মমতার রাজত্বে বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবার কারণ সত্যিই এক বৃহৎ ষড়যন্ত্র

বুধবার, আগস্ট ৩১, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

মুর্শিদাবাদের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আগুন লাগার পর থেকেই যেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে আগুন লেগেছে। তাপ যে স্বাস্থ্য মন্ত্রক নিজের দখলে রাখা মমতার পক্ষে কষ্টদায়ক হচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সাংবাদিক বৈঠকে আলপটকা মন্তব্য শুনে।আগুনের পিছনে কি কারণ তা যদিও দমকল দফতরের তদন্ত করা উচিত কিন্তু মহাময়ী মমতা সরকারের নির্দেশে এবার সে কাজে নামবে রাজ্য সিআইডি, যে সংস্থার একমাত্র কাজ হলো পুলিশ মন্ত্রী মমতার খাড়া করা তত্ব কে সত্যে প্রমাণিত করা। নির্বাচনে গদি হারিয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে রাজ্যের একটি নিধিরাম সর্দার স্বাস্থ্য সমিতির উচ্চ পদে আসীন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যে কি ভীষণ দূরদর্শী তা বোধহয় "চক্রান্তের" তত্ব আসার আগে বাংলার মানুষ জানতে পারেননি। জানতে পারলে বোধহয় এবার চন্দ্রিমা কে ভোটে গো হারা হারতে হতো না।

তৃণমূলের রাজত্বে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি যে কোন গড্ডালিকায় ঢুকেছে তা দেখতে বেশি দূরদৃষ্টি লাগে না


চক্রান্তের তত্ব তো প্রতিষ্ঠা হয়েই গেছে। এয়ার কন্ডিশনার চালিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদি কাড়তে নাকি অধীর চৌধুরীর লোকেরা হাসপাতালে আগুন লাগাতে চেয়েছিল। তিনজন মানুষ, যার মধ্যে একটি ছোট মেয়েও আছে, তাঁরা হঠাৎ মারা গেলেন আর তাঁদের নিকট আত্মীয় স্বজনরা জানলেন যে মৃত্যু যে হাসপাতালে আগুন লাগলো সেই হাসপাতালের উর্দ্ধতন কতৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য দফতরের গাফিলতির ফলে লাগেনি বরং লেগেছে কংগ্রেস আর সিপিএমের (মুর্শিদাবাদে সিপিএমের হাল যদিও হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের থেকেও বেহাল) চক্রান্তের কারণে। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর মানুষের কাছে সরকারের ফরমান এলো, তাঁরা যেন বেশি দাবি দাওয়া না করেন, করলে বিপদ আছে সে কথাও বুঝিয়ে দেওয়া হলো। আর মমতার রাজত্বে স্বাস্থ্য দফতরের অব্যবস্থার কথা বলাও বা ভাবাও মহা পাপ। কারণ এই রাজ্য উন্নয়নের স্বর্গরাজ্য, এই হলো সব পেয়েছির রাজ্য। তাই তো বিরোধীরা গায়ের জ্বালা মেটাতে হাসপাতালে আগুন লাগায় !

তৃণমূলের রাজত্বে পশ্চিম বাংলার রাজনীতি যে কোন গড্ডালিকায় ঢুকেছে তা দেখতে বেশি দূরদৃষ্টি লাগে না। এক দিকে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যেমন আল্ট্রা সাউন্ড, এমআরআই, সিটি স্ক্যান, মায় এক্সরে মেশিনের অভাব, অন্যদিকে প্রতিদিন বেড়ে চলেছে রুগীর সংখ্যা। অপ্রতুল পরিকাঠামো আর গড়িমসির সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যে সকল ডাক্তার, নার্স, ও হাসপাতাল কর্মীরা মানুষ কে সুস্থ করে তোলার ভয়ানক যুদ্ধ করছেন, আর এর মধ্যেই অবহেলার ঘটনা স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে চলেছে যার ফলে মৃত্যু হচ্ছে শিশু থেকে প্রৌঢ় সকলের, আর প্রতিটি মৃত্যুর পরেই সেই মৃতের পরিবার ও স্বজনদের ক্রোধের শিকার সরকারের বদলে, তৃণমূলের মেজ-সেজ নেতাদের বদলে হচ্ছেন ডাক্তার, নার্স, আর হাসপাতাল কর্মীরা। এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদের মতন যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলো ঘটছে তার আসল কারণ তো সরকারের উদাসীনতা আর অবহেলা। কিন্তু সেই সত্য জনতা জনার্দনের থেকে গোপন করে রাখার তাগিদটা আমাদের গণতন্ত্রের ভজন গাওয়া তৃণমূলীদের কাছে বড় বেশি প্রয়োজন, তাই দরকার যে কোনো বিরোধী দলের সদস্য বা নেতাকে ধরে জেলে পুরে একটা ষড়যন্ত্রের তত্ব খাড়া করা। বয়স্ক মানুষদের আশা করি মনে আছে ১৯৭০ এর দশকে কথায় কথায় নিজের সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যবহার করা "বিদেশী হাতের" গল্প। মমতার দলের জন্ম তো সেই ফ্যাসিবাদী - মিথ্যাচারী কংগ্রেসের ঔরসেই, ফলে সেই পুরানো ষড়যন্ত্রের মদ কে নতুন বোতলে নতুন লেবেল সেঁটে বিক্রি করায় আশ্চর্য হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই।

নাটকের বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, সেই নাটক কে অতিরঞ্জিত করে একেবারে স্বপন সাহার সিনেমা বানানোতে মমতা বাঁড়ুজ্যের জুটি নেই। শুধু মমতা বাঁড়ুজ্যের একটিই খামতি থাকে যে সে জনগণ কে চিরকালই গবেট ভেবে এসেছে। এই ধরুন যখন রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন মরণ দশা, যখন ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, ইত্যাদী রোগে ভোগা মানুষ সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না, যখন হাসপাতালে আগুন লাগায় বা চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে মমতার রাজত্বে রুগীদের প্রাণ যাচ্ছে সেই হাসপাতালে যেখানে তাঁরা সুস্থ হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে এসেছিলেন, তখন  সরকারের নিজস্ব ত্রুটি ও দুর্বলতার কথা স্বীকার করে নিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করা কি বেশি জরুরী ছিল না ? কিন্তু ভারতবর্ষে কোন কালে কোন নেতা বা মন্ত্রী নিজের দলের বা সরকারের গাফিলতির কথা জন সমক্ষে স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে ? মমতা তাই সেই মমতাতে, কারণ জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর সাজে না। কারণ যে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে মমতা বা তার দল রাজনীতি করে, সেই মানসিকতা জনগণ কে গণতন্ত্রে শাসক নয় বরং প্রজা, তাও ভিখারি প্রজা, হিসেবে গণ্য করে। যাদের কিছু দান খয়রাত করলেই, দুই জন পার্টি কর্মী কে সাময়িক চাকরি দিয়ে সিভিক পুলিশ বানালেই, অসম্ভব রকমের আনুগত্য পাওয়া যায়। তাই নিজের দলের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারের কোনো আত্মসমালোচনা মমতার করা সাজে না। রাজা কে বলা যায় যে ব্যাটা তুই ন্যাংটা, রাজা নিজে কখনোই সে কথা স্বীকার করবে না।

যাবতীয় তাত্বিক ও নৈতিক কচকচানির মধ্যে একটি সত্য কিন্তু প্রকাশ্যে জ্বল জ্বল করছে, তা হলো এই যে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি, বা গণ স্বাস্থ্য পরিষেবা, চরম সংকটে ডুবে আছে, আর এই ডুবিয়ে রাখার পিছনে আছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্র কোনো বিরোধী দলের দুষ্ট বুদ্ধির পরিণাম নয়, বরং দীর্ঘ সময় ধরে সমস্ত সংসদীয় দলগুলোর সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের ফসল।

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে পঙ্গু করার কার্য শুরু করে জ্যোতি বোসের সরকার, সেই ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিক থেকে। তখন সবে সবে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির হাওয়া ঢুকতে শুরু করেছে আর তারই সাথে সাথে শুরু হয় নার্সিং হোমের আগমন। অতীতের ছোট ছোট নার্সিং হোম ও বেসরকারি বা দাতব্য হাসপাতালের জায়গায় আস্তে থাকে বড় আর মাঝারি মাপের নার্সিং হোম যাদের বেশির ভাগের মালিক ছিল সরকারি হাসপাতালে চাকরি করা ডাক্তাররা, আবার অনেক নার্সিং হোমে কমিশনের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো সরকারি ডাক্তারদের। সিপিএমের লোকাল কমিটি আর ডাক্তারি গণ সংগঠন কে হাত করেই এই ব্যবসার ভিত গভীরে শিকড় গাড়ে।পরবর্তী কালে মনমোহনীয় নয়া উদারনৈতিক বাতাসে ভেসে আসে রুবি, পিয়ারলেস থেকে এই কয়েক বছর আগে আগুন লাগা আমরি। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলোয় মানুষে কুকুরে একসাথে থাকতে শুরু করে, একটা বেডের জন্যে দালাল থেকে পার্টির নেতা সবাই কমিশন খেতে শুরু করে। ফলে প্রথমে স্বছল মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আর পরবর্তী কালে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষদেরও একটু ভালো চিকিৎসার আশায় সারা জীবনের কষ্টে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে নার্সিং হোম ও বেসরকারি হাসপাতালের শরণার্থী হতে হয়। আর এই ফাঁকেই জ্যোতি বোস আর বুদ্ধ ভট্টাচার্যের আমলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে শুরু করে নার্সিং হোমগুলো। অন্যদিকে হুহু করে মান পড়তে থাকে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। রাজ্যের সবচেয়ে নাম করা চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষা কেন্দ্র এসএসকেএম (পিজি হাসপাতাল), মেডিক্যাল কলেজ, নীল রতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ, ইত্যাদী ধুঁকতে থাকে পরিকাঠামো আর চিকিৎসকের অভাবে। রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ তুলে বামফ্রন্ট সরকার চিরকাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিজেদের কুকীর্তি চেপে রাখার চেষ্টা করতে থাকে।

পরিবর্তনের হাওয়ায় চেপে যখন মমতা ক্ষমতায় আসে তখন জন মোহিনী প্রকল্পের আড়ালে সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের হাল ফেরানোর কথা বলা হলেও (২০১২ সালে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চালু হয়) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকে সেই তিমিরেই। বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থে মমতার নেতৃত্বে চলা তৃণমূল সরকার ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও জোরে গড্ডালিকায় দিকে ঠেলে দেয়। ফলে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাল তো আরও খারাপ হতেই থাকে আর তার সাথে সাথে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর লাভের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।স্বাস্থ্য দফতর কে মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে রাখার সাথে সাথে আরইটি স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১১-১২ সালের পরে আর প্রকাশ হতে দেয়নি, এর ফলে শেষ সমীক্ষার পরে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঠিক অবস্থানটা কোথায় তা বোঝা দুস্কর হয়ে গেছে। কথায় কথায় নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির ফর্মুলা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরানোর দাওয়াই সেই বস্তা পঁচা পাবলিক - প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেলের মধ্যে খোঁজার গল্প বাদে মমতার খাতায় হাতে রয়েছে শুধু পেন্সিল।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর চাপে ভারতের শাসক শ্রেণী যখন দেশের জনগণ কে ঢপের কীর্তন শুনিয়ে শান্ত করে রাখার "উন্নয়নমূলক রাষ্ট্রের" শেষ স্তম্ভ, খাদ্য-স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে, বেসরকারিকরণের মাধ্যমে, বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর তখন কোনো প্রদেশেই গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সুস্থ্য হয়ে ওঠার আশা করা একটা অলীক কল্পনার বেশি কিছুই হবে না। কারণ বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ পুঁজির লোভ ও লালসাকে চরিতার্থ করতে যেভাবে প্রকৃতি কে ধ্বংস করে একের পর এক দেশকে নিঃশেষ করা হচ্ছে তার ফলে বেড়ে চলা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট দূষণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যে অবনতি হওয়া ভীষণ সাধারণ ব্যাপার। ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে মারণ রোগগুলোর প্রকোপ ও সংখ্যা। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া, কালা জ্বর, জন্ডিস, সহ অসংখ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াচ্ছেন। যাদের মধ্যে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা যেমন আছেন তেমনি আছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব, আরে একেবারে হতদরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তরা যদিও বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সাহায্যে আরোগ্য লাভ করতে পারেন কিন্তু সেই পরিষেবার দিকে যেতে নিম্ন মধ্যবিত্তদের পা কাঁপে, গরিব বা হতদরিদ্রদের কথা বাদ দেওয়াই ভালো। কিন্তু এই ৭০ শতাংশ মানুষের আশা ও ভরসার গণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অনেক উৎসাহী ও পরিশ্রমী এবং সৎ ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মী থাকা সত্বেও শুধু মাত্র লোকবল, পরিকাঠামো, আর্থিক অনুদান, এবং আমলাতান্ত্রিক ফিতের ফাঁসের চাপে এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জনগণের কোনো কল্যাণ হচ্ছে না।

২০১০-১১ সালের স্বাস্থ্য বিষয়ক সমীক্ষার ফলে দেখা গেছিল যে ভারতবর্ষে প্রায় ৬.৩ কোটি মানুষ প্রতি বছর স্বাস্থ্যের পিছনে খরচের কারণে দরিদ্র সীমার নিচে নেমে যান।গ্রামাঞ্চলে ৬.৯ শতাংশ মানুষ এবং শহরাঞ্চলে ৫.৫ শতাংশ মানুষ এই ব্যবস্থার শিকার।  এই সংখ্যাটা এই ছয় বছরে নিশ্চয় মনমোহন ও নরেন্দ্র মোদীর বিদেশী পুঁজি ও নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দামামা বাজিয়ে পুজো করার সৌজন্যে বেড়েছে, এবং এর প্রকোপ যে পশ্চিমবঙ্গে ছেয়ে গেছে সে কথাও নিশ্চয় সত্য, কারণ সমগ্র দেশে ২০০৪-০৫ সালের পরিসংখ্যানে ১৫ শতাংশ মানুষ ব্যাপক হারে বেড়ে চলা স্বাস্থ্য পরিষেবার মূল্যের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, আর ২০১১-১২ তে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৮ শতাংশ। জনগণের এই সংকটের সুযোগ নিয়েই তো আজ দুর্গাপুরের একটা বেসরকারি হাসপাতাল টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে রুগী (গ্রাহক) টানার চেষ্টা করার সুযোগ পাচ্ছে। আমরি থেকে অ্যাপোলো, হাসপাতালের জায়গায় পাঁচ তারা হোটেল খুলে রুগীদের ঘাড় ভেঙে টাকা নিচ্ছে। এমনকি মৃত মানুষ কে ভেন্টিলেটরে রেখে যতদিন সম্ভব টাকা রোজগার করে চলেছে।এর সাথেই তাল মিলিয়ে কেন্দ্রের মোদী সরকার ও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের ছত্রছায়ায় একের পর এক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ব্যবসার ঝাঁপি সাজিয়ে বসছে, এমনকি কোটি কোটি টাকা ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে এই সব কলেজে বকলমে ভর্তিও চলছে। অনেক দিন আগে, ১১ অক্টোবর ২০১২ এর আনন্দবাজার পত্রিকা কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই পিপিপি মডেলের মেডিক্যাল কলেজের বিরোধিতা করেছিলেন বিখ্যাত সার্জেন ডাঃ দেবী শেঠী। তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে এর ফলে মেডিক্যাল পড়াশুনা শুধু যে গরিবের হাতের বাইরে চলে যাবে তাই নয় বরং এই সব কলেজ থেকে পাশ করে যে সব স্বচ্ছল বাড়ির ছেলে মেয়েরা কোনোদিন গরিব মানুষের সেবা করবে না বরং এই ডাক্তারি বিদ্যা ব্যবহার করবে কোটি কোটি টাকা রোজগারের জন্যে।

ষড়যন্ত্র করে ধীরে ধীরে যে ভাবে ভারতের মতন গরিব মানুষের  দেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে আইএমএফ ও ডব্লিউটিও'র নির্দেশে, তার ফলে আগামী দিনে অনেক বেশি বেশি করে ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকে। ১৯৯৫ সালে ভারতের জনসংখ্যা ছিল ৯৬ কোটি আর দেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি লগ্নি ছিল ১.১ শতাংশ, আর ২০১৪ সালে ১২৩ কোটি মানুষের দেশ হয় সত্বেও স্বাস্থ্যের পিছনে বরাদ্দ বেড়ে জিডিপির ১.৪ শতাংশ হয় মাত্র। মোদী সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবার নামে শুধু নানা কায়দায় স্বাস্থ্য বীমা বিক্রি করে জনগণের ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে ছিনিমিনি খেলছে। মমতা সরকারও সেই একই খেলা উন্নয়ন ও জনকল্যাণের মোড়কে মুড়ে খেলছে। বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার হাতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বেচে দেওয়ার স্বার্থে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কে শুধু গাফিলতি করে পঙ্গু করা হচ্ছে না বরং ষড়যন্ত্র করে বিকল করে দেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের আশার শেষ ঠিকানা সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হাসপাতালগুলোকে। মমতা আর চন্দ্রিমার ষড়যন্ত্রের সমীক্ষায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে আগুন লেগে হয়তো মৃত্যু হয়েছে তিন জনের, কিন্তু যদি সরকার আর কর্পোরেট সংস্থাগুলোর এই ষড়যন্ত্র কে আমরা আরো গভীরে গিয়ে দেখি তাহলে হয়তো দেখতে পাবো যে এই ষড়যন্ত্রের জালে পড়ে সারা দেশে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ এই জন্যে মারা যাচ্ছেন যে ইচ্ছাকৃত ভাবে গণ স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। আগুনে জ্বলে মৃত্যু হলে সরকারকে বিরোধিতার তীরে বিদ্ধ করা সম্ভব হয়, কিন্তু সারা দেশ জুড়ে যে দানা মাঝিরা আজ সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পঙ্গুত্বের কারণে প্রিয়জনদের হারাচ্ছেন তাঁদের ক্ষতি করার মূল কু চক্রী যে সরকারি নেতা-মন্ত্রী-আমলা আর কর্পোরেট প্রভুরা, তারা খুব সহজেই এই অন্যায়ের শাস্তির থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হয়।জনগণকে হত্যা করার দায়ে এই অপরাধীদের শাস্তি কোন আদালত দেবে ?

    
   


   

গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বুধবার, আগস্ট ২৪, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

একদিকে দেশজুড়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সমস্ত অ-কংগ্রেসী ও বাম বিরোধী শক্তিদের ঐক্যবদ্ধ করে সিপিএমের স্বপ্নের তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলার তাগিদ আর অন্যদিকে ঘরের মাঠে বিরোধীদের দলের লোকেদের ভয় দেখিয়ে আর লোভের ফাঁদে ফেলে একের পর এক জেলা পরিষদ ও পুরসভা দখল করার তাগিদ, মোদ্দা কথা হলো নিজের ঘর কে বিরোধী শূন্য করে বিরোধীদের দাম না দেওয়ার অভিযোগ করে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে তীর ছোড়া হলো আজ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রধান রাজনৈতিক চাল। দেশজুড়ে মোদী বিরোধী গণ বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে তলে তলে পুরানো দোস্ত বিজেপির সাথে সেটিং বজায় রেখেও বিরোধিতার পারা চড়িয়ে দেশের অন্যান্য বিরোধীদের মধ্যমণি হয়ে এবার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সির দিকে যখন মমতা বন্দোপাধ্যায় নজর দিচ্ছেন, রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা, বিরোধীদের প্রতি অবজ্ঞা, ইত্যাদী অভিযোগের তীর যখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দিকে ছুড়ছেন, ঠিক সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি বিরোধী দল দ্বারা পরিচালিত গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পৌরসভা আজ তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত রাজ্য সরকার কে সেই একই অপরাধের অভিযুক্ত হিসেবে গণ্য করছেন, অভিযোগ করছেন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বঞ্চনার এবং ছলে-বলে-কৌশলে বিরোধী শিবিরে ভাঙ্গন ধরানোর প্রয়াস করার।

গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা এবং মমতা বন্দোপাধ্যায়


মমতা বন্দোপাধ্যায় সহ সমগ্র দক্ষিণপন্থী ও অতি দক্ষিণপন্থীরা চিরকাল কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের গণতন্ত্র বিরোধী বলে গালাগাল করে থাকলেও তাঁরা নিজেরা সরকারে থাকলে বিরোধীদের কি চোখে দেখেন সে কথা আজ সবারই মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। সিপিএমের সামাজিক-ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে মমতার অভিযোগ ছিল যে জ্যোতি বোস - বুদ্ধদেবরা কোনদিন বিরোধীদের মতামতকে গ্রাহ্য না করে দম্ভ নিয়ে বিরোধীদের কোনঠাসা করে নিজেদের রাজত্বকে মজবুত করার চেষ্টা করতো। মূলত সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গ বিরোধী শূন্য ছিল শেষ দুই - তিন বছর বাদ দিলে। তার আগে সিদ্ধার্থ রায়ের আমলেও পশ্চিমবঙ্গ বিরোধী শূন্য ছিল কারণ বিরোধীরা জেলে বা বধ্যভূমিতে ছিলেন, রক্তে ভেসে ছিল গণতন্ত্রের পথ। আজ মমতার আমলেও সেই পুরানো মদ কে নতুন বোতলে করে চোলাই করে চালান দেওয়া হচ্ছে। সৌজন্যে জোতদার পুত্র শুভেন্দু অধিকারী, ডিল সেটিং এর মাস্টার মুকুল রায় আর তৃণমূলের অন্যান্য সকল মেজ ও সেজ নেতারা। গণতন্ত্র আজ বিরোধী শূন্য রাখলেই কামাই বেশি হয়, মমতার দল আর দলের ভাই বোনেদের হাত খরচা ভালো হয়, আর এই কামাই বাড়াবার একমাত্র রাস্তা হলো সকল বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের প্রাণ আর মালের ভয় দেখিয়ে নিজের দিকে টেনে আনা। তাই কাল অবধি জলপাইগুড়ির যে সকল তথা কথিত বামেরা নীতি আর আদর্শের কথা বলে মমতার পিতৃ শ্রাদ্ধ করছিলেন তাঁরা আজ সকলে মুকুল - শুভেন্দুর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে তৃণমূলের ঝান্ডা নাড়াচ্ছেন। ঠিক যেমন গতকাল অবধি যে লোকটা সিপিএমের ভিতরে বিপ্লবী-বিদ্রোহী বুলি ছুটিয়ে বিমান-বুদ্ধদের নীতি কথার শুলে বিদ্ধ করতো, সেই লোকটাই নীতি কথা কে শৌচালয়ে ফ্লাশ করে তৃণমূলের টিকিটে ভোটে জিতে মমতার গুণ কীর্তন করছে। এদের দলে নিয়ে নিজেকে সততা আর পরিছন্নতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা মমতা বন্দোপাধ্যায় কি নীতির পরিচয় দিচ্ছেন তা আজ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জানা হয়ে গেছে।

গণতন্ত্রের গান গাওয়া সরকারী আর আধা সরকারী বাম ও প্রাক্তন নকশালদের আজ প্রচন্ড ব্যথা লেগেছে মমতার এহেন আচরণে। অথচ সেই বাম আমলেও এই খেলাই যে চোরাগোপ্তা ভাবে চলতো সে কথা এখনো এই রাজ্যের মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। হয়তো অনেক রাখ ঢাক করে বাম আমলে দুর্নীতি আর বিরোধীদের সপক্ষে টেনে এনে পঞ্চায়েত থেকে পৌরসভা অবধি কমিশন কামাবার প্রক্রিয়াটা চলতো, যা আজ মমতার আমলে চোখের সামনে একেবারে দিনের আলোয় চলছে, তবুও ঘটনা হচ্ছে যে এই রাজ্যে আজ যারা অভিযোগ করছেন গণতন্ত্র হরণের তাঁরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কালে কোনো না কোনো ভাবে বিরোধীদের সাথে ঠিক এই ভাবেই ব্যবহার করেছেন। আর তাই হয়তো মমতার ভয়ে আর ক্ষমতার লোভে যখন বিরোধী শিবিরে ভাঙ্গন ধরছে তখন রাজ্যের মানুষ অবাক হচ্ছেন না। সমগ্র বিরোধীদের চেয়ে মাত্র কয়েক লক্ষ বেশি ভোটে জিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে মমতার দম্ভ বুদ্ধের চেয়ে কম বাড়েনি এ কথা আজ দিনের আলোর মতন স্পষ্ট। তৃণমূল নেত্রী জানেন যে দল কে ২০২১ সালের নির্বাচনী বৈতরণী ও তার আগে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন ও ২০২০ সালের পুর নির্বাচনে জিততে হলে এখন থেকেই সন্ত্রাস কে লাগামহীন ঘোড়ার মতন ছোটাতে হবে। জনসমক্ষে ভাবমূর্তি ধরে রাখতে দুই একটি প্রমোটার আর কাউন্সিলার কে না হয় কিছুদিন জেলে রেখে পরে জামিনে বের করে আনা যাবে, কিন্তু প্রমোটারীর আর ঠিকাদারির দালালির টাকার উপর থেকে রাজ্যের কোনো অঞ্চলে নিজের একচেটিয়া অধিকার মমতা বন্দোপাধ্যায় শিথিল করতে পারেন না। তিনি এবার বেগ দিচ্ছেন কেন্দ্রে ক্ষমতার চাঁদ ধরার জন্যে, অনেকটা ২০০৯ সালের পুনরাবৃত্তি করার আশায় আর কেন্দ্রে প্রতিযোগিতা করতে চাই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা যা এই গরিব রাজ্যে প্রমোটারী আর সিন্ডিকেট রাজ বাদ দিয়ে অন্য কোথাও পাওয়া দুস্কর। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে তৃণমূল নৈব নৈব চ করে টিকে আছে, আর তাই সারা দেশের মধ্যমণি হয়ে ২০১৯ সালে ময়দানে নামার তাগিদটা বেশি বলে রাজ্যের মানুষকে দেখতে হবে নির্লজ্জ তৃণমূল নেতাদের টাকা খাওয়া আর শুনতে হবে নেত্রীর শুদ্ধিকরণের প্রতিশ্রুতি।

বিরোধী শূন্য গণতন্ত্র নাকি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রে নাকি শাসকের চেয়ে বিরোধীদের মূল্য বেশি, গণতন্ত্র মানে নাকি বিরোধীদের কথাও শোনা এবং সবাই কে সাথে নিয়ে চলা। আশা করি এই সমস্ত প্রবচন পাঠকেরা এর আগেও আনন্দ বাজার মার্কা বাজারী সংবাদ মাধ্যমের পাতায় বারবার পড়েছেন, কিন্তু বাস্তব জীবনে এর সাথে কোনো মিল খুঁজে পাননি। মাঝে মাঝে আমাদের কর্পোরেট মিডিয়া গোষ্ঠীগুলি বিলেতের উদাহরণ টেনে এনে আমাদের যদিও বলে যে গণতন্ত্রে বিরোধীদেরও বিশাল ভূমিকা আছে, তবুও বাস্তবে ঘটনা হলো যে ভোটে জিতে যে ক্ষমতায় আসে সে কোনদিন বিরোধীদের কথা শুনে কাজ করতে আসে না, সে আসে পাঁচ বছরে আখের গুছিয়ে নিয়ে পরবর্তী পাঁচ বছরে ক্ষমতায় থাকার পথ সুগম করতে।কেউ কেউ তৃণমূলের মতন তাড়াতাড়ি চেটেপুটে থালা পরিস্কার করার ঠেলায় পড়ে সারদা - নারদা প্রভৃতি কান্ডে জড়িয়ে পড়ে আর কেউ কেউ সরকারী বামেদের মতন ৩৪ বছর ঠাকুরঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে কলা খেয়ে শেষে ধরা পড়ে যায়। এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক সেট আপে রাজনীতি করতে আসার মূল উদ্দেশ্য হলো টু পাইস ইনকাম করা। শুনেছি মুম্বাই আর দিল্লিতে নাকি বিলেতের কায়দায় রাজনৈতিক পার্টিতে রীতিমত বেতন নিয়ে চাকুরী করা যায়। সিপিএম আবার এই ব্যবস্থাটি কে একটু বিপ্লবী বাম আতর চড়িয়েছিল এক কালে হোল টাইমারদের বেতন দিয়ে পুষে রেখে। তাই এই দেশে, বা এই ব্যবস্থায় যারাই রাজনীতিতে আসে তাঁদের উদ্দেশ্য হয় কিছু পয়সা কামিয়ে নেওয়া, আর পয়সা কামানো যাবে একমাত্র বড় বড় ব্যবসায়ী আর কর্পোরেট সংস্থাগুলোর থেকে, গ্রামের জোতদার আর আড়তদার-মজুতদার-কালোবাজারীদের থেকে, পাড়ার প্রমোটার আর বৈশ্যালয়ের মক্ষীর থেকে, আর এরা তখনই টাকা দেবে যখন এদের ব্যবসার ভালো মন্দ এই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে, বা সোজা কথায় যখন সেই রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলের সরকারী ক্ষমতা থাকবে বা অন্তত পক্ষে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার প্রবল সম্ভাবনা থাকবে, যেমন ধরুন এই ২০১১ সালে মমতার পিছনে কি বিপুল ভাবে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো, প্রমোটাররা, জমি আর নারীর দালালরা, জোতদাররা টাকা ঢেলেছিল, অথবা এই ২০১৪ সালের নির্বাচনে কি বিপুল পরিমানের অর্থ বড় বড় বহুজাতিক ও দেশী মুৎসুদ্দি কর্পোরেট সংস্থাগুলো মোদীর পিছনে ঢেলেছিল। এই টাকা দেওয়া হয় শান্তিতে ব্যবসার নামে লুটপাট চালাবার জন্যে, আইনের খোঁচা থেকে বাঁচতে, আর যে কোনো সমস্যায় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন পেতে। আর জমি, নারী, খনিজ পদার্থ থেকে বাড়ি, গাড়ি, ঠান্ডা পানীয় নিয়ে ব্যবসা করে কামিয়ে খাওয়া লোকেদের জন্যে কোন রাজনৈতিক পার্টি ভোটে জিতলো তার চেয়ে বেশি জরুরী হলো যে কার রাজত্বে বেশি আমদানির সুযোগ আছে। ঠিক তেমনি  ভাবেই সমস্ত নির্বাচনী (সরকারী ও আধা সরকারী বাম সহ) পার্টির কাছে এবং এই দলের নেতাদের কাছে ভোটে জেতার তাগিদ হলো বেশি আমদানির তাগিদ বা কোথাও কোথাও বর্তমান আয় কে বজায় রাখার একমাত্র পথ। আচ্ছা ধরুন ক্ষমতাহীন এসইউসি বা সরকারী নকশালপন্থী দলগুলোকে স্বেচ্ছায় বড় বড় ব্যবসায়ী আর দালালেরা টাকা দেবে কেন যদি না এদের কোনো সংসদীয় ক্ষমতা না থাকে? কিন্তু সরকারী ভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় না থেকেও রাজ্যে শক্তির হিসেবে আর কিছু টিম টিম করে জ্বলতে থাকা পুরসভায় ক্ষমতায় থাকার দরুন কংগ্রেস আর সিপিএম তবুও অনেক টাকা আয় করতে পারে। আর সেই টাকার উত্সের মূল জায়গা হলো এদের দখলে থাকা জেলা পরিষদ বা পুরসভাগুলো, যেখানে ঠিকা পাওয়ার জন্যে কমিশন চলে আর কমিশনের বা দালালির বখরা সেই দরজায় দাড়ানো আর্দালি থেকে রাজ্য নেতৃত্ব অবধি পৌঁছয়। তৃণমূলের টাকার ক্ষিদে এতই বেশি যে পশ্চিমবঙ্গে শিবরাত্রির সলতের মতন জ্বলতে থাকা সমস্ত বিরোধীদের আস্তানায় এবার ওরা হাত মেরেছে আর টেনে নিচ্ছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোটে লড়ে জেতা জনপ্রতিনিধিদের। আর এখানেই কাটা ঘায়ে একেবারে নুন ঘষা হয়ে গেছে বিরোধীদের জন্যে। প্রবল জোরে তাঁরা চিৎকার শুরু করেছে “গণতন্ত্র বিপন্ন” বলে।

আমাদের সামনে যে বস্তুটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রং করে “গণতন্ত্র” হিসেবে পরিবেশন করা হয় তার স্বরূপ বা শাঁসটা কিন্তু খোলের চেয়ে একেবারে আলাদা।এই গণতন্ত্র নামক বস্তুটা আসলে বড় লোকেদের, টাকাওয়ালা কুমিরদের স্বার্থে তৈরি একটা গরিব মারার মেশিন যার মধ্যে যে কোনো সাধু ব্যক্তিই নিজের সততা রক্ষা করতে পারবে না। বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি এবং তার ভারতীয় মুৎসুদ্দি কর্পোরেট দালালেরা প্রথমেই ঠিক করে নেয় যে কাদের দিয়ে ওদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য পূরণ হবে এবং সেই রাজনৈতিক শক্তি কে, এমনকি তারা যদি চরম বিপ্লবী সেজে থাকা বামপন্থী হয় তবুও তাদের নির্বাচন জেতাতে বিভিন্ন কর্পোরেট শিবির খেলায় নামে। প্রত্যেকটি সংসদীয় রাজনৈতিক দল কোনো না কোনো বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থার দালাল এবং এই দলগুলির মধ্যে যে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয় তা আসলে বিভিন্ন বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার নিজেদের ব্যাবসায়িক প্রতিপত্তি, বিভিন্ন বিদেশী শক্তির নিজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা বাদে আর কিছুই নয়। কারণ বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আসল প্রতিযোগিতা হলো গুটিকয়েক বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থার দ্বারা এশিয়া-আফ্রিকা-দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাজার দখল করে, প্রাকৃতিক সম্পদ, ও শ্রম লুট করে চরম মুনাফা আয় করার প্রতিযোগীতা। আর এর ফলেই সৃষ্ট হয় শাসকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরস্পরের সাথে ক্ষমতা নিয়ে মারামারি। যদিও এদের নীতি আর আদর্শ মোটের উপর একই রকমের, তবুও এরা লড়াই করে নিজেদের বিদেশী মালিক ও তাদের দেশী দালালদের স্বার্থে। কংগ্রেস আর বিজেপি তো বটেই তৃণমূল আর সিপিএমের মতন দলগুলোও কোনো না কোনো বৃহৎ কর্পোরেট শক্তির স্বার্থ রক্ষা করে আর তাই এদের ক্ষমতা দখলের লড়াই ঝুটো গণতন্ত্রের দেউড়ি পার হয়ে রক্তাক্ত লড়াইয়ে পরিণত হয়। আর এই লড়াইতে চাপে পড়ে বা বেশি খাওয়ার লোভে শিবির পরিবর্তন করা কোনো বড় কথা নয়। আর গণতন্ত্রে বিরোধীদের অধিকার নিয়ে যেসব টেক্সট বুক গণতন্ত্রী আর তথাকথিত সমাজবাদী বামেরা গলা ফাটায় তারা আসলে লুটের মাল সরকারপক্ষ কে বিরোধী পক্ষের সাথে ভাগ করে খাওয়ার পক্ষে ওকালতি করে। কারণ শেষ বিচারে এদের রাজনীতি করার উদ্দেশ্য হলো অর্থ আয় করা, অনেক অনেক অর্থ আয় করা, চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে অনুজ পাণ্ডের মতন, উত্তর প্রদেশ সহ অন্যান্য উত্তর ভারতীয় রাজ্যের রাজনীতিবিদদের মতন, রাজার হলে জীবন যাপন করা গরিব প্রজার মাঝে। এত খাঁটি সামন্তবাদী চেতনার মানুষ এই সোনার দেশের বাইরে কোথায় আর পাওয়া যাবে?

গণতন্ত্র চিরকাল শাসক শ্রেণীর, অর্থাৎ যে সামাজিক-আর্থিক শ্রেণী একটি দেশে বা সমাজে সবচেয়ে শক্তিশালী শ্রেণী হিসেবে বিরাজ করে, সেই শ্রেণীর স্বার্থে চলে। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রচন্ড ভক্তি সহকারে শাসক শ্রেণী, অর্থাৎ জোতদার, জমিদার, দালাল পুঁজিপতি, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর স্বার্থে খাটে আর লাভের গুড় শাসক শ্রেণী কে চাটায়। এই ব্যবস্থার ভিতরে গিয়ে গরিব মানুষ, শোষিত জনজাতির মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ কোনোদিনই মুক্তি পাবেন না তাঁদের উপর চলতে থাকা নির্মম শোষণ ও অত্যাচার থেকে। শোষিত মানুষের মুক্তির সব চেয়ে বড় শত্রু তো এই জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসে থাকা পঁচা গলা ব্যবস্থাটাই। তাই এই ব্যবস্থাটাকে, শোষণের উপর টিকে থাকা ব্যবস্থাটাকে উৎখাত করেই গরিব মানুষ মুক্তি অর্জন করতে পারেন শোষণ ও অত্যাচার থেকে আর সেই উৎখাত করার স্বার্থে আজ গরিব মানুষকে ব্যাপক সংগ্রাম করতে হবে সকল ধরনের শাসক শ্রেণীর দালালদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া মুক্তির আর কোনো পথ নেই, কোনোদিন ছিলও না।    

উনায় দলিতদের মহা সমাবেশ ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসকশ্রেণীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল

মঙ্গলবার, আগস্ট ১৬, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

উনায় দলিতদের মহা সমাবেশ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল মোদী সরকারকে

১৫ই আগস্ট ভারতের নানা প্রান্তে সরকারী উদ্যোগে স্বাধীনতা দিবস পালন করা হলেও আসল স্বাধীনতার পথে পা বাড়ালেন লক্ষ লক্ষ দলিত মানুষ, খাস নরেন্দ্র মোদীর ঘাঁটি আর হিন্দুত্ববাদের গবেষনাগার গুজরাটের বুকে।ব্রাক্ষণত্ববাদী সমাজের অত্যাচার হাজার হাজার বছর ধরে যে দলিতেরা মুখ বুজে সহ্য করে গেছেন আজ তাঁরা আওয়াজ তুলেছেন যে এই অত্যাচার, এই শোষণ আর এই অপমান তাঁরা আর মুখ বুজে মেনে নেবেন না। মনুবাদী সমাজের রক্ষকদের চোখে চোখ রেখে নিজেদের বিদ্রোহী স্পর্ধার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে দলিত জনতা জানান দিলেন যে গুজরাট মোদী বা আরএসএস এর বাপের সম্পত্তি নয়, গুজরাট সমগ্র খেটে খাওয়া গরিব মানুষের, দলিত - মুসলমান আর আদিবাসীদের। যে গুজরাটিরা আজ অবধি গরু কে মাতৃ রূপে পুজো করে এসেছে এবার যেন গরুর শেষকৃত্য তারাই সম্পন্ন করে।

জিগ্নেশ মেভানি ও দলিত প্যান্থারের ডাকে অনুষ্ঠিত হওয়া উনার এই বিশাল দলিত সমাবেশে দলিত জনতা নিজেদের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকারের জন্যে, সম্মানের জন্যে এসেছিলেন এবং পথে আসতে আসতে এদের বারবার লড়তে হয়েছে হিন্দুত্বের লেংটি পরিহিত বজরং দল ও আরএসএস এর সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত নেড়ি কুকুরদের সাথে। বিজেপি আর আরএসএস নানা কায়দায় চেষ্টা করেছিল এই মিছিল কে আটকাতে; এই মিছিলের থেকে দেশের সমস্ত কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, মোদী নানা নাটক করে নিজের ঝুটো দলিত প্রেম জাহির করে গুজরাটের দলিতদের ঠেকিয়ে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে নিজেদের দলিত প্রেমী সাজাবার চেষ্টা করেছিল, নানা ভাবে দলিত আন্দোলনকারীদের উপর দমন পীড়ন ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়, তবুও শেষ লড়াইতে এই সমস্ত বাঁধা বিঘ্নতা টপকিয়ে দলিতদের মিছিল আহমেদাবাদ থেকে উনায় পৌঁছালো। সেই উনা যেখানে গরুর চামড়া ছাড়ানোর কারণে দলিতদের গাড়ির সাথে বেঁধে অমানবিক ভাবে চাবুক ও লাঠি পেটা করেছিল সংঘ পরিবারের কর্মীরা। যাদের এই গতকাল অবধি “গো-রক্ষক” বলে সম্মানিত করতো মোদীর সরকার। চাপে পড়ে যদিও মোদী দলিত ভোটের চিঁড়ে ভেজাতে, বিশেষ করে আসছে বছরের উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে, গো-রক্ষকদের সম্পর্কে মেপে মেপে কটু কথা বললো, ভালো আর খারাপ গো-রক্ষকদের পার্থক্য দেখালো, তবুও আজ দলিতদের হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডার তলে টেনে আনতে আরএসএস আর নরেন্দ্র মোদী সমান ভাবে ব্যর্থ। বরং উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপির দলিত ভোট ব্যাঙ্ক, যা ২০১৪ সালের মোদী হাওয়ায় সৃষ্টি করা হয়েছিল, তাতেও ভাঙন ধরেছে। গরু আর ব্রাক্ষণত্ববাদী অত্যাচারের কথা ছেড়ে দিলেও এই কিছুদিন আগে যে দয়াশংকর সিংহ নামক রাজপুত ক্ষত্রিয় নেতাকে দলিত নেত্রী মায়াবতীর বিরুদ্ধে জঘন্য মন্তব্য করার জন্যে দল থেকে ছয় বছরের জন্যে বহিস্কার করা হয়েছিল সেই লোকটার সাথে খোলাখুলি বিজেপির সমস্ত নিচু ও মধ্য শ্রেণীর নেতা ও কর্মীদের মাখামাখি এবং দয়াশংকর কে উচ্চ জাতির নায়ক বানিয়ে মাথায় তুলে নাচানাচি দেখে উত্তর প্রদেশের দলিত সমাজ বুঝতে পেরেছে যে তাঁদের মুসলমান বিরোধী বিদ্বেষের মাধ্যমে নিজেদের দিকে টেনে রাখার চেষ্টা যে বিজেপি আর আরএসএস করে তারা আসলে কি চরম ভাবে মনুবাদের দর্শনে বিশ্বাসী, কি চরম দলিত বিরোধী।

আজ ভারতবর্ষ জুড়ে দলিত সমাজ উঠে দাঁড়াচ্ছে। যে অন্ধ্র প্রদেশের বর্তমান রাজধানী হায়দ্রাবাদে দাঁড়িয়ে মোদী সাহেব নাটক করে গো-রক্ষকদের বললে দলিতদের ছেড়ে তাকে গুলি করতে, খুন করতে, সেই অন্ধ্রের মাটিতে গো-রক্ষার নামে দলিতদের উপর আক্রমণ করলো উচ্চ জাতির জোতদারদের ফৌজ। মোদীর ভাষণের পরেও সমগ্র গুজরাট জুড়ে সংঘ পরিবারের গুন্ডাদের দাপাদাপি চললো দলিতদের উনার মিছিলে যাওয়ার থেকে আটকাতে। কিন্তু এত সত্ত্বেও আরএসএস আর মোদী কলকে পেল না। লক্ষ লক্ষ দলিতের কন্ঠে ধ্বনিত হলো উনায় জড়ো হওয়া দলিতদের স্লোগান - “গরুর লেজ তুমি রাখো, আমায় আমার জমি দাও” - অর্থাৎ এবার থেকে আর গুজরাটের দলিতেরা সে সব কাজ করবেন না যে কাজ তাঁদের দলিত বানায়। সারা গুজরাট জুড়ে দলিত সমাজ আর গরুর শেষকৃত্য করবে না, তাঁরা উচ্চ জাতির পায়খানা আর পেচ্ছাপ পরিস্কার করবেন না, তাঁরা আর দলিত থাকবেন না, স্বাধীন মানুষ হবেন। ১৫ আগস্টের দিন যখন সারা দেশ জুড়ে শাসক শ্রেণী ধার্মিক রীতির মতন করে স্বাধীনতা দিবস পালন করে খেটে খাওয়া মানুষ কে জোর করে বোঝাবার চেষ্টা করে যে তাঁরা স্বাধীন ঠিক তেমনি এই বছর থেকে সমগ্র গুজরাট এবং সমগ্র ভারতবর্ষের দলিত ও শোষিত সমাজের কাছে ১৫ই আগস্ট স্মরনীয় হয়ে থাকবে উনা দিবস হিসেবে, সংকল্প দিবস হিসেবে, যতদিন না দলিত সমাজ ও সমগ্র শোষিত জাতি ও সম্প্রদায় ব্রাক্ষণত্ববাদী শোষণের জাঁতাকল ভেঙ্গে মুক্ত না হচ্ছেন।

ভারতবর্ষের দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের উলঙ্গ রূপটি শুধুমাত্র বিজেপি ও আরএসএস এর শাসনকালেই সম্মুখে আসে এবং মিথ্যার সব দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ে। ভারতের খেটে খাওয়া জনগণ আজ শুধুমাত্র বিজেপির শাসনেই পরিস্কার ভাবে নগ্ন কর্পোরেট ও ব্রাক্ষণত্ববাদী শোষণ কে দেখতে পায়। কংগ্রেসী শাসনে এই নগ্ন কর্পোরেট পুজোটা অনেক ঢেকে ঢুকে ও কল্যাণকারী রাষ্ট্রের ভাওতার আড়ালে হয় আর ব্রাক্ষণত্ববাদ ও হিন্দুত্ববাদ রাতের আঁধারে দাঁত নখ বের করে আক্রমণ করে। বিজেপির বেলায় সেই রাখঢাক করার কোনো দরকার নেই, কারণ রাখ ঢাক করলেই রাষ্ট্র যন্ত্রের মালিক শাসক শ্রেণী পলিসি পারাল্যসিস এর দোহাই দিয়ে সরকার বদল করার ছুতো খুঁজবে।
তাই তো এই কয়েকদিন আগে যে লোকটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে দলিত স্বার্থের কথা বলছিল সেই লোকটাই আবার লাল কেল্লার ছাতে দাঁড়িয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেওয়ার সময়ে খুব সযত্নে দেশ জুড়ে বেড়ে চলা দলিত ও আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের ঘটনাকে এড়িয়ে যায়। এই লোকটার দলের মন্ত্রীরাই এক বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য কে চাপ দিয়ে দলিত ছাত্রদের পড়াশুনায় ছেদ টানে, যার ফলে প্রাণ হারাতে হয় রোহিথ ভেমুলার মতন তরতাজা মেধাবী প্রাণ কে। আর মৃতের মা কে শুনতে হয় নানা ধরনের গঞ্জনা আর গালমন্দ এই বিজেপির খোঁচরদের থেকেই।

উত্তর প্রদেশের ভোটে জিততে বিজেপিকে হাতিয়ার করতেই হবে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাকে এবং ভালো ভাবে দাঙ্গা লাগিয়ে মানুষের প্রাণ নিতে পটু লোকজনের অভাব মার্কিন পুঁজির পা চাটা কুকুর সংঘ পরিবারের ছাউনিতে কোনদিনই হয়নি। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের মতন এক রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা রাজ্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করা অনেক বছর ধরেই সুবিধাজনক রাজনৈতিক কদম ছিল। দলিত ও শুদ্র জাতির মানুষদের চিরকালই উচ্চ জাতির দাঙ্গাবাজরা নিজেদের পেয়াদা হিসেবে ব্যবহার করেছে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত দাঙ্গায়। দলিতদের সেই পদাতিক বাহিনী হিসেবে হিন্দুত্ববাদের কাছে অপরিসীম গুরুত্ব । যদিও দাঙ্গায় পদাতিক বাহিনী হিসেবে কাজ ফুরোলে সেই দলিতের মাথায় জুতো মেরেই ব্রাক্ষণত্ববাদ নিজেকে উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ রূপে জাহির করার প্রচেষ্টা করে। দলিতদের মনুবাদীদের ঘুঁটি হিসেবে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় যোগদান করার কারণ সম্পর্কে উত্তর প্রদেশের বহুজন আন্দোলনের জনক কাঁশি রাম বলেছিলেন যে এর শিকড় রয়েছে দলিতদের সাবর্ণ সমাজের উপর আর্থিক ও সামাজিক নির্ভরতার মধ্যে। কাঁশি রামের মতে যেহেতু জমির মালিকানা মূলতঃ উচ্চ জাতির ক্ষত্রিয় ও শূদ্রদের এক অংশের হাতে কুক্ষিগত, ব্যবসা বাণিজ্য যেহেতু বৈশ্য জাতির দ্বারা কুক্ষিগত তাই এদের পক্ষে হয় রোজগারের নামে, বা মদের বোতলের বিনিময়ে, বা দু বেলার আহারের বিনিময়ে দলিতদের মুসলিম নিধন যজ্ঞে নামানো খুবই সহজ। আর উত্তর ভারতে এই কাজটাই আরএসএস দীর্ঘদিন ধরে জাতিহীন ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজের নামে করে চলেছে। তাই যদি মদ আর রুটির হাতছানি সত্বেও দলিত সমাজ হিন্দুত্বের পতাকার তলার থেকে বের হয়ে এসে নিজস্ব স্বাধীন উদ্যোগে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ক্ষমতার লড়াইতে সামিল হয় তাহলে আরএসএস এর মতন শক্তির কাছে তা হবে মৃত্যু পরোয়ানা। কারণ দলিত এবং শূদ্রদের ছাড়া শুধু ব্রাক্ষণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য জাতির সম্মিলিত শক্তি দেশের জনসংখ্যার ২৬ শতাংশের বেশি হওয়া মুশকিল। আর এর ফলে আরএসএস ও বিজেপির হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চিরকালের মতন পাঁকে ডুবে যাবে।

গুজরাটের দলিতেরা অনেক মার খেয়ে, অনেক চোখ রাঙানি, অনেক শাসানি সহ্য করে উনায় মিছিলে যোগ দেন ও সংকল্প নেন এক নতুন বিদ্রোহের। এর ফলে মিছিল থেকে ফেরার পথে পাতিদার ও রাজপুতদের হাতে আক্রান্ত হন দলিত আন্দোলনকারীরা। যেহেতু গুজরাটে দলিতেরা বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক নয় তাই তাঁদের সুরক্ষা দিতে বিশেষ তাগিদ অনুভব করেনি গুজরাট সরকার। আর পুলিশের চোখের সামনে সংঘ পরিবারের কর্মীদের সমর্থনে উচ্চ জাতির সামন্তপ্রভুদের দলিতদের উপর এই আক্রমণ দেশের কর্পোরেট মিডিয়া ঢেকে রাখতে চাইছিল বালুচিস্তান নিয়ে মোদীর বক্তব্যের ঢোল বাজিয়ে। তবুও আগুনের গতিতে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিবাদে মুখর হয় দেশের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি।

দলিত প্যান্থারের ডাকে এই উনা চলো'র ডাক গুজরাটের দলিত সমাজের কাছে এক আলোড়ন যেমন সৃষ্টি করেছে, তেমনি করে সারা দেশে দলিত আন্দোলনে এখনো প্রভাব ফেলতে পারেনি, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে, যে রাজ্যে মূল ধারার রাজনীতির পাঁকে শাসকশ্রেণীর স্বার্থে দলিত আন্দোলনকে বেঁধে রেখেছেন মায়াবতী। তবুও উনার দলিত আন্দোলনের রেশ এত তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার নয়, কারণ গুজরাট ব্রাক্ষণত্ববাদ ও মনুবাদের এক শক্ত ঘাঁটি আর তীব্র জাতি বিদ্বেষ দ্বারা লালিত পালিত গুজরাটি বৈশ্য জাতি, যা গুজরাটের শাসক জাতি, কোনো ভাবেই দলিতদের ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনা কে সহ্য করবে না আর যে কোনো প্রকারে গুজরাটের শূদ্র সমাজকে দলিত আন্দোলনের বিরুদ্ধে চালিত করবে এবং দলিত ও মুসলিমদের মধ্যে যে সংগ্রামী ঐক্য তৈরি হয়েছে তা ভাঙার চেষ্টা করবে। গুজরাটি বৈশ্য জাতি দেশের সর্বশক্তিমান ও সবচেয়ে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল জাতি, যাদের মুঠোয় বড় বড় শিল্প, ব্যবসা, আর লগ্নি পুঁজির ফাটকাবাজি। এর ফলে সরকার যে এদেরই গোলামী করবে তা একটি শিশুও বলতে পারবে। ফলে লড়াই শেষ হয়নি, বরং উনায় ১৫ আগস্ট যে লড়াইয়ের সূচনা হলো তা আগামী দিনে আরো তীব্র হবে এবং এই লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করতে হলে দলিত জনতাকে গুজরাটের উচ্চ জাতিগুলোর হাত থেকে আর্থিক ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে হবে, এবং এর একমাত্র পথ হতে পারে এক সার্বিক কৃষি বিপ্লবী সংগ্রাম যা সামন্তপ্রভুদের কবল থেকে জমি ও রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে দলিত গরিব কৃষকদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কায়েম করবে। এই লড়াই বাদে বাকি সব লড়াইয়ের শেষে আর্থিক ক্ষমতার অভাবে চিরকালই দলিত আন্দোলন সাবর্ণ শাসকশ্রেণীর সম্মিলিত শক্তির সামনে হেরে যাবে। আজ যাতে দলিতদের আর হারতে না হয় তার জন্যে সমগ্র গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে এসে রাজনৈতিক ভাবে সামিল হতে হবে এই লড়াইয়ে এবং এই লড়াইকে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ল্যাপটপ নয় কাশ্মীরের জনতা শুধু স্বাধীনতা চান

মঙ্গলবার, আগস্ট ১৬, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

ল্যাপটপ নয় কাশ্মীরের জনতা শুধু স্বাধীনতা চান


কাশ্মীরের মানুষ, ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা যখন সর্বত্রে ভারতীয় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে দখলদারি আর আগ্রাসী শক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে পাথর ছুড়ে ছুড়ে নিজেদের স্বাধীনতার দাবি জানাচ্ছেন, যখন আধা সামরিক বাহিনীর হাতে খুন, ধর্ষণ, আর ছররার আঘাতে অন্ধ ও আহত হয়েও কাশ্মীরের মানুষ প্রাণের চেয়ে বেশি প্রিয় স্বাধীনতার দাবির থেকে এক কদম পিছিয়ে আসতে রাজি নন, যখন সমগ্র ভারতের উচ্চ জাতির হিন্দুদের প্রবল ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়েও কাশ্মীরের মানুষ মানবতার পরিচয় দিয়ে ভারতীয় জনতা ও ভারতীয় শাসকশ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য রেখা টেনে সংগ্রাম করে চলেছেন তাঁদের জন্মগত অধিকার আদায় করে নিতে, ঠিক তখনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীর থেকে হাজারো মাইল দূরে মধ্যপ্রদেশের মাটিতে নিজের দলের কর্মী ও ভাড়াটে ভিড়ের সামনে কাশ্মীরের প্রসঙ্গে বললো যে কাশ্মীরের সমস্যা উন্নয়নের সমস্যা, পাথরের বদলে কাশ্মীরের ছাত্র যুবদের হাতে ল্যাপটপ তুলে দিলে তাঁরা নাকি শান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন, বিদ্রোহের অবসান হবে পাকা রাস্তা গড়ে আর স্বনিযুক্তি প্রকল্পের দৌলতে। যদিও মোদীর উন্নয়নের মডেল রাজ্য গুজরাটের মাটিতে আজ ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দলিত জনগণ এক অভিনব বিদ্রোহে নেমেছেন যার তাপে নরেন্দ্র ঘনিষ্ঠ আনন্দি বেন প্যাটেলের মুখ্যমন্ত্রীর চাকরিটা গেছে। দলিতেরা লড়ছেন এবং তাঁদের তীব্র লড়াই ও ধীরে ধীরে মুসলমান আর দলিতদের মধ্যে গড়ে উঠতে থাকা ব্রাক্ষণত্ববাদ ও হিন্দুত্ববাদ বিরোধী সংগ্রামী ঐক্য শাসক শ্রেণীর বিশ্বস্ত নেড়ি আরএসএস ও বিজেপির অনেক কষ্টে সৃষ্টি করা ধর্মীয় মেরুকরণের নীতির মুখেই মলত্যাগ করছে, যার পরিণাম হলো যে উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিকে যাতে গুজরাটের দলিতদের তীব্র সংগ্রাম প্রভাবিত না করতে পারে তাই নরেন্দ্র আজ চিৎপুরের যাত্রার কায়দায় ন্যাকা ন্যাকা অভিনয় করে দলিতদের নিজেদের কোঁচরে বেঁধে রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে, আর গুজরাটে পাঁকে পড়েও নরেন্দ্র উন্নয়নের সোনার পাথরবাটির স্বপ্ন দেশের অন্যান্য জায়গার দলিত মানুষদের দেখিয়ে চলেছে ভোটে জেতার স্বার্থে। সেই উন্নয়ন আর প্রযুক্তির গল্প মোদী কাশ্মীরের বিক্ষুব্ধ মানুষকেও শোনাতে চায়।

ভারতের শাসকশ্রেণীর জন্ম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔরসে, সাম্রাজ্যবাদের জারজ সন্তান এই শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিরা খেটে খাওয়া শ্রমিক-কৃষকদের রক্ত আর শ্রম শুষে নিয়ে কটা রুটির টুকরো ছুড়ে দিয়ে ভাবে গরিব মানুষগুলো চুপ করে ওই রুটি চিবিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে আর শোষণ অত্যাচারের রোলারের ছোটার পথে কোনো রকমের বাঁধার সৃষ্টি করবে না। দান খয়রাত করে শোষিত মানুষের মুখ বন্ধ করার রাজনীতি মোদী শুরু করেনি, এটা শাসকশ্রেণীর এক বহু পুরানো পদ্ধতি, তবে যেহেতু গরিবের সারি প্রচন্ড লম্বা তাই এই পাইয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করার কৌশল বারবার ব্যর্থ হয়। গরিবের মুখ বন্ধ করার মতন খয়রাত করার সামর্থ্য তো স্বয়ং মার্কিন শাসকশ্রেণীর নেই তো মোদী বা অন্যান্য ভারতীয় নেতারা কোন ছার।

কাশ্মীরে কিছু কাশ্মীরি দালাল কিনে, উত্তরপ্রদেশে কিছু দলিতকে কিনে, মোদী ভেবেছিল সবার মুখ বন্ধ করে দেবে, কিন্তু সে আশা গুড়ে বালি। সমগ্র দক্ষিণ কাশ্মীর ৩৫ দিন কার্ফু-ছররা-লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস সয়ে লড়াই চালিয়ে গেছে। ঠিক যেমন কিছুদিন আগেই উত্তর কাশ্মীরের হান্দারা লড়াইয়ের সময়ে কাশ্মীরি জনতা আধা সামরিক বাহিনী ও সেনার তীব্র আক্রমণের সামনেও বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিলেন হিন্দুত্ববাদী হিংস্র ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে। এই লড়াইকে চাকরি, রেশন, বা ল্যাপটপ দিয়ে কি রোখা যাবে? নিজের জন্মভূমির স্বাধীনতার দাবি করার জন্যে যে আট থেকে আশি পর্যন্ত বয়সের মানুষেরা নির্দ্বিধায় প্রাণ দিচ্ছেন খালি হাতে পাথর ছুড়ে, তাঁদের বাড়ির লোকেরা কি মৃতের বদলে সরকারি চাকরি বা ছররায় আহত হওয়া চোখের বদলে ল্যাপটপ পেয়ে আনন্দিত হবেন? মোদী বা তার চ্যালা চামুন্ডারা যখন উন্নয়নের কথা জোর দিয়ে বারবার বলছে তার মানে হচ্ছে যে পাথর হাতে কাশ্মীরি বালক বালিকারা ভারতের শাসকশ্রেণী কে প্রচণ্ড বেগ দিচ্ছে।

যখন উন্নয়নের রাস্তার গল্প,  গণতন্ত্র-মানবতা-কাশ্মীরিত্বের গল্প মোদী মধ্যপ্রদেশে বিজেপি কর্মী ও দেশি-বিদেশি কর্পোরেট মিডিয়াকে শোনাচ্ছিল, ঠিক তখনই খুনি ফৌজের প্রতি চরম ঘৃণা নিয়ে কাশ্মীরের সন্তানেরা মাতৃ ভূমির মুক্তির দাবিতে ওই উন্নয়নের ধাপ্পার ফানুস পাথর ছুড়ে ফুঁটো করছিলেন। জনতার রক্তে যখন পথ ভেসে যাচ্ছে তখন গৃহমন্ত্রী সংসদে রেশনের ট্রাকের ফিরিস্তি দিয়ে কাশ্মীরি জনতার প্রতি নিজের কর্তব্য পূরণ করার বাহবা কুড়োচ্ছিল, আর তখনই ফৌজের গুলিতে নিহত স্কুল পড়ুয়ার অভিভাবকরা, ছররা লেগে অন্ধ হয়ে যাওয়া আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা সকলে করুণা বা চাকরি ভিক্ষে করছিলেন না, তথাকথিত শান্তি আলোচনা ও রাজনৈতিক সমাধান দাবি করছিলেন না, দাবি করছিলেন স্বাধীনতা, তার চেয়ে কম তাঁরা কিছুই চান না।

ঘরে বাইরে কাশ্মীরে চাপে পড়া মোদী কে নিজের কাপড় বাঁচানোর স্বার্থে দালাল আর মোসাহেবদের নিয়ে জনতার নজর উগ্র দেশপ্রেম আর হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে অন্য দিকে ঘোরাবার চেষ্টা করছে। কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে দেশের উচ্চ জাতির বাবুদের মধ্যে মুসলিম বিরোধী প্রচার তুঙ্গে তুলে, সব ব্যাপারে পাকিস্তানের কাঁধে দোষ চাপিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে  চাইছে। হিন্দুত্ববাদীদের পুরানো দোসর ও মার্কিন মুলুকের ওকালতি করা দালাল সাংবাদিক থেকে সাংসদ হওয়া স্বপন দাসগুপ্ত নির্লজ্জের মতন ব্রাক্ষণত্ববাদী সামরিক অভিযানের ও অত্যাচারের পক্ষে সংসদ ভবনে ভাষণ দিল, আর আশা করলো যে মোদী পাকিস্তান কে শাস্তি দিয়ে কাশ্মীরের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করবে।  

ভারতের শাসকশ্রেণীর চরম প্রতিক্রিয়াশীল চেহারার প্রতিবিম্ব আরএসএস ও বিজেপি সহ অন্যান্য প্রকাশ্যে হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডা নাড়ানো শক্তিদের মধ্যে দেখা যায়। ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের স্বরূপ এদের কার্যকলাপ দেখে চেনা যায়। কিন্তু যে সকল শক্তি ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল দালাল মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি ও জোতদার জমিদারদের ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ও সম্প্রসারণবাদের পক্ষে প্রগতিশীলতার  বা বামপন্থার মুখোশ পড়ে ওকালতি করে তাদের কার্যকলাপের পিছনে মূল উদ্দেশ্য কখনোই সহজে বোঝা যায় না।

যেদিন থেকে কাশ্মীরের লড়াই তুঙ্গে উঠেছে, জনতার মধ্যে স্বাধীনতার দাবি তীব্র হয়েছে ঠিক সেই সময়ের থেকেই সংঘ পরিবার ও মোদী সরকারের সমালোচক হিসেবে অনেক শক্তিই উঠে এসেছে, এরা সকলে টিভির পর্দায়, সংসদ ভবনের ভিতর, সোশ্যাল মিডিয়ায়, সংবাদপত্রের পাতায়, এবং নানা আলোচনা চক্রে কাশ্মীরের মানুষের পাথর ছোড়ার নিন্দা করছে, আর ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর হিংসাত্মক আক্রমণের ঘটনাগুলিরও নরম নরম গলাবাজি করে বিরোধিতা করছে। আর তারা এই সমালোচনা ও নিন্দা করে দাবি জানাচ্ছে যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যেন পাকিস্তানের সাথে আলোচনায় বসে, কাশ্মীরি জনতার কথা এবং তাঁদের দাবি দাওয়া শোনে, যেন শান্তিপূর্ণ ভাবে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করে। এই সমস্ত ভাঁট যখন তারা বকছে ঠিক তখনই নব্য গান্ধীবাদ ও সুকিবাদের মণিপুরী মিশ্রণ ইরোম চানু শর্মিলা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক বাহিনীর বিশেষ অধিকার আইন (আফস্পা) বাতিলের দাবিতে চলতে থাকা অনশন আন্দোলন পুলিশের সাথে এসে প্রত্যাহার করে নিল। সরকার ষোলো বছর তাকে গ্রেফতার করেছে ও তার অনশন ভঙ্গ করার চেষ্টা চালিয়েছে। ভারতের শাসকশ্রেণী আলোচনা বা সমালোচনা সহ্য করতে পারে না কারণ ব্রাক্ষণত্ববাদে সমালোচনা করা পাপ এবং নিম্ন জাতির নিঃশর্ত বিশ্বাসের পথে চলে সামগ্রিক ভাবে সমগ্র উচ্চ জাতির মানুষের পদলেহন করা কে শাস্ত্র সম্মত বলে গণ্য করা হয়। তাই ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতির শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিরা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করেও কোনোদিনই মানুষের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে মূল্য দেয়নি। অনশন আর গ্রেফতার ও অত্যাচারের সামনে ভেঙে পড়ে শেষ পর্যন্ত ইরোম শর্মিলা কে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে আর তার মধ্যে দিয়ে আবার প্রমাণিত হলো যে গান্ধীবাদের পথে চলার আমন্ত্রণ ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী সবসময়ে বিদ্রোহী জনতাকে দিলেও ওই পথে যাত্রা শুরু করার পরে কর্পোরেট সমর্থন (আন্না হাজারে মার্কা) না থাকলে কোনদিন শাসকশ্রেণী কোনো আন্দোলন কে পাত্তা দেয় না। কারণ ভীরুত্বের দর্শনে চলা সত্যাগ্রহ ও অনশন শেষ পর্যন্ত শাসকশ্রেণীর উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। ইরোম শর্মিলা এবার ভোটে দাঁড়িয়ে শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতে চায় এবং এর মধ্যে দিয়ে আফস্পা বিরোধী আন্দোলনে তাঁর যেটুকু অবদান ছিল তাতেও জল ঢালা হয়ে গেল।

তাই যারা আজ কাশ্মীরি জনতার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওকালতি করছে তাদের আজ সকলকে জানানো উচিত যে শান্তিপূর্ণ নির্ভেজাল গান্ধীবাদ ও সুকিবাদের পথে চলে ইরোম শর্মিলা কি বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হলো? কাশ্মীরি গান্ধীদের যে আফস্পা কবলিত এবং সামগ্রিক ভাবে সংবাদ মাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকা অঞ্চলে কোনোদিনই ভারতের শাসকশ্রেণী পাত্তা দেবে না তা কি তারা জানে না? নাকি সব জেনেও ন্যাকা সাজছে টু পাইস কামানোর স্বার্থে?

ভারতের গণতন্ত্র তাদের পক্ষে, যারা কোটি কোটি টাকা খরচা করে ভোটে জেতে মদ, মাংস, হুল্লোড়, আর পেশী শক্তির দৌলতে। যে গরিব মানুষগুলো দিনের পর দিন দেশের নকশা থেকে কর্পোরেট আগ্রাসনের ফলে মুছে যাচ্ছে ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, তামিল নাদ, মহারাষ্ট্র, বা গুজরাটে, তাঁরা গান্ধীবাদের পথে চলে কোথায় অনশন বা সত্যাগ্রহ করে নিজেদের জীবন, জীবিকা, ঘর, সংসার ও পরিবেশ কে রক্ষা করতে পারবে সে কথা কোনো বিশেষজ্ঞ জানান দিতে পারে না। যে কাশ্মীরে নির্বাচন মানে ঘর থেকে বন্দুকের নলের মুখে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বুথের লাইনে দাঁড় করানো হয় প্রচারের হাওয়া টানতে, সেই রাজ্যে দিল্লির কাঠপুতুলদের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়ে যে কি পরিবর্তন আনা যায় তা ১৯৮৭ সালে কাশ্মীরি জনতা দেখেছেন। প্রতিটি বাড়িতে ১৩ থেকে ৭৫ বছর বয়সী মহিলাকে ফৌজিরা গণধর্ষণ করলে মানুষের মনের অবস্থা কি হয় তা কুনান পোশপড়ার জনতা জানেন।

আজ যদি কাশ্মীরের জনগণ প্রতিবাদ - প্রতিরোধের রাস্তা ছেড়ে দেন তাহলে ভারতের শাসকশ্রেণীরই উপকার হবে। যদি তাঁরা আমরণ অনশনে বসেন তাহলেও ভারতের শাসকশ্রেণীর বালাই ষাট, কারণ না খেয়ে লোকগুলো সব মরে গেলে ভারতের গুলির খরচা কমে যাবে আর সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের উপর যেহেতু কাশ্মীরে কঠিন নিষেধাজ্ঞা চাপানো আছে তাই এই মৃত্যুর খবরও কোনদিন কাশ্মীরের বাইরে যাবে না। যারা আজ কাশ্মীরি জনতাকে পাথর ছেড়ে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিচ্ছেন তারা সেদিন কোথায় ছিলেন যখন মিলিটারির বুটের নিচে কাশ্মীরের জনতার আত্মসম্মান লুন্ঠিত হচ্ছিল। কেন তারা ভারতের শাসকশ্রেণীকে বন্দুক আর আফ্স্পার মতন কালা আইন প্রত্যাহার করে, সমস্ত দোষী ও খুনি-অত্যাচারী সৈনিকদের শাস্তি দিয়ে, কাশ্মীরের জনতার অত্যাচার বন্ধ করে তাঁদের আলোচনায় ডাকার কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে না? কাশ্মীরের মানুষের সাথে ভারতের শাসকশ্রেণীর কোনো আলোচনা কোনো কালে হয়নি আর কোনো কালে হতেও পারবে না কারণ ভারতের শাসন ক্ষমতায় যে দলই আসুক না কেন তারা মনেপ্রাণে ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণীর ভৃত্যের বেশি কিছু হবে না এবং সেই শাসকশ্রেণীর ঘোষিত গা-জোয়ারি করে কাশ্মীর কে দখলে রাখার নীতির বিরুদ্ধে হাঁটার সাহস কোনদিন দেখাতে পারবে না৷ অথবা আমরা বলতে পারি যে বর্তমান শাসন কাঠামোয় ভারতের মসনদে শুধু সেই সমস্ত রাজনৈতিক শক্তিই বসতে পারে যারা ভারতের শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গী ও কার্যকলাপ কে অন্ধ সমর্থন করে। ফলে কাশ্মীর সমস্যার কোনো গণতান্ত্রিক ও পরিণত মানসিকতার পরিবেশে যে সমাধান হবে সে আশা করা হবে আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখা। শোষক আর শোষিতের মধ্যে আলোচনা হবে কি নিয়ে? ভারতের শাসকশ্রেণী আজ অবধি কোনোদিনই কোনো জাতি সত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করেনি।১৯৭৬ সালের জাতি সংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রস্তাবনায় ভারতের শাসক শ্রেণী সই করে। এই প্রস্তাবে বিশ্বের নিপীড়িত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকৃত হয় এবং এই প্রস্তাবনায় সই করার আগেই মিজো-নাগা-খাসি জনজাতির অসংখ্য মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে লড়ার কারণে ভারত সরকার নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। কাশ্মীরের বহু আগেই নাগা ও মিজোদের গণহত্যা করে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দমনের কাজে হাত পাকিয়েছিল ভারতের শাসকশ্রেণী। নেহরু থেকে ইন্দিরা কারুর হাত রক্ত মুক্ত ছিল না। আসাম, মনিপুর, বা শ্রীলঙ্কায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দমন করতে ভারতের শাসকশ্রেণী কোন দিন পিছপা হয়নি আর অন্য কোথাও আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে ভারত সরকার সবসময়ে শর্ত রেখেছে আত্মসমর্পণের ও ভারতের শাসকশ্রেণীর নিঃশর্ত কর্তৃত্ব স্বীকার 
করে নেওয়ার।

কাশ্মীরের জনগণ ১৯৫৩ এর পরে কোনোদিনই ভারতের সাথে থাকতে চায়নি এবং কাশ্মীরের জনতার এই ইচ্ছাকে ভারতের শাসকশ্রেণী কোনোদিনই দাম দেয়নি। তাহলে আজ যে দাম দেবে সে কথা রাজনীতিতে অজ্ঞ মানুষও দাবি করবে না। কাশ্মীরের মানুষকে তাই বারবার আলোচনার টোপ দিয়ে বিভ্রান্ত করা, বারবার উন্নয়নে বিদ্রোহের সমাপ্তি হওয়ার তত্ত্ব আওড়ানো তথাকথিত সরকারের বিরোধী আর সমালোচকেরাও মুখে না বললেও ল্যাপটপ স্বাধীনতার চেয়ে বেশি ভালো এই লাইন তারাও প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট। কারণ এর মধ্যে দিয়েই বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সেবা করা যাবে, আন্তর্জাতিক চীন বিরোধী যুদ্ধ চক্রের অংশ  ঘাঁটি অঞ্চল হিসেবে কাশ্মীরকে ব্যবহার করা যাবে। তবুও মাঝে মধ্যেই এদের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের মতন “কিক এন্ড কিসের” কৌশল ব্যবহার করতে হয় আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় কাশ্মীর নিয়ে হইচই থামাতে, দেশের জনতার নজর ঘোরাতে, আর কাশ্মীরের জনতার সংগ্রাম কে লাগাম লাগিয়ে থামাবার জন্যে।

আজ লড়াইয়ের ময়দানে পাথর হাতে লড়তে থাকা জনতা যে ল্যাপটপ আর মোবাইল নিয়ে চুপ করবেন না ইন্টারনেট আর মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ কাটা কাশ্মীরে তা মোদী আর ওর মোসাহেবদের বোঝাতে স্বাধীনতার দাবিতে, প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বার্থে, জাতির মুক্তির স্বার্থে লড়াই তীব্র করতে হবে। মৌলবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে প্রগতিশীলতার পথে এগিয়ে যেতে হবে। আর এই কাজে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে কাশ্মীরের নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে। কাশ্মীরের লড়াইকে ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের, সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত শক্তিগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ করা নিতান্ত প্রয়োজন। কারণ সামগ্রিক ভারতবর্ষ জুড়ে এক বিরাট ও সামগ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবর্তন বাদে কাশ্মীরের জনগণের আশা ও আকাঙ্খা কে বাস্তবায়িত করতে পারা অসম্ভব। কাশ্মীরের জনতার সাথে ভারতের জনতার, বাস্তারের জনতার, তামিলনাদ, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডের সংগ্রামী গরিব শ্রমিক-কৃষক- জেলে- দলিত -আদিবাসীদের সংগ্রামী ঐক্য ভারত-পাকিস্তান-মার্কিন ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে কাশ্মীরে নতুন সূর্য ওঠার বন্দোবস্ত করবে আর সেই উদিত সূর্যের প্রখর উজ্জ্বলতায় মুছে যাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের অন্ধকার। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে