সরোজ দত্ত : অমরত্বের ৫০ বছরেও যার কলম কে ভয় করে শাসকশ্রেণী

বৃহস্পতিবার, আগস্ট ০৫, ২০২১ 0 Comments A+ a-


সেই মধ্যরাতে কোন গগনভেদী চিৎকার কেউই শুনতে পায়নি, কারণ তিনি ক্রন্দনরত অবস্থায় প্রাণ ত্যাগ করেননি। নেতা ছিলেন, তাই নেতার মতন মৃত্যু বরণ করেছিলেন। মাথা উঁচু করে জীবন দান করেন তাঁর স্বপ্নের সুন্দর সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। তাই তাঁর উদ্ধত শির কেটে নিয়ে গেছিল রাষ্ট্রীয় ঘাতক বাহিনী আর সেই মাথা বিগত ৫০ বছরে খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাঁকেও পাওয়া যায়নি, রাষ্ট্রের হাতে খুন হলেও তিনি রাষ্ট্রের খাতায় নিখোঁজ। তিনি সরোজ দত্ত, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) [সিপিআই(এম-এল)] এর প্রতিষ্ঠাতা ও নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের জন্মদাতা চারু মজুমদারের প্রধান সেনাপতি। আজ থেকে ৫০ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ৪ঠা/৫ই আগস্ট মধ্যরাতে, ভারতের শাসকশ্রেণী তাঁকে হত্যা করে।

ভারতের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তাত্ত্বিক যে বুনিয়াদ চারু মজুমদার সৃষ্টি করেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাও জেদং চিন্তাধারার ভারতের মাটিতে সফল প্রয়োগ করে, এই মাটির বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ করে, তাকে বিশ্বজনীন করার এবং সমস্ত ধরণের সংশোধনবাদী আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে যে ভূমিকা সরোজ দত্ত পালন করেন, তা ঐতিহাসিক ও অনবদ্য। 

সরোজ দত্তের হত্যার খবর শুনে চারু মজুমদার লিখলেন, “কমরেড সরোজ দত্ত পার্টির নেতা ছিলেন এবং নেতার মতোই তিনি বীরের মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর বিপ্লবী নিষ্ঠা এক আদর্শ হিসেবে তরুণদের গ্রহণ করতে হবে, সমস্ত দুর্বলতা কাটিয়ে আরও দৃঢ়ভাবে বিপ্লবের পথ গ্রহণ করতে হবে। শ্রমিক এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হয়ে এই হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে হবে।” 

পূর্ব বঙ্গের নড়াল জেলায় ১৯১৪ সালের ১৩ই মার্চ সরোজ দত্ত জন্ম গ্রহণ করেন। নড়াল ভিক্টোরিয়া কলিজিয়েট স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন আর তারপরে সেখান থেকেই আইএ পাশ করে তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন ১৯৩৩ সালে। ছাত্র অবস্থায় সরোজ দত্ত রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। এর পরে তিনি ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ অবধি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজীতে এমএ পড়েন ও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তারপরে তিনি ১৯৩৯ সালে যদিও বা অমৃতবাজার পত্রিকায় সহ সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন, কিন্তু কর্মচারী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁর চাকরী চলে যায়। 

অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে সরোজ দত্তের যোগাযোগ ছিল এবং তিনি যুদ্ধের সময়ে স্বাধীনতা পত্রিকায় যোগদান করেন। বেলা দত্তের সাথে যখন তাঁর বিয়ে হয় তখন তাঁর স্ত্রী একজন দলীয় সদস্য হলেও তিনি তা ছিলেন না এবং সেই নিয়েও তিনি গর্ব করতেন। তেভাগা ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কে উচ্ছেদ করার সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের অনীহা প্রভৃতি তাঁকে প্রভাবিত করে। 

ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলনে সংশোধনবাদ বিরোধী সংগ্রাম তীব্র হওয়ায়, বিশেষ করে জওহরলাল নেহেরু ১৯৬২ সালে চীন আক্রমণ করায় তিনি প্রতিবিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন।  ১৯৬৩ সাল থেকে তিনি সাপ্তাহিক ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। এই পত্রিকায় থাকাকালীন সরোজ দত্ত সিপিআই-র শোধনবাদী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি কে অনুধাবন করে মাও জেদং চিন্তাধারা প্রয়োগের পক্ষ নেন। এই নিয়ে পরবর্তীতে গঠিত সিপিআই (মার্কসবাদী) নেতৃত্বের সাথে তাঁর মতভেদ তীব্র হয়। 

এই মতাদর্শগত সংগ্রাম চলাকালীন, ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের সূচনা করেন চারু মজুমদার আর সরোজ দত্ত এই সংগ্রাম কে দুই হাত তুলে সমর্থন জানান আর গড়ে তোলেন দেশব্রতী পত্রিকা, যা বাংলা ভাষায় বিপ্লবী সাংবাদিকতার এক নতুন নিদর্শন হয়ে ওঠে। এর পরে সরোজ দত্ত হয়ে ওঠেন শাসক শ্রেণীর কাছে এক আতঙ্কের বস্তু।

তাঁর তীক্ষ লেখনী দিয়ে সরোজ দত্ত বিপ্লবী সাংবাদিকতার সাথে যে দুইটি বিশেষ সংগ্রাম চালিয়েছেন তা হল চারু মজুমদারের কতৃত্ব কে ভারতের বিপ্লবী সংগ্রামে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম আর শাসক শ্রেণীর তৈরী করা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও মনীষীদের স্বরূপ তিনি বিপ্লবী যুব সমাজের সামনে উন্মোচন করেন, নেতৃত্ব দেন মূর্তি ভাঙার সংগ্রামে, পুরানো কে ভেঙে নতুন কে প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্রায় নিয়ে।

চারু মজুমদারের কতৃত্ব কে বারবার আক্রমণ সহ্য করতে হয় দক্ষিণপন্থী ও অতি বাম সুবিধাবাদের থেকে। এই লড়াইয়ে সরোজ দত্ত হয়ে ওঠেন তাঁর তাত্ত্বিক সেনাপতি। সিপিআই (এম–এল) দলের ভিতরে তিনি চারু মজুমদারের কতৃত্বের প্রশ্নে দুই লাইনের সংগ্রাম চালান, ও যে ভাবে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টিতে লিন বিয়াও সংগ্রাম চালান মাও জেদং কে রক্ষা করার, সেই রকম সংগ্রাম তিনি ভারতের মাটিতে চালান। নানা রঙের সংশোধনবাদী ধারার নির্লজ্জ আক্রমণ থেকে চারু মজুমদার কে শুধু তিনি রক্ষা করেননি, বরং যে ভাবে ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস কার্ল মার্কসের কতৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে ভাবে য়োসিফ স্তালিন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের কতৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে ভাবে লিন বিয়াও মাও জেদং-র কতৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঠিক তেমনি সরোজ দত্ত সেইদিন চারু মজুমদারের বিপ্লবী কতৃত্ব কে প্রতিষ্ঠা করেন। 

তাই যে এঙ্গেলস এর শহীদ দিবসের সাথে তাঁর শহীদ দিবস মিলে মিশে একাকার হল, সেই এঙ্গেলসের পথে চলেই, এঙ্গেলসের “কতৃত্ব প্রসঙ্গে”-র মতন সরোজ দত্ত লিখলেন “বিপ্লবী কতৃত্ব প্রসঙ্গে”, ও সিপিআই (এম-এল) দলের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা রঙ বেরঙের সংশোধনবাদী ধারার মুখোশ তিনি ছিড়ে ফেলেন তাঁর ধারালো শব্দ, যুক্তি ও তথ্য দিয়ে। 

“শশাঙ্ক” নামে কলম ধরেন সিপিআই (এম-এল) বাংলা মুখপত্র দেশব্রতী পত্রিকায়। শুধু মার্কসবাদী তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়, “পত্রিকার দুনিয়ায়” নামক কলামে নিয়মিত বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যম ও শোধনবাদী পত্র-পত্রিকার ঝানু সাংবাদিকতার সমস্ত নিদর্শন কে তিনি কাটা ছেঁড়া করে দেখাতেন রাইফেল হাতে উদ্ধত ভারতের দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষককে দেখে কী চরম ভয়ই না পেয়েছে দেশী-বিদেশী শাসক শ্রেণী। এ ছাড়াও, চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রভাব ভারতের কৃষি বিপ্লবে ১৯৬৯-৭০ সালে পড়ার কারণে, নতুন আলোকে, মাও জেদং-র চিন্তাধারার আলোকে নতুন করে যখন ভারতের উপরিকাঠামো কে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও দর্শন কে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম চিনতে শিখলো, তখন ভারতের শাসক শ্রেণীর দ্বারা মানুষের উপর মানুষের শোষণ কে বজায় রাখার কাজ যে তথাকথিত মনীষীরা আর তাঁদের দর্শন করেছিল, তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন এই তরুণ প্রজন্মের অগ্রগামী অংশ।

অকাট্য তথ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে সুভাষ বসু, ‘বিদ্যাসাগর’ থেকে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রামমোহন রায় থেকে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের সাধের মনীষীদের স্বরূপ তিনি উন্মোচন করেন, তাঁদের চিহ্নিত করেন সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে ও বিধান দেন এদের মূর্তি ভেঙে যুব সমাজ ঠিক কাজই করছে। সরোজ দত্ত লেখেন পুরানো কে ভাঙা হচ্ছে নতুন গড়তে। বললেন “পুরানো কে না ভাঙলে নতুন গড়া যায় না”, তাই তিনি উপরিকাঠামোর ক্ষেত্রে বিপ্লবের চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষা কে ব্যবহার করলেন ভারতের বিশেষ পরিস্থিতির সাথে।

সরোজ দত্তের তথ্যবহুল লেখায় সিপিআই (এম-এল) এর কর্মী ও সমর্থকেরা যেমন একদিকে চিনতে শিখলেন শাসকশ্রেণীর, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পদলেহী, সামন্তবাদী ও মুৎসুদ্দী বেনিয়া পুঁজিপতিদের দালাল মনীষীদের স্বরূপ, স্বাধীনতা আন্দোলনের নামে ভারতের বৃহৎ জোতদার-জমিদার আর মুৎসুদ্দী পুঁজিপতিদের ব্রিটিশ শাসকদের সাথে রক্ষিতার মতন দর কষাকষির অঙ্ক, তেমনি তাঁরা শিখলেন কী ভাবে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মাথায় চড়ে বসে, বেইমান নেতৃত্ব এই শাসকশ্রেণীর লেজুড়বৃত্তি করেছে। “পত্রিকার দুনিয়ায়” কলামে “শশাঙ্ক” যেমন বনেদি বুর্জোয়া কাগজগুলোর, আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্যা স্টেটসম্যান, যুগান্তর ও অমৃতবাজার পত্রিকার, ধূর্ত সাংবাদিকতার স্বরূপ জনতার সামনে তুলে ধরলেন, ঠিক তেমনি, কী ভাবে গণশক্তি, কালান্তর, দেশহিতৈষী, প্রভৃতি রঙ বেরঙের আধুনিক সংশোধনবাদের মুখপত্র গুলো মানুষ কে বিষাক্ত রাজনীতি দিয়ে বশ করতে চাইছে, তাও তিনি প্রকাশ্যে আনলেন। 

পি সুন্দারাইয়া থেকে বিটি রনদিভে, জ্যোতি বোস থেকে প্রমোদ দাশগুপ্ত, নাগী রেড্ডি থেকে উৎপল দত্ত, বা ফ্রন্টিয়ার পত্রিকার সমর সেন, কাউকেই রেয়াত করেনি তাঁর কলম। বর্তমান সময়ে একটি দেশের বিপ্লবী সংগ্রাম যে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম না করে এক পাও এগোতে পারবে না, সেই কথা কিন্তু সরোজ দত্ত বারবার তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করেছেন। যে কোন মতাদর্শগত সংগ্রামে দুইটি মূল পক্ষ হয়, আর তাই, চারু মজুমদারের কতৃত্ব কে নিঃশর্ত ভাবে মেনে নিয়ে, সরোজ দত্ত বলতেন “আমি চারু মজুমদারের পক্ষ”, যা তাঁকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে মাও জেদং এর উত্তরাধিকারী হিসাবে গণ্য হওয়া লিন বিয়াও-র সমকক্ষ করে তোলে। 

তাই অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায় তাঁর আর লিন বিয়াও-র মৃত্যুর মধ্যে। সরোজ দত্ত কে হত্যা করা হয় চারু মজুমদারের আগে, আর লিন বিয়াও কে ঠিক তার এক মাস পরে হত্যা করা হয়। আবার চারু মজুমদার জীবিত থাকা অবধি চীন থেকে লিন বিয়াও-র মৃত্যুর কথা ঘোষণা করা হয়নি। আর চারু মজুমদার কে হত্যা করার পরেই আন্তর্জাতিক  সংশোধনবাদীরা, ঝৌ এনলাই আর দেঙ শিয়াওপিং এর নেতৃত্বে, মাও জেদং কে ঘেরাও করে চীনের রঙ পাল্টে, পুঁজিবাদ পুনঃস্থাপন করা শুরু করে, যার বিরুদ্ধে বিশ্বে প্রথম আওয়াজ ওঠে বর্ধমানের কামালপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত সিপিআই (এম-এল) এর দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে, ১৯৭৩ সালে। 

সংশোধনবাদী লাইনের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামে, লিন বিয়াও আর সরোজ দত্ত বিপ্লবী কতৃত্ব রক্ষার সংগ্রামে একাকার হয়ে গেছেন, আর তাই তাঁকে মানার ভান করেও তাঁর রাজনৈতিক লাইনের, চারু মজুমদার, লিন বিয়াও ও মাও জেদং এর প্রতি তাঁর নিঃশর্ত বিশ্বাস কে ব্যঙ্গ করে অনেকেই আজ তাঁকে “একপেশে” বলেন। আর এই “একপেশে” বলে সরোজ দত্ত কে আক্রমণ করে আসলে আক্রমণ করা হয় চারু মজুমদার কে, যিনি সরোজ দত্ত কে পার্টির নেতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ও সমগ্র যুব-ছাত্র সমাজ কে তাঁর দৃষ্টান্ত মেনে কাজ করতে বলেছেন। সরোজ দত্ত “একপেশে” হলে চারু মজুমদার কি তাঁর পক্ষ ধারণ করতেন? সরোজ দত্ত যা লিখেছেন তাতে কি শাসকশ্রেণীর গাতৃদাহ হয়েছে না শোষিত মানুষের? লড়াইটা যখন দুইটি শ্রেণীর, দুইটি শিবিরের তখন তো একটি পক্ষই ধারণ করা উচিত। সেই সময়ে অন্য পক্ষকেও গুরুত্ব দেওয়ার কথা যাঁরা বলেন তাঁদের উদ্দেশেই সরোজ দত্ত বলেন যে “মনে হয় লাথি মেরে শালাদের দাঁতের পাটি খসিয়ে দিই!”

বর্তমানে যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদী-র সরকার কে সমালোচনা করা হচ্ছে এই বলে যে এই সরকার তার বিরুদ্ধে লেখার সাহস দেখানো সব সাংবাদিকদের উপর নজরদারি করছে বা জেলে পুড়ছে, প্রতিক্রিয়াশীল ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের মতন, তখন সরোজ দত্ত তাঁর শাহাদাতের ৫০ বছর পরে ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন। সরোজ দত্ত শুধু সরকারের বিরুদ্ধে লেখেননি, তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সক্রিয় ভাবে নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে যেখানে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার অভিযোগ করা হচ্ছে মোদীর বিরুদ্ধে, তার ৫০ বছর আগে সরোজ দত্তের উদ্ধত শির কেটে ফেলে আতঙ্কিত শাসক কারণ তিনি এক শাসক বদলে অন্য শাসক, এক শোষণের বদলে অন্য শোষণের কথা বলেননি, বলেছিলেন শোষণহীন সমাজের কথা, লিখেছিলেন ব্যবস্থা বদলের কথা, এক শ্রেণীর দ্বারা অন্য শ্রেণী কে উৎখাত করে নতুন রাষ্ট্র গড়ার কথা। 

যদিও বর্তমানে অনেকেই সরোজ দত্তের বিপ্লবী সত্তা বাদ দিয়ে তাঁকে শুধুই একজন “কবি” বা “সাংবাদিক” হিসাবে তুলে ধরেন, এই রকম কোন পরিচয়ে সরোজ দত্ত নিজেকে পরিচিত করাননি কোনদিনই। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন একজন “বিপ্লবী” হিসাবে আর তাই তিনি নিজ প্রাণ দিতে কোনদিন পিছপা হননি। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্লোগান “fight self, combat revisionism” (আত্মস্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করুন, সংশোধনবাদ কে নাকচ করুন) এর তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন তাঁর কমরেডদের, যে একটা for (জন্যে) যদি এই স্লোগানে ঢোকানো হয়, “fight for self” যদি হয়ে যায়, সেটা কিন্তু গোটা রাজনীতি কে বদলে দিতে পারে। তাই সরোজ দত্ত নিজের সংগ্রামে একটিও ভেজাল শব্দ ঢোকাননি, নির্ভীক চিত্তে আত্মস্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করেন ও প্রাণ দেন। 

পার্টির নেতা হিসাবে, চারু মজুমদারের উত্তরাধিকারী হিসাবে সরোজ দত্ত কোন বিশেষ সুবিধা চাননি। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে বহু যোজন দূরে বসে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী-সুলভ কায়দায় তিনি বিপ্লব নিয়ে থিসিস লেখেননি। লড়াইয়ের ময়দানে, গ্রামে গঞ্জে, তিনি চারু মজুমদারের সহযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধে যোগ দেন। স্মৃতি কথায় বলা হয় যে যখন তাঁর জীবনসঙ্গিনী বেলা দত্ত তাঁর কাছে জানতে চান যে তিনি কেন নিজে লড়াইয়ে জড়াচ্ছেন, তখন সরোজ দত্ত বলেন “এইডা কি কইলা বেলা! যুদ্ধে কি শুধু বাহিনী মরব! আরে দুই একডা সেনাপতিরও তো জান যাইব!” 

তিনি জানতেন রাষ্ট্র পেলে তাঁকে ছিঁড়ে খাবে কারণ তিনি কানু স্যানাল নন, সন্তোষ রানা বা অসীম চ্যাটার্জি নন, তিনি সরোজ দত্ত, সিপিআই (এম-এল) এর রণনীতি ও রণকৌশল পরিচালক চারু মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা। তবুও ভীত হননি, শাসকের কাছে তাঁর জীবন ভিক্ষা করেননি, সংবিধান বা আইনের দোহাই দেননি। যে রাষ্ট্র তাঁর কাছে বেআইনি, যে রাষ্ট্র কে তাঁর দল সিপিআই (এম-এল) শত্রু ঘোষণা করেছিল, সেই রাষ্ট্রের কাছে কোন আশা আজকের দিনের স্বঘোষিত মধ্যবিত্ত বিপ্লবীদের মতন তিনি পোষেননি। 

ফলে আজ যাঁরা সরোজ দত্তের মৃত্যুর তদন্তের দাবি তোলেন, যাঁরা তাঁর হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি তোলে সেই শাসকের কাছে যে সরোজ দত্ত কে হত্যা করেছিল, তাঁদের চেয়ে বড় সরোজ দত্তের নাম নিয়ে সরোজ দত্ত বিরোধিতা কে করে? যে সরোজ দত্ত বিপ্লবীদের জেলে “রাজবন্দী” হওয়ার আন্দোলন না করে জেল ভাঙার লড়াই করতে বলেন চারু মজুমদারের শিক্ষা অনুসারে, যে সরোজ দত্ত কংগ্রেস সরকার দেশব্রতী ও লিবারেশন এর অফিস হানা দেওয়ার পরে আইনী লড়াইয়ের প্যাঁচে না পড়ে বরং বেআইনী ভাবে পত্রিকা ছাপানোর পদ্ধতি গ্রহণ করেন, সেই সরোজ দত্তের কথা বলে রাষ্ট্রের কাছে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা কি ধৃষ্টতা নয়?

সরোজ দত্ত কে মেরে খুনী শাসকশ্রেণী ভেবেছিল চারু মজুমদারের বিপ্লবী কতৃত্ব কে শেষ করে দেওয়া যাবে, কিন্তু গত ৫০ বছর ধরে উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির মতন জেগে থাকা সরোজ দত্ত তাঁর লেখনী ও তাঁর নিষ্ঠার সাথে যে হাজারো মানুষ কে বিপ্লবের পথে চলার অনুপ্রেরণা দেবেন, সেই হিসাব তারা করতে পারেনি। ফলে, সরোজ দত্ত আজও তাঁদের কাছে এক আতঙ্কের বস্তু। 

সরোজ দত্ত কে আজকের দিনে স্মরণ করে, তাঁর স্মৃতিতে সেই পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে চিরকালের মতন স্লোগান দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া হবে সরোজ দত্তের সাথে বেইমানি করা। সরোজ দত্তের কোন বাড়ি নেই, সরোজ দত্ত কোথাও ফিরে যেতে চাননি, শুধু এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। প্রতিটি মুহূর্তে যেহেতু সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি, সব কিছুর মধ্যেই পরিবর্তন হচ্ছে, তাই কী হলে কী হতে পারতো অতীতে সেই আলোচনায় আটকে না থেকে, চারু মজুমদারের যে রাজনীতি কে প্রয়োগ করতে গিয়ে সরোজ দত্ত প্রাণ দিলেন, যে রাজনীতি ভারতীয় উপমহাদেশে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাও জেদং এর চিন্তাধারার সঠিক প্রয়োগের ফসল, সেই রাজনীতি কে, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বৃহৎ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার জন্যে, উন্নীত করা, সমাজের দ্বন্দ্বগুলোর বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে তাদের সমাধানের পথ খোঁজা, এই হল সরোজ দত্ত কে স্মরণ করার একমাত্র পথ। সেই পথে চলা এবং সরোজ দত্তের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সাহসের সাথে সমাজ বিপ্লবের সংগ্রামে ঝাঁপ দেওয়াই হবে সরোজ দত্ত কে সঠিক ভাবে সম্মান জানানো। চারু মজুমদারের ভাষায় যা শ্রমিক এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হওয়ার সংগ্রাম করা।

ফিরে দেখা নন্দীগ্রাম আন্দোলন: মমতার উবাচ, বুদ্ধের ওয়াও-ওয়াও ও বাস্তবিক ঘটনাগুলো

বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ০১, ২০২১ 0 Comments A+ a-

নন্দীগ্রাম আন্দোলন মমতা শুভেন্দু উবাচ ও বাস্তব


মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় যদি প্লাস্টার করা ঠ্যাং উঁচিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারতেন, তবে হয়তো তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস তুলনামূলক ভাবে ভাল ফল করতো। এতদিন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই(এম)] নন্দীগ্রামে গুলি চালানো নিয়ে "যা করেছি, বেশ করেছি" মার্কা কথা বলে গালাগালি খেয়েছে। হঠাৎ নন্দীগ্রামে পুলিশের সন্ত্রাসের সাথে মমতা  তাঁর দলের প্রাক্তন হেভিওয়েট নেতা শুভেন্দু অধিকারী আর শিশির অধিকারীর “বাপ-ব্যাটার” নাম জড়িয়ে দেওয়ায় যেমন নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে হাসির খোরাকে পরিণত করলেন, তেমনি আচমকা সিপিআই(এম) কর্মীদেৱ  মধ্যে দারুণ একটা “ওয়াও-ওয়াও” অনুভূতি জাগ্রত করলেন।এই “ওয়াও-ওয়াও” অনুভূতি রোগ শয্যায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হল। 


২০১১ সালে বিধায়ক পদ খুইয়ে গোসা করে রাজনৈতিক সন্ন্যাসে চলে যাওয়া বুদ্ধ হঠাৎ উত্তেজনায় একটা বিবৃতিও লিখে আলিমুদ্দিন ছাপ মেরে প্রসে পাঠিয়ে দিলেন। মমতার কাছ থেকে সিপিআই(এম) হঠাৎ জানতে পারলো যে সিপিআই(এম) ক্যাডার এবং  বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ গুলি চালায়নি! এও জানা গেল যে ২৩৪টা আসন জিতে বসে থাকা টানা ৩০ বছর ধরে চলা একটা সরকারের পুলিশ মাত্র ৩০ টা আসন জেতা দলের  নেতার (যাদের আগামী৫০০ বছরে ক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভবনা দেখা যাচ্ছিল না) অনুমতি ছাড়া কাজ করতো না। শুধু তাই নয়, বিরোধীদের কথায় চাষীদের উপর গুলিও চালিয়ে দিতো! "আমি যে গুলি চালাইনি, এটাতো আমি জানতুমই না!" বুদ্ধবাবু এই লাইনটা শুধু বিবৃতিতে লিখতে বাকি রেখেছিলেন। অথবা কনফিডেন্ট বুদ্ধ বাবু একটু চাপ না নিয়ে ল্যাদ খাচ্ছিলেন, ১০ বছর পর সব জানাজানি হবে বলে। অথবা তৃণমূল কংগ্রেস এর শিশির অধিকারীই আসলে বামফ্রন্টের পুলিশ মন্ত্রী ছিল এই কথাটা শুধু বলা বাকি।


শিশির অধিকারী সহ সিপিআই(এম) এর অনেকেই  প্রশ্ন তুলেছেন যে গুলি চালানো পুলিশ অফিসারদের মমতা কেন শাস্তি দিলেন না? ন্যায্য প্রশ্ন। এই দাবি "ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি" রেখেছিল এবং তার জন্য ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতাদের এক অংশকে নিষিদ্ধ মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে দেখিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় জেলে ঢোকায় মমতা বন্দোপাধ্যায় এর সরকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ১৯৭২-৭৭ সাল পর্যন্ত নকশালপন্থী এবং সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের রক্তে হোলি খেলা কতজন কুখ্যাত পুলিশ অফিসার বা কংগ্রেসী মাফিয়া জল্লাদ গুন্ডাকে শাস্তি দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার? কী হয়েছিল রুনু গুহনিয়োগীদের?  


জ্যোতি বসুরা জানতেন  কংগ্রেসের হয়ে সন্ত্রাস চালাবার জন্য পুলিশদের শাস্তি দিলে ভারসাম্য বিগড়ে যাবে। জ্যোতি-বুদ্ধ কোম্পানি  বিরোধীদের উপর গুলি চালাতে বললে তখন আর অফিসাররা গুলি চালাবে না। বিরোধীদের একটু সবক শেখাবার আদেশ দিলে অফিসাররা আর মনের ফুর্তিতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে সৃজনশীলতা ফলাবেনা। ভারতের 'গণতন্ত্রের' এটাই রীতি । ব্যাতিক্রম থাকতে পারে কিছু, তার পেছনেও কিছু নির্দিষ্ট কারণ থাকতে পারে। মমতাও ক্ষমতায় আসার পরে তাই করলেন যা জ্যোতি বসু করেছিলেন কংগ্রেসি আমলের পুলিশ আমলাদের সাথে। শুধু তাই নয়, একটু বেশীই আপন করে নিলেন তাদের। কারণ মমতা জানতেন এদের উপর ভিত্তি করেই টিকে থাকতে হবে।


এতদিন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পেছনে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা CIA এর হাত ছিলো বলে প্রচার করা হয়েছে  সিপিআই(এম) এর তরফে। একথা সত্য যে আমেরিকান পুঁজির স্বার্থ রক্ষায় পৃথিবীর যে কোনো দেশে গিয়ে ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত চালায় CIA। এটাও সত্যি যে CIA এর টার্গেট হয় মূলত বামপন্থীরা। কারণ বামপন্থীরাই মূলত মার্কিন পুঁজি বা মার্কিন বাণিজ্যের  জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকেন। এবার একটু নন্দীগ্রামের দিকে তাকাই। নন্দীগ্রামে বামফ্রন্ট সরকার বৃহৎ মার্কিন কম্পানি ডাও কেমিক্যালস এর কেমিক্যাল হাবের জন্য ১৯,000 একর জমি অধিগ্রহণ করছিল। 


ছোট করে ডাও কেমিক্যালস এর  পরিচয় দেওয়া যেতে পারে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট দের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনারা যে নাপাম বোমা প্রয়োগ করেছিলো তার যোগানদার ছিলো ডাও। ভোপালে ১৯৮৪ সালে আরো বেশী মুনাফার জন্য সেফটি মেজার না নেওয়ার জন্য ইউনিয়ন কার্বাইড নামে একটি আমেরিকান সংস্থার কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস লিক করায় প্রায় ১৬,000 হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, পাঁচ  লাখের বেশী মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে যায়। কংগ্রেস সরকারের সহায়তায় উনিয়ন কার্বাইড কর্তা এন্ডারসন ভারত থেকে পালায়। ইউনিয়ন কার্বাইড এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়নি। কংগ্রেস সরকার হোক বা জাতীয়তাবাদের ঠিকাদার অধিকারীদের বর্তমান দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার, এই নিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে আর একটাও কথা কেউ বলেনা। এই ইউনিয়ন কার্বাইড মিশে গেছে ডাও এর সাথে। সুতরাং এই ডাও কেমিক্যালস হল ইউনিয়ন কার্বাইড। ডাও কেমিক্যালস  প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে নিষিদ্ধ/কালো তালিকা ভুক্ত সংস্থা। 


ডাও এর কেমিক্যাল হাবটি নির্মাণের বরাত পেয়েছিলো ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্ঠী। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৫০-এর দশকে সুকার্নোর নেতৃত্বাধীন আমেরিকা-বিরোধী জাতীয়তাবাদী সরকারকে সামরিক অভ্যুথানের এর মাধ্যমে উচ্ছেদ করা  হয়। CIA এর মদদে  এই সামরিক অভ্যুথান এবং কমিউনিস্ট-বিরোধী গণহত্যা সংগঠিত করে ইন্দোনেশিয়ার সেনা এবং মাফিয়ারা। এই মাফিয়াদের অন্যতম নেতা ছিলেন সালেম গোষ্ঠীর কর্ণধার  সুহার্তো সালেম। এর থেকে সালেমদের সাথে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ এবং CIA এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক খুব সহজেই অনুমেয়। সুতরাং নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে CIA যদি কোনো ভূমিকা নিয়েই থাকে, তবে সেটা নিয়েছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বিরুদ্ধেই। কারণ CIA মমতা নয়, তাই CIA নিশ্চয় সেম সাইড করতে যাবে না! 


প্রশ্ন হলো যে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কৃষকরা না চাইলে জমি অধিগ্রহণ হবেনা এই বিবৃতি দেওয়ার পরেও কেন আন্দোলন চলতে থাকলো? কারণটা হল এই যে টিভিতে বা সকালের সংবাদপত্রে মুখ্যমন্ত্রীর বয়ানের সাথে সিপিআই (এম) এর জেলা নেতা এবং বন্দুকধারী ক্যাডারদের আচরণের কোনো সামঞ্জস্য ছিলনা। মানুষ ২ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে গ্রামবাসীদের থেকে বেশী পুলিশ জমায়েত করে, বাচ্চা বুড়ি রেয়াত না করে বাড়ি থেকে টেনে বের করে পিটিয়ে, ধানের গোলা জ্বালিয়ে দিয়ে, ঘর ভেঙে, জমি দখলের দৃশ্য টিভিতে দেখেছিলেন । মানুষ দেখেছিলেন  সিঙ্গুরের অত্যন্ত উর্বর জমিকে মুখ্যমন্ত্রী অবলীলায় একফসলি বা বাঁজা জমি বলে উল্লেখ করেছিলেন। কৃষকরা সরকারকে বিশ্বাস করতেন না। শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে সরকারকে বিশ্বাস করা আদৌ কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলেই মনে করি। 


সিবিআই কেন ১৪ই মার্চ গুলি চালানো নিয়ে ক্লিনচিট দিয়েছিল? শ্রেণী স্বার্থের কথা, প্রশাসনিক ভারসাম্যের কথা ছেড়েই দিলাম, সিবিআই আদতে কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা কি না সেই প্রশ্নও আপাতত তোলা থাক। সিবিআই এর রিপোর্টে আসলে কী লেখা ছিল? এটাই লেখা ছিল যে পুলিশ গুলি চালিয়ে কৃষকদের খুন করার আগে সমস্ত নিয়ম নীতি পালন করেছিল; পুলিশ কোনো গাফিলতি করেনি। যেমন মাইকে ওয়ার্নিং দেওয়া, কাঁদানে  গ্যাসের শেল  ফাটানো, হাওয়ায় গুলি করা, ইত্যাদি। আর এই দেখে সিপিআই(এম) আহ্লাদে আটখানা। আন্দোলনের সমর্থকদের কেউ কেউ কনফিউজড। কিছুক্ষণের জন্য ধরেই নিলাম যে সিবিআই এর সব কথা সত্যি। তাতে কী যায় আসে? 


ধরা যাক একদল লোক আপনার বাড়ির দরজা ধাক্কিয়ে বললো "ডাকাতি আমাদের পেশা, আপনার বাড়ি শান্তিপূর্ণ ভাবে ডাকাতি করে চলে যাবো, আমাদের কাজে সহযোগিতা করুন"। এবার আপনি কী করবেন আপনাকে জানিয়ে ডাকাতি করতে এসেছে বলে "চুপচাপ শান্তিপূর্ণ ভাবে" ডাকাতি করতে দেবেন, তাইতো? সিপিআই(এম) এর লজিক অনুযায়ী আপনার তাই করা উচিৎ। কিন্তু আপনি যদি ডাকাতের সাথে সংঘাতে জড়ান এবং ডাকাতের গুলিতে আহত হন বা আপনার বাড়ির কেউ মারা যায়, তবে সিপিআই(এম) এর যুক্তি অনুযায়ী আপনার অভিযোগ করার কোনো অধিকার নেই। অথবা দোষ তো আপনারই! কারণ ডাকাত তো সতর্কবার্তা দিয়েছিল! ডাকাত তো শান্তিপূর্ণ ডাকাতিতে সহযোগিতা করার কথা বলেছিল! 


নন্দীগ্রামে মার্কিন সংস্থা ডাও কেমিক্যালের  হয়ে যেমন মাঠে নেমেছিল বামফ্রন্ট সরকার, তেমনি বামপন্থীরাই কৃষকদের সংগঠিত করে মাটিতে দাঁড়িয়ে গড়ে তুলেছিলেন আন্দোলন। তৃণমূল সেই সময় প্রধান বিরোধী দল ছিল, তাই আন্দোলনে তার একটা স্বাভাবিক প্রভাব ছিলো। মমতা ছিলেন কলকাতায় বসে আন্দোলনের নেতা, আর শুভেন্দু অধিকারী  ছিলেন কাঁথিতে বসে আন্দোলনের নেতা। আন্দোলনের শুরুটা সিপিআই (এম-এল পিসিসি) নেতা সুমিত সিনহাকে ছাড়া ভাবা যায় না। মাওবাদীদের নেতাদের বাদ দিয়ে আন্দোলনের মধ্যেখানটা ধরে রাখা, আন্দোলনের শক্তি সংগ্রহ, প্রচার, বিস্তার ভাবা যায় না। এ ছাড়াও এসইউসিআই, সিপিআই (এম-এল)-এর বিভিন্ন গোষ্ঠী, প্রগতিশীল বামপন্থী মানুষের অবদান আন্দোলনকে অনেক শক্তি যুগিয়ে ছিল। এবং অবশ্যই তৃণমূলের  স্বভাব সুলভ বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আন্দোলনের শেষটা হয়না। 


২০০৬ সালের জুন মাসে সুমিত সিনহারা নন্দীগ্রমে প্রায় ৮০০ মানুষের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালান জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে। সেই সমীক্ষা  থেকে উঠে আসে ৯০% কৃষক জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আতঙ্কিত এবং অনিচ্ছুক। আমার অভিজ্ঞতায় এর কারণটা হল নন্দীগ্রামের উল্টোদিকে হলদিয়া শিল্পাঞ্চল, এ ছাড়া নন্দীগ্রামেই জেলিংহাম কারখানা জন্য জমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতি পূরণ এবং চাকরির প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৃষকদের অভিজ্ঞতা ভাল ছিল না। সার্ভে রিপোর্টের উপর ভিত্তি  করে জুলাই মাসে সুমিত সিনহা একাই নন্দীগ্রাম পৌঁছে  গিয়ে কৃষকদের সাথে আলাপ আলোচনা চালাতে থাকেন, ছোট ছোট কর্মসূচীও নিতে থাকেন। 


মনে রাখতে হবে নন্দীগ্রাম ছিলো সিপিআই(এম) এর ঘাঁটি। বিরোধীদের অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না বললেই চলে। সুতরাং সুমিত সিনহারা যাদের সংগঠিত করছিলেন তারা কিন্তু সিপিআই(এম) এরই কর্মী সমর্থক ছিলেন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডে প্রায় ১০,০০০ কৃষকের জমায়েত হয়। সেই জমায়েতে উপস্থিত ছিলেন পিসিসি সিপিআই (এম-এল) নেতা প্রয়াত সন্তোষ রাণা, জামাতে উলেমা এ হিন্দ নেতা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী সহ আরো অনেকে। এর পালটা হিসাবে লক্ষ্মণ শেঠের নেতৃত্বে সিপিআই(এম) একই জায়গায় প্রায় ১০,০০০ মানুষের জমায়েত করে মানুষকে জমি অধিগ্রহণের এর পরিকল্পনা, চাকরি, উন্নয়ন নিয়ে নানা কথা বলে। সেই সভাতেই সিপিআই(এম) এর কর্মীরাই মঞ্চে উঠে প্রতিবাদ করে, সিপিআই(এম) নেতৃত্বের সাথে সংঘাতে জড়ায়। এর পর সিপিআই(এম) এর ঐ জমায়েত থেকেই জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন এক অন্য মাত্রা পায়। 


৩ জানুয়ারী ২০০৭ এ গড়চক্রবেড়িয়ার একটি পঞ্চায়েত অফিসে একজন সরকারি আমলা আসেন নির্মল ভারত (নরেন্দ্র মোদী সাহেব যার নাম “স্বচ্ছ ভারত”  দিয়েছেন) বা পায়খানা বসানোর প্রকল্প সংক্রান্ত কাজে। কিন্তু ঐ দিনই "বর্তমান" কাগজে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি খবর বের হওয়ায় গ্রামের মানুষের মনে হয় যে, আমলাটি জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজেই এসেছেন। সুমিত সিনহার নেতৃত্বে কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ মিছিল পঞ্চায়েত অফিস যায় এবং ঝগড়ায় জড়ায়। কৃষকদের সাথে প্রথমে খুব ঔদ্ধত্যের  সাথে কথা বলা হলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে চলে যায়। 


পঞ্চায়েত থেকে পায়খানা বসাবার কথা বলা হলে কৃষকরা বলেন "জমি চলে যাবে আর এখন হাগা নিয়ে চিন্তা করতে হবে!"  পঞ্চায়েত অফিস থেকে বিশাল মিছিল ছড়িয়ে পরে। এই মিছিলকে চেজ করতে পুলিশ আসে, যত দূর মনে পড়ছে কয়েকজনের পায়ে আর আঙুলে পুলিশের গুলিও লেগেছিল। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীরা দারগাপুরা মোড়ে  পুলিশদের বেধে রাখে, পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তিনটে রাইফেল ছিনতাই করে। পরে যদিও জামাত এ উলেমা হিন্দের সামাদ গিয়ে রাইফেলগুলো ফেরত দিয়ে আসে। এর পর ৭ জানুয়ারী সিপিআই(এম ) গ্রাম দখল করার চেষ্টা করে, ভরত মন্ডল, শেখ সেলিম, সহ ৭ জন খুন হয় সিপিআই(এম) বাহিনীর হাতে। বাড়ির সামনে পানের বড়জ থেকে গুলি চালাচ্ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা শঙ্কর সামন্ত। ক্ষিপ্ত কৃষকরা ধাওয়া করে তাকে ধরে ফেলে এবং জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেয়। 


জমি অধিগ্রহণের পক্ষে থাকা সিপিআই(এম) কর্মীরা ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। আর বাকি সিপিআই(এম) এর কৃষকরা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআই (মাওবাদী), এসইউসি, ইত্যাদি দলে সামিল হয়ে আন্দালন চালাতে থাকেন। এর পর ১৪ মার্চ সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নন্দীগ্রামে ঘটে। সমস্তটা লেখার পরিসর নেই। শুরুতে না থাকলেও সিপিআই (মাওবাদী) দলের রাজ্য নেতৃত্ব খুব গুরুত্ব দিয়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। মাওবাদী দলের কর্মীরা গ্রামে হিরো হয়ে হঠেন। ১৪ মার্চ এর পর সিপিআই(এম) এর প্রতি মানুষের ঘৃণার ফলে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বা লাল সেলাম বললে গ্রামবাসীরা রেগে যেতেন। পরবর্তীতে দেখেছি ঐ গ্রামবাসীরা দেখা হলে বা বিদায়ের সময় একে অন্যকে হাত মুঠো করে লাল সেলাম বলছেন।


শিশির অধিকারীর সাহায্য ছাড়া ১৪ই মার্চ পুলিশ ঢুকতে পারতো না এই কথা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। তবে তারিখ ভুল, ১০ নভেম্বর ২০০৭ এ সিপিআই (এম) এর “অপারেশন সূর্যোদয়”  অধিকারী বাপ-ব্যাটার সাহায্য ছাড়া সম্ভব ছিল না। আর শুধু অধিকারী বাপ ব্যাটাই নয়, এখানে পার্থ চ্যাটার্জি এবং খোদ মমতারও ভূমিকা আছে। অক্টোবর মাসে কলকাতায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মধ্যস্ততায় বুদ্ধ-মমতার সেটিং হয়। ঠিক হয় এবার আন্দোলন গোটাতে হবে। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। পুলিশ না ঢুকলে নির্বাচন হবেনা। নির্বাচন না হলে তৃণমূলের  খাটনি বৃথা যাবে। নির্বাচনে খাতা খোলার স্বার্থে তৃণমূলের এই আপসকে কাজে লাগিয়ে সিপিআই(এম) পুনরায় গ্রাম দখল করতে চেয়েছিল। 


সিপিআই(এম )এর হামলার মুখে আর প্রতিরোধ না গড়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব সবাইকে ত্রাণ শিবিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। তৃণমূল চেয়েছিল মাওবাদীরা ধরা পড়ুক, মারা যাক, তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের ঘর জ্বলুক, তারা খুন হয়ে যাক, কিন্তু যে কোনো মূল্য পঞ্চায়েত নির্বাচন হোক। তৃণমূলের এই নীতির ফলেই সিপিআই(এম) ব্যাপকভাবে হত্যা এবং সন্ত্রাস চালিয়ে গ্রাম দখল করে। সিপিআই(এম) এর এই সন্ত্রাসের মুখে একমাত্র সিআরপিএফ এর ভরসায় তৃণমূল কর্মীরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। সিপিআই(এম) এর সশস্ত্র আগ্রাসনের সামনে তৃণমূল কংগ্রেস  নেতৃত্ব ভেবেছিল যে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেছে। কিন্ত মানুষ ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে সব হিসেব উল্টে দিয়েছে। মানুষের কাছে তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া আর কোনো নির্বাচনী বিকল্প ছিল না। 


আমরা, যাঁরা তখন ছাত্র, নন্দীগ্রামের কৃষকদের থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম করা শিখতে যেতাম, আর কৃষকদের নাটক, গান, বক্তৃতায় বা গ্রাম পাহারায় রাত জেগে বোঝানোর চেষ্টা করতাম আন্দোলনটা শুধুমাত্র সিপিআই(এম) এর বিরুদ্ধে নয়, এই লড়াই আমেরিকান পুঁজিপতিদের নির্দেশিত অপ উন্নয়নের বিরুদ্ধে। বোঝাতাম কী ভাবে অন্য রাজ্য গুলোতে অন্য দল গুলোও পুঁজিপতিদের স্বার্থে শ্রমিক কৃষকদের উপর অত্যাচার করছে। আমরা আন্দোলনের সংগঠকদের সাহায্য করতাম। আমাদের সংগঠন ইউএসডিএফ (যা এখন আরএসএফ) এর কয়েক জন নেতা-নেত্রী স্নাতকোত্তরের পড়া কাটিয়ে স্থায়ী ভাবে আন্দোলনের কাজে নন্দীগ্রামে থাকতে শুরু করেছিল। এ ছাড়াও আইসা, পিডিএসএফ, এআইপিএসএফ  এর কমরেডরা আন্দোলনের প্রচারে, সংহতি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

 

নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলন সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের উৎসাহিত করেছিল, শুধু তাই নয় দেশ জুড়ে জমি অধিগ্রহণের  ঢেউ আটকে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের চাপেই ২০১০ সালে কংগ্রেস সরকার ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন বদলে নতুন আইন আনতে বাধ্য হয়। যা এতদিন কোনো তথাকথিত প্রগতিশীল সরকারের মাথায় আসেনি। এর থেকে শিখেছিলাম আইন পার্লামেন্টে তৈরি হয়না, বরং মেহনতী মানুষের সব কিছু হুল্লাট করে দেওয়া আন্দোলনেই জনস্বার্থবাহী আইন তৈরি হতে পারে। আর পার্লামেন্ট নিজে নিজে যা আইন তৈরি করে তা সবই জনবিরোধী। ফলে আমরা যারা মাটিতে দাঁড়িয়ে নন্দীগ্রামের কৃষকদের লড়াই দেখেছি, বিশাল আন্দোলনে অতিসামান্য হলেও কনট্রিবিউট করেছি, তারা গর্বিত। শুধু তাই নয়, এখন যাঁরা  আরএসএফ, আইসা, পিডিএসএফ, এআইএসএফ করেন তাঁদেরও  মনের জোর এটা দেয় যে তাঁদের সংগঠনগুলো একটা বিশাল ঐতিহাসিক আন্দোলনের সরাসরি শরিক হয়েছিল।

 

নন্দীগ্রামের কৃষকের লাশ ভাঙিয়ে কেউ বিধায়ক,, সাংসদ  বা মন্ত্রী হয়েছেন। নন্দীগ্রামের কৃষকের লাশ ভাঙিয়ে কিছু বুদ্ধিজীবী সল্টলেকে জমিও পেয়েছেন, বিভিন্ন সরকারি পদ পেয়েছেন। আর যাঁরা মাটিতে দাঁড়িয়ে সংগঠনটা করেছিলেন তাঁরা এখনো মামলার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আছেন, অনেকেই রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় জেলে আছেন এখনো। আর আমরা পেয়েছি মানুষের ভালবাসা। কৃষকের লাশগুলো আমাদের কাছে চেতনা। তাই যখন কোনো রাজনীতি ব্যবসায়ী তার সাময়িক রাজনৈতিক স্বার্থে আন্দোলন নিয়ে দায়িত্ব জ্ঞানহীন মন্তব্য করে বসে এবং সেই সুযোগে সে দিনকার জল্লাদরা আবার জেগে  উঠে আন্দোলনটাকেই নস্যাৎ করে দিতে চায়, তখন আবার আন্দোলনের কথা প্রচার করা জরুরি। আজকের লক্ষী ছানা সিপিআই(এম) কে দেখে সে দিনের সিপিআই(এম) কে বোঝা সম্ভব নয়। ১০ বছর ক্ষমতায় না থাকা একটা দল আক্রমণের কেন্দ্র বিন্দুও হতে পারেনা। কিন্তু নন্দীগ্রামের আন্দোলন নস্যাৎ করার মধ্যে দিয়ে আগামী দিনের বিশ্বায়ন তথা সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে যে কোনো লড়াইকে অস্বীকার করার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে যায়। তাই এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যাক্তির কর্তব্য বলে মনে করি।



“নো ভোট টু বিজেপি” স্লোগান কি আদতে বিজেপি-আরএসএস এর ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করতে সাহায্য করবে?

শুক্রবার, মার্চ ২৬, ২০২১ 0 Comments A+ a-

“নো ভোট টু বিজেপি” স্লোগান কি আদতে বিজেপি-আরএসএস এর ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করতে সাহায্য করবে?


ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যখন ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের নাকের ডগার থেকে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা সিটের মধ্যে ১৮টি ছিনিয়ে নেয়, তখন গোটা রাজ্য জুড়ে যদিও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই(এম)] এর নেতৃত্বাধীন ধুঁকতে থাকা ও রাজনৈতিক ভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া বামফ্রন্ট ও তার মালিক কংগ্রেস পার্টি নিতান্তই খুশি হয়, অনেক প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক সংগঠন ও মানুষ কিন্তু চোখে সর্ষে ফুল দেখেন। রাজ্যে বিজেপি ২০২১ এ ক্ষমতায় আসছে আর এসে ব্যাপক জনগণ কে বেনাগরিক করে দেওয়ার স্বার্থে জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জী (এনআরসি) করছে বলে একটা আতঙ্কের মহল তৈরী হয়। এর পরে করোনা ভাইরাসের নাম নিয়ে যখন রাজ্য সরকার কে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে মানুষের গণতান্ত্রিক সব অধিকার খর্ব করে দিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র সরকার, তখন কোন বিকল্প রাজনীতির সন্ধান না করে, কোন রাজনৈতিক ভাবে বলিষ্ঠ কর্মসূচী না রেখে, একদল ফ্যাসি-বিরোধী বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্র-যুবরা জড় হয়ে “একটিও ভোট বিজেপি কে না” বা “নো ভোট টু বিজেপি” নামক একটি আন্দোলনের জন্ম দিলেন কলকাতা শহরে।


জন্মলগ্ন থেকেই “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকেরা বলে আসছেন যে তাঁরা চান রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী ভোট যেন ভাগ না হয় আর সকল মানুষ কে তাঁরা অনুরোধ করবেন যাতে তাঁরা তাঁদের ভোট যে কোন দল কে দিলেও বিজেপি কে যেন না দেন। এই নীতির সাথে রাজনৈতিক ভাবে সমমনোভাব প্রকাশ করে একমাত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন [সিপিএই (এম-এল) লিবারেশন] ও অন্য কিছু ভোটপন্থী প্রাক্তন নকশালপন্থীরা। “নো ভোট টু বিজেপি” বলে তাঁরা নানা ভাবে কলকাতা শহরে ও কিছু মফৎসলে প্রচার শুরু করেন। তবে যেহেতু এই রাজনৈতিক লাইনে স্পষ্ট ভাবে কোন বিশেষ দলকে ভোট দেওয়ার কথা বলা হয়নি তাই বারবার এর সুফল কুড়াবার চেষ্টা করে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। যেহেতু তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা সংগঠন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে রাজ্যে, তাই নির্দ্বিধায় এই দলের ঘাড়ে চেপেই নির্বাচনী বৈতরণী পার করার চেষ্টা করে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন সমর্থিত “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলন। আবার বিজেপি-বিরোধিতার কারণে এই আন্দোলনের উপর চরম ভাবে ক্ষেপে যায় সিপিআই (এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোট। গোটা রাজ্যে তারা বিজেপি কে হারাবার চেয়ে তৃণমূল কংগ্রেস কে পরাজিত করার উপর বেশি জোর দেয়।


পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন কে পাখির চোখ করে যখন বিজেপি ও তার পিতৃপ্রতীম সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) তীব্র গতিতে সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে, মুসলিম-বিদ্বেষ তীব্র করে, হিন্দু ভোটের মেরুকরণ করা শুরু করলো তৃণমূল কংগ্রেস কে অনায়েসে হারাতে, সেই সময়ে অনেক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মনে করলেন যে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলন করে বিজেপি-বিরোধী ভোটের মেরুকরণ না করলে পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া কালবৈশাখীর তাণ্ডব আটকানো যাবে না। ফলে নানা ভাবে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলনের প্রচার শুরু হল এবং শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রামে দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বও সমর্থন জানিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, যখন গোটা রাজ্যে বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়া নিজের পক্ষে টেনে ও ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে রাজ্যের ক্ষমতা হাতাতে চাইছে তখন সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ কে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বললেই কি ফ্যাসিবিরোধী দায়িত্ব খালাস হয়ে যায়? শুধু বিজেপি কে ভোট না দিতে বলে অন্য যে কোন প্রার্থী কে ভোট দিতে বললে কি হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে, যা এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের নানা আদিবাসী ও দলিতদের মধ্যে শক্ত ভিত গড়ে তুলেছে এনআরসি থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, রোখা সম্ভব?


তাত্ত্বিক ভাবে অনেকে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলনের নানা ব্যাখ্যা করেছেন। তবে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের কথা বলেও তাঁদের সাথে সম্পর্কহীন এই আন্দোলনের মূল কর্মপদ্ধতি হল অন্য দলের সংগঠনের ঘাড়ে চেপে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করো। যাঁদের ডাকে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলন শুরু হল, পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের কোন সংগঠন কেন বিজেপি কে পরাস্ত করতে গত সাত বছরে গড়ে উঠলো না? কেন তাঁদের তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে বামফ্রন্টের মতন বিলীন হতে থাকা শক্তির সাহায্য প্রার্থী হতে হয় বিজেপি কে হারাতে? অথচ ২০১৩ সালের শেষ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কিন্তু আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে নিজের সংগঠন কে শক্তিশালী করে তুলেছে ও নানা কায়দায় বিজেপির বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করেছে? তাহলে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী শিবির কেন পারেনি? সমস্যাটা কি টেকনিক্যাল বা অর্থের সমস্যা? নাকি রাজনৈতিক সমস্যা?


আদতে যে অজুহাত দিয়েই এই “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলন গড়ে তোলা হোক না কেন, এর আসল উদ্দেশ্য হল বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষ কে সক্রিয় প্রতিরোধের রাস্তা থেকে সরিয়ে, ভাত আর ইজ্জতের সংগ্রাম থেকে সরিয়ে, শুধু মাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই যে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা যায় সেই দেউলিয়া রাজনীতিতে বিশ্বাস করিয়ে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের পথে ঠেলে দেওয়া। এই পথ দোদুল্যমান অথচ আত্মস্বার্থে চিরমগ্ন শহুরে মধ্যবিত্তদের প্রিয় হবেই কারণ এতে আছে উদারনৈতিক রাজনীতির স্রোত ধারা, তবে এই পথ শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি ও শোষিত মানুষ কে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেবে না, কারণ এই পথের কোন নির্দিষ্ট কর্মসূচী নেই। বিজেপি-র বিরুদ্ধে কাকে নির্বাচিত করবেন জনগণ? আর তার নীতিগুলো কি সত্যিই বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে? এই প্রশ্নটি যতটা সাধারণ গরিব মানুষ কে নাড়া দেবে—কারণ প্রতিবার তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ঠকতে হয় আর সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হতে হয়—ততটা শহুরে মধ্যবিত্ত কে নাড়া দেবে না। কারণ শেষোক্তদের প্রতিদিন রাজনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে হয় না।


একটি নেতিবাচক স্লোগান—“নো ভোট টু বিজেপি”—কোন ইতিবাচক রাজনীতির জন্ম দিতে পারে না কারণ এই রাজনীতি একটা কাজ করতে মানা করলেও ঠিক কী করতে হবে সেই কথা বলছে না। বিজেপির বিরুদ্ধে যদি একজন তৃণমূল কংগ্রেস বা কংগ্রেস বা সিপিআই (এম) কে ভোট দেন তাহলে কী গ্যারান্টি আছে যে ভোটে জিতে সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি একটু ভাল দামের জন্যে নিজেকে বিজেপি কে বিক্রি করে দেবেন না? বা সাধারণ মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না? এই নেতিবাচক “নো ভোট টু বিজেপি” স্লোগানের জায়গায় যদি “রেজিস্ট বিজেপি” বা “ডিফিট বিজেপি” বা “ডিফিট আরএসএস” স্লোগান তুলে সংগ্রামটিকে ভোটের সমীকরণের রাজনীতির থেকে মুক্ত করে সক্রিয় রাজনৈতিক প্রতিরোধের পথে, আরএসএস ও বিজেপি কে সমূলে রাজ্য থেকে উৎখাত করতে দেওয়া হয় তাহলে কি বেশি মানুষ কে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে নাড়া দেওয়া সম্ভব হত না? সম্ভব হত না কি একটি লড়াকু সংগঠন গড়ে প্রতি এলাকায় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে প্রতিরোধ করা?


পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বেই দেখা গেল এই রাজ্যে ভোট হচ্ছে না বরং গণতন্ত্রের ঘোমটা দিয়ে খেমটা নাচ হচ্ছে। অসংখ্য কেন্দ্রে দেখা গেল ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এর গরমিল। দেখা গেল নানা অঞ্চলে আরএসএস ও বিজেপির সশস্ত্র হার্মাদ বাহিনী কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর চোখের সামনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষ কে বিজেপি কে ভোট দিতে বাধ্য করছে। দেখা গেল কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অঞ্চলের বাসিন্দারা অভিযোগ জানালেন বিজেপির দালালি করার। এই কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েই কিন্তু ধেই ধেই করে নেচেছিল বিমান বোস-সূর্যকান্ত মিশ্ররা। সিপিআই (এম) আর কংগ্রেস স্বাগত জানিয়েছিল মোদী সরকারের আধা-সামরিক বাহিনী কে। আর বিজেপির সরাসরি দালালি করা ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা তো স্পষ্ট ভাবেই দেখা গেল। রাজ্যের শাসকদল যখন একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থায় তখন কী ভাবে “নো ভোট টু বিজেপি” বলে একটি প্রি-ফিক্সড (পূর্বনির্ধারিত) ম্যাচে বিজেপি কে নির্বাচনী খেলায় এমন বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীরা হারাতে চায় যাঁদের নিজেদের মাটির সাথে কোন সম্পর্ক নেই আর মানুষের মাঝে কোন সংগঠন নেই?


সিপিআই (এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের দেউলিয়াপনা দেখে থাকলেও, কংগ্রেসের সন্ত্রাস দেখে থাকলেও, তৃণমূল কংগ্রেসের লুঠতরাজ দেখে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিজেপি-আরএসএস এর ভয়ানক ফ্যাসিবাদী শাসন দেখাননি। তাই তাঁদের ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ানোর প্রক্রিয়াটা লম্বা আর তাতে নির্বাচন কোন বিকল্প না। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মানুষের পছন্দ বা বাছাই করার ভূমিকা কম থাকে বরং শাসকশ্রেণীর দ্বারা অনুমোদিত, তাদের শ্রেণীস্বার্থ কে সুদক্ষ ভাবে রক্ষা করার ক্ষমতার অধিকারী রাজনীতিবিদদের বিজয় চিরকালই সুনিশ্চিত থাকে। কোন নির্বাচনের ফলাফল কোনদিনই শাসকশ্রেণীর চাহিদার বিপরীতে যেতে পারে না কারণ বিশ্বের ইতিহাস সাক্ষী যে এই ঘটনা ঘটলেই হয় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে না হয় অন্য কোন কায়দায় সেই রকম বিজয়ী শক্তি কে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি পরাস্ত করে।


তবুও যেহেতু অনেকে “নো ভোট টু বিজেপি” আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিজেপি কে তৃণমূল কংগ্রেস বা সিপিআই (এম) এর মতন দলের মাধ্যমে হারাবার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁদের মহৎ সেন্টিমেন্ট কে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলা উচিত যে এই মুহূর্তে এই দিবাস্বপ্নে মজে থাকলে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের চরম ক্ষতি হবে। তার চেয়ে বেশি দরকার হল সাধারণ মানুষ কে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী গণসংগ্রামে নিয়ে আসা ও তাঁদের সংগঠিত করে আরএসএস ও বিজেপি কে প্রতিরোধ করা এবং পরাস্ত করা। তার জন্যে দরকার এই প্রতিরোধের রাজনীতির সাথে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে সবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা পূর্ণ করার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বিজেপি ও আরএসএস যে অর্থনীতির শক্তিতে বলীয়ান হচ্ছে সেই অর্থনীতির পাল্টা একটি বিকল্প অর্থনৈতিক মডেল জনগণ কে দেখানো ও তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্যে, জনগণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার জন্যে উৎসাহিত করে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে আসা আজ ভীষণ জরুরী আর তাই বিজেপির সমস্ত দুর্বল খুঁটিতে আজ ধাক্কা দিতে হবে সজোরে। নির্বাচনী ভীরুর ক্রন্দন আজ জনগণ কে কোন ভাবেই রক্ষা করবে না।

ঐতিহাসিক ২৪শে ফেব্রুয়ারি: বহরমপুর থেকে প্রেসিডেন্সি জেল এর সংগ্রামের কথা

বুধবার, ফেব্রুয়ারী ২৪, ২০২১ 0 Comments A+ a-

চিরকালই শাসক শ্রেণী চেষ্টা করে যাতে জনগণ কোনদিনই শোষিত মানুষের সংগ্রামের কাহিনী, তাঁদের শিকল ভাঙার সংগ্রামের কথা যাতে জানতে না পারে। তাই যে যে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কাহিনী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কে উদ্বুদ্ধ করে মহা সংগ্রামের পথে চলতে, তাকে আড়াল করে রাখা হয়। তাই ১৯৭১ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি বহরমপুর জেল এর ভিতরে বন্দী, নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের আলোকে গড়ে ওঠা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) [সিপিআই (এম-এল)] এর কর্মীদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও শাহাদাত, এবং তার ঠিক পাঁচ বছর পরেই, ১৯৭৬ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি সেই পার্টির নেতৃত্বেই শাসকশ্রেণীর বজ্র কঠিন ঘেরাটপে বন্ধ কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙার মধ্যে রয়েছে এক সংগ্রামী সম্পর্ক যা শাসকশ্রেণী কোন ইতিহাসে জীবিত না রাখলেও মানুষের চেতনায় তা চির জীবন্ত।

নকশালবাড়ির জন্মদাতা ছিলেন চারু মজুমদার, যিনি ভারত উপমহাদেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট দ্বন্দ্বগুলোর সঠিক সমাধানের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম শুরু করেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, মাও জেদং-এর  চিন্তাধারার সঠিক প্রয়োগ মারফৎ। এর ফলে ভারত উপমহাদেশের দার্জিলিং জেলার তিনটি ছোট্ট গ্রাম―নকশালবাড়ি, ফাঁসীদেওয়া আর খড়িবাড়ি―জেগে ওঠে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনায়। প্রথমবার কৃষক জমি দখল বা ফসলের জন্যে নয়, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্যে সংগ্রাম শুরু করেন। জন্ম হয় নকশালবাড়ি-র 

এই সংগ্রাম যেমন কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংশোধনবাদের নির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশগুলোর বিরুদ্ধে জেহাদ ছিল, তেমনি চীনের মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চেতনায়, আত্মত্যাগের রাজনীতির ভিত্তিতে নতুন মানুষ গড়ারও সংগ্রাম ছিল। সেই নতুন মানুষ, মাও জেদং-এর চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ মানুষ যা কে কোন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বা আধুনিক অস্ত্র দমন করতে পারবে না কারণ সে, মাও-র ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও উত্তরাধিকারী লিন বিয়াও-র ভাষায়, "একটি আত্মিক এটম বোমায়" পরিণত হবে। 

চারু মজুমদারের রাজনীতির আলোকে, যা মাও জেদঙ্গের চিন্তাধারার ভারতীয় উপমহাদেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সঠিক প্রয়োগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিপ্লবী রাজনীতি, সেই নতুন মানুষ গড়ার কাজ শুরু করে সিপিআই (এম-এল)। আর সেই নতুন মানুষ, রাষ্ট্রের বেড়ি আর শৃঙ্খল, উঁচু পাঁচিল আর রাইফেল কে উপেক্ষা করে বন্দী শালা থেকে মুক্ত হয়ে আপামর খেটে খাওয়া জনতার সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে চায়। তাই সে জেল ভাঙে। আর ভাঙে শাসকের ঔদ্ধত্ব। 

সেদিন বহরমপুর জেলের শহীদ বিপ্লব ভট্টাচার্য, মৃদুল সরকার, আশিস ভট্টাচার্য, গোরা দাশগুপ্ত, নজরুল ইসলাম, কানাইলাল বঙ্গ, প্রভাত ব্যানার্জ্জী এবং তিমিরবরণ সিংহ সেই নতুন মানুষ ছিলেন, যাঁদের শারীরিক মৃত্যু হলেও চেতনা যাঁদের আজও অমর ও অমলিন। তাঁরা চারু মজুমদারের রাজনীতির আলোকে উপলব্ধি করেন যে জেলে বসে থেকে পুরানো, শোষক রাষ্ট্র কে মান্যতা দিয়ে বা তার কাছে কিছু সুবিধা চাওয়া একটি বিপ্লবীর জীবনে কদর্য কাজ।তাঁর কাজ হল বিদ্রোহ করা, মাও জেদং-এর  চিন্তাধারার প্রচার ও প্রসার করা এবং শ্রমিক শ্রেণী এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হওয়া। তাই তাঁরা শাসকের চোখে চোখ রেখে সংগ্রাম করেন ও শহীদ হন।

তাঁদের শাহাদাত কে শ্রদ্ধা জানান চারু মজুমদার ও দুনিয়ার বিপ্লবীরা। শহীদ হয়ে তাঁরা অনুপ্রেরণা দেন আগামী দিনের বিপ্লবীদের। যখন সরোজ দত্ত ও লিন বিয়াও এর শাহাদাতের পরে চারু মজুমদার কে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে হত্যা করা হল, তখন সিপিআই (এম-এল) কে ভাঙতে এগিয়ে এল পার্টির মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একের পর এক শত্রুর দালালেরা। কানু স্যানাল, সৌরেন বোস, নাগভূষণ পট্টনায়ক, অসীম চট্টোপাধ্যায়, প্রভৃতি নেতারা বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেরি করা শুরু করে সংশোধনবাদী তত্ত্ব, নকশালবাড়ির নাম নিয়ে নকশালবাড়ি কে জাল করার কাজ শুরু করে। আর তার প্রভাব জেলে বন্দী সিপিআই (এম-এল) কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও পড়ে। অনেকে মনে করেন সিপিআই (এম-এল) ভেঙে গেছে, অনেকে লাইন চেঞ্জ করেন আর অনেকে অপেক্ষা করেন চারু মজুমদারের রাজনীতির ভিত্তিতে আবার সংগ্রাম গড়ে ওঠার।

শেষ দলটি আনন্দিত হয় যখন তাঁরা শোনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির নেতা মহাদেব মুখার্জী, যাঁকে নিজ ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় কমিটির অতিরিক্ত সদস্য জগজিৎ সিংহ জোহাল ওরফে "শর্মা" কেন্দ্রীয় কমিটিতে কো-অপট করেন, ঘোষণা করেন "শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড চারু মজুমদার বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন তাঁর রাজনীতির মধ্যে, বেঁচে আছেন তাঁর নিজের হাতে গড়া সিপিআই (এম-এল) এর মধ্যে, বেঁচে আছেন জনগণের মধ্যে।" যার অর্থ সিপিআই (এম-এল) ও চারু মজুমদারের রাজনীতি বিলুপ্ত হয়নি, বেঁচে আছে। আর এই আশ্বাস থেকেই নতুন লড়াই গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে কামালপুর-কালীনগরের সংগ্রাম, রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার নতুন উৎসব শুরু হয় দক্ষিণবঙ্গে। 

যদিও বাইরে নানা বেইমানির কারণে দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরে সিপিআই (এম-এল) ধাক্কা খায় ও মহাদেব মুখার্জি শিলং থেকে গ্রেফতার হন, জেলের ভিতরে সংশোধনবাদ এর বিরুদ্ধে লড়াই চলতে থাকে। এই সংগ্রামে অগ্রগামী হয় কলকাতা শহরের আলিপুরে অবস্থিত প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী সিপিআই (এম-এল) কর্মীরা। জেল পার্টি কমিটি (জেপিসি) ও আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী মহাদেব মুখার্জীর মধ্যে চলতে থাকলো গোপনে কথোপোকন, সংবাদ আদানপ্রদান যা পরে "জেল থেকে নির্দেশ" নামক পুস্তিকায় ছাপা হয়। এই আলোচনার মধ্যেই স্থির হয় যে সিপিআই (এম-এল) চারু মজুমদারের রাজনীতিতে অবিচল থাকবে।  জেলের ভিতর "রাজনৈতিক বন্দী" হওয়ার দাবি না করে জেল ভাঙার সংগ্রামে এগোনোর পথে অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত নেয় জেপিসি। 

১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেস সরকার যখন জরুরী অবস্থা জারি করে ঝুঠো গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে ফেলে দেয়, তখন বেশির ভাগ সংশোধনবাদী বাম ও জেলবন্দি প্রাক্তন নকশালরা হতাশাবাদের জাল ছড়াতে শুরু করে। চারু মজুমদার আর নকশালবাড়ি-র সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রাজনীতি কোন কাজে আসবে না বরং সংসদীয় দলগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে সংসদীয় সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কংগ্রেস কে হারাতে হবে–এই লাইন প্রচার শুরু করে। 

এরই মধ্যে, দীর্ঘ দিন ধরে জেলের মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম করে সিপিআই (এম-এল) প্রেসিডেন্সি জেল জেপিসি সিদ্ধান্ত নেয় যে জেল ভেঙে আপামর খেটে খাওয়া জনগণের সাথে একাত্ম হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মুক্তাঞ্চল। চারু মজুমদারের স্বপ্ন কে, হাজারো হাজারো শহীদদের স্বপ্ন কে বাস্তবায়িত করতে হবে। এই সংকল্প নিয়ে, সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ, নির্দিষ্ট দায়িত্ব বন্টন ও মাও জেদং-এর চিন্তাধারা ও চারু মজুমদারের রাজনীতির উপর নিঃশর্ত বিশ্বাস রেখে, জয়ী হওয়ার আশা বুকে বেঁধে ৪২ জন কমিউনিস্ট বিপ্লবী প্রেসিডেন্সি জেলের মতন শাসকশ্রেণীর তীক্ষ নজরদারিতে থাকা ঔপনিবেশিক জমানার বন্দীশালা ভেঙে বের হতে উদ্ধত হন। 

এর আগে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে কিছু সিপিআই (এম-এল) পাঁচিল টপকে পালালেও ৪২ জনের মতন বড় দলের একসাথে পালানো অতীতে কোনদিন হয়নি। কিন্তু সেই ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে, দেশের কণ্ঠরুদ্ধ করে যখন ইন্দিরার স্বৈরতন্ত্র চলছে, ঠিক দুপুর বেলা, বহরমপুর জেলের বন্দী হত্যার বদলা নিয়ে জেল ভাঙলেন চারু মজুমদারের রাজনীতির পতাকাতলে থাকা ৪২ জন বিপ্লবী। তাঁরা জেলের দেওয়াল টপকে পালালেন না, জেলের সদর দরজা ভেঙে বের হলেন। তাঁদের চলে যাওয়ার পরে আধ ঘন্টা জেল গেট খোলা থাকলেও কিন্তু প্রায় বন্দী ২,০০০ তথাকথিত "নকশালপন্থীর" একজনও বাইরে এলেন না। 

তবে যে কোন ঘটনা ঘটলে মানুষ জানতে পারলেও, চারু মজুমদার বলেছেন সেই ঘটনা ঘটার পিছনে অজস্র ত্যাগ, সংগ্রাম ও চোখের জল আড়ালে থেকে যায়। সেদিন নিজ দায়িত্বে, স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসে স্বদেশ ঘোষ ও কালু হালদার ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁদের কমরেডরা জেল থেকে যাতে সুরক্ষিত ভাবে চলে যেতে পারেন তাই জেলগেটের কাছে তাঁরা পজিশন নিয়ে কার্বাইন-ধারী কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ (সিআরপি) কে আটকাবেন। সেদিন সেই জেলগেট এর কাছে তাঁরা দীর্ঘক্ষণ এম্বুশ করে সিআরপি কে আটকে বাকি ৪০ জন কে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দেন। এই সংগ্রামে স্বদেশ ও কালু শাহাদাত লাভ করেন ও ভারত উপমহাদেশের বিপ্লবী সংগ্রামে চির অমর হয়ে যান। 

যদিও প্রেস সেন্সরশিপের কারণে বেশির ভাগ মানুষ প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙার কথা, এমার্জেন্সির বুকে ইন্দিরার নাকে ঝামা ঘষে দেওয়ার কথা জানতে পারেননি, তবুও সেই ঘটনার কথা পরে দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে। বহরমপুরের শহীদদের সাথে একাত্ম হলেন স্বদেশ ও কালু। ১৯৭১ এর শহীদ নজরুল ইসলাম ও তিমির বরণ সিংহ আর ১৯৭৬ এর শহীদ স্বদেশ-কালু এক ও অবিচ্ছিন্ন হলেন। আর প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙা, ১৯৭৬ এর মতন প্রতিক্রিয়ার ভাটার সময়ে, প্রমাণ করলো চারু মজুমদার-এর রাজনীতির স্বার্থকতা, মাও জেদং-এর চিন্তাধারার স্বার্থকতা। আর প্রমাণ করলো যে প্রতিক্রিয়া কখনোই প্রগতি কে আটকে রাখতে পারে না। হিম্মত নিয়ে এগিয়ে গেলে জয় অবশ্যম্ভাবী। তাই ২৪শে ফেব্রুয়ারির যে স্ফুলিঙ্গ বহরমপুরের জেলে জ্বলেছিল তা প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে স্বার্থকতা লাভ করলো। 

বর্তমানে যখন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গোটা দেশে একটি অঘোষিত জরুরী অবস্থা জারী করে গোটা ভারতবর্ষ কে একটি জেলখানায় পরিণত করেছেন, যখন সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারই না, সাথে সাথে তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ—জমি ও জীবিকা—কেড়ে নিয়ে বৃহৎ কর্পোরেটদের সিন্দুকে মুনাফার পাহাড় বানাবার ব্যবস্থা হচ্ছে, তখন প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙার সংগ্রাম অন্ধকারে আলো জ্বালাবার হিম্মত দেয়। স্বদেশ আর কালু বলে ওঠেন, নির্ভয়ে এগিয়ে চলুন, জয় হবেই। বিজেপি কে উচ্ছেদ করা সম্ভব চারু মজুমদারের রাজনীতির মাধ্যমেই । সমস্ত ক্লীবতা, মতাদর্শের দৈনতা, স্বার্থপরতা আর বেইমানির বিরুদ্ধে এটাই একমাত্র জবাব।  রুখে দাঁড়ানোর স্পর্ধা। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে