সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষবাস্প ছড়াতে পশ্চিমবঙ্গে একজোট বিজেপি ও তৃণমূল

শনিবার, অক্টোবর ২৯, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

TMC BJP nefarious nexus to incite communal tension in West Bengal - representative image - Credit Muslim Mirror
পশ্চিমবঙ্গে মমতার প্রশ্রয়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে সঙ্ঘ পরিবার - ছবি নমুনা স্বরূপ। স্বত্ব মুসলিম মিরর 


একটা প্রবাদ আছে যে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।পাঞ্জাব আর বাংলার চেয়ে বেশি সমগ্র ভারতে কারুরই ঘর বোধহয় দাঙ্গার আগুনে পোড়েনি তাই যখন বাংলার আকাশের কোন লাল হচ্ছে দাঙ্গার আগুনে, তখন সামগ্রিক ভাবে সমস্ত খেটে খাওয়া গরিব বাঙালিদের আজ দাঙ্গা ও অশান্তির সিঁদুরে মেঘ দেখে নিজেদের তৈরি করতে হবে এক ব্যাপক প্রতিরোধ সংগ্রামের জন্যে, কারণ রাজ্যে আজ তৃণমূলের সাথে টেবিলের তলায় হাত মিলিয়ে উঠে আসছে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের রথ, বাংলার মাটি যে সত্যিই ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছে দুর্জয় ঘাঁটি রইলো না মমতার প্রশাসনিক সাহায্যের কারণে তা আজ কিন্তু বাংলার সাধারণ মানুষ নিজেদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। খড়্গপুর আর হাজীনগরে মহরম ও দুর্গাপূজার বিসর্জনের আড়ালে যে ঘৃণ্য দাঙ্গা লাগানো হলো, যে ভাবে তৃণমূল আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও আরএসএস হাত মিলিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পথে নামলো তা কিন্তু চোখে তাক লাগিয়ে দিল। যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী কে নিয়ে সাধারণ একটা কার্টুন সম্বলিত ইমেল ফরোয়ার্ড করার দায়ে একজন অধ্যাপককে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে, বা তারক বিশ্বাসের মতন নাস্তিকতার প্রচারকারীদের হঠাৎ এক তৃণমূলী নেতার অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার করে অবলীলায়, সেই রাজ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে দাঙ্গার আগুনে হাওয়া দিতে থাকা তপন ঘোষের মতন লোকেরা বা হিন্দু দেব দেবীর ছবি দেওয়া প্রোফাইলের আরএসএস কর্মীরা কিন্তু সরকারের ক্রোধ বা কোপের শিকার হয় না। যে রাজ্য সরকারকে আবার বিজেপি মুসলমান তোষনকারী বলে অভিযুক্ত করে সে রাজ্যে এই ঘটনা সত্যিই তাজ্জব করে।

দাঙ্গা কোনদিন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয়নি।সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করার জন্যে লাগে পরিকল্পনা, প্রচার  ও পরিকাঠামো, আর এই দুইয়ের মধ্যে নিখুঁত সমন্বয় সাধন করার মাধ্যমেই দাঙ্গার মাধ্যমে রাজনৈতিক লাভ কুড়ানো সম্ভব হয়। পশ্চিমবঙ্গের ভিতর আরএসএস ও অন্যান্য ব্রাক্ষণত্ববাদী হিন্দু সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রভাব শুরু থেকেই উঁচু জাতের শহুরে অবাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আর সাম্প্রদায়িক দ্বন্ধ এই রাজ্যে, যে রাজ্যে শ্রমিক-কৃষকদের জঙ্গী আন্দোলন সমগ্র ভারতের শাসক শ্রেণী কে বারবার কাঁপিয়ে তুলেছিল, শুধুমাত্র অবাঙালি মুসলমান ও অবাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ খেটে খাওয়া বাঙালিরা ধর্ম ভীরু হয়ে উঠতে থাকলো নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দুয়ার খুলে যেতেই। হঠাৎ করে রাজ্যের বাইরে কাজ করতে যাওয়া উঁচু জাতের হিন্দুদের মনে হলো যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের ভীষণ বাড়বাড়ন্ত হয়েছে আর ঘরে ফেরার পরে সেই কথাই তারা প্রতিবেশীদের জানাতে থাকলো। শহর ও মফসলের যে সমস্ত গুটিকয়েক অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানরা পাশাপাশি নির্ঝঞ্ঝাটে বাস করতেন সে সমস্ত জায়গায় ধীরে ধীরে ghettoisation শুরু হলো আর আমাদের প্রগতিশীল ও তৎকালীন ‘বামফ্রন্ট’ শাসিত পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত ভদ্রলোকদের পাড়ার দূর দূর পর্যন্ত কোথাও মুসলমান বা দলিত নমঃশূদ্র মানুষের বাস আর দেখা গেল না। নব্বইএর দশকের শেষের দিকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আঁচল ধরে এই রাজ্যে সিঁধ কেটে বিজেপি-আরএসএস ও নানা ধরণের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের বেনোজল কে ঢুকতে দেখেও নির্লিপ্ত থাকে ব্রাক্ষণত্ববাদী নেতৃত্বে চলা বামফ্রন্ট সরকার। মমতার অসীম করুণায় আর তৃণমূলের সহযোগিতায় ভাইরাসের মতন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে ব্রাক্ষণত্ববাদী রাজনীতি, সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষে নিজ স্বার্থে মমতা থেকে বুদ্ধ সবাই জল  ঢালতে থাকে এবং এই বিষ বৃক্ষের ফল পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাস কে বিষিয়ে দেয়।

বিজেপির সাথ ছেড়ে কংগ্রেস কে সাথে নিয়ে যেদিন থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায় রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছিল সেইদিন থেকে তৃণমূল কংগ্রেস ও রাজ্য সরকারের দৃষ্টি ছিল যেনতেন প্রকারে বুদ্ধদেবের পথে চলে রাজ্যের থেকে জঙ্গী শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন কে নিকেশ করার দিকে, আর তাই ২৭ শতাংশ মুসলমান জনসংখ্যার এই রাজ্যে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ ছড়ানোর কাজে বিশেষ করে নামে মমতার সরকার। যে রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের করুণ দশা সচ্চার কমিটির রিপোর্টের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে সেই রাজ্যের মুসলমানদের উন্নয়নের নামে মমতার অবদান ছিল ইমাম ভাতা, মজলিশ, হাদিস পাঠ, মাথায় দাবনি বেঁধে দোয়া করা, ও ইফতার পার্টি। মুসলমানদের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ কে সমস্ত মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের কথায় সমস্ত সম্প্রদায় কে, বাংলা ভাষী ও উর্দু ভাষী মুসলমান নির্বিশেষে সকল কে চলতে জোর করে মমতার সরকার। সারা রাজ্য জুড়ে কট্টর কাঠ মোল্লাদের তোয়াজ করা শুরু করে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকার আর এই সুযোগে নেপোয় মারে দই’য়ের  মতন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সংঘ পরিবারের পাল্টা প্রচারের, হিন্দু অবাঙালিদের সাথে সাথে এবার অভিজাত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সুপ্ত জাতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ কে সারা রাজ্য জুড়ে তীব্র করার কাজে জোটে আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। পরবর্তীকালে এদের সাথে জোটে হিন্দু সংহতির তপন ঘোষের মতন পাঁড় দাঙ্গাবাজরা। ২০১৪ সালের মোদী তরঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দুটি লোকসভা আসন, যার মধ্যে একটি শ্রমিক আন্দোলনের গড় - আসানসোল জিতে নেয় বিজেপি। তারপর থেকেই অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বাংলার মাটিতে নিজের ঘাঁটি শক্তিশালী করতে নামে বিজেপি। মমতা বন্দোপাধ্যায় জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপ রোধ করতে কোন পদক্ষেপই নেয়নি, সরকার বরং অনীহা দেখিয়ে তলে তলে এই হিন্দুত্ববাদের আঁচে হাওয়া দিয়েছে হিন্দু সন্ত্রাসের ঊর্ধ্বগামী লেলিহান শিখা দেখে সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘুদের নিজের ভোট ব্যাংকের স্বার্থে মেরুকরণ করার জন্যে।

গোপীবল্লভপুরের জোতদার ঘরের সন্তান, আরএসএস এর পাঁড় নেতা দিলীপ ঘোষ কে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির মাথা করে অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী প্রথমতঃ শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে খাস পাড়া গাঁয়ে বিজেপির ঝান্ডা শক্ত করে গেঁড়ে দেওয়ার কাজ শুরু করলো আর দ্বিতীয়ত্বঃ তৃণমূলের আমলে আইন শৃঙ্খলার অবনতি, সিন্ডিকেটবাজি, গণতন্ত্র হরণ, আর মহিলাদের উপর বেড়ে চলা অত্যাচারের পরিচিত অভিযোগের রাজনীতির গন্ডির বাইরে এনে বিজেপিকে ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে ২০১৯ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে নিজেদের দুর্জয় ঘাঁটি বানানোর কাজে লাগালো। অমিত শাহ - নরেন্দ্র মোদী ও দিলীপ ঘোষের মতন কেউকেটেরা জানে যে শুধু মাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চাকরি, সস্তা রেশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে ভাবে তথাকথিত সার্কাসি বাম ও কংগ্রেস-তৃণমূল ভোটে জিতেছে তার সাথে টেক্কা দেওয়া বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয় কারণ বিজেপির শাসনে কোনো রকমের রাখঢাক না করেই একচেটিয়া বিদেশী পুঁজির জুতো চাটা  হয় এবং জনগণের উপর বিদেশী শোষণ শাসনের নাগপাশ কে শক্ত করা হয়। তাই আর্থিক উন্নয়নের কথা, চাকরির প্রতিশ্রুতি, বা কালো টাকা ফেরত আনার মতন বুজরুকি দাবি বারবার চলবে না আর তাই গুজরাট মডেল কে অনুসরণ করে তীব্র ধর্মীয় বিদ্বেষের পরিবেশ সৃষ্টি করে, অভিজাত ও নমঃশূদ্র হিন্দুদের মুসলমানদের জূজূ দেখিয়ে এক ছাতার তলে এনেই একমাত্র বিজেপির পক্ষে ভোটে জেতা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে তাই আজ গুজরাট মডেল অনুসরণ করে বিজেপি ও তার সহযোগীরা যেমন একদিকে দাঙ্গার আগুন লাগাচ্ছে ঠিক তেমনি অন্যদিকে এই দাঙ্গা আর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে গেরুয়া শিবির রাজ্যের জোতদার-জমিদার ও বেনিয়া মুৎসুদ্দিদের সাথে সাথে বিদেশী বৃহৎ পুঁজিকেও ইশারা করছে যে তারা যেন এবার বিজেপির উপর কৃপা বর্ষণ করে এবং পশ্চিমবঙ্গের মসনদে যেন আগামী বার বিজেপি জিতে আসতে পারে।


পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দাঙ্গা আর হিংসার খেলায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তৃণমূল ও বিজেপি


মালদার চাঁচল, হুগলির চন্দননগর, পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর, বা উত্তর চব্বিশ পরগনার নৈহাটির অনতিদূরে হাজীনগরে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সৃষ্টি এই রাজ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসা হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো করলো তার প্রতিরোধে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা তৃণমূল কংগ্রেস কি করলো? খড়্গপুরে দীর্ঘদিন ধরে অবাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্ধ চলে আসছে। রেল মাফিয়াদের এই শহরে ফরওয়ার্ড ব্লক ও কংগ্রেসের হাতে একসময়ে সমস্ত বড় বড় গুন্ডা ও মাফিয়ারা থাকলেও পরবর্তীকালে মেরুকরণের খেলায় ঢুকে বিজেপি সমস্ত সমাজবিরোধী শক্তির হিন্দু অংশ কে নিজের কবলে এনেছে। কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের বিধায়ক থাকা জ্ঞান সিংহ সোহনপাল ওরফে ‘চাচা’ কে ভোটে হারাতে তৃণমূল বিজেপির সাথে গোপন চুক্তি করেছিল বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই। আইআইটি খড়্গপুরে দীর্ঘদিন ধরে সাংস্কৃতিক সংগঠন সেজে বসে থাকা আরএসএস এর গুন্ডাদের শাখা বা অস্ত্র শিক্ষার শিবির চলছিল, তার সাথেই চলছিল ঘৃণার প্রচার। দিলীপ ঘোষের নির্বাচনে জেতার পর থেকেই খড়্গপুরের অবাঙালি (মূলতঃ হিন্দিভাষী ও তেলেগু) হিন্দুদের মধ্যে উল্লাস দেখা যায়, রমরমা বাড়ে বিজেপির সংগঠনের। দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বসে আবাঙালি আরএসএস কর্মীরা হিন্দু বাঙালি সেজে হিন্দি ও ইংরাজি ভাষায় যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গার নাম করে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছিল তারা দিলীপ ঘোষের ভোটে জেতার সময়ের থেকেই আরও চনমনে হয়ে ওঠে। আরএসএস এর নেতৃত্বে বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতন হিন্দুত্ব-সন্ত্রাসবাদী সংগঠন খড়্গপুর, আসানসোল, দুর্গাপুর, রাণীগঞ্জ, নৈহাটি, দুবরাজপুর, হাওড়া, ইত্যাদী শহরে স্থানীয় অবাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ী ও সমাজবিরোধী-মাফিয়াদের সাহায্যে বিগত ১৮ বছর ধরে নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা করার পর ২০১৪ সালে মোদীর বিজয়ের পর থেকেই তীব্র গতিতে নিজেদের শক্তি ও অনুপ্রবেশ কে বাড়িয়ে নেয়। সিপিএমের প্রতিপত্তি অস্ত গেছে, কংগ্রেসের অবস্থা তথৈবচ, রাজ্যে তৃণমূলের সাথে সরাসরি টেক্কা দেওয়ার মতন কর্পোরেট অনুমোদন প্রাপ্ত তেমন কোন বড় শক্তি না থাকার কারণে দ্রুত শূন্য স্থান পূরণ করে আরএসএস ও তার নানাবিধ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো।

মমতার সরকার মুখে বারবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা ও বিজেপির প্রতি হুঁশিয়ারি শোনা গেলেও তৃণমূলের একেবারে তৃণমূল স্তরে গেলেই জানা যাচ্ছে যে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের লড়াই করার কোন নির্দেশ কালীঘাট থেকে আসেনি কারণ কালীঘাটে ব্রাক্ষণত্ববাদী নেত্রী নিজে কোন ভাবেই চান না যে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদের জূজূ রাজ্য থেকে গায়েব হয়ে যায় কারণ তাতে ভীত সন্ত্রস্ত মুসলমান ভোট ব্যাংকের মেরুকরণের কাজে বাঁধা আসবে আর যতদিন দাঙ্গার উপক্রম জারি থাকবে ততদিন মানুষ কে ভয় দেখিয়ে স্বার্থ সিদ্ধি করা যাবে। এই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের খেলায় পূর্ব মেদিনীপুর থেকে শুরু করে নৈহাটি পর্যন্ত সকল জায়গায় তৃণমূলের হিন্দুত্ববাদী নেতারাও সমান ভাবে জড়িত। তাই খুব সাবধানে মমতা বন্দোপাধ্যায় দাঙ্গার ঘটনা কে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদ বললেও, বিজেপি ও আরএসএস কে পুরানো কংগ্রেসী কায়দায়  সাম্প্রদায়িক সংগঠন বললেও একবারের জন্যেও হিন্দুত্ববাদ বা ব্রাক্ষণত্ববাদ শব্দগুলো উচ্চারণ করেনি। বলা হয়নি যে এই দলগুলোর নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বা কি করে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীরা রাজ্যে ঘাঁটি শক্ত করলো তার তদন্তের কথাও। তাতে হয়তো অতীতে এই দলগুলোকে কি ভাবে প্রত্যক্ষ ভাবে মদত করে বাম আমলে রাজ্যে জমি পাইয়ে দিয়েছিল তৃণমূল ও মমতা - সে কথা আবার প্রকাশ্যে এসে যেত।

প্রদীপ পাশির নাম শোনা আছে ? এক কালের সিপিএমের  মস্তান থেকে বর্তমানে হাজীনগর অঞ্চলের তৃণমূলের কুখ্যাত সিন্ডিকেটবাজ ও তোলাবাজ নেতায় পরিণত হয়েছে এই লোকটা। হাজীনগরের দাঙ্গায় মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হয়ে ব্যাপক হারে উচ্চ জাতির হিন্দুদের ক্ষেপানোর ও নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ করে প্রদীপ, কিছুক্ষণের জন্যে পুলিশ তাকে ধরে গারদে পুরলেও, পরে উপর মহলের চাপে প্রদীপ পাশি ছাড়া পায়। তৃণমূলের এহেন নেতা যদি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অবাঙালি গুন্ডাদের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমান নিধন যজ্ঞে অবলীলায় সামিল হতে পারে তাহলে মমতার কি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে ভাষণ দেওয়া সাজে ? মমতার দল তৃণমূলের যে সব নেতারা মাথায় তিলক কেটে ঘুরে বেড়ায়, দূর্গা পূজা কমিটির সভাপতিত্ব করে, মাজারে চাদর চড়ায়, বা ঈদের দিনে মাথায় টুপি পড়ে বাজারে ঘোরে তাদের দিয়ে কি আর ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা রক্ষা করা যায় ?  যে রাজ্যে তপন থেকে দিলীপ ঘোষের মতন কুখ্যাত হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজেরা সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দলীয় সম্মেলনে ধর্মীয় বিদ্বেষ মূলক ভাষণ দেয় আইনের তোয়াক্কা না করে, সেই রাজ্যে মমতা বন্দোপাধ্যায় কোন সুশাসনের কথা বলে। আসানসোলে বিজেপির বহিরাগত সাংসদ সুপ্রিয় বড়াল (বাবুল সুপ্রিয়) হিন্দুদের গরুর আবেগ নিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলে যে দাঙ্গা করাতে চাইছে তা কি তৃণমূলের প্রশাসনের ব্রাক্ষণত্ববাদী মাথাদের সমর্থন ছাড়া সম্ভব হতে পারে ? মমতা যে নানা কথার আড়ালে বিজেপি ও আরএসএস কে রাজ্যের রাজনীতির আঙিনায় প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরে কংগ্রেস ও সিপিএম কে টেক্কা দিতে চাইছে সে কথা কি বোঝা খুব শক্ত ? মমতার রাজত্বে পুলিশ ও প্রশাসনের উপর দলীয় প্রভাব সিপিএমের জমানার চেয়েও তীব্র হওয়া সত্বেও প্রশাসন যখন একদিকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়তে থাকা বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে আক্রমণ করছে তখনই তারা হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডাধারীদের বিরুদ্ধে এত নরম আর এত কোমল কেন ?  


শ্রমিক আন্দোলনের ভাঁটার কারণে পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়েছে  সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প  



সাবর্ণ ভদ্রলোক বাঙালি সমাজে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব প্রবল ছিল তবুও বাংলার মাটিতে বহু বছর ধরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি, এর একমাত্র কারণ ছিল ১৯৫০-৭০ এর দশক অবধি এই রাজ্যে শ্রমিক ও কৃষকের আন্দোলন তীব্র হয়েছিল মালিক-জোতদারদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার পরে বিপুল ভাবে শ্রমিক ও কৃষক সমাজ আন্দোলিত হয়। সেদিন শ্রমিক ও কৃষকদের জাগ্রত চেতনায় ভীত হয়ে নানা ভাবে কংগ্রেসী শাসকেরা ও জনসংঘের নেতারা চেষ্টা করেছিল পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে আবার শ্যামা প্রসাদের মতন দানবের ছায়া চাপিয়ে দিতে কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়।পূর্ব বাংলার থেকে শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঠাঁই পাওয়া সাবর্ণ উদ্বাস্তুরা বামপন্থী আন্দোলনের সাথে জুড়েছিলেন এবং আন্দোলনের মধ্যে থাকায় তাঁদের মধ্যে, বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছিল তা চাপা পড়ে যায়।  শ্রমিক ও কৃষকের ঐক্যবদ্ধ এই জঙ্গী সংগ্রামে জোর ধাক্কা লাগে যখন নানা প্রতিশ্রুতির তুফান ছুটিয়ে জ্যোতি বোসের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কারখানা মালিকদের সাথে হাত মিলিয়ে জ্যোতি বোস আর সিপিএম শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলন কে দুর্বল করতে শুরু করে লক আউটের খেলা। শিল্প নির্ভর শহরগুলো ডুবে যায় অন্ধকারে, শ্রমিকদের বাড়িতে শুরু হয় দু মুঠো ভাতের জন্যে হাহাকার। চা বাগানের শ্রমিকদের না খেতে পেয়ে মুখে রক্ত উঠে মরে যাবার কথা বাদ দিলাম, শহরাঞ্চলের, খাস কলকাতার কাছেপিঠের চটকলগুলোয় কত শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান, বিহারি-বাঙালি নির্বিশেষে না খেতে পেয়ে বা বিনা চিকিৎসায় সেই আশির দশকের মাঝের সময়ের থেকে যে মারা গেছেন তার কোন হিসেব নেই।নব্বইয়ের দশকের থেকে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির হাওয়া ঢোকার সাথে সাথে এই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া শ্রমিক মহল্লায় ঢোকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ। মালিকের দরকার হয় কারখানার বন্ধ জমির উপর বহুতল অট্টালিকার, যেখানে বাস করবে বাংলার মাটির সাথে সম্পর্কহীন একদল ক্লীব রক্তচোষা নয়া পঙ্গপাল শ্রেণীর, ভদ্রলোকের  প্রজাতি। সেই বহুতলের শিল্পের গড্ডালিকায় ডোবা বাংলার মাটিতে শ্রমিকের পিঠে ছুরি চালায় এই সব বন্ধ কারখানার জমির দালালি করা সিপিএম। শ্রমিকরা সিপিএমের এই বেইমানি দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেন আর এখানেই ধীরে ধীরে সুযোগ করে নিজের রাজনীতি প্রচার করতে থাকে সংঘ পরিবার। শিল্পহীন ও কর্ম সংস্থানের সুযোগহীন বাংলার শ্রমিক শ্রেণী ক্রমাগত নিঃস্ব ও বাইরের রাজ্যে দিন মজুরে  পরিণত হয়। ধর্মের প্রভাব বাড়ে মানুষের সংকটের কালে আর তাই ধীরে ধীরে মাটির ভিতর শিকড় শক্ত করে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। পূর্ব বাংলার থেকে পালিয়ে আসা প্রাক্তন উদ্বাস্তু অভিজাত বাঙালিদের মধ্যে সুপ্ত মুসলমান বিদ্বেষ চাড়া দিয়ে জাগে। বন্ধ কারখানার প্রাক্তন শ্রমিকেরা এবং কোন রকমে চাকরি বাঁচিয়ে কাজ করতে থাকা শ্রমিকদের শেখানো হয় তাঁদের সাথে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে মুসলমান শ্রমিকটি কাজ করছেন তিনি নাকি পাকিস্তানের চর, তাঁর ছেলে নাকি হিন্দু মেয়ে ফুসলিয়ে বিয়ে করে নিজের ধর্মে বদলে দেবে, তাঁর বাড়িতে নাকি রোজ গরু কাটা হয়, ইত্যাদি। সরকারি বাম আর ডানের মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না এই ঘৃণ্য সংঘ পরিবারের রাজনীতি প্রচারের বেলায়। সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস, বকলমে সকলেই কোন না কোন ভাবে নিজেদের তৃণমূল স্তরের কর্মীদের দিয়ে ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ ছড়ায়। আজ সেই বিষের বীজ থেকে গড়ে উঠেছে অৰ্থনৈতিক অর্থে মরুভূমি হয়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের মহীরুহ বিষ বৃক্ষ। শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলন ও সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে রাখতে এই সাম্প্রদায়িক বিষ বৃক্ষের ফলই মালিক ও জোতদার শ্রেণীর প্রচন্ড কাজে লাগে, আর তাই তাদের আদেশে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে সরকারি ভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও দাঙ্গার উদ্বোধন করে ফেলেছে মমতার সরকার।এই বিষ বৃক্ষের থেকেই মাটিতে রোপন হচ্ছে সানাউল্লাহ বা প্রদীপ পাশির মতন বিষাক্ত বীজদের  যারা আগামী দিনে আরও ঘৃণ্য রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবে সংঘ পরিবার কে সাহায্য করতে।

 

বাংলার শ্রমজীবী মানুষ কে ঐক্যবদ্ধ করেই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের রথ কে রোখা সম্ভব হবে


একেবারে অশ্বমেধ যজ্ঞ! সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে ঘোড়াটা পাঠানো হয়েছে, সদর্পে ছুটে ছুটে সেই ঘোড়া আমাদের শান্তির ফসল নষ্ট করছে এই বাংলার বুকে। আর এই ঘোড়া কে এতদিন রক্ষা করেছে, দানাপানি খাইয়েছে একদল অবাঙালি উঁচু জাতের হিন্দু ব্যবসায়ী ও একদল উঁচু জাতের শহুরে বাঙালি যারা নিজেদের বাঙালি পরিচয় নিয়ে লজ্জিত এবং হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান এর পক্ষে ওকালতি করে। এই ঘোড়া আমাদের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছে, আমাদের জনগণ কে পায়ের ক্ষুর দিয়ে পিষেছে, আর তাই আজ বাঙালি শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া শ্রমিক ও কৃষকের, আদিবাসী ভাই বোনেদের, বাংলার দলিত সমাজের, বাংলার মুসলমান ও খ্রিস্টান ভাই বোনেদের কর্তব্য হলো এই সাম্প্রদায়িক ঘোড়ার মুন্ডুচ্ছেদ করার, সুদূর মহারাষ্ট্রে আর দিল্লিতে বসে যারা সারা ভারতের খেটে খাওয়া মানুষ কে জোতদার-জমিদার আর বৃহৎ বিদেশী কর্পোরেট পুঁজি ও তার দেশি মুৎসুদ্দিদের গোলাম বানিয়ে বন্দি করতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার।

পশ্চিমবঙ্গে বিগত দুই বছরে যে ভাবে হিন্দুত্ববাদের রথ মমতার গোপন সমর্থনে বলীয়ান হয়ে নিজের প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে যে গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী বাঙালিদের পক্ষে তাল মেলানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সরাসরি প্রতিরোধ না করে সরকারি বামপন্থীরা হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কে শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবি ও ছাত্র সমাজ কেন্দ্রিক করে রেখে ইচ্ছাকৃত ভাবে শ্রমজীবি মানুষকে এই লড়াই থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। শ্রমজীবি জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কখনোই বিপ্লবী বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিতে পারবেন না আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে আর তাই এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে নিজেদের বিষাক্ত রাজনীতির প্রসার করা আজ বিজেপি ও আরএসএস এর কাছে একেবারে জলভাত হয়ে উঠেছে। সারা বাংলা জুড়ে যখন বিজেপি হিন্দুত্ববাদের ঝাণ্ডা তুলে তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণের পক্ষে সোচ্চার হয়ে পথে নেমেছে, সুদূর পাড়া গাঁয়ে ঢুকে কৃষকে কৃষকে দাঙ্গা লাগাবার উস্কানি দিচ্ছে তখন গুটিকয়েক ছাত্র-ছাত্রী ও কিছু সাংস্কৃতিক কর্মীদের দিয়ে মিছিল করানো বাদে বাম আন্দোলনের তথাকথিত কান্ডারীরা আর কিছুই করেনি। আজ এই সংকীর্ণতার গন্ডি পেরিয়ে, এই comfort zone  এর থেকে বাইরে এসে, চেনা গন্ডির বাইরে এসে, সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক কৃষকের কাছে পৌঁছে তাঁদের মধ্যে লেগে পড়ে থেকে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা। আজ দরকার সমস্ত আদিবাসী, দলিত, ও শোষিত জনজাতির জনগণের শ্রমজীবি অংশ কে পশ্চিমবঙ্গের আক্রান্ত সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে সংগ্রামী মেলবন্ধে জড়িত করা, কারণ সংঘ পরিবার পরবর্তী কালে উচ্চ জাতির হিন্দু বাঙালিদের সাহায্যে আক্রমণ এই সকল সম্প্রদায়ের উপর নামিয়ে আনবে।  এটাই হিন্দুত্ববাদী-ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষণ।


গণতন্ত্র প্রিয় প্রতিটি প্রগতিশীল বাঙালিকে আজ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের সাপ কে মারতে উদ্যোগ নিতে হবে, জনগণের প্রাণ, জীবিকা, ও সম্পত্তি রক্ষার জন্যে যখন তৃণমূলের সরকার কিছুই করবে না, যখন তৃণমূলের নেতারা রাত বিরেতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঝান্ডা নিয়ে এসে সংখ্যালঘু মুসলমান ও খ্রিস্টানদের বাড়িতে আগুন লাগাবার চেষ্টা করবে, মেয়েদের ধর্ষণ করার চেষ্টা করবে, পুরুষদের গুম খুন করবে, তখন সামগ্রিক ভাবে সমস্ত গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষ কে এগিয়ে আসতে হবে, লড়তে হবেই এই কর্পোরেট স্পনসরশিপ প্রাপ্ত সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং এক হয়ে পরাস্ত করতে হবে এই আগ্রাসন কে। বাংলা আর বাঙালির অস্তিত্ব এই হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনের সামনে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে যদি আজ থেকেই দলগত, ব্যক্তিগত, নীতিগত বিভেদ দূর করে আমরা সবাই এক হয়ে লড়াই শুরু না করি। বাংলার মাটিতে যদি ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা যায় তাহলে কিন্তু সমস্ত ভারতের সামনেই তা এক উদাহরণ হয়ে গণতন্ত্রের দাবিতে লড়তে থাকা মানুষ কে সাহস ও অনুপ্রেরণা দেবে গেরুয়া বাহিনী কে পরাস্ত করার লড়াইয়ে এগিয়ে আসতে। আজ উদাহরণ ও অনুপ্রেরণার বড়ই অভাব, তাই আসুন আমরা একজোট হয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করি, অনুপ্রেরণা দিই দেশজোড়া বিজেপি-আরএসএস বিরোধী সংগ্রাম কে।    

সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের আড়ালে কর্পোরেট স্বার্থে বিজেপি করাচ্ছে গণহত্যা

বুধবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

ঝাড়খণ্ডের হাজারীবাগের বরকাগাঁওয়ে  বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময়ে গ্রামবাসীদের উপর চালানো পুলিশের গুলিতে আহত যুবক ছবির সত্বঃ নয়া সাবেরা বিকাশ কেন্দ্র ও দা ওয়্যার 


যতদিন যাচ্ছে দেশের মিডিয়া গোষ্ঠীগুলো যুদ্ধের দামামা বাজানোর কাজে বেশি বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে আর এদের হাব ভাব ও সরকারের প্রতি ভক্তি দেখে মনে হচ্ছে যে মার্কিন মুলুক থেকে এদের সর্দারেরা হয়তো বার্তা পাঠিয়েছে যে শুধু ২০১৭ সালের উত্তর প্রদেশ নির্বাচনেই নয়, বরং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও মোদীকেই আবার জিতিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে দিল্লির মসনদে। বিজেপি কে বাদ দিয়ে অন্য কোনো সংসদীয় দল যে এত উলঙ্গ চাটুকারিতার সাথে মার্কিন একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। তাই বোধহয় শেয়ার হোল্ডার থেকে মহাজনদের চাপে সাংবাদিক মহলে বেশ বিদ্রোহী ইমেজ বজায় রাখা সাংবাদিকেরাও মোদীর গুণকীর্তন  করতে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের জয়জয়কার করে বিশ্রী হট্টগোল করতে, ন্যাংটো হয়ে সেই পাঁকেই নেমেছে, যে পাঁকে নামা গো ভক্ত সাংবাদিককূলকে এই সেদিনও এরা গালমন্দ করতো, সরকারের দালাল বলতো। পেটের দায় যে বড় দায়, সরকার বাহাদুরের সাথে ঝগড়া করা যায় কিন্তু লগ্নিকারী মার্কিন কর্পোরেশনগুলোর সাথে তা করলে যে বাংলো-গাড়ি-ব্যাংক ব্যালান্স বা বিদেশে গচ্ছিত কালো টাকা, সবই ফেঁসে যাবে !

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছে বলে যখন ব্রাক্ষণত্ববাদী মিডিয়া ধেই ধেই করে নাচছে আর সরকারি বামপন্থী সংবাদ মাধ্যম যখন এই মুজরোতে করতাল বাজিয়ে তাল দিচ্ছিল ঠিক তখনই সবার অলক্ষ্যে কাশ্মীরের জনগণ তো বটেই এমনকি এই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সীমানার থেকে অনতিদূরেই হাজারীবাগে কৃষক হত্যা করছে রঘুবর দাসের বিজেপি সরকার। এনটিপিসি’র তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যে খনন কার্যের জন্যে হাজারীবাগ জেলার তিন ফসলি জমি দখল করার বিরোধিতা করে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাসীরা লড়ছিলেন, গত ১লা অক্টোবর সকালবেলায় গ্রামবাসীদের উপর হামলা করে ছয় জন কে খুন এবং ৪০ জনকে আহত করে রঘুবর দাসের খুনি পুলিশ বাহিনী।

ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার করণপুরা উপত্যকায় ৪৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কয়লা খননের বরাত পায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসি, যে সংস্থার ব্যাপক হারে বেসরকারিকরণ করেছে কংগ্রেস আর বিজেপি সরকার। ২০০৪ সাল থেকেই এই অঞ্চলে নিজের প্রতিপত্তি বিস্তার করার প্রচেষ্টা শুরু করে এনটিপিসি, কিন্তু ব্যাপক গণ বিক্ষোভ ও কৃষকদের প্রতিরোধের ফলে বেশি দাঁত বসাতে অপারগ হয় সংস্থাটি। কিন্তু কেন্দ্রে মোদী সরকার আর রাজ্যে  রঘুবর দাসের সরকার প্রতিষ্ঠার পরেই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে খননের অধিকার প্রাপ্তি করা জলভাত হয়ে যায় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর পক্ষে। ১৭,০০০ হেক্টরের মধ্যে প্রায় ২৫০০ হেক্টরে খননের জন্যে বন মন্ত্রকের থেকে অনুমতি প্রাপ্ত হলেও আইন অনুসারে জঙ্গল এলাকার ৭০ শতাংশের বেশি গ্রাম সভার সম্মতি ছাড়া সেই অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণ ও খনন কার্য না করা গেলেও বিজেপির মদতে এনটিপিসি এই বছরের মে মাস থেকে খনন কার্য শুরু করে।যার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন সাধারণ গ্রামবাসীরা এবং তাঁরা শান্তিপূর্ণ ভাবে ‘সত্যাগ্রহের’ পথ ধরে আন্দোলন করতে থাকেন এই খনন কার্যের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে।

পাকড়ি বারোয়াদিহ অঞ্চলে ১৬০০ কোটি টন কয়লা মজুত আছে আর এই কয়লা ব্লকের আগে কখনো কেন্দ্রীয় সরকার এত বড় ক্যাপটিভ ব্লক  বরাদ্দ করেনি। এনটিপিসি এই অঞ্চলের খনন কাজের ঠিকা দেয় দুইটি এমন সংস্থা কে যাদের উপর দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির অভিযোগ লেগে আসছে, বেআইনি খননের অভিযোগও আছে। থ্রিবেনি আর্থ  মুভার্স ও সৈনিক মাইনিং নামক এই দুই সংস্থা কেওনঝড় আকরিক লোহা উত্তোলনের কেলেঙ্কারি থেকে কয়লা কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিল এবং থ্রিবেনি আর্থ মোভার্স এর বিরুদ্ধে শাহ কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের তদন্তেও অনেক বার দুর্নীতির দ্বারা সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার অভিযোগ ছিল। এই দুই সংস্থার কর্তাদের সাথে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি নেতৃত্বের ভীষণ গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক স্থাপন হওয়ার ফলে একেবারে আইন কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এরা পুলিশ ও প্রশাসন কে ব্যবহার করে খনন কার্য শুরু করে এবং কংগ্রেসি বিধায়ক নির্মলা দেবীর নেতৃত্বে পরিচালিত শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম কে মাওবাদী প্রভাব যুক্ত বলে পুলিশ লেলিয়ে দেয় প্রতিবাদী গ্রামবাসীদের উপর। নির্মলা দেবী সহ অন্যান্য সমস্ত প্রতিবাদী নারীদের যখন ১লা অক্টোবর ভোর ৪টা নাগাদ চুলের মুঠি ধরে টেনে সরিয়ে দিতে থাকে থ্রিবেনি ও সৈনিক মাইনিং এর ভাড়াটে ঝাড়খন্ড পুলিশ, তখন সেখানে উপস্থিত প্রায় ৪০০ কৃষকেরা গর্জে উঠে প্রতিরোধ করতেই তাঁদের উপর বেপরোয়া হয়ে গুলি চালানো শুরু করে রঘুবর দাসের বাহিনী। ঘটনার সময়ে গুলিতে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়েন ৪৬ জন মানুষ, যাঁদের মধ্যে মৃত্যু হয় রঞ্জন রবিদাস, মাহতাব আলম, রাজেশ সাউ, অভিষেক রাই, পবন সাউ, এবং অন্য একজনের।

এই বছরের গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণ ও খুন করা এই এলাকায় নতুন ঘটনা নয়। এই পুলিশি সন্ত্রাস তীব্র রূপ ধারণ করে ২০১৩ সাল থেকে যখন এই এলাকায় প্রথম আক্রমণ করে ঝাড়খন্ড সরকারের খুনি বাহিনী। ২০১৩ সালের ২৩শে জুলাই পুলিশ খনি কোম্পানির ঠিকেদারদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী পাগর গ্রামের কৃষকদের উপর গুলি চালায় এবং এই আক্রমণে নিহত হন কেশর মাহাতো নামক একজন কৃষক। ২০১৫ সালের ১৪ অগাস্ট এই এলাকায় পুলিশের গুলি চালনায় ১ জন সাংবাদিক সহ ৬ জন আহত হন এবং সেই দিন পুলিশ ২২ রাউন্ড গুলি চালায় কয়লা খননকারী ঠিকাদার সংস্থার পক্ষ থেকে। বারবার এই অঞ্চলে জমি দখল করতে হিংস্র রূপ ধারণ করেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, যারা আজ কর্পোরেট মহলের ভাড়াটে ফৌজ হিসেবে কাজ করছে। ঝাড়খণ্ডের সৃষ্টি হওয়ার নৈপথ্যে ছিল কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে সহজে খননের বরাত পাইয়ে কমিশন আয় করা এবং গত ১৬ বছরে ঝাড়খণ্ডের পুলিশ ও প্রশাসন পুরোদস্তুর কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দালাল রূপে কাজে পারদর্শিতা দেখিয়েছে এবং অসংখ্য যুবক যুবতীদের মাওবাদী আখ্যা দিয়ে হত্যা করে, বন্দি করে আর অপহরণ করে সরকারি মেডেল জিতেছে। করণপুরা আর বরকাগাঁও অঞ্চলেও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর টাকা খেয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী এগিয়ে এসেছে এলাকার কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে ও ব্যাপক হারে গ্রামবাসীদের তাঁদের জমি ও সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করতে।          

সমগ্র করণপুরা অঞ্চল তিন ফসলি জমিতে সমৃদ্ধ এবং প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কৃষি অর্থনীতি এই এলাকার মানুষের প্রধান উপার্জন।বহুদিন ধরে এই অঞ্চলের সমস্ত গ্রাম সভায় কৃষি জমি খনির জন্যে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ হয়েছে এবং এলাকার কৃষকেরা হাতে করে কয়লা উত্তোলন করে তা বিক্রি করে গ্রামসভাকে রাজস্ব দিয়ে বিকল্প অর্থনীতির পথ দেখিয়েছেন সরকারকে।বিকল্প কয়লা উত্তোলনের পথে চলে যদি একটি টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব রাস্তার উদ্ভাবন হয় তাহলে দেশের অনেক অঞ্চলে খনিজ পদার্থ খননের জন্যে তা কাজে আসতে পারে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জঙ্গলের ক্ষতি না করে, জনগণ কে উচ্ছেদ না করেই। কিন্তু সেই পথে চললে সৈনিক মাইনিংস বা থ্রিবেনি আর্থমুভিং এর মতন সংস্থাগুলো টাকা আয় করতে পারবে না, বেদান্ত বা পস্কো কোটি কোটি ডলার লাভ কামাতে পারবে না, ভারতের সরকারকে তাহলে কর্পোরেট খননকারী সংস্থার জায়গায় বরাত দিতে হবে এলাকার জনগণ কে, বিশেষ করে সেই আদিবাসী জনতা কে যাঁরা বহু যুগ ধরে সঞ্চিত সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রকৃতি কে রক্ষা করে চলেছেন বলেই আজ ভারতবর্ষের মানুষের কাছে শ্বাস নেওয়ার জন্যে অক্সিজেন রয়েছে। আর জনগণ কে বা সরকারি গণ সংস্থা, যেমন গ্রাম সভাকে যদি বরাত দেওয়া হয় কয়লা বা আকরিক লোহা উত্তোলনের তাহলে তো কমিশনের অঙ্ক শূন্য হয়ে যাবে।  তাই কমিশন কামাবার ধান্দায় এগিয়ে থাকতে রঘুবর দাসের সরকার সেই সমস্ত প্রস্তাবকে নাকচ করে কৃষক মারতে উদ্ধত হয়েছে।  

ঝাড়খন্ড সরকার এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ আদানি ও বেদান্তের মতন কুখ্যাত সংস্থার সাথে মৌ স্বাক্ষরিত করেছে, সেপ্টেম্বর মাসের ২০ তারিখে মুম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত ঝাড়খন্ড রোড শো’র মাধ্যমে ১৯৫০ কোটি টাকার মৌ সই করেছে। এই ‘মৌবাদের’ ঠেলায় আগামী দিনে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী জনগণের প্রাণ অতিষ্ঠ করতে ময়দানে আর জঙ্গলে বেশি জোরদার করা হবে ভারত রাষ্ট্রের আদিবাসী খেঁদাও অভিযান - অপারেশন গ্রিন হান্ট কে। আদানি ও বেদান্তের পাতে লাভের ক্ষীর তুলে দিতে ছত্তিশগড় ও ওডিশার মতন তীব্র করা হবে ঝাড়খণ্ডের রাষ্ট্রীয় মদত প্রাপ্ত ‘বেসরকারি’ হার্মাদ বাহিনীগুলোকে। হাজারীবাগের ঘটনা স্পষ্ট করছে যে আগামী দিনে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার, কেন্দ্রের মোদী সরকারের সামরিক সমর্থনে বলীয়ান হয়ে তীব্র হিংসাত্মক অভিযান চালাবে খনি কর্পোরেশনগুলোর পক্ষ থেকে। ছত্তিশগড়ের স্তরেই গণহত্যা, ধর্ষণ, পুলিশ ও বেসরকারি কর্পোরেট মিলিশিয়ার মাধ্যমে সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সরকার সমস্ত রাজ্যের আদিবাসী জনগণের সম্পদ তুলে দিতে চায় কর্পোরেটদের হাতে।  

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, ভারতের কর্পোরেট মিডিয়ার নির্লজ্জ ভাবে সরকারের পদলেহন করা নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি, কিন্তু যে বিষয়টা আজ বেশি করে আলোচনা করা দরকার, তা হলো কি ভাবে মোদী সরকার, একের পর এক আগডুম বাগডুম প্রচার অভিযানের মধ্যে দিয়ে কর্পোরেট লুঠ তরাজ থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিচ্ছে সীমান্তের নাটকের দিকে। ফ্যাসিবাদী ব্রাক্ষণত্ববাদ আজ অভিজাত হিন্দুদের মধ্যে উগ্র দেশপ্রেম ও জাতি বিদ্বেষের হুজুগ তুলে সামগ্রিক ভাবে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারগুলোকে সংকুচিত করার ফন্দি কষছে। শ্রমিক-কৃষক, মেহনতি জনতা, দলিত-আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের ঐক্য কে ভাঙ্গার জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচা করছে। আর এই ষড়যন্ত্রগুলোর পিছনে সর্বদাই রয়েছে দেশি ও বিদেশি পুঁজির উদার সমর্থন। এই বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির আজ মোদীকে দরকার আগামী বেশি কিছু বছরের জন্য। তাই তারা যে করে হোক মোদী কে এক বলিষ্ঠ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হিন্দু নেতা হিসেবে ২০১৯ সালের পরেও প্রতিষ্ঠিত করে রাখতে চায়।আর তাই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে, পাকিস্তান আর চীনের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে, কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম পুরোদস্তুর বিজেপি ও মোদী কে পুনরায় হিরো বানাবার স্বার্থে এখন সমস্ত কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর লড়াইয়ের ঘটনা কে চাপা দিচ্ছে গগনভেদী যুদ্ধ হুঙ্কার দিয়ে। আর সেই যুদ্ধের হুজুগে মেতে উচ্চ জাতির স্বচ্ছল লোকেরা হাততালি দিলেও ঝাড়খণ্ডের হাজারীবাগের মতন ঘটনায় রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে মৃত্যু হচ্ছে গরিব দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের। তাই এই যুদ্ধ আর পরাক্রমণের হুজুগের বাইরে গিয়ে আমাদের আজ গরিব মানুষের সাথে মিলে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তার ভারতীয় মুৎসুদ্দি দালালদের দেশের জল-জঙ্গল-মাটি ও মানুষ বেচার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

    

মোদীর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্প আর ব্রাক্ষণত্ববাদী কর্পোরেট মিডিয়ার নির্লজ্জ দালালি

শনিবার, অক্টোবর ০১, ২০১৬ 0 Comments A+ a-



২৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ভারতের সেনাবাহিনীর মহাপরিচালক (অপারেশন) রণবীর সিংহ এক সাংবাদিক সম্মেলনে মোদী সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করেন  যে ভারতের সেনাবাহিনীর একটি টিম নাকি বুধবার মধ্যরাতের সাড়ে ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে কয়েক কিলোমিটার এলাকার ভিতরে কিছু জঙ্গী “লঞ্চপ্যাডে” সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে এমন জঙ্গীদের খতম করেছে যারা নাকি কিছুদিনের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে ভারতের সেনা ঘাঁটির উপর আবার উরির কায়দায় হামলা করার পরিকল্পনা করছিল। এর সাথে সাথে রণবীর সিংহ বলেন  যে এই আক্রমণে ভারতের সেনাবাহিনীর হামলায় ৩৫ জন জঙ্গী ও তাদের সমর্থকের মৃত্যু হয়েছে এবং এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর রণবীর সিংহ টেলিফোন করে পাকিস্তানের সেনা কর্তাদের নাকি জানিয়েছেন।রণবীর সিংহ বলেন যে ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে নাকি গোপন সূত্রে পাওয়া পাকা খবর ছিল যে এই সব সন্ত্রাসবাদীরা নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে হামলা করতে আসছিল।

সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের এই বিবৃতি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই মোদী ভক্তদের উল্লাসের বাঁধ ভেঙে যায়।এই সাংবাদিক সম্মেলনের পর থেকেই কর্পোরেট পাবলিক রিলেশন্স বা জন সম্পর্ক অভিযানের মতন ভারত সরকার ও বিজেপি নিজেদের পিঠ চাপড়াতে থাকে। সারা দেশজুড়ে কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমগুলো নানা ভাষায় আর নানা ভাবে মানুষ কে বোঝাতে থাকে কি ভাবে ভারতের সেনা বাহিনী এমন এক দুঃসাহসিক অভিযান করে পাকিস্তানের দখলে থাকা এলাকার ভিতরে ঢুকে জঙ্গী হত্যা করে ভারতের স্বার্থ কে সুরক্ষিত করেছে। চতুর্দিকে শুধু মোদীর জয় জয়কারে আকাশ বাতাস ভরে গেল। বিজেপির নেতারা বুক বাজিয়ে বলতে থাকলো যে “বলেছিলাম না, মোদীর ভারত চুপচাপ আক্রমণ সহ্য করবে না”, মোদী কে হিন্দু ভারতের সর্বাধিনায়ক রক্ষাকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করে টুইটার জুড়ে তার প্রশংসার ঝড় বইয়ে দেয় অমিত শাহ থেকে শুরু করে সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা।মোদী প্রশংসার এই বন্যায় সংসদীয় বাম-ডান-মাঝখানের সব বিরোধীরাও  ভেসে যায়  দুই হাত তুলে মোদী সরকারের জয় জয়কার করে। কর্পোরেট মহল ভারতের সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রশংসা করে উচ্চগ্রামে। আনন্দ মাহিন্দ্রা থেকে কিরণ শাও মজুমদার, সকলেই মোদী সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বিজেপির পদক্ষেপের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানান দেয়। ভারতের কর্পোরেট দুনিয়ার সমর্থন পেয়ে আরও আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়ে মোদী সরকার ও বিজেপি। জোর কদমে ঢাক বাজতে থাকে।কর্পোরেট মিডিয়ায় রক্ত পিপাসু কিছু লোক, যারা বেশ কয়েকদিন ধরে পাকিস্তানের রক্ত চাই, রক্ত চাই, বলে চিৎকার করছিলো, তারাও এই ঢাকে কাঠি দিল আর সাথে সাথে যে সকল সংবাদ মাধ্যম এতদিন মধ্যপন্থায় গিয়ে বলছিলো যে যুদ্ধ নয় কূটনৈতিক ভাবে পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়াও, তারাও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর শুনে ধেই ধেই করে নেচে উঠলো। সমগ্র দেশের সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে, টিভির পর্দা জুড়ে, রেডিও, ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুধুই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। মনে হলো যদি দেশের কিছু নিয়ে গর্ব করার থাকে, তাহলে তা হলো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, যদি ভারতের সর্ব শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব বলে কিছু থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তা হলো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক।  

তবু অনেকগুলো ফাঁক রয়ে গেছে সামরিক বাহিনীর মহাপরিচালক (অপারেশন) রণবীর সিংহের বক্তব্যে, যা নিয়ে আমাদের দেশের শাসকশ্রেণীর বশংবদ সংবাদ মাধ্যম কোনোদিন মাথা ঘামাবে না বা প্রশ্ন তুলবে না।অথচ সত্য কে জানার জন্যে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া ভীষণ জরুরী। প্রশ্ন তোলার অধিকার একটা গণতান্ত্রিক দেশের সমস্ত নাগরিকের আছে, আর দেশপ্রেম বা জাতীয় সুরক্ষার নামে যদি দেশলাইয়ের বাক্স থেকে রিকশার টায়ার কেনার মাধ্যমে যে জনগণ কর দিচ্ছে তাঁরা জানতে না পারেন যে তাঁদের টাকা সরকার কি ভাবে অপচয় করছে, তাহলে সুনিশ্চিত হতে হবে যে ডাল মে কুছ কালা হায়।

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে যে ভারতের সেনাকর্তার এই সাংবাদিক সম্মেলনে কোনো সাংবাদিক কে প্রশ্ন করতে দেওয়া হয়নি। ভারতীয় সেনার ডিজিএমও রণবীর সিংহ এই তথাকথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য  প্রমাণ বা নথি পেশ করেননি, জানিয়েছেন যে উপযুক্ত সময়ে ভারতীয় সেনা এই নথি প্রকাশ করবে। কোন জঙ্গী সংগঠনের উপর হামলা করা হলো, কি করে জানা গেল যে তারা জঙ্গী ঘাঁটিতেই হামলা করেছে, বা কোথায় কোথায় এই হামলা করা হলো তার কোনো তথ্যই এই সাংবাদিক সম্মেলনে পেশ করা হয়নি। এই সাংবাদিক বৈঠকের পরে ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর ছড়িয়ে পড়তেই পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনী সোজাসুজি এমন কোনো আগ্রাসনের খবর অস্বীকার করে জানায় যে ভারতের তরফ থেকে বুধবার ভয়ানক গোলা বর্ষণ করা হয় এবং এর ফলে তাদের দুই জন সৈন্য মারা গেছে। সেই গোলাবর্ষণের ঘটনাকে যদি ভারতের সেনা বাহিনী সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের গল্পের সাথে গুলিয়ে ফেলতে চায় তাহলে সেটা হবে ভারতের শাসকশ্রেণীর দেউলিয়াপনার নিদর্শন,  তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো এই তথাকথিত “সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” ঘটনাটি কে সেই রকম গুরুত্ব দেয়নি যা সাধারণতঃ ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে কোন সংঘর্ষ পেয়ে থাকে। এই হালকা ভাবে দেখাটাও অনেকের চোখে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে।

আমরা আগেই একটা শংকা প্রকাশ করেছিলাম যে যদিও ভারতের মোদী সরকার একটা জঙ্গী হিন্দুত্ববাদী সরকার এবং প্রতিবেশী দেশ ও কাশ্মীর সহ অন্যান্য জাতিসত্তার বিরুদ্ধে আক্রমণ করার অভিপ্রায় এই সরকারের রন্ধে রন্ধে, তবুও যতদিন না মার্কিন দেশের নির্বাচন শেষ হচ্ছে ততদিন ভারতের বা পাকিস্তানের পক্ষে কোনো রকম বড় ধরণের সামরিক অভিযান করা সম্ভব নয়, কারণ এই দুই সরকার যে মার্কিন শাসক শ্রেণীর গোলামি করে তারা এই মুহূর্তে যেন তেন প্রকারে হিলারি ক্লিন্টন কে জিতিয়ে রাষ্ট্রপতি করে গরিব আমেরিকানদের ধাপ্পা দিতে বিস্তর পরিশ্রম করছে। ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে যুদ্ধ হলে মার্কিন সরকারকে, যে সরকার এখন ওবামার নেতৃত্বে সেই ডেমোক্র্যাটদের হাতেই রয়েছে, একটা পক্ষ নিতেই হবে - যা নিঃসন্দেহে ভারতের পক্ষে যাবে কারণ ভারতের বাজার ও খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার পাকিস্তানের চেয়ে বেশ বড় এবং অনেক বেশি করে একচেটিয়া পুঁজির উপযোগী। আর এই ভাবে যদি ডেমোক্র্যাট সরকার কে পাকিস্তানের বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকেরা সরাসরি ভারতের পক্ষে ঝুঁকতে দেখে তাহলে তারা হয়তো হিলারিকে ভোট দিতে ইতস্তত করবে, যা ডেমোক্র্যাটদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের জূজূ দেখিয়ে যে মুসলমান ভোটের মেরুকরণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে জল ঢেলে দেবে। ফলে এই বছরের নভেম্বর অবধি লাগাম ধরে রাখার নির্দেশ নয়া দিল্লি ও ইসলামাবাদে এসেছে হোয়াইট হাউস থেকে। তাই উরিতে জঙ্গী হামলার পরেই এক সময়ে পাকিস্তান কে উপযুক্ত ভাষায় জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া নরেন্দ্র মোদীও গুটিয়ে গেছিল ও কেরলের কোঝিকোডে অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অপুষ্টি দূর করার যুদ্ধের কথা বলে বা কখনো ইন্দাস নদীর  জলবণ্টন চুক্তি খারিজ করা বা পাকিস্তান কে দেওয়া মোস্ট ফেভারড নেশন এর তকমা সরিয়ে দেওয়ার কথা বলে  হাওয়া ঘোরাবার চেষ্টা তাকে করতে হয়। কিন্তু মোদীর ম্যানেজার’রা বুঝেছিল যে এই সব জবাবে বিজেপির পাঁড় সমর্থকেরা, উঁচু জাতের ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত হিন্দুরা কোনো ভাবেই সন্তুষ্ট হবে না এবং এর ফলে হয়তো উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে সমর্থন খোয়াতে হতে পারে। ফলে একটা সাপ মেরে লাঠি অক্ষত রাখার পথ খুঁজে পাওয়ার দরকার ছিল গেরুয়া শিবিরের কাছে।

মার্কিন দেশ থেকেই পথ বাতলানো হলো। কথা হলো মোদীর প্রিয় পাত্র ও আরএসএস এর সমর্থক তথা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা  অজিত দোভাল ও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুসান রাইসের মধ্যে। সেই টেলিফোনে বাৰ্তালাপের পরেই রণবীর সিংহ কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলন করে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর দেন, যে স্ট্রাইকের সাথে আবার কিছুদিন আগে রিলায়েন্স ঘনিষ্ঠ কুইন্ট ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত ভারতের পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে হামলা করে ২০০ জঙ্গী মারার ভুঁয়ো খবরের অনেক মিল রয়েছে। সেই ভুঁয়ো স্ট্রাইকের কথা কিন্তু এই ভারতের সেনাবাহিনী কয়েক দিন আগেই নস্যাৎ করেছিল। কিন্তু সেই খবর যখন কুইন্ট প্রকাশ করে তখন চলছিল মোদীর সাথে সামরিক বাহিনীর কর্তাদের বৈঠক, হয়তো সেই বৈঠকের পূর্ব নির্দ্ধারিত স্বিদ্ধান্ত ছিল প্রচার মাধ্যম কে ব্যবহার করে যুদ্ধের জিগির জিইয়ে রেখে মোদীর স্বার্থ পূরণ করা। কিন্তু কোন সবুজ সঙ্কেত ছাড়াই যখন কুইন্ট বাড়িয়ে চড়িয়ে সেই ভক্তদের সাধের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খবর প্রকাশ করে তখন বেকায়দায় পড়ে যায় ভারতীয় শাসক শ্রেণী ও মোদী। পরের বারের আগে সাবধানে পা ফেলে নরেন্দ্র মোদী আর কর্পোরেট মিডিয়া সমস্ত পদক্ষেপ পরিকল্পনা অনুসারে নেয়। যতদূর জল গড়িয়েছে তাতে বিজেপি’র পিতৃপ্রতিম সংগঠন আরএসএস এর পুরানো মিত্র মুসলিম লীগ ও তার নেতা নওয়াজ শরীফের যোগও স্পষ্ট হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস নির্দেশ অনুসারে হয়তো বিরিয়ানির পাতে পাতানো বন্ধুত্ব এই সংকট কালে কাজে এসেছে মোদীর। তাই তো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার সময়ে আগেই বলে দেওয়া হচ্ছে যে পাকিস্তান সরকারকে ভারতের সামরিক আগ্রাসনের বিস্তারিত খবর দেওয়া হচ্ছে।

ভারতের সেনাবাহিনী যদি সত্যিই এই অভিযান করে থাকতো তাহলে মিলিটারির পক্ষ থেকে এমন তথ্য সাংবাদিক সম্মেলনেই প্রকাশ করা হতো যা দিয়ে পাকিস্তানের সেনার সমর্থনে বেড়ে চলা ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ কে দুনিয়ার সামনে খোলাখুলি দেখানো যেত। কিন্তু দেখানো হলো না, হয়তো সরকারের ফটোশপ মন্ত্রক তথ্য ও প্রমাণ অকাট্য রূপে সৃষ্টি করার কাজে জুটেছে। মনে পড়ে জেএনইউ কাণ্ডের ভিডিও? বা সম্বিৎ মহাপাত্রের মার্কিন সৈন্যের ঝান্ডা উত্তোলনের ছবিকে কারুকার্য করে ভারতীয় সেনার ঝান্ডা উত্তোলনের ছবি বানিয়ে জনতাকে দেশপ্রেমের টনিক খাওয়ানোর চেষ্টা?

ভারতের শাসক শ্রেণী ও তার সরকারি যন্ত্রের পক্ষে কোন রকমের জালিয়াতি অসম্ভব নয়। ভেজাল করে যে সরকারকে দেশপ্রেমের নামে উগ্র বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করতে হয়, কাশ্মীরে প্রায় ৯০ জন মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, ১০,০০০ স্বাধীনতা কামী জনগণ কে জখম আর পঙ্গু করে নিজেকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে হয়, সেই সরকারের কোন কথায় শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষের বিশ্বাস করা অসম্ভব।

উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নামক ঘটনা কে মাইলেজ হিসেবে ব্যবহার করে ব্যাপক হারে ভোট কামানোর লক্ষ্যেই আরএসএস এর বেনারস শাখা ২৯শে সেপ্টেম্বর গঙ্গার ঘাটে সন্ধ্যা আরতিতে মোদী সরকারের বিজয়ের শঙ্খনাদ করে। বেনারস মোদীর নির্বাচন কেন্দ্র ও হিন্দু ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান। এই জায়গায় হঠাৎ করে হিন্দুত্বের আবেগ জাগিয়ে তোলার ঘটনাও চোখে সন্দেহজনক ঠেকছে অনেকের। অন্যদিকে এই ঘটনার জেরে পাকিস্তানের মিডিয়ায় পাকিস্তানের সেনার হাতে ভারতের সৈনিকের গ্রেফতার হওয়া থেকে শুরু করে ভারতের বেশ কয়েকজন সৈনিক কে মেরে ফেলার খবর প্রকাশ হতে থাকে। ভারতের মিডিয়া আবার সেই সব খবর কে সরকারের কথা মতন নাকচ করে দেয় এবং ভারতের সৈন্যের জয় জয়কার করতে থাকে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর এবিপি চ্যানেল একটি টুইট করে জানান দেয় যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নাকি সারা রাত চোখের পাতা এক না করে জেগে বসে ছিল। এমনকি লোকটা নাকি সারা রাত্রি জল খায়নি ! এই কথাও প্রচার করছে এবিপি’র মতন তথাকথিত নিরপেক্ষ সংবাদ সংস্থা।  
 
ভারতের কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম ও সরকারি বামপন্থীরা এই সরকারের বিবৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্ববিরোধ ও ফাঁকগুলোর কোনরকম সমালোচনা করার চেষ্টা করেনি। অথচ স্পষ্ট ভাবেই দেখা যাচ্ছে যে মোদী সরকার খুব চালাকির সাথে ভারতের উঁচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রাখতে এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উৎপত্তি করেছে। অথচ সাংবাদিকেরা কোন ভাবেই এই সহজ অঙ্কটা জনতার সামনে প্রকাশ করতে চাইছে না। কি এমন হলো যে সমস্ত সংবাদ সংস্থার চরিত্রটা সরকারি প্রচার মাধ্যমের মতন হয়ে গেল? কেন সরকারের দাবি প্রতিধ্বনি করাই সংবাদমাধ্যমের একমাত্র কাজ হয়ে উঠলো? কেন স্বাধীন ভাবে, সত্যের অনুসন্ধান করে জনগণের সামনে প্রকাশ করার কাজে এত অনীহা সাংবাদিকদের? কেন আমাদের দেশে স্বাধীন ও সাহসী সাংবাদিকতার এত অভাব?

ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলো নেহরু আমলেও শাসক শ্রেণীর চাটুকারিতা করতো, ইন্দিরার জমানায় কংগ্রেসের সামনে হামাগুড়ি দিত, সরকারের কথা পাঁচালীর মতন আউরে যেত। কিন্তু এমন কিছু সাহসী সাংবাদিক সেদিনও মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে ছিলেন যাঁরা কোনো ভাবেই ফ্যাসিবাদের সামনে মাথা নত করেননি, পেশার প্রতি, গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তাঁরা প্রশ্ন করেছিলেন স্বৈরতন্ত্র কে, পুলিশের হাতে মার খেয়েও, জেলের ভিতর বন্দি হয়েও, তাঁরা ঝোঁকেননি অন্যায়ের সামনে।  আজ সেই স্বাধীন ও নির্ভীক এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সাংবাদিকদের বড় অভাব। আর তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি। টিভি ও ইন্টারনেটে সংবাদ বিক্রি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই পুঁজিপতিদের হাতে সংবাদ মাধ্যম সম্পূর্ণ কুক্ষিগত ছিল, সত্তরের বা আশির দশকেও ছিল, কিন্তু তাও সেই সময়ে প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম কে পাঠকের কাছে নিজের কাগজ বিক্রির জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এবং বিশ্বাসযোগ্য খবর ছাপতে হতো। কারণ কারুর পত্রিকা যদি সরকারের ঢাক পেটাতে থাকতো তাহলে পাঠকদের প্রতিযোগী গোষ্ঠীর কাগজের পাঠক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রচুর। সেই নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সাংবাদিকেরা খবরের পিছনে দৌড়তেন। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতে ধীরে ধীরে সংবাদের ব্যবসা কুক্ষিগত হওয়ার পর থেকেই সংবাদ সংগ্রহ করার চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হলো সংবাদ সৃষ্টি করার, পাঠক বা দর্শকের চেয়ে বেশি জরুরী হলো টিআরপি যার দমে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ আয় করা সম্ভব হয় টাইমস, জি, আনন্দ বা ফক্স গোষ্ঠীর। তাই দরকার হয় জানার যে বিজ্ঞাপন দাতারা কোন রাজনীতিটা আজ উর্দ্ধে তুলতে চায়, আজ্ঞাবাহক ভৃত্যের মতন তাই মিথ্যার চাদরে মনিবের নগ্ন দেহ ঢাকতে চায় কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যম। মনে রাখতে হবে এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের মূল কাজ হলো রাজনৈতিক জনমত তৈরি করে নিজেদের বিজ্ঞাপনদাতা ও লগ্নিকারী সংস্থাগুলোর স্বার্থ রক্ষা করা। তা বিজেপির দরবারে মুজরো করা অর্ণব গোস্বামীর টাইমস নাউ বা পাইওনিয়ার সংবাদপত্র হোক বা বিপ্লবী সাজা আনন্দ গোষ্ঠীর দি টেলিগ্রাফ অথবা এনডিটিভি হোক এদের সবাইকে মালিকের সামনে কুর্নিশ করতেই হবে। তাই যত বিপ্লবী বা সরকার বিরোধী কিছু কর্পোরেট সাংবাদিক সেজে থাক না কেন একদিন খোলাখুলি তাদের কাঞ্চন গুপ্ত বা স্বপন দাশগুপ্তের মতন হাটের মাঝে শাসকশ্রেণীর চাটুকারিতা করতেই হবে। আর এখানেই লুকিয়ে বিপদ।

যতদিন এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যার গোলা কে ভাঙার স্বার্থে বিকল্প জনতার সংবাদ মাধ্যম তৈরি না করা যাবে, যতদিন না এই কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের চাটুকারিতার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত তৈরি করে এই মিথ্যার সওদাগরদের ভাতে মারা না যাবে, ততদিন আমাদের দেশের মানুষ কে যুদ্ধ ও হিংসার পক্ষে, জাতি ঘৃণা ও দমন পীড়নের পক্ষে টেনে আনার এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে। আজ সময় এসেছে মিথ্যার এই কারখানায়, ভেজাল জনমত তৈরির এই কারখানায়, বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজির দালাল মিডিয়ার উপর জনগণের সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা, মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের দ্বারা সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের। সার্জারি ছাড়া যে রোগী কে বাঁচানো যাবে না।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে