গরিবের বিদ্রোহের ডঙ্কা শোনা যায় কাশ্মীর থেকে মধ্যপ্রদেশ, দার্জিলিং থেকে বস্তার পর্যন্ত

বৃহস্পতিবার, জুন ১৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-



আমাদের গণতন্ত্রে গরিব মানুষের দুইটি অধিকার স্বীকৃত, মাথা নত করে চিরকাল শাসক শ্রেণীর শাসানি শুনে জীবন যাপন করা ও প্রতি পাঁচ বছর অন্তর লোকসভা থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেওয়া। অনেক সময়ে ভোট দিলে ভোটারকে ধরে মিলিটারির জিপ গাড়ির সামনে বেঁধে গ্রামের মানুষ কে বিক্ষোভ ও প্রতিরোধের পথ থেকে সরে আসার শাসানি দেওয়ার জন্যে ঘোরানো হয় উদয়াস্ত। মানব ঢালের ব্যবহার কে জোর গলায় সমর্থন করে বড় বড় সেনা কর্তারা, যাঁদের ছয় সংখ্যার বেতন ও পেনশন গরিব মানুষের থেকে পরোক্ষ করের নামে শোষণ করে নেওয়া অর্থ থেকেই দেওয়া হয়। আর বীর পুঙ্গব পুলিশ বাহিনী হিন্দু রাষ্ট্র হতে চলা ভারতের হিন্দু কৃষকদের উপর বেপরোয়া হয়ে গুলি চালিয়ে নিজের দর্প প্রতিষ্ঠা করে।

কাশ্মীর থেকে মধ্যপ্রদেশের মান্দসৌর বহু দূর, তবুও সেই কাশ্মীর থেকে মান্দসৌর সব জায়গায় জনগণের রক্তের বন্যায় রাস্তার মাটি লাল হয়ে উঠছে। টগবগ করে বয়ে চলা গরিব মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের, ভারতের অন্নদাতা কৃষকের রক্ত আজ মধ্যপ্রদেশ সহ সকল রাজ্যের মাটিতে কৃষক জনগণের মধ্যে মোদী সরকার ও তার চামচাদের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের এক জোয়ার জাগিয়ে তুলছে আর এই জোয়ার কে ভারতের মাটিতে ঠেকাতে পারে একমাত্র একটি বড় মাপের ভ্রাতৃঘাতী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। তাই আজ বিজেপি ও আরএসএস মরিয়া হয়ে সেই রকমই এক দাঙ্গা দেশের নানা কোনায় ছড়াতে চাইছে।

কিন্তু  ৯০% নিচু জাতির হিন্দু ও দলিত কৃষকদের নেতৃত্বে চলা এই বৃহৎ আন্দোলনের মধ্যে যে ধর্মের গরু শিং গেঁথে কোন লাভ হিন্দুত্ববাদীদের করে দেবে না সেকথা আজ জোর করে বলা যায় আর তাই রাজস্থানে গরু’র নামে দাঙ্গা লাগাবার চেষ্টা করেও বিজেপির সরকার কিন্তু কৃষকদের বৃহৎ আন্দোলনকে ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং বিজেপি ও আরএসএস এর গালে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় কষিয়ে কৃষকদের মহা আন্দোলন আজ মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র পার করে গুজরাট ও রাজস্থানে ছড়াচ্ছে।

কৃষকের উপর অত্যাচার করা হলো সামন্ততন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ এবং যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক আজও চরম ভাবে উপস্থিত এবং তার বিস্তর প্রতিপত্তি, তাই এই মহাদেশে একদিকে যেমন ধর্মীয় মৌলবাদ ও হিংসার বাড়বাড়ন্ত অবধারিত ভাবে বিচরণ করছে, ঠিক তেমনি এই মহাদেশে কৃষক জনগণ কে এবং শোষিত জনজাতির জনগণ কে সামন্তবাদী শাসক শ্রেণী চরম নিঃসংকোচে হত্যা করছে, ধর্ষণ করছে এবং তাঁদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে নতুবা গোলাম বানিয়ে রাখছে।

কাশ্মীর থেকে দার্জিলিং হয়ে বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগণের উপর শাসক শ্রেণীর চরম অত্যাচার, বস্তার থেকে মান্দসৌর হয়ে ঝাড়খণ্ডের হাজারীবাগ আর পশ্চিমবঙ্গের ভাঙড়ে জনগণের উপর পুলিশ-মিলিটারির গুলি চালনা প্রমাণ করছে যে স্বাধীনতা নামক যে বস্তুটির গুণগান আনন্দবাজার জাতীয় বাজারি সংবাদমাধ্যমগুলো প্রতি ১৫ই আগস্ট ও ২৬শে জানুয়ারি করে, সেই বস্তুটি আসলে আম্বানি, আদানি, টাটা থেকে শুরু করে টোডি আর জোতদার-জমিদারদের স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা মুজিব ইন্দিরা গান্ধীর পাঠানো ট্যাঙ্কের নলে চেপে নিয়ে এসেছিল সে স্বাধীনতা ছিল গোলামীর নগ্নতা ঢাকার জন্যে ব্যবহৃত সস্তা ও শত ছিন্ন গোলাপি আবরণ।

এই স্বাধীনতায় সবাই সমান নয় বলেই তো কাশ্মীরের কিশোর-কিশোরীদের চোখের মণি লক্ষ্য করে চলে সিআরপিএফের ছররা আর হরিয়ানার মাটিতে উপদ্রপ চালানো জাটদের জন্যে থাকে আলোচনায় বসার নিমন্ত্রণ।  তাই তো কলকাতার রাস্তায় পুলিশের জিপে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যাওয়া বিজেপি নেতা ও কর্মীদের উপর পুলিশ লাঠি বর্ষণ করে না, কিন্তু ভাঙড়ে চালায় গুলি আর দার্জিলিং এ নামে মিলিটারি। তাই আজ পাহাড়ি মানুষের উপর দুই বাংলায় বাঙালি জাতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোন সরকার ব্যবস্থা নেয় না, বরং অল্প অল্প করে জাতি দ্বন্ধের আগুনে ঘি ঢেলে খেটে খাওয়া গোর্খা বা পাহাড়ি আদিবাসীদের সাথে খেটে খাওয়া গরিব বাঙালির দাঙ্গা লাগাতে উদগ্রীব শাসক শ্রেণী। কারণ তার ফলেই কল-কারখানায় বা ধানের ক্ষেতে শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে শ্রমিক ও কৃষক ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে পারবে না।

আর ঠিক যখন দেশের মানুষ, বিশেষ করে দুই বাংলার মানুষ, শাসক শ্রেণীর এই সকল চক্রান্তের ব্যাপারে জানতে শুরু করছে, ঠিক যখন তাঁরা ধরে ফেলছেন যে কি ভাবে বিদেশী পুঁজির বাঁধনহীন শোষণ ও লুন্ঠনের স্বার্থে দুই বাংলার মাটিতে কখনো হিন্দু-মুসলমান তো কখনো পাহাড়ি ও বাঙালি বা আদিবাসী ও বাঙালি দ্বন্ধ লাগিয়ে শাসক শ্রেণী জনগণ কে হিংসা ও বৈরিতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ঠিক তখনই শাসক শ্রেণী শুরু করে ভদ্দরলোকের খেলা - ক্রিকেট, আর সেই ক্রিকেট কে কেন্দ্র করে জাতীয় সংকীর্ণতাবাদী উন্মাদনা সৃষ্টি করে শাসক শ্রেণীর প্রচার যন্ত্র।

আমরা শুনি কে ভাল ইংরাজি বলতে জানা ক্রিকেট ক্যাপ্টেন আর কে নয়, বাংলাদেশের সাথে ম্যাচ জেতার বহু আগেই আমাদের জানানো হয় কেন ফাইনালে ভারত ও পাকিস্তানের ম্যাচ (যা আসলে হিন্দু-মুসলমানের প্রতিযোগিতা হিসেবে পুরো মহাদেশে দেখানো হয়) হওয়া উচিত।  আমরা ভুলে যাই যে আজও ভাঙড়ে মানুষের উপর আরাবুলের হার্মাদ বাহিনী হামলা চালাচ্ছে, আমরা ভুলে যাই যে দার্জিলিং এর রাস্তায় মিলিটারির ভারী বুটের আওয়াজ আর আমরা ভুলে যাই যে বাংলাদেশের পাহাড়ে ধ্বস নেমেছে কারণ শাসক শ্রেণী পাহাড়ি জনগণ কে খতম করে সেখানে বাঙালি অধিবাসীদের দিয়ে একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল গড়তে চায়।

আর এই ক্রিকেটের ফাঁকে আম্বানি গোষ্ঠী ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে কৃষ্ণা-গোদাবরী বেসিনের গ্যাস উত্তোলন করে বেচার, অর্থাৎ জাতীয় সম্পত্তি লুঠ করে বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজিকে বেচার পথ প্রশস্ত করে, সই হয় ₹৪০,০০০ কোটির চুক্তি, আর রাষ্ট্র যন্ত্রের পাহারাদার মোদী সরকার নিজ প্রভুর সুখ দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়, গরু কে রাষ্ট্র পশু ঘোষণার তোড়জোড় শুরু হয় আর দেশবাসী কে জানানো হয় কেমন করে ময়ূরের অশ্রু পান করে ময়ূরী গর্ভবতী হয়।  
বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তার দেশীয় মুৎসুদ্দি দালাল আম্বানি আর আদানিদের মতন পুঁজিপতিরা কি করে ভারতের সম্পদ লুঠছে  তার থেকে আমাদের চোখ ঘোরাবার জন্যে যেমন বিজেপির চাকর অর্ণব গোস্বামী বা সুধীর চৌধুরীর মতন পেটোয়া সাংবাদিকদের পাকিস্তান-পাকিস্তান চিৎকার আছে, তেমনি আছে গর্ভবতী মহিলাদের নিরামিষ খেতে বলার কেন্দ্রীয় সরকারের ফরমান আর তেমনি আছে সেনা বাহিনীর পরেই উচ্চবিত্তদের দেশ প্রেম জাহির করার অন্যতম উপায় -ক্রিকেট।

এই ক্রিকেটের স্টেডিয়ামের শোরগোলের ফাঁকেই অন্যদিকে মমতা বন্দোপাধ্যায় হুমকি দেন ভাঙড়ের কৃষকদের, জোর করে জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কে দমন করার চেষ্টা করেন, ছাত্র ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্র কলেজ স্কোয়ারে মিছিল আর মিটিং নিষিদ্ধ হয় আর তলে তলে বিজেপির থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে তৃণমূল নেত্রী এই রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে প্রবেশের দরজা হাট করে খুলে দেন আরএসএস ও তার সঙ্গীদের। বেড়ে চলে গো-রক্ষক অবাঙালি উঁচু জাতের হিন্দুদের অত্যাচার, বজরং দলের অস্ত্র শিবির আর আরএসএস এর ঘৃণার বাণী ছড়াবার বেসরকারি স্কুলগুলো। চাপা পড়ে সারদা-নারদা ইত্যাদি, ভেসে থাকে শুধু দিলীপ ঘোষের চেহারাটা।

আর কয়েকদিন পরেই ঈদ, বুরহান ওয়ানি কে খুন করে গত বছর যে সকল সেনাকর্মীরা স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল, যে মেহবুবা মুফতি খুশি হয়েছিল, আজ তাঁরাই হাজারো হাজারো নির্ভীক বুরহান কে সোপোর থেকে কুলগাওম হয়ে শ্রীনগরের রাস্তায় দেখে আতংকিত; কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েও শিবরাজ সিংহ আজ আন্দোলনকারী কৃষকদের মাথা নোয়াতে অক্ষম, বাংলার মাটিতে তর্জন গর্জন করলেও তৃণমূল কংগ্রেস ভাঙড়ের কৃষকদের হার মানাতে অক্ষম হয় আর দার্জিলিং মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছুড়ে প্রতিবাদ করে মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রিসভা বৈঠকের।

তাই সময় জলের মতন বয়ে গেলেও শাসক শ্রেণীর অন্তরে সেই স্বস্তি আর ফিরে আসে  না, বরং হাসিনা থেকে মমতা সকলকেই তাঁদের সরকারের দ্বারা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা গণ আন্দোলন ও সংগ্রামের কর্মীদের রক্তমাখা চেহারাগুলো লন্ডনের বুকে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা বহুতলের মতন বিভীষিকা হয়ে তাড়া করে। তাই ওরা আতঙ্কে হাত পা ছোড়ে আর প্রতিবাদী চেহারাগুলো কে খুঁজে খুঁজে হত্যা করে, জেলের ভিতর ইউএপিএ নামক কালা কানুন ব্যবহার করে আটক করে। মেদিনীপুরে তৃণমূল নেতার দ্বারা মুসলিম কিশোর কে অর্ধমৃত করে গায়েব করার প্রচেষ্টার কথা ধামা চাপা পড়ে যায়, আসানসোলে আরএসএস এর দ্বারা বাইরের রাজ্যের থেকে মুড়ি মুড়কির মতন সমাজবিরোধী কর্মী-সমর্থকদের বোঝাই করে এনে থাকার বন্দোবস্ত করে দেওয়া রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে না।  

শাসক শ্রেণী আজ খুন করে, জেলে পুড়ে, ধর্ষণ করে নিস্তার পাবে না কারণ আজ ১২০ কোটির দেশে প্রায় ৯০ কোটি মানুষের পিঠ দেওয়ালে এসে ঠেকেছে, তাঁদের কাছে বেঁচে থাকার একমাত্র উপকরণ হলো তীব্র সংগ্রাম এবং লড়াই ছেড়ে দিলে তাঁরা টিকতে পারবেন না। তাই তো কর্পোরেট লুটের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ডের বড়কা গাওঁ থেকে ছত্তিশগড়ের বস্তার হয়ে উড়িষ্যার নিয়মগিরির আদিবাসী জনগণ আজ একাট্টা হয়ে লড়ছেন। তাই তো আজ ভাঙড় মাথা নোয়াতে অস্বীকার করছে আর তাই আজ রমেল চাকমা কে খুন করেও বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী দুই চোখের পাতা এক করতে পারছে না।

শাসক শ্রেণীর দ্বারা যখন পুরানো কায়দায় আর জনগণ কে শোষণ শাসন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না এবং জনগণও যখন পুরানো কায়দায় শোষিত হতে চাননা, ঠিক সেই মুহূর্তই হয় বিপ্লবের পূর্ব-মুহূর্ত, ঠিক সেই মুহূর্তেই বেজে ওঠে বিদ্রোহের দামামা, ঠিক তখনই দাঙ্গাবাজ, বিভেদকামী, মৌলবাদী, ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে তীব্র লড়াই, এমন লড়াই যে শুধু ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেই শাসক শ্রেণী নিজ কতৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হবে না, কারণ গণ বিদ্রোহের লাভার স্রোতে তাঁদের সব প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিরোধই একেবারে জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাবে।  

সুকান্তের সেই লাইনগুলো কি আজও আমাদের চোখের সামনে সত্য হয়ে উঠছে না ?

বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে,
আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে,
এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ,
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ;
স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব
শুনেছ? শুনছো উদ্দাম কলরব?
নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট;
রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট।
প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত,
দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত;
তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি,
তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি।
তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে
বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।।





এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে