যাদবপুরের লড়াইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির বাইরে ছড়িয়ে প্রতিরোধ কে উৎসবে পরিণত করুন

শনিবার, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯ 0 Comments A+ a-


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের জয়ধ্বনি দেওয়া মাড়োয়ারি-গুজরাটি মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের জুতোচাটা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-পরিচালিত তথাকথিত ছাত্র সংগঠনের ভেক ধরা অবাঙালি দাঙ্গাবাজ গুণ্ডাবাহিনীর ফ্রন্টাল সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) তীব্র তান্ডবলীলা চালিয়ে আক্রমণ করলো পড়ুয়াদের, ভাঙচুর চালালো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে, তছনছ করলো ছাত্র ইউনিয়নের অফিস ও কালি লেপে দিল লেনিন, চে গেভারা, ভগৎ সিং, প্রভৃতি বিপ্লবীর ছবিতে। 

এই আক্রমণে সামনের থেকে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী’র বশংবদ ভৃত্য ও আসানসোলের দাঙ্গাবাজ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সাংসদ সুপ্রিয় বড়াল ওরফে বাবুল সুপ্রিয়, যাঁর উপর আরএসএস ন্যস্ত করেছে বাংলার হিন্দিকরণের ও বাঙালি সাবর্ণ ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায় কে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ছাতার তলায় আনার কাজ। 

এক কালে হিন্দি গান গেয়ে বোম্বাই শহরের উচ্চবিত্তদের মধ্যে স্থান করে নেওয়া বাবুল চিরকালই হিন্দির দোসর। সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদী’র পক্ষ নিয়ে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো অভিজিৎ ভট্টাচার্যের মতনই সুযোগ বুঝে বিজেপি’তে যোগ দেওয়া বাবুল আজ পশ্চিমবঙ্গের মসনদে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বসার স্বপ্ন দেখছে। আসানসোল শহরে করা দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তাঁর স্থান রাজ্য বিজেপিতে রাজ্য অধ্যক্ষ দিলীপ ঘোষ বা তাঁর গোষ্ঠীর লকেট চাটুজ্যে ও সায়ন্তন বোসের চেয়ে অনেক উপরে করে দিয়েছে। তাই আজ বাম ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি ও শাসক শ্রেণীর চোখের বিষ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গো-বলয়ের থেকে বাংলায় পাঠানো হিন্দি-ভাষী অনুপ্রবেশকারী গুন্ডাদের নিয়ে বাবুল হিম্মত করে ঢোকার চেষ্টা করে এবং ছাত্রদের গায়ে হাত তোলে নিজের ঔদ্ধত দেখাতে। 

আশু ও তিমিরের যাদবপুর এর আগে একা একা মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হিংস্র পুলিশের মোকাবিলা করে “হোক কলরব” তুলেছিল, এর আগে যাদবপুর হিন্দি আধা-পর্ণ ছবি নির্মাতা ও মোদী’র দালাল ভিবেক অগ্নিহোত্রী ও তাঁর ভাড়াটে গুন্ডাদের রুখে দিয়েছিল, আর গত ১৯শে সেপ্টেম্বর সেই ছাত্ররাই, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করে, মারের বদলে পাল্টা মার দিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ঐতিহ্য কে রক্ষা করলেন গেরুয়া ফ্যাসিস্ট গুন্ডাদের থেকে এবং ব্যারিকেড গড়ে তুললেন বাবুলের বিরুদ্ধে যিনি ছাত্রদের মেরে, ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করে জোর করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঙালি এবিভিপি’র খাতা খোলার চেষ্টা করছিলেন। 

এই সংগ্রামের ফলে ধাক্কা খেয়েছে সংঘ পরিবারের ষড়যন্ত্র। বাংলার বুকে ৪২টি লোকসভা আসনের ১৮টি দখল করে বাঙালি মুসলিমদের জোর করে বিতাড়িত করে হিন্দি ও গুজরাটি-ভাষীদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়ে যাঁরা ভেবেছিল এই রাজ্যে তাঁদের টেক্কা দেওয়ার কেউ নেই, তাঁরাই ছাত্রদের হাতে মার খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। বিজেপি নেতা থেকে রাজ্যপাল হওয়া জগদ্বীপ ধানকরের ছাত্র আন্দোলন কে ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন করার চেষ্টা করা ও হবু মুখ্যমন্ত্রী কে রক্ষা করা দেখে কারুরই জানতে বাকি নেই যে গেরুয়া বাহিনী চোট খেয়েছে।  পুলিশ প্রশাসনের উপর সর্বাত্মক কব্জা করেও (সৌজন্যে রাজীব কুমার ও মমতা’র মোদী’র সাথে সাক্ষাৎ) আরএসএস বুঝছে যে বাংলা দখলের জন্যে আরও অনেক লড়াই চালাতে হবে, অনেক রক্ত ঝরাতে হবে। 

তাই যাদবপুর কে শায়েস্তা করতে সুদূর আসানসোল, খড়্গপুর ও ঝাড়খন্ড থেকে আনানো হচ্ছে সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনী। ছাত্রদের হিংসার হুমকি দিচ্ছে সায়ন্তনের দলবল। তাঁরা কলকাতার বুকে মিছিল করে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণে মারার, জেলে পোড়ার হুমকি দিচ্ছে। বাবুল চ্যালেঞ্জ করছে ছাত্রদের, হুমকি দিচ্ছে মানসিক চিকিৎসালয়ে হীরক রাজা’র মতন মগজ ধোলাই করিয়ে ছাত্রদের নাকি সে বাধ্য হতে শেখাবে। এই সব হুমকিতে ছাত্র-ছাত্রীরা ভয় পাননি, যাদবপুর ভয় পায়নি, ভয় পেয়েছে কিছু ধুরন্ধর সুবিধাবাদীরা, যাঁরা বাবুল কে রোখার লড়াই কে বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্যবাদী বলে পলিটিক্যালি কারেক্ট হতে চাইছে।

এদের মুখে লাথি মেরে, সহযোগিতা ও উদার গণতন্ত্রের সোনার পাথরবাটি’র স্বপ্নের মায়াজাল ছিন্ন করে ছোট ছোট অঙ্কুরগুলো, যাঁরা কাল মহীরুহে পরিণত হবে, বুঝতে পেরেছে যে মারের বদলে পাল্টা মার না দিলে, ইটের বদলে পাটকেল না দিলে শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা পদদলিত হবেন তাই নয়, সমগ্র সমাজে আরএসএস এর স্বৈরতন্ত্র কায়েম হলে মেহনতি মানুষ, শ্রমিক ও কৃষক পদদলিত হবেন, তাঁদের ইজ্জত লুন্ঠিত হবে, তাঁরা লাঞ্চিত হবেন পদে পদে। যাদবপুরের লড়াই তাই মাথা নত করে না থাকার লড়াই, যাদবপুরের লড়াই স্বপ্ন দেখার লড়াই, যাদবপুরের লড়াই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে ন্যায় সঙ্গত বিদ্রোহ। 

তবে মুশকিল হবে যদি এই প্রতিরোধ, এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, সে যে সংগঠনের কর্মীরাই করে থাকুক না কেন, যদি তা শুধু শহুরে, শিক্ষিত, প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সীমিত থেকে যায়, যদি তার পরিধি বিস্তার করে শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের মধ্যে না পৌঁছতে পারে, যদি তা শোষিত জনগণ কে সক্রিয় প্রতিরোধের সংগ্রামে সামিল করে, ফ্যাসিবাদ কে যে পরাজিত করা যায়, নিজের ভাগ্য যে নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই সত্য উপলব্ধি করিয়ে তাঁদের উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে না যেতে দেয়, তাহলে কিন্তু যাদবপুরের সংগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সেটা শুধু ছাত্র সংগ্রাম থেকে যাবে, জনগণের সংগ্রাম হয়ে উঠবে না। 

আজ নির্মম ভাবে সারা ভারত জুড়ে জনগণের উপর শোষণের রোলার চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন মোদী সরকার। যে ভাবে এই সরকার হাতেগোনা কিছু দেশী মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের হাতে দেশের সম্পদ ও শ্রম বেচে দিচ্ছে, যে ভাবে এই সরকার বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির কাছে ভারতের সমস্ত ক্ষেত্র কে উদার করে খুলে দিচ্ছে অবাধ আধা-ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুন্ঠনের স্বার্থে, যে ভাবে এই সরকার ভারত রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর মধ্যেই অভ্যন্তরীন দ্বন্ধ তীব্র করে দিয়েছে এ যাবৎকাল ভারসাম্য বজায় রাখার সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো কে শুধু কিছু হাতেগোনা বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও তাঁদের বিদেশী মালিকদের তাঁবেদারে পরিণত করে, তা দেখে কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষ বুঝতে পারবেন যে এই ভারতীয় মেকী গণতন্ত্র, যা ব্যবহার করে আজ অবধি মানুষ কে বোকা বানিয়েছে ভারতের শাসক শ্রেণী, তার মেয়াদ কিন্তু প্রায় উত্তীর্ণ। 

আরএসএস ও মোদী সরকার কোন ভাবেই আর এই গণতন্ত্রের খোলস পড়ে থাকতে চায় না বরং জায়নবাদী ইজরায়েল, রাশিয়া বা তুর্কির চরম প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের মতন এরা এবার গণতন্ত্র কে সাম্প্রদায়ীকরণ ও নির্বাচন কে অসার একটি অনুশীলনে পরিণত করবে। এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক দল ও এক নেতার স্লোগানের আড়ালে বিরোধী দলগুলো কে নিস্তেজ করে দিয়ে, সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিগুলোতে সুড়সুড়ি দিয়ে, চরম ইসলামবিদ্বেষ ও ব্রাক্ষণত্ববাদী প্রচারের মাধ্যমে এক স্বৈরতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্র এরা গড়ে তুলতে চায় ২০২২ সালের মধ্যেই। তার জন্যেই বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাড়ু, আসাম প্রভৃতি রাজ্যে বিজেপি’র একচেটিয়া শাসন ক্ষমতা চাই। কাশ্মীরে ও আসামে লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনগণের থেকে বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, তাঁদের চরম ভাবে নির্যাতন করে ভারতের নব্য শাসকশ্রেণীর পদলেহী বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে এবার তাঁরা পিছু হটবে না। 

এই অবস্থায় কি কমিউনিস্ট, বামপন্থী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ও প্রগতিশীল ছাত্র-যুবদের, যাঁদের দেশ ও ভবিষ্যৎ আজ আক্রান্ত হয়েছে হিন্দি ভাষা ও হিন্দুত্বের পদাতিক বাহিনী দ্বারা, চুপ করে বসে থাকা ও রাজনৈতিক ভাবে গুটিয়ে যাওয়া উচিত না ফেটে পড়া উচিত, বিস্ফোরিত হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগ্রামের ময়দানে? আজ যখন মোটামুটি ভাবে সকল ধরণের বামপন্থী আন্দোলনই নানা ধরণের চোরাবালিতে নাকানিচোবানি খাচ্ছে তখন কিন্তু ছাত্র-যুব শক্তি তাঁদের মেধা দিয়ে এবং দূরদৃষ্টি দিয়ে নতুনত্ব সৃষ্টি করতে পারেন যদি তাঁরা দলে দলে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষদের মধ্যে, শোষিত জনগণের মধ্যে যে ভাবে মাছ জলে মিশে থাকে সে ভাবে মিশে যেতে পারেন, একাত্ম হতে পারেন এবং তাঁদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, তাঁদের রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে নেতৃত্বে উত্তীর্ণ করতে পারেন।এলাকা-ভিত্তিক ক্ষমতার সংগ্রামই আগামীদিনের মহাসংগ্রামের ময়দানে নানা স্রোত হতে মিলিত হবে, এই কাজে বিলম্ব করা উচিত নয়। 

সময় আজ বিলাসিতা আর বিলম্ব মানেই মৃত্যু। শুধু যে ছাত্র-যুবরাই আক্রান্ত তা না, তাঁদের সাথে সাথে কলকারখানার শ্রমিকেরা, বন্ধ কারখানার বেকার শ্রমিকেরা, শহুরে অসংগঠিত শ্রমিকেরা, কৃষকেরা ও গ্রামীণ সর্বহারা শ্রেণীও আক্রান্ত হতে চলেছেন প্রতি পদে। তাই এখনই যাদবপুরের প্রতিরোধ কে একটা সঙ্কল্পের সাথে, একটা সচেতনতার সাথে, গণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মূল্যবোধের সাথে জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়া উচিত, শ্রেণীর মধ্যে নিয়ে যাওয়া উচিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের বাইরে এনে এই প্রতিরোধ সংগ্রাম কে দূর্গা পুজোর চেয়েও বড় সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করা উচিত।

এই কাজ ছাত্র-যুবরা, তা তাঁরা যাদবপুরের হন বা অন্য কোন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের, কিন্তু নিশ্চয় সফল ভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন কারণ তাঁরা সকাল আট’টা বা ন’টার সূর্যের মতন প্রখর ও উজ্জ্বল। তাঁরা যদি আজ শোষিত মানুষের সাথে একাত্ম হতে পারেন তাহলে আজই ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা সম্ভব, যদি কাল পারেন তাহলে কাল সম্ভব। এই সংগ্রাম কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার নয়, এই সংগ্রাম শক্ত হাতে হাল ধরার সংগ্রাম, যা শ্রমিক ও কৃষকের সংগ্রাম এবং ছাত্র-যুব শক্তি এই সংগ্রামে বার্তাবাহকের কাজ যদি সঠিক ভাবে করতে পারেন তাহলে সুউচ্চ কেল্লার মসনদ থেকে মোদী ও তাঁর সাগরেদদের, হিন্দুত্ববাদী বদমায়েশদের, বাবুলের মতন হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের, হিন্দি আগ্রাসনের নায়কদের টেনে নামানো সম্ভব, সড়কে, মাঠে, ময়দানে সংগ্রাম করে তাঁদের পরাস্ত করাও সম্ভব। এই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়। যাদবপুরের ঐতিহ্য কে সামনে রেখে আজ বাংলার কোনে-কোনে শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামী ব্যারিকেড গড়ে তুলতে, পথে নেমে ফ্যাসিবাদ কে প্রতিহত করতে আজ ছাত্র-যুবদের এগিয়ে আসতেই হবে।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে