একমাত্র চারু মজুমদারের পথ ধরেই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের কবর খোঁড়া সম্ভব

রবিবার, জুলাই ২৮, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


ভারতের তথা বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক অন্যতম পথিকৃৎ হলেন চারু মজুমদার। তাঁর ৪৮তম শহীদ দিবস আজ, অর্থাৎ ২৮শে জুলাই, যে দিনটাকে অনায়াসে জাতীয় শহীদ দিবস বলা যেতে পারে, কারণ চারু মজুমদারের আত্মত্যাগের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ভারতের জনগণের মুক্তির সংগ্রাম প্রাণ দেওয়া প্রতিটি বিপ্লবীর মহান আত্মত্যাগ। ১৯৭২ সালের এই দিনটিতে যদিও ইন্দিরা গান্ধীর ফ্যাসিস্ট খুনী পুলিশের অমানুষিক অত্যাচারের সামনে দৃঢ় চিত্তে নিজের শিরদাঁড়া ও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শীর্ণ চেহারার মানুষটি নিজের প্রাণ হারিয়েছিলেন, যদিও এই দিনটায় ভারতের খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামের চরম ক্ষতি হয়, তবুও এই দিনটি অনুপ্রেরণার, এই দিনটি নতুন করে জ্বলে ওঠার দিন। 

ব্যক্তি চারু মজুমদার মারা গেলেও, শহীদ বিপ্লবী চারু মজুমদারের রাজনীতি কিন্তু সেদিন মারা যায়নি। সেই রাজনীতি অমর, কারণ তা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাও সেতুঙের চিন্তাধারার কষ্টিপাথর দিয়ে যাঁচাই করা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবী তত্ত্ব, আর বিজ্ঞানের মৃত্যু হয় না, বিপ্লবীর মৃত্যু হয় না। তাই তো ৫-৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ এ পুনর্গঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)'র বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান মহাদেব মুখার্জী ১৯৭৩ এর ১৫-১৮ জুনে অনুষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশনে বলেন: "শ্রদ্ধেয় নেতা বিজ্ঞান, শ্রদ্ধেয় নেতা কর্তৃত্ব, শ্রদ্ধেয় নেতা বিশ্বাস, শ্রদ্ধেয় নেতা বিপ্লব। তিনিই মহান আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব চেয়ারম্যানের চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিপ্লবী কর্তৃত্ব। আমাদের পরম প্রিয় শ্রদ্ধেয় নেতাই আমাদের চিনিয়েছেন চেয়ারম্যান মাওকে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা প্রমাণ করছে আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতার জাতীয় কর্তৃত্ব ও চেয়ারম্যান মাও-এর আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব অভিন্ন। তাই তো মরিয়া হয়ে ওরা দেখাতে চাইছে উভয়ের মধ্যে বিরোধ। কিন্তু ওরা যতই বিরোধ দেখাতে চাইছে ততই বেশী ক’রে বিপ্লবী জনতা উপলব্ধি করছে তাঁদের মধ্যে কতো মিল!" চারু মজুমদারের রাজনীতি অমর বিজ্ঞান বলেই তা আজও বেঁচে আছে গরিব মানুষের সংগ্রামে, প্রতিরোধের লড়াইয়ে, সমাজ বদলের লড়াইয়ে। 

এই বছর নানা সংগঠনের তরফ থেকে চারু মজুমদারের জন্ম শতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। ভোটপন্থী, ভোটবিরোধী, চারু মজুমদার কে নমঃ নমঃ করে পুজো করা লোকেরা আবার চারু মজুমদার কে দুই চক্ষের বিষ হিসেবে গণ্য করা লোকেরা, সবাই ১৯১৯ সাল কে তাঁর জন্মের সাল মেনে তাঁর জন্ম শতবার্ষিকী পালন করা শুরু করেছেন নানা ধরণের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এই জন্ম শতবার্ষিকী পালনের ঠেলায় আজ আবার চারু মজুমদার উঠে এসেছেন আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। ভোটপন্থী, অভোটপন্থী, ভোট বয়কটপন্থী, সশস্ত্র বিপ্লবপন্থী, শান্তিপূর্ণ বিপ্লবপন্থী (!), আম্বেডকরপন্থী ও নানা ধরণের শক্তিরা আজ চারু মজুমদার নিয়ে নানা ধরণের আলোচনা করছে এবং তাঁদের সকল আলোচনার মধ্যে যে সাধারণ সূত্রটা পাওয়া যাচ্ছে তা হলো যে চারু মজুমদারের রাজনীতিতে ভুল ছিল, উনি ঠিক ভাবে মাও সেতুঙ বোঝেননি, উনি হঠকারী ছিলেন, উনার উচিত ছিল সংসদীয় পথকেও গ্রহণ করার, এবং অবশ্যই গণসংগঠন গড়ে তোলা। 

এই পরিস্থিতিতে চারু মজুমদার কে এই সবজান্তা বিপ্লবীদের হাত থেকে রক্ষা করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আর শুধু রক্ষা করাই কাজ নয়, দরকার হলো বর্তমান পরিস্থিতে চারু মজুমদারের রাজনীতির থেকে শিক্ষা নেওয়া ও সেই রাজনীতি কে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, যাতে তাঁদের রাজনৈতিক চেতনার মান উন্নীত হতে পারে এবং তাঁরা নেতৃত্বে উত্তীর্ণ হতে পারেন।  

বর্তমানে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’র ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের উৎস স্রোত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নেতৃত্বে ভারতে কর্পোরেট-সামন্তবাদ জোটের একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা “হিন্দু রাষ্ট্র ” গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়িয়ে, যখন অবশিষ্ট, হাতেগোনা যায় এমন কিছু, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো কে খর্ব করা হচ্ছে কালা আইনের রোলার চালিয়ে, ঠিক তখন ভীষণ জরুরী হয়ে উঠেছে এই ঘৃণ্য চক্রান্ত কে চূর্ণ করতে চারু মজুমদারের রাজনৈতিক শিক্ষা ও তত্ত্ব আয়ত্ত করা এবং সেই তত্ত্বের ভিত্তিতে গরীব মানুষ কে, খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ কে ঐক্যবদ্ধ করে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রাম গড়ে তোলা। চারু মজুমদারের রাজনীতি ভীরুর ক্রন্দন নয়, শোষকের প্রতি শোষিতের আকুতি-মিনতি নয়, জনগণ কে সংসদীয় রাজনীতির গড্ডালিকায় ফেলে দেওয়া নয়, গণআন্দোলন ও গণসংগঠনের নাম নিয়ে কলুর বলদের মতন গোল গোল ঘোরানো নয়, চারু মজুমদারের রাজনীতি হলো শ্রেণী সংগ্রামের মহাঔষধি এবং তার প্রয়োগ হওয়া উচিত ভারতের জনগণের ঘাড়ের উপর জেঁকে বসা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে উচ্ছেদ করতে, ভারতের মানুষ কে এক নতুন, মুক্ত, জনগণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ তৈরি করতে পথ দেখাতে। 

অথচ ভীষণ চতুরতার সাথে চারু মজুমদারের রাজনীতির এই জরুরী অংশকে বাদ দিয়ে তাঁকে নিয়ে এবং তাঁর রাজনীতি নিয়ে শুধুই বড় বড় বক্তৃতা করে পাণ্ডিত্য জাহির করা, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণের থেকে চারু মজুমদারের রাজনীতি কে বিচ্ছিন্ন করে তা নিয়ে এবং ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত চলমান সশস্ত্র সংগ্রাম কে নিয়ে আলোচনা করা ও শুধু এর মধ্যে খুঁত ধরতে থাকা হলো একধরণের মারাত্মক সংশোধনবাদী পদ্ধতি, যা নবীন বিপ্লবী যুব ও শ্রমিক-কৃষক কে রাজনৈতিক ভাবে বিভ্রান্ত করার এক ঘৃণ্য চক্রান্ত। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিপদ, কর্পোরেট-সামন্ত শক্তির জোটের দালাল মোদী সরকারের চক্রান্ত ও আগ্রাসনের প্রতিরোধে চারু মজুমদারের রাজনীতির ভূমিকা কে জেনেশুনে বাদ দেওয়া হচ্ছে, তাকে জেনেশুনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পিছনে যাতে শোষিত মানুষ তাঁর মুক্তির চাবি কাঠি খুঁজে না পায়। তবুও, চারু মজুমদার শিখিয়েছেন যে কোন কথার মৃত্যু হয় না, আজ যা বলা হচ্ছে তা যদিও মানুষ গ্রহণ করছেন না তবুও কথাগুলো থেকে যাচ্ছে এবং আগামী দিনে নিজ অভিজ্ঞতায় মানুষ বুঝবেন কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক। 

হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ হলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা গড়ে তোলা বিশ্বজুড়ে দাপট দেখানো নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির সাথে ভারতের সামন্তবাদ ও মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের ঘনিষ্ঠ মিলনের ফসল।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট “ভাগ করো-শাসন করো”, যাকে ইংরাজী ভাষায় বলা হয় “divide & rule”, নীতির স্বার্থে একদিন ঔপনিবেশিক ভারতে গড়ে তোলা একটি ফ্যাসিবাদী দল আজ ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করেছে একমাত্র নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির সাহায্যে, ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের ও সামন্তপ্রভুদের সাহায্যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যে। সারা বিশ্বের মতনই ভারতের শাসকশ্রেণীর দ্বারা আর পুরানো কায়দায় শোষণ ও শাসন সম্ভব হচ্ছে না বর্তমানে; গরীব মানুষ কে উন্নয়নের নামে, কর্মসংস্থানের নামে আজ আর বোকা বানিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, তাই বিশ্বজুড়ে একদিকে যখন অর্থনীতির নামে নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে ঠিক তখনই রাজনীতির নামে কট্টর রক্ষণশীলতার কথা বলা হচ্ছে। 

আমেরিকায়  ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রিটেনে বরিস জনসন, রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন, তুর্কীতে রিসেপ এরদোয়ান, ব্রাজিলে জাইর বোলসোনারো, ইত্যাদির মতন ফ্যাসিবাদী, বর্ণ বিদ্বেষী ও চরম ভাবে ধর্মীয় মৌলবাদী রাষ্ট্র কর্তাদের উথ্বানের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ভারতে মোদী’র উথ্বান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মূলতঃ সমাজতন্ত্রের বিশ্বজয়ের গতিরোধ করতে যে কেইনসিয়ান অর্থনীতির সূত্র ধরে “জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র” ও উদারনৈতিক রাজনীতির মুখোশ পড়ে সাম্রাজ্যবাদ মানুষকে বোকা বানাচ্ছিল, চরম আর্থিক সংকটে এবং ফাটকাবাজির ক্ষেত্রে মন্দা আসায় লগ্নি পুঁজি কে যে বিশ্বজুড়ে ধাক্কা খেতে হয়েছে তার ফলে সেই আবরণ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদকে খুলে ফেলতে হয় এবং ভারতের মতন আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলোতেও ঝুটো গণতন্ত্রের আবরণ খুলে ফেলতে হয় শোষণ ও লুঠের স্বার্থে। 

ভারতের মানুষের শত্রু হিসেবে চারু মজুমদার যাদের চিহ্নিত করেছিলেন তারা হলো বৃহৎ মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ। বর্তমানে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের পতন হয়েছে ও পুতিনের নেতৃত্বাধীন নয়া জারতান্ত্রিক রুশ সাম্রাজ্যবাদ যদিও সোভিয়েত জমানার শোষণ-লুন্ঠনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে তবুও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপত্তির সামনে তার কোন অস্তিত্বই নেই। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির সাহায্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারতের উপর প্রায় একচেটিয়া প্রতিপত্তি কায়েম করেছে এবং সামন্তপ্রভুদের ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে নিত্য নতুন কায়দায় ভারত কে শোষণ ও লুণ্ঠন করে চলেছে। চারু মজুমদারের দেখানো মূল দ্বন্দ্বগুলির মধ্যে আজও বিরাজমান হলো কৃষকের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব, শ্রমিকের সাথে মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজির দ্বন্দ্ব, জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বগুলির মধ্যে আজও প্রধান দ্বন্দ্ব সামন্তবাদের সাথে আপামর কৃষক জনগণের দ্বন্দ্ব আর এই প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধান অন্যান্য দ্বন্দ্বগুলোর সমাধান করবে। 

যে “ভাগ করো আর শাসন করো”  নীতি প্রয়োগ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা একদিন ভারত উপমহাদেশের সর্বহারা শ্রেণী কে ও কৃষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, দেশ ভাগ করেছিল, সাম্প্রদায়িক নরসংহারের ঘৃণ্য আগুন জ্বালিয়েছিল, বিশ্ব জুড়ে সেই ভাগ করো আর শাসন করো নীতি আজ প্রয়োগ হচ্ছে। বুকের পাটা বাজিয়ে মোদী সরকার আরএসএসের সাহায্যে গোটা দেশে শুধু যে মুসলিম-বিদ্বেষের বীজ রোপন করেছে তাই নয়, বরং একের পর এক মুসলিম ধর্মালম্বী কে নির্মম ভাবে হত্যা করে, সেই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও বানিয়ে, মানুষ মারা ও সন্ত্রাস ছড়ানো কে আজ একটা সাধারণ গা-সওয়া ব্যাপারে পরিণত করেছে। এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি লাভে রয়েছে বৃহৎ মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা, সামন্তপ্রভু আর ফোঁড়েরা। গরীব মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদের পাহাড় তুলে, শ্রেণী সংগ্রামের ভাটার টান কে উপলক্ষ্য করে তাঁরা এমন এক ব্যবস্থা মোদী সরকারের মাধ্যমে গড়ে তুলছে, যার ফলে তাঁদের আর শ্রমিক-কৃষকদের শোষণ করতে অসুবিধা না হয়। সমস্ত দাবি দাওয়া ও ক্ষোভ-বিক্ষোভ কে মুসলিম জূজূ দেখিয়ে, বা পাকিস্তান সম্পর্কে বিদ্বেষের বন্যা বইয়ে যাতে অন্য খাতে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় সেই ব্যবস্থা তাঁরা করছে এবং তাতে সফলও হচ্ছে নানা জায়গায়। 

হিন্দু সম্প্রদায়ের ঐক্যের নামে ও মুসলিম-বিদ্বেষের অস্ত্র ব্যবহার করে দলিত-আদিবাসী থেকে শুরু করে তথাকথিত শূদ্র বা হিন্দু  বর্ণ ব্যবস্থার নিম্ন জাতের  মানুষদের নিজেদের পালে যে ভাবে বিজেপি ও আরএসএস টেনে নিয়েছে, যেভাবে শোষিত জাতের  মানুষ কে মুসলিম বিদ্বেষের বিষাক্ত প্রচারের শিকার করে তাঁদের দিয়ে মুসলিম হত্যা ও নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে, এবং যে ভাবে সামন্ততান্ত্রিক ব্রাক্ষণত্ববাদী চেতনা কে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা মোদী সরকার কোন রাখঢাক ছাড়াই করছে, তার ফলে সংসদীয় প্রবাহে গা ভাসানো কোন দলের, এমনকি সরকারি নকশালপন্থীদেরও, ক্ষমতা নেই এই স্রোতকে রুখে দেওয়ার ও মানুষ কে বিজেপির বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দাঁড়  করানোর। এর কারণ বিজেপি বা আরএসএস এর বিকল্প কোন মজবুত রাজনৈতিক ভিত্তি এই সংসদীয় দলগুলির নেই। তাঁরা যে ব্যবস্থা কে ব্যবহার করে মানুষ কে সামান্য বা ন্যূনতম স্বস্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করানোর কথা প্রচার করে, ফ্যাসিবাদের আমলে তা সোনার পাথরবাটি। 

ভারতের শাসকশ্রেণীর স্বার্থে চালিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আজ হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের দুর্গ হয়ে উঠেছে। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের উথ্বানের পিছনে সঙ্কটগ্রস্ত ভারতের শাসকশ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদত আছে বলেই, ব্র্যান্ড মোদী’র উপর আন্তর্জাতিক লগ্নি ও একচেটিয়া পুঁজির চরম ভরসা আছে বলেই ভারতে মোদী সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে বা ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্ত কলকব্জা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ খুলে ফেলতে পেরেছে নির্দ্বিধায়। আর এই পরিস্থিতিতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে ব্যবস্থার ভিতর থেকে পরাস্ত করার আষাঢ়ে গল্প শোনানো শোধনবাদী বাম লেবেল-আঁটা দলগুলির মধ্যে আটকে থেকে বহু বিপ্লবী সত্ত্বা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে, ধাক্কা খেয়ে হতাশ হয়ে বসে যাচ্ছে আর না হয় প্রতিবিপ্লবী হয়ে উঠছে। 

এই সময়ে চারু মজুমদারের প্রয়োজনীয়তা প্রচন্ড বেশি। যদিও অনেক বিজ্ঞ তাত্ত্বিক পন্ডিতেরা, যাঁরা আজও হাতে সাতের দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঘিয়ের গন্ধ শুঁকিয়ে জীবন কাটান, বলবেন যে চারু মজুমদার তো কোনদিনই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ নিয়ে কিছু লিখে বা বলে যাননি, তাঁর সময়ে তো আরএসএস এত শক্তিশালী ছিল না, ইত্যাদী। তাঁদের অনেকেই চারু মজুমদার কে বর্তমান পরিস্থিতিতে অকেজো বা অপ্রাসঙ্গিক বলে দূরে ঠেলে দেবেন, যেমন এত বছর নানা ভাবে কায়দা করে তাঁর রাজনীতি কে অপ্রাসঙ্গিক এবং ভ্রান্ত বলে শাসকশ্রেণীর চাটুকারিতা করে ফুটেজ খেয়েছেন এবং সংসার চালিয়েছেন। অনেকে আবার হয় ডাঃ বিআর আম্বেদকর কে চারু মজুমদারের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে বলবেন যে ভারতে ফ্যাসিবাদের পতন শ্রেণী সংগ্রাম দিয়ে নাকি হবে না, জাতমুক্তির সংগ্রাম দিয়ে হবে। অন্যদিকে অনেকে আবার আম্বেদকর আর চারু মজুমদার কে সমপরিমানে মিশ্রণ করে হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করার জগাখিচুড়ি লাইন দেবেন। স্রোত, পাল্টা স্রোত আর চোরা স্রোতের মাঝে পড়ে যে বা যাঁরা বাস্তবিক একটি প্রতিরোধ সংগ্রামের কথা ভাবছেন, যাঁরা আন্তরিক ভাবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করতে উদগ্রীব, তাঁরা কিন্তু বারবার দিশাহারা হয়ে যাবেন। 

চারু মজুমদার সত্যিই আরএসএস’র বর্তমান উথ্বান দেখেননি, মোদী ও অমিত শাহের মতন চরম ফ্যাসিবাদী ও বিভেদকামী শাসকদের দেখেননি। তবুও তিনি কিন্তু সঠিক ভাবে বুঝেছিলেন ভারতের শাসকশ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র কে। তিনিই কিন্তু প্রথম দেখিয়েছিলেন যে ভারতবর্ষ নামক যে দেশটির আজ জন্ম হয়েছে তা আসলে অনেকগুলি বিবিধ জাতির সম্মিলিত এক ইউনিয়ন এবং এই বিবিধ জাতিগুলির মধ্যে ঐক্যের চেতনা এসেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। স্বাধীনতার নামে সোনার পাথরবাটি দেখিয়ে যখন ভারতের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণী ও সামন্তপ্রভুরা দেশের ক্ষমতায় আসীন হলো তখন তাঁদের কাছে দেশের ঐক্য জরুরী হয়ে উঠলো শোষণ ও লুন্ঠনের সাহায্যে। আর এই জন্যেই উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে বার বার দেশের মানুষের, বিশেষ করে অ-হিন্দি জাতিগুলির থেকে, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দাবি করে শাসক শ্রেণী। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় যে জাতীয় ঐক্য’কে, যে ঐক্যের নামে কাশ্মীর থেকে নাগাল্যান্ড, মনিপুর থেকে আসামে চলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সেই ঐক্য আসলে শোষণের স্বার্থে ঐক্য, জনতার ঐক্য না, এই শিক্ষা কিন্তু চারু মজুমদার অনেক আগেই দিয়েছিলেন। 

আবার ইন্দিরা গান্ধীর দ্বারা শক্তিশালী কেন্দ্র গঠনের ঘটনা কে চারু মজুমদার শাসকশ্রেণীর সংকটের ফল হিসেবে দেখিয়েছিলেন। বর্তমানে মোদী ঠিক ইন্দিরা’র কায়দায় চলে এক শক্তিশালী কেন্দ্র গঠন করতে চাইছে আর তাই তাঁর দরকার ভারতের বিভিন্ন জাতির আনুগত্য। সেই আনুগত্য তৈরি করতে পারে একটা ঐক্যের চেতনা আর সে রকম ঐক্য গড়ে তুলতে চাই এক জাতীয়তাবাদী চেতনা, আর যেহেতু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণ কে পরিচালিত করে কোন জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীরা দেবে না, তাই তাদের কাছে বিকল্প হলো ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা। ভারতবর্ষ হিন্দুদের স্বাভাবিক বাসভূমি বলে জায়নবাদী ইজরায়েলি কায়দায় ভারতের মানুষ কে হিন্দু ধর্মের, ব্রাক্ষণত্ববাদী ধর্মের সাথে এক করে দেখানো হচ্ছে। এই সেদিন পর্যন্ত জাতের ভিত্তিতে বিভক্ত ও জাতের মাধ্যমে পরিচালিত সমাজটিকে আজ অধুনা করে পরিবেশিত করা হচ্ছে শোষিত মানুষদের, দলিত ও আদিবাসীদের ঠকাতে এবং হিন্দুত্বের জাতীয়তাবাদের গরল তাঁদের পান করাতে।  

আজ মোদী’র নেতৃত্বে ভারত সরকার চেষ্টা করছে আরএসএস নির্দেশিত হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার, যে হিন্দু রাষ্ট্র ধর্মের ভিত্তিতে জাতি-রাষ্ট্র গঠন করার চেষ্টা করবে এবং ধর্মের জিগির তুলে দেশের বিবিধ জাতিগুলিকে এক ছাতার তলায় আনবে। তবে এই ধর্মীয় ঐক্য এবং ঐক্যের ভিত্তিতে আনুগত্য ঠিক তখন হতে পারে যখন ধর্ম কে আক্রান্ত হিসেবে দেখানো যাবে। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ৮২ শতাংশ মানুষের ধর্ম কে ১৪ শতাংশ সংখ্যালঘুর দ্বারা আক্রান্ত হিসেবে দেখিয়ে, নানা কায়দায় মিথ্যাটা বারবার বলে তা সত্যি হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে, মুসলিম ধর্মালম্বী নানা জাতির নানা ভাষার মানুষের বিরুদ্ধে হিন্দু সাবর্ণ সমাজের মধ্যে যে ঘৃণা চিরকাল বিরাজ করেছে তা আরও বলিষ্ঠ ভাবে নিম্ন জাতির হিন্দুদের, দলিতদের ও আদিবাসীদের মধ্যে প্রোথিত করা আজ মোদী সরকারের খুঁটি মজবুত করার সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। 

বেকারত্বের সমস্যায় তীব্র ভাবে ভোগা ভারতের সমাজের যুবদের, দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করা শ্রমিক ও কৃষকদের, বারবার নানা কায়দায় নিজেদের ঘৃণ্য রাজনীতি দিয়ে বশীভূত করে, মুসলিম-বিদ্বেষ কে তীব্র করে, চরম আর্থিক সঙ্কট ও সীমাহীন কর্পোরেট-সামন্তবাদী লুঠতরাজ কে বাঁচিয়ে রাখতে জনগণের দৃষ্টি মূল সমস্যাগুলোর থেকে সরিয়ে এক কৃত্রিম সমস্যার দিকে ঘুরিয়ে দিতে বিজেপি-আরএসএস ও মোদী সরকার সফল হয়েছে। নানা জায়গায় যে ভাবে মুসলিম ধর্মালম্বী মানুষ কে রাস্তার উপর, জনসমক্ষে পিটিয়ে, কুপিয়ে খুন করে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা বুক চিতিয়ে ঘুরছে, যে ভাবে তাঁরা নির্দ্বিধায় এই সব মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ভিডিও বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে ত্রাস ও উল্লাস দুই ছড়াচ্ছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে গরিব ও শোষিত মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ ও ঘৃণা বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি, শোষণ ও বঞ্চনার প্রতি বারুদের স্তুপের মতন জমা হয়েছিল তার লক্ষ্যবস্তু কে খুব কায়দা করে পাল্টে দিয়ে বর্তমান সরকার শ্রেণী সংগ্রাম কে ধর্মীয় সংগ্রামে, ফ্যাসিবাদী হিংসাত্মক লড়াইয়ে পরিণত করেছে। আর এই কাজ করার সময়ে বারবার কিন্তু মোদী সরকার বা আরএসএস এর নেতৃত্ব ঘোষণা করেছে যে নকশালপন্থা তাঁদের কাছে এক বড় বিপদ ও শত্রু এবং তাঁরা এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়বেনই। 

শহুরে নকশাল” বলে রাষ্ট্রের শোষণ ও লুন্ঠনের বিরোধিতা করা অবিপ্লবী মানুষগুলো কে জেলে পুড়ে, স্বাধীনচেতা সংবাদমাধ্যমের উপর দমনপীড়নের অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাষ্ট্র কিন্তু বারবার জানান দিচ্ছে যে চারু মজুমদার ও নকশালবাড়ি তাঁদের শত্রু, চারু মজুমদারের রাজনীতি তাঁদের শত্রু। অথচ চারু মজুমদার হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের এই নগ্ন উল্লাস দেখেননি, তিনি আরএসএস এর হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা যেতে দেখেননি, তবে তিনি দেখেছিলেন কৃষকের বিপ্লবী প্রতিভা, শ্রমিকের হিম্মত এবং সর্বোপরি এই শোষিত মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত হওয়া শ্রেণী ঘৃণা যাকে সমস্ত সংসদীয় দল চেপে রাখতে চায়, বিস্ফোরিত হতে দিতে চায় না। নকশালবাড়ি নিয়ে নাকি কান্না কাঁদা অনেকেই কিন্তু সেই পথই বেছে নিয়েছিলেন এবং এর ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে নেতৃত্বের খামতি হয় তাকে ব্যবহার করে নেপোয় মারে দই করেছে আরএসএস ও বিজেপি। 

নরেন্দ্র মোদী কে দেশের গরিবের নিজের লোক হিসেবে চিহ্নিত করে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ’কে সাধারণ মানুষের কাছে, এমনকি হিন্দু ধর্মের দ্বারা শোষিত দলিত ও আদিবাসী মানুষের কাছেও গ্রহণ যোগ্য করে তুলেছে আরএসএস এর কর্মীরা। দেশজুড়ে বিজেপি’র পালে যে হাওয়া লেগেছে তার পিছনে দেশের হিন্দুত্ববাদের পাঁকে ডোবা সাবর্ণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের যেমন হাত আছে তেমনি সমর্থন আছে বহু হতদরিদ্র মানুষের যাঁরা আশা করে আছেন যে মোদী সরকার মুসলিম সম্প্রদায়কে ও পাকিস্তান কে “উচিত শিক্ষা দিয়ে” তাঁদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে। তাঁদের কাছে মোদী দারিদ্র্য থেকে হিন্দু ধর্মালম্বীদের, যার মধ্যে অনেক দলিত ও আদিবাসী নিজেদের গণ্য করেন, মুক্তির কান্ডারি। তাঁরা এ কথা বিশ্বাস করেন কারণ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী প্রচার, সর্বগ্রাসী প্রচার, মানুষকে এই কথা বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে। যেহেতু সমস্ত বৃহৎ মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা বা সামন্তপ্রভুরা উঁচু জাতের হিন্দু, তাই তাঁদের পক্ষে তাঁদের উপরে আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল শ্রমিক ও কৃষককে বশে আনতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। 

আজ যদি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের উথ্বানের শ্রেণী সম্পর্কের কথা বলি, ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের উৎসের কথা বলি, যা নিয়ে নিত্য চর্চা চলছে দেশের রাজনীতির আঙিনায়, তাহলে অবশ্যই বলতে হবে ভারতের অসমাপ্ত কৃষি বিপ্লব, অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যা সমগ্র ভারতবর্ষের মাটির থেকে সামন্তবাদ কে উচ্ছেদ করে  নয়া-গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি স্থাপিত করবে, এই বিপদের জন্যে দায়ী।  আমরা যেন ভুলে না যাই যে অর্থনীতির দিক থেকে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির তল্পিবাহক এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ, যার গোড়া হচ্ছে ব্রাক্ষণত্ববাদ, কিন্তু আসলে রাজনৈতিক ভাবে ও সামাজিক ভাবে চরম রক্ষণশীল কারণ এর শিকড় কিন্তু রয়েছে   ভারতের আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত। 

ব্রাক্ষণত্ববাদী সাবর্ণ হিন্দুদের সামাজিক প্রতিপত্তির উৎস হলো সামন্ততন্ত্রে তাঁদের উচ্চ অবস্থান। ভারতে স্বাধীন পুঁজিবাদের বিকাশের রাস্তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা রোধ করায় ও মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের জন্ম দেওয়ায় কোনদিনই ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাত আভিজাত্য ও জাত শোষণের অবসান ঘটেনি। জমির মালিক হিসেবে চিরকাল উচ্চ জাতির হিন্দুদের প্রতিপত্তি সারা ভারত জুড়ে কায়েম থেকেছে এবং নিচু জাতের দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের দিয়ে বেগার খাটানো, বাঁধা মজুর করে রেখে তাঁদের শ্রম শোষণ করা, বা দলিতদের দিয়ে অমানুষিক শ্রম করানোর মুলে রয়েছে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাত ব্যবস্থার মান্যতা, যা নিজেদের শোষণ ও শাসনের স্বার্থে যদিও সাম্রাজ্যবাদ ও মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ কখনো কখনো সংস্কার করে নিয়েছে, তবুও এর ভিত্তিতে কেউই আঘাত করেনি।  

তাই সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব কে আম্বেদকর বা অন্যান্য তথাকথিত সংস্কারপন্থী রাজনীতিবিদেরা, যাঁরা নিয়মতান্ত্রিকতার পাঁকে ডুবিয়ে শোষিত জনজাতির মানুষের সংগ্রাম কে শেষ করার প্রচেষ্টা করেছে, বুর্জোয়া রাষ্ট্র কে মহান হিসেবে চিহ্নিত করেছে, বা ভিতর থেকে ব্যবস্থা বদলের আকাশকুসুম সম্ভাবনার কথা শুনিয়ে হতদরিদ্র্র মানুষ কে আলেয়ার পিছনে ছুটিয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে চারু মজুমদারের সঠিক বিপ্লবী রাজনীতি, যা শেখায় যে শুধুমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেই ছুড়ে ফেলা সম্ভব এই পঁচাগলা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা কে। শুধু মাত্র সামন্ততন্ত্রকে গ্রামাঞ্চলে উচ্ছেদ করা গেলেই কিন্তু ব্রাক্ষণত্ববাদ দুর্বল হবে, কারণ যে জমির উপর ও উৎপাদনের উপকরণের উপর শ্রেণীগত ও জাতগত মালিকানার কারণে তার এই প্রতিপত্তি, তা উচ্ছেদ হলে জাত ব্যবস্থা ও তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ধর্মীয় বিধান শোষিত মানুষ মানবেন না। শোষিতেরা যদি শোষিত হতে না চান তাহলে কিন্তু শাসকের মহা বিপদ আর তাই তো বারবার নানা জায়গায় নানা কায়দায় মোদী সরকার থেকে শুরু করে আরএসএস ও বিজেপি’র নেতা ও কর্মীরা ঘোষণা করতে থাকেন যে “নকশালপন্থা” তাঁদের শত্রু। তাই তো তাঁরা চারু মজুমদার কে মুছে ফেলতে চায়, নকশালবাড়িতে অমিত শাহের মতন এক হিন্দুত্ববাদী অপরাধী কে নিয়ে গিয়ে ওরা চারু মজুমদার কে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে। 

আজ যদি গ্রামে গ্রামে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষককে বিপ্লবী রাজনীতি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে নিয়ে আসা যায়, যদি আজ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের শিকড় যে সামন্তবাদ, তাকে উচ্ছেদ করার কঠিন সংগ্রামে তাঁদের সামিল করা যায় তাহলে, কিন্তু শাসক শ্রেণী ও তাঁদের দালাল মোদী সরকার এবং আরএসএস-বিজেপি হালে পানি পাবে না। যদি আজ কৃষকের নিজের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বিজয় অর্জন শুরু হয় তাহলে কিন্তু মোদী’র বিপরীতে নকশালবাড়ি কৃষি বিপ্লবের সঠিক রাস্তা - এই সত্য প্রকাশিত হবেই। হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গা, হিংসা ও মানুষ মারার রাজনীতি কে উদারনৈতিক পাতি-বুর্জোয়াদের কান্নাকাটি থামাবে না, থামাবে কৃষি বিপ্লবের আগুন। জোতদার-জমিদার ও ধনী কৃষকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকেরা যে মুহূর্তে নিজেদের জীবনের লাগাম নিজেদের হাতে তুলে নেবেন, যে মুহূর্তে একটি গ্রামের ব্যাপক কৃষক মিলে নিজেদের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন ও সেই শাসন ব্যবস্থার রক্ষার স্বার্থে নির্দ্বিধায় শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়বেন, সে মুহূর্তে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ভিত্তি যে ব্রাক্ষণত্ববাদী সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক-আর্থিক ব্যবস্থা, তা খতম হবে। তবে এই খতম হওয়াটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হবে না, এর জন্যে চাই বিপ্লবী চেতনার সঠিক প্রয়োগ ও বিপ্লবী রাজনীতি দিয়ে জনগণ কে শিক্ষিত করে তোলা। 

চারু মজুমদার শিখিয়েছেন দেশের দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষককে রাজনীতি দিয়ে সচেতন করে, তাঁদের নেতৃত্বে উন্নীত করেই বিপ্লবী সংগ্রাম সফল হবে। বর্তমানে এই কাজেই বিস্তর ফাঁক থেকে গেছে, যে ফাঁক দিয়ে গলেছে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের গরল। চারু মজুমদারের দেখানো জনগণতান্ত্রিক ভারতের স্বপ্ন কে আজ নতুন করে দেখানো দরকার শ্রেণী কে। বিকল্প কী? এই প্রশ্নটি যখন আরএসএস এর কর্মীরা করে, যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ মোদী’র বিকল্প নেই বলে মানুষের আনুগত্য দাবি করে, তখন বিকল্প হিসেবে নকশালবাড়ি, বিকল্প হিসেবে শ্রীকাকুলাম, বিকল্প হিসেবে কালীনগর-কামালপুর তুলে ধরা আজ বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কর্তব্য। চারু মজুমদারের রাজনীতি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের যেসব স্তাবকেরা দশকের পর দশক ধরে সমালোচনা আর খিল্লি করতে থাকলো তাঁদের কলার ধরে জবাব চাওয়াও আজ বিপ্লবীদের কর্তব্য। মনে রাখতে হবে যেহেতু চারু মজুমদার ও নকশালবাড়ি কে আরএসএস-বিজেপি ও মোদী সরকার যমের মতন ভয় পায় তাই এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিষদাঁত ভাঙতে পারে শুধু চারু মজুমদারের রাজনীতি আর নকশালবাড়ি’র রাস্তা। 

আর সে রাস্তা বিপ্লবের রক্তঝরা পথ, যে পথের বাঁকে বাঁকে আত্মত্যাগের প্রয়োজন, মানুষের মুক্তির স্বার্থে নিজ প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকার মানসিকতা নিয়েই সে পথে চলা যায়। আত্মস্বার্থ, আত্মপ্রতিষ্ঠার ঝোঁক, নিজেকে বাঁচিয়ে তবে বিপ্লব করার চিন্তা কাউকে বিপ্লবের পথে এক পা’ও এগোতে দেবে না বরং ঠেলে দেবে সংশোধনবাদের ও সুবিধাবাদের পাঁকে। প্রশ্ন করতে শেখাবে বিপ্লবী পথ কে আর সন্দেহ করতে শেখাবে বিপ্লবের কতৃত্বমূলক নেতৃত্ব কে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর স্বাধীনচেতা, উদারনৈতিক পাতি-বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের প্রতিপত্তির কারণে চারু মজুমদারের আত্মত্যাগের রাস্তা, কৃষি বিপ্লবের রাস্তায় সততা নিয়ে চলার পথে বিস্তর বাঁধা সৃষ্টি হয়েছে, শ্রেণীর সাথে কমিউনিস্ট কর্মীদের একাত্ম হওয়ার প্রচেষ্টাতেও খামতি এসেছে প্রচুর এবং এর ফলে বারবার ধাক্কা খেতে হয়েছে ও হচ্ছে কৃষি বিপ্লব কে, সংগঠিত হওয়ার ও নিজ প্রতিপত্তি কায়েম করার সুযোগ পাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ। তাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি’র দ্বারা পরিচালিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যে স্লোগান কে চারু মজুমদার আপন করে নিয়েছিলেন এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক শর্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেই “আত্মস্বার্থ চূর্ণ করো; সংশোধনবাদ কে নাকচ করো” স্লোগান কে আজ প্রতিটি পদে পদে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের উপলব্ধি করা উচিত ও প্রয়োগ করা উচিত। 

শাসকশ্রেণী ও তার দালাল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী মোদী সরকার ও আরএসএস-বিজেপি কিন্তু চারু মজুমদার ও নকশালবাড়ি কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে হিংস্র পশুর মতন ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভারতের কৃষি বিপ্লবী সংগ্রাম কে, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব কে চূর্ণ করতে আর আপনি এই সময়ে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েও নকশালবাড়ির থেকে যদি দূরে সরে থাকেন, যদি চারু মজুমদারের রাজনীতির থেকে দূরে সরে থাকেন, তাহলে বুঝবেন ধৃষ্টতা ছাড়া আপনি কিছুই করছেন না। চারু মজুমদারের শতবর্ষ পালন করা, তাঁর শহীদ দিবস হিসেবে আজকের দিনটা পালন করার চেয়েও জরুরী হলো তাঁর রাজনীতি কে অধ্যয়ন করা, তাঁর রাজনীতি কে উপলব্ধি করা ও সেই রাজনীতি দিয়ে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকদের, শ্রমিকদের ও খেটে খাওয়া মানুষদের জাগিয়ে তোলা, তাঁদের আসল শত্রু ও আসল মিত্রের পরিচয় করানো যাতে নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মহাসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সাম্প্রদায়িক ও নানা জাতির এক অভিনব ঐক্য গড়ে উঠতে পারে। চারু মজুমদার মধ্যগগনে বিরাজমান দীপ্ত সূর্যের মতন প্রখর আলো ছড়িয়ে আমাদের পথ দেখাচ্ছেন। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ও তার দোসর নানা রঙের সংশোধনবাদী জোকাররা যখন আজ হাত দিয়ে সূর্যের আলো কে রোধ করে আমাদের হতাশা ও অবসাদের অন্ধকারে ঠেলতে চাইছে তখন চারু মজুমদারের মতন চিৎকার করে মাও’র বিখ্যাত উক্তি বলুন: বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে