মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় নয়া ফ্যাসিবাদের বিজয়

মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ০৬, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

(এই প্রবন্ধটা লিখেছিলাম ট্রাম্পের ভোটে জেতার পরেই কিন্তু মোদীর নোট বাতিলের ঘোষণার পরে এই লেখাটা প্রকাশ করতে পারিনি অন্যান্য লেখার চাপে। - লেখক ৬ই ডিসেম্বর ২০১৬)

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?

কুসুমকুমারী দাসের এই পংক্তিগুলো আজ মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় দেখে আবার মনে পড়ে গেল। আট বছর আগে এই রকমই এক নভেম্বরে, সারা মার্কিন দেশ জুড়ে এক উল্লাসের জোয়ার উঠেছিল। মিথ্যাবাদী, পরদেশ দখলকারী, যুদ্ধবাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চূড়ামণি ওয়াল স্ট্রিটের কর্পোরেশনগুলোর দালাল জর্জ বুশের পতন আর এক কৃষাঙ্গ স্পষ্ট বক্তা ও স্বপ্নের ফেরিওয়ালা বারাক ওবামার মার্কিন দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার উপলক্ষে সেদিন ছিল বিজয় উল্লাস। কৃষাঙ্গরা, অভিবাসী জনগণ, মেক্সিকো থেকে টানেল খুঁড়ে পেটের ক্ষিদে নিবারণ করতে আসা গরিব মেক্সিকানরা, মুসলমান সম্প্রদায় - এরা সবাই ভেবেছিল এবার এদের উপর জাতিগত, বর্ণগত, এবং আর্থিক শোষণের অবশেষ হবে, পুলিশি সন্ত্রাস নিকেশ হবে, এবং মার্কিন দেশ এক সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও ইনক্লুসিভ দেশ হয়ে উঠবে। বিগত আট বছর ধরে মার্কিন জনগণ দেখেছেন, খেটে খাওয়া মানুষ দেখেছেন, কৃষাঙ্গ-মেক্সিকান-মুসলমান সবাই দেখেছেন, কি ভাবে ধীরে ধীরে ওবামা তার কৃষাঙ্গ - গরিব দরদী - উদারতার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে আর এক যুদ্ধ বাজ, কৃষাঙ্গ হত্যাকারী, কর্পোরেট দালাল হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করে নিজের ভোট ব্যাঙ্ক সেই অসংখ্য গরিব মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কি ভাবে ইরাক থেকে সেনা সরানোর কথা ঘোষণা করে সেই ইরাকে আবার ইসলামিক স্টেট্ বা দায়েশ নামক ইসলামী সন্ত্রাসী বাহিনী কে ডলার আর অস্ত্র সরবাহ করে গড়ে তুলেছে মধ্য প্রাচ্যে মার্কিন সামরিক আধিপত্য কায়েম রাখতে, কি ভাবে সিরিয়ার সরকার কে উচ্ছেদ করতে ইসলামিক স্টেট্ ও আল কায়েদা ঘনিষ্ঠ সংগঠনগুলোকে স্বাধীনতা সংগ্রামী সাজিয়ে পাঁচ বছর ধরে ধীরে ধীরে সিরিয়াকে ধ্বংস করেছে, প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়েছে ও লক্ষ লক্ষ মানুষ কে উদ্বাস্তু করে ছেড়েছে সারা বিশ্বে।

সেই ওবামার সাথী আর মার্কিন শাসক শ্রেণীর খাস সমর্থক পরিবারের বধূ - হিলারি ক্লিন্টন তাই যখন নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বললো যে সে নাকি কর্পোরেট ও বড় বড় ব্যাঙ্কের সাথে লড়াই করে মার্কিন সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে তখন ফিক ফিক করে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন মানুষ। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থে ডেমোক্র্যাটদের বড় বড় বুলি, বার্নি স্যান্ডার্স এর সমাজতন্ত্রী ভাষণবাজি কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন তুলেছিল - তোমরা যদি এতই খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষপাতিত্ব করার দল তা হলে তোমাদের শাসনকালেই কেন পিষে মরতে হলো আমাদের ? নিজেদের ফাঁপা ও দেউলিয়া রাজনীতি দিয়ে ডেমোক্র্যাট দল জনগণ কে আর বোকা বানাতে পারেনি, আর সেই সুযোগটা নিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। সরাসরি ফ্যাসিবাদী রাজনীতি কে মার্কিন দেশের রাজনীতির শীর্ষে এত নগ্ন ভাবে বোধহয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কেউই আনতে পারেনি। ফ্যাসিবাদ চিরকালই শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভ কে কাজে লাগায় জাতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করে ক্ষমতার আলিন্দে প্রবেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গো-হারা হেরে যখন বিষাদ ও বিক্ষোভ জার্মানির পথে পথে বিরাজ করছিল আর সামগ্রিক ভাবে বলশেভিক বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ঠিক তখনই জার্মান জনগণের, জার্মান শ্রমিকদের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশের ক্ষোভ কে ধনী পুঁজিপতিদের থেকে সরিয়ে ইহুদিদের আর বামপন্থীদের দিকে নিক্ষেপ করাই ছিল হিটলারের ক্ষমতায় আসার চাবি কাঠি। এই ঘৃণার বাতাস পুঁজিপতিদের ঘাড়ের উপর ঝুলন্ত বলশেভিক বিপ্লবের খাঁড়াটা দূর করে দিয়েছিল আর হিটলার কে এনে দিয়েছিল জার্মান একচেটিয়া পুঁজির সার্বিক সমর্থন। আজ ডোনাল্ড ট্রাম্পও একশত বছর পরে সেই একই ধরণের পন্থা অবলম্বন করে নিজের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করছে মার্কিন দেশে আর এই কাজে তার সবচেয়ে বড় সমর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেমোক্র্যাটদের আর তথাকথিত মার্কিন উদারতাবাদীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা আর কর্পোরেট-ব্যাঙ্ক  রাজত্বের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত সাধারণ শ্রমজীবি মার্কিন জনগণের ক্ষোভ, যার প্রতিফলন হয় ট্রাম্পের পক্ষে জনাদেশে। ঠিক যে ভাবে সাম্রাজ্যবাদের পীঠস্থান ব্রিটেনের শ্রমজীবি মানুষ দলে দলে ভোট দিয়েছিলেন ব্রেক্সিট এর পক্ষে আর দেখিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে লেবার পার্টির দেউলিয়াপনার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল লেবারের সংস্কারপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের নির্লজ্জ ভাবে বৃহৎ পুঁজির দালালি করা দেখে, টোরি সরকারের বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রীয় কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো বন্ধ করার ফলে, আর এই ক্ষোভ কে ব্রিটেনের ফ্যাসিবাদীরা উগ্র জাতীয়তাবাদের কবলে এনে উস্কে দিয়েছে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ক্রোধে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন নাগরিকদের, শ্বেতাঙ্গ মানুষদের, উচ্চবিত্ত আর শ্রমজীবি মানুষের পশ্চাৎপদ অংশের সমর্থন জিতেছে এই বলে যে ও সেই ছেলে যে কাজে বড় করে দেখাবে, ন্যাকার কান্না কাঁদবে না বরং মানুষের ভাষায় মানুষের কথা বলবে। ঠিক যে ভাবে একদিন হিটলারের মতন, মুসোলিনির মতন ফ্যাসিবাদীরা সমাজতান্ত্রিক বুলি ছুটিয়ে, সামাজিক ন্যায় ও জাতি গঠনের, জাতিকে শ্রেষ্ঠ করে তোলার দাবি করে নির্বাচনে জিতে এসেছিল ঠিক তেমনি করেই ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে এসেছে। সেই শ্বেতাঙ্গদের, সেই উচ্চবিত্ত আর ধনিক শ্রেণীর সমর্থন পেয়ে যারা বহুদিন ধরে আর কৃষ্ণাঙ্গ, মেক্সিকান, আরব বা এশিয়ানদের আর নিজেদের দেশে সহ্য করতে পারছে না। “নোংরা জাতির” লোকগুলোকে নিজেদের সাথে এক বাসে-ট্রেনে চাপতে দেখলে যাদের গা ঘিনঘিন করে, যারা মনে করে এই অভিবাসী ও কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যেই মার্কিন দেশ পিছিয়ে পড়েছে, বেকারি বেড়েছে, যারা মনে করে বিশ্বের সকল সমস্যার মূল হলো ইসলাম ধর্ম আর এই ধর্ম আর এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শেষ করে ফেললেই পৃথিবী একেবারে স্বর্গের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠবে, ঠিক তাদেরই মনের কথা তাদের ভাষায় বলে আর তাদের ভুল ও বিকৃত চেতনা কে সঠিক আখ্যা দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি ব্যক্তি, কিন্তু তাকে ভোট দেওয়া মার্কিন ভোটার সমাজের ২৫ শতাংশ মানুষ কিন্তু তার নীতির প্রতি নিজেদের সমর্থন কে ব্যক্ত করেছে। তারা বুঝিয়েছে যে শত নিন্দা সত্বেও তারা কিন্তু ট্রাম্পের সাথে দাঁড়াতে চায় কারণ ট্রাম্প তাদের আর্থিক উন্নয়নের কথা বলে, তাদের চাকরির কথা বলে, তাদের বর্ণের হৃত গৌরব কে পুনরায় স্থাপন করার কথা বলে, ওই এশিয়ান আর মেক্সিকানদের দেশ থেকে তাড়িয়ে, মুসলমানদের তাড়িয়ে, আমেরিকার সম্পদে সাদা মানুষের অধিকারের কথা বলে। তাই শ্বেতাঙ্গ উচ্চবিত্ত ও পশ্চাৎপদ মার্কিন শ্রমজীবি মানুষের কাছে, “বাবু শ্রমিক” শ্রেণীর কাছে আজ ট্রাম্প সেই বড় কাজ করা খোকার নব নির্মিত রূপ, মসীহ, রক্ষাকর্তা। দু-চারটে মেয়ের শ্লীলতাহানিতে এই রক্ষণশীল শ্বেতাঙ্গ উচ্চবিত্তদের খারাপ লাগার কোন কারণ নেই, কারণ সেই শ্লীলতাহানির মধ্যেই পুরুষতন্ত্রের বিজয় দেখে শ্বেতাঙ্গ স্ট্রেট পুরুষেরা। শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবি জনগণ ওয়াল স্ট্রিটের প্রিয় পাত্রী হিলারি ক্লিন্টন কে ধিক্কার জানিয়ে বুঝিয়ে দিলেন যে ট্রাম্প কে দেওয়া তাঁদের ভোট আসলে হিলারির নকল গরিব প্রেমের বিরুদ্ধে একটা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়।    

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভোটে জিতে আসা এক আলাদা ধরণের আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে দুনিয়া জুড়ে। বহুবছর বাদে মার্কিন নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী কে নিয়ে নাচানাচি করছে না কর্পোরেট মিডিয়া গোষ্ঠীগুলি, যার মানে দাঁড়াচ্ছে যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় হয়তো অনেকগুলো কর্পোরেট সংস্থার পক্ষে শুভ নয়। বিশ্বায়ন আর নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দুনিয়ায় মার্কিন কর্পোরেট জগৎ গোটা বিশ্বের অর্থনীতির উপর তার মালিকানা কায়েম করেছে আর তার ফলে সমস্ত দেশের কর্পোরেট মিডিয়াগুলোই তেড়ে ফুঁড়ে ট্রাম্পের বিরোধিতা করেছিল সমগ্র নির্বাচন প্রচার পর্ব জুড়ে। বেশির ভাগ কর্পোরেট মিডিয়া আমাদের কে দেখিয়েছিল যে ট্রাম্প আসলে একটা বর্ণ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ একজন ফ্যাসিস্ট এবং একজন মুনাফাখোর পুঁজিপতি। আমার মনে হয় এই ব্যাখ্যার সাথে কেউ দ্বিমত হবেন না আর যে কোন সুস্থ চেতনার মানুষ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষই মানবেন যে ট্রাম্প আসলে একটা ফ্যাসিস্ট এবং ওর শাসনে বিশ্বের পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হবে। কিন্তু তার মানে কি এই যে হিলারি ক্লিন্টন যদি রাষ্ট্রপতি হতেন তাহলে বিশ্বের পরিস্থিতি বদলে যেত, শান্তি, ঐক্য, আর সম্প্রীতির মেলবন্ধনে আমেরিকা সহ সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যেত, সমগ্র দুনিয়ায় কেউ মার্কিন বোমা আর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারাতেন না আর বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন সংস্থাগুলো, ওয়াল স্ট্রিটের কুমিরেরা শ্রমজীবি মানুষের টাকা থুড়ি ডলার আর চুরি করতো না? সমগ্র নির্বাচন প্রচার কালে হিলারি ক্লিন্টন নিজেকে শ্রমজীবি মার্কিন নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে দেখাতে চেয়েছিল আর ট্রাম্প কে একজন অসহিংসু পুঁজিপতি যুদ্ধবাজ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল। অথচ ট্রাম্প হিলারি ক্লিন্টনের চেয়ে বেশি করে ওয়াল স্ট্রিট আর বৃহৎ ব্যাঙ্কের রোষানলের শিকার হয়েছিল। এই অদ্ভুত পরিস্থিতির যদি বস্তুগত মূল্যায়ন করি তাহলে দেখা যাবে যে ট্রাম্প আসলে মার্কিন শাসক শ্রেণীর চরম প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রতিনিধি, যারা মুখোশ খুলে নিজেদের ভয়াবহ চেহারা প্রকাশ্যে দেখিয়ে পশ্চাৎপদ জনতার অবচেতনার সুযোগ নিয়ে ব্যাপক লুট ও শোষণের রাজত্ব বহাল করতে চায়, আর অন্যদিকে হিলারি ক্লিন্টন বর্তমানে শক্তিশালী সেই শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধি যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে সমান পরিমানের লুট ও শোষণের রাজত্ব কায়েম রাখতে চায়।  শোষণ ও লুন্ঠনের পরিমাণে দুই প্রতিদ্বন্ধির মধ্যে ফারাক না থাকলেও কি ভাবে লুট ও শোষণ করা হবে তাই নিয়ে ছিল বিস্তর মতভেদ। আর তাই মার্কিন কর্পোরেট দুনিয়ার মধ্যেও ধরেছিল ফাটল এবং শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সবচেয়ে নগ্ন ভাবে শোষণ ও লুণ্ঠনে বিশ্বাসী শক্তিই নির্বাচনের বৈতরণী পার করলো।

যে কোন রাজনৈতিক নেতার মতনই ট্রাম্পও নিজের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছুড়ে ফেলে দেবে আস্তাকুঁড়েতে যদিও মুসলমান ও অন্যান্য অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এবং কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নতুন করে রাষ্ট্রীয় উস্কানিতে বিদ্বেষ আর হিংসার জোয়ার হয়তো আছড়ে পড়তে পারে, কারণ বিশ্বের চলমান প্রবণতার সাথে তাল মিলিয়ে এবার মার্কিন শাসক শ্রেণীও খোলাখুলি বলবে যে মার্কিন দেশের সমস্ত সমস্যার কারণ হলো মুসলমানরা, আর্থিক সংকট আর বেকারির কারণ হলো মেক্সিকানরা আর অন্য্ অভিবাসীরা আর সামগ্রিক ভাবে বেড়ে চলা অপরাধের কারণ হলো কৃষ্ণাঙ্গরা। ফলে লাগবে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণ বিদ্বেষী দাঙ্গা হাঙ্গামা আর সেই সুযোগে একের পর এক জন বিরোধী আইন পাশ করিয়ে নিজেদের শোষণ আর লুন্ঠনের রাজত্ব কে আরও শক্তিশালী করে তুলবে ট্রাম্প সরকার। যদিও ভারত থেকে মার্কিন দেশে গিয়ে থিতু হওয়া ব্রাক্ষণত্ববাদী অভিবাসীদের সবাই  ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিল নিজেদের মুসলমান ও কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষ থেকে, বর্ণ বিদ্বেষের বিপুল জোয়ার থেকে তারা কিন্তু নিজেদেরকেও বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না কারণ ফ্যাসিবাদ ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে এমনকি সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদেরও। ফলে গতকাল যারা ইহুদিদের তুলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে আওয়াজ ওঠায়নি আজ তাদের যখন গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়ি আসবে তখন ওদের পাশেও কেউ দাঁড়াবে না। পৃথিবীর সোজা হিসেবে তো এটাই। আন্তর্জাতিক মঞ্চে কিছু নিন্দা আর কিছু বাছাই করা বিশ্লেষণ দিয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কটূক্তি করা ছাড়া বিশ্বের কোন শক্তির ক্ষমতা নেই ট্রাম্পের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানোর। ভারতে আরএসএস ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা দীর্ঘদিন ধরে ট্রাম্প কে তাদের নতুন মালিক হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার দাবি জানাচ্ছিল, অনেকে আবার ট্রাম্পের বিজয় কামনা করে যজ্ঞ করেছিল, ফলে এবার তো বুক বাজিয়ে বলার সময় এসেছে যে যজ্ঞে ফল মেলে হাতেনাতে নামাজে মেলে না। ব্রাক্ষণত্ববাদের ধেই ধেই নাচার আওয়াজে প্রতিবেশী পাকিস্তান-আফগানিস্তান ও মধ্য প্রাচ্যের জনগণের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, বোমা তাঁদের উপর যেমন পড়ছিল তেমনিই পড়বে, আইএস গোষ্ঠীর চাঁদার অঙ্কে ট্রাম্প সাহেব কে কোন কাটছাঁট সিআইএ করতে দেবে না। আমরা মানুষ মারার কারখানা বন্ধ হতে দেখবো না বরং দেখবো নতুন সমীকরণে কারখানার ম্যানেজার বদল হতে। ওবামা দ্রুত সুর পাল্টে বলেছে যে মানুষ যেন ট্রাম্প কে একটা সুযোগ দেন। ওয়াল স্ট্রিট বেজায় চটে গেছিল হিলারি ক্লিন্টনের পরাজয়ে, কিন্তু এবার আবার রাগ, দুঃখ ভুলে ট্রাম্পের গোষ্ঠীর সাথে হাত মিলিয়ে চলতে রাজি মার্কিন শাসক শ্রেণীর সর্ব বৃহৎ অংশ।

মার্কিন আক্রমণ থেকে দুনিয়ার জনগণের নিস্তার নেই, মার্কিন সমর্থিত ইসলামিক স্টেটের সন্ত্রাসী ও তথাকথিত “স্বাধীনতা সংগ্রামী” জঙ্গীদের বোমায় সিরিয়ার শিশুদের রক্ত গড়াতেই থাকবে, মার্কিন মদতপুষ্ট জায়নবাদী ইজরায়েলের বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে প্যালেস্টাইনের সাধারণ মানুষ মরতে থাকবে, মার্কিন মদত প্রাপ্ত সৌদি আরব নির্লজ্জ ভাবে বিমান হানা করে ইয়েমেনের রাস্তা নিরীহ জনগণের রক্তে লাল করে দেবে, মার্কিন মদতপুষ্ট পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানের ইসলামিক মৌলবাদী শক্তিগুলো পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে মৃত্যুর খেলায় নামবে আর খুন করবে নিরীহ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাদের, মার্কিন মদতপুষ্ট ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দিতে থাকবে হিংসা আর মৃত্যুর ধোঁয়া। অন্যদিকে এই সন্ত্রাসের ধুঁয়ো তুলে মার্কিন জনগণের উপর পুলিশি রাষ্ট্রের কড়া পাহারা চাপাবে নয়া প্রশাসন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে শুরু করবে বিদ্বেষমূলক অভিযান আর নিজেদের তল্পি বাহক এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন শাসক গোষ্ঠী কে দিয়েও এই মার্কিন অভিযান কে বিশ্বের কোনায় কোনায় প্রয়োগ করাবে, ফলে বিভীষিকা শুধুই আজ বিভিষীকা থাকবে না, বরং বড় বেশি জোরে আমাদের সকলকেই ধীরে ধীরে কামড়াবে। আর যে সব সাবর্ণ শ্বেত চামড়া প্রেমী ‘ভদ্দরলোক’ ভাবছেন যে এবার ট্রাম্পের শাসনে মুসলমানদের বেশ ভালো করেই জবাই করা যাবে, তাদের জেনে রাখা উচিত যে একবার মার্কিন মুলুক থেকে মুসলমানদের মেরে তাড়ানোর পরেই ট্রাম্প ভক্তদের নজর পড়বে ওই দেশে পড়াশুনা বা চাকরির সূত্রে পৌঁছানো তাদের ভাই-বোন বা সন্তানদের উপর, কারণ শত চেষ্টা করেও তারা তো আর বর্ণ বদল করতে পারবে না।ফলে যারা ডালে বসে সেই ডালকেই কাটছিল তারা কিন্তু শীঘ্রই মাটিতে পড়বে। সোনার ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প এসেছে, ট্রাম্পেট থুড়ি দামামা বাজছে চতুর্দিকে একচেটিয়া পুঁজির নয়া ফ্যাসিবাদী খলনায়কের, সারা দুনিয়ার জনগণ যদি আজ উঠে না দাঁড়ান তাহলে কিন্তু ভবিষ্যৎ হবে বিপন্ন। পর্বতে ধোঁয়া দেখা দিচ্ছে, কোথাও তো আগুন লেগেছেই।           


 

টাকা কালো - টাকা সাদা - মোদী ম্যাজিকে চাপা পড়ে গেল অনেক কথা

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১০, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

কালো টাকা’র নাকি অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়েছে কারণ নরেন্দ্র মোদী ৮ নভেম্বর রাতে হঠাৎ ঘোষণা করলো যে সরকার পুরানো পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোট নাকি বাতিল করছে এবং জনগণের কাছে যে পরিমাণ নগদ টাকা আছে তা তাঁরা হয় ব্যাঙ্কে জমা করতে পারেন অথবা ব্যাঙ্কে এসে নিজের সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রতিদিন ₹ ৪০০০ পর্যন্ত বদলে নিয়ে যেতে পারেন। দয়ালু সরকার জনগণ কে ৩০শে ডিসেম্বর অবধি সময় দিয়েছে আর বলেছে “দেশের স্বার্থে একটু কষ্ট সহ্য” করতে। মোটামুটি গোটা দেশে একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে, এতই তীব্র হট্টগোল যে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এত সহজে মার্কিন নির্বাচন জিতে রাষ্ট্রপতি পদের ৪৫তম দাবিদার হয়ে গেল সে কথা কারুর মাথায় থাকলো না। সব তর্ক-বিতর্ক হঠাৎ গায়েব হয়ে গিয়ে শুধু পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটের গল্প আর মোদী সরকারের জয়ধ্বনি কানে বাজছে। কালো টাকা তোমার দিন বুঝি সত্যিই শেষ। কিন্তু এই নোট বাতিল করে কি সত্যিই কালো টাকাকে জব্দ করা যাবে ?

কালো টাকা নির্মূলের মোদীর গিমিক চাপা দিচ্ছে সত্যকে


কালো টাকা মানে হলো যে টাকা কর না দিয়ে আয় করা হয়েছে; সেই টাকার সিংহভাগের মালিক হলো বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো, গ্রামের বড় বড় জোতদার ও ধনী কৃষকরা, আর শহরে বাস করা জমি-বাড়ির দালালরা, ফোঁড়েরা, মাফিয়ারা, সিনেমা অভিনেতারা, ক্রিকেট খেলোয়াড়রা, সরকারি আমলাতন্ত্রের উঁচু সিংহাসনে বসা লোকেরা, রাজনৈতিক নেতারা, মন্ত্রী আর পুলিশ কর্তারা। এই কালো টাকার অধিকাংশই নগদের রূপে থাকে না বরং দ্রুত জমি, বাড়ি, সোনা, বা শেয়ার-স্টকে বদলে যায়। ভারতবর্ষে কালো টাকার বড় অংশটা কর্পোরেট সংস্থাগুলোর। যারা শুধু কর ফাঁকিই দেয় না বরং যাদের আবার সরকার কর ছাড় দিয়ে বেশি করে চুরি করার রাস্তা করে দেয়, আর করে দেয় এই বলে যে দেশের উন্নয়নে নাকি এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো শরিক। এই কর্পোরেটদের আর আমলা-মাফিয়া-মন্ত্রী-নেতা-অভিনেতাদের কালো টাকা নানা কায়দায় ভারত থেকে বিদেশে চলে যায়, গচ্ছিত হয়ে যায় বিদেশী ব্যাঙ্কে বা বড় বড় কর্পোরেশনের শেয়ারে বা বৃহৎ লগ্নি পুঁজির কারখানা ব্যাঙ্কগুলোর বন্ডে। আবার বিদেশ থেকে এই টাকার একাংশ যখন প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ হিসেবে ভারতে ফিরে আসে তখন এই আগমনী পুঁজি কে ভারত সরকারই আবার কর ছাড় দেয় দেশের “অর্থনৈতিক উন্নয়নের” স্বার্থে। নিজেদের মুনাফার লক্ষ লক্ষ কোটি টাকাকে আবার কর মুক্ত করে ভারতবর্ষে বিনিয়োগ করে সেই টাকার থেকে উৎপন্ন লাভের একটা বড় অংশ কে জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে নিজেদের জনপ্রিয় করে তুলতে নানা রকমের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির বা সিএসআর কার্যকলাপের মাধ্যমে এই সব কর্পোরেট সংস্থাগুলোই আবার কালো টাকার একটা বড় অংশ কে লোক দেখানো সমাজ সেবার নামে সাদা করে। তাইতো নানা ধরণের ব্যবসায়িক প্রকল্প কে চরিতার্থ করার স্বার্থে এই সকল কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দরকার জনমত সৃষ্টি ও মানুষের চৈতন্য কে দখলে নেওয়া এবং এই কাজে এদের সিএসআর আর থিঙ্ক ট্যাংক সংস্থাগুলো প্রচন্ড কাজে আসে। তাই আজ খেলাধুলো থেকে সিনেমা, পরিবেশ থেকে অর্থনীতি, সব ব্যাপারেই নীতা আম্বানি কে দেখা যায়, তাই আজ আদানি সাহেবের সমস্ত কুকীর্তি ও ছলে বলে কৌশলে জনগণের থেকে জমি-জল ও প্রাকৃতিক সম্পদ কেড়ে নেওয়ার ঘটনাগুলো কোনদিন “দেশপ্রেমিক” নরেন্দ্র মোদী সরকারের রোষানলে পড়ে না।কালো টাকার বলেই ভোটের প্রচারে হেলিকপ্টার থেকে প্রাইভেট জেট ব্যবহার করে আর পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচা করে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে। যেহেতু তেরঙ্গা ঝান্ডা নাড়িয়ে গেরুয়া বসন পড়ে যে কোন আরএসএস সমর্থকের কালো টাকা সাদা হয়ে যায় তাই এই পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিলে কি সত্যিই এই নেকড়েদের কোন রকমের ক্ষতি হতে পারে?

সারা দেশ জুড়ে যখন নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত কে নিয়ে সাধুবাদ দেওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে আর তথাকথিত “দেশভক্ত” ও “জাতীয়তাবাদী” সংবাদ মাধ্যমগুলি বারবার এই সিদ্ধান্তের ফলে কালো টাকা শেষ হয়ে যাবার মতন মিথ্যা প্রচারের বন্যা ছুটিয়ে চলেছে তখন বুঝতে হবে যে ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। ভারতবর্ষের অর্থনীতির মূল উৎপাদক শক্তি হলো কৃষক, যদিও ভারতের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দরুন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে আর দরিদ্র-ভূমিহীন ও মধ্য কৃষকদের পক্ষে চাষের খরচ মিটিয়ে ঘরে দুই পয়সা তোলা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলার কথা নতুন করে বলার কোন দরকার নেই। সেই কৃষকদের অধিকাংশের হাতে, গ্রামের খেটে খাওয়া জনগণ যাঁদের কাছে এনরেগা প্রকল্পের জব কার্ড নেই, তাঁদের হাতে, অর্থ বা তাঁদের ঘরোয়া সঞ্চয়ের অর্থ কিন্তু নগদেই থাকে আর তার মধ্যে পাঁচশো বা হাজার টাকার নোট থাকা আশ্চর্যজনক নয়। শহরের শ্রমিকদের, বিশেষ করে সমস্ত ঠিকা শ্রমিক ও দিনমজুরদের মজুরি কিন্তু আজও নগদেই হয়। বেশির ভাগ মাড়োয়ারি ফার্মে আজও নগদ টাকায় কেরানীদের বেতন দেওয়া হয়। আর ঠিক এই ৭-৮ তারিখ নাগাদ অনেক ছোট কোম্পানির কর্মীদের বেতন হয়, বেশিরভাগই নগদে। শহরে কাজ করতে আসা বেশির ভাগ দিন মজুরদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই, তাঁদের সিংহভাগ আজও  বাড়িতে টাকা পাঠান মানি অর্ডার করে না হয় নিজে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসেন। তাঁদের সঞ্চিত অর্থ মোটামুটি গ্রামের বাড়িতে বা শহরের বস্তির ঘরে জমানো থাকে কৌঁটো বা বাক্সে, বিয়ে বা চিকিৎসার জন্যে, অথবা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার থেকে বাঁচার জন্যে। পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ার ফলে এরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন কারণ এদের পক্ষে মাইলের পর মাইল হেঁটে নগদ টাকা নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে তা বদলে আবার নগদ টাকা নিয়ে গ্রামে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসা ভীষণ মুশকিল ও বিপদজনক।কলকাতা সহ অন্যান্য শহরের ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে ফুটপাতের হকারের কথা ভাবুন, অনেক মানুষের ঘর চালাবার সম্বল বোধহয় গুটিকয়েক পাঁচশো টাকার নোটেই রয়েছিল আর তাঁদের পক্ষে দুই দিন ঘরে বসে থেকে তৃতীয় দিন ব্যাঙ্কে বা পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজেদের টাকার নোট বদলিয়ে তবে বাজার করে দু মুঠো চাল-ডাল নিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে কত কষ্ট আর বেদনা আছে তা কি নরেন্দ্র মোদী সাহেব তার বাংলো বাড়িতে বসে দেশের গরিব মানুষ কে দেশের স্বার্থে কষ্ট করার ভাষণ দিয়ে বুঝতে পারবে? মোদীর গিমিকের চক্করে হয়তো ওর সাবর্ণ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ভোটব্যাঙ্ক আনন্দে আপ্লুত হবে, হয়তো কর্পোরেট সংস্থাগুলো মিটিমিটি করে হাসবে তবে জনগণ কিন্তু একেবারেই খুশি হবেন না।

জনগণের এই দুর্ভোগের সময়ে একমাত্র রেহাইয়ের পথ হলো ব্যাঙ্কে গিয়ে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বদল করা। আর নোট বদল করে এক লপ্তে শুধুমাত্র ₹৪০০০ অবধি পাওয়া যাবে আর এর ফলে গরিব মানুষের, যাঁরা নিজেরা বাড়িতে স্বল্প অর্থ সঞ্চয় করে রেখেছিলেন ভবিষ্যতের জন্যে বা যাঁদের সমস্ত মাসের খরচা তাঁদের শ্রমের বদলে পাওয়া মজুরির নগদ টাকায় চলে, তাঁদের পড়তে হবে প্রচন্ড অসুবিধায়। আর এই সুযোগে নেপোয় মারে দই করবে দেশী মুৎসুদ্দি পুঁজি ও বৃহৎ বিদেশী লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন সরকারি ব্যাঙ্কগুলো। কোটি কোটি লোকের ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলানোর মাধ্যমে এরা মালিক হয়ে উঠবে লক্ষ কোটি টাকার যা এরা কায়দা করে বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে ঋণ দেবে, যে ঋণের টাকা নির্দ্বিধায় সাফ করে বসে থাকবে আম্বানি আর আদানি গোষ্ঠী। এই কয়েক মাস আগেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত হয়েছিল যে প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার কোটি টাকার ঋণ সরকারি ব্যাঙ্কগুলো নিজেদের খাতায় বাজে ঋণ হিসেবে নথিভুক্ত করে মকুব করে দিয়েছে। এর লাভ বলা বাহুল্য বড় বড় কর্পোরেশন ও পুঁজিপতিরাই উঠিয়েছে কারণ সাধারণ কৃষকেরা ব্যাঙ্কের ঋণ আদায়কারীদের চাপে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। একদিকে যেমন এই গরিব মানুষদের টাকা জমা করে নিজেদের পুঁজির পাহাড় আরও উঁচু করবে এই ব্যাঙ্কগুলো ঠিক তেমনি আবার ছোট খাটো দালাল-ফোঁড়ে-অপরাধীদের কালো টাকা সাদা করার জন্যে বিপুল পরিমানের ঘুষের খেলাও চলবে আর নানা কায়দায় ব্যাঙ্কের বড় বড় কর্তারা সেই ঘুষের কালো টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠবে। পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল করার সাথে সাথে হঠাৎ আবার মোদী সরকার নতুন পাঁচশো টাকার নোটের সাথে সাথে একেবারে দুই হাজার টাকার নোট ছাপতে চলেছে যা কালো নগদ টাকা কে ভবিষ্যতে আরও সহজে রাখার বন্দোবস্ত করে দিল।  তাই মোদী সরকারের সিদ্ধান্তে যে বৃহৎ লগ্নি পুঁজির আর আমলাতন্ত্রের পোয়াবারো হয়েছে সে কথা আলাদা করে বলার দরকার হবে না।    
 

এত বীভৎস চিৎকার করে যে ভাবে মোদী সরকারের নোট খারিজ করার সিদ্ধান্ত কে কিছু ঘোড়েল সমর্থন করছে আর যে ভাবে ওদের যুক্তিহীন সমর্থন কে পুঁজি করে মোদী ভক্তকূল সমগ্র ইন্টারনেট ও সংবাদ মাধ্যমে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বলে যে মোদী সরকার ভারতবর্ষ থেকে কালো টাকা কে চিরতরে মুছে ফেলছে - তাতে মনে হচ্ছে যে আর কিছু হোক না হোক অন্য সমস্ত পদক্ষেপের মতন এই সরকারি সিদ্ধান্তটাও বৃহৎ আকারে বাজারজাত করবে আরএসএস ও তার গৌরী সেনেরা। ফলে যুক্তি ও তথ্যের চেয়ে উপরে স্থান পাবে প্রচন্ড আবেগ মাখানো, তেরেঙ্গায় মোড়া এই পলিটিক্যাল গিমিকটা, যা উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের আগে নিজের পোর্টফোলিও শক্তিশালী করার জন্যে খুব মাথা খাটিয়ে বিজেপি’র নেতারা বের করেছিল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে নরেন্দ্র মোদী যদিও ৮ নভেম্বর সন্ধ্যা আটটায় এই নোট বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত টিভিতে নানা ধরণের ভাঁট বকে জানান দিল, বিজেপির ছোট বড় নেতারা আর উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের টিকিটের  প্রত্যাশায় বসে থাকা আরএসএস কর্মীরা কিন্তু আধ ঘন্টার মধ্যে নিজেদের ফেসবুক ও টুইটারে মোদী সরকারের সিদ্ধান্ত কে সাধুবাদ দিয়ে পোস্ট দিল। এই পোস্টগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই গ্রাফিক্স সহ, যা মোটামুটি ফটোশপ বা ভেক্টর গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে বানাতে গেলে ১ ঘণ্টা লেগেই যায়, যদি না সেই নেতার ব্যক্তিগত কোন কর্মী এই কাজের জন্যে ঠাঁয় দিয়ে বসে না থাকে। সোজা কথায় মানে দাঁড়াচ্ছে যে আরএসএস ও বিজেপির সকল স্তরের কর্মীদের কাছে এই খবর আগেই চলে এসেছিল, যার অর্থ দাঁড়ায় যে এই আরএসএস ও বিজেপির কর্মীদের ছাড়াও এদের অনেক ঘনিষ্ঠ লোকেদের পক্ষে সরকারের এই পদক্ষেপের ব্যাপারে জেনে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া অসম্ভব ছিল না। ঠিক যেমন অসম্ভব নয় কলকাতার  বড়বাজার ও তার আশেপাশে বসা বড় বড় মাড়োয়ারি বেনিয়াদের পক্ষে এই সময়ের মধ্যে কোটি কোটি টাকা জমি, বাড়ি, দোকান, শেয়ার, বন্ড, অথবা সোনার গয়নায় বদলে ফেলা। দু-চারটে স্টক ব্রোকারের অফিসে গেলে বা দুই একটা গদিতে গেলে আপনি দেখবেন কি ভাবে প্রতিদিন নিত্য নতুন কোম্পানি তৈরি হচ্ছে, কি ভাবে সেই কোম্পানির প্রায় দশ বছরের পুরানো এন্ট্রি তৈরি হচ্ছে আর কি ভাবে সন্ধ্যে বেলার মধ্যে সেই কোম্পানি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আর শেয়ারের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা হয়ে যাচ্ছে। ইনকাম ট্যাক্সের অফিসারদের সাথে এই মাড়োয়াড়িদের ওঠা বসা সেই ১৯৬০ এর দশকের থেকে। ইনকাম ট্যাক্সের অফিসাররা দুর্গাপূজার আগে ৫০ লক্ষ থেকে দুই কোটি টাকা অবধি ঘুষ নেয় এক একটা রেইড থেকে আর তার আগে ৪০-৫০ লক্ষের মধ্যেই আটকে থাকে অঙ্কটা। মে আর জুন মাসের থেকেই সমস্ত মাড়োয়ারি কারবারীদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ইনকাম ট্যাক্স অফিসারদের জন্যে মদ-মাংস আর মেয়েমানুষের জোগাড়ের। ইনকাম ট্যাক্স ছাড়াও সেবি, সেলস ট্যাক্স ও অন্য সমস্ত বিভাগেই টাকার উপঢৌকনের অঙ্কটা স্থির থাকে। টাকা পাঠাতে থাকলে আর কোন গন্ডগোল হয়না। তাই এই সব লোকেরা, যাদের সিংহভাগের সাথে বিজেপি-আরএসএসের শুধু যে সুদৃঢ় যোগাযোগ আছে তাই নয় বরং পশ্চিমবঙ্গে এরাই গেরুয়া বাহিনীর মূল পৃষ্টপোষক, যে এই খবর সময় থাকতে পায়নি বা পেয়ে নিজেদের সিংহ ভাগ নগদ টাকা নানা কায়দায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাদা করে নেয়নি সে কথা কে হলফ করে বলতে পারবে?   



নানা ভড়ং বাজি করে সরকার আজ মানুষের, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের টোপ দেওয়ার কাজে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। কালো টাকা দমনের নামে পুরানো নোট বাতিল করে নতুন নোট চালু করার ঘটনা কিন্তু চাপা দিয়ে দিল কি ভাবে এবিভিপি’র নেতা ও কর্মীরা জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাজিব নামক ছাত্র কে গত মাসে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পরেও আজ অবধি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ দিল্লি পুলিশ তাঁকে খোঁজার কোন প্রচেষ্টা তো করেইনি বরং পুলিশ ও সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ করার দাবিতে আন্দোলনরত নাজিবের মা সহ জেএনইউ’র ছাত্র ছাত্রীদের উপর আক্রমণ করে তাঁদের গ্রেফতার করার ঘটনাকে। যে ঘটনা কে কেন্দ্র করে মোদী সরকারের নিন্দায় সরব হয়েছিলেন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। কালো টাকার নামে লোককে ঢপ দেওয়ার মোদীর এই চালে চাপা পড়ে গেল কি ভাবে এনডিটিভি কে একদিনের জন্যে নিষিদ্ধ করার প্রয়াস করে মোদী সরকার ও পরবর্তীকালে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক করতে সেই সিদ্ধান্ত কে স্থগিত করে বিজেপি ও আরএসএস।  পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিলের ঘোষণায় চাপা পড়ে গেল কি ভাবে দেশের শিল্প ও বাণিজ্যে সঙ্কটের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে সেই তথ্য, হারিয়ে গেল আলীগড় সহ উত্তরপ্রদেশের নানা প্রান্তে দাঙ্গা লাগিয়ে মানুষ মারার কাজে কি ভাবে এগিয়ে চলেছে সংঘ পরিবারের বানর সেনা সেই কাহিনী, আর চাপা পড়ে গেল কি ভাবে হিন্দুত্ব প্রীতিতে বাজি ফাটিয়ে সমগ্র দিল্লি শহর কে বিষাক্ত ধুঁয়ার কবলে ঠেলে দিয়েছিল উচ্চবিত্ত সাবর্ণ সমাজ। কালো টাকা উদ্ধারের এই ঢপের কীর্তন শুনে যদিও মোসাহেবের দল বাহবা দিচ্ছে তবুও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষেরা, গরিব ও খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণ, রাস্তায় ঘাটে ভিড়ে মিশে থাকা আমার আর আপনার মতন লোকেরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে এই সিদ্ধান্তে আপাতত গরিব মানুষের চরম ভোগান্তি বাদে,  কয়েকদিনের মজুরির ক্ষতি বাদে আর কিছুই নেই।  লোকে তবুও মোদী পূজা করবে কারণ মোদী ভারতবর্ষের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ১৬ কোটি সাবর্ণ উচ্চবিত্তদের কাছে চিরকালই একজন দেবতা হিসেবে চিহ্নিত হবে, যাকে প্রশ্ন করা যায়না, যার উদ্দেশ্য কে মন্দ বলা যায়না, যার কথা শুধু নাকি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয় ও সুবোধ বালকের ন্যায় তার গুণগান করে নিজেদের দেশভক্তির পরিচয় দিতে হয়। আজ কালো টাকা বহু সংবাদ কে ঢেকে দিল, গতকাল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক আর পাকিস্তান ঢেকে  দিয়েছিল আর আগামী কাল উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন ঢেকে দেবে অনেক অপ্রিয় সত্য কে। কিন্তু সত্যিই কি হাত দিয়ে সূর্যের আলো কে রোখা যায় ? বা শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় ?

শতবর্ষে নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষাগুলোকে সারসংকলন করে এগিয়ে চলুন

সোমবার, নভেম্বর ০৭, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মহান নভেম্বর বিপ্লব জিন্দাবাদ

নভেম্বর মানে শীতের আগমন, নভেম্বর মানে পরিবর্তন - আর এই নভেম্বর বিপ্লবের মাস। প্যারিস কমিউনের পরে বিশ্বের বুকে প্রথম শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্রের জন্ম হয় এই ৭ই নভেম্বর ১৯১৭ সালে। সেই নভেম্বরের রাতে তীব্র শীতের আগমনী কামড় কে উপেক্ষা করে ক্ষুধিত শ্রমিকেরা বেয়নেটের শক্তিতে উচ্ছেদ করেন কেরেনস্কি'র নেতৃত্বে চলা তথাকথিত বাম সরকার কে আর জারের শীত প্রাসাদে উত্তোলিত হয় রক্তিম পতাকা। রাতে বিনিদ্র থেকে এই বিপ্লব কে নেতৃত্ব দেন লেনিন ও স্তালিন নামক দুই ব্যক্তি, যাঁদের সম্পর্কে কেউ সেই দিন পর্যন্ত বেশি কথা জানতেন না, কিন্তু এই রাতের পর থেকেই এই দুই জন পৃথিবীতে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টিই শুধু করলেন না বরং নিজেরাও শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জ্বলন্ত মশাল হয়ে রইলেন।

লেনিনের নেতৃত্বে নভেম্বর রুশ বিপ্লবের ফলে জন্ম নিয়েছিল শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব রাষ্ট্র যন্ত্র আর গঠিত হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া, তারপরের সমস্ত ঘটনাক্রম ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, শ্রমিক ও কৃষকের সৃজনশীল ক্ষমতা বিশ্ব কে দেখিয়েছে, প্রথমে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের যৌথ আগ্রাসন কে ঠেকায় আর তারপরে হিটলারের ফ্যাসিবাদী আক্রমণ কে শুধু ঠেকানোই নয় বরং একেবারে বার্লিনে ঢুকে নাজি শাসন উচ্ছেদ করে রাইখস্ট্যাগের মাথায় লাল পতাকা উত্তোলন করে স্তালিনের নেতৃত্বাধীন লাল ফৌজ। কাঠের লাঙলের দেশ রাশিয়া থেকে পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ও বিশ্বের প্রথম মহাকাশে মানুষ পাঠানো দেশে পরিণত হয় শ্রমিক-কৃষকের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন। লেনিনের আদর্শে বলীয়ান ও স্তালিনের নেতৃত্বে চলা সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, অত্যাচারিত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে হিম্মত জুটিয়েছিল এবং সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করেছিল। বিশ্ব কে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত করার শ্রেয় অজেয় লাল ফৌজের টুপিতে পালক হিসেবে শোভিত হলো। বিশ্বের ছয় ভাগের এক ভাগ কে সাম্রাজ্যবাদের দখল থেকে মুক্ত করে শ্রমিক-কৃষক রাজত্বে নিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে আসার আগেই মুক্ত হয় সমগ্র পূর্ব ইউরোপ, চীন, কোরিয়া। বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে বিদ্রোহ আর টলমল করতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পায়ের তলার জমি। তাই তো বাইরের থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কে দখল করতে অপারগ হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন নতুন করে সেজে ওঠা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের পান্ডারা হিসেবে কষে ভিতর থেকে বেইমানদের সাহায্যে দুর্গ দখল করার লড়াইয়ে নামে। শুরুতে ট্রটস্কি ও জিনোভিয়েব-কামেনেভদের মতন বেইমানদের দিয়ে যে ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন কে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল সাম্রাজ্যবাদীরা ঠিক সেই রকম ভাবেই তারা প্রচেষ্টা শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে লাল পতাকা উচ্ছেদ করার আর এই কাজে এদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে স্তালিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ঘাঁপটি মেরে থাকা ক্রুশ্চেভ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।   


স্তালিনের মৃত্যুর পরে ১৯৫৬ সালে ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে লেনিন ও স্তালিনের পতাকা ফেলে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা দখল করে একদল আমলাতান্ত্রিক-পুঁজিবাদপন্থী বেইমানরা, যারা নানা রকমারি স্লোগানের আড়ালে তুলে ধরে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ধ্বজ্জা ও এদের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী কালে পরিণত হয় বিশ্বের সর্ব বৃহৎ সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে। উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশ দখলের লড়াইয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে, বিশ্বের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর সাথে সোভিয়েত শাসক শ্রেণী জোট বাঁধে বিপ্লবী আন্দোলন কে ধ্বংস করতে, চীনা কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুঙ যখন সোভিয়েত পার্টির বেইমানি ও সংশোধনবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেন তখন থেকেই চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধ চক্রান্তে কোন রাখ ঢাক না রেখেই সোভিয়েত শাসক শ্রেণী যোগ দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতর পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরেও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে শ্রমিক শ্রেণীর রাজত্ব কে ক্ষমতাচ্যুত ধনিক শ্রেণীর থেকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরলো, তুলে ধরলো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সামগ্রিক জনগণ কে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নীতি শিক্ষার কর্তব্য, তুলে ধরলো কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে ও বাইরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সংশোধনবাদী সকল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাবার প্রয়োজনীয়তা, আর তুলে ধরলো রাষ্ট্র ও পার্টির ভিতর আমলাতন্ত্রকে ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তা। এই সকল নীতির সারসংকলন করে মাও সেতুঙ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা পুঁজিবাদপন্থীদের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালান যা পরবর্তীকালে এক সম্পূর্ণ বিপ্লবের রূপ নেয় - যা মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপ নেয় এবং চীনা পার্টি থেকে লিউ শাও চি ও তেঙ শিয়াও পিঙের সদর দফতর কে চূর্ন করে। মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব নভেম্বর বিপ্লব ও চীন বিপ্লবের পরে দুনিয়া কাঁপানো মহান তৃতীয় এমন এক বিপ্লব যা শুধু নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা কে নতুন সময়ে নতুন করে পুনঃপ্রতিষ্ঠাই করেনি বরং এক নতুন যুগের সূচনা করেছে - যে যুগ কে লিন  পিয়াও বলেছিলেন "মাও সেতুঙের যুগ" - যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ এগিয়ে চলেছে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে আর সমাজতন্ত্র এগিয়ে চলেছে বিশ্ববিজয়ের দিকে।


সেই মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রথম পর্বে বিজয় লাভের পরেই মাও সেতুঙ বলেছিলেন যে একটা নয় বরং দশটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব করা দরকার চীনে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঠেকাবার জন্যে। কিন্তু  সেইদিনের বিজয়ের উল্লাসে সবার দৃষ্টি সরে গেছিল মাও সেতুঙের সেই সাবধানবাণীর থেকে আর তাই ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে রহস্যজনক ভাবে মাও সেতুঙের সহযোদ্ধা ও উত্তরাধিকারী লিন পিয়াও প্রথমে নিখোঁজ হন, পরে নিহত হন ও প্রায় দুই বছর ধরে তাঁর প্রসঙ্গে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার পরে হঠাৎ গোপনে অনুষ্ঠিত চীনা পার্টির কংগ্রেসে "পুঁজিবাদপন্থী" হিসেবে নিন্দিত হন। আর যে নিন্দা করেছিল, সেই চৌ এনলাই নিজে পুঁজিবাদী পথগামী তেঙ শিয়াও পিং কে পুনরায় পার্টি ও সরকারে ফেরত আনে এবং মাও সেতুঙের বিরুদ্ধে নয়া কেন্দ্র গড়ে তোলে। অতঃপর মাও সেতুঙের মৃত্যুর একমাসের মধ্যেই পার্টি ও রাষ্ট্রে নিজের আধিপত্য কায়েম করে তেঙ শিয়াও পিং এবং চীনের দশাও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতনই হয়। দ্রুত শ্রমিক-কৃষকের একনায়কতন্ত্রের জায়গা নেয় পার্টির একনায়কতন্ত্র তথা পার্টির নেতাদের আর আমলাদের একনায়কতন্ত্র, যার থেকে সৃষ্টি হয় নয়া পুঁজিবাদী শ্রেণীর। গ্রামের কৃষক ও শহরের শ্রমিকদের উপর চলতে থাকে "বাজার সমাজতন্ত্রের" শোষণের রোলার এবং তাই প্রতি বছর চীনের বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠিত হয় প্রায় ৭০০'র উপর নন্দীগ্রাম।

বিশ্বের বুকে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক দেশটা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কমিউনিস্ট আতংক পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিন বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে শোষণে আর অনাহারে ক্লিষ্ট মানুষ, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষ এই ঘৃণ্য মানুষ খেঁকো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, চিৎকার করে নিজের "আজাদী" দাবি করছে। মানুষের বিদ্রোহ আর বিক্ষোভের মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সকল দেশের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণী কে নিজের গণতান্ত্রিক আবরণ হাটের মাঝে খসাতে হচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে বিদ্রোহী মানুষ কে কমিউনিস্টদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে প্রতিদিন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ও ওয়াল স্ট্রিটের বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর ঢালা টাকায় গড়ে উঠছে একের পর এক এনজিও, ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন, বড় বড় কর্পোরেট মিডিয়া সংস্থা, ইত্যাদি। এদের সকলের কাজ হলো পুঁজিবাদীদের থেকে পয়সা নিয়ে পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদের শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানুষের ক্ষোভ কে বিপ্লবের পথ থেকে দূরে সরিয়ে নানা ধরণের কর্মকান্ডে আটকে রেখে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও শাসন কে নিশ্বাস নিতে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া। রোজ নানা ধরণের নীতি আদর্শের ব্যাখ্যা করে বিপ্লব থেকে জনগণ কে দূরে সরিয়ে রেখে বিপ্লবের প্রস্তুতি করার ছল করে নানা ধরণের কমিউনিস্ট নামধারী, মার্কস ও লেনিনের নাম ব্যবহারকারী পার্টি ও সংগঠনও গড়ে উঠছে একের পর এক। নানা ভাবে নানা কায়দায় আমাদের নানা ধরণের মার্কসবাদীরা দিস্তা দিস্তা কাগজ আর জিবি জিবি ডেটা খরচা করে বোঝাচ্ছে যে কেন এখনও বিপ্লবের সময় হয়নি, যাঁরা বিপ্লব করছেন বা বিপ্লবের কথা বলছেন তাঁরা নাকি সবাই হঠকারী ও জনবিচ্ছিন্ন। আর এই সবের মধ্যেই নভেম্বর বিপ্লব আমাদের দেখায় আজ থেকে শত বছর আগের সেই দিনটাকে, যেদিন প্রতি পদে পদে 'মার্কসবাদী' পন্ডিতেরা দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচা করে বারবার বলার চেষ্টা করেছিল যে রাশিয়ায় বিপ্লব সম্ভব নয়, লেনিন হঠকারী, বলশেভিক পার্টি জনবিচ্ছিন্ন ইত্যাদি। আর তবুও নভেম্বর বিপ্লব হয়। নভেম্বর বিপ্লব হয় কারণ একদিকে রাশিয়ার গরিব মানুষের সামনে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা ছাড়া যে পথ খোলা ছিল তা ছিল অনাহার ও দাসত্বের মাধ্যমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া আর অন্যদিকে নভেম্বর বিপ্লব হয়েছিল কারণ লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি এই বিপ্লব কে সচেতন ভাবে পরিচালিত করেছিল, কারণ শ্রমিক-কৃষক-নাবিক-সৈনিকদের সংগ্রামী ও অগ্রগামী অংশগুলোর মধ্যে সঠিক ভাবে সঙ্গতি রেখে পরিচালনা করা হয়েছিল এই মহান বিপ্লব কে।

আজ ভারতবর্ষ সহ সমগ্র বিশ্বে যে ভাবে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের উপর মার্কিন বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির দ্বারা পরিচালিত নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির শোষনের জগদ্দল পাথর চেপে বসেছে, তাকে শুধুমাত্র কফির কাপে তুফান তুলে বা বোহেমিয়ান এক্টিভিজম দিয়ে উচ্ছেদ করা যাবে না। প্রতিটি দিন আর প্রতিটি মুহূর্তে জনগণের উপর এই শোষনের পাহাড়ের ওজন বেড়ে চলবে শাসক শ্রেণীর মুনাফা অর্জনের অভিলাষে। ফলে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো কে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করার স্বার্থে শাসক শ্রেণীর দরকার হবে এমন সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির যারা যেনতেন প্রকারে জনগণের ঐক্য কে খন্ডিত তো করবেই সাথে সাথে জনগণের মধ্যে বৈরিতামূলক সম্পর্ক কে স্থাপন করবে যার ফলে জনগণের একাংশ অন্য অংশ কে তীব্র ঘৃণা করবে। আর এই কাজে ভারত সহ বিশ্বের সকল আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশে জাঁকিয়ে বসছে ধর্মীয় মৌলবাদের ভিত্তিতে রাজনীতির ময়দানে নামা ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো, যাদের এই রাজনীতি কে এগিয়ে নিয়ে যেতে কোটি কোটি ডলার উপঢৌকন দিচ্ছে বিশ্বের তাবড় তাবড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো। ভারতবর্ষে মোদীর উথ্বান ও তারপর থেকেই সামগ্রিক ভাবে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণ, নিপীড়িত জাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমাজ, ও দলিত-আদিবাসীদের মতন শোষিত জনগণ কে যে ভাবে রাষ্ট্র ও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের নগ্ন আক্রমণ সইতে হচ্ছে তা প্রমাণ করছে যে শাসক শ্রেণী আর সাম্রাজ্যবাদ, দুটোই আজ ভীষণ গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত, এবং এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে তাদের শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের রক্ত চোষার নিত্যনতুন ফন্দি বের করতে হচ্ছে। যার মানে দাঁড়ালো যে শাসক শ্রেণী আর পুরানো কায়দায় শোষণ করতে পারছে না আর শোষিত শ্রেণী পুরানো কায়দায় শোষিত হতে চাইছে না। আর এই পরিস্থিতিতে শান্তি জল ছিটিয়ে যারা বলছে যে ফ্যাসিবাদের পতন হবে ভোটের বাক্সে তারা জেনেশুনে শয়তানি করে জনগণকে এই মানুষ খেঁকো ব্যবস্থার শিকার বানিয়ে রাখতে চাইছে -অর্থাৎ এরাই হলো শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাম্রাজ্যবাদ, দেশি দালাল পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের পা চাটা শ্বাপদের দল।

আজ ভারতবর্ষে যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যখন সমস্ত গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকে এক সংগ্রামী মঞ্চে আনার জন্যে লড়াই চলছে তখনই কমিউনিস্ট বিরোধী, শ্রমিক-কৃষক বিরোধী কিছু গণতন্ত্রী সেজে থাকা শক্তি নানা ভাবে চেষ্টা করছে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে বিভেদ সৃষ্টি করার। কখনো আইডেন্টিটি পলিটিক্স এর তাস খেলে, কখনো ধর্মীয় মৌলবাদের সাহায্য নিয়ে, বা কখনো শাসক শ্রেণীর প্রতি মোহ সৃষ্টি করার কাজ করে এই সমস্ত শক্তি আজ সর্ব ভারতীয় স্তরে এক বৃহৎ ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চ গড়ে তুলতে, এক সংগ্রামী যুক্ত ফ্রন্ট গড়ে তুলতে বাঁধা দিচ্ছে, শ্রমিকে-শ্রমিকে, কৃষকে-কৃষকে দাঙ্গা লাগাবার কাজে এরা সংঘ পরিবার ও প্রতিক্রিয়াশীল মুসলমান সংগঠনগুলো কে বিশাল সহযোগিতা করছে। ভারতবর্ষের শাসক শ্রেণীর কাছে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে সমাজে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দরিদ্র মানুষের ঐক্য ভেঙে নিজের রাজত্ব কে অক্সিজেন যোগান দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই বাঁচার। আর এই ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করে এক নয়া গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ গঠন করার লড়াইয়ে আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয় নভেম্বর বিপ্লব, আজও অন্ধকারে পথের হদিস দেয় নভেম্বর বিপ্লব, আর আজও ধাক্কা খাওয়ার পরে, বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পরে ভেঙে না পড়ে, হতাশাগ্রস্ত না হয়ে বরং পরবর্তী লড়াইয়ের জন্যে ভালো ভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার শিক্ষা দেয় নভেম্বর বিপ্লব। তাই আজ নভেম্বর বিপ্লবের মশাল শত বছরেও আমাদের উঠে দাঁড়াবার আর ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে, লেনিনের মশাল - স্তালিনের মশাল আমাদের পথ দেখাচ্ছে সমাজ বিপ্লবের, শোষকদের উচ্ছেদ করে শোষিত মানুষের রাজত্ব গড়ার পথ দেখাচ্ছে। যদি আজ আমরা এই পথে চলতে দ্বিধা করি, যদি আজ আমরা ইতিহাসের নবনির্মাণের ডাক শুনতে অস্বীকার করি তাহলে কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।  আসুন নভেম্বর বিপ্লবের এই মহান দিনে শপথ নিই প্রতিটি দিন কে ৭ই নভেম্বরের মতন ঐতিহাসিক দিনে পরিণত করার, প্রতিদিন বিশ্বের থেকে একটু একটু করে সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহকদের উচ্ছেদ করার। মানব সমাজের ইতিহাস প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস - জয় আমাদের হবেই। 

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষবাস্প ছড়াতে পশ্চিমবঙ্গে একজোট বিজেপি ও তৃণমূল

শনিবার, অক্টোবর ২৯, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

TMC BJP nefarious nexus to incite communal tension in West Bengal - representative image - Credit Muslim Mirror
পশ্চিমবঙ্গে মমতার প্রশ্রয়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে সঙ্ঘ পরিবার - ছবি নমুনা স্বরূপ। স্বত্ব মুসলিম মিরর 


একটা প্রবাদ আছে যে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।পাঞ্জাব আর বাংলার চেয়ে বেশি সমগ্র ভারতে কারুরই ঘর বোধহয় দাঙ্গার আগুনে পোড়েনি তাই যখন বাংলার আকাশের কোন লাল হচ্ছে দাঙ্গার আগুনে, তখন সামগ্রিক ভাবে সমস্ত খেটে খাওয়া গরিব বাঙালিদের আজ দাঙ্গা ও অশান্তির সিঁদুরে মেঘ দেখে নিজেদের তৈরি করতে হবে এক ব্যাপক প্রতিরোধ সংগ্রামের জন্যে, কারণ রাজ্যে আজ তৃণমূলের সাথে টেবিলের তলায় হাত মিলিয়ে উঠে আসছে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের রথ, বাংলার মাটি যে সত্যিই ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছে দুর্জয় ঘাঁটি রইলো না মমতার প্রশাসনিক সাহায্যের কারণে তা আজ কিন্তু বাংলার সাধারণ মানুষ নিজেদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। খড়্গপুর আর হাজীনগরে মহরম ও দুর্গাপূজার বিসর্জনের আড়ালে যে ঘৃণ্য দাঙ্গা লাগানো হলো, যে ভাবে তৃণমূল আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও আরএসএস হাত মিলিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পথে নামলো তা কিন্তু চোখে তাক লাগিয়ে দিল। যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী কে নিয়ে সাধারণ একটা কার্টুন সম্বলিত ইমেল ফরোয়ার্ড করার দায়ে একজন অধ্যাপককে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে, বা তারক বিশ্বাসের মতন নাস্তিকতার প্রচারকারীদের হঠাৎ এক তৃণমূলী নেতার অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে অবলীলায়, সেই রাজ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে দাঙ্গার আগুনে হাওয়া দিতে থাকা তপন ঘোষের মতন লোকেরা বা হিন্দু দেব দেবীর ছবি দেওয়া প্রোফাইলের আরএসএস কর্মীরা কিন্তু সরকারের ক্রোধ বা কোপের শিকার হয় না। যে রাজ্য সরকারকে আবার বিজেপি মুসলমান তোষনকারী বলে অভিযুক্ত করে সে রাজ্যে এই ঘটনা সত্যিই তাজ্জব করে।

দাঙ্গা কোনদিন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয়নি।সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করার জন্যে লাগে পরিকল্পনা, প্রচার  ও পরিকাঠামো, আর এই দুইয়ের মধ্যে নিখুঁত সমন্বয় সাধন করার মাধ্যমেই দাঙ্গার মাধ্যমে রাজনৈতিক লাভ কুড়ানো সম্ভব হয়। পশ্চিমবঙ্গের ভিতর আরএসএস ও অন্যান্য ব্রাক্ষণত্ববাদী হিন্দু সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রভাব শুরু থেকেই উঁচু জাতের শহুরে অবাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আর সাম্প্রদায়িক দ্বন্ধ এই রাজ্যে, যে রাজ্যে শ্রমিক-কৃষকদের জঙ্গী আন্দোলন সমগ্র ভারতের শাসক শ্রেণী কে বারবার কাঁপিয়ে তুলেছিল, শুধুমাত্র অবাঙালি মুসলমান ও অবাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ খেটে খাওয়া বাঙালিরা ধর্ম ভীরু হয়ে উঠতে থাকলো নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দুয়ার খুলে যেতেই। হঠাৎ করে রাজ্যের বাইরে কাজ করতে যাওয়া উঁচু জাতের হিন্দুদের মনে হলো যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের ভীষণ বাড়বাড়ন্ত হয়েছে আর ঘরে ফেরার পরে সেই কথাই তারা প্রতিবেশীদের জানাতে থাকলো। শহর ও মফসলের যে সমস্ত গুটিকয়েক অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানরা পাশাপাশি নির্ঝঞ্ঝাটে বাস করতেন সে সমস্ত জায়গায় ধীরে ধীরে ghettoisation শুরু হলো আর আমাদের প্রগতিশীল ও তৎকালীন ‘বামফ্রন্ট’ শাসিত পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত ভদ্রলোকদের পাড়ার দূর দূর পর্যন্ত কোথাও মুসলমান বা দলিত নমঃশূদ্র মানুষের বাস আর দেখা গেল না। নব্বইএর দশকের শেষের দিকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আঁচল ধরে এই রাজ্যে সিঁধ কেটে বিজেপি-আরএসএস ও নানা ধরণের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের বেনোজল কে ঢুকতে দেখেও নির্লিপ্ত থাকে ব্রাক্ষণত্ববাদী নেতৃত্বে চলা বামফ্রন্ট সরকার। মমতার অসীম করুণায় আর তৃণমূলের সহযোগিতায় ভাইরাসের মতন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে ব্রাক্ষণত্ববাদী রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষে নিজ স্বার্থে মমতা থেকে বুদ্ধ সবাই জল  ঢালতে থাকে এবং এই বিষ বৃক্ষের ফল পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাস কে বিষিয়ে দেয়।

বিজেপির সাথ ছেড়ে কংগ্রেস কে সাথে নিয়ে যেদিন থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায় রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছিল সেইদিন থেকে তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারের দৃষ্টি ছিল যেনতেন প্রকারে বুদ্ধদেবের পথে চলে রাজ্যের থেকে জঙ্গী শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন কে নিকেশ করার দিকে, আর তাই ২৭ শতাংশ মুসলমান জনসংখ্যার এই রাজ্যে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ ছড়ানোর কাজে বিশেষ করে নামে মমতার সরকার। যে রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের করুণ দশা সচ্চার কমিটির রিপোর্টের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে সেই রাজ্যের মুসলমানদের উন্নয়নের নামে মমতার অবদান ছিল ইমাম ভাতা, মজলিশ, হাদিস পাঠ, মাথায় দাবনি বেঁধে দোয়া করা, ও ইফতার পার্টি। মুসলমানদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ কে সমস্ত মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের কথায় সমস্ত সম্প্রদায় কে, বাংলা ভাষী ও উর্দু ভাষী মুসলমান নির্বিশেষে সকল কে চলতে জোর করে মমতার সরকার। সারা রাজ্য জুড়ে কট্টর কাঠ মোল্লাদের তোয়াজ করা শুরু করে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকার আর এই সুযোগে নেপোয় মারে দই’য়ের  মতন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সংঘ পরিবারের পাল্টা প্রচারের, হিন্দু অবাঙালিদের সাথে সাথে এবার অভিজাত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সুপ্ত জাতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ কে সারা রাজ্য জুড়ে তীব্র করার কাজে জোটে আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। পরবর্তীকালে এদের সাথে জোটে হিন্দু সংহতির তপন ঘোষের মতন পাঁড় দাঙ্গাবাজরা। ২০১৪ সালের মোদী তরঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দুটি লোকসভা আসন, যার মধ্যে একটি শ্রমিক আন্দোলনের গড় - আসানসোল জিতে নেয় বিজেপি। তারপর থেকেই অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বাংলার মাটিতে নিজের ঘাঁটি শক্তিশালী করতে নামে বিজেপি। মমতা বন্দোপাধ্যায় জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপ রোধ করতে কোন পদক্ষেপই নেয়নি, সরকার বরং অনীহা দেখিয়ে তলে তলে এই হিন্দুত্ববাদের আঁচে হাওয়া দিয়েছে হিন্দু সন্ত্রাসের ঊর্ধ্বগামী লেলিহান শিখা দেখে সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘুদের নিজের ভোট ব্যাংকের স্বার্থে মেরুকরণ করার জন্যে।

গোপীবল্লভপুরের জোতদার ঘরের সন্তান, আরএসএস এর পাঁড় নেতা দিলীপ ঘোষ কে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির মাথা করে অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী প্রথমতঃ শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে খাস পাড়া গাঁয়ে বিজেপির ঝান্ডা শক্ত করে গেঁড়ে দেওয়ার কাজ শুরু করলো আর দ্বিতীয়ত্বঃ তৃণমূলের আমলে আইন শৃঙ্খলার অবনতি, সিন্ডিকেটবাজি, গণতন্ত্র হরণ, আর মহিলাদের উপর বেড়ে চলা অত্যাচারের পরিচিত অভিযোগের রাজনীতির গন্ডির বাইরে এনে বিজেপিকে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে ২০১৯ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে নিজেদের দুর্জয় ঘাঁটি বানানোর কাজে লাগালো। অমিত শাহ - নরেন্দ্র মোদী ও দিলীপ ঘোষের মতন কেউকেটেরা জানে যে শুধু মাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চাকরি, সস্তা রেশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে ভাবে তথাকথিত সার্কাসি বাম ও কংগ্রেস-তৃণমূল ভোটে জিতেছে তার সাথে টেক্কা দেওয়া বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয় কারণ বিজেপির শাসনে কোনো রকমের রাখঢাক না করেই একচেটিয়া বিদেশী পুঁজির জুতো চাটা  হয় এবং জনগণের উপর বিদেশী শোষণ শাসনের নাগপাশ কে শক্ত করা হয়। তাই আর্থিক উন্নয়নের কথা, চাকরির প্রতিশ্রুতি, বা কালো টাকা ফেরত আনার মতন বুজরুকি দাবি বারবার চলবে না আর তাই গুজরাট মডেল কে অনুসরণ করে তীব্র ধর্মীয় বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি করে, অভিজাত ও নমঃশূদ্র হিন্দুদের মুসলমানদের জূজূ দেখিয়ে এক ছাতার তলে এনেই একমাত্র বিজেপির পক্ষে ভোটে জেতা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে তাই আজ গুজরাট মডেল অনুসরণ করে বিজেপি ও তার সহযোগীরা যেমন একদিকে দাঙ্গার আগুন লাগাচ্ছে ঠিক তেমনি অন্যদিকে এই দাঙ্গা আর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে গেরুয়া শিবির রাজ্যের জোতদার-জমিদার ও বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের সাথে সাথে বিদেশী বৃহৎ পুঁজিকেও ইশারা করছে যে তারা যেন এবার বিজেপির উপর কৃপা বর্ষণ করে এবং পশ্চিমবঙ্গের মসনদে যেন আগামী বার বিজেপি জিতে আসতে পারে।


পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দাঙ্গা আর হিংসার খেলায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তৃণমূল ও বিজেপি


মালদার চাঁচল, হুগলির চন্দননগর, পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর, বা উত্তর চব্বিশ পরগনার নৈহাটির অনতিদূরে হাজীনগরে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সৃষ্টি এই রাজ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসা হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো করলো তার প্রতিরোধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা তৃণমূল কংগ্রেস কি করলো? খড়্গপুরে দীর্ঘদিন ধরে অবাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্ধ চলে আসছে। রেল মাফিয়াদের এই শহরে ফরওয়ার্ড ব্লক ও কংগ্রেসের হাতে একসময়ে সমস্ত বড় বড় গুন্ডা ও মাফিয়ারা থাকলেও পরবর্তীকালে মেরুকরণের খেলায় ঢুকে বিজেপি সমস্ত সমাজবিরোধী শক্তির হিন্দু অংশ কে নিজের কবলে এনেছে। কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের বিধায়ক থাকা জ্ঞান সিংহ সোহনপাল ওরফে ‘চাচা’ কে ভোটে হারাতে তৃণমূল বিজেপির সাথে গোপন চুক্তি করেছিল বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই। আইআইটি খড়্গপুরে দীর্ঘদিন ধরে সাংস্কৃতিক সংগঠন সেজে বসে থাকা আরএসএস এর গুন্ডাদের শাখা বা অস্ত্র শিক্ষার শিবির চলছিল, তার সাথেই চলছিল ঘৃণার প্রচার। দিলীপ ঘোষের নির্বাচনে জেতার পর থেকেই খড়্গপুরের অবাঙালি (মূলতঃ হিন্দিভাষী ও তেলেগু) হিন্দুদের মধ্যে উল্লাস দেখা যায়, রমরমা বাড়ে বিজেপির সংগঠনের। দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বসে আবাঙালি আরএসএস কর্মীরা হিন্দু বাঙালি সেজে হিন্দি ও ইংরাজি ভাষায় যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গার নাম করে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছিল তারা দিলীপ ঘোষের ভোটে জেতার সময়ের থেকেই আরও চনমনে হয়ে ওঠে। আরএসএস এর নেতৃত্বে বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতন হিন্দুত্ব-সন্ত্রাসবাদী সংগঠন খড়্গপুর, আসানসোল, দুর্গাপুর, রাণীগঞ্জ, নৈহাটি, দুবরাজপুর, হাওড়া, ইত্যাদী শহরে স্থানীয় অবাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ী ও সমাজবিরোধী-মাফিয়াদের সাহায্যে বিগত ১৮ বছর ধরে নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা করার পর ২০১৪ সালে মোদীর বিজয়ের পর থেকেই তীব্র গতিতে নিজেদের শক্তি ও অনুপ্রবেশ কে বাড়িয়ে নেয়। সিপিএমের প্রতিপত্তি অস্ত গেছে, কংগ্রেসের অবস্থা তথৈবচ, রাজ্যে তৃণমূলের সাথে সরাসরি টেক্কা দেওয়ার মতন কর্পোরেট অনুমোদন প্রাপ্ত তেমন কোন বড় শক্তি না থাকার কারণে দ্রুত শূন্য স্থান পূরণ করে আরএসএস ও তার নানাবিধ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো।

মমতার সরকার মুখে বারবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা ও বিজেপির প্রতি হুঁশিয়ারি শোনা গেলেও তৃণমূলের একেবারে তৃণমূল স্তরে গেলেই জানা যাচ্ছে যে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের লড়াই করার কোন নির্দেশ কালীঘাট থেকে আসেনি কারণ কালীঘাটে ব্রাক্ষণত্ববাদী নেত্রী নিজে কোন ভাবেই চান না যে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদের জূজূ রাজ্য থেকে গায়েব হয়ে যায় কারণ তাতে ভীত সন্ত্রস্ত মুসলমান ভোট ব্যাংকের মেরুকরণের কাজে বাঁধা আসবে আর যতদিন দাঙ্গার উপক্রম জারি থাকবে ততদিন মানুষ কে ভয় দেখিয়ে স্বার্থ সিদ্ধি করা যাবে। এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের খেলায় পূর্ব মেদিনীপুর থেকে শুরু করে নৈহাটি পর্যন্ত সকল জায়গায় তৃণমূলের হিন্দুত্ববাদী নেতারাও সমান ভাবে জড়িত। তাই খুব সাবধানে মমতা বন্দোপাধ্যায় দাঙ্গার ঘটনা কে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ বললেও, বিজেপি ও আরএসএস কে পুরানো কংগ্রেসী কায়দায়  সাম্প্রদায়িক সংগঠন বললেও একবারের জন্যেও হিন্দুত্ববাদ বা ব্রাক্ষণত্ববাদ শব্দগুলো উচ্চারণ করেনি। বলা হয়নি যে এই দলগুলোর নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বা কি করে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীরা রাজ্যে ঘাঁটি শক্ত করলো তার তদন্তের কথাও। তাতে হয়তো অতীতে এই দলগুলোকে কি ভাবে প্রত্যক্ষ ভাবে মদত করে বাম আমলে রাজ্যে জমি পাইয়ে দিয়েছিল তৃণমূল ও মমতা - সে কথা আবার প্রকাশ্যে এসে যেত।

প্রদীপ পাশির নাম শোনা আছে ? এক কালের সিপিএমের  মস্তান থেকে বর্তমানে হাজীনগর অঞ্চলের তৃণমূলের কুখ্যাত সিন্ডিকেটবাজ ও তোলাবাজ নেতায় পরিণত হয়েছে এই লোকটা। হাজীনগরের দাঙ্গায় মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হয়ে ব্যাপক হারে উচ্চ জাতির হিন্দুদের ক্ষেপানোর ও নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ করে প্রদীপ, কিছুক্ষণের জন্যে পুলিশ তাকে ধরে গারদে পুরলেও, পরে উপর মহলের চাপে প্রদীপ পাশি ছাড়া পায়। তৃণমূলের এহেন নেতা যদি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অবাঙালি গুন্ডাদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমান নিধন যজ্ঞে অবলীলায় সামিল হতে পারে তাহলে মমতার কি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে ভাষণ দেওয়া সাজে ? মমতার দল তৃণমূলের যে সব নেতারা মাথায় তিলক কেটে ঘুরে বেড়ায়, দূর্গা পূজা কমিটির সভাপতিত্ব করে, মাজারে চাদর চড়ায়, বা ঈদের দিনে মাথায় টুপি পড়ে বাজারে ঘোরে তাদের দিয়ে কি আর ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা রক্ষা করা যায় ?  যে রাজ্যে তপন থেকে দিলীপ ঘোষের মতন কুখ্যাত হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজেরা সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দলীয় সম্মেলনে ধর্মীয় বিদ্বেষ মূলক ভাষণ দেয় আইনের তোয়াক্কা না করে, সেই রাজ্যে মমতা বন্দোপাধ্যায় কোন সুশাসনের কথা বলে। আসানসোলে বিজেপির বহিরাগত সাংসদ সুপ্রিয় বড়াল (বাবুল সুপ্রিয়) হিন্দুদের গরুর আবেগ নিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলে যে দাঙ্গা করাতে চাইছে তা কি তৃণমূলের প্রশাসনের ব্রাক্ষণত্ববাদী মাথাদের সমর্থন ছাড়া সম্ভব হতে পারে ? মমতা যে নানা কথার আড়ালে বিজেপি ও আরএসএস কে রাজ্যের রাজনীতির আঙিনায় প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরে কংগ্রেস ও সিপিএম কে টেক্কা দিতে চাইছে সে কথা কি বোঝা খুব শক্ত ? মমতার রাজত্বে পুলিশ ও প্রশাসনের উপর দলীয় প্রভাব সিপিএমের জমানার চেয়েও তীব্র হওয়া সত্বেও প্রশাসন যখন একদিকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে আক্রমণ করছে তখনই তারা হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডাধারীদের বিরুদ্ধে এত নরম আর এত কোমল কেন ?  


শ্রমিক আন্দোলনের ভাঁটার কারণে পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়েছে  সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প  



সাবর্ণ ভদ্রলোক বাঙালি সমাজে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব প্রবল ছিল তবুও বাংলার মাটিতে বহু বছর ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি, এর একমাত্র কারণ ছিল ১৯৫০-৭০ এর দশক অবধি এই রাজ্যে শ্রমিক ও কৃষকের আন্দোলন তীব্র হয়েছিল মালিক-জোতদারদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার পরে বিপুল ভাবে শ্রমিক ও কৃষক সমাজ আন্দোলিত হয়। সেদিন শ্রমিক ও কৃষকদের জাগ্রত চেতনায় ভীত হয়ে নানা ভাবে কংগ্রেসী শাসকেরা ও জনসংঘের নেতারা চেষ্টা করেছিল পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে আবার শ্যামা প্রসাদের মতন দানবের ছায়া চাপিয়ে দিতে কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়।পূর্ব বাংলার থেকে শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঠাঁই পাওয়া সাবর্ণ উদ্বাস্তুরা বামপন্থী আন্দোলনের সাথে জুড়েছিলেন এবং আন্দোলনের মধ্যে থাকায় তাঁদের মধ্যে, বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছিল তা চাপা পড়ে যায়।  শ্রমিক ও কৃষকের ঐক্যবদ্ধ এই জঙ্গী সংগ্রামে জোর ধাক্কা লাগে যখন নানা প্রতিশ্রুতির তুফান ছুটিয়ে জ্যোতি বোসের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কারখানা মালিকদের সাথে হাত মিলিয়ে জ্যোতি বোস আর সিপিএম শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলন কে দুর্বল করতে শুরু করে লক আউটের খেলা। শিল্প নির্ভর শহরগুলো ডুবে যায় অন্ধকারে, শ্রমিকদের বাড়িতে শুরু হয় দু মুঠো ভাতের জন্যে হাহাকার। চা বাগানের শ্রমিকদের না খেতে পেয়ে মুখে রক্ত উঠে মরে যাবার কথা বাদ দিলাম, শহরাঞ্চলের, খাস কলকাতার কাছেপিঠের চটকলগুলোয় কত শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান, বিহারি-বাঙালি নির্বিশেষে না খেতে পেয়ে বা বিনা চিকিৎসায় সেই আশির দশকের মাঝের সময়ের থেকে যে মারা গেছেন তার কোন হিসেব নেই।নব্বইয়ের দশকের থেকে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির হাওয়া ঢোকার সাথে সাথে এই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া শ্রমিক মহল্লায় ঢোকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ। মালিকের দরকার হয় কারখানার বন্ধ জমির উপর বহুতল অট্টালিকার, যেখানে বাস করবে বাংলার মাটির সাথে সম্পর্কহীন একদল ক্লীব রক্তচোষা নয়া পঙ্গপাল শ্রেণীর, ভদ্রলোকের  প্রজাতি। সেই বহুতলের শিল্পের গড্ডালিকায় ডোবা বাংলার মাটিতে শ্রমিকের পিঠে ছুরি চালায় এই সব বন্ধ কারখানার জমির দালালি করা সিপিএম। শ্রমিকরা সিপিএমের এই বেইমানি দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেন আর এখানেই ধীরে ধীরে সুযোগ করে নিজের রাজনীতি প্রচার করতে থাকে সংঘ পরিবার। শিল্পহীন ও কর্ম সংস্থানের সুযোগহীন বাংলার শ্রমিক শ্রেণী ক্রমাগত নিঃস্ব ও বাইরের রাজ্যে দিন মজুরে  পরিণত হয়। ধর্মের প্রভাব বাড়ে মানুষের সংকটের কালে আর তাই ধীরে ধীরে মাটির ভিতর শিকড় শক্ত করে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। পূর্ব বাংলার থেকে পালিয়ে আসা প্রাক্তন উদ্বাস্তু অভিজাত বাঙালিদের মধ্যে সুপ্ত মুসলমান বিদ্বেষ চাড়া দিয়ে জাগে। বন্ধ কারখানার প্রাক্তন শ্রমিকেরা এবং কোন রকমে চাকরি বাঁচিয়ে কাজ করতে থাকা শ্রমিকদের শেখানো হয় তাঁদের সাথে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে মুসলমান শ্রমিকটি কাজ করছেন তিনি নাকি পাকিস্তানের চর, তাঁর ছেলে নাকি হিন্দু মেয়ে ফুসলিয়ে বিয়ে করে নিজের ধর্মে বদলে দেবে, তাঁর বাড়িতে নাকি রোজ গরু কাটা হয়, ইত্যাদি। সরকারি বাম আর ডানের মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না এই ঘৃণ্য সংঘ পরিবারের রাজনীতি প্রচারের বেলায়। সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস, বকলমে সকলেই কোন না কোন ভাবে নিজেদের তৃণমূল স্তরের কর্মীদের দিয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ ছড়ায়। আজ সেই বিষের বীজ থেকে গড়ে উঠেছে অৰ্থনৈতিক অর্থে মরুভূমি হয়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের মহীরুহ বিষ বৃক্ষ। শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলন ও সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে রাখতে এই সাম্প্রদায়িক বিষ বৃক্ষের ফলই মালিক ও জোতদার শ্রেণীর প্রচন্ড কাজে লাগে, আর তাই তাদের আদেশে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে সরকারি ভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও দাঙ্গার উদ্বোধন করে ফেলেছে মমতার সরকার।এই বিষ বৃক্ষের থেকেই মাটিতে রোপন হচ্ছে সানাউল্লাহ বা প্রদীপ পাশির মতন বিষাক্ত বীজদের  যারা আগামী দিনে আরও ঘৃণ্য রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবে সংঘ পরিবার কে সাহায্য করতে।

 

বাংলার শ্রমজীবী মানুষ কে ঐক্যবদ্ধ করেই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের রথ কে রোখা সম্ভব হবে


একেবারে অশ্বমেধ যজ্ঞ! সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে ঘোড়াটা পাঠানো হয়েছে, সদর্পে ছুটে ছুটে সেই ঘোড়া আমাদের শান্তির ফসল নষ্ট করছে এই বাংলার বুকে। আর এই ঘোড়া কে এতদিন রক্ষা করেছে, দানাপানি খাইয়েছে একদল অবাঙালি উঁচু জাতের হিন্দু ব্যবসায়ী ও একদল উঁচু জাতের শহুরে বাঙালি যারা নিজেদের বাঙালি পরিচয় নিয়ে লজ্জিত এবং হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান এর পক্ষে ওকালতি করে। এই ঘোড়া আমাদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছে, আমাদের জনগণ কে পায়ের ক্ষুর দিয়ে পিষেছে, আর তাই আজ বাঙালি শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া শ্রমিক ও কৃষকের, আদিবাসী ভাই বোনেদের, বাংলার দলিত সমাজের, বাংলার মুসলমান ও খ্রিস্টান ভাই বোনেদের কর্তব্য হলো এই সাম্প্রদায়িক ঘোড়ার মুন্ডুচ্ছেদ করার, সুদূর মহারাষ্ট্রে আর দিল্লিতে বসে যারা সারা ভারতের খেটে খাওয়া মানুষ কে জোতদার-জমিদার আর বৃহৎ বিদেশী কর্পোরেট পুঁজি ও তার দেশি মুৎসুদ্দিদের গোলাম বানিয়ে বন্দি করতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার।

পশ্চিমবঙ্গে বিগত দুই বছরে যে ভাবে হিন্দুত্ববাদের রথ মমতার গোপন সমর্থনে বলীয়ান হয়ে নিজের প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে যে গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী বাঙালিদের পক্ষে তাল মেলানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সরাসরি প্রতিরোধ না করে সরকারি বামপন্থীরা হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কে শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবি ও ছাত্র সমাজ কেন্দ্রিক করে রেখে ইচ্ছাকৃত ভাবে শ্রমজীবি মানুষকে এই লড়াই থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। শ্রমজীবি জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কখনোই বিপ্লবী বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিতে পারবেন না আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে আর তাই এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে নিজেদের বিষাক্ত রাজনীতির প্রসার করা আজ বিজেপি ও আরএসএস এর কাছে একেবারে জলভাত হয়ে উঠেছে। সারা বাংলা জুড়ে যখন বিজেপি হিন্দুত্ববাদের ঝাণ্ডা তুলে তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণের পক্ষে সোচ্চার হয়ে পথে নেমেছে, সুদূর পাড়া গাঁয়ে ঢুকে কৃষকে কৃষকে দাঙ্গা লাগাবার উস্কানি দিচ্ছে তখন গুটিকয়েক ছাত্র-ছাত্রী ও কিছু সাংস্কৃতিক কর্মীদের দিয়ে মিছিল করানো বাদে বাম আন্দোলনের তথাকথিত কান্ডারীরা আর কিছুই করেনি। আজ এই সংকীর্ণতার গন্ডি পেরিয়ে, এই comfort zone  এর থেকে বাইরে এসে, চেনা গন্ডির বাইরে এসে, সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক কৃষকের কাছে পৌঁছে তাঁদের মধ্যে লেগে পড়ে থেকে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা। আজ দরকার সমস্ত আদিবাসী, দলিত, ও শোষিত জনজাতির জনগণের শ্রমজীবি অংশ কে পশ্চিমবঙ্গের আক্রান্ত সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে সংগ্রামী মেলবন্ধে জড়িত করা, কারণ সংঘ পরিবার পরবর্তী কালে উচ্চ জাতির হিন্দু বাঙালিদের সাহায্যে আক্রমণ এই সকল সম্প্রদায়ের উপর নামিয়ে আনবে।  এটাই হিন্দুত্ববাদী-ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষণ।


গণতন্ত্র প্রিয় প্রতিটি প্রগতিশীল বাঙালিকে আজ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের সাপ কে মারতে উদ্যোগ নিতে হবে, জনগণের প্রাণ, জীবিকা, ও সম্পত্তি রক্ষার জন্যে যখন তৃণমূলের সরকার কিছুই করবে না, যখন তৃণমূলের নেতারা রাত বিরেতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঝান্ডা নিয়ে এসে সংখ্যালঘু মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বাড়িতে আগুন লাগাবার চেষ্টা করবে, মেয়েদের ধর্ষণ করার চেষ্টা করবে, পুরুষদের গুম খুন করবে, তখন সামগ্রিক ভাবে সমস্ত গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষ কে এগিয়ে আসতে হবে, লড়তে হবেই এই কর্পোরেট স্পনসরশিপ প্রাপ্ত সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং এক হয়ে পরাস্ত করতে হবে এই আগ্রাসন কে। বাংলা আর বাঙালির অস্তিত্ব এই হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনের সামনে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে যদি আজ থেকেই দলগত, ব্যক্তিগত, নীতিগত বিভেদ দূর করে আমরা সবাই এক হয়ে লড়াই শুরু না করি। বাংলার মাটিতে যদি ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা যায় তাহলে কিন্তু সমস্ত ভারতের সামনেই তা এক উদাহরণ হয়ে গণতন্ত্রের দাবিতে লড়তে থাকা মানুষ কে সাহস ও অনুপ্রেরণা দেবে গেরুয়া বাহিনী কে পরাস্ত করার লড়াইয়ে এগিয়ে আসতে। আজ উদাহরণ ও অনুপ্রেরণার বড়ই অভাব, তাই আসুন আমরা একজোট হয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করি, অনুপ্রেরণা দিই দেশজোড়া বিজেপি-আরএসএস বিরোধী সংগ্রাম কে।    

সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের আড়ালে কর্পোরেট স্বার্থে বিজেপি করাচ্ছে গণহত্যা

বুধবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

ঝাড়খণ্ডের হাজারীবাগের বরকাগাঁওয়ে  বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময়ে গ্রামবাসীদের উপর চালানো পুলিশের গুলিতে আহত যুবক ছবির সত্বঃ নয়া সাবেরা বিকাশ কেন্দ্র ও দা ওয়্যার 


যতদিন যাচ্ছে দেশের মিডিয়া গোষ্ঠীগুলো যুদ্ধের দামামা বাজানোর কাজে বেশি বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে আর এদের হাব ভাব ও সরকারের প্রতি ভক্তি দেখে মনে হচ্ছে যে মার্কিন মুলুক থেকে এদের সর্দারেরা হয়তো বার্তা পাঠিয়েছে যে শুধু ২০১৭ সালের উত্তর প্রদেশ নির্বাচনেই নয়, বরং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও মোদীকেই আবার জিতিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে দিল্লির মসনদে। বিজেপি কে বাদ দিয়ে অন্য কোনো সংসদীয় দল যে এত উলঙ্গ চাটুকারিতার সাথে মার্কিন একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। তাই বোধহয় শেয়ার হোল্ডার থেকে মহাজনদের চাপে সাংবাদিক মহলে বেশ বিদ্রোহী ইমেজ বজায় রাখা সাংবাদিকেরাও মোদীর গুণকীর্তন  করতে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের জয়জয়কার করে বিশ্রী হট্টগোল করতে, ন্যাংটো হয়ে সেই পাঁকেই নেমেছে, যে পাঁকে নামা গো ভক্ত সাংবাদিককূলকে এই সেদিনও এরা গালমন্দ করতো, সরকারের দালাল বলতো। পেটের দায় যে বড় দায়, সরকার বাহাদুরের সাথে ঝগড়া করা যায় কিন্তু লগ্নিকারী মার্কিন কর্পোরেশনগুলোর সাথে তা করলে যে বাংলো-গাড়ি-ব্যাংক ব্যালান্স বা বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা, সবই ফেঁসে যাবে !

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছে বলে যখন ব্রাক্ষণত্ববাদী মিডিয়া ধেই ধেই করে নাচছে আর সরকারি বামপন্থী সংবাদ মাধ্যম যখন এই মুজরোতে করতাল বাজিয়ে তাল দিচ্ছিল ঠিক তখনই সবার অলক্ষ্যে কাশ্মীরের জনগণ তো বটেই এমনকি এই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সীমানার থেকে অনতিদূরেই হাজারীবাগে কৃষক হত্যা করছে রঘুবর দাসের বিজেপি সরকার। এনটিপিসি’র তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যে খনন কার্যের জন্যে হাজারীবাগ জেলার তিন ফসলি জমি দখল করার বিরোধিতা করে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাসীরা লড়ছিলেন, গত ১লা অক্টোবর সকালবেলায় গ্রামবাসীদের উপর হামলা করে ছয় জন কে খুন এবং ৪০ জনকে আহত করে রঘুবর দাসের খুনি পুলিশ বাহিনী।

ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার করণপুরা উপত্যকায় ৪৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কয়লা খননের বরাত পায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসি, যে সংস্থার ব্যাপক হারে বেসরকারিকরণ করেছে কংগ্রেস আর বিজেপি সরকার। ২০০৪ সাল থেকেই এই অঞ্চলে নিজের প্রতিপত্তি বিস্তার করার প্রচেষ্টা শুরু করে এনটিপিসি, কিন্তু ব্যাপক গণ বিক্ষোভ ও কৃষকদের প্রতিরোধের ফলে বেশি দাঁত বসাতে অপারগ হয় সংস্থাটি। কিন্তু কেন্দ্রে মোদী সরকার আর রাজ্যে  রঘুবর দাসের সরকার প্রতিষ্ঠার পরেই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে খননের অধিকার প্রাপ্তি করা জলভাত হয়ে যায় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর পক্ষে। ১৭,০০০ হেক্টরের মধ্যে প্রায় ২৫০০ হেক্টরে খননের জন্যে বন মন্ত্রকের থেকে অনুমতি প্রাপ্ত হলেও আইন অনুসারে জঙ্গল এলাকার ৭০ শতাংশের বেশি গ্রাম সভার সম্মতি ছাড়া সেই অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণ ও খনন কার্য না করা গেলেও বিজেপির মদতে এনটিপিসি এই বছরের মে মাস থেকে খনন কার্য শুরু করে।যার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন সাধারণ গ্রামবাসীরা এবং তাঁরা শান্তিপূর্ণ ভাবে ‘সত্যাগ্রহের’ পথ ধরে আন্দোলন করতে থাকেন এই খনন কার্যের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে।

পাকড়ি বারোয়াদিহ অঞ্চলে ১৬০০ কোটি টন কয়লা মজুত আছে আর এই কয়লা ব্লকের আগে কখনো কেন্দ্রীয় সরকার এত বড় ক্যাপটিভ ব্লক  বরাদ্দ করেনি। এনটিপিসি এই অঞ্চলের খনন কাজের ঠিকা দেয় দুইটি এমন সংস্থা কে যাদের উপর দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির অভিযোগ লেগে আসছে, বেআইনি খননের অভিযোগও আছে। থ্রিবেনি আর্থ  মুভার্স ও সৈনিক মাইনিং নামক এই দুই সংস্থা কেওনঝড় আকরিক লোহা উত্তোলনের কেলেঙ্কারি থেকে কয়লা কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিল এবং থ্রিবেনি আর্থ মোভার্স এর বিরুদ্ধে শাহ কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের তদন্তেও অনেক বার দুর্নীতির দ্বারা সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার অভিযোগ ছিল। এই দুই সংস্থার কর্তাদের সাথে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি নেতৃত্বের ভীষণ গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক স্থাপন হওয়ার ফলে একেবারে আইন কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এরা পুলিশ ও প্রশাসন কে ব্যবহার করে খনন কার্য শুরু করে এবং কংগ্রেসি বিধায়ক নির্মলা দেবীর নেতৃত্বে পরিচালিত শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম কে মাওবাদী প্রভাব যুক্ত বলে পুলিশ লেলিয়ে দেয় প্রতিবাদী গ্রামবাসীদের উপর। নির্মলা দেবী সহ অন্যান্য সমস্ত প্রতিবাদী নারীদের যখন ১লা অক্টোবর ভোর ৪টা নাগাদ চুলের মুঠি ধরে টেনে সরিয়ে দিতে থাকে থ্রিবেনি ও সৈনিক মাইনিং এর ভাড়াটে ঝাড়খন্ড পুলিশ, তখন সেখানে উপস্থিত প্রায় ৪০০ কৃষকেরা গর্জে উঠে প্রতিরোধ করতেই তাঁদের উপর বেপরোয়া হয়ে গুলি চালানো শুরু করে রঘুবর দাসের বাহিনী। ঘটনার সময়ে গুলিতে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়েন ৪৬ জন মানুষ, যাঁদের মধ্যে মৃত্যু হয় রঞ্জন রবিদাস, মাহতাব আলম, রাজেশ সাউ, অভিষেক রাই, পবন সাউ, এবং অন্য একজনের।

এই বছরের গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণ ও খুন করা এই এলাকায় নতুন ঘটনা নয়। এই পুলিশি সন্ত্রাস তীব্র রূপ ধারণ করে ২০১৩ সাল থেকে যখন এই এলাকায় প্রথম আক্রমণ করে ঝাড়খন্ড সরকারের খুনি বাহিনী। ২০১৩ সালের ২৩শে জুলাই পুলিশ খনি কোম্পানির ঠিকেদারদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী পাগর গ্রামের কৃষকদের উপর গুলি চালায় এবং এই আক্রমণে নিহত হন কেশর মাহাতো নামক একজন কৃষক। ২০১৫ সালের ১৪ অগাস্ট এই এলাকায় পুলিশের গুলি চালনায় ১ জন সাংবাদিক সহ ৬ জন আহত হন এবং সেই দিন পুলিশ ২২ রাউন্ড গুলি চালায় কয়লা খননকারী ঠিকাদার সংস্থার পক্ষ থেকে। বারবার এই অঞ্চলে জমি দখল করতে হিংস্র রূপ ধারণ করেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, যারা আজ কর্পোরেট মহলের ভাড়াটে ফৌজ হিসেবে কাজ করছে। ঝাড়খণ্ডের সৃষ্টি হওয়ার নৈপথ্যে ছিল কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে সহজে খননের বরাত পাইয়ে কমিশন আয় করা এবং গত ১৬ বছরে ঝাড়খণ্ডের পুলিশ ও প্রশাসন পুরোদস্তুর কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দালাল রূপে কাজে পারদর্শিতা দেখিয়েছে এবং অসংখ্য যুবক যুবতীদের মাওবাদী আখ্যা দিয়ে হত্যা করে, বন্দি করে আর অপহরণ করে সরকারি মেডেল জিতেছে। করণপুরা আর বরকাগাঁও অঞ্চলেও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর টাকা খেয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী এগিয়ে এসেছে এলাকার কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে ও ব্যাপক হারে গ্রামবাসীদের তাঁদের জমি ও সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করতে।          

সমগ্র করণপুরা অঞ্চল তিন ফসলি জমিতে সমৃদ্ধ এবং প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কৃষি অর্থনীতি এই এলাকার মানুষের প্রধান উপার্জন।বহুদিন ধরে এই অঞ্চলের সমস্ত গ্রাম সভায় কৃষি জমি খনির জন্যে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হয়েছে এবং এলাকার কৃষকেরা হাতে করে কয়লা উত্তোলন করে তা বিক্রি করে গ্রামসভাকে রাজস্ব দিয়ে বিকল্প অর্থনীতির পথ দেখিয়েছেন সরকারকে।বিকল্প কয়লা উত্তোলনের পথে চলে যদি একটি টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব রাস্তার উদ্ভাবন হয় তাহলে দেশের অনেক অঞ্চলে খনিজ পদার্থ খননের জন্যে তা কাজে আসতে পারে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জঙ্গলের ক্ষতি না করে, জনগণ কে উচ্ছেদ না করেই। কিন্তু সেই পথে চললে সৈনিক মাইনিংস বা থ্রিবেনি আর্থমুভিং এর মতন সংস্থাগুলো টাকা আয় করতে পারবে না, বেদান্ত বা পস্কো কোটি কোটি ডলার লাভ কামাতে পারবে না, ভারতের সরকারকে তাহলে কর্পোরেট খননকারী সংস্থার জায়গায় বরাত দিতে হবে এলাকার জনগণ কে, বিশেষ করে সেই আদিবাসী জনতা কে যাঁরা বহু যুগ ধরে সঞ্চিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রকৃতি কে রক্ষা করে চলেছেন বলেই আজ ভারতবর্ষের মানুষের কাছে শ্বাস নেওয়ার জন্যে অক্সিজেন রয়েছে। আর জনগণ কে বা সরকারি গণ সংস্থা, যেমন গ্রাম সভাকে যদি বরাত দেওয়া হয় কয়লা বা আকরিক লোহা উত্তোলনের তাহলে তো কমিশনের অঙ্ক শূন্য হয়ে যাবে।  তাই কমিশন কামাবার ধান্দায় এগিয়ে থাকতে রঘুবর দাসের সরকার সেই সমস্ত প্রস্তাবকে নাকচ করে কৃষক মারতে উদ্ধত হয়েছে।  

ঝাড়খন্ড সরকার এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ আদানি ও বেদান্তের মতন কুখ্যাত সংস্থার সাথে মৌ স্বাক্ষরিত করেছে, সেপ্টেম্বর মাসের ২০ তারিখে মুম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত ঝাড়খন্ড রোড শো’র মাধ্যমে ১৯৫০ কোটি টাকার মৌ সই করেছে। এই ‘মৌবাদের’ ঠেলায় আগামী দিনে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী জনগণের প্রাণ অতিষ্ঠ করতে ময়দানে আর জঙ্গলে বেশি জোরদার করা হবে ভারত রাষ্ট্রের আদিবাসী খেঁদাও অভিযান - অপারেশন গ্রিন হান্ট কে। আদানি ও বেদান্তের পাতে লাভের ক্ষীর তুলে দিতে ছত্তিশগড় ও ওডিশার মতন তীব্র করা হবে ঝাড়খণ্ডের রাষ্ট্রীয় মদত প্রাপ্ত ‘বেসরকারি’ হার্মাদ বাহিনীগুলোকে। হাজারীবাগের ঘটনা স্পষ্ট করছে যে আগামী দিনে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার, কেন্দ্রের মোদী সরকারের সামরিক সমর্থনে বলীয়ান হয়ে তীব্র হিংসাত্মক অভিযান চালাবে খনি কর্পোরেশনগুলোর পক্ষ থেকে। ছত্তিশগড়ের স্তরেই গণহত্যা, ধর্ষণ, পুলিশ ও বেসরকারি কর্পোরেট মিলিশিয়ার মাধ্যমে সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার সমস্ত রাজ্যের আদিবাসী জনগণের সম্পদ তুলে দিতে চায় কর্পোরেটদের হাতে।  

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, ভারতের কর্পোরেট মিডিয়ার নির্লজ্জ ভাবে সরকারের পদলেহন করা নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি, কিন্তু যে বিষয়টা আজ বেশি করে আলোচনা করা দরকার, তা হলো কি ভাবে মোদী সরকার, একের পর এক আগডুম বাগডুম প্রচার অভিযানের মধ্যে দিয়ে কর্পোরেট লুঠ তরাজ থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিচ্ছে সীমান্তের নাটকের দিকে। ফ্যাসিবাদী ব্রাক্ষণত্ববাদ আজ অভিজাত হিন্দুদের মধ্যে উগ্র দেশপ্রেম ও জাতি বিদ্বেষের হুজুগ তুলে সামগ্রিক ভাবে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারগুলোকে সংকুচিত করার ফন্দি কষছে। শ্রমিক-কৃষক, মেহনতি জনতা, দলিত-আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের ঐক্য কে ভাঙ্গার জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচা করছে। আর এই ষড়যন্ত্রগুলোর পিছনে সর্বদাই রয়েছে দেশি ও বিদেশি পুঁজির উদার সমর্থন। এই বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির আজ মোদীকে দরকার আগামী বেশি কিছু বছরের জন্য। তাই তারা যে করে হোক মোদী কে এক বলিষ্ঠ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হিন্দু নেতা হিসেবে ২০১৯ সালের পরেও প্রতিষ্ঠিত করে রাখতে চায়।আর তাই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে, পাকিস্তান আর চীনের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে, কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম পুরোদস্তুর বিজেপি ও মোদী কে পুনরায় হিরো বানাবার স্বার্থে এখন সমস্ত কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর লড়াইয়ের ঘটনা কে চাপা দিচ্ছে গগনভেদী যুদ্ধ হুঙ্কার দিয়ে। আর সেই যুদ্ধের হুজুগে মেতে উচ্চ জাতির স্বচ্ছল লোকেরা হাততালি দিলেও ঝাড়খণ্ডের হাজারীবাগের মতন ঘটনায় রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে মৃত্যু হচ্ছে গরিব দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের। তাই এই যুদ্ধ আর পরাক্রমণের হুজুগের বাইরে গিয়ে আমাদের আজ গরিব মানুষের সাথে মিলে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তার ভারতীয় মুৎসুদ্দি দালালদের দেশের জল-জঙ্গল-মাটি ও মানুষ বেচার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

    

মোদীর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্প আর ব্রাক্ষণত্ববাদী কর্পোরেট মিডিয়ার নির্লজ্জ দালালি

শনিবার, অক্টোবর ০১, ২০১৬ 0 Comments A+ a-



২৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ভারতের সেনাবাহিনীর মহাপরিচালক (অপারেশন) রণবীর সিংহ এক সাংবাদিক সম্মেলনে মোদী সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করেন  যে ভারতের সেনাবাহিনীর একটি টিম নাকি বুধবার মধ্যরাতের সাড়ে ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে কয়েক কিলোমিটার এলাকার ভিতরে কিছু জঙ্গী “লঞ্চপ্যাডে” সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে এমন জঙ্গীদের খতম করেছে যারা নাকি কিছুদিনের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে ভারতের সেনা ঘাঁটির উপর আবার উরির কায়দায় হামলা করার পরিকল্পনা করছিল। এর সাথে সাথে রণবীর সিংহ বলেন  যে এই আক্রমণে ভারতের সেনাবাহিনীর হামলায় ৩৫ জন জঙ্গী ও তাদের সমর্থকের মৃত্যু হয়েছে এবং এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর রণবীর সিংহ টেলিফোন করে পাকিস্তানের সেনা কর্তাদের নাকি জানিয়েছেন।রণবীর সিংহ বলেন যে ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে নাকি গোপন সূত্রে পাওয়া পাকা খবর ছিল যে এই সব সন্ত্রাসবাদীরা নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে হামলা করতে আসছিল।

সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের এই বিবৃতি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই মোদী ভক্তদের উল্লাসের বাঁধ ভেঙে যায়।এই সাংবাদিক সম্মেলনের পর থেকেই কর্পোরেট পাবলিক রিলেশন্স বা জন সম্পর্ক অভিযানের মতন ভারত সরকার ও বিজেপি নিজেদের পিঠ চাপড়াতে থাকে। সারা দেশজুড়ে কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমগুলো নানা ভাষায় আর নানা ভাবে মানুষ কে বোঝাতে থাকে কি ভাবে ভারতের সেনা বাহিনী এমন এক দুঃসাহসিক অভিযান করে পাকিস্তানের দখলে থাকা এলাকার ভিতরে ঢুকে জঙ্গী হত্যা করে ভারতের স্বার্থ কে সুরক্ষিত করেছে। চতুর্দিকে শুধু মোদীর জয় জয়কারে আকাশ বাতাস ভরে গেল। বিজেপির নেতারা বুক বাজিয়ে বলতে থাকলো যে “বলেছিলাম না, মোদীর ভারত চুপচাপ আক্রমণ সহ্য করবে না”, মোদী কে হিন্দু ভারতের সর্বাধিনায়ক রক্ষাকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করে টুইটার জুড়ে তার প্রশংসার ঝড় বইয়ে দেয় অমিত শাহ থেকে শুরু করে সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা।মোদী প্রশংসার এই বন্যায় সংসদীয় বাম-ডান-মাঝখানের সব বিরোধীরাও  ভেসে যায়  দুই হাত তুলে মোদী সরকারের জয় জয়কার করে। কর্পোরেট মহল ভারতের সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রশংসা করে উচ্চগ্রামে। আনন্দ মাহিন্দ্রা থেকে কিরণ শাও মজুমদার, সকলেই মোদী সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বিজেপির পদক্ষেপের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানান দেয়। ভারতের কর্পোরেট দুনিয়ার সমর্থন পেয়ে আরও আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে মোদী সরকার ও বিজেপি। জোর কদমে ঢাক বাজতে থাকে।কর্পোরেট মিডিয়ায় রক্ত পিপাসু কিছু লোক, যারা বেশ কয়েকদিন ধরে পাকিস্তানের রক্ত চাই, রক্ত চাই, বলে চিৎকার করছিলো, তারাও এই ঢাকে কাঠি দিল আর সাথে সাথে যে সকল সংবাদ মাধ্যম এতদিন মধ্যপন্থায় গিয়ে বলছিলো যে যুদ্ধ নয় কূটনৈতিক ভাবে পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়াও, তারাও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর শুনে ধেই ধেই করে নেচে উঠলো। সমগ্র দেশের সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে, টিভির পর্দা জুড়ে, রেডিও, ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুধুই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। মনে হলো যদি দেশের কিছু নিয়ে গর্ব করার থাকে, তাহলে তা হলো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, যদি ভারতের সর্ব শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব বলে কিছু থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তা হলো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক।  

তবু অনেকগুলো ফাঁক রয়ে গেছে সামরিক বাহিনীর মহাপরিচালক (অপারেশন) রণবীর সিংহের বক্তব্যে, যা নিয়ে আমাদের দেশের শাসকশ্রেণীর বশংবদ সংবাদ মাধ্যম কোনোদিন মাথা ঘামাবে না বা প্রশ্ন তুলবে না।অথচ সত্য কে জানার জন্যে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া ভীষণ জরুরী। প্রশ্ন তোলার অধিকার একটা গণতান্ত্রিক দেশের সমস্ত নাগরিকের আছে, আর দেশপ্রেম বা জাতীয় সুরক্ষার নামে যদি দেশলাইয়ের বাক্স থেকে রিকশার টায়ার কেনার মাধ্যমে যে জনগণ কর দিচ্ছে তাঁরা জানতে না পারেন যে তাঁদের টাকা সরকার কি ভাবে অপচয় করছে, তাহলে সুনিশ্চিত হতে হবে যে ডাল মে কুছ কালা হায়।

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে যে ভারতের সেনাকর্তার এই সাংবাদিক সম্মেলনে কোনো সাংবাদিক কে প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়নি। ভারতীয় সেনার ডিজিএমও রণবীর সিংহ এই তথাকথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য  প্রমাণ বা নথি পেশ করেননি, জানিয়েছেন যে উপযুক্ত সময়ে ভারতীয় সেনা এই নথি প্রকাশ করবে। কোন জঙ্গী সংগঠনের উপর হামলা করা হলো, কি করে জানা গেল যে তারা জঙ্গী ঘাঁটিতেই হামলা করেছে, বা কোথায় কোথায় এই হামলা করা হলো তার কোনো তথ্যই এই সাংবাদিক সম্মেলনে পেশ করা হয়নি। এই সাংবাদিক বৈঠকের পরে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর ছড়িয়ে পড়তেই পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনী সোজাসুজি এমন কোনো আগ্রাসনের খবর অস্বীকার করে জানায় যে ভারতের তরফ থেকে বুধবার ভয়ানক গোলা বর্ষণ করা হয় এবং এর ফলে তাদের দুই জন সৈন্য মারা গেছে। সেই গোলাবর্ষণের ঘটনাকে যদি ভারতের সেনা বাহিনী সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্পের সাথে গুলিয়ে ফেলতে চায় তাহলে সেটা হবে ভারতের শাসকশ্রেণীর দেউলিয়াপনার নিদর্শন,  তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো এই তথাকথিত “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” ঘটনাটি কে সেই রকম গুরুত্ব দেয়নি যা সাধারণতঃ ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে কোন সংঘর্ষ পেয়ে থাকে। এই হালকা ভাবে দেখাটাও অনেকের চোখে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।

আমরা আগেই একটা শংকা প্রকাশ করেছিলাম যে যদিও ভারতের মোদী সরকার একটা জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী সরকার এবং প্রতিবেশী দেশ ও কাশ্মীর সহ অন্যান্য জাতিসত্তার বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অভিপ্রায় এই সরকারের রন্ধে রন্ধে, তবুও যতদিন না মার্কিন দেশের নির্বাচন শেষ হচ্ছে ততদিন ভারতের বা পাকিস্তানের পক্ষে কোনো রকম বড় ধরণের সামরিক অভিযান করা সম্ভব নয়, কারণ এই দুই সরকার যে মার্কিন শাসক শ্রেণীর গোলামি করে তারা এই মুহূর্তে যেন তেন প্রকারে হিলারি ক্লিন্টন কে জিতিয়ে রাষ্ট্রপতি করে গরিব আমেরিকানদের ধাপ্পা দিতে বিস্তর পরিশ্রম করছে। ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ হলে মার্কিন সরকারকে, যে সরকার এখন ওবামার নেতৃত্বে সেই ডেমোক্র্যাটদের হাতেই রয়েছে, একটা পক্ষ নিতেই হবে - যা নিঃসন্দেহে ভারতের পক্ষে যাবে কারণ ভারতের বাজার ও খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার পাকিস্তানের চেয়ে বেশ বড় এবং অনেক বেশি করে একচেটিয়া পুঁজির উপযোগী। আর এই ভাবে যদি ডেমোক্র্যাট সরকার কে পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকেরা সরাসরি ভারতের পক্ষে ঝুঁকতে দেখে তাহলে তারা হয়তো হিলারিকে ভোট দিতে ইতস্তত করবে, যা ডেমোক্র্যাটদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের জূজূ দেখিয়ে যে মুসলমান ভোটের মেরুকরণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে জল ঢেলে দেবে। ফলে এই বছরের নভেম্বর অবধি লাগাম ধরে রাখার নির্দেশ নয়া দিল্লি ও ইসলামাবাদে এসেছে হোয়াইট হাউস থেকে। তাই উরিতে জঙ্গী হামলার পরেই এক সময়ে পাকিস্তান কে উপযুক্ত ভাষায় জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া নরেন্দ্র মোদীও গুটিয়ে গেছিল ও কেরলের কোঝিকোডে অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি দূর করার যুদ্ধের কথা বলে বা কখনো ইন্দাস নদীর  জলবণ্টন চুক্তি খারিজ করা বা পাকিস্তান কে দেওয়া মোস্ট ফেভারড নেশন এর তকমা সরিয়ে দেওয়ার কথা বলে  হাওয়া ঘোরাবার চেষ্টা তাকে করতে হয়। কিন্তু মোদীর ম্যানেজার’রা বুঝেছিল যে এই সব জবাবে বিজেপির পাঁড় সমর্থকেরা, উঁচু জাতের ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত হিন্দুরা কোনো ভাবেই সন্তুষ্ট হবে না এবং এর ফলে হয়তো উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে সমর্থন খোয়াতে হতে পারে। ফলে একটা সাপ মেরে লাঠি অক্ষত রাখার পথ খুঁজে পাওয়ার দরকার ছিল গেরুয়া শিবিরের কাছে।

মার্কিন দেশ থেকেই পথ বাতলানো হলো। কথা হলো মোদীর প্রিয় পাত্র ও আরএসএস এর সমর্থক তথা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা  অজিত দোভাল ও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইসের মধ্যে। সেই টেলিফোনে বাৰ্তালাপের পরেই রণবীর সিংহ কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলন করে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর দেন, যে স্ট্রাইকের সাথে আবার কিছুদিন আগে রিলায়েন্স ঘনিষ্ঠ কুইন্ট ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত ভারতের পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে হামলা করে ২০০ জঙ্গী মারার ভুঁয়ো খবরের অনেক মিল রয়েছে। সেই ভুঁয়ো স্ট্রাইকের কথা কিন্তু এই ভারতের সেনাবাহিনী কয়েক দিন আগেই নস্যাৎ করেছিল। কিন্তু সেই খবর যখন কুইন্ট প্রকাশ করে তখন চলছিল মোদীর সাথে সামরিক বাহিনীর কর্তাদের বৈঠক, হয়তো সেই বৈঠকের পূর্ব নির্দ্ধারিত স্বিদ্ধান্ত ছিল প্রচার মাধ্যম কে ব্যবহার করে যুদ্ধের জিগির জিইয়ে রেখে মোদীর স্বার্থ পূরণ করা। কিন্তু কোন সবুজ সঙ্কেত ছাড়াই যখন কুইন্ট বাড়িয়ে চড়িয়ে সেই ভক্তদের সাধের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর প্রকাশ করে তখন বেকায়দায় পড়ে যায় ভারতীয় শাসক শ্রেণী ও মোদী। পরের বারের আগে সাবধানে পা ফেলে নরেন্দ্র মোদী আর কর্পোরেট মিডিয়া সমস্ত পদক্ষেপ পরিকল্পনা অনুসারে নেয়। যতদূর জল গড়িয়েছে তাতে বিজেপি’র পিতৃপ্রতিম সংগঠন আরএসএস এর পুরানো মিত্র মুসলিম লীগ ও তার নেতা নওয়াজ শরীফের যোগও স্পষ্ট হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস নির্দেশ অনুসারে হয়তো বিরিয়ানির পাতে পাতানো বন্ধুত্ব এই সংকট কালে কাজে এসেছে মোদীর। তাই তো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার সময়ে আগেই বলে দেওয়া হচ্ছে যে পাকিস্তান সরকারকে ভারতের সামরিক আগ্রাসনের বিস্তারিত খবর দেওয়া হচ্ছে।

ভারতের সেনাবাহিনী যদি সত্যিই এই অভিযান করে থাকতো তাহলে মিলিটারির পক্ষ থেকে এমন তথ্য সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রকাশ করা হতো যা দিয়ে পাকিস্তানের সেনার সমর্থনে বেড়ে চলা ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ কে দুনিয়ার সামনে খোলাখুলি দেখানো যেত। কিন্তু দেখানো হলো না, হয়তো সরকারের ফটোশপ মন্ত্রক তথ্য ও প্রমাণ অকাট্য রূপে সৃষ্টি করার কাজে জুটেছে। মনে পড়ে জেএনইউ কাণ্ডের ভিডিও? বা সম্বিৎ মহাপাত্রের মার্কিন সৈন্যের ঝান্ডা উত্তোলনের ছবিকে কারুকার্য করে ভারতীয় সেনার ঝান্ডা উত্তোলনের ছবি বানিয়ে জনতাকে দেশপ্রেমের টনিক খাওয়ানোর চেষ্টা?

ভারতের শাসক শ্রেণী ও তার সরকারি যন্ত্রের পক্ষে কোন রকমের জালিয়াতি অসম্ভব নয়। ভেজাল করে যে সরকারকে দেশপ্রেমের নামে উগ্র বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করতে হয়, কাশ্মীরে প্রায় ৯০ জন মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, ১০,০০০ স্বাধীনতা কামী জনগণ কে জখম আর পঙ্গু করে নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে হয়, সেই সরকারের কোন কথায় শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষের বিশ্বাস করা অসম্ভব।

উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নামক ঘটনা কে মাইলেজ হিসেবে ব্যবহার করে ব্যাপক হারে ভোট কামানোর লক্ষ্যেই আরএসএস এর বেনারস শাখা ২৯শে সেপ্টেম্বর গঙ্গার ঘাটে সন্ধ্যা আরতিতে মোদী সরকারের বিজয়ের শঙ্খনাদ করে। বেনারস মোদীর নির্বাচন কেন্দ্র ও হিন্দু ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান। এই জায়গায় হঠাৎ করে হিন্দুত্বের আবেগ জাগিয়ে তোলার ঘটনাও চোখে সন্দেহজনক ঠেকছে অনেকের। অন্যদিকে এই ঘটনার জেরে পাকিস্তানের মিডিয়ায় পাকিস্তানের সেনার হাতে ভারতের সৈনিকের গ্রেফতার হওয়া থেকে শুরু করে ভারতের বেশ কয়েকজন সৈনিক কে মেরে ফেলার খবর প্রকাশ হতে থাকে। ভারতের মিডিয়া আবার সেই সব খবর কে সরকারের কথা মতন নাকচ করে দেয় এবং ভারতের সৈন্যের জয় জয়কার করতে থাকে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর এবিপি চ্যানেল একটি টুইট করে জানান দেয় যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাকি সারা রাত চোখের পাতা এক না করে জেগে বসে ছিল। এমনকি লোকটা নাকি সারা রাত্রি জল খায়নি ! এই কথাও প্রচার করছে এবিপি’র মতন তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদ সংস্থা।  
 
ভারতের কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম ও সরকারি বামপন্থীরা এই সরকারের বিবৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্ববিরোধ ও ফাঁকগুলোর কোনরকম সমালোচনা করার চেষ্টা করেনি। অথচ স্পষ্ট ভাবেই দেখা যাচ্ছে যে মোদী সরকার খুব চালাকির সাথে ভারতের উঁচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখতে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উৎপত্তি করেছে। অথচ সাংবাদিকেরা কোন ভাবেই এই সহজ অঙ্কটা জনতার সামনে প্রকাশ করতে চাইছে না। কি এমন হলো যে সমস্ত সংবাদ সংস্থার চরিত্রটা সরকারি প্রচার মাধ্যমের মতন হয়ে গেল? কেন সরকারের দাবি প্রতিধ্বনি করাই সংবাদমাধ্যমের একমাত্র কাজ হয়ে উঠলো? কেন স্বাধীন ভাবে, সত্যের অনুসন্ধান করে জনগণের সামনে প্রকাশ করার কাজে এত অনীহা সাংবাদিকদের? কেন আমাদের দেশে স্বাধীন ও সাহসী সাংবাদিকতার এত অভাব?

ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলো নেহরু আমলেও শাসক শ্রেণীর চাটুকারিতা করতো, ইন্দিরার জমানায় কংগ্রেসের সামনে হামাগুড়ি দিত, সরকারের কথা পাঁচালীর মতন আউরে যেত। কিন্তু এমন কিছু সাহসী সাংবাদিক সেদিনও মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে ছিলেন যাঁরা কোনো ভাবেই ফ্যাসিবাদের সামনে মাথা নত করেননি, পেশার প্রতি, গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তাঁরা প্রশ্ন করেছিলেন স্বৈরতন্ত্র কে, পুলিশের হাতে মার খেয়েও, জেলের ভিতর বন্দি হয়েও, তাঁরা ঝোঁকেননি অন্যায়ের সামনে।  আজ সেই স্বাধীন ও নির্ভীক এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সাংবাদিকদের বড় অভাব। আর তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি। টিভি ও ইন্টারনেটে সংবাদ বিক্রি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই পুঁজিপতিদের হাতে সংবাদ মাধ্যম সম্পূর্ণ কুক্ষিগত ছিল, সত্তরের বা আশির দশকেও ছিল, কিন্তু তাও সেই সময়ে প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম কে পাঠকের কাছে নিজের কাগজ বিক্রির জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এবং বিশ্বাসযোগ্য খবর ছাপতে হতো। কারণ কারুর পত্রিকা যদি সরকারের ঢাক পেটাতে থাকতো তাহলে পাঠকদের প্রতিযোগী গোষ্ঠীর কাগজের পাঠক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। সেই নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সাংবাদিকেরা খবরের পিছনে দৌড়তেন। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতে ধীরে ধীরে সংবাদের ব্যবসা কুক্ষিগত হওয়ার পর থেকেই সংবাদ সংগ্রহ করার চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হলো সংবাদ সৃষ্টি করার, পাঠক বা দর্শকের চেয়ে বেশি জরুরী হলো টিআরপি যার দমে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ আয় করা সম্ভব হয় টাইমস, জি, আনন্দ বা ফক্স গোষ্ঠীর। তাই দরকার হয় জানার যে বিজ্ঞাপন দাতারা কোন রাজনীতিটা আজ উর্দ্ধে তুলতে চায়, আজ্ঞাবাহক ভৃত্যের মতন তাই মিথ্যার চাদরে মনিবের নগ্ন দেহ ঢাকতে চায় কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম। মনে রাখতে হবে এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের মূল কাজ হলো রাজনৈতিক জনমত তৈরি করে নিজেদের বিজ্ঞাপনদাতা ও লগ্নিকারী সংস্থাগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা। তা বিজেপির দরবারে মুজরো করা অর্ণব গোস্বামীর টাইমস নাউ বা পাইওনিয়ার সংবাদপত্র হোক বা বিপ্লবী সাজা আনন্দ গোষ্ঠীর দি টেলিগ্রাফ অথবা এনডিটিভি হোক এদের সবাইকে মালিকের সামনে কুর্নিশ করতেই হবে। তাই যত বিপ্লবী বা সরকার বিরোধী কিছু কর্পোরেট সাংবাদিক সেজে থাক না কেন একদিন খোলাখুলি তাদের কাঞ্চন গুপ্ত বা স্বপন দাশগুপ্তের মতন হাটের মাঝে শাসকশ্রেণীর চাটুকারিতা করতেই হবে। আর এখানেই লুকিয়ে বিপদ।

যতদিন এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যার গোলা কে ভাঙার স্বার্থে বিকল্প জনতার সংবাদ মাধ্যম তৈরি না করা যাবে, যতদিন না এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের চাটুকারিতার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি করে এই মিথ্যার সওদাগরদের ভাতে মারা না যাবে, ততদিন আমাদের দেশের মানুষ কে যুদ্ধ ও হিংসার পক্ষে, জাতি ঘৃণা ও দমন পীড়নের পক্ষে টেনে আনার এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে। আজ সময় এসেছে মিথ্যার এই কারখানায়, ভেজাল জনমত তৈরির এই কারখানায়, বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজির দালাল মিডিয়ার উপর জনগণের সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের দ্বারা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের। সার্জারি ছাড়া যে রোগী কে বাঁচানো যাবে না।

মার্কিন নির্বাচনের চাপেই মোদী'র "সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের" গল্পে বাজার গরম করার প্রচেষ্টা

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মোদীর মুখে শান্তি বাণী  সত্বেও উরি বা অন্য কোনো ঘটনা নিয়ে মার্কিন সমর্থনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হতে পারে




অনেক বছর আগে যখন নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিল আর মনমোহন সিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিল, তখন প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তানের সাথে সীমানায় সংঘর্ষ ও উগ্রপন্থী হানা নিয়ে কড়া কড়া ভাষণ দিত নরেন্দ্র মোদী। সেই সময়ে নরেন্দ্র মোদী দাবি করতো যে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলে পাকিস্তানকে কড়া জবাব দেবে বিজেপির সরকার। প্রধানমন্ত্রী পদে বসার দুই বছরের মধ্যে মোদীর রাজত্বে ঘটেছে পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর, পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে হামলা, এবং সর্বশেষ হলো উরি সেনা ছাউনিতে হামলা। এই হামলার পরেই তথাকথিত “জাতীয়তাবাদী” মিডিয়া একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়ে, ভারী ভারী শব্দ বাণ ছুড়ে টিভির পর্দা আলো করে স্টুডিওর শীত তাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে পাকিস্তান কে সীমিত ও পূর্ণ যুদ্ধ দ্বারা একেবারে কাবু করার নানা ফন্দি দর্শকদের জানালো টিভি সামরিক বিশেষজ্ঞরা, এছাড়াও সমস্ত অন্তর্জাল জুড়ে ভাসতে থাকলো মোদী ভক্তদের যুদ্ধের হুঙ্কার, কেউ কেউ হিসেব কষে বলে দিল যে মার্কিন যুক্তরাস্ট্র কে সাথে নিয়ে পাকিস্তানকে কি ভাবে বিচ্ছিন্ন করে কয়েক ঘণ্টার যুদ্ধে হারিয়ে দেওয়া যায় এবং পাকিস্তানের ভূ খন্ডকে দখল করা যায়। এরই মধ্যে একাংশ আবার পাকিস্তান ও চীন দুই দেশকেই জব্দ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সাথে অন্যান্য সামরিক শক্তির মদত চাওয়ার বুদ্ধিও দিল। এত শতের মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস চুপ থাকে কি করে? আরএসএস নেতা ও কাশ্মীরের উপর ভারতীয় খবরদারি ও দখলদারি বজায় রাখার কৌশল ও রণনীতি পরিকল্পনা করার মূল হোতা রাম মাধব বললো যে দাঁতের বদলে পাকিস্তানের চোয়াল ভেঙে দিতে হবে। আরএসএস ময়দানে নামতেই অনেকে আশা করেছিল যে মোদী যুদ্ধ বা সীমিত যুদ্ধের পরিকল্পনা তো করবেই। রিলায়েন্স গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ কুইন্ট নামক ওয়েবসাইটটি তো “গোপন সূত্রের” খবর পাওয়ার ভিত্তিতে একেবারে জানান দিয়ে দিল যে ভারতীয় সেনা নাকি একেবারে সানি দেওলের সিনেমার মতন হেলিকপ্টারে করে পাকিস্তানে ঢুকে ব্যাপক যুদ্ধ করে ২০ জন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী সহ ২০০ জন কে মেরেছে। চাটুকারিতার এহেন নিদর্শনে তাজ্জব হয়ে গেল সেনাবাহিনীই। ভারতের সৈন্য বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা খোলাখুলি অস্বীকার করলো এই রকম কোনো অভিযানের কথা। ফলে কুইন্টের ঢপের কীর্তন শুনে যে ভক্তকূল উল্লাস করছিল তাদের উপর যেন একেবারে পাহাড় ভেঙে পড়লো।

বেশ কিছুদিন পরে আবার ২৮শে সেপ্টেম্বর সার্জিকাল স্ট্রাইক করে ৩৫ জন জঙ্গী খতমের দাবি করে ভারতের সেনাবাহিনীর ডিজিএমও রণবীর সিংহ। দাবি করা হয় যে ভারতের বাহিনী নাকি বলিউডি কায়দায় পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে নানা জঙ্গী ঘাঁটিতে হামলা করেছে আর এই ঘটনার ফলে নাকি পাকিস্তানের সাথে ভারতের সেনার গোলাগুলি হয়েছে। খবরের সততা অবশ্য পাকিস্তান অস্বীকার করেছে আর দাবি করেছে ভারত শুধু গোলাবর্ষণ করেছে যার ফলে দুই পাকিস্তান সৈনিকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আগু পিছু কিছুই বিচার না করে ভারতের সেনা কর্তার বক্তব্য কে বেদ বাক্য মেনে ভারতের কর্পোরেট মিডিয়া অক্ষরে অক্ষরে প্রচার করে জানান দিতে থাকলো যে ভারত উরির ঘটনার বদলা নিয়ে নিয়েছে এবং মোদী নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। যদিও মোদীর উপর ভক্তকূলের আশা ছিল ইন্দিরা বা লাল বাহাদুরের কায়দায় এক সম্পূর্ণ যুদ্ধ করার তবে কোঝিকোডের মোদী উবাচের প্রিয় তার ঢাক বাজানো বন্ধ হয়েছে মাত্র কিছু দিন আগে। আর ঠিক কি হয়েছিল কোঝিকোডে?  

মোদী ভক্ত ও কর্পোরেট মিডিয়ার শেষ আশা ছিল যে মোদী উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে দলীয় কর্মীদের তাঁতিয়ে তুলতে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সাথে সাথে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট,ও পাঞ্জাবের নির্বাচনের প্রাক্কালে উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ার ছড়িয়ে হিন্দুত্ববাদ কে জেতাতে নিশ্চয় কোনো জঙ্গী পদক্ষেপ নেবে। দেশজোড়া সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো কেরলের কোঝিকোডে বিজেপির সমাবেশে। কেরলে মোদী মুখ খুললো বটে তবে সেই মুখ খোলা ছিল ধূর্ততায় ভরা। একদিকে মোদী পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একঘরে করার, সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ঘোষণা করার কথা বললো, অন্যদিকে বেকারি, দারিদ্র্, অশিক্ষা ইত্যাদির বিরুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান কে একসাথে যুদ্ধ করে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার কথা বললো। কানহাইয়া কুমারের ঐতিহাসিক “আজাদী” স্লোগানের কয়েকটা বিষয়কে কাটছাঁট করে, বিশেষ করে আরএসএস এর কাছে নিষিদ্ধ “আজাদী” শব্দটা বাদ দিয়ে কিছু ভেজাল নেহরুবাদী ভাষণ দিল মোদী।

ভক্তকূল যে যুদ্ধের আশায় দিনরাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি, সেই যুদ্ধ তাদের কল্পনাতেই থেকে গেল। যুদ্ধের লাইভ কভারেজের জন্যে যে সমস্ত কর্পোরেট মিডিয়া গোষ্ঠী স্পন্সর খুঁজছিল, তারাও কেমন ম্রিয়মান হয়ে গেল আর যুদ্ধ না শান্তি নিয়ে বিতর্ক সভা করার জন্যে স্পন্সর খোঁজা শুরু করলো1। আর ২৮শে সেপ্টেম্বরের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর আবার যুদ্ধের খিদেতে কাতর হয়ে রক্তের জন্যে হাহাকার করা সেই কর্পোরেট মিডিয়া ও হিন্দুত্ববাদী এজেন্টদের জন্যে অক্সিজেন নিয়ে আসলো। সবার আগে মোদীর সমর্থক ভারতীয় মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা ও তাদের পোষা বড় কর্তারা চিৎকার করে সমর্থন জানান দিল আর সেই আওয়াজ শুনে পদলেহী মিডিয়ার কেষ্ট বিস্টুরা সব তর্ক-বিতর্ক সরিয়ে রেখে মিনিটে মিনিটে প্রচার করতে থাকলো ভারতের বদলার, দেখে মনে হচ্ছে কর্পোরেট মিডিয়ার ন্যাংটো হয়ে বাজারে এসে নিজেকে সরকারের প্রচার মন্ত্রকের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করার দিন খুব বেশি দূরে নয়। কোন সাংবাদিক প্রশ্ন করলো না যে কেমন করে এই হামলা করা হয়, যে তিনটি সেক্টরের কথা ভারতীয় সেনা বলছে সেখানে যে জঙ্গী ঘাঁটির উপর আক্রমণের কথা বলা হলো সেগুলো কাদের, কি করে জানা গেল সেগুলো জঙ্গী ঘাঁটি তা নিয়ে কোনো উচ্চ বাচ্য ভারতের সেনা বাহিনীর নেই।কর্পোরেট মিডিয়াও জনগণের চোখে ঠুলি পড়াতে পেরে খুশি আর ভারতীয় সেনা কর্তারাও মোদী ও বিজেপির মুখ রক্ষা করতে পারার জন্যে খুশি। আর কোনো প্রশ্নই উঠলো না যে যদি এক রাতের হামলায় ভারতীয় সেনা এত জঙ্গী কে মারতে পারে তাহলে আবার ভবিষ্যতে এই রকম অভিযান আর হবে না ঘোষণা করে রণবীর সিংহ কাকে বার্তা দিতে চাইলো? ঘটনাগুলো অনেকটা নাটুকে হয়ে গেল না ?


মোদীর খোলাখুলি যুদ্ধে না যাওয়ার স্বিদ্ধান্ত অনেকের কাছেই পরিণত রাজনীতির পরিচয় বলে মনে হয়েছে, অনেক তথাকথিত বামপন্থী লোকেরাও মোদী সাহেবের কোঝিকোডে দেওয়া দারিদ্র মোচন ও অশিক্ষা দূর করার আহ্বান কে সাধুবাদ জানালো, চারিদিকে যখন মোদীর ভক্তকূল যুদ্ধং দেহি ফানুস ফেটে যাওয়ায় হা হুতাশ করছিল ঠিক তখন দেশের গণতান্ত্রিক শিবিরের অনেকেই মোদীর এই নয়া নাটকের শিকার হয়ে গেলেন। যুদ্ধ হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আরএসএস বা বিজেপি জঙ্গী হিন্দুত্ববাদ আর যুদ্ধের পক্ষে জনমত কে উগ্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলার রাজনীতি থেকে সরে শান্তি আর প্রগতির রাজনীতি গ্রহণ করেছে। আরএসএস আর বিজেপি কে উত্তর প্রদেশ, গুজরাট আর পাঞ্জাবে কোনঠাসা অবস্থা থেকে উঠে এসে রাজ্যের মসনদে বসতে যুদ্ধ না হোক তো অন্তত পক্ষে যুদ্ধ যুদ্ধ জঙ্গীপনার আবহাওয়া কে জিইয়ে রাখতে হবে ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার কে জাগিয়ে তুলতে হবে প্রতি কয়েক সপ্তাহ অন্তর। বর্তমানে ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে সরকারী ভাবে যুদ্ধ বা সীমিত সামরিক হঠকারিতার পিছনে মার্কিন সমর্থন ভীষণ প্রয়োজন, বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন পাকিস্তানের সাথে ভারতের পুরানো প্রভু রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আর চীনের সাথেও ইসলামাবাদের দোস্তি সুদৃঢ় অন্যদিকে ভারতের সরকারও পাকিস্তানের আব্বা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সাথে শুধু সামরিক ও পারমানবিক সমঝোতায় নয় বরং একে অপরের ঘাঁটি ব্যবহার করার মতন লিমোয়া চুক্তির নাগপাশে বাঁধা পড়েছে। মার্কিন দেশে এই সময়ে নির্বাচনের হাওয়া, মুসলমান বিদ্বেষ, এশীয় জনজাতির প্রতি বিদ্বেষ ও অন্যন্য প্রকারের বর্ণ বিদ্বেষ ছড়িয়ে রিপাব্লিকান পার্টির  ডোনাল্ড ট্রাম্প যে প্রচারের ঝড় তুলে সাদা চামড়ার ভোটের মেরুকরণ করছে তাকে রুখতে ডেমোক্রাট হিলারি ক্লিন্টনের পক্ষে ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভত মার্কিন ভোটারদের নিজের পক্ষে ধরে রাখা ভীষণ দরকার, আর তাই এই মুহূর্তে কোনো রকম যুদ্ধ অভিযানে মার্কিন আশীর্বাদ জুটবে না। তাই মোদী ৫৬ ইঞ্চির ছাতি ফুলিয়ে পাকিস্তান ধ্বংস করার কথা না বলে সেই পুরানো বামপন্থী বুলিগুলো কে নতুন সংঘ পরিবারের বোতলে করে চোলাই করে সময় কাটাচ্ছে। বড় মাত্রার যুদ্ধের জন্যে অন্তত নভেম্বর অবধি অপেক্ষা করতে হবে। ততদিন রণবীর ও মনোহর পরিক্করেরা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্প শুনিয়ে বাজার গরম করে রাখবে।

মোদী যখন ক্ষমতায় এসেছিল সেই সময় দেশজোড়া একটা কংগ্রেস বিরোধী রোষানলের লাভা বয়ে চলেছিল। ব্র্যান্ড মোদীর পক্ষে নির্বাচনে প্রায় ১৬ কোটি ভোট পাওয়া সম্ভব হয়েছিল কারণ জাতীয় স্তরে বিজেপি ছাড়া কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে কেউ উঠে আসতে পারেনি। দুই বছরের মোদী শাসনকালে জনগণের দুর্দশা মনমোহন সিংহের কংগ্রেসী আমলের চেয়েও বেশি হয়েছে, খাদ্যবস্তু ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়েছে, জনকল্যাণ প্রকল্পগুলোর খাতে খরচা কমানো হয়েছে বার বার, কৃষি সংকট তীব্র হয়েছে - ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বিতরণ তো দূর অস্ত, বরং যাদের হাতে স্বল্প জমি আছে তাঁদেরও জমির উপর কর্পোরেট আগ্রাসনের জূজূ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। প্রতিটি বিদেশ ভ্রমণেই মোদী ভারত কে “হার্ড সেল” করার চেষ্টা করে, বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যের জমি-জল-জঙ্গল বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের ভারতীয় দালাল আদানি-আম্বানি গোষ্ঠী কে বেচার জন্যে মৌ এর পর মৌ সই করেছে কেন্দ্র ও সেই সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। সম্প্রতি বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাস এই সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে মুম্বাই শহরে  “মোমেন্টাম ঝাড়খন্ড গ্লোবাল ইনভেস্টর্স সামিট ২০১৭” অনুষ্ঠানে খনিজ সমৃদ্ধ ঝাড়খন্ডকে “মেক ইন ইন্ডিয়া” অভিযানের গেটওয়ে হিসেবে তুলে ধরে প্রায় ১৯৫০ কোটি টাকার মৌ সই করেছে। ঠিক উরি সেনা ছাউনির উপর আক্রমণের দুই দিনের মাথায়। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ, যখন দেশের রাজনীতি জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উত্তাল ছিল তখনই চুপচাপ কুখ্যাত আদানি গোষ্ঠী ও বেদান্ত গোষ্ঠীর সাথে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকার মৌ চুক্তি সই করে তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ইস্পাত প্রকল্পের নামে। এই সমস্ত প্রকল্প রূপায়ন করতে ঝাড়খণ্ডে ব্যাপক হারে আদিবাসী উচ্ছেদ অভিযান চলবে, অপারেশন গ্রিন হান্টের নামে চলবে আদিবাসীদের উপর দমন পীড়ন। কেন্দ্রের মোদী সরকার ও বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির সরকার একের পর এক প্রকল্প নিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর উন্নয়ন করার জন্যে যখন লেগে পড়ে রয়েছে তখন জনতা কে শুধু “সুদিন” বা “আচ্ছে দিন” আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের বাক্সের দিকে টেনে আনা যে খুবই কঠিন তা নাগপুরের জানা আছে। এর সাথেই মাথায় রাখুন সমগ্র গুজরাটের দলিতদের মাথা তুলে ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, সমগ্র উত্তর প্রদেশের দলিত জনতার মধ্যে বিজেপি বিরোধী হাওয়ার প্রবলতর হওয়ার কথা, পাতিদার আন্দোলনের ফলে বিজেপির আর মোদীর হিন্দুত্ববাদের গবেষণাগার গুজরাটে ব্যাকফুটে যাওয়ার ঘটনা, যে ঘটনাগুলো তীক্ষ ইঙ্গিত করছে বিজেপির অতি কষ্টে সাজানো হিন্দুত্ববাদের মেরুকরণের তাসের ঘরের ভেঙে পড়ার সম্ভাবনার দিকে। ফলে নতুন করে সেই পুরানো ফর্মুলায় মেরুকরণ করা অসম্ভব হওয়ায় এবং তিন রাজ্যে নির্বাচনের মুখে জনগণের দৃষ্টি মূল্যবৃদ্ধি, ঘনীভূত হওয়া অর্থনৈতিক সংকট, ও সামগ্রিক ভাবে মোদী সরকারের ব্যর্থতা থেকে সরাতে যুদ্ধের ডংকা বাজানো ছাড়া আরএসএস ও বিজেপির সামনে অন্য কোন রাস্তা নেই আর নওয়াজ শরীফের কাছেও শাপে বরদানের মতই ভারতের সাথে যুদ্ধ পাকিস্তানের আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে এবং তীব্র ইসলামিক মেরুকরণ করার কাজে মদত করবে। আর যুদ্ধ না হওয়া অবধি নওয়াজ শরীফ ও মুসলিম লীগ ভারত বিরোধী ও হিন্দু বিরোধী বিষাক্ত আবহাওয়া সৃষ্টি করে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা জনগণের স্বর কে, গণ আন্দোলনগুলোকে শক্ত হাতে দেশপ্রেমের নামে দমন করতে পারবে।

তাই বন্ধু, যুদ্ধ যে হবে না তা নয়, হয়তো সম্পূর্ণ যুদ্ধ  না হয়ে একটা সীমিত লড়াই হতে পারে যাতে বেশ কিছু সৈনিক কে দুই দেশের সরকার ও শাসকেরা  কোরবানির পাঁঠা বানিয়ে একদিকে নির্বাচনের জন্যে ইস্যু সৃষ্টি করতে পারবে আর অন্য দিকে নানা রকমের অস্ত্র, গোলাগুলি, কফিন বা অন্য সামরিক চুক্তি বা কেনা বেচার কাজে প্রচুর কমিশন আয় করতে পারবে। ঠিক যেমন একদিন বাজপেয়ীর আমলে একদিকে কার্গিল যুদ্ধ কে ব্যবহার করে মূল্য বৃদ্ধি ও বিলগ্নিকরণের ফলে নাজেহাল হওয়া জনতার দৃষ্টি ঘুরিয়ে উগ্র দেশপ্রেমের হাওয়া তুলে ভোট কুক্ষিগত করেছিল বিজেপি আর অন্যদিকে সেই কার্গিলে মৃত সৈন্যদের দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়ার জন্যে কফিন কেনার অছিলায় কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করেছিল বড় বড় রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আমলা ও সেনা কর্তারা। ভুলে গেলে চলবে না যে সৈন্য বাহিনীর নামে দেশপ্রেমের শপথ নেয় যে বিজেপি সেই বিজেপিই কিন্তু বঙ্গারু লক্ষণের মতন লোকেদের পুষে রাখে। আর যদি তাও করা সম্ভব না হয় নভেম্বরের পরে তাহলে দেশজুড়ে সাবর্ণ হিন্দুদের তাঁতিয়ে তুলতে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতন কাহিনী জনগণের কানে যুদ্ধবাজ কর্পোরেট মিডিয়া ঠুসে ঠুসে ভরবে।

যদি সংকট ঘনীভূত হয় আর মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে হয় তাহলে হয়তো নভেম্বরের পরে আর উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও গুজরাট নির্বাচনের আগেই পুরো মাত্রার যুদ্ধ হতে পারে, যার ফলে আবার দেশপ্রেমের জিগির তুলে নির্বাচনের মাঠে গোল দেওয়ার চেষ্টা করবে বিজেপি এবং জনগণের ঘাড়ে অসম্ভব মাত্রার করের বোঝা চাপবে। জনতার থেকে আদায় করা করের টাকায় যেমন মার্কিন সামরিক শিল্প ও আমাদের দেশের নেতা-মন্ত্রী-আমলারা ফুলে ফেঁপে উঠবে অন্যদিকে তেমনি ব্যাপক হারে কালোবাজারি করে বিজেপির আসল ভোটার মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা লাভ করবে। মৃত্যু আর ধ্বংসের দৃশ্য দেখিয়ে যখন কর্পোরেট মিডিয়া কোটি কোটি টাকা রোজগার করবে ঠিক তখনই দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণ কে সামরিক শক্তির দমে তাঁদের জমি-জল-জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করবে, তাঁদের প্রতিরোধ কে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করবে গুলি আর বোমা মেরে। সেই আদিবাসী জনগণ যদি তাঁদের জঙ্গল আর জমি রক্ষার সংগ্রামে কর্পোরেট-রাষ্ট্র যন্ত্রের এই চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তখন এই আদিবাসীদের উগ্রপন্থী আর মাওবাদী আখ্যা দিয়ে ব্রাক্ষণত্ববাদী সরকার হত্যা করবে। এই যুদ্ধই আবার মোদী আর ভারতের শাসক শ্রেণী কে সুযোগ দেবে দেশের জনগণের, বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষকের রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের অধিকার কেড়ে নিতে, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো খর্ব করে উগ্র দেশপ্রেমের জোয়ার তুলে ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদ কে প্রতিষ্ঠা করতে। ভারতের শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে নিজেদের স্বার্থে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো যে কয়েকটি হাতে গোনা সাংবিধানিক অধিকার আদায় করতে পেরেছিলেন তা কিন্তু যুদ্ধের নামে, রাষ্ট্র রক্ষার নামে মোদীর নেতৃত্বে ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী খর্ব করবে, কেড়ে নেবে, এবং যুদ্ধের দোহাই দিয়ে সমগ্র দেশকে একটা রাজনৈতিক জেলখানায় পরিণত করবে।


আমাদের মধ্যে যে সকল মানুষ প্রগতিশীল রাজনীতির কথা ভাবেন, খেটে খাওয়া মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে লড়াই করেন তাঁদের আজ সাবধানে পা ফেলতে হবে। শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোদী বা আরএসএস-বিজেপির যুদ্ধ বিরোধী রূপে যেন আমরা বশ না হয়ে যাই। জনগণ কে যেন আমরা এই নেকড়ের দলের কন্ঠে কোকিলের স্বরে ভুলে যেতে না দিই যে এই সুন্দর সুর আসলে ভবিষ্যতের হিংস্রতা কে আড়াল করার ছল। নেকড়ের ফাঁদে পড়বেন না, নেকড়ের লক্ষ্য মানুষের বুক চিরে রক্ত মাংস খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করা।নেকড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে আমাদের তৈরি হতে হবে, মানুষকে নেকড়ের থাবা থেকে বাঁচাতে আমাদের মাঠে নামতেই হবে।       


  1. সম্প্রতি ২৮শে সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার গোষ্ঠী ঠিক এই রকমই এক বিতর্ক সভার আয়োজন একেবারে খাস “দা পার্কে” করেছিল, যেখানে জনতার টাকায় মোটা পেনশন আয় করা প্রাক্তন সেনা কর্তা ও আধা সামরিক বাহিনীর কর্তারা শুনিয়ে গেল জনতার ঘাড়ে করের বাড়তি বোঝা চাপিয়ে কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। সেই বিতর্ক সভায় সবচেয়ে ভালো ভাবে যুদ্ধের উন্মাদনার বেলুন চুপসে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী  দেবলীনা, যাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তথাকথিত সামরিক বিশারদদের কপালে ওই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেও ঘামের বিন্দু এনে দিয়েছিল।


এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে