ক্যাম্পাসে এবিভিপি কে হারাতে গেলে আগে ক্যাম্পাসের বাইরে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে হবে

রবিবার, ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

বাংলার বুকে কমিউনিস্ট নিধন যজ্ঞের প্রস্তুতি শুরু করেছে ফ্যাসিস্ট এবিভিপি  


গত ২১শে ফেব্রুয়ারি রাজধানী দিল্লির রামজস কলেজে উমর খালিদ ও অন্যান্য ছাত্র ও গণআন্দোলনের কর্মীদের একটি সেমিনার বন্ধ করতে পুলিশের সহায়তায় এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃপক্ষের মদতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় আরএসএস এর ক্যাম্পাস গুন্ডা বাহিনী এবিভিপি। এই ঘটনার সময়ে মারধর করা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের, যৌন হেনস্থা করা হয় ছাত্রীদের, শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের পেটানো হয় আর উমর খালিদ কে হত্যা করার চেষ্টা করে গলায় নাগপুরের দেওয়া দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট ঝোলানো গৈরিক সন্ত্রাসীরা।

ছাত্র-ছাত্রীরা ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা যখন একসাথে  ২২শে ফেব্রুয়ারি স্থানীয় মরিস নগর থানায় এবিভিপির গুন্ডামির বিরুদ্ধে নালিশ করতে যাচ্ছিলেন তখন পুলিশের সাহায্যে তাঁদের উপর পাথর, রড, চেন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবিভিপির ভাড়াটে গুন্ডারা, সাথে ছিল পূর্ব দিল্লির থেকে আসা আরএসএস এর শাখা কর্মী ও প্রধানরা। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল নারীদের শ্লীলতাহানি করা আর তাই পুলিশের সামনে অকুতোভয় হয়ে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের শ্লীলতাহানি করে হিন্দুত্ববাদী গুন্ডারা। কয়েকজন ভাড়াটে মহিলা এনে আরএসএস এর গুন্ডারা প্রতিরোধ গড়তে থাকা ছাত্রীদের উপর লেলিয়ে দেয় আর এই সব কিছুর নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় গুন্ডা থেকে ছাত্র নেতা সাজা উচ্চ জাতির হিন্দুত্ববাদী পান্ডারা। এই আক্রমণের পরে ছাত্র-ছাত্রীদের ধরে দিল্লি পুলিশের গাড়ি গোটা শহর ঘুরিয়ে পরে নানা জায়গায় ছেড়ে দেয়।

এই আক্রমণের ঘটনা কে চিরচারিত প্রথা মেনে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তি নিন্দা করছে, সবাই বলছে যে ছাত্র ছাত্রীদের গণতান্ত্রিক অধিকার আজ লাঞ্ছিত হয়েছে এবং আরএসএস আজ ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজ প্রতিপত্তি ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠা করতে ব্রতী হয়েছে। এবিভিপির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হচ্ছে এবং সমগ্র সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নিয়ে বিস্তর তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। তবে এই শত আলোচনার মধ্যে মূল বিষয়ের কাছেও কোন রাজনৈতিক শক্তি ঘেঁষছে না আর গেলেও নানা রকমের কায়দা করে মূল সমস্যার মূল সমাধান নিয়ে কেউই আলোচনা করতে উৎসাহী নয়। তবে ভারতবর্ষের ছাত্র আন্দোলনের ধারার উপর চাপিয়ে দেওয়া এই এবিভিপির সন্ত্রাস কে সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ না করলে এর বিরুদ্ধে সঠিক লড়াইয়ের পথ বেরিয়ে আসবে না এবং সমস্ত প্রতিরোধ আন্দোলনই সুবিধাবাদের চক্রব্যূহে ঘুরপাক খেয়ে বিলীন হয়ে যাবে।

এবিভিপি’র রাজনীতি এবং সংগঠনের চালিকা শক্তি কি?


যদিও আরএসএস দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে প্রচার করে আসছে যে এবিভিপি একটি ছাত্র সংগঠন, তবুও আসলে এবিভিপি হলো আরএসএস এর একটি যুব ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী যা প্রধানতঃ সাভারকারের আদর্শে চলে দেশের বিভিন্ন কোনায় মুসলিম নিধন করার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছিল ষাটের দশকের শুরুতে। উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধী, মুসলিম ও খ্রিস্টান বিদ্বেষী, দলিত বিরোধী ও কর্পোরেট পুঁজির এবং সামন্তবাদের পদলেহী এই সংগঠনের মূল কাজ হলো ভারতের ছাত্র সমাজের উপর নিজ প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং ছাত্রদের কর্পোরেট দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধার যে পরিকল্পনা ভারতের শাসক শ্রেণী করেছে, তাকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

আরএসএস ভারতবর্ষ কে বৌদ্ধিক ভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে রাখতে চায় এবং ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন ব্যবস্থার বশে রাখতে চায়। আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে, ভারতের শাসক শ্রেণী উচ্চ শিক্ষার থেকে ভর্তুকি ও সরকারি ভূমিকা কে খতম করে উচ্চশিক্ষা কে একটি পণ্য হিসেবে বাজারজাত করার প্রচেষ্টা সেই নব্বইয়ের দশক থেকে করে চলেছে। সারা বিশ্বের তাবড় একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলো ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় টাকা ঢালছে ব্যাপক মুনাফার আশায়।

নয়া উদারনৈতিক আর্থিক নীতির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী  গরিবের থেকে শিক্ষার অধিকার ক্রমেই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে; প্রচেষ্টা চলছে দলিত, আদিবাসী, পিছিয়ে থাকা জাতি, ও সংখ্যালঘুদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার আর উচ্চশিক্ষা কে শুধুমাত্র বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির জন্যে সুলভ মূল্যে আজ্ঞাবাহক ক্রীতদাস বানাবার কারখানায় পরিণত করার। আর শিক্ষা ক্ষেত্রে এহেন আক্রমণের বিরুদ্ধে যাতে প্রগতিশীল ছাত্রশক্তি গর্জে উঠতে না পারে, আন্দোলনের পথে চলে সরকারের ষড়যন্ত্রগুলোকে চূর্ণ করতে না পারে তাই আরএসএস এর দরকার পরে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে এবিভিপির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর উপস্থিতি।  


যে কর্পোরেট-সামন্তবাদী ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থায় ভারতবর্ষকে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার নিয়ে যেতে চায় তার জন্যে দরকার যে ভারতের উচ্চ শিক্ষার ক্যাম্পাসগুলোয় শাসক শ্রেণীর প্রতি আনুগত্য যেন তৈরি করা হয়। সেই আনুগত্য তৈরি করে, প্রশ্ন করার অভ্যাস থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বিরত করে শুধুমাত্র রাষ্ট্র যন্ত্র ও শাসক শ্রেণীর হুকুম শুনে কুচকাওয়াজ করতে শেখানোর জন্যে এবিভিপি কে  প্রতিটি ক্যাম্পাসে আজ আরএসএস এর ভীষণ প্রয়োজন। আর বড়লোকের বাড়ির ছেলে মেয়েরা, যারা সাবর্ণ হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করার সুবাদে সমস্ত সুবিধাপ্রাপ্ত করে উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করার আগেই রাষ্ট্র যন্ত্র ও শাসক শ্রেণীর নেড়িতে পরিণত হয়, তাঁদের জন্যে এবিভিপি হলো একটি শ্রেষ্ঠ  রাজনৈতিক কারিয়ারের লঞ্চপ্যাড।  

সমস্ত ক্যাম্পাসের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট ও অন্যান্য প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল কোর্সের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে মেডিওক্রিটি বা মধ্য মেধা এবং ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য দেখানোর প্রচলনটা বেশি। এই সমস্ত কলেজ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রচলিত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কায়দায় “ডিসিপ্লিন” বা অনুশাসন বজায় রাখার দরুন এই ক্যাম্পাসে ছাত্রদের স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে দেওয়া হয় না, বরং চিরকাল ধরে চলে আসা কায়দায় মুখ বুজে চলতে বাধ্য করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বা ম্যানেজমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝানো হয় যে তাঁরা নাকি বিশেষ মেধার অধিকারী এবং তার ফলে তাঁরা দেশের ব্যাপক শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং তাঁদের পকেট থেকে দেওয়া আয়করের ফলেই নাকি দেশ চলবে এগিয়ে। এই ভাবে প্রথমে তাঁদের নিজের নব্য শ্রেণীর প্রতি ও সাথে সাথে রাষ্ট্র যন্ত্রের প্রতি অনুগত করা হয়। সেই অনুগত, প্রশ্ন করতে অক্ষম, রাষ্ট্রের খাওয়ানো টোটকাকে শ্রেষ্ঠ মনে করা, বৌদ্ধিক ভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছাত্রদের ও কিছু ছাত্রীদের সংগঠন এবিভিপি নিজেদের কর্মীর অভাব পূরণ করে মদ, মেয়ে, আর টাকার প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা স্থানীয় গুন্ডা বাহিনী কে দিয়ে।

টেকনোক্রাটদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের প্রভাব বেশি হয় কারণ ফ্যাসিবাদ উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধানের পথ বাতলায়। যেহেতু ফ্যাসিবাদ শেখায় যে প্রযুক্তি দিয়েই বিশ্বের সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব এবং মানুষ কে প্রযুক্তির কাছে মাথা নত করে থাকতে হবে, তাই এই ফ্যাসিবাদী দর্শন প্রযুক্তিবিদ ও ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য ধারার ছাত্রদের কাছে ভীষণ আপিলিং হয়ে ওঠে। বেশি করে তাঁরা এই রাজনীতির কাছে ঘেঁষে এবং ভারতবর্ষের মতন দেশে, যেখানে জাতির ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়, সেই দেশে উচ্চ জাতির হিন্দু বাড়ির থেকে আসা ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তির অন্যান্য ধারার ছাত্র-ছাত্রীরা সহজেই এই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির শিকার হয়। তাঁরা এই ফ্যাসিবাদের কবলে পরেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্লোগান দিয়ে নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে দেশের সরকারের সমস্ত কাজকর্ম ও প্রকল্প কে অনলাইন করার কথা বলছে, যেভাবে ক্যাশলেস ও ডিজিটাল অর্থনীতির কথা বলছে তার মধ্যে দিয়েই দেশের গরিবদের প্রভূত উন্নয়ন হবে। এই চিন্তাধারার শিষ্য পেয়ে গেরুয়া শিবিরের, বিশেষ করে এবিভিপিরও বেশ সুবিধা হয়।

যেহেতু ভারতবর্ষে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা এতই শক্তিশালী যে মহিলাদের শৈশব থেকেই পুরুষের দাসত্বে বেঁধে রাখা হয়, এবং ধীরে ধীরে অধিকাংশ মহিলার শিরায়-উপশিরায় এই চেতনা ঢোকানো হয় যে তাঁরা পুরুষের অধীন, তাঁদের নিজস্ব পরিচয় পুরুষ কে বাদ দিলে থাকে  না এবং পুরুষের শাসনেই তাঁদের জীবন যাপন করতে হবে, তাই বেশির ভাগ মহিলাদের মধ্যে নিজের সম্পর্কে এবং নিজ লিঙ্গ সম্পর্কে একধরণের হীনমন্যতা কাজ করে এবং তাঁরা স্বাধীন, প্রগতিশীল চেতনা সম্পন্ন, এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো মহিলাদের সঠিক ভাবে গ্রহণ করতে পারেন না।

তেমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে “তুমিই জন্ম থেকে শ্রেষ্ঠ” শুনে বড় হওয়া পুরুষদের মধ্যে তীব্র নারী বিদ্বেষের জন্ম হয় শৈশব থেকেই। তাঁদের চোখের সামনে যদি নারী চাকরি করে, আর্থিক ভাবে স্বাধীন হয়, বিয়ে না করে, বা স্বামীকে ডিভোর্স দেয়, যদি পুরুষদের সঙ্গে বসে মদ্যপান করে, বা যদি সামান্য একটা সিগারেট খায় তাহলেই সেই নারী হয়ে যায় দুশ্চরিত্রা, এবং সেই নারীকে ধর্ষণ করার আর না হয় শ্লীলতাহানি করে সমাজে তাঁর জন্যে ঠিক করা “স্থানে তাঁকে পৌঁছে দিতে ” পুরুষতান্ত্রিক সমাজ খুবই উদগ্রীব হয়ে ওঠে। আর তাই পাড়ার রকে বসা পল্টুর থেকে অফিসের মেজ বাবু সেনগুপ্ত সাহেব আজকাল ধর্ষণ বা মহিলাদের উপর হওয়া হামলার ঘটনায় মুখ খুলে অবলীলায় বলতে পারে “মেয়েরা এই ভাবে চললে এটাই তো হবে” আর সাথে সাথে তাঁদের আবার  মুসলমান নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের চাপানো পাহাড় দেখে ভীষণ কষ্ট হয় বলে তাঁরা জানান দেয়।

এই ধরণের সামাজিক আর আর্থিক পরিস্থিতির থেকে উঠে আসা পিছিয়ে থাকা চেতনার, তীব্র গণতন্ত্র বিরোধী, নারী বিদ্বেষী, চরম ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদী, ও ফ্যাসিবাদী সাবর্ণ হিন্দুদের টেনে আনে এবিভিপি নিজ ছাতার তলায় আর এই সামাজিক কারণগুলোর ফলেই ওদের জোটে কামুক-ধর্ষক গুন্ডাদের সেই বাহিনী যাদের ওরা নিয়ে যায় প্রতিটি আক্রমণে মহিলাদের উপর নিজের একাকিত্বের নৈরাশা ঝাড়তে। টাকা, মদ আর নারীর উপর হাত মারার সুযোগ পেয়ে দিল্লি থেকে কলকাতা বা হায়দ্রাবাদ, সব জায়গায় মিনি দিলীপ ঘোষেদের দলে লোকের কমতি হয় না। বারবার বিজেপি ও আরএসএস এর ব্রাক্ষণত্ববাদী পন্ডিতেরা এই গুন্ডা বাহিনীকে এই বলে ক্ষেপায় যে বামপন্থী নারী দুশ্চরিত্রা এবং তাঁর উপর আক্রমণ করা হলো হিন্দু ধর্মের ধ্বজ্জাধারীদের পবিত্র ধার্মিক কর্তব্য।  আর এই ভাবেই টাটা-আম্বানি-আদানীদের টাকা নিয়ে ভারতের ক্যাম্পাস থেকে বিরোধী স্বরকে শেষ করে দেওয়ার সশস্ত্র লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কে (রাষ্ট্র যন্ত্রও তীব্র ভাবে ব্রাক্ষণত্ববাদের দর্শনে বিশ্বাসী ও তীব্র নারী বিদ্বেষী) সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবিভিপি।

এবিভিপির বিরুদ্ধে লড়াই আরএসএস এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের থেকে আলাদা হতে পারে না 


যদি এবিভিপি কে আরএসএস এর থেকে আলাদা করে, হিন্দুত্ববাদ ও ব্রাক্ষণত্ববাদের ধ্বজ্জাধারী ফ্যাসিবাদী শক্তির থেকে আলাদা করে শুধুমাত্র একটি ক্যাম্পাসের ছাত্র সংগঠন হিসেবে দেখা হয় তাহলে এক বিশাল রণনৈতিক ভুল হবে। এবিভিপি ছাত্র শক্তিতেই বলীয়ান হয়ে চলে না, এবিভিপির পিছনে, বিশেষ করে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, গুজরাট, প্রভৃতি রাজ্যে রয়েছে বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর পরোক্ষ সমর্থন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সশস্ত্র গুণ্ডা বাহিনীর সমর্থন আর আছে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা। এদের সাথে টাকা বা সংগঠনের ব্যাপকতায় অন্য প্রগতিশীল, বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনগুলো টেক্কা দিতে পারে না। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পথ হতে হবে ভিন্ন। আর সেই লড়াই শুধু ক্যাম্পাসের মধ্যে আটকে রাখলে পরাজয় হবে ছাত্র শক্তিরই।

যেহেতু এবিভিপি আরএসএস এর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তাই দেশ জোড়া ব্রাক্ষণত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, কর্পোরেট-সামন্ততান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের সম্মিলিত লড়াইয়ের থেকে আলাদা ভাবে লড়াই করে, নিজেদের লড়াই কে শুধু মোটা চশমা পড়া, আঁতলামি করা, ও তাত্বিক পন্ডিতি ঝাড়া লোকেদের মধ্যে আটকে রেখে, প্রগতিশীল বাম ও গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির লড়াই কোনদিনই এবিভিপি’র মতন গৈরিক সন্ত্রাসী ফ্যাসিবাদীদের পরাস্ত করতে পারবে না।

সারা দেশ জুড়ে আরএসএস ও বিজেপির, বিশেষ করে মোদী সরকারের দ্বারা নানা কায়দায় চাপিয়ে দেওয়া হিন্দুত্ববাদ ও কর্পোরেট শোষণের বিরুদ্ধে আজ সাধারণ শ্রমিক, কৃষক, শোষিত জনজাতির মানুষ, নিপীড়িত জাতির মানুষ আজ রুখে দাঁড়াচ্ছেন এবং জমি-জল-জঙ্গল-জীবিকা রক্ষার গণআন্দোলনগুলি আজ মজবুত হচ্ছে। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কোথাও ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাক্ষণত্ববাদী শাসক শ্রেণী ও তাদের দালাল গেরুয়া সন্ত্রাসীরা সুখে নেই, কারণ মানুষ আজ ওদের বিরুদ্ধে অল্প অল্প করে উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছেন বিশেষ করে গুজরাটের উনায় দলিতদের উপর আরএসএস এর অত্যাচারের ঘটনার কারণে এবং ছত্তিশগড় ও ঝাড়খণ্ডে ব্যাপক হারে আদিবাসী হত্যার ঘটনায় আজ সেই সব রাজ্যের শোষিত মানুষও রুখে দাঁড়াচ্ছেন ফ্যাসিস্ট আরএসএস এর কর্পোরেট তোষণের বিরুদ্ধে। ধীরে ধীরে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে, এমনকি বিজেপির শক্তিশালী দুর্গ গুজরাটের বুকেও। এই সময়ে ছাত্র আর যুবদের আন্দোলন যদি এই ব্যাপক জনগণের আন্দোলনের সাথে না মিশে যায়, তাহলে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা সম্ভব হবে না।

বর্তমান ছাত্র আন্দোলন কে একাত্ম করতে হবে শ্রমিক-কৃষকের সাথে 


ভারতবর্ষের ক্যাম্পাসের ছাত্র আন্দোলন কে শুধুমাত্র স্টুডেন্টস ইউনিয়ন গড়ার লড়াইয়ে আটকে রাখার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে শাসক শ্রেণীর দাস সমস্ত দক্ষিণ ও বামপন্থী দল করে এসেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশিক শাসন কালে ভারতবর্ষের মানুষ কে বিদ্রোহের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ভারতের মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি, বড় জমিদারদের স্বার্থে গড়ে দিয়েছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বোর্ড। যার মধ্যে অন্যতম হলো বর্তমান সংসদ, বিধানসভাগুলো, মিউনিসিপ্যালিটির বোর্ড ও কলেজে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের বোর্ড। এই বোর্ড দখলের লড়াই, সংসদ দখলের লড়াইয়ের মধ্যে আটকে রেখে দেশের ছাত্র সমাজ থেকে শুরু করে সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষকে এক বৈপ্লাবিক পরিবর্তনের লড়াইয়ে সামিল হওয়ার থেকে বিপথগামী করার এই রাজনীতির সূচনা করে ব্রিটিশ শাসকেরা আর বর্তমান ভারতের শাসকরা, সেই মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা, সেই জোতদার-জমিদাররা, আর তাদের বিদেশী মালিকেরা ভারতের জনগণ কে, ছাত্র সমাজ কে, সমস্ত খেটে খাওয়া মানুষ কে ধোকা দেওয়ার স্বার্থে সেই বোর্ডগুলোকেই ঘষে মজে কাজে লাগিয়ে চলেছে।

সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বিপ্লবী সংগ্রাম করা যায় একমাত্র গরিব খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইয়ের সাথে এক হয়ে, সেই লড়াইয়ের স্বার্থে দিকে দিকে সংহতিমূলক লড়াই গড়ে তুলে এবং নিজেদের লড়াইতে গরিব মানুষ কে সামিল করার ও গরিব মানুষের উপর নিজ কতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে তাঁদের লড়াইয়ে সামিল হয়ে তাঁদের লড়াইকে বিজয়ের দিকে নিয়ে গিয়ে। বর্তমান ছাত্র যুব আন্দোলন সেই পথ থেকে কয়েকশো ক্রোশ দূরে, শুধুমাত্র একাডেমিক লড়াইতে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে আর তার ফলে ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে এলিটিজম তুঙ্গে উঠছে। এই এলিটিজম ক্যাম্পাসে এবিভিপি কে উচ্ছেদ করার লড়াই না করে এবিভিপির সাথে তর্ক-বিতর্ক করে সমস্যার সমাধানের অলীক স্বপ্ন ছাত্রদের একটি বড় অংশ কে দেখাচ্ছে ও তাঁদের বিশ্বাস করতে শেখাচ্ছে যে বর্তমান শাসন ব্যবস্থার মধ্যেই শান্তিপূর্ণ তর্ক-বিতর্কের আদর্শ উদারনৈতিক আবহাওয়া গড়ে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা সম্ভব।

অন্যদিকে আরএসএস, বিজেপি ও এবিভিপির মতন সংগঠন, জনগণের পিছিয়ে থাকা বৃহৎ অংশটিকে, যাঁদের চেতনার মান এখনো নিম্নস্তরে, তাঁদের, এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে এই এলিটিস্ট ছাত্র-যুবদের জনগণের থেকে  বিচ্ছিন্নতা কে এবং আঁতলামি কে উদাহরণ হিসেবে টেনে তুলছে এবং নিজেদের গরিব মানুষের খাঁটি প্রতিনিধি হিসেবে জাহির করে নানা জায়গায় সিঁধ কেটে প্রবেশ করছে। যেহেতু এদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে, সহজ সরল ভাষায় নিজেদের কথা কে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের শরিক ছাত্র শক্তি ছড়িয়ে দিতে অক্ষম হচ্ছে, যেহেতু সমস্ত প্রগতিশীল এবং বামপন্থী ছাত্র ও যুব সংগঠন সারাদিন শুধু তাত্বিক বিতর্ক, আম্বেদকর ও মার্কস, ফ্যাসিবাদের সূত্র নিয়ে আলোচনায় মত্ত তাই তাঁরা আর গ্রামের মানুষের কাছে, শহরের শ্রমিকের কাছে তাঁদের ঘরের ছেলে মেয়ের মতন যেতে পারেন না। তাঁরা কষ্ট সহ্য করে বিজলী বাতি ও পাখাহীন কৃষকের কুটিরে রাত কাটাতে পারেন না, এবং সর্বোপরি তাঁরা সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারেন না। এর ফলে ধীরে ধীরে ছাত্র-যুব আন্দোলনের সাথে গণতান্ত্রিক জনগণের বিচ্ছিন্নতা বেড়ে গেছে আর অন্যদিকে এই বিচ্ছিন্নতা কে কাজে লাগিয়ে গেরুয়া ফ্যাসিস্ট বাহিনী আজ ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিক কৃষকের আন্দোলনের মধ্যে এক মস্ত বিভেদের প্রাচীর গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমানে ছাত্র ও যুব শক্তির রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এলিটিজম ও সুবিধাবাদ কে বর্জন করে নিজেদের ক্যাম্পাসের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ করে না রেখে সামগ্রিক ভাবে খেটে খাওয়া মানুষের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্যে ছড়িয়ে পড়া। প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি শ্রমিক মহল্লায় পৌঁছে যাওয়া ও সেখানকার গরিব ও শোষিত মানুষকে রাজনীতি দিয়ে শিক্ষিত করে তোলা, তাঁদের চেতনার মানের উন্নতি সাধন করানো এবং আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদ কে পরাস্ত করার দেশব্যাপী ব্যাপক গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে তাঁদের সামিল করা। একমাত্র দেশজোড়া আরএসএস-বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তুলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই কে বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, এবং যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় দেখেননি, তাঁদের মধ্যে প্রচার ও প্রসারের প্রধান কাজটি ছাত্র-ছাত্রীদের করতে হবে।

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ছাত্র-যুবদের কর্তব্য 


ভারতবর্ষের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন প্রতিটি ছাত্র-যুবদের নিজের আন্দোলনকে দ্বান্ধিক ভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। তাঁদের প্রতিটি আন্দোলন কে এই দেখে বিচার করতে হবে যে সেই সংগ্রামের ফলে দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ ও শোষিত জনজাতির মানুষের কি লাভ হবে। তাঁদের দেখতে হবে যে তাঁদের প্রতিটি লড়াই যেন শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ ও শোষিত জনজাতির মানুষের স্বার্থে হয় এবং এই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণীর তৈরি করা সমস্ত বাঁধার প্রাচীর পার হয়ে কি ভাবে ক্যাম্পাসের বাইরের দুনিয়ার মানুষের অধিকার ও মুক্তির লড়াইয়ের সাথে একাত্ম হওয়া যায় সংহতির সেতু ব্যবহার করে।

কর্পোরেট ও জোতদার শ্রেণীর এক ঘৃণ্য মিলনে আজ ভারতবর্ষের মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার। বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজি ও তার দালাল মুৎসুদ্দি ভারতীয়  পুঁজিপতিদের মালিকানাধীন কর্পোরেশনগুলো আজ গ্রাস করে নিতে চলেছে দেশের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ এবং শেষ করে দিতে চাইছে উর্বর জমিগুলো কে উন্নয়নের নামে। এই মুহূর্তে দেশের কোনায় কোনায় শ্রমিক-কৃষক শোষিত জনজাতির মানুষেরা রুখে দাঁড়াচ্ছেন এই কর্পোরেট-সামন্তবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্র যন্ত্র তাঁদের উপর নামিয়ে আনছে তীব্র হিংসাত্মক আক্রমণ। আর কারিয়ারের দৌড়ে বুঁদ হয়ে থাকা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ভারতবর্ষের মানুষের উপর চলমান এই শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা লড়াইয়ের মাঝে আছে এক বিশাল প্রাচীর। স্বার্থের প্রাচীর।

ছাত্রনং অধ্যায়ং তপঃ, ব্রাক্ষণত্ববাদী  শাসক শ্রেণী এই শ্লোক পড়িয়ে ছাত্র শক্তিকে আজ রাজনীতির থেকে বিশেষ করে বাম ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বিরামহীন কারিয়ার গড়ার ইঁদুর দৌড়ে বুঁদ করে রেখেছে। এমনকি যে ছাত্র-ছাত্রীরা আজ প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের পথে চলেছেন তাঁদের উপর হয় নামিয়ে আনছে এবিভিপির মতন ফ্যাসিবাদী সংগঠনের আক্রমণ আর না হয় চিনির বুলেটের মাধ্যমে, টোপ দিয়ে, গবেষণার ফান্ড দিয়ে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁদের বশীভূত করছে। সামগ্রিক ভাবে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে তাই আজ কর্মীর বড়ই  অভাব। সরকারি দলগুলো বাদে মধ্যবিত্ত বাড়ির থেকে আসা উচ্চ জাতির ও এক শ্রেণীর দলিত ও শোষিত জনজাতির ছাত্র ছাত্রীরা আর কোন ছাত্র সংগঠনে বেশি ঘেঁষতে চাইছেন না এই কারণেই। ফলে সংখ্যাতে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের আজ ভাঁটার টান চলছে।

তাই ক্যাম্পাসের মধ্যে বাঁধা থেকে শাসক শ্রেণীর হাত কে শক্তিশালী না করে, দলে দলে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের সংগ্রামের সাথে নিজেদের জুড়ে, বেশি করে শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষদের সাথে মিলেমিশে তাঁদের সংগঠিত করার কাজে জুড়েই প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ছাত্র শক্তি এই ভাঁটার বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে পারবে, আরএসএস এবং তার পিট্টু বাহিনী এবিভিপি কে জনগণের সংগ্রামের ময়দানে পরাস্ত করতে পারবে এবং দেশের মধ্যে জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসা কর্পোরেট-সামন্তবাদ জোটের ফ্যাসিবাদী শাসন কে উৎখাত করার সংগ্রামে নিজের ভূমিকা সঠিক ভাবে পালন করতে পারবে। আজ প্রগতিশীল ছাত্র-যুবদের সবারই মনে রাখা উচিত ১০০ বছর আগে লেনিনের সেই আহবান - “বিলম্ব মানেই মৃত্যু” - আর তাই এই পরিস্থিতিতে আজ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে যদি বিলম্ব করা হয়, তাহলে তার ফল হবে মারাত্মক। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে