মোদী’র বিজয়ের কারণ জনগণের মূর্খতা নয় বিরোধীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ও সুবিধাবাদী অবস্থান

রবিবার, মে ২৬, ২০১৯ 0 Comments A+ a-

বিরোধীরা কি মোদী’র কোনো বিকল্প হাজির করতে পেরেছিলো?


জনজীবনের মান উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ক্ষেত্রেই ডাহা ফেল করেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এলো নরেন্দ্র মোদী'র নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী সরকার। বিরোধীরা সকলেই ইভিএম আর  নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরব। আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লার মত শাসক পরিবার গুলো ভোট ব্যবস্থাকে যে ম্যানিপুলেট করে এটা যেন প্রথমবার জানা গেল!  হতবাক বোদ্ধা কুল হতাশ জনগণের সাম্প্রদায়িক মূর্খামি নিয়ে। তাদের অঙ্ক অনুযায়ী বিজেপি জেতার অর্থ জনগণ রুটি-রুজি, কর্মসংস্থান চায় না, শুধুই রাম মন্দির আর পাকিস্তান'কে বোমা মারতে চায়।  

কিছুক্ষণের জন্য ধরে নেওয়া যাক যে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ছিল এবং ইভিএম এ কারচুপি হয়নি। কিন্তু তবুও কি  বিরোধীদের ভোট দেওয়ার মত কোনো কারণ ছিলো? বিরোধীরা কি মোদী’র কোনো বিকল্প হাজির করতে পেরেছিলো?  

কৃষি সংকট আর কৃষক আত্মহত্যার ধারাবাহিকতা কংগ্রেসের শাসন থেকেই প্রবাহমান। আঞ্চলিক দলগুলোর শাসন এর বাইরে নয়। বিজেপি হোক বা কংগ্রেস, কৃষি সংকট সমাধানে ঋণ মকুব আর ন্যূনতম সমর্থন মূল্য বা এমএসপি'র ভাঁওতা ছাড়া কেউ কোনো মৌলিক সমাধানের কথা বলতে পারেনি। 

আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভারতবর্ষের কৃষি সমস্যার সমাধান পরিকাঠামো বিকাশ করে বা সেচ কেটে হবে না, বরং উৎপাদন সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই সম্ভব, যে কাজ কোন ভোটপন্থী পার্টি শাসক শ্রেণীর বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে করবে না। কৃষি সমস্যা মৌলিক ভূমি সংস্কার, কৃষক ও বাজারের মধ্যবর্তি পরজীবি  শ্রেনীর উচ্ছেদ, এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৃষি পরিকল্পনা আর কৃষকদের বৈপ্লবিক রেমৌলডিং বাদে সম্ভব না। মোদী'র বিপরীতে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা কেউই কৃষককে জমি, রুটি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে পারেননি, অথবা চাননি, কারণ এই ক্ষেত্রে তাঁদের সামন্তবাদী রাজনৈতিক অবস্থান মোদী'র চেয়ে আলাদা নয়। 

১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে যাবতীয় সরকারের আমলে একের পর এক বড় কারখানা  বন্ধ হয়ে যাওয়া আর ক্ষমতায় এলে বন্ধ কারখানা খোলার মিথ্যা প্রতিশ্রুতির স্ক্রিপ্ট জনতার মুখস্থ।  ঠিকা প্রথায় নিয়োগের বদলে আত্মমর্যাদা যুক্ত স্থায়ী চাকরির অধিকারের কথা কথা বিরোধীরা বলেনি। মোদী চাকরি খেয়ে নিয়েছে, এ কথা বলেও সরকারি চকরির ক্ষেত্রে পদ বিলোপের বদলে শূন্য পদে নিয়োগের কথা কেউ বললো না। কেউ বললো না মানুষের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব সরকারের আর এই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে শুধু বেসরকারি ক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যে সরকারের কাজ নয় ।

সমস্ত সরকারের আমলে স্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগের গ্রাফ দিন দিন নিম্নমুখী হয়েছে। বেসরকারীকরণের ফলে খেটে খাওয়া গরিব মানুষ বঞ্চিত হয়েছে স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জায়গায় এখন শুধু জনগণ কে ঢপের কীর্তন শোনানোর জন্যে স্বাস্থ্য বীমা দিয়ে বড় বড় বীমা কর্পোরেশনের লাভ করিয়ে সরকার এই দায়িত্ব থেকে যে নিষ্কৃতি পেতে পারে না সে কথা কোন ভোটপন্থী পার্টি বা প্রার্থী কিন্তু জোর গলায় বললো না। 

স্বাস্থ্যের মতনই জনগণের স্বার্থে, দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের স্বার্থে জরুরী শিক্ষার খাতে অর্থ বরাদ্দ কম হয়েই চলেছে। সরকারি লগ্নির জায়গায় বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজি কে এবং দেশী মুৎসুদ্দি পুঁজি কে শিক্ষা নিয়ে চড়া দামে ব্যবসা করে লাভের গুড় বস্তাবন্দি করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে ব্যাঙের ছাতার মতন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়তে দিয়েছে একের পর এক সরকার। মোদী সরকার সরাসরি শিক্ষার উপর আক্রমণ করে বিগত পাঁচ বছরে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু বরাদ্দ ছাঁটাই হয়নি, বরং স্কলারশিপের টাকায় কোপ মেরে গরিব, বিশেষ করে দলিত, আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া জাতির ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকারের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল এই সরকার। এর বিরুদ্ধে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, সরকারি শিক্ষায় ফী বৃদ্ধি থেকে স্কলারশিপ শেষ করে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে, শিক্ষার সার্বিক বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে কোন বিরোধী দল এমন কোন অবস্থান গ্রহণ করেছিল কি যা সত্যিই মানুষের উপকার করতে পারতো?
  
প্রতিরক্ষা খাতে, দেশের সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে, খনিজ সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে, নিজেদের জল-জঙ্গল-জমি'র অধিকার থেকে উচ্ছেদ হওয়ার বিরুদ্ধে লড়াকু মানুষদের দমন করার খাতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্র বরাদ্দ করে তাতে কাটছাঁট করে জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করার কথা কোন মূল ধারার বিরোধী দল কি জোর গলায় ঘোষণা করে মানুষ কে নিজেদের পক্ষে টেনে আনতে পেরেছিল? পারেনি কারণ বিরোধীরা যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন তারাও অন্য কিছু করে দেখাতে পারেনি। 

চৌকিদার চোরই বটে কিন্তু কংগ্রেস তৃণমূল বা অন্যান্য বিরোধীরা যদি আজ হঠাৎ সাধু সাজতে চায় তবে ঘোড়াও কি হাসবে  না? 

সুতরাং বিজেপি সরকার যা করছে সেটাকেই স্বাভাবিক এবং কাঙ্খিত উন্নয়নের মডেল বলে এতদিন জনগণের মনে গেঁথে দিয়েছে বিরোধীরা। আত্মমর্যাদার সাথে রুটি রুজির অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প মডেল হাজির করতে পারেনি বিরোধীরা।  তারাইতো শিখিয়েছে ঋতু পরিবর্তনের মত দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার, জলের দরে সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া আর শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়াটাই কাঙ্খিত অর্থনৈতিক সংস্কার। সুতরাং বিরোধীরা এতদিন যা বলে এসেছে বিজেপিতো সেটাই আরো ভালোভাবে করছে।

কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকার আসার আগে কংগ্রেস কি অন্ধ পাকিস্তান বিরোধী উগ্রতা প্রচার করেনি? অরবিন্দ কেজরিওয়াল, রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দোপাধ্যায় বা মহম্মদ সেলিমদের মতন আমাদের সেকুলার নেতারা কি তীর্থ স্থান ঘুরে ঘুরে রাজনীতির ধর্মীয় বাতাবরণ তৈরি করেনি? বাটলা হাউস এনকাউন্টারের মত গুচ্ছ গুচ্ছ ঘটনা কি ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের বিরুদ্ধে ঘটায়নি কংগ্রেস?

বিরোধীরা যে মতাদর্শবিহীন রাজনীতির চর্চা করেছে, তার বিপরীতে গেরুয়া মতাদর্শ মানুষের মনে জায়গা করে নিতে সফল হয়েছে। “ওটাতো পলিটিকাল ওপিনিয়ান” বলে একটা কথা চালু হয়েছে। যার মোদ্দা কথা রাজনৈতিক নেতারা তো মিথ্যা অভিযোগ করবেই, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবেই। এটা যেন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। যুক্তি বুদ্ধি চর্চার বদলে ব্যাক্তি আনুগত্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অবক্ষয়ের লুম্পেন রাজনীতি ফ্যাসিবাদের ভিত্তি তৈরি  করবে এটা কি স্বাভাবিক নয়? সংঘের প্রচারকরা অবলীলায় সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পারে দুর্নীতিতো সবাই করে, কৃষকের উপর গুলিতো সবাই চালায় কিন্তু একমাত্র বিজেপি বিপন্ন হিন্দুদের রক্ষা করতে পারে বিশ্বজুড়ে ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রসারের থেকে। বিরোধী দল গুলো কি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের  সাথে গলা মিলিয়ে  ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ভীতি তৈরি করেনি? ভুয়া ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে সংঘ পরিবার হিন্দুদের মধ্যে তৈরি করেছে এক ফাঁপা পুনঃজাগরণের স্বপ্ন, আর এই রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে, পাল্টা লড়াই গড়ে তুলতে কোন ভোটবাজ পার্টিকে মানুষ উদ্যোগ নিতে দেখেননি।  বলাবাহুল্য, দ্বিতীয় মোদী সরকার কাগুজে গনতন্ত্রটুকুও  লোপাটের দিকে যাবে, দেশে এক নতুন ধরণের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। 

সুতরাং বিরোধীরা যে জমি তৈরি  করেছে তাকে কাজে লাগিয়েই ফসল ঘরে তুলেছে সংঘ পরিবার। ফ্যাসিবাদের উত্থান তখনই হয় যখন জনগণ প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি বিরক্ত হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদ নতুন কিছু করে দেখিয়ে চমক দেয়। জনগণ কখনো ভাবেনি যে লালবাজারের বড় কর্তার কলারে কেউ হাত দিতে পারে বা কালো টাকার কারবারিদের সায়েস্তা করতে সমগ্র দেশে নোটই বাতিল করে দেওয়া যায়! বা ঘরে ঢুকে পাকিস্তানকে মেরে আসা যায়! কিন্তু আদতে ফ্যাসিবাদ উগ্র কায়দায় প্রচলিত শোষণ মূলক ব্যাবস্থাকেই রক্ষা করে। তাই কোনো সমস্যারই সমাধান করতে পারেনা।

ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে কংগ্রেস কত নিষ্পাপ, গান্ধী বা নেহরুর মতন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা কত দেশ প্রেমিক এই সব প্রচার করলে আদতে লুজ বল দেওয়া হয়। ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজন বিকল্প মতাদর্শ, বিকল্প সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি, যা বাস্তবিকই কৃষি সমস্যা, শিল্প সমস্যা, কর্মসংস্থানের মত সমস্যাগুলোর মৌলিক সমাধান করবে । আর প্রয়োজন ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ ও উচ্ছেদের যোগ্যপন্থা। যতদিন সেই বিকল্প কে মানুষের সামনে তুলে ধরা না যাবে ততদিন পর্যন্ত ভোটের মেশিনে বোতাম টিপে ফ্যাসিবাদ কে জব্দ করা যাবে এই রকম দিবাস্বপ্নই বিক্রি করা যাবে, ফ্যাসিবাদ কে উচ্ছেদ করা যাবে না। 

বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা ও নকশাল - বিজেপি রাজনীতির বিভেদ

সোমবার, মে ২০, ২০১৯ 0 Comments A+ a-

Statue smashing of Vidyasagar by Naxals and the BJP. What's the difference?
বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নকশাল ও বিজেপি'র রাজনীতি 

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সভাপতি অমিত শাহের কলকাতা’র রোড শো’র সময়ে তাঁর ভাড়াটে হিন্দি-ভাষী গুন্ডারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যাসাগর কলেজে হামলা করায় এবং ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবক্ষ মূর্তি ভেঙে ফেলায় বাঙালি সমাজ চরম ভাবে ক্ষুণ্ণ হয় এবং এই বাঙালিদের মধ্যেই আমরা-ওরা বলে এক ভাগাভাগি হয়ে যায়। গত ১৫ মে থেকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ও বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে বিজেপি-তৃণমূল তরজা তুঙ্গে উঠেছে, দুই পক্ষই একে অপরকে বিদ্যাসাগর ও বাঙালি-বিরোধী বলে চিহ্নিত করছে। কলকাতা সহ শেষ দফার লোক সভা ভোটে যে নয়টি আসনে ভোটগ্রহণ হলো তাতে বিদ্যাসাগর অদৃশ্য এক আত্মার মতন ঝুলে থাকলেন বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের মাথায়।

এরই মধ্যে, স্লো পয়জনিং এর মতন একদল তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলন তুঙ্গে ওঠার সময় বিপ্লবী পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা সিপিআই (এম-এল) কর্মীদের দ্বারা বিদ্যাসাগর সহ শাসক শ্রেণী’র খুব পছন্দের সব তথাকথিত মনীষীদের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে আরএসএস ও বিজেপি’র কুকর্মের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ১৯৭০ সালে সিপিআই(এম-এল) কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের মুন্ডু ভেঙে দেওয়া কে উল্লেখ করে বিজেপি’র বর্তমান অন্যায় কে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করা হয় সোশ্যাল মিডিয়া সহ নানা সংবাদ মাধ্যমে। অনেকে আবার নকশালদের সাথে বিজেপ’র মিল খুঁজে পান।

উদার গণতন্ত্রীরা, পার্লামেন্টারি শোধনবাদী বামপন্থীরা ও তাঁদের লেজুড়বৃত্তি করা কিছু তথাকথিত “নকশাল” লেবেল আঁটা ফেসবুক বিপ্লবীরা মিলে সমস্বরে বিদ্যাসাগর বন্দনায় নামে। সবাই মিলে বিজেপি-আরএসএস কতৃক বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা ও নকশালপন্থী সিপিআই(এম-এল) কর্মীদের মূর্তি ভাঙার উভয়ের বিরোধিতা করেন। একদিকে বিজেপি-আরএসএস এর বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা কে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের বাঙালি’র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর নগ্ন আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় আর অন্যদিকে, সিপিআই(এম-এল) এর মূর্তি ভাঙা কে অতি-বাম বিচ্যুতি, একপেশে চিন্তার ফসল, ভুল রাজনীতি, ইত্যাদি বলে সমালোচনা করা হয়।

২০১৮ সালে ত্রিপুরায় ভোটে জিতে বিজেপি’র লেনিন মূর্তি ভাঙার বিরুদ্ধে কিছু বামপন্থী ছাত্রদের দ্বারা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের অন্যতম দালাল শ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্যের কালীঘাট স্থিত মূর্তি ভাঙার ঘটনায় যদিও বা  সিপিআই(এম-এল) এর দ্বারা মনীষীদের মূর্তি ভাঙার ঘটনার উল্লেখ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে হয়েছিল, বিদ্যাসাগরের ভূলুণ্ঠিত হওয়ায় সেই অর্ধ শতাব্দী পুরানো ঘটনা আবার রাজ্যের রাজনীতিতে টেনে আনছে কিছু ধুরন্ধর রাজনৈতিক কারবারি, যাঁদের অভিপ্রায় হলো জনগণের স্মৃতিতে এখনো শ্রদ্ধার আসন গ্রহণ করে থাকা নকশালপন্থীদের বিজেপি-আরএসএস এর সমকক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা। এর বিরুদ্ধে অনেক তথাকথিত আধুনিক নকশালপন্থী মিনমিন করে ফেসবুক প্রতিবাদ করলেও তাঁরা আক্রমণের মূল বিষয়বস্তুটি স্বীকার করেছেন। তাঁরাও ১৯৭০ সালে সিপিআই (এম-এল) কর্মী সমর্থকদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ-বিরোধী ও ঔপনিবেশিক লুন্ঠন-বিরোধী লাইনকে, সেই লাইনের তাত্বিক ভিত্তি প্রস্তুতকারী বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা, বিপ্লবী সাংবাদিক ও কবি, তথা সিপিআই(এম-এল) পলিটব্যুরো সদস্য সরোজ দত্ত কে কায়দা করে আক্রমণ করছে অতীতের “ভুল” শুধরে নেওয়ার নাম করে, আর সরোজ দত্তের আড়ালে তাঁদের আক্রমণের আসল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্মদাতা, নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের ও সিপিআই(এম-এল) এর স্রষ্টা চারু মজুমদার।

এই আক্রমণ নতুন নয়। গত পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় ধরে রঙ বেরঙের সংশোধনবাদ চারু মজুমদার কে, তাঁর নির্ভুল রাজনীতিকে, তাঁর নেতৃত্বাধীন সিপিআই(এম-এল) পার্টি কে অবিশ্রান্ত ভাবে আক্রমণ করে এসেছে। চারু মজুমদার ও সিপিআই(এম-এল) এর উপর এই আক্রমণ আসলে ভারতের কৃষি বিপ্লবের সঠিক লাইনের উপর আক্রমণ এবং সেই লাইন কে সমর্থনকারী চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ ও ভাইস চেয়ারম্যান লিন পিয়াও এর নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কে আক্রমণ। সেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে আক্রমণ, যে পার্টি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের জনগণের আশা ও ভরসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পুঁজিবাদ-পথগামী লিউ শাওচি-তেঙ শিয়াও পিং ও তাঁদের অনুগামীদের বিরুদ্ধে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব কে পরিচালিত করে এবং পার্টির নবম জাতীয় কংগ্রেসে মাও সেতুঙের চিন্তাধারা’র বিজয় পতাকা উড়িয়েছিল। এই আক্রমণের কারণ ছিল চারু মজুমদারের নিজ হাতে গড়া সিপিআই(এম-এল) সংশোধনবাদী ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে, মাও সেতুঙের চিন্তাধারা কে অস্ত্র করে লড়াই করেছিল এবং ভারতের মাটিতে মাও সেতুঙের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও উত্তরাধিকারী রূপে প্রতিষ্ঠিত লিন পিয়াও কতৃক জনযুদ্ধের সাধারণ লাইন কে প্রয়োগ করেছিল। এই প্রয়োগ কে আটকানোর ও সিপিআই(এম-এল) সম্পর্কে মানুষ কে বীতশ্রদ্ধ করে দেওয়ায় ব্রতী হয়েই সেই সত্তরের দশক থেকে নানা রঙের সংশোধনবাদীরা নকশালবাড়ি কে চোলাই করে ব্যবসা করা শুরু করে।

বর্তমানে যখন বিজেপি’র দ্বারা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার বিরোধিতায় নকশালপন্থীদের টানা হচ্ছে, যখন কায়দা করে সত্তরের দশকের মতনই চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত ও অসংখ্য শহীদের রক্তে লাল সিপিআই(এম-এল) কে ভ্রান্ত বলে, কালাপাহাড় বলে চিহ্নিত করে বিজেপি’র সমগোত্রীয় করার চেষ্টা চলছে তখন আমাদের উচিত দ্বান্ধিক ভাবে দেখা কেন সেদিন ছাত্র-যুব পার্টি সমর্থকদের দ্বারা বিদ্যাসাগর সহ নানা তথাকথিত “জাতীয় মনীষীদের” মূর্তি ভাঙা হয়েছিল এবং এই ভাঙার পিছনে কী রাজনীতি ছিল।

পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাড়ি রাজনীতির জন্ম হয় সেই ১৯৬৫  সালেই যখন লিন পিয়াও এর দ্বারা মাও সেতুঙের জনযুদ্ধের তত্ব কে সঙ্কলিত করে প্রকাশিত করা হয় জনযুদ্ধের জয় দীর্ঘজীবী হোক নামক পুস্তিকাটি। এই পুস্তিকায় গোটা বিশ্ব কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকা হলো তার গ্রামাঞ্চল আর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা তার শহর। গ্রাম দিয়ে  শহর ঘেরার জনযুদ্ধের তত্ব কে সারা বিশ্বের বিপ্লবের আঙিনায় প্রথমবার রণনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই রাজনীতির মূল সিদ্ধান্ত হলো যে সংসদীয় পথে কমিউনিস্টরা বিশ্বে কোন মৌলিক পরিবর্তন করতে পারবে না এবং একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই তাঁরা ক্ষমতা দখল করতে পারেন। এই শিক্ষায় আলোকিত হয়ে চারু মজুমদার তাঁর ঐতিহাসিক আটটি দলিল তৈরি করা শুরু করেন যার মাধ্যমে নকশালবাড়ি’র প্রাথমিক তাত্বিক ভিত্তি তিনি স্থাপন করেন। নকশালবাড়ির সংগ্রামের জোয়ার গ্রাম ছাড়িয়ে যখন শহরে পরে তখন সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে হাজারো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) কর্মীরা দলে দলে এই বিপ্লবী আন্দোলনে জোর দেন। পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী যাতে বিপ্লবের রাশ নিজের হাতে না তুলে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষককে সংগ্রামের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যাতে শ্রেণীর সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তাই চারু মজুমদার তাঁদের শ্রেণীর সাথে একাত্ম হওয়ার উপর জোর দেন ও শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী আয়ত্ত করে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে বলেন।

এই পর্যায়ে, অসংখ্য ছাত্র-যুবরা চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের, যাকে চারু মজুমদার বলশেভিক নভেম্বর বিপ্লব ও চীন বিপ্লবের পরে বিশ্বের তৃতীয় মহান বিপ্লব বলেন, থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সর্বহারা শ্রেণীর দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে ভারতের ইতিহাসের মূল্যায়ন করতে বসেন এবং তাঁরা অনুভব করেন যে ভারতের ইতিহাস কৃষকের সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাস। ভারতের ইতিহাস ক্ষমতাবান সংখ্যালঘু শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু শোষিত শ্রেণীর ইতিহাস। তাঁরা দেখেন যে বাংলার রেনেসাঁ’র তথাকথিত প্রাণ পুরুষ বলে যাঁদের তাঁদের সামনে রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণী তুলে ধরেছে তাঁরা সকলেই সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসনের দালালি করেছে। রামমোহন রায় থেকে বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ থেকে বঙ্কিমচন্দ্র, গান্ধী থেকে সুভাষ বোস, প্রত্যেকের ইতিহাস সাম্রাজ্যবাদের সেবা করার ইতিহাস।

তাঁরা দেখেন যে বিদ্যাসাগর মশাই কে বাংলা শিক্ষার প্রাণ পুরুষ বলা হয়, তিনি তাঁর কর্মজীবনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের পুতুল হিসেবে কাজ করেছেন। যে সময়ে বাংলার কৃষকের উপর, আদিবাসী মানুষের উপর শোষনের রোলার চালাচ্ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন সেইসময়ে তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা, যার লক্ষ্য ছিল শাসকদের জন্যে কেরানি তৈরি করা, বুনিয়াদ কে শক্তিশালী করছিলেন। যে সময়ে সারা দেশের কৃষক ও জনগণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা কে ছুড়ে ফেলতে হাতে অস্ত্র নিয়ে জেগে উঠলেন ১৮৫৭ সালে, সেই সময়ে সেই জনগণের বিদ্রোহ কে দমন করার জন্যে পাঠানো ফৌজ কে রাখার জন্যে বিদ্যাসাগর খুলে দেন সংস্কৃত কলেজের দরজা। দেশের মানুষের সাথে এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কী হতে পারে?

অনেকে বলেন, বিশেষ করে সংশোধনবাদী বামেরা যাঁরা এখন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ত্যাগ করে আম্বেদকর ও তথাকথিত বহুজন রাজনীতির ভক্ত হয়ে উঠেছেন, যে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব হলো উনি নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যোগ্য অবদান রেখেছেন এবং বিধবা বিবাহ শুরু করেছিলেন। ঠিক যে ভাবে তাঁরা ব্রিটিশ শাসকদের দালাল রামমোহন রায় কে ব্রাহ্মণত্ববাদ-বিরোধী সমাজ সংস্কারক হিসেবে দেখান ঠিক সেভাবেই তাঁরা বিদ্যাসাগরের প্রশংসায় পঞ্চ মুখ হন। তবে তাঁরা কেউই দেখেন না, বা দেখতে চান না, যে এই তথাকথিত বাংলার রেনেসাঁ’র নায়কদের কর্মকান্ড ছিল বাংলার তৎকালীন নব্য-উদিত  পাতি-বুর্জোয়া ভদ্রলোক সমাজের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ।

বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষায় বাংলার আপামর দলিত, আদিবাসী বা শূদ্র সমাজের কোন স্থান ছিল না। বিধবা বিবাহের প্রচলন শুরু হয়েছিল এবং শেষ হয়েছিল কলকাতার বনেদি সমাজের গন্ডির মধ্যে। এমনকি সংস্কৃত কলেজে তিনি কোন কালেই শূদ্র, দলিত বা আদিবাসী জনগণের জন্যে শিক্ষার কোন ব্যবস্থা করেননি। তাঁর সমগ্র কর্মকান্ডের কেন্দ্র বিন্দু ছিল কলকাতার ভদ্রলোক সমাজ, যে সমাজ কে ব্রিটিশ শাসকেরা নানা সুযোগ সুবিধা ও সরকারি চাকরী দিয়ে বশ করে রাখতে চেয়েছিল। কলকাতার বাইরে বিদ্যাসাগরের তথাকথিত সমাজ সংস্কারের ছায়াও পথ মাড়ায়নি। তাই সেখানে অশিক্ষা, কুসংস্কার, সামন্তবাদী অত্যাচার ও নারী বিদ্বেষ তার স্বমহিমায় রাজত্ব করতে থাকে।

আপামর কট্টর ব্রাক্ষণ বিদ্যাসাগর জাতের প্রশ্নে ভীষণ রক্ষণশীল ছিলেন এবং বাংলার নমঃশুদ্র সমাজের শিক্ষার জন্যেও তিনি কোন দিনই কিছু করেননি। বরং তাঁর সমস্ত কর্মকান্ড ছিল ব্রাক্ষণ ও উচ্চ বর্ণের হিন্দু ভদ্রলোক সমাজ কেন্দ্রিক। যে রেনেসাঁ’র কথা বাংলার মানুষের কাছে শাসক শ্রেণী প্রচার করে তা ছিল আপামোর সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণার গন্ডির থেকে বের করে বাংলার সাবর্ণ ভদ্রলোক সমাজ কে ঔপনিবেশিক ছাঁচে গড়ে তোলার একটা প্রচেষ্টা। তাঁরা যাতে কোন ভাবেই ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র না ধারণ করেন তার জন্যেই এই নতুন শ্রেণী কে শিক্ষিত করার দায় নেন বিদ্যাসাগরের মতন লোকেরা।

তাঁর ক্ষুরধার লেখনী ব্যবহার করে, ইতিহাসের সঠিক মার্কসবাদী বিশ্লেষণ করে সরোজ দত্ত দেখান যে বিদ্যাসাগরের কর্মকান্ডই ছিল সাম্রাজ্যবাদের সেবা করা এবং তার জন্যে কেরানি তৈরি করতে সাহায্য করা। যে সময়ে দেশের প্রধান দ্বন্ধ ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের সাথে দেশের কৃষক জনগণের দ্বন্ধ সেই সময়ে সেই দ্বন্ধে কৃষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা বিদ্যাসাগরের স্বরূপ তিনি খুলে দেন ছাত্র-যুবদের সামনে। “বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে” লেখায় তিনি দেখান যে সরকার হঠাৎ বিদ্যাসাগর দিয়ে মেদিনীপুরে কৃষকদের বিপ্লবী সংগ্রাম কে দমন করার চেষ্টা করছে ঠিক যেমন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব অগ্নিযুগের বাংলার সবচেয়ে তপ্ত মেদিনীপুরে এসে বিপ্লবীদের বিভ্রান্ত করতে বিদ্যাসাগর নিয়ে চর্চা শুরু করেছিলেন। সরোজ দত্ত দেখালেন যে যখনই বিপ্লব আর বিদ্রোহের তাপ শাসকশ্রেণীর গায়ে লাগে তাঁরা তখনই বিদ্যাসাগর কে ব্যবহার করে ঢাল হিসেবে। তাই তিনি বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার সমর্থন করেন।

দেশব্রতী'তে প্রকাশিত তাঁর “মূর্তি ভাঙার সমর্থনে” লেখায় সরোজ দত্ত লেখেন যে সিপিআই(এম-এল) সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে ছাত্র-যুবদের মধ্যে একটি নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। বাংলার জেগে ওঠা ছাত্র-যুবদের তিনি বন্যার সাথে তুলনা করে বলেন যে পার্টি আগল সরিয়ে দেওয়ায় নদীর জল তীব্র বেগে ছুটেছে তবে পার্টি সেখানে ছড়ি হাতে মাস্টারি করবে না যে সেই জল কোন ক্ষেত ভাসাবে আর কোন পথে ছুটবে। তিনি ছাত্র-যুবদের সামনে ও সামগ্রিক ভাবে ভারতের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাছে এক মহান কর্তব্য তুলে ধরেন — যে অতীতের বেইমানি করা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার দালালদের মূর্তি ভাঙতে হবে নতুন মূর্তি স্থাপন করার জন্যে। সরোজ দত্ত জোর দেন ইতিহাসের থেকে বাদ পড়ে যাওয়া সেই সব মহান কৃষক বিদ্রোহীদের, আদিবাসী বিদ্রোহীদের, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ সহ দেশের কৃষকদের ও আদিবাসীদের নানা অভ্যুথানের নায়ক-নায়িকাদের মূর্তি স্থাপনের উপর। তিনি বলেন যে এই নতুন মূর্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই জোর দিতে হবে শ্রেণীর উপর, কোন শ্রেণীর নায়কদের কমিউনিস্টরা প্রথমে প্রতিষ্ঠা করবে জনমানসে? অবশ্যই সেই শহীদ নায়কদের যাঁরা শোষিত শ্রেণীর থেকে উঠে এসেছিলেন।  

চারু মজুমদার তাঁর লেখায় সুশীতল রায়চৌধুরি সহ সিপিআই(এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে সংখ্যালঘুদের এই মূর্তি ভাঙার রাজনীতির বিরোধিতার বিরুদ্ধে লেখনী ধরেন। তিনি দেখান যে যদিও নকশালবাড়ি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পথ চলা ভারতের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য হলো ভিত কে, অর্থাৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপ্লব করা, চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতন এর আশু লক্ষ্য যদিও উপরিকাঠামোর বিপ্লবী পরিবর্তন করা নয়, তবুও ছাত্র-যুব সমাজ যেহেতু বিপ্লবী শিক্ষায় নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গী আয়ত্ত করেছেন তাই তাঁরা এই ঝুটো সমাজ সংস্কারকদের মূর্তি দেখে, তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের তৈরি কৃত্রিম ভক্তি দেখে শ্রেণী ঘৃণায়  ফেটে পড়ছেন। তাই চারু মজুমদার এই মূর্তি ভাঙার কর্মকান্ড কে বৃহৎ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আনুষাঙ্গিক হিসেবে চিহ্নিত করেন।

আজ অবধি চারু মজুমদার বা সরোজ দত্তের রাজনীতির কোন দ্বান্ধিক বিশ্লেষণ না করে যাঁরা একযোগে এই মূর্তি ভাঙার রাজনীতির বিরোধিতা করেন তাঁরাই কিন্তু আসলে কাপড়ের আড়াল থেকে শাসক শ্রেণীর স্তন্যপান করে জীবন যাপন করেন। নানা ধরণের বিপ্লবী সাজা মানুষদের মধ্যে চারু মজুমদার ও সরোজ দত্তের সঠিক রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা আসলে শাসকশ্রেণীর প্রতি গোপন আনুগত্য থেকে আসে। তাই তাঁরা সেই চারু মজুমদার ও সিপিআই(এম-এল) এর রাজনীতির বিরোধিতা করেন যে রাজনীতি কে চৌ এনলাই ও তেঙ শিয়াওপিং চক্রের দ্বারা ১৯৭১ এ সংগঠিত প্রতিবিপ্লবী অভ্যুথানের আগে পর্যন্ত মাও সেতুঙের নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সঠিক বলে মনে করেছে। তাঁদের চারু মজুমদার ও সরোজ দত্ত বিরোধিতা আসলে লিন পিয়াও বিরোধিতার রাস্তা ধরে সোজা মাও সেতুঙের বিরোধিতার নামান্তর। পাছে আজ জনসমক্ষে উলঙ্গ হয়ে যেতে হয় তাই তাঁরা ভারী ভারী মার্কসবাদী জার্গন দিয়ে নিজেদের ঘৃণ্য রাজনীতি কে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা চালায় ক্রুশ্চেভের বংশধরেরা। এদের গূঢ় অভিসন্ধি হলো জনগণ কে বিপ্লবের পথে চালনা না করে সংসদীয় রাজনীতি ও তার থেকে উৎপন্ন হতাশায় ঘেরাবন্দি করে রাখা।

এই তো গেল তথাকথিত বাম ও ফেসবুকীয় বিপ্লবীদের উপাখ্যান। বর্তমানে যে ভাবে বিদ্যাসাগরের মূর্তি বিজেপি-আরএসএস এর অবাঙালি ভাড়াটে গুন্ডারা এসে দুস্পর্ধা দেখিয়ে বাংলার বুকে, কলকাতার বুকে ভেঙে দিয়ে গেল তার বেলায় কী রাজনীতি হওয়া উচিত? এখানেও পথ দেখাবেন মাও সেতুঙ। তাঁর শিক্ষা হলো: “শত্রু যার বিরোধিতা করে আমাদের তা সমর্থন করা উচিত এবং শত্রু যার সমর্থন করে আমাদের তা বিরোধিতা করা উচিত”।

সংঘ পরিবারের বিদ্যাসাগর-বিরোধিতার কারণ হচ্ছে চরম এক প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাক্ষণত্ববাদী নীতি যা হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্কারগুলিরও তীব্র বিরোধিতা করে। সংঘ পরিবারের আদর্শ অনুসারে হিন্দু ধর্ম একেবারে পারফেক্ট এবং এর কোন ধরণের সংস্কারের দরকার নেই। যেহেতু রামমোহন রায় সতী প্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন বা বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবা বিবাহের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন তাই উভয়কেই সেই সময়ে গোঁড়া ব্রাক্ষণত্ববাদী ধর্ম সভার নেতা রাধাকান্ত দেব’র রোষানলে পড়তে হয়েছিল। উভয়কে ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের গোঁড়া অংশের বিরোধিতা সহ্য করতে হয়। আজ যে সংঘ পরিবার হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের দর্শন নিয়ে ভারতের জনগণ কে ভাগ করতে এবং চরম আকারে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে বিজেপি’র শাসনকে পোক্ত করায় ব্রতী হয়েছে তাঁদের কাছে বিদ্যাসাগর বা রামমোহন রায়ের ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থে করা সংস্কারও অসহ্যকর। সংঘ পরিবার রাধাকান্ত দেব’র উত্তরসূরী, তাঁরা ধর্ম সভার বর্তমান ধ্বজ্জাধারী।

এই সংঘ পরিবারের উদ্দেশ্য হলো ভারতে কর্পোরেট-সামন্তবাদী-মুৎসুদ্দি জোটের একনায়কতন্ত্র কে সুসংহত করতে হিন্দু ধর্মের প্রতিক্রিয়াশীল সমস্ত ব্যবস্থা গুলো ফিরিয়ে আনা। নারীর অধিকার কেড়ে নেওয়া, শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া, কৃষকের অধিকার কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে জনগণের ন্যূনতম অধিকারগুলো কেড়ে নেওয়া এবং মানুষ কে রাষ্ট্রের বশংবদ দাসে পরিণত করা। হিন্দু সমাজে জোর করে ঢোকানো পিছিয়ে পড়া জাতি, দলিত সমাজ ও আদিবাসীদের দিয়ে এই সংঘ পরিবার গোটা দেশে মুসলিম ও খ্রিস্টান বিরোধী নিধনযজ্ঞ চালাতে চায় আর এই কাজে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানো লেনিন থেকে নিরীহ বিদ্যাসাগর সবাই সংঘ পরিবারের শত্রু।

বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পিছনের দুইটি কারণ থাকতে পারে। হতে পারে বিজেপি ও আরএসএস এর গুন্ডারা জেনেশুনে ভীষণ পরিকল্পনা করে এই মূর্তি ভেঙেছে যাতে তাঁদের ন্যারেটিভটা, যে তাঁরা বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি কে ঘৃণা করে, তাঁরা হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে নিরীহ সংস্কারগুলি কে ঘৃণা করে এবং তাঁরা বাংলার বুকে গায়ের জোর দেখিয়ে বাঙালি কে হেয় করতে পারলেও বাঙালিরা যে সমবেত ভাবে এই গেরুয়া উত্তর ভারতীয় হিন্দিভাষী গুন্ডাদের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না, প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ও বাঙালিরা হেয় হয়। একটা সেন্স অফ ইম্পানিটি আজ এদের পরিচালিত করছে, পিছনে মোদী-শাহ থেকে সমস্ত রাষ্ট্র যন্ত্র। এই আক্রমণের লক্ষ্য হলো বাঙালি কে আক্রমণ করা এবং বুক চিতিয়ে ঘোষণা করা যে আগামী তে এই হবে বাংলার ভবিতব্য।

আবার হতে পারে যে বিজেপি ও আরএসএস এর এই গুন্ডারা জানতো না কার মূর্তি তাঁরা ভাঙছে। চোখের সামনে দাঙ্গা করার সময় যাই আসে তাঁকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে চালিত হয়েই এই গুন্ডারা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে সেটা প্রথমটার চেয়ে বেশি উদ্বেগজনক কারণ এখানে শত্রু এক এমন ফৌজ কে বাজারে ছেড়েছে যা খ্যাপা ষাঁড়ের মতন যাকে পাচ্ছে তাকে গুঁতোচ্ছে, যা পারছে ভাঙছে। তাই এই শত্রু কে রুখতে গেলে এক তীব্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাংলার শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষ কে গড়ে তুলতেই হবে না হলে শত্রু কিন্তু প্রতিটি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করবে এবং অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দেবে।
বিদ্যাসাগর কে সংঘ পরিবার ধ্বংস করতে চাইলে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের রুখে দাঁড়াতে হবেই। তাঁদের বিদ্যাসাগরের প্রতি ঘৃণার কারণ হলো ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ও শোষনের বিরুদ্ধে ঘৃণা, কিন্তু সংঘ পরিবারের বিদ্যাসাগরের প্রতি ঘৃণার কারণ মনুবাদী নৃশংস ব্রাক্ষণত্ববাদী একনায়কতন্ত্রের প্রতি ভালবাসা। তাই বৈপরীত্যের ঐক্যের মতনই আজ বিপ্লবী কমিউনিস্টদের বিদ্যাসাগরের পক্ষে, অর্থাৎ বাংলার নিজস্বতার পক্ষে, হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, তবে তার সাথে সাথে তাঁদের কর্তব্য হবে খেটে খাওয়া মানুষকে, শ্রমিক ও কৃষকদের এটা বোঝানো যে বিদ্যাসাগর বা রামমোহন বা গান্ধী কেউই তাঁদের স্বার্থের কথা ভাবেননি। বিপ্লবী কমিউনিস্টদের অবশ্যই বিদ্যাসাগরের প্রতি তৈরি করা মিথ কে ভাঙতে হবে এবং তাঁর স্বরূপ বারবার সরোজ দত্তের শিক্ষার আলোকে তুলে ধরে জনগণ কে শিক্ষিত করে তুলতে হবে।

এখন বিপ্লবী কমিউনিস্টদের আশু কর্তব্য হলো সারা দেশে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ছোট ছোট বিন্দু সৃষ্টি করে এক বৃহৎ সুনামিতে পরিবর্তন করা। বিপ্লবী সংগ্রাম কে ফ্যাসিবিরোধী মহা সংগ্রামের সাথে মিলিত করে গড়ে তোলা এক মহান সংগ্রাম। বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে সমস্ত দালাল মনীষীদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করেও শাসক শ্রেণীর দ্বারা এই ভাবে ঘৃণ্য আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষ করে ব্যারিকেড তৈরি করতে নেতৃত্ব দেওয়া আজ জরুরী হয়ে উঠেছে।  বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গ এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে এবং হিন্দি-হিন্দু উপনিবেশবাদের ধ্বজ্জাধারী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ না বিপ্লবী সংগ্রাম কোনটা এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জিতবে তার উপরই নির্ভর করে আছে বাঙালির অস্তিত্বের প্রশ্ন, বাংলার শ্রমজীবী মানুষের, বাংলার কৃষকের ভবিষ্যৎ। এই জন্যেই বিপ্লবী কমিউনিস্টদের আজ চরম শ্রেণী ঘৃণা নিয়ে প্রতি পদে আরএসএস ও বিজেপি’র বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম করতে হবে এবং এর জন্যে যদি বিদ্যাসাগরের মূর্তি কে যদি রক্ষা করতে হয় তাহলে প্রধান শত্রু কে পরাস্ত করার লক্ষ্য নিয়ে তাও করা উচিত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা ও বিপ্লবী সংগ্রামে তাকে কাজে লাগানো কমিউনিস্টদের পক্ষে ভীষণ জরুরী হয়ে উঠেছে বর্তমানে।   

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে