যুদ্ধ ও উগ্র দেশপ্রেমের জিগির তুলে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ভোটের বাজার দখলের লড়াই কে পরাস্ত করুন

সোমবার, ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


ভাঙচুর চলছে, দেশপ্রেমের ভাঙচুর। সেই পুরানো চাল ভাতে বাড়ছে শাসকশ্রেণী আর গোগ্রাসে তা চেটেপুটে খাচ্ছে আমাদের দেশপ্রেমের নেশায় আচ্ছন্ন সাবর্ণ শহুরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত লোকেরা। যুদ্ধ চাই, ভীষণ যুদ্ধ চাই তাদের, আর যুদ্ধের তর সইছে না, অবিলম্বে যুদ্ধ চাই। পাকিস্তানের লাশ দেখে তবেই এবার নাস্তা পানি খাবেন কর্তারা, তাই ফেসবুক, টুইটার সহ নানা সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। 

পুলওয়ামা হামলা হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধের জিগির একদম ছাদ ভেদ করে আকাশে পৌঁছে যেতে চায়। তাই চিৎকার — যুদ্ধ চাই, যুদ্ধ চাই। যুদ্ধ না হলে তো আর হিসেব নিকেশ হবে না, নিরামিষাশী মোদী ভক্তদের রাতের পনীর মশালা হজম হবে না, সকালে পরিষ্কার মলত্যাগ হবে না। তাই যুদ্ধ চাই, রক্তে স্নাত মাটি দেখেই আজ চোখ জুড়াবে ভক্তকুলের। 

তাই সেই ভারত যখন চীন আক্রমণ করে ১৯৬২ সালে তখন যেমন চিনা বাদাম ওয়ালা কে গড়ের মাঠে ফেলে পেটাতো কংগ্রেস দলের গুন্ডারা বা মহিলাদের লাল ব্লাউজের উপর ব্লেড চালাতো, বা কমিউনিস্টদের বন্দী করে জেলে রেখে অত্যাচার করতো, তেমনি আজ কাশ্মীরি মানুষ, যাদের জমি কে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে দাবি করে দেশপ্রেমিকদের দল, তাদের দেখতে পেয়েই রে রে করে তেড়ে মারতে যাচ্ছে গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা দেশপ্রেমিক বাছুরের দল, স্লোগান তাদের “জ্যায় সিরি রাম” আর হাতে তাদের ধারালো অস্ত্র। 

খুঁজে খুঁজে আক্রমণ করা হচ্ছে কাশ্মীরি ছাত্র-ছাত্রীদের, ব্যবসায়ীদের, এমনকি প্রসিদ্ধ ডাক্তারদের। হুমকি দেওয়া হচ্ছে, ধরে পেটানো হচ্ছে, দেরাদুন, জম্মু প্রভৃতি জায়গায় কাশ্মীরি মানুষদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আর লাগানো হচ্ছে দেশদ্রোহীর তকমা। এই আক্রান্ত মানুষদের, যারা ওই মৃত জওয়ানদের মতন যুদ্ধ করতে গিয়ে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হননি, বরং নিজের জীবনযাপনের তাগিদে, লেখাপড়া শেখার তাগিদে, চাকরী করার তাগিদে নিজ ভিটে মাটি ছেড়ে ভারতের নানা কোনায় পড়ে আছেন হৃদয়ের এক কোণে একটুকরো কাশ্মীর কে লালন করে, তাদের রক্ষা করতে যে বা যারা এগিয়ে এসেছেন তারাও আক্রান্ত হয়েছেন বিবেচনাহীন, ফ্যাসিবাদের গরল পান করা উগ্র দেশপ্রেমিক নামক সংঘ পরিবারের সন্ত্রাসীদের  হাতে। 

যে বা যারা করেছে যুদ্ধের বিরোধিতা তারা আজ দেশদ্রোহী, যে বা যারা ভারত রাষ্ট্রের কাশ্মীরের উপর সামরিক দখলদারি’র বিরোধিতা করছে তারা দেশদ্রোহী, যারা আজ সাধারণ মানুষের উপর দেশপ্রেমের লেবেল আঁটা হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের বিরোধিতা করছে তারা আজ দেশদ্রোহী হিসেবে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের পোষ্য বাহিনীর কাছে চিহ্নিত হচ্ছে। আর এই বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ যে ভাল আছে তা কিন্তু মোটেই নয়। 

যুদ্ধের বিরুদ্ধে, সেনা নিয়ে নির্লজ্জের মতন রাজনীতি করার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিরুদ্ধে মুখ খোলায় পশ্চিমবঙ্গেও হাজারে হাজারে গেরুয়া বাহিনীর জওয়ান’রা আক্রমণ করছে মুক্ত চিন্তার মানুষদের, বামপন্থীদের এবং অন্যান্য সকলকেই যারা রক্ত চাই, রক্ত চাই বলে চিৎকার করছে না। আক্রান্তদের বাঁচাতে গড়ে উঠছে না কোন বিপ্লবী ফ্যাসিবিরোধী ব্যারিকেড, আর তাই এই একের পর এক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আক্রমণে জর্জরিত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল চেতনার মানুষ।

বনগাঁ থেকে হাওড়া, কলকাতা থেকে সুদূর রানীগঞ্জ সর্বত্রই হিন্দুত্ববাদী শক্তি নিজের পেশীর জোর দেখিয়ে ভোটের আগে বাজার গরম করতে নেমেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও বা আশ্বাস দিয়েছেন যে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করবে তাঁর সরকার কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা যে ফাঁকা বুলি সবাই জানে। তৃণমূলের পৃষ্টপোষকতা ছাড়া বিজেপি ও আরএসএসের এই রাজ্যের বুকে এই ভাবে বুক বাজিয়ে মানুষের বাড়িতে শয়ে শয়ে গুন্ডা নিয়ে গিয়ে আক্রমণ করা সম্ভব হতো না। 

সামনে লোকসভা নির্বাচন আর এই সময়ে এই রকম ভাবে উগ্র দেশপ্রেমের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অন্যায়গুলো কে চাপা দিয়ে দেওয়ার সুযোগ কি আর কেউ খোয়াতে চাইবে, যখন সেই অন্যায় নীতির ফলে দেশের অর্থনীতি গত পাঁচ বছরে এমন গড্ডালিকায় গিয়ে ঢুকেছে যে তার বেরিয়ে আসা দুস্কর? 

তাই ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম নিধন যজ্ঞ শুরু করার আগে নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে লক্ষ লক্ষ ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীদের সাহায্যে গোধারা রেল স্টেশনে আগুনে পুড়ে মৃত ৫৬ জন আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীদের মৃতদেহ দাহ না করতে দিয়ে আহমেদাবাদে নিয়ে এসে সারা শহর প্রদীক্ষণ করিয়ে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে নিজের রাজনৈতিক অভীষ্ট অর্জন করেছিলেন, ঠিক সেই ভাবেই  ছকটা আবার তৈরী করা হচ্ছে। 

প্রতিটি মৃত জওয়ানের পরিবারের সম্মতি ছাড়াই বিজেপি তাঁদের মৃতদেহ নিয়ে বিশাল বিশাল মিছিলের আয়োজন করেছে। না, তাঁদের শ্রদ্ধা জানাতে নয়, বরং এই সুযোগে মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষের বীজ কে চারায় রূপান্তরিত করতে, কাশ্মীরের মাটিতে ভারতের শাসকশ্রেণীর দ্বারা নিষ্ঠুর ভাবে জনগণ কে অত্যাচার ও শোষণ করার কাজে সমর্থন আদায়ের স্বার্থে, আগামী নির্বাচনে মোদী ও বিজেপি কে আতঙ্কের থেকে ভোট দেওয়ানোর স্বার্থে এই মিছিলগুলি’র আয়োজন করা হয়েছে। এই মিছিলগুলি সিআরপিএফের নিহতদের শেষ যাত্রার মিছিলের জায়গায় গণতন্ত্রের অবশিষ্টের অন্তর্জলি যাত্রা হিসেবে বেশি কুখ্যাতি অর্জন করেছে। 

যত বেশি করে লাশ নিয়ে মিছিল বিজেপি ও আরএসএস করছে, তত বেশি করে দেশের প্রান্তে প্রান্তে কাশ্মীরি মানুষদের উপর বেছে বেছে হামলা করা হচ্ছে। জম্মু ও কাশ্মীরে মুসলিম মানুষদের বেছে বেছে হামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তেরঙা ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল করে, পাকিস্তান কে গাল পেড়ে আসলে দেশজুড়ে মুসলিম বিদ্বেষের আগুনে হাওয়া দিয়ে নির্বাচনের আগে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চাইছে বিজেপি ও মোদী সরকার। সারা দেশের সংখ্যাগুরু হিন্দু সমাজের মধ্যে তীব্র ভাবে কাশ্মীরি মানুষদের ব্যাপারে ও মুসলিম জনতার ব্যাপারে যে ভীতি গেড়ে বসে আছে তার আঁচে হাওয়া দিয়ে নিজের নির্বাচনী স্বার্থসিদ্ধি করে নেওয়াই এখন রাফ্যাল থেকে নীরব মোদী কাণ্ডে জর্জরিত বিজেপি’র অভিলাষ। এই অভিলাষ চরিতার্থ করতে বিজেপি ও আরএসএস কিন্তু যে কোন সীমা ছাড়িয়ে নোংরামো করতে পারে আর তা বুঝতে হলে আপনাকে রাজনীতি নিয়ে পিএইচডি করতে হবে না। 

প্যাটার্নটা কিন্তু সেই একই। জায়গায় জায়গায় কাশ্মীরি মানুষদের উপর আক্রমণের প্যাটার্নটা এক, আক্রমণের সমর্থনে সিআরপিএফের জওয়ানদের মৃত্যুর যুক্তি ব্যবহার করে অপরাধটাকে ঢাকার চেষ্টা চলছে। সেই ২০০২ সালে যেমন মোদী নিউটনের তৃতীয় নিয়ম উল্লেখ করে বলেছিলেন যে গুজরাটে মুসলিম নিধন যজ্ঞ আসলে গোধারা কাণ্ডের “রিয়্যাকশন” মাত্র, তেমনি আজ সাম্প্রদায়িক হিংসা কে, গণতন্ত্র-বিরোধী হিংসা কে জনগণের রোষ বলে চালানোর চেষ্টা করছে বিজেপি ও আরএসএস। 

দেশের সব বড়-ছোট সংবাদ মাধ্যমের মুখে কাপড় গুঁজে তাদের কোন ধরণের সরকারের সমালোচনা করতে দেওয়া হচ্ছে না। মোদী’র পদলেহী সব সংবাদ মাধ্যম যুদ্ধং দেহি মনোভাব নিয়ে এমন এক আলোচনা চালাচ্ছে যার সব দিকেই যুদ্ধ কে, হিংসা কে কাশ্মীরের মতন একটি জটিল সমস্যার সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। সংখ্যালঘু মানুষরা, বিজেপি বিরোধীরা আর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ-বিরোধীরা যে কেউ এই আক্রমণের শিকার হতে পারেন।

আর এই হট্টগোলে কেউ একবারও জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছে না যে পুলওয়ামায় সিআরপিএফের জওয়ানদের উপর আক্রমণ কাদের ব্যর্থতায় হলো? কে এর দ্বায়িত্ব স্বীকার করছেন? কে পদত্যাগ করলেন? কেন মোদী সরকারের কাশ্মীর নীতি কাশ্মীর কে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিল?   

দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে কাশ্মীরের সমস্যা কে নিজ রণনৈতিক কারণে জিইয়ে রেখেছে ভারতের শাসকশ্রেণী। স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরের মানুষের সাথে গণভোট নিয়ে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে প্রতারণা করার পরেই কিন্তু বিদেশী শক্তির অনুপ্রেরণায় ১৯৮৯ সাল থেকে জঙ্গী আন্দোলন গড়ে ওঠে কাশ্মীর উপত্যকায় যার জের আজ পর্যন্ত চলছে। 

চরম সামরিক আগ্রাসন ও দৈনিক অকথ্য অত্যাচার, গুমখুন, ধর্ষণ ও ব্যাপক হারে ভারত রাষ্ট্রের দ্বারা নিরীহ স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদের নরসংহার হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার দাবির থেকে, নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির থেকে এক চুলও নড়েননি। প্রতি গ্রীষ্মে বরফ গললে তারা কিন্তু পথে নেমে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সেনা বাহিনীর সাথে হাতে পাথর নিয়ে যুদ্ধ করেন, গুলি বা ছররা খেয়েও তারা গলা ফাটিয়ে ভারতের থেকে স্বাধীনতা চান।

হায়না যেমন লাশের ঘ্রাণ পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে ওঠে, আমাদের পেট ভরে খেতে পাওয়া, মোটা অর্থ আয় করা, সাবর্ণ উচ্চবিত্ত ও শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তথাকথিত দেশপ্রেমের ধ্বজ্জাধারীরা ঠিক তেমনি কাশ্মীরের মাটিতে সেনা বা আধা বা সিকি সেনার গুলিতে প্রাণ হারানো কাশ্মীরি মানুষের লাশ দেখে সেই রকমই উল্লাস প্রকাশ করে। কাশ্মীরের শিশুর চোখ লক্ষ্য করে ভারত রাষ্ট্র ছররা ছুড়লে তারা হুইস্কির গ্লাসে তুফান তুলে সেই ঘটনা কে স্বাগত জানায়। তারা ক্ষেপে যায় শুধু কাশ্মীরের মানুষ কে পাল্টা প্রতিরোধ করতে দেখলে। তারা রেগে যায় জনগণ কে পাথর ছুড়তে দেখলে। কারণ তখন তাদের জাতীয়তাবাদী অনুভূতিতে সুড়সুড়ি লাগে। 

কাশ্মীরের মাটিতে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার ৩০ বছরে প্রায় ১০০,০০০ মানুষ খুন হয়েছেন, যাদের সিংহভাগ’ই কিন্তু সাধারণ মানুষ। অনেক ভুয়ো এনকাউন্টার, কাস্টডিয়াল ডেথ, গুম খুন করে লাশ গোপন স্থানে কবর দিয়ে দেওয়া, নারীদের সামরিক বাহিনীর দ্বারা গণধর্ষণ করানো, ইত্যাদি, অকথ্য অত্যাচার দীর্ঘদিন ধরে বিরামহীন ভাবে চলছে। তবুও এই রাষ্ট্রীয় হিংসা, রক্তপাত ও নারীর উপর অত্যাচার হিন্দুত্ববাদের গরল পান করা তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের উদ্বেলিত করে না। 

তারা প্রশ্ন করেননা ভারতের জনতার রক্ত ঘামের টাকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে আদায় করে নিজের রাজত্ব চালানো সরকার কে — যে কেন কাশ্মীরে এত রক্তপাত? কেন গণতান্ত্রিক ভাবে, আলোচনা করে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না খুঁজে শুধুই বন্দুকের নলের থেকে সমাধান বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার? কেন সরকার কাশ্মীরি মানুষদের মানুষ না ভেবে শুধুই বন্দুকের টিপ প্র্যাকটিস করার উপকরণ হিসেবে গণ্য করছে? 

তারা উদ্বেলিত হয় না কারণ তাদের দেশপ্রেম তাদের মতনই ঠুনকো। তাদের দেশপ্রেম অমর শহীদ ভগত সিং, রাজগুরু, সুখদেব, মাস্টারদা সূর্য সেন, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম, ইত্যাদির দেশপ্রেমের মতন সাচ্চা না, বরং হেগড়েওয়ার, গোলওয়ালকার, সাভারকার বা শ্যামা মুখুজ্জ্যে’র মতন নকল দেশপ্রেম, সাম্রাজ্যবাদের জুতো চাটার বহিঃ আবেশ, যাতে তাদের আসল ঘৃণ্য চেহারাটা প্রকাশিত না হয়। 

এরা দেশ বলতে বোঝে এক টুকরো মাটিকে, পাথরকে, পাহাড় আর নদীকে, এরা দেশ বলতে বোঝে দেশের জমি ও সম্পদ কে। দেশের ব্যাখ্যায় এদের অভিধানে মানুষের কোন স্থান নেই। তাই মানুষ কে মেরে ফেলা চলবে তবে জমি এদের চাইই চাই। যখন বিদেশী কর্পোরেশনগুলি ভারতের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যায়, ভারতের মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা যখন জনগণের করের টাকা চুরি করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করে, দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশী পুঁজির গোলামী করে, তখন এদের দেশপ্রেম ঘুমিয়ে থাকে লেপ মুড়ি দিয়ে। 

যখন কোন বেহায়া হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রাক্তন মহারানী ভিক্টোরিয়া’র জন্মদিন পালন করে তাঁকে দেশের রক্ষাকারী বলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কে স্বাগত জানায়, তখন এরাই নির্লজ্জের মতন তাঁকে সাবাস বলে পিঠ চাপড়ায়। অনাহারক্লিষ্ট আদিবাসীরা যখন না খেতে পেয়ে মরে যায় তখন এরা ফাস্টফুড খেতে ব্যস্ত থাকে, যখন রাইফেলের জোরে, রকেট লঞ্চারের জোরে ছত্তিশগড় বা ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের সরকার তাঁদের গ্রাম, জঙ্গল বা জমির থেকে উচ্ছেদ করতে চায়, তখন “উন্নয়নের” ডঙ্কা বাজিয়ে এই অকাল কুষ্মান্ডের দল তা সমর্থন করে। এর ফলেই নির্লজ্জ ভাবে বুক বাজিয়ে কাশ্মীরের জনগণের ওপর চলমান অত্যাচার ও শোষণ কে এরা দুই হাত তুলে সমর্থন করতে পারে আর জনগণের পাল্টা প্রতিরোধ কে, তাদের পাল্টা সংগ্রাম কে ভীষণ ভাবে ঘৃণা করতে পারে, কারণ মানুষ এদের শত্রু আর বৃহৎ পুঁজির ছুড়ে দেওয়া হাড় এদের খাদ্য।

তাই আধা সেনা হত্যার বিরোধিতা করার নাম করে যারা আরো বেশি বেশি করে হিংসা চালাতে চাইছে, যারা সরকার কে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন না করে ঝুটা দেশপ্রেমের জিগির তুলে সরকার বিরোধীদের, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী বিরোধীদের উপর একেবারে পরিকল্পনা করে হামলা করতে শুরু করেছে, তারা কিন্তু আজ দেশের জনগণের, খেটে খাওয়া মানুষের বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছে। 

সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে আরএসএস’র পুষ্যি বাহিনী বিরোধীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করছে, সিআরপিএফের মৃত জওয়ানদের রেফারেন্স টেনে এনে বাম ও গণতান্ত্রিক বিরোধীদের হিটলারের কায়দায় হত্যা করার ষড়যন্ত্র কে উন্মোচন করছে। তার কারণ হলো এই বিরোধীরা মোদী সরকারের অপদার্থতা কে তুলে ধরে কঠিন প্রশ্ন তুলছেন, খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্য-রোজগার-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সামাজিক সুরক্ষার দাবি তুলে সরকারকে তুলোধুনো করছেন, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের কথা তুলে উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারের ঝড় কে রুখে দিচ্ছেন। তাই বিরোধীদের দমন করা আজ বিজেপি-আরএসএস ও তাদের পেয়াদাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সামনে কঠিন সময়। উগ্র জাতীয়তাবাদ, যুদ্ধের জিগির আর সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে বিজেপি আগামী নির্বাচনে বিজয় অর্জন করতে চাইবে। তারা চাইবে সমস্ত বিরোধীদের নিস্তব্ধ করে দিয়ে দেশের জনগণের শ্রম, দেশের খনিজ সম্পদ, মাটি, জঙ্গল ও জল বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের দালাল দেশী মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিতে। মোদী চাইবে সাম্প্রদায়িক ভাবে বিভক্ত দেশের জনগণের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে নিজের সিন্দুকে ধনের পাহাড় জড়ো করতে। দেশের মানুষ খেতে চাইলে, রোজগার চাইলেই তাদের পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ দেখানো হবে, দেশপ্রেমের নাম করে রাষ্ট্র প্রেম শেখানো হবে। আর এই সোজা হিসাবটা যদি কেউ জনগণের সামনে তুলে ধরতে চান তাহলেই তাকে “দেশদ্রোহী” তকমা পেয়ে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে হবে। 

কাশ্মীরি জনগণের উপর চলতে থাকা আক্রমণ কে রুখতে, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মানুষের উপর হতে থাকা আক্রমণ কে রুখতে, দেশের নানা প্রান্তে যুদ্ধ উন্মাদনা  সৃষ্টি করার বিরুদ্ধে লড়াকু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের উপর চলমান রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও হিন্দুত্ববাদী আক্রমণ কে রুখতে আজ পথ নিতে হবে সক্রিয় প্রতিরোধের আর তা করতে গেলে প্রথমেই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে রাজনৈতিক ভাবে জাগ্রত করে তাদের নেতৃত্বে উত্তীর্ণ করতে হবে এই প্রতিরোধ সংগ্রামের। 

খাদ্যের দাবি, কর্ম সংস্থানের দাবি, কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্যের দাবি, শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন ₹১৮,০০০ করার দাবি, শিক্ষা খাতে জিডিপি’র ১০% বরাদ্দ করার দাবি, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে ঢেলে সাজিয়ে জনগণ কে বিনামূল্যে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা দেওয়ার দাবি, দলিত-আদিবাসী-মুসলিম-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের সমান অধিকার ও বৈষম্যহীন সুযোগের দাবি তুলে আজ জনগণ কে তাদের শত্রু মোদী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টেনে আনতেই হবে। একমাত্র শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই পারবে মানুষের জীবন কে যুদ্ধের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে ও ভারতবর্ষের মাটিতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে কবর দিতে। তাই বিলম্ব না করেই বাস্তবের মাটিতে এই লড়াইয়ে মানুষের শত্রু কে পরাস্ত করতে এগিয়ে আসুন, জনতার সাথে একাত্ম হোন আর প্রতিরোধের  রাজনীতি দিয়ে তাদের সৃজনীশক্তি’র বিকাশ ঘটান। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে