একটি নিষিদ্ধ নাম - চারু মজুমদার - এক বিপ্লবীর কথা

শুক্রবার, জুলাই ৩১, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

চারু মজুমদার
চারু মজুমদার
(১৯১৮-১৯৭২)
জানি না আজকের অধুনা প্রজন্মের স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারী কিশোর বা তরুণদের মধ্যে কতজন তাঁর সম্পর্কে জানেন।আমাদের সময়েও বেশি ছেলে মেয়েরা চিনতো না, কারণ ভারতবর্ষে তাঁর নামটা নিষিদ্ধ নাম, তাকে নিয়ে চর্চা করলে রাত্রে বাড়ির দরজায় পুলিশ কড়া নাড়ে, আর জন সমক্ষে তাঁর নাম উঠলেই মধ্যবিত্তরা হা হা করে তেড়ে আসে।  

রোগা পাতলা চেহারার এই মানুষটি এক অদম্য বিপ্লবী বহ্নিশিখা বহন করতেন তাঁর বুকের ভিতর, ভারতের ইতিহাস কে তিনি আমাদের চিনিয়েছেন কৃষকের সংগ্রামের ইতিহাস হিসাবে এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের কথা সবচেয়ে ভালো ভাবে তিনিই বুঝেছিলেন, তিনিই বুঝেছিলেন যে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে এক নয়া গণতান্ত্রিক সমাজ গড়া, এবং শুধু বুঝেই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং নিজের হাতে ভারতবর্ষের সর্ববৃহত কৃষি বিপ্লবের আগুন জ্বালালেন তিনি। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়েরা নেমে এলেন দেশের জন্যে জীবন দিতে, কৃষকের মুক্তির জন্যে সংগ্রাম করতে, এবং তাঁরা হাসি মুখে দেশের মুক্তির স্বার্থে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। গড়ে তুললেন এক নয়া ইতিহাস যা প্রতিনিয়ত দেশের শাসক শ্রেণীকে আজও আতঙ্কিত করে তোলে। সেই আতঙ্কের কারণেই একদিন ইন্দিরা গান্ধীর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় ১২ দিন অকথ্য অত্যাচার চালায় লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে। সেই অত্যাচারের মুখেও এই শীর্ণ চেহারার মানুষটি অবিচল ছিলেন নিজের আদর্শের প্রতি এবং মানুষের মুক্তির জন্যে নিজের প্রাণ বলিদান দিলেন ২৮ শে জুলাই ১৯৭২ এর সকালবেলা।  তাঁর মৃত্যুতে স্বস্তি পায়নি ইন্দিরা ও তার সরকার, তাই তো গভীর রাতে শহরের আলো নিভিয়ে মানুষটাকে নিয়ে গিয়ে নিক্ষেপিত করা হলো কেওরাতলার ঘাটে। 

মানুষটার নাম, চারু মজুমদার, এবং তাঁর নাম আজও মুখে আনা মানা।  কারণ তাঁর হাত ধরেই তো জন্ম নিল এই দেশের কৃষক বিদ্রোহ, তাঁর চোখ দিয়েই তো জনগণ চিনলেন যে সমস্ত ভোট পার্টিগুলি জোতদার - জমিদার আর পুঁজিপতিদের দালাল, তাদের রং আলাদা, ঢং আলাদা, কিন্তু ভিতরে সব ভোট পার্টিই এক।  তাই তো তার কথা উঠলে এক ঘাটে আজও জল খায় কংগ্রেস - সিপিএম - তৃণমূল - বিজেপি, কারণ সবাই তাঁর বিরোধী, কারণ তিনি যে বিদ্রোহী, তাঁর কথা জানলে মানুষ যে বিদ্রোহ করতে চায়, ভেঙ্গে ফেলতে চায় পঁচা সমাজ ব্যবস্থা কে এবং প্রতিষ্ঠা করতে চায় এক নতুন সমাজ।  তাই চারু মজুমদার এক নিষিদ্ধ নাম, কারণ তার নামে যুক্ত আছে বিদ্রোহ আর বিপ্লব। 

চারু মজুমদার ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি নিজের জীবন উত্সর্গিত করেছিলেন বামপন্থী শ্রমিক -কৃষকের জঙ্গী বিপ্লবী সংগ্রামে এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বহু মত বহু পথের মধ্যে তিনিই প্রথম খুঁজে বার করেন মুক্তির একমাত্র পথকে, যে পথ কৃষি বিপ্লবের পথ।  চারু মজুমদার অধুনা সিপিআই এবং সিপিআই (এম) এর ভিতর আদর্শগত দুই লাইনের সংগ্রাম চালান সংসদীয় সুবিধাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে যা তাঁর শহীদ হওয়ার প্রায় চল্লিশ বছর পরে সাধারণ মানুষের কাছে জলের মতন স্পষ্ট হয়ে গেছিল। চারু মজুমদার সংগ্রাম করেন সিপিএমের বিপ্লব বিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে যা ব্যবহার করে জ্যোতি বোস -প্রমোদ দাসগুপ্ত চক্র যেনতেন প্রকারে মন্ত্রিত্ব দখলের রাজনীতি করতে শুরু করে বাংলার মাটিতে।  

চারু মজুমদার দেখান যে একমাত্র সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের পথে চলেই ভারতের কৃষক জনসাধারণ মুক্তি লাভ করতে পারেন সমস্ত শোষণ অত্যাচার থেকে এবং ভারতবর্ষকে প্রকৃত ভাবে স্বাধীন করা সম্ভব শুধুমাত্র গণ বিপ্লবের মাধ্যমে। মাও জেদং এর নীতির ভিত্তিতে তিনি তুলে ধরেন গ্রামে গ্রামে জোতদার -জমিদার ও তাদের পেটোয়া রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে কৃষক যুদ্ধের লাইন, যা ষাটের দশকে লিন বিয়াও এর দ্বারা "জনযুদ্ধের জয় দীর্ঘজীবি হউক" পুস্তিকায় প্রকাশিত হয়। এই লাইনের ভিত্তিতে তিনি রচনা করেন আটটি ঐতিহাসিক দলিলের যা সিপিএমের নির্লজ্জ রাজনীতির স্বরূপ সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে প্রকাশ করে, এবং এই আটটি দলিলের ভিত্তিতেই তিনি নিজে লেগে থেকে গড়ে তোলেন দার্জিলিং জেলার তিনটি থানা অঞ্চলে কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রাম। 

এই সংগ্রামের স্ফুলিং পরে সারা ভারতে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পরে যখন যুক্ত ফ্রন্টের গৃহ মন্ত্রী জ্যোতি বোসের পুলিশ ২৫ শে মে ১৯৬৭ তে গুলি চালায় নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষক রমণীদের উপর। ১১ জন কৃষক রমনী, কৃষক ও শিশুর রক্তে সিক্ত নকশালবাড়ির মাটি সারা ভারতবর্ষে নকশালবাড়ির পথে কৃষি বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দেয়, যাকে মাও জেদং এর নেতৃত্বাধীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি - ভারতে বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ বলে অবিহিত করে। 

ভারতবর্ষ ব্যাপী সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের মধ্যেই মার্কসবাদ -লেনিনবাদ মাও জেদং এর চিন্তাধারার ভিত্তিতে গড়ে তোলেন এক বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি - সিপিআই (এম-এল) এবং সমগ্র ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণীর কাছে এক আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠেন চারু মজুমদার, অন্যদিকে দেশের গরীব খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তির অগ্রদূত। সিপিআই (এম - এল) এর নেতৃত্বে সারা ভারতে গড়ে ওঠে তীব্র সশস্ত্র সংগ্রাম, এবং এই সংগ্রামকে সঠিক ভাবে সার সংকলন করে চারু মজুমদার অতি বাম ও ডান দুই বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন।  কিন্তু অত্যাধিক ভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর প্রতিনিধিরা নানা জায়গায় পার্টির নেতৃত্ব দখল করে বসে এবং সৃজনশীল ভাবে মার্কসবাদী রাজনীতি প্রয়োগ করে জনগণকে বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত করার জায়গায় গড়ে ওঠে হঠকারী সামরিকবাদী রাজনীতি, যার এক প্রমুখ নেতা ছিল বর্তমানের গণতান্ত্রিক বাম মার্কা অসীম চাটুজ্যে।  এই লাইনের ফলে তীব্র বিচ্যুতির শিকার হয় নকশালবাড়ির পথে গড়ে ওঠা সংগ্রাম।  গরীব - ভূমিহীন কৃষকদের রাজনীতির মাধ্যমে জাগ্রত করার জায়গায় বেশি প্রাধান্য পায় অ্যাকশন এবং চারু মজুমদারের কথা কে বিকৃত করে পরিবেশন করে সিপিআই (এম-এল) এর এক বড় অংশ। 

চারু মজুমদার এত সত্বেও সঠিক পথে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ার লাইনের পক্ষে সংগ্রাম করে গেছেন।তিনি সমরবাদী হঠকারী লাইনের সমালোচনা করে লিখেছিলেন রাজনীতি কে প্রাধান্য দেওয়ার কথা, বলেছিলেন অ্যাকশন বন্ধ থাকলেও ক্ষতি হবে না কিন্তু কৃষকদের রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত করে জাগিয়ে তোলার কাজ বহু বেশি জরুরি। 

তাঁর কথার বিরুদ্ধে চলে সিপিআই (এম-এল) ৭১ সালের মাঝে এক বড়সর ধাক্কা খায়। বহু বিপ্লবীর প্রাণ যায় এবং শহীদের মৃত্যু বরণ করেন চারু মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সহ যোদ্ধা সরোজ দত্ত।  এই সরোজ দত্তের মৃত্যুর পর চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্র করে ডান ও বাম দুই বিচ্যুতির উকিলরা, কিন্তু তার মধ্যেই চারু মজুমদার একাই সংগ্রাম চালান সমস্ত রকম সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে, গড়ে তোলা শুরু করেন পার্টিকে কৃষকের মাঝে, সবার উপরে স্থান দিতে বলেন রাজনীতিকে, এবং সেই রাজনীতির ভিত্তিতে গরীব - ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার শিক্ষা দেন বিপ্লবীদের। 

চারু মজুমদারের শেষ প্রবন্ধ - "জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ" ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক অনবদ্য রচনা, যা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে কমিউনিস্ট কর্মীদের প্রচন্ড ভাবে সাহায্য করবে নীতি ও কৌশল বোঝার জন্যে।  

১৬ই জুলাই দক্ষিন কলকাতার এক শেল্টার থেকে গভীর রাতে রুনু গুহনিয়োগী ও তার দলবল উঠিয়ে নিয়ে যায় চারু মজুমদার কে, এবং তীব্র অত্যাচার চালিয়ে তাঁকে হত্যা করে ২৮ শে জুলাই।  এর পর থেকে তাঁকে মুছে ফেলতে, তাঁর সৃষ্টি নকশালবাড়ির আন্দোলনকে ধ্বংস করতে ৪০ বছরের উপর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের শাসকশ্রেণী, তবুও চারু মজুমদারের আত্মা তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।  

চারু মজুমদারের নাম নেওয়া এই দেশে নিষিদ্ধ।  চারু মজুমদার কে স্মরণ করা এই দেশের আইন মোতাবিক বিপদজনক। চারু মজুমদারের নীতিতে বিশ্বাস করা এই দেশের শাসকশ্রেনীর সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া।  তবুও প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ চারু মজুমদারের নাম প্রতিদিন নেন, তাঁর জীবন উত্সর্গ করা কে স্মরণ করেন এবং প্রতিবছর প্রচুর নতুন নতুন মানুষ চারু মজুমদারের নীতিকে সঠিক মেনে ক্ষেতে খামারে খেটে খাওয়া মানুষদের সংগ্রামের সাথে যুক্ত হচ্ছেন রাষ্ট্র ও তার প্রভুদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে। আজ তাঁরা আর বিচার চান না চারু মজুমদারের হত্যার, কারণ হত্যাকারীর কাছে কখনোই হত্যার বিচার আশা করা যায় না। এই নতুন সংগ্রামীরা বুঝেছেন যে শুধু মাত্র চারু মজুমদারের স্বপ্নের ভারত গড়েই তাঁর হত্যার সঠিক বিচার সম্ভব, কারণ চারু মজুমদার এই শাসক শ্রেনীর করুণা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তাদের উত্খাত করতে। 

চারু মজুমদার মধ্যবিত্তদের নায়ক হতে চাননি, তিনি কৃষককে - শ্রমিককে নায়ক তৈরী করার লড়াই করে গেছেন। তিনি ছিঁড়ে দিয়ে গেছেন সুবিধাবাদী সংসদীয় রাজনীতির মুখোস, যার ফলে আজ আর ভোট বাদী বাম ও ডান কেউই জনগণকে নির্বাচনী টোপ দিয়ে বেশিদিন ভাঁওতা দিতে পারছে না।  চারু মজুমদারের ফলেই পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত 'বাম' সরকার ঠেলায় পরে নম: নম: করে ভূমিসংস্কারের কাজ সারে এবং কৃষকদের বিদ্রোহ ঠেকাতে তিন স্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বানায়।  এই সব করা হয় জোতদার ও জমিদারদের কৃষকের বর্ষা মুখ থেকে বাঁচাতে। 

অন্যদিকে চারু মজুমদারের নামেই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আজ কৃষক ও শ্রমিক উঠে দাঁড়াচ্ছেন মার্কিন একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে, বহুজাতিক কর্পোরেটগুলির শোষণের বিরুদ্ধে, জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে।  রুখে দাঁড়াতে শিখছেন মহিলারা, আদিবাসীরা এবং দলিত জাতির মানুষেরা। তাই আজ চারু মজুমদার মৃত্যুর ৪৩ বছর পরেও শাসক শ্রেনীর কাছে 'আতঙ্কের বস্তু'।          

আজ ২৮শে জুলাই, চারু মজুমদারের শহীদ দিবস উপলক্ষে, এই মহান বিপ্লবীকে বিশ্লেষকের পক্ষ থেকে সেলাম জানাই আমরা সবাই। তুমি বেঁচে আছো তোমার রাজনীতিতে, তোমার স্বপ্নের ভারত গড়ার সংগ্রামে, যা আজ অসংখ্য মানুষের স্বপ্নে পরিণত হয়েছে, এবং তুমি মানুষের মুক্তির ধ্রুবতারা হয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।                                 
                     

ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি ও ভারতের অব্যবস্থা

সোমবার, জুলাই ২৭, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

ইয়াকুব মেমন কে ফাঁসি দিতে উদগ্রীব হয়েছে ফডনবীসের নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র সরকার এবং বিজেপি আরএসএস  সমর্থকগণ সমগ্র দেশ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও মুসলমান ঘৃণার ঢেউ তোলার জন্যে সচেষ্ট হয়েছে এই ফাঁসির সাজা কে ঘিরে। আমাদের সামনে সমস্ত কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমগুলি আজ ইয়াকুব মেমন কে এক খুনি, সন্ত্রাসী, হত্যাকারী, ইত্যাদি বলে চিত্রিত করে চলেছে এবং আমরাও মুড়ি চানাচুর বা পাস্তা খেতে খেতে সেই সব খবরের নির্যাস বেমালুম গিলে ফেলছি। মনে হচ্ছে এক ইয়াকুব কে ফাঁসি দিলেই সন্ত্রাসবাদীরা ভিজে বেড়ালের মতন কাঁপতে কাঁপতে এসে ভারতের প্রতিটি থানায় আত্মসমর্পণ করবে, আইএসআই আর পাকিস্তান কোনো ঘুটি খুঁজে পাবে না এই দেশে নাশকতা চালাবার জন্যে। সব সমস্যার সমাধান একটি ফাঁসি, যেমন একদিন কলকাতায় ধনঞ্জয়কে ধরে লটকানো হয়েছিল ফাঁসিকাঠে, তেমনি এবার ইয়াকুবের ফাঁসি হবে মুখরোচক চানাচুর। এই ভাবেই একটি জাতির মানসিকতার ধরন গড়তে ও যে কোনো ঘটনার সমর্থন বা বিরোধিতা সৃষ্টি করতে সিদ্ধহস্ত হয়েছে এই কর্পোরেট মিডিয়াগুলি। তাই এরা আজ তামাম দুনিয়ার পুঁজিপতি ও রাজনৈতিক নেতাদের খুবই আদুরে রক্ষিতা। 
  
ইয়াকুব মেমনের কোথায় ফিরে আসলে দেখব যে আসলে ইয়াকুব কে এবং কেন তাঁর এই পরিনতি। ইয়াকুব কোনো বিপ্লবী, বিদ্রোহী বা জন নায়ক নয়, সে হল মুম্বাইয়ের ত্রাস দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গী টাইগার মেমনের ভাই। যে টাইগার মেমন দাউদের সাথে মাইল ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ের জায়গায় জায়গায় ঘটিয়েছিল ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং প্রথমবার ভারতবাসীদের পরিচিত করিয়েছিল আরডিএক্স, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল একে ৪৭ ইত্যাদী নামের সাথে। এই বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল বোম্বাই, অধুনা মুম্বাই শহরের দাঙ্গা, যা শুরু হয়েছিল ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ এ বিজেপি - আরএসএস কতৃক অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়ার পর।  এই দাঙ্গায় শিবসেনা ও বিজেপির যৌথ আক্রমনে বহু মুসলমান মানুষের প্রাণ যায়, অনেকের বাড়ি ঘর জ্বলে যায় এবং বহু মানুষ আহত হন।  এই দাঙ্গার সুযোগেই ঘোলা জলে মাছ ধরতে দাউদ ও টাইগার কে হাত করে মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্ত পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আই এস আই এবং এদের মাধ্যমেই ঘটায় একের পর এক বিস্ফোরণ। এই ঘটনার আগেই টাইগার সপরিবারে ভারত ছেড়ে প্রথমে দুবাই ও পরে পাকিস্তানে যায় ভারতীয় আইন থেকে বাঁচতে, দাউদ এবং টাইগার পায় আইএসআই এর নিরাপদ আশ্রয়, এবং এখানেই ইয়াকুবের সাথে টাইগারের দ্বন্ধ শুরু হয়।  ইয়াকুব ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা 'র' কে জানায় যে সে এবং তার স্ত্রী টিভিতে বিস্ফোরণের খবর শোনে এবং জানতে পারে যে তাদেরও পুলিশ হন্য হয়ে খুঁজছে। এই ঘটনা জেনে পেশায় চার্টার্ড একাউন্টেন্ট মেমন ভারতে ফেরার পরিকল্পনা করে এবং সেই মত সে আইএসআই এর চোখে ফাঁকি দিতে নেপাল পাড়ি দেয়, এবং ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট এ ইচ্ছে করেই নিজের ব্যাগ থেকে এক গাদা পাসপোর্ট ফেলে দেয়।  ওখানে তাঁকে গ্রেফতার করলে সে পুলিশ কে জানায় যে সে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়, পরে তাকে সেখানে 'র' এর এজেন্টরা জেরা করে এবং ভারতে নিয়ে আসে।  
কিন্তু ভারতে আসতেই দিল্লি পুলিশ দাবি করে যে ইয়াকুব মেমন কে তারা নয়া দিল্লি রেল স্টেশন থেকে গ্রেফতার করেছে। সেদিন থেকে শুরু হলো মেমনের উপর টাডা আইনে বিচার, অত্যাচার, স্বীকারোক্তি আদায় এবং শেষমেষ ফাঁসির সাজা। কিন্তু কেন হটাত করে ইয়াকুবের উপর এই শাস্তির খাঁড়া নামল ?

এর একটাই কারণ ছিল, ভারতের সরকার ভালো ভাবেই জানত যে দাউদ বা টাইগার তাদের খপ্পরে কোনও দিনই পড়বে না, মুম্বাই বিস্ফোরণের কেস সলভ করাও দায় হবে মুম্বাই পুলিশের, এবং এই সময়ে ইয়াকুবের মতন বলির পাঁঠা পেলে কজনে ছেড়ে দেবে ? 

হয়তো একটু বিচক্ষণতার পরিচয় দিলে ভারত সরকার এবং তার কূটনৈতিক কর্মীদের দ্বারা ইয়াকুবের সাহায্যে সারা দুনিয়ায় পাকিস্তানের সরকার ও তার গুপ্তচর সংস্থার কার্যকলাপ বহু আগেই ফাঁস করে দেওয়া সম্ভব হত, জানানো সম্ভব হতো দুনিয়ার আঙ্গিনায় দাউদ ও টাইগারকে সরকারী ভাবে পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। বিশেষত যখন ইয়াকুব সেই কারণেই ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।  সে তো পাকিস্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে চিরকালের জন্যে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকতে পারত, কিন্তু তার দেশের কথা ভেবে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র ফাঁস করার চেষ্টাই দায় হয়ে দাঁড়ালো। এই গন্ডমূর্খামির ফলে ভারত আজও দাউদ ইব্রাহিম বা টাইগার মেমনের কলার ছুঁতে পারল না, তারা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে করাচিতে, তাদের কোনো ভয় নাই কারণ তারা জানে ভারত সরকার তাদের ধরতে পারবে না এবং ইয়াকুবের মতন কিছু বলির পাঁঠাকে যূপকাষ্ঠে চড়িয়ে হাততালি দিয়ে বাহবা কুড়োবে।                 
ভারতীয় সরকার ও তার রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে কোনো সন্ত্রাসবাদী ঘটনার জন্যে একটাই বাঁচার রাস্তা আছে, কিছু মুসলমানকে গ্রেফতার করো, তাদের চার্জশিট দাও, কেস চালাও এবং যে কোনও প্রকারে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে প্রতিপন্ন করো।  এভাবেই একদিন পুলিশের হাতে ধরা পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গিলানি কে জেল খাটতে হয়, নিরীহ আফজাল গুরুকে নির্মম ভাবে মার খেয়ে স্বীকারোক্তি দিতে হয় যে সে সন্ত্রাসবাদী এবং শেষে ফাঁসিতে চাপতে হয়।  কারণ এই দেশের আইন মানে মুসলমানকে সন্ত্রাসবাদী বানিয়ে জেলে চালান করে দেওয়া এবং তদন্তের ইতি টানা। তাই শ্রীকৃষ্ণ কমিশনে দোষী সাব্যস্ত হয়েও বোম্বাইয়ের গুন্ডা দাঙ্গাবাজ বাল ঠাকরে বহুদিন বুকফুলিয়ে শাসন করে আইন কে কাঁচকলা দেখিয়ে পটল তোলে, গুজরাট দাঙ্গায় দোষী সাব্যস্ত বিজেপি কর্মীদের সাজা মকুব হতে থাকে আদালতে, তিস্তা শেত্লাবাদের মতন দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যকারীদের পড়তে হয় অমিত শাহ - রাজনাথ সিংহের দ্বারা পরিচালিত সিবিআই এর তদন্তের রোষানলে।  
        
বিজেপি - আর এস এস ক্ষমতায় আসার পর এই ঘটনা আরও বাড়বে। বর্তমানে ইয়াকুবের পক্ষে মানুষের আওয়াজ শুনতে চাইছে না বিজেপি সরকার। তাদের দাবি যে সকল মানুষ ফাঁসির সাজা মকুবের ডাক দিচ্ছে তারা সবাই পাকিস্তান যাক। নায়ক সলমান খান যখন টাইগার এর ফাঁসির দাবি তোলে তখনি তার বাড়ির সামনে মিছিল করে দাঙ্গাবাজ শিবসেনা ও আরএসএস।  কিন্তু ওদেরই পুলিশ এবং জাতীয় তদন্ত সংস্থা (নিয়া) অন্যদিকে মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণের দায়ে অভিযুক্ত আরএসএস সমর্থিত সন্ত্রাসবাদী সংস্থা 'অভিনব ভারত' ও তার সদস্য বিজেপির বিদ্যার্থী পরিষদের নেত্রী সাধ্বী প্রজ্ঞা, আরএসএস প্রচারক অসীমানন্দ, কর্নেল পুরোহিত ইত্যাদীদের বিরুদ্ধে নরম হয়ে কেস হেরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে সরকারী কৌসুলি কে। মা' কে দেখার বাহানায় সরকারী খরচায় আরএসএস এর সন্ত্রাসবাদী সাধু অসীমানন্দ পশ্চিমবাংলার বাঁকুড়া জেলায় সরকারী অতিথিশালায় চর্ব-চোষ্য- লেহ্য-পেয় সেবন করে আয়েশ করতে পারে। সর্বোপরি দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ায় এবং প্রশাসনকে মানুষ হত্যায় ব্যবহার করার অপরাধে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে।  তার কারণ এই দেশের শাসকশ্রেণী বড় বড় পুঁজিপতি ও জোতদার - জমিদারদের ভীষণ প্রয়োজন এক ব্রাহ্মন ফ্যাসিবাদী শাসনের, যাতে তারা ভারতবর্ষের মানুষের মনে সাম্প্রদায়িকতা, জাতি ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে শোষণ - লুণ্ঠনের প্রক্রিয়াকে জিইয়ে রাখতে পারে।

এই হিন্দু ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি করে এবং এর প্রচার ও প্রসারের কাজে আরএসএস এর সাথে যুক্ত হয়েছে কর্পোরেট মিডিয়া, যাদের লাগাতার প্রচার শেষমেষ মধ্যবিত্ত ও গরিব হিন্দু মানুষকে এটা বিশ্বাস করতে শেখাবে যে সমস্ত মুসলমান মানুষ ভারতবাসীর শত্রু, তারা সবাই পাকিস্তানের গুপ্তচর, এবং তারা ভারত ভেঙ্গে আর একটা পাকিস্তান বানাতে চায়।  এই তথ্যের নাই কোনো ভিত্তি, নাই কোনো সারবত্তা, শুধু আছে কথার মারপ্যাঁচ।  আর যত বেশি করে হিন্দু গরিব ও মধ্যবিত্ত কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচার গিলবে তত বেশি করে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদটা স্পষ্ট করা যাবে।  যার দ্বারা মোদী ও তার মালিকদের সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও মেরুকরণের নীতি বাস্তব হবে। 

কিন্তু এই নীতির ফলে বেশি বেশি করে মুসলমান মানুষ এই কথাটা বিশ্বাস করতে শিখবে যে ভারতবর্ষে তার সমান অধিকার নাই, সে এই দেশে ব্রাত্য, তাকে সবাই ঘৃনা করে।  এর ফলে লাভ কুরবে ওয়াইসি মার্কা মোল্লাহতান্ত্রিক দালালরা, যারা মুসলমান খেপিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাতে থাকবে।  এই বিভাজন ও মেরুকরণের ফল কিন্তু হবে ভয়াবহ।                                 
        
সব কথার শেষে এটা উল্লেখ করা দরকার যে ২১ বছর জেল খাটার পর এখন ইয়াকুবের অপেক্ষা ফাঁসি কাঠে ঝোলার।  ভারতে আসার সময়ে ইয়াকুবকে টাইগার বলে যে 'তুমি ভারতে যাচ্ছ গান্ধী হয়ে, ওরা তোমায় ফাঁসি দেবে গডসে বানিয়ে'। আর এই দুনিয়াতে টাইগারদের কথাই যে সবসময় সঠিক হয়ে ওঠে সেটাই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।                            

তৃণমূলী ছাত্র পরিষদের দক্ষিনপন্থী সন্ত্রাস ও পশ্চিমবাংলা

সোমবার, জুলাই ১৩, ২০১৫ 0 Comments A+ a-

তৃণমূলী আক্রমনে এবার শিকার হলো কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে উপাচার্য পর্যন্ত। মুলনায়ক প্রফেসর শঙ্কু বাবুর চ্যালা সৌরভ অধিকারী ও তার মাথায় অভয়্দানের হাত রাখা রুদ্র প্রতাপ তৃণমূলী ছাত্র নেতৃত্ব। সারা বাংলা সহ সমগ্র ভারতবর্ষের গণতন্ত্রপ্রেমী ও প্রগতিশীল মানুষ, সত্যিকারের ছাত্র - ছাত্রীরা, শিক্ষক, অধ্যাপক থেকে শুরু করে বিদ্বজন, এরা -ওরা - আমরা - তোরা হয়ে মামুলি শ্রমজীবি মানুষ, যাদের আবার শিক্ষিত মানুষেরা সমগোত্রের না হওয়ার কারণে তীব্র ঘৃণার সাথে অছ্যুত গোষ্ঠীর বানিয়ে রাখেন, তাঁরা পর্যন্ত তীব্র প্রতিবাদের অংশ হলেন এই ফ্যাসিস্ট হামলার বিরোধিতা করে।  নেত্রী এই সব ক্ষেত্রে চুপ থাকেন না হলে তিনি চিত্কার করে পাল্টা হুমকি দেন বা শঙ্কু স্যারের বাহিনীকে কলকে খাইয়ে পথে নামান যাতে তারা চিত্কার করে, আস্ফালন করে, পেশী প্রদর্শন করে মানুষ কে ভয় দেখিয়ে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে সফল হয়।  

বস্তুত সিপিএমের পঁচা-গলা সমস্ত কারুকার্য মাছি মারা নকল করেই তৃণমূলী পান্ডারা দিদি - পিসির সরকার কে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনটি "চুপ চাপ - জোড়া ফুলে ছাপ " করিয়ে নেওয়ার অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলার মানুষ ৩৪ বছরের তথাকথিত বাম শাসনের সবচেয়ে কালো ২০০৭-২০১১ কালেও সন্ত্রাসের এই নগ্ন চেহারা দেখেনি।  হয়তো বা বহুদিন ধরে ক্ষমতা থেকে দুরে থাকা চরম কংগ্রেসী প্রতিক্রিয়াশীল জোতদার -জমিদারদের গোষ্ঠীগুলি ও তাদের তাবেদার প্রমোটার মাফিয়া চক্র একটু বেশিই উত্সাহিত হয়ে গেছে শোষনের রোলার জনগণের উপর চালাতে। আর সবের উপরে আছে মমতাময় মুখ্যমন্ত্রী, যার কথা রাজ্যে শেষ কথা।  তার মুখে মুখে কথা বলায় ডাক্তার গড়াইয়ের মতন স্নায়ু চিকিত্সককে শুধু চাকরি থেকে বসিয়ে দেওয়া হয় না বরং দিদির গুড বুক এ নাম তোলার প্রচেষ্টায় রত, নেতার কুকুরের এসএসকেএম এ ডায়ালিসিসের সুপারিশ করা, তথাকথিত ডাক্তার নির্মল মাঝির দ্বারা এম সি আই স্বীকৃতি বাতিলের স্তর অবধি যেতে হয়।  সব শিল্প - কারখানা মালিকের সাথে ষড়যন্ত্র করে একদিকে এই রাজ্যের কলকারখানা বন্ধ করিয়ে প্রমোটার - মাফিয়াদের দিয়ে সেই জমিতে বহুতল ফ্ল্যাট বানাবার রমরমা শিল্প চলছে দিদির আশীর্বাদে, অন্যদিকে বেকার যুবরা মুখ্যমন্ত্রীর ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে জানতে পারছেন যে তেলে ভাজার শিল্পই যথার্থ শিল্প। এহেন পরিস্থিতিতে বাংলার শুভ চেতনা সম্পন্ন মানুষ কোনো ভাবেই তৃণমূলী শাসন কে বরদাস্ত করতে পারছেন না।  বার বার তাঁরা ফেটে পড়ছেন বিক্ষোভে, প্রতিবাদে, এবং বার বার তাঁদের উপর নেমে আসছে পুলিশী লাঠি, তৃণমূলী বোমা - গুলি। কারণ সন্ত্রাস ছাড়া মানুষ কে পদদলিত করে রাখার কোনও পন্থা মমতা ব্যানার্জি ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের জানা নেই, আর এই পথই এদের গণতন্ত্রের একমাত্র পরীক্ষিত পথ যা দিয়ে মানুষ কে বশে রাখা যায়, বিশেষ করে এই রাজ্যে,  কারণ এই রাজ্যের নাম পশ্চিম বাংলা এবং এখানে তৃণমূলের বিকল্প তৃণমূল, আর গণতন্ত্রের সূর্য অস্ত গেছিল সেই সিদ্ধার্ত রায়ের জমানাতেই। তারপর থেকে পরে আছে শুধু মঙ্গল চন্ডির উপোস, শনি ঠাকুরের দুয়ারে মাথা ঠোকা, আর রাজনৈতিক নৈরাজ্য।  
                   
একদিকে তৃণমূলী বড় খোকারা সন্ত্রাসী আক্রমণ চালিয়ে গ্রাম -মফ্ত্স্বল- শহর সর্বত্রে সৃষ্টি করেছে ব্যাপক আতঙ্কের পরিবেশ। অনুব্রত ওরফে কেষ্ট বোমা মেরে ও বোমা মারার হুমকি দিয়েও পাঁচ মিনিটে জামিন পায়, তাপস পাল ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েও পাঁচ ঘন্টায় জামিন পায়, মনিরুল ইসলাম - আরাবুল ইসলামরা কলার চড়িয়ে ঘোরে, মদন মিত্র চ্যালা চামুন্ডাদের সাথে বসে জেলে মদের ফোয়ারা ছোটায়, আর রাজ্যের ১ নম্বর ভাইপো বিরোধীদের উদ্দ্যেশে হাত কেটে দেওয়ার - চোখ উপড়ে ফেলার হুমকি দিয়েও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াতে পারে। এই দেখে ছোট খোকা তৃণমূলী ছাত্র পরিষদ উত্সাহ পায় কলেজে কলেজে সিপিএমের কায়দায় সন্ত্রাস চালিয়ে, ছাত্র চমকিয়ে, চাঁদা তুলে বড় দাদাদের গুড বুকে নাম তোলাতে।  বড়রা তাদের বকে না, বরং বলে 'যা এগিয়ে যা আমরা তো আছিই', আর এর ফলেই হয় কলেজে কলেজে ছাত্রদের উপর হামলা, ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি, বোমাবাজির মাধ্যমে, ছাত্র বোর্ড গড়ে কলেজ ফান্ডের টাকা আত্মসাত করে তৃণমূলী  ছাত্র পরিষদের এগিয়ে যাওয়া। 

সিন্ডিকেট রাজের থেকেও বড় এই রাজ্যে ছাত্র গুন্ডা নেটওয়ার্ক। তাদের টাকা না দিয়ে কোনও ভাবেই কলেজে ঢোকা যাবে না, ভর্তি হওয়া চলবে না এবং সর্বপরি কোনও ভাবে বামপন্থী কোনও ছাত্র সংগঠন করা চলবে না।  তৃণমূলেরই মদতে বস্তুত বেড়ে চলেছে বিদ্যার্থী পরিষদের প্রতিপত্তি, কারণ এই রাজ্যে এক কালে তৃণমূলের আঁচল ধরেই বিজেপির বিষধর সাপ প্রবেশ করেছিল এবং সেই সময় দুই ছাত্র সংগঠনের মিত্রতা খুবই মধুর ছিল।      

প্রশ্ন হলো তৃণমূলী ছাত্র পরিষদ করে কারা? তারা কাদের বাড়ির ছেলে - মেয়ে আর কি তাদের উদ্দেশ্য ? একটু ঘাঁটলে দেখা যাবে যে তৃণমূলী ছাত্র পরিষদ, কংগ্রেসী ছাত্র পরিষদ বা সংঘের বিদ্যার্থী পরিষদ একই শ্রেণী বিন্যাসের ছাত্র -ছাত্রীরা করে।  তারা সমাজের উচ্চ শ্রেনীর, মূলত বনেদী ও উচ্চ জাতির ছেলে মেয়ে, যাদের বাবা কাকারা হয় কংগ্রেসী বা তৃণমূলী বা আরএসএস এর নীতির প্রতি অভিভূত, যারা গরিবদের ঘৃনা করে, অথবা যে কোনও ধরনের দু নম্বরি কারবারে জড়িত। এদের পরিবারের প্রভাবেই ছোট বেলার থেকে এদের মধ্যে অতি দক্ষিনপন্থী চিন্তাধারার জন্ম হয়, তারা প্রথমে বাবা কাকার দৌলতে পাড়ার রংবাজিতে হাত পাকায়, ইস্কুলে মারামারি ঝামেলায় জড়িয়ে থাকে, এবং বাবা কাকার রাজনৈতিক যোগাযোগ থেকে তারা স্কুল পাশ করে কলেজে ভর্তি হয় যেখানে তাদের গুন্ডাগিরির হাতে খড়ি হয়।  প্রথমত তারা নিজেদের শিক্ষাগত অপারগতা ঢাকতে রাজনীতি কে হাতিয়ার করে, পরবর্তিতে সেই রাজনীতির প্যাঁচে ফেলে শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সকলকে তাদের প্রমোশন দিতে বাধ্য করে, আর এর ফাঁকে চলে ছাত্র - ছাত্রী মহলে নিজের প্রতিপত্তি বিস্তার করার সংগ্রাম। 

এই ভাবেই প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় অশোক - সৌরভ - শঙ্কুদের মতন গুন্ডা ছাত্র নেতাদের, যাদের লেখাপড়ার পাট তাড়াতাড়ি চুকে যায় কিন্তু ছাত্র নেতাগিরি চলতে থাকে বহু বছর অবধি। প্রতিরোধ না পেয়ে এরা কালসাপের মতন জড়িয়ে ধরে বাংলার ধুঁকতে থাকা শিক্ষা ব্যবস্থাকে, ফলে কলেজে ভর্তি থেকে মার্কশীট বার করার জন্যে তাদের বর্ধিত অঙ্ক তোলা তুলে আদায় করার ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে চলে এবং বিরোধী শুন্য বাংলায় ছাত্র রাজনীতিকে এই ভাবে পাঁকে ডোবাবার ষোলো কলা পূর্ণ হয়। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, ইত্যাদি জায়গাগুলি যেখানে একটু মেধা সম্পন্ন বাঙালি ছাত্রদের সংখ্যা বেশি, সেগুলি বাদ দিলে বাকি পুরো বাংলার শিক্ষা জগতেই তৃণমূলের একচেটিয়া শাসন কায়েম হয়ে গেছে।  এবং তার সাথে এই তথাকথিত গনতন্ত্র প্রেমী মহিলার দলের বোমা গুলির শব্দে বার বার কেঁপে উঠছে তথাকথিত শিক্ষার মন্দির।  

এত সত্বেও এই বাংলার মাটিতে আর অতীতের মতন কোনও প্রতিবাদ প্রতিরোধ নেই।  যাদবপুরের পর আর কোথাও তৃণমূল কে প্রতিহত করতে ছাত্রদের কোনও সংঘবদ্ধ উদ্যোগ চোখে পরে না। যেহেতু বেশির ভাগ সম্পন্ন ঘরের ছেলে - মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই রাজ্য ছেড়ে চলে যায় উচ্চ শিক্ষা ও ভালো কর্ম সংস্থানের খোঁজে। গরিব মানুষের ছেলে মেয়েরা কোনও কালেই কলেজ তো দুরের কথা স্কুলের মুখ দেখতে পায় না, আর যারা পায় তাদের পক্ষে নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিরোধের চেয়ে কোনও মতে লেখাপড়া শেষ করে মা বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করার তাগিদই বেশি থাকে।  কারণ তাঁদের উপর থাকে ভবিষ্যতে সংসার টানার চাপ আর তাই জলে থেকে কুমিরের সাথে বিবাদের পথ তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই নিতে পারেন না। আর এই কাল চক্রেই এই রাজ্যের শাসক দল ও তার পেটোয়া বাহিনী গর্ভধারণ থেকে কেওড়াতলার লাইন সব ক্ষেত্রেই নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে এবং কোনও বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকেই বেড়ে উঠতে দেয় না।  প্রতিবাদের - প্রতিরোধের দিন আজ পশ্চিম বাংলায় দরকার খুবই, না হলে আগামী দিনে মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে।  

পরিত্যক্ত বাম শিবির ও তার নেতা সিপিএমের দ্বারা মানুষ কে বাঁচানোর সংগ্রাম গড়ে তোলা অসম্ভব কারণ তাদের দলের অস্তিত্ব বাঁচবে কিনা সেই কথা বিমান -বুদ্ধ - সূর্যরা আজ হলফ করে বলতে পারবে না। এদের মিনমিনে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের কথা শুনে বাংলার মানুষের কানে ব্যথা হয়ে গেছে , তাই আজ খুবই দরকার হলো প্রগতিশীল বিকল্প বাম ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার, যার লক্ষ্য কলেজ বোর্ড গড়ার চেয়ে বেশি হতে হবে ছাত্র - ছাত্রী ও শিক্ষক সমাজ কে ঐক্যবদ্ধ ভাবে তৃণমূলী সন্ত্রাস ও বিদ্যার্থী পরিষদের ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদী আক্রমনের বিরোধিতায় ও প্রতিরোধে সামিল করা এবং বাংলার মাটিতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে পরাস্ত করা।  এই কার্য সিদ্ধি করতে প্রথমত বিকল্প প্রগতিশীল বাম ছাত্র সংগঠনগুলি কে ঐক্যবদ্ধ করা দরকার এক বৃহত যৌথ মঞ্চে এবং একটি সাধারণ কর্মসূচির দ্বারা পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার যা রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রে তৃণমূলী সন্ত্রাস ও বিদ্যার্থী পরিষদের সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র কে প্রতিহত করতে পারবে। 

যতদিন না আমাদের বাম ছাত্র বন্ধুরা এই রকম কোনও উদ্যোগ নেওয়া শুরু না করছেন ততদিন পর্যন্ত কিন্তু বাংলার অন্যান্য ক্ষেত্র গুলি সহ  শিক্ষা ক্ষেত্রেও তৃণমূলী সন্ত্রাস ও একনায়কতন্ত্র কায়েম থাকবে এবং বাংলার ছাত্র সমাজের শিক্ষাগত মানের অবক্ষয় হতেই থাকবে। শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে তৃণমূল কে বিতাড়িত করার প্রচেষ্টায় যত দেরী হবে ততই ফাঁস গলার উপর শক্ত হয়ে চেপে বসবে।   
                

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে