বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর হিন্দি-হিন্দুত্বের আক্রমণ কে রুখে দিন

সোমবার, এপ্রিল ১৭, ২০১৭ 0 Comments A+ a-



গত কয়েক বছর ধরে ইন্টারনেটের, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার আনাচে-কানাচেতে ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে উঠেছে আরএসএসবিজেপির নিজস্ব বাংলা প্রচার মাধ্যম। এই প্রচার মাধ্যমের বাংলার বহর অনেকটা ভূতের ভবিষ্যৎ সিনেমার ভুতোরিয়ার মতন - “হামি একদম বাঙালি আছি” গোছের। মোটামুটি মাড়োয়ারিদের টাকায় বেড়ে চলা আরএসএস ও বিজেপি এবার পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে হাজারে হাজারে বাঙালি বেকারদের মাসে ₹৭,০০০ থেকে ₹১৫,০০০ মাসোহারা দিয়ে নিজেদের পেটোয়া বাহিনীতে ভর্তি করছে। এই পেটোয়া বাহিনী দিয়ে, গেরুয়া হার্মাদদের দিয়ে রাম নবমী থেকে হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষে রাজ্যের কোনায় কোনায় দাঙ্গা ও হিংসার আগুন জ্বালাচ্ছে মার্কিন-ইজরায়েলের মদতপুষ্ট মোদী সরকার।

আরএসএস ও বিজেপি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর প্রায় ₹৩০০ কোটি বিনিয়োগ করে চলেছে নিজেদের জাল ছড়াবার স্বার্থে। উত্তর ভারত ও বোম্বাই-আহমেদাবাদের থেকে নিয়ে এসেছে দলীয় পদে বেতন দিয়ে সদস্য নিয়োগ করার লাইন। গ্রামে গঞ্জে, শহরে আর শহরতলীতে একটাই আওয়াজ, বিজেপি করলে টাকা পাওয়া যাবে! প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে ! আরএসএস এর শাখা করলে পাওয়া যাবে প্রচুর টাকা ও বিজেপি ক্ষমতায় আসলে সাবর্ণ হিন্দুদের হবে সরকারি চাকরি, মুসলমানদের ব্যবসা দখল করে দেওয়া হবে দলিত ও পিছিয়ে পড়া জাতির হিন্দু বাঙালিদের। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দয়ায় আজ আর্থিক ভাবে কাঙাল হয়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এই বিশাল অংকের টাকা আর আর্থিক প্রলোভন যে বিজেপি ও আরএসএস কে সাংগঠনিক অনেক বাঁধা পেরিয়ে যেতে সাহায্য করবে সে কথা বলাই বাহুল্য।

অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানা থাকলে কম টাকা আর পেটোয়া বাহিনীতে কাজ আর একটু লেখাপড়া জানা থাকলে বেশি টাকায় একেবারে আইটি সেলের চাকরি। হ্যাঁ, সেই আইটি সেল যার নেতারা পাকিস্তানের চর বৃত্তি করার অভিযোগে পুলিশের জালে ধরা পড়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের সংঘ পরিবারের ট্রেনিং প্রাপ্ত বাঙালি কম হওয়ায়, এই সেলে বিশেষ করে বিহারী ও উত্তর ভারতীয় অবাঙালিদের রমরমা বেশি। আর যেহেতু এদের বেশির ভাগই আরএসএস এর দীক্ষা প্রাপ্ত তাই ওপার বাংলার সালাফি মোল্লাদের মতন এদেরও বাঙালির নিজস্বতা, তাঁর সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং বাঙালির নববর্ষ পালন ভীষণ ভাবে অভারতীয় মনে হয়। তাই আজ বিজেপি ও আরএসএস এর রাজ্যস্থিত এবং রাজ্যের বাইরে অবস্থিত আইটি সেলের বাংলার ভারপ্রাপ্ত স্বয়ং সেবকরা জোর গলায় নববর্ষ পালনের বিরোধিতা করছে।

পয়লা বৈশাখ পালন নাকি ভীষণ অভারতীয়, এবং রাম নবমীর মতন উৎসবকে পশ্চিমবঙ্গে সার্বজনীন ভাবে পালন না করে “বাংলাদেশী” গন্ধওয়ালা বাঙালির নববর্ষ পালনের তীব্র বিরোধিতা করেছে আরএসএস এর কর্মী সমর্থকেরা। যেহেতু বিজেপির ভাড়াটে পল্টন ছাড়া রাম নবমী বা হনুমান জয়ন্তীর মতন অবাঙালি উৎসবে কোন বাঙালি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দেয়নি তাই মুঘল সম্রাট আকবরের বানানো  বাঙালির নিজস্ব ক্যালেন্ডারের পয়লা বৈশাখ পালনের ধুম দেখে নাগপুর থেকে দিল্লির অশোক রোড হয়ে দিলীপ ঘোষের ঠেক মুরলী ধর স্ট্রিটে বিরাট জ্বালা ধরেছে। বাঙালি কেন উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্বের স্বার্থে, মারাঠি আর গুজরাটিদের স্বার্থে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি কে ত্যাগ করবে না তাই নিয়ে বিশাল বিক্ষোভ গেরুয়া শিবিরে।

এই সব সাইটে মুসলিম ও খ্রিস্টান বিরোধী ন্যাক্কারজনক ঘৃণার বাণী ছড়ানো ছাড়াও একেবারে খোলাখুলি বলা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্বকেই তুলে ধরতে। আরএসএস এর হাফপ্যান্ট থেকে হিন্দু সংহতির ফুলপ্যান্ট অবধি প্রমোশন প্রাপ্ত হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা এই বিষয়টা কিছুতেই মানতে চায় না যে তাদের হিন্দি ও হিন্দুত্বের শত তাঁবেদারি সত্বেও আর মোল্লাতন্ত্রের শত ফতোয়া সত্বেও সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমজীবি বাঙালি, গ্রামে গঞ্জে বাস করা কোটি কোটি বাঙালি কিন্তু নিজেদের বাঙালি হিসেবেই চেনেন এবং ওই হিন্দুত্ব বা সালাফি জামাতি পরিচয়ে তাঁরা নিজেদের পরিচিত হতে চাননা আজও। আর অশিক্ষিত অবাঙালি সংঘ কর্মীদের সাথে চেতনার মানে অগ্রসর বাঙালি শ্রমজীবি মানুষ কিন্তু হাজার প্রলোভন আর মিথ্যা অপপ্রচার সত্বেও নিজ বাঙালি সত্তা কে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

BJP IT Cell on Bengali New Year and Ram Navami


ছবিটা দেখলেই বুঝবেন যে বিজেপির আইটি সেল ইন্টারনেট জুড়ে প্রচার চালাচ্ছে - বাংলার পয়লা বৈশাখ পালন আসলে একটি জেহাদি প্রকল্প যার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ নাকি পশ্চিমবঙ্গ কে আগ্রাসন করার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং হিন্দুরা নাকি তাতে শেষ হয়ে যাবে। ওরা বলছে হিন্দু বাঙালিরা নাকি পশ্চিমবঙ্গে ভীষণ বিভীষিকার মধ্যে বাস করছে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ও হোয়াটস্যাপ ইত্যাদি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের উপর আক্রমণ বলে ছড়িয়ে, ওরা হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে চাইছে। পশ্চিমবঙ্গের সাবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে সুপ্ত ইসলাম বিদ্বেষ কে ব্যবহার কে মুসলিম বিরোধী হিংসায় পরিণত করতে চাইছে।  আর এই ভাড়াটে বাহিনীর দল আজ বাঙালি হিন্দুদের নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি কে ত্যাগ করতে বলছে, বাঙালিত্ব নামক সত্বা কে ত্যাগ করে ভারতীয়ত্ব, অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশ-গুজরাট-মহারাষ্ট্রের উচ্চ জাতির হিন্দুত্বকে ধারণ করতে বলছে।

আর্থিক ভাবে দুর্দশাগ্রস্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রচুর সাবর্ণ হিন্দুদের অন্যান্য রাজ্যে, বিশেষ করে সংঘ পরিবারের ঘাঁটি বোম্বাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, ইত্যাদি জায়গায় কাজের খোঁজে, বিশেষতঃ বিদেশী বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে পরিচালিত তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের চাকরির খোঁজে পাড়ি জমাতে হয়। এই সব শহরে থাকার দরুন এদের পরিচয় হয় সংঘ পরিবারের জঙ্গীদের সাথে, যারা ধীরে ধীরে এই সাবর্ণ বাঙালিদের মধ্যে হীনমন্যতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে, যার ফলে এরা নিজের ভাষা, সংস্কৃতি মায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতি ভীষণ ভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়। বারবার এরা পশ্চিমবঙ্গে শারোদোৎসবে বা অন্যান্য সময়ে এসে এই হীনমন্যতা অন্যদের মধ্যেও  নিজেদের রাজ্য, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ঢুকিয়ে যায়। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাইরে যাওয়ার এবং বাংলা ও বাঙালিত্ব কে ঘৃণা করার একটা প্রবণতা সেই আশির দশকের শেষ থেকেই সারা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, যদিও তখন সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক গণসংগঠন বিজেপি দেশের রাজনীতিতে একটি তুচ্ছ ফ্যাক্টর ছিল।

ভারতের প্রতিটি প্রান্তরে চাকরিসূত্রে বা ব্যবসাসূত্রে বসবাসকারী প্রবাসী উচ্চবিত্ত হিন্দু বাঙালিদের সিংহ ভাগই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলার প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও নানা কায়দায় আরএসএস ও হিন্দুত্বের পল্টন কে সমর্থন করে কারণ উত্তর ভারত, কর্ণাটক, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের নানা প্রান্তরে থেকে এদের মধ্যে এক হীনমন্যতার জন্ম হয়েছে, এরা নিজেদের ভাষায়, এমনকি সহকর্মী বাঙালিদের সাথেও কথা বলতে লজ্জা বোধ করে, পাছে এদের অবাঙালি সাথীদের খুব খারাপ লাগে। আর এই হীনমন্যতার এর ফলে এদের কোনদিন কলকাতায় দুই মাড়োয়ারি লোকের রাজস্থানি বা হিন্দিতে কথা বলা দেখে বা দুই গুজরাটি শেঠের গুজরাটিতে কথা বলা দেখে জানতে ইচ্ছা করে না যে কেন তারা একঘর বাঙালির সামনে আপন মাতৃভাষায় কথা বলছে আর কেন নিজেদের বাঙালি শ্রমিক ও কর্মচারীদের হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য করে?

এই হীনমনস্ক ও নিজের জাতি ও ভাষা কে হীন ভাবা প্রবাসী বাঙালি লোকেদের উপর ভিত্তি করেই পশ্চিমবঙ্গে আজ ঘাঁটি গড়ার কথা ভাবছে আরএসএস এবং হিন্দুত্ব পরিবারের অন্যান্য উত্তর ভারতীয় দলগুলি। এদের মাধ্যমেই এই উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের দালালরা আজ বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন লাগাবার কথা ভাবছে হিন্দি ভাষা ও হিন্দুত্বের ধ্বজ্জাধারী দিলীপ আর তপন ঘোষেদের সাহায্যে। তাই আজ উড়িষ্যার বুক থেকে অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী চিৎকার করে ঘোষণা করতে পারে যে বিরোধী শূন্য রাম রাজ্যের শুরু হবে পশ্চিমবঙ্গের বুকে গেরুয়া ঝান্ডা উড়িয়ে আর সেই ঝান্ডা তখনই উড়বে যখন বাঙালির নিজস্ব সত্তার বেঁচে থাকা কিছুটা ধ্বংসাবশেষ কে গুড়িয়ে দেওয়া যাবে হিন্দি ও হিন্দুত্বের রথের চাকার তলে।      

বিগত তিন দশকে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি ঘৃণা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণাটা বাঙালি সাবর্ণ সমাজের মধ্যে অনেক দৃঢ় ভাবে অবস্থিত হয়েছে এবং এর সাথে পশ্চিমবঙ্গে বিনা বাঁধায় চলতে থাকা হিন্দির আগ্রাসনের ফলে বাংলা সাহিত্য, শিল্প, সিনেমা, নাটক, সংগীত সবই শহরাঞ্চলের থেকে একেবারে দূর দূরান্তের গ্রামে ধাক্কা খেয়েছে। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ইস্কুলে বেশি করে ইংরাজি ও হিন্দি শিখছে। টাকার সংকট যে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের নেই তারা নিজেদের সন্তানদের বাংলা মিডিয়াম ইস্কুলে ভর্তি না করে ইংরাজি মিডিয়াম ইস্কুলে ভর্তি করাচ্ছে, যে ইস্কুলের সিলেবাস ঠিক করে দেয় দিল্লিতে বসা সংঘ পরিবারের কর্মকর্তারা। এর ফলে ধীরে ধীরে শিশু বয়স থেকেই বাঙালিদের সন্তানদের মধ্যে বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে।

কেবল টিভির মাধ্যমে ঘরে ঘরে হিন্দি সিরিয়াল, সিনেমা, গান, ইত্যাদি দিয়ে বোম্বাই ও দিল্লির শাসক শ্রেণী সমস্ত রাজ্যের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি কে শেষ করতে উত্তর ভারতীয় উচ্চ জাতির হিন্দুদের জীবনশৈলী কে ভারতীয়ত্ব হিসেবে ধীরে ধীরে সাবর্ণ উচ্চবিত্ত বাঙালিদের মননে গেঁথে দিয়েছে বহু বছর ধরে। তার সাথে এবার জুড়েছে উত্তর ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতি কে বাঙালি হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস। আর এই খেলায় বেশ মিল দেখা যায় সালাফি ইসলামের ভক্ত বাংলাদেশী মোল্লাদের আর হিন্দুত্বের ভক্ত পশ্চিমবঙ্গের গেরুয়া বাহিনীর। দুই দলেরই মনে হয় যে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি তার ধর্মের পথে বড় বেশি অন্তরায় আর অতএব সেই ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে হয় আরবি আর না হয় হিন্দি কে চাপিয়ে দাও।

দক্ষিণ ভারতে পেরিয়ারের ন্যায় জাতীয় আন্দোলন করে বাঙালির স্বাভিমান কে জাগিয়ে তুলে হিন্দি ভাষী ব্রাক্ষণত্ববাদী উত্তর ভারতীয়-মরাঠি ও গুজরাটি শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে নামাতে কোন নেতাই বাংলায় পারেনি। অথচ নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি কে রক্ষা করতে ওপর বাংলা থেকে শুরু করে শিলচরের ভাষা আন্দোলনেও কিন্তু একদিন সামনের সারিতে ছিল বাঙালি। এই বাঙালির দৃপ্ত হুঙ্কারের সামনে ধর্মীয় বাঁধনে বাঙালি'কে বেঁধে নিজেদের দাস বানানোর পরিকল্পনা করা পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীকে একদিন নাকে খত দিয়ে বুঝতে হয়েছিল যে গরিব বাঙালি কারুর ধর্মীয় ক্রীতদাস হতে পারে না, অন্য কারুর ভাষা ও সংস্কৃতি কে সে মাথায় তুলে নাচতে পারে না। কিন্তু এপার বাংলায়, শাসক শ্রেণীর চক্রান্তে ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির প্রয়াসে নিজ জাতির স্বাভিমানের জন্যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বরং শাসকশ্রেণীর সাথে হাতে হাত মিলিয়ে বাঙালি ব্রাক্ষণত্ববাদীরা আক্রমণ করেছিল গোর্খা, কামতাপুরি, ঝাড়খন্ডী, প্রভৃতি আদিবাসী আন্দোলনের উপর এবং বাংলা কে করে তুলেছিল একটি আঞ্চলিক আগ্রাসী সংস্কৃতি।

বাঙালির স্বাভিমানের দাবিতে, তাঁর জাতীয়তাবাদের দাবিতে, দুই বাংলার মানুষের মিলনের দাবিতে গড়ে ওঠা সকল আন্দোলনকে হয় বাঙালি সাবর্ণ ব্রাক্ষণত্ববাদীরা হেয় চোখে দেখেছে, তার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করেছে, আর না হয় বাঙালির বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে কৃত্রিম দেশপ্রেমের, ভারতের অবাঙালিদের সাথে ঐক্যের ও পার্শবর্তী বাংলাদেশের বাঙালিদের সাথে শত্রুতার সম্পর্ক রাখার শিক্ষা দেওয়া শুরু করেছে আধা-ঔপনিবেশিক ভারতের হিন্দি-মরাঠি-গুজরাটি ভাষী শাসক শ্রেণী।

তাই যে বাঙালি জাতির মুসলমান কে রাস্তায় ফেলে ঘৃণ্য ভাবে আক্রমণ করে মরাঠি শিব সেনা, সেই দলেরই ঝান্ডা আর ডান্ডা দুলিয়ে কখনো বামফ্রন্ট তো কখনো তৃণমূলের ছত্রছায়ায় বাংলা দাপিয়ে বেড়ায় এই রাজ্যেরই মরাঠি দালাল কিছু সাবর্ণ বাঙালি। আর এই ভাবে নিজ জাতির মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ ও মরাঠি ব্রাক্ষণত্ববাদী উচ্চ জাতির প্রতি প্রেম নিবেদন করার সময়ে এই লোকগুলো ভুলে যায় যে মরাঠি আগ্রাসনের ফলে বাংলা কে কি দৈন্যের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে আর কি বীভৎস অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ এই রাজ্যের বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের সইতে হয়েছিল। যে অত্যাচারের ফলে আজও বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানি গানে "বর্গী এল দেশে" বলে ভয় দেখানো হয়।

অথচ সেদিন বাংলার মুসলমান নবাবই কিন্তু বাংলার মানুষ কে রক্ষা করার জন্যে একের পর এক যুদ্ধ করেন মরাঠি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, মরাঠিদের দ্বারা বাঙালিদের ক্রীতদাস বানাবার বিরুদ্ধে। কিন্তু যেহেতু ব্রিটিশ মালিকেরা ক্রীতদাস সাবর্ণদের অধিকাংশকেই শিখিয়ে গেছে যে মুসলমান শাসক মানেই খারাপ তাইতো বাংলা কে মরাঠি আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা করা নবাব আলীবর্দী খান থেকে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভাবে যুদ্ধ করে শহীদ হওয়া নবাব সিরাজউদ্দৌলা আজ খল নায়ক আর মরাঠি রাজা ও ব্রিটিশ দালালেরা আজ হিন্দুত্বের ইতিহাসের মহানায়ক আর তাই বাংলার বুকে যারা মরাঠি গেরুয়া ঝান্ডা ওড়ায় তাদেরও মহানায়ক।

বাঙালির নিজ জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বার্থে যেহেতু কোন বামপন্থী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম গড়ে ওঠেনি, মায়ায় পেরিয়ারপন্থী দ্রাবিড় আন্দোলনের মতন কোন সংগ্রাম বাঙালি করতে পারেনি দিল্লি-বোম্বাই-আহমেদাবাদের বিরুদ্ধে, তাই আজ বাঙালি জাতিকে, বিশেষ করে ধনবান সাবর্ণ হিন্দুদের নিজেদের পক্ষে টেনে নিতে হিন্দি ভাষী হিন্দুত্ববাদী শক্তির কোন কষ্টই হচ্ছে না। এতো একেবারে স্বেচ্ছায় কে কে পড়িবে ক্রীতদাসের বেড়ি, তাহার লাগি লাগিলো কাড়াকাড়ি। শত খারাপ লাগলেও, আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাঙালিদের, বাংলার আপামর শ্রমিক ও কৃষকদের নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, ও জীবনশৈলী কে রক্ষা করার স্বার্থে এগিয়ে আসতেই হবে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামে।

আরএসএস করতে গেলে যেহেতু প্রথমেই নিজ ভাষা কে ও সংস্কৃতি কে বাদ দিয়ে হিন্দি ভাষা ও হিন্দুত্বের সংস্কৃতি কে গ্রহণ করতে হয়, মোল্লা হতে গেলে যেহেতু নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি কে বাদ দিয়ে শুধু আরবিতে কেতাদুরস্ত হতে হয়, তাই এই দুই দলের লোকেদের কাছে আর পেটোয়া বাহিনীর কাছে যে মানুষ নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি কে ভালবাসে, যে মানুষ শ্রমজীবি মানুষের সংস্কৃতি কে ভালবাসে ও বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন কে, সে এমনকি বৃহৎ দেশের বৃহৎ জাতি গড়ার নামেই হোক না কেন, বিরোধিতা করে, সে মানুষ হয় ঘৃণার পাত্র, একেবারে কেউকেটা শ্রেণীশত্রু। তাই দেখা যায় সব জায়গায় বাঙালি প্রগতিশীল জনগণের উপর, ছাত্র-ছাত্রীদের উপর, শ্রমিক ও কৃষকের উপর যে বর্বর হিন্দুত্ববাদী ও সালাফি জামাতিরা আক্রমণ করছে তাদের আক্রমণের লক্ষ্য কিন্তু এই মানুষগুলোর নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি দৃঢ় থাকার সংকল্প, যা বৃহত্তর হিন্দু রাষ্ট্র বা ইসলামিক উম্মা বানাতে বাঁধা দেয়।  আজ দুই বাংলার মানুষ কে বিভেদের পথে নিয়ে যেতে, একে অপরের শত্রু বানাতে, বাঙালি-বাঙালিতে দ্বন্ধ বাড়াতে এই বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতি কে জোর করে বাঙালির উপর চাপিয়ে দেওয়া যেমন চলছে তেমনি এই চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে নানা ভাবে নানা জায়গায় জনগণ বিস্ফোরণের ন্যায় ফেটে পড়ছেন।

আজ দুই পাড়ের বাংলার মানুষের উপর, তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর, তাঁদের লড়াকু ঐতিহ্যের উপর ঝুলছে ভীষণ বিপদজনক খাঁড়া, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার খাঁড়া, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার খাঁড়া। আর এই সংকট থেকে বাঙালি কে, বিশেষ করে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া শ্রমজীবি বাঙালিদের, দলিত বাঙালিদের, বিভিন্ন আদিবাসী জনগণ কে, এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ কে দুই বাংলায় রুখে দাঁড়াতে হবে হিন্দুত্ববাদী ও সালাফি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। রুখে দাঁড়াতে হবে সকল ভাষা ও সংস্কৃতির উপর অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির, শাসক শ্রেণীর ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন কে আটকে দিতে। আজ যদি দুই বাংলার অসংখ্য মানুষ, গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ এই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তাহলে ইতিহাসের রথের চাকা এগিয়ে যাবে তরতর করে, ভেঙে দেবে প্রতিক্রিয়াশীলদের সমস্ত বাঁধা বিঘ্নতা এবং গড়ে তুলবে এক অন্যান্য ঐক্যবদ্ধ বাংলা যা হিন্দুত্ববাদী আর সালাফি মৌলবাদীদের বাদে সমস্ত প্রগতিশীল বাঙালির চেতনার মধ্যে দৃঢ় ভাবে আজও প্রোথিত আছে এক সুন্দর ভবিষ্যতের লক্ষ্য হিসেবে।

বাংলার জয় হোক, বাঙালি জাতির জয় হোক, বাংলার মানুষের জয় হোক।  

 

ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে আজ বাঙালি কে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তেই হবে

শনিবার, এপ্রিল ১৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-



বাংলার ১৪২৪ সালে বাঙালি জাতি আজ প্রবেশ করলো। নানা দিকে মহা ধুমধামে শুভ নববর্ষ পালন করতে দুই বাংলার মানুষ উঠে পড়ে লেগেছেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ, এই দুই বাংলার মানুষের উপর আজ নেমে আসছে অসংখ্য আক্রমণ, এই দুই বাংলার মানুষের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি কে আজ পদদলিত করে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে আগ্রাসী হিন্দি ও আরবি মৌলবাদ। ভারতবর্ষের শাসক শ্রেণীর দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম ভাষা হিন্দি ও তার আনুষঙ্গিক সংস্কৃতি আজ পশ্চিমবঙ্গের বুক থেকে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি কে শেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। অন্যদিকে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের পদলেহী জামাতি সালাফিরা আজ বাংলাদেশের বুকে সহি ইসলামের নাম করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কে যেমন জোর করে মোছার চেষ্টা চালাচ্ছে আরবি আগ্রাসনের মাধ্যমে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে বাঙালি শাসক শ্রেণী আজ বাংলাদেশের আদিবাসী ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর জোর করে বাংলা ভাষা কে চাপিয়ে তাঁদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে শেষ করে দিতে চাইছে।  

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ এই দুই জায়গায় ধর্মীয় মৌলবাদ আধুনিক নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির হাত ধরে ভীষণ শক্তিশালী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দুই জায়গার সংখ্যালঘুরা আজ আক্রান্ত এবং আতঙ্কিত।  তাঁরা আজ ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন, কারণ  কখন যে তাঁদের উপর আক্রমণ শুরু করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মৌলবাদী শক্তি, তার কোন ঠিক নেই।  অন্যদিকে নিজেদের বেশ ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করা মমতা বন্দোপাধ্যায় বা শেখ হাসিনা কিন্তু গোপনে সেই মৌলবাদী শক্তিদেরই হাত ধরে রেখেছে যাদের বিরুদ্ধে দিন রাত তাঁরা গলা ফাটাচ্ছে মাঠে ময়দানে। তাই মমতা বন্দোপাধ্যায় আজ নিজের লোকেদের যেমন বাজারে হনুমান পুজো করতে নামাচ্ছে তেমনি শেখ হাসিনা গোপনে জামাতিদের বাংলা নববর্ষের উৎসবে হামলা করতে টাকা দিচ্ছে।

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি এক হওয়া সত্বেও শাসক শ্রেণীর নিজ স্বার্থে বাংলার মানুষ কে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে রাখা হয়েছে, বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর কে বিগত দুইশো বছর ধরে আরও উঁচু করা হয়েছে এবং বর্তমানে নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির স্রোতে গা ভাসিয়ে বাংলায় আগমন হওয়া উগ্র হিন্দুত্ববাদ আর সালাফিবাদ বাংলার মানুষ কে আবার অন্ধকার অতীতে নিয়ে যেতে চাইছে, নিয়ে যেতে চাইছে সেই ভয়াবহ ১৯৪৬ সালে, যখন ধর্মের দোহাই দিয়ে আরএসএস-হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ বাঙালি কে দিয়ে বাঙালি কে মেরেছিল, গরিব বাঙালি কে দিয়ে তাঁর অন্য্ ধর্মের গরিব বাঙালি ভাই কে হত্যা করিয়েছিল দেশভাগের ঘৃণ্য খেলা খেলতে। এই হিংসা ও রক্তপাত দিয়ে যে পথ চলা অধুনা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ শুরু করে সে পথের প্রতি কোন প্রতি প্রান্তরে শুধুই ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষবৃক্ষের সারি দেখা যায়।

আজ সেই ঘৃণা ও বিদ্বেষের হাত ধরে দিলীপ ঘোষ, কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, ইত্যাদী হিন্দি ভাষী ও তাদের দালালেরা আজ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের  উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে নিজেদের সংস্কৃতি ও ভাষা কে, নিজেদের উগ্র হিন্দু ধর্মের প্রকরণ কে আর শেষ করে দিতে চাইছে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক মৈত্রী ও ঐক্য কে।জোর করে অশ্রুত হনুমান পুজো, রাম নবমীর সশস্ত্র মিছিল থেকে শুরু করে সমস্ত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় মসজিদে শুয়োরের মাংস ফেলে আর মন্দিরে গরুর মাংস ফেলে সেই এক শতাব্দী পুরানো কায়দায় দাঙ্গা লাগাচ্ছে বিজেপি, আরএসএস, ভিএইচপি, বজরং দল ও হিন্দু সংহতির মতন ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদী দল।  

ঠিক একই ভাবে আজ সৌদি আরবের টাকায় বলীয়ান হয়ে জামাতি সালাফিরা আজ বাংলাদেশের নারী-শিশু-বৃদ্ধ সকলের উপর নামিয়ে আনছে সহি ইসলামের খাঁড়া, যে কেউ তাদের নিম্ন মানের চেতনা কে প্রশ্ন করছে তাদের কল্লা ফেলছে অন্ধকারে চাপাতির কোপে। ধর্মের দোহাই দিয়ে সারা বাংলাদেশ জুড়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর আর সালাফি মোমিনের খুন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। এপারে মমতা আর ওপারে হাসিনা তবুও নির্বিকার চিত্তে মনুষ্যত্বের শত্রুদের এই বিভীষিকা দেখে চুপ করে বসে তালে তাল ঠুকছে।

অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতন বাঙালির নিজস্বতা আজ হিন্দুত্ব ও সালাফি ইসলামের আক্রমণে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সহজেই স্বল্প চেতনার মানুষগুলো কে ভুল বুঝিয়ে হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামী শক্তিরা আজ বাংলার সংস্কৃতি ও মৈত্রীর বন্ধনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে আর বাঙালি কে দিয়ে বাঙালি কে খুন করিয়ে নেপোয় মারে দই’র মতন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।  এই ষড়যন্ত্রের ফলে আসতে আসতে বাঙালির মনন থেকে ও চেতনা থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে আর হিন্দি ও আরবি ধীরে ধীরে নিজের ঘাঁটি গেড়ে বসবে। যে বাঙালি পঞ্চাশ বছর আগে সংগ্রাম করে নিজের ভাষা ও নিজের পরিচয় কে আদায় করে নেওয়ার স্বার্থে এক নদী রক্ত বিসর্জন দিয়েছিল, সেই বাঙালি আজ কেন পদদলিত হয়ে পড়ে থাকবে পর-জাতির সামনে? কেন বাঙালি নিজের পরিচয় কে নিয়ে পয়লা বৈশাখের পরে আর গর্বিত হবে না ? কেন সে নিজের ভাষায় কথা বলা, প্রার্থনা করা, গান গাওয়া, থেকে কাজ করার অধিকারের জন্যে গলা ফাটাতে পারছে না ? কেন মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে দাবি জানাতে পারছে না ?

এই সবের কারণ হলো বাংলা ও বাঙালির নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে আটকে পড়া। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের স্লোগান তোলা ভারতের শাসক শ্রেণী ও সালাফি ইসলামের রক্ষাকারী বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী আজ বাঙালি জাতিকে বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজির কাছে বন্ধক রেখেছে। বাংলার শ্রম, সম্পদ, ও প্রকৃতি কে ধ্বংস করতে আজ বৃহৎ একচেটিয়া পুঁজির পোষা কুকুরের ভূমিকা পালন করছে দুই বাংলার শাসক শ্রেণী। তারা জানে যে নানা ভাষা ও নানা সংস্কৃতি কে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও দেশি মুৎসুদ্দিরা পছন্দ করে না, বরং তারা চায় একটি ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ, যাতে ওদের পক্ষে সব সময়ে সহজেই নিজেদের পণ্য উৎপাদন করানো ও বন্টন করানো সম্ভব হয়। আর বাঙালি কে এই জন্যেই টেনে আনা হচ্ছে হিন্দি আর আরবির জালে, যাতে অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন বাঙালি জাতি তাঁর নিজস্বতা কে হারিয়ে দাস হয়ে যায় শাসক শ্রেণীর ভাষা ও সংস্কৃতির।

বাংলা ও বাঙালির উপর এই আগ্রাসন কে শুধু মেকি বুদ্ধিজীবিদের সভা সমিতি করে বা পয়লা বৈশাখের উচ্চ মধ্যবিত্ত সুলভ কার্নিভাল করে রোখা সম্ভব নয়। বাংলা ও বাঙালির নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি, যা দুই বাংলার আপামর খেটে খাওয়া মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি, তাকে রক্ষা করতে আজ বাঙালি কে গড়ে তুলতেই হবে এক প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বাংলা ও বাঙালির শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং ওদের দালাল বাঙালি সামন্তশ্রেণী ও মুৎসুদ্দি শক্তির বিরুদ্ধে। একমাত্র গরিব বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই পারবে এক নতুন বাংলার নির্মাণ করতে আর সেই বাংলা কে গড়ে তুলতে আজ দুই বাংলার প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক মানুষ কে সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।     

রাম নবমীর নামে সশস্ত্র মিছিল করে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক আগুন লাগাবার পরিকল্পনা কে কারা আজ রুখবে ?

বুধবার, এপ্রিল ০৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একজোট হোন।


৫ই এপ্রিল সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে রাম নবমী পালনের ডাক দিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। গেরুয়া শিবিরের এই দুই দলের দাবি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এবার রাম প্রীতি জাগাতে হবে এবং উত্তর ভারতের ন্যায় পশ্চিমবঙ্গেও রাম-ভিত্তিক রাজনীতি, যার আর একটি অংশ হলো তীব্র ভাবে নিরামিষাশী খাদ্য অভ্যাস পালন করা, শুরু করতে হবে। রাম নবমী বাঙালি হিন্দুরা পালন করবেন, না করবেন না, সে প্রশ্নটা আমাদের আলোচনার বিষয় হতে পারে না, আর কেউ যদি পশ্চিমবঙ্গে রাম নবমী পালনও করতে চান তাহলে তাদের বাধা দেওয়া হবে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা কে উল্লঙ্ঘন করা। তবে আরএসএস আর ভিএইচপি যেহেতু রাম নবমী পালনের ডাক দিয়েছে তাই এই ডাকের পিছনে যে সরল ধর্ম বিশ্বাস কাজ করছে তা নয়, বরং আছে এক গূঢ় অভিসন্ধি যা ফাঁস করে হাটের মাঝে হাঁড়ি ভাঙলে স্বয়ং বিজেপির নেতা ও বিধায়ক দিলীপ ঘোষ।



রাম নবমীর মিছিলের নামে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ত্রিশূল ও তলোয়ার সহযোগে সশস্ত্র মিছিল করতে চায় আরএসএস ও ভিএইচপি এবং এদের সাথে রাজ্য জুড়ে বিজেপিও এই অনুষ্ঠানে সামিল হতে চায়। এই সশস্ত্র মিছিল নিয়ে আরএসএস এর নেতা জিষ্ণু বোস ও ভিএইচপি নেতা শৌরিশ মুখার্জী রাজ্য জুড়ে প্রচার কার্য শুরু করেছে।  আরএসএস এর পশ্চিমবঙ্গের সম্পাদক বিদ্যুৎ মুখার্জী এই কাজের জন্যে ক্রমাগত সমস্ত শাখা কর্মীদের উপর চাপ দিয়ে চলেছে ভাড়াটে লোক জোগাড় করে মিছিলগুলোয় ভিড় বাড়ানোর জন্যে। সশস্ত্র মিছিল করার পুলিশি বা আইনি কোন অনুমতির ধার ধারেনা হিন্দুত্ব শিবির, কারণ ব্রাক্ষণত্ববাদী প্রশাসন কোনদিনই এদের জঙ্গী কার্যকলাপের রাশ টেনে ধরেনি, বরং বার বার এদের কে সাহায্য করেছে শক্তি বৃদ্ধি করতে, আর তাই আজ দিলীপ ঘোষের মতন লোকেরা সংবাদ মাধ্যমে জোর গলায় ঘোষণা করছে যে পশ্চিমবঙ্গে সশস্ত্র মিছিল হবেই এবং সেই মিছিল’কে রুখবার শক্তি নাকি কারুর নেই।

পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ নিজের হাতে হাতকড়া পড়ে বসে আছে, মমতা বন্দোপাধ্যায় আর হুঙ্কার দিচ্ছে না, পাছে আবার মদন জেলে যায় আর নারদার হাঁড়ি হাটে ভেঙে ফেলে দুই পাত্তর মদ গিলে। অথচ ঠিক এই সময়েই বোলপুরে বিশ্বভারতীর প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীদের উপর তৃণমূলী সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হলো, রাজ্য জুড়ে বাম আন্দোলনের উপর নামানো হলো অত্যাচারের খড়গ, তবে যেহেতু তৃণমূলের সাথে বিজেপির ইয়ারিটা সেই দুই দশক পুরানো, তাই বর্তমানে বিজেপি কে কোলে পিঠে করে পশ্চিমবঙ্গে ধেড়ে বানাবার দায়িত্ব তৃণমূল কংগ্রেসের কাঁধেই চেপেছে। নরেন্দ্র মোদীর সাথে উপরে ঝগড়া করার ভাওঁতা করে তলে তলে গেরুয়া শিবিরের সাথে হাত মিলিয়ে রাজ্যে ভোটারদের ধর্মীয় মেরুকরণের ছাঁচে ফেলার তৃণমূলী ষড়যন্ত্র কিন্তু আর চাপা নেই। তবুও আজ মমতা নিজের ধর্ম নিরপেক্ষ ইমেজ বজায় রাখতে সক্ষম কারণ বহু সালাফি সংগঠন আজ পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের অন্যান্য কোনায় মমতার মতন একজন চরম মুসলমান বিদ্বেষী ব্রাক্ষণত্ববাদী নেত্রীকে মুসলমানদের রক্ষা কর্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করে চলেছে কিছু টাকা ও অঢেল রাজনৈতিক সমর্থনের বিনিময়ে।

পশ্চিমবঙ্গের সাবর্ণ ভদ্রলোক সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভাবে মুসলমান, খ্রীস্টান ও দলিত-আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের তরল গরল বেয়ে চলেছিল সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে, তা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে বিগত ৩০ বছরে, সেই রাম মন্দির আন্দোলনের  সময় থেকে, যখন সাধারণ হিন্দু বাঙালিদের আরএসএস এর বাইরের থেকে পাঠানো নেতারা নানা কায়দায় বোঝাতে শুরু করেছিল যে ভারতবর্ষে মুসলমানরা নাকি রাজার হালে আছে আর প্রত্যেকটি সরকার নাকি এদের তোষণ করে ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে। আপনি গোটা কলকাতা চষে যদি ঘোরেন, ট্রামে, বাসে, লোকাল ট্রেন বা মেট্রোতে এই আলোচনা বহুবার শুনবেন আর বারবার আপনাকে জানান দেওয়া হবে যে হিন্দুরা নাকি মুসলমানদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে এই পশ্চিমবঙ্গেরই প্রতিটি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায়। তথ্য নেই, কোন সূত্র নেই, তবুও পার্ক সার্কাসের চার নম্বর বস্তি থেকে মেটিয়াবুরুজ এলাকায় খুপরির মধ্যে বাস করা গরিব ও অনাহার ক্লীষ্ট মুসলমান শ্রমিক, মুচি, বা মিস্ত্রিরা নাকি আরব দেশের দালাল বা পাকিস্তানের চর, এই শিক্ষাটা আপনাকে ছোট বেলার থেকেই দেওয়া হবে যদি আপনি এই উচ্চ জাতির হিন্দু বাড়িতে জন্মান।  সেই পশ্চিমবঙ্গে আজ যখন বিজেপি দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পেয়েছে তখন ধীরে ধীরে প্রাক্তন লাল আর সবুজদের অনেক বড় খেলোয়াড়ই আজ গেরুয়া শিবিরে যোগ দেওয়ার আশায় বুক বাঁধছে। ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের ভদ্রতার মেকি আবাস খুলে ভয়ঙ্কর নগ্ন শরীরটা আজ আলোয় আসছে।

উত্তর প্রদেশের আরএসএস এর পদচিহ্ন অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গের বুকে বিগত পাঁচ বছর ধরে তীব্র ভাবে জঙ্গী কার্যকলাপ ও বিকৃত তথ্য ও মিথ্যা সংবাদের ভিত্তিতে হিন্দুত্ববাদী শিবির গ্রাম থেকে শহর সব জায়গায় জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিষবাস্প ছড়িয়ে দাঙ্গা লাগাবার রসদ সংগ্রহ করে চলেছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের শাসনে অকুতোভয় হয়ে। মিথ্যা খবর, গুজব, ও এক শ্রেণীর দালাল সাংবাদিকদের সাহায্যে হিন্দুত্ববাদী শিবিরের সবচেয়ে জঙ্গী শক্তি হিন্দু সংহতি আজ পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় দাঙ্গা লাগিয়েছে, খোলাখুলি আমেরিকা ও জায়নবাদী ইসরায়েলের টাকা খেয়ে রাস্তায় নেমে মুসলমান বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়েছে এবং আজ অবধি এই অগুনতি দাঙ্গা হাঙ্গামার জন্যে এদের লোকেদের একজনকেও মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। এমনকি শিলিগুড়ি লাইনের (বিজেপির সাথে বেসরকারি জোট) স্বার্থে সিপিএম ও কংগ্রেসও এই রাজ্যে বেড়ে চলা সাম্প্রদায়িক হিংসা ও ঘৃণার প্রচারের বিরুদ্ধে কোন পাল্টা কর্মসূচি না নিয়ে শুকনো বিবৃতি দিয়ে নিজেদের দায় সেরেছে।

রাম নবমীর মতন অবাঙালি উৎসব কে কেন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে? কেন জোর করে গ্রামে গঞ্জে হিন্দি ভাষার প্রচলন বাড়ানো হচ্ছে আরএসএস এর স্কুলগুলোর মাধ্যমে? এর কারণ হলো যে বিজেপি এবার পশ্চিমবঙ্গ কে পাখির চোখ করে উত্তর প্রদেশ ও আসামের মডেল অনুসরণ করে দখল করতে চায়। আগামী লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের দুই নম্বর পার্টি হয়ে ওঠা বিজেপির তাৎক্ষণিক লক্ষ্য এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস কে সরিয়ে ক্ষমতার আলিন্দে আসা এখন একটি দীর্ঘ মেয়াদের প্রকল্প গেরুয়া শিবিরের। এই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আগে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও শ্রমজীবি মানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রামগুলিকে শেষ করা ও পশ্চিমবঙ্গের শ্রমজীবি মানুষের লড়াকু ঐতিহ্য কে শেষ করা ভীষণ জরুরী, আর তাই এই লড়াইগুলো কে এবং লড়াইয়ের ঐতিহ্য কে শেষ করতে আজ আরএসএস এর কর্মসূচী হলো দাঙ্গা হাঙ্গামার মাধ্যমে, হিন্দুত্ববাদের মতাদর্শের ভিত্তিতে জাতি ও ধর্ম ঘৃণার উপর ভর করে, রাজ্যের গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে নিজের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা ও বিজেপির ঝুলিতে বৃহৎ হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক গড়ে মেরুকরণের ফসল ঢোকানো।

যেহেতু আরএসএস ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী শক্তি মারাঠি ও গুজরাটি বাদে অন্যান্য কোন জাতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, বিবিধতা, ও ভাষা এবং সংস্কৃতির বৈচিত্র কে আরবি ওয়াহাবি কায়দায় অস্বীকার করে ও ঘৃণা করে, তাই তাদের পক্ষে আজ পশ্চিমবঙ্গের গরিব মানুষের মধ্যে হিন্দি ভাষার প্রচলন কে বাড়িয়ে তাঁদের কে হিন্দি ভাষা ও উত্তর ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতির ক্রীতদাসে পরিণত করা ভীষণ জরুরী। তাই রাম নবমী পালন, রাম ও হনুমান আরাধনার প্রচলন শুরু করা, আমিষ খাওয়ার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করার থেকে শুরু করে হিন্দি ভাষা কে  বাঙালি, তামিল, সাঁওতাল, অহমীয়, ইত্যাদী সকল জাতির প্রধান ভাষা হিসেবে স্থাপিত করতে আজ লেগে পড়ে লেগেছে আরএসএস। আর এই কাজে সমস্ত গেরুয়া সংগঠনগুলি আজ কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।  

যুক্তি অবশ্যই হেগড়েওয়ার-গোলওয়ালকার-সাভারকারের মতন ব্রাক্ষণত্ববাদীদের সৃষ্ট “অখন্ড ভারতের” দর্শন, যে ভারতে রাজত্ব করবে উত্তর ভারতীয়, গুজরাটি, মারাঠি, ও মাড়োয়ারি উচ্চ জাতির হিন্দুরা আর যে ভারতের একটিই ভাষা হবে -হিন্দি, একটিই ধর্ম হবে - হিন্দুত্ব আর একটিই সংস্কৃতি হবে - হিন্দুত্ববাদ।  সেই ভারতের প্রয়োজনেই আজ প্রতিটি অঞ্চলের স্বতন্ত্রতা কে, বৈচিত্র কে শেষ করে এক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কে পত্তন করতে উদগ্রীব হয়েছে বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজি ও দেশি মুৎসুদ্দি আর জোতদারদের টাকায় চলা আরএসএস ও বিজেপি। তাই আজ নরেন্দ্র মোদীর কাছে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরালা, মনিপুর, আসাম, ইত্যাদী আজ ভীষণ জরুরী, কারণ এই রাজ্যগুলোয় আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডা কে শক্তিশালী ভাবে খাড়া করতে পারলে আর দেখতে হবে না, উত্তর প্রদেশের মতন জাতি দ্বন্ধ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত আবহাওয়ায়  ভরিয়ে দেওয়া হবে এই সব রাজ্যের আকাশ আর বাতাস আর শেষ করে দেওয়া হবে এই রাজ্যগুলোয় বাস করা মানুষের বৈচিত্র্যময় নিজস্ব সংস্কৃতি ও সমস্ত ভাষাগুলো কে।

বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতি কে এই উত্তর ভারতীয় ব্রাক্ষণত্ববাদী আগ্রাসনের থেকে রক্ষা করতে দক্ষিণ বা বামপন্থী কোন পার্টি বা সংগঠন এগিয়ে আসছে না নিজেদের “সর্বভারতীয়” ও “রাজনৈতিক ভাবে সঠিক” ইমেজ বজায় রাখতে।  প্রাদেশিকতার “প্রতিক্রিয়াশীল” দাগ লাগার থেকে বাঁচার জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সহ সকল অ-হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোর প্রধানধারার রাজনৈতিক দলগুলো আজ আরএসএস এর হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের আগ্রাসী ফ্যাসিবাদী আক্রমণের সামনে উরু গেড়ে বসে আছে। তাঁরা আজ প্রতিবাদ করার স্পর্ধা দেখাতে পারছে না, পাছে মোদী সরকার ওদের কুকীর্তিগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরে! তাই, এমনকি বাঙালির স্বাতন্ত্রতা নিয়ে হাওড়া ব্রিজ থেকে বড়বাজারের দেওয়ালে স্লোগান লেখা আমরা বাঙালি’ও আজ নিশ্চুপ হয়ে আরএসএস এর সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমান নিধন যজ্ঞের কান্ডারীদের দলে নাম লিখিয়েছে। আজ নিজেদের আদিবাসী সমাজের দাবিগুলো কে আস্তাকুঁড়েতে ছুড়ে ফেলে শুধু মাত্র টাকার লোভে সাওঁতাল ও বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর থেকে উঠে আসা প্রধানধারার রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব আরএসএস এর সাথে হাত মিলিয়েছে ও অপারেশন গ্রীন হান্ট থেকে শুরু করে খ্রীষ্টান মিশনারিগুলোর উপর আক্রমণ নামিয়ে আনতে হিন্দুত্ববাদ কে সাহায্য করছে।

এই পরিস্থিতিতে রাম নবমীর নামে যখন হাতে ত্রিশূল, তলোয়ার, ভোজালি সহ ভয়ানক সব ধারালো অস্ত্র নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় রাস্তায় হিন্দুত্ববাদী আরএসএস -ভিএইচপি-হিন্দু সংহতি সহ সকল গেরুয়া সন্ত্রাসীদের দলের গুন্ডারা তাণ্ডব করবে, যখন ভদ্রলোক সমাজের শিরায়-উপশিরায় বাস করা ব্রাক্ষণত্ববাদের সুপ্ত চেতনা কে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলতে একের পর এক মিথ্যা ও কুৎসার সাহায্যে মুসলমান ও খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ সংগঠিত করবে আরএসএস ও বিজেপি, তখন কে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে, জনগণের ঐক্য কে সুদৃঢ় করে শত্রুর আক্রমণ কে রুখে দিতে পথে নামবে? কে তৃণমূলের সাহায্যে আরএসএস ও বিজেপির এই ঘৃণ্য তাণ্ডবকে প্রতিহত করবে আর গেরুয়া শিবির কে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎখাত করবে? একমাত্র সংগ্রামী কমিউনিস্টরাই এই কাজ করতে সক্ষম, কিন্তু অসংখ্য ভাগে ভাগ হয়ে থাকা বিপ্লবী বামপন্থীরা, জনগণের স্বার্থ কে সামনে রেখে কি এক হওয়ার সাহস বা সদিচ্ছা দেখাতে পারবেন? অমুক নেতা ভাল না, তমুক নেতার লাইন মানিনা, অমুকের সংগঠন তমুক লাইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এনেছিল - এই দ্বন্ধগুলো কে নিজের জায়গায় রেখে, নিজেদের মধ্যে মতাদর্শগত সংগ্রাম কে বজায় রেখেও কি তাঁরা এক হয়ে ফ্যাসিবাদের কবর খোঁড়ার সদিচ্ছা দেখাতে পারবেন? কে অতি বাম আর কে ক্ষতি বাম এই তর্ক কে গৌণ করে ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা কে প্রধান কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে ঢোল বাজিয়ে কাফকা আর কিউবা না আউড়ে শ্রমিক কৃষকের বস্তিতে আর বাসায় গিয়ে তাঁদের রাজনীতি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে নামাতে পারবেন?

মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অসংখ্য ব্যাখ্যার মতনই আমাদের দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, অসংখ্য কমিউনিস্ট পার্টি ও গ্রুপ আছে, যদিও এই প্রবন্ধে তাদের সকলকেই বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী বলে আখ্যা দেওয়াটা লক্ষ্য নয়, তবুও এদের বেশির ভাগের মধ্যেই সুবিধাবাদ ও সংসদীয় ব্যবস্থার মোহটা এতই গভীরে প্রোথিত যে এদের পক্ষে রাস্তায় নেমে, সরকারি পন্থা বাদ দিয়ে সরাসারি গণসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জনগণের স্বার্থে, খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্যের স্বার্থে আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন, দিলীপ আর তপন ঘোষের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদের রথের চাকা ভেঙে দেওয়ার লড়াই করার কোন সম্ভাবনা নেই। তবুও এই সকল দলের অধিকাংশ কর্মী ও সমর্থকই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির চরম বিরোধী আর তাই আজ সকল প্রগতিশীল বামপন্থীদের কর্তব্য হলো পার্টিবাজির সংকীর্ণ গন্ডির বাইরে বেরিয়ে অন্যান্য দলের কর্মী ও সমর্থকদের সাথে কথা বলা, মত বিনিময় করা, এবং একসাথে সঙ্কল্প নিয়ে সক্রিয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদী গেরুয়া শিবির কে পশ্চিমবঙ্গের মাটির থেকে এবং বাঙালি ও আদিবাসী জনগণের মনন থেকে উৎখাত করা। এই লড়াইয়ে আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো ঐক্য আর এই ঐক্য আজ অর্জন করা যেতে পারে নিজেদের মধ্যে লাইন আর নীতিগত পার্থক্য বজায় রেখেও।

আজ যদি পাল্টা প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মাধ্যমে পদে পদে হিন্দুত্ববাদের বানর সেনা কে আটকানো না হয়, যদি ওদের মুসলিম বিদ্বেষী, খ্রীস্টান বিদ্বেষী, নারী বিদ্বেষী, এবং খেটে খাওয়া মানুষের লড়াই বিদ্বেষী প্রচার ও মিথ্যাচারের যন্ত্র কে ভেঙে দিয়ে জনগণের মধ্যে সত্য প্রচারের স্বার্থে ব্যাপক প্রচার কার্য না করা হয়, তাহলে কিন্তু আগামী কাল পশ্চিমবঙ্গের মাটি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের রক্তে সিক্ত হবে, উত্তর ভারতীয় হিন্দি আগ্রাসীদের চক্রান্তে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় লিপ্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই রাজ্য কে শেষ পর্যন্ত আর একটা গুজরাট বা উত্তর প্রদেশের মতন সাম্প্রদায়িক হিংসার আঁতুড়ঘরে পরিণত করবেন। সেই ভবিষ্যৎ আগামী প্রজন্ম ও বাঙালি জাতির পক্ষে, হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টান-বৌদ্ধ-বাউল-আদিবাসী-জৈন-শিখ সহ পশ্চিমবঙ্গের সকল মানুষের পক্ষে হবে ভয়াবহ। আজ যদি রাম নবমীর নামে সশস্ত্র মিছিল ও দাঙ্গার মাধ্যমে আমরা পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস এর নেতৃত্বাধীন গৈরিক বাহিনী কে নিজেদের প্রতিপত্তি কে বলিষ্ঠ ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে দিয়ে ফেলি তাহলে আগামী প্রজন্ম ও ইতিহাস আমাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না। তাই সাধু সাবধান ! তোমার মা-মাটি-মানুষ আজ হিন্দুত্ববাদের হাতে আক্রান্ত-লুন্ঠিত-পদদলিত। সময় এসেছে রুখে দাঁড়ানোর, সময় এসেছে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করার। পশ্চিমবঙ্গের আকাশের লাল সূর্যের উত্তাপে জ্বালিয়ে দিন হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের সকল চক্রান্ত কে আর রক্তিম আভা দিয়ে পথ দেখান সমগ্র ভারতবর্ষকে আগামী দিনে এক সৌভ্রাতৃত্বে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণ করার।   

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে