রাজস্থানে হিন্দুত্ববাদীর দ্বারা বাঙালি মুসলিম শ্রমিকের নৃশংস হত্যার জবাব কি হবে?

রবিবার, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭ 0 Comments A+ a-


যে বাতাসে বিগত ২৫ বছর ধরে ভেঙে পড়া বাবরি মসজিদের সুড়কির ধুলো ভেসে বেড়াচ্ছে সেই বাতাসে দীর্ঘ দিন ধরে লালিত পালিত হয়ে ওঠা যুব সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশই যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ নিয়ে চলবে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই ছিল না, কারণ এই বিষাক্ত চিন্তাধারার মানুষ সৃষ্টি করার কর্তব্য বর্তেছিল আরএসএস ও তার বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী গণসংগঠনের উপর, যার মধ্যে প্রধান হলো বিজেপি। সেই বিষাক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের মধ্যে অনেকের শিরায় উপশিরায় এখনও ঘৃণার গরলের স্রোত বয়ে চলেছে এবং সেই স্রোত কে চাঙ্গা করার জন্যে মোদী সরকারের বদন্যতায় আজ আরএসএস, বিজেপি সহ সকল হিন্দুত্ববাদী শক্তি তীব্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টার ফলেই দেখা গেল রাজস্থানের রাজসামান্দে শম্ভুলাল রাগীর নামক এক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট দুষ্কৃতী তাঁর ১৫ বছর বয়স্ক ভাগ্নের সাহায্যে কি রকম নির্মম ভাবে আফরাজুল শেখ নামক এক বাঙালি শ্রমজীবিকে হত্যা করেছে। শুধু হত্যাই নয় সমস্ত ঘটনার ভিডিও রেকর্ডিং করিয়ে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমত বুক ফুলিয়ে প্রচারও করেছে শম্ভুলাল ও তার হিন্দুত্ববাদী সাগরেদরা। আফরাজুলের আকুতি বিনতি কে অগ্রাহ্য করে তাঁকে কি নির্মম ভাবেই না গাঁইতি দিয়ে আঘাত করে করে মাটিতে ফেলে তারপরে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, তা আজ ভারতবর্ষের অসংখ্য মানুষ ইন্টারনেটের সাহায্যে দেখেছেন। আর তাঁরা দেখেছেন শম্ভুলাল কে ক্যামেরার সামনে এসে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ কে ধমক দিতে, “লাভ জেহাদের” মতন আরএসএস-সৃষ্ট ঘৃণার রাজনীতির ফর্মুলা কে ব্যবহার করে নিজের ঘৃণ্য অপরাধ কে এবং নিজ হীনমনস্কতা কে মহান করে দেখাবার প্রচেষ্টাও চোখে পড়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ বছর পরে, মোদী-অমিত শাহের হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের শাসনকালে এর চেয়ে ভালো আর কি দেখতে চাইবেন?


শম্ভুলাল রাগীর আফরাজুল শেখ কে কেন হত্যা করলো? কি এমন তাঁর রাগ ছিল আফরাজুলের মতন এক দিন-আনি-দিন-খাই শ্রমজীবি মানুষের সাথে যে তাঁকে এত নৃশংস ভাবে হত্যা করা দরকার হয়ে পড়লো? শম্ভুলাল রাগীর এর অভিযোগ অনুসারে আফরাজুল শেখ নাকি একজন লাভ জেহাদি, যে নাকি মহিলাদের সাথে বিয়ে করে তাঁদের মুসলিম বানাবার ষড়যন্ত্র চালায়। এই অভিযোগের সপক্ষে যেমন শম্ভুলাল রাগীর কোন প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করেনি, ঠিক তেমনিই, বেশ জোর গলায় এই অভিযোগ কে মিথ্যা বলে খন্ডন করেছেন আফরাজুলের পরিবার। রাজস্থানে আফরাজুল শেখের সঙ্গে থাকা তাঁর জামাইয়ের ভাষায় - বিড়ি খাওয়া ছাড়া তাঁর আর কোন দোষ ছিল না এবং দ্বিতীয় বিয়ে তিনি কোনদিনই করেননি। শম্ভুলাল রাগীর বা ওর আরএসএস এবং বজরং দলের নেতৃত্ব অবশ্য সংবাদ কে অগ্রাহ্য করেন এবং তাঁরা বেশি ভরসা করেন বিজেপির দ্বারা পেটোয়া সংবাদ মাধ্যম কে ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যার বেসাতির উপর। আর যদি কেউ কোন মেয়েকে বা ছেলে কে ভালোবেসে বিয়ে করেন, এবং সেই মেয়ে বা ছেলে নিজ ইচ্ছায় নিজের ধর্ম পরিবর্তন করেন, তার জন্যে শম্ভুলালের মতন লোকেদের মানুষ মারার অধিকার কোন আইন দিয়েছে তার জবাব দেওয়ার দায়ও হিন্দুত্ববাদী শিবির নিজ ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলেছে।


মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে বারবার করে এই ঘৃণ্য অপরাধের কারণ হিসেবে শম্ভুলালের বক্তব্যের থেকে “লাভ জেহাদ” কে তুলে ধরছে। “লাভ জেহাদ” এর তত্ব আবিষ্কার করেছিল উত্তর প্রদেশের মসনদে আসীন যোগী আদিত্যনাথ, যখন সে শুধুমাত্র গোরক্ষনাথ মঠের প্রধান পুরোহিত হওয়ার সৌজন্যে বিজেপির টিকিটে সাংসদ ছিল এবং হিন্দু যুব বাহিনী নামক একটি জঙ্গী সংগঠন কে পরিচালনা করতো। সেই হিন্দু যুব বাহিনী সমগ্র পূর্ব উত্তরপ্রদেশে ২০০৭ সাল থেকেই বজরং দলের সাথে হাত মিলিয়ে ভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক কে ভাঙতে জঙ্গী আক্রমণ শুরু করেছিল এবং সেই আক্রমণ কে জনতার সামনে রাজনৈতিক ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলার জন্যে যোগী আদিত্যনাথ লাভ জেহাদ তত্বের আমদানি করে। এই লাভ জেহাদের ফর্মুলাটা মস্তিস্ক প্রসূত করার মতন মস্তিষ্কের অধিকারী যোগী আদিত্যনাথ নয় বলেই তাঁকে নাৎসি জার্মানির থেকে ইহুদি বিদ্বেষের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি বিশেষ ধরণের প্রোপাগান্ডা কে ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে নকল করতে হয়। নাৎসিদের প্রচারে জোর দেওয়া হয় যে ইহুদিরা জার্মানির বুকে, তথা সমগ্র ইউরোপের বুকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠার জন্যে আর্য ইউরোপীয় মেয়েদের ফুসলিয়ে বিয়ে করে ধর্মান্তিকরন করছে। এই কুযুক্তির পক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ যেমন সেদিন নাৎসি পার্টি বা হিটলার দিতে পারেনি তেমনি এই গুজবমূলক প্রচারের পক্ষে আজ অবধি কোন বাস্তব-ভিত্তিক প্রমাণ যোগী আদিত্যনাথ এবং তাঁর দল দিতে পারেনি। কিন্তু প্রমাণ দিলে তো আর গল্পের গরু গাছে উঠবে না আর এখানে তো সংঘ পরিবারের পবিত্র গরু মাতাকে গাছে তুলে মই নিয়ে পালাতে হবে, তাই সংঘ পরিবারের দাঙ্গাবাজেদের প্রথমে মগজে না ঢুকলেও যোগী আদিত্যনাথ কিন্তু লাভ জেহাদ নিয়ে প্রচার তুঙ্গে তোলেন। ২০১৩ সালে এই লাভ জেহাদ ও "হিন্দু মেয়েদের উপর মুসলিমদের ঘৃণ্য নজরের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে দুই ভাইয়ের প্রাণ গিয়েছে" এই অজুহাত তুলে যখন আরএসএস ও বজরং দল মুজফ্ফরনগরে মুসলিম নিধন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত করে এবং ২০১৪ সালে সেই দাঙ্গার মুনাফা হিসেবে সমস্ত উত্তরপ্রদেশে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে বিজেপি, ঠিক তখনই লাভ জেহাদ ও যোগী আদিত্যনাথের কদর বোঝে আরএসএস ও বিজেপি এবং এর ফলেই আজ নরেন্দ্র মোদীর উত্তরসূরী হিসেবে যোগী আদিত্যনাথ উঠে এসেছে।


সেই লাভ জেহাদ কে যখন তখন ব্যবহার করে যে কোন ভিন্ন ধর্মের যুগলের প্রেমের সম্পর্ককে ভেঙে দিতে বা সেই যুগল কে নৃশংস ভাবে হত্যা করতে আরএসএস ও বজরং দলের কর্মী ও নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, টাকা যেহেতু আদানি আর আম্বানি এবং তাঁদের মালিক - বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির-মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলোর থেকে আসে সেহেতু এই ধরণের আক্রমণের কোন শেষ নেই এবং সারা দেশজুড়ে আরএসএস ও বজরং দল বুক বাজিয়ে, রাষ্ট্র যন্ত্রের আশীর্বাদধন্য হয়ে লাভ জেহাদের উপর মিথ্যার বেসাতি নিয়ে ব্যবসা করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ইজরায়েল ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অর্থে এবং রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে বলীয়ান হয়ে দাঙ্গার বীজ রোপনকারী হিন্দু সংহতিও সেই একই প্রচার কে তুঙ্গে তুলে প্রেমের বিরুদ্ধে, ভিন্ন ধর্মালম্বী যুগলদের বিরুদ্ধে আক্রমণ নামিয়ে আনছে। এর সাথে আবার যুক্ত রয়েছে গো-রক্ষার নামে মুসলিমদের হত্যা করার কর্মসূচী, ফলে এই কর্মসূচীগুলি সফলতার সাথে পূর্ণ করে আরএসএস ও বজরং দলের শীর্ষ পদগুলোয় উন্নত হয়ে মোটা টাকা কামানোর এবং সুযোগ বুঝে বিজেপির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে আরও অর্থ আয় করার লোভে প্রচুর সংখ্যক উচ্চ জাতির কর্মহীন ও লুম্পেন শ্রেণীর হিন্দু যুবকেরা গো-বলয়ের রাজ্যগুলিতে নানা ধরণের ফ্যাসিস্ট হিংসার ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে এবং যেহেতু এই ঘটনাগুলি একের পর এক জায়গায় সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের পক্ষে সুচারু ভাবে কাজ করছে তাই বিজেপি সরকার দুই হাত তুলে এই ঘটনাগুলোকে সমর্থন করছে এবং দোষীদের নানা কায়দা করে, আইন কে ভেঙে আর মুড়িয়ে, জেল থেকে বা পুলিশের কবল থেকে বের করে আনছে। সার্বিক ভাবে দেখতে গেলে যেহেতু পুলিশ-মিলিটারি-আইন আদালত ও আমলাতন্ত্রের সর্ববৃহৎ অংশটি হলো হিন্দুত্ববাদী-ফ্যাসিবাদে বিশ্বাসী তাই বিজেপি সরকার কেস হালকা নাও যদি করে, রাষ্ট্র নিজের মালিকের শ্রেণীস্বার্থ পূর্ণ করতে এই দাঙ্গাবাজ ও খুনি-সন্ত্রাসী হিন্দুত্ববাদীদের কোনদিন শাস্তি দেবে না।


রাজস্থানে এই বছরে, বিগত নয় মাসে চারটি লিঞ্চ কিলিং এর ঘটনা হয়েছে এবং শুধু মাত্র ৬ই ডিসেম্বরেই তিন জন মুসলমানের উপর রাম মন্দিরের দাবি নিয়ে ফ্যাসাদ পাকানো আরএসএস এর কর্মীরা আক্রমণ করেছিল। এরই মধ্যে আফরাজুলের শেখ কে নৃশংস ভাবে হত্যা করে তার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়া ও হোয়াটস্যাপ দ্বারা প্রচার শুরু করে হিন্দুত্বের বীর পুঙ্গব শম্ভুলাল রাগীর। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পরে সারা দেশে এবং প্রচারিত হতে থাকে বার বার, যাতে সবাই দেখে বিজয়ী হিন্দুত্ব কি করে মুসলিমদের কুপিয়ে শেষ করতে চায়, হিংস্র নেকড়ের পালের চেয়ে বেশি পাশবিক হয়ে কি ভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চায় সংখ্যালঘু ও দলিত জাতির মানুষ কে। এই ভিডিও দেখে যেমন প্রতিবাদ ও নিন্দায় ফেটে পড়েছেন দেশের একটা বড় অংশের মানুষ, ঠিক তেমনি করেই ভারতে ও ভারতের বাইরে বসবাসকারি সংখ্যালঘু উঁচু জাতের হিন্দু ধনী ও মধ্যবিত্তের একটা অংশ বিনা সঙ্কোচে তাঁদের উল্লাস প্রকাশ করেছে এই ভিডিও দেখে। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেও আরএসএস এর শাখায় খাকি নেংটি পরিহিত, সবে হিন্দি বলা শিখে বাংলা ভুলে যাওয়া কিছু সাবর্ণ ভদ্রলোকেরাও “ছোটলোক” মুসলিমদের, যাদের তারা “কাটা” বা “কাটোয়া” বলে ডাকতে অভ্যস্ত, এহেন ভাবে মরতে দেখে নিজেদের উল্লাস গোপন রাখতে পারেনি। আরএসএস এর টাকায় চালানো ইন্টারনেটে গিয়ে বারবার বুক বাজিয়ে ঘোষণা করেছে যে এবার সব মুসলিমদের সাথে এই ব্যবহারই করতে হবে।


কি আছে শম্ভুলাল রাগীরের ভিডিওতে, যে ভিডিও রেকর্ড করতে সে নিজের ১৫ বছরের ভাগ্নে কে সাথে করে নিয়ে গেছিল মুসলিম নিধনের মতন পবিত্র কর্তব্যে সামিল হতে? মালদার কালিয়াচকের থেকে রাজস্থানে গিয়ে ২০ বছর ধরে দিন মজুরের কাজ করা আফরাজুল শেখ কে একটা কাজের টোপ দিয়ে শুনশান, জঙ্গলের মতন জায়গায় নিয়ে আসে শম্ভুলাল রাগীর। তারপরে কাজের জায়গা দেখাবে বলে আফরাজুল কে একটু এগিয়ে যেতে বলেই পিছন থেকে গাঁইতি দিয়ে আঘাত করা শুরু করে শম্ভুলাল রাগীর। হতচকিত হয়ে আহত আফরাজুল চিৎকার করে জানতে চায় যে সে কি দোষ করেছে যে তাঁকে সম্পূর্ণ অচেনা শম্ভুলাল মারছে? কাকুতি মিনতি করতে শুরু করে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠা বাঙালি আফরাজুল, কারণ রাজস্থান তাঁর দেশ না, সেখানে আফরাজুলের পক্ষে কেউ দাঁড়াবার নেই, মালদায় আছে স্ত্রী ও তিন কন্যা, যার মধ্যে এক ষোড়শী এখনো ইস্কুলে পড়ে। তাই ভূমিপুত্রের রুদ্র মূর্তি দেখে প্রতিরোধ না করে হাত জোর করে মালদার টানে, মাগ্গে, মাগ্গে বলে চেঁচায় আফরাজুল। “ও বাবু মেরো না গো”। “ও বাবু বাঁচাও” - বলে আকুতি করতে থাকে আফরাজুল। এক মুহূর্তের জন্যে ক্ষতবিক্ষত আফরাজুল চেপে ধরে ঘাতকের গাঁইতি, সে ভাবে হয়তো কোন ভুলের জন্যে, কোন দোষের জন্যে সে শুধু মার খাচ্ছে, কারণ তাঁর ঘাতক তখনো নিশ্চুপ। এর পরেই শম্ভুলাল রাগীর কেড়ে নিতে চায় গাঁইতি কিন্তু পেরে ওঠে না আর তাই সজোরে লাথি মারতে মারতে বলে ওঠে আফরাজুলকে যে গাঁইতি ছাড়তে, ও আফরাজুলকে মারবে না। সেই আশ্বাসে গাঁইতি ছেড়ে দেয় আফরাজুল শেখ আর তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তাঁকে গাঁইতি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে শম্ভুলাল রাগীর নামক হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী। তখনো বোধহয় দেহে প্রাণ ছিল আফরাজুলের তাই ঝটিতে গিয়ে একটা দা এনে মাথায় কোপ মারে আরএসএস এর সৃষ্ট ভারত মাতার বীর সন্তান সাজা, ভারতীয় সংষ্কৃতির ধ্বজ্জাধারী ভেড়ুয়া ভন্ডটা। ভিন রাজ্যের মাটিতে আফরাজুল তখন প্রায় ৯০ শতাংশ প্রাণহীন। একটা গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আর লাভ জেহাদিদের কি পরিণাম হবে বলতে বলতে সেই গোঙাতে থাকা প্রায় মৃত আফরাজুলের শরীরে এক বোতল জ্বালানি তেল ঢালে শম্ভুলাল, তারপর আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ভাষণ চলতে থাকে জেহাদিদের বিরুদ্ধে; পুরানো সিনেমার ফ্লপ নায়কের মতন পোশাক পরিহিত খুনিটার ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল বোধহয় পাকিস্তান যাচ্ছে যুদ্ধ করতে। পরে সে ভুল ভাঙ্গে, মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ অবধি হয় তেমনি হিন্দুত্ববাদীদের দৌড় ওই মন্দির অবধি আর “মন্দির ওয়াঁহী বানায়েঙ্গে” গোছের পাঁয়তারা মারার মধ্যেই সীমিত থাকে চিরকাল।


বাংলার মাটির থেকে রুজির টানে সুদূর রাজস্থানের মেওয়ার অঞ্চলে গিয়ে শ্রম বিক্রি করে খাওয়া আফরাজুল শেখের তখন গোঙানি আর শোনা যাচ্ছে না, বরং আগুনের ফাটফাট শব্দে যখন তাঁর চামড়া জ্বলছে তখন হয়তো চিরতরে শ্রমজীবন থেকে অবসর নিলেন খেটে খাওয়া তিন মেয়ের বাপ। দেশদ্রোহী মুসলমান তো তাই বীর পুঙ্গব রাজপুত আর মেওয়ারিদের মতন শিশু কন্যা কে দুধে ডুবিয়ে বা নুন খাইয়ে মারতে পারেননি। মারতে পারলে, বৌ কে সতী বলে জীবন্ত জ্বালালে বা খেটে না খেয়ে শম্ভুলালের মতন বেকার হয়ে বসে থেকে আরএসএস এর টাকায় দিনযাপন করলে হয়তো আফরাজুল কে মরতে হতো না। আর মরতে হতো না যদি আফরাজুল শেখ শম্ভুলালের মতন ভয়ানক বদমায়েশের কাছে কাকুতি-মিনতি না করে লড়াই করতে পারতেন। যদি গাঁইতি কেড়ে পাল্টা আক্রমণ করতে পারতেন। তাহলে কাহিনী পাল্টে যেত, হয়তো বা মুসলিমদের আবার সন্ত্রাসী বলে জঘন্য শেয়াল কান্না কাঁদতো নরেন্দ্র মোদী ও তার পঙ্গপালের দল, কিন্তু তবুও একটি নিরীহ মানুষের জীবন বেঁচে যেত। শম্ভুলাল রাগীর আবার খুব চালাকি করে এমন একজন মুসলিমকে খুঁজে বের করেছে যে রাজসামান্দ এলাকায় বহিরাগত। সেই এলাকার ৯৭ শতাংশ হিন্দুদের অত্যাচারে চিরকাল মাথা নিচু করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকেন চরম দরিদ্র মুসলিম জনগণ। এর মধ্যে আবার বহিরাগত হলে তো আর কথাই নেই, যে কোন কারণেই বহিরাগতদের ধরে পেটানোর লাইসেন্স রাজস্থানের সরকার স্থানীয় উঁচু জাতের হিন্দুদের দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে বাঙালি মুসলিমদের অবস্থাটা আরও শোচনীয় কারণ তাঁদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে। দিল্লী, হরিয়ানা, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে কথায় কথায় বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং তাঁদের উপর সন্ত্রাসবাদের, জাল নোট পাচারের এবং চোরাচালানের মিথ্যা কেস দিয়ে তাঁদের জেল বন্দি করে এবং তাঁদের সকল ধরণের সচিত্র পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলে। ফলে গরিব মানুষগুলির, যাঁদের অশিক্ষার ফলে এটুকুও জানা নেই যে আইডি কার্ডের নাম্বার কোথায় থাকে, তাঁদের নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই ভয়টা আফরাজুলের মধ্যেও ছিল এবং তিনি তাই সাতে-পাঁচে থাকতে পছন্দ করতেন না।


তবে যেহেতু তিনি মুসলিম, তায় আবার বহিরাগত বাঙালি মুসলিম; শ্রেণীগত ভাবে সবে ছোট ছোট প্রকল্পে শ্রমিক সরবাহ করে দরিদ্র থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যায়ে ওঠা শুরু করেছিলেন, তাই শিকার হিসেবে তাঁকেই চিহ্নিত করে শম্ভুলাল রাগীর। সাথে সাথে গড়ে তোলে একটি কাহিনী, তার পাড়ার একটি মেয়ের মালদায় কোন মুসলিম বাঙালির সাথে পালিয়ে যাওয়ার গল্প, যাতে লাভ জেহাদের যে গল্প তাকে আরএসএস আর বজরং দলের নেতারা শিখিয়ে দিয়েছে তা সে ক্যামেরার সামনে আওড়াতে পারে ঠিক করে। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টরা কখনোই কোন শক্তিশালী, লড়াকু এবং টক্করের মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে না কারণ সেটা করতে গেলে লড়াই করার হিম্মত দরকার হয় আর সফট টার্গেট বা নরম নিশানার লাভ হলো যে এই লোকেরা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন না তাঁদের শারীরিক বলের অভাবে বা ঘটনার আকস্মিকতায় চকিত হয়ে যাওয়ার ফলে। যে মুহূর্তে আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদীদের এহেন নরম নিশানার শিকারেরা ভীত হয়ে ওঠে ঠিক তখনই আক্রমণকারীদের মনে বল ফিরে আসে।  যে হীনমন্যতার থেকে আক্রমণ সানায় এই হিন্দুত্ববাদীরা, যাঁদের জীবনের ঘৃণার প্রাথমিক হাতেখড়ি নিজেদের বাড়ির থেকেই হয়,যে মুসলিম বিদ্বেষের শিক্ষা এরা নিজের বাপ-ঠাকুর্দার কাছে পায়, সেই হীনমন্যতা কে পরিপুষ্ট করে এক একটি সফল অপারেশন করে, এক একটি মহম্মদ আখলাক, পেহলু খান, জুনেদ বা আফরাজুল শেখের মতন নিরীহ মুসলিমেরা, যাঁরা তাঁদের নিজ জীবনে কোনদিন রুখে দাঁড়াতে শেখেননি, বরং যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা ব্রাক্ষণত্ববাদী-সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সামনে মাথা নত করে থেকে তাঁরা মাথা উঁচু করা ভুলে গেছেন এবং হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের সাথে কোন লড়াই করার সাহস দেখাতে পারেন না, সেই রকম মানুষদের খুন করে। এই সামন্ততান্ত্রিক গোলামীর মানসিকতার ফলেই এই উপমহাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। আফরাজুল শেখ পাল্টা লড়াই করতে পারেননি কারণ তিনি ঝামেলা চাননি এবং চেয়েছিলেন শুধু বাঁচতে। সেই সুযোগ কোনদিন মাগনায় শম্ভুলাল রাগীর দিত না।


কি কারণে শম্ভুলাল রাগীর আফরাজুল শেখ কে হত্যা করে? সেটা বুঝতে গেলে আমাদের দেখতে হবে যে শম্ভুলাল রাগীর আসলে কে? আসলে শম্ভুলাল রাগীর একজন স্বল্পশিক্ষিত মানুষ যার বাস রাজসামন্দের রাগীর কলোনিতে। খানায় খন্দে ভরা, মশা ও মাছির উপদ্রবে কাহিল নিম্নবিত্ত এই কলোনিতে জাতিগত ভাবে পিছিয়ে থাকা রাগীরদের বাস এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এই অঞ্চলের বাতাসে মিশে আছে। বিগত তিন দশকের উপর এই অঞ্চলে আরএসএস তার শাখা চালায় এবং সেই শাখায় শম্ভুলাল রাগীরের মতন স্বল্প শিক্ষিত নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেদের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের ট্রেনিং দেওয়া হয়। ছোট বয়স থেকেই বাচ্ছাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষাক্ত চিন্তা ঢোকানো হয়, হিন্দুত্বের এক মনগড়া, সোনালী ইতিহাসের গল্প শুনিয়ে মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার বীজ শিশু মননে প্রোথিত করানো হয় যাতে ভবিষ্যতে সেই বীজ ফুটে এক বিষবৃক্ষের জন্ম হয় যা আরএসএস কে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।


শম্ভুলাল রাগীর এমন এক পরিবেশে বড় হওয়া মানুষ, যার তিন কন্যা সন্তান আছে এবং যার মধ্যে একটি মানসিক ভারসাম্যহীন। বেশ কয়েক বছর ধরে বজরং দল ও আরএসএস এর সাথে শম্ভুলাল রাগীরের ঘনিষ্টতা বাড়ে, এবং নরেন্দ্র মোদীর হিংসাত্মক রাজনীতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শম্ভুলাল রাগীর বেশি বেশি করে হিন্দুত্ববাদী প্রচারের কাজ করা শুরু করে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে শম্ভুলাল রাগীরের ধুঁকতে থাকা মার্বেলের ব্যবসা নোটবন্দির ফলে বন্ধ হয়ে গেলেও নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপির প্রতি আস্থা আরও বেড়ে যায় শম্ভুলাল রাগীরের। স্থানীয় ভাবে আরএসএস ও বিজেপির থেকে প্রচুর টাকা আয় করে রাগীর এবং বজরং দলের লাভ জেহাদ নিয়ে প্রচারের কাজেও শম্ভুলাল রাগীর কে পাওয়া যায়। এই ঘটনার থেকে আঁচ করা যায় যে স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরাই শম্ভুলাল রাগীর কে কোন দুর্বল ও সাধারণ মুসলিম কে খুঁজে খুন করে ভিডিও বানাতে বলে। যেহেতু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারিগর থেকে ২০০২ সালের গুজরাটের নরমেধ যজ্ঞের হোতারা আজও বহাল তবিয়তে ঘুরছে, রাজনৈতিক সাফল্যের মগডালে বসে আছে, যেহেতু মোহাম্মদ আখলাক থেকে পেহলু খান বা জুনেদের আততায়ীরা আজও বাইরে কলার তুলে ঘুরছে, তাই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের আদর্শে পরিচালিত ভারতের আইনের কোন ভয় শম্ভুলাল রাগীরের ছিল না। সেই জন্যে অবলীলায় আফরাজুল শেখ কে হত্যা করে মন্দিরে গিয়ে ভাষণ দিয়ে সে একেবারে ছকে বাঁধা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিজেকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। শাস্তি নিয়ে সে চিন্তিত ছিল না দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, আশ্বাস অনেক উপর থেকেই এসেছিল বোধহয়, বলা হয়েছিল যে রাষ্ট্র যন্ত্র যখন হিন্দুত্ববাদী শক্তির কুক্ষিগত তখন আর শম্ভুলাল কে মারে কে?


রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার সকল ধরনের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের মদত দিয়ে এসেছে। এই রাজ্যেই পদ্মাবতী সিনেমার বিরুদ্ধে রাজপুত সম্প্রদায়ের জোতদার জমিদারদের দাঙ্গা করতে দেওয়া হয়েছে, এই রাজ্যের ইস্কুলের ইতিহাসে রানা প্রতাপ কে হলদিঘাটির যুদ্ধে বিজয়ী হিসেবে দেখানো হয়েছে, ইস্কুলের শিশু-কিশোরদের হিন্দুত্ববাদী মেলায় নিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেখানে বজরং দলের ভাড়াটে গুন্ডারা কচি বয়সের ছেলে মেয়েদের লাভ জেহাদ নিয়ে বুঝিয়েছে, মুসলিম সম্প্রদায় কে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে আর মানুষের চেয়ে বেশি গরুকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। সেই গরু কে, যে গরু কে মানুষখেঁকো গরুতে পরিণত করেছে নরেন্দ্র মোদী’র বিজেপি সরকার। এহেন রাজস্থানের মাটিতে যদি কেউ হিন্দুত্ববাদী ঝাণ্ডা তুলে কোন অপরাধ করেন, মানুষ কে হত্যা করেন, নারীকে ধর্ষণ করেন, তাহলে শুধুই যে সেই অপরাধীদের সাত খুন মাফ হবে তাই নয়, বরং সেই লোকেদের মাথায় তুলে নেচে বিজেপি ভোট বাক্সে বা ইভিএম যন্ত্রে হিন্দুত্ব মেরুকরণের ফায়দা লুটবে। এই হলো রাজস্থান, যে রাজ্যের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের অর্থের যোগান দেয় মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ, ইজরায়েল এর খুনি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ আর বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন বৃহৎ কর্পোরেশনগুলো এবং তাদের ভারতীয় মুৎসুদ্দি দালালরা। এই অর্থেই ভরণপোষণ করা হয় শম্ভুলাল রাগীরের মতন ঘৃণ্য কীটদের, যারা ভারতের শাসক শ্রেণীর স্বার্থে দেশের প্রান্তে প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হিংসার মাধ্যমে জনগণের মধ্যেকার ঐক্য কে ভেঙে দিচ্ছে, যাতে মোদী সরকারের জন-বিরোধী চক্রান্তগুলোর বিরুদ্ধে, নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা ভারতবর্ষ কে বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর কাছে, ওদের ভারতীয় দালাল আদানি ও আম্বানিদের কাছে টুকরো টুকরো করে বিক্রি করা সম্ভব হয় এবং জনগণ প্রতিরোধের পথে এগোতে না পারেন। আর এই হত্যালীলা কে বন্ধ করার, এই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পের থেকে দেশ ও দেশের খেটে খাওয়া মানুষ কে মুক্ত করার সংগ্রাম আজও গড়ে উঠতে পারছে না, কারণ যাঁরা আজ জনগণের নেতা সেজে বসেছেন তাঁরা আজও জনগণ কে রাষ্ট্রীয় নিয়মতান্ত্রিকতার শেকলে বেঁধে রাখছেন। তাঁরা মানুষ কে সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে শুধুই কথার মারপ্যাঁচ কষে মানুষের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে ওঠা রাষ্ট্র যন্ত্রের প্রতি মানুষ কে ফের আস্থাবান করার চেষ্টা করছে। আর বিরোধী শক্তির এই বেইমানির ফলে, এই ধরণের ভোঁতা আন্দোলনের ফলে আজ রাজস্থানের পুলিশ ও রাষ্ট্র যন্ত্র শম্ভুলাল রাগীর কে মানসিক ভারসাম্যহীন হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে যাতে সে তাড়াতাড়ি জেল থেকে ছাড়া পায় এবং আবার ফিরে যায় আরএসএস এর সংগঠনে।


এই হিংসা, এই নৃশংস নরসংহার, এই ঘৃণ্য রাজনীতি ও সায়েদপুরের গ্রামে আফরাজুলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে যে ভাবে তাঁর স্ত্রী ও মেয়েরা কেঁদে কেঁদে আকুল হচ্ছে তা দেখে, মাড়োয়ারি ও গুজরাটিদের থেকে চাঁদা নিয়ে পার্টি চালানো তৃণমূল-সিপিএম বা জাতীয় কংগ্রেসের মতন দলগুলি যে ভাবে রাজস্থানী ও গুজরাটি বেনিয়াদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে তা দেখে প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি বেশি করে বিশ্বাস হচ্ছে যে ভারতের আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পূর্ণ রূপে, এবং সরকারি রূপে শুধু যে হিন্দুত্ব-করণ হয়েছে তাই নয়, বরং বর্তমান ভারতের মোদী সরকার তার প্রতিপত্তি দিয়ে এমন এক ব্যবস্থা সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে যে ব্যবস্থায় দেশের ৯০ শতাংশ ব্যবসা বাণিজ্য ও পুঁজির মালিক, বিশেষ করে বাংলার সিংহ ভাগ শিল্প ও বাণিজ্যের মালিক, মাড়োয়ারি ও গুজরাটি বেনিয়াদের দেশের মালিকের আসনে সরকারি ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে এবং তাঁদের পছন্দের ভাষা হিন্দি কে, তাঁদের নিরামিষাশী বৈষ্ণব খাদ্য অভ্যাস এবং তাঁদের সংস্কৃতি কে সমগ্র ভারতবর্ষের সমস্ত জাতি ও জনগণের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে।  যাঁরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন, গর্জে উঠবেন, যাঁরা এই সিদ্ধান্ত কে মানবেন না, রক্তচোষা মাড়োয়ারি ও গুজরাটি বেনিয়াদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন, তাঁদের কে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে ভারতের ভাঁড়দের দল আরএসএস খুন করাবে। এই মাড়োয়ারি-গুজরাটি বেনিয়া চক্রের ষড়যন্ত্রে সমস্ত জাতির মানুষের উপর উত্তর ভারতীয়, হিন্দি ভাষী, নিরামিষাশী, সাবর্ণ হিন্দু ধনিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র স্থাপিত হবে। এই একনায়কতন্ত্র কে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা সেই নেহরু আমল থেকে চলে আসছে আর বর্তমানে মোদী সরকার সারা দেশজুড়ে হিন্দুত্বের ঘৃণ্য রাজনীতি দিয়ে হিন্দু জাতির মানুষের মেরুকরণে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ায়, শম্ভুলাল রাগীরের মতন লক্ষ লক্ষ খুনি কে লালন-পালন করে তৈরি করায় সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যে আজ আর ১৯৬০’এর দশকের মতন কঠিন হবে না তা বলাই বাহুল্য। হীনমন্যতায় ভোগা সাবর্ণ বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে স্বচ্ছল ও অনেক আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ আজ জোরালো গলায় হিন্দুত্ববাদ কে সমর্থন করছে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বাস করে। তাঁরা আজ রাজস্থানের বজরং দলের গুন্ডা শম্ভুলাল রাগীরের হাতে বাঙালি আফরাজুলের মৃত্যু কে হিন্দু ধর্মযোদ্ধার হাতে দেশদ্রোহী এবং অধর্মী মুসলমানের মৃত্যু হিসেবে দেখছে এবং তাই এরা আজ নির্লজ্জের মতন আরএসএস এর এই খুনি বদমায়েশটাকে বাহবা দিচ্ছে। তপন ঘোষের মতন জঘন্য কীটগুলো পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মধ্যে সুপ্ত সাম্প্রদায়িক ঘৃণা কে কিভাবে বিষ দিয়ে ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়েছে তা আফরাজুলের মৃত্যুর পরে পশ্চিমবঙ্গে বাস করা বাংলা-ভাষী থেকে হিন্দি-ভাষী হতে চলা বরাহ-নন্দ’দের হাত তালি দেওয়া দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।


অনেকে প্রশ্ন তুলছেন এই ভয়াবহ হিংসার ছবি দেখে, শম্ভুলাল রাগীরের মতন এক হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদীর আস্ফালন দেখে, যে এর শেষ কোথায়? অনেকে চিন্তিত এই ভেবে যে এবার হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি সারা ভারত জুড়ে হয়তো ব্যাপক হারে মুসলিম নিধন শুরু করবে, ঠিক যেমন বর্মার বৌদ্ধ ফ্যাসিবাদী শক্তি রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ঠিক যেমন সার্বিয়ার বুকে, বা ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনের বুকে হাজার হাজার মুসলিম জনগণ কে রোজ বোমা ও গুলিতে মরতে হয়েছে বা হচ্ছে। ঠিক যেমন প্যালেস্টাইনের মাটিতে স্বাধীনতার জন্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়া আরব মুসলিম ও খ্রিস্টানদের কে জায়নবাদী ইজরায়েলি শক্তি গণহত্যা করে নিকেশ করেছে হয়তো সেই ভাবেই ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রধান, শ্বেত ফ্যাসিবাদের বর্তমান বিশ্বগুরু ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাহায্যে কাশ্মীরের মাটিতে বৃহৎ আকারে গণ হত্যা চালাবে। হয়তো বা উত্তর প্রদেশ আর গুজরাটে বৃহৎ নরসংহারের মাধ্যমে জ্বালিয়ে মারবে কোটি কোটি মুসলিমদের। এই চিন্তা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষকে, সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত জনজাতির মানুষকে আজ ভাবিয়ে তুলছে, উদ্বেল করে তুলছে। সবার প্রশ্নের মূল বিষয় হলো যে এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে গেলে মানুষের কি করা উচিত ? কি ভাবে এই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ও নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের জীবন, জীবিকা ও জীবনযাপনের অধিকার কে রক্ষা করা যায়? কি ভাবে জন্ম ও ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের উপর যে আক্রমণ নেমে আসছে, যে ঘৃণার ও বঞ্চনার তাঁরা স্বীকার হচ্ছেন তাকে রোখা যায় কি করে? বিজেপি যদি একটি রাজ্যে বা কেন্দ্রে ভোটে হেরে যায় তাহলে কি শম্ভুলাল রাগীরের মতন শয়তানরা হেরে যাবে? তাহলে কি দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসা, বিদ্বেষ ও দ্বন্ধ চিরকালের মতন শেষ হয়ে যাবে? মোদী সরকারের পতন হলেই কি মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ থেকে শুরু করে আদিবাসী ও দলিত জনগণ সাবর্ণ হিন্দু সমাজের সাথে সমানতার ভিত্তিতে বাঁচার অধিকার পাবে? ভারত কি ২০১৯ এর নির্বাচনে মোদী কে হারিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা কে ভোট দেবে? রাষ্ট্র যন্ত্রের সকল কলকব্জা কি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে প্রাণপাত করে? আর শেষ অবধি কি বাবরি মসজিদ থেকে শুরু করে গুজরাটের মুসলিমদের গণহত্যা’র ঘটনার চেয়ে ব্যতিক্রম হয়ে শম্ভুলাল রাগীরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে ভারতীয় আইনে?


দুঃখের কথা হলো যে শেষের সকল প্রশ্নের উত্তরই হলো - না। ভারতবর্ষ কোন কালেই সংবিধান প্রদত্ত আদর্শে চলে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমাজতন্ত্রের কোন মডেল গড়ে তোলার চেষ্টা করেনি, বরং একটি ঝুটো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কে আদর্শ ব্যবস্থা বলে জনগণ কে ৭০ বছর ধরে শুধু বোকা বানিয়েছে। কংগ্রেস থেকে বিজেপি, সিপিএম থেকে তৃণমূল, ভারতের শাসকশ্রেণী আম্বানি-আদানি-টাটা-বিড়লা-গোয়েঙ্কা প্রভৃতির মতন মুৎসুদ্দি দালাল পুঁজিপতিদের তল্পিবাহক। এরা নিঃশর্ত ভাবে সেবা করে ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের, তাদের মালিক - বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলোর, এবং এই দুইয়ের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শক্তিশালী হয়ে গেঁড়ে বসে থাকা আধা সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক জোতদার ও জমিদারদের। এই বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা আর জোতদার জমিদারেরা বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্বার্থ রক্ষার জন্যে ভারত কে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রের নেতৃত্বে সেই ১৯৫০ এর দশক থেকে আনার চেষ্টা করছে এবং এই কেন্দ্রীয় শাসন গড়ে তোলার জন্যে এদের দরকার হলো এক নেতা, এক ধর্ম ও এক ভাষা। যদিও বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদী আজ ওদের এই কাজে সবচেয়ে নির্লজ্জ্ব ভাবে এবং সবচেয়ে ভালো ভাবে সেবা করছে, ১৯৪৭ সাল থেকে কিন্তু কংগ্রেস সরকার সেই একই কাজ গোপনে ও প্রকাশ্যে করে এসেছে। আজ যে তৃণমূল ও সিপিএম এর মতন দল নিজেদের বিজেপির বিকল্প বলছে, তারা কোন ভাবেই হিন্দুত্ব শিবিরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কোন প্রগতিশীল বিকল্প নয়, বরং প্রতিক্রিয়াশীলতায় তারা বিজেপিরই বিকল্প। ভারতের মানুষের কাছে আসল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বিকল্প রাজনীতি কে, যে রাজনীতি গরিব খেটে খাওয়া মানুষ কে দেবে বেঁচে থাকার অধিকার, কাজের অধিকার ও রোজগারের সুরক্ষা,যে রাজনীতি কৃষককে দেবে জমি, গরিব কে দেবে খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, সেই রাজনীতি কে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে একমাত্র তীব্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, গরিব মানুষের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে।


ভারতবর্ষের নানা ভাষা ও নানা সংস্কৃতির জনগণ কে যদি একটা জিনিস ঐতিহাসিক ভাবে এক করতে পেরেছিল তবে তা ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা যা ঔপনিবেশিক শাসনকালে জনগণের বৃহত্তম অংশ কে টেনে এনেছিল বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে। সেই মহান ঐক্য কে ধ্বংস করার স্বার্থে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভা কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন দুর্বল ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের সুযোগ তুলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে, বাংলা কে ভাগ করে এবং খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যে ঘুণ ধরানো শুরু করে, যার রেশ ধরে আজও নরেন্দ্র মোদী ভারতে শাসন করছে এবং পাকিস্তান ও  বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বর্তমানে যখন নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির স্রোতে গা ভাসানো শাসক শ্রেণীর পিট্টু মোদী সরকার বার বার নানা কায়দায় জনগণ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দেশ ও দেশের সম্পদ কে বেচে দিচ্ছে বৃহৎ বিদেশী পুঁজির কাছে। এই বিদেশী পুঁজির কাছে ভারতবর্ষ কে বন্ধক রেখে দেওয়ার মানে হলো যে দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ব্যাপক লুঠপাট ও সরকারি আমলাতন্ত্রের ব্যাপক হারে পকেটের ওজন বৃদ্ধি হওয়া। এই টাকা কামানোর সাথে সাথে ভারতের সরকার ও সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলি লক্ষ্য রাখে যে ভারতের জনগণ যেন এই লুঠপাটের বিরুদ্ধে মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারেন আর তাই তাঁদের কে বিভক্ত রাখতে, একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে এদের কোন জুটি নেই। এই সকল দলগুলির মধ্যে একমাত্র বিজেপিই বর্তমানে শাসক শ্রেণীর লুঠপাটের স্বার্থে সবচেয়ে ভালো ভাবে জনগণ কে ধর্মীয় মৌলবাদের মাধ্যমে উস্কানি দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম এবং সেই দাঙ্গার সাহায্যে বিপুল ভাবে জনগণ কে মেরুকরণের মাধ্যমে নিজের কুক্ষিগত করতে ওস্তাদ। আর এই বিজেপি কে শাসক শ্রেণীর বানানো ভোট যন্ত্রেই যাঁরা হারাতে চাইছে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। ভোট বাক্স দিয়ে যদিও বা কোথাও বিজেপিকে হারানোও যায়, তবুও শম্ভুলাল রাগীরদের হাত থেকে আফরাজুল শেখের মতন গরিব মুসলিমদের বাঁচানো যাবে না।


ভারতের জনগণের উপর জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের আসল উৎস হলো গ্রামাঞ্চলে বিরাজমান আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদনের উপকরণের উপর মালিকানার ধরণ। ভারতবর্ষের ৭৫ শতাংশ কৃষকই হয় দরিদ্র ও না হয় ভূমিহীন কৃষক যাঁদের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কাটে অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে। দিন আনি দিন খাই এই লোকেদের উপর শাসন করে গ্রামাঞ্চলের ৫ শতাংশ জোতদার-জমিদার ও অন্যান্য ফোঁড়েরা। ধর্মীয় মৌলবাদের মূল কেন্দ্র কিন্তু ভারতের গ্রামাঞ্চলেই এবং এই গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে পরিযায়ী হয়ে যাওয়া মানুষেরাই এই ধর্মীয়  মৌলবাদের বীজ কে সেখানে রোপন করেন এবং কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট ভারতের মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সাথে এই ধর্মীয় মৌলবাদের মেলবন্ধন ঘটান। সামন্ততন্ত্রের থেকে উৎপত্তি হওয়া ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদের নিকেশ করা যায় তাই একমাত্র ভারতের বুক থেকে সামন্ততন্ত্রকে চিরকালের মতন ঝেঁটিয়ে সাফ করে এবং ভারতের অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লড়াই কে পূর্ণ করে। এই লড়াই ভোটের বাক্সে নয় বরং লড়া হবে ক্ষেতে-খামারে, কল কারখানায়, পথে ঘাটে এবং সমস্ত জায়গায় যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি কে দেখা যাবে। এই লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য হবে গ্রামাঞ্চলে সামন্ততন্ত্র কে উচ্ছেদ করে সেই জায়গায় এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কে প্রতিষ্ঠিত করা। আর সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কে প্রতিষ্ঠা করেই জনগণ কিন্তু ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী শক্তির, নরেন্দ্র মোদীর, আরএসএস ও বিজেপির শাসনের অবসান ঘটাতে পারবে, দেশের থেকে শম্ভুলাল রাগীরের মতন ভয়ানক ভাবে বিকৃত ফ্যাসিস্টদের অস্তিত্ব কে মুছে দিয়ে মানুষকে দিতে পারবে ঐক্য, শান্তি ও প্রগতির পরিবেশ। যে পরিবেশে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-শিখ-জৈন-পার্সি-বৌদ্ধ সকলকেই দেওয়া যেতে পারে সুস্থ ভাবে এবং সুরক্ষিত ভাবে জীবন যাপনের সুযোগ। আর এই আগামীকালের সম্ভাবনা কিন্তু সুপ্ত রয়েছে আমাদের নিজেদের মধ্যেই, ব্যাস একটু চেষ্টা করলেই, একটু কঠিন পরিশ্রম করলেই এবং নিজের লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর থাকলেই কোন শক্তি মানুষ কে ভারতবর্ষের মাটিতে প্রগতির মশাল জ্বালানোর থেকে বিরত করতে পারবে না। একমাত্র কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ফ্যাসিবাদ কে চিরকালের মতন এই দেশের মাটিতে কবর দেওয়া সম্ভব, একমাত্র কঠোর বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই সম্ভব এমন এক ভবিষ্যতের নির্মাণ করা যেখানে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হবে না, গুজরাটের মতন নরমেধ যজ্ঞ হবে না, যে দেশে আফরাজুলের মতন নিরীহ মানুষ কে গাঁইতির কোপ খেয়ে ও আগুনে জ্বলে কোন শম্ভুলাল রাগীরের হাতে মরতে হবে না, যে দেশে ক্ষুধার্থ শিশু কে রেশন কার্ড আর আধার কার্ডের সংযুক্তিকরণের অভাবের কারণে না খেয়ে যাতনায় ভাত-ভাত করে কেঁদে মরতে হবে না, যে দেশে কোন দানা মাঝিকে নিজের স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে করে বহন করে নিয়ে যেতে হবে না, আর যে দেশে সত্যি কথা লেখার দোষে কোন গৌরী লঙ্কেশ কে আততায়ী গুলি করে মারবে না।

সেই সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্যে আকাশ থেকে কেউ পড়বেন না, ফেরেস্তা বা দেবদূত নামবেন না, কোন মহানায়কের জন্মও হবে না। এই মহান, ঐতিহাসিক ও জরুরী কর্তব্য আজ কাঁধে তুলে নিতে হবে আমার-আপনার মতন সকল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষদের। কারণ শ্রম দিয়ে যাঁরা পৃথিবীটি কে উন্নত এক গ্রহে পরিণত করেছেন, একমাত্র তাঁরাই পারবেন তীব্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীর থেকে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ কে, ধর্মীয় মৌলবাদ কে, মানুষের উপর মানুষের শোষণ ও অত্যাচার কে চিরকালের মতন শেষ করতে। তবে এই শেষ করার শেষ লড়াই কে তীব্রতর করতে, গণতন্ত্রের পক্ষে আমাদের স্লোগান কে তীক্ষ করে তুলতে আমরা যত দেরী করবো তত বেশি আফরাজুলের প্রাণ নরেন্দ্র মোদীর ভক্তদের হাতে যাবে, তত বেশি করে ভোটবাজ দালালেরা জনগণ কে ভোটের কানা গলিতে ঢুকিয়ে তাঁদের গণতন্ত্র’র থেকে, শ্রেণী সংগ্রামের থেকে দূরে ঠেলে রাখতে সক্ষম হবে। তাই বর্তমানের সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো এক মুহূর্তও নষ্ট না করে বৃহৎ সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্যে লড়াইয়ের ময়দানে তাৎক্ষণিক যোগদান। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ও সংগ্রামই আগামীদিনে এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের শাসনাধীন ভারতবর্ষ কে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, সকল জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সকল ধর্মের মানুষ কে সুরক্ষিত ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান করা এক নয়া গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে রূপান্তরিত করতে পারবো আর আফরাজুল শেখের মতন খেটে খাওয়া মানুষদের শম্ভুলাল রাগীরের মতন ফ্যাসিবাদী গুন্ডাদের থেকে রক্ষা করতে পারবো, মানবতা কে রক্ষা করতে পারবো।  

চীনা কমিউনিস্ট পার্টি'র শি জিনপিং চিন্তাধারার তত্ব মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে ঢেকে দিতে পারবে না

শনিবার, অক্টোবর ২৮, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

চীনের সঙ্কট: মাও বনাম শি


বর্তমান চীনের সাথে কমিউনিস্টদের সম্পর্কটা বর্তমানের শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্তের সাথে ঘোড়ার সম্পর্কের মতন, পাহাড়ে বা সমুদ্র সৈকতে ছুটি কাটাতে গেলে কেউ কেউ কখনো চড়ে ফেলেন, কেউ না চড়ে দেখেন আর কেউ দেখেও দেখেন না। সেই চেয়ারম্যান মাও জেদং ও নেই আর সেই বিপ্লবের গান’ও নেই, শুধু চীনে পড়ে আছে একটা ফিকে হয়ে যাওয়া লাল আস্তরণ যা দেখিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব একটি পার্টি কংগ্রেস করেন এবং সেই কংগ্রেসে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের গাঁজাখুরি তত্ব কে গালভারী নাম দিয়ে পার্টির পথনির্দেশক তাত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সেই তত্বের জয়গান করে আকাশ পাতাল ভরিয়ে দেয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক তথা দেশের রাষ্ট্রপতির মোসাহেবের দল। আবার দুই বার পর পর সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরেই বিদায় নিতে হয় একজন  নেতা কে আর তাঁর স্থানে অভিষেক হয় কোন নতুন নেতার। বর্তমান চীনের কমিউনিস্ট নামধারী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিং পাঁচ বছর অতিক্রমণ করে ফেললেন এবং সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশতম জাতীয় কংগ্রেসে তাঁর রাজনৈতিক লাইন, যার গালভারী নাম হলো - নয়া যুগের চীনা বৈশিষ্ট সম্পন্ন সমাজতন্ত্রের উপর শি জিনপিং এর চিন্তাধারা, পার্টির পথনির্দেশক তাত্বিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হলো। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পূর্ণ পথনির্দেশক তাত্বিক ভিত্তি হলো - মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাও জেদং চিন্তাধারা, দেঙ জিয়াওপিং তত্ব, তিন প্রতিনিধিত্বের তত্ব (জিয়াং জেমিন), বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন তত্ব (হু জিনতাও), নয়া যুগের চীনা বৈশিষ্ট সম্পন্ন সমাজতন্ত্রের উপর শি জিনপিং এর চিন্তাধারা। এর মধ্যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হিসেবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হলো বিশ্বের চলমান দ্বন্ধ কে বোঝার বৈজ্ঞানিক উপায় এবং মাও জেদং চিন্তাধারা হলো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম প্রজন্মের নেতৃত্বের, যাঁর মধ্যমণি ছিলেন মাও জেদং, যৌথ প্রয়াস দ্বারা সৃষ্ট চীনের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বাস্তব প্রয়োগ। ফলে দেখতে গেলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি’র নেতৃত্ব মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও জেদং এর  চিন্তাধারার ধারালো তলোয়ার ফেলে তার জায়গায় নকল রাংতার তলোয়ার বানিয়ে হাতে ধরে বসে আছে এবং সেই অস্ত্রকেও আবার ব্যবহার করতে ভয় পাচ্ছে, যদি বা রাংতার আঘাতেই শত্রুর শরীরে ঘা লেগে যায়। যেমন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশতম জাতীয় কংগ্রেসের প্রস্তাবে এই বছরে কার্ল মার্কসের পুঁজি প্রকাশের ১৫০ বছরের কথা বলা থাকলেও কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার কথা খুব সন্তর্পণে আড়াল করা হলো, সে বাদ যাওয়া নিছক বাদ যাওয়া নয় বরং বেশ হিসেবে কষেই বাদ দেওয়ার ঘটনা, কারণ নভেম্বর বিপ্লব কে বাদ দিয়ে দিলে তো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তাত্বিক ভিত্তির লেনিনবাদের উৎসটা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে, প্রশ্ন ওঠে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র কে নিয়ে এবং সমাজতন্ত্র কে নিয়েও।  

এই চীনা বৈশিষ্ট সম্পন্ন সমাজতন্ত্র, যাকে বাজার সমাজতন্ত্র বা আদতে সমাজতন্ত্রের মোড়কে উদ্দাম পুঁজিবাদী নগ্ন শোষণ শাসনের ব্যবস্থা বলা যায়, তা হলো মাও জেদং বেঁচে থাকার সময় থেকেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বার বার করে পরিস্ফুটিত হতে থাকা একটি লাইন যার বিরুদ্ধে মাও জেদং কে নিজেকে বহুবার লড়তে হয়েছে এবং দমন করতে হয়েছে এই ঘৃণ্য পুঁজিবাদী দর্শনের পথিকদের, যাদের অন্যতম ছিল লিউ শাওকি এবং তাঁর দোসর দেঙ জিয়াওপিং। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের কাছে বর্তমানে ভীষণ প্রিয় এই বাজার সমাজতন্ত্রের লাইন আসলে মেকি কমিউনিস্ট পার্টির ভন্ড শোধনবাদী নেতাদের দেয় চীনের শ্রমজীবি মানুষের রক্ত ঘামে সৃষ্ট সম্পদ কে জলের দরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবির কে বিক্রি করার অবাধ অধিকার এবং সাথে সাথে এক দলীয় শাসনের মাধ্যমে, জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের নামে, শ্রমিক ও কৃষকদের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে পদদলিত করে রাখার জন্যে সীমাহীন সামরিক ক্ষমতা। মাও জেদং এর মৃত্যুর পরেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরের শোধনবাদীদের দ্বারা চীনের রঙ পাল্টানোর কাজ তীব্র গতিতে শুরু হয় এবং আজ থেকে ৩৫ বছর আগে, ১৯৮২ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাদশ জাতীয় কংগ্রেসে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ মোটামুটি সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে যেহেতু চীনের মাটিতে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ অবধি মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের তীব্র আগুন জ্বলে উঠেছিল এবং বিরাট বিরাট সংগ্রাম করে চীনা শ্রমিক-কৃষক ও সৈনিকরা পুঁজিবাদী পথগামীদের ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র কে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মতন চীনের মাটি থেকে দ্রুত গতিতে লাল ঝান্ডা ফেলে দেওয়ার ও মাও জেদং এর বিরুদ্ধে, মাও জেদং এর চিন্তাধারার বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধে নামার হিম্মত চীনা সংশোধনবাদী নেতৃত্বের হয়নি। এদের তাই কাজ করতে হয়েছে মাও জেদং কে মাথায় তুলেই, মাও কে মহান বলে তারপরেই এরা মাও এর পথের ও তাঁর চিন্তাধারার তীব্র বিরোধিতা করেছে। ১৯৬৯ সালেই মাও জেদং এর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম জাতীয় কংগ্রেসে মাও জেদং এর উত্তরাধিকারী হিসেবে উঠে আসা লিন বিয়াও বলেছিলেন যে - যে কোন শক্তি যদি চীনের মাটিতে দাঁড়িয়ে মাও জেদং এর চিন্তাধারার বিরোধিতা করে বা তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তাহলে সমগ্র চীনের জনগণ তার নিন্দা করবে এবং তাকে দন্ডিত করবে। এই দণ্ডিত হওয়ার আতঙ্কে জরাগ্রস্ত হয়ে চলা চীনা সংশোধনবাদীদের পান্ডা দেঙ জিয়াওপিং নিজে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় ১৯৮৯ সালে সমগ্র চীন জুড়ে শুরু হওয়া সংশোধনবাদ-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেখে। সেই আন্দোলন কে পরবর্তী কালে মার্কিন মদতপুষ্ট দুষ্ট শক্তির সাহায্যপুষ্ট বলে  চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দেঙ চক্র দমন করে, তবে দ্বিতীয় মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগুনের আতংক কিন্তু চীনা সংশোধনবাদীদের, দেঙ জিয়াওপিং এর ছানাদের আজও তাড়া  করে বেড়াচ্ছে, এমন তাড়া করছে যে ফি বছরেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কোন না কোন তাবড় নেতা চীনা ইতিহাস ও সমাজের দোহাই দিয়ে জনগণ কে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষা কে খন্ডন করার আহবান জানিয়ে থাকে, মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব কে বিভীষিকা ও চরম নৈরাজ্য হিসেবে চিহ্নিত করে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ কে, চীনা গণমুক্তি ফৌজের সৈনিকদের  মাও জেদং এর চিন্তাধারার দিকে আকৃষ্ট না হয়ে বরং আত্মোন্নতির পথে চলে পুঁজিবাদের ভাল দোসর হওয়ার জন্যে আবেদন করে থাকে।

বর্তমানে শি জিনপিং এর আমলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব ও চীনা পুঁজিবাদ প্রচন্ড সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। মনে রাখতে হবে যে চীনা বাজার সমাজতন্ত্রের নামে প্রতিষ্ঠিত এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রাথমিক ভাবে দেঙ জিয়াওপিং আমলাতান্ত্রিক পুঁজির উপর নির্ভরশীল হয়ে গড়ে তুললেও এর পরিচালনার মূল শক্তি ছিল বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির দ্বারা চীনের মাটিতে পশ্চিমী প্রযুক্তিতে গড়ে তোলা কারখানাগুলো। চীনা পুঁজিবাদীরা মূলতঃ আমলাতান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি এবং এর ফলে চীনা পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিতে বিকশিত হতে পারেনি বরং স্বদেশে বিদেশী পুঁজি কে ব্যবসা করতে দেওয়ার বদলে কমিশন কামিয়ে নিজেদের পুঁজির পাহাড় বৃদ্ধি করে সেই পুঁজি পরবর্তী কালে লগ্নি করে নিজের দেশে ও অন্যের দেশে সস্তায় ব্যাপক উৎপাদনের ফর্মুলা কে কাজে লাগিয়ে মুনাফা কামিয়ে চীনা পুঁজির বিকাশ হয়েছে। তাই চীনের পুঁজিবাদীরা তীব্র ভাবে বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্য ও বিদেশী লগ্নির উপর নির্ভরশীল আর যেহেতু চীনের মাটিতে আগত বিদেশী পুঁজি চীনের শ্রমজীবি জনগণ কে শুধু যে শোষণ করবে তাই নয় বরং তাঁদের দেশের সম্পদ ও রসদ কে লুঠ করে নিয়ে চলে যাবে, তাই এর ফলে চীনা জনগণের মধ্যে যে তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঘৃণার ঝড় উঠতে পারে সেই ঝড় কে ঠেকা দিতে চীনা শাসক শ্রেণী আজ শ্রমিক ও কৃষক ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গড়ে তুলে দেশের প্রান্তে প্রান্তে প্রতি বছর অন্ততঃ পক্ষে সাত থেকে আট হাজার বৃহৎ গণসংগ্রাম কে দমন করে চলেছে। যত বেশি করে চীনের মাটিতে বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি ঘাঁটি গেড়ে বসছে, যত বেশি করে কৃষকেরা জমি হারাচ্ছেন এবং শ্রমিকেরা কাজ ও কাজের অধিকার হারাচ্ছেন তত বেশি চীনের মাটিতে শ্রমিক শ্রেণী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্ধ, চীনা জনগণ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার দ্বন্ধ তীব্র হচ্ছে।  এই দ্বন্ধ যত তীব্র হচ্ছে তত বেশি করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সকল কে নিয়ে চলার, সামগ্রিক উন্নয়নের, জনগণের আশা আকঙ্ক্ষা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একের পর এক প্রস্তাব গ্রহণ করে চলেছে এবং জনগণ কে বুঝিয়ে চলেছে যে চীনে প্রধান দ্বন্ধ এখন অসম ও অপরিপূর্ণ উন্নয়নের সাথে জনগণের চিরন্তন বেড়ে চলা এক উন্নত জীবন যাপনের অভিলাষের দ্বন্ধ। চীনের প্রধান দ্বন্ধ কে উন্নয়নের সাথে জনগণের উচ্চ অভিলাষের দ্বন্ধ বলে আসলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি পুঁজিবাদ কে শক্তিশালী করে তোলা ও চীনের উপর চীনা আমলাতান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের একচেটিয়া শাসন কে বলিষ্ঠ করতে চাইছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ভাবে সংকটগ্রস্ত সাম্রাজ্যবাদের বেঁচে থাকার রসদ যোগাচ্ছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেইমান সংশোধনবাদী নেতৃত্ব, সাম্রাজ্যবাদের কাছে চীনের মাটি, শ্রম ও সম্পদ কে উপঢৌকন দিয়ে।  চীনের সমাজের প্রধান দ্বন্ধ যে ক্ষমতার আলিন্দে বসা বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে চীনা সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন জনগণের দ্বন্ধ, সে কথা কে আড়াল করতে, মাও জেদং এর চিন্তাধারার  আলোর থেকে জনগণ কে দূরে সরিয়ে রেখে সময়ে অসময়ে একটি দুটি “মার্কসবাদী” তত্ব কথা আওড়ে নিজেদের শাসন কে যথাসম্ভব শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা তীব্র ভাবে করে চলেছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব। কিন্তু ওদের সব আশায় গুড়ে বালি হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদের সংকট কাটছে না বরং বেড়ে চলেছে আর অন্যদিকে দেশের মধ্যে চীনা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তীব্র ভাবে বেড়ে চলেছে শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে।   

যেহেতু চীনের বুকে সাম্রাজ্যবাদ ও চীনা পুঁজির শোষণ ও শাসনে অতীষ্ট শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণের সাথে দেশের শাসক শ্রেণী দেশি আমলাতান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্ধ আজ তীব্র আকার ধারণ করে চীনের প্রধান দ্বন্ধ রূপে উঠে আসছে তাই সেই দ্বন্ধ কে চাপা দেওয়ার জন্যে এবং সেই তীব্র দ্বন্ধের থেকে জনগণের দৃষ্টি কে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে আজ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের দরকার হচ্ছে একের পর এক পঁচা গলা অ-মার্কসীয় তত্বের। তাই মাও জেদং আর দেঙ জিয়াওপিং এর পরে আজ শি জিনপিং এর পুঁজিবাদী তত্ব কে তাঁর নামে পার্টির সংবিধানে লেখা হচ্ছে, মাও জেদং এর মতন উচ্চ স্থানে শি জিনপিং এর মতন বামন কে আজ বাঁশ দিয়ে ঠেলে তুলে নিজেদের সঙ্কট থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে চীনের শাসক শ্রেণী। তাই তো আজ দীর্ঘ ৪০ বছর পরে, হুয়া গুওফেং এর পতনের পরে, শি জিনপিং কে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি করে পার্টির চিরকালীন নেতা করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, যা দেখে আবার হিংসায় মুখ গুমরে যাচ্ছে জিয়াং জেমিন ও  হু জিনতাও এর মতন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রাক্তন হয়ে যাওয়া সাধারণ সম্পাদকদের, যাঁদের মাত্র দুইটি পাঁচ বছরের পর্বের পরেই পার্টির পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে গদি ত্যাগ করতে হয়েছিল। চীনা সমাজে বেড়ে চলা শ্রেণী দ্বন্ধ, ক্ষমতায় আসীন চীনা বুর্জোয়া শ্রেণী ও তার বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী মালিকদের সাথে প্রতিদিন বৃদ্ধি পাওয়া চীনা শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের দ্বন্ধ কে চাপা দিতে তাই আজ শি জিনপিং কে মাও জেদং এর মতন এক জননেতা সাজিয়ে দেখানো হচ্ছে, বলা হচ্ছে শি জিনপিং নাকি জনগণের কাছে উন্নয়নের সুফল ছড়িয়ে দিতে ও চীন কে এক বিশ্ব শক্তিতে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্কটগ্রস্ত নেতারা চীনা সমাজের মধ্যে বেড়ে চলতে থাকা বিদ্রোহের উপাদান কে ঠেকাতে আজ শি জিনপিং কে এক শিখন্ডি বানিয়ে তুলেছে। তবে হাত দিয়ে চাইলেই সূর্যের আলো থেকে পৃথিবীকে ঢেকে দেওয়া যায় না। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও জেদং এর  চিন্তাধারা আসলে সমাজ কে বৈজ্ঞানিক ভাবে ব্যাখ্যা করে থাকে বলেই সেই ব্যাখ্যায় ভুল থাকতে পারে না, আর যেহেতু সংশোধনবাদী শক্তিগুলি সমাজ কে বিকৃত ভাবে ব্যাখ্যা করে তাই ওদের ব্যাখ্যায় এবং প্রয়োগে জনগণের লড়াই কে দীর্ঘদিন চাপা দেওয়া যায় না, বরং জনগণের লড়াই তীব্র হয়ে ওঠে, শ্রেণী সংগ্রাম ফেটে পড়েই। সেই দ্বন্ধ কে ঢাকা দেওয়ার বা শ্রমিক - কৃষক ও মেহনতি জনগণের পুঁজিবাদ বিরোধী লড়াই কে নিরস্ত করার কোন ক্ষমতাই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের নেই, দুনিয়ার কোন সংশোধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নেই।

স্তালিনের মৃত্যুর পরে মাও জেদং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কে উত্তরাধিকারী সূত্রে লাভ করেন, রক্ষা করেন ও এক নতুন স্তরে, মাও জেদং এর চিন্তাধারার স্তরে তাকে উন্নত করেন। মাও জেদং এর চিন্তাধারা হলো এমন এক যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ এগিয়ে চলেছে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে এবং সমাজতন্ত্র এগিয়ে চলেছে বিশ্ব বিজয়ের দিকে। মাও জেদং এর যুগ লেনিনের যুগের চেয়ে, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের চেয়ে,এক গুণগত ভাবে আলাদা যুগ এবং এই যুগে বিপ্লবই প্রধান প্রবণতা এবং সংশোধনবাদ হলো প্রধান বিপদ। মাও জেদং এর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম জাতীয় কংগ্রেসে তাঁর উত্তরাধিকারী রূপে প্রতিষ্ঠিত - লিন বিয়াও মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে এক নতুন যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ রূপে এবং সমগ্র বিশ্বের বিপ্লবের রণাঙ্গনের এক জরুরী রণনৈতিক ও মতাদর্শগত হাতিয়ার রূপে প্রতিষ্ঠিত করে যান। মাও জেদং এর চিন্তাধারা আমাদের শেখায় যে একটি সমাজে বিপ্লবের পরেও, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণী সহজেই ক্ষমতা দখল করতে পারে, এবং তাকে একমাত্র ঠেকানো যেতে পারে শ্রেণী সংগ্রাম কে অগ্রাধিকার দিয়ে, বুর্জোয়া চিন্তাধারার বিরুদ্ধে সর্বহারা চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে এবং সব কিছুর উপর বিপ্লবের স্বার্থ কে অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র কে শক্তিশালী করার লড়াই চালিয়ে। ১৯৬৯ সালে মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে মাও জেদং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীদের সাবধান করেছিলেন যে একটি সাংষ্কৃতিক বিপ্লবে নয় বরং চীনের ভিতর পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা রুখতে কম করে দশটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব করা দরকার। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সজাগতার অভাব থেকেই ঝৌ এনলাই ও দেঙ জিয়াওপিং চক্র ষড়যন্ত্র করে লিন বিয়াও কে হত্যা করে, দশম জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে নতুন যুগের থেকে বিচ্ছিন্ন করে লেনিনের যুগেরই একটি ছোট বৃদ্ধি হিসেবে দেখায় ও তারপর ধীরে ধীরে সারা চীন জুড়ে পুঁজিবাদী শক্তিগুলি কে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ এর মধ্যে ক্ষমতার উচ্চ আসনে ফিরিয়ে আনে এবং মাও জেদং এর মৃত্যুর পরেই পুঁজিবাদ কে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। মাও জেদং এর শিক্ষার আলোক থেকে জনগণ কে দূরে সরিয়ে রাখতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাদশ জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় যে চীন একটি প্রাথমিক স্তরের সমাজতান্ত্রিক সমাজ এবং এই সমাজে ক্ষমতাচ্যুত বুর্জোয়া

তবুও, এত কথা লিখে, বলে ও প্রচার করেও কিন্তু দেঙ জিয়াওপিং বা তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা, শি জিনপিং এর মতন তাঁর ভক্তরা কিন্তু জনগণের মধ্যে থেকে মাও জেদং এর চিন্তাধারার আলোটা দূর করতে পারছে না, তাঁরা পারছে না মাও জেদং এর নাম ও চিন্তাধারা কে জনগণ থেকে বিছিন্ন করতে। মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষা কিন্তু জনগণের মধ্যে থেকেই  গেছে। তাঁরা, অর্থাৎ চীনের ব্যাপক শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ  কিন্তু প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে মাও জেদং  এর কাছে শিখেছেন যে একেবারে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেলেও সংগ্রাম করে ক্ষমতায় ফেরা যায় শুধু মাত্র সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক লাইন কে অনুসরণ করে এবং জনগণের সেবা করার লাইন কে গ্রহণ করে। চীনের শ্রমিক ও কৃষকদের এক প্রজন্ম তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম কে মাও এর চিন্তাধারা উত্তরাধিকারী সূত্রে দিয়ে যাচ্ছেন এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কার শিক্ষা ও চেতনার কথাও বলে যাচ্ছেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব যখন বিগত চার দশক ধরে মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে খন্ডন করতে ও মাও জেদং ও লিন বিয়াও এর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষা কে নেতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করে মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ঠিক তখনই চীনের প্রান্তে প্রান্তে বেড়ে চলা মাও এর জনপ্রিয়তা এবং সেই জনপ্রিয়তা কে খন্ডন করতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেইমান নেতৃত্বের নতুন নতুন তত্ব দাঁড় করিয়ে তীব্র সংকট থেকে চীনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কে বাঁচানোর প্রচেষ্টা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে মাও জেদং কতই সঠিক ভাবে সেই ১৯৬০ এর দশকের শেষে বলেছিলেন যে চীনে সমাজতন্ত্র জিতবে না পুঁজিবাদ তা এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ঠিক হবে এবং সেই সংগ্রাম আজ ইতিহাসে সবচেয়ে তীব্র রূপ ধারণ করছে বলেই শি জিনপিং এর মতন এক পুঁজিবাদের পদলেহী বরাহ নন্দন কে শিখন্ডি করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেইমান সংশোধনবাদী নেতৃত্ব কে ও চীনা আমলাতান্ত্রিক ও মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ কে আজ নিজেকে ও নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হচ্ছে। বৃহৎ উঁচু মাও জেদং এর মূর্তি গড়ে মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চালাতে হচ্ছে।  মাও জেদং এর চিন্তাধারা কে তবুও এই ঘোড়ার বেশে ঘাস খাওয়া গাধার দল কিন্তু পরাস্ত করতে পারছে না, চারদিকে এরা কেমন যেন নগ্ন হয়ে যাচ্ছে, আর তাই জনগণ এদের, এই নব্য সম্রাটদের ঘোড়া থেকে টেনে নামাতে উঠে পড়ে লেগেছেন, নিজেদের শরীরের সমস্ত ক্ষত কে উপেক্ষা করেই। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাও জেদং এর চিন্তাধারা আগামী দিনে  চীনের জনগণ কে বিপ্লবের পথে, বৃহৎ সংগ্রামের পথে নিয়ে আসবেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে মাও জেদং যে মহান শিক্ষা চীনা জনগণের ও বিশ্বের জনগণের জন্যে রেখে গেছেন সেই অস্ত্র কে ব্যবহার করে চীনের জনগণ, বিশ্বের বিপ্লবীদের সাথে আন্তর্জাতিক বিপ্লবী জোট গড়ে তুলে চীনের বুকে সমাজতন্ত্রের, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের পতাকা কে আবার বলিষ্ট ভাবে প্রতিষ্ঠা করবেনই। এটাই ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম এবং ইতিহাসের চাকা প্রগতির চাকা, তা ক্রমশই সামনে এগিয়ে যায়, প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদের ধ্বজ্জাধারী সংশোধনবাদীরা বেশিদিন সেই চাকাকে পিছনে ঘোরাবার প্রচেষ্টা চালাতে পারবে না, বরং সেই চাকার নিচেই ইতিহাসের নিয়মে তাঁদের পিষ্ট হয়ে যেতেই হবে এক নতুন শোষণহীন সমাজের স্বার্থে।  চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেইমান সংশোধনবাদী পুঁজিবাদী নেতারা সাবধান হয়ে যাও, জনগণ জাগছেন, মাও জেদং তাঁদের সূর্যের মতন আলো দেখছেন তাঁর দুর্জয় চিন্তাধারার মাধ্যমে।  


মোদী রাজত্বে ক্রোনি কর্পোরেট শাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ হোক বিকল্প গণমাধ্যম

বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

নরেন্দ্র মোদী ও গৌতম আদানি ক্রোনি পুঁজিবাদ


বেশ কিছুদিন ধরে  ভারতের হিন্দি ও ইংরাজী ভাষার টিভি চ্যানেলগুলো ও পত্রপত্রিকাগুলো বেশ ঘটা করে গুরমিত রাম রহিম ইনসান নামক ভন্ড বাবাজির তথাকথিত পালিতা কন্যা এবং আদতে গুপ্ত গার্লফ্রেন্ড হানিপ্রীত ইনসান কে নিয়ে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী সংবাদ মাধ্যম হয় শারদোৎসব আর না হয় মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচারে ব্যস্ত। কেউ নরেন্দ্র মোদী কে মেপে মেপে সমালোচনা করছে তো কেউ বলছে নরেন্দ্র মোদীর উচিত আরও জোরে তাঁর তথাকথিত সংস্কারের রথ চালানো।
এরই মধ্যে  একটা ভীষণ চাঞ্চল্যজনক ঘটনা ঘটে গেল, যার নৈপথ্যে কিন্তু আবার একটি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় পুঁজির মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যম। অস্ট্রেলিয়ার সরকারি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যম এবিসি’র ফোর্থ কর্নার অনুষ্ঠানে সম্প্রতি প্রসারিত হলো একটি অনবদ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দ্বারা উত্তোলিত তথ্যে পরিপূর্ণ তথ্যচিত্র, যাঁর মূল বিষয় ছিল ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি গৌতম আদানি’র দুর্নীতিপূর্ণ ব্যবসা এবং আদানি গোষ্ঠীর দ্বারা দেশে বিদেশে কালো টাকার চোরাকারবার। উল্লেখনীয় ব্যাপার হলো যে নরেন্দ্র মোদী, তাঁর পার্টি বিজেপি ও তার ভাবাদর্শের উৎস, আরএসএস, কিন্তু আদানি গোষ্ঠীর নিমক খেয়ে তার সেবা করে এবং সমস্ত রকম প্রচলিত আইনের হাত থেকে আদানি গোষ্ঠী’র স্বার্থ কে রক্ষা করে। এহেন মোদী-শাসিত ভারতবর্ষের বুকে আদানি গোষ্ঠীর সমালোচনা করা বা নিন্দা করা বেসরকারি ভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হঠাৎ সমালোচক কে দিনের আলোয় আততায়ীর হাতে গুলি খেতে হতে পারে বা হঠাৎ আদানির উকিল কোটি কোটি টাকার মানহানির মামলা করার ভয় দেখিয়ে চিঠি পাঠাতে পারে সমালোচনাকারী সংবাদ মাধ্যমের দফতরে। ঠিক যেমন প্রখ্যাত পত্রিকা ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলি কে ধমকানো হয়, যার ফলে চাকরি হারান আদানি গোষ্ঠীর নানা দুর্নীতির তদন্তকারী ও কট্টর সমালোচক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা। এবিসি ভারতে অবস্থিত নয় এবং ভারতের থেকে তাঁদের আয় প্রায় নগন্য ফলে তাঁদের পক্ষে যে ভাবে সাহসিকতার সাথে গৌতম আদানি ও তাঁর আপাদমস্তক দুর্নীতি ও কালো কারবারে ডুবে থাকা আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে একটি দুর্দান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা সম্ভব হলো, আদানির বিজ্ঞাপনের থেকে টাকা আয় করা এবং গৌতম আদানির জুতো চাটা দেশি দালাল সংবাদ মাধ্যমগুলোর সেই সাধ্য হতো না।

আদানি গোষ্ঠীর উৎপত্তি গৌতম আদানি ও তাঁর সিঙ্গাপুর স্থিত ভাইয়ের হাত ধরে। আম্বানি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানির মতনই গৌতম আদানি নিরামিষাশী এক গুজরাটি বেনিয়া, যাঁর উত্থান শুরু হয় গুজরাটে বিজেপি শাসন শুরুর সাথে সাথে। কলেজ-ছুট এক বেনিয়া গুজরাটি তাঁর শেষ সম্বল দিয়ে ফাটকা খেলা শুরু করে হিরের ব্যবসায় ও পরবর্তী কালে নয়া-উদার অর্থনৈতিক হাওয়ায় ভেসে প্রবেশ করে গুজরাটের ক্রোনি পুঁজিবাদের শিবিরে। ক্রোনি পুঁজিবাদ আসলে মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের দেশ ভারতের একটি বহুল প্রচলিত ব্যবস্থা যার মূল হলো শাসক রাজনৈতিক দলগুলি ও প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র কে পকেটস্থ করে নিজের ব্যবসা কে প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি লাভজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা। গৌতম আদানির বন্দর, তাপ বিদ্যুৎ, খনিজ সম্পদ উত্তোলন, বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসাগুলো বিগত দুই দশকে তীব্র গতিতে বেড়ে দেশের প্রথম সারিতে চলে আসে দুইটি প্রধান কারণে। প্রথমতঃ গৌতম আদানি ঘুষ দিতে কার্পণ্য করেনি আর দ্বিতীয়তঃ নরেন্দ্র মোদী’র মতন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর অকৃত্রিম অনুচর ও তল্পিবাহক হয়ে ওঠে। মোদীর শাসনকালে, গৌতম আদানির ব্যবসা যেমন ফুলে ফেঁপে ওঠে, তেমনি সমস্ত রকমের আইন কে জুতোয় পিষে সমগ্র গুজরাটে বিশাল আয়তনের জমি দখল করা আদানির পক্ষে জলভাত হয়ে যায়। আদানি গোষ্ঠী যত না তাঁদের বাণিজ্যের দ্বারা অর্থ আয় করেছে তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি করেছে দেশের কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করে। দেশের যে দালাল সংবাদ মাধ্যমগুলো নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট বাতিলের স্বিদ্ধান্তে “কালো টাকা ধ্বংস হলো” বলে বিশ্রী রবে শিয়াল-চিৎকার জুড়েছিল তাদের কেউই কিন্তু আদানির দ্বারা কর ফাঁকি দিয়ে কেইম্যান আইল্যান্ড বা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড এর মতন কর-হীন দেশে নিজেদের জাল কোম্পানির একাউন্টে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা নিয়ে কিন্তু টু শব্দটি করেনি।

ভারতের মতন দেশে গৌতম আদানির আদানি গোষ্ঠী বা ধীরুভাই আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠী (এখন দুই ভাগে বিভক্ত) ইত্যাদির পক্ষে বৃহৎ পুঁজির কারবারি হয়ে ওঠার পিছনে লুকিয়ে থাকে চূড়ান্ত দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর (সকল রঙের) চরম কর্পোরেট দালালি। শুধু মোটা অঙ্কের ঘুষ রাজনৈতিক পার্টিগুলিকে ও আমলাতন্ত্র কে দিয়ে এই ক্রোনি পুঁজিবাদীরা শুধু যে নিজেদের জন্যে সমস্ত আইন শিথিল করিয়ে ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধি এনেছে তাই নয়, এদের বিরামহীন ব্যবসায়িক অভিযানে, বড় তাপ বিদ্যুৎ, পেট্রো-কেমিকেল বা বন্দরের ব্যবসায় দেশের পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও জনগণের, গরিব খেটে খাওয়া জনগণের ব্যাপক আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ঘুষে কুকুর কেও বাপ বলায়। তাই হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েও আদানি গোষ্ঠী ভারতে কলার তুলে ব্যবসা করতে পারে কারণ আরএসএস ও সমগ্র হিন্দুত্ব শিবির এই নিরামিষাশী গুজরাটি মুৎসুদ্দি বেনিয়ার স্বার্থ কে রক্ষা করার পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে। আজ যে গুজরাটের ভুঁয়ো উন্নয়নের ছেলে ভোলানো গল্প শুনিয়ে নরেন্দ্র মোদী কে হিরো সাজানোর চেষ্টা চালায় ভারতের কর্পোরেট টাকায় চলা মূলধারার সংবাদ মাধ্যম, সেই গুজরাটের সিংহভাগ বন্দর ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কিন্তু আদানির, আর আদানি টাকা তুলেছে শেয়ার মার্কেট থেকে, সেই শেয়ার মার্কেটে টাকা এসেছে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির পুতুল লগ্নিকারী বা এফআইআই’র মাধ্যমে এবং এই সকল প্রকল্পগুলো গড়ে উঠেছে পরিবেশ কে ধ্বংস করে এবং গরিব জনগণের জীবন ও জীবিকা কে লাথি মেরে। এক একটা জায়গায় আদানি গোষ্ঠী ব্যবসা করার ফলে সৃষ্ট হয়েছে অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক সঙ্কট। এবিসির অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা গেল যে কি ভাবে বিজেপি’র সমর্থনে বলীয়ান হয়ে সমস্ত রকমের পরিবেশ সম্পর্কিত আইন কে কাঁচকলা দেখিয়ে এবং বিভিন্ন ধরণের সামাজিক প্রতিরক্ষার আইন উল্লঙ্ঘন করে গৌতম আদানি তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। দেখা গেল গোয়ার ভাস্কো দা গামায় কয়লা উত্তোলনের নামে কি ভাবে পরিবেশ ও জনসাধারণের ক্ষতি করেছে আদানি গোষ্ঠী, দেখা গেলো কর্ণাটকে কি ভাবে লাভের টাকা চুষে নিয়ে একটি এলাকার পরিবেশ ও অর্থনীতি কে বিশ বাঁও পানিতে ফেলে উধাও হয়ে গেল আদানি গোষ্ঠী, দেখানো হলো কি ভাবে গৌতম আদানির পাহারাদার সেজে ক্রাইম ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসাররা নেড়ির মতন তেড়ে এলো অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকদের গুজরাট থেকে তাড়িয়ে দিতে, রীতিমত খুনের হুমকি দিয়ে। যে রাজ্যের প্রাক্তন গৃহমন্ত্রী দলীয় কোন্দলে খুন হয়ে যান আর অন্য এক প্রাক্তন গৃহমন্ত্রী একের পর এক ভুঁয়ো এনকাউন্টারে মুসলমানদের নিজ স্বার্থে ও বিজেপিকে ভোটে জেতানোর স্বার্থে খুন করিয়েও আইন কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহাল তবিয়তে দেশের শাসক দলের প্রধান হয়ে জনগণের করের টাকায় সরকারি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করে, সেই রাজ্যে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের লোকেদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যে আদানি কে বাঁচাতে হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তা বলার জন্যে বিশেষ কোন গবেষণা করার দরকার পরে না। সাহেবের রাজ্যে আদানি’র সাম্রাজ্য অক্ষত রাখতে সদা প্রস্তুত হিন্দুত্ববাদী শিবির ও তার রাষ্ট্র যন্ত্র।

অস্ট্রেলিয়া থেকে এবিসি হঠাৎ এমনি এমনি আদানি গোষ্ঠীর কালো ইতিহাস কে খুঁড়ে বের করতে আসেনি, বরং অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সমস্ত বড় রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় পুঁজিপতিদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে গৌতম আদানি যে বৃহৎ এলাকা জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় কয়লা খনি গড়ে কয়লা উত্তোলন করতে চায় এবং সমস্ত অঞ্চলের ভূ গর্ভস্থ পানি চুষে এলাকাটি কে মানুষ, পশু পাখির বাসের অযোগ্য মরুভূমিতে পরিণত করতে চায় তার বিরুদ্ধে সমগ্র অস্ট্রেলিয়া জুড়ে গড়ে উঠেছে তীব্র গণআন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের চাপে পড়ে (মনে রাখতে হবে অস্ট্রেলিয়া সাদা চামড়ার মানুষের দেশ, কালো চামড়ার মানুষের নয়) বড় বড় ব্যাঙ্কগুলি আদানির প্রকল্পে অর্থ লগ্নি করার থেকে পিছু হঠে এবং এর ফলে অস্ট্রেলিয়া’র আদানি দালাল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভীষণ মুশকিলে পড়ে। কারণ তাঁরা এর মধ্যেই কোটি কোটি ডলার উপঢৌকন পেয়েছে গৌতম আদানির থেকে, সেই জন্যে তাঁরা খনন কার্য শুরু হলে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে বলে জনগণের করের টাকা দিয়ে আদানির জন্যে পরিকাঠামো বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে, এটা জেনেও যে তাঁদের এই কর্মকান্ডে অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশ ও জনগণের জীবন ও জীবিকার অভূতপূর্ব ও অপূরণীয় ক্ষতি হবে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ওয়ানগান ও জাগলিংও জনগণ এই খনির বিরুদ্ধে তাঁদের মত দিয়েছেন এবং জমি দিতে অস্বীকার করেছেন, তবে আদানির থেকে কোটি কোটি ডলার ঘুষ খাওয়া রাজনৈতিক নেতারা সেই জমি কেড়ে নিতে আজ বদ্ধপরিকর। #Stop Adani নামক এই সংগ্রামের সাথী হয়ে জনগণের শত্রু আদানি গোষ্ঠীর স্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপক মানুষের সামনে তুলে ধরতে এবিসি কর্পোরেশনের মতন রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে চলা সংবাদ সংস্থা আদানির বিরুদ্ধে কোমর কষে নেমেছে এবং এক তথ্যসম্পূর্ণ রিপোর্ট জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে চলা এই সংবাদ মাধ্যমের এই সমালোচনামূলক রিপোর্টিং সম্ভব হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার শাসক শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্ধের কারণেই। এক মিনিটের জন্যে ভাবুন পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ ধ্বংসকারী ভাঙ্গর প্রকল্প, কৃষি-বিরোধী ন্যানো কারখানা বা নন্দীগ্রামের অদূরে সালেম গোষ্ঠীর প্রকল্পের বিরুদ্ধে কি আনন্দবাজার গোষ্ঠী (যারা একদিকে মোদী বিরোধিতার সুর চড়ায় আনন্দবাজার পত্রিকা বা দি টেলিগ্রাফে আর অন্যদিকে কাঞ্চন গুপ্ত বা জয়ন্ত ঘোষালের মতন হিন্দুত্বের ধ্বজ্জাধারী ইজরায়েলি দালালদের চাকরিতে রাখে) কোনদিন মুখ খুলতে পারতো? আরে আনন্দবাজার বা অন্য বাজারি কাগজ তো দূরের কথা আমাদের সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তির ২০০৭-০৮ এর সংখ্যাগুলো যদি পড়েন তাহলে দেখবেন মনে হবে টাটা বা সালেমের মুখপত্র পড়ছেন। শুধু বিজেপির বিরুদ্ধে কামান দেগে তেমন লাভ হবে না, কারণ বিজেপি বর্তমানে যা করছে তার পিছনে যদি সিপিএম বা কংগ্রেসের মতন দলগুলোর সুপ্ত সমর্থন না থাকতো তাহলে ভারতবর্ষ কর্পোরেট লুঠের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতে পারতো না। ভারতের রাজনীতি ও সংবাদ মাধ্যমের দুনিয়ার তাবড় সব খেলোয়াড় বর্তমানে আদানি আর আম্বানিদের হয়ে খেপ খেলছে এবং তাই আপনি এদের আক্রমণের নিশানায় কখনো কর্পোরেট পুঁজি কে পড়তে দেখবেন না, বরং এদের কাছে শুনবেন আদানি বা আম্বানিদের স্তুতি, তাঁদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি  (সিএসআর) প্রকল্পগুলি কি ভাবে সমাজের উন্নয়ন (বা সমাজের উন্নয়নের নামে কর ফাঁকি দেওয়ার ভাঁওতাবাজি) করছে, তার ফিরিস্তি। স্বাধীন দেশের বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যম ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশের বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে এই হলো ফারাক।

ভারতের সমস্যার দুটো বড় দিক হলো, এক, এই দেশে কখনো পুঁজিবাদী বিপ্লব সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসন কে উৎখাত করেনি, এবং দুই, এই দেশের বৃহৎ পুঁজির মালিকদের কেউই জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি নন, বরং মুৎসুদ্দি বেনিয়া সম্প্রদায়ের লোক যাঁরা বিদেশী পুঁজির কাছে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা রেখেছে নিজেদের, কখনো পুঁজির জন্যে তো কখনো প্রযুক্তির জন্যে। বিদেশী পুঁজি কে পরাস্ত করে নিজের শক্তিতে একটি শক্তিশালী বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তি হয়ে ওঠার কোন প্রবণতা ভারতের পুঁজিপতিরা দেখায়নি, বরং উদার অর্থনীতির সাহায্যে, বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ও বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নিকারীদের অর্থে বলীয়ান হয়ে নিজেদের কর্পোরেট সংস্থাগুলোর বিদেশে সম্প্রসারণ ঘটানো শুরু করে টাটা-আম্বানি-আদানি জাতীয় সকল মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিকেরা। এরা চরম ভাবে বিদেশী পুঁজির দালাল এবং এরা কোন ভাবেই বিশ্বের কোথাও নিজেদের অস্তিত্ব বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সাহায্য বাদে টিকিয়ে রাখতে পারবে না, এবং মূলত বেনিয়া পুঁজির মালিক এই সংস্থাগুলো ভারতকে শিল্পে স্বনির্ভর করে তুলতে চিরকালই অপারগ থাকবে। ভারতের এই বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিকদের ঢাল করে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকেরা প্রায় দেশের সকল ক্ষেত্রে বিপুল পরিমানের অর্থ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লগ্নি করেছে এবং কোটি কোটি ডলার প্রতিদিন দেশের মাটির থেকে শুষে নিংড়ে নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। আদানি আর আম্বানির মতন দালাল পুঁজির মালিকেরা নিজেদের কমিশন কামিয়ে অট্টালিকা বানিয়ে নিজেদের ধন বৃদ্ধি জাহির করছে এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের একটি সামান্য আলপিন থেকে সিংহাসনে আসীন মহারাজ কে কিনে পকেটে ভরে রেখেছে। যেহেতু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল থেকে ভারতের সংবাদ মাধ্যমের উপর একচেটিয়া মালিকানা কায়েম করেছে এই মুৎসুদ্দি বেনিয়া পুঁজিপতিরা এবং যেহেতু এদের পুঁজি ও রাষ্ট্রের সাথে দহরম মহরমের ফলে এরা ছোট এবং মাঝারি সংবাদ মাধ্যমগুলো কে গ্রাস করে ফেলে, তাই এই দেশে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতার লেশমাত্র উপস্থিত, এই কল্পনা করাও ঘোর অন্যায় হবে। বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি আজ আম্বানি বা আদানিদের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে ভারতের শ্রম, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুঠ করছে এবং তার সাথে সাথে এই দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশ কে কিনে নিয়ে নিজেদের কর্মকান্ড কে সাধুবাদ দিয়ে জনগণ কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই আম্বানি-আদানিরা আবার বিশাল টাকা দিয়ে, ব্যক্তিগত বিমান দিয়ে, জমি আর শেয়ার দিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও আরএসএস এর মতন ঘৃণ্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের নিজেদের দারোয়ান হিসেবে পুষছে, তাদের দিয়ে দেশের কোনায় কোনায় জনগণের ঐক্য ভাঙতে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার আগুন জ্বালাচ্ছে।  এই চরম ঘৃণ্য ব্যবস্থার স্বরূপটি জনগণের চোখের সামনে তুলে ধরতে আমাদের দেশের তথাকথিত স্বাধীন মিডিয়া অপারগ, কারণ বিজ্ঞাপনের বড় বালাই। তাই তারা মেতে আছে হানিপ্রীত সিংহে ও যৌবন ধরে রাখার টিপস দেওয়ায়।  

এখন আর খবরের উপর ভিত্তি করে সংবাদপত্র বিক্রি হয় না, বরং কাগজ ছাপার খরচ থেকে লাভের টাকা সবটাই আসে শুধু মাত্র বিজ্ঞাপন থেকে অর্জিত অর্থ থেকে। সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলগুলো এখন শুধু বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে এবং তার সাথে বিজ্ঞাপনদাতার স্বার্থ বিঘ্নিত হয়না এমন নিরীহ কাঁচি চালানো খবর বিনামূল্যে পাঠক বা দর্শকদের কাছে পরিবেশিত করে। তাই এই মূলধারার কর্পোরেট-মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলি ভারতের মানুষের কোন কল্যাণে আর আসতে পারবে না, ফলে আজ জনগণের কাছে সত্য সংবাদ ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারে শুধু মাত্র গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বিকল্প সংবাদ মাধ্যমগুলি, যেগুলি জনগণের চাঁদার টাকায় বা ছোট ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপনের টাকায় নিজেদের প্রকাশনা চালায়। বিকল্প গণমাধ্যমআজ ভারতের দরকার, এই কঠিন পরিস্থিতিতে জনগণের একটি বিশেষ প্রয়োজন। শুধু আদানির মতন দেশের অর্থ বিদেশে পাচারকারী মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের বিরুদ্ধেই নয়, বরং সামগ্রিক ভাবে ভারতের সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের ঘৃণ্য শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের অংশীদার হিসেবে আজ বিকল্প মিডিয়ার প্রয়োজন প্রচন্ড। সকল ধরণের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল জনগণ কে ঐক্যবদ্ধ করে, বিদেশী পুঁজি ও দেশি মুৎসুদ্দি পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক বিরাট দেশপ্রেমী প্রচার মাধ্যম গড়ে তোলার জন্যে আজ সমস্ত ফ্যাসিবিরোধী ও গণতান্ত্রিক সাংবাদিকদের আজ একসাথে আসতে হবে, শুধু পয়সা রোজগারের আকঙ্ক্ষা থেকে নয়, বরং দেশের জনগণের সামনে দেশের আসল শত্রু, আদানি-আম্বানি-টাটা ইত্যাদির, মোদী আর আরএসএস এর মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্যে। আজ সময় হয়েছে আমাদের কলমগুলিকে তলোয়ারের ন্যায় ব্যবহার করার, মূলধারার কর্পোরেট-মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বিকল্প গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার এবং এই সংগ্রামে আমরা যদি পিছিয়ে পড়ি, তাহলে ইতিহাস আমাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না।
 

বাংলার মাটিতে দাঙ্গার চক্রান্ত চূর্ণ করতে ঐক্যবদ্ধ হোন

মঙ্গলবার, জুলাই ২৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-



একটা সামান্য ফেসবুক পোস্ট থেকে যে ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা সমগ্র বাদুড়িয়ায় শুরু হলো এবং ক্রমেই পৌঁছে গেল বসিরহাট ও সংলগ্ন স্বরূপনগর, হিঙ্গলগঞ্জ, দেগঙ্গা ও হাসনাবাদ অঞ্চলে,  তা দেখে মনে হলো যে এই সাম্প্রদায়িক হিংসার জন্যে জমি প্রস্তুত করা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। কারণ বিনা পরিকল্পনায় আর বিনা সাংগঠনিক প্রস্তুতিতে এই ধরণের সংগঠিত হিংসা ও দাঙ্গা ছড়ানো অসম্ভব হয়ে যায়। সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে একটা ফেসবুক শেয়ারের কয়েক ঘন্টার মধ্যে যে কাণ্ড গোটা বাদুড়িয়া অঞ্চলে হলো তার পিছনে রয়েছে গূঢ় অভিসন্ধি।

বসিরহাট-বাদুড়িয়া সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণ কি ? কেন হঠাৎ তেঁতে উঠে এমন তীব্র হিংসায় সামিল হলো এই অঞ্চলের লোকেরা? কেন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রশাসন ও দাপুটে তৃণমূলী হার্মাদ বাহিনী আজ ব্যাকফুটে চলে গেল? কি ভাবে তপন ঘোষ - জিষ্ণু বোসের মতন হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা উত্তর চব্বিশ পরগনার মতন কৃষক আন্দোলনের জেলায় নিজেদের আধিপত্য একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সরকার ও তথাকথিত বাম ও প্রগতিশীল শক্তির অগোচরে প্রতিষ্ঠা করতে পারলো? আর হঠাৎ করেই কি, একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই দাঙ্গা শুরু হলো? এর পিছনে কি কোন পরিকল্পনা বা সমন্বয় ছিল না ? যদি ছিল তাহলে কারা ছিল তার পিছনে? বিভিন্ন ধর্মীয় ও মৌলবাদী সংগঠনের এই দাঙ্গার পিছনে ভূমিকা কি ছিল? কেন পুলিশ নির্বাক দর্শক হয়ে বসিরহাট-বাদুড়িয়া কে জ্বলে যেতে দিল?


আপনি যদি বাংলা বা সর্ব ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ পরিবেশন দেখেন, হিন্দুত্ববাদী পেটোয়া মিডিয়া কে বাদ দিয়েই, তবে দেখবেন সব জায়গায় দেখানো হচ্ছে যে এই দাঙ্গা একটি স্বতঃস্ফূর্ত দাঙ্গা আর এর না কোন পরিকল্পনা ছিল, না কোন লক্ষ্য ছিল। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত একটি দাঙ্গা এক জায়গার থেকে শুরু হয়েও অন্য জায়গায় এত তাড়াতাড়ি কি করে ছড়িয়ে পড়লো আর কেনই বা পুলিশ বা প্রশাসন আধা সামরিক বাহিনীর সমর্থনে এই দাঙ্গা কে দমন করতে পারলো না? যেমন ওরা দমন করেছিল লালগড়ের জনগণের ন্যায়সঙ্গত লড়াইকে বা ভাঙড়ের কৃষকদের আন্দোলন কে, ঠিক সেই ভাবে প্রশাসন কেন নখ দাঁত বের করে দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে কেন ঝাঁপিয়ে পড়লো না? কেন যে ভাবে লাঠি চার্জ করে কিছুদিন আগেই যেভাবে নবান্ন অভিযানকারী বামফ্রন্টের কর্মীদের ক্ষত বিক্ষত করেছিল মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পুলিশ বাহিনী সেই ভাবে লাঠি চার্জ করে দাঙ্গাবাজদের হাড় ভাঙতে পারলো না ?

আসলে বাদুড়িয়া-বসিরহাটের দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতটা মোটেই কোন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নয় বা শৌভিক সরকারের মতন এক কিশোরের ফেসবুক পোস্ট সংক্রান্ত নয়, আসলে এগুলো হলো উপলক্ষ, দাঙ্গার কারণ লুকিয়ে আছে অন্যত্রে, যা এক বৃহৎ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ এবং কিছুটা হলেও স্থানীয় দুর্নীতির সাথে যুক্ত।


বাদুড়িয়া-বসিরহাট দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিত



ইছামতি নদীর পাড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে বছরের পর বছর এক সাথে বাস করেছেন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই শ্রমজীবি মানুষ। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্য কে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল কৃষকদের সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রাম ও শ্রমিক শ্রেণীর জঙ্গী আন্দোলন। এর ফলে অনেক চেষ্টা করেও গত শতাব্দীর ৬০ ও ৭০ এর দশকে এই অঞ্চলে কল্কে পায়নি সংঘ পরিবার বা অন্যান্য দাঙ্গাবাজ ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলো।

তবে ১৯৯০ এর  দশক থেকেই এই সমস্ত অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভেদের পটভূমি তৈরি করা শুরু হয়, এবং আশ্চর্যজনক ভাবে সেইদিন এই বিভাজন সৃষ্টির হোতা কিন্তু ছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস এর প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে তিনি বিজেপির হাত ধরেন এবং সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে নিজ প্রভাব বিস্তারের স্বার্থে তিনি ও তাঁর পার্টি - তৃণমূল কংগ্রেস সেদিন কিন্তু আরএসএস ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।

তৃণমূলের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধার কারণেই বিজেপির প্রথম বিধায়ক রাজ্য বিধানসভায় ১৯৯৯ সালে অশোকনগর উপনির্বাচন জিতে প্রবেশ করে। সেই সময়েই পশ্চিমবঙ্গের থেকে দুইজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয় বিজেপির আর রাজ্যে আস্ফালন বেড়ে চলে বিজেপির। যদিও বাম আমলে মুসলমানদের অবস্থা রাজ্যে ভীষণ করুন হয়, তবুও তৃণমূলের সাহায্যে সেই সময়ের থেকেই বিজেপি প্রচার করা শুরু  করে যে রাজ্যে মুসলমান তোষণ নাকি বেড়ে গেছে এবং হিন্দুদের থেকে নাকি মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হতে চলেছে। সেই বিষাক্ত প্রচার কে না তো তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার কোনদিন খন্ডন করেছিল আর না তৃণমূল কংগ্রেস বা জাতীয় কংগ্রেস।

২০১৪ সালের মোদী-ঢেউ যখন সারা ভারতে গেরুয়া রঙ লাগানো শুরু করলো, তখন পশ্চিমবঙ্গের থেকে আবার দুইটি আসন অনায়সে জিতে গেল বিজেপি আর সেই বিজয়ের ফলে আরএসএস এর নেতৃত্ব চরম উৎফুল্ল হয়, কারণ পশ্চিমবঙ্গ কে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও বিভাজনের মানচিত্রে না আনতে পারলে ব্রাক্ষণত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক কর্পোরেট-সামন্তবাদী ফ্যাসিবাদ কে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, কারণ পশ্চিমবঙ্গ, তামিল নাড়ু, কেরল, প্রভৃতি রাজ্য থেকেই ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী পায় সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবি পদাতিক বাহিনী কে।

বিজেপি ও আরএসএস এর পুনরুত্থানের পিছনে বসিরহাট এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল। ২০১৫ সালের বিধানসভা উপনির্বাচনে এই বসিরহাট থেকেই ভোটে জিতে বিধানসভায় প্রবেশ করেন শমীক ভট্টাচার্য। এই বসিরহাটের মাটিতে এসেই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার কে ফেলে বিজেপির সরকার গড়ার ডাক দিয়েছিলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, ২০১৬  সালের বিধানসভা নির্বাচনে গো-হারা হারতে হয় বিজেপি কে এই কেন্দ্রে।

তবে হিন্দুত্ববাদীদের ঘৃণ্য প্রচার পিছিয়ে থাকে না। বিশেষ করে প্রতিবেশী জেলায় জমি আন্দোলন শুরু হতেই কৃষক জনগণ কে জমি বা সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রাম থেকে দূরে রাখতে এবং বন্ধ কলকারখানার শ্রমিকদের কারখানা খোলার আন্দোলন বা চালু কারখানার শ্রমিকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে দূরে ঠেলে দিতে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাইল ও মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার টাকায় চলা হিন্দু সংহতি, আরএসএস ও বজরং দল।

এই অঞ্চলে একই সময়ে গজিয়ে উঠেছে মার্কিন দালাল সৌদি আরবের টাকায় তৈরি হওয়া সালাফি জঙ্গী ইসলামের পাঠ শেখানোর মাদ্রাসা, এবং সেই মাদ্রাসা চালাতে বাইরের থেকে আসছে সালাফি ইসলামী মৌলানারা, যাঁদের শিরায়-উপশিরায় বইছে মার্কিন-ইসরাইল-সৌদি জোটের ছড়ানো ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ। এই মৌলানা ও ইমামদের একটি বড় অংশই শাসক পার্টি তৃণমূলের শিবিরে জুটেছে এবং পার্টির নানা সেলের ছোট বড় নেতা হয়ে উঠেছে।

এলাকায় এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছে রাম ও হনুমানের মন্দির, যাঁর সাথে দিন-আনি-দিন-খাই শ্রমজীবি হিন্দুদের কোন কালেই কোন সম্পর্ক ছিল না। ইছামতির পাড়ে এই বাদুড়িয়া-বসিরহাট অঞ্চলের অনেক গ্রামে ধীরে ধীরে তলোয়ার ও লাঠি খেলা শেখানোর টোপ দিয়ে নিরীহ গরিব হিন্দু বাড়ির শিশু ও কিশোরদের নিয়ে আসে আরএসএস ও বজরং দলের কর্মীরা আর তারপর তাঁদের মন কে বিষিয়ে তোলানো হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে।

হাজারো হাজারো ঝুটো ভিডিও, ছবি ও বিকৃত তথ্য পরিবেশন করে হোয়াটস্যাপ ও ফেসবুকের মাধ্যমে হিন্দু যুব সমাজের একটা বড় অংশকেই মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে আরএসএস। কিন্তু বহু বছর ধরে এক সাথে বাস করা মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লাগানো বাংলার মাটিতে যে কঠিন সে কথা বুঝেছে আরএসএস আর তাই বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও পূর্ব উত্তর প্রদেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মী ও সমর্থকদের ভাড়া করে পশ্চিমবঙ্গে আনিয়েছে গেরুয়া বাহিনী। যেই মুহূর্তে যেখানে দাঙ্গার প্রয়োজন, সেই মুহূর্তে সেখানে দলে দলে লোক কে ট্রেনে বা ট্রাকে চাপিয়ে পাঠিয়েছে আরএসএস। বিএসএফ কে ব্যবহার করে রাজনাথ সিংহ আরএসএস এর হিন্দুত্বের বিষ কে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে গভীরে রোপন করার পরিকল্পনায় সহায়তা করার জন্যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করাচ্ছে জামাতি জঙ্গীদের, যাঁদের একটা বড় অংশ হিঙ্গলগঞ্জ ও দেগঙ্গায় আশ্রয় নিচ্ছে নানা ধরণের সুন্নি সংগঠনগুলোর শেল্টারে।


কিছুদিন আগেই, ঈদের পরের দিন, অর্থাৎ ২৭শে জুন - আরএসএস এর বেসরকারি বাংলা মুখপত্র দৈনিক যুগশঙ্খ প্রথম পৃষ্টায় একটি উস্কানি মূলক খবর ছাপে - ঈদের দিন বাদুড়িয়ার মসজিদে উড়লো পাকিস্তানের পতাকা। ছবিটি পত্রিকার কেউ তোলেনি, কারণ ছবিটি একটি মোবাইল থেকে তোলা হয়েছিল এবং পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা হয়েছিল। কোন হিন্দুত্ববাদী গ্রূপ থেকে ছবিটি পেয়েই প্রথম পাতায় বড় বড় করে কাল্পনিক তথ্য সহ দৈনিক যুগশঙ্খ এই খবরটি ছাপে, আর ছবিটিতে পাকিস্তানের ঝান্ডা বলে দেখানো হচ্ছে ইসলামিক ঝান্ডা কে, যার ধারে কোন সাদা পাড় নেই। এই রকম ঝুটো, অথচ জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী প্রথম পাতার খবর দেখে সেই সময়েই কিন্তু বাদুড়িয়ার মানুষ ও অন্যান্য জায়গার প্রগতিশীল ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ কিন্তু বুঝে গেছিলেন যে ধুলাগড় ও হাজীনগরের মতন এবার বাদুড়িয়া নিয়েও কোন চক্রান্ত আরএসএস ও বিজেপি ফেঁদেছে।


শৌভিক সরকার ও বাদুড়িয়ার দাঙ্গা 

শৌভিক সরকার কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ 

বাদুড়িয়ার রুদ্রপুরের মাগুরখালী গ্রামের ছেলে শৌভিক সরকার। ১৭ বছরের স্কুল ছাত্রটি তাঁর সম্পর্কের জেঠু বাবলু সরকারের বাড়িতে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই মানুষ। মাগুরখালীতে হিন্দু ও মুসলিমরা নির্বিরোধে বছরের পর বছর বাস করেছেন এবং একে অপরের ধর্ম কে শ্রদ্ধা করেছেন, একে অপরের সুখ দুঃখের সাথী হয়েছেন। ঘটনার সূত্রপাত সোমবার  ৩ জুলাই ২০১৭ তে। বেশ কিছুদিন ধরেই শৌভিক ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপের দ্বারা পরিচালিত আরএসএস এর বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক প্রচারের শিকার হয় এবং মুসলমানদের ধর্মীয় স্থলের উপর একটি ন্যাক্কারজনক ছবি সহ পোস্ট সে নিজের ফেসবুকে শেয়ার করে, যা দেখে তাঁর মুসলমান সহপাঠীরা ক্ষিপ্ত হয় এবং শৌভিক কে ক্ষমা চেয়ে পোস্টটা ডিলিট করে দিতে অনুরোধ করে। কিন্তু শৌভিক ক্ষমাও চায়নি এবং পোস্টটি ডিলিট করতেও অস্বীকার করে, কারণ তখন আরএসএস এর কিছু লোক শৌভিককে অনুপ্রেরণা দেয় পোস্টটা ডিলিট না করতে।

সন্ধ্যে বেলায় প্রায় ২০০ জন বহিরাগত, যাঁদের অধিকাংশই অবাঙালী (যা উত্তর চব্বিশ পরগনার গ্রামাঞ্চলে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়) সেখানে হাজির হয় এবং শৌভিকের বাড়ির উপর আক্রমণ করা শুরু করে। স্থানীয় মাগুরখালী মিলন মসজিদের সভাপতি আমিরুল ইসলাম থেকে শুরু করে স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দারা এই বহিরাগত গুন্ডাদের আক্রমণ কে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন তবুও সংখ্যায় বা পেশী শক্তিতে তাঁরা পেরে ওঠেন না আর এই সুযোগে বাবলু সরকারের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা, যারা প্রত্যেকেই বহিরাগত ও “নারা--তকবির আল্লাহু-আকবর” স্লোগান দিতে দিতে আসে। তবে সেই বহিরাগত হামলাকারীদের হাত থেকে শৌভিক কে কিন্তু রক্ষা করেন এলাকার মুসলমানেরাই। তথাকথিত মুসলিম ধর্মরক্ষী বাহিনীর লাগানো আগুন নিভিয়ে বাবলু সরকারের বাড়ি কে কিন্তু এলাকার মুসলমানরাই রক্ষা করেন। শৌভিক কে পুলিশ পরে এসে যখন গ্রেফতার করে তখন সে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লুকিয়ে ছিল একটি পাট ক্ষেতে।

সেই সন্ধেবেলার বহিরাগতদের বাঁধানো ঝামেলার পরে কিন্তু মাগুরখালী গ্রামে আর কোন হিংসার ঘটনা ঘটেনি। তবে যদিও গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের মানুষই শৌভিকের অর্বাচীন কাজের সমালোচনা করেছেন, কেউই তাঁর উপর আক্রমণ বা পুলিশি পদক্ষেপ কে সমর্থন করছেন না, কারণ এর ফলে ওই কিশোরের ভবিষ্যতের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে বলে সবার বিশ্বাস। সাম্প্রদায়িক উস্কানি সত্বেও হিন্দু ও মুসলমানরা একসাথে বসে শৌভিক সরকারের বাড়িতে হওয়া আক্রমণের বিরোধিতা করেন ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরোধিতা করেন এবং আশা করেন যে গ্রামের ছেলে শীঘ্রই বাড়ি ফিরবে এবং পড়াশুনো ঠিক করে করবে।

যদিও হিন্দুদের একটি অংশ কিন্তু শৌভিকের উপর ক্ষিপ্ত তাঁর অপরিমাণদর্শিতার অভাবের কারণে এবং এই ভাবে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি মনের মধ্যে ঘৃণা পুষে রাখার কারণে। তবে গ্রামের মুসলমানেরা শৌভিকের কীর্তি কে কিন্তু বাচ্চা ছেলের কীর্তি বলে ধার্তব্যের মধ্যেই আনছেন না। আর তাই মাগুরখালীর অশান্তির ফলে তেঁতুলতলা, বাঁশপোতা থেকে শুরু করে ১৬ কিমি দূরের বসিরহাটে দাঙ্গা বাঁধলেও এই গ্রামের মানুষ নিজেদের ঐক্য কে পরস্পরের ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জাহির করে আরও শক্তিশালী করে তুলেছেন, কারণ তাঁরা বুঝেছেন যে এই হানাহানির সময়ে, এই ধরনের প্ররোচনার ও ষড়যন্ত্রের সময়ে, একমাত্র মানুষের ঐক্যই পারে অন্ধকারের শক্তি কে হারিয়ে দিতে।

শৌভিক সরকারের উপর আক্রমণ কারা করলো? গ্রাম বাংলার মাটিতে হঠাৎ করে এত অবাঙালির উৎপত্তি হলো কোথা থেকে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরের সাথে সাথে এ’ও জানা দরকার যে মুসলিম সমাজের একটা অংশ কে বোমা, লাঠি ও তলোয়ার দিয়ে কারা রুদ্রপুর বাজার, জঙ্গলপুর বাজার অবরোধ করতে মদত করে এবং কারা এই অবরোধ কে মুসলিমদের দ্বারা হিন্দুদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, হিন্দু মহিলার ধর্ষণ করা, হিন্দু জনগণ কে হত্যা করার মিথ্যা খবর বানিয়ে পরিস্থিতি কে আরও উত্তপ্ত করতে চার দিকে গুজব ছড়িয়েছিল? আর সেই গুজব শুনে পিস্তল, বোমা ও তলোয়ার নিয়ে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি ও কপালে লাল সিঁদুরের টিপ পড়ে কারা নানা  জায়গায় মুসলিমদের দোকান ও বাড়িতে আগুন লাগায়, বাস ও ট্রাক জ্বালিয়ে দেয় এবং রেল অবরোধ করে?

শৌভিকের বাড়িতে যাঁরা আগুন লাগাতে গেছিল তাঁদের এলাকার মানুষেরা কোন দিন দেখেননি, এবং তাঁদের বেশিরভাগ লোকই হিন্দি ভাষী ছিল। সেই আক্রমণকারীদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁরা যে সকলেই মুসলমান দুষ্কৃতী ছিল তারও কোন প্রমাণ নেই। মাগুরখালীর জনগণ এই হামলার কথা চাউর করেননি, মাগুরখালী গ্রামের মুসলমান যুবক বরং দমকল ডেকে বাবলু সরকারের বাড়ির আগুন নেভাতে নেমেছিলেন। তাহলে এই হিন্দি ভাষী আক্রমণকারীরা কাদের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে এসেছিল শৌভিক সরকারের বাড়িতে আগুন লাগাতে?

যদি আমরা ধরেও নিই যে শৌভিকের মুসলিম সহপাঠীরা দেগঙ্গার বেড়াচাঁপা অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়া অল ইন্ডিয়া সুন্নাত আল জামায়েত, অল ইন্ডিয়া মজলিস এ ইত্তেহাদুল মুসলিমীন, বা মাগরিবী বাঙাল আঞ্জুমান এ ওয়াজিন নামক কিছু সৌদি-মার্কিন অর্থে পরিচালিত সালাফি ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী সংগঠন কে ডেকে এনেছিল শৌভিকের বাড়িতে আগুন জ্বালাতে, তাহলেও প্রশ্ন হলো এত তাড়াতাড়ি এত বড় স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত করাতে পারলো মাত্র কয়েকজন স্কুল পড়ুয়া? যে ফেসবুক পোস্টটি কে নিয়ে এত ঝামেলা সেই পোস্টটিতে এমন কি ছিল যে সংখ্যাগুরু  সম্প্রদায়ের পাল্টা আক্রমণ, মাগুরখালী গ্রামের জনগণের প্রতিরোধ, এই সবের চিন্তা না করেই ২০০ জনের উপর অবাঙালী হঠাৎ বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুর সম্প্রীতির নীড় এই গ্রামে আক্রমণ করে?

অস্বীকার করে লাভ নেই যে রাজারহাট এলাকার মৌলবাদী তোষণের স্বার্থে পরিচালিত আলিয়াহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সালাফি ছাত্রদের সমর্থনে অনেক অশিক্ষিত ও অসামাজিক পেশায় লিপ্ত মুসলমানদের- যাঁদের বেশির ভাগই শাসক পার্টি তৃণমূলের ঝান্ডাধারী-সঙ্গে নিয়ে অল ইন্ডিয়া সুন্নাত আল জামায়েত সমগ্র রুদ্রপুর বাজার ও জঙ্গলপুর বাজারে প্রথমে অবরোধ করে এবং পুলিশ অবরোধ ওঠাতে আসলেই তাঁরা দাঙ্গা করা শুরু করে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কিছু দোকান আর রাস্তায় চলা বাস ও লরিতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় রাস্তায় নেমে মুসলিম জনগণ কে নিরস্ত হওয়ার জন্যে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের নেতারা, কিছু অন্য সুন্নি সংগঠনের নেতৃত্ব ও এলাকার পরিচিত মৌলবীরা।

পুলিশের সাথে দাঁড়িয়ে তাঁরা অনুরোধ করেন মুসলিমদের কোন প্ররোচনার ফাঁদে না পড়তে এবং দাঙ্গাকারী সালাফি গুন্ডাদের বিচ্ছিন্ন করতে। পরিস্থিতি যখন প্রায় নাগালের মধ্যে চলে আসছিল ঠিক তখনই বিজেপির প্রচার মাধ্যমের দ্বারা ঝুটো ভিডিও ও ছবি দেখিয়ে রাজ্যের ও দেশের সর্বত্রে মুসলিম বিদ্বেষ কে বাড়িয়ে তোলা শুরু হলো। মিথ্যা প্রচারের ঢোল তীব্র ভাবে পেটানো শুরু করে সংঘ পরিবারের ভাড়াটে বাহিনীরা। ইন্টারনেটের সাথে সাথে হাতে-হাত মিলিয়ে বিজেপির পা-চাটা দালাল অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক চ্যানেল, বিজেপি সাংসদ ও দুই নম্বরি কারবারি সুভাষ চন্দ্রের জি নিউজ এবং অন্য অনেক হিন্দুত্ববাদী টিভি চ্যানেল খবরটি কে বিকৃত করে প্রকাশ করা শুরু করে। তাঁরা দেখায় যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় না থাকার কারণে এখানকার হিন্দুরা অসুরক্ষিত এবং তাই বিজেপি কে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আনা চাই।

এই প্রচারের সাথে সাথেই কিন্তু শুরু হলো হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডব। এলাকায় এলাকায় বাইকে চড়ে, পিস্তল, বোমা ও তলোয়ার নিয়ে, মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে রাম ভক্ত হনুমানের দল কিন্তু শুরু করলো একের পর এক মুসলিম বস্তির উপর হামলা, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো পুলিশের জিপ, পাথর বর্ষণ করা হলো পুলিশের বড়কর্তাদের উপর। প্রায় সাতজন মুসলিম কে ভয়ানক ভাবে হামলা করে এই হিন্দুত্ববাদী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী, জ্বালিয়ে দেয় দোকান-বাজার আর লুটে নেয় গরিব মানুষের বাড়ি। হিন্দুত্ববাদীদের এই আক্রমণ কে হিন্দি ও ইংরাজী মিডিয়া কিন্তু সম্পূর্ণ রূপে অগোচরে নিয়ে যায় এবং সামনে রাখে শুধু -মুসলিম মৌলবাদের উথ্বানে বাংলা বিপন্ন - এই স্লোগান।

হিন্দুত্ববাদী অবাঙালী গুন্ডাদের বিরুদ্ধে কিন্তু দিকে দিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন খেটে খাওয়া হিন্দু ও মুসলিম জনগণ। দাঙ্গার সবচেয়ে ঘৃণ্য সময়ে তাঁরা কিন্তু বাংলা’র এক অদ্বিতীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির গড়লেন, তাঁরা কিন্তু দেখালেন যে হিন্দুত্ববাদীদের প্ররোচনা সত্বেও তাঁরা, গ্রাম বাংলার মানুষেরা, কিন্তু নিজেদের ঐক্য কে ভাঙতে দেবেন না। তাই হিন্দুত্ববাদী ভাড়াটে অবাঙালী দাঙ্গাবাজদের বাজার খারাপ হলো এবং তাঁদের বিক্ষিপ্ত হিংসা ও প্রচুর পরিমাণে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে নিজেদের কে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হলো।

আরএসএস বিভিন্ন প্রদেশ থেকে যে অবাঙালী লোকেদের নিয়ে এসেছে টাকা দিয়ে ভাড়া করে, তার থেকে প্রায় ২০০০-৩০০০ লোককে তাঁরা দেগঙ্গা,স্বরূপনগর, হিঙ্গলগঞ্জ, বাদুড়িয়া ও বসিরহাট অঞ্চলে পাঠায় দাঙ্গা লাগাতে। আর এদের চোখের সামনে দেখেও মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সেই বীর পুঙ্গব পুলিশ বাহিনী কিন্তু ভাঙড়ের মতন তাঁদের উপর নখ দাঁত খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, বরং মদত করেছে কাজ সেরে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে। ধরা পড়ে  শুধু শৌভিক সরকারের মতন নাবালক চুনোপুঁটিরা আর দিলীপ ঘোষ-তপন ঘোষের মতন ব্রাক্ষণত্ববাদী-ফ্যাসিবাদী লোকেরা থেকে যায় পুলিশের থেকে সহস্র যোজন দূরে। হালকা মেজাজে দলের রাজ্য দপ্তরে দিলীপ ঘোষ সংবাদ মাধ্যম কে নির্লজ্জের মতন নিজেদের ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা সব জাল ভিডিও দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে সমগ্র বাদুড়িয়ায় ও বসিরহাটে হিন্দুদের নাকি ভীষণ খারাপ অবস্থা।

মিলন মন্ডল, অভিরূপ মজুমদারের মতন কট্টর আরএসএস এর ভাড়াটে কর্মীরা ইন্টারনেটে কখনো বাংলাদেশের থেকে নেওয়া ছবি তো কখনো গুজরাট দাঙ্গার ছবি কে নির্লজ্জের মতন বাদুড়িয়া আর বসিরহাটের দাঙ্গা বলে চালাবার চেষ্টা করে। বজরং দলের লোকেরা সাদা কাগজের উপর শৌভিক সরকারের ফাঁসি চাই দাবিতে পোস্টার ছাপিয়ে নানা জায়গায় লাগিয়ে দেয় মুসলমানদের উপর দোষ চাপাতে আর খুঁজে খুঁজে মুসলমান গরুর মালিকদের হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দাঙ্গার আড়ালে। তবে যেহেতু রাজ্যটা হলো পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট বা উত্তর প্রদেশ নয়, তাই এই সকল চক্রান্তের সফল হওয়ার জায়গায় নানা ভাবে ধাক্কা খেতে হলো বিজেপি ও আরএসএস কে।

বসিরহাট - দুর্নীতিবাজ-দাঙ্গাবাজ বিজেপির গলার কাঁটা


রাজ্য বিজেপির পক্ষে বসিরহাট হয়ে উঠেছে গলার কাঁটা। অনেক দিন ধরে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়ে, জোতদার-জমিদারদের ভাড়াটে গুন্ডাদের একটা বড় অংশ কে নিজেদের দিকে টেনে এনে, সাবর্ণ লুম্পেন হিন্দুদের একটা বড় অংশ কে এবং নিচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগণ কে হিন্দুত্ববাদের শিবিরে এনে ২০১৫ সালে কোন ভাবে বসিরহাটের থেকে নিজেদের মোদী যুগের প্রথম বিজেপি বিধায়ক জিতিয়ে এনেছিল রাজ্য নেতৃত্ব।  তবে ২০১৬ সালে সেই বেলুন চুপসে যায়, যার ফলে বিজেপি পরে বৃহৎ সঙ্কটে।

বিজেপির বসিরহাটের নেতা বিকাশ সিংহ, নিজের সহচর সুজিত বিশ্বাস ও হিঙ্গলগঞ্জের নেতা জয়দেব বর্মন সহ অনেকের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে বসিরহাট-হিঙ্গলগঞ্জ সহ নানা জায়গার গরিব মানুষের থেকে টাকা নেন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। দাঙ্গা লাগার আগে, আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৩ই জুন ২০১৭ তে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিকাশ সিংহ-সুজিত বিশ্বাসেরা প্রায় ১২০০ গরিব পরিবার থেকে ঝুটো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ₹৪ লক্ষ করে তুলেছিলেন এবং সেই টাকা বেমালুম হাপিস করে দেন। ফলে যে গরিব মানুষগুলো চাষের জমি বন্দক দিয়ে বা চড়া সুদে নানা মহাজনের থেকে ঋণ  নিয়ে এত এত টাকা এই বিজেপি নেতাদের দিয়েছিলেন তাঁরা পড়েন অথৈ জলে।

সমগ্র বসিরহাট জুড়েই বিজেপির বিরুদ্ধে এক গণ বিক্ষোভ জাগ্রত হতে থাকে এবং এর ফলে কার্যত বাড়ি ছাড়া হয়ে থাকতে হয় বসিরহাটের বিজেপি নেতৃত্ব কে। বিজেপির মধ্যেই যারা এই টাকায় ভাগ পায়নি তাঁরা রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কাছে নালিশ করলেও কট্টর হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজটাও কিন্তু বিকাশ সিংহ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের পাশেই দাঁড়ায়। রাজ্য সরকার এই দুর্নীতির তদন্তের ভার রাজ্য সিআইডি’র হাতে তুলে দিয়েছে আর তার পরে এলাকায় বিজেপির উপর আরও চাপ বাড়ে এবং যে বসিরহাটের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে বেশ কয়েক বছর আগে দাপুটে দল হয়ে উঠেছিল বিজেপি, সেই বিজেপির অফিসে ধুপ ধুনো দেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া ভার হয়ে ওঠে।

নরেন্দ্র মোদী নিজে এসে বসিরহাটে প্রচার করে যাওয়া সত্বেও শমীক ভট্টাচার্যের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীর কাছে বেমালুম পরাজয় দেখিয়ে দিয়েছে যে বিজেপি এই অঞ্চলে ব্যাপক ভাবেই জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং এই পার্টির পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে এলাকায় নিজের প্রতিপত্তি পুনঃস্থাপন করার জন্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো ছাড়া আর কোন রাস্তা ছিল না।

বসিরহাট-হিঙ্গলগঞ্জ সহ নানা জায়গায় এমন বহু লোকের উপর আক্রমণ করা হয়েছে যাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন বা বিকাশ সিংহ, সুজিত বিশ্বাস বা জয়ন্ত বর্মনের মতন দুর্নীতিবাজ হিন্দুত্ববাদী ঠগদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আড়ালে বিজেপি ক্রমাগত ভাবে তৃণমূল কে পিছনে ঠেলে সমগ্র বসিরহাটে নিজের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে আর এই কাজে দিলীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ দুর্নীতিবাজ বিকাশ সিংহ এক মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।

মূলতঃ নিজেদের প্রতিপত্তিকে পুনঃস্থাপন করার জন্যে এবং বসিরহাটের ভাঙা সংগঠন কে জোড়া লাগাতেই আরএসএস এর নেতৃত্বে বিজেপি এই দাঙ্গার প্রস্তুতি করেছিল বিভিন্ন মাধ্যম কে ব্যবহার করে। সমগ্র অঞ্চলের চোরাচালানকারী, নারী পাচারকারী, শিশু পাচারকারীদের একত্রিত করে এক বিশাল বাহিনী আরএসএস তৈরি করেছে এবং তার সাথে জুড়েছে দুষ্কৃতীদের বাহিনী বজরং দল আর দাঙ্গাবাজ গোপাল পাঁঠার অনুগামী তপন ঘোষের হিন্দু সংহতি।
বাদুড়িয়া - বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও মুসলিম সংগঠনগুলির ভূমিকা

বাদুড়িয়া - বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও মুসলিম সংগঠনগুলির ভূমিকা



যদিও শৌভিক সরকারের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সামগ্রিক ভাবে সুন্নি মুসলমান সমাজের মধ্যে একটি উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তবে যে ভাবে কট্টর মৌলবাদী সংগঠনগুলির একটা বড় অংশ দাঙ্গা ও হাঙ্গামার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তা কিন্তু অভাবনীয় ছিল। বিশেষ করে অনেকগুলো সুন্নি মুসলমান সংগঠনের নেতারা যে ভাবে পুলিশের সাথে নেমে বিক্ষুব্ধ জনগণ কে শান্ত করার চেষ্টা করেন, তার থেকে অনেক তথাকথিত হিন্দু সংগঠনেরও অনেক শেখার আছে।

শৌভিকের ফাঁসির দাবিতে আর স্রেফ দাঙ্গা করে নিজেদের প্রতিপত্তি জাহির করতে চাওয়া সংগঠনগুলির কিন্তু লোকবল যেমন কম ছিল তেমনি এদের বেশির ভাগই ছিল বাইরের দল, যারা এলাকার সমাজবিরোধীদের পথে নামায়। হায়দ্রাবাদের নিজামের কুখ্যাত রাজাকার বাহিনীর স্রষ্টা যে দল, সেই অল ইন্ডিয়া মজলিশ এ ইত্তিহাদে মুসলিমীন বা এআইএমআইএম দলের কিন্তু এই দাঙ্গার পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে এলাকার মুসলমানরা মনে করছেন। ওয়াইসি নেতৃত্বকারী এই দলের সাথে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বহু মুসলমান সম্প্রদায় থেকে আসা চোরাচালানকারী যেমন যুক্ত ঠিক তেমনি যুক্ত কিছু মাছের ভেঁড়ির মালিক, ভিন রাজ্য থেকে আসা মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার মৌলবীরা, যাঁরা চরম ভাবে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি কে ঘৃণা করেন।

এআইএএমআইএম এর নেতৃত্বকারী ওয়াইসি ভ্রাতৃকূল এর আগেও সালাফীবাদের প্রচারের মাধ্যমে দেশের মুসলমানদের মধ্যে বিষাক্ত চেতনার বীজ রোপনের চেষ্টা করেছে এবং বহু অশিক্ষিত এবং পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের প্রতিপত্তি বিস্তার করে ওয়াইসি ভ্রাতৃকূল কিন্তু নানা রাজ্যে মুসলমান ভোট কে ভাগ করে বিজেপি ও আরএসএস কে সাহায্য করে দিয়েছে। বিহার এর নির্বাচনে ওয়াইসির ঝাঁপিয়ে পড়া কে অনেকে স্রেফ মনে করে দেখতে পারেন।

তবে একক ভাবে শুধু এআইএএমআইএম কে দোষ দিয়ে লাভ নেই, কারণ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত ও আশ্বাস না পেলে কিন্তু মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি কোনদিনই ঘুরে দাঁড়াতে পারতো না পশ্চিমবঙ্গের জমিতে। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদীদের চরম হারে মেরুকরণের অভিযান দেখিয়েও কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ভাবে মেরুকরণ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে আর তলে তলে মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলির সাথে তালমিল ঠিক রেখেই দাঙ্গার ছক কষছে আরএসএস-বজরং দল ও হিন্দু সংহতি।

বাদুড়িয়া-বসিরহাট দাঙ্গার শিক্ষা কি ? এই পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির কি করণীয়?


বাদুড়িয়া ও বসিরহাটের দাঙ্গার পরে রাজ্যে হিন্দু সংহতি ও এআইএএমআইএম এর সভা সমিতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আরও তাড়াতাড়ি নেগেটিভ পপুলারিটি বা নেতিবাচক জনপ্রিয়তা পেয়ে যাবে এই দুই ফ্যাসিবাদী সংগঠন। আজ এই দলগুলির সভা সমিতির উপর নিষেধাজ্ঞা না চাপিয়ে দরকার ছিল এই দলগুলোর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে মোকাবিলা করা আর সেই ক্ষেত্রে কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছে।

২০১১ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার সময়ে তাঁর পিছনে বলিষ্ঠ সমর্থন দিতে দাঁড়ায় হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের গত ছয় বছরের সরকারের মেয়াদে সবচেয়ে বেশি অক্সিজেন পেয়ে একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি। তপন ঘোষের মতন দাঙ্গাবাজরা পুলিশি সুরক্ষায় রাজ্য জুড়ে হিন্দুদের, বিশেষ করে গরিব ও পিছিয়ে থাকা হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে বারবার। শহর ও মফৎস্বল থেকে দূরে এবার গ্রামাঞ্চলের মাটিতে এরা আরএসএস ও বিজেপির স্বার্থে বিভাজনটি আরও চরম করতে চায়।

গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে আজ খুঁজে দেখতে হবে নিজেদের দুর্বলতাগুলো এবং সেগুলো কে আজ কাটাতে হবে যথার্থ ভাবে। তাঁদের আজ মানুষের কাছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পৌঁছাতে হবে কারণ আজ বিদ্যুৎ গতিতে কিন্তু আরএসএস বা সুন্নি সংগঠনগুলির ঘৃণা ভরা প্রচার তাঁদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই কিন্তু লোকে এই সমস্ত প্রচারে বিশ্বাস করে ফেলছেন এবং সেই তথ্যগুলো কে পুনরায় নতুন লোকেদের মধ্যে প্রচার করছেন।

সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে আজ বাদুড়িয়া-বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার থেকে শিক্ষা নিয়ে একটা জনপ্রিয় এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রচার মাধ্যম গড়ে তুলতে হবে, যাতে সমগ্র জনগণের কাছে যে কোন ঘটনার  একটি বিশদ, তথ্যপূর্ণ এবং সমালোচনা-মূলক প্রতিবেদন পেশ করা যায় এবং তার মাধ্যমে সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বৈরিতা সৃষ্টি কে রোখা যায়। আর এই কাজ করতে গেলে চাই সংগঠন ও মানুষের মধ্যে পৌঁছে যাবার প্রচেষ্টা।

আমাদের বুঝতে হবে যে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বা মৌলবাদ বেশি সর্বনাশী। দেখতে গেলে তো সব মৌলবাদী শক্তিই খারাপ তাহলে ভারতে প্রধান শত্রু হবে কে ? এর জন্যে দেখতে হবে যে ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে কোন সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তাহলে আমাদের সামনে আসবে হিন্দু সম্প্রদায় এবং এর মৌলবাদী অংশ যা হিন্দুত্ববাদ নামে পরিচিত। কেন হিন্দুত্ববাদ কে সবচেয়ে ভয়ানক বলে মানছি? কারণ যে কোন দেশের সাম্প্রদায়িক সংঘাতে বা মৌলবাদের বৃদ্ধিতে সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের যোগদান বেশি হয়। হিন্দুত্ববাদ কে যেমন আমরা পাকিস্তান বা বাংলাদেশে প্রধান শত্রু মানতে পারবো না তেমনিই আবার আমরা ভ্যাটিকান সিটিতে শিখ মৌলবাদের বিরোধিতা করতে যাব না।

হিন্দুত্ববাদের দাঙ্গা লাগাবার মূল পরিকল্পনা হলো যে এরা হিন্দুদের, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে একটি বিপন্ন ও দুর্বল সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণ কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উৎসাহ দিতে থাকে।  তাই প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিটি প্রতিনিধির আজ দরকার হলো তথ্য ও জ্ঞান এবং তাই দিয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষদের বোঝাতে হবে যে কেন তাঁরা নন, বরং দেশে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, দলিত ও আদিবাসীরা। আর এই কাজ তর্ক বিতর্ক করে সম্ভব নয়, সম্ভব শুধু মাত্র ভীষণ ধৈর্য সহকারে জনগণ কে বোঝানো মারফত। ট্রেনে-বাসে-অফিসে আর কারখানায় মানুষের সাথে কথা বলা দরকার, তাঁদের ভুল ধারণা ভাঙ্গা দরকার এবং যে মিথগুলো দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে শাসক শ্রেণী তা আজ ভাঙা দরকার।

প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি এই কাজগুলো করতে পারে যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে এবং ক্রমাগত প্রচার চালাবার জন্যে কর্মী পাওয়া যায়। আর এই প্রস্তুতি গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে আজ থেকেই করে যেতে হবে না হলে সামনে আরও অনেক বাদুড়িয়া -বসিরহাটের মতন ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও অশান্তি। আগামী বাংলা কে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার থেকে মুক্ত করতে, বাংলার সামগ্রিক খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ঐক্য কে দৃঢ় ভাবে স্থাপন করতে, অবাঙালী-বহিরাগত রক্তচোষা মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি, ফোঁড়ে, দালাল, সুদের কারবারীদের থেকে বাংলা কে রক্ষা করতে, আজ জনগণের গভীরে পৌঁছাতে হবে, তাঁদের সম্পূর্ণ সত্য বলতে হবে এবং সমস্ত ভোটপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির স্বরূপ এদের সামনে আনতে হবে। তবেই জনগণ কে একটি গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল আন্দোলনের পতাকাতলে সমবেত করে আরএসএস - বিজেপির মতন ঘৃণ্য দাঙ্গাবাজ মার্কিন দালাল শক্তি কে বাংলার মাটিতে পরাস্ত করা সম্ভব।  
    

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে