ফিরে দেখা নন্দীগ্রাম আন্দোলন: মমতার উবাচ, বুদ্ধের ওয়াও-ওয়াও ও বাস্তবিক ঘটনাগুলো

বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ০১, ২০২১ 0 Comments A+ a-

নন্দীগ্রাম আন্দোলন মমতা শুভেন্দু উবাচ ও বাস্তব


মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় যদি প্লাস্টার করা ঠ্যাং উঁচিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারতেন, তবে হয়তো তাঁর তৃণমূল কংগ্রেস তুলনামূলক ভাবে ভাল ফল করতো। এতদিন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) [সিপিআই(এম)] নন্দীগ্রামে গুলি চালানো নিয়ে "যা করেছি, বেশ করেছি" মার্কা কথা বলে গালাগালি খেয়েছে। হঠাৎ নন্দীগ্রামে পুলিশের সন্ত্রাসের সাথে মমতা  তাঁর দলের প্রাক্তন হেভিওয়েট নেতা শুভেন্দু অধিকারী আর শিশির অধিকারীর “বাপ-ব্যাটার” নাম জড়িয়ে দেওয়ায় যেমন নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে হাসির খোরাকে পরিণত করলেন, তেমনি আচমকা সিপিআই(এম) কর্মীদেৱ  মধ্যে দারুণ একটা “ওয়াও-ওয়াও” অনুভূতি জাগ্রত করলেন।এই “ওয়াও-ওয়াও” অনুভূতি রোগ শয্যায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হল। 


২০১১ সালে বিধায়ক পদ খুইয়ে গোসা করে রাজনৈতিক সন্ন্যাসে চলে যাওয়া বুদ্ধ হঠাৎ উত্তেজনায় একটা বিবৃতিও লিখে আলিমুদ্দিন ছাপ মেরে প্রসে পাঠিয়ে দিলেন। মমতার কাছ থেকে সিপিআই(এম) হঠাৎ জানতে পারলো যে সিপিআই(এম) ক্যাডার এবং  বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ গুলি চালায়নি! এও জানা গেল যে ২৩৪টা আসন জিতে বসে থাকা টানা ৩০ বছর ধরে চলা একটা সরকারের পুলিশ মাত্র ৩০ টা আসন জেতা দলের  নেতার (যাদের আগামী৫০০ বছরে ক্ষমতায় আসার কোনো সম্ভবনা দেখা যাচ্ছিল না) অনুমতি ছাড়া কাজ করতো না। শুধু তাই নয়, বিরোধীদের কথায় চাষীদের উপর গুলিও চালিয়ে দিতো! "আমি যে গুলি চালাইনি, এটাতো আমি জানতুমই না!" বুদ্ধবাবু এই লাইনটা শুধু বিবৃতিতে লিখতে বাকি রেখেছিলেন। অথবা কনফিডেন্ট বুদ্ধ বাবু একটু চাপ না নিয়ে ল্যাদ খাচ্ছিলেন, ১০ বছর পর সব জানাজানি হবে বলে। অথবা তৃণমূল কংগ্রেস এর শিশির অধিকারীই আসলে বামফ্রন্টের পুলিশ মন্ত্রী ছিল এই কথাটা শুধু বলা বাকি।


শিশির অধিকারী সহ সিপিআই(এম) এর অনেকেই  প্রশ্ন তুলেছেন যে গুলি চালানো পুলিশ অফিসারদের মমতা কেন শাস্তি দিলেন না? ন্যায্য প্রশ্ন। এই দাবি "ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি" রেখেছিল এবং তার জন্য ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতাদের এক অংশকে নিষিদ্ধ মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে দেখিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় জেলে ঢোকায় মমতা বন্দোপাধ্যায় এর সরকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ১৯৭২-৭৭ সাল পর্যন্ত নকশালপন্থী এবং সিপিআই(এম) সহ বামপন্থীদের রক্তে হোলি খেলা কতজন কুখ্যাত পুলিশ অফিসার বা কংগ্রেসী মাফিয়া জল্লাদ গুন্ডাকে শাস্তি দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার? কী হয়েছিল রুনু গুহনিয়োগীদের?  


জ্যোতি বসুরা জানতেন  কংগ্রেসের হয়ে সন্ত্রাস চালাবার জন্য পুলিশদের শাস্তি দিলে ভারসাম্য বিগড়ে যাবে। জ্যোতি-বুদ্ধ কোম্পানি  বিরোধীদের উপর গুলি চালাতে বললে তখন আর অফিসাররা গুলি চালাবে না। বিরোধীদের একটু সবক শেখাবার আদেশ দিলে অফিসাররা আর মনের ফুর্তিতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে সৃজনশীলতা ফলাবেনা। ভারতের 'গণতন্ত্রের' এটাই রীতি । ব্যাতিক্রম থাকতে পারে কিছু, তার পেছনেও কিছু নির্দিষ্ট কারণ থাকতে পারে। মমতাও ক্ষমতায় আসার পরে তাই করলেন যা জ্যোতি বসু করেছিলেন কংগ্রেসি আমলের পুলিশ আমলাদের সাথে। শুধু তাই নয়, একটু বেশীই আপন করে নিলেন তাদের। কারণ মমতা জানতেন এদের উপর ভিত্তি করেই টিকে থাকতে হবে।


এতদিন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পেছনে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা CIA এর হাত ছিলো বলে প্রচার করা হয়েছে  সিপিআই(এম) এর তরফে। একথা সত্য যে আমেরিকান পুঁজির স্বার্থ রক্ষায় পৃথিবীর যে কোনো দেশে গিয়ে ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত চালায় CIA। এটাও সত্যি যে CIA এর টার্গেট হয় মূলত বামপন্থীরা। কারণ বামপন্থীরাই মূলত মার্কিন পুঁজি বা মার্কিন বাণিজ্যের  জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকেন। এবার একটু নন্দীগ্রামের দিকে তাকাই। নন্দীগ্রামে বামফ্রন্ট সরকার বৃহৎ মার্কিন কম্পানি ডাও কেমিক্যালস এর কেমিক্যাল হাবের জন্য ১৯,000 একর জমি অধিগ্রহণ করছিল। 


ছোট করে ডাও কেমিক্যালস এর  পরিচয় দেওয়া যেতে পারে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট দের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনারা যে নাপাম বোমা প্রয়োগ করেছিলো তার যোগানদার ছিলো ডাও। ভোপালে ১৯৮৪ সালে আরো বেশী মুনাফার জন্য সেফটি মেজার না নেওয়ার জন্য ইউনিয়ন কার্বাইড নামে একটি আমেরিকান সংস্থার কারখানা থেকে বিষাক্ত গ্যাস লিক করায় প্রায় ১৬,000 হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, পাঁচ  লাখের বেশী মানুষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে যায়। কংগ্রেস সরকারের সহায়তায় উনিয়ন কার্বাইড কর্তা এন্ডারসন ভারত থেকে পালায়। ইউনিয়ন কার্বাইড এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়নি। কংগ্রেস সরকার হোক বা জাতীয়তাবাদের ঠিকাদার অধিকারীদের বর্তমান দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার, এই নিয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে আর একটাও কথা কেউ বলেনা। এই ইউনিয়ন কার্বাইড মিশে গেছে ডাও এর সাথে। সুতরাং এই ডাও কেমিক্যালস হল ইউনিয়ন কার্বাইড। ডাও কেমিক্যালস  প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে নিষিদ্ধ/কালো তালিকা ভুক্ত সংস্থা। 


ডাও এর কেমিক্যাল হাবটি নির্মাণের বরাত পেয়েছিলো ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্ঠী। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৫০-এর দশকে সুকার্নোর নেতৃত্বাধীন আমেরিকা-বিরোধী জাতীয়তাবাদী সরকারকে সামরিক অভ্যুথানের এর মাধ্যমে উচ্ছেদ করা  হয়। CIA এর মদদে  এই সামরিক অভ্যুথান এবং কমিউনিস্ট-বিরোধী গণহত্যা সংগঠিত করে ইন্দোনেশিয়ার সেনা এবং মাফিয়ারা। এই মাফিয়াদের অন্যতম নেতা ছিলেন সালেম গোষ্ঠীর কর্ণধার  সুহার্তো সালেম। এর থেকে সালেমদের সাথে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ এবং CIA এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক খুব সহজেই অনুমেয়। সুতরাং নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে CIA যদি কোনো ভূমিকা নিয়েই থাকে, তবে সেটা নিয়েছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বিরুদ্ধেই। কারণ CIA মমতা নয়, তাই CIA নিশ্চয় সেম সাইড করতে যাবে না! 


প্রশ্ন হলো যে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কৃষকরা না চাইলে জমি অধিগ্রহণ হবেনা এই বিবৃতি দেওয়ার পরেও কেন আন্দোলন চলতে থাকলো? কারণটা হল এই যে টিভিতে বা সকালের সংবাদপত্রে মুখ্যমন্ত্রীর বয়ানের সাথে সিপিআই (এম) এর জেলা নেতা এবং বন্দুকধারী ক্যাডারদের আচরণের কোনো সামঞ্জস্য ছিলনা। মানুষ ২ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে গ্রামবাসীদের থেকে বেশী পুলিশ জমায়েত করে, বাচ্চা বুড়ি রেয়াত না করে বাড়ি থেকে টেনে বের করে পিটিয়ে, ধানের গোলা জ্বালিয়ে দিয়ে, ঘর ভেঙে, জমি দখলের দৃশ্য টিভিতে দেখেছিলেন । মানুষ দেখেছিলেন  সিঙ্গুরের অত্যন্ত উর্বর জমিকে মুখ্যমন্ত্রী অবলীলায় একফসলি বা বাঁজা জমি বলে উল্লেখ করেছিলেন। কৃষকরা সরকারকে বিশ্বাস করতেন না। শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে সরকারকে বিশ্বাস করা আদৌ কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলেই মনে করি। 


সিবিআই কেন ১৪ই মার্চ গুলি চালানো নিয়ে ক্লিনচিট দিয়েছিল? শ্রেণী স্বার্থের কথা, প্রশাসনিক ভারসাম্যের কথা ছেড়েই দিলাম, সিবিআই আদতে কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা কি না সেই প্রশ্নও আপাতত তোলা থাক। সিবিআই এর রিপোর্টে আসলে কী লেখা ছিল? এটাই লেখা ছিল যে পুলিশ গুলি চালিয়ে কৃষকদের খুন করার আগে সমস্ত নিয়ম নীতি পালন করেছিল; পুলিশ কোনো গাফিলতি করেনি। যেমন মাইকে ওয়ার্নিং দেওয়া, কাঁদানে  গ্যাসের শেল  ফাটানো, হাওয়ায় গুলি করা, ইত্যাদি। আর এই দেখে সিপিআই(এম) আহ্লাদে আটখানা। আন্দোলনের সমর্থকদের কেউ কেউ কনফিউজড। কিছুক্ষণের জন্য ধরেই নিলাম যে সিবিআই এর সব কথা সত্যি। তাতে কী যায় আসে? 


ধরা যাক একদল লোক আপনার বাড়ির দরজা ধাক্কিয়ে বললো "ডাকাতি আমাদের পেশা, আপনার বাড়ি শান্তিপূর্ণ ভাবে ডাকাতি করে চলে যাবো, আমাদের কাজে সহযোগিতা করুন"। এবার আপনি কী করবেন আপনাকে জানিয়ে ডাকাতি করতে এসেছে বলে "চুপচাপ শান্তিপূর্ণ ভাবে" ডাকাতি করতে দেবেন, তাইতো? সিপিআই(এম) এর লজিক অনুযায়ী আপনার তাই করা উচিৎ। কিন্তু আপনি যদি ডাকাতের সাথে সংঘাতে জড়ান এবং ডাকাতের গুলিতে আহত হন বা আপনার বাড়ির কেউ মারা যায়, তবে সিপিআই(এম) এর যুক্তি অনুযায়ী আপনার অভিযোগ করার কোনো অধিকার নেই। অথবা দোষ তো আপনারই! কারণ ডাকাত তো সতর্কবার্তা দিয়েছিল! ডাকাত তো শান্তিপূর্ণ ডাকাতিতে সহযোগিতা করার কথা বলেছিল! 


নন্দীগ্রামে মার্কিন সংস্থা ডাও কেমিক্যালের  হয়ে যেমন মাঠে নেমেছিল বামফ্রন্ট সরকার, তেমনি বামপন্থীরাই কৃষকদের সংগঠিত করে মাটিতে দাঁড়িয়ে গড়ে তুলেছিলেন আন্দোলন। তৃণমূল সেই সময় প্রধান বিরোধী দল ছিল, তাই আন্দোলনে তার একটা স্বাভাবিক প্রভাব ছিলো। মমতা ছিলেন কলকাতায় বসে আন্দোলনের নেতা, আর শুভেন্দু অধিকারী  ছিলেন কাঁথিতে বসে আন্দোলনের নেতা। আন্দোলনের শুরুটা সিপিআই (এম-এল পিসিসি) নেতা সুমিত সিনহাকে ছাড়া ভাবা যায় না। মাওবাদীদের নেতাদের বাদ দিয়ে আন্দোলনের মধ্যেখানটা ধরে রাখা, আন্দোলনের শক্তি সংগ্রহ, প্রচার, বিস্তার ভাবা যায় না। এ ছাড়াও এসইউসিআই, সিপিআই (এম-এল)-এর বিভিন্ন গোষ্ঠী, প্রগতিশীল বামপন্থী মানুষের অবদান আন্দোলনকে অনেক শক্তি যুগিয়ে ছিল। এবং অবশ্যই তৃণমূলের  স্বভাব সুলভ বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আন্দোলনের শেষটা হয়না। 


২০০৬ সালের জুন মাসে সুমিত সিনহারা নন্দীগ্রমে প্রায় ৮০০ মানুষের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালান জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে। সেই সমীক্ষা  থেকে উঠে আসে ৯০% কৃষক জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আতঙ্কিত এবং অনিচ্ছুক। আমার অভিজ্ঞতায় এর কারণটা হল নন্দীগ্রামের উল্টোদিকে হলদিয়া শিল্পাঞ্চল, এ ছাড়া নন্দীগ্রামেই জেলিংহাম কারখানা জন্য জমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতি পূরণ এবং চাকরির প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৃষকদের অভিজ্ঞতা ভাল ছিল না। সার্ভে রিপোর্টের উপর ভিত্তি  করে জুলাই মাসে সুমিত সিনহা একাই নন্দীগ্রাম পৌঁছে  গিয়ে কৃষকদের সাথে আলাপ আলোচনা চালাতে থাকেন, ছোট ছোট কর্মসূচীও নিতে থাকেন। 


মনে রাখতে হবে নন্দীগ্রাম ছিলো সিপিআই(এম) এর ঘাঁটি। বিরোধীদের অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না বললেই চলে। সুতরাং সুমিত সিনহারা যাদের সংগঠিত করছিলেন তারা কিন্তু সিপিআই(এম) এরই কর্মী সমর্থক ছিলেন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম বাস স্ট্যান্ডে প্রায় ১০,০০০ কৃষকের জমায়েত হয়। সেই জমায়েতে উপস্থিত ছিলেন পিসিসি সিপিআই (এম-এল) নেতা প্রয়াত সন্তোষ রাণা, জামাতে উলেমা এ হিন্দ নেতা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী সহ আরো অনেকে। এর পালটা হিসাবে লক্ষ্মণ শেঠের নেতৃত্বে সিপিআই(এম) একই জায়গায় প্রায় ১০,০০০ মানুষের জমায়েত করে মানুষকে জমি অধিগ্রহণের এর পরিকল্পনা, চাকরি, উন্নয়ন নিয়ে নানা কথা বলে। সেই সভাতেই সিপিআই(এম) এর কর্মীরাই মঞ্চে উঠে প্রতিবাদ করে, সিপিআই(এম) নেতৃত্বের সাথে সংঘাতে জড়ায়। এর পর সিপিআই(এম) এর ঐ জমায়েত থেকেই জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন এক অন্য মাত্রা পায়। 


৩ জানুয়ারী ২০০৭ এ গড়চক্রবেড়িয়ার একটি পঞ্চায়েত অফিসে একজন সরকারি আমলা আসেন নির্মল ভারত (নরেন্দ্র মোদী সাহেব যার নাম “স্বচ্ছ ভারত”  দিয়েছেন) বা পায়খানা বসানোর প্রকল্প সংক্রান্ত কাজে। কিন্তু ঐ দিনই "বর্তমান" কাগজে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি খবর বের হওয়ায় গ্রামের মানুষের মনে হয় যে, আমলাটি জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজেই এসেছেন। সুমিত সিনহার নেতৃত্বে কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ মিছিল পঞ্চায়েত অফিস যায় এবং ঝগড়ায় জড়ায়। কৃষকদের সাথে প্রথমে খুব ঔদ্ধত্যের  সাথে কথা বলা হলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে চলে যায়। 


পঞ্চায়েত থেকে পায়খানা বসাবার কথা বলা হলে কৃষকরা বলেন "জমি চলে যাবে আর এখন হাগা নিয়ে চিন্তা করতে হবে!"  পঞ্চায়েত অফিস থেকে বিশাল মিছিল ছড়িয়ে পরে। এই মিছিলকে চেজ করতে পুলিশ আসে, যত দূর মনে পড়ছে কয়েকজনের পায়ে আর আঙুলে পুলিশের গুলিও লেগেছিল। ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীরা দারগাপুরা মোড়ে  পুলিশদের বেধে রাখে, পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তিনটে রাইফেল ছিনতাই করে। পরে যদিও জামাত এ উলেমা হিন্দের সামাদ গিয়ে রাইফেলগুলো ফেরত দিয়ে আসে। এর পর ৭ জানুয়ারী সিপিআই(এম ) গ্রাম দখল করার চেষ্টা করে, ভরত মন্ডল, শেখ সেলিম, সহ ৭ জন খুন হয় সিপিআই(এম) বাহিনীর হাতে। বাড়ির সামনে পানের বড়জ থেকে গুলি চালাচ্ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা শঙ্কর সামন্ত। ক্ষিপ্ত কৃষকরা ধাওয়া করে তাকে ধরে ফেলে এবং জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেয়। 


জমি অধিগ্রহণের পক্ষে থাকা সিপিআই(এম) কর্মীরা ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। আর বাকি সিপিআই(এম) এর কৃষকরা ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআই (মাওবাদী), এসইউসি, ইত্যাদি দলে সামিল হয়ে আন্দালন চালাতে থাকেন। এর পর ১৪ মার্চ সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নন্দীগ্রামে ঘটে। সমস্তটা লেখার পরিসর নেই। শুরুতে না থাকলেও সিপিআই (মাওবাদী) দলের রাজ্য নেতৃত্ব খুব গুরুত্ব দিয়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। মাওবাদী দলের কর্মীরা গ্রামে হিরো হয়ে হঠেন। ১৪ মার্চ এর পর সিপিআই(এম) এর প্রতি মানুষের ঘৃণার ফলে ইনকিলাব জিন্দাবাদ বা লাল সেলাম বললে গ্রামবাসীরা রেগে যেতেন। পরবর্তীতে দেখেছি ঐ গ্রামবাসীরা দেখা হলে বা বিদায়ের সময় একে অন্যকে হাত মুঠো করে লাল সেলাম বলছেন।


শিশির অধিকারীর সাহায্য ছাড়া ১৪ই মার্চ পুলিশ ঢুকতে পারতো না এই কথা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। তবে তারিখ ভুল, ১০ নভেম্বর ২০০৭ এ সিপিআই (এম) এর “অপারেশন সূর্যোদয়”  অধিকারী বাপ-ব্যাটার সাহায্য ছাড়া সম্ভব ছিল না। আর শুধু অধিকারী বাপ ব্যাটাই নয়, এখানে পার্থ চ্যাটার্জি এবং খোদ মমতারও ভূমিকা আছে। অক্টোবর মাসে কলকাতায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মধ্যস্ততায় বুদ্ধ-মমতার সেটিং হয়। ঠিক হয় এবার আন্দোলন গোটাতে হবে। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। পুলিশ না ঢুকলে নির্বাচন হবেনা। নির্বাচন না হলে তৃণমূলের  খাটনি বৃথা যাবে। নির্বাচনে খাতা খোলার স্বার্থে তৃণমূলের এই আপসকে কাজে লাগিয়ে সিপিআই(এম) পুনরায় গ্রাম দখল করতে চেয়েছিল। 


সিপিআই(এম )এর হামলার মুখে আর প্রতিরোধ না গড়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব সবাইকে ত্রাণ শিবিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। তৃণমূল চেয়েছিল মাওবাদীরা ধরা পড়ুক, মারা যাক, তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের ঘর জ্বলুক, তারা খুন হয়ে যাক, কিন্তু যে কোনো মূল্য পঞ্চায়েত নির্বাচন হোক। তৃণমূলের এই নীতির ফলেই সিপিআই(এম) ব্যাপকভাবে হত্যা এবং সন্ত্রাস চালিয়ে গ্রাম দখল করে। সিপিআই(এম) এর এই সন্ত্রাসের মুখে একমাত্র সিআরপিএফ এর ভরসায় তৃণমূল কর্মীরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। সিপিআই(এম) এর সশস্ত্র আগ্রাসনের সামনে তৃণমূল কংগ্রেস  নেতৃত্ব ভেবেছিল যে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেছে। কিন্ত মানুষ ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে সব হিসেব উল্টে দিয়েছে। মানুষের কাছে তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া আর কোনো নির্বাচনী বিকল্প ছিল না। 


আমরা, যাঁরা তখন ছাত্র, নন্দীগ্রামের কৃষকদের থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম করা শিখতে যেতাম, আর কৃষকদের নাটক, গান, বক্তৃতায় বা গ্রাম পাহারায় রাত জেগে বোঝানোর চেষ্টা করতাম আন্দোলনটা শুধুমাত্র সিপিআই(এম) এর বিরুদ্ধে নয়, এই লড়াই আমেরিকান পুঁজিপতিদের নির্দেশিত অপ উন্নয়নের বিরুদ্ধে। বোঝাতাম কী ভাবে অন্য রাজ্য গুলোতে অন্য দল গুলোও পুঁজিপতিদের স্বার্থে শ্রমিক কৃষকদের উপর অত্যাচার করছে। আমরা আন্দোলনের সংগঠকদের সাহায্য করতাম। আমাদের সংগঠন ইউএসডিএফ (যা এখন আরএসএফ) এর কয়েক জন নেতা-নেত্রী স্নাতকোত্তরের পড়া কাটিয়ে স্থায়ী ভাবে আন্দোলনের কাজে নন্দীগ্রামে থাকতে শুরু করেছিল। এ ছাড়াও আইসা, পিডিএসএফ, এআইপিএসএফ  এর কমরেডরা আন্দোলনের প্রচারে, সংহতি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

 

নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলন সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের উৎসাহিত করেছিল, শুধু তাই নয় দেশ জুড়ে জমি অধিগ্রহণের  ঢেউ আটকে দিয়েছিল। এই আন্দোলনের চাপেই ২০১০ সালে কংগ্রেস সরকার ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন বদলে নতুন আইন আনতে বাধ্য হয়। যা এতদিন কোনো তথাকথিত প্রগতিশীল সরকারের মাথায় আসেনি। এর থেকে শিখেছিলাম আইন পার্লামেন্টে তৈরি হয়না, বরং মেহনতী মানুষের সব কিছু হুল্লাট করে দেওয়া আন্দোলনেই জনস্বার্থবাহী আইন তৈরি হতে পারে। আর পার্লামেন্ট নিজে নিজে যা আইন তৈরি করে তা সবই জনবিরোধী। ফলে আমরা যারা মাটিতে দাঁড়িয়ে নন্দীগ্রামের কৃষকদের লড়াই দেখেছি, বিশাল আন্দোলনে অতিসামান্য হলেও কনট্রিবিউট করেছি, তারা গর্বিত। শুধু তাই নয়, এখন যাঁরা  আরএসএফ, আইসা, পিডিএসএফ, এআইএসএফ করেন তাঁদেরও  মনের জোর এটা দেয় যে তাঁদের সংগঠনগুলো একটা বিশাল ঐতিহাসিক আন্দোলনের সরাসরি শরিক হয়েছিল।

 

নন্দীগ্রামের কৃষকের লাশ ভাঙিয়ে কেউ বিধায়ক,, সাংসদ  বা মন্ত্রী হয়েছেন। নন্দীগ্রামের কৃষকের লাশ ভাঙিয়ে কিছু বুদ্ধিজীবী সল্টলেকে জমিও পেয়েছেন, বিভিন্ন সরকারি পদ পেয়েছেন। আর যাঁরা মাটিতে দাঁড়িয়ে সংগঠনটা করেছিলেন তাঁরা এখনো মামলার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আছেন, অনেকেই রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় জেলে আছেন এখনো। আর আমরা পেয়েছি মানুষের ভালবাসা। কৃষকের লাশগুলো আমাদের কাছে চেতনা। তাই যখন কোনো রাজনীতি ব্যবসায়ী তার সাময়িক রাজনৈতিক স্বার্থে আন্দোলন নিয়ে দায়িত্ব জ্ঞানহীন মন্তব্য করে বসে এবং সেই সুযোগে সে দিনকার জল্লাদরা আবার জেগে  উঠে আন্দোলনটাকেই নস্যাৎ করে দিতে চায়, তখন আবার আন্দোলনের কথা প্রচার করা জরুরি। আজকের লক্ষী ছানা সিপিআই(এম) কে দেখে সে দিনের সিপিআই(এম) কে বোঝা সম্ভব নয়। ১০ বছর ক্ষমতায় না থাকা একটা দল আক্রমণের কেন্দ্র বিন্দুও হতে পারেনা। কিন্তু নন্দীগ্রামের আন্দোলন নস্যাৎ করার মধ্যে দিয়ে আগামী দিনের বিশ্বায়ন তথা সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে যে কোনো লড়াইকে অস্বীকার করার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে যায়। তাই এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যাক্তির কর্তব্য বলে মনে করি।



এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে