লেনিনের মূর্তি থেকে লেনিনবাদ রক্ষার্থে, বিপ্লবের পথেই হবে এগোতে

শুক্রবার, মার্চ ০৯, ২০১৮ 0 Comments A+ a-


আজ থেকে ২৬ বছর আগে অনেক লোকে চেষ্টা করেছিল লেনিনের মূর্তি ভেঙে লেনিন কে জনতার মন থেকে, জনতার চেতনা থেকে মুছে দিতে। দেশটা রাশিয়া, সালটা ১৯৯১, আর ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে গর্বাচেভ ও য়েলৎসিনের মধ্যে, তার মধ্যে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো লেনিনের মূর্তিগুলো কে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একদল লোক। লেনিনের পাথরের মূর্তি রাস্তায় পড়ে ভেঙে যেতেই তাঁদের উল্লাস শুরু হলো। যাঁরা সেই ১৯৯১ সালে রাশিয়া সহ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন দেশে লেনিনের মূর্তি ভেঙেছিলেন, কাস্তে হাতুড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো করেছিলেন, তাঁদের অনেক সাজিয়ে গুজিয়ে সমাজতন্ত্র-বিরোধী ও সাম্যবাদ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে পশ্চিমী বৃহৎ পুঁজির মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যম তুলে ধরেছিল এবং আমাদের মতন ছা-পোষা  আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশের চাটুকার সাংবাদিকেরা সেই লেনিন-বিরোধী “স্বাধীনতা সংগ্রাম” কে একেবারে লেবু লঙ্কা সহকারে গরম ভাতে চটকে মেখে জনগণ কে খাইয়েছিল। যেহেতু লেনিন হলেন সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহক বিভিন্ন রঙ বেরঙের শোধনবাদীদের কাছে মৃত্যুর ফেরেস্তার মতন, তাই এহেন লেনিনের মূর্তি ভাঙ্গা হতে দেখে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজরা, জাতি বিদ্বেষের আগুন জ্বালাবার কারিগরেরা সারা বিশ্বের মতন ভারতেও উল্লাস করেছিল। উল্লাস করেছিল এই ভেবে যে এবার বুঝি লেনিন আর লেনিনবাদ সত্যিই দোজখের আগুনে পুড়ে ছাই হবে। তাঁরা আশা করেছিল যে লেনিন থেকে লেনিনবাদ, লাল ঝাণ্ডা থেকে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বলশেভিক ধাঁচের, চীন ধাঁচের বিপ্লবের সম্ভাবনা বুঝি সেই আদিম যুগের ডাইনোসরের মতন অবলুপ্ত হল। সালটা তখন ১৯৯১।


দেখতে দেখতে ২৫ বছর কেটে গেলেও, লেনিনের মূর্তি ভেঙে রাশিয়া সহ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি দেশে উগ্র কমিউনিস্ট-বিরোধী ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরেও, চীনের বুকে পুঁজিবাদের পতাকা পতপত করে ওড়া সত্ত্বেও, লেনিনের প্রেতাত্মা এখনো সাম্রাজ্যবাদ ও তার তল্পিবাহকদের ভীষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যাজক, পুরুত ও মোল্লাদের কাজে লাগিয়েও বিশ্বের উপর লেনিনের প্রেতাত্মার প্রভাব কে সাম্রাজ্যবাদীরা শেষ করতে পারছে না, লেনিনের মরদেহ কে কবরে চাপা দেওয়ার জিগির তুলে লেনিনবাদ কে কেন জানি না শেষ করতে পারছে না। মনে পড়ছে মার্কস ও এঙ্গেলস এর বলে যাওয়া আর এক প্রেতাত্মার কথা, “কমিউনিজম এর প্রেতাত্মার” কথা। মার্কস ও এঙ্গেলস এর লেখা কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহারের প্রথম লাইনেই উল্লেখিত আছে যে ইউরোপ ও তার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরা কমিউনিজমের ভূত দেখছে। প্রথম ভূমধ্য যুদ্ধের কুখ্যাত চক্রান্তি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম লেলো কুকুর বড় জর্জ বুশ একদিন বুক বাজিয়ে বলেছিল যে কমিউনিজমের কফিনে শেষ পেরেক নাকি সেই পুঁতেছে। তারপর অবশ্য মিসিসিপি নদী দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে, ছোট বুশ এসে আফগানিস্তান আর বাপের স্বপ্নের ইরাক দখল করেছে, ওবামা সিরিয়া থেকে ইয়েমেন, সর্বত্রে আগুন জ্বেলেছে, ট্রাম্পের ঘাড়ে ভর করে আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নতুন করে বেঁচে উঠতে চাইছে সর্বগ্রাসী এক সর্বনাশের পাঁকে ডুবতে ডুবতে। তবুও এদের কমিউনিজমের ভূত তাড়া করেই বেড়াচ্ছে, লেনিন এখনো আতংকিত করেই চলেছেন, ২০১৮ সাল এসেও নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না মুছে যাওয়া লাল ঝাণ্ডার “আতঙ্কের” থেকে, লাল সন্ত্রাস যেন সর্বত্রে ভয় দেখাচ্ছে আমাদের খুবই আপন ট্রাম্পবাবু ও দেশে দেশে তাঁর পোষা নেড়িদের। কফিনের পেরেক উপরে ফেলে কমিউনিজম ও বিপ্লবী বামপন্থা বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসেছে বলেই তো আমাদের দেশে শ্যামা মুখুজ্জ্যের ছানারা ভোটের পর ভোট বুক বাজিয়ে জিতেও কোনদিন নিস্তার পাচ্ছে না কমিউনিস্ট-আতঙ্কের থেকে।লাল আতঙ্ক ওদের যত্র তত্র হিসি করে ফেলতে বাধ্য করছে।কোথাও নিস্তার নেই।  


নিস্তার নেই বলেই আজ বিলোনিয়ার বুকে লেনিন মূর্তি ভাঙতে, গেরুয়া বানর সেনা কে নিয়ে আসতে হয় বিশাল দলবল আর বুলডোজার। চে গেভারা কে যে বলিভিয়ান সৈনিক গুলি করে খুন করেছিল, সে বারবার জীবন্ত চে কে মারতে গিয়ে তাঁর চোখে চোখ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সিআইএ’র লোকেরা তাঁকে আকণ্ঠ মদ্যপান করিয়ে শেষ পর্যন্ত বন্দুক হাতে চে’র সামনে পাঠায় এবং সেই মাতাল সৈনিক তখন ভয়ে, আতঙ্কে ও নেশার তীব্র ঘোরে জোরে টিপে ধরে ট্রিগার। গুলিগুলো যখন চে গেভারা কে এফোঁড় ওফোঁড় করছিল তখনও চে নির্লিপ্ত, তবে সেই সৈনিক তীব্র ভাবে কেঁপে উঠেছিল, তাঁর অন্তর কেঁপে উঠেছিল। সরোজ দত্তের গলা কেটে মুন্ডুটা ধর থেকে আলাদা করতে সে রাতে রুনু গুহনিয়োগী ও দেবী রায়ের মতন ইন্দিরার পোষ্য নেড়িদেরও প্রচুর মদ খেতে হয়েছিল। প্রচুর মদ আবার খেতে হলো সেই বুলডোজার চালককে যাকে দিয়ে ত্রিপুরার বুকে লেনিনের মূর্তিটি ভাঙ্গানো হলো। সালটা ২০১৮। লেনিনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও লেনিনের আতঙ্ক দুইটি আজও বিদ্যমান ও বেশি বেশি করে প্রকট হয়ে উঠছে। ফিনিক্স পাখির কথা অনেকে গল্পের পাতায় পড়েছেন। লেনিন আজ মূর্তমান ফিনিক্স পাখি সেজে এই বিশ্বে এক আতঙ্কের মতন চেপে বসেছেন তাঁদের হৃদয়ে যাঁরা জনগণ কে, গরিব আর খেটে খাওয়া মানুষ কে, শোষণ ও অত্যাচার করে নিজেদের বিশাল মসনদ গড়ে তুলছে। কবি সুকান্তের ভাষায় যাদের মহল গড়ে উঠেছে মজুর ও কিষানের হাড়গোড় দিয়ে, তাঁরাই লেনিনের দুঃসপ্ন দেখছেন।  


ত্রিপুরার বুকে লেনিনের মূর্তি ভেঙে ফেলাটা জাতীয় সংবাদ হয়ে উঠলো। বিভিন্ন রাজ্যে ও সারা পৃথিবীতে খুব শীঘ্রই প্রচারিত হয়ে গেল লেনিন মূর্তি ভাঙ্গার কাহিনী। হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের এই কর্মকাণ্ড কে দু হাত তুলে সমর্থন শুধু ব্রাক্ষণত্ববাদী, উঁচু জাতের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত হিন্দুরাই নয়, বরং প্রচুর বেহেস্তের স্বপ্ন দেখা ঈমান রক্ষাকারী মৌলবী এবং পাদ্রীগণও প্রকাশ্যে ও গোপনে করে বসলে। তাঁদের সকলের ‘রা একজায়গায় এসে মিললো, তার কারণ শত্রুর শত্রু তো আমার বন্ধুই বটে। তাই সিপিএমের বিরুদ্ধে ঘৃণা থেকে যখন লেনিনের মূর্তি ভাঙ্গা হলো তখন শির্কের বিরুদ্ধে জয় হয়েছে বা মুশরিকদের পতন হয়েছে বলে যে কম মৌলবাদীরা ধেই ধেই করে নেচেছে তাই নয়, বরং অনেকে আবার এই মূর্তি ভাঙ্গার মধ্যে হিন্দুত্ববাদী শিবিরের ইসলামের প্রতি আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছে। অনেকে মিটিমিটি হেসেও আবার প্রকাশ্যে লেনিন মূর্তি ভাঙার ভীষণ বিরোধিতা করছেন।  যেমন ধরুন আমাদের মমতা বন্দোপাধ্যায়। সিপিএমের ভদ্রলোক নেতারা যখন ধুতির কোছা সামলাতে সামলাতে ঠিক কি ভাষায় ত্রিপুরার বুকে নির্বাচন-পরবর্তী হামলা ও লেনিন মূর্তি ভাঙার বিরোধিতা করবেন তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বাঁকুড়ার মাটির থেকে আচমকা মার্কস-লেনিনের মূর্তি ভাঙ্গা চলবে না বলে গর্জে উঠলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। জাতীয় সংবাদের দ্বিতীয় শিরোনাম। লাগ-লাগ-লাগ মাভৈ মাভৈ। 


পিআর আর টিআরপি’র এই যুগে লেনিনের মূর্তি ভালোই বাজার ধরেছে। রাম মাধব থেকে বড়বড় আরএসএস নেতা, কলকাতা থেকে আরএসএস’র ঘাঁটি গড়ে তুলতে ত্রিপুরা পাঠানো সেই রাজ্যের বড়লাট, থুড়ি গভর্নর সাহেব, তথাগত রায়, সকলেই উল্লসিত লেনিনের মূর্তি ধুলোয় মিশিয়ে যেতে দেখে। লেনিন কিন্তু তবুও, মৃত্যুর প্রায় একশত বছর পরেও এত প্রাসঙ্গিক। লেনিন বারবার বুর্জোয়া কাগজের ভাষায় অপ্রাসঙ্গিক হয়েও কেন যেন এত প্রাসঙ্গিক। আচ্ছা আপনি লক্ষণ ভোপাতকার’কে চেনেন? কখনো নাম শুনেছেন? বা ধরুন আপনার কি মনে হয় সুন্দর সিংহ ভান্ডারী কে? শুনেছেন তাঁর নাম? না, আপনার চট করে মনে পড়ছে না। তবে লেনিন কে সেটা আপানার জানা আছে। মানে দাঁড়ালো ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদীরা, যাঁরা আজ বুক বাজিয়ে লেনিনের মূর্তি ভেঙে উল্লাস করছে, মিষ্টিমুখ করছে আর মদের ফোয়ারা ছোটাচ্ছে, দুনিয়া কি তাঁদের কথা মনে রাখবে, মনে রাখবে কি তাঁদের কথা যাঁরা একদিন রাশিয়া বা সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নানা দেশের মাটিতে লেনিনের মূর্তি ভেঙেছিলেন? তাঁদের কারুর নাম মনে পড়ে? 


তবুও মূর্তি ভাঙ্গে, কারণ মূর্তি না ভাঙলে নতুন মূর্তি গড়া যায় না। লেনিন না ভাঙলে শ্যামা মুখুজ্জ্যে গড়া  যাবে না, লাল ঝাণ্ডা না পোড়ালে গেরুয়া বা  তেরঙ্গা ঝাণ্ডা উত্তোলন করা যাবে না। আসলে সেই কবে বুড়ো মার্কস সাহেব বলে গেছেন যে এযাবৎকাল অবধি বিশ্বের ইতিহাস শুধুই শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর সাথে ক্ষমতার জন্যে, উৎপাদনের উপকরণের উপর মালিকানার জন্যে এবং নিজ শ্রেণী কে শাসক শ্রেণীতে রূপান্তরিত করার জন্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ করে চলেছে। তা এই শ্রেণী সংগ্রামের ময়দানে শ্রমিক ও কৃষকের মুক্তির লড়াইয়ের কান্ডারি লেনিন আছেন, শোষিত-নির্যাতিত ভারতবাসীর স্বার্থে সংগ্রাম করে জীবনদান করা টিপু সুলতান, সিধু-কানু, মঙ্গল পাণ্ডে, রানী লক্ষ্মীবাঈ, ক্ষুদিরাম, বীরসা মুন্ডা, বাঘা যতীন, ভগৎ সিংহ থেকে চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত এবং দ্রোণাচার্য ঘোষেরা যেমন আছেন ঠিক তেমনি আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল নেহরু-গান্ধী-শ্যামা মুখুজ্জ্যে-গোলবালিকার মতন বুর্জোয়া শিবিরের পূজনীয় সকল চরিত্রগুলো। তাই একদলের মূর্তি গড়া ও একদলের মূর্তি ভাঙ্গা চলতেই থাকবে, শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস মূর্তি ভাঙার ইতিহাস। লেনিন কে কেউটে লেনিন থেকে ঢোঁড়া লেনিন বানিয়ে যে সংশোধনবাদীরা আজ ইবাদত করছে তাঁরাই কিন্তু রাষ্ট্র, বিপ্লব ও শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে লেনিনীয় সকল নীতি ও আদর্শ কে সেই ১৯৬৪ সালেই বিসর্জন দিয়েছিল। তাঁরা চায় গান্ধী ও লেনিন, শ্যামা মুখুজ্জ্যে ও কার্ল মার্কস, বিনায়ক সাভারকার ও ভগৎ সিংহ সবাই একত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করুন আর মাঝখান থেকে নেপোয় মারে দই এর মতন বড় বড় কর্পোরেটগুলো শান্তিপ্রিয় ভারতবাসীর মাটি, জল, শ্রম ও সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যাক। লড়াইয়ের জন্যে তো আবার নির্বাচন অবধি অপেক্ষা করতে হবে, কারণ সংবিধান আজ পূজনীয় আসমানী গ্রন্থ হয়েছে নব্য আম্বেদকরবাদী ও প্রাচীন ডাঙ্গে বা রণদিভেবাদী “বামপন্থীদের”, আর সংবিধান বলে সরকার অনুমোদিত সকল মূর্তি নিজ জায়গায় থাকবে, আক্রমণ হবে শুধু নির্বাচনের আগে পরে। লেনিন কে ভাঙতে তাই বিজেপি কে ডাকতে হয় বুলডোজার। যে লেনিন নাকি বহু বছর আগেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন সেই লেনিন কে নিয়ে শুরু হয় বহু হৈচৈ, রাশিয়াতে লেনিনের পাথরের মূর্তি ভাঙার ২৫ বছর পরে। 


আজ বিতর্ক চলছে কার মূর্তি ভারতবর্ষে থাকবে আর কার থাকবে না তাই নিয়ে। নানা মুনির নানা মত। নরেন্দ্র মোদী থেকে তথাগত রায়, রাম মাধব থেকে প্রকাশ কারাত, সকলেই নিজ নিজ মত রেখে চলেছেন। কেউ মনে করে অভারতীয়দের মূর্তি ভারতে রাখা চলবে না, আবার কেউ মনে করেন যে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে যাঁরা সামিল হননি তাঁদের মূর্তি গড়া চলবে না। আবার অনেকের মত যে সব মতের মনীষী ও প্রথিকৃৎদের মূর্তি কে শিল্প কলা হিসেবে গণ্য করে (অর্থাৎ শিল্পটা রাজনীতির থেকে আলাদা করে দেখা উচিত - এই বক্তব্যের প্রবক্তারা) রক্ষা করা উচিত। নানা মত আর নানা ধারা ও উপধারার বামপন্থীরা, কমিউনিস্টরা, বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবীরা কিন্তু মূর্তি প্রসঙ্গে নানা মত পোষেন।  আর প্রতিটি মতের আপন একটি পথ আছে। সেই ঠাকুর যেমন বলেছিলেন “যত মত তত পথ”, ঠিক তেমনি। তবে যেহেতু মার্কসবাদ-লেনিনবাদ উদারনৈতিক “যত মত তত পথ” মতবাদের বিপরীতে একটি শ্রেণীর মত ও পথ কে উর্দ্ধে তুলে ধরে তাই মূর্তির প্রশ্নেও সমস্যার সমাধানটি সেই সূত্রটি ধরেই খোঁজা উচিত। 


কার মূর্তি থাকবে? কার মূর্তি থাকবে না? মার্কসবাদ-লেনিনবাদ আমাদের শেখায় যে শ্রেণী শাসন ক্ষমতায় থাকে তাঁরা ভিত্তির উপর, অর্থাৎ অর্থনীতির উপর নিজেদের একচেটিয়া অধিকার বজায় রাখে আর সেই অর্থনীতির ভিত্তির উপরে গড়ে ওঠে উপরিকাঠামো যার অঙ্গ হল শিল্প কলা, স্থাপত্য কলা ইত্যাদি, ফলে সেই উপরিকাঠামোর উপরও তাঁদের দখলদারি বজায় থাকে। একটি সমাজের অর্থনীতি ও রাজনীতি যে শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত সেই শ্রেণী অবশ্যই সেই সকল মূর্তি, কলা ও ভাস্কর্য কে প্রাথমিকতা দেবে বা সহ্য করবে যা তাঁদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক  প্রতিপত্তিকে সমর্থন করবে, রক্ষা করবে ও জনমানসে বৈধতা দেবে। গান্ধী-নেহরু থেকে শ্যামা মুখুজ্জ্যে বা হেগরেওয়ার, ভারতবর্ষের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীর যাঁদের দরকার পড়েছে, তাঁদের একটি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তাঁদের মূর্তি ও ছবি কে প্রতিষ্ঠা করে তাঁদের মনীষী বানানো হয়েছে। সংগ্রামের ময়দানে শ্রমিক শ্রেণীর লেনিনের সামনে তাই আজ দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের জুতো চাটা দালাল শ্যামা মুখুজ্জ্যে থেকে শুরু করে সাভারকার। লেনিন কে গড়তে গেলে হারাতে হবে শ্যামা ও সাভারকার কে। মধ্যপন্থা বলে কিছু নেই। ভারতের আইন লেনিন কে রক্ষা করবে না, ভারতের শাসকশ্রেণী লেনিনের মূর্তি বাঁচাবে না বরং ভাঙতে মদত দেবে।  


ভারতের শাসকশ্রেণী’র যখন লেনিনের দরকার হয়েছে তখন তাঁরা লেনিন কে ব্যবহার করেছেন শ্রমিক শ্রেণীর আনুগত্য আদায় করার জন্যে আর যখন দরকার হয়েছে শ্যামা মুখুজ্জ্যের, ঠিক তখনই লেনিন কে ভেঙে ফেলা দরকার হয়েছে। এই জন্যেই, বর্তমান সমাজে যেহেতু বৃহৎ মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতি, সামন্তপ্রভু ও বিদেশী কর্পোরেটদের দালালরা শাসন চালাচ্ছে, তাই তাঁরা যে লেনিন রক্ষার্থে ভীষণ চিন্তিত হবে তা নয়, বরং তাঁরা চেষ্টা করবে যেনতেন প্রকারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পোষ্য ও হিন্দুত্ববাদী উত্তর ও পশ্চিম ভারতীয় বেনিয়াদের বাংলার মাটির উপর হিন্দি আগ্রাসনের মূল কান্ডারি, শ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্যে কে জনমানসে একটি জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, আর এই প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে ওদের মার্কসবাদ ও তাঁর মহারথীদের আক্রমণ করতেই হবে। তাই তো অভাব-ক্লিষ্ট বাংলায় এসইউভি গাড়ি চেপে ঘোরা হিন্দি-ভাষী উত্তর ভারতীয় শাসক শ্রেণীর দালাল দিলীপ ঘোষ-তপন ঘোষ ইত্যাদী অকালকুষ্মান্ডদের  দল প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সারা রাজ্যে বাম ও প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষদের হত্যা করে নিজেদের ঘৃণ্য বিদ্বেষ-পূর্ণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কে মানুষের গভীরে নিয়ে যেতে। 


যাদবপুর থেকে কেওড়াতলা, সর্বত্রে গর্জে ওঠা জনগণের কাছে শ্বাপদের মতন বেধড়ক লাথি খেয়েও কিন্তু ঘৃণার রাজনীতির কান্ডারি দিলীপ ঘোষ বা তপন ঘোষেরা লেজ গুটিয়ে গোয়ালে বসে থাকবে সেটা ভাবা হবে চূড়ান্ত মূর্খতা। মূর্তির রাজনীতির ময়দানে আজ শাবল হাতে নেমেছে শাসক শ্রেণীর ভাড়াটিয়া এই বাহিনী আর মার্কস, লেনিন বা মাও, কারুর মূর্তিই এদের হাত থেকে রক্ষা পাবে না, কারণ যেনতেন প্রকারে নিজ রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কে বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক স্তরেও প্রতিষ্ঠা করার তাড়না আজ হিন্দুত্ববাদী শ্বাপদদের  ক্ষেপিয়ে তুলেছে। নরেন্দ্র মোদী থেকে অমিত শাহ প্রতি বছর ৩০০০ কোটি টাকা পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি করছে মিলিশিয়া ও জঙ্গী বাহিনী গড়ে তুলে দাঙ্গা বাঁধাতে। হাজারো তপন ঘোষ তৈরি করা এদের কাছে নস্যি, কারণ টাকায় বড় বড় লোকেদের বাপ বলায়। 


তৃণমূলের অর্ধেক আর সিপিএমের বারো আনা আজ বিজেপি তে ঢোকার জন্যে পা বাড়িয়ে রেখেছে। হিন্দুত্বের রাজনীতি কে আজ রাজ্যের জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় রোপন করে বিষবৃক্ষের ফলের অপেক্ষায় বসে আছে ভ্রাতৃঘাতী রাজনীতির পাকা মাথারা। ঠিক এই সময়ে লেনিন বা মাও বেঁচে থাকলে কি করতেন? মূর্তি বাঁচানোর জন্যে যে জঙ্গী মেজাজ বিপ্লবী ও অবিপ্লবী বামেরা কলকাতার রাজপথে দেখাচ্ছেন, সেই মেজাজ কে কোন লড়াইয়ে লাগাতে বলতেন স্তালিন? কি ভাবে গড়ে উঠবে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রাম? কাদের সাথে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণের প্রতিনিধি কমিউনিস্টদের জোট গড়া উচিত আর কাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার? আর লড়াইয়ের মুখ্য ধরণ কি হবে? লড়াইয়ের জন্যে সংগঠন কি রকম হওয়া দরকার? শত্রুর শৃঙ্খলের সবচেয়ে দুর্বল অংশটি কোথায় আর কি ভাবে তার উপর হাতুড়ির ঘা মারতে হবে?          


লেনিনের মতবাদ কে, লেনিনবাদ কে,  সঠিক ভাবে আমাদের মাটির বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ করে সৃষ্টিশীলতার সাথে প্রয়োগ করে বিপ্লবের পথে এগিয়ে যেতে পারলেই কিন্তু আমরা লেনিনের মূর্তি ও সর্বোপরি লেনিন কে রক্ষা করতে সক্ষম হতে পারবো এবং এর সাথে আমরা সাম্রাজ্যবাদ, বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও সামন্তবাদের সকল দালালদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও তাঁদের গুরুদের মূর্তি, দুইটি কেই ধসাতে পারবো। শাবল চালাতে হবেই শ্যামা মুখুজ্জ্যে থেকে সকল মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের দালালদের মূর্তির উপর, শাবল চালাতেই হবে শাসক শ্রেণীর মনীষীদের মূর্তি ও স্তম্ভ ভেঙে সেখানে শোষিত ও অত্যাচারিত জনগণের প্রতিনিধি বিপ্লবীদের এবং মনীষীদের স্তম্ভ ও মূর্তি গড়ার জন্যে। বিপ্লবটা ভোজসভা নয় সেটা এক চীনা কমিউনিস্ট নেতা বহু আগেই স্পষ্ট করে দেখিয়েছিলেন আর মূর্তি ভাঙ্গা যে বিপ্লবের একটি অভিন্ন অঙ্গ সেকথা সরোজ দত্ত স্পষ্ট করে মার্কসবাদী তথ্য ও নীতি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। শ্রেণী সংগ্রামের ফলে মূর্তি ভেঙে যাবেই। যে শ্রেণী হারবে তার মূর্তি কে বিজয়ী শ্রেণী চূর্ণ চূর্ণ করে দেবে। 


বর্তমানে বিপ্লবী আন্দোলনের বিদ্রোহী স্রোতে ভাটার টান এসেছে বিপ্লবী নেতৃত্ব গড়ে না ওঠার জন্যে এবং বিপ্লবীদের মধ্যে প্রচুর বিভেদ সৃষ্টি হওয়ার ফলে। তবে যে মুহূর্তে বিপ্লবী বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবেন, নিজেদের মধ্যেকার বিভেদ কে দূর করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কে ভিত্তি করে শাসক শ্রেণী, ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়তে, ঠিক তখনই কিন্তু যাদবপুরের মতন পাল্টা মার দেওয়ার পথ প্রশস্ত হবে, পথ প্রশস্ত হবে ফ্যাসিবাদ কে ঠেঙিয়ে বিদায় করার। আর সেই পাল্টা মারের ভয়ে চিরকাল হিন্দুত্ববাদী-ফ্যাসিবাদ লেজ গুটিয়ে পালায়, এর অন্যতম কারণ হল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ লোক আনে ভাড়া করে, মদ আর মহিলা’র টোপ দিয়ে, ফলে এদের লোকেরা কোনদিনই আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শক্তিশালী আন্দোলনের সামনে দাঁড়াতে পারে না। আজ এই শিক্ষাটা শিরোধার্য করা প্রচন্ড দরকার। এক লেনিন আজ নানা মত ও নানা পথের বামেদের অন্তত এক জায়গায় এনেছেন, পাল্টা মারটা  যে কত জরুরী তা বুঝিয়েছেন, তবে এর চেয়েও বেশি দরকার হলো সেই পাল্টা মার কে জনগণের শত্রু হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ও তার মালিক বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি, মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক দেশীয় পুঁজি এবং সামন্তবাদের আগ্রাসন, শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা এবং শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। 


বিপ্লব ব্যতিরেকে এক শ্রেণী অন্য শ্রেণী কে উৎখ্যাত করে প্রকৃত পক্ষে কখনোই ক্ষমতা দখল করতে পারে না। আপসে বলশেভিক বিপ্লব বা চীন বিপ্লব হয় না, হয় ফাটলের নেপাল। তাই বিপ্লবের প্রতীক ও বিপ্লবী জনগণ ও নেতৃত্ব কে বলিষ্ঠ ভাবে রক্ষা করতে এবং বিপ্লবের বহ্নিশিখা কে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে দরকার হল বিপ্লবী সংগ্রামের। সাংবিধানিক লিপির দাসত্ব না করে, আইডেন্টিটি পলিটিক্স এর পুতুল হয়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর দালালি না করে, নির্বাচনের পাঁকে নিজের আদর্শ ও জনগণের আশা ও আকঙ্ক্ষা কে না ডুবিয়ে, বিপ্লবী কমিউনিস্টদের দরকার আজ জোর কদমে শত্রুর বিরুদ্ধে তীব্র শ্রেণী সংগ্রামের আগুন জ্বেলে সেই আগুনে প্রতিক্রিয়াশীল সমস্ত শক্তি এবং তাঁদের দালাল সমস্ত প্রতিষ্ঠান, চিহ্ন ও নীতি কে জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া। এই আগুন জ্বালানোটা আজ বিপ্লবীদের কর্তব্য। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্টরা কখনো আগুন নেভাতে শান্তি জল ছেটায় না, বরং বিপ্লবের আগুন দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের আগুন কে শেষ করে। এই লড়াইয়ের মেজাজ কমিউনিস্টদের একটি অত্যন্ত জরুরী গুণ, আর এই গুণ কে বাদ দিলে শুধু কমিউনিস্টদের খোলসটা পড়ে থাকে আসল সারটা বেরিয়ে যায়। লেনিনের মূর্তি কে রক্ষা করা ও লেনিনবাদ কে রক্ষা করার তাই “এক হি রাস্তা” - কৃষি বিপ্লবের রাস্তা, যে রাস্তায় চলে আমাদের স্বদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতী জনতা শুধু যে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদীদের কবর চাপা দেবে তাই নয়, বরং লেনিন ও লেনিনবাদের পতাকা হাতে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে মিলিত হবে রাশিয়া-চীন-ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লবী জনগণের সাথে, যাতে দেশে দেশে লেনিনের প্রেতাত্মা গ্রাস করে প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীগুলিকে এবং তাঁদের মালিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সকল তল্পিবাহকদের। লেনিন আর লেনিনবাদের বিজয় তো সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসের চিতা জ্বেলেই হতে পারে। দেশে দেশে একদিন সকাল হবেই, কারণ হাত দিয়ে বেশিক্ষণ সূর্যের রশ্মি কে আটকানো যায় না। লেনিনের ভাল সৈনিক হতে গেলে, লেনিনবাদের লাল আগুনে তপ্ত হয়ে নয়া সেই সকাল আনতে আমাদের আরও জোরে ছুটতে হবে, কমরেড লেনিন আহবান দিচ্ছেন যে।  


এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে