CAA NRC এবং DAMAL নিয়ে প্রসেনজিৎ বসুর সাম্প্রতিক লেখার জবাবে

বুধবার, ডিসেম্বর ৩০, ২০২০ 0 Comments A+ a-



প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মাননীয় প্রসেনজিৎ বসু গতকাল "'দামাল' না বিজেপি-র 'দালাল?" শিরোনামে তাঁর ফেসবুক পেজে একটি ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধটিতে তিনি তার স্বভাব সুলভ মেধার পরিচয় দিয়েছেন, যার বস্তুবাদিতা দেখলে কার্ল মার্কস নিজের সমস্ত দাড়ি ছিঁড়ে ফেলবেন এবং যুক্তি কাঠামো দেখে এরিস্টটল দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরবেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে অপ্রাসঙ্গিক অযৌক্তিক প্রবন্ধ লেখার ক্ষমতা খুব কম প্রতিভাবানেরই থাকে। আমি এখানে মাননীয়  প্রসেনজিৎ বসুর প্রত্যেকটা ছত্র তুলে আলোচনা করলাম। একলাইনও বাদ দেইনি। ফলত প্রবন্ধটি দীর্ঘ হবে।

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ 

"২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি বারবার বলেছে যে আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করে হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, তারপর এনআরসি করে "ঘুসপেটিয়া"-দের দেশ থেকে বার করে দেওয়া হবে। অমিত শাহ গোটা দেশকেই এই ক্রনোলজি বুঝিয়েছিল (নিচের ভিডিওটি দেখুন):
দিলীপ ঘোষ আরও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল যে পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি "মুসলিম ঘুসপেটিয়া" আছে, গোটা ভারতে ২ কোটি। তাদের জন্যেই এনআরসি (নিচের ভিডিওটি দেখুন):"

(ঘুসপেটিয়ার বানান মূল লেখায় "ঘুষপেটিয়া" থাকায় তা বদলানো হল - সম্পাদক, বিশ্লেষক)



আমাদের কথাঃ
প্রসেনজিৎ বসু একেবারে লিংক খুজে দিয়েছেন কষ্ট করে। যেখান থেকে তিনি বিজেপি নেতা মন্ত্রীদের কোট করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি  প্রক্রিয়ায় মধ্যে দিয়ে মুসলমানদের তাড়ানো হবে এবং তার আগে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯, বা সিএএ ২০১৯ এর মধ্যে দিয়ে হিন্দুদের নাগরিকত্ব সুরক্ষিত করা হবে।

আমরা জানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং আইনমন্ত্রী রবি শঙ্কর প্রসাদ বলেছেন জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী বা এনপিআর-র সাথে এনআরসি-র কোনো সম্পর্ক নেই। বিরোধীরা নাকি ভুল বুঝিয়েছেন।
প্রসেনজিৎ বসু কি এই দুই মন্ত্রীর মুখের কথায় বিশ্বাস করেছেন? করে থাকলে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এনপিআর রুখতে রিলে অনশনের মত মারাত্মক চাপ সৃষ্টিকারি কর্মসূচি কেন নিয়েছিলেন লকডাউনের আগে?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন দেশে কোনো ডিটেনশন ক্যাম্প নেই
প্রসেনজিৎ বসুরা কি তাদের লিফলেট থেকে আসামে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে বন্দিদের মুক্ত করার দাবি সরিয়ে নেবেন? কারণ ভারতের "গণতন্ত্রে" সর্বোচ্চ পদে আসিন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ভারতে ডিটেনশন ক্যাম্পই নেই, তাহলে কার মুক্তি চাইছেন প্রসেনজিৎ বসুরা?

সম্ভবত  মোদিজীর প্রতিশ্রুতি দেওয়া ১৫ লাখ টাকাটি একমাত্র প্রসেনজিৎ বসুই পেয়েছেন। আর বাৎসরিক দুই কোটি প্রতিশ্রুত চাকরির মধ্যে বিজেপির দেওয়া চাকরিটি বসু বাবুই পেয়েছেন।  তাই বিজেপি নেতা মন্ত্রীদের মুখের কথায় এত বিশ্বাস। প্রসেনজিৎ বসু এরপর হয়তো বিজেপি নেতাদের কথা শুনে গরুর দুধে সোনা খুজে দেশের অর্থনীতি শোধরাবার পরামর্শ দেবেন বা বিজেপি নেতাদের কথা মত জ্যোতিষকে বৈজ্ঞানিক ব্যাপার ঠাউরে কোমরে তাবিচ বেধে সিপিএম ডোবার কালে রাজনৈতিক ভাগ্যান্বেষনে নেমেছিলেন। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ও যিনি গর্বিত সিপিএম।

মুখের কথা আর জল্পনা দিয়ে নয়, প্রামাণ্য নথিপত্রের উপর আন্দোলন হয় জানতাম। প্রসেনজিৎ বাবুরা নতুন পথ দেখাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু আমরা পুরানো পথে, অর্থাৎ প্রামাণ্য নথির উপর ভিত্তি করে বলবো যে এনআরসি-তে হিন্দু মুসলিম সবাই বাদ যাবে, সিএএ ২০১৯ কাউকেই বাঁচাবে না। হিন্দুকে রাখবে, মুসলিমকে তাড়াবে–এই প্রচার হিন্দুদের আন্দোলন থেকে নির্লিপ্ত করেছে এবং আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে বিজেপির হাত শক্ত করেছে।

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

"দেশের ধর্মনিরপেক্ষ জনগণ সিএএ-২০১৯-এর বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তায় নামে, নেতৃত্ব দেন মুসলিম মহিলারা। গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে টানা এই বছরের মার্চ মাস অবধি এই গণ-আন্দোলন চলে। দেশের অনেক শহরেই শান্তিপূর্ণ ধর্না এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি চলেছিল লকডাঊন হওয়া পর্যন্ত।"

প্রসেনজিৎ বসুর আর এক পালোয়ান  সেনাপতি অনির্বাণ তলাপাত্র ২৪ অগাস্ট দলিত আদিবাসী মাইনোরিটি আন্দোলন লীগ (দামাল) এর বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন "এটাও মনে রাখা দরকার যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ এবং NRC-NPR-এর বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালত Supreme Court-এ ১৫০টির বেশি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা করা হয়েছে Joint Forum against NRC - নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্ত মঞ্চ-র পক্ষ থেকে। এই মামলাগুলির ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবেই এই CAA ২০১৯ আইনটিকে বলবৎ করা যাবে না। এই মামলাগুলির শুনানিও এখনো শুরু হয় নি। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এই আইনের আওতায় এখুনি কাউকে নাগরিকত্ব দিতে পারবে না। এইটাইতো NRC-NPR-CAA বিরোধী আন্দোলনের সবথেকে বড় সাফল্য এখনো অবধি।"

আমাদের কথাঃ

বসুবাবু আলাদা করে "শান্তিপূর্ণ" আন্দোলনের কথা বলেছেন। "অশান্তিপূর্ণ" আন্দোলনগুলো কে তিনি ধারণ করছেন না? আলাদা করে শান্তি পূর্ণ লেখার প্রয়োজন কেন হলো? শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের তাগিদ সরকারপক্ষের নাকি বিরোধী পক্ষের?

হয় প্রসেনজিৎ বসুরা ইচ্ছাকরে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন অথবা বুঝতে ভুল করেছেন যে সারা দেশ জুড়ে যে আন্দোলন হয়েছিলা, যে আন্দালনে মুসলিম মহিলারা সামনের সারিতে ছিলেন এবং মুসলিম এলাকা গুলোতেই বড় বড় অবস্থান গুলো হয়েছিলো… সেই আন্দোলন উদ্বাস্তদের নাগরিকত্ব পাওয়া আটকাবার জন্য হয়নি। আন্দোলন হয়েছিলো নাগরিকত্ব হারানো আটকানোর জন্য। বেনাগরিক হওয়া থেকে আত্মরক্ষা করা ছিলো এই আন্দোলনের এসেন্স, জাতীয় পতাকা, সংবিধান রক্ষা এই গুলো ছিলো এপিয়ারেন্স। 

২০০৩ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, বা সিএএ ২০০৩ পাস হওয়ার সময় থেকে নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুরা যে আন্দোলন করে এসেছেন বা নাগরিকত্বের নামে হয়রানির বিরুদ্ধে মতুয়া ও অন্যান্য নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুরা যে আন্দোলন করে এসেছেন, সেই আন্দালনে উচ্চবর্ণ এলিটদের পাওয়া যায়নি। বরং প্রসেনজিৎ বসুর তৎকালীন পার্টি সিপিএম  এই আইনটির বিরুদ্ধে আন্দোলন ধর্মঘট দূরে থাক একটা মানব বন্ধনও করেনি। এখনও যেমন নাগরিকত্বের নামে ক্রমাগত হয়রানি, আত্নহত্যা,অপমানের শিকার নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের নিয়ে এদের কোনো সংবেদনশীলতা  দেখা যাচ্ছ না।
 
অথচ সিএএ ২০০৩ প্রণয়ন হওয়ার পর থেকেই নাগরিকত্ব পাওয়া এবং হয়রানি বন্ধের জন্য নতুন আইন আনার দাবির আন্দালনে নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের পাশে থেকেছে মুসলিম সংগঠন গুলো। ফলে আজ মুসলিম ধর্মালম্বী নেতারা "NO CAA" স্লোগানটা কেন ভুল, কেন উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের ন্যায্য দাবীকে সমর্থন জানিয়ে, বিজেপির সিএএ ২০১৯ যে একটি ভাঁওতা সেটাকে এক্সপোজ করে, এনআরসি-তে হিন্দু-মুসলিম সবাই বাদ যাবে এটা বুঝিয়েই বিজেপির কোমর ভেঙে দেওয়া যাবে সেটা বুঝেছেন। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম নেতাদের বিবেক বুদ্ধি বসু বাবুর থেকে বেশী এটা মেনে নেওয়া কষ্টের বইকি।

সিএএ ২০১৯-এর মধ্যে দিয়ে ৩১,৩১৩ জনের বাইরে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব নয়, রুলস বের করলেই সেটা "দুধ কা দুধ, পানি কা পানি" হয়ে যাবে। তাই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের আগে কোনো ভাবেই বিজেপি রুল বের করবেনা।  তাই দামাল সেই শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জ করে আসছিল যে বিজেপির ভোটের আগে রুলস প্রকাশ করে দেখাক! হলও তাই, অমিত শাহ দুই বার রুল বের করার সময়সীমা মিস করলো। আনন্দবাজার পত্রিকা ফ্রন্ট পেজে লিখলো পূজোর আগেই নাকি নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, পূজো পেরিয়ে গেল। এবার অমিত শাহ  বাংলা সফরে এসে সিএএ এর নাম উচ্চারণ করলোনা। বিজেপির মতুয়া ভিত্তিতে ভাঙন ধরলো। বিজেপি বুঝলো করোনার দোহাই দিয়ে আর মতুয়া ক্ষোভ ঠেকানো যাবে না। 

এবার বিজেপির ত্রাতার ভূমিকায় হাজির হয়ে যুক্তি সরবরাহ করলো প্রসেনজিৎ বাবুরা। কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বললেন যে বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টে কেস করেছে, সুপ্রিম কোর্ট এই কেসের ফয়েসলা করলে তবে জানুয়ারীতে সিএএ ২০১৯ লাগু করে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে (পরে অমিত শাহ বললেন যে করোনা ভাইরাসের টিকা প্রদান করার পরে রুলস বের হবে-সম্পাদক, বিশ্লেষক), যদিও প্রসেনজিৎ বাবু এবং কৈলাশ বিজয়বর্গীয় জানেন যে সুপ্রিম কোর্ট সিএএ ২০১৯ এর উপর কোনো স্টে অর্ডার দেয়নি। ফলে সুপ্রিম কোর্ট এর রায়ের জন্য বা বিরোধীদের জন্য রুলস প্রকাশ আটকে আছে এমনটা নয়। কৈলাশ বিজয়বর্গীয় না হয় মতুয়াদের প্রতারিত করছে, প্রশ্ন হল প্রসেনজিৎ বসুরা কাকে প্রতারিত করছে, জনতাকে নাকি নিজেদের?

"NO CAA"-এর ভুল স্লোগানের জন্য নাগরিকত্ব রক্ষার লড়াইয়ে অনবদ্য লড়াইটা ছোটো হয়ে যায়না। এই লড়াইয়ের যা ভাল, যা গৌরবময়, তার  কৃতিত্ব জনতার, আর ভুলটুকুর দায় অবশ্যই প্রসেনজিৎ বসুর বা অন্যান্য এলিট বুদ্ধিজীবীদের নিতে হবে। এদের ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা ভুল স্লোগানের জন্য আন্দোলনটি মুসলিম জনতা আর বিরোধী একটিভিস্টদের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আর হিন্দুদের হয় বিজেপির দিকে ঠেলেছে নয়তো নিস্ক্রিয় করে দিয়েছে। 

এখন আত্মসমালোচনা করে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে যখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্য তৈরি করে এটাকে মুসলিম ইস্যুর বদলে খেটে দেশের নিপীড়িত শোষিত মানুষের সংগ্রামে পরিণত করার সুযোগ এসেছে তখন বসু বাবুরা ক্ষেপে উঠেছে, ভুল শুধরে এগুবেন না! ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদ বড় বালাই!  

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেন:

"নাগরিকপঞ্জি বিরোধী যুক্তমঞ্চ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এবং কলকাতার জনগণনা ভবনে স্মারকলিপি দিয়ে এনপিআর বন্ধ করার দাবিতে ১২ই মার্চ থেকে কলকাতার রাজাবাজার ধর্নামঞ্চে রিলে-অনশনও শুরু করে। কিন্তু ২৪শে মার্চ থেকে দেশজুড়ে করোনাভাইরাস জনিত লকডাউন ঘোষণা হওয়ায় আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়।  

কেরালা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ এবং তেলেঙ্গানার মতন বেশ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভায় সিএএ-২০১৯ বিরোধী প্রস্তাব পাশ হয়। শুধু দেশের ভিতরে নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয়রা এই আন্দোলনের সমর্থনে সোচ্চার হয়। জাতিসংঘের UNHCR-ও এনআরসি এবং সিএএ ২০১৯-র বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। "

আমাদের বক্তব্যঃ

প্রসেনজিৎ বাবুরা খুবই বুদ্ধিমান, তারা ডেপুটেশন আর রিলে অনশন করে রাজ্য সরকারকে চাপে ফেলার কর্মসূচী নিয়ে কেন্দ্রের এনপিআর  কর্মসূচী আটকাবার পরিকল্পনা করেছিলেন। সত্যিটা হল নাগরিকত্ব একান্তভাবেই কেন্দ্র তালিকাভুক্ত বিষয়। ভারতের সংবিধানের ২৫৬, ২৫৭(১) ধারা অনুযায়ী রাজ্য সরকার কখনোই কেন্দ্রের আইনের বা কর্মসূচীর বিরোধতা করতে পারেনা। এমনকি কেন্দ্রের কর্মসূচী চাকরের মত রাজ্য সরকার মানতে বাধ্য। 

নাগরিকত্ব রাজ্যের এক্তিয়ার বহির্ভূত বিষয়। দেশে কোনো রাজ্য সরকারের এনআরসি-সিএএ মানবো না বললে তার কোনো সাংবিধানিক কাঠামোগত গুরুত্ব নেই। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে জনতার সমবেত প্রতিরোধ সংগ্রাম একমাত্র এনআরসি-এনপিআর আটকাতে পারে। এনআরসি-র উৎস সিএএ ২০০৩-এর পক্ষে ভোট দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো পরিচালিত রাজ্য সরকার গুলো সিএএ ২০১৯-এর বিরুদ্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সিএএ ২০০৩ কে চাপা দিয়ে নিজেদের পিঠ বাঁচাবার জন্য এমন করেছে। 
কিন্তু জেনে বুঝে প্রসেনজিৎ বসুরা কেন এমন কথা লিখছে? সংশোধনবাদ থেকে আইনবাদ, আইনবাদ থেকে প্রতারণা, এর পর কোথায় পৌছবেন দেখতে হবে।

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ব্যতীত মুষ্টিমেয় কিছু সংগঠন অবশ্য সিএএ-২০১৯-এর পক্ষে দাঁড়ায় - সারা ভারত মতুয়া মহাসংঘ এবং তাদের সহযোগী কিছু "উদ্বাস্তু" সংগঠন। এরাই প্রশ্ন তুলেছিল সিএএ-২০১৯-এর মাধ্যমে যদি "হিন্দু" উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পেয়ে যায়, তাহলে "মুসলমানদের" আপত্তি করার কি আছে?

এর উত্তরগুলি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বারবার দেওয়া হয়েছেঃ

১। সিএএ-২০১৯ ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য এনে নাগরিকত্ব প্রদান করার কথা বলছে। শুধু মুসলমানরাই নয়, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে আস্থা রাখা সকল নাগরিকই এর বিরুদ্ধে, কারণ এটা সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ ধারার পরিপন্থী।

২। যদি সমস্ত উদ্বাস্তুদের স্বার্থে এই আইন হত তাহলে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা করে নাম নেওয়ার কি দরকার ছিল, সমস্ত ধরণের উদ্বাস্তুদের জন্য একরকম আইন বানানো হল না কেন? শুধু বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফঘানিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য আলাদা আইন কেন? শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার বা চিন থেকে আসা উদ্বাস্তুদের এই আইনের আওতায় আনা হল না কেন?
এর কোন প্রত্যুত্তর বিজেপি বা মতুয়া মহাসংঘ দিতে পারেনি। বরং এখন তারা "দামাল" বলে একটি সংগঠনকে খাড়া করেছে তাদের হয়ে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনকে আক্রমণ করতে।

আমাদের কথাঃ

প্রসেনজিৎ বসুরা কিন্তু একবারও এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না যে কেন মতুয়া বা উদ্বাস্তু সংগঠনগুলো সিএএ কে সমর্থন জানাচ্ছে? কেন তারা নাগরিকত্ব চাইছে? কোথায় তাদের সমস্যা? এদের সমস্যা সমাধানে প্রসেনজিৎ বাবুদের বিকল্প প্রস্তাবই বা কী? নাকি নাগরিকত্বের নামে হয়রানির শিকার হলে মতুয়ারা বলবে প্রসেনজিৎ বাবুরা বলেছেন আমরা নাগরিক, তাই আমাদের হয়রানি করা যাবেনা! নমঃশূদ্রদের সমস্যার প্রতি এই অসংবেদনশীলতা বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় ছাড়া আর কী?

ধর্মনিরপেক্ষ দেশে আইনে ধর্মের নাম লেখা উচিৎ নয়, রেজিস্টার্ড রিফিউজিদের মধ্যে একজনও মুসলিম থাকলে সে নাগরিকত্ব না পেলে এটা বৈষম্য। এই কারণে আমরা অবশ্যই সিএএ ২০১৯-এর মতাদর্শগত বিরোধিতা করি। কিন্তু এই আইন রেজিস্টার্ড রিফিউজি বাদ দিয়ে বাকি বেনাগরিক হতে চলা মানুষের উপর বৈষম্য করছে না। 

এনআরসি-তে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই বাদ যাবে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব আর এনআরসি-র সাথে সিএএ-কে জুড়ে প্রচার করলে বোঝায় যে হিন্দু সুরক্ষিত আর বিপদটা মুসলিমদের। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আন্দালন থেকে দূরে ঠেলে এটা এনআরসি  সফল করার চক্রান্ত ছাড়া আর কী?

প্রসেনজিৎ বসু তারপর লিখেছেনঃ

"৩। অসমে এনআরসি-র ফলে ১৯ লক্ষ মানুষ বাদ গেছে। সিএএ-২০১৯-এর মাধ্যমে যদি নাগরিকত্ব পাওয়া যায় তাহলে ১৪ লক্ষ এনআরসি-ছুট হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবে আর ৫ লক্ষ মুসলমান পাবে না । দেশজুড়ে এনআরসি হলে হিন্দুরা "শরণার্থী" হিসেবে গণ্য হবে আর মুসলমানরা "অনুপ্রবেশকারী" হয়ে যাবে   - এটা কি একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

৪। সিএএ-২০১৯-এর আওতায় নাগরিকত্ব পেতে গেলে প্রমাণ সমেত আবেদন করতে হবে যেটা বেশিরভাগ উদ্বাস্তুই করতে পারবে না। এই "নাগরিকত্ব দেওয়ার" ব্যাপারটা পুরোটাই একটা ধাপ্পাবাজি। আসলে আরএসএস-বিজেপি নাগরিকত্বের মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন করে বাংলায় ক্ষমতা দখল করতে চাইছে আর মতুয়ারা মহাসংঘ এই খেলায় তাদের ল্যাংবোট হয়ে গেছে। "

আমাদের কথাঃ

দেখুন বসু বাবুর কান্ড! তিন নং পয়েন্টে বলেছেন সিএএ ২০১৯ আসামে ১৪ লাখ মানুষকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেবে, আর ঠিক তার পর চার নং পয়েন্টে বলছেন এই আইনটা ধাপ্পাবাজি, উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবেনা!

"আখির কহেনা ক্যায়া চাহতে হো!"

জানিয়ে রাখি আমরা প্রসেনজিৎ বসুর চার নং পয়েন্টের সাথে একমত। এবং চার নং পয়েন্টটিই সত্যি হলে প্রসেনজিৎ বাবুর এই গোটা প্রবন্ধটি অর্থহীন হয়ে যায়। প্রসেনজিৎ বসু কি সচেতন ভাবে প্যাচাল পাড়ছেন?

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

এই "দামাল" নামের সংগঠনটির মুখপাত্ররা গতকাল মৌলালি মোড়ে একটি সভা করে জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছে, যে তারা না বুঝে এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়ে পড়েছিল এবং ভুল করে রাজাবাজারের ধর্নামঞ্চে রিলে-অনশনেও বসে পড়েছিল। এখন তাদের দিব্যচক্ষু উন্মীলিত হয়েছে, তাই তারা প্রকাশ্যে বলেছে যে এনআরসি এবং সিএএ ২০১৯-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাই অনুচিত, এতে নাকি বিজেপি-র সুবিধা হবে।

অর্থাৎ "দামাল"-এর মতে এনআরসি-সিএএ ২০১৯ বিরোধী পুরো আন্দোলনটাই ভুল, সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া ১৫০ জনস্বার্থ মামলা ভুল, দেশের ৬টা রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া প্রস্তাবগুলি সবই ভুল, UNCHCR-এর অবস্থান ভুল - ঠিক শুধু সিএএ ২০১৯-এর পক্ষে যারা, অর্থাৎ মতুয়া মহাসংঘ আর বিজেপি। এরা "দামাল" না বিজেপি-র "দালাল"? 
 
আমাদের বক্তব্যঃ

প্রসেনজিৎ বসুর এই বক্তব্য ১০০% বিশুদ্ধ মিথ্যা। নিয়মিত দামাল যা বলে আসছে গত কালকেও বক্তারা তাই বলেছেন। আন্দালনের ভুলগুলোর সমালোচনা করে সঠিকটাকে আঁকড়ে ধরা ডেভেলপমেন্ট করা, এটাই মার্কসবাদী পদ্ধতি বলে জানতাম, প্রসেনজিৎ বাবুরা এখন সেই পদ্ধতি ছেড়ে বিজেপির আই টি সেলের পদ্ধতি নিয়েছেন। অমিত শাহ, দিলীপ ঘোষের মুখের কথার প্রতি অগাধ আস্থার কথাতো তিনি শুরুতেই জানিয়েছেন।

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

"সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক যে কিছু স্বঘোষিত মুসলমান নেতা বিভ্রান্ত হয়ে "দামাল"-এর সাথে ভিড়ে সিএএ ২০১৯-কে সমর্থন করছে আর এনআরসি-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কুৎসা করছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীতে যে গোটাকতক ইহুদি নিজেদের পিঠ বাঁচাতে যোগ দিয়েছিল, এরা অনেকটা তাদের মতন। বাকিরা মার খায় খাক, জেলে যাক, আমরা বিজেপি-কে তেল মেরে নিজেদের আখের গুছিয়ে নি - এইটা এদের মানসিকতা।"

আমাদের বক্তব্যঃ

সুতরাং মুসলিম ধর্মালম্বী নেতারা বসু সাহেবের সাথে একমত না হলে, তারা পর্যালোচনার মাধ্যমে আন্দোলনের ভুল শুধরে এগিয়ে যেতে চাইলে, মতুয়াদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধানের দাবিতে সোচ্চার হয়ে মতুয়াদের মধ্যে বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারকে ধাক্কা দিতে চাইলে তারা বিভ্রান্ত, বুদ্ধিহীন, বিজেপিকে তেল মেরে আখের গোছানো ইত্যাদি। আর বসু বাবু মুসলিম সমাজের সাচ্চা প্রতিনিধি!  
দামাল বা এই মঞ্চকে সমর্থন জানানো কোনো মুসলিম নেতা বা মতুয়া নেতা সিএএ ২০১৯ কে সমর্থন জানায়নি। মঞ্চে স্পষ্ট ভাবে শর্তহীন জন্মগত নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি ছিলো, উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে এখনো পর্যন্ত ভারতে বসবাসরত সকলের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার দাবি ছিলো, ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার আধার প্রকল্প বাতিল করার দাবি ছিলো,  যা নিয়ে প্রসেনজিৎ বসুরা মুখে ছিপি এটে বসে আছেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি আধারের ধরনের একটি পাঞ্চ কার্ড হিটলার চালু করেছিলেন, যা ইহুদি, কমিউনিস্ট হত্যায়, শ্রমিক আন্দোলন ধ্বংস করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।  মঞ্চে প্রত্যেক বক্তা বলেছেন যে সিএএ ২০১৯ আসলে মতুয়া উদ্বাস্তুদের প্রতি একটা ভাওতা। তার পরেও এই নির্লজ্জ গোয়েবেলসিয়ও মিথ্যা প্রচার কার স্বার্থে?

প্রসেনজিৎ বসু লিখেছেনঃ

"পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের আগে একদিকে সারা ভারত মতুয়া মহাসংঘের নেতৃত্ব আর বিজেপি-র বনগাঁর সাংসদ "সিএএ রুলস আনো, হিন্দুদের নাগরিকত্ব দাও" বলে হাওয়া গরম করা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে "দামাল" নামক দালাল-দের নামিয়ে দেওয়া হয়েছে এনআরসি-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কুৎসা করতে। কলকাঠি কারা নাড়ছে বুঝতে কি খুব অসুবিধা হচ্ছে?  
আমরা যারা এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ২০১৯-কে দেশের গরীব-উদ্বাস্তু-মুসলিম সংখ্যালঘু-দলিত এবং আদিবাসীদের "অনুপ্রবেশকারী"/"বেনাগরিক" বানিয়ে অত্যাচার করার একটা চক্রান্ত বলে মনে করি, তাদের এই বিশ্বাসঘাতকদের থেকে সাবধান হতে হবে, এদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। এনআরসি-সিএএ ২০১৯ বিরোধী আন্দোলনকে আরও ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী করতে হবে।"

আমাদের বক্তব্যঃ

প্রসেনজিৎ বসু এটা চেপে যাচ্ছেন যে সিএএ ২০১৯ কাউকেই "অবৈধ অনুপ্রবেশকারী" বা বেনাগরিক বানাচ্ছে না। সিএএ ২০০৩ কোটি কোটি মানুষকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী/বেনাগরিক বানিয়ে দিয়েছে। সিএএ ২০০৩-এর প্রয়োগেই এনআরসি হচ্ছে। একজন মানুষকে যেমন দুইবার খুন করা যায়না, তেমনি দুইবার বেনাগরিকও করা যায়না। 

প্রসেনজিৎ বসু কখনোই জানার চেষ্টা করেননি, নাকি জেনে বুঝে দীর্ঘ ১৭ বছর নাগরিকত্বের নামে মতুয়াদের উপর পুলিশ প্রশাসনের অত্যাচার হয়রানির কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছেন? বিজেপি সিএএ ২০১৯ লাগু করে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। আমরা মনে করি বিজেপি ভাওতা দিয়েছিলো মতুয়াদের, প্রসেনজিৎ বসুও চার নং পয়েন্টে সেই কথা কথাই লিখেছেন। এবার সেই সব মতুয়ারা, যারা বিশ্বাস করে সিএএ ২০১৯ তাদের নাগরিকত্ব দেবে, যদি প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবি তুলে আন্দোলন করে তবে সেটা যে এসেন্সে বিজেপি-বিরোধী আন্দোলন হবে সেটা উপলব্ধির মত জ্ঞান কি বসু বাবুর নেই?

হিন্দু থাকছে মুসলিম থাকছেনা, এসব বলে প্রসেনজিৎ বাবুরা আসলে সমস্যাটাকে সেকুলারিজমের সমস্যা হিসেবে দেখাতে চাইছেন, আসলে এটা মূলত রুটি-রুজির সমস্যা, দাস-শ্রমিক বানাবার চক্রান্ত। শেষমেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত।  সিএএ ২০১৯ আসলে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন থেকে হিন্দুদের দূরে সরাবার একটা ফাঁদ ছাড়া কিছু নয়। 
সমস্ত গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষকে মতুয়াদের নাগরিকত্বের দাবি এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে একসাথে সোচ্চার হতে হবে। নয়তো বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করে এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন সফল করা যাবেন না। এইটুকু বোঝার বুদ্ধি প্রসেনজিৎ বাবুর নেই?  প্রসেনজিৎ বলে রাখি, ২০২১ সালে বিজেপিকে এনে বা না এনে ২০২৬ সালে বা কোনো দিনই আপনারা, অর্থাৎ সিপিএম, ক্ষমতায় আসতে পারবেন না। রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসার জন্য অহেতুক ফাকায় হাত পা না ছুড়ে যে বস্তুবাদীতা এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা প্রয়োজন সেটা আপনাদের নেই।।বিজেপির বেগার শ্রমিক হয়েই রয়ে যেতে হবে।

নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০'র (NEP 2020) বিরুদ্ধে আজ আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ নেই

মঙ্গলবার, আগস্ট ০৪, ২০২০ 0 Comments A+ a-

নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০, NEP 2020

নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ (NEP 2020)  ঘোষণা করল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী'র নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি'র (বিজেপি) সরকার। নয়া শিক্ষানীতিতে স্কুল এবং উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কারমুখী পদ্ধক্ষেপ গ্রহণ করা হলো। শিক্ষা নীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের অধিকার শুধু মাত্র কেন্দ্রের কুক্ষিগত করা হলো।

সরকার এই শিক্ষানীতি কে ছাত্র-ছাত্রীদের সুশিক্ষা ও ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলের কথা বললেও আসলে এই শিক্ষানীতির দ্বারা শিক্ষাক্ষেত্র কে বেসরকারিকরণ ও মুক্ত চিন্তার পরিসর কে শেষ করে যান্ত্রিকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্ত ভোকেশনাল এডুকেশন ও স্কুল স্তরে পাঠ্যসূচি সংক্ষিপ্ত করে মূল ধারনায় নামিয়ে আনার মানে ছাত্র-ছাত্রী দের যন্ত্রে পরিণত করা। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা'র (WTO) শিক্ষানীতি মেনে স্কিলড লেবার বা দক্ষ শ্রমিক  তৈরীর চক্রান্ত ও দেশের হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স কে গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলিতে সস্তায় খাটানোর জন্য স্কিলড লেবার তৈরী করা, এই হলো এই শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচলিত অর্থনৈতিক বৈষম্য কে, সরকারি এবং বেসরকারি নির্বিশেষে সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন রেগুলেশন চালু, আঞ্চলিক ভাষায় অনলাইন কোর্সে জোর ও ই-লাইব্রেরিতে জোর দিয়ে, আরো তীব্র করে তোলা হলো।

শুধুমাত্র পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় জোর দিয়ে সরকার মাতৃভাষায় সকল স্তরে শিক্ষা গ্রহণের ও শিক্ষান্তে কাজের অধিকার ও দাবিকে নাকচ করে দিল। এবং এমফিল তুলে দিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এক বছরের জন্য করে দিয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাকে শেষ করে দিলো। আগেই CBCS সিস্টেম এর মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রকে বেসরকারি কোম্পানির অধীনে নিয়ে চলে এসেছে সরকার।

"এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত" এর আওতায় ৬-৮ ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রজেক্ট এর অপশন দিয়ে আসলে তাদের মধ্যে বিজেপির "এক দেশ, এক আইন, এক ভাষা" এই প্রচার ও শিক্ষাক্ষেত্রে গৌরিকিকরণ এর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সংস্কৃত ভাষা কে প্রায় বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে ঘুরিয়ে অহিন্দিভাষীদের উপর হিন্দি চাপিয়ে দিতে চাইছে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের অভীষ্ট অর্জন করতে।

গরীবের উপর লেখাপড়া করার বোঝা বাড়াতে ১২ বছরের প্রচলিত স্কুল শিক্ষা কে ৫+৩+৩+৪ এর ভিত্তিতে ১৫ বছরের যেমন করে দেওয়া হল তেমনি শিশু শ্রমের বয়েসের সীমারেখা পার করেই যাতে গরীব কিশোরেরা লেখাপড়া ছেড়ে দেয় তার ব্যবস্থা করে রাখলো এই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ চারটি সেমিস্টার। উচ্চমাধ্যমিকে, কলা ও বিজ্ঞানে কোনো ভেদ থাকবে না। স্নাতক স্তরে পুরো কোর্স না করেই পাওয়া যাবে সার্টিফিকেট। এই সবের ফলে গরীবের পড়াশুনো অসমাপ্ত থেকে যাবে। 

এই নীতি অনুযায়ী অধ্যাপকদের বেতন, পেনশন এর দায় নেবে না কেন্দ্রীয় সরকার। 

বিজেপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন মোদী ঘোষণা করেছিলেন যে ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বাৎসরিক দুই কোটি করে চাকরি দেওয়া হবে দশ কোটি বেকার কে, বেকারত্ব দূর করা হবে। তবে দীর্ঘ ছয় বছরে চাকরি তো কেউ পাইনি উপরন্ত বেকরত্বের হার বেড়েছে ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ হারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারি ক্ষেত্রে জায়াগ ফাঁকা থাকলেও সেখানে চাকরির সিট কমিয়ে কর্পোরেট কোম্পানি গুলিকে নিজেদের মাটি শক্ত করতে সাহায্য করেছে বিজেপি সরকার।
 
পরিবেশ-বিরোধী EIA 2020'র মতোই নয়া শিক্ষানীতি প্রয়োগ করে সরকার শিক্ষাকে কর্পোরেটগুলির প্রতিষ্ঠানে পাকাপাকি ভাবে পরিণত করলো। লকডাউনের আড়ালে একের পর এক সরকারের জনবিরোধী ও কর্পোরেট স্বার্থের জন্য আনা আইন গুলি দেখে এটা সুস্পষ্ট ভাবে বোঝা যায় যে এই সরকারের একটিও নীতি ও আইন জনগণের পক্ষে কথা বলেনা। দেশের সমস্ত সম্পদ ও প্রতিষ্ঠান গুলি এই জনবিরোধী আইনের মাধ্যমে ও দেশের মানুষের মধ্যে বৈষম্য  তীব্র করে আসলে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতেই তুলে দিচ্ছে।

নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০'র দ্বারা ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নষ্টের বিরুদ্ধে ও সকল জনবিরোধী কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষা আইনের বিরুদ্ধে আজ আন্দোলনে নামতেই হবে।

উগ্র চীন-বিদ্বেষের স্রোতে ভাসা কি কিছু কমিউনিস্ট নামধারীদের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়?

শনিবার, জুন ২০, ২০২০ 0 Comments A+ a-

শি জিনপিং ও নরেন্দ্র মোদী
ছবি: উইকি মিডিয়া 

ভারত-চীন সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্বের ফলে গোটা ভারত জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ার উঠেছে, যার সাথে সামঞ্জস্য পাওয়া যায় ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময়ের। চূড়ান্ত রকমের উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ঢাকা দেওয়া হচ্ছে আসল ঘটনাগুলো কে, তথ্য কে করা হচ্ছে বিকৃত এবং একটি এমন চিত্র উপস্থাপন করা হচ্ছে যার ফলে মনে হচ্ছে চীন ভারতের মানুষের প্রধান শত্রু এবং চীন-সম্পর্কিত সব কিছু বর্জন করার নামই জাতীয়তাবাদ। যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেলিভিশনে সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সাথে আলোচনার শেষে স্বীকার করে নিয়েছেন যে ভারতের ভূখণ্ডে চীনা গণ মুক্তি ফৌজ অনুপ্রবেশ করেনি, তবুও দেশজুড়ে চীন ও চীনা সামগ্রী বয়কটের নামে এক উগ্র জাতীয়তাবাদের জোয়ার উঠেছে। এই জোয়ারের ফলে মোদী সরকার কে বারবার করে চীনের সাথে যুদ্ধ করার উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।  

ঠিক যেমন ১৯৬২ সালে উত্তর-পূর্ব আসাম ফ্রন্টিয়ার বা নেফায়, যা এখন অরুণাচল প্রদেশ নামে পরিচিত, চীনা গণ মুক্তি ফৌজের হাতে ভারতীয় সেনা পর্যুদস্ত হওয়ায় সারা ভারত জুড়ে কমিউনিস্টদের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনার সাথে কংগ্রেসি গুণ্ডারা লাল ব্লাউজ পরিহিত মহিলাদের উপর ব্লেড চালায়, চিনা বাদামওয়ালা কে বেধড়ক মারধর করে, চীন সংক্রান্ত বই ও তথ্য পুড়িয়ে দেয় আর চীন থেকে সামগ্রী আমদানি করে বিক্রি করা দোকানদারদের উপর হামলা চালায়, তেমনি, বর্তমানে চীনের সামগ্রী ভাঙচুর, আগুন জ্বালানো আর এমন কী চীনা খাবার বিক্রি করা দোকানদারদের উপর হামলা, ইত্যাদি করে ভারতের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ একটি আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে। এবার এই উগ্র জাতীয়তাবাদের ঝাণ্ডা নিয়ে তান্ডব শুধু হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) বা তার সংসদীয় সংগঠন, মোদী’র ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) করছে না, বরং কংগ্রেস পার্টি থেকে শুরু করে সব রঙের সংসদীয় দলগুলোই করছে। আর হাস্যকর ভাবে এই বালখিল্যতায়, মোদী বিরোধিতা করার নামে যোগ দিয়েছে সাবেকি বামপন্থীদের একটা বড় অংশ।  

শুধুই সেদিনের “চীন ভারত কে আক্রমণ করেছে” বলে উগ্র জাতীয়তাবাদের মোড়কে নিজেদের দলীয় পতাকা কে মুড়ে জওহরলাল নেহরুর লেজুড় হওয়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) নয়, সেদিন সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিএমের জন্ম, যে দল এখনো চীন যে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ মনে করে, তাঁরাও উগ্র চীন বিরোধিতার খেলায় শরিক। কিছু সাবেক “নকশালপন্থী” দল, যাঁদের পরিচয় এক কালে ছিল মাওপন্থী হিসাবে আর কিছু বিপ্লবী সাজা ইন্টারনেট-ভিত্তিক “নকশালপন্থী” যাঁরা চীন কে “সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী” বলে আমেরিকার চেয়েও বেশি গালাগাল করে থাকেন, তাঁরাও আজ এই চীন-বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী জিগির তোলা দেখে আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনি। ভারত কেন চীন কে উচিত শিক্ষা দিচ্ছে না, কেন মোদী ভয় পেয়েছে গোছের উদ্ভট বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ঝোলে ডোবানো রুটি চিবিয়ে তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচী সারছেন। গোটা ভারতবর্ষে হাতে গোনা কিছু কমিউনিস্ট নামধারী দল বাদ দিলে, বেশির ভাগের অবস্থানের সাথে কংগ্রেসের অবস্থানের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া দুস্কর।  

চীনে সমাজতন্ত্র আছে না পুঁজিবাদ? চীন কে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী বলা উচিত না সাধারণ পুঁজিবাদী দেশ? শী জিংপিং কে সন্দেহ করা উচিত না খিস্তি দেওয়া উচিত? এই সব বিতর্কের জন্যে আমরা অন্য কোন দিন নির্ধারণ করবো। বর্তমানে প্রশ্ন হলো যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) কি ১৯৬২ থেকে আজ অবধি কখনো সীমান্ত নিয়ে নিজেদের অবস্থান বদলেছে? ভারত কি কোনদিন ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা নির্ধারিত, চীন কে চরম অপমান করে তার থেকে কেড়ে নেওয়া আকসাই চীন ও গ্যালোয়ান নদীর উপত্যকা সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর, সীমারেখা কে “ঐতিহাসিক অন্যায়” বলে স্বীকার করবে?  

উক্ত দুইটি প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক হওয়ার তাৎপর্য খুব গভীর। প্রথমতঃ যেহেতু ভারত আর চীনের সীমান্ত নিয়ে বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি তাই সুস্পষ্ট করে বলা যেতে পারে যে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময়কার দুই দেশের অবস্থান বর্তমানেও বিরাজ করছে। অর্থাৎ যে অবস্থান থেকে সেদিন সিপিএম বা সাবেকি “নকশালপন্থীরা” ভারতের চীন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হন, বর্তমানে সেই রাজনৈতিক অবস্থান ত্যাগ করে তাঁরা উগ্র জাতীয়তাবাদের নামাবলী গায়ে দিয়েছেন নিজেদের ভোটের বাজারে বা চায়ের দোকানের রাজনীতির আড্ডায় একটু প্রাসঙ্গিক করে রাখতে।  

অথচ ১৯৬২ সালে ভারতের সমাজতান্ত্রিক চীন আক্রমণের বিরোধিতা করে, পুলিশের সন্ত্রাস সহ্য করেও কিন্তু সিপিএম ১৯৬৭ তে নির্বাচনে কংগ্রেস কে মাত দিয়েছিল ও পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করেছিল। যদিও তারপরের ইতিহাস অনেক কালিঝুলি মাখা ও সিপিএমের বেইমানির উপাখ্যানে ভরা, তবুও এটা কিন্তু ঘটনা যে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধ করেও রাজনীতির ময়দানে, এমন কী ভোটের বাজারেও, প্রাসঙ্গিকই শুধু না, বরং একটি নির্ণয়কারক শক্তি হিসাবে একটি কমিউনিস্ট পার্টি থাকতে পারে যদি তার মাটির সাথে, শ্রেণীর সাথে আর শ্রেণী সংগ্রামের সাথে নিবিড় সম্পর্ক থাকে। ঠিক যেমন মাও বলেছিলেন “জলের ভিতর মাছের মতন থাকা” তা যদি এই কমিউনিস্টরা অল্প স্বল্প প্রয়োগ করতেন তাহলে নির্লজ্জের মতন বিজেপি আর আরএসএস এর সাথে উগ্র চীন বিরোধিতার প্রতিযোগিতায় নামতে হতো না।  

বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত চীন আক্রমণ করছে না চীন ভারত আক্রমণ করছে এই বিষয় নিয়ে অনেকে কোন ধরণের অনুসন্ধান না করেই বুর্জোয়া কাগজ পড়ে চীন কে আগ্রাসী বলে স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছেন। এই কাজ যে সংসদীয় বামেরা করছে তাই নয় বরং বুকে নকশাল লেবেল আঁটা অনেক বিদ্বজনেরাও করছেন। চীন ভারতের যে এলএসি আছে তার উপর দ্বন্দ্বের মূল কারণ হলো “ম্যাক মাহন লাইন” যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা গায়ের জোরে তৎকালীন দুর্বল রাজতন্ত্রী চীনের উপর সীমানা হিসাবে চাপায়। সেই বেআইনি “ম্যাক মাহন লাইন” কে চীনের সামন্ততন্ত্রী সম্রাটেরাও মানতে পারেননি, তবে ব্রিটিশদের সামনে দুর্বল শক্তি হওয়ায় তাঁরা বিরোধিতা কে তীব্র করতে পারেননি।  

যখন ১৯৪৯ সালে চীন মুক্ত হয় সামন্ততন্ত্র আর আধা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে তখন সিপিসি’র নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন চীনের থেকে যে সমস্ত ভূখণ্ড সাম্রাজ্যবাদীরা চীনের দুর্বলতার ও পরাধীনতার সুযোগ নিয়ে কেড়ে নেয়, তা ফেরত নেওয়ার। তার মধ্যে অন্যতম হয় ফরমোজা দ্বীপ যেখানে চীনের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক চিয়াং কাইশেক পালিয়ে যায় নিজের গো-হারা হারা বাহিনী কে নিয়ে আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কোলে বসে গঠন করে এক প্রতিবিপ্লবী সরকার। সেই ফরমোজা বহুদিন ধরে চীনা প্রজাতন্ত্র হিসাবে পরিচিত হলেও পরে তার নাম হয় তাইওয়ান। আজও চীন কে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ঠিক তেমনি হংকং, ম্যাকাও, প্রভৃতি দ্বীপের উপর চীনের আধিপত্য পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহকেরা বারবার সেখানে প্রতিবিপ্লবী বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছে মাও-পরবর্তী, দেঙ-পন্থী সিপিসি’র নৈতিক ও আদর্শগত দেউলিয়াপনার সুযোগ নিয়ে।   

ভারতের সাথে সীমান্ত নিয়েও চীন বারবার আলোচনা চালিয়েছে এবং ঐতিহাসিক পঞ্চশীল নীতি, যা সমাজতান্ত্রিক বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মাও এর দূরদৃষ্টির এক অনবদ্য অবদান, কে ভিত্তি করে সমস্ত বিরোধ মেটানোর চেষ্টা চালিয়েছে। অথচ ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রতিনিধি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহারলাল নেহরু কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দখলকৃত ভূমি ত্যাগ করতে অস্বীকার করে ও প্রতিক্রিয়াশীল সম্প্রসারণবাদী নীতিতে অনড় থাকে। পরবর্তী কালে, যখন স্তালিন-পরবর্তী সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি’র বেইমান নেতৃত্বের সাথে সিপিসি’র আদর্শগত বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে, তখন চীন কে জব্দ করতে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ নেহরু কে হাত করে ও মার্কিন-সোভিয়েত সমর্থনে বলীয়ান হয়ে নেহরু চীন-বিরোধিতা কে তুঙ্গে তোলে আর “ফরোয়ার্ড প্যাট্রলিং" এর নাম করে ভারতের বাহিনী কে বারবার চীনা সীমান্ত উল্লঙ্ঘন করায় ও চীনের উপর হামলা করে বসে।  

সেই সময়ে চীন ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল আক্রমণ কে শুধু মাত্র ঠেকায়নি, বরং গণ মুক্তি ফৌজ ভারতের সীমানা অতিক্রম করে এগিয়ে এসেও আবার পুনরায় নিজের পুরানো অবস্থানে ফিরে গিয়েছিল। ভারতের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণী যেহেতু জাতিগত ও বর্ণগত শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাস করে তাই সাদা চামড়ার ফৌজ বাদে আর কারুর হাতে পরাস্ত হওয়া তাদের ব্রাক্ষণত্ববাদী শ্রেষ্ঠতন্ত্রের দর্প কে চূর্ণ করে দেয়। চীনের কাছে পরাজয়ের জ্বালা তাই সোভিয়েত-মার্কিন আর ইজরায়েলিদের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করা নেহরু’র সহ্য হয়নি। পক্ষাঘাতে তাঁর মৃত্যু হয় চীনের কাছে হারের কয়েক বছরের মধ্যেই। তবে ভারতের চীন-বিরোধী প্রচার কিন্তু তুঙ্গে থাকে আর কোন সরকারই মাও বেঁচে থাকাকালীন চীনের সাথে সম্পর্ক কে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেনি। ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টির সরকার তৈরি হওয়ার পরে দেঙ-পন্থী নেতৃত্বের সাথে ভাব জমাতে যদিও তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী ও আরএসএস কর্মী অটল বিহারি বাজপেয়ী চীন যান, তবে সম্পর্কের বরফ গলতে অনেক সময় লাগে।  

চীনা নেতৃত্ব যদিও চিরকাল পঞ্চশীলের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান চেয়ে এসেছে, কিন্তু ভারতের আগ্রাসী ভূমিকা বারবার সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। যদিও ১৯৯৬ সালের আর ২০০৫ সালের দুটি চুক্তির পরে চীন সীমান্তে ভারত ও চীনা সৈন্যরা কোন ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে, তবুও এই সীমান্তে ভারতের শাসক শ্রেণী নিজের সেনা জমায়েত করে, সামরিক পরিকাঠামো গড়ে তুলে, চীন নিয়ে গণ মাধ্যম কে ব্যবহার করে ভীতি সঞ্চার করে ও মনমোহন সিংহ এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের সময় থেকেই “ফরোয়ার্ড প্যাট্রলিং” এর পদ্ধতি পুনরায় গ্রহণ করে বারবার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই পরিকাঠামো গড়ার মূল কারণ হলো ভারতের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-নেতৃত্বাধীন চীন-বিরোধী জোট, যার পোশাকি নাম ইন্দো-প্যাসিফিক এলায়েন্স, এর একটি মুখ্য সদস্য হওয়া। এই দলে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদীরা আছে এবং এদের লক্ষ্য হল চীন কে সামরিক ভাবে ঘিরে ফেলা।  

ভারতের সংবাদ মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে চীন-বিরোধী উস্কানিমূলক কথা বার্তা বলে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হচ্ছে জনমানসে। চীন-বিরোধী এই উগ্র জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলার কারণ হলো ইন্দো-প্যাসিফিক এলায়েন্স ও কোয়াড কে জনমানসে ন্যায়সঙ্গত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা ও একটি দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ভারত কে চীন-বিরোধী যুদ্ধের জন্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঘাঁটিতে পরিণত করা। ভারতের মানুষ যাতে ভারতের বুকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির বিরোধিতা না করেন, চীন-বিরোধী যুদ্ধে ভারতের গরীবদের কামানের খোরাক বানানোর বিরোধিতা না করেন, তাই এই উগ্র চীন-বিরোধী জাতীয়তাবাদের জিগির বারবার তোলা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হতেও থাকবে।  

বর্তমানে পূর্ব লাদাখে ভারতীয় বাহিনী আর চীনা গণ মুক্তি ফৌজের মধ্যে যে সংঘাত হয়েছে তার কারণ কিন্তু লুকিয়ে আছে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চীন-বিরোধী আস্ফালনে। চীনের সাথে “বাণিজ্য যুদ্ধ” যখন থেকে ট্রাম্প শুরু করেছে তখন থেকে ভারতে বিজেপি চীন-বিরোধী প্রচার তুঙ্গে তুলেছে ও চেষ্টা করেছে ভারত কে বিদেশী পুঁজির কাছে চীনের বিকল্প একটি সস্তা রসদ, সম্পদ ও শ্রমের দেশ হিসাবে তুলে ধরে নিলাম করতে। চীনের নামে কোভিড-১৯ অতিমারী ছড়ানোর অভিযোগ কে ভারত সরকার বেসরকারি ভাবে, ভারতের শাসক শ্রেণীর মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা ন্যায্য প্রতিপন্ন করে।  চীন-বিরোধী উগ্র প্রচারের মধ্যেই মোদী কিন্তু  “আত্মনির্ভর ভারত” অভিযানের নামে দেশ কে সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশে বাঁধার কর্মসূচী নিয়েছেন। চীন-বিরোধী যুদ্ধের জিগির ওঠার আগে থেকেই কোভিড-১৯, “আত্মনির্ভর ভারত” ও নানা অজুহাতে চীনের পণ্য বয়কটের রাজনীতি ভারতে তীব্র হয়েছে। আর এর পিছনে ট্রাম্পের অবদান কম না।  

ট্রাম্পের ভারত ভ্রমণের সময়ে যখন দিল্লী শহরে মুসলিম-নিধন যজ্ঞ চলছিল, ঠিক তখন মুখোমুখি বৈঠকে ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা ট্রাম্পকে জানান যে তাঁরা চীনা প্রযুক্তি ও আমদানি কম করার পক্ষে। মোদী সরকারের প্রাণপুরুষ রিলায়েন্স কোম্পানির মালিক মুকেশ আম্বানি তো ট্রাম্প কে দেখিয়েও দেন যে তাঁর জিও কোম্পানির ৫জি প্রযুক্তিতে কোন চীনা উপকরণ ব্যবহার হয়নি। ট্রাম্প সাহেব খুশি হন ও চীন-বিরোধী জিগির তীব্র করার আদেশ দিয়ে, ভারতে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে, মার্কিন মুলুকে ফিরে যান। বেশ কিছু সময় বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানুষের ভয়ে গর্তে সেঁধিয়ে থেকে বর্তমানে সেখান থেকে বেরিয়েই আবার চীন-বিরোধী উস্কানি মূলক ও বিদ্বেষের বাণী নিঃসৃত করা শুরু করেছেন তিনি, যা মোদী ও ভারতের শাসকশ্রেণী মন দিয়ে শ্রবণ করছে।  

বর্তমানে চীন-বিরোধী লড়াই ভারত একা করতে পারবে না কারণ চীন পাকিস্তান নয়। আর চীনের সাথে যেহেতু রাশিয়ার সম্পর্ক খুব মধুর এবং দুই দেশ মিলে বিশ্বে মার্কিন সাম্রাজ্যের বিস্তারের পথে বারবার বাঁধা দিচ্ছে, তাই ভারতের পক্ষে হঠাৎ করে রাশিয়া কে ক্ষেপানো সম্ভব হবে না। উল্টো দিকে চীনের ভারতে ব্যবসায়িক স্বার্থ যেমন জড়িয়ে তেমনি রাশিয়ারও। তাই শি আর ভ্লাদিমির পুতিন দুই জনই কিন্তু কোন ভাবে ভারত কে চটাতে চাননা। তাই চীনা গণমাধ্যমে ভারতের সাথে সীমান্ত সংঘাত কে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। চীনা উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার না করে সিপিসি নেতৃত্ব বারবার শান্তিপূর্ণ ভাবে ভারতের সাথে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করার বার্তা দিতে থাকে এবং সীমান্তে উত্তেজনা কমানোর উপর জোর দেয়। রেনমিন রিবাও বা পিপল'স ডেলি ও গ্লোবাল টাইমস - এর মতন সিপিসি’র মুখপত্রগুলো কিন্তু ভারতের বিজেপি-পন্থী ও বিজেপি-বিরোধী মূলধারার সংবাদপত্রগুলোর মতন যুদ্ধ ও হিংসার জিগির তোলেনি। চীনা টেলিভিশন উপস্থাপকরা সামরিক পোশাক পড়ে দর্শকদের মধ্যে প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে বিদ্বেষ উস্কে দিতে আসেনি।  বরং বারবার করে তাঁরা ভারত কে ও মোদী সরকার কে আবেদন করেন শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে।  

মোদী হঠাৎ যে শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন প্রতিনিধি রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে চীন নিয়ে বিবৃতি দিলেন, এটা কিন্তু শুধু চীনের চাপে না বা ভারতের শান্তির প্রতি আকঙ্ক্ষা থেকে না। মোদী চেয়েছিলেন চীন সীমান্তে উত্তেজনা টিকিয়ে রেখে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে ও তার সাথে কোভিড-১৯ প্রকোপের ফলে ভারতের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে বীভৎস, জীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা জনসমক্ষে বেরিয়ে এসেছে, সরকারের ব্যর্থতা ও অন্যায়গুলো যে ভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তা ঢেকে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে। তবে আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের নতুন উত্থান নিয়ে ব্যস্ত চীন যে ভারতের উস্কানির আর মোদীর রাজনৈতিক অভিলাষায় অচিরেই জল ঢেলে দিতে পারে সে কথা নয়া দিল্লী ও ভারতের শাসক শ্রেণী কিন্তু আন্দাজ করতে পারেনি।  

এটা ঘটনা যে ভারতের একার শক্তিতে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব না। যখন নেহরু ১৯৬২ সালে চীন-বিরোধী যুদ্ধ শুরু করেন, তখন তাঁর সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদী সোভিয়েত নেতৃত্ব ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল জায়নবাদী ইজরায়েল। বর্তমান বিশ্বের ভৌগলিক রাজনীতির সমীকরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসার ফলে ভারত এখন মার্কিন দিকে ঝুঁকে আছে, ইজরায়েলের সাথে মোদী নিবিড় ভাবে ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক কে বেঁধেছেন, আর অন্যদিকে চীন রাশিয়া, ইরান, ভেনেজুয়েলা, প্রভৃতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী  আধিপত্য-বিরোধী দেশের সাথে হাত মিলিয়ে একটি নতুন সমীকরণ তৈরি করছে। যদি ভারত বর্তমানে চীন আক্রমণ করতে চায় তবে রাজনৈতিক ভাবে দুর্বল ও অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু শুকনো সমর্থন করতে পারবে আর অস্ত্র ব্যবসায়ী ইজরায়েল কোটি কোটি ডলার মুনাফা করবে। ফলে সেই যুদ্ধে চীনের লাভ বেশি আর ভারতের কম। ভারতের মধ্যবিত্তদের বাদ দিলে বিশ্বের আর কোন দেশে এই রকম অর্বাচীন ভাবে যুদ্ধের নাম নিয়ে মানুষ ক্ষেপানো সম্ভব না। ব্রাক্ষণত্ববাদী ভারতের উচ্চ জাতির ধনী ও মধ্যবিত্তরা যুদ্ধের উপাসক কারণ যুদ্ধে তাঁদের বাড়ির লোকের প্রাণ যেমন যাবে না তেমনি তাঁদের আর্থিক স্বার্থ সিদ্ধিও হবে।  

মোদী ও বিজেপি-আরএসএস যেহেতু এই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের স্বার্থ রক্ষাকারী রাজনৈতিক শক্তি তাই নানা কায়দায় যুদ্ধের আর উগ্র দেশপ্রেমের জিগির তুলে রাজনীতির ময়দান গরম করার চেষ্টা এরা চালিয়ে যাবেই। দেশের আর্থিক সংকট, কর্মহীনতা, মূল্যবৃদ্ধি, দেশের সম্পদ বিদেশী পুঁজির কাছে বিক্রি করে দেওয়া, প্রভৃতির থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে মোদী সরকার ও আরএসএস এর যেমন যুদ্ধ প্রয়োজন ঠিক তেমনি দেশের আপামর শ্রমিক ও কৃষকের কাছে এহেন যুদ্ধ হল একটা অভিশাপ, কারণ তার ফলেই তাঁদের কাঁধে চাপবে দেশপ্রেমের নাম চড়া করের বোঝা, সৃষ্টি হবে কৃত্রিম খাদ্য সঙ্কটের আর চরম ভাবে বৃদ্ধি পাবে কালোবাজারি। তাই দেশের শ্রমজীবী মানুষ কে অবশ্যই যুদ্ধের বিরোধিতা করতে হবে। কমিউনিস্ট নামধারী শক্তিগুলো যদি এই সোজা হিসাব গুলিয়ে দিয়ে ভারতের শাসকশ্রেণীর চোঙা ফুঁকে মানুষ কে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা চালান, মোদী কেন চীনাদের হাতে নিহত ভারতীয় সেনাদের বদলা নিচ্ছে না গোছের অভিযোগ তুলে ন্যাকামো করেন, ও বিজেপি-কংগ্রেসের সাথে দেশপ্রেম দেখাবার বা চীন-বিরোধিতা দেখাবার প্রতিযোগিতায় নামেন তাহলে বুঝতে হবে কাউটস্কি’র নেতৃত্বাধীন উগ্র-দেশপ্রেমের জোয়ারে গা-ভাসানো দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের বেইমান পীত সমাজতন্ত্রীদের তালিকায় নাম তুলেছেন এই সব বিপ্লবী সাজা বাঘা বাঘা সংগঠকেরা। এদের থেকে ভারতের শ্রমজীবী মানুষদের শত যোজন দূরে রাখতে হবে।  

করোনা ভাইরাসের সময়ে ঐতিহাসিক ২৫শে মে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের ৫৩তম বার্ষিকী পালন

সোমবার, মে ২৫, ২০২০ 0 Comments A+ a-

ঐতিহাসিক ২৫শে মে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ

বর্তমানে ঐতিহাসিক ২৫শে মে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের ৫৩তম বার্ষিকী এমন একটা সময়ে পালন হচ্ছে, যে সময়ে বিশ্বের বুকে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি আর্থিক সঙ্কটের পাঁকে পড়ে নিজের ব্যর্থতার, নিজের কুকর্মের ফলে সৃষ্ট মন্দার দায় করোনা ভাইরাসের মতন একটি জীবাণু-বাহিত ছয় মাস পুরানো রোগের উপর চাপিয়ে দিয়ে সেই অজুহাতে শ্রমজীবী মানুষের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। শ্রমিকশ্রেণীর বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অধিকারগুলো কেড়ে নিতে চাইছে। এই সময়ে আমাদের গতানুগতিক তাত্ত্বিক বাগড়ম্বরতা বাদ দিয়ে, পুরানো কাসুন্দি না ঘেটে, দেখা দরকার যে এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের রাজনীতির আলোকে আন্তর্জাতিক বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির এবং তাদের দেশীয় দালাল মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের দ্বারা সাধারণ মানুষ কে নিজেদের শোষণের জাঁতাকলে পিষে, তাঁদের রক্ত চুষে, এই সঙ্কট থেকে পরিত্রান পাওয়ার অপচেষ্টা কে রোখা যায় ও শ্রমজীবী মানুষ কে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের বৃহৎ রণক্ষেত্রে আনা যায়। 


ভারতের আর্থিক সঙ্কট বিশ্বের বাজারে চলমান বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সঙ্কটেরই একটা পরিণাম বা প্রতিবিম্ব। যেহেতু ১৯৭০ এর থেকেই পুঁজির উপর মুনাফার হার কমছে এবং নানা ধরণের শিল্পের বৃদ্ধি নিম্নগামী হয়ে যায়, যেহেতু লগ্নি পুঁজি নিজের চরিত্র অনুসারে চরম মুনাফার খোঁজে উৎপাদন প্রক্রিয়ার থেকে বেরিয়ে ফাটকা খেলে অনুৎপাদক পুঁজির পাহাড় সৃষ্টি করা শুরু করে এবং অর্থ দিয়ে আরও অর্থ তৈরি করে সমাজে চরম বৈষম্যের সৃষ্টি করে, তার ফলে বার বার এই ফাটকা খেলার বুদবুদ ফেটে যাওয়ায় সঙ্কট আরও গভীর হয় বারবার। এই ফাটকা খেলা, এই কাল্পনিক পুঁজির উদ্ভব ও গায়েব হওয়া এবং গোটা বিশ্বে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সঙ্কটের থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্যে লগ্নি ও স্থায়ী খরচ কমানো ছাড়া গতি নেই। আর এই খরচ কমানো যেতে পারে জমি, শ্রম ও কাঁচামাল হয় আরও সস্তা করে দিয়ে বা একেবারে বিনামূল্যে যদি তা সরকার বৃহৎ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেয়। আর শুধু তাই না, বৃহৎ কর্পোরেটদের আজ চাই পুঁজির যোগানও, যে পুঁজি যদিও তারা বৃহৎ ব্যাঙ্কগুলোর থেকে, বিশেষ করে ভারতের মতন দেশের সরকারি মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলোর থেকে ঋণ হিসাবে অল্প সুদে জুটিয়ে নেবে, কিন্তু ফেরত দেবে না। এর ফলে ব্যাঙ্কে লগ্নিকারী পুঁজির মালিকেরা সঙ্কটে পড়বে আর সবচেয়ে বেশি সঙ্কটগ্রস্ত হবেন দেশের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীরা। 


আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার এই সস্তা জমি আর কাঁচামাল তুলে দিতে দেশের সমস্ত ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজির ও বিদেশী পুঁজির আনাগোনা অবাধ করে দিয়েছে। ঋণের সুযোগ করে দিয়েছে ব্যাঙ্কগুলোর থেকে আর চরম মন্দার মধ্যেও মানুষের হাতে টাকার যোগান বাড়িয়ে অর্থনীতিতে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বৃদ্ধি না করে, মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ না তৈরি করে বরং একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিশেষ করে শ্রম আইন সংশোধন করে, শ্রমিকশ্রেণীর বহু সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত অধিকারগুলো কেড়ে নিয়ে, আর জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) বানিয়ে কোটি কোটি গরিব মানুষ কে, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সস্তা শ্রমিক বানাবার পথ প্রশস্ত করেছে। 


পুঁজির সঙ্কটের কারণে ভারতের অর্থনীতি গড্ডালিকায় পড়ে সেই ২০১১-১২ সাল নাগাদ আর তারপরে কোনদিনই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বরং ডিসেম্বর ২০১৯ এ শেষ হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ৪.৭% এ এসে পড়ে। জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২০ বা চতুর্থ ত্রৈমাসিকের সঠিক হিসাব এখনো এসে পৌঁছায়নি তবে এই ভাবে আর্থিক বৃদ্ধির হার পড়তে থাকায় অর্থনীতিবিদদের একাংশের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েও মোদী সরকার কিন্তু সেই অর্থবছর ২০১৭-১৮ থেকেই আর্থিক মন্দার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে এসেছে।


দেশের লোক সিনেমা দেখছে বলে দেশে আর্থিক মন্দা নেই বা গাড়ি শিল্পে চাহিদা পড়ে গেছে মানুষ বেশি ট্যাক্সি চড়ছে বলে বা পকৌড়া বিক্রি করাও একধরণের কর্মসংস্থান, ইত্যাদি কথা বলে আসল আর্থিক ইস্যু কে বারবার চাপা দিলেও, মার্চের মাঝামাঝি এসে তা সম্ভব না হওয়ায়, আমেরিকা সহ পশ্চিমী অর্থনীতিগুলোর মতন সব দোষ নন্দ ঘোষ বলে করোনা ভাইরাস কে দোষ দিয়েছে মোদী সরকার। করোনা ভাইরাসের ফলে মধ্যবিত্তদের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্ক কে হাতিয়ার করে নিজের পুরানো অভিলাষ চরিতার্থ করা শুরু করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জনবিরোধী আইনগুলো কে করোনা ভাইরাসের প্রকোপের সাথে লড়ার উপকরণ হিসাবে দেখিয়ে। 


এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, যখন লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে ভারতের এক রাজ্যের থেকে অন্য রাজ্যে প্রায় কয়েকশ বা কয়েক হাজার কিলোমিটার হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে বা ট্রাকে লুকিয়ে যেতে হচ্ছে, যখন দেশের শ্রমজীবী মানুষ পথ দুর্ঘটনায় রাস্তার পশুর মতন প্রাণ হারাচ্ছেন, যখন গর্ভবতী মহিলা কে ৫০০ কিলোমিটার হেঁটে যেতে হচ্ছে, ছোট শিশুদের কাঁধে চাপিয়ে প্রখর রৌদ্রে শ্রমিকেরা গ্রামের পানে যাচ্ছেন, আর সরকার তাঁদের পরিবহন দেওয়া তো দূরের কথা, দেখা মাত্রই অমানবিক ভাবে অত্যাচার করছে, তাঁদের উপর নানা ধরণের কেমিক্যাল স্প্রে করে তাঁদের জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে আর যেনতেন প্রকারে চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে শ্রমিকেরা মালিকদের জন্যে সমস্যা সৃষ্টি করে নিজেদের কর্মস্থল থেকে না চলে যান, সেই সময়ে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের শিক্ষা আমাদের বলে যে এই শ্রমিকদের লাঞ্ছনা, এদের বেদনা ও চরম হতাশার মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে আছে আগামী কে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা ও সেই ক্ষমতা কে ইন্ধন যোগান দেওয়ার মতন ক্ষোভ। 


ভারতের শাসকশ্রেণী যে এই শ্রমজীবী মানুষ কে কীটপতঙ্গের চেয়ে বেশি কিছু ভাবে না তা বারবার দেখা গেল বিজেপি’র নানা ধরণের শ্রমিক-বিরোধী ও ধনী-বান্ধব প্রকল্পে। ধনী আর মধ্যবিত্তরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাটি বাজালেন, প্রদীপ জ্বালালেন আর অন্যদিকে সেই বারান্দার নিচ দিয়ে, নিজেদের হাতে বানানো অট্টালিকাগুলো কে তীব্র ঘৃণা ভরা নজরে দেখে, তপ্ত রাজপথে ছেঁড়া চটি পড়ে এগিয়ে চললেন শ্রমিকেরা। এই দেশের বুকে যখন প্রধানমন্ত্রী টিভিতে মধ্যবিত্ত কে ভারতবর্ষ কে বিদেশী পুঁজি কে বিক্রি করে দিয়ে “আত্মনির্ভর” বানাবার সোনার পাথরবাটি বিক্রি করছেন, তখন কিন্তু হাজার মাইল নিজের বাবা কে সাইকেলের কেরিয়ারে বসে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে কিশোরী মেয়ে প্রমাণ করছে আত্মনির্ভরতা একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের শ্রমজীবী মানুষের জন্যে কত জরুরী। এই সঙ্কটের সময়ে যেমন পুঁজি চেষ্টা করছে গ্রামাঞ্চলের সামন্তশ্রেণীগুলোর সাথে মিলে একটি বৃহৎ জাঁতাকলে কৃষক ও শ্রমিকদের পিষবার, তখনই তাঁর উপর অত্যাচার ও তাঁর লাঞ্ছনার কথা নিজের গ্রামে গিয়ে শোনাচ্ছেন শ্রমিকেরা। আর এর ফলে ক্ষোভের আগুন প্রশমিত হচ্ছে না, ক্ষোভ নিভে যাচ্ছে না, বরং ধিকিধিকি করে জ্বলছে। 


এরই মধ্যে আম্ফান ঘূর্ণি ঝড়ে যাঁরা সর্বস্বান্ত হলেন তাঁদের মাথার উপর কিন্তু এনআরসি’র ঘন কালো মেঘ। তাঁদের বাড়ি ঘর, গরু ছাগলের সাথে তাঁদের পরিচয়ের কাগজী টুকরোও ভেসে গেছে। তাঁদের কাঁচা বাড়ির দেওয়ালের সাথে তাঁদের নাগরিকত্বের শেষ নিশানীও ধ্বসে গেছে। ঝড়ের পরে পুনর্গঠনের মাঝেই আবার হিন্দুত্ববাদী বর্গী সেনা এনআরসি দিয়ে হতদরিদ্র বাঙালি নমঃশূদ্র, আদিবাসী ও মুসলিম মানুষের থেকে শ্রমের মূল্যের দর কষাকষির ক্ষমতা কেড়ে নেবে। নিংড়ে তাঁদের রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে আম্বানি আর আদানীদের সিন্দুকে মোহর ভরবে।


এই পরিস্থিতিতে শাসকশ্রেণী কে আটকাতে ও পরাস্ত করতে পারে নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের চেতনা। নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষের কৃষকদের প্রথম রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্যে সংগ্রাম। পরবর্তীকালে এই সংগ্রাম উন্নত হলেও নকশালবাড়ি এক চিরন্তন সূর্যের মতন জ্বলজ্বল করে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষ কে আশার বাণী শুনিয়েছে। তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছে প্রতি পদে। আজ যখন শাসকশ্রেণী, আন্তর্জাতিক বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি, তাদের তাঁবেদার দেশীয় মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ চরম সঙ্কটে নিম্মজিত ও এর থেকে পরিত্রাণ পেতে শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে আরও ভারী শোষণের বোঝা চাপাতে চাইছে তখন দেশের শ্রমজীবী মানুষ কে রাজনৈতিক ভাবে জাগিয়ে তোলার ও নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ ও তার শিক্ষার আলোকে সুসজ্জিত করার এর চেয়ে বেশি ভাল পরিস্থিতি কিন্তু আর হবে না। 


বর্তমানে যদি নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষেরা এবং সংগঠনগুলো নিজেদের বৈরিতা ও সংকীর্ণতার গণ্ডি পার হয়ে এই করোনা ভাইরাসের আড়ালে ভারতের শাসকশ্রেণীর দ্বারা শ্রমজীবী মানুষের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষদের নিয়ে নিজেদের সাধ্য অনুসারে এবং সৎ প্রচেষ্টা দ্বারা জোট বাঁধতে পারেন, সমন্বয় করে যৌথ ও সংহতিমূলক সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেন তবে বিগত ৫৩ বছরে বারবার ধাক্কা খাওয়ার, বারবার পিছিয়ে পড়ার ও একে অপরকে ল্যাং মারার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে একটি নতুন সূচনা হতে পারে। চারু মজুমদার নকশালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহ ও তারপরে শ্রীকাকুলামের বিদ্রোহের জন্মদাতা। তিনি বলেছিলেন নকশালবাড়ি মরেনি আর মরবে না কোনদিন। তার বক্তব্য এই ৫৩ বছরে শুধু সঠিকই প্রতিপন্ন হয়েছে। তবে নকশালবাড়ি বেঁচে থাকবে ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ তার প্রয়োগ হচ্ছে।


যতক্ষণ নকশালবাড়ি’র রাজনীতি দেশের শ্রমিক আর কৃষকের মধ্যে প্রবেশ করবে ততক্ষণ নকশালবাড়ি বেঁচে থাকবে। চারু মজুমদারের রাজনীতি দিয়ে করোনা ভাইরাসের নামে চালিত শাসকশ্রেণীর আক্রমণ কে প্রতিহত করা, প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত করাই নয়, বর্তমান পরিস্থিতি দাবি করছে এই রাজনীতি দিয়ে মানুষ কে সচেতন করে দেশের সমস্ত এনআরসি-বিরোধী আন্দোলন কে শ্রমজীবী মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে পরিণত করা। যদি ৫৩তম নকশালবাড়ি দিবসের কোন ডাক থাকে তাহলে তা এর চেয়ে আলাদা কিছু হতে পারে না। 


প্রসঙ্গ: লক ডাউনের ত্রাণ রাজনীতি বনাম বামপন্থী খাদ্য আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি

শনিবার, মে ১৬, ২০২০ 0 Comments A+ a-

বামপন্থী খাদ্য আন্দোলনের পুনরাবৃত্তি
Add caption

প্রবাদে বলে একই নদীতে দুইবার স্নান করা যায় না। কোনো কিছুই আগের মতন হয় না। যেমন ৭৬’র মন্বন্তর আর ৪৩’র মন্বন্তর এক নয়, ৫৯’র খাদ্য সঙ্কটের সাথেও ৬৬ সালের খাদ্য সঙ্কটের বিস্তর ফারাক আছে। সুতরাং ২০২০ সালের খাদ্য সংকট মোকাবিলার আন্দোলন  আগের খাদ্য আন্দোলনের মতন হবে না সেটা আবিষ্কার করতে অতিরিক্ত বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন নেই। সবুজ বিপ্লবের পর খাদ্য উৎপাদন অনেক বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সাথে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন সংকট। কৃষক ফসলের দাম পাননা। এই সঙ্কটের প্রতিফলন আমরা দেখি কৃষক আত্মহত্যায়, খালি পায়ে কৃষক লং মার্চে বা কৃষী বিপ্লবী আন্দোলনে।

পুঁজি’র রাজত্বে সম্পদের অভাব হয় না।পুঁজির আমলে সম্পদের বা খাদ্য সম্পদের অভাব থাকে না, সমস্যা হয় এর বন্টনে। গুদামে খাবার পঁচে কিন্তু তবুও মানুষ অনাহারে থাকে, কারণ মানুষের হাতে টাকা নামক কাগুজে অর্থ পর্যাপ্ত  পরিমাণে থাকে না, সমস্যাটা বন্টন ব্যবস্থায়, এটাই তো মার্কসবাদের প্রাথমিক “অ, আ, ক, খ” শিক্ষা! এর সাথে ভারতের মতন একটি আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশের আঞ্চলিক ক্ষমতাবানদের দাপট পুষ্ট দূর্নীতি গরিব শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনাকে অন্যমাত্রা দেয়। সঙ্কটের সময় এই সমস্ত আঞ্চলিক ক্ষমতাবানদের লোভি জিভ যে হাঁটুর নিচে নেমে আসে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  সুতরাং বাজারে খাদ্য শস্যের অভাবে ত্রাণ শিবির বন্ধ হচ্ছে না, এই  পর্যবেক্ষণের ফলে যিনি সিদ্ধান্তে পৌছাবেন যে দেশে কোনো খাদ্য সঙ্কট নেই, তিনি টাইম মেশিনে চড়ে মার্কস পূর্ববর্তি সময়ে বসে ভাবনা চিন্তা করছেন হয়তো!

১৯৪৩ এর মন্বন্তরে বাংলা প্রভিন্সে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ৩০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষকে অনাহারে রেখে হত্যা করে। তবুও কিন্তু তখন ব্যাপকভাবে খাদ্য লুটপাট বা খাদ্য দাঙ্গা হয়নি। আবার ২০০৭ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গে রেশন দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লো, তখন ব্যাপক ভাবে মানুষ অনাহারে ছিল ব্যাপারটা কিন্তু এই রকম নয়। জমি অধিগ্রহণ-বিরোধী কৃষক আন্দোলন গরিব মানুষকে অধিকার অর্জনের উৎসাহ জুগিয়েছিলো। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের হিসাব অনুযায়ী ভারতে বেকারত্বের হার ৭.৮%। অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই পরিমাণ বেকারত্ব বিগত শতাব্দীর সাতের দশকে দেখা গিয়েছিল। সেই সময় কিন্তু ব্যাপক যুব বিদ্রোহ দেখা গিয়েছিল। ফেব্রুয়ারী মাস অবধি কিন্তু সাতের দশকের ধারে কাছের যুব বিদ্রোহ দেখা যায়নি। ১২ মে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি'র তথ্য অনুযায়ী ভারতে বেকারত্বের হার বর্তমানে ২৪.৩%। এখনো কিন্তু কোনো যুব বিদ্রোহ দেখা যাচ্ছে না। তার মানে কি এই যে বেকারত্বের সমস্যা নেই দেশে?

সুতরাং যারা স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের সংখ্যা দিয়ে সমস্যা মাপার চেষ্টা করছেন তাঁরা ইতিহাস বোধের দফা রফা করছেন যে শুধু তাই নয়, বাইরে থেকে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে চেতনা নিয়ে যাওয়ার বা সচেতন উদ্যোগের লেনিনের তত্ত্বের  বিরুদ্ধে আর একটি তত্ত্ব হাজির করছেন। এই যুক্তি অনুযায়ী ভারতে শ্রমিকরা সুখে আছে, কারণ লকডাউনের আগে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভের কর্মসূচী দেখা যায়নি। যদিও এই সমস্ত যুক্তি কাঠামো নতুন কিছু নয়। বিপ্লবী আন্দোলন কে নাকচ করার জন্য এই ধরনের যুক্তি বাম আন্দোলনে অনেকবার এসেছে, এখনো আসে। মজার বিষয় হল ত্রাণ কর্মসূচীকে সমর্থন করতে গিয়ে বিপ্লবী শিবিরের কেউ কেউ এমনই ভারত সেবাশ্রম মোডে পৌছে গেছেন যে এত দিন যে যুক্তিগুলোর বিরোধিতা করে এসেছেন বর্তমানে সেই যুক্তিগুলোকেই খড়কুটোর মতন আঁকড়ে ধরছেন।

ঔপনিবেশিক শাসনকালের ১৯৪৩ এর মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্পে যোগী ডাকাত গরিব বুভুক্ষু মানুষের কাছে গিয়ে বিভিন্ন  কর্মসূচী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে বোঝার চেষ্টা চালিয়েছিল যে তাঁরা ছিনিয়ে নিয়ে খাচ্ছেন না কেন? আজ কিছু বাম লেখক বাড়িতে বসে বা ত্রাণ বিলিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন যে  যেহেতু জনগণ খাদ্য ছিনিয়ে খাচ্ছেন না  তাই সব ঠিকঠাকই আছে নিশ্চয়!

কিন্তু সত্যিই কি রেশন নিয়ে বিক্ষোভ অতি নগন্য? প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই কোথাও না কোথাও স্বতঃস্ফূর্ত রেশন বিক্ষোভের খবর আসছে, উৎসাহী পাঠক "রেশন ক্ষোভ" লিখে গুগুল করে নিতে পারেন। সমস্ত ঘটনার উল্লেখ করে বর্তমান লেখাটি ভারাক্রান্ত করবো না। শুধু কয়েকটি উদাহরণ দেব। ১লা মে ২০২০ হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা লিখেছে "রেশনে সরকার নির্ধারিত পরিমাণে খাদ্যশস্য দিতে হলে ব্যাবসা তুলে দিতে হবে। কারণ, জেলা থেকে কলকাতা পর্যন্ত চলছে বখরা। শুক্রবার এমনই চাঞ্চল্যকর দাবি করলেন বীরভূমের লাভপুরের এক রেশন ডিলার। এদিন রেশনে কম সামগ্রী মিলছে বলে অভিযোগ করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন স্থানীয়রা। কমবেশি একই ছবি দেখা গিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের নারায়ণপুর, মুর্শিদাবাদের জলঙ্গীতেও"

গত ১১ই মে জি ২৪ঘন্টা রাজ্য সরকারের রিপোর্ট উল্লেখ করে বলেছে "১ মে থেকে ১০ মে পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে ৪৪৫ জন রেশন ডিলারকে। সাসপেন্ড করা হয়েছে ৬৯ জনকে। পেনাল্টি হয়েছে ২৯ জনের। আইনি ব‍্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৫১ জনের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৩ জন ডিলারকে। ডিলার ছাড়াও রেশন দুর্নীতিতে যুক্ত ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে এক জনকে। মোট ৬৩৮ জনের বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা নেওয়া হয়েছে"।

বলাবাহুল্য এই সবই হয়েছে গণ অসন্তোষের চাপে। বামপন্থীরা যখন ত্রাণ বিলোচ্ছে তখন নেতাদের অপেক্ষা না করেই শাসকদলের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে খেটে খাওয়া মানুষ বিক্ষোভে নেমেছেন। করোনা ভাইরাস আর স্যোশাল ডিসটেন্সিং নিয়ে বাম নেতারা ব্যতিব্যস্ত থাকতে পারেন, গরিব মানুষ কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করেই পথে নামছেন। যখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ৮ মে তাড়াতাড়ি ভিডিও কনফারেন্স ডেকে তৃণমূলের জেলা সভাপতিদের রেশন দুর্নীতি নিয়ে শাসাতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন কোনো র‍্যাডিক্যাল বাম লেখক যদি রেশন ক্ষোভ কে নগন্য বলেন এবং রেশন বন্টনে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে থাকেন, তবে তাকে দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! অবশ্য যিনি ইতালিতে কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকটি উৎসাহ ব্যঞ্জক কর্মসূচীকে "শ্রেণী সংগ্রামের সংক্রমণ" বলে উল্লেখ করতে পারেন, তিনি কী ভাবে বাংলার লাগাতার রেশন ক্ষোভকে নগন্য বলতে পারেন সেই রহস্যের সমাধান করে দিয়েছেন কবি সৃজন সেন। কবি লিখেছিলেন "মনসার পূজা ঢের বেশী ভালো, কে চাহে পূজিতে জ্যান্ত সাপ!"

সাধারণ ভাবেই আমাদের দেশে মানুষ পুরো রেশন পাননা। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। লকডাউনের মধ্যেও রেশন দুর্নীতি চলেছে। কোথাও কোথাও জনতার চাপে পড়ে দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে। লকডাউনের ফলে কর্মহীনতা গরিবকে আরো বেশী রেশনকে আকড়ে ধরতে বাধ্য করেছে। সাম্রাজ্যবাদের প্রেসক্রিপশন মেনে অটল বিহারি বাজপেয়ী’র-নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি’র (বিজেপি) সরকার দারিদ্র্য সীমার নিচে ও উপরে হিসাবে (APL-BPL) ভাগ করে ধীরে ধীরে গণবন্টন ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে এসেছে। অন্য দিকে গণবন্টন ব্যবস্থার বিস্তার ঘটানো এবং একে শক্তিশালী করার দাবি ভারতে যে কোনো বাম দলেরই সাধারণ দাবি। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে রেশন আন্দোলন থেকে দূরে থাকার জন্য কিছু লেখক ভারতের গণবন্টন ব্যবস্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যদিও ২০১৯ সালে গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্সের তথ্য অনুযায়ী ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের র‍্যাঙ্ক ১০২। এমন পরিস্থিতিতেই মনে হয় ঘোড়া হেসে ওঠে। সৌভাগ্যবশতঃ এমন কুযুক্তি লেখকদের একান্তই নিজস্ব মতামত এবং তা কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে আসেনি। 

তেল নুন সাবান সহ রেশনে আরো বেশী পণ্য সরবরাহের দাবি করা যায়, গণবন্টন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার দাবি করা যায়। কিন্তু মানুষকে প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার লড়াইয়ে সংগঠিত না করে বামপন্থীরা যদি ত্রাণ বিতরণে ব্যস্ত থাকে তবে আরো  আগে বাড়ার লড়াই হবে কী ভাবে? বামপন্থীরা চাঁদা তুলে ত্রাণ দিচ্ছেন। আর তৃণমূল কংগ্রেস অধিকারের রেশন চুরি করে ত্রাণ দিয়ে দয়া দেখাচ্ছে। কে কত দয়া দেখাতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। যেহেতু এক র‍্যাডিক্যাল বাম লেখক লিখেছেন যে রেশনের চাল গম যেহেতু চিবিয়ে খাওয়া যায় না তাই কমিউনিটি কিচেন চালানো হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে আমার দুটো প্রশ্ন আছে – যারা ত্রাণে রান্না করা খাবার না দিয়ে চাল ডাল দিচ্ছেন উনি কি সেগুলোর বিরোধিতা করছেন? কারণ ত্রাণের চাল ডালও তো চিবিয়ে খাওয়া যায় না তাই না? দ্বিতীয় প্রশ্ন কমিউনিটি কিচেন নাম হয়েছে যখন তখন সংগঠকরা সপরিবারে গরিব মানুষদের সাথে কমিউনিটি কিচেনের রান্না খাচ্ছেন নাকি বাড়ির খাবার খাচ্ছেন? বাড়ির খাবার খেলে "কমিউনিটি" কিচেন নাম কেন? সাম্যবাদী ফ্লেভার ছড়ানোর জন্য? ত্রাণ দাতারা কি ত্রাণ গ্রহীতাদের সাথে নিজেকে এক কমিউনিটি মনে করছেন?
রেশন দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করতে গেলে শাসকদলের গুন্ডা বাহিনীর মুখো-মুখোমুখি হতে হয়। মার খাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। ফলে সমস্যাটাকে দেখতে না পাওয়াই প্রথম বিকল্প। কিন্তু যখন মানুষ দেখতে বাধ্য করে তখন প্রেস কনফারেন্স আর ফেসবুকে জঙ্গিপনাই রাজনৈতিক কর্মসূচী হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি কিন্তু এই বিক্ষোভকে ভোট বাক্সে চালানের চেষ্টা করছে। জাগো কমরেড! জাগো!

কলকাতা শহরে কিছু রিক্সা চলতে দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু রিক্সা চালকদের  সাথে কথা বললেই জানা যাবে পেটের দায়ে লকডাউন ভেঙে পুলিশের থেকে লুকিয়ে কিভাবে তাঁদের রিক্সা চালাতে হয়! জানা যাবে কত টাকা আয়, কত টাকা ফাইন দিতে হয় রোজ, শরীরের কত জায়গায় কতগুলো লাঠির দাগ আছে। জানালায় বসে রিক্সা দেখলে আর একটা রিক্সাকে পাঁচবার গুনলে মনে হতেই পারে রিক্সা চলাচল স্বাভাবিক আছে।

২৯ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ সেক্রেটারি জারি করা নোটিশ অনুযায়ী রিক্সা চালক, পরিযায়ী শ্রমিক সহ গরিবদের লকডাউনের মধ্যে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার কথা জেলা প্রশাসনের। আর যাদের রেশন কার্ড আসেনি তাদের কাছে  কাউন্সিলরের মাধ্যে ফুড কুপন সরবরাহ করার কথা খাদ্য দপ্তরের। রাজ্য সরকার নোটিশ দিয়েই খালাস। কলকাতার মেয়র বা জেলা শাসক গরিবদের জন্য কোনো ব্যবস্থাই করেনি। ফুড কুপন গরিবদের হাতে পৌছবার আগেই খেয়ে ফেলেছে শাসক দলের আঞ্চলিক নেতারা।

এই গরিব মেহনতী মানুষেরাও নাগরিক। এরা দেশলাই কিনলেও ট্যাক্স দেন। কেন এই মানুষদের নির্ভর করতে হবে অন্যের ত্রাণ সাহায্যের উপর। এই সমস্ত মানুষকে তাঁদের অধিকার আদায়ে সাহায্য করতে  তাঁদের সচেতন ও সংগঠিত করে নির্দিষ্ট অথরিটির উপর চাপ দেওয়া যেত। কেউ কোথাও এই কাজ করছেন না বা সমস্ত বামপন্থী ভারত সেবাশ্রম মোডে চলে গেছেন এই কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু এটা সামগ্রিক চিত্র নয়। ত্রাণ বিতরণই সাধারণ চিত্র। মানুষকে অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠিত করার থেকে ত্রাণ বিতরণ সমাজে সুবিধাভোগী অংশের জন্য অনেক বেশী গ্রহণ যোগ্য। নিজেদের সুবিধাবাদী কর্মকাণ্ড দিয়ে গা বাঁচানো’র নীতি কে  উৎসাহী তরুণ বামপন্থী কর্মীদের বাগে রাখতে একটা সাধারণ কর্মসূচী হিসাবে চালানো হচ্ছে নাকি?

আসলে ব্যাতিক্রমহীন ভাবে সবাই নিজের সামাজিক অবস্থান থেকে চিন্তা করেন, সচেতন ভাবে বা অবচেতনে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রমজীবী মানুষের চেতনার ভেতর হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর আত্মসম্মান, অধিকার বোধ ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। এই আত্মসম্মান অধিকার বোধ সে ফিরে পায় লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে, সংগঠনের মধ্যে দিয়ে। লড়াই আর সংগঠনের ভাটা আসলে আবার দয়াবান বাবুদের রমরমা বাজার শুরু হয়। গরিব মানুষ তখন অর্জিত অধিকারকেও দয়া ভাবতে শুরু করে। পুলিশ বা সরকারি আধিকারিক স্বাভাবিক ভদ্র ব্যবহার করলে মানুষ ভাবে বাবু কত ভালো মানুষ। গরিব মানুষ অধিকার সচেতন হোক, সমাজে সুবিধাভোগী অংশ  তা কোনদিনই চায় না। গরিব মানুষ অধিকার সচেতন হলে তাঁরা বাবুদের উপর নির্ভর করবেন না। আর গরিবরা বাবুর উপর নির্ভর না করলে বাবু দয়া দেখাবেন কাকে? দয়া দেখাতে না পারলে স্বর্গ দুরে থাক এই জগতেও মহান ব্যক্তিদের তালিকায় ঠাই হবে না।

এই বাবু রাজনীতির বিরুদ্ধে দাড়িয়েই কমিউনিস্ট রাজনীতির উত্থান। অধিকার সচেতন শ্রমজীবী মানুষের গণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাই মার্কসবাদীর কাজ। উৎপাদ-বন্টন ব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের গণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মার্কসবাদীর লক্ষ্য বলে জানতাম। এই কাজ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে হয়। ত্রাণ বিলি করে লড়াকু চেতনার বদলে পরনির্ভরশীল ভিখারি চেতনা ছড়িয়ে নয়। বাবু সেজে দান ধ্যানের মধ্যে জন সংযোগটা কংগ্রেসীরা করে দেখেছি, কমিউনিস্টের জনসংযোগ মানে অধিকার অর্জনের সাথি হওয়া। দান ধ্যানের জনসংযোগ অনেক পুরানো হয়ে গেছে। দক্ষিণপন্থীরাও এখন তৃণমূল স্তরে গরিব মানুষের ইস্যু নিয়ে লড়াই করে।

বামপন্থী আন্দোলনের যে বন্ধুদের সাথে এই বিতর্ক তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীল বাবুদের সাথে এক সারিতে বসানোর ধৃষ্টতা আমার নেই। তাঁদের জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং অতীতে তাঁদের করা ত্যাগকে সম্মান করি। কিন্তু মাথার ভিতরে কোথাও বাবুরা গেড়ে বসছে না তো? ভয় কোথাও   কর্মসূচী কে নির্ধারণ করছে না তো? ত্রাণের সমর্থনে নিজেদের ঘোষিত মতাদর্শগত অবস্থানকে নাকচ করে এরকম উদ্ভট যুক্তি না সাজিয়ে বিষয়টা রাজনৈতিক ভাবে ভেবে দেখার অনুরোধ করবো।

যখন দেখা যায় "নকশালপন্থী" হিসেবে পরিচিত একদল বুদ্ধিজীবী এবং নেতা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে চিঠি লিখে জানান যে তাঁরা করোনা পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সাথে কাজ করতে চান এবং প্রশাসনকে সাহায্য করতে চান তখন রাজনীতি নিয়ে প্রাথমিক ধারণাটাই গুলিয়ে যায়। বিরোধী দলের কাজ বিরোধিতা করা, শাসক দল বা প্রশাসনকে চাপে রাখা। তার বদলে লিখিত ভাবে সহযোগিতার অঙ্গিকার নতুনই বটে। এর সাথে ত্রাণবিলিয়ে ক্ষোভ  প্রশমিত করার কর্মসূচীরকোনো গুনগত পার্থক্য আছে কি? চারু মজুমদার স্তালিনকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন "ঘৃণা করুন  চূর্ণ করুন মধ্যপন্থাকে"। কিন্তু এখন দেখছি চূর্ণ করার মত কোনো মধ্যপন্থা নেই। গোটা খেলাটাই চলে এসেছে দক্ষিণ দিকে। ফেসবুকে অতিবাম আর রাস্তায় দক্ষিণ। রেশন নিয়ে প্রশাসন কে চাপ দেওয়ার জন্য বিপ্লবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রশাসনকে চাপ দেওয়াটা রাজনীতির প্রাথমিক অ আ ক খ।

ত্রাণ বিতরণকে সমর্থন করতে গিয়ে এমনই দক্ষিণপন্থী অরাজনৈতিক চিন্তায় ঢুকে গেছেন কমরেড যে একটি সাধারণ রাজনৈতিক কর্মসূচীকেও “বাম অ্যাডভেঞ্চারিজম” মনে হচ্ছে! জঙ্গি অর্থনীতিবাদ বা “বাম অ্যাডভেঞ্চারিজম” এর বিকল্প হিসাবে ত্রাণ বিলি করা কে বিপ্লবী মডেল হিসাবে তুলে ধরা অবশ্যই লেখকের মৌলিকত্বের দাবি রাখে, কিন্তু এর সাথে মার্কসবাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

না, ৫৯ বা ৬৬র খাদ্য আন্দোনের রিপিট টেলিকাস্ট হবেনা। এখনকার আন্দোলন হবে এখনকারই মতন।  অতীতের খাদ্য আন্দোলনের সংশোধনবাদী গাড্ডায় পরে ভোট বাক্সে চালান হওয়াটা যদি ট্রাজেডি হয়, তবে ২০২০ সালের বৈপ্লবিক ত্রাণ বিলি কর্মসূচী যে একটি কমেডি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

লেনিন ১৫০ বছরেও পুরানো হননি, শেখাচ্ছেন বর্তমানে কী করতে হবে

বুধবার, এপ্রিল ২২, ২০২০ 0 Comments A+ a-


এই বছর ২২শে এপ্রিল ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ওরফে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা, শিক্ষক, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক লেনিন ১৫০ বছর পূর্ণ করলেন। যদিও লেনিনের বয়স হয় না আর লেনিনবাদ কোনদিন পুরানো হয় না, তাই এই এত বছর পরেও লেনিন কেন দুর্বার তা নিয়ে বাকি সবার মতন তাত্ত্বিক ঘ্যান ঘ্যান না করে বা পুরানো কাসুন্দি না ঘেটে চেষ্টা করছি অল্প কিছু কথায় লেনিনের বর্তমান যুগে কী ভূমিকা তা নিয়ে একটু মস্তিষ্কের শ্যাওলা জমা অঞ্চলে আঁচড় কাটার। 

ওই যে বললাম, লেনিন বুড়ো হন না, তাঁর বয়েস বাড়ে না, তবে লেনিন আর লেনিনবাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে করতে অনেকের চুল পেকে যায়, চুল পড়েও যায় আর আবার চোখে ছানিও পড়ে যায়। তবুও তাঁদের অনেকেই আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, মানে যখন মাথার উপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল আর মাও সেতুঙের মুখে জ্বলন্ত সিগারেট ছিল, তখন থেকেই সেই একই কথা বলে আসছেন, লেনিন কে নাকি ঠিক করে বুঝে প্রয়োগ করতে হবে। লেনিন নিয়ে অবশ্য সবারই এক এক ধরণের মতাদর্শগত স্ট্যান্ডপয়েন্ট বা দলীয় লাইন আছে। 

ধরুন আপনি বললেন যে আপনি ভোট বিরোধী, সশস্ত্র বিপ্লব করতে চান, পার্লামেন্ট বয়কট করতে চান তাহলে কিন্তু আপনাকে ধরতে হবে লেনিন কে। লেনিনের নির্বাচন বয়কটের ডাক, লেনিনের বলশেভিক বিপ্লবের ডাক আর পার্লামেন্ট কে শুয়োরের খোঁয়াড় বলা হল আপনার অমোঘ হাতিয়ার। অন্যদিকে ধরুন আপনি খেয়েদেয়ে উঠে ভাবলেন একটু বামপন্থী রাজনীতি করবেন দুপুর বেলা না ঘুমিয়ে আর নির্বাচন লড়বেন এবং অবশ্যই যাঁরা নির্বাচন বয়কট করতে হবে বলে গোল করছে তাঁদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম করবেন, তবুও আপনার লেনিন চাই। সেই “লেফট উইং কমুনিজম — এন ইনফ্যান্টাইল ডিসর্ডার” আপনাকে কোট করতে হবে, বারবার লেনিনের ডুমা কে ব্যবহার করার কথা বলে মানুষ কে বোঝাতে হবে যে বিপ্লব-টিপ্লব না বরং ভোটই আসল হাতিয়ার। 

সে যাই হোক, আপনার দেওয়ালে শুধুই কার্ল মার্কস, ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস আর ভই লেনিন টাঙানো, নাকি লেনিনের পরে যোসেফ স্তালিনও শোভা পান, নাকি মাও সেতুঙ’ও আছেন সবার শেষে সে কথা আপনিই ভাল জানেন। তবে এখানে যেটা নিয়ে আলোচনা আমায় সেই বিষয়ে ফিরতে হবে। লেনিন ১৯০২ সালে “কী করতে হবে?” নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত করেন যাতে তিনি বার্নস্টাইন এর মার্কসবাদ কে সমালোচনা করার স্বাধীনতার দাবি’র বিরোধিতা, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের লেজুড়বৃত্তি করা, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং সেই প্রবন্ধের একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি হল — “বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন হয় না।” 

যেহেতু বর্তমানে আমাদের দেশের, বা সমগ্র বাংলার বুকে কাজ করা নানা ধরণের বামপন্থী সংগঠনগুলো “সময়ের অভাব” বা কোন টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে নিজেদের দলের নতুন বা পুরানো রিক্রুটদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূলগুলো নিয়ে তাত্ত্বিক শিক্ষা না দিয়ে চে গেভারা’র ডায়েরি, কমিউনিস্ট পার্টি’র ইস্তাহার, গান্ধী, আম্বেদকর আর দেশের সংবিধানের পাঠ দিয়েই শর্টকাটে তাঁদের পথে নামান তখন বোঝাই যায় যে আসলে কী ধরণের বিপ্লব করার ইচ্ছা তাঁরা পোষণ করেন। এই গল্পে সিপিআই (এম) বা সিপিআই জাতীয় দল কে গণ্যও করলাম না। ফলে আজ তত্ত্বের দিশাহীনতা নতুন কর্মীদের কর্মউদ্যোগের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার কর্মীদের মধ্যে তত্ত্ব শেখাবার যে প্রয়াস করা উচিত একটি নেতৃত্বের তাও সব জায়গায় দেখা যায় না বোধহয় দল থেকে বোর হয়ে লোক পালিয়ে যাবে এই ভয়ে। 

তাই আজ যেহেতু তত্ত্বের বালাই নেই তাই যা কিছু একটু যুক্তি বা গল্প দিয়ে দাঁড় করানো যায় তাই তত্ত্ব হয়ে যায়। ফলে বিনা শ্রেণী সংগ্রাম করেই দাবি ওঠে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে ও ভারত উপমহাদেশ থেকে জাতপ্রথা কে উচ্ছেদ করার। কী করে তা সম্ভব সে কথা কিন্তু কেউই বলেন  না। আর থেকে যায় মুখস্থ বিদ্যা। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে সেই শত বৎসর পুরানো জর্জি দিমিত্রভের লাইন, অর্থাৎ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট সহ অন্যান্য সকল ফ্যাসিবিরোধী শক্তির সাথে যুক্ত ফ্রন্ট গড়ার লাইন। 

এই লাইনের এমন মোহ যে সকল রাখ ঢাক ছেড়ে ১৯৯৮ সালে প্রথমবার সিপিআই (এম) জাতীয় কংগ্রেসের সাথে বর্তমান শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কে আটকাবার স্বার্থে যুক্তফ্রন্ট করতে রাজি হয়ে যায়। এর থেকেই ২০০৪ সালে ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ এলায়েন্স বা ইউপিএ জন্ম নেয়। এখনো সিপিএই (এম) সেই স্বপ্নই দেখে তবে সাথে আরও অনেক নতুন দোসর জুটেছে তার। বিজেপি যদিও এসব কে আর পাত্তা দেয় না। আবার সিপিআই(এম) এর চেয়ে যারা একটু বা অনেকটা বামে, তাদের অনেকেই আবার আম্বেদকরপন্থী, এনজিও-পন্থী, হ্যানপন্থী-ত্যানপন্থী সকলের সাথেই ফ্যাসি-বিরোধী জোট গড়তে চান। তাদের বক্তব্য যে করেই হোক বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদী কে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। যেন ২০১৪ সালের আগে ভারতবর্ষ শ্রমজীবী মানুষের জন্যে একটি বেহেস্ত ছিল। যেন মোদী শুধু ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে আর তার পিছনে অন্য কোন গূঢ় অভিসন্ধি নেই। 

মার্কস এক কালে গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা করে মতাদর্শের ক্ষেত্রে আপস কে তীব্র ভাবে ভর্ৎসনা করেছিলেন। লেনিন সারা জীবন প্র্যাগমাটিজম দেখিয়ে মার্কসবাদ কে সুবিধাবাদ ও গোঁড়ামিবাদের থেকে রক্ষা করেছেন এবং নতুন স্তরে উন্নীত করেছেন, অর্থাৎ লেনিনবাদে বিকশিত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে, যখন সাম্রাজ্যবাদ —  অর্থাৎ পুঁজিবাদের বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্তরে উন্নীত হওয়া, যাকে লেনিন চিহ্নিত করেন মুর্মূষু পুঁজিবাদ হিসাবে — নিজের লোভ ও  লালসা কে চরিতার্থ করতে মানুষের জীবন নিয়ে, পৃথিবীর জল-বায়ু আর প্রকৃতি কে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে, যে সময়ে পুরাতন, জরাজীর্ন পার্লামেন্টারি ডেমোক্র্যাসি বা সংসদীয় গণতন্ত্রের সাইনবোর্ড খুলে দিয়ে একটি ভয়াবহ ও নগ্ন ফ্যাসিবাদী শাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া হয়ে ভারতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন মার্কস, লেনিন বা মাও’র শিক্ষার আলোকে বর্তমান ফ্যাসিবাদ থেকে মানুষ কে উদ্ধার করার, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে এই ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করার আর নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থা গড়তে কী ধরণের পদক্ষেপ করা যায় তা নিয়ে কিন্তু তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে কোন কাজ হয়নি আর হচ্ছেও না। 

আসলে তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা’র উপর শুধু বুদ্ধিজীবী, স্কলার ও একাডেমিক মহলেরই একচেটিয়া মালিকানা। মাঠে-ঘাটে যাঁরা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কাজ করছেন, যাঁরা জনগণের বিভিদ অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের বাস্তবতার থেকে শিক্ষা লাভ করছেন তাঁদের মধ্যে কিন্তু তত্ত্ব কে বিকশিত করার কাজ বেশি হচ্ছে না। মাও এর শিক্ষার আলোকে যদি আমরা তত্ত্ব ও প্রয়োগের সম্পর্ক কে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তাহলে দেখা যাবে যে ভাবে বাস্তবে তত্ত্বের প্রয়োগের ফলে যে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে, যা ইতিবাচক ও নেতিবাচক শিক্ষা লাভ হচ্ছে তার সঠিক সারসঙ্কলন করে আগামীদিনে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে, তার মদদদাতা উচ্চবর্ণের সামন্তপ্রভুদের, মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী — বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ — শক্তিদের উচ্ছেদ করতে, তাদের থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে কী করতে হবে এই নিয়ে কিন্তু বিস্তারিত চর্চা হচ্ছে না। 

লেনিন কোনদিন ৫০ বছর পুরানো তাত্ত্বিক লাইন কে গোঁড়াদের মতন অনুসরণ করেননি, করলে রুশ বিপ্লব হতো না, সোভিয়েত ইউনিয়ন হতো না।  আবার তিনি মার্কসবাদ কে জলাঞ্জলি দিয়ে পাতি-বুর্জোয়া পরিচয় রাজনীতি বা সুবিধাবাদী জোট গঠন করেননি, তিনি মার্কসবাদের মূল শিক্ষাগুলো কে নিয়ে আপস করেননি। বর্তমানের বামেদের বড় অংশগুলোই হয় পরিচয় রাজনীতির জন্যে, না হয় সুবিধাবাদী অবস্থানের জন্যে বা অনৈতিক জোট গঠনের জন্যে মার্কসবাদ কে জলাঞ্জলি দিচ্ছে, বুর্জোয়াদের হাতে তামুক খাচ্ছে। আর এটা করার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও তারা হাজির করছে, যদিও সেই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা মার্কসবাদের আতসকাঁচে ধোপেও টেকে না। 

তত্ত্ব কে বর্তমান সময়ের উপযোগী না করলে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্নতা যেমন কাটবে না তেমনি যারা বিপ্লবের বা সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেন, যারা সততার সাথে মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেন, তাদের অনেকেই বর্তমানে যে একটা দিশাহারা বা হতাশাছন্ন অবস্থায় রয়েছেন, তার থেকে মুক্তি পাওয়াও সম্ভব নয়। অথচ তত্ত্বের ক্ষেত্রে যেটুকু নতুন করা দরকার বলে রব উঠেছে, তা উঠেছে তাদের মধ্যে থেকে যাদের লক্ষ্য হলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কে উদারনৈতিক গণতন্ত্রী একটি মতবাদে পরিণত করে শ্রমিক শ্রেণী কে চিরতরের জন্যে পুঁজির গোলাম বানিয়ে রাখা। তাই বার বার তত্ত্ব বিকাশ করা ও “নতুন করে ভাবা” নিয়ে যে সব রাজনৈতিক নেতারা ও তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা নিজেদের ঝুড়ি নিয়ে এসেছে ততবার সেই ঝুড়ির থেকে বার্নস্টাইন থেকে কাউটস্কি, টিটো থেকে ক্রুশ্চেভ, তেঙ শিয়াও পিং থেকে গর্বাচেভের পঁচাগলা তত্ত্বের বিকট দুর্গন্ধময় মিশ্রণ বেরিয়েছে।  যতবার মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সেতুঙের চিন্তাধারা কে বর্তমান সময়ে এসে, বাস্তব প্রয়োগের থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলোর সারসঙ্কলন করে, জনগণের ও শ্রমিক শ্রেণীর নানা সংগ্রামের সারসঙ্কলন করে, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক শিক্ষাগুলোর দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ করে ও সারসঙ্কলন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন নতুন তত্ত্বের দ্বারা বলীয়ান করার প্রয়োজন বস্তুগত কারণে পড়েছে, ততবার নানা ধরণের ছাল গায়ে দিয়ে এসে সংশোধনবাদের ফেরিওয়ালারা নিজেদের পুরানো মদ নতুন বোতলে করে বেচতে চেয়েছে। 

এটা বোঝা খুব দরকার যে বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন তাত্ত্বিক অস্ত্র ছাড়া বিশ্ব জুড়ে মাথা চাড়া দেওয়া ধর্মীয় ও বর্ণবিদ্বেষী ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা যাবে না। দিমিত্রভের দুনিয়ায় ছিল একটি শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের ছিল একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী — লাল ফৌজ —  যা একটি বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী ছিল, শ্রমজীবী মানুষের নিজের সেনা ছিল। যেহেতু শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী সেইদিন ছিল তাই প্রতিটি দেশের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের সাথে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন ও শ্রমিক শ্রেণীর নিজের রাষ্ট্র, লেনিনের হাতে গড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ছিল খুবই নিবিড়। তাই সেইদিন চীনা বিপ্লবের সময়ে চীনা লাল ফৌজ পেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অগাধ সমর্থন এবং বিশ্বের মঞ্চে নানা জাতির নিপীড়িত ও শোষিত মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস পেয়েছিলেন। 

বর্তমানে শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক ঐক্য ভেঙে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা বশীভূত শ্রমজীবী মানুষ কে এখন তাঁর নিজের ভাই কে, নিজের বোন কে ঘৃণা করতে শেখাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের ঔরসজাত ফ্যাসিবাদ আর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেই সব শক্তির সাথে পুরানো কায়দায় আবার যুক্তফ্রন্ট গঠন করার লাইন সামগ্রিক ভাবে বিপ্লবী গণসংগ্রামের ব্যাপক ক্ষতি করবে। কারণ সেই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হতে পারে একটি বাস্তব সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এবং সেই যুক্তফ্রন্ট অবশ্যই আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় শ্রেণীগুলির শক্তি ভারসাম্যের দ্বারা প্রচন্ড প্রভাবিত হয়। আন্তর্জাতিক ভাবে যেহেতু শ্রমিক শ্রেণীর নিজের রাষ্ট্র, সৈন্য ও রাজনৈতিক কেন্দ্র নেই তাই এই রকম জোটে বার বার নেপোয় মারে দই করে যাবে জোটসঙ্গীরা, বুর্জোয়ারা। এইরকম জোট কে ব্যবহার করে তারা শ্রমিক ও কৃষকদের উপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করবে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত না করে।   

বরং এই পরিস্থিতিতে লেনিনের থেকে শেখা উচিত কী করে একটি জাতির মানুষ কে ছিনিয়ে নিতে হয় শাসক শ্রেণীর প্রভাব থেকে। শেখা উচিত কী ভাবে গোপনে ও প্রকাশ্যে কাজ করে, কী ভাবে নিয়মিত প্রচার করে, কী ভাবে শ্রমজীবী মানুষের সংবাদমাধ্যম গড়ে ও মানুষের কাছে তাঁর শ্রেণীর কথা প্রতিদিন নানা ভাবে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের শ্রেণী চেতনা কে জাগ্রত করে সংগঠিত করতে হয় শ্রেণী কে। শিখতে হবে নিরলস হয়ে কাজ করা, শিখতে হবে আত্মস্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার কথা।  লেনিনের থেকে শিখতে হবে ধৈর্য্য এবং সুযোগ কে কাজে লাগাবার কলা। তবেই সম্ভব হবে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে একটি শ্রেণী চেতনা কে জাগ্রত করা ও তাঁদের শ্রেণী সংগ্রামে’র রাজনীতি দিয়ে নেতৃত্বে উন্নীত করা, যাতে তাঁরা তাঁদের অভীষ্ট অর্জনের জন্যে সমগ্র শ্রেণী ও জাতি কে নেতৃত্ব দিতে পারেন। 

লেনিনের ১৫০ বছরে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ একটি ভীষণ খারাপ পরিস্থিতিতে আছেন। করোনা ভাইরাসের নাম করে শুধু যে শ্রমজীবী মানুষদের কর্মহীন করে দেওয়া হয়েছে ভারতের মতন দেশগুলোয় তাই নয়, বরং এই রোগ প্রতিরোধের নাম করে ধীরে ধীরে সমস্ত রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে জনগণের। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের মতপ্রকাশের অধিকারও, এবং চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি কর্পোরেট-ফ্যাসিবাদী শাসন, ভারতের মতন দেশে যা আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের কাঁধে চেপে মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে ও শ্রমজীবী, শোষিত মানুষ কে ধর্ম ও জাতের ভিত্তিতে আলাদা করে দিচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়ে গেছে এবং ফ্যাসিবাদীরা একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্যে নির্লজ্জের মতন ওকালতি করছে কারণ সঙ্কটগ্রস্ত একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির তাই আজ চাই বেঁচে থাকার জন্যে। 

এই সঙ্কটের থেকে লেনিন মুক্তি দেবেন না আকাশ থেকে নেমে এসে। কোন বস্তুবাদী সে আশা করে না। এই সঙ্কট থেকে সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় মার্কসবাদ আর আম্বেদকর নিয়ে চর্চা করা মানুষেরা উদ্ধার করতে আসবেন না। এই সঙ্কট থেকে নানা ধরণের তথাকথিত বাম হতে গিয়ে বিধির বাম হওয়া নেতারা রক্ষা করতে আসবেন না শোষিত মানুষ কে। এই  সঙ্কট থেকে মুক্তি দেবে সৎ প্রয়াস। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সেতুঙ’র চিন্তাধারা’র বাস্তব ভিত্তিতে অর্জিত শিক্ষার ও শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের বস্তুগত সারসঙ্কলন এবং তার থেকে গ্রহণ করা শিক্ষা কে তাত্ত্বিক ভাবে বিকশিত করেই মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। অতীতের ভুলের থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে সঠিক লাইন নিতেই হবে।  আর এই কাজে ভুল হবেই, তবে ভুল না করলে শিখবে কে? 

লেনিন এর থেকে শিখতে হবে অন্ধকার পৃথিবীতে, শোষণের কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া দুনিয়ায়, কী করে হতাশ না হয়ে তত্ত্ব ও প্রয়োগের মেলবন্ধন করে, গোঁড়ামিবাদ ও সুবিধাবাদ কে পরাস্ত করে মার্কসবাদের অস্ত্রসম্ভার এ নতুন অস্ত্র যোগান দিতে হয়। শিখতে হবে কী করে শ্রমিক শ্রেণী কে, কৃষকদের ও মেহনতি মানুষদের তাঁদের অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে হয়। কী করে আমরা পুরানো চশমা খুলে নতুন পাওয়ারের চশমা পড়ে বিশ্বকে দেখবো, বুঝবো ও বদলাবো, তার হদিশ পেতেই লেনিন কে ১৫০ বছর পরেও আঁকড়ে ধরতে হবে। কারণ লেনিন বুড়ো হননা, বুড়ো হয়ে হারিয়ে যায় তারা যারা লেনিন কে লেনিনের মতন প্রয়োগ না করে সুউচ্চ মন্দিরে দেবতা করে সাজিয়ে রেখে দেন। অবশেষে মনে থাকে যেন, লেনিন বলেছিলেন — বিলম্ব মানেই মৃত্যু। তাই পা চালিয়ে কমরেডস, একটু পা চালিয়ে। 

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য লোপ পায়নি তীব্র হয়েছে

শুক্রবার, ফেব্রুয়ারী ২১, ২০২০ 0 Comments A+ a-


খুব হৈচৈ করে পার হলো আরও একটা ২১শে  ফেব্রুয়ারি। এই বছরে জাতীয় শহীদ বেদিতে মাল্যদান করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টলছিলেন ও চরম বিভ্রান্তের মতন তাকিয়ে ছিলেন। যে ভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারা কোলা ব্যাঙের মতন থপ থপ করে গিয়ে ভীষণ লোক দেখানো ঢং করে পুস্পস্তবক দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন তাতে কারুরই বুঝতে অসুবিধা থাকে না যে কী ভীষণ আনুষ্ঠানিকতা হয়ে গেছে অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি’র ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করা। এর ফলে মানুষের মধ্যেও ভাষা আন্দোলন ও বাংলা ভাষার মর্যাদার লড়াই নিয়ে, সালাম, বরকত, জব্বার, রফিকদের শাহাদাত নিয়ে, একটা গতানুগতিক ভাব দেখা দিয়েছে। মনে হয় ভাষা আন্দোলন আর ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আর বাঙালির চেতনা কে ছোঁয় না, তাঁর জীবনের সাথে সম্পর্ক রাখে না। যদি বাংলাদেশে বাঙালি নেতৃত্বের নিজের দেশের গৌরবজ্জল অধ্যায় নিয়ে এই রকম মনোভাব থাকে তাহলে যে বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ এক খাদের দিকে গড়িয়ে চলেছে তা বলাই বাহুল্য। 

বাঙালির কাছে ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য কোনদিন কম হবে না। বাংলা ভাষা কে রক্ষা করতেই নয়, বাংলার বুকে বাস করা অসংখ্য আদিবাসী জনজাতির মানুষের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি কে রক্ষা করার দায়ও কিন্তু বাঙালির। ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষা কে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই ছিল না, শুধুই উর্দু উপনিবেশবাদ কে উৎখাত করার লড়াই ছিল না, শুধুই সমমর্যাদার বা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লড়াই ছিল না। ভাষা আন্দোলন যে কোন রাষ্ট্রীয় মদতপ্রাপ্ত ভাষার রোলার সেই রাষ্ট্রের নিপীড়িত, শোষিত, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু মানুষের নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি’র উপর চালানো রোখার লড়াই। তাই চাকমা, পাহাড়ি, রাজবংশী, কোচ, সাঁওতাল প্রভৃতি জনজাতির মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচিতি কে সমমর্যাদা দেওয়ারও লড়াই হল ভাষা আন্দোলন। এটা বাংলাদেশের পরিচয়। এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্য। 

সেই মধ্যযুগ থেকে বাংলা কে ক্রমাগত লড়াই চালাতে হয়েছে নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে। বাংলার বুকে এসে জেঁকে বসা ব্রাক্ষণ জাতির শাসকেরা, যাঁদের বেশির ভাগের আগমন হয়েছিল বর্তমান ভারতের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকগুলোর থেকে, ধীরে ধীরে যে ভাবে বাংলার মানুষের উপর শুধু রাজনৈতিক নয় বরং সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করেছিল তার থেকে মুক্তি এসেছিল নবাব যুগে, যখন থেকে বাংলা ভাষার ব্যবহার সাহিত্যে শুরু হয়। ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণীরা যা করতে দিতে চায়নি, মুসলিম নবাব শাসনকালে তাই সম্ভব হয়ে উঠেছিল, যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো কৃত্তিবাসের রামায়ণ, যা সংস্কৃতের বাইরে এনে একটা মহাকাব্য কে মানুষের ভাষায় প্রচার করেছিল। 

অথচ আজ, তথাকথিত স্বাধীনতার ৪৮ বছরে এসেও, আমরা কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভাষা আন্দোলন কে তাঁদের নিজেদের, তাঁদের আপন করে তুলতে পারিনি কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হল পাকিস্তানী মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের থেকে ক্ষমতার ব্যাটন ভারতপন্থী কিছু বাঙালি মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি আর বৃহৎ জোতদার-জমিদারদের হাতে যাওয়া। যাদের নেতা হলো মুজিব থেকে হাসিনা। যে গরিব, খেটে খাওয়া শ্রমিক আর কৃষক হলো বাংলার ৮০ শতাংশ তাঁদের কাছে যেহেতু স্বাধীনতা আজও এক অজানা বস্তু হয়ে রয়েছে তাই জোর করে তাঁদের মধ্যে ভাষা আন্দোলন ও ২১শে ফেব্রুয়ারি’র শহীদদের নিয়ে কোন উদ্দীপনা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। অভুক্ত বাঙালি ভাষার চেয়ে বেশি খাবার কে চায়, ইতিহাসের চেয়ে বেশি বর্তমান কে চায়। 

তাই দলে দলে বাঙালিকে আজও দেশ ছেড়ে বিদেশ গিয়ে টাকা অর্জন করতে হয়, বিশ্বের দেশে দেশে গিয়ে নানা জাতির ভাষায় কথা বলে, তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশে নিজের পরিবারের মুখে দুই বেলা অন্ন তুলে দিতে হয়। এর চেয়ে চরম অপমানের কথা কী হতে পারে যে ধনে ধানে, পুষ্পে ভরা, শস্য-শ্যামলা এই দেশে নানা জাতির, নানা ভাষার, নানা সংস্কৃতির মানুষের দুই বেলা পেট ভরানোর বন্দোবস্ত করা যায় না? কী কারণ যে আজও বাংলাদেশে সেই সাম্য এল না যার জন্যে একদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লক্ষ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়েছেন? 

বাংলা ভাষা আন্দোলন কে শুধু একটা দিবসে পরিণত করে তার শপথগুলো ভুলিয়ে দেওয়ার পিছনে যে রাজনীতি আছে, দেশের ভিতর অসাম্যের উর্দ্ধগামী গ্রাফের যে রাজনীতি আছে, তার মূল হলো মুষ্টিময় কিছু বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি, জোতদার-জমিদারদের হাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া। জনগণের, আদিবাসী-পাহাড়ি মানুষের, পানি-জঙ্গল-জমি কেড়ে নিয়ে, মানুষের শ্রম কে নিংড়ে নিয়ে, গার্মেন্ট শ্রমিকের রক্ত চুষে, মাঠের কৃষকের ঘাড় ভেঙে যে বিপুল সম্পদের পাহাড় এই হাতেগোনা কীট পতঙ্গের দলেরা করেছে তার ফলেই  কিন্তু আজ বাঙালি তাঁর নিজভূমি বাংলাদেশে অভুক্ত থাকছেন, তাই বাঙালি শ্রমিক বিদেশ যাচ্ছেন পয়সা রোজগার করতে আর ফিরছেন লাশ হয়ে। 

ভাষা আন্দোলন কে মানুষের মুক্তির আন্দোলন থেকে, সামন্তবাদ-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ-বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির দাপট থেকে মুক্তির আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো একটা অন্যায়। রফিক-জব্বাররা কিন্তু শুধুই ভাষার সমমর্যাদার জন্যে প্রাণ দেননি। একুশে ফেব্রুয়ারি কোনদিনই শুধু বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের দিন নয়, এই দিন হলো বাংলার শোষিত-নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের রুখে দাঁড়াবার দিন। যা স্বাভাবিক ভাবে তাঁদের বাংলাদেশের সমস্ত সম্পদের উপর মালিকানা কায়েম করার লড়াই, সমমর্যাদা, ন্যায়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লড়াই। চরম ফ্যাসিবাদী, স্বাধীনতা-বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী, ভারতের দালাল হাসিনা সরকার তাই যখন শহীদ দিবস পালন করার নাটক করে, যখন আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা রফিক-জব্বারদের আত্মত্যাগ নিয়ে জ্ঞান দেয়, ঠিক তখন তাঁদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হবে বাংলাদেশের আপামর মানুষ কে। গড়ে তুলতে হবে গ্রামে গ্রামে ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম, যা দিয়ে মুক্ত করা যাবে বাংলাদেশ কে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি সত্যিই সম্মান জানানো যাবে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ কে সম্পন্ন করে। দেশের প্রতিটি কোনে শ্রমজীবী মানুষের বিজয় ঝান্ডা উড়িয়ে। বাংলার সাথে সাথে সমস্ত আদিবাসী, পাহাড়ি, নির্যাতিত জনজাতির ভাষা ও সংস্কৃতি কে রক্ষা করে ও সমমর্যাদা দিয়ে। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে