ধর্ষণের বিরুদ্ধে সুজেট জর্ডানের লড়াই নির্যাতিত নারীর কাছে এক প্রেরণা

রবিবার, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হলো যে সুজেট জর্ডান ধর্ষিত হয়েছিলেন এবং মমতার লাগনো "সাজানো ঘটনার" যে সাইন বোর্ডটি কাকলী ও মদনের মতন মো সাহেবরা জি হুজুর রব তুলে পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণকারীদের রক্ষার স্বার্থে সুজেটের উপর লাগিয়েছিলেন তা কুত্সা ছাড়া আর কিছুই নয়. একটা মিথ্যা কে সত্যি বলে চালাতে গেলে কাউকে যে কত নিচে নামতে হয় তার উদাহরণ ২০১২ তে ঘটিত এই ঘৃণ্য পাশবিক ধর্ষণ কাণ্ড.

সাজা আর আদালতের রায় নিয়ে মমতা ব্যানার্জী যে নিজের থুতু নিজে চেটে ক্ষমা চাইবেন সে আশা গুড়ে বালি. হয়তো নজিরবিহীন কাণ্ড হবে যে সরকার পক্ষ নিজ থেকে সাজার বিরুদ্ধে আপিল করে বসলে.  অথবা নির্বাচনের প্রাক মুহূর্তে ১৮০ ডিগ্রী ডিগবাজি খেয়ে এ কথাও বলতে পারেন যে তিনি চিরকালই সুজেট জর্ডানের জন্যে ন্যায়ের লড়াই লড়েছেন.

এই সকল রাজনৈতিক নোংরামি ছাড়া যে জিনিসটা সব চেয়ে বেশি তীক্ষ ভাবে বিঁধেছে তা হলো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক অর্ধ সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এক ধর্ষিত নির্যাতিত নারীর উপর আসল পাশবিক অত্যাচার তো ওই ধর্ষণের খবর বের হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়. প্রগতিশীলতার চাদর গায়ে দেওয়া বাঙালী মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সমাজে অধিষ্টিত ভদ্র লোকেরা, যাঁরা মঙ্গল চণ্ডীর উপস করেন আবার নারী শক্তির প্রতীক দুর্গা পুজোয় ধুতির কোঁচা ধরে ধুনুচি নাচেন, তাঁরাই আবার সুজেট জর্ডানের ধর্ষণের ঘটনার উপর মন্তব্য করেন নাক সিঁটকে. কাকলী -মদনের শেখানো নারী বিদ্বেষী মনোভাব থেকে তাঁরা জানতে চান কেন সুজেট মধ্য রাতে ওই পার্ক স্ট্রীট অঞ্চলের পান শালায় গেছিলেন? গণ ধর্ষণ তিনি সহ্য করলেন কি ভাবে? তিনি কোন ধরণের পোষাক পড়েছিলেন? তিনি কি মদ খেয়েছিলেন ? ইত্যাদী. মোদ্দা কথা হলো যে প্রমাণ করুন আপনি ধর্ষিত হয়েছেন. স্বেচ্ছায় শয্যা সঙ্গিনী হননি.

অথচ এই লোকগুলো যখন দিল্লীর ঘৃণ্য গণ ধর্ষণের খবর সেই একই বছর শুনলো তখন সেই খবরে তাঁদের বীরত্ব জাগিয়ে দিলে. ধর্ষণ বিরোধী, নারী দরদী সেজে গেলেন তাঁরা রাতারাতি. তর্ক-বিতর্কে চায়ের পেয়ালা উল্টে গেল, নারী সুরক্ষা নিয়ে সবাই গলা চড়াতে থাকলেন. সুজেট কে নিয়ে  নয়. কারণ মধ্যবিত্ত পুরুষতন্ত্রের চশমা পড়ে দেখলে তো সুজেট জর্ডান এক নষ্ট মেয়ে. ঠিক যেমন সিনেমায় দেখা যায়. সুজেট মদ খেতেন, সিগারেট ধরিয়ে ধুঁয়া ছাড়তেন প্রকাশ্যে, রাত বিরেতে পার্টিতে যেতেন, ছেলেদের সাথে মিশতে দ্বিধা করতেন না, আর তার উপর মেয়েটার ডিভোর্স হয়েছে - নিশ্চয় চরিত্রের দোষ দেখে স্বামী ছেড়ে দিয়েছে! একটু মাসিমা গোছের ভদ্র মহিলা বলবেন, অ্যাঙ্গলো ইন্ডিয়ানদের তো চরিত্র জন্মগত ভাবে নষ্ট গোছের.

আর সুজেট এই সব কিছুর উপরে হাতুড়ি মারলেন মুখ খুলে প্রকাশ্যে এসে. বললেন ধর্ষিতা নারী কেন লজ্জায় মুখ ঢাকবে ? লজ্জায় মুখ ঢাকা উচিত ধর্ষকদের, কারণ অপরাধ তারা করেছে. পুরুষতান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কিন্তু সর্বদা ধর্ষিতার মুখ ঢেকে এসেছে, আমাদের হাড়ে মজ্জায় এই চেতনা ঢুকিয়েছে যে ধর্ষণ হওয়া নারীর আর সন্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার নেই, যদি কোন পুরুষ দয়া করে তাঁদের হাত ধরেন তাহলে তাঁরা রক্ষা পান. আমদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এঁটো কাটা মানার প্রবণতা তো নারীর উপরেও প্রয়োগ হয়, এঁটো হওয়া মেয়েমানুষ তো পুরুষদের কাছে গ্রহণ যোগ্য নয়.

তাই ধর্ষিতা নারীর প্রতি সহমর্মিত পুরুষতন্ত্র তাঁদের 'নির্ভয়া' নামে ডাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, কারণ সেখানে তো ধর্ষিতা পুরুষের সামনে, ধর্ষকের আক্রমণে শত ছিন্ন হয়ে, এক করুণার প্রার্থী হয়ে প্রকাশিত হয় পর্দার আড়াল থেকে. কিন্তু সেই ধর্ষিতা যদি পাল্টা আক্রমণ করে ধর্ষকদের, যদি পুরুষতন্ত্রের চাপানো বাঁধ ভেঙে মুখ আর পরিচয় লুকিয়ে থাকতে অস্বীকার করে আর প্রকাশ্যে এসে ধর্ষণের বিরুদ্ধে মুখ খোলে তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সেই নারীর বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা সুজেট জর্ডানের ক্ষেত্রে সমাজের রক্ষাকারীরা শুরু করে.

আজ সময় এসেছে এই কথাটি আরো শক্তিশালী ভাবে বলার যে ধর্ষণ নারীর দোষে নয় পুরুষের দোষে হয়. পুরুষগণ ধর্ষণ করে তাদের বিকৃত কামনাকে চরিতার্থ করার জন্যে, নারীর উপর নিজের প্রভুত্ব কায়েম করার স্বার্থে. নারীর সমান অধিকার আছে যেখানে খুশি যখন ইচ্ছে যাওয়ার, মদ খাওয়ার, সিগারেট টানার, নিজের পছন্দের পোশাক পড়ার. আর ধর্ষণ হয় কারণ পুরুষগণ নিজের সমকক্ষ হিসেবে নারীকে দেখতে পারে না. সেই নারীকে শিক্ষা দেওয়ার পাশবিক পদ্ধতি হলো ধর্ষণ. আর নারীকে বোরখা পড়িয়ে, মুখ ঢাকিয়ে এই ধর্ষকদের থেকে বাঁচানো যাবে না. ধর্ষণ থেকে বাঁচার স্বার্থে দরকার এক শক্তিশালী পাল্টা মারের সংগ্রাম. নারীর নিজ সত্বা কে রক্ষা করার স্বার্থে আজ সুজেট জর্ডানের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে তাঁদের লড়তে হবে পুরুষতন্ত্র ও ধর্ষণতন্ত্রের বিরুদ্ধে.

মৃত্যুতে সুজেট জর্ডানের শরীরের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে কিন্তু যে যুদ্ধ তিনি শুরু করেছিলেন তা আজ আরো বেশি করে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে, আর ধর্ষণকারী সমাজের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছে. তাই সুজেট  জর্ডান হয়তো পুরুষতন্ত্রের ঘৃণা উপচে পড়ছে কিন্তু শোষিত নির্যাতিত নারীর কাছে তিনি এক সংগ্রামী প্রতীক হয়ে থাকবেন. 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে