বাংলার মাটিতে দাঙ্গার চক্রান্ত চূর্ণ করতে ঐক্যবদ্ধ হোন

মঙ্গলবার, জুলাই ২৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-



একটা সামান্য ফেসবুক পোস্ট থেকে যে ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা সমগ্র বাদুড়িয়ায় শুরু হলো এবং ক্রমেই পৌঁছে গেল বসিরহাট ও সংলগ্ন স্বরূপনগর, হিঙ্গলগঞ্জ, দেগঙ্গা ও হাসনাবাদ অঞ্চলে,  তা দেখে মনে হলো যে এই সাম্প্রদায়িক হিংসার জন্যে জমি প্রস্তুত করা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। কারণ বিনা পরিকল্পনায় আর বিনা সাংগঠনিক প্রস্তুতিতে এই ধরণের সংগঠিত হিংসা ও দাঙ্গা ছড়ানো অসম্ভব হয়ে যায়। সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে একটা ফেসবুক শেয়ারের কয়েক ঘন্টার মধ্যে যে কাণ্ড গোটা বাদুড়িয়া অঞ্চলে হলো তার পিছনে রয়েছে গূঢ় অভিসন্ধি।

বসিরহাট-বাদুড়িয়া সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণ কি ? কেন হঠাৎ তেঁতে উঠে এমন তীব্র হিংসায় সামিল হলো এই অঞ্চলের লোকেরা? কেন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রশাসন ও দাপুটে তৃণমূলী হার্মাদ বাহিনী আজ ব্যাকফুটে চলে গেল? কি ভাবে তপন ঘোষ - জিষ্ণু বোসের মতন হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা উত্তর চব্বিশ পরগনার মতন কৃষক আন্দোলনের জেলায় নিজেদের আধিপত্য একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সরকার ও তথাকথিত বাম ও প্রগতিশীল শক্তির অগোচরে প্রতিষ্ঠা করতে পারলো? আর হঠাৎ করেই কি, একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই দাঙ্গা শুরু হলো? এর পিছনে কি কোন পরিকল্পনা বা সমন্বয় ছিল না ? যদি ছিল তাহলে কারা ছিল তার পিছনে? বিভিন্ন ধর্মীয় ও মৌলবাদী সংগঠনের এই দাঙ্গার পিছনে ভূমিকা কি ছিল? কেন পুলিশ নির্বাক দর্শক হয়ে বসিরহাট-বাদুড়িয়া কে জ্বলে যেতে দিল?


আপনি যদি বাংলা বা সর্ব ভারতীয় মিডিয়ার সংবাদ পরিবেশন দেখেন, হিন্দুত্ববাদী পেটোয়া মিডিয়া কে বাদ দিয়েই, তবে দেখবেন সব জায়গায় দেখানো হচ্ছে যে এই দাঙ্গা একটি স্বতঃস্ফূর্ত দাঙ্গা আর এর না কোন পরিকল্পনা ছিল, না কোন লক্ষ্য ছিল। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত একটি দাঙ্গা এক জায়গার থেকে শুরু হয়েও অন্য জায়গায় এত তাড়াতাড়ি কি করে ছড়িয়ে পড়লো আর কেনই বা পুলিশ বা প্রশাসন আধা সামরিক বাহিনীর সমর্থনে এই দাঙ্গা কে দমন করতে পারলো না? যেমন ওরা দমন করেছিল লালগড়ের জনগণের ন্যায়সঙ্গত লড়াইকে বা ভাঙড়ের কৃষকদের আন্দোলন কে, ঠিক সেই ভাবে প্রশাসন কেন নখ দাঁত বের করে দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে কেন ঝাঁপিয়ে পড়লো না? কেন যে ভাবে লাঠি চার্জ করে কিছুদিন আগেই যেভাবে নবান্ন অভিযানকারী বামফ্রন্টের কর্মীদের ক্ষত বিক্ষত করেছিল মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পুলিশ বাহিনী সেই ভাবে লাঠি চার্জ করে দাঙ্গাবাজদের হাড় ভাঙতে পারলো না ?

আসলে বাদুড়িয়া-বসিরহাটের দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতটা মোটেই কোন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নয় বা শৌভিক সরকারের মতন এক কিশোরের ফেসবুক পোস্ট সংক্রান্ত নয়, আসলে এগুলো হলো উপলক্ষ, দাঙ্গার কারণ লুকিয়ে আছে অন্যত্রে, যা এক বৃহৎ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ এবং কিছুটা হলেও স্থানীয় দুর্নীতির সাথে যুক্ত।


বাদুড়িয়া-বসিরহাট দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিত



ইছামতি নদীর পাড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে বছরের পর বছর এক সাথে বাস করেছেন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই শ্রমজীবি মানুষ। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্য কে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল কৃষকদের সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রাম ও শ্রমিক শ্রেণীর জঙ্গী আন্দোলন। এর ফলে অনেক চেষ্টা করেও গত শতাব্দীর ৬০ ও ৭০ এর দশকে এই অঞ্চলে কল্কে পায়নি সংঘ পরিবার বা অন্যান্য দাঙ্গাবাজ ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলো।

তবে ১৯৯০ এর  দশক থেকেই এই সমস্ত অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভেদের পটভূমি তৈরি করা শুরু হয়, এবং আশ্চর্যজনক ভাবে সেইদিন এই বিভাজন সৃষ্টির হোতা কিন্তু ছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস এর প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে তিনি বিজেপির হাত ধরেন এবং সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে নিজ প্রভাব বিস্তারের স্বার্থে তিনি ও তাঁর পার্টি - তৃণমূল কংগ্রেস সেদিন কিন্তু আরএসএস ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।

তৃণমূলের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধার কারণেই বিজেপির প্রথম বিধায়ক রাজ্য বিধানসভায় ১৯৯৯ সালে অশোকনগর উপনির্বাচন জিতে প্রবেশ করে। সেই সময়েই পশ্চিমবঙ্গের থেকে দুইজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয় বিজেপির আর রাজ্যে আস্ফালন বেড়ে চলে বিজেপির। যদিও বাম আমলে মুসলমানদের অবস্থা রাজ্যে ভীষণ করুন হয়, তবুও তৃণমূলের সাহায্যে সেই সময়ের থেকেই বিজেপি প্রচার করা শুরু  করে যে রাজ্যে মুসলমান তোষণ নাকি বেড়ে গেছে এবং হিন্দুদের থেকে নাকি মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হতে চলেছে। সেই বিষাক্ত প্রচার কে না তো তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার কোনদিন খন্ডন করেছিল আর না তৃণমূল কংগ্রেস বা জাতীয় কংগ্রেস।

২০১৪ সালের মোদী-ঢেউ যখন সারা ভারতে গেরুয়া রঙ লাগানো শুরু করলো, তখন পশ্চিমবঙ্গের থেকে আবার দুইটি আসন অনায়সে জিতে গেল বিজেপি আর সেই বিজয়ের ফলে আরএসএস এর নেতৃত্ব চরম উৎফুল্ল হয়, কারণ পশ্চিমবঙ্গ কে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও বিভাজনের মানচিত্রে না আনতে পারলে ব্রাক্ষণত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক কর্পোরেট-সামন্তবাদী ফ্যাসিবাদ কে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, কারণ পশ্চিমবঙ্গ, তামিল নাড়ু, কেরল, প্রভৃতি রাজ্য থেকেই ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী পায় সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবি পদাতিক বাহিনী কে।

বিজেপি ও আরএসএস এর পুনরুত্থানের পিছনে বসিরহাট এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল। ২০১৫ সালের বিধানসভা উপনির্বাচনে এই বসিরহাট থেকেই ভোটে জিতে বিধানসভায় প্রবেশ করেন শমীক ভট্টাচার্য। এই বসিরহাটের মাটিতে এসেই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার কে ফেলে বিজেপির সরকার গড়ার ডাক দিয়েছিলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, ২০১৬  সালের বিধানসভা নির্বাচনে গো-হারা হারতে হয় বিজেপি কে এই কেন্দ্রে।

তবে হিন্দুত্ববাদীদের ঘৃণ্য প্রচার পিছিয়ে থাকে না। বিশেষ করে প্রতিবেশী জেলায় জমি আন্দোলন শুরু হতেই কৃষক জনগণ কে জমি বা সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রাম থেকে দূরে রাখতে এবং বন্ধ কলকারখানার শ্রমিকদের কারখানা খোলার আন্দোলন বা চালু কারখানার শ্রমিকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে দূরে ঠেলে দিতে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরাইল ও মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার টাকায় চলা হিন্দু সংহতি, আরএসএস ও বজরং দল।

এই অঞ্চলে একই সময়ে গজিয়ে উঠেছে মার্কিন দালাল সৌদি আরবের টাকায় তৈরি হওয়া সালাফি জঙ্গী ইসলামের পাঠ শেখানোর মাদ্রাসা, এবং সেই মাদ্রাসা চালাতে বাইরের থেকে আসছে সালাফি ইসলামী মৌলানারা, যাঁদের শিরায়-উপশিরায় বইছে মার্কিন-ইসরাইল-সৌদি জোটের ছড়ানো ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষ। এই মৌলানা ও ইমামদের একটি বড় অংশই শাসক পার্টি তৃণমূলের শিবিরে জুটেছে এবং পার্টির নানা সেলের ছোট বড় নেতা হয়ে উঠেছে।

এলাকায় এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছে রাম ও হনুমানের মন্দির, যাঁর সাথে দিন-আনি-দিন-খাই শ্রমজীবি হিন্দুদের কোন কালেই কোন সম্পর্ক ছিল না। ইছামতির পাড়ে এই বাদুড়িয়া-বসিরহাট অঞ্চলের অনেক গ্রামে ধীরে ধীরে তলোয়ার ও লাঠি খেলা শেখানোর টোপ দিয়ে নিরীহ গরিব হিন্দু বাড়ির শিশু ও কিশোরদের নিয়ে আসে আরএসএস ও বজরং দলের কর্মীরা আর তারপর তাঁদের মন কে বিষিয়ে তোলানো হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে।

হাজারো হাজারো ঝুটো ভিডিও, ছবি ও বিকৃত তথ্য পরিবেশন করে হোয়াটস্যাপ ও ফেসবুকের মাধ্যমে হিন্দু যুব সমাজের একটা বড় অংশকেই মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে আরএসএস। কিন্তু বহু বছর ধরে এক সাথে বাস করা মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লাগানো বাংলার মাটিতে যে কঠিন সে কথা বুঝেছে আরএসএস আর তাই বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও পূর্ব উত্তর প্রদেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মী ও সমর্থকদের ভাড়া করে পশ্চিমবঙ্গে আনিয়েছে গেরুয়া বাহিনী। যেই মুহূর্তে যেখানে দাঙ্গার প্রয়োজন, সেই মুহূর্তে সেখানে দলে দলে লোক কে ট্রেনে বা ট্রাকে চাপিয়ে পাঠিয়েছে আরএসএস। বিএসএফ কে ব্যবহার করে রাজনাথ সিংহ আরএসএস এর হিন্দুত্বের বিষ কে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে গভীরে রোপন করার পরিকল্পনায় সহায়তা করার জন্যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করাচ্ছে জামাতি জঙ্গীদের, যাঁদের একটা বড় অংশ হিঙ্গলগঞ্জ ও দেগঙ্গায় আশ্রয় নিচ্ছে নানা ধরণের সুন্নি সংগঠনগুলোর শেল্টারে।


কিছুদিন আগেই, ঈদের পরের দিন, অর্থাৎ ২৭শে জুন - আরএসএস এর বেসরকারি বাংলা মুখপত্র দৈনিক যুগশঙ্খ প্রথম পৃষ্টায় একটি উস্কানি মূলক খবর ছাপে - ঈদের দিন বাদুড়িয়ার মসজিদে উড়লো পাকিস্তানের পতাকা। ছবিটি পত্রিকার কেউ তোলেনি, কারণ ছবিটি একটি মোবাইল থেকে তোলা হয়েছিল এবং পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা হয়েছিল। কোন হিন্দুত্ববাদী গ্রূপ থেকে ছবিটি পেয়েই প্রথম পাতায় বড় বড় করে কাল্পনিক তথ্য সহ দৈনিক যুগশঙ্খ এই খবরটি ছাপে, আর ছবিটিতে পাকিস্তানের ঝান্ডা বলে দেখানো হচ্ছে ইসলামিক ঝান্ডা কে, যার ধারে কোন সাদা পাড় নেই। এই রকম ঝুটো, অথচ জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী প্রথম পাতার খবর দেখে সেই সময়েই কিন্তু বাদুড়িয়ার মানুষ ও অন্যান্য জায়গার প্রগতিশীল ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ কিন্তু বুঝে গেছিলেন যে ধুলাগড় ও হাজীনগরের মতন এবার বাদুড়িয়া নিয়েও কোন চক্রান্ত আরএসএস ও বিজেপি ফেঁদেছে।


শৌভিক সরকার ও বাদুড়িয়ার দাঙ্গা 

শৌভিক সরকার কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ 

বাদুড়িয়ার রুদ্রপুরের মাগুরখালী গ্রামের ছেলে শৌভিক সরকার। ১৭ বছরের স্কুল ছাত্রটি তাঁর সম্পর্কের জেঠু বাবলু সরকারের বাড়িতে মা মারা যাওয়ার পর থেকেই মানুষ। মাগুরখালীতে হিন্দু ও মুসলিমরা নির্বিরোধে বছরের পর বছর বাস করেছেন এবং একে অপরের ধর্ম কে শ্রদ্ধা করেছেন, একে অপরের সুখ দুঃখের সাথী হয়েছেন। ঘটনার সূত্রপাত সোমবার  ৩ জুলাই ২০১৭ তে। বেশ কিছুদিন ধরেই শৌভিক ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপের দ্বারা পরিচালিত আরএসএস এর বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক প্রচারের শিকার হয় এবং মুসলমানদের ধর্মীয় স্থলের উপর একটি ন্যাক্কারজনক ছবি সহ পোস্ট সে নিজের ফেসবুকে শেয়ার করে, যা দেখে তাঁর মুসলমান সহপাঠীরা ক্ষিপ্ত হয় এবং শৌভিক কে ক্ষমা চেয়ে পোস্টটা ডিলিট করে দিতে অনুরোধ করে। কিন্তু শৌভিক ক্ষমাও চায়নি এবং পোস্টটি ডিলিট করতেও অস্বীকার করে, কারণ তখন আরএসএস এর কিছু লোক শৌভিককে অনুপ্রেরণা দেয় পোস্টটা ডিলিট না করতে।

সন্ধ্যে বেলায় প্রায় ২০০ জন বহিরাগত, যাঁদের অধিকাংশই অবাঙালী (যা উত্তর চব্বিশ পরগনার গ্রামাঞ্চলে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয়) সেখানে হাজির হয় এবং শৌভিকের বাড়ির উপর আক্রমণ করা শুরু করে। স্থানীয় মাগুরখালী মিলন মসজিদের সভাপতি আমিরুল ইসলাম থেকে শুরু করে স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দারা এই বহিরাগত গুন্ডাদের আক্রমণ কে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন তবুও সংখ্যায় বা পেশী শক্তিতে তাঁরা পেরে ওঠেন না আর এই সুযোগে বাবলু সরকারের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা, যারা প্রত্যেকেই বহিরাগত ও “নারা--তকবির আল্লাহু-আকবর” স্লোগান দিতে দিতে আসে। তবে সেই বহিরাগত হামলাকারীদের হাত থেকে শৌভিক কে কিন্তু রক্ষা করেন এলাকার মুসলমানেরাই। তথাকথিত মুসলিম ধর্মরক্ষী বাহিনীর লাগানো আগুন নিভিয়ে বাবলু সরকারের বাড়ি কে কিন্তু এলাকার মুসলমানরাই রক্ষা করেন। শৌভিক কে পুলিশ পরে এসে যখন গ্রেফতার করে তখন সে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লুকিয়ে ছিল একটি পাট ক্ষেতে।

সেই সন্ধেবেলার বহিরাগতদের বাঁধানো ঝামেলার পরে কিন্তু মাগুরখালী গ্রামে আর কোন হিংসার ঘটনা ঘটেনি। তবে যদিও গ্রামের দুই সম্প্রদায়ের মানুষই শৌভিকের অর্বাচীন কাজের সমালোচনা করেছেন, কেউই তাঁর উপর আক্রমণ বা পুলিশি পদক্ষেপ কে সমর্থন করছেন না, কারণ এর ফলে ওই কিশোরের ভবিষ্যতের উপর খারাপ প্রভাব পড়বে বলে সবার বিশ্বাস। সাম্প্রদায়িক উস্কানি সত্বেও হিন্দু ও মুসলমানরা একসাথে বসে শৌভিক সরকারের বাড়িতে হওয়া আক্রমণের বিরোধিতা করেন ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরোধিতা করেন এবং আশা করেন যে গ্রামের ছেলে শীঘ্রই বাড়ি ফিরবে এবং পড়াশুনো ঠিক করে করবে।

যদিও হিন্দুদের একটি অংশ কিন্তু শৌভিকের উপর ক্ষিপ্ত তাঁর অপরিমাণদর্শিতার অভাবের কারণে এবং এই ভাবে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি মনের মধ্যে ঘৃণা পুষে রাখার কারণে। তবে গ্রামের মুসলমানেরা শৌভিকের কীর্তি কে কিন্তু বাচ্চা ছেলের কীর্তি বলে ধার্তব্যের মধ্যেই আনছেন না। আর তাই মাগুরখালীর অশান্তির ফলে তেঁতুলতলা, বাঁশপোতা থেকে শুরু করে ১৬ কিমি দূরের বসিরহাটে দাঙ্গা বাঁধলেও এই গ্রামের মানুষ নিজেদের ঐক্য কে পরস্পরের ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জাহির করে আরও শক্তিশালী করে তুলেছেন, কারণ তাঁরা বুঝেছেন যে এই হানাহানির সময়ে, এই ধরনের প্ররোচনার ও ষড়যন্ত্রের সময়ে, একমাত্র মানুষের ঐক্যই পারে অন্ধকারের শক্তি কে হারিয়ে দিতে।

শৌভিক সরকারের উপর আক্রমণ কারা করলো? গ্রাম বাংলার মাটিতে হঠাৎ করে এত অবাঙালির উৎপত্তি হলো কোথা থেকে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরের সাথে সাথে এ’ও জানা দরকার যে মুসলিম সমাজের একটা অংশ কে বোমা, লাঠি ও তলোয়ার দিয়ে কারা রুদ্রপুর বাজার, জঙ্গলপুর বাজার অবরোধ করতে মদত করে এবং কারা এই অবরোধ কে মুসলিমদের দ্বারা হিন্দুদের ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, হিন্দু মহিলার ধর্ষণ করা, হিন্দু জনগণ কে হত্যা করার মিথ্যা খবর বানিয়ে পরিস্থিতি কে আরও উত্তপ্ত করতে চার দিকে গুজব ছড়িয়েছিল? আর সেই গুজব শুনে পিস্তল, বোমা ও তলোয়ার নিয়ে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি ও কপালে লাল সিঁদুরের টিপ পড়ে কারা নানা  জায়গায় মুসলিমদের দোকান ও বাড়িতে আগুন লাগায়, বাস ও ট্রাক জ্বালিয়ে দেয় এবং রেল অবরোধ করে?

শৌভিকের বাড়িতে যাঁরা আগুন লাগাতে গেছিল তাঁদের এলাকার মানুষেরা কোন দিন দেখেননি, এবং তাঁদের বেশিরভাগ লোকই হিন্দি ভাষী ছিল। সেই আক্রমণকারীদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁরা যে সকলেই মুসলমান দুষ্কৃতী ছিল তারও কোন প্রমাণ নেই। মাগুরখালীর জনগণ এই হামলার কথা চাউর করেননি, মাগুরখালী গ্রামের মুসলমান যুবক বরং দমকল ডেকে বাবলু সরকারের বাড়ির আগুন নেভাতে নেমেছিলেন। তাহলে এই হিন্দি ভাষী আক্রমণকারীরা কাদের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে এসেছিল শৌভিক সরকারের বাড়িতে আগুন লাগাতে?

যদি আমরা ধরেও নিই যে শৌভিকের মুসলিম সহপাঠীরা দেগঙ্গার বেড়াচাঁপা অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়া অল ইন্ডিয়া সুন্নাত আল জামায়েত, অল ইন্ডিয়া মজলিস এ ইত্তেহাদুল মুসলিমীন, বা মাগরিবী বাঙাল আঞ্জুমান এ ওয়াজিন নামক কিছু সৌদি-মার্কিন অর্থে পরিচালিত সালাফি ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী সংগঠন কে ডেকে এনেছিল শৌভিকের বাড়িতে আগুন জ্বালাতে, তাহলেও প্রশ্ন হলো এত তাড়াতাড়ি এত বড় স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত করাতে পারলো মাত্র কয়েকজন স্কুল পড়ুয়া? যে ফেসবুক পোস্টটি কে নিয়ে এত ঝামেলা সেই পোস্টটিতে এমন কি ছিল যে সংখ্যাগুরু  সম্প্রদায়ের পাল্টা আক্রমণ, মাগুরখালী গ্রামের জনগণের প্রতিরোধ, এই সবের চিন্তা না করেই ২০০ জনের উপর অবাঙালী হঠাৎ বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুর সম্প্রীতির নীড় এই গ্রামে আক্রমণ করে?

অস্বীকার করে লাভ নেই যে রাজারহাট এলাকার মৌলবাদী তোষণের স্বার্থে পরিচালিত আলিয়াহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সালাফি ছাত্রদের সমর্থনে অনেক অশিক্ষিত ও অসামাজিক পেশায় লিপ্ত মুসলমানদের- যাঁদের বেশির ভাগই শাসক পার্টি তৃণমূলের ঝান্ডাধারী-সঙ্গে নিয়ে অল ইন্ডিয়া সুন্নাত আল জামায়েত সমগ্র রুদ্রপুর বাজার ও জঙ্গলপুর বাজারে প্রথমে অবরোধ করে এবং পুলিশ অবরোধ ওঠাতে আসলেই তাঁরা দাঙ্গা করা শুরু করে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কিছু দোকান আর রাস্তায় চলা বাস ও লরিতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় রাস্তায় নেমে মুসলিম জনগণ কে নিরস্ত হওয়ার জন্যে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেলের নেতারা, কিছু অন্য সুন্নি সংগঠনের নেতৃত্ব ও এলাকার পরিচিত মৌলবীরা।

পুলিশের সাথে দাঁড়িয়ে তাঁরা অনুরোধ করেন মুসলিমদের কোন প্ররোচনার ফাঁদে না পড়তে এবং দাঙ্গাকারী সালাফি গুন্ডাদের বিচ্ছিন্ন করতে। পরিস্থিতি যখন প্রায় নাগালের মধ্যে চলে আসছিল ঠিক তখনই বিজেপির প্রচার মাধ্যমের দ্বারা ঝুটো ভিডিও ও ছবি দেখিয়ে রাজ্যের ও দেশের সর্বত্রে মুসলিম বিদ্বেষ কে বাড়িয়ে তোলা শুরু হলো। মিথ্যা প্রচারের ঢোল তীব্র ভাবে পেটানো শুরু করে সংঘ পরিবারের ভাড়াটে বাহিনীরা। ইন্টারনেটের সাথে সাথে হাতে-হাত মিলিয়ে বিজেপির পা-চাটা দালাল অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক চ্যানেল, বিজেপি সাংসদ ও দুই নম্বরি কারবারি সুভাষ চন্দ্রের জি নিউজ এবং অন্য অনেক হিন্দুত্ববাদী টিভি চ্যানেল খবরটি কে বিকৃত করে প্রকাশ করা শুরু করে। তাঁরা দেখায় যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় না থাকার কারণে এখানকার হিন্দুরা অসুরক্ষিত এবং তাই বিজেপি কে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আনা চাই।

এই প্রচারের সাথে সাথেই কিন্তু শুরু হলো হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডব। এলাকায় এলাকায় বাইকে চড়ে, পিস্তল, বোমা ও তলোয়ার নিয়ে, মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে রাম ভক্ত হনুমানের দল কিন্তু শুরু করলো একের পর এক মুসলিম বস্তির উপর হামলা, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো পুলিশের জিপ, পাথর বর্ষণ করা হলো পুলিশের বড়কর্তাদের উপর। প্রায় সাতজন মুসলিম কে ভয়ানক ভাবে হামলা করে এই হিন্দুত্ববাদী ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী, জ্বালিয়ে দেয় দোকান-বাজার আর লুটে নেয় গরিব মানুষের বাড়ি। হিন্দুত্ববাদীদের এই আক্রমণ কে হিন্দি ও ইংরাজী মিডিয়া কিন্তু সম্পূর্ণ রূপে অগোচরে নিয়ে যায় এবং সামনে রাখে শুধু -মুসলিম মৌলবাদের উথ্বানে বাংলা বিপন্ন - এই স্লোগান।

হিন্দুত্ববাদী অবাঙালী গুন্ডাদের বিরুদ্ধে কিন্তু দিকে দিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন খেটে খাওয়া হিন্দু ও মুসলিম জনগণ। দাঙ্গার সবচেয়ে ঘৃণ্য সময়ে তাঁরা কিন্তু বাংলা’র এক অদ্বিতীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির গড়লেন, তাঁরা কিন্তু দেখালেন যে হিন্দুত্ববাদীদের প্ররোচনা সত্বেও তাঁরা, গ্রাম বাংলার মানুষেরা, কিন্তু নিজেদের ঐক্য কে ভাঙতে দেবেন না। তাই হিন্দুত্ববাদী ভাড়াটে অবাঙালী দাঙ্গাবাজদের বাজার খারাপ হলো এবং তাঁদের বিক্ষিপ্ত হিংসা ও প্রচুর পরিমাণে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে নিজেদের কে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হলো।

আরএসএস বিভিন্ন প্রদেশ থেকে যে অবাঙালী লোকেদের নিয়ে এসেছে টাকা দিয়ে ভাড়া করে, তার থেকে প্রায় ২০০০-৩০০০ লোককে তাঁরা দেগঙ্গা,স্বরূপনগর, হিঙ্গলগঞ্জ, বাদুড়িয়া ও বসিরহাট অঞ্চলে পাঠায় দাঙ্গা লাগাতে। আর এদের চোখের সামনে দেখেও মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সেই বীর পুঙ্গব পুলিশ বাহিনী কিন্তু ভাঙড়ের মতন তাঁদের উপর নখ দাঁত খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, বরং মদত করেছে কাজ সেরে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে। ধরা পড়ে  শুধু শৌভিক সরকারের মতন নাবালক চুনোপুঁটিরা আর দিলীপ ঘোষ-তপন ঘোষের মতন ব্রাক্ষণত্ববাদী-ফ্যাসিবাদী লোকেরা থেকে যায় পুলিশের থেকে সহস্র যোজন দূরে। হালকা মেজাজে দলের রাজ্য দপ্তরে দিলীপ ঘোষ সংবাদ মাধ্যম কে নির্লজ্জের মতন নিজেদের ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা সব জাল ভিডিও দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে সমগ্র বাদুড়িয়ায় ও বসিরহাটে হিন্দুদের নাকি ভীষণ খারাপ অবস্থা।

মিলন মন্ডল, অভিরূপ মজুমদারের মতন কট্টর আরএসএস এর ভাড়াটে কর্মীরা ইন্টারনেটে কখনো বাংলাদেশের থেকে নেওয়া ছবি তো কখনো গুজরাট দাঙ্গার ছবি কে নির্লজ্জের মতন বাদুড়িয়া আর বসিরহাটের দাঙ্গা বলে চালাবার চেষ্টা করে। বজরং দলের লোকেরা সাদা কাগজের উপর শৌভিক সরকারের ফাঁসি চাই দাবিতে পোস্টার ছাপিয়ে নানা জায়গায় লাগিয়ে দেয় মুসলমানদের উপর দোষ চাপাতে আর খুঁজে খুঁজে মুসলমান গরুর মালিকদের হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দাঙ্গার আড়ালে। তবে যেহেতু রাজ্যটা হলো পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট বা উত্তর প্রদেশ নয়, তাই এই সকল চক্রান্তের সফল হওয়ার জায়গায় নানা ভাবে ধাক্কা খেতে হলো বিজেপি ও আরএসএস কে।

বসিরহাট - দুর্নীতিবাজ-দাঙ্গাবাজ বিজেপির গলার কাঁটা


রাজ্য বিজেপির পক্ষে বসিরহাট হয়ে উঠেছে গলার কাঁটা। অনেক দিন ধরে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়ে, জোতদার-জমিদারদের ভাড়াটে গুন্ডাদের একটা বড় অংশ কে নিজেদের দিকে টেনে এনে, সাবর্ণ লুম্পেন হিন্দুদের একটা বড় অংশ কে এবং নিচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগণ কে হিন্দুত্ববাদের শিবিরে এনে ২০১৫ সালে কোন ভাবে বসিরহাটের থেকে নিজেদের মোদী যুগের প্রথম বিজেপি বিধায়ক জিতিয়ে এনেছিল রাজ্য নেতৃত্ব।  তবে ২০১৬ সালে সেই বেলুন চুপসে যায়, যার ফলে বিজেপি পরে বৃহৎ সঙ্কটে।

বিজেপির বসিরহাটের নেতা বিকাশ সিংহ, নিজের সহচর সুজিত বিশ্বাস ও হিঙ্গলগঞ্জের নেতা জয়দেব বর্মন সহ অনেকের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করে বসিরহাট-হিঙ্গলগঞ্জ সহ নানা জায়গার গরিব মানুষের থেকে টাকা নেন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। দাঙ্গা লাগার আগে, আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৩ই জুন ২০১৭ তে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিকাশ সিংহ-সুজিত বিশ্বাসেরা প্রায় ১২০০ গরিব পরিবার থেকে ঝুটো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ₹৪ লক্ষ করে তুলেছিলেন এবং সেই টাকা বেমালুম হাপিস করে দেন। ফলে যে গরিব মানুষগুলো চাষের জমি বন্দক দিয়ে বা চড়া সুদে নানা মহাজনের থেকে ঋণ  নিয়ে এত এত টাকা এই বিজেপি নেতাদের দিয়েছিলেন তাঁরা পড়েন অথৈ জলে।

সমগ্র বসিরহাট জুড়েই বিজেপির বিরুদ্ধে এক গণ বিক্ষোভ জাগ্রত হতে থাকে এবং এর ফলে কার্যত বাড়ি ছাড়া হয়ে থাকতে হয় বসিরহাটের বিজেপি নেতৃত্ব কে। বিজেপির মধ্যেই যারা এই টাকায় ভাগ পায়নি তাঁরা রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের কাছে নালিশ করলেও কট্টর হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজটাও কিন্তু বিকাশ সিংহ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের পাশেই দাঁড়ায়। রাজ্য সরকার এই দুর্নীতির তদন্তের ভার রাজ্য সিআইডি’র হাতে তুলে দিয়েছে আর তার পরে এলাকায় বিজেপির উপর আরও চাপ বাড়ে এবং যে বসিরহাটের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে বেশ কয়েক বছর আগে দাপুটে দল হয়ে উঠেছিল বিজেপি, সেই বিজেপির অফিসে ধুপ ধুনো দেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া ভার হয়ে ওঠে।

নরেন্দ্র মোদী নিজে এসে বসিরহাটে প্রচার করে যাওয়া সত্বেও শমীক ভট্টাচার্যের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থীর কাছে বেমালুম পরাজয় দেখিয়ে দিয়েছে যে বিজেপি এই অঞ্চলে ব্যাপক ভাবেই জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং এই পার্টির পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে এলাকায় নিজের প্রতিপত্তি পুনঃস্থাপন করার জন্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো ছাড়া আর কোন রাস্তা ছিল না।

বসিরহাট-হিঙ্গলগঞ্জ সহ নানা জায়গায় এমন বহু লোকের উপর আক্রমণ করা হয়েছে যাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন বা বিকাশ সিংহ, সুজিত বিশ্বাস বা জয়ন্ত বর্মনের মতন দুর্নীতিবাজ হিন্দুত্ববাদী ঠগদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আড়ালে বিজেপি ক্রমাগত ভাবে তৃণমূল কে পিছনে ঠেলে সমগ্র বসিরহাটে নিজের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে আর এই কাজে দিলীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ দুর্নীতিবাজ বিকাশ সিংহ এক মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।

মূলতঃ নিজেদের প্রতিপত্তিকে পুনঃস্থাপন করার জন্যে এবং বসিরহাটের ভাঙা সংগঠন কে জোড়া লাগাতেই আরএসএস এর নেতৃত্বে বিজেপি এই দাঙ্গার প্রস্তুতি করেছিল বিভিন্ন মাধ্যম কে ব্যবহার করে। সমগ্র অঞ্চলের চোরাচালানকারী, নারী পাচারকারী, শিশু পাচারকারীদের একত্রিত করে এক বিশাল বাহিনী আরএসএস তৈরি করেছে এবং তার সাথে জুড়েছে দুষ্কৃতীদের বাহিনী বজরং দল আর দাঙ্গাবাজ গোপাল পাঁঠার অনুগামী তপন ঘোষের হিন্দু সংহতি।
বাদুড়িয়া - বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও মুসলিম সংগঠনগুলির ভূমিকা

বাদুড়িয়া - বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও মুসলিম সংগঠনগুলির ভূমিকা



যদিও শৌভিক সরকারের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সামগ্রিক ভাবে সুন্নি মুসলমান সমাজের মধ্যে একটি উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তবে যে ভাবে কট্টর মৌলবাদী সংগঠনগুলির একটা বড় অংশ দাঙ্গা ও হাঙ্গামার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তা কিন্তু অভাবনীয় ছিল। বিশেষ করে অনেকগুলো সুন্নি মুসলমান সংগঠনের নেতারা যে ভাবে পুলিশের সাথে নেমে বিক্ষুব্ধ জনগণ কে শান্ত করার চেষ্টা করেন, তার থেকে অনেক তথাকথিত হিন্দু সংগঠনেরও অনেক শেখার আছে।

শৌভিকের ফাঁসির দাবিতে আর স্রেফ দাঙ্গা করে নিজেদের প্রতিপত্তি জাহির করতে চাওয়া সংগঠনগুলির কিন্তু লোকবল যেমন কম ছিল তেমনি এদের বেশির ভাগই ছিল বাইরের দল, যারা এলাকার সমাজবিরোধীদের পথে নামায়। হায়দ্রাবাদের নিজামের কুখ্যাত রাজাকার বাহিনীর স্রষ্টা যে দল, সেই অল ইন্ডিয়া মজলিশ এ ইত্তিহাদে মুসলিমীন বা এআইএমআইএম দলের কিন্তু এই দাঙ্গার পিছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে এলাকার মুসলমানরা মনে করছেন। ওয়াইসি নেতৃত্বকারী এই দলের সাথে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বহু মুসলমান সম্প্রদায় থেকে আসা চোরাচালানকারী যেমন যুক্ত ঠিক তেমনি যুক্ত কিছু মাছের ভেঁড়ির মালিক, ভিন রাজ্য থেকে আসা মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার মৌলবীরা, যাঁরা চরম ভাবে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি কে ঘৃণা করেন।

এআইএএমআইএম এর নেতৃত্বকারী ওয়াইসি ভ্রাতৃকূল এর আগেও সালাফীবাদের প্রচারের মাধ্যমে দেশের মুসলমানদের মধ্যে বিষাক্ত চেতনার বীজ রোপনের চেষ্টা করেছে এবং বহু অশিক্ষিত এবং পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের প্রতিপত্তি বিস্তার করে ওয়াইসি ভ্রাতৃকূল কিন্তু নানা রাজ্যে মুসলমান ভোট কে ভাগ করে বিজেপি ও আরএসএস কে সাহায্য করে দিয়েছে। বিহার এর নির্বাচনে ওয়াইসির ঝাঁপিয়ে পড়া কে অনেকে স্রেফ মনে করে দেখতে পারেন।

তবে একক ভাবে শুধু এআইএএমআইএম কে দোষ দিয়ে লাভ নেই, কারণ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের প্রচ্ছন্ন মদত ও আশ্বাস না পেলে কিন্তু মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি কোনদিনই ঘুরে দাঁড়াতে পারতো না পশ্চিমবঙ্গের জমিতে। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদীদের চরম হারে মেরুকরণের অভিযান দেখিয়েও কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ভাবে মেরুকরণ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে আর তলে তলে মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলির সাথে তালমিল ঠিক রেখেই দাঙ্গার ছক কষছে আরএসএস-বজরং দল ও হিন্দু সংহতি।

বাদুড়িয়া-বসিরহাট দাঙ্গার শিক্ষা কি ? এই পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির কি করণীয়?


বাদুড়িয়া ও বসিরহাটের দাঙ্গার পরে রাজ্যে হিন্দু সংহতি ও এআইএএমআইএম এর সভা সমিতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আরও তাড়াতাড়ি নেগেটিভ পপুলারিটি বা নেতিবাচক জনপ্রিয়তা পেয়ে যাবে এই দুই ফ্যাসিবাদী সংগঠন। আজ এই দলগুলির সভা সমিতির উপর নিষেধাজ্ঞা না চাপিয়ে দরকার ছিল এই দলগুলোর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে মোকাবিলা করা আর সেই ক্ষেত্রে কিন্তু মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার হাত গুটিয়ে বসে আছে।

২০১১ সালে মমতা বন্দোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার সময়ে তাঁর পিছনে বলিষ্ঠ সমর্থন দিতে দাঁড়ায় হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের গত ছয় বছরের সরকারের মেয়াদে সবচেয়ে বেশি অক্সিজেন পেয়ে একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলি। তপন ঘোষের মতন দাঙ্গাবাজরা পুলিশি সুরক্ষায় রাজ্য জুড়ে হিন্দুদের, বিশেষ করে গরিব ও পিছিয়ে থাকা হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে বারবার। শহর ও মফৎস্বল থেকে দূরে এবার গ্রামাঞ্চলের মাটিতে এরা আরএসএস ও বিজেপির স্বার্থে বিভাজনটি আরও চরম করতে চায়।

গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে আজ খুঁজে দেখতে হবে নিজেদের দুর্বলতাগুলো এবং সেগুলো কে আজ কাটাতে হবে যথার্থ ভাবে। তাঁদের আজ মানুষের কাছে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পৌঁছাতে হবে কারণ আজ বিদ্যুৎ গতিতে কিন্তু আরএসএস বা সুন্নি সংগঠনগুলির ঘৃণা ভরা প্রচার তাঁদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই কিন্তু লোকে এই সমস্ত প্রচারে বিশ্বাস করে ফেলছেন এবং সেই তথ্যগুলো কে পুনরায় নতুন লোকেদের মধ্যে প্রচার করছেন।

সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে আজ বাদুড়িয়া-বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার থেকে শিক্ষা নিয়ে একটা জনপ্রিয় এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রচার মাধ্যম গড়ে তুলতে হবে, যাতে সমগ্র জনগণের কাছে যে কোন ঘটনার  একটি বিশদ, তথ্যপূর্ণ এবং সমালোচনা-মূলক প্রতিবেদন পেশ করা যায় এবং তার মাধ্যমে সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বৈরিতা সৃষ্টি কে রোখা যায়। আর এই কাজ করতে গেলে চাই সংগঠন ও মানুষের মধ্যে পৌঁছে যাবার প্রচেষ্টা।

আমাদের বুঝতে হবে যে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বা মৌলবাদ বেশি সর্বনাশী। দেখতে গেলে তো সব মৌলবাদী শক্তিই খারাপ তাহলে ভারতে প্রধান শত্রু হবে কে ? এর জন্যে দেখতে হবে যে ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে কোন সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। তাহলে আমাদের সামনে আসবে হিন্দু সম্প্রদায় এবং এর মৌলবাদী অংশ যা হিন্দুত্ববাদ নামে পরিচিত। কেন হিন্দুত্ববাদ কে সবচেয়ে ভয়ানক বলে মানছি? কারণ যে কোন দেশের সাম্প্রদায়িক সংঘাতে বা মৌলবাদের বৃদ্ধিতে সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের যোগদান বেশি হয়। হিন্দুত্ববাদ কে যেমন আমরা পাকিস্তান বা বাংলাদেশে প্রধান শত্রু মানতে পারবো না তেমনিই আবার আমরা ভ্যাটিকান সিটিতে শিখ মৌলবাদের বিরোধিতা করতে যাব না।

হিন্দুত্ববাদের দাঙ্গা লাগাবার মূল পরিকল্পনা হলো যে এরা হিন্দুদের, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে একটি বিপন্ন ও দুর্বল সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণ কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে, খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উৎসাহ দিতে থাকে।  তাই প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতিটি প্রতিনিধির আজ দরকার হলো তথ্য ও জ্ঞান এবং তাই দিয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষদের বোঝাতে হবে যে কেন তাঁরা নন, বরং দেশে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, দলিত ও আদিবাসীরা। আর এই কাজ তর্ক বিতর্ক করে সম্ভব নয়, সম্ভব শুধু মাত্র ভীষণ ধৈর্য সহকারে জনগণ কে বোঝানো মারফত। ট্রেনে-বাসে-অফিসে আর কারখানায় মানুষের সাথে কথা বলা দরকার, তাঁদের ভুল ধারণা ভাঙ্গা দরকার এবং যে মিথগুলো দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে শাসক শ্রেণী তা আজ ভাঙা দরকার।

প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি এই কাজগুলো করতে পারে যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে এবং ক্রমাগত প্রচার চালাবার জন্যে কর্মী পাওয়া যায়। আর এই প্রস্তুতি গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে আজ থেকেই করে যেতে হবে না হলে সামনে আরও অনেক বাদুড়িয়া -বসিরহাটের মতন ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও অশান্তি। আগামী বাংলা কে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার থেকে মুক্ত করতে, বাংলার সামগ্রিক খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ঐক্য কে দৃঢ় ভাবে স্থাপন করতে, অবাঙালী-বহিরাগত রক্তচোষা মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি, ফোঁড়ে, দালাল, সুদের কারবারীদের থেকে বাংলা কে রক্ষা করতে, আজ জনগণের গভীরে পৌঁছাতে হবে, তাঁদের সম্পূর্ণ সত্য বলতে হবে এবং সমস্ত ভোটপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির স্বরূপ এদের সামনে আনতে হবে। তবেই জনগণ কে একটি গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল আন্দোলনের পতাকাতলে সমবেত করে আরএসএস - বিজেপির মতন ঘৃণ্য দাঙ্গাবাজ মার্কিন দালাল শক্তি কে বাংলার মাটিতে পরাস্ত করা সম্ভব।  
    

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে