CAA NRC এবং DAMAL নিয়ে প্রসেনজিৎ বসুর সাম্প্রতিক লেখার জবাবে

বুধবার, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০ 0 Comments A+ a-



প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মাননীয় প্রসেনজিৎ বসু গতকাল "'দামাল' না বিজেপি-র 'দালাল?" শিরোনামে তাঁর ফেসবুক পেজে একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধটিতে তিনি তার স্বভাব সুলভ মেধার পরিচয় দিয়েছেন, যার বস্তুবাদিতা দেখলে কার্ল মার্কস নিজের সমস্ত দাড়ি ছিঁড়ে ফেলবেন এবং যুক্তি কাঠামো দেখে এরিস্টটল দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরবেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে অপ্রাসঙ্গিক অযৌক্তিক প্রবন্ধ লেখার ক্ষমতা খুব কম প্রতিভাবানেরই থাকে। আমি এখানে মাননীয়  প্রসেনজিৎ বসুর প্রত্যেকটা ছত্র তুলে আলোচনা করলাম। একলাইনও বাদ দেইনি। ফলত প্রবন্ধটি দীর্ঘ হবে।

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ 

"২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি বারবার বলেছে যে আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করে হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, তারপর এনআরসি করে "ঘুসপেটিয়া"-দের দেশ থেকে বার করে দেওয়া হবে। অমিত শাহ গোটা দেশকেই এই ক্রনোলজি বুঝিয়েছিল (নিচের ভিডিওটি দেখুন):
দিলীপ ঘোষ আরও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল যে পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি "মুসলিম ঘুসপেটিয়া" আছে, গোটা ভারতে ২ কোটি। তাদের জন্যেই এনআরসি (নিচের ভিডিওটি দেখুন):"

(ঘুসপেটিয়ার বানান মূল লেখায় "ঘুষপেটিয়া" থাকায় তা বদলানো হল - সম্পাদক, বিশ্লেষক)



আমাদের কথাঃ
প্রসেনজিৎ বসু একেবারে লিংক খুজে দিয়েছেন কষ্ট করে। যেখান থেকে তিনি বিজেপি নেতা মন্ত্রীদের কোট করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি  প্রক্রিয়ায় মধ্যে দিয়ে মুসলমানদের তাড়ানো হবে এবং তার আগে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯, বা সিএএ ২০১৯ এর মধ্যে দিয়ে হিন্দুদের নাগরিকত্ব সুরক্ষিত করা হবে।

আমরা জানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং আইনমন্ত্রী রবি শঙ্কর প্রসাদ বলেছেন জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী বা এনপিআর-র সাথে এনআরসি-র কোনো সম্পর্ক নেই। বিরোধীরা নাকি ভুল বুঝিয়েছেন।
প্রসেনজিৎ বসু কি এই দুই মন্ত্রীর মুখের কথায় বিশ্বাস করেছেন? করে থাকলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এনপিআর রুখতে রিলে অনশনের মত মারাত্মক চাপ সৃষ্টিকারি কর্মসূচি কেন নিয়েছিলেন লকডাউনের আগে?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন দেশে কোনো ডিটেনশন ক্যাম্প নেই
প্রসেনজিৎ বসুরা কি তাদের লিফলেট থেকে আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে বন্দিদের মুক্ত করার দাবি সরিয়ে নেবেন? কারণ ভারতের "গণতন্ত্রে" সর্বোচ্চ পদে আসিন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ভারতে ডিটেনশন ক্যাম্পই নেই, তাহলে কার মুক্তি চাইছেন প্রসেনজিৎ বসুরা?

সম্ভবত  মোদিজীর প্রতিশ্রুতি দেওয়া ১৫ লাখ টাকাটি একমাত্র প্রসেনজিৎ বসুই পেয়েছেন। আর বাৎসরিক দুই কোটি প্রতিশ্রুত চাকরির মধ্যে বিজেপির দেওয়া চাকরিটি বসু বাবুই পেয়েছেন।  তাই বিজেপি নেতা মন্ত্রীদের মুখের কথায় এত বিশ্বাস। প্রসেনজিৎ বসু এরপর হয়তো বিজেপি নেতাদের কথা শুনে গরুর দুধে সোনা খুজে দেশের অর্থনীতি শোধরাবার পরামর্শ দেবেন বা বিজেপি নেতাদের কথা মত জ্যোতিষকে বৈজ্ঞানিক ব্যাপার ঠাউরে কোমরে তাবিচ বেধে সিপিএম ডোবার কালে রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষনে নেমেছিলেন। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ও যিনি গর্বিত সিপিএম।

মুখের কথা আর জল্পনা দিয়ে নয়, প্রামাণ্য নথিপত্রের উপর আন্দোলন হয় জানতাম। প্রসেনজিৎ বাবুরা নতুন পথ দেখাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু আমরা পুরানো পথে, অর্থাৎ প্রামাণ্য নথির উপর ভিত্তি করে বলবো যে এনআরসি-তে হিন্দু মুসলিম সবাই বাদ যাবে, সিএএ ২০১৯ কাউকেই বাঁচাবে না। হিন্দুকে রাখবে, মুসলিমকে তাড়াবে–এই প্রচার হিন্দুদের আন্দোলন থেকে নির্লিপ্ত করেছে এবং আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে বিজেপির হাত শক্ত করেছে।

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

"দেশের ধর্মনিরপেক্ষ জনগণ সিএএ-২০১৯-এর বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তায় নামে, নেতৃত্ব দেন মুসলিম মহিলারা। গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে টানা এই বছরের মার্চ মাস অবধি এই গণ-আন্দোলন চলে। দেশের অনেক শহরেই শান্তিপূর্ণ ধর্না এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি চলেছিল লকডাঊন হওয়া পর্যন্ত।"

প্রসেনজিৎ বসুর আর এক পালোয়ান  সেনাপতি অনির্বাণ তলাপাত্র ২৪ অগাস্ট দলিত আদিবাসী মাইনোরিটি আন্দোলন লীগ (দামাল) এর বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন "এটাও মনে রাখা দরকার যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ এবং NRC-NPR-এর বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালত Supreme Court-এ ১৫০টির বেশি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা করা হয়েছে Joint Forum against NRC - নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্ত মঞ্চ-র পক্ষ থেকে। এই মামলাগুলির ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবেই এই CAA ২০১৯ আইনটিকে বলবৎ করা যাবে না। এই মামলাগুলির শুনানিও এখনো শুরু হয় নি। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই আইনের আওতায় এখুনি কাউকে নাগরিকত্ব দিতে পারবে না। এইটাইতো NRC-NPR-CAA বিরোধী আন্দোলনের সবথেকে বড় সাফল্য এখনো অবধি।"

আমাদের কথাঃ

বসুবাবু আলাদা করে "শান্তিপূর্ণ" আন্দোলনের কথা বলেছেন। "অশান্তিপূর্ণ" আন্দোলনগুলো কে তিনি ধারণ করছেন না? আলাদা করে শান্তি পূর্ণ লেখার প্রয়োজন কেন হলো? শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের তাগিদ সরকারপক্ষের নাকি বিরোধী পক্ষের?

হয় প্রসেনজিৎ বসুরা ইচ্ছাকরে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন অথবা বুঝতে ভুল করেছেন যে সারা দেশ জুড়ে যে আন্দোলন হয়েছিলা, যে আন্দালনে মুসলিম মহিলারা সামনের সারিতে ছিলেন এবং মুসলিম এলাকা গুলোতেই বড় বড় অবস্থান গুলো হয়েছিলো… সেই আন্দোলন উদ্বাস্তদের নাগরিকত্ব পাওয়া আটকাবার জন্য হয়নি। আন্দোলন হয়েছিলো নাগরিকত্ব হারানো আটকানোর জন্য। বেনাগরিক হওয়া থেকে আত্মরক্ষা করা ছিলো এই আন্দোলনের এসেন্স, জাতীয় পতাকা, সংবিধান রক্ষা এই গুলো ছিলো এপিয়ারেন্স। 

২০০৩ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, বা সিএএ ২০০৩ পাস হওয়ার সময় থেকে নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুরা যে আন্দোলন করে এসেছেন বা নাগরিকত্বের নামে হয়রানির বিরুদ্ধে মতুয়া ও অন্যান্য নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুরা যে আন্দোলন করে এসেছেন, সেই আন্দালনে উচ্চবর্ণ এলিটদের পাওয়া যায়নি। বরং প্রসেনজিৎ বসুর তৎকালীন পার্টি সিপিএম  এই আইনটির বিরুদ্ধে আন্দোলন ধর্মঘট দূরে থাক একটা মানব বন্ধনও করেনি। এখনও যেমন নাগরিকত্বের নামে ক্রমাগত হয়রানি, আত্নহত্যা,অপমানের শিকার নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের নিয়ে এদের কোনো সংবেদনশীলতা  দেখা যাচ্ছ না।
 
অথচ সিএএ ২০০৩ প্রণয়ন হওয়ার পর থেকেই নাগরিকত্ব পাওয়া এবং হয়রানি বন্ধের জন্য নতুন আইন আনার দাবির আন্দালনে নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের পাশে থেকেছে মুসলিম সংগঠন গুলো। ফলে আজ মুসলিম ধর্মালম্বী নেতারা "NO CAA" স্লোগানটা কেন ভুল, কেন উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের ন্যায্য দাবীকে সমর্থন জানিয়ে, বিজেপির সিএএ ২০১৯ যে একটি ভাঁওতা সেটাকে এক্সপোজ করে, এনআরসি-তে হিন্দু-মুসলিম সবাই বাদ যাবে এটা বুঝিয়েই বিজেপির কোমর ভেঙে দেওয়া যাবে সেটা বুঝেছেন। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম নেতাদের বিবেক বুদ্ধি বসু বাবুর থেকে বেশী এটা মেনে নেওয়া কষ্টের বইকি।

সিএএ ২০১৯-এর মধ্যে দিয়ে ৩১,৩১৩ জনের বাইরে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব নয়, রুলস বের করলেই সেটা "দুধ কা দুধ, পানি কা পানি" হয়ে যাবে। তাই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের আগে কোনো ভাবেই বিজেপি রুল বের করবেনা।  তাই দামাল সেই শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জ করে আসছিল যে বিজেপির ভোটের আগে রুলস প্রকাশ করে দেখাক! হলও তাই, অমিত শাহ দুই বার রুল বের করার সময়সীমা মিস করলো। আনন্দবাজার পত্রিকা ফ্রন্ট পেজে লিখলো পূজোর আগেই নাকি নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, পূজো পেরিয়ে গেল। এবার অমিত শাহ  বাংলা সফরে এসে সিএএ এর নাম উচ্চারণ করলোনা। বিজেপির মতুয়া ভিত্তিতে ভাঙন ধরলো। বিজেপি বুঝলো করোনার দোহাই দিয়ে আর মতুয়া ক্ষোভ ঠেকানো যাবে না। 

এবার বিজেপির ত্রাতার ভূমিকায় হাজির হয়ে যুক্তি সরবরাহ করলো প্রসেনজিৎ বাবুরা। কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বললেন যে বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টে কেস করেছে, সুপ্রিম কোর্ট এই কেসের ফয়েসলা করলে তবে জানুয়ারীতে সিএএ ২০১৯ লাগু করে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে (পরে অমিত শাহ বললেন যে করোনা ভাইরাসের টিকা প্রদান করার পরে রুলস বের হবে-সম্পাদক, বিশ্লেষক), যদিও প্রসেনজিৎ বাবু এবং কৈলাশ বিজয়বর্গীয় জানেন যে সুপ্রিম কোর্ট সিএএ ২০১৯ এর উপর কোনো স্টে অর্ডার দেয়নি। ফলে সুপ্রিম কোর্ট এর রায়ের জন্য বা বিরোধীদের জন্য রুলস প্রকাশ আটকে আছে এমনটা নয়। কৈলাশ বিজয়বর্গীয় না হয় মতুয়াদের প্রতারিত করছে, প্রশ্ন হল প্রসেনজিৎ বসুরা কাকে প্রতারিত করছে, জনতাকে নাকি নিজেদের?

"NO CAA"-এর ভুল স্লোগানের জন্য নাগরিকত্ব রক্ষার লড়াইয়ে অনবদ্য লড়াইটা ছোটো হয়ে যায়না। এই লড়াইয়ের যা ভাল, যা গৌরবময়, তার  কৃতিত্ব জনতার, আর ভুলটুকুর দায় অবশ্যই প্রসেনজিৎ বসুর বা অন্যান্য এলিট বুদ্ধিজীবীদের নিতে হবে। এদের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা ভুল স্লোগানের জন্য আন্দোলনটি মুসলিম জনতা আর বিরোধী একটিভিস্টদের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আর হিন্দুদের হয় বিজেপির দিকে ঠেলেছে নয়তো নিস্ক্রিয় করে দিয়েছে। 

এখন আত্মসমালোচনা করে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে যখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্য তৈরি করে এটাকে মুসলিম ইস্যুর বদলে খেটে দেশের নিপীড়িত শোষিত মানুষের সংগ্রামে পরিণত করার সুযোগ এসেছে তখন বসু বাবুরা ক্ষেপে উঠেছে, ভুল শুধরে এগুবেন না! ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদ বড় বালাই!  

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেন:

"নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এবং কলকাতার জনগণনা ভবনে স্মারকলিপি দিয়ে এনপিআর বন্ধ করার দাবিতে ১২ই মার্চ থেকে কলকাতার রাজাবাজার ধর্নামঞ্চে রিলে-অনশনও শুরু করে। কিন্তু ২৪শে মার্চ থেকে দেশজুড়ে করোনাভাইরাস জনিত লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়।  

কেরালা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ এবং তেলেঙ্গানার মতন বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভায় সিএএ-২০১৯ বিরোধী প্রস্তাব পাশ হয়। শুধু দেশের ভিতরে নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয়রা এই আন্দোলনের সমর্থনে সোচ্চার হয়। জাতিসংঘের UNHCR-ও এনআরসি এবং সিএএ ২০১৯-র বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। "

আমাদের বক্তব্যঃ

প্রসেনজিৎ বাবুরা খুবই বুদ্ধিমান, তারা ডেপুটেশন আর রিলে অনশন করে রাজ্য সরকারকে চাপে ফেলার কর্মসূচী নিয়ে কেন্দ্রের এনপিআর  কর্মসূচী আটকাবার পরিকল্পনা করেছিলেন। সত্যিটা হল নাগরিকত্ব একান্তভাবেই কেন্দ্র তালিকাভুক্ত বিষয়। ভারতের সংবিধানের ২৫৬, ২৫৭(১) ধারা অনুযায়ী রাজ্য সরকার কখনোই কেন্দ্রের আইনের বা কর্মসূচীর বিরোধতা করতে পারেনা। এমনকি কেন্দ্রের কর্মসূচী চাকরের মত রাজ্য সরকার মানতে বাধ্য। 

নাগরিকত্ব রাজ্যের এক্তিয়ার বহির্ভূত বিষয়। দেশে কোনো রাজ্য সরকারের এনআরসি-সিএএ মানবো না বললে তার কোনো সাংবিধানিক কাঠামোগত গুরুত্ব নেই। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে জনতার সমবেত প্রতিরোধ সংগ্রাম একমাত্র এনআরসি-এনপিআর আটকাতে পারে। এনআরসি-র উৎস সিএএ ২০০৩-এর পক্ষে ভোট দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো পরিচালিত রাজ্য সরকার গুলো সিএএ ২০১৯-এর বিরুদ্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সিএএ ২০০৩ কে চাপা দিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাবার জন্য এমন করেছে। 
কিন্তু জেনে বুঝে প্রসেনজিৎ বসুরা কেন এমন কথা লিখছে? সংশোধনবাদ থেকে আইনবাদ, আইনবাদ থেকে প্রতারণা, এর পর কোথায় পৌছবেন দেখতে হবে।

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ব্যতীত মুষ্টিমেয় কিছু সংগঠন অবশ্য সিএএ-২০১৯-এর পক্ষে দাঁড়ায় - সারা ভারত মতুয়া মহাসংঘ এবং তাদের সহযোগী কিছু "উদ্বাস্তু" সংগঠন। এরাই প্রশ্ন তুলেছিল সিএএ-২০১৯-এর মাধ্যমে যদি "হিন্দু" উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যায়, তাহলে "মুসলমানদের" আপত্তি করার কি আছে?

এর উত্তরগুলি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বারবার দেওয়া হয়েছেঃ

১। সিএএ-২০১৯ ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য এনে নাগরিকত্ব প্রদান করার কথা বলছে। শুধু মুসলমানরাই নয়, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে আস্থা রাখা সকল নাগরিকই এর বিরুদ্ধে, কারণ এটা সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ ধারার পরিপন্থী।

২। যদি সমস্ত উদ্বাস্তুদের স্বার্থে এই আইন হত তাহলে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা করে নাম নেওয়ার কি দরকার ছিল, সমস্ত ধরণের উদ্বাস্তুদের জন্য একরকম আইন বানানো হল না কেন? শুধু বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফঘানিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য আলাদা আইন কেন? শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার বা চিন থেকে আসা উদ্বাস্তুদের এই আইনের আওতায় আনা হল না কেন?
এর কোন প্রত্যুত্তর বিজেপি বা মতুয়া মহাসংঘ দিতে পারেনি। বরং এখন তারা "দামাল" বলে একটি সংগঠনকে খাড়া করেছে তাদের হয়ে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনকে আক্রমণ করতে।

আমাদের কথাঃ

প্রসেনজিৎ বসুরা কিন্তু একবারও এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না যে কেন মতুয়া বা উদ্বাস্তু সংগঠনগুলো সিএএ কে সমর্থন জানাচ্ছে? কেন তারা নাগরিকত্ব চাইছে? কোথায় তাদের সমস্যা? এদের সমস্যা সমাধানে প্রসেনজিৎ বাবুদের বিকল্প প্রস্তাবই বা কী? নাকি নাগরিকত্বের নামে হয়রানির শিকার হলে মতুয়ারা বলবে প্রসেনজিৎ বাবুরা বলেছেন আমরা নাগরিক, তাই আমাদের হয়রানি করা যাবেনা! নমঃশূদ্রদের সমস্যার প্রতি এই অসংবেদনশীলতা বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় ছাড়া আর কী?

ধর্মনিরপেক্ষ দেশে আইনে ধর্মের নাম লেখা উচিৎ নয়, রেজিস্টার্ড রিফিউজিদের মধ্যে একজনও মুসলিম থাকলে সে নাগরিকত্ব না পেলে এটা বৈষম্য। এই কারণে আমরা অবশ্যই সিএএ ২০১৯-এর মতাদর্শগত বিরোধিতা করি। কিন্তু এই আইন রেজিস্টার্ড রিফিউজি বাদ দিয়ে বাকি বেনাগরিক হতে চলা মানুষের উপর বৈষম্য করছে না। 

এনআরসি-তে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই বাদ যাবে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব আর এনআরসি-র সাথে সিএএ-কে জুড়ে প্রচার করলে বোঝায় যে হিন্দু সুরক্ষিত আর বিপদটা মুসলিমদের। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আন্দালন থেকে দূরে ঠেলে এটা এনআরসি  সফল করার চক্রান্ত ছাড়া আর কী?

প্রসেনজিৎ বসু তারপর লিখেছেনঃ

"৩। অসমে এনআরসি-র ফলে ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ গেছে। সিএএ-২০১৯-এর মাধ্যমে যদি নাগরিকত্ব পাওয়া যায় তাহলে ১৪ লক্ষ এনআরসি-ছুট হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবে আর ৫ লক্ষ মুসলমান পাবে না । দেশজুড়ে এনআরসি হলে হিন্দুরা "শরণার্থী" হিসেবে গণ্য হবে আর মুসলমানরা "অনুপ্রবেশকারী" হয়ে যাবে   - এটা কি একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

৪। সিএএ-২০১৯-এর আওতায় নাগরিকত্ব পেতে গেলে প্রমাণ সমেত আবেদন করতে হবে যেটা বেশিরভাগ উদ্বাস্তুই করতে পারবে না। এই "নাগরিকত্ব দেওয়ার" ব্যাপারটা পুরোটাই একটা ধাপ্পাবাজি। আসলে আরএসএস-বিজেপি নাগরিকত্বের মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন করে বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে চাইছে আর মতুয়ারা মহাসংঘ এই খেলায় তাদের ল্যাংবোট হয়ে গেছে। "

আমাদের কথাঃ

দেখুন বসু বাবুর কান্ড! তিন নং পয়েন্টে বলেছেন সিএএ ২০১৯ আসামে ১৪ লাখ মানুষকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেবে, আর ঠিক তার পর চার নং পয়েন্টে বলছেন এই আইনটা ধাপ্পাবাজি, উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবেনা!

"আখির কহেনা ক্যায়া চাহতে হো!"

জানিয়ে রাখি আমরা প্রসেনজিৎ বসুর চার নং পয়েন্টের সাথে একমত। এবং চার নং পয়েন্টটিই সত্যি হলে প্রসেনজিৎ বাবুর এই গোটা প্রবন্ধটি অর্থহীন হয়ে যায়। প্রসেনজিৎ বসু কি সচেতন ভাবে প্যাচাল পাড়ছেন?

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

এই "দামাল" নামের সংগঠনটির মুখপাত্ররা গতকাল মৌলালি মোড়ে একটি সভা করে জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছে, যে তারা না বুঝে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়ে পড়েছিল এবং ভুল করে রাজাবাজারের ধর্নামঞ্চে রিলে-অনশনেও বসে পড়েছিল। এখন তাদের দিব্যচক্ষু উন্মীলিত হয়েছে, তাই তারা প্রকাশ্যে বলেছে যে এনআরসি এবং সিএএ ২০১৯-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাই অনুচিত, এতে নাকি বিজেপি-র সুবিধা হবে।

অর্থাৎ "দামাল"-এর মতে এনআরসি-সিএএ ২০১৯ বিরোধী পুরো আন্দোলনটাই ভুল, সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া ১৫০ জনস্বার্থ মামলা ভুল, দেশের ৬টা রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া প্রস্তাবগুলি সবই ভুল, UNCHCR-এর অবস্থান ভুল - ঠিক শুধু সিএএ ২০১৯-এর পক্ষে যারা, অর্থাৎ মতুয়া মহাসংঘ আর বিজেপি। এরা "দামাল" না বিজেপি-র "দালাল"? 
 
আমাদের বক্তব্যঃ

প্রসেনজিৎ বসুর এই বক্তব্য ১০০% বিশুদ্ধ মিথ্যা। নিয়মিত দামাল যা বলে আসছে গত কালকেও বক্তারা তাই বলেছেন। আন্দালনের ভুলগুলোর সমালোচনা করে সঠিকটাকে আঁকড়ে ধরা ডেভেলপমেন্ট করা, এটাই মার্কসবাদী পদ্ধতি বলে জানতাম, প্রসেনজিৎ বাবুরা এখন সেই পদ্ধতি ছেড়ে বিজেপির আই টি সেলের পদ্ধতি নিয়েছেন। অমিত শাহ, দিলীপ ঘোষের মুখের কথার প্রতি অগাধ আস্থার কথাতো তিনি শুরুতেই জানিয়েছেন।

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

"সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক যে কিছু স্বঘোষিত মুসলমান নেতা বিভ্রান্ত হয়ে "দামাল"-এর সাথে ভিড়ে সিএএ ২০১৯-কে সমর্থন করছে আর এনআরসি-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কুৎসা করছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীতে যে গোটাকতক ইহুদি নিজেদের পিঠ বাঁচাতে যোগ দিয়েছিল, এরা অনেকটা তাদের মতন। বাকিরা মার খায় খাক, জেলে যাক, আমরা বিজেপি-কে তেল মেরে নিজেদের আখের গুছিয়ে নি - এইটা এদের মানসিকতা।"

আমাদের বক্তব্যঃ

সুতরাং মুসলিম ধর্মালম্বী নেতারা বসু সাহেবের সাথে একমত না হলে, তারা পর্যালোচনার মাধ্যমে আন্দোলনের ভুল শুধরে এগিয়ে যেতে চাইলে, মতুয়াদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধানের দাবিতে সোচ্চার হয়ে মতুয়াদের মধ্যে বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারকে ধাক্কা দিতে চাইলে তারা বিভ্রান্ত, বুদ্ধিহীন, বিজেপিকে তেল মেরে আখের গোছানো ইত্যাদি। আর বসু বাবু মুসলিম সমাজের সাচ্চা প্রতিনিধি!  
দামাল বা এই মঞ্চকে সমর্থন জানানো কোনো মুসলিম নেতা বা মতুয়া নেতা সিএএ ২০১৯ কে সমর্থন জানায়নি। মঞ্চে স্পষ্ট ভাবে শর্তহীন জন্মগত নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি ছিলো, উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে এখনো পর্যন্ত ভারতে বসবাসরত সকলের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার দাবি ছিলো, ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার আধার প্রকল্প বাতিল করার দাবি ছিলো,  যা নিয়ে প্রসেনজিৎ বসুরা মুখে ছিপি এটে বসে আছেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি আধারের ধরনের একটি পাঞ্চ কার্ড হিটলার চালু করেছিলেন, যা ইহুদি, কমিউনিস্ট হত্যায়, শ্রমিক আন্দোলন ধ্বংস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।  মঞ্চে প্রত্যেক বক্তা বলেছেন যে সিএএ ২০১৯ আসলে মতুয়া উদ্বাস্তুদের প্রতি একটা ভাওতা। তার পরেও এই নির্লজ্জ গোয়েবেলসিয়ও মিথ্যা প্রচার কার স্বার্থে?

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

"পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের আগে একদিকে সারা ভারত মতুয়া মহাসংঘের নেতৃত্ব আর বিজেপি-র বনগাঁর সাংসদ "সিএএ রুলস আনো, হিন্দুদের নাগরিকত্ব দাও" বলে হাওয়া গরম করা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে "দামাল" নামক দালাল-দের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে এনআরসি-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কুৎসা করতে। কলকাঠি কারা নাড়ছে বুঝতে কি খুব অসুবিধা হচ্ছে?  
আমরা যারা এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ২০১৯-কে দেশের গরীব-উদ্বাস্তু-মুসলিম সংখ্যালঘু-দলিত এবং আদিবাসীদের "অনুপ্রবেশকারী"/"বেনাগরিক" বানিয়ে অত্যাচার করার একটা চক্রান্ত বলে মনে করি, তাদের এই বিশ্বাসঘাতকদের থেকে সাবধান হতে হবে, এদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। এনআরসি-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনকে আরও ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী করতে হবে।"

আমাদের বক্তব্যঃ

প্রসেনজিৎ বসু এটা চেপে যাচ্ছেন যে সিএএ ২০১৯ কাউকেই "অবৈধ অনুপ্রবেশকারী" বা বেনাগরিক বানাচ্ছে না। সিএএ ২০০৩ কোটি কোটি মানুষকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী/বেনাগরিক বানিয়ে দিয়েছে। সিএএ ২০০৩-এর প্রয়োগেই এনআরসি হচ্ছে। একজন মানুষকে যেমন দুইবার খুন করা যায়না, তেমনি দুইবার বেনাগরিকও করা যায়না। 

প্রসেনজিৎ বসু কখনোই জানার চেষ্টা করেননি, নাকি জেনে বুঝে দীর্ঘ ১৭ বছর নাগরিকত্বের নামে মতুয়াদের উপর পুলিশ প্রশাসনের অত্যাচার হয়রানির কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছেন? বিজেপি সিএএ ২০১৯ লাগু করে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। আমরা মনে করি বিজেপি ভাওতা দিয়েছিলো মতুয়াদের, প্রসেনজিৎ বসুও চার নং পয়েন্টে সেই কথা কথাই লিখেছেন। এবার সেই সব মতুয়ারা, যারা বিশ্বাস করে সিএএ ২০১৯ তাদের নাগরিকত্ব দেবে, যদি প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবি তুলে আন্দোলন করে তবে সেটা যে এসেন্সে বিজেপি-বিরোধী আন্দোলন হবে সেটা উপলব্ধির মত জ্ঞান কি বসু বাবুর নেই?

হিন্দু থাকছে মুসলিম থাকছেনা, এসব বলে প্রসেনজিৎ বাবুরা আসলে সমস্যাটাকে সেকুলারিজমের সমস্যা হিসেবে দেখাতে চাইছেন, আসলে এটা মূলত রুটি-রুজির সমস্যা, দাস-শ্রমিক বানাবার চক্রান্ত। শেষমেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত।  সিএএ ২০১৯ আসলে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন থেকে হিন্দুদের দূরে সরাবার একটা ফাঁদ ছাড়া কিছু নয়। 
সমস্ত গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষকে মতুয়াদের নাগরিকত্বের দাবি এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে একসাথে সোচ্চার হতে হবে। নয়তো বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন সফল করা যাবেন না। এইটুকু বোঝার বুদ্ধি প্রসেনজিৎ বাবুর নেই?  প্রসেনজিৎ বলে রাখি, ২০২১ সালে বিজেপিকে এনে বা না এনে ২০২৬ সালে বা কোনো দিনই আপনারা, অর্থাৎ সিপিএম, ক্ষমতায় আসতে পারবেন না। রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসার জন্য অহেতুক ফাকায় হাত পা না ছুড়ে যে বস্তুবাদীতা এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা প্রয়োজন সেটা আপনাদের নেই।।বিজেপির বেগার শ্রমিক হয়েই রয়ে যেতে হবে।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে