ঐতিহাসিক ২৪শে ফেব্রুয়ারি: বহরমপুর থেকে প্রেসিডেন্সি জেল এর সংগ্রামের কথা

বুধবার, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০২১ 0 Comments A+ a-

চিরকালই শাসক শ্রেণী চেষ্টা করে যাতে জনগণ কোনদিনই শোষিত মানুষের সংগ্রামের কাহিনী, তাঁদের শিকল ভাঙার সংগ্রামের কথা যাতে জানতে না পারে। তাই যে যে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কাহিনী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কে উদ্বুদ্ধ করে মহা সংগ্রামের পথে চলতে, তাকে আড়াল করে রাখা হয়। তাই ১৯৭১ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি বহরমপুর জেল এর ভিতরে বন্দী, নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের আলোকে গড়ে ওঠা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) [সিপিআই (এম-এল)] এর কর্মীদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও শাহাদাত, এবং তার ঠিক পাঁচ বছর পরেই, ১৯৭৬ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি সেই পার্টির নেতৃত্বেই শাসকশ্রেণীর বজ্র কঠিন ঘেরাটপে বন্ধ কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙার মধ্যে রয়েছে এক সংগ্রামী সম্পর্ক যা শাসকশ্রেণী কোন ইতিহাসে জীবিত না রাখলেও মানুষের চেতনায় তা চির জীবন্ত।

নকশালবাড়ির জন্মদাতা ছিলেন চারু মজুমদার, যিনি ভারত উপমহাদেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট দ্বন্দ্বগুলোর সঠিক সমাধানের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম শুরু করেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাও জেদং-এর  চিন্তাধারার সঠিক প্রয়োগ মারফৎ। এর ফলে ভারত উপমহাদেশের দার্জিলিং জেলার তিনটি ছোট্ট গ্রাম―নকশালবাড়ি, ফাঁসীদেওয়া আর খড়িবাড়ি―জেগে ওঠে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনায়। প্রথমবার কৃষক জমি দখল বা ফসলের জন্যে নয়, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্যে সংগ্রাম শুরু করেন। জন্ম হয় নকশালবাড়ি-র 

এই সংগ্রাম যেমন কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংশোধনবাদের নির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশগুলোর বিরুদ্ধে জেহাদ ছিল, তেমনি চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চেতনায়, আত্মত্যাগের রাজনীতির ভিত্তিতে নতুন মানুষ গড়ারও সংগ্রাম ছিল। সেই নতুন মানুষ, মাও জেদং-এর চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ মানুষ যা কে কোন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বা আধুনিক অস্ত্র দমন করতে পারবে না কারণ সে, মাও-র ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও উত্তরাধিকারী লিন বিয়াও-র ভাষায়, "একটি আত্মিক এটম বোমায়" পরিণত হবে। 

চারু মজুমদারের রাজনীতির আলোকে, যা মাও জেদঙ্গের চিন্তাধারার ভারতীয় উপমহাদেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সঠিক প্রয়োগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিপ্লবী রাজনীতি, সেই নতুন মানুষ গড়ার কাজ শুরু করে সিপিআই (এম-এল)। আর সেই নতুন মানুষ, রাষ্ট্রের বেড়ি আর শৃঙ্খল, উঁচু পাঁচিল আর রাইফেল কে উপেক্ষা করে বন্দী শালা থেকে মুক্ত হয়ে আপামর খেটে খাওয়া জনতার সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে চায়। তাই সে জেল ভাঙে। আর ভাঙে শাসকের ঔদ্ধত্ব। 

সেদিন বহরমপুর জেলের শহীদ বিপ্লব ভট্টাচার্য, মৃদুল সরকার, আশিস ভট্টাচার্য, গোরা দাশগুপ্ত, নজরুল ইসলাম, কানাইলাল বঙ্গ, প্রভাত ব্যানার্জ্জী এবং তিমিরবরণ সিংহ সেই নতুন মানুষ ছিলেন, যাঁদের শারীরিক মৃত্যু হলেও চেতনা যাঁদের আজও অমর ও অমলিন। তাঁরা চারু মজুমদারের রাজনীতির আলোকে উপলব্ধি করেন যে জেলে বসে থেকে পুরানো, শোষক রাষ্ট্র কে মান্যতা দিয়ে বা তার কাছে কিছু সুবিধা চাওয়া একটি বিপ্লবীর জীবনে কদর্য কাজ।তাঁর কাজ হল বিদ্রোহ করা, মাও জেদং-এর  চিন্তাধারার প্রচার ও প্রসার করা এবং শ্রমিক শ্রেণী এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হওয়া। তাই তাঁরা শাসকের চোখে চোখ রেখে সংগ্রাম করেন ও শহীদ হন।

তাঁদের শাহাদাত কে শ্রদ্ধা জানান চারু মজুমদার ও দুনিয়ার বিপ্লবীরা। শহীদ হয়ে তাঁরা অনুপ্রেরণা দেন আগামী দিনের বিপ্লবীদের। যখন সরোজ দত্ত ও লিন বিয়াও এর শাহাদাতের পরে চারু মজুমদার কে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে হত্যা করা হল, তখন সিপিআই (এম-এল) কে ভাঙতে এগিয়ে এল পার্টির মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একের পর এক শত্রুর দালালেরা। কানু স্যানাল, সৌরেন বোস, নাগভূষণ পট্টনায়ক, অসীম চট্টোপাধ্যায়, প্রভৃতি নেতারা বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেরি করা শুরু করে সংশোধনবাদী তত্ত্ব, নকশালবাড়ির নাম নিয়ে নকশালবাড়ি কে জাল করার কাজ শুরু করে। আর তার প্রভাব জেলে বন্দী সিপিআই (এম-এল) কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও পড়ে। অনেকে মনে করেন সিপিআই (এম-এল) ভেঙে গেছে, অনেকে লাইন চেঞ্জ করেন আর অনেকে অপেক্ষা করেন চারু মজুমদারের রাজনীতির ভিত্তিতে আবার সংগ্রাম গড়ে ওঠার।

শেষ দলটি আনন্দিত হয় যখন তাঁরা শোনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির নেতা মহাদেব মুখার্জী, যাঁকে নিজ ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় কমিটির অতিরিক্ত সদস্য জগজিৎ সিংহ জোহাল ওরফে "শর্মা" কেন্দ্রীয় কমিটিতে কো-অপট করেন, ঘোষণা করেন "শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড চারু মজুমদার বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন তাঁর রাজনীতির মধ্যে, বেঁচে আছেন তাঁর নিজের হাতে গড়া সিপিআই (এম-এল) এর মধ্যে, বেঁচে আছেন জনগণের মধ্যে।" যার অর্থ সিপিআই (এম-এল) ও চারু মজুমদারের রাজনীতি বিলুপ্ত হয়নি, বেঁচে আছে। আর এই আশ্বাস থেকেই নতুন লড়াই গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে কামালপুর-কালীনগরের সংগ্রাম, রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার নতুন উৎসব শুরু হয় দক্ষিণবঙ্গে। 

যদিও বাইরে নানা বেইমানির কারণে দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরে সিপিআই (এম-এল) ধাক্কা খায় ও মহাদেব মুখার্জি শিলং থেকে গ্রেফতার হন, জেলের ভিতরে সংশোধনবাদ এর বিরুদ্ধে লড়াই চলতে থাকে। এই সংগ্রামে অগ্রগামী হয় কলকাতা শহরের আলিপুরে অবস্থিত প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী সিপিআই (এম-এল) কর্মীরা। জেল পার্টি কমিটি (জেপিসি) ও আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী মহাদেব মুখার্জীর মধ্যে চলতে থাকলো গোপনে কথোপোকন, সংবাদ আদানপ্রদান যা পরে "জেল থেকে নির্দেশ" নামক পুস্তিকায় ছাপা হয়। এই আলোচনার মধ্যেই স্থির হয় যে সিপিআই (এম-এল) চারু মজুমদারের রাজনীতিতে অবিচল থাকবে।  জেলের ভিতর "রাজনৈতিক বন্দী" হওয়ার দাবি না করে জেল ভাঙার সংগ্রামে এগোনোর পথে অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত নেয় জেপিসি। 

১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেস সরকার যখন জরুরী অবস্থা জারি করে ঝুঠো গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে ফেলে দেয়, তখন বেশির ভাগ সংশোধনবাদী বাম ও জেলবন্দি প্রাক্তন নকশালরা হতাশাবাদের জাল ছড়াতে শুরু করে। চারু মজুমদার আর নকশালবাড়ি-র সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রাজনীতি কোন কাজে আসবে না বরং সংসদীয় দলগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে সংসদীয় সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কংগ্রেস কে হারাতে হবে–এই লাইন প্রচার শুরু করে। 

এরই মধ্যে, দীর্ঘ দিন ধরে জেলের মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম করে সিপিআই (এম-এল) প্রেসিডেন্সি জেল জেপিসি সিদ্ধান্ত নেয় যে জেল ভেঙে আপামর খেটে খাওয়া জনগণের সাথে একাত্ম হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মুক্তাঞ্চল। চারু মজুমদারের স্বপ্ন কে, হাজারো হাজারো শহীদদের স্বপ্ন কে বাস্তবায়িত করতে হবে। এই সংকল্প নিয়ে, সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ, নির্দিষ্ট দায়িত্ব বন্টন ও মাও জেদং-এর চিন্তাধারা ও চারু মজুমদারের রাজনীতির উপর নিঃশর্ত বিশ্বাস রেখে, জয়ী হওয়ার আশা বুকে বেঁধে ৪২ জন কমিউনিস্ট বিপ্লবী প্রেসিডেন্সি জেলের মতন শাসকশ্রেণীর তীক্ষ নজরদারিতে থাকা ঔপনিবেশিক জমানার বন্দীশালা ভেঙে বের হতে উদ্ধত হন। 

এর আগে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে কিছু সিপিআই (এম-এল) পাঁচিল টপকে পালালেও ৪২ জনের মতন বড় দলের একসাথে পালানো অতীতে কোনদিন হয়নি। কিন্তু সেই ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে, দেশের কণ্ঠরুদ্ধ করে যখন ইন্দিরার স্বৈরতন্ত্র চলছে, ঠিক দুপুর বেলা, বহরমপুর জেলের বন্দী হত্যার বদলা নিয়ে জেল ভাঙলেন চারু মজুমদারের রাজনীতির পতাকাতলে থাকা ৪২ জন বিপ্লবী। তাঁরা জেলের দেওয়াল টপকে পালালেন না, জেলের সদর দরজা ভেঙে বের হলেন। তাঁদের চলে যাওয়ার পরে আধ ঘন্টা জেল গেট খোলা থাকলেও কিন্তু প্রায় বন্দী ২,০০০ তথাকথিত "নকশালপন্থীর" একজনও বাইরে এলেন না। 

তবে যে কোন ঘটনা ঘটলে মানুষ জানতে পারলেও, চারু মজুমদার বলেছেন সেই ঘটনা ঘটার পিছনে অজস্র ত্যাগ, সংগ্রাম ও চোখের জল আড়ালে থেকে যায়। সেদিন নিজ দায়িত্বে, স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে স্বদেশ ঘোষ ও কালু হালদার ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁদের কমরেডরা জেল থেকে যাতে সুরক্ষিত ভাবে চলে যেতে পারেন তাই জেলগেটের কাছে তাঁরা পজিশন নিয়ে কার্বাইন-ধারী কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ (সিআরপি) কে আটকাবেন। সেদিন সেই জেলগেট এর কাছে তাঁরা দীর্ঘক্ষণ এম্বুশ করে সিআরপি কে আটকে বাকি ৪০ জন কে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দেন। এই সংগ্রামে স্বদেশ ও কালু শাহাদাত লাভ করেন ও ভারত উপমহাদেশের বিপ্লবী সংগ্রামে চির অমর হয়ে যান। 

যদিও প্রেস সেন্সরশিপের কারণে বেশির ভাগ মানুষ প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙার কথা, এমার্জেন্সির বুকে ইন্দিরার নাকে ঝামা ঘষে দেওয়ার কথা জানতে পারেননি, তবুও সেই ঘটনার কথা পরে দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে। বহরমপুরের শহীদদের সাথে একাত্ম হলেন স্বদেশ ও কালু। ১৯৭১ এর শহীদ নজরুল ইসলাম ও তিমির বরণ সিংহ আর ১৯৭৬ এর শহীদ স্বদেশ-কালু এক ও অবিচ্ছিন্ন হলেন। আর প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙা, ১৯৭৬ এর মতন প্রতিক্রিয়ার ভাটার সময়ে, প্রমাণ করলো চারু মজুমদার-এর রাজনীতির স্বার্থকতা, মাও জেদং-এর চিন্তাধারার স্বার্থকতা। আর প্রমাণ করলো যে প্রতিক্রিয়া কখনোই প্রগতি কে আটকে রাখতে পারে না। হিম্মত নিয়ে এগিয়ে গেলে জয় অবশ্যম্ভাবী। তাই ২৪শে ফেব্রুয়ারির যে স্ফুলিঙ্গ বহরমপুরের জেলে জ্বলেছিল তা প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে স্বার্থকতা লাভ করলো। 

বর্তমানে যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গোটা দেশে একটি অঘোষিত জরুরী অবস্থা জারী করে গোটা ভারতবর্ষ কে একটি জেলখানায় পরিণত করেছেন, যখন সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারই না, সাথে সাথে তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ—জমি ও জীবিকা—কেড়ে নিয়ে বৃহৎ কর্পোরেটদের সিন্দুকে মুনাফার পাহাড় বানাবার ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙার সংগ্রাম অন্ধকারে আলো জ্বালাবার হিম্মত দেয়। স্বদেশ আর কালু বলে ওঠেন, নির্ভয়ে এগিয়ে চলুন, জয় হবেই। বিজেপি কে উচ্ছেদ করা সম্ভব চারু মজুমদারের রাজনীতির মাধ্যমেই । সমস্ত ক্লীবতা, মতাদর্শের দৈনতা, স্বার্থপরতা আর বেইমানির বিরুদ্ধে এটাই একমাত্র জবাব।  রুখে দাঁড়ানোর স্পর্ধা। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে