রাজস্থানে হিন্দুত্ববাদীর দ্বারা বাঙালি মুসলিম শ্রমিকের নৃশংস হত্যার জবাব কি হবে?

রবিবার, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭ 0 Comments A+ a-


যে বাতাসে বিগত ২৫ বছর ধরে ভেঙে পড়া বাবরি মসজিদের সুড়কির ধুলো ভেসে বেড়াচ্ছে সেই বাতাসে দীর্ঘ দিন ধরে লালিত পালিত হয়ে ওঠা যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশই যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ নিয়ে চলবে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই ছিল না, কারণ এই বিষাক্ত চিন্তাধারার মানুষ সৃষ্টি করার কর্তব্য বর্তেছিল আরএসএস ও তার বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী গণসংগঠনের উপর, যার মধ্যে প্রধান হলো বিজেপি। সেই বিষাক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের মধ্যে অনেকের শিরায় উপশিরায় এখনও ঘৃণার গরলের স্রোত বয়ে চলেছে এবং সেই স্রোত কে চাঙ্গা করার জন্যে মোদী সরকারের বদন্যতায় আজ আরএসএস, বিজেপি সহ সকল হিন্দুত্ববাদী শক্তি তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টার ফলেই দেখা গেল রাজস্থানের রাজসামান্দে শম্ভুলাল রাগীর নামক এক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট দুষ্কৃতী তাঁর ১৫ বছর বয়স্ক ভাগ্নের সাহায্যে কি রকম নির্মম ভাবে আফরাজুল শেখ নামক এক বাঙালি শ্রমজীবিকে হত্যা করেছে। শুধু হত্যাই নয় সমস্ত ঘটনার ভিডিও রেকর্ডিং করিয়ে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমত বুক ফুলিয়ে প্রচারও করেছে শম্ভুলাল ও তার হিন্দুত্ববাদী সাগরেদরা। আফরাজুলের আকুতি বিনতি কে অগ্রাহ্য করে তাঁকে কি নির্মম ভাবেই না গাঁইতি দিয়ে আঘাত করে করে মাটিতে ফেলে তারপরে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, তা আজ ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষ ইন্টারনেটের সাহায্যে দেখেছেন। আর তাঁরা দেখেছেন শম্ভুলাল কে ক্যামেরার সামনে এসে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ কে ধমক দিতে, “লাভ জেহাদের” মতন আরএসএস-সৃষ্ট ঘৃণার রাজনীতির ফর্মুলা কে ব্যবহার করে নিজের ঘৃণ্য অপরাধ কে এবং নিজ হীনমনস্কতা কে মহান করে দেখাবার প্রচেষ্টাও চোখে পড়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ বছর পরে, মোদী-অমিত শাহের হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের শাসনকালে এর চেয়ে ভালো আর কি দেখতে চাইবেন?


শম্ভুলাল রাগীর আফরাজুল শেখ কে কেন হত্যা করলো? কি এমন তাঁর রাগ ছিল আফরাজুলের মতন এক দিন-আনি-দিন-খাই শ্রমজীবি মানুষের সাথে যে তাঁকে এত নৃশংস ভাবে হত্যা করা দরকার হয়ে পড়লো? শম্ভুলাল রাগীর এর অভিযোগ অনুসারে আফরাজুল শেখ নাকি একজন লাভ জেহাদি, যে নাকি মহিলাদের সাথে বিয়ে করে তাঁদের মুসলিম বানাবার ষড়যন্ত্র চালায়। এই অভিযোগের সপক্ষে যেমন শম্ভুলাল রাগীর কোন প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করেনি, ঠিক তেমনিই, বেশ জোর গলায় এই অভিযোগ কে মিথ্যা বলে খন্ডন করেছেন আফরাজুলের পরিবার। রাজস্থানে আফরাজুল শেখের সঙ্গে থাকা তাঁর জামাইয়ের ভাষায় - বিড়ি খাওয়া ছাড়া তাঁর আর কোন দোষ ছিল না এবং দ্বিতীয় বিয়ে তিনি কোনদিনই করেননি। শম্ভুলাল রাগীর বা ওর আরএসএস এবং বজরং দলের নেতৃত্ব অবশ্য সংবাদ কে অগ্রাহ্য করেন এবং তাঁরা বেশি ভরসা করেন বিজেপির দ্বারা পেটোয়া সংবাদ মাধ্যম কে ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যার বেসাতির উপর। আর যদি কেউ কোন মেয়েকে বা ছেলে কে ভালোবেসে বিয়ে করেন, এবং সেই মেয়ে বা ছেলে নিজ ইচ্ছায় নিজের ধর্ম পরিবর্তন করেন, তার জন্যে শম্ভুলালের মতন লোকেদের মানুষ মারার অধিকার কোন আইন দিয়েছে তার জবাব দেওয়ার দায়ও হিন্দুত্ববাদী শিবির নিজ ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলেছে।


মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে বারবার করে এই ঘৃণ্য অপরাধের কারণ হিসেবে শম্ভুলালের বক্তব্যের থেকে “লাভ জেহাদ” কে তুলে ধরছে। “লাভ জেহাদ” এর তত্ব আবিষ্কার করেছিল উত্তর প্রদেশের মসনদে আসীন যোগী আদিত্যনাথ, যখন সে শুধুমাত্র গোরক্ষনাথ মঠের প্রধান পুরোহিত হওয়ার সৌজন্যে বিজেপির টিকিটে সাংসদ ছিল এবং হিন্দু যুব বাহিনী নামক একটি জঙ্গী সংগঠন কে পরিচালনা করতো। সেই হিন্দু যুব বাহিনী সমগ্র পূর্ব উত্তরপ্রদেশে ২০০৭ সাল থেকেই বজরং দলের সাথে হাত মিলিয়ে ভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক কে ভাঙতে জঙ্গী আক্রমণ শুরু করেছিল এবং সেই আক্রমণ কে জনতার সামনে রাজনৈতিক ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার জন্যে যোগী আদিত্যনাথ লাভ জেহাদ তত্বের আমদানি করে। এই লাভ জেহাদের ফর্মুলাটা মস্তিস্ক প্রসূত করার মতন মস্তিষ্কের অধিকারী যোগী আদিত্যনাথ নয় বলেই তাঁকে নাৎসি জার্মানির থেকে ইহুদি বিদ্বেষের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি বিশেষ ধরণের প্রোপাগান্ডা কে ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে নকল করতে হয়। নাৎসিদের প্রচারে জোর দেওয়া হয় যে ইহুদিরা জার্মানির বুকে, তথা সমগ্র ইউরোপের বুকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠার জন্যে আর্য ইউরোপীয় মেয়েদের ফুসলিয়ে বিয়ে করে ধর্মান্তিকরন করছে। এই কুযুক্তির পক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ যেমন সেদিন নাৎসি পার্টি বা হিটলার দিতে পারেনি তেমনি এই গুজবমূলক প্রচারের পক্ষে আজ অবধি কোন বাস্তব-ভিত্তিক প্রমাণ যোগী আদিত্যনাথ এবং তাঁর দল দিতে পারেনি। কিন্তু প্রমাণ দিলে তো আর গল্পের গরু গাছে উঠবে না আর এখানে তো সংঘ পরিবারের পবিত্র গরু মাতাকে গাছে তুলে মই নিয়ে পালাতে হবে, তাই সংঘ পরিবারের দাঙ্গাবাজেদের প্রথমে মগজে না ঢুকলেও যোগী আদিত্যনাথ কিন্তু লাভ জেহাদ নিয়ে প্রচার তুঙ্গে তোলেন। ২০১৩ সালে এই লাভ জেহাদ ও "হিন্দু মেয়েদের উপর মুসলিমদের ঘৃণ্য নজরের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে দুই ভাইয়ের প্রাণ গিয়েছে" এই অজুহাত তুলে যখন আরএসএস ও বজরং দল মুজফ্ফরনগরে মুসলিম নিধন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত করে এবং ২০১৪ সালে সেই দাঙ্গার মুনাফা হিসেবে সমস্ত উত্তরপ্রদেশে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে বিজেপি, ঠিক তখনই লাভ জেহাদ ও যোগী আদিত্যনাথের কদর বোঝে আরএসএস ও বিজেপি এবং এর ফলেই আজ নরেন্দ্র মোদীর উত্তরসূরী হিসেবে যোগী আদিত্যনাথ উঠে এসেছে।


সেই লাভ জেহাদ কে যখন তখন ব্যবহার করে যে কোন ভিন্ন ধর্মের যুগলের প্রেমের সম্পর্ককে ভেঙে দিতে বা সেই যুগল কে নৃশংস ভাবে হত্যা করতে আরএসএস ও বজরং দলের কর্মী ও নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, টাকা যেহেতু আদানি আর আম্বানি এবং তাঁদের মালিক - বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির-মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলোর থেকে আসে সেহেতু এই ধরণের আক্রমণের কোন শেষ নেই এবং সারা দেশজুড়ে আরএসএস ও বজরং দল বুক বাজিয়ে, রাষ্ট্র যন্ত্রের আশীর্বাদধন্য হয়ে লাভ জেহাদের উপর মিথ্যার বেসাতি নিয়ে ব্যবসা করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ইজরায়েল ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অর্থে এবং রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে বলীয়ান হয়ে দাঙ্গার বীজ রোপনকারী হিন্দু সংহতিও সেই একই প্রচার কে তুঙ্গে তুলে প্রেমের বিরুদ্ধে, ভিন্ন ধর্মালম্বী যুগলদের বিরুদ্ধে আক্রমণ নামিয়ে আনছে। এর সাথে আবার যুক্ত রয়েছে গো-রক্ষার নামে মুসলিমদের হত্যা করার কর্মসূচী, ফলে এই কর্মসূচীগুলি সফলতার সাথে পূর্ণ করে আরএসএস ও বজরং দলের শীর্ষ পদগুলোয় উন্নত হয়ে মোটা টাকা কামানোর এবং সুযোগ বুঝে বিজেপির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে আরও অর্থ আয় করার লোভে প্রচুর সংখ্যক উচ্চ জাতির কর্মহীন ও লুম্পেন শ্রেণীর হিন্দু যুবকেরা গো-বলয়ের রাজ্যগুলিতে নানা ধরণের ফ্যাসিস্ট হিংসার ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে এবং যেহেতু এই ঘটনাগুলি একের পর এক জায়গায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পক্ষে সুচারু ভাবে কাজ করছে তাই বিজেপি সরকার দুই হাত তুলে এই ঘটনাগুলোকে সমর্থন করছে এবং দোষীদের নানা কায়দা করে, আইন কে ভেঙে আর মুড়িয়ে, জেল থেকে বা পুলিশের কবল থেকে বের করে আনছে। সার্বিক ভাবে দেখতে গেলে যেহেতু পুলিশ-মিলিটারি-আইন আদালত ও আমলাতন্ত্রের সর্ববৃহৎ অংশটি হলো হিন্দুত্ববাদী-ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসী তাই বিজেপি সরকার কেস হালকা নাও যদি করে, রাষ্ট্র নিজের মালিকের শ্রেণীস্বার্থ পূর্ণ করতে এই দাঙ্গাবাজ ও খুনি-সন্ত্রাসী হিন্দুত্ববাদীদের কোনদিন শাস্তি দেবে না।


রাজস্থানে এই বছরে, বিগত নয় মাসে চারটি লিঞ্চ কিলিং এর ঘটনা হয়েছে এবং শুধু মাত্র ৬ই ডিসেম্বরেই তিন জন মুসলমানের উপর রাম মন্দিরের দাবি নিয়ে ফ্যাসাদ পাকানো আরএসএস এর কর্মীরা আক্রমণ করেছিল। এরই মধ্যে আফরাজুলের শেখ কে নৃশংস ভাবে হত্যা করে তার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া ও হোয়াটস্যাপ দ্বারা প্রচার শুরু করে হিন্দুত্বের বীর পুঙ্গব শম্ভুলাল রাগীর। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পরে সারা দেশে এবং প্রচারিত হতে থাকে বার বার, যাতে সবাই দেখে বিজয়ী হিন্দুত্ব কি করে মুসলিমদের কুপিয়ে শেষ করতে চায়, হিংস্র নেকড়ের পালের চেয়ে বেশি পাশবিক হয়ে কি ভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চায় সংখ্যালঘু ও দলিত জাতির মানুষ কে। এই ভিডিও দেখে যেমন প্রতিবাদ ও নিন্দায় ফেটে পড়েছেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ, ঠিক তেমনি করেই ভারতে ও ভারতের বাইরে বসবাসকারি সংখ্যালঘু উঁচু জাতের হিন্দু ধনী ও মধ্যবিত্তের একটা অংশ বিনা সঙ্কোচে তাঁদের উল্লাস প্রকাশ করেছে এই ভিডিও দেখে। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও আরএসএস এর শাখায় খাকি নেংটি পরিহিত, সবে হিন্দি বলা শিখে বাংলা ভুলে যাওয়া কিছু সাবর্ণ ভদ্রলোকেরাও “ছোটলোক” মুসলিমদের, যাদের তারা “কাটা” বা “কাটোয়া” বলে ডাকতে অভ্যস্ত, এহেন ভাবে মরতে দেখে নিজেদের উল্লাস গোপন রাখতে পারেনি। আরএসএস এর টাকায় চালানো ইন্টারনেটে গিয়ে বারবার বুক বাজিয়ে ঘোষণা করেছে যে এবার সব মুসলিমদের সাথে এই ব্যবহারই করতে হবে।


কি আছে শম্ভুলাল রাগীরের ভিডিওতে, যে ভিডিও রেকর্ড করতে সে নিজের ১৫ বছরের ভাগ্নে কে সাথে করে নিয়ে গেছিল মুসলিম নিধনের মতন পবিত্র কর্তব্যে সামিল হতে? মালদার কালিয়াচকের থেকে রাজস্থানে গিয়ে ২০ বছর ধরে দিন মজুরের কাজ করা আফরাজুল শেখ কে একটা কাজের টোপ দিয়ে শুনশান, জঙ্গলের মতন জায়গায় নিয়ে আসে শম্ভুলাল রাগীর। তারপরে কাজের জায়গা দেখাবে বলে আফরাজুল কে একটু এগিয়ে যেতে বলেই পিছন থেকে গাঁইতি দিয়ে আঘাত করা শুরু করে শম্ভুলাল রাগীর। হতচকিত হয়ে আহত আফরাজুল চিৎকার করে জানতে চায় যে সে কি দোষ করেছে যে তাঁকে সম্পূর্ণ অচেনা শম্ভুলাল মারছে? কাকুতি মিনতি করতে শুরু করে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠা বাঙালি আফরাজুল, কারণ রাজস্থান তাঁর দেশ না, সেখানে আফরাজুলের পক্ষে কেউ দাঁড়াবার নেই, মালদায় আছে স্ত্রী ও তিন কন্যা, যার মধ্যে এক ষোড়শী এখনো ইস্কুলে পড়ে। তাই ভূমিপুত্রের রুদ্র মূর্তি দেখে প্রতিরোধ না করে হাত জোর করে মালদার টানে, মাগ্গে, মাগ্গে বলে চেঁচায় আফরাজুল। “ও বাবু মেরো না গো”। “ও বাবু বাঁচাও” - বলে আকুতি করতে থাকে আফরাজুল। এক মুহূর্তের জন্যে ক্ষতবিক্ষত আফরাজুল চেপে ধরে ঘাতকের গাঁইতি, সে ভাবে হয়তো কোন ভুলের জন্যে, কোন দোষের জন্যে সে শুধু মার খাচ্ছে, কারণ তাঁর ঘাতক তখনো নিশ্চুপ। এর পরেই শম্ভুলাল রাগীর কেড়ে নিতে চায় গাঁইতি কিন্তু পেরে ওঠে না আর তাই সজোরে লাথি মারতে মারতে বলে ওঠে আফরাজুলকে যে গাঁইতি ছাড়তে, ও আফরাজুলকে মারবে না। সেই আশ্বাসে গাঁইতি ছেড়ে দেয় আফরাজুল শেখ আর তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তাঁকে গাঁইতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে শম্ভুলাল রাগীর নামক হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী। তখনো বোধহয় দেহে প্রাণ ছিল আফরাজুলের তাই ঝটিতে গিয়ে একটা দা এনে মাথায় কোপ মারে আরএসএস এর সৃষ্ট ভারত মাতার বীর সন্তান সাজা, ভারতীয় সংষ্কৃতির ধ্বজ্জাধারী ভেড়ুয়া ভন্ডটা। ভিন রাজ্যের মাটিতে আফরাজুল তখন প্রায় ৯০ শতাংশ প্রাণহীন। একটা গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আর লাভ জেহাদিদের কি পরিণাম হবে বলতে বলতে সেই গোঙাতে থাকা প্রায় মৃত আফরাজুলের শরীরে এক বোতল জ্বালানি তেল ঢালে শম্ভুলাল, তারপর আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ভাষণ চলতে থাকে জেহাদিদের বিরুদ্ধে; পুরানো সিনেমার ফ্লপ নায়কের মতন পোশাক পরিহিত খুনিটার ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল বোধহয় পাকিস্তান যাচ্ছে যুদ্ধ করতে। পরে সে ভুল ভাঙ্গে, মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ অবধি হয় তেমনি হিন্দুত্ববাদীদের দৌড় ওই মন্দির অবধি আর “মন্দির ওয়াঁহী বানায়েঙ্গে” গোছের পাঁয়তারা মারার মধ্যেই সীমিত থাকে চিরকাল।


বাংলার মাটির থেকে রুজির টানে সুদূর রাজস্থানের মেওয়ার অঞ্চলে গিয়ে শ্রম বিক্রি করে খাওয়া আফরাজুল শেখের তখন গোঙানি আর শোনা যাচ্ছে না, বরং আগুনের ফাটফাট শব্দে যখন তাঁর চামড়া জ্বলছে তখন হয়তো চিরতরে শ্রমজীবন থেকে অবসর নিলেন খেটে খাওয়া তিন মেয়ের বাপ। দেশদ্রোহী মুসলমান তো তাই বীর পুঙ্গব রাজপুত আর মেওয়ারিদের মতন শিশু কন্যা কে দুধে ডুবিয়ে বা নুন খাইয়ে মারতে পারেননি। মারতে পারলে, বৌ কে সতী বলে জীবন্ত জ্বালালে বা খেটে না খেয়ে শম্ভুলালের মতন বেকার হয়ে বসে থেকে আরএসএস এর টাকায় দিনযাপন করলে হয়তো আফরাজুল কে মরতে হতো না। আর মরতে হতো না যদি আফরাজুল শেখ শম্ভুলালের মতন ভয়ানক বদমায়েশের কাছে কাকুতি-মিনতি না করে লড়াই করতে পারতেন। যদি গাঁইতি কেড়ে পাল্টা আক্রমণ করতে পারতেন। তাহলে কাহিনী পাল্টে যেত, হয়তো বা মুসলিমদের আবার সন্ত্রাসী বলে জঘন্য শেয়াল কান্না কাঁদতো নরেন্দ্র মোদী ও তার পঙ্গপালের দল, কিন্তু তবুও একটি নিরীহ মানুষের জীবন বেঁচে যেত। শম্ভুলাল রাগীর আবার খুব চালাকি করে এমন একজন মুসলিমকে খুঁজে বের করেছে যে রাজসামান্দ এলাকায় বহিরাগত। সেই এলাকার ৯৭ শতাংশ হিন্দুদের অত্যাচারে চিরকাল মাথা নিচু করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকেন চরম দরিদ্র মুসলিম জনগণ। এর মধ্যে আবার বহিরাগত হলে তো আর কথাই নেই, যে কোন কারণেই বহিরাগতদের ধরে পেটানোর লাইসেন্স রাজস্থানের সরকার স্থানীয় উঁচু জাতের হিন্দুদের দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে বাঙালি মুসলিমদের অবস্থাটা আরও শোচনীয় কারণ তাঁদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে। দিল্লী, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে কথায় কথায় বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং তাঁদের উপর সন্ত্রাসবাদের, জাল নোট পাচারের এবং চোরাচালানের মিথ্যা কেস দিয়ে তাঁদের জেল বন্দি করে এবং তাঁদের সকল ধরণের সচিত্র পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলে। ফলে গরিব মানুষগুলির, যাঁদের অশিক্ষার ফলে এটুকুও জানা নেই যে আইডি কার্ডের নাম্বার কোথায় থাকে, তাঁদের নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই ভয়টা আফরাজুলের মধ্যেও ছিল এবং তিনি তাই সাতে-পাঁচে থাকতে পছন্দ করতেন না।


তবে যেহেতু তিনি মুসলিম, তায় আবার বহিরাগত বাঙালি মুসলিম; শ্রেণীগত ভাবে সবে ছোট ছোট প্রকল্পে শ্রমিক সরবাহ করে দরিদ্র থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যায়ে ওঠা শুরু করেছিলেন, তাই শিকার হিসেবে তাঁকেই চিহ্নিত করে শম্ভুলাল রাগীর। সাথে সাথে গড়ে তোলে একটি কাহিনী, তার পাড়ার একটি মেয়ের মালদায় কোন মুসলিম বাঙালির সাথে পালিয়ে যাওয়ার গল্প, যাতে লাভ জেহাদের যে গল্প তাকে আরএসএস আর বজরং দলের নেতারা শিখিয়ে দিয়েছে তা সে ক্যামেরার সামনে আওড়াতে পারে ঠিক করে। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা কখনোই কোন শক্তিশালী, লড়াকু এবং টক্করের মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে না কারণ সেটা করতে গেলে লড়াই করার হিম্মত দরকার হয় আর সফট টার্গেট বা নরম নিশানার লাভ হলো যে এই লোকেরা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন না তাঁদের শারীরিক বলের অভাবে বা ঘটনার আকস্মিকতায় চকিত হয়ে যাওয়ার ফলে। যে মুহূর্তে আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদীদের এহেন নরম নিশানার শিকারেরা ভীত হয়ে ওঠে ঠিক তখনই আক্রমণকারীদের মনে বল ফিরে আসে।  যে হীনমন্যতার থেকে আক্রমণ সানায় এই হিন্দুত্ববাদীরা, যাঁদের জীবনের ঘৃণার প্রাথমিক হাতেখড়ি নিজেদের বাড়ির থেকেই হয়,যে মুসলিম বিদ্বেষের শিক্ষা এরা নিজের বাপ-ঠাকুর্দার কাছে পায়, সেই হীনমন্যতা কে পরিপুষ্ট করে এক একটি সফল অপারেশন করে, এক একটি মহম্মদ আখলাক, পেহলু খান, জুনেদ বা আফরাজুল শেখের মতন নিরীহ মুসলিমেরা, যাঁরা তাঁদের নিজ জীবনে কোনদিন রুখে দাঁড়াতে শেখেননি, বরং যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা ব্রাক্ষণত্ববাদী-সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সামনে মাথা নত করে থেকে তাঁরা মাথা উঁচু করা ভুলে গেছেন এবং হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের সাথে কোন লড়াই করার সাহস দেখাতে পারেন না, সেই রকম মানুষদের খুন করে। এই সামন্ততান্ত্রিক গোলামীর মানসিকতার ফলেই এই উপমহাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আফরাজুল শেখ পাল্টা লড়াই করতে পারেননি কারণ তিনি ঝামেলা চাননি এবং চেয়েছিলেন শুধু বাঁচতে। সেই সুযোগ কোনদিন মাগনায় শম্ভুলাল রাগীর দিত না।


কি কারণে শম্ভুলাল রাগীর আফরাজুল শেখ কে হত্যা করে? সেটা বুঝতে গেলে আমাদের দেখতে হবে যে শম্ভুলাল রাগীর আসলে কে? আসলে শম্ভুলাল রাগীর একজন স্বল্পশিক্ষিত মানুষ যার বাস রাজসামন্দের রাগীর কলোনিতে। খানায় খন্দে ভরা, মশা ও মাছির উপদ্রবে কাহিল নিম্নবিত্ত এই কলোনিতে জাতিগত ভাবে পিছিয়ে থাকা রাগীরদের বাস এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এই অঞ্চলের বাতাসে মিশে আছে। বিগত তিন দশকের উপর এই অঞ্চলে আরএসএস তার শাখা চালায় এবং সেই শাখায় শম্ভুলাল রাগীরের মতন স্বল্প শিক্ষিত নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেদের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের ট্রেনিং দেওয়া হয়। ছোট বয়স থেকেই বাচ্ছাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষাক্ত চিন্তা ঢোকানো হয়, হিন্দুত্বের এক মনগড়া, সোনালী ইতিহাসের গল্প শুনিয়ে মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার বীজ শিশু মননে প্রোথিত করানো হয় যাতে ভবিষ্যতে সেই বীজ ফুটে এক বিষবৃক্ষের জন্ম হয় যা আরএসএস কে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।


শম্ভুলাল রাগীর এমন এক পরিবেশে বড় হওয়া মানুষ, যার তিন কন্যা সন্তান আছে এবং যার মধ্যে একটি মানসিক ভারসাম্যহীন। বেশ কয়েক বছর ধরে বজরং দল ও আরএসএস এর সাথে শম্ভুলাল রাগীরের ঘনিষ্টতা বাড়ে, এবং নরেন্দ্র মোদীর হিংসাত্মক রাজনীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শম্ভুলাল রাগীর বেশি বেশি করে হিন্দুত্ববাদী প্রচারের কাজ করা শুরু করে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে শম্ভুলাল রাগীরের ধুঁকতে থাকা মার্বেলের ব্যবসা নোটবন্দির ফলে বন্ধ হয়ে গেলেও নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির প্রতি আস্থা আরও বেড়ে যায় শম্ভুলাল রাগীরের। স্থানীয় ভাবে আরএসএস ও বিজেপির থেকে প্রচুর টাকা আয় করে রাগীর এবং বজরং দলের লাভ জেহাদ নিয়ে প্রচারের কাজেও শম্ভুলাল রাগীর কে পাওয়া যায়। এই ঘটনার থেকে আঁচ করা যায় যে স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরাই শম্ভুলাল রাগীর কে কোন দুর্বল ও সাধারণ মুসলিম কে খুঁজে খুন করে ভিডিও বানাতে বলে। যেহেতু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারিগর থেকে ২০০২ সালের গুজরাটের নরমেধ যজ্ঞের হোতারা আজও বহাল তবিয়তে ঘুরছে, রাজনৈতিক সাফল্যের মগডালে বসে আছে, যেহেতু মোহাম্মদ আখলাক থেকে পেহলু খান বা জুনেদের আততায়ীরা আজও বাইরে কলার তুলে ঘুরছে, তাই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের আদর্শে পরিচালিত ভারতের আইনের কোন ভয় শম্ভুলাল রাগীরের ছিল না। সেই জন্যে অবলীলায় আফরাজুল শেখ কে হত্যা করে মন্দিরে গিয়ে ভাষণ দিয়ে সে একেবারে ছকে বাঁধা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজেকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। শাস্তি নিয়ে সে চিন্তিত ছিল না দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, আশ্বাস অনেক উপর থেকেই এসেছিল বোধহয়, বলা হয়েছিল যে রাষ্ট্র যন্ত্র যখন হিন্দুত্ববাদী শক্তির কুক্ষিগত তখন আর শম্ভুলাল কে মারে কে?


রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার সকল ধরনের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের মদত দিয়ে এসেছে। এই রাজ্যেই পদ্মাবতী সিনেমার বিরুদ্ধে রাজপুত সম্প্রদায়ের জোতদার জমিদারদের দাঙ্গা করতে দেওয়া হয়েছে, এই রাজ্যের ইস্কুলের ইতিহাসে রানা প্রতাপ কে হলদিঘাটির যুদ্ধে বিজয়ী হিসেবে দেখানো হয়েছে, ইস্কুলের শিশু-কিশোরদের হিন্দুত্ববাদী মেলায় নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেখানে বজরং দলের ভাড়াটে গুন্ডারা কচি বয়সের ছেলে মেয়েদের লাভ জেহাদ নিয়ে বুঝিয়েছে, মুসলিম সম্প্রদায় কে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে আর মানুষের চেয়ে বেশি গরুকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। সেই গরু কে, যে গরু কে মানুষখেঁকো গরুতে পরিণত করেছে নরেন্দ্র মোদী’র বিজেপি সরকার। এহেন রাজস্থানের মাটিতে যদি কেউ হিন্দুত্ববাদী ঝাণ্ডা তুলে কোন অপরাধ করেন, মানুষ কে হত্যা করেন, নারীকে ধর্ষণ করেন, তাহলে শুধুই যে সেই অপরাধীদের সাত খুন মাফ হবে তাই নয়, বরং সেই লোকেদের মাথায় তুলে নেচে বিজেপি ভোট বাক্সে বা ইভিএম যন্ত্রে হিন্দুত্ব মেরুকরণের ফায়দা লুটবে। এই হলো রাজস্থান, যে রাজ্যের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের অর্থের যোগান দেয় মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ, ইজরায়েল এর খুনি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ আর বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন বৃহৎ কর্পোরেশনগুলো এবং তাদের ভারতীয় মুৎসুদ্দি দালালরা। এই অর্থেই ভরণপোষণ করা হয় শম্ভুলাল রাগীরের মতন ঘৃণ্য কীটদের, যারা ভারতের শাসক শ্রেণীর স্বার্থে দেশের প্রান্তে প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হিংসার মাধ্যমে জনগণের মধ্যেকার ঐক্য কে ভেঙে দিচ্ছে, যাতে মোদী সরকারের জন-বিরোধী চক্রান্তগুলোর বিরুদ্ধে, নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা ভারতবর্ষ কে বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর কাছে, ওদের ভারতীয় দালাল আদানি ও আম্বানিদের কাছে টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা সম্ভব হয় এবং জনগণ প্রতিরোধের পথে এগোতে না পারেন। আর এই হত্যালীলা কে বন্ধ করার, এই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পের থেকে দেশ ও দেশের খেটে খাওয়া মানুষ কে মুক্ত করার সংগ্রাম আজও গড়ে উঠতে পারছে না, কারণ যাঁরা আজ জনগণের নেতা সেজে বসেছেন তাঁরা আজও জনগণ কে রাষ্ট্রীয় নিয়মতান্ত্রিকতার শেকলে বেঁধে রাখছেন। তাঁরা মানুষ কে সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে শুধুই কথার মারপ্যাঁচ কষে মানুষের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ওঠা রাষ্ট্র যন্ত্রের প্রতি মানুষ কে ফের আস্থাবান করার চেষ্টা করছে। আর বিরোধী শক্তির এই বেইমানির ফলে, এই ধরণের ভোঁতা আন্দোলনের ফলে আজ রাজস্থানের পুলিশ ও রাষ্ট্র যন্ত্র শম্ভুলাল রাগীর কে মানসিক ভারসাম্যহীন হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে যাতে সে তাড়াতাড়ি জেল থেকে ছাড়া পায় এবং আবার ফিরে যায় আরএসএস এর সংগঠনে।


এই হিংসা, এই নৃশংস নরসংহার, এই ঘৃণ্য রাজনীতি ও সায়েদপুরের গ্রামে আফরাজুলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে যে ভাবে তাঁর স্ত্রী ও মেয়েরা কেঁদে কেঁদে আকুল হচ্ছে তা দেখে, মাড়োয়ারি ও গুজরাটিদের থেকে চাঁদা নিয়ে পার্টি চালানো তৃণমূল-সিপিএম বা জাতীয় কংগ্রেসের মতন দলগুলি যে ভাবে রাজস্থানী ও গুজরাটি বেনিয়াদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে তা দেখে প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি বেশি করে বিশ্বাস হচ্ছে যে ভারতের আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পূর্ণ রূপে, এবং সরকারি রূপে শুধু যে হিন্দুত্ব-করণ হয়েছে তাই নয়, বরং বর্তমান ভারতের মোদী সরকার তার প্রতিপত্তি দিয়ে এমন এক ব্যবস্থা সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে যে ব্যবস্থায় দেশের ৯০ শতাংশ ব্যবসা বাণিজ্য ও পুঁজির মালিক, বিশেষ করে বাংলার সিংহ ভাগ শিল্প ও বাণিজ্যের মালিক, মাড়োয়ারি ও গুজরাটি বেনিয়াদের দেশের মালিকের আসনে সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং তাঁদের পছন্দের ভাষা হিন্দি কে, তাঁদের নিরামিষাশী বৈষ্ণব খাদ্য অভ্যাস এবং তাঁদের সংস্কৃতি কে সমগ্র ভারতবর্ষের সমস্ত জাতি ও জনগণের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে।  যাঁরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন, গর্জে উঠবেন, যাঁরা এই সিদ্ধান্ত কে মানবেন না, রক্তচোষা মাড়োয়ারি ও গুজরাটি বেনিয়াদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন, তাঁদের কে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে ভারতের ভাঁড়দের দল আরএসএস খুন করাবে। এই মাড়োয়ারি-গুজরাটি বেনিয়া চক্রের ষড়যন্ত্রে সমস্ত জাতির মানুষের উপর উত্তর ভারতীয়, হিন্দি ভাষী, নিরামিষাশী, সাবর্ণ হিন্দু ধনিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হবে। এই একনায়কতন্ত্র কে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা সেই নেহরু আমল থেকে চলে আসছে আর বর্তমানে মোদী সরকার সারা দেশজুড়ে হিন্দুত্বের ঘৃণ্য রাজনীতি দিয়ে হিন্দু জাতির মানুষের মেরুকরণে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ায়, শম্ভুলাল রাগীরের মতন লক্ষ লক্ষ খুনি কে লালন-পালন করে তৈরি করায় সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যে আজ আর ১৯৬০’এর দশকের মতন কঠিন হবে না তা বলাই বাহুল্য। হীনমন্যতায় ভোগা সাবর্ণ বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে স্বচ্ছল ও অনেক আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ আজ জোরালো গলায় হিন্দুত্ববাদ কে সমর্থন করছে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বাস করে। তাঁরা আজ রাজস্থানের বজরং দলের গুন্ডা শম্ভুলাল রাগীরের হাতে বাঙালি আফরাজুলের মৃত্যু কে হিন্দু ধর্মযোদ্ধার হাতে দেশদ্রোহী এবং অধর্মী মুসলমানের মৃত্যু হিসেবে দেখছে এবং তাই এরা আজ নির্লজ্জের মতন আরএসএস এর এই খুনি বদমায়েশটাকে বাহবা দিচ্ছে। তপন ঘোষের মতন জঘন্য কীটগুলো পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মধ্যে সুপ্ত সাম্প্রদায়িক ঘৃণা কে কিভাবে বিষ দিয়ে ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়েছে তা আফরাজুলের মৃত্যুর পরে পশ্চিমবঙ্গে বাস করা বাংলা-ভাষী থেকে হিন্দি-ভাষী হতে চলা বরাহ-নন্দ’দের হাত তালি দেওয়া দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।


অনেকে প্রশ্ন তুলছেন এই ভয়াবহ হিংসার ছবি দেখে, শম্ভুলাল রাগীরের মতন এক হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদীর আস্ফালন দেখে, যে এর শেষ কোথায়? অনেকে চিন্তিত এই ভেবে যে এবার হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি সারা ভারত জুড়ে হয়তো ব্যাপক হারে মুসলিম নিধন শুরু করবে, ঠিক যেমন বর্মার বৌদ্ধ ফ্যাসিবাদী শক্তি রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ঠিক যেমন সার্বিয়ার বুকে, বা ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনের বুকে হাজার হাজার মুসলিম জনগণ কে রোজ বোমা ও গুলিতে মরতে হয়েছে বা হচ্ছে। ঠিক যেমন প্যালেস্টাইনের মাটিতে স্বাধীনতার জন্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়া আরব মুসলিম ও খ্রিস্টানদের কে জায়নবাদী ইজরায়েলি শক্তি গণহত্যা করে নিকেশ করেছে হয়তো সেই ভাবেই ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রধান, শ্বেত ফ্যাসিবাদের বর্তমান বিশ্বগুরু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাহায্যে কাশ্মীরের মাটিতে বৃহৎ আকারে গণ হত্যা চালাবে। হয়তো বা উত্তর প্রদেশ আর গুজরাটে বৃহৎ নরসংহারের মাধ্যমে জ্বালিয়ে মারবে কোটি কোটি মুসলিমদের। এই চিন্তা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষকে, সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত জনজাতির মানুষকে আজ ভাবিয়ে তুলছে, উদ্বেল করে তুলছে। সবার প্রশ্নের মূল বিষয় হলো যে এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে গেলে মানুষের কি করা উচিত ? কি ভাবে এই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ও নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের জীবন, জীবিকা ও জীবনযাপনের অধিকার কে রক্ষা করা যায়? কি ভাবে জন্ম ও ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের উপর যে আক্রমণ নেমে আসছে, যে ঘৃণার ও বঞ্চনার তাঁরা স্বীকার হচ্ছেন তাকে রোখা যায় কি করে? বিজেপি যদি একটি রাজ্যে বা কেন্দ্রে ভোটে হেরে যায় তাহলে কি শম্ভুলাল রাগীরের মতন শয়তানরা হেরে যাবে? তাহলে কি দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসা, বিদ্বেষ ও দ্বন্ধ চিরকালের মতন শেষ হয়ে যাবে? মোদী সরকারের পতন হলেই কি মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ থেকে শুরু করে আদিবাসী ও দলিত জনগণ সাবর্ণ হিন্দু সমাজের সাথে সমানতার ভিত্তিতে বাঁচার অধিকার পাবে? ভারত কি ২০১৯ এর নির্বাচনে মোদী কে হারিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা কে ভোট দেবে? রাষ্ট্র যন্ত্রের সকল কলকব্জা কি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে প্রাণপাত করে? আর শেষ অবধি কি বাবরি মসজিদ থেকে শুরু করে গুজরাটের মুসলিমদের গণহত্যা’র ঘটনার চেয়ে ব্যতিক্রম হয়ে শম্ভুলাল রাগীরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে ভারতীয় আইনে?


দুঃখের কথা হলো যে শেষের সকল প্রশ্নের উত্তরই হলো - না। ভারতবর্ষ কোন কালেই সংবিধান প্রদত্ত আদর্শে চলে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রের কোন মডেল গড়ে তোলার চেষ্টা করেনি, বরং একটি ঝুটো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কে আদর্শ ব্যবস্থা বলে জনগণ কে ৭০ বছর ধরে শুধু বোকা বানিয়েছে। কংগ্রেস থেকে বিজেপি, সিপিএম থেকে তৃণমূল, ভারতের শাসকশ্রেণী আম্বানি-আদানি-টাটা-বিড়লা-গোয়েঙ্কা প্রভৃতির মতন মুৎসুদ্দি দালাল পুঁজিপতিদের তল্পিবাহক। এরা নিঃশর্ত ভাবে সেবা করে ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের, তাদের মালিক - বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলোর, এবং এই দুইয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শক্তিশালী হয়ে গেঁড়ে বসে থাকা আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক জোতদার ও জমিদারদের। এই বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা আর জোতদার জমিদারেরা বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্বার্থ রক্ষার জন্যে ভারত কে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের নেতৃত্বে সেই ১৯৫০ এর দশক থেকে আনার চেষ্টা করছে এবং এই কেন্দ্রীয় শাসন গড়ে তোলার জন্যে এদের দরকার হলো এক নেতা, এক ধর্ম ও এক ভাষা। যদিও বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদী আজ ওদের এই কাজে সবচেয়ে নির্লজ্জ্ব ভাবে এবং সবচেয়ে ভালো ভাবে সেবা করছে, ১৯৪৭ সাল থেকে কিন্তু কংগ্রেস সরকার সেই একই কাজ গোপনে ও প্রকাশ্যে করে এসেছে। আজ যে তৃণমূল ও সিপিএম এর মতন দল নিজেদের বিজেপির বিকল্প বলছে, তারা কোন ভাবেই হিন্দুত্ব শিবিরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কোন প্রগতিশীল বিকল্প নয়, বরং প্রতিক্রিয়াশীলতায় তারা বিজেপিরই বিকল্প। ভারতের মানুষের কাছে আসল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বিকল্প রাজনীতি কে, যে রাজনীতি গরিব খেটে খাওয়া মানুষ কে দেবে বেঁচে থাকার অধিকার, কাজের অধিকার ও রোজগারের সুরক্ষা,যে রাজনীতি কৃষককে দেবে জমি, গরিব কে দেবে খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, সেই রাজনীতি কে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে একমাত্র তীব্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, গরিব মানুষের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে।


ভারতবর্ষের নানা ভাষা ও নানা সংস্কৃতির জনগণ কে যদি একটা জিনিস ঐতিহাসিক ভাবে এক করতে পেরেছিল তবে তা ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা যা ঔপনিবেশিক শাসনকালে জনগণের বৃহত্তম অংশ কে টেনে এনেছিল বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে। সেই মহান ঐক্য কে ধ্বংস করার স্বার্থে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন দুর্বল ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের সুযোগ তুলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে, বাংলা কে ভাগ করে এবং খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যে ঘুণ ধরানো শুরু করে, যার রেশ ধরে আজও নরেন্দ্র মোদী ভারতে শাসন করছে এবং পাকিস্তান ও  বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বর্তমানে যখন নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির স্রোতে গা ভাসানো শাসক শ্রেণীর পিট্টু মোদী সরকার বার বার নানা কায়দায় জনগণ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দেশ ও দেশের সম্পদ কে বেচে দিচ্ছে বৃহৎ বিদেশী পুঁজির কাছে। এই বিদেশী পুঁজির কাছে ভারতবর্ষ কে বন্ধক রেখে দেওয়ার মানে হলো যে দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ব্যাপক লুঠপাট ও সরকারি আমলাতন্ত্রের ব্যাপক হারে পকেটের ওজন বৃদ্ধি হওয়া। এই টাকা কামানোর সাথে সাথে ভারতের সরকার ও সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি লক্ষ্য রাখে যে ভারতের জনগণ যেন এই লুঠপাটের বিরুদ্ধে মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারেন আর তাই তাঁদের কে বিভক্ত রাখতে, একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে এদের কোন জুটি নেই। এই সকল দলগুলির মধ্যে একমাত্র বিজেপিই বর্তমানে শাসক শ্রেণীর লুঠপাটের স্বার্থে সবচেয়ে ভালো ভাবে জনগণ কে ধর্মীয় মৌলবাদের মাধ্যমে উস্কানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম এবং সেই দাঙ্গার সাহায্যে বিপুল ভাবে জনগণ কে মেরুকরণের মাধ্যমে নিজের কুক্ষিগত করতে ওস্তাদ। আর এই বিজেপি কে শাসক শ্রেণীর বানানো ভোট যন্ত্রেই যাঁরা হারাতে চাইছে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। ভোট বাক্স দিয়ে যদিও বা কোথাও বিজেপিকে হারানোও যায়, তবুও শম্ভুলাল রাগীরদের হাত থেকে আফরাজুল শেখের মতন গরিব মুসলিমদের বাঁচানো যাবে না।


ভারতের জনগণের উপর জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের আসল উৎস হলো গ্রামাঞ্চলে বিরাজমান আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদনের উপকরণের উপর মালিকানার ধরণ। ভারতবর্ষের ৭৫ শতাংশ কৃষকই হয় দরিদ্র ও না হয় ভূমিহীন কৃষক যাঁদের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটে অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে। দিন আনি দিন খাই এই লোকেদের উপর শাসন করে গ্রামাঞ্চলের ৫ শতাংশ জোতদার-জমিদার ও অন্যান্য ফোঁড়েরা। ধর্মীয় মৌলবাদের মূল কেন্দ্র কিন্তু ভারতের গ্রামাঞ্চলেই এবং এই গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে পরিযায়ী হয়ে যাওয়া মানুষেরাই এই ধর্মীয়  মৌলবাদের বীজ কে সেখানে রোপন করেন এবং কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট ভারতের মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সাথে এই ধর্মীয় মৌলবাদের মেলবন্ধন ঘটান। সামন্ততন্ত্রের থেকে উৎপত্তি হওয়া ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের নিকেশ করা যায় তাই একমাত্র ভারতের বুক থেকে সামন্ততন্ত্রকে চিরকালের মতন ঝেঁটিয়ে সাফ করে এবং ভারতের অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লড়াই কে পূর্ণ করে। এই লড়াই ভোটের বাক্সে নয় বরং লড়া হবে ক্ষেতে-খামারে, কল কারখানায়, পথে ঘাটে এবং সমস্ত জায়গায় যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি কে দেখা যাবে। এই লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য হবে গ্রামাঞ্চলে সামন্ততন্ত্র কে উচ্ছেদ করে সেই জায়গায় এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কে প্রতিষ্ঠিত করা। আর সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কে প্রতিষ্ঠা করেই জনগণ কিন্তু ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী শক্তির, নরেন্দ্র মোদীর, আরএসএস ও বিজেপির শাসনের অবসান ঘটাতে পারবে, দেশের থেকে শম্ভুলাল রাগীরের মতন ভয়ানক ভাবে বিকৃত ফ্যাসিস্টদের অস্তিত্ব কে মুছে দিয়ে মানুষকে দিতে পারবে ঐক্য, শান্তি ও প্রগতির পরিবেশ। যে পরিবেশে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-শিখ-জৈন-পার্সি-বৌদ্ধ সকলকেই দেওয়া যেতে পারে সুস্থ ভাবে এবং সুরক্ষিত ভাবে জীবন যাপনের সুযোগ। আর এই আগামীকালের সম্ভাবনা কিন্তু সুপ্ত রয়েছে আমাদের নিজেদের মধ্যেই, ব্যাস একটু চেষ্টা করলেই, একটু কঠিন পরিশ্রম করলেই এবং নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর থাকলেই কোন শক্তি মানুষ কে ভারতবর্ষের মাটিতে প্রগতির মশাল জ্বালানোর থেকে বিরত করতে পারবে না। একমাত্র কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ফ্যাসিবাদ কে চিরকালের মতন এই দেশের মাটিতে কবর দেওয়া সম্ভব, একমাত্র কঠোর বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই সম্ভব এমন এক ভবিষ্যতের নির্মাণ করা যেখানে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হবে না, গুজরাটের মতন নরমেধ যজ্ঞ হবে না, যে দেশে আফরাজুলের মতন নিরীহ মানুষ কে গাঁইতির কোপ খেয়ে ও আগুনে জ্বলে কোন শম্ভুলাল রাগীরের হাতে মরতে হবে না, যে দেশে ক্ষুধার্থ শিশু কে রেশন কার্ড আর আধার কার্ডের সংযুক্তিকরণের অভাবের কারণে না খেয়ে যাতনায় ভাত-ভাত করে কেঁদে মরতে হবে না, যে দেশে কোন দানা মাঝিকে নিজের স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে করে বহন করে নিয়ে যেতে হবে না, আর যে দেশে সত্যি কথা লেখার দোষে কোন গৌরী লঙ্কেশ কে আততায়ী গুলি করে মারবে না।

সেই সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যে আকাশ থেকে কেউ পড়বেন না, ফেরেস্তা বা দেবদূত নামবেন না, কোন মহানায়কের জন্মও হবে না। এই মহান, ঐতিহাসিক ও জরুরী কর্তব্য আজ কাঁধে তুলে নিতে হবে আমার-আপনার মতন সকল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষদের। কারণ শ্রম দিয়ে যাঁরা পৃথিবীটি কে উন্নত এক গ্রহে পরিণত করেছেন, একমাত্র তাঁরাই পারবেন তীব্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীর থেকে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ কে, ধর্মীয় মৌলবাদ কে, মানুষের উপর মানুষের শোষণ ও অত্যাচার কে চিরকালের মতন শেষ করতে। তবে এই শেষ করার শেষ লড়াই কে তীব্রতর করতে, গণতন্ত্রের পক্ষে আমাদের স্লোগান কে তীক্ষ করে তুলতে আমরা যত দেরী করবো তত বেশি আফরাজুলের প্রাণ নরেন্দ্র মোদীর ভক্তদের হাতে যাবে, তত বেশি করে ভোটবাজ দালালেরা জনগণ কে ভোটের কানা গলিতে ঢুকিয়ে তাঁদের গণতন্ত্র’র থেকে, শ্রেণী সংগ্রামের থেকে দূরে ঠেলে রাখতে সক্ষম হবে। তাই বর্তমানের সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো এক মুহূর্তও নষ্ট না করে বৃহৎ সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্যে লড়াইয়ের ময়দানে তাৎক্ষণিক যোগদান। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ও সংগ্রামই আগামীদিনে এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের শাসনাধীন ভারতবর্ষ কে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, সকল জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সকল ধর্মের মানুষ কে সুরক্ষিত ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান করা এক নয়া গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে রূপান্তরিত করতে পারবো আর আফরাজুল শেখের মতন খেটে খাওয়া মানুষদের শম্ভুলাল রাগীরের মতন ফ্যাসিবাদী গুন্ডাদের থেকে রক্ষা করতে পারবো, মানবতা কে রক্ষা করতে পারবো।  

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে