ নেই, তেমনি টেরেসা কে খিস্তি খেউর করে অপমান করার অধিকারও কারুর নেই, বিশেষ করে তাদের যারা কোনোদিনই কোনো কুষ্ঠ রোগী কে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেননি, যাদের কাছে কুষ্ঠ রোগ পূর্ব জন্মের পাপ, যারা কুষ্ঠ রোগীদের বাড়ির থেকে তাড়িয়ে দেয়। উঁচু জাতের বনেদি বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে কলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকা ভিখারি আর অনাহারে মরা মানুষগুলো আসলে কীট পতঙ্গের চেয়ে বেশি নয়। ওই অর্ধ নগ্ন লোকগুলোর শরীর থেকে যদি রক্ত আর পুঁজ গড়ায় তাহলে কে আর নিজেকে অশুদ্ধ করে সেই ঘা নিরাময় করার প্রচেষ্টা করবে? টেরেসার সিস্টার বাহিনী কিন্তু সেই কাজ করেছিল। 


গোটা দেশজুড়ে যে ভাবে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস এর চ্যালারা, মোদীর চ্যালারা, আজ মাদার টেরেসা কে গালাগাল করছে তাতে স্পষ্ট হচ্ছে এই ব্রাক্ষণত্ববাদী শ্বাপদদের দলের লোকেরা কত বেশি করে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, কত ঘৃণা এদের মধ্যে ভরা হয়েছে ভিন্ন ধর্ম ও জাতির লোকেদের সম্বন্ধে, কত ঘৃণার চোখে এরা সমস্ত নারীদের দেখে। টেরেসার নামে ঘৃণ্য আর অশ্লীল কটূক্তি পড়ে যে কেউই বুঝতে পারবেন যে কি পরিমানের বিষ আজ আরএসএস এই দেশে ঢালছে, কত বিষাক্ত হয়ে গেছে আপনার প্রতিবেশী ওই বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার যুবকের হৃদয়টা। কারণ ব্রাক্ষণত্ববাদ রন্ধে রন্ধে ছুটে চলেছে আর ব্রাক্ষণত্ববাদ সমাজে সকলকে নিজের থেকে নিচে থাকা স্তরের মানুষদের ঘৃণা করবে শেখায়, হত্যা করতে, ধর্ষণ করতে, শোষণ করতে শেখায়। মাদার টেরেসার নামে ব্রাক্ষণত্ববাদীরা ক্ষেপে উঠছে আর তাঁকে ধর্ম পরিবর্তনের সেপাই বলছে কারণ মাদার টেরেসা বা অন্যান্য খ্রিষ্টান নানেরা ভারতবর্ষে মূলত দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করেন ও এদের হিন্দু ধর্মের প্রভাব থেকে বের করে আনেন, জাতি শোষণের থেকে অল্পের জন্যে হলেও মুক্তি দেওয়ান। এর ফলে একদিকে যেমন আরএসএসের মতন সন্ত্রাসবাদী হিন্দু সংগঠনের দাঙ্গার স্বার্থে গড়ে তোলা ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজের তত্ব বিশ বাঁও জলে পড়ে যায়, ঠিক তেমনি দলিত, আদিবাসী ও নিচু জাতির হিন্দুরা ব্রাক্ষণত্ববাদের ভিত্তিতে সৃষ্টি করা জাতি ব্যবস্থার দমন পীড়ন মানতে নারাজ হন এবং মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সমান অধিকার দাবি করেন। যা আবার হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর পক্ষে ভয়াবহ। তাই তো বজরং দলের লোকেরা যখন উড়িষ্যার কন্ধমলে খ্রিষ্টান নানেদের ধর্ষণ করেছিল তখন তারা 'ভারত মাতার জয়' বলে স্লোগান দিয়ে প্রমাণ করেছিল যে নানেদের এরা কি পরিমান ঘৃণা করে এবং খ্রিষ্টানদের এরা ভারতবর্ষের বাইরের লোক হিসেবে গণ্য করে। 

মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে আর ওবামার কাছে ধমক খাওয়ার পরেও সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে, বজরং দল কে ব্যবহার করে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য। একের পর এক গির্জায় আক্রমণ করা হয়েছে, গির্জার পাদ্রী কে মারা হয়েছে, অল্টার এ হনুমান বসানো হয়েছে। এই সব কিছু হয়েছে দেশের জনগণের অন্তরে সুপ্ত ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা কে খ্রিষ্ট ধর্মের দিকে মুড়িয়ে।

সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে দেখবেন টেরেসা কে নিয়ে সেই সব সামন্ততান্ত্রিক ঔরসে জন্মানো লোকেদের কটু কথা যারা নিজের জীবনে টেরেসার কর্মকান্ডের, এমনকি সবচেয়ে মামুলি কর্মকান্ডেরও নখের যোগ্য হবে না। আর এই সব পড়ে হয়তো যে কোনো শুভ চেতনা সম্পন্ন মানুষ হয়তো ক্যাথলিক চার্চের পাদ্রীর মতন বলবেন যে পরম পিতা ঈশ্বর এদের ক্ষমা করুন। কিন্তু ক্ষমার চেয়ে বেশি আজ এদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, এদের শিরায় শিরায় ছুটে চলা ব্রাক্ষণত্ববাদের বিষ যেন আপনাকে স্পর্শ না করতে পারে, আরো মানুষকে যেন কোন ভাবেই বুদ্ধিভ্রষ্ট না করতে পারে তার জন্যে লড়তে হবে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে।
ভারতবর্ষে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ চালাবার জন্যে, ইভাঞ্জেলিস্ট কাজকর্মের জন্যে অনেক বিদেশী সংস্থা টাকা দেয়, কিন্তু তার চেয়ে বেশি বিদেশী লগ্নি বকলমে করা হয় মোদী কে ভোটে জেতাতে, মোদীর ব্যবসায়িক প্রকল্পে, মোদীর দ্বারা উদার করে দেওয়া প্রতিরক্ষা, রেল, বীমা, সহ অন্যান্য শিল্পে। সেই সময়ে বিদেশী পুঁজির বলে বলীয়ান হয়ে চলা কর্পোরেট সংস্থার থেকে বেতন নিয়ে যে সব পাকা ব্রাক্ষণত্ববাদী লোকেরা বারে বসে ব্ল্যাক ডগ খায় আর সপ্তাহান্তে পরিবারকে নিয়ে বিদেশী পুঁজিতে চলা কম্পানির মাল্টিপ্লেক্সে বিদেশী পুঁজির লগ্নিতে বানানো সিনেমা দেখে মার্কিন দেশের পুঁজিতে চলা কোম্পানির ঠান্ডা পানীয় গিলতে গিলতে, তখন তাদের হিন্দুত্বের উপর গর্ববোধ হয়তো শৌচালয়ে যায়। 


এই লড়াইতে যোগদান করার আগে আজ গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকে আজ নিজেদের ও সংঘ পরিবারের লোকেদের মধ্যে মাদার টেরেসা নিয়ে একটা বিভেদ রেখা স্পষ্ট করতে হবে। আমরা যে কোনো মূল্যেই মাদার টেরেসার ধর্মীয় কুপমুণ্ডুকতা, কুসংস্কার, বুজরুকি, ও অবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাভাবনার নির্মম সমালোচনা করবো, আমরা নিশ্চয় দেখাবো যে কি ভাবে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির মতন সংস্থাগুলো আসলে দেশের মানুষের মধ্যে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ঘৃণা কে ডান খয়রাতের মাধ্যমে নির্মূল করার চেষ্টা করে এই মানুষদের বিপ্লবী আন্দোলনের পথ থেকে সরিয়ে আনে। কিন্তু আমরা কোনো ভাবেই সংঘ পরিবারের সংখ্যালঘু বিরোধী, খ্রিষ্টান ও ক্যাথলিক বিরোধী ফাঁদে পা দেব না, কোনো ভাবেই একজন নারীর নামে ঘৃণ্য অপবাদ শুনবো না। আমাদের কলমে, কিবোর্ডে, আর মুষ্টিবদ্ধ হাতের আঘাতে চূর্ণ চূর্ণ করতে হবে শাসক শ্রেণীর গেরুয়া বসন পরিহিত দালালদের।

প্রভু না হলে আমাদের ক্ষমা করবেন না যে।

#WorkersStrikeBack ২ সেপ্টেম্বরের দেশব্যাপী ধর্মঘটে সামিল হলেন ১৮ কোটি শ্রমজীবী জনতা

শনিবার, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

সারা দেশ জুড়ে ১৮ কোটি শ্রমজীবি মানুষ ও কর্মচারী বৃন্দ ধর্মঘটে যোগ দিলেন ২রা সেপ্টেম্বর

নরেন্দ্র মোদী যখন ভোটে জিতেছিল ২০১৪ সালে, তখন সারা দেশ ও বিদেশ জুড়ে কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম ব্যাপক প্রচার করেছিল যে ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা ও ভরসার প্রতিফলন নাকি ভোটের বাক্সে হয়েছে আর তার ফলে ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪ সালে ৮১ কোটি ৪৫ লক্ষ ভোটারের মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ৫৪ কোটি ৬৬ লক্ষ মানুষ এবং এই সংখ্যার ৩১ শতাংশ মানুষ, অর্থাৎ ১৬ কোটি ৭৬ লক্ষ মানুষ মোদী কে (বিজেপি কে) ভোট দেন। সেই ১৬ কোটি ৭৬ লক্ষ মানুষের ভোটে জিতে মোদী শুরু করে কর্পোরেট পদ লেহন। দেশ জুড়ে বিলগ্নিকরণ আর উদারীকরণের মনমোহন সিংহের তৈরি ব্যবস্থা কে আরও বলিষ্ঠ করে নরেন্দ্র মোদী। শ্রমিক বিরোধী, কৃষক বিরোধী এবং জনতা বিরোধী একের পর এক নীতি প্রয়োগ করা শুরু করে আরএসএস এর নেতৃত্বে চলা ভারত সরকার। আর এই সরকারের বিরুদ্ধে, এই ১৬ কোটির সরকারের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে ১৮ কোটি শ্রমজীবি মানুষ ও কর্মচারী বৃন্দ ধর্মঘটে যোগ দিলেন ২রা সেপ্টেম্বর। নরেন্দ্র মোদী সরকারের শ্রমিক মারা নীতির বিরুদ্ধে, ব্যাপক হারে দেশের সম্পদ বিদেশী পুঁজির কাছে লগ্নির নামে বিক্রি করে দেওয়ার বিরুদ্ধে, কর্পোরেট ফ্যাসিবাদ কে প্রশ্রয় দিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে, ব্যাপক হারে বেড়ে চলা ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করে ব্যাপক শোষণ করার বিরুদ্ধে এবং বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাযুজ্য রেখে সমগ্র দেশে শ্রমজীবি জনতার ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি করার দাবিতে এই ধর্মঘট ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের ডাকে অনুষ্ঠিত হয় গত বছর এই একই দিনে এই দাবিগুলিতে ধর্মঘট হয়েছিল এবং তৎকালীন ধর্মঘটের সময়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি কথা দিয়েছিল যে শ্রমিকদের দাবি খতিয়ে দেখা হবে। অথচ এক বছর ঘুরেও শ্রমিকেরা সেই একই তিমিরে রইলেন, মাঝখান থেকে মোদী সরকার শ্রমিক অধিকার হননের পথ থেকে না সরে বিপুল স্পর্ধা নিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে খারিজ করে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সম্মিলিত আন্দোলন শুরু হতেই মোদীর চামচারা আলোচনার কথা বলে, আর সেই আলোচনার নামে নাটক চলে গোটা আগস্ট মাস জুড়ে।শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘটের পথে যেতে হয়। আর শাসকশ্রেণীর যাবতীয় চোখ রাঙানি আর ধমকানো কে অগ্রাহ্য করে, চরম উপেক্ষা করে সারা দেশের শ্রমজীবি মানুষ এই ধর্মঘটে সামিল হয়েছেন। এই একদিনে ভারতের কর্পোরেট রাঘব বোয়ালরা একদিনে ১৮ লক্ষ কোটি টাকার লোকসান দেখলো শ্রমিকদের সম্মিলিত ও সংহতিমূলক সংগ্রামের ফলে।  

  নামক হ্যাশট্যাগ দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের খবর আজ প্রতিটি শহরের শ্রমিকদের কাছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কর্মচারীদের কাছে পৌঁছে গেছে, দেশের প্রতিটা কোনের সংগ্রামী শ্রমিকদের লড়াইয়ের খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং দেশ বিদেশের কোনে কোনে পৌঁছে গেছে। এই লড়াইয়ে ব্রাক্ষণত্ববাদী আরএসএস এর শ্রমিক সংগঠন বিএমএস গত বারের মতন এবারও বেইমানি করে শ্রমিক আন্দোলনের পিঠে ছুরি মারার জন্যে ধর্মঘট ভাঙ্গার কাজে নেমেছে। দিল্লি শহরের পরিবহন ও অন্যান্য শিল্পে মালিকশ্রেণীর দালাল হিসেবে কাজ করা বিএমএস সংগঠনের নেতাদের উপর ভর করে ২রা সেপ্টেম্বর অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও নরেন্দ্র মোদীর সরকার যৌথ ভাবে শ্রমিক ধর্মঘটের বিরোধিতা করতে নামে। বিএমএস সরকারি ভাবে একটি প্রতিপত্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন হয় সত্বেও এই ধর্মঘট কে রুখতে বিশেষ কিছু করে উঠতে অপারগ হয় কারণ ব্যাপক হারে শ্রমিকদের, এমনকি বিএমএস সমর্থক শ্রমিকদের মধ্যেও এই ধর্মঘটের প্রতি বিপুল সমর্থন ছিল। যে সমর্থনের বাতাস কে হিন্দুত্ববাদী ঘৃণার বাতাস দিয়ে দাবিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সংঘ পরিবারের তথাকথিত শ্রমিক নেতা সেজে থাকা বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও দেশী মুৎসুদ্দিদের পা চাটা শ্বাপদের দল। 

কলকাতায় মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজের শ্রমিক বিরোধী ভাবমূর্তি ও কর্পোরেট বান্ধব ছবি রক্ষা করার স্বার্থে ধর্মঘট ভাঙতে পথে নামিয়েছিল নিজের গুন্ডা ও পুলিশ বাহিনী। ব্যারাকপুর, দুর্গাপুর, আসানসোল, সহ বিভিন্ন প্রান্তে শাসক দলের আক্রমণের মুখে পড়েছেন আন্দোলনরত শ্রমিকেরা। শ্রমিক আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরে মালিক শ্রেণীর দালালি করে বিধায়ক হওয়া ব্রাক্ষণত্ববাদী শোভনদেব চাটুজ্যে খোলাখুলি শ্রমিক মারতে রাস্তায় নামিয়েছিল নিজের নেড়িদের। কলকাতা শহরে ও শহরতলীতে শ্রমিকদের ও কর্মচারীদের উপর জবরদস্তি করে ধর্মঘট ভাঙ্গার খেলায় নেমে মমতা দেশের কর্পোরেট মিডিয়ার ভীষণ পছন্দের নেত্রী হয়ে উঠেছে। পথে পথে পুলিশ কে ঢাল করে তৃণমূলী গুন্ডারা যে ভাবে ধর্মঘটী শ্রমিকদের আর কর্মচারীদের আক্রমণ করেছে, দলীয় লোকেদের আর পুলিশকে দিয়ে বাস আর ট্রাম চালিয়ে যে ভাবে মমতা প্রচার মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে কর্পোরেট বান্ধব সরকারের নেত্রী হিসেবে উঠে আসার চেষ্টা করেছে তা অতি ঘৃণ্য দক্ষিণপন্থী দেউলিয়াপনার একটা নিদর্শন।  

২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটের সবচেয়ে ভালো প্রভাব পড়েছিল দক্ষিণের অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক ও কেরলে, উত্তরের নয়ডা ও হরিয়ানার শিল্পাঞ্চলে  এবং অন্যান্য জায়গায়।শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ ও সংহতিমূলক সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কিত হয় মোদীর মনিব আম্বানি-আদানি সহ বিদেশী বৃহৎ পুঁজির মালিকেরা। তাদের নির্দেশে সমস্ত কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, হয় বারবার প্রচার করেছে যে  ধর্মঘট ব্যর্থ, না হয় একেবারে ব্ল্যাকআউট করে দিয়েছিল ধর্মঘটের নানা প্রান্তের লড়াইয়ের খবর, নানা প্রান্তের বিজয়ের খবর । এই প্রচারের বিশেষ নির্দেশ এসেছিল হোয়াইট হাউস থেকে, ওয়াল স্ট্রিট থেকে, যাতে ভারতের কর্পোরেট প্রেমী উচ্চ জাতির মধ্যবিত্তদের বোঝানো যায় যে শ্রমিক ধর্মঘট ব্যর্থ হয়েছে এবং এর ফলে গরিব মানুষের মনেও একটা হতাশা সৃষ্টি করা যায়।  

কর্পোরেট মিডিয়ার ব্ল্যাকআউট সত্বেও ২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটের প্রভাব সারা দেশে কম বেশি পড়েছে এবং কর্পোরেট দুনিয়ার ব্যাপক আর্থিক লোকসান হয়েছে। তবুও এ সম্ভাবনা ক্ষীণ যে মোদী সরকার এই বাৎসরিক প্রতীকী সংগ্রামে ভীত হয়ে শ্রমিক বিরোধী নীতি প্রণয়ন করা বন্ধ করবে। কারণ মোদী সরকার ভারতের বনিয়া ও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর স্বার্থ রক্ষা করার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশী ও বিদেশী কর্পোরেটদের সৌজন্যে পাওয়া প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা খরচা করে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসেছে, এবং ২০১৯ এর মধ্যেই এই সরকার যেনতেন প্রকারে দেশের সম্পদ বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির কাছে বিক্রি করতে বদ্ধপরিকর। আর এই দেশ বিক্রি করার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ কে দমন করতে মোদীর সাথে হাত মিলিয়ে চলতে পিছপা হবে না মমতা-জয়াললিথা-কেজরিওয়াল বা কংগ্রেস। এদের রং আর ঢং আলাদা হলেও খোলের ভিতরে শাঁসটা একই। এই সমস্ত শাসক দলের টিকিটা কোনো না কোনো ভাবে বাঁধা আছে ওয়াল স্ট্রিটের বড় বড় দফতরে। তাই যেমন মমতা মুখে শ্রমিক-কৃষক দরদ দেখাতে পারে, সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম নিয়ে আবেগপ্রবণ ভাষণ দিতে পারে, মুখে বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করতে পারে, তেমনি কাজে সে চিরকাল বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে উদারীকরণ আর বিলগ্নিকরণের বিরোধিতা করতে পারে না বরং আড়াল থেকে সমর্থন জুগিয়ে চলে। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত মমতার দল কংগ্রেসের মন্ত্রিসভায় ছিল আর বামপন্থী স্লোগানের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখলেও, তলে তলে মনমোহন সরকারের সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে সমর্থন করে এসেছিল মমতা বন্দোপাধ্যায়। তেমনি কেজরিওয়াল থেকে জয়াললিথা, মুখে মোদী সরকারের কর্পোরেট প্রীতির বিরোধিতা করলেও আদতে সেই নীতির প্রণয়ন করে চলেছে নিজেদের রাজত্বে।        

নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রধান শত্রু হলো শ্রমিক শ্রেণী। এই আর্থিক নীতির প্রবক্তারা চায় শ্রমিক শ্রেণীর পিঠের মাজা ভেঙে দিয়ে তাঁদের চরম শোষণ করে লাভের পাহাড় উঁচু করতে। তাই শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়া বা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সহ যে কোনো সংগ্রামে সামিল হওয়ার থেকে বিরত করতে শাসকশ্রেণীর কলমপেশা দালালেরা একের পর এক ঘৃণ্য শ্রমিক বিরোধী পরিকল্পনা করে চলেছে। ভারতবর্ষে আজকের দিনে শ্রম আইন সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালের চেয়েও বেশি নির্লজ্জ্ব ভাবে মালিকশ্রেণীর, বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করছে। ঔপনিবেশিক কালেও শ্রমিকদের যে ন্যূনতম অধিকারগুলি ছিল তা আজ মোদী সরকার কেড়ে নিচ্ছে।আর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে আজ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় বলিষ্ঠ ভাবে প্রসারিত করা হচ্ছে সারা দেশে যাতে শ্রমিক শ্রেণীর আর কৃষকের সংগ্রামী ঐক্যে ভাঙ্গন ধরানো যায় এবং এর মাধ্যমে এক নগ্ন দাস-মালিক ব্যবস্থার পত্তন করানো যায়।  সারা দেশে আজ হিন্দুত্ববাদ আর ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে খেটে খাওয়া জনগণ কে, বিশেষ করে দলিত ও আদিবাসী জনগণকে, যারা দেশের খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির মালিকানাধীন বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার থেকে বিরত করে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে।হিন্দুত্ববাদীদের নব উথ্বানের কারণ ছিল নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির আগমন আর এই ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনকে রুখতে আজ বেশি করে দরকার হলো ২রা সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটের মতন শ্রমিক শ্রেণীর সংঘবদ্ধ এবং বিভিন্ন শিল্প জুড়ে এক অভিনব সংহতিমূলক লড়াইয়ের। পরিবহন শ্রমিকের লড়াইতে সাথে থাকতে হবে ইস্পাত শিল্পের শ্রমিকদের, ক্ষেত মজুরদের সংগ্রামে রুখে দাঁড়াতে হবে কয়লাখনির শ্রমিকদের, ঠিক শ্রমিকদের আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে স্থায়ী শ্রমিকদের। এই সংহতির মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা সম্ভব শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপক ঐক্য, লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই শ্রমিক শ্রেণীর চেতনা তীক্ষ হয় আর জাগ্রত হয় শ্রেণী ঐক্যের অনুভূতি।

মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন কে রুখতে তাই আজ সারা দেশের শ্রমিক শ্রেণী কে এগিয়ে আসতে হবে এক ব্যাপক গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগ্রামে আর এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব সিপিএম মার্কা সুবিধাবাদের পাঁকে ডোবা শাসক শ্রেণীর লাল চোলা পড়া দালালদের হাতে থাকলে শ্রমিক শ্রেণীর কোনো লাভ হবে না। তাই প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বিপ্লবী শক্তিকে আজ এগিয়ে এসে এই লড়াই কে গড়ে তুলতে হবে, টাকা আনা পাইয়ের জন্যে নয়, ভোটে সিট্ বৃদ্ধির জন্যে নয়, বরং গোটা দেশ জুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর ইজ্জ্বত প্রতিষ্ঠার জন্যে, শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্যে, শ্রমিক আর কৃষকের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্যে। এই লড়াই যদি আজ সমগ্র দেশে গড়ে উঠতে না পারে, এই লড়াইতে যদি দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু সমাজ-নিপীড়িত জনজাতির মানুষ কে এক সুঁতোয় না বাঁধা যায়, তাহলে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করার চিন্তা শুধু কেতাবি কথা হিসেবে থেকে যাবে আর দেশ জুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর উপর আক্রমণ থামবে না। পাঠক মনে রাখবেন, শ্রমিক শ্রেণী হলো বিপ্লবের নেতা শ্রেণী এবং অন্য সমস্ত শ্রেণী কে শোষণের থেকে মুক্ত না করে সে নিজেকে যেমন মুক্ত করতে পারে না, ঠিক তেমনি তাঁর উপর নেমে আসা আক্রমণ কে যদি প্রতিহত না করা যায়, তাহলে শ্রমিকের পরে সেই আক্রমণ তীব্র হবে কৃষকদের উপর, তার পরে আরও তীব্র হবে আপনাদের মতন বুদ্ধিজীবী আর ছাত্র-যুবদের উপর।  আর এই কথা লেখার জন্যে আমাকে কোনো ভাবেই ভবিষ্যৎ বাণী করতে হচ্ছে না, কারণ গত ২৬ বছর ধরে যে হারে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দৌলতে সারা দেশ জুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর উপর আক্রমণ হয়েছে, প্রতিরোধের অভাবে প্রথমে কৃষকদের উপর এবং পরে ছাত্র ও যুবদের উপর তারই পুনরাবৃত্তি আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। আজ সময় এসেছে জেগে ওঠার, গর্জে ওঠার, দাসত্বের বাঁধন ভাঙ্গার লড়াই করার - আর এই লড়াইতে আঁতলামি নয়, চাই হিম্মত আর স্পর্ধা। লড়াই করার হিম্মত আর বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত যুদ্ধ ক্ষেত্রে টিকে থাকার স্পর্ধা। কারণ শেষ বিচারে সত্যিই শ্রমিক শ্রেণীর আজকের দিনে হারাবার আর কিছু নেই, জেতার জন্যে আছে সারা বিশ্ব।       

     

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে