নোবেল চর্চা: এস্তের দুফ্লো ও অভিজিৎ ব্যানার্জি'র দৈনতার অর্থনীতি আসলে অর্থনীতির দৈন্যতা

রবিবার, অক্টোবর ২০, ২০১৯ 0 Comments A+ a-

Esther Duflo and Abhijit Banerjee won the Nobel Prize in Economic Sciences along with Michael Kremer in 2019

ম্যাসাচুটেস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'র ফরাসী-মার্কিন অর্থনীতিবিদ এস্তের দুফ্লো, তাঁর বাঙালি-মার্কিন অর্থনীতিবিদ সহকর্মী ও সাথী অভিজিৎ ব্যানার্জি, ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ক্রেমার যৌথ ভাবে ২০১৯ সালের অর্থনীতি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দারিদ্র্য মোচন করার ক্ষেত্রে তাঁদের নানা গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষার কারণে তাঁদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি ২০১১ সালে দরিদ্রের অর্থনীতি শীর্ষক তাঁদের যে অর্থনৈতিক অনুসন্ধান প্রকাশ করেন তাতে উন্নয়নমূলক অর্থনীতির সূত্র ধরে তাঁরা দেখান যে দরিদ্র মানুষের অর্থনীতি কী বস্তু। দরিদ্রের অর্থনীতি হল শ্রম বেচে তাঁরা যে জীবিকা আয় করেন শুধু শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকতে, যাতে তাঁরা শ্রম বিক্রি করতে পারেন, সেই অর্থ তাঁরা কী ভাবে খরচ করেন এবং সেই খরচের সাথে কী করে বিশ্ব একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্বার্থ কে জোড়া যায় যাতে এদের দ্বারা চালিত দেশগুলোর পঙ্গু হয়ে যাওয়া অর্থনীতি কে চাঙ্গা করা যায়।

ডেভেলপমেন্টাল ইকোনোমিক্স বা উন্নয়নশীল অর্থনীতির সূত্রগুলো ক্লাসিক কেইনেসিয়ান মাইক্রো-ইকোনোমিক তত্ত্বের খুচরো তবে আরও উন্নত অংশ বলা যেতে পারে। এটা উল্লেখ্যযোগ্য যে দুফ্লো ও ব্যানার্জি তাঁদের কাজ কে কেন্দ্রীভূত করেছেন গরীব দেশগুলোয়, যাতে তাঁরা গরীব মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম কে প্রত্যক্ষ ভাবে অধ্যয়ন করতে পারেন এবং সাথে সাথে randomised controlled trials (বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা) এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের মাইক্রো-ইকোনোমিক তত্ত্বের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করতে পারেন।

দরিদ্রের অর্থনীতি  আসলে মার্কস কর্তৃক প্রুধোঁ’র লেখা দৈন্যতার দর্শন এর সমালোচনা দর্শনের দৈন্যতা’র  মতনই অর্থনীতির দৈন্যতা বলে বেশ চালিয়ে দেওয়া সম্ভব। কী আছে দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্বে? কী ভাবে তাঁরা বর্তমান বিশ্বে হুহু করে বেড়ে চলা আর্থিক আসমাঞ্জস্য ও দৈন্যতা কে দূর করতে চান? কী ভাবে তাঁরা দরিদ্রের কষ্ট লাঘব করতে চান? বছরের পর বছর ধরে তাঁরা যে ভাবে মাটি আঁকড়ে বিশ্বের দৈন্যতার শিখন্ডে থাকা অঞ্চলে গিয়ে গবেষণা করেছেন তার নিটফল কী? যে নোবেল পুরস্কার বিশ্বের তাবড় তাবড় বিদ্বানদের, যাঁরা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, দেওয়া হয়, তা দুফ্লো ও ব্যানার্জি কে দেওয়া হল কেন? 

বিশ্ব পুঁজিবাদের বর্তমান স্তর হল সাম্রাজ্যবাদী অর্থাৎ একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্তর। পুঁজিবাদের স্বাধীন প্রতিযোগিতার যুগের থেকে প্রবর্তিত হয়ে পুঁজির চরম কেন্দ্রিকরণের মধ্যে দিয়ে একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির জন্ম। বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষের দিক থেকেই এই একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি চরম সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আসে আর্থিক উদারীকরণ, অর্থাৎ সরকার বা রাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার ও বাজারের omnipotence, বেসরকারিকরণ অর্থাৎ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে — যা জনগণের দেওয়া করের টাকায় গড়ে উঠেছে — কর্পোরেট সংস্থাগুলো কে বেচে দেওয়া, এবং বিশ্বায়ন অর্থাৎ প্রতিটি দেশের বাজার, কাঁচা মালের বা প্রাকৃতিক সম্পদের উৎসগুলো কে বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির জন্যে উদার করে খুলে দেওয়ার নীতি। এই নীতি কে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি বলা হয়।

এই নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির দুনিয়ায় একটি রাষ্ট্রযন্ত্র যত তাড়াতাড়ি আর যত বেশি করে অর্থনীতির থেকে নিজেকে সরিয়ে  নিয়েছে, যত বেশি সে বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের স্বার্থে নিজের দেশের সীমান্ত পুঁজির জন্যে আলগা করে দিয়েছে তত বেশি করে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে, ধনীর সিন্দুক যেমন একদিকে ফুলে ফেঁপে উঠছে, দরিদ্র মানুষ আরও বেশি করে শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, তাঁরা দিন দিন তাঁদের বেঁচে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছেন আর এর ফলে সমাজে শ্রেণী দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠছে। 

এই শ্রেণী দ্বন্দ্ব কে নিকেশ করতে, দরিদ্র মানুষদের কিছু ছাড়, কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়ে, তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ দিয়ে টিকিয়ে রেখে তাঁদের শ্রম কে নিংড়ে নেওয়ার অর্থনীতি হল "উন্নয়নমূলক অর্থনীতি"। কী করে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে, বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জিভূত দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের ক্ষোভ কে শান্ত করা যায় কিছু অর্থের বিনিময়ে, কী করে পুঁজির মানবিক মুখোশ দেখিয়ে শোষকের ভয়াবহ রূপ কে দরিদ্র মানুষের দৃষ্টির অগোচরে রাখা যায়, কী ভাবে "পাইয়ে দেওয়ার" রাজনীতির মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষদের সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম থেকে অনেক দুরে রাখা যায়, তারই নাম "উন্নয়নমূলক অর্থনীতি" যা দুফ্লো ও ব্যানার্জি জুটির বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা'র মূল ভিত্তি। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র অর্থনৈতিক দর্শনের মূল বিষয়টাই হল যে সামগ্রিক ছবিটা না দেখে অংশটা দেখা। “প্লাম্বার রূপে অর্থনীতিবিদ” শীর্ষক তাঁর লেখায় দুফ্লো বলেছেন যে অর্থনীতিবিদদের কাজ হবে প্লাম্বারের মতন লিকেজ মেরামত করা, বৃহৎ সমস্যাটা সমাধান করতে না যাওয়া। অর্থাৎ, তাঁর মতে শুধুমাত্র পুঁজিবাদের সঙ্কটের বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে অর্থনীতিবিদদের উচিত সাহায্য করা, সামগ্রিক পুঁজিবাদের সঙ্কট কে নিয়ে গবেষণা করার বা এই ব্যবস্থা কে কী ভাবে পরিবর্তন করা যায় তা অর্থনীতিবিদদের দেখার কথা নয়।

দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার পদ্ধতি হল গরিব মানুষের মধ্যে গিয়ে থাকা, তাঁদের দৈনিক জীবনযাপন কে লক্ষ্য করা, তাঁদের খরচ ও অর্থনৈতিক বিকল্পগুলো কে যথাসম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অধ্যয়ন করা ও এর ভিত্তিতে মাইক্রো-ইকোনোমিক কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া, বিশেষ করে যা এই দরিদ্র মানুষদের জীবনে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। আর এই পরিবর্তনের জন্যে দুফ্লো ও ব্যানার্জি নির্ভর করেন রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের উপর। এই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তাঁরা চান যে দরিদ্র মানুষের হাতে কিছু অর্থ দেওয়া হোক, সে universal basic income বা সার্বজনীন মৌলিক আয় হিসেবে হোক বা সরকারি প্রকল্প অনুসারে সরাসরি দরিদ্র মানুষের ব্যাঙ্ক একাউন্ট এ ট্রান্সফার করেই হোক, যাতে সেই অর্থ দিয়ে তাঁরা বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকতে পারেন ও শ্রম বিক্রি করার পরিস্থিতিতে থাকেন। 

তবে যদিও এই ধরণের অর্থনৈতিক গবেষণা কে দারিদ্র্য দূর করার প্রয়াস হিসাবে চালানো হচ্ছে, এই ধরণের বিক্ষিপ্ত নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা কোন ভাবেই সার্বিক ভাবে দারিদ্র্য দূর করতে পারে না কারণ এই সমস্যাটা মাইক্রো-ইকোনোমিক নয়, সমস্যাটা বৃহৎ একটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা যা বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার ফসল, এবং পুঁজিবাদের, একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির, বিশ্বের উপর জেঁকে বসে থাকা রক্তচোষা ব্যবস্থার সার্বিক উচ্ছেদ না করে, সমাধান করা সম্ভব নয়। দারিদ্র্য কে অতি-দারিদ্র্যে পৌঁছানোর থেকে আটকানো আর দারিদ্র্য নির্মূল করার রাজনৈতিক-অর্থনীতির মধ্যে বিস্তর গুণগত পার্থক্য আছে।

শ্রমের শোষণ, উৎপাদনের উপকরণের উপর পুঁজির মালিকানা ও সামগ্রিক ভাবে পুঁজির চরম কেন্দ্রিকরণের ফলেই যে বিশ্বের প্রতিটি কোনে দারিদ্র্য এত চরমে উঠছে, ব্রিটেনের মতন দেশেও অনাহারে মানুষ জীবন কাটাচ্ছে, সে কথা কিন্তু দুফ্লো ও ব্যানার্জি স্বীকার করেন না বা সেই সমস্যার সমাধানে তাঁদের কোন দিক নির্দেশ নেই। মনে রাখা দরকার নিজেকে “মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদদের” থেকে অনেক দূরে সরিয়েও শুধুমাত্র “অর্থনৈতিক বৈষম্যে” পুঁজির ভূমিকা কে দেখানোর জন্যে, অসাম্যের কথা বলার জন্যে টমাস পিকেটি কিন্তু নোবেল পাননি। তাই দুফ্লো ও ব্যানার্জি যে নোবেল পেয়েছেন তার কারণ তাঁরা সাবধানে নিজেদের এক সুবিধাজনক মিস্ত্রির ভূমিকায় চিত্রিত করেছেন, সমাজ বিজ্ঞানী হিসেবে না। তাঁদের তত্ত্বে, দুফ্লো ও ব্যানার্জি দেখিয়েছেন কী ভাবে রাষ্ট্র কে ব্যবহার করে দরিদ্র মানুষ কে কিছুটা সুরাহা বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিতরেই, পুঁজিবাদ কে রক্ষা করতে দেওয়া উচিত। 

এই সার্বজনীন মৌলিক আয় যদিও নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির রাষ্ট্র কে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তির থেকে দূরে রেখে বাজারের দালাল বানিয়ে রাখার পদ্ধতির থেকে আলাদা তবুও এটা কিন্তু নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির উপদেষ্টারা আসলে পছন্দ করেছেন। তাই ভারতে কংগ্রেস পার্টি বিগত লোকসভা নির্বাচনে ব্যানার্জি’র সাহায্যে একটি ন্যূনতম আয় প্রকল্প (ন্যায়) নিজের প্রতিশ্রুতিতে যুক্ত করে যার মাধ্যমে দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষদের মাসিক ৬,০০০ টাকা করে, বাৎসরিক ৭২,০০০ টাকা সরাসরি ট্রান্সফার করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। 

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কিন্তু ন্যায়ের চরম বিরোধিতা করে এই বলে যে এর ফলে ভারতের কোষাগারের উপর চাপ পড়বে এবং চরম দুর্নীতি বাড়বে। অথচ প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি নামক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদী’র সরকার ভারতের কৃষকদের মাসে ৫০০ টাকা করে, বছরে ৬,০০০ টাকা, তিন কিস্তিতে দেওয়া শুরু করেছে। শুরুতে লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেলেও, তৃতীয় কিস্তির ক্ষেত্রে আধারের সাথে প্রকল্প কে যুক্ত করার কথা বলে সরকার অনেক কৃষককে এই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া শুরু করে। মোদী’র এই প্রকল্পের ফলে না তো গ্রামাঞ্চলে পণ্য বা পরিষেবার চাহিদা বৃদ্ধির কোন সুযোগ তৈরি হল আর না এর ফলে কৃষকের মূল সমস্যাগুলো, যেমন ফসলের ন্যায্য দাম, কৃষি ঋণ মকুব বা সেচের বন্দোবস্ত হল। 

যদিও ন্যায় প্রকল্পে সরকার কে বাৎসরিক ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হবে বলে বিজেপি চিৎকার শুরু করে ও দেশের ধনী ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, ক্ষমতায় ফিরেই যে মোদী সরকার কর্পোরেট করের উপর ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে কোষাগারের ১.৪৬ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি করে আর সরকারের আর্থিক বছরের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ যে ৩.৩% এ বেঁধে রাখার প্রস্তাব ছিল তা বকলমে উল্লঙ্ঘন করে, তার বেলায় কিন্তু কোন হট্টগোল হয় না।

বর্তমানে ভারতের অর্থনীতির উপর এক কালো ঘন মেঘ জড় হয়েছে। মোদী’র বিধ্বংসী নোটবন্দি ও জিএসটি প্রচলনের ফলে যে ব্যাপক ক্ষতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে হয় তার ফলে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হন। এর ফলে কিন্তু বাজারে চাহিদার একটা ভাটার সৃষ্টি হয় কারণ মানুষের হাতে খরচের যোগ্য অর্থ কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবে কম হতে থাকে। এর ফলে বর্তমানে গাড়ি, ক্রেতা সামগ্রী, পোশাক সহ বহু শিল্পে ব্যাপক মন্দা দেখা দেয় ও আরও অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে রাস্তায় চলে আসেন। 

এই মন্দার পরিণাম তরঙ্গের মতন বারবার করে ঘুরে ফিরে অর্থনীতি কে আঘাত করতেই থাকবে ও এর থেকে চট করে একটু স্বস্তি পাওয়ার জন্যেই দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র সার্বজনীন মৌলিক আয় কিন্তু কাজে আসতে পারতো। বিশেষ করে যখন এমএনরেগা’র মতন সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পে সরকারি খরচের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। 

বর্তমানে যদি দরিদ্র মানুষের কাছে মাসিক কিছু অর্থ আসে তাহলে তাঁরা সেই অর্থ খরচ করবেন এবং এর ফলে বাজারে পণ্যের চাহিদা ফিরবে ও তার ফলে আবার শিল্পে কর্মসংস্থান হবে। যত কর্মসংস্থান হবে তত বেশি চাহিদা সৃষ্টি হবে আর তার ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি, নতুন কোন আঘাত না পাওয়া পর্যন্ত, ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কেনিয়াতে বর্তমানে এই রকমই একটি পরীক্ষা চালাচ্ছেন দুফ্লো ও ব্যানার্জি, অথচ ভারতে এর প্রয়োজন থাকলেও সরকারের উদাসীনতায় দরিদ্র মানুষের অর্থ কষ্ট ও বেকারত্বের সমস্যা দিন-দিন বেড়েই যাবে। 

যদিও দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্ব দিয়ে বর্তমানের চাহিদার সঙ্কটের সময়ে একটি সাময়িক সুরাহা পাওয়া সম্ভব তবুও একথা বোঝা উচিত যে এই তত্ত্বের মূল লক্ষ্য কিন্তু দরিদ্র মানুষ কে রক্ষা করা নয় বরং জনগণের গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি কে বাঁচিয়ে রাখা। সরকার অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প গড়ে মানুষ কে কর্মসংস্থান দিয়ে, একটি পরিকল্পিত অর্থনীতি গ্রহণ করে জনগণ কে বাজারের অনিশ্চয়তা, চলমান ও চক্রাকারে আবর্তনশীল সঙ্কট থেকে মুক্তি দিচ্ছে না, উৎপাদনের উপকরণের উপর শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কায়েম করছে না, পণ্যের ও অর্থের বন্টনে সমাজের ভূমিকা কে প্রধান করছে না, বরং সামাজিক অর্থ দিয়ে বেসরকারি ক্ষেত্র কে বৃদ্ধি পেতে ও পুঁজি কে সঙ্কট মুক্ত হতে সাহায্য করছে। এর ফলে দরিদ্রের ক্ষমতায়ন হচ্ছে না, দরিদ্র কে দিয়ে বরং ধনীর সঙ্কট মোচন করানো হচ্ছে। 

দুই দিক থেকে বস্তু কে দেখলে তার দুটি দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র নীতি পুঁজির একচেটিয়া শোষণ ও শাসন বজায় রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে মাইক্রো-ইকোনোমিক সমস্যার, চাহিদার সমস্যার সমাধান করার জন্যে। তবে কেইনেসিয়ান অর্থনীতির মতনই দুফ্লো ও ব্যানার্জি’র তত্ত্ব আসলে ঠেকা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি কে চরম সঙ্কট থেকে ও গরিব মানুষের বিদ্রোহ থেকে বাঁচানো ছাড়া আর কিছুই না। 

দুফ্লো ও ব্যানার্জি কে আজ দ্বান্দ্বিক ভাবে বোঝাই যথেষ্ট নয়। আজ জরুরী কর্তব্য হল দরিদ্র মানুষের অর্থনীতি আসলে কী সেটা প্রতিষ্ঠা করা জনসমক্ষে। মার্কসবাদ কে বাদ দিয়ে, সমাজতন্ত্র কে বাদ দিয়ে, শ্রমিকশ্রেণীর শাসনে নতুন সমাজ না গড়ে যে দারিদ্র্য মোচন হয় না, দরিদ্র মানুষের, শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট লাঘব হয় না, অনাহার, অশিক্ষা, হিংসা ও বিদ্বেষের কোন সুরাহা হয় না তা বাংলার মানুষ কে বোঝানো একান্তই জরুরী।

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে