সিরিয়াতে রুশ বিমান হানা মুক্তির চিহ্ন নয় - সাম্রাজ্যবাদের লুঠের মালের বখরার লড়াইয়ের চিহ্ন

শুক্রবার, অক্টোবর ৩০, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

বেশ কিছুদিন ধরে ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু তথাকথিত বামপন্থী বন্ধুগণ দেখলাম সিরিয়াতে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও সৌদি - ইস্রায়েল দুষ্ট চক্র দ্বারা প্রযোজিত ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বিমান হানা নিয়ে ভীষন ভাবে মেতে উঠেছেন। এই রুশ বিমান হানার মধ্যে অনেক তথাকথিত বাম ও কমিউনিস্টরা খুঁজে পাচ্ছেন সোভিয়েতের গন্ধ, তাঁদের মনে আশা যোগাচ্ছে পুতিনের রুশ, যেন এই রাশিয়া মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীদের ধ্বংস করে দেবে এবং এই যুদ্ধের মধ্যে তাঁরা সমাজতন্ত্রের উপকরণ খুঁজছেন অনুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারা। এদের এই কর্মকান্ড দেখে হাঁসি পায় আবার খুব মায়াও হওয়া স্বাভাবিক। বহুদিন সোভিয়েত এর গুনগান গেয়ে সকালের ইয়ে করা থেকে রাতের আহারের পর সেই ঢেকুর তোলা হয়নি যে, তাই আজ সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ধুয়ো তুলে রুশ যুদ্ধ বিমান ওড়া দেখে হাততালি না দিয়ে থাকা যায় নাকি ?

রাশিয়া কি সত্যি সত্যি ইসলামিক স্টেট ও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে ? পুতিন কি মার্কিণ দখলদারি থেকে বিশ্ব কে মুক্ত করার ব্রত নিয়েছেন ? আসাদ এর সরকার কি বিপ্লবী বিক্রমে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ধ্বংস করতে সত্যিই উদ্যোগী ? আমরা এই সমস্ত প্রশ্নের উপর গভীর অনুসন্ধান ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত কে বিশ্লেষণ করেই সঠিক উত্তর পেতে পারি।  

১৯৫৬ সালে, স্তালিনের মৃত্যুর ৩ বছর পর, আনুষ্ঠানিক ভাবে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে খ্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সংশোধনবাদীরা ক্ষমতা দখল করে বিশ্বের প্রথম ও সর্ব বৃহত শ্রমিক শ্রেনীর রাষ্ট্রের এবং সেখানে পুঁজিবাদ কে পুন: প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজির শাসন রূপে। সেই পুঁজিবাদ অল্প কিছু বছরের মধ্যেই পররাষ্ট্রগ্রাসি ও উপনিবেশ - আধা উপনিবেশে পুঁজি রপ্তানিকারী এক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মাও জেদং এর নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এর তীব্র বিরোধিতা করে এবং এই সমাজতন্ত্রের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রসার করানো সোভিয়েত রাষ্ট্র ও তার নেতৃত্ব কে খোলাখুলি সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ হিসাবে চিন্তিত করেন।  বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুইটি শিবিরের জন্ম হয়, একদিকে সোভিয়েতপন্থী সংশোধনবাদীদের, যারা খোলাখুলি মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের নীতির পক্ষে ওকালতি করে ও পুঁজিবাদ থেকে শান্তিপূর্ণ (পড়ুন সংসদীয় কায়দায়) সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ঘৃণ্য মার্কসবাদ - লেনিনবাদ বিরোধী লাইন আমদানি করে। অন্যদিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও মাও জেদং এর নেতৃত্বে বিশ্বের বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন ঘনীভূত হয় এবং বিপ্লবের মাধ্যমে, এশিয়া -আফ্রিকা- দক্ষিণ আমেরিকার গ্রামাঞ্চল দিয়ে পৃথিবীর শহরাঞ্চল - ইউরোপ ও আমেরিকা কে জনযুদ্ধের মাধ্যমে দখল করার বিপ্লবী লাইনের পক্ষ অবলম্বন করে। দেশে দেশে জ্বলে ওঠে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জনযুদ্ধের আগুন।  ঠিক এমন সময়ে ১৯৬৯ সালে লিন বিয়াও কতৃক মাও জেদং এর চিন্তাধারার ভিত্তিতে যে রাজনৈতিক প্রস্তাব চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেসে গৃহীত হয় তার সারমর্মে বিশ্বের প্রধান চারটি দ্বন্ধ দেখানো হয় -: প্রথম দ্বন্ধ দুনিয়ার নিপীড়িত জনগণের সাথে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্ধ, পুঁজিবাদী ও সংশোধনবাদী দেশে পুঁজিবাদ ও শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যেকার দ্বন্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বাজার দখলের স্বার্থে দ্বন্ধ, এবং সমাজতান্ত্রিক দেশের সাথে সাম্রাজ্যবাদী ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বন্ধ। এই দ্বন্ধগুলির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে যে বাজার দখলের দ্বন্ধ ছিল তার ফলেই ঠান্ডা যুদ্ধ চরম রূপ ধারণ করে এবং এই দ্বন্ধে বেশিদিন নিজের মুখোস না ধরে রাখতে পারায় এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে দেশের তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক উপরিকাঠামোর দ্বন্ধের ফলে ৮০'র দশকের শেষ পর্ব থেকে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মসনদে ধস নামতে থাকে এবং শোধনবাদের তীব্র সংকটের মধ্যে দিয়ে ১৯৯১ এর শেষ লগ্নে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়, যে ঘটনা কে অতিরঞ্জিত করে বুর্জোয়া সাংবাদিকরা আজ পর্যন্ত কমিউনিজমের সংকটের ঝাল খায়।  

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ায় এবং য়েলত্সীন শাসনকালে রাশিয়ার ক্রমাগত দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ও একের পর এক উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশ হারানোর মধ্যে দিয়ে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ নিজের শক্তির পরিধি বাড়িয়ে ফেলে এবং রাশিয়ার সকল প্রাক্তন উপনিবেশ ও অর্ধ উপনিবেশে নিজের শাসন জারি করে।  এই সময়েই পৃথিবীতে মুক্ত বাণিজ্য, উদারনৈতিক অর্থনীতির বাড়বাড়ন্ত বাড়ে তীব্র গতিতে এবং মার্কিণ বহুজাতিক পুঁজি তার সর্বগ্রাসী রূপে অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে মুক্ত হতে পৃথিবীর প্রতিটি কোনায় নিজের উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে থাকে।  রাশিয়া ধীরে ধীরে য়েলত্সীনের শাসন কালে এক বিধ্বস্ত দেশে রুপান্তরিত হয়, অর্থনীতিতে দেউলিয়া, রাজনীতিতে  বৈশ্যাবৃত্তির শিকার এক অবসাদের দেশে পরিণত হয়।  এই সময়ে প্রাক্তন কেজিবি অফিসার ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উঠে আসে য়েলত্সীন কে চাপ দিয়ে এবং চেচেন গৃহযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে নিজেকে রাশিয়ার মানুষের রক্ষা কর্তা হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাতে থাকে। পুতিন সেই কেজিবি অফিসারদের অন্যতম যারা গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত - পেরেস্ত্রোইকা নীতির সমর্থন তো করতো কিন্তু সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের এক ইঞ্চি জমিও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ কে ছাড়তে তৈরি ছিল না। সোভিয়েত রাশিয়ায় তাঁরা নিজেদের ক্ষমতা এক ফোটা খর্ব হতে দিতে তৈরি ছিল না, কিন্তু মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও গর্বাচেভের বিরোধী শিবিরের য়েলত্সীন নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং গর্বাচেভের পতনের রাস্তা সাফ করে দেয়, কেজিবি ভেঙ্গে পড়ায় পুতিনকে কর্মচ্যুত হয়ে প্রশাসনের চাকরিতে ঢুকতে হয়। 

রুশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর পুতিন গ্যাস্প্রম নামক এক সংস্থা কে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তলে, গ্যাস্প্রম এর সমস্ত পরিচালকবর্গ হয় প্রাক্তন কেজিবি এজেন্ট বা পুতিনের ঘনিষ্ট বুর্জোয়া। পুতিন বিরোধী মার্কিণ একচেটিয়া পুঁজির দালাল যেসব পুঁজিপতিরা রুশ দেশে য়েলত্সীনের আমলে অতি মাত্রায় ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, পুতিন তাঁদের গারদে পোরে নিজ পছন্দের রুশ একচেটিয়া পুঁজিকে অগ্রাধিকার দিতে। বিশ্ব জুড়ে জ্বালানি ব্যবসায় গ্যাস্প্রম  ক্রমাগত ভাবে নিজ পরিধি বিস্তার করতে থাকে এবং জর্জ বুশ শাসনকাল থেকেই মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ পুতিনের রুশ সাম্রাজ্যবাদের বারবৃদ্ধি রোখার জন্যে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি বানাবার প্রচেষ্টায় রত হয়।  এর ফলে পোল্যান্ড এর মাটিতে মার্কিণ ক্ষেপণাস্ত্র তাক করে রাখা হয় মস্কো কে নিশানা করে এবং বদলায় পুতিন তাঁর বিমান বাহিনীকে মার্কিণ নৌবহর কে চমকে দিতে ব্যবহার করে।  এই নয়া শীত যুদ্ধে একদিকে বিশ্বের সর্ব বৃহত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা তার অফুরন্ত উপনিবেশ ও অর্ধ উপনিবেশের উপর নির্ভর করে রুশ সাম্রাজ্যবাদ কে মাত দিতে থাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে।  পুতিন নিজের সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ কে গোপন করার পন্থা হিসেবে বেছে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্তালিন কে। খ্রুশ্চেভ আমলে যে স্তালিন কে রুশ শোধনবাদীরা রুশ জনগণের সামনে খলনায়ক সাজাবার প্রচেষ্টা করেছিল সেই স্তালিন কে রুশ দেশের 'জাতীয় নায়ক' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো পুতিন আমলে।  সোভিয়েত স্মৃতি উস্কে দিতে শুরু হলো বিশাল সামরিক কুচকাওয়াজ, লাল ফৌজের মহিমা প্রচার করে রুশ জনগণ কে ধোকা দিয়ে নয়া জার সাম্রাজ্যের প্রসার করার কাজ এগোতে থাকলো পুরোদস্তুর। 

সিরিয়া সেই খ্রুশ্চেভ পরবর্তী আমল থেকেই সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের এক আধা উপনিবেশ ছিল। বশর আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ এর শাসনকাল থেকেই সেখানে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সোভিয়েত একচেটিয়া পুঁজির বিনিয়োগের এক লোভনীয় গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে। মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের কাছে ইরাক - সিরিয়া ও ইরান এই তিনটি দেশ কে মার্কিণ একচেটিয়া পুঁজির নয়া উপনিবেশে পরিণত করা ভীষন দরকারী হয়ে ওঠে জ্বালানি সুরক্ষার জন্যে, এই লক্ষ্যে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এক যোগে ২০০৩ এ ইরাক আক্রমণ করে নিজস্ব পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং নজর দেয় ইরান ও সিরিয়ার উপর। ইরাক যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে মার্কিণ একচেটিয়া পুঁজি নিজের বিরুদ্ধে শুধু আরবদেরই নয় বরং প্রগতিশীল শান্তিকামী মার্কিণ নাগরিক সমাজের ক্ষোভও উস্কে দেয়।  প্রবল যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের ফলে বুশ কে গদি হারাতে হয় এবং শান্তির দূত সেজে ওবামা রাষ্ট্রপতি হয়।  ওবামার প্রশাসন মার্কিণ জ্বালানি সংকট থেকে বাঁচতে ও মার্কিণ একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির স্বার্থে সরাসরি যুদ্ধের জায়গায় রোনাল্ড রেগানের কায়দায় ছায়া যুদ্ধে নামে। সিরিয়াতে কোটি কোটি ডলার ঢেলে তৈরি করে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদীদের, যাদের মার্কিণ বাহিনী স্বাধীনতা সেনানী রূপে সহযোগিতা করার প্রকাশ্য ঘোষণা করে। এই কার্যকলাপে ফরাসী, ব্রিটিশ, জার্মান একচেটিয়া পুঁজি সমান ভাবে যোগদান করে এবং মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের নয়া উপনিবেশ তুর্কির সীমানা দিয়ে নিয়মিত সন্ত্রাসবাদীদের অস্ত্র ও রসদ যোগানোর কাজ চলতে থাকে আসাদের সরকারকে উত্খাত করার স্বার্থে।  

এর মধ্যেই এই তথাকথিত স্বাধীনতা সেনানীদের একটা বড় অংশ আল কায়দার সিরিয়ান সংস্করণ আল নুসরা কে শক্তিশালী করে তোলে। অন্যদিকে সিআইএ এর গুপ্তচর আল বাগদাদী গড়ে তোলে নব্য তালিবানী ইসলামিক স্টেট নামক চরম সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী যার প্রাথমিক কার্য হলো সিরিয়া দখল করা এবং অ-মুসলমান ও শিয়া মুসলমানদের নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ছড়ানো। মার্কিণ গুপ্তচর সিআইএ এর কিছু নথি থেকে এই কথাটা স্পস্ট হয়েছে যে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ নিজ স্বার্থেই তালিবানের কায়দায় এই ইসলামিক স্টেট কে তৈরি করেছে, যেমন তারা একদা সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ কে হারাতে তৈরি করেছিল লাদেনের আল কায়দা ও তালিবান কে।  

মার্কিণ ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের টাকায় ও অস্ত্রে বলিয়ান হয়ে এবং তুর্কির এরদোগানের সরকারের খোলাখুলি সমর্থনে ইসলামিক স্টেট সিরিয়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং জনগণের উপর নামিয়ে আনে অকথ্য অত্যাচার।  সিরিয়ার সরকারী ফৌজকে বহু জায়গায় ইসলামিক স্টেটের জঙ্গীদের কাছে পরাস্ত হতে হয় এবং এর সাথে যুক্ত হয় ইসলামিক স্টেট এর বিরুদ্ধে লড়াকু কুর্দিশ জনতার ফৌজ ওয়াইপিজি ও রোজাভার উপর তুর্কির গোলা বর্ষণ। মার্কিণ ও ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামিক স্টেট কে পরাস্ত করার নামে বিমান হানা চালিয়ে ইসলামিক স্টেট এর চেয়ে বেশি আসাদের সেনাবাহিনীকে নিশানা বানায়। এই ভাবে সিরিয়াকে ক্রমাগত ভাবে গিলে ফেলতে আগ্রাসী হয় মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য কাঠপুতুল সেনা। 

এই সংকট কালে দেশের জনগণ কে সশস্ত্র করে, ইসলামিক স্টেট ও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের বিপদের বিরুদ্ধে জাগ্রত করে দেশ ব্যাপী এক প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলার জায়গায় সিরিয়ার বশর আল আসাদ মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে দর কষা শুরু করে, এবং এই প্রচেষ্টায় রাশিয়ার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। রুশ তার সৈন্য বাহিনীকে সিরিয়াতে পাঠায় এবং মহা ধুমধাম করে ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য মার্কিণ কাঠপুতুল সেনার বিরুদ্ধে বিমান হামলা করা শুরু করে। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পেটোয়া সংবাদ মাধ্যম গেল গেল রব তোলে এবং ক্রমাগত রুশ বিরোধী প্রচার চালায়। রুশ অন্যদিকে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ কে সন্ধির বার্তা দেয়, আসাদ ঘোষণা করেন যে তিনি দেশের গৃহযুদ্ধ শেষ হলে সরে দাঁড়াতে তৈরি এবং পুতিন নিজের সাম্রাজ্যে বিন্দুমাত্র ঘাটতি না সয়েও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ কে এই বার্তা দেয় যে গৃহযুদ্ধ শেষে সিরিয়ার বাজার কে বন্টন করতে রুশ তৈরি যদি আমেরিকা তাদের শর্ত মানতে প্রস্তুত হয়।  আশ্চর্যজনক ভাবে মার্কিণ দোসর জার্মানি এই প্রস্তাবে সারা দেয় এবং ঘোষণা করে যে সিরিয়ার সংকট যুদ্ধ দ্বারা নয় বরং রাজনৈতিক ভাবে সমাধান করতে হবে।  মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ চাপে পড়ে সিরিয়া নিয়ে আলোচনায় রাজি হয় এবং আলোচনায় নিজের পাল্লা ভারী রাখতে রুশ চাপ দিয়ে ইরানকেও শরিক করে।  এর ফলে সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গি নিধন শেষ করে এবং আসাদের বিরুদ্ধে লড়াকু সমস্ত মার্কিণ কাঠপুতুল সেনা কে পরাস্ত করে রুশ সিরিয়াকে স্বাধীন ভাবে চলতে দেবে না বরং সে নিজ একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে সিরিয়াতে নিজের প্রতিপত্তি বাড়াবে এবং মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে সিরিয়ার ক্ষমতা ও বাজার মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভাগ করে নেবে।  

এই সমঝোতা করার ইচ্ছের সাথে শক্তি প্রদর্শন করে নিজের দাপট বজায় রাখার তাগিদ এখন রুশ ও মার্কিণ দুই পক্ষেই প্রবল রূপ ধারণ করেছে। মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ শক্তিশালী, সংকটে জরাজীর্ণ হলেও তার আছে প্রচুর আধা ও নয়া উপনিবেশ, বিশ্ব কে লুঠ করে সে যত ধন ঘরে তোলে প্রতি বছর তা কোনও কালে অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কল্পনাও করতে পারেনি।  অন্যদিকে জ্বালানির বাজারে মন্দার ছোঁয়া লাগায় রুশ সাম্রাজ্যবাদের অর্থনীতি ঘোর সংকটে, রাশিয়ার অর্থনীতি সংকটের মুখে এবং রুশের তেমন কোনও নয়া ও আধা উপনিবেশের ভান্ডার নেই যা দিয়ে সে এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করবে।  মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের পান্ডারা তাই রুশ কে নিয়ে চিন্তিত নয় অতটা, কারণ রাশিয়ার অর্থনীতি এখন বিশ্বের ১৫তম, সে দিক থেকে দেখলে স্পেনের পিছনে রাশিয়ার স্থান। কিন্তু মার্কিণ দুশ্চিন্তা হলো এই যে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে পুতিন চেষ্টা করবেন যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢেলে সিরিয়ার সংকট কে বেশিদিন জিইয়ে রাখতে এবং এর ফলে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ চটজলদি সিরিয়ার তেল ও গ্যাসের সম্পদে হাত দিতে পারবে না।    

আসাদ ক্রমাগত তাঁর রাজনৈতিক সত্তা ও স্বাধীনতা হারিয়েছেন, তিনি এখন শুধু মাত্র রাশিয়ার এক গুটি ছাড়া কিছুই নন, এবং যে কোনও দিন নিজের সাম্রাজ্য ও পুঁজির স্বার্থে পুতিন সরকার আসাদকে উত্সর্গ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। সিরিয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এ এক বিশাল বিপদ, যা কোনও ভাবেই ইসলামিক স্টেট এর বিপদের চেয়ে কম নয়।  সিরিয়া নিয়ে ফাটকা খেলা মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ২০১১ তে শুরু করলেও এখন বাজারদরে রাশিয়া অনেক এগিয়ে। লেনিনের ভাষায় এদের দ্বন্ধ এখন বাজার ও কাঁচামাল দখলের দ্বন্ধ, লুঠের মাল বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্ধ।  এবং এই দ্বন্ধের ফলে জনগণ কে গোলাম বানাবে বিজয়ী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠির।  

সিরিয়ার মানুষ কে নিয়ে এই আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের জুয়া খেলার সময়ে বিশ্বের বিপ্লবী মার্কসবাদী শক্তির ভূমিকা কি হওয়া উচিত?

প্রথমেই আমাদের দেখতে হবে যে এই মুহুর্তে সিরিয়াতে প্রধান শত্রু কে ? সিরিয়ার পরিস্থিতি ও মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক পট ভূমিকায় এই শত্রু নিশ্চিত ভাবে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসর অন্যান্য পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি। এই প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে এই মুহুর্তে কোন শক্তি প্রবল ভাবে লড়ছে? এই প্রশ্নের জবাবে মেকি মার্কসবাদীরা অবশ্যই রুশ কে দেখাবেন।  কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি যে আসলে রুশ মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ বা ইসলামিক স্টেট এর জঙ্গীদের সাথে লড়ছে না বরং শক্তি প্রদর্শন করে নিজের দর কষাকষির জায়গা তৈরি করছে। সিরিয়ার সেনা ও সরকার এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিজ শক্তির ভিত্তিতে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের বিরুদ্ধে লড়ছিল কিন্তু তারা আজ রাশিয়ার শরণার্থী এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে দর কষাকষি করে নিজেদের দেশের সম্পদ মার্কিণ ও রুশ দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে লুঠতে দিতে তৈরি।

অন্যদিকে কুর্দিশ জনতার ফৌজগুলি কুর্দ স্বাধীনতার স্বার্থে তুর্কি ও সিরিয়ার সরকার এবং ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য জঙ্গীদের সাথে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করছেন। আজ সিরিয়ার বিপ্লবী দেশপ্রেমিক শক্তির উচিত মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের সাথে রুশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্ধের সুযোগ গ্রহণ করা, কুর্দিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহযোগিতা করা এবং দেশব্যাপী মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের বাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা। এই লড়াই কে এই মুহুর্তে মার্কিণ - রুশ দ্বন্ধ যদিও অনেক সাহায্য করবে কিন্তু পরবর্তীকালে নিজ একচেটিয়া পুঁজির শোষণ লুণ্ঠনের অধিকারের স্বার্থে সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবে। সিরিয়াতে এক বিপ্লবী শক্তির উঠে দাঁড়ানো দরকার যা শ্রমিক - কৃষক ও মেহনতি মানুষের স্বার্থে সংগ্রাম করবে, কুর্দিশ স্বাধীনতার দাবিকে স্বীকার করবে এবং ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য মার্কিণ পদলেহী কুকুরদের বিরুদ্ধে লড়াইতে যুক্ত ভাবে সামিল হতে সিরিয়ার সরকারের উপর চাপ দেবে। রুশ বিমান হানার এইটুকু সুযোগ একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যেই সিরিয়ার বিপ্লবী দেশপ্রেমিক শক্তিগুলি নিতে পারে এবং তাকে ব্যবহার করে মার্কিণ পদলেহী ইসলামিক স্টেট, আল নুসরা ও অন্যান্য পেটোয়া বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারে। একই সাথে এই শক্তিকে দেশের মানুষ কে রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হবে সাম্রাজ্যবাদীদের জুয়া খেলার বিরুদ্ধে ও আসাদের দুর্বল নেতৃত্বের ব্যাপারে এবং তাঁদের নেতৃত্ব দেবে দেশ কে সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুরদের থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে।  

রুশ বিমান হানা দেখে উল্লাসিত সিরিয়া থেকে হাজারো মাইল দুরে বসা মেকি বামপন্থীরা কঠিন শ্রম দিয়ে মুক্তি সংগ্রামে খেটে খাওয়া মানুষকে সামিল করা কাকে বলে তা জানেন না।  যেহেতু রুশ বিমান হানা চালাচ্ছে তাই নাকি স্বতস্ফুর্ত ভাবে মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহক ইসলামিক স্টেট ও আল নুসরা সহ অন্যান্য জঙ্গীদের পতন ঘটবে, এই বালখিল্য চিন্তা আজ মস্কো কে মুক্তির কেন্দ্র বানিয়ে নিজ দুর্বলতা ঢাকার এক জঘন্য প্রয়াসে পরিণত হয়েছে। বিপ্লবী বামপন্থী ও মার্কসবাদীদের এটা মনে রাখতে হবে যে রাশিয়া যুদ্ধে নেমেছে নিজ একচেটিয়া পুঁজির রক্ষা ও শক্তিবৃদ্ধির স্বার্থে, নিজ দেশের সংকট থেকে মানুষের চোখ ঘোরাবার স্বার্থে, কোনও ভাবেই মানব মুক্তির স্বার্থে না।  কারণ সাম্রাজ্যবাদ নিজেই মানবমুক্তির সব চেয়ে বড় শত্রু এবং সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংস ব্যতিরেকে মানব জাতির সত্যিকারের কোনও কল্যাণ সম্ভব নয়।

                                              

মানুষ খেঁকো গরু ও ভারতের রাজনীতি

সোমবার, অক্টোবর ১৯, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

ছোটবেলায় ইস্কুলে গরুর উপর রচনা আমরা প্রায় সকলেই লিখেছি। পেন্সিলের ডগা চিবিয়ে খাতায় লিখতাম গরু একটি গৃহপালিত পশু, গরুর চারটি পা, দুইটি শিং, গরু ঘাস খায়, ইত্যাদী। ছোটবেলা থেকেই জানতাম গরু শান্তশিষ্ট স্বভাবের পশু, এর কোনো আক্রোশ নাই, এবং মূলত গরু তৃণভোজী প্রাণী।  কিন্তু আজ আমার চোখের সামনে সেই তৃণভোজী গরু ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে সাংঘাতিক এক মানুষ খেঁকো প্রাণী, অক্টোবরের শুরু থেকে আজ অবধি প্রায় তিনটি মানুষ কে গরু খেয়ে ফেলেছে, শুধু তাই নয় সারা দেশ জুড়ে মানুষ খেঁকো গরু এক আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। 

মহাম্মদ আখলাক নামক উত্তর প্রদেশের দাদরি জেলার এক বাসিন্দা কে গরু মাতার সন্তানেরা দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে প্রথমে। তাঁর দোষ ছিল যে তিনি নাকি গরু মাতার মাংস ভক্ষণ করেছিলেন, যাই হোক যদিও পরবর্তী কালে প্রমাণিত হয় যে তাঁর ফ্রিজে রাখা মাংস গরুর না বরং পাঁঠার, তবুও তাঁকে প্রাণ হারাতে হয়। উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর জেলার এক যুবক নোমান কে শিমলার কাছে গরু ছানারা পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে গরু পাচারের অভিযোগের ভিত্তিতে, তাও আবার পুলিশের চোখের সামনে। বিজেপি শাসিত রাজ্যের গরু ভক্ত পুলিশ বীর বিক্রমে নোমানের সাথীদের গ্রেফতার করে জেলে পোরে, যদিও হত্যাকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কারণ তারা বানর সেনার (ওই বজরং দল আর কি) সদস্য। এই খুনের রেশ মিটতে না মিটতেই ফের ১০ দিন ধরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে হার মানেন কাশ্মীরি যুবক জাহিদ, যার ট্রাকে করে গরু পাচার হচ্ছে বলে গাড়িতে পেট্রল বোমা ছোড়ে জাতীয়তাবাদী নিরামিষাশী সন্ত্রাসবাদী ওরফে সংঘ সমর্থকরা।  

এই সকল হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে দেশজোড়া প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদে সামিল হলেও, মোদী জমানায় বিজেপি ও তার পিতৃদেব আরএসএস এর তাতে বয়েই গেল। বুক ফুলিয়ে আরএসএস মুখপত্র পাপী গো মাংস ভক্ষণকারীদের মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত করার বিধান দেয় তার অনুগত নন্দী ভৃঙ্গীদের। কুত্সিত চিত্কার করে পথে নামে গেরুয়া বসনধারী গো সন্তানেরা। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী আদেশ দেন যে গো মাংস ভক্ষণ ত্যাগ করলে তবেই মুসলমানরা ভারতে বাস করবে। যদিও তিনি উত্তর পূর্ব ভারত, কেরল ও গোয়া সহ বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে গো মাংস ভক্ষণকারী হিন্দু ও খ্রিস্টানরা কি করে ভারতে থাকার লাইসেন্স পাবেন তা নিয়ে মৌন ব্রত ধারণ করেন। এই সুযোগে উচ্চ বর্ণের হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হিমাচল প্রদেশের হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে সমগ্র দেশে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করে গরুর রক্ষনাবেক্ষণ হেতু গৌ শালা তৈরি করার আদেশ দেয়।  ঠিক যেমন জম্মু কাশ্মীরের আদালত হঠাত হিন্দু ধর্মের অনুভূতির সুরসুরি দিয়ে কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্রের আইন দ্বারা গরুর মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করে। 

সারা দেশের মানুষকে হঠাত এই গরু চক্রে বেঁধে বিজেপির কি লাভ হচ্ছে ? প্রাথমিক ভাবে এটা স্পষ্ট যে সারা দেশের ৩১% ভোট পেয়ে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে গত বছর দেশে ক্ষমতা দখল করেছে। বিজেপি নিশ্চিত ভাবে জানে যে তাদের কোনো মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক নাই ফলে যত বেশি করে হিন্দুদের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের পাঁকে ফেলা যাবে তত বেশি করে তারা দেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার চালাতে পারবে। তাই আজ ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণ ভেদের সমর্থক আরএসএস হঠাত করে শোষিত দলিত ও আদিবাসী সমাজকে তাদের দিকে টানার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একের পর এক প্রচার কার্য চালাচ্ছে। দলিত ও আদিবাসীদের একটা বড় অংশ কে টেনে আনতে পারলে বিজেপির হিন্দু ভোটের সমীকরণের রাজনীতির ষোলো আনায় আঠারো আনা আদায় হবে এবং কর্পোরেট পুঁজির কাছে আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড় - জঙ্গল - নদী জলের দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে। 

দ্বিতীয়ত: বিজেপির সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতা আজ দেশের আপামর জনগণের সামনে প্রকাশ্য হচ্ছে। নির্বাচনের পূর্বে মোদীর বড় বড় ভাষণের ফানুস  আজ মানুষের সামনে ফেটে পড়েছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের লাগাম ছাড়া মূল্য বৃদ্ধি, গণ বন্টন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রয়াস, সামাজিক প্রকল্পের খাতে ব্যাপক ব্যয় সংকোচ, খেটে খাওয়া মানুষের উপর শোষনের রোলার চালানো, বিদেশী পুঁজির কাছে ভারতবর্ষের সম্পদকে পাইকারী মূল্যে বেচে দেওয়া, ইত্যাদি যখন সরকারের উপর মানুষের আক্রোশ বাড়ছে, বিশেষ করে ২রা সেপ্টেম্বর দেশ জোড়া ধর্মঘটে ব্যাপক হারে শ্রমিক শ্রেনীর সামিল হওয়ায় কর্পোরেট পুঁজি ও তাদের রক্ষিতা বিজেপির শ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগার ঠিক তখন সরকারের কাছে হয় যুদ্ধ লাগানো না হয় দাঙ্গা লাগিয়ে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিজেদের শোষণ শাসনের নীতি প্রণয়ন করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নাই। 

এই উপরোক্ত কারণগুলির জন্যে আজ সারা দেশ জুড়ে গরুকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার আবরণ হিসাবে ব্যবহার করছে বিজেপি ও তার পিতা আরএসএস। যত বেশি করে মানুষের উপর শোষণ ও অত্যাচারের বোঝা বাড়বে তত বেশি করে এদের এই প্রচেষ্টায় ঘি ঢালবে গেরুয়াধারীদের চাঁদা যোগানকারী বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি, দেশী জোতদার -জমিদার ও মুত্সুদ্দি পুঁজিপতিরা। মুসলমান নিধন ধর্মের চেয়ে বেশি কর্মের তাড়না এই সত্যটি মানুষের কাছে অবশ্য বেশি দিন গোপন থাকবে না। কারণ গরুর আবরণ চিরকাল মানুষের দৃষ্টি থেকে আরএসএস এর কুকর্ম কে আড়াল করবে না। তৃণ ভোজী গরু যখন গণ আন্দোলনের ঠেলায় ক্ষিপ্ত হয়ে শিং বাগিয়ে আরএসএস - বিজেপি ও তাদের বানর সেনার পিছনে ছুটবে তখন কিন্তু গেরুয়া বসনধারী মেকি সন্ন্যাসী ও সাধুদের বাঁচাতে স্বর্গ থেকে কোনও দেবদূত বা অবতার আসবে না।  এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।   
                         

দুর্গাপুজোর চাঁদা, পুজোর নামে মোচ্ছব, ক্লাব কাহিনী ও অন্যান্য

শুক্রবার, অক্টোবর ১৬, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

দূর্গা পুজো যাকে আমরা মূলত শারদ উত্সব হিসেবে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের প্রধান জাতীয় উত্সব হিসেবে জানি, তা আজ বানিজ্যকরণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের এক অস্ত্র হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেছে। মূলত হিন্দু সমাজের উচ্চ জাতির সামন্ত প্রভুদের এই উত্সব বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশক অবধি মূলত জমিদার বাড়ির ঠাকুর দালানে অনুষ্ঠিত হত, এবং চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষ বোসের প্রচেষ্টায় মূলত একটি বারোয়ারি পুজো হিসেবে কলকাতার মধ্যবিত্তদের পাড়ার গলিতে প্রবেশ করে। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে বারোয়ারি দুর্গাপূজার হিরিক বাড়ে প্রথম যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের আমল থেকে, মানে সেই ১৯৬৭ সাল থেকে যখন জ্যোতি বোস প্রথম গৃহ মন্ত্রী হয়ে পুলিশ দিয়ে শ্রমিক - কৃষক আন্দোলন দমন করা শুরু করে। ১৯৭৭ এ বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই বারোয়ারি পুজোর ব্যাপ্তি শহর ছাড়িয়ে মফত্সল ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, সরকারী দান ধ্যানে ও সিপিএম এর লোকাল কমিটির নেতাদের বদনত্যায় ব্যাঙের ছাতার ন্যায় বহু ক্লাব ঘর গজিয়ে ওঠে এবং দূর্গা পুজোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। বলা বাহুল্য এই সকল ক্লাবের রাজনৈতিক সমীকরণের বদল হয় মমতাময়ী মা - মাটি - মানুষ সরকারের আমলে। পাড়ার কাউন্সিলর থেকে তৃণমূলী নেতারা পুজো কমিটির মাথায় বসে, এবং তথাকথিত বামপন্থীদের নাস্তিক সাজা ন্যাকামি বাদ দিয়ে এই দক্ষিণপন্থীদের নেতৃত্বে পুজো কমিটিগুলি হয়ে ওঠে অতি মাত্রায় আগ্রাসী ও পুজোর ব্যয় বেড়ে চলে হুহু করে সাথে চলে ক্লাবের দাদাদের মোচ্ছব। 

চাঁদা না তুললে দূর্গা পূজা বারোয়ারি ভাবে হয় না।  চাঁদা না দিলে দাদাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুরসুরি লাগে এবং তারা তখন বাড়ির দরজার সামনে ছিল চিত্কার জুড়ে দেন, কখনো দিদির দুষ্টু ভাইদের ন্যায় চাঁদা দিতে অপারগ প্রতিবেশীর দেওয়ালে বা গ্রিলের সামনে হিসি করে দিয়ে পালিয়ে যায়, বা বাজারে ও গলিতে অশ্রাব্য শ্লোক পাঠ শুরু করে গৃহ কর্তা কে দেখে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিজেপির মোদী সরকারের যোগ করা হিন্দু ধর্মের আগ্রাসী ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট দর্শন, যার ফলে এখন চাঁদা চাওয়াটা এক রকম সংবিধানিক অধিকারে দাঁড়িয়েছে।  চাঁদা তো দাদা হিন্দু ধর্মের স্বার্থে, না দিলে আপনি দেশদ্রোহী, দিলে অবশ্যই দেশ প্রেমী। 

ধরুন আপনি অ-হিন্দু এক মুসলমান বা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ এবং পাড়ার দাদারা আপনার দরজায় রসিদ নিয়ে হাজির। আপনি বললেন যে আপনি হিন্দু নন, তাহলে কি? মা তো সবার, টাকা ছাড়া কি চলবে বন্ধু ধর্ম তো সব এক! তখন আপনি জানতে চাইলেন যে ধরুন আমি পাড়ায় একটি মিলাদ শরিফ বা খ্রিস্টমাস উদযাপন করতে চাই এবং এর জন্যে যদি ঘর প্রতি এক শত টাকা চাঁদা তুলি? তখন আপনাকে জানানো হবে যে আপনার ধর্মটি এই দেশের বা এই রাজ্যের ধর্ম নয় এবং ওই সব উত্সবের খরচা কোনও ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ গর্বিত হিন্দুরা দিতে রাজি নয়। আপনি বললেন যে তাহলে আমি কেন অন্য ধর্মের উত্সবে চাঁদা দিতে বাধ্য ? তখনই ঝুলি থেকে বেড়াল বেড়িয়ে আসবে, সংখ্যালঘু প্রীতি দেখানো দিদির ভাইরা আপনাকে আরএসএস এর কায়দায় চোখ রাঙিয়ে জানিয়ে দেবে, এই দেশ হিন্দু দেশ এবং এখানে থাকতে গেলে আপনাকে অবশ্যই হিন্দু ধর্মের (তথাকথিত শ্রেষ্ঠতার দর্শনের) স্বার্থে দাদাদের মদ মাংসের টাকা যোগাতে হবেই।      

চাঁদার রসিদ মোটামুটি পাঁচশো টাকার আসেপাশে ঘোরাঘুরি করছে, যার ফলে সাধারণ গরিব শ্রমজীবি মানুষ, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ নিদারুণ সংকটে পড়ছেন। চাঁদা না দিলে পাড়ায় থাকা যাবে না, চলতে বসতে আপনাকে অপমানিত হতে হবে, তাই ছেলের দ্বিতীয় জামার বদলে ওই ক্লাবের ছেলেদের চাঁদার নামে তোলা দেওয়ায় শ্রেষ্ঠ পন্থা হয়ে ওঠে। এই অত্যাচারে একপ্রকার সকলেই অতিষ্ঠ, তবুও মানুষ আগ্রাসী তৃণমূলী সন্ত্রাসের ভয়ে, নিজের পাড়ায় এক ঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়ে, বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সন্ত্রাসের ভয়ে চুপচাপ ফুলে ছাপের মতনই নীরব থাকা শ্রেষ্ঠ মনে করেন।  

পুজোর নামে এই সন্ত্রাসী আক্রমণ চলবে দূর্গা থেকে সরস্বতী পুজো অবধি, প্রতি মাসে আপনাকে গুনতে হবে অসংখ্য টাকা শুধু পাড়ার ছেলেদের মদ - মাংস খাওয়ানোর টাকা যোগাতে। কেন দিতেই হবে পুজোর চাঁদা ? এতে সাধারণ গরিব মানুষের কি লাভ ? যে গরিব কৃষকের ফসল মারা গেল, যে বন্ধ কারখানার শ্রমিক পেট চালাতে দিন মজুরের কাজ করছে তাঁর এই পুজোর মোচ্ছবে কি লাভ হচ্ছে ? পুজোয় শুধু লাভের মুখ দেখে একের পর এক পুজো কমিটি যারা পুজোর চাঁদার টাকার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করছে, লাভ তোলে কংগ্রেসী (তৃণমূলী সহ) ও গৈরিক বাহিনীর নেতারা যাদের বদন্যতায় পুজো কমিটিগুলি মোচ্ছব করতে পারে লোকের টাকায়। এই ক্লাবগুলি থেকে বেড়িয়ে আসে ভোটের পদাতিক বাহিনী যারা আপনাকে বুথে কোন বোতাম টিপতে হবে তা জানিয়ে দেয়।  এই কারণেই এদের তোয়াজ করে চলে সমস্ত ভোট বাদী দলের নেতৃত্ব এবং সেই সমর্থনের ছাতার তলায় এই সব ক্লাব মানুষের ওপর শোষণ অত্যাচারের রোলার চালিয়ে বারোয়ারি পুজোর নামে মোচ্ছব করার টাকা তোলে।  

যত দিন এই আধা সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও তার অনুষাঙ্গিক পঁচা সমাজ ব্যবস্থা টিকে থাকবে ততদিন চলবে ধর্মের নামে এই শোষণ ও অত্যাচারের রোলার, যার সাথে সত্যিই মিলিয়ে দেখলে ওই দাদরীতে গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে ঘটিত হত্যাকান্ডের কোনও ফারাক নাই। আজকের নতুন প্রজন্মের যুব সমাজের উচিত মানুষের টাকায় এই ভাবে শহর ও রাজ্য জুড়ে চলতে থাকা বাত্সরিক মোচ্ছব উত্সবের তীব্র বিরোধিতা করা এবং মানুষকে সংঘবদ্ধ করে এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এ না হলে সারাজীবন শুধু কষ্টে অর্জিত টাকা তথাকথিত ধর্মীয় আবেগের সুরসুরি মেটাতে চলে যাবে, আর ফুলে ফেঁপে উঠবে কিছু মদন মিত্তির।        

           

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে