সুগত বসুর জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া ভাষণ তৃণমূলের সুবিধাবাদী অবস্থান স্পস্ট করলো

সোমবার, ফেব্রুয়ারী ২৯, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

অবশেষে তৃণমূল জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় মুখ খুললো, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মুখে এই ইশ্যূতে কুলুপ আঁটা থাকলেও খুব কায়দা করে তৃণমূলের ব্যাক বেঞ্চ সাংসদ ও মার্কিন দেশের প্রাক্তন অধ্যাপক সুগত বসু কে দিয়ে শুদ্ধ ইংরাজী ভাষায় খুব মার্জিত ভাবে একটা বিরোধিতা করা হলো। সুগত বসুর ভাষণ শুনে অবশ্য বোঝা গেল না যে তিনি ও তাঁর পার্টি আদতে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের উপর নৃশংস রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের বিরোধিতা করছেন না কি বিজেপির প্রতি একটা সুপ্ত সমর্থনের পরিবেশ তৈরি করছেন।

যে মমতা দেশের সব ব্যাপার নিয়ে গত দেড় বছর ধরে হট্টগোল করেন, যে দলের সাংসদরা এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সকল জন বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে নানা রকম নর্তন কীর্তন করে নিজেদের দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাতো, আচমকা এমন কি হলো যে দেশের মানুষের উপর এত বড় একটা ফ্যাসিবাদী হামলার সময়ে সেই পার্টির কেষ্ট বিস্টুরা সবাই চুপ আর তাত্বিক বচন বাগীশ সুগত বসুর মতন লোক সংসদ ভবনে বগল বাজিয়ে নিজের জ্ঞানের বহর প্রকাশ করছেন?

সুগত বসু রাজনীতির ময়দানে নতুন মুখ হলেও আসলে তিনি মার্কিন বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির বাঙালি মুখপত্র। তাঁর বক্তব্যের সার করলে দেখা যাবে তিনি খুব ধূর্ততার সাথে শাসক বিজেপি ও আরএসএস কে বুদ্ধি দিলেন যে হঠকারিতা না করে ছাত্র আন্দোলন কে খুব ঠান্ডা মাথায় দমন করতে । তিনি চতুরতার সাথে বললেন যে কানহাইয়া কুমারের ভাষণের কিছু অংশের সাথে তিনি সহমত, আর কিছু অংশের সাথে তিনি সহমত নন। তার মানে তিনি (এবং তাঁর পার্টি) এটা মানে যে জেএনইউ এর ছাত্রদের কার্যকলাপে "দেশদ্রোহ" রয়েছে। সুগত বাবু তাঁর পান্ডিত্য ঝেড়ে তৃণমূলের পক্ষ থেকে বিজেপি সরকারকে জানাতে চাইলেন যে মমতা বিজেপির পক্ষেই আছে শুধু প্রকাশ্যে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারা বন্ধ করুক বিজেপি।

বিজেপির প্রতি মমতার যে সুপ্ত একটা সমর্থন আছে সে কথা সবাই জানেন। অতি মাত্রায় ব্রাক্ষণত্ববাদী মমতা বন্দোপাধ্যায় সর্ব প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের জমিতে খাল কেটে বিজেপির কুমির কে সেই ১৯৯৮ সালে ঢুকিয়েছিলেন।তার আগে যদিও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ১৯৪৭ সাল থেকেই শিবির গেড়ে বসে ছিল, তবুও মারোয়ারী ব্যবসায়ী, কিছু হিন্দি ভাষী উত্তর ভারতীয় উচ্চ জাতির হিন্দুদের ছাড়া কেউ এই হিন্দুত্ববাদী কেউটে সাপদের  কাছে ভিড়তো না। মমতা বন্দোপাধ্যায় কংগ্রেস ছাড়ার পরেই এই হিন্দুত্ববাদী নেংটিধারীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হন এবং এদের কে পশ্চিমবঙ্গে ভিত গড়তে সাহায্য করেন। তিনি এই সেদিনও বিজেপির লেজ ধরে ঝুলছিলেন যেদিন মোদী ও তাঁর সাগরেদরা গুজরাটের মুসলমান নিধন যজ্ঞ করছিল। নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুসলমানদের গণহত্যা ও গণধর্ষণের মই বেয়ে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় অধিষ্ট হন সেই ২০০২ এর শেষ দিকে তখন এই মমতা বন্দোপাধ্যায় ফুলের তোড়া দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন মোদীকে।

২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে একমাত্র সাংসদ নির্বাচিত হয়ে এবং ২০০৬ সালের নির্বাচনে গো হারা হেরে মমতার আক্ষেপ শুরু হয় ভোট ব্যাঙ্ক খুয়ে যাওয়ায় এবং বামফ্রন্ট সরকারের সামাজিক-ফ্যাসিবাদী হামলায় যখন সিঙ্গুর - নন্দীগ্রামের মানুষ জেরবার হচ্ছিলেন ঠিক সেই সময়ে আচমকা মুসলমানদের দুঃখে বুক ফেটে গেল মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মতন ব্রাক্ষণদের। শুরু হলো মুসলমান তোষণ, সেই প্রাচীন নেহরু-গান্ধী পদ্ধতিতে, যার মূল কথা হলো মোল্লা আর মুফতিদের তেল মেরে হাত করে সামগ্রিক মুসলমান সমাজের উপর নিজের প্রতিপত্তি কায়েম করার চেষ্টা করা। সামগ্রিক ভাবে মুসলমানদের দেখানো যে ব্রাক্ষণত্ববাদীরা তাঁদের মঙ্গল কামনা করে কিন্তু কার্যত সেই মুসলমানদের আরও পিছিয়ে দিতে, আরও বেশি ধর্ম ঘেঁষা, ধর্মান্ধ বানানোর প্রচেষ্টা বাদে এটা কিছুই না। ঠিক যেমন নেহরু-গান্ধীর সাথে চলতেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, যাঁর নীতি ছিল প্রতিক্রিয়াশীল এবং যিনি হাড়ে হাড়ে মুসলমানদের আধুনিক হওয়ার বিরোধিতা করতেন। সেই খেলায় আজ মজেছেন মমতা এবং তাই মুসলমানদের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক বিকাশ না করে শুধুই মৌলবাদী কিছু শক্তিকে বাঁশে ঠেলে উপরে চড়িয়ে যাচ্ছে এই সরকার।

মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই লুকোচুরি খেলা চলছে তৃণমূল আর বিজেপির। প্রথমে বিজেপির উপর আক্রমণ চালিয়ে নিজেকে ধর্ম নিরপেক্ষ হিসাবে পাচার করার প্রচেষ্টা চালান মমতা এবং পরবর্তীতে মমতার বিরোধিতা করে এগিয়ে এসে বিজেপি সারদা কান্ড নিয়ে হইচই করেও কিছু প্রসাদ আর সিন্নি খেয়ে ঠান্ডা হয়ে বসে গেল।

বিজেপি জেএনইউ তে পুলিশ ও আরএসএস এর গুন্ডা পাঠানোর অনেক আগেই মমতা ২০১৪ সালে যাদবপুরের বেচাল ছেলে মেয়েদের পিটুনি দিতে বিশাল পুলিশ বাহিনী পাঠান যার ফলে সৃষ্ট হয় 'হোক কলরব' আন্দোলনের। ২০১৪ সালের সেই বৃষ্টি ভেজা দিনগুলিতে পথে নামেন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, যার জবাব দিতে চট জলদি তত্কালীন পিসির আদুরে ভাইপো (বর্তমানে ব্রাত্য) প্রফেসর শঙ্কু ওরফে শঙ্কু পান্ডা তৃণমূলী ছাত্রদের (গাঁ ঝেঁটিয়ে তুলে আনা ভিড় আর সরকারী ছাত্র গুন্ডা বাহিনী) নিয়ে কলকাতায় মমতার আর এক ভাইপো অভিষেক বাড়ুজ্যের উস্কানিতে মিছিল করেন। সেদিনও আরএসএস এর সদস্য রাজ্যপাল ছাত্রদের কড়া ধমক দিয়ে ঠান্ডা করতে চেয়েছিলেন, শাঁসিয়েছিলেন এমন ভাবে যেন যাদবপুরের ছাত্ররা উত্তর প্রদেশ বা হরিয়ানার গো বলয়ের এবিভিপি সমর্থক, তাঁর শাসানি শুনে থমকে যাবে। যাদবপুর তবুও ছাত্র শক্তির জোর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আলিন্দে বসা মমতাকে দেখিয়েছিল, যার চাপে সেদিন ওই তৃণমূলের পদলেহী উপাচার্য অভিজিত চক্রবর্তী কে পদত্যাগ করে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়।

আজ যখন জেএনইউ এর ছাত্রদের পাশে, হিন্দুত্ববাদী-ব্রাক্ষণত্ববাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে যাদবপুর লড়াই করছে তখন ওই অবাঙালি কিছু আরএসএস গুন্ডা কে দিয়ে প্রথমে যাদবপুরে ভাঙচুর করিয়ে তারপর বিজেপির দ্রৌপদী রুপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চাটুজ্যে প্রভৃতি নাট্যকাররা আরএসএস এর বানর সেনা নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঙ্গামা করার চেষ্টা করেন, তখন মমতার গণতন্ত্র প্রেম কোথায় থাকে আর কোথায় লুকিয়ে পড়ে হিন্দুত্ববাদ বিরোধিতা, তা আর কারুর চোখে পড়ে না। মমতার মার্কিনি অধ্যাপক সাংসদ ছাত্রদের উপর হামলার ঘটনায় চোখ থেকে কুম্ভিরাশ্রু ঝরান, আর মমতারই 'দুষ্টু' ছোট ছেলের দল বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে ঢুকে অবস্থানকারী ছাত্রদের পেরেক লাগানো ডান্ডা দিয়ে পিটিয়ে বুক চিতিয়ে ঘোরে। দিল্লি পুলিশের তাঁবেদারি আর বর্ধমান পুলিশের তাঁবেদারির মধ্যে আদেও কি কোনো ফারাক আছে? আমার জন্মভূমি, শ্রমিক আন্দোলনের পবিত্র মাটি, কাজী নজরুলের পবিত্র মাটি, আসানসোলের (যে শহর থেকে অবাঙালি ও উচ্চ জাতির বাঙালি হিন্দু ভোটে জিতেছিলেন গাইয়ে সুপ্রিয় বড়াল, ওরফে বাবুল সুপ্রিয়) বুকে দাঁড়িয়ে বিজেপির অবাঙালি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদী হুঙ্কার ছেড়ে ঘোষণা করে যে পশ্চিমবঙ্গে ভোটে জিতে উনি যাদবপুরের ছাত্রদের লাথি মেরে বের করে দেবেন। আর মমতার প্রশাসন শুধু ভিজে বেড়ালের মতন বসে থেকে পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রী, পশ্চিমবঙ্গের একটি নামী প্রতিষ্ঠানের নামে এই বিষ মেশানো ভাষণ শুনলো। কোথায় ছিল তখন মমতার বঙ্গ প্রীতি ?

মমতা আর মোদীর গট আপ গেম ভালোই চলছে, একজন মোল্লা তোষণ করছে তো অন্যজন অবাঙালি ও উচ্চ জাতির হিন্দু বাঙালি ভোটারদের মেরুকরণ করে চলছে। এই পাঁকে পশ্চিমবঙ্গের গরিব, শোষিত মানুষ কে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার প্রচেষ্টা চলছে, যাতে বিদেশী বৃহৎ পুঁজি-দেশীয় দালাল পুঁজি-নব্য জোতদার-জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার থেকে এই ব্যাপক অংশের মানুষ কে বিরত করা যায়।

বাজপেয়ীর আমলে বিদেশী কর্পোরেটদের কোটি কোটি টাকা তখনও বিজেপির ঝুলিতে সেই ভাবে ঢোকেনি যেমনটি আজ মোদী শাসনকালে ঢুকছে। কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলি তাদের বিশাল অর্থ বলের সাহায্যে যে কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে কিনে রাখতে পারে। সংসদীয় বাম থেকে তৃণমূল কংগ্রেস, আদি কংগ্রেস থেকে বিজেপি আজ তাদের পকেটে। দেশের কোনায় কোনায় আদিবাসী জনগণ কে তাঁদের জল - জঙ্গল - পাহাড় থেকে খেদিয়ে সেই জমি আর জঙ্গল, যার নিচে লুকানো আছে খনিজ সম্পদ, আজ সস্তায় বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তার দেশীয় দালালদের কাছে খুচরো পয়সার দরে বিক্রি করে কমিশন কামাচ্ছে বিজেপি-কংগ্রেস সহ সকল শাসক পার্টি। যতদিন বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বসে ছিল ততদিন তাঁরাও ভাগ পেয়েছে, আজ পাচ্ছে তৃণমূল, আর তাই তৃণমূলের বিরুদ্ধে কামাই থেকে বঞ্চিত সিপিএম কংগ্রেস এক হয়েছে।

দেশের সম্পদ, জমি, প্রকৃতির এই লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল জনগণ, ছাত্র-যুবরা আদিবাসী ও দরিদ্র কৃষকদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। যদিও ভারত সরকার ২০০৯ সাল থেকে আদিবাসী সমাজকে তাঁদের জমি ও জঙ্গল থেকে ছুড়ে ফেলতে বিদেশী ও দিশি পুঁজির টাকায় চলা খনি কর্পোরেশনগুলির স্বার্থে এক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির প্রবক্তারা আজ দেশ জুড়ে কৃষক আত্মহত্যা, আদিবাসীদের উপর শোষণ অত্যাচারের বিরোধী আওয়াজ কে কন্ঠরুদ্ধ করতে চাইছে, দেশপ্রেমের জোয়ার তুলে দেশ বেচার প্রচেষ্টায় রত হয়েছে পরগাছা চাটুকার বিদেশী পুঁজির দালালদের দল, যাদের সদর দফতর আজ আরএসএস এর নাগপুর কেন্দ্র। 

কিন্তু বাংলার মাটিতে এই ভাঁড়দের প্রচেষ্টায় বাঁধা হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক ও শ্রমিকের ঐক্য, যাঁরা দশকের পর দশক এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছেন, যাঁরা ভাগ করো শাসন করো নীতিকে ভালো করে জানেন, যাঁরা ধর্ম-বর্ণ-জাতের উর্দ্ধে এসে একসাথে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-জঙ্গল মহলের ব্যাপক সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেন। তাই তো বাংলার এই গরিব, খেতে না পাওয়া, শীর্ণ - জীর্ণ মানুষগুলোকে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের দেশী দালালরা এত ভয় পায়। তাই মমতার সমর্থনে বিজেপির ব্যাটন নাচ দেখছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, ঠিক যেমন কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপির সমর্থনে তৃণমূলের খেমটা নাচ দেখছে দেশের মানুষ।

যাদবপুরে আমি কোনো দিন পড়িনি, জানি ওটা প্রেসিডেন্সির মতনই একটা এলিটিস্ট এবং অনেকাংশে জনগণ থেকে বিছিন্ন একটা প্রতিষ্ঠান, যেখানে ছাত্ররা আজ ব্যারিকেড গড়ে লড়াই করেও ছাত্র জীবনের শেষে পরীক্ষা দিয়ে হাকিম হবেন, নীতি নির্ধারক হবেন শাসক শ্রেণীর। তবুও বহু ছাত্র-ছাত্রী আবার ওই ক্যারিয়ার গড়ার ইঁদুর দৌড় থেকে দুরে থেকে শোষিত - নির্যাতিত মানুষের স্বার্থে কাজ করে যান। ঐতিহাসিক ভাবে দেখতে গেলে আমার ঠাকুরদা যাদবপুরের প্রথম ব্যাচের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস হতো মুরারীপুকুরের সেই বিখ্যাত বোমা বাড়ির কাছে। সেই সময়ে জঙ্গল কেটে  ১৯২৪ সালে অরবিন্দ ভবন তৈরি হওয়ার পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন যাদবপুরে চলে আসে, মার্কসবাদী দর্শন ভারতে সুপরিচিত হওয়ার আগেই, তখন ঠাকুরদা সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাদা চামড়ার সাহেব ও তার নীল চোখের ঘোড়সাওয়ার পুলিশদের পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়েছিলেন।

আজ যখন দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনৈতিক ভাবে বেশি চেতনাসম্পন্ন ও শক্তিশালী, যখন তাঁদের পক্ষে সমগ্র বিশ্ব দাঁড়িয়ে পড়তে পারে, তখন ওই ক্যাম্পাস থেকেই বিজেপির বাতুলতা কে আজ যাদবপুরের পূর্বতন ছাত্র ছাত্রীদের মতন  ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের কায়দায় জবাব দিয়ে যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের মানুষকে দেখাতে হবে যে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে প্রতিরোধ করে পরাজিত করা যায়।সত্যি কারের দেশপ্রেম কি আর সত্যিকারের জাতীয়তাবাদ কি সেই শিক্ষা যাদবপুরের আর গোটা বাংলার ছাত্র-ছাত্রীদের অবাঙালি কৈলাশ বাবু ও তাঁর নাচিয়ে-গাইয়ে-বাজিয়েদের অবশ্যই দিতে হবেই। গরিব মানুষের সকল সংগ্রাম কে, শ্রমিক - কৃষক, দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘুদের সকল সংগ্রাম কে আজ বিশেষ করে হিম্মত দেবে ছাত্র-ছাত্রীদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই। 

ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে সরোজ দত্ত বলে গেছেন যে 'কোঁতকা বাপ বলাবে' - সংসদীয় বাম রাজনীতিবিদরা যখন দেশের ছাত্র শক্তিকে ভেড়ার পাল বানাবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তীব্র ফ্যাসিস্ট আক্রমণের মুখে ঠিক তখনই ওই কোঁতকা ভীষন জরুরী হয়ে পড়েছে ফ্যাসিস্টদের ভিতরে ভীতির সঞ্চার করতে। ছাত্র শক্তির পাল্টা প্রতিরোধের সংগ্রামই তৃণমূল ও বিজেপির ঐক্য কে, সুগত বসুর দ্বিচারিতা কে এবং রুপা-লকেট-দিলীপদের ফাঁপা দেশপ্রেমের  হাঁড়ি হাটের মাঝে ভাঙবে।

ফ্যাসিস্ট জাতীয়তাবাদ আর মেকি দেশপ্রেমের চোঙ্গা পড়ে থাকা বিজেপির অবাঙালি দাঙ্গাবাজদের আজ বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলার সময় এসেছে। মনে রাখবেন, যত দেরী করবেন তত বেশি কামড়াবে ফ্যাসিবাদ। সময় থাকতে ওদের বিষ দাঁত কে প্রতিরোধ সংগ্রামের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দিতেই হবে।   

        

হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র গণ প্রতিরোধ গড়তে হলে শোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে তীব্র ভাবে

মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

আমাদের দেশের রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপুর্ণ সন্ধিক্ষণে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি। সারা দেশ জুড়ে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে খাকি হাফ প্যান্ট পরিহিত আরএসএস এর গুন্ডা বাহিনী। বিজেপি সরকারের বেসরকারি পেটোয়া বাহিনী হিসেবে এরা আত্মপ্রকাশ করেছে এবং অতীতের দাঙ্গাকারী সংঘ কর্মীদের থেকে এই খেঁকি কুকুরের দল আজ দেশপ্রেমের ছাল গায়ে দিয়ে দেশের বিরুদ্ধ মতের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে বামপন্থী কর্মী- সমর্থক ও শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ-দলিত-আদিবাসী-মহিলা  ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। আক্রমণ করা হচ্ছে রাষ্ট্র যন্ত্রের সহায়তায়।যখন এই আরএসএস - বিজেপি - বজরং দলের বানর সেনা দাঁত খিঁচিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করছে ঠিক সেই সময়ে বিজেপি পরিচালিত ও বিজেপি বিরোধী শক্তির দ্বারা পরিচালিত রাজ্যে রাষ্ট্র শক্তি মিটিমিটি করে হাঁসছে।

জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্রদের একটি অংশ যখন কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারের উপর একটি রাজনৈতিক কর্মসূচী অনুষ্ঠিত করে তখন থেকেই সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের শাসক শ্রেণী ও তাদের ভৃত্য নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার ছাত্রদের বিরুদ্ধে, জেএনইউ এর বিরুদ্ধে এবং সামগ্রিক ভাবে সমস্ত বামপন্থীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনে। গোটা দেশ জুড়ে মূলধারার কর্পোরেট মিডিয়ার একটা বড় অংশ বামপন্থীদের দেশের শত্রু, পাকিস্তানের চর হিসাবে ছাপ মেরে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনে। এই আক্রমণ কে যথাযত ভাবে প্রতিপন্ন করার জন্যে শাসক শ্রেণী সেই ১৯৬২ সালের কংগ্রেসী কায়দায় উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধী হাওয়া জাগিয়ে তোলে।

সংশোধনবাদী বাম নেতারা, যাদের দিন কাটে রাষ্ট্রের মহিমা গেয়ে আর বুর্জোয়া সংবিধানের উপর গঙ্গা জল ছিটিয়ে শ্রেণী সমঝোতার ও সংসদীয় রাজনীতির ভজন গেয়ে, ছাত্র - যুবদের শেখালেন যে আক্রমণের বদলা যেন না নেওয়া হয়। যখন উচ্চ জাতির হিন্দুত্ববাদী শয়তানরা ওই শাসক শ্রেনীর পুতুল আদালতের চত্বরে বামপন্থী কর্মী সমর্থক ও ছাত্র নেতাদের মাটিতে ফেলে মারছিল এটা স্পস্ট করে দিতে যে এই রাষ্ট্র ওদের সম্পত্তি, এই রাষ্ট্র যন্ত্র ওদের শ্রেণীর মালিকানাধীন এবং ওরা এই দেশে হাঁসতে হাঁসতে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ-দলিত-মুসলমান-খ্রিস্টান-আদিবাসীদের অনায়াসে হত্যা করে বুক চিতিয়ে ঘুরতে পারে।ওদের শাস্তি দিতে এই দেশে আইন তৈরি হয়নি, আইনের চোখ বাঁধা কারণ তা গরিবের, শোষিতের স্বার্থে কোনো ভালো কর্ম করতে পারে না।  তাই তো আজ দেশের কোনায় কোনায় শোষিত মানুষের এই পঁচা গলা মানুষখেঁকো ব্যবস্থার উপর থেকে আস্থা উঠে গেছে।

কিন্তু আমাদের সংসদীয় মদ খেয়ে মাতাল তথাকথিত বামপন্থীরা কিন্তু এ কথা মানতে নারাজ, যে এদেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাটা আসলে কিছু দালাল পুঁজিপতি, সামন্তপ্রভু, নেতা-মন্ত্রী-সান্ত্রী ইত্যাদির স্বার্থে তৈরি হয়েছে, ওরা অস্বীকার করে যে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র আসলে বিদেশী ও দিশি পুঁজির স্বার্থে জোতদারদের সাথে হাত মিলিয়ে মানুষকে ঠ্যাঙানি দেওয়ার একটা যন্ত্র। কারণ ওই সংসদীয় বামেরা অনেক আগেই শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম কে পিছনে ফেলে শুধু মাত্র সংসদীয় কায়দায় গদি দখল করা এবং গদির চামড়া নিয়ে কুকুরের মতন কামরাকামরি করে অন্যান্য সংসদীয় বুর্জোয়া দলেদের মতনই নিজেদের তৈরি করেছে।

পশ্চিমবঙ্গে তো বিপ্লবী রাজনীতির কথা, মার্কসবাদের কথা সিপিআই - সিপিএম সহ অন্যান্য বামফ্রন্ট শরিকরা অনেক আগেই নিজেদের অভিধান থেকে কেটে দিয়েছিল। দিল্লি সহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তবুও এদের মাঝে মধ্যে সামাজিক ও আর্থিক ন্যায়ের জন্যে সংগ্রামের গরম গরম বুলি আওড়ে নিজেদের হাতে গোনা কিছু কর্মীদের তাঁতিয়ে রাখতে হয়।দিল্লির বামপন্থী রাজনীতিতে সিপিএম ও সিপিআইয়ের ছাত্র ও শ্রমিক ইউনিয়নের লড়াইগুলো সরকারি নকশালপন্থী সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের রাজনীতির চেয়েও অনেক নিরামিষাশী। জেএনইউ তে আগেও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে অনেক আদর্শগত তর্ক -বিতর্ক হতো, কিন্তু সেই সব বিতর্কের শুরু আর শেষ চায়ের কাপেই হতো, ফলে তা কোনো দিনই আপামর দেশে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

গত ৯ই ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে সংসদীয় বামেরা সেইরকমই কিছু একটা ভেবে বসেছিল, যেই তারা বুঝলো যে ছাত্র-ছাত্রীরা জঙ্গী হয়ে আন্দোলনে নামতে চলেছে, তখনই বিভেদের রাজনীতি ঢুকিয়ে দিতে ওই ইয়েচুরি- ডি রাজা - দীপঙ্কর চক্র ভয়ানক ভাবে লাফিয়ে পড়লো। ওরা বলা শুরু করলো যে নির্দোষ ছাত্রদের উপর যেন পুলিশী আক্রমণ  না হয়, প্রকারন্তরে এই কথা বলে ওরা স্বীকার করে নিল যে কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্লোগান দেওয়াটা একটা দোষ বা অপরাধ।এর সাথেই শুরু হলো কানহইয়া কুমার কে বাঁচানোর নামে উমর খালিদ কে বলির পাঁঠা বানাবার চক্রান্ত। কিন্তু এ তো ২০১৬ ! ছাত্র-ছাত্রীরা এই টোটকা খেয়ে ভুলে গেল না যে আক্রমণ লাল ঝান্ডার উপর হয়েছে এবং প্রতিরোধ এক সাথে করতে হবে। তাই যদিও উমর খালিদ, অনির্বান ভট্টাচার্যদের ছাত্র সংগঠন ডিএসইউ গত নভেম্বরেই আদর্শগত বিভেদ ও দুই লাইনের লড়াইতে ভেঙ্গে যায়, তবুও স্বতস্ফুর্ত ভাবে গোটা জেএনইউ এর বামপন্থী ছাত্র-ছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে উমর খালিদ ও অন্যান্য কর্মীদের পক্ষে দাঁড়ান এবং বাধ্য করেন সংসদীয় বাম রাজনীতির প্রবক্তাদের ঢেকুর তুলে ছাত্রদের দাবি মানতে।গোটা দেশের বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক ছাত্র যুবদের সমর্থন যখন জেএনইউ এর রাজনৈতিক অবস্থান কে সমর্থন জানিয়ে বলীয়ান করছে ঠিক সেই সময়ে আমাদের সংসদীয় বামেরা ছাত্র যুবদের শেখাতে থাকলো যে মিছিলে আক্রমণ করলে পাল্টা মার মারতে যেও না বরং গান্ধীগিরি করে আক্রমণকারীদের গোলাপ ফুল উপহার দাও।

একথা সুবিদিত যে ন্যাক্কার জনক দালালির রাজনীতির মাধ্যমে গান্ধী চিরকাল শোষিত মানুষকে শোষকের জুতোয় চুমু খাওয়ার শিক্ষা দিয়ে এসেছে। আজকের দিনে মার্কসবাদের ছাল গায়ে দিয়ে এই নব্য গান্ধীবাদী বামেরা দেশের ফুটন্ত যৌবন আর বিদ্রোহের প্রতীক ছাত্র ও যুবদের সেই শোষক আর শাসকদের সাথে সাথে ওদের পোষা কুকুর বাহিনীকেও  চুমু খাওয়া শেখাচ্ছে। এটা সত্য যে দিল্লির মতন শহরে উচ্চ জাতির ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের সংখ্যা মূল শহরে এবং সমস্ত প্রতিষ্ঠানে প্রবল।তাই তাদের তরফ থেকে যে আক্রমণ হবে সে কথা তো রাজনীতির দুনিয়ায় গতকাল প্রবেশ করা যে কোনো শিশুও বলে দেবে।কিন্তু গোলাপ দেওয়ার পিছনের উদ্দেশ্য কি? “শত্রুর হৃদয় পরিবর্তনের” যে শিক্ষা গান্ধী তার দালালির জীবনে দিয়ে গেছে এই গোলাপ দেওয়া কি তারই বিধু বিনোদ চোপড়ার সিনেমার সংস্করণের ‘মার্কসবাদী’ প্রয়োগ নয়?

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাস ও আস্থা রাখার কথা যখন ওই তথাকথিত বামেরা বলে তখন তাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত যে তারা কি গণতন্ত্র কে শুদ্ধ এবং পবিত্র একটি শ্রেণীহীন বস্তু হিসাবে গণ্য করেন? এটাও সরকারী বামপন্থী আর নকশালপন্থীদের জনসমক্ষে ঘোষণা করা উচিত যে তারা এই দেশের ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলি, যেমন পার্লামেন্ট, আদালত, পুলিশ মিলিটারির উপর জনতার থেকেও বেশি নির্ভরশীল। কারণ এই নির্ভরশীলতা বাড়াতে, জনগণ কে নিয়মতান্ত্রিক করে শাসক শ্রেণীর সামনে দুর্বল প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টারই অঙ্গ হলো আপামর বিদ্রোহী ও জঙ্গী ছাত্র যুবদের বদলা নিতে বাঁধা দেওয়া।

সিপিএম আজ দিল্লিতে বড় আইনের শাসনের কথা বলছে, অহিংসার কথা বলছে আর ভুলিয়ে দিতে চাইছে ৩৪ বছর ধরে তাদের খুনি হার্মাদ বাহিনী কি ভাবে পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ জনগণ, বিপ্লবী কর্মীদের হত্যা করে এসেছে। যদি বিজেপি আর আরএসএস ফ্যাসিবাদী হয় তাহলে সিপিএম ও সামাজিক ফ্যাসিবাদী একটি ঘৃণ্য শক্তি, রাজ্য বদলালেও ওদের হাত থেকে রক্তের দাগ মুছবে না।

আজকের দিনে যদি ফ্যাসিস্ট বাহিনী বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের উপর আক্রমণ করে এবং যদি আদর্শের কারণে, প্রশ্ন করার কারণে দেশের কোনো প্রান্তে বামপন্থী কর্মীদের উপর আক্রমণ হয় তাহলে সেই জায়গায় বিপ্লবী বামপন্থীদের কর্তব্য হলো জনগণ কে সাথে নিয়ে ওই আক্রমণের বদলা নিতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সিপিএম, সিপিআই, সরকারী নকশাল নেতারা এই আন্দোলন ও প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে অপারগ হবে কারণ ওদের চোখ আটকে আছে ভোটের বাক্সে আর ওদের চরিত্র আজ রাজনৈতিক গণিকাবৃত্তির পতিতালয়ে পড়ে থেকে থেকে নিকৃস্ট হয়ে গেছে। ওই নেতৃত্ব তার কর্মীদের ও সমর্থকদের কাছে ফ্যাসিবাদের শক্তিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে বিজেপি কে এক জুজু রূপে পরিবেশিত করবে।

দেশে আরএসএস ও বিজেপির আসল শক্তি ও কর্পোরেট মিডিয়ায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো শক্তির মধ্যে অনেক অন্তর আছে। এটা সঠিক যে দিল্লি সহ দেশের বড় বড় শহরের কোনায় কোনায় অবস্থিত উচ্চ জাতির হিন্দু অভিজাত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির বেশির ভাগ লোকই বিজেপির জাতীয়তাবাদের চরণামৃত সেবন করে এবং ব্রাক্ষণত্ববাদের দৃষ্টি ভঙ্গির থেকে দেশ ও সমাজকে মেপে চলে। এই উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উচ্চ জাতির হিন্দুদের মূল আয়ের উৎস হলো কর্পোরেট সংস্থায় চাকরি, ব্যাবসা বা সরকারী চাকরি।কিন্তু এই শ্রেণীর বাইরে যে বিরাট ভারতবর্ষ আছে, যেখানে আছেন কোটি কোটি মানুষ, যাঁরা খেতে পাননা দুইবেলা, যাঁদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষ দিনে ৭০ টাকার কম রোজগার করে সংসার চালান, ওই ক্ষেতে কাজ করা কৃষকরা, ওই কারখানার শ্র্মিকরা, ওই জঙ্গলের থেকে খেদানো আদিবাসী সমাজ, ওই ব্রাক্ষণত্ববাদের দ্বারা পদপিষ্ট দলিতরা, ওই দেশের কোনায় কোনায় হিন্দুত্ববাদের আক্রমণ ও আতঙ্কে দিন কাটানো সংখ্যালঘুরা, ওই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মানুষেরা, এরা সবাই সম্মিলিত ভাবে বিজেপি-আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। এরাই তো প্রকৃত বিপ্লবী বামপন্থীদের শক্তি। এই ৯০ কোটি মানুষ বাকি ৩৫ কোটির চেয়ে বেশি শক্তিশালী, যাদের তীব্র আক্রমণ আর যুদ্ধ করেও দাবিয়ে রাখতে পারছে না ভারতের শাসক শ্রেণী। তাই ঐক্য যদি করতে হয় ছাত্র - যুব বন্ধুরা তাহলে ওই শোষিত-বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিন। ওই শোষিত-নির্যাতিত মানুষের কোটি কোটি হাত আপনার প্রতিটি আঙ্গুল কে শক্তিশালী করে তুলবে, এত শক্তিশালী যে আপনার ঘুষিতে ওই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ বারবার ছিন্ন ভিন্ন হবে।

মনে রাখবেন ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে সংশোধনবাদ সব চেয়ে আগে ফ্যাসিবাদের আক্রমণের মুখে শ্রমিক শ্রেণীকে, আপামর জনগণকে নিরস্ত্র করে এবং বুর্জোয়াদের স্বার্থে সৃষ্ট ও লালিত-পালিত পঁচা গলা এই সমাজ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক - সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপর জনগণ কে ভরসা করতে শেখায়।সংশোধনবাদ চিরকাল স্ব উদ্যোগে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম করতে শ্রমিক - কৃষকদের বাঁধা দেয় এবং তাঁদের নিয়ে যায় নির্বাচনী কানা গলিতে। বারবার বিপ্লবী উদ্যোগ কে শেষ করার এই প্রচেষ্টা সংশোধনবাদ গত এক শতাব্দী ধরে করছে।সময়ের সাথে সাথে তারা শুধু নতুন কায়দা ও কৌশল রপ্ত করেছে জনগণ কে সংগ্রামী পথ থেকে ঠেলে সংসদীয় নর্দমায় ফেলার।

আজ সময় এসেছে সংশোধনবাদের গোপন ও প্রকাশ্যে রচিত ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রগুলিকে ধ্বংস করে দেশব্যাপী ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার। শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতা-ছাত্র-যুব-দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু-মহিলা এঁদের সবার উপর যতবার ফ্যাসিস্ট বাহিনী আক্রমণ করার চেষ্টা করবে ততবার ওই আক্রমণগুলিকে নাস্তানাবুদ করে দিতে হবে তীব্র জঙ্গী প্রতিরোধ গড়ে তুলে। বুদ্ধ বাবুর জঙ্গী আন্দোলনের বিরুদ্ধে করা কটুক্তি যদি আপনার রাজনীতির ভিত হয় তাহলে আপনি এই লড়াইয়ে অবশ্যই ফ্যাসিবাদের পক্ষে চলে যাবেন। যদি জঙ্গী প্রতিরোধ গড়ে ফ্যাসিবাদ ও তার মালিক বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজি, দেশি দালাল পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদী - মনুবাদী জোতদারদের কতৃত্ব খতম করার রাজনীতিতে আপনি বিশ্বাস করেন তবে অবশ্যই আপনি শেষ পর্যন্ত জনগণের শিবিরেই থাকবেন।  আজ দিন এসেছে আরএসএস ও বিজেপির কবর খোঁড়ার।ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যায় আজ মানুষ সেই কবর খুঁড়ে চলেছেন - তাঁদের হাত শক্তিশালী করুন - প্রকৃত ভাবে জনগণের গণতন্ত্র গড়ে তুলতে এগিয়ে আসুন।     

জেএনইউ এর ছাত্রদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে কি দিল্লীর বসন্তের শুরু ?

বুধবার, ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

জাতীয়তাবাদ ও দেশ প্রেম নিয়ে বেশ একটা কীর্তন শুরু হয়েছে কর্পোরেট মিডিয়াগুলিতে, সৌজন্যে আফজাল গুরু ও জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়৷ গত ৯ই ফেব্রুয়ারী জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন বা ডিএসইউ এর তরফ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি অনুষ্ঠান করার জন্যে উপাচার্যের কাছে আবেদন করা হয়৷ কর্মসূচী ছিল আফজাল গুরু ও মকবুল ভট্ট এর রাষ্ট্রীয় হত্যার বিরোধিতা করা এবং কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের গণতান্ত্রিক অধিকার কে স্বীকার করা৷ 

স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এই আবেদনে সাড়া দেননি৷ এর ফলে ডিএসইউ এর ছাত্র ছাত্রীরা এই অনুষ্ঠান সরিয়ে আনে সবরমতি ধাবাতে৷ এই অনুষ্ঠানের কথা শুনেই রে রে করে তেড়ে আসে আরএসএস এর ছানারা, অর্থাৎ এবিভিপি' র গুন্ডাবাহিনী, নেতৃত্বে অবশ্যই এক ব্রাক্ষণ সন্তান সৌরভ শর্মা, যে জোতদারদের ছেলে মেয়েদের ভোটের জোরে জিতে জেএনইউ এর ছাত্র ইউনিয়নের একমাত্র গেরুয়া ব্রাক্ষণত্ববাদী মুখ৷ গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নের উপর হামলা কে রুখে দিতে এগিয়ে আসেন সামগ্রিক ভাবে সমস্ত বাম ও গনতান্ত্রিক ছাত্র ছাত্রীরা৷ নিজেদের সংগঠনের বেড়ি ভেঙ্গে ছাত্র ছাত্রীরা যে এভাবে ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন তা সৌরভ শর্মা বা তাঁর আরএসএস এর অভিভাবকরা ভাবতে পারেননি৷ তাই শিয়ালের মতন চেঁচিয়ে সৌরভ শর্মা আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা বিজেপির দ্বারস্থ হয়, শুরু হয় হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি৷ বিজেপির পূর্ব দিল্লীর সাংসদ মহেশ গিরি আচমকা দক্ষিণ দিল্লীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা কে তাঁর মালিক কর্পোরেট সংস্থাগুলির পোষা মিডিয়ার সাহায্যে বিকৃত করে দেখিয়ে দেশের মধ্যে তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধিতার আবহাওয়া সৃষ্টি করতে চাইলেন। 

আরএসএস এর খাকি নেংটি পরিহিত বানর সেনা জেএনইউ এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বামপন্থী ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে, বিশেষ করে কমিউনিস্ট এবং আদ্যন্ত নাস্তিক উমর খালিদের সাথে পাকিস্তানের জঙ্গী কমিউনিস্ট বিরোধী লশকর এ তইবা ও জয়শ মুহম্মদ গোষ্ঠীর সঙ্গে খালিদের সংস্রব থাকার মিথ্যা প্রচার শুরু করে

দেশের গৃহ মন্ত্রীর আদেশে বিজেপির ভৃত্য 
দিল্লীর ঘুষখোর পুলিশ শুরু করে ছাত্রদের উপর দমনপীড়ন৷ ছাত্র ইউনিয়নের প্রধান কানহইয়া কুমার কে গ্রেফতার করা হয় এবং এবিভিপি বাদে সমস্ত ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছাত্র ছাত্রীদের উপর পুলিশি নির্যাতন শুরু হয়৷ প্রবীণরা স্মৃতিচারণ করেন যে এভাবে হোস্টেলে একমাত্র ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার সময় ব্যতিরেকে কখনোই পুলিশি হামলা হয়নি৷ গত বছর মোদীর এককালের গুরু এবং এখনকার বিরোধী আডবানি বলেছিলেন যে দেশে জরুরী অবস্থার মতন পরিস্থিতি এখনো বিরাজ করছে৷ সেই সত্যটা যে ছত্তিশগড়-ঝাড়খন্ড-কাশ্মীর-মণিপুর-নাগাল্যান্ড পেরিয়ে দিল্লীর মাটিতে বাস্তবায়িত হবে এ কথা বিজেপির অনেক বড় বড় নিন্দুকেরা ভাবতে পারেনি৷

কানহইয়া কুমার, সিপিআই এর গোবেচারা নিরামিষাশী ছাত্র সংগঠন এআইএসএফ'র কর্মী এবং তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে৷ বিহারের গরীব দলিত পরিবারের সন্তান আজ ব্রাক্ষণত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট আরএসএস ও বিজেপির চক্ষুশূল, কারণ এই দলিত - মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে  কিছু প্রগতিশীল উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের সমর্থনে জেএনইউ চিরকালই বামপন্থী ছাত্র-ছাত্রীদের ভোটে জিতিয়েছে৷ আর দেশের যে কোনো অংশে ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক-কৃষক, দলিত-আদিবাসী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ফ্যাসিস্ট শক্তির ও রাষ্ট্র যন্ত্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে জেএনইউ চিরকালই সোচ্চার থেকেছে৷ যে ভাবে দেশের বৃহৎ ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট কলেজগুলোর ক্যাম্পাসে আরএসএস ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের প্রসার হয়েছে সে ভাবে জেএনইউ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে গেরুয়া সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলি কল্কে পায়নি৷ অথচ দেশ কে, দেশের মাটিকে, দেশের সম্পদ কে বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির কাছে বেচার শর্তই হলো এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা আজ অবধি চলতে থাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট কেরানী বানাবার শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়েও বেশি প্রতিক্রিয়াশীল এবং চরম ভাবে সাম্প্রদায়িক মশলা পূর্ণ হবে৷ গত কয়েক বছর ধরে এই দাবি করে আসছে বিজেপি ও কংগ্রেসের মনিব বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও ডব্লিউটিও৷

তাই ক্ষমতায় এসেই মোদী প্রথমে দেশের সমস্ত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর আরএসএস এর খবরদারি বাড়াবার সিদ্ধান্ত নেন এবং শুরু করেন দেশের অন্যতম চলচিত্র ও টিভি শিল্পের প্রতিষ্ঠান, পূণা স্থিত এফটিআইআই এর অধ্যক্ষের পদে আরএসএস এর চামচা এবং কিছু ফ্লপ বি গ্রেড পর্ণ সিনেমায় কাজ করা গজেন্দ্র চৌহান কে বসিয়ে  যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে পথে নামেন এফটিআইআই এর পড়ুয়ারা এবং সাথে দাঁড়ায় সমগ্র ভারতের প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীরা, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা৷

এর পরেই ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় যে নেট পরীক্ষা ব্যতিরেকে অন্যন্য ছাত্র -ছাত্রীদের গবেষণার বৃত্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে৷ এই সিদ্ধান্তকে উচ্চ শিক্ষাকে ডব্লিউটিওর হুকুম মেনে পণ্যে পরিণত করার ষড়যন্ত্র বলে চিন্হিত করে দিল্লী সহ সমগ্র দেশে ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, যা #occupyUGC আন্দোলন হিসাবে খ্যাতি লাভ করে৷ শেষ পর্যন্ত সরকারকে পিছিয়ে আসতে হয় এবং ইউজিসির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হয়৷

এ বছরের জানুয়ারী মাসে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বন্দারু দত্তরেয়া ও স্মৃতি ইরানীর আদেশে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার জন্যে পাঁচ জন দলিত ছাত্র কে বহিষ্কার করে এবং তাঁদের হোস্টেল থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলা হয়৷ রোহিথ ভেমুলা সহ পাঁচ জন ছাত্র ক্যাম্পাসের খোলা আকাশের নিচে আন্দোলন চালিয়ে যান এবং তাঁদের সমর্থনে উত্তাল হয় গোটা দেশের প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীরা৷ জেএনইউ পিছিয়ে থাকে না৷ ঠিক এই সময় ফ্যাসিবাদী এভিবিপি'র অত্যাচার, জাতিবাদী লাঞ্ছনা ও বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের ব্রাক্ষণত্ববাদী শোষণের চাপে রোহিথ ভেমুলা কে নিজের প্রাণ দিতে হয়৷

এর পর সারা দেশের প্রগতিশীল ছাত্র শক্তি তীব্র আন্দোলনে ফেটে পড়ে, দেশের রাজপথে ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আরএসএস ও বিজেপির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন ছাত্র - ছাত্রীরা৷ জেএনইউ এগিয়ে আসে দিল্লীর রাজপথে, নেতৃত্ব দেয় জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির৷ তাঁদের মিছিলে হামলা চালায় দিল্লী পুলিশ ও আরএসএসের যৌথ বাহিনী৷ দিল্লীর ছাত্র রাজনীতির মণ্ডপে পিছিয়ে পড়ে এবিভিপি ও অন্যন্য দক্ষিণপন্থী ছাত্র সংগঠন৷ দলিত ছাত্র ছাত্রীদের থেকে তারা বিশেষ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়

ভারতবর্ষে বামপন্থী জঙ্গী ছাত্র আন্দোলনে সেই আশির দশক থেকে ভাঁটা শুরু হয়, যে ফাঁক গলে মন্ডলপন্থী, উগ্র হিন্দুত্ববাদী, দলিত বিরোধী, সংরক্ষণ বিরোধী এবং অন্যন্য ছাত্র রাজনীতি নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠে৷ জেএনইউ তারই মধ্যে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন টিকে ছিল৷ টিকে ছিল কারণ সেখানকার পরিবেশে ছাত্র-ছাত্রীদের এই নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির সময়েও, বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের সময়েও দ্বান্ধিক ভাবে, বস্তুগত ভাবে দেশ, সমাজ ও বিশ্ব কে দেখার ও বিশ্লেষণ করার জন্যে সিনিয়রদের তরফ থেকে প্রেরণা দেওয়া হতো৷ বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা গরীব ও দলিত - আদিবাসী সমাজের ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেরই মার্কসবাদে হাতেখড়ি এই জেএনইউ তেই৷ তাই চিরকালই এই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সরকারের চক্ষুশূল হয়ে থেকেছে৷ তা সে কংগ্রেস সরকার হোক বা বিজেপি সরকার


জেএনইউ তে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ছাত্র সংঘ কে শক্তিশালী করার দ্বায়িত্ব সংঘ পরিবার গুজরাটের প্রাক্তন গুন্ডা, দাঙ্গাবাজ ও বর্তমান বিজেপির অধ্যক্ষ অমিত শাহ কে দেয়৷ অমিত শাহের নির্দেশে মোদীর সরকার হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোয় ওস্তাদ সুব্রামনিয়াম স্বামী কে জেএনইউ এর উপাচার্য পদের জন্যে নির্বাচিত করে৷ খবর প্রকাশ হতেই স্বামী ঘোষণা করেন যে জেএনইউ "রাষ্ট্রদ্রোহীদের" আড্ডা, এবং তিনি আধা সামরিক বাহিনীর সাহায্যে জেএনইউ তে দমন পীড়ন চালিয়ে ছাত্রদের কাবু করবেন৷ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং সামগ্রিক ভাবে সুব্রামনিয়াম স্বামীর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগেই মোদী সরকার চালাকি করে ঘোষণা করায় যে জেএনইউ তে উপাচার্যের জন্যে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি৷

এবার জেএনইউ তে ভোটে জেতার জন্যে ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদীদের প্রয়োজন হবে বাম ছাত্রদের দুর্বলতার৷এবং তাই আচমকা শুরু হলো আফজাল গুরুর ফাঁসির বিরোধিতা করার মধ্যে দিয়ে ছাত্র -ছাত্রীদের বিরুদ্ধে বিজেপি - আরএসএস ও কর্পোরেট মিডিয়ার অপপ্রচার। 

এদের প্রচারে সমস্ত যুক্তি, তর্ক, প্রশ্ন এক পাশে রেখে শুধু উগ্র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ কে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা চলতে থাকলো। কিন্তু জেএনইউ থাকলো জেএনইউ তেই, পুলিশী সন্ত্রাসের কারণে কিছু ছাত্র কে আত্মগোপন করে কাজ চালাতে হলো ঠিকই, কিন্তু প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন জোয়ার সৃষ্টি করে দিল্লীতে, নিজেদের বাড়ি ও স্বজনদের থেকে দুরে থাকা নিরস্ত্র ছাত্র ছাত্রীরা অকুতোভয় হয়ে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়তে থাকলেন।আন্দোলনের চাপে নাস্তানবুদ হয়ে শেষ পর্যন্ত শাসক শ্রেণী নগ্ন আক্রমণ শুরু করে। দিল্লীর রাস্তায় যেকোনো দাড়িওয়ালা, ঝোলা ওয়ালা বা একটু বেপরোয়া দেখতে ছেলে মেয়েদের ধরে জেলে পোরা শুরু করে ক্ষত্রিয় রাজনাথ সিংহের পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় অধ্যাপক এস.এ.আর গিলানি কে, যিনি বহু বছর পুলিশের মিথ্যে মামলার (সংসদ ভবন হামলার কেসে, এবং এই কেসেই আফজল গুরুর ফাঁসি হয়) কারণে জেলে ছিলেন এবং প্রায় ১১ বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে মুক্তি দেয় প্রমাণ ও তথ্যের অভাবে। তাঁকে আবার দেশদ্রোহী বলে শুরু করা হয় অকথ্য অত্যাচার।কানহইয়া কুমারকে বিচারের জন্যে আনার সময়ে পাটিয়ালা আদালত চত্বরে বামপন্থী কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক এবং সাংবাদিকদের উপর বেপরোয়া আক্রমণ চালানো হয়, এবং দেশকে নির্লজ্জ ভাবে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির কাছে বিক্রি করার সওদাগর মোদীর সেপাইরা এই আক্রমণ করে দেশপ্রেমের নামে, যা আসলে দেশভক্তির চেয়ে বেশি রাষ্ট্র ভক্তির পরিচয় - উগ্র ব্রাক্ষণত্ববাদের উপক্রম।

কোর্ট চত্বরে অল্প বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের উপর হামলার নেতৃত্ব দেন বিজেপির দিল্লীর তিন বিধায়কের একজন, ব্রাক্ষণ সন্তান ও.পি শর্মা। তিনি ক্যামেরার সামনে সিপিআই এর এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাকে মাটিতে ফেলে পেটান এবং তাঁর সাথে যুক্ত হয়ে আদালত চত্বরের গেরুয়া উকিল বাহিনী নির্মম ভাবে ছাত্র - ছাত্রী ও সাংবাদিক দের প্রহার করেন। আর এই নির্লজ্জ কীর্তি দেখে মুচকি হাঁসি হাসে ভীম সিং বাসসির দিল্লি পুলিশ। এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এই বছর অবসর গ্রহণ করার পরে বাসসি তাঁর খাকি প্যান্ট দর্জি কে দিয়ে ছোট করিয়ে পড়বেন যাতে করে নাগপুরের প্রভুদের কৃপায় তাঁর একটা রাজ্যপাল বা কোনো সরকারি বিশেষজ্ঞ পদ জোটে

এত সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রের নগ্ন ফ্যাসিবাদী আক্রমণের পরেও সরকারি বামপন্থী দলগুলি সেই নিয়ম রক্ষার কায়দায় গণতন্ত্র কে রক্ষা করা এবং বিজেপির হাত থেকে সংবিধান রক্ষার পুরানো বুলি কপচানো বাদে আর কিছু করছে না। নির্লজ্জের মতন নিজ ঘটি বাটি বাঁচাবার স্বার্থে কাশ্মীরের স্বাধীনতা বা আফজালের ফাঁসি সংক্রান্ত কোনো স্লোগান দিতে ছাত্র যুবদের মানা করছেন। তবুও ছাত্র ছাত্রীরা স্লোগান দিচ্ছেন, গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী উমর খালিদের সমর্থনে দাঁড়াচ্ছেন এবং বৃদ্ধ শোধনবাদী শৃগালদের প্রবচন না শুনে ঐক্যবদ্ধ ভাবে একাই লড়ে চলেছেন এক যুদ্ধ। কারণ ছাত্র ছাত্রীরা বুঝেছেন যে আদতে আক্রমণ জেএনইউ এর নামে শুরু হলেও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের আসল লক্ষ্য হলো লাল ঝান্ডা এবং লাল ঝান্ডার নিচে সমবেত সকল শ্রমিক-কৃষক-দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। যেহেতু জেএনইউ তে বামপন্থী ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা বেশি তাই শাসক শ্রেণী ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। তাই আজ একসাথে আক্রান্ত হচ্ছেন সমস্ত দলের বামপন্থী কর্মী সমর্থকরা

দেশদ্রোহী বলে যাঁরা রাষ্ট্র শক্তির আউটসোর্স্ড বাহিনী হয়ে আজ ছাত্র ছাত্রী এবং প্রতিবাদী সাংবাদিকদের পেটাচ্ছে তাদের সাথে মুসোলিনির পেটোয়া বাহিনীর কোনো গুণগত পার্থক্য আছে কি? একদিকে ভারতের মাটি, জল, আকাশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, মানবসম্পদ সবকিছুই পাইকারি দরে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের তাঁবেদার দিশি দালাল পুঁজিপতিদের কাছে মোদী সরকার বিক্রি করছে, অন্যদিকে অপারেশন গ্রীন হান্টের নামে গরীব আদিবাসী জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। জল, জমি, জঙ্গল থেকে আদিবাসী মানুষদের উচ্ছেদ করে সেই জমি "দেশের উন্নয়নের " নামে বড় বড় আকরিক খনি কোম্পানিগুলির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আর দেশের ৮০ ভাগ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করার, তাঁদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারগুলিকে রক্ষা করার সংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের দেশ দ্রোহী বলে জেলে বন্ধ করা হচ্ছে, গুম খুন করা হচ্ছে এবং এই ফ্যাসিবাদের জয়ধ্বনি তুলে একটা পঁচা গলা অত্যাচারী ব্যবস্থাকে রক্ষা করার ব্রত নিয়েছে ওই বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির দ্বারা চালিত সংবাদমাধ্যম ও তাদের পেটোয়া দালাল সাংবাদিকরা

ঠিক যখন জেএনইউ এর নামে ও.পি শর্মা এবং তাঁর সাগরেদরা বামপন্থী কর্মীদের রাস্তায় ফেলে পেটাচ্ছে, ঠিক তখনই সুদূর ছত্তিশগড়ে আদিবাসী জনগণের জঙ্গলের উপর থেকে সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়েছে রমণ সিং এর বিজেপি সরকার, যাতে জঙ্গল, পাহাড়, নদী সব কিছু বিদেশী আর দিশি পুঁজিপতিরা লুটে পুটে খেতে পারে। সারা দেশের সংবাদে যখন শুধুই জেএনইউ, ঠিক সেই সময়ে এই সিদ্ধান্ত আদতেই কি আমাদের খুব একটা আশ্চর্য করেছে? আজ এই ৮০ ভাগ মানুষের স্বার্থে, খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থে লড়াই করা যদি দেশদ্রোহ হয় তবে সকল প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীনতা প্রেমী মানুষকে বলিষ্ঠ ভাবে বলতে হবে যে -হ্যাঁ, আমি দেশদ্রোহী, কারণ তোমাদের মতন আমার কাছে দেশ মানে মাটি, বালি, জল, পাথর আর কাঁটা তার নয়। আমার কাছে দেশ মানে দেশের মানুষ, টাটা-বিড়লা-আম্বানি-আদানি নয় বরং নিজের শ্রম দিয়ে সম্পদ সৃষ্টি করা, খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি জনগণ, যাঁদের বেশির ভাগের পেটে আজ তোমাদের তথাকথিত দেশপ্রেমের কারণে দুইবেলা ভাত যায় না। আমরা দেশদ্রোহী কারণ আমাদের কাছে ভারত মাতা মানে এক কাল্পনিক মূর্তির পূজা নয়, যতবার তোমরা আর তোমাদের মনিব ওই জোতদার-জমিদার-দালাল পুঁজিপতি- ওই উচ্চ জাতির ব্রাক্ষণত্ববাদী শয়তানরা-ওই উর্দি গায়ে রাইফেলধারী বাহিনী আমাদের মা আর বোনদের ধর্ষণ করো দেশের প্রান্তে প্রান্তে ততবার আমাদের ভারত মাতা লাঞ্ছিত হয় এবং তোমাদের ওই ডাইনী ভারত মাতার লম্পট সন্তানদের বিরুদ্ধে আমাদের লাঞ্ছিত গরীব ভারতমাতার সন্তানরা লড়ে যাবে। লড়ে যাবে ততদিন যতদিন তোমাদের সিংহাসন থেকে টেনে নোংরা নর্দমায় ফেলে তোমাদের মুখে মূত্র ত্যাগ না করতে পারছে এ দেশের গরীব ও শোষিত জনতা- এ দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণ-আদিবাসী-দলিত-সংখ্যালঘু নারী ও পুরুষ। 

আজ থেকে ১৪ বছর আগে ২০০২ এর এমনই এক ফেব্রুয়ারি মাসে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের আদর্শ পুরুষ নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন "যা হচ্ছে তা নিউটনের তৃতীয় নিয়ম -প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে অনুকরণে হচ্ছে"। মোদী বলেছিলেন গুজরাটে মুসলমান নিধন যজ্ঞের সময়ে এবং আজ সময় এসেছে দেশের সমস্ত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানুষের এই প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বিপ্লবী সংগ্রামের আগুনে সাম্প্রদায়িক ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ও তার আনুষঙ্গিক সমস্ত শয়তানি পরম্পরা কে জ্বালিয়ে দিয়ে নিউটনের দ্বারা আবিষ্কৃত মহান বৈজ্ঞানিক নিয়মের সম্মান করা। আজ যদি আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগোতে দ্বিধা থাকে তাহলে কিন্তু সত্যিই পিছিয়ে পড়বো। বসন্ত প্রাগে এসেছিল, বসন্ত এসেছিল আরবে, এবার বসন্ত দিল্লীতে। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে