ঔরঙ্গজেব - কেন হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীদের কাছে একটি ঘৃণ্য নাম ?

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

ঔরঙ্গজেব কেন হিন্দুত্ববাদীদের কাছে একটি ঘৃণ্য নাম?


কিছুদিন ধরে কানে আসছিল যে আরএসএস নাকি এখন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব কে নিয়ে নানা ধরণের প্রচার চালাচ্ছে, যা একপ্রকারে আমরা ছোটবেলার থেকে ভারতের স্কুল শিক্ষা ও হিন্দু পারিবারিক শিক্ষায় যা শিখে এবং শুনে আসছি তারই নামান্তর। ঔরঙ্গজেব নাকি ভীষন অত্যাচারী সম্রাট ছিল এবং হিন্দুদের সে নাকি দু চক্ষে দেখতে পারত না, তাঁর শাসনকালে নাকি লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের ধরে ধরে মুসলমান বানানো হয়েছে এবং সে নাকি ভারতের বহু হিন্দু মন্দির ধবংস করেছে। ঔরঙ্গজেব মানেই খুন খারাপ, অত্যাচার, লুন্ঠন ও হিন্দুদের মুসলমানে ধর্মান্তরিত করার অপচেষ্টা। এই শিক্ষাটি আমাদের শিরায় শিরায় আরএসএস এর জন্মদাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দুই শত বছর ধরে ঢুকিয়ে আসছে যাতে ভারতীয়রা তাঁদের স্বাধীন মুঘল সাম্রাজ্যকাল থেকে ব্রিটিশদের পদদলিত হয়ে দাসের জীবন বাঁচা কে শ্রেয় মনে করে।  

আবুল মুজ্জাফার মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ ঔরঙ্গজেব স্বাধীন ভারতের শেষ শক্তিশালী মুঘল সম্রাট ছিলেন। তাঁর শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্য ভারতের ভূখন্ডে দক্ষিন ও মধ্য পশ্চিম ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে যুদ্ধ চালায়। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের দক্ষিন অঞ্চলের দুই মুসলমান শাসিত রাজ্য, আদিল শাহীর বিজাপুর ও কুতুবশাহীর গোলকন্ডা ভারতের মুঘল সাম্রাজ্য যুদ্ধ করে দখল করে।  বিদারের যুদ্ধে সিরি মারজান কে পরাস্ত করতে ভারতের মুঘল ফৌজ প্রথমবার রকেট ও গ্রেনেড ব্যবহার করে যা আমাদের দেশের সেই সময়ে ভাঙ্গন ধরা সামন্তবাদী ব্যবস্থা ও উদীয়মান দেশী পুঁজিবাদের একটি লক্ষণ ছিল।  ১৬৬৩ তে ঔরঙ্গজেবের নেতৃত্বে ভারতের মুঘল সরকার লেহ ও লাদাখে নিজেদের প্রতিপত্তি কায়েম করে।    


যে কোনও জাতি, ব্যক্তি, ধর্ম, ঘটনার বিশ্লেষণ বা বিচারের আগে আমাদের প্রয়োজন সেই সব ব্যক্তি, জাতি, ধর্ম বা ঘটনার সময়কালের পারিপার্শ্বিক দুনিয়াকে জানা এবং সেই পরিবেশের, চেতনার মানের, পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা। ঔরঙ্গজেব একজন অত্যাচারী সম্রাট ছিলেন, প্রশ্ন হলো সম্রাট মাত্রেই কি অত্যাচারী হতেন না ? কিছু ব্যতিক্রম ছিলেন যাদের নিয়ে আজও বহু আলোচনা হয় আর বাকিদের ব্যাপারে সভা কবিদের বন্দনা ভজনা কে মনে রেখে কেউ কেউ তাঁদের বীরত্বের গাথা আজও গান আর কেউ কেউ কোনও রাজা - বাদশার নাম শুনলেই গালাগাল দেন। ঔরঙ্গজেব অন্যান্য রাজা - বাদশাদের থেকে কোনও ভাবেই আলাদা ছিলেন না। তাঁর লক্ষ্য ছিল মুঘল সাম্রাজ্য কে বাঁচিয়ে রাখা এবং তার পরিধি বৃদ্ধি করা। সেই লক্ষেই ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজত্ব চালিয়েছিলেন যা তাঁর পিতা শাহজাহানের থেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।  কিন্তু ষোড়শ শতকে যখন ঔরঙ্গজেব রাজত্ব করছিলেন তখন ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার বলে কিছু হত না, কারণ মানব সভ্যতা তখনও সেই স্তরে উন্নত হয়নি যে গণতন্ত্র - প্রজাতন্ত্র ইত্যাদী মানুষের চেতনায় জায়গা নেবে।  জনগণ সেই সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা, উত্পাদনের প্রক্রিয়া ও সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থেকে ধীরে ধীরে সামন্তবাদের ধ্বংসের দিকে যাচ্ছিলেন।  যে ব্রাক্ষন্যবাদ শত শত বছর ধরে ভারতের জনগণের উপর জগদ্দলের মতন চেপে বসে ছিল সেই পাথরকে ইসলামে দীক্ষিত মুঘল সম্রাটরাও সরাবার চেষ্টা করেনি তাঁদের রাজত্ব বাঁচাবার ও সাম্রাজ্য বাড়াবার তাগিদে।


ঔরঙ্গজেব ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। ইতিহাসে কোনও রাজা সম্রাট ধর্ম নিরপেক্ষ ছিলেন না কারণ তাঁদের নিজেদের সভার ধর্মগুরুদের মতামত নিয়ে স্বিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হত।  কিন্তু ঔরঙ্গজেব কি অন্য ধর্মের প্রতি অত্যাচার করা কে তাঁর রাজনীতি বানিয়েছিলেন? বা এমন কোনো মুঘল বাদশাহ ছিলেন কি যিনি অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার করে গেছেন? ঔরঙ্গজেব ইসলামিক শারিয়া আইন চালু করে সেই সময়কার উত্তর ভারতে মদ্যপান, জুয়া ও বৈশ্যাবৃত্তি নিষিদ্ধ করেন।  তাঁর রাজত্ব কালে রাজপুত জয় সিংহ তাঁর সেনাপতি হিসাবে বিখ্যাত হন, রাজপুতদের তিনি মনসাব্দারী দেন এবং মধ্য ও দক্ষিন ভারতে যুদ্ধ চালাবার সময়ে মুঘলদের সৈন্যদের হাতে কোনো মন্দির ভাঙ্গা হয়নি, যদিও সেই সময় তাঁরা ঔরঙ্গজেব এর বিরোধী ব্রাক্ষণ গোষ্টির নেতৃত্বে চলা উত্তর ভারতের বহু মন্দির ভেঙ্গে দেন।  ১৬৬৬ সালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ভারতে সতী প্রথা নিষিদ্ধ করেন, যা আকবরের আমলে প্রথম নিষিদ্ধ হওয়ার পর আবার পুরোদমে চালু হয়ে যায়। ঔরঙ্গজেব শাহজাহান বা জাহাঙ্গীরের মতন সরকারী অর্থে মোচ্ছব পালন করা, মহল ও প্রাসাদ তৈরি থেকে দুরে থাকেন ও হিন্দুদের উপর ৫% হারে জিজিয়া কর চাপান ও মুসলমানদের উপর ২.৫% জাকাত কর চাপান।  এর ফলে তিনি ব্রাক্ষণদের বিরাগভাজন হন।


শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের সাথে ঔরঙ্গজেবের লড়াই বহুদিন চলে এবং এই লড়াইতে উস্কানি দেন পাহাড়ি রাজ্যের হিন্দু রাজারা, যারা মুঘল সম্রাটের কাছে শিখ গুরুকে পরাস্ত করার আবেদন জানান। কিন্তু শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের সাথে ছিলেন বহু মুসলমান এবং মুঘল সম্রাটের পক্ষে ছিলেন বহু হিন্দু এবং একজন পৌত্তলিকা পুজারী না হয়ে তিনি অন্য একজন পৌত্তলিকা পূজা বিরোধীকে কেন পৌত্তলিকা পূজারীদের কথা শুনে মারতে চাইছেন - এই প্রশ্ন তুলে গুরু গোবিন্দ সিংহ ঔরঙ্গজেব কে ভর্ত্সনা করেন।  এ ছাড়াও মহারাষ্ট্রে শিবাজীর বিরুদ্ধে মুঘল সম্রাট তাঁর সামরিক অভিযান চালান এবং পরবর্তীকালে শিবাজীর পুত্র কে হত্যা করেন।  হয়তো বা এই সব নিদর্শন তুলে আমাদের দেশের হিন্দু ফ্যাসিবাদী শক্তি ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে চায় তাদের সাধের হিন্দু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বার্থে ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করতে।  কিন্তু তারা কেউ এ কথা বলে না যে ঔরঙ্গজেবের সমস্ত সামরিক কর্মকান্ড ছিল রাজনৈতিক এবং এর সাথে ধর্মের প্রচারের চেয়ে বেশি জরুরি ছিল তাঁর সাম্রাজ্য বাড়াবার তাগিদ। যে তাগিদ সেই সময়ের সমস্ত রাজার মধ্যেই ছিল কারণ সকলেই তাঁদের সাম্রাজ্য কে বিস্তারিত করতে চাইতেন।


তবে ঔরঙ্গজেব যে কারণে ইতিহাসে ঘৃণিত হয়েছেন তার কারণ এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যখন তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তখন থেকেই ইতিহাস কে বিকৃত করে পরিবেশন করে সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়ানো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের ঔরসজাত আধুনিক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের মজ্জাগত হয়ে গেছে।   স্বাধীন মুঘল ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রথম বড়সর ধরনের পরাজয় স্বীকার করতে হয় ১৬৮৬-১৬৯০ অবধি চলা চাইল্ড যুদ্ধে। বোম্বাই ও মাদ্রাসে ব্রিটিশ ফৌজ ঘেরাবন্দী হয়।  সিদ্দী ইয়াকুব এর নেতৃত্বাধীন নৌ বহর এবং তার সাথে হাবিশ ফৌজের আক্রমণে ব্রিটিশ ফৌজরা ধরাশয়ী হয়।  সমঝোতা করতে যখন ব্রিটিশরা মুঘল সাম্রাজ্যের পায়ে পড়ে তখন মুঘল সম্রাটের দরবারে তাদের বিশাল অঙ্কের অর্থ ক্ষতিপূরণ দিতে হয় এবং মুঘল সম্রাটের সামনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মাথানত করে গড় করতে হয়, যার ফলে তারা ছাড়া পায়। এর পরে হেনরি এভরি নামক জলদস্যু যখন হজযাত্রীদের জাহাজ আক্রমন করে তখন ঔরঙ্গজেব ব্রিটিশদের উপর আবার আক্রমণ নামিয়ে আনেন এবং ব্রিটিশদের সমস্ত কারখানা ও ব্যবসা বন্ধ করিয়ে দেন।  এর ফলে ব্রিটিশরা সেই সময়ে ৬ লক্ষ পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দিয়ে শাস্তির হাত থেকে বাঁচে এবং পৃথিবীতে প্রথমবার বিশ্বজুড়ে একজন অপরাধী কে ধরতে অভিযান শুরু হয়।  যদিও সেই সময় হেনরি এভরি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।


ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঔরঙ্গজেবের এই যুদ্ধগুলি, ব্রিটিশদের পরাজয়, এবং মাটিতে নাক খত দেওয়ার কাহিনী আজও আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষার ঔরসজাত আধা ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাত্র - ছাত্রীদের জানতে দিতে চায় না। কারণ এই যুদ্ধগুলি ছিল স্বাধীন ভারতের দ্বারা তত্কালীন বিশ্বের সর্ব শক্তিমান রাষ্ট্রের বাহিনীকে পরাস্ত করার ঘটনা।  যা হয়তো আমাদের দেশের যুব ছাত্ররা জানলে তাঁদের মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে গর্ব বোধ হবে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি হবে।  


ব্রিটিশরা কোনো কালেই এই অপমান হজম করতে পারেনি এবং এর ফলে তারা মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে বিকৃত করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার ঘৃণ্য কৌশল গ্রহণ করে। যার ফলে আজও শৈশব থেকে ইতিহাসের পাতায় ঔরঙ্গজেব সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট নেতিবাচক শিক্ষাই দেওয়া হয় এবং কোনও ঐতিহাসিক এই নিয়ে বিশেষ উত্সাহ নিয়ে স্বাধীন গবেষণা করেন না। ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থা তকে পাশ করে এই দেশের ছাত্র -ছাত্রীদের মধ্যে ব্রিটিশ ও মার্কিণ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি এক বিশেষ ধরণের দুর্বলতা জন্মায়। তাঁরা ভাবে যে ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা ভারতীয়দের থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ এবং আমরা আজও অসভ্য। আমরা ট্রেনে - বাসে -ট্রামে - অফিসে এই আলোচনা অনেক শুনেছি যে ব্রিটিশরা থাকলে নাকি দেশের অনেক উন্নতি হত ! এবং এই কথা বলেন এ দেশের তথা কথিত শিক্ষিত মধ্য বিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষেরা !

ঔরঙ্গজেব সম্রাট ছিলেন স্বাধীন ভারতের, যে ভারতের মানুষ কে বিদেশীদের গোলামী করতে হতো না, যে ভারতে মানুষকে অন্য দেশের পুঁজির স্বার্থে নিজের শ্রম, জল, জঙ্গল, জমি, জীবিকা উত্সর্গ করতে হত না।  তাঁরা বাঁচতেন স্বাধীন ভারতের মাটিতে, যে মাটিতে আমরা প্রায় ৩০০ বছর ধরে বিদেশী পুঁজির গোলামী করছি প্রাণ ও মান খুইয়ে। সত্যিকারের কোনো দেশপ্রেম থাকলে তা অবশ্যই বিদেশী পুঁজির গোলামী কে ঘৃণা করবে এবং দেশের স্বাধীন বিকাশের ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করবে। যারা এর উল্টোটা করে তারা মেকি ও ভন্ড দেশ প্রেমিক এবং এদের অবিলম্বে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হোক।                    
     









এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে