যাদবপুরে আরএসএস এর হামলা - ষড়যন্ত্রের প্রথম পর্ব

সোমবার, মে ১৬, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

আশঙ্কা ছিল সেদিন থেকে যেদিন ইন্দোরের আরএসএস কর্মী ও বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় আসানসোলের মাটিতে দাঁড়িয়ে যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের লাথি মারার কথা ঘোষণা করেছিল। সেদিন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম কৈলাশ কে যাদবপুরে আসতে, আসলে দেখতো লাথিটা কে কাকে মারছে, আর কার পশ্চাৎদ্বার রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে। কিন্তু নেংটিদের পার্টির পতাকাতলে যাদবপুর কেন যদুপুরে যাওয়ার অবস্থা নেই। বিজেপি পড়েছে মহা সঙ্কটে, একদিকে চাপ দিয়ে মমতাকে নিজেদের দিকে টেনে পুরানো দিনের মতন তৃণমূলের সহযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে পদ্মফুল ফোটানোর জন্যে হম্বিতম্বি করছে, অন্যদিকে উচ্চ জাতির হিন্দুদের ব্রাক্ষণত্ববাদী রাজনীতিতে দীক্ষিত করে আরএসএস এর আদর্শগত লাইনকে উজ্জীবিত করার চেষ্টাও চলছে। বিরোধী ঐক্যের নামে, শিলিগুড়ি মডেলের নামে বিজেপির আঁচে ধুতির কোঁচা দিয়ে হাওয়া দিয়েছে সূর্য আর মানসরা। এতে বলীয়ান হয়ে, আর মমতার কমিউনিস্ট বিরোধী পরোক্ষ সমর্থনে উল্লাসিত হয়ে আরএসএস এর জিষ্ণু বোস, বিজেপির দিলীপ, আর নরেন্দ্র এর মোসাহেবরা ভাবলো পশ্চিমবঙ্গের নকশালী বামেদের দুইটি টিমটিম করে জ্বলতে থাকা আঁতুড় ঘর -যাদবপুর আর প্রেসিডেন্সিতে আগ্রাসন চালানো হোক দেশপ্রেমের নামে, যাতে দিল্লি আর নাগপুরের খাতায় একটু ভালো নাম্বার তোলা যায়। ভোটের খাতা তো বালাই ষাট।

ঘটনাক্রম - হামলা ও পাল্টা মার 


যেমন ভাবা, তেমন হাগা। প্রথম দফায় ফেব্রুয়ারি মাসে দেশপ্রেমের ন্যাপি পড়ে যখন বাছুর বাহিনী যাদবপুরে আক্রমণ করে তখন বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের তর্জন গর্জনে রূপা বাহিনী মেকুর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। দ্বিতীয় দফায় ভোটের কারণে কোনো রিস্ক নিতে অমিত মানা করেছিল, তাই গরমে লেমনচুষ চুষতে চুষতে, রেজ্জাক মোল্লা কে গাল দিতে দিতে রূপা-দিলীপ-রাহুলরা ভোট কেটে ঝুলি ভরানোর কাজে লিপ্ত থাকলো। কারণ শক্ত ঘাঁটি যে বীরভূম সেখানে অধিকাংশ বিজেপি কর্মী তো মুসলমান, ভোট পাইলসের চেয়ে মারাত্মক ব্যাথা, অনেক সময় কাকাকেও বাপ বলায়। ভোট নাটকের শেষ পর্ব ৫ই মে মিটে যেতেই ঝুলির থেকে ব্রহ্ম দৈত্য লাফ মেরে বের হলো। একেবারে খাস পৈতে ঝোলানো ব্রহ্ম দৈত্য। জাতে খাঁটি বামুন । তবে সেই কল পাড়ের খানকিদের সতী সাজার মতন বিজেপি আর আরএসএস প্রথমেই নিজের পুঁতিগন্ধময় উপস্থিতি যাদবপুরে জানান দিতে চায়নি। ওরা জানতো কিছু উঁচু জাতের গাঁজা ফোঁকা এলিট বাঙালি বাদে আরএসএস এর কল্কে আর কেউ যাদবপুরে টানতে চাইবে না। প্রেসিডেন্সি দুর অস্ত। তাই যাদবপুরে আরএসএস এর নেংটি বাহিনীর দুই নম্বর আক্রমণের প্রেক্ষাপটে ভিবেক অগ্নিহোত্রীর সিনেমা প্রদর্শন। 

সংখ্যা দেখাতে দরকার হলো কিছু ভাড়াটে ভিড়, যা আবার জিষ্ণু নিজে যোগান দেয়, বেশির ভাগই অবাঙালি ছেলেদের ভিড়, যারা মূলতঃ উত্তর ভারতীয় বনিয়া ও ক্ষত্রিয় জাতের ব্যবসায়ী ও দুই নম্বরি কারবারিদের ছেলে। সব কটাই সিঙ্গল, ফ্রাস্টেটেড আর ধর্ষক টাইপের। সাথে কিছু বাঙালি উচ্চ জাতির এলিট আঁতেল, যাদের উপর ভর করে বঙ্গের বৈতরণী পার করার চেষ্টায় আছে অমিত-নরেন্দ্র জুটি। এই ২০০ টাকা প্রতি মাথা ভাড়াটে ভিড় কে ভিবেকের সমর্থক হিসেবে পাচার করার চেষ্টা করে জিষ্ণু আর ওর নাগপুরী সাঙ্গপাঙ্গরা। যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীরা ভিবেক কে কালো পতাকা দেখিয়ে স্লোগান দেওয়া শুরু করতেই খিস্তি শুরু করে জিষ্ণুর ভাড়াটে খোঁচর বাহিনী, সাথে ধর্ষণের হুমকি। এর মধ্যে ভিবেক বলে ওঠে রোহিতের কথা, বলে যে ও মনে করে না যে রোহিতের হত্যা করা হয়েছে। সত্যিই! ভিবেকের এমন করার কোনো কারণ দেখা যায় না, কারণ সে না তো রোহিতের জাত ভাই, আর না সে দলিত আন্দোলনের সাথে যুক্ত, সে বিজেপির দালাল এক সেমি পর্ন সিনেমা নির্মাণকারী মেকি বুদ্ধিজীবী। এত সবের মধ্যে ঘোষণা হয় যে যাদবপুরের কিছু নারী বিদ্বেষী, কল্কে খোর, এক্স তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ও ফ্রাস্টেটেড ছেলেদের সমর্থনে আরএসএস এর বালক সেনা, এভিবিপি ওখানে ইউনিট খুলবে। জিষ্ণুর খোঁচর বাহিনী দাপাদাপি শুরু করে, মহিলা সাংবাদিকের বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়, নিরামিষাশী কিছু 'গান্ধীবাদী বামপন্থী' ছাত্র সংগঠনের মেয়েদের সাথে শ্লীলতাহানি করে। এই ধাক্কাধাক্কির মধ্যে আতঙ্কিত ভিবেক গাড়ি নিয়ে লাইভ টুইট করতে করতে, কাঁধের হাড় ভেঙে যাওয়ার অভিনয় করতে করতে ওখান থেকে কেটে পড়ে। জিষ্ণু আর ওর দলকে খেঁদিয়ে ৮ বির দিকে পাঠিয়ে কালো পতাকার ছাত্ররা চলে যান মুজাফফর নগর দাঙ্গার উপর বানানো তথ্য চিত্র দেখতে। এই ছাত্ররা আরএসএস আর জিষ্ণুদের খোঁচরদের হালকা করে দেখেছিলেন কারণ যাদবপুরে ওরা বহিরাগত আর ওদের কোনো সংগঠন নেই। সেখানেই বিপত্তি।  ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে আটটার থেকে আক্রমণ শুরু করে গো মাতার সন্তান বাছুর সেনার দল। হিন্দিতে খিস্তি, মেয়েদের পোশাক ধরে টান আর অপ্রস্তুত ছাত্রদের মার। হুলস্থূল কান্ড শুরু হয়।হতভম্ব হওয়া ছাত্রদের কিছুটা সময় লাগে সবটা বুঝে উঠতে, অপ্রস্তুত থাকার মাশুল হিসেবে অনেক ছাত্রদের আহত হতে হয় আর ছাত্রীদের যৌন হেনস্থা করে বাছুর সেনা। এর মধ্যে আশু-তিমিরের যাদবপুর, হোক কলরবের যাদবপুর পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। গান্ধীবাদী নিরামিষাশীদের পিছনে ঠেলে এগিয়ে আসে নবীন রক্তের প্লাবন, গড়ে ওঠে ব্যারিকেড, কেলানি খায় বাছুরের দল। বাছুরের হাম্বা হাম্বা আর্তনাদ শুনে গো মাতা সন্তানদের রক্ষার্থে শিং বাগিয়ে এগিয়ে আসে যাদবপুরের গেটে। ভাড়াটে ভিড় নিয়ে অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলি বাছুর বাঁচাতে কোমরে কাপড় গুঁজে শাসানি দিতে দিতে গেটে এসে যাত্রা পালা শুরু করে। বিজেপি নেত্রী হিসেবে যাদবপুর কে গুজরাট ভেবে দশ মিনিট সময় দেয় না হলে গেট ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকার হুমকি দেয় রূপা। যাদবপুরের সম্মিলিত গর্জন ও মুষ্টিবদ্ধ হাজার হাজার হাত দেখে গোয়ালে ফেরার সিদ্ধান্ত নেই বাইরের গো বাহিনী। ঘেরাও এ পড়ে পাকড়াও হওয়া চার সংঘি কে যখন ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তম মধ্যম দিতে প্রস্তুত তখন ছাত্র দরদী সেজে ক্যাম্পাসে আসে উপাচার্য। উপাচার্য মশাই খুব কায়দা করে ওই চার জন কে ছাত্রদের দখল থেকে মুক্ত করে বাইরে চলে যেতে দেন আর ছাত্রদের বলেন যে বাইরে অপেক্ষারত পুলিশ নাকি ওই চারজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে।যদিও আদতে মমতা - মোদী ম্যাচ ফিক্সিং এর ফল স্বরূপ বাইরে কোনো পুলিশ ওই চারজন কামুক ধর্ষক সংঘি বাছুরদের ধরেনি বরং পলায়নরত রূপার দল ওদেরকে নিজেদের সাথে নিয়ে চলে যায়। মমতার এই মাস্টার স্ট্রোকে সাপ মরলো আর লাঠিও অক্ষত থাকলো। 

ভীরুত্বের দর্শনে বিশ্বাসী তথাকথিত "বাম" ও "লিবারেল" আঁতেলরা যাদবপুরে চাড্ডি বাছুরদের হামলার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা পাল্টা আক্রমণকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করে সংসদীয় রাজনীতিতে নিজেদের সতীত্ব বজায় রাখতে। তাদের কথার সারবত্তা হলো চাড্ডি বাহিনীর হামলায় মার খাওয়া উচিত ছিল, পাল্টা মার দেওয়া হঠকারিতা। এই সুরে সুর মেলালো পরে সমগ্র কর্পোরেট মিডিয়া, যাদের কভারেজে গো বলয়ের চাড্ডিধারী বাছুর সেনাকে এক নিরীহ, আক্রান্ত, এবং নিতান্ত গোবেচারা গণতান্ত্রিক (বিশেষ করে বাম-মাওবাদী বিরোধী "দেশপ্রেমী" গণতন্ত্রী) শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে, যাদের উপর নাকি যাদবপুরে অনেক অত্যাচার করা হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অসহনশীল বলে অভিযোগ করলো অভীক সরকারের আনন্দ বাজার। 

ভালো কথা, এবার বিজেপির পিছনে যাদবপুর ইস্যুতে সমর্থনের কাঠি গুঁজতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছে আনন্দ গোষ্ঠী, কারণ মার্কিন মুলুক থেকে বাপেদের হুকুম এসেছে বিজেপিকে আক্রান্ত আর হতভাগা বামপন্থীগুলোকে আক্রমণকারী হিসেবে দেখাও। তাই যখন ভিবেক আর ওর আরএসএস এর চ্যালাদের কালো পতাকা দেখালো যাদবপুরের সংখ্যাগরিষ্ট ছাত্র-ছাত্রীরা তখন ফাঁক পেয়ে ভেতরে গলে অসহিংষুতার পাঠ পড়ানো শুরু হলো আনন্দবাজারের। কারণ এই লড়াই সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত সিপিএম-সিপিআই এর ছাত্র সংগঠনগুলি শান্তিপূর্ণ ভাবে করেনি, করেছে অনেক হাজারো ছাত্র-ছাত্রীরা যাদের কাছে তাঁদের সহপাঠি, তাঁদের বন্ধুদের রক্ষা করা ও তাঁদের উপর করা হামলার জবাব দেওয়াটা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় ছিল। যাঁদের উপর গুরু দ্বায়িত্ব পড়েছিল সমগ্র দেশে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির উপর বেড়ে চলা আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শক্তির আক্রমণগুলির বদলা নেওয়ার, আখলাক থেকে রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর বদলা নেওয়ার। তাই তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার ছাত্র সংগ্রামের ঐতিহ্যর কথা স্মরণ করে, আনন্দবাজার, রুপার্ট মারডক, বা নরেন্দ্রের কি অভিমত, তা জানার কোনো ইচ্ছে বাংলার ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো কালে ছিল না আর কোনো কালে হবেও না। তাঁরা লড়েছেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় পরিচয়।


নাগপুরের ষড়যন্ত্রের জাল অনেক বৃহৎ  



যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর সংঘ পরিবারের আক্রমণ কোনো বিছিন্ন ঘটনা নয়। দেশজুড়ে যে ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে গেরুয়াকরণের স্বার্থে একের পর এক হামলা হচ্ছে, এই হামলা তারই একটি অবিচ্ছেদ্য ভাগ। সংঘ পরিবার দেশের সেই সব ক্যাম্পাসে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চায় যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী চিন্তাধারা প্রবল, বা যেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পিছপা হননা, যেখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা দেশ ও সমাজ কে নিয়ে ভাবেন, এবং তাঁদের চিন্তা যেখানে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর নির্দ্ধারিত গন্ডির বাইরে বের হয়ে প্রশ্ন করে সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাকেই। আমেরিকার টাকা খেয়ে ভারতীয় বাজারে বিদেশী একচেটিয়া লগ্নি পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী আরএসএস যে ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চাইছে এই হিন্দুরাষ্ট্রে, তার কাছে এই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। গায়ের শক্তির চেয়ে বড় তাত্বিক ও বুদ্ধির চ্যালেঞ্জ এই ছাত্র-ছাত্রীদের থেকেই আসে বলে এদের সংঘ পরিবারের শাখা স্কুলে আর টোলে পড়াশুনো করে বাছুর তৈরি হওয়া খোঁচররা ঘৃণা করে। কারণ বুদ্ধি আর মেধায়, তর্কে আর যুক্তিতে, চাড্ডিধারী গেরুয়া বাছুররা কোনো দিনই প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পেরে ওঠে না। এর ফলে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র ওর সরকার গড়ার পরেই স্বিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক ওরা দেশের সমস্ত মুক্ত চিন্তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জায় আনবে আর যেটুকু মুক্ত আর দ্বান্ধিক চিন্তা এই ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অবশিষ্ট আছে দেশের কয়েকটি কোনায় হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠানে, তাকে যে করেই হোক দমন করে ইঞ্জিনিয়ারিং আর টেকনিকাল শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির মতন কড়া মিলিটারী শাসনের মতন ব্যবস্থা পত্তন করিয়ে মুক্তমনা ছাত্র-ছাত্রীদের জোর করিয়ে বশ করবে।সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা কে ধীরে ধীরে ব্রাক্ষণত্ববাদীদের একচেটিয়া করার পরিকল্পনা আর ডব্লিউ টি ও এর নির্দেশ মতন শিক্ষার পাইকারী হারে বাজারীকরণের পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আরএসএস এর নেতৃত্বে মোদী সরকার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির উপর ব্যাপক হারে আক্রমণ নামিয়ে আনতে চাইছে।

হিন্দুরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে দেশের একটা বড় অংশের শিক্ষিত সমাজের (যাঁদের অধিকাংশই উচ্চ জাতির হিন্দু ) ব্রাক্ষণত্ববাদের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য। প্রশ্ন তুলে আর খোলা মনে যুক্তি ও তর্কের সাহায্যে যাঁরা সত্যের সন্ধান করেন, তাঁরা হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তাদের পক্ষে বিপদের চিহ্ন। এই আনুগত্য সৃষ্টি করতেই নরেন্দ্র আর ওর সরকার দেশের প্রতিক্রিয়াশীল ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও বেশি করে প্রতিক্রিয়াশীল বানাবার প্রচেষ্টায় রত হয়েছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো যে ভারতের সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে সংঘ পরিবারের মতামতকে দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করা, এবং এই ষড়যন্ত্রের পিছনে যে সিপিএমের শয্যা সঙ্গী কংগ্রেসের পরোক্ষ মদত নেই সেটা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না, কারণ কংগ্রেসের পরোক্ষ মদত ছাড়া হিন্দুত্ববাদী - ব্রাক্ষণত্ববাদীদের পক্ষে কোনো ভাবেই ওদের অভিলাষা চরিতার্থ করা সম্ভব হতো না।এই ষড়যন্ত্রটি আরএসএস এর চেয়ে বেশি দেশের ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণীর ষড়যন্ত্র। আরএসএস ও নরেন্দ্রের সরকার শুধুমাত্র এই ষড়যন্ত্রকে খোলাখুলি ভাবে প্রয়োগ করে চলেছে বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির স্বার্থে।তাই কংগ্রেস এই সম্পর্কে কিছু কটু কথা বলেও চুপচাপ আরএসএস কে সমর্থন করে চলেছে। কারণ দেশের শাসকশ্রেণী ভারতের শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতা শুধুমাত্র কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যেই ভাগ করতে দিতে চায়। বাকি সমস্ত পার্টিকে এই দুই দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে জোট গড়েই কার্য সিদ্ধি করতে হবে জাতীয় বা রাজ্য স্তরে। তাই নরেন্দ্র সরে গেলে যদি কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় ফেরে তখন যাতে ব্রাক্ষণত্ববাদী নীতি আলাদা করে প্রতিষ্ঠা না করতে হয় এবং যাতে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির কাছে দেশের সম্পদ, জমি, জল, জঙ্গল, আর জনগণের ভবিষ্যত বিক্রি করার বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক-গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষেরা ক্ষেপে না ওঠে, তার বন্দোবস্ত বিজেপি সুন্দর ভাবে করে যাচ্ছে, এবং এই কর্মের লাভের গুড় কংগ্রেসও খাবে। 

মনে পড়ে বাজপেয়ী জমানা ? যখন বিলগ্নীকরণ আর বিদেশী পুঁজির বিরোধিতা করেছিল কংগ্রেস, আর ঠিক তার পরেই ভোটে জিতে বিলগ্নীকরণ ও আর্থিক উদারীকরণের উকিল মনমোহন কে গদিতে বসিয়ে বিজেপির বানিয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে তীব্র গতিতে গাড়ি ছুটিয়ে দেয় সোনিয়া। সরকারী বামেরা সেদিনও কংগ্রেসের কোলে দোল খেয়েছিল, আজও তারা নির্লজ্জ কান কাটার মতন কংগ্রেস কে হামি খাচ্ছে। কংগ্রেস চিরকালের মতন নিত্যনতুন কায়দায় হিন্দুত্বের আঁচে বাতাস করে যাতে করে দেশের সাম্প্রদায়িক বিভেদটা প্রকট থাকে আর জনতার ঐক্য যেন খণ্ডিত হয়। 

বিজেপি আর কংগ্রেস, দুই দলই চরম ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী হিন্দু ফ্যাসিবাদী পার্টি। একটি পার্টিকে যদিও সবার সামনে গেরুয়া বসন পড়ে চলতে হয়, অন্যজন নিজের ঘৃণ্য হিন্দুত্ববাদ মেকি ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে লুকিয়ে রাখে। তাই ভারতের হিন্দু ব্রাক্ষণত্ববাদী সামন্তপ্রভু ও মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের স্বার্থে কংগ্রেস আর বিজেপি যে একই ঘাটে জল খায় আর লোক দেখানো কুস্তি লড়ে সেকথা দেশের গরিব আর খেটে খাওয়া জনগণ ভালো ভাবেই উপলব্ধি করছেন। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর হামলার মূল উদ্দেশ্য


এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর বেড়ে চলা আক্রমণগুলি, যা বলিউড মার্কা দেশপ্রেমের নামে আজ আরএসএস এর বাছুর বাহিনী চালাচ্ছে তার আসল উদ্দেশ্য হলো ব্যাপক হারে শহুরে মধ্যবিত্তদের কর্পোরেট দাসে পরিণত করা। 

বর্তমানে যে হারে দেশের ভিতর নয়া উদারনৈতিক আর্থিক নীতিগুলির ফলে গরিব কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী, আদিবাসী জনগণ সহ প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হচ্ছে, তাতে কোটি কোটি জনতার ক্ষোভ-বিক্ষোভ উপচে পড়ছে শাসক শ্রেণী ও সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থার উপর। এই ক্ষোভের ফলে যত্রতত্র জনতা বিদ্রোহে ফেটে পড়ছেন, সংগ্রামের ব্যারিকেড গড়ে শাসকশ্রেণীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছেন। যেমন ধরুন ছত্তিসগড়ের বাস্তার, মহারাষ্ট্রের গাদরিচলি থেকে মারাঠওয়ারা-বিদর্ভ, উড়িষ্যার ব্যাপক জনগণ, ঝাড়খণ্ডের ব্যাপক আদিবাসী জনগণ, এঁরা সবাই আজ লড়ছেন দেশি-বিদেশী কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। আর এই লড়াইকে, কংগ্রেসি নেতা চিদম্বরমের ভাষায় "বুদ্ধিগত" সমর্থন দিচ্ছে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর থেকে বেরিয়ে আসা কিছু মানুষ। সরকার বাহাদুর যখন জনতার রক্ত ঘামে অর্জিত কোটি কোটি টাকা শাসকশ্রেণীর স্বার্থে শহুরে মধ্যবিত্তদের, বিশেষ করে উচ্চ জাতির হিন্দু মধ্যবিত্তদের, কর্পোরেট ও বিদেশী পুঁজির শাসনের পক্ষে টেনে আনতে খরচা করছে, যখন সরকার ও শাসক শ্রেণী দেশের লেখাপড়া জানা ২৫ শতাংশ মানুষের চেতনা ও স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা কে শেষ করার চেষ্টা করছে, ঠিক তখন বহু শিক্ষক, সাংবাদিক, কর্মচারী, ছাত্র-ছাত্রী, এবং ওই শিক্ষিত ২৫ শতাংশের একটা অংশ বাকি মানুষদের কাছে ওই গরিব মানুষগুলোর কথা, দেশের ৮০ শতাংশের কথা, দেশের সম্পদ, জমি-জল-জঙ্গল-সম্পদ লুটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, ব্যাপক জনতার মধ্যে নানা কায়দায় এই কর্পোরেট লুটপাটের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন। 

এই সাহসী কয়েকজন এমন ভাবে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশের ব্যাপক শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার স্বার্থের সাথে যেভাবে নিজেদের একাত্ম করে তুলছেন ও প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজ করছেন তার ফলে দেশের মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেকেই অনুপ্রাণিত হচ্ছে জনতার সংগ্রামে যুক্ত হতে। অথচ এই মধ্যবিত্তদের শোষিত-নির্যাতিত গরিব মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে কুঁয়োর ব্যাঙ বানিয়ে রাখতে অবিরাম প্রচার চালাচ্ছে শাসক শ্রেণী। তাই এই বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস কে সম্পুর্ন করে যে সমস্ত মধ্যবিত্ত দেশের গরিবদের স্বার্থের সাথে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁদের নির্মম ভাবে দমন করতে রাষ্ট্রের মালিকদের প্রয়োজন এক জি হুজুর বলে মাথা নত করে চলা মধ্যবিত্ত কেরানি শ্রেণী। যারা প্রশ্ন করবে না, শুধু হুকুম তালিম করবে, আর প্রভুর গুণ কীর্তন করবে। তাই প্রথমে দরকার ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার আরো প্রতিক্রিয়াশীলকরণ। তার বিরোধিতা যেহেতু বিপ্লবী বাম, প্রগতিশীল, ও গণতান্ত্রিক ছাত্র-ছাত্রীরা করবেন তাই শুরু থেকেই তাঁদের কে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে, তাঁদের নামে কুৎসা করে, তাঁদের উপর আক্রমণ করে এই ছাত্র শক্তিকে দমন করতে চায় ভারতের শাসক শ্রেণীর গেরুয়া নেড়ি কুকুর আরএসএস এর নন্দী-ভৃঙ্গীদের দল। 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বিচ্ছিন্ন নয়, জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, এফটিআইআই, টিআই এসএস, আইআইটি মাদ্রাজ, হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদির মতন যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশের প্রগতিশীল চিন্তাধারা সমগ্র প্রতিষ্ঠানটিকে আরএসএস এর চক্ষু শূল বানিয়েছে। হয়তো এর পর আক্রমণ হবে প্রেসিডেন্সিতে, বা অন্য কোথাও। 

গেরুয়া আক্রমণের জবাব - যাদবপুর লাইন


আরএসএস এর বাছুর বাহিনীর আক্রমণের জবাব তর্ক-বিতর্ক করে দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ ফ্যাসিবাদী ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তি কোনোদিন তর্কের মাধ্যমে, যুক্তির মাধ্যমে সত্য জানার চেষ্টা করে না। মৌলবাদের একটিই নীতি, যার সারমর্ম হলো যা চোদ্দ পুরুষ করে এসেছে, যা চোদ্দ পুরুষ মেনে এসেছে, তাই চলবে- তাই চালাবো। ধর্মান্ধ আর জাতি বিদ্বেষী শক্তি যদি যুক্তি-তর্ক মানতো তাহলে বাংলাদেশে এত জন মুক্তমনা ব্লগারকে চাপাতি খেতে হতো না। তাই এই উপমহাদেশ জুড়ে আরএসএস ও অন্যান্য মৌলবাদী শক্তিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরে প্রতিহত ও পরাজিত করার একটাই পন্থা, যাদবপুর। মুষ্টির বিরুদ্ধে মুষ্টি, গায়ের জোরের বদলায় গায়ের জোর, ইঁটের বদলে পাটকেল। একমাত্র এই পথ অবলম্বন করলেই গেরুয়া বাহিনী ল্যাঙট ভেজাবে হিসি করে। একমাত্র মহিলাদের হাতে হেনস্থা হয়েই বিকৃত কামুক সংঘ বাছুররা, দিলীপ ঘোষের মতন ভাঁড়েরা লাল আতঙ্কে শুধু কাঁপবেই না, বরং সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাবে, গোবর আর মূত্র বিসর্জন বন্ধ হয়ে যাবে।

আপামর ছাত্র-যুবদের কর্তব্য যাদবপুরের পথ ধরে আরএসএস এর নেংটি ছেঁড়া, এলিটিষ্ট প্রতিষ্ঠানের গন্ডির বাইরে এসে শ্রমিক-কৃষক-ব্যাপক মেহনতি জনতার সংগ্রামগুলির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, নিজেদের লড়াইকে খেটে খাওয়া শোষিত ও নির্যাতিত জনতার লড়াইয়ের সাথে একাত্ম করে তোলা। আর তার মধ্যে দিয়েই ভারতের বীর ছাত্র-ছাত্রীরা বিদেশী পুঁজির জুতো চাটা সংঘ পরিবারের ডাল কুত্তাদের পরাস্ত করতে পারবেন। 




                            

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে