শ্রীশ্রী রবিশংকর থেকে বিজয় মালয়া: টাকা আর রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে ভারতের Art of Living থেকে Art of Leaving
Art of living এবং art of leaving এর যাত্রা পথের সাথে ভালোই পরিচয় হলো এই সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে। শ্রী শ্রী রবিশংকর যিনি স্বঘোষিত একজন দেব পুরুষ, তাঁর হঠাৎ শখ হলো যে দিল্লির মৃতপ্রায় যমুনা নদীর পাড়ে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাবেশ করে 'বিশ্ব সাংস্কৃতিক উৎসব' করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ, অভুক্ত কাঙাল ভারতবর্ষে কোটি কোটি টাকা খরচা করে শুধু যমুনা কে আরও মৃতপ্রায় করতে শুধু বিশাল মঞ্চই প্রস্তুত হলো না, দেশ বিদেশ থেকে আসা ভক্তকুলের স্বার্থে দেশের মিলিটারি নামিয়ে সেতু গড়া হলো। যে মিলিটারির জনগণের উপর করা অত্যাচার আর ধর্ষণের বিরুদ্ধে বলার জন্যে কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য সহ সমস্ত জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নেড়ির মতন খেঁকিয়ে উঠেছিল ভারতের স্বঘোষিত দেশপ্রেমী বাহিনী, তাদের আজ সেই মিলিটারি বাহিনীর এক কোটিপতি সাধু বাবার হয়ে বিনামূল্যে পরিশ্রম করা হয়তো দেব সেবা মনে হয়ে থাকতে পারে। আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো যে অরবিন্দ কেজরিবাল কথায় কথায় বিজেপির বিরুদ্ধে ভীষণ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তিনি আচমকা ভেজা বেড়ালের মতন লেজ গুটিয়ে সটান শ্রীশ্রী বাবার পদযুগল ছুঁতে বিজেপি ও আরএসএস এর কর্তাদের সাথে, এমনকি নরেন্দ্র মোদীর সাথে, হাসতে হাসতে ছুটে চলেছেন! ভারতবর্ষের এক চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ভন্ডের দিল্লির পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে কিছু না বলে অরবিন্দ কেজরিবাল ও নরেন্দ্র মোদী প্রমাণ করলেন যে রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণী কি ভাবে এই সব ধর্মের নামে ব্যবসা চালানো কে ধুপ ধুনো দিয়ে পুজো করছে।
![]() |
"Photo Credit: --pradeep--via Compfight |
দিল্লির যমুনা নদী, যা হরিয়ানা থেকে নদী হয়ে ঢুকে নর্দমা হিসেবে নিষ্কাশিত হয়, তা আইটিও সেতুর কাছে এসে বিকট দুর্গন্ধময় এক নোংরা নালার চেয়ে বেশি কিছু থাকে না। এই যমুনার পাড়গুলোয় একসময়ে কমনওয়েলথ গেমস ও যমুনা ব্যাংক মেট্রো স্টেশন তৈরি হওয়ার পরে নদীর ফ্লডপ্লেন জাতীয় বস্তু ইতিহাস হয়ে গেছে। যেটুকু গাছপালা রয়েছে তা এবার শ্রীশ্রী বাবার নর্তন কীর্তনের চাপে মায়ের ভোগে যাওয়ার পরিস্থিতি উত্পন্ন হয়েছে। ভন্ড বাবা শ্রীশ্রী রবিশংকর এ কথা মানতে নারাজ। তাঁর দৈব শক্তি মারফত তিনি জেনেছেন যে কোনও গাছপালা বা প্রকৃতির কোনো ক্ষতি তাঁর ভক্তকুল করেনি, বরং দেশের স্বার্থে অনুষ্ঠিত এই মহান বিশ্ব সাংস্কৃতিক উৎসবে আগত মানুষের ভিড়ের কথা ভেবে কিছু গাছপালার ডাল আর পাতা ছাঁটা হয়েছে মাত্র। এর মধ্যেই আবার ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনাল শ্রীশ্রী বাবার এই কর্মকাণ্ডের উপর পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা ঘোষণা করেছে। যে জরিমানা দেবেন না বরং জেল যাবেন বলে ঘোষণা করে হঠাৎ শ্রীশ্রী বাবা ডিগবাজি খেয়ে ঘোষণা করলেন যে তিনি কিস্তিতে টাকা শোধ করবেন। হাঁসির কথা যে দেশ-বিদেশের সকল ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূদের গুরু, বড় বড় পুঁজিপতি - কর্পোরেট গোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক গুরু, হিন্দুত্ববাদী - ব্রাক্ষণত্ববাদী শক্তিগুলির রাজনৈতিক চেহারা এই শ্রীশ্রী বাবার পকেটে নস্যি মাত্র পাঁচ কোটি টাকা নেই। হয়তো তিনি এখনো ঠিক করে সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের ভক্ত করে তুলতে পারেননি।
হ্যাঁ, সরকারি ব্যাংকগুলো আজ দেশি-বিদেশী কর্পোরেট সংস্থাগুলোর টাকা যোগানকারী সংস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই সরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই সেই ২০১২ সালে দেশের অন্যতম পুঁজিপতি বিজয় মালয়ার রুগ্ন হয়ে পড়া কিংফিশার এয়ারলাইন্স কে চাঙ্গা করতে সাধারণ মানুষের টাকা ওই বিলাসবহুল জীবন যাপনে ব্যস্ত,.সুন্দরী তরুণীদের কোমরে হাত জড়িয়ে ঘুরতে ব্যস্ত, দেশপ্রেমিক মালয়ার সংস্থায় ঢালে কংগ্রেস সরকার।কথা ছিল বিজয় মালয়া কিংফিশার এয়ারলাইন্স এর কর্মীদের বকেয়া বেতন মেটাবেন এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর টাকা মেটাবেন। সেইসময়ে জনগণের টাকায় এক হাঙর পুঁজিপতির স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কেন প্রশ্ন তুলে অনেক প্রতিবাদ হলেও তলে তলে সাঁট গাঁটের দৌলতে মালয়া প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে পেয়ে যান। তারপর সবই ইতিহাস, বকেয়া বেতন থাকলো বকেয়া, বরং কিছু রাজনৈতিক শক্তিকে একজোট করে রাজ্যসভার সাংসদ হন মালয়া, যেমনটি সাংসদ ছিলেন আম্বানী ও জিন্দল, ঠিক সেই রকম। শোনা যায় মার্চের প্রথম সপ্তাহে ব্যাগপত্র গুছিয়ে দেশ ছেড়ে পাখি বহুদুর উড়ে যায় এবং ৯০০০ কোটি টাকাও সেই সত্যজিত রায়ের সোনার কেল্লার মতন উবে গেল।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি রিপোর্ট অনুসারে ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ১১৪,০০০ কোটি টাকার ঋণ সরকারি ব্যাংকগুলোর খাতায় মওকুফ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো অবশ্য জানায়নি যে কত শতাংশ ঋণ ব্যবসায়িক আর কত শতাংশ ব্যক্তিগত, আর এটাও জানা যায়নি যে ব্যক্তিগত ঋণের কতটা কোটিপতি লোকেদের আর কতটা সাধারণ মানুষের। তবে একটা দৈব সত্য জানা গেছে যে যদিও ভারতের অন্নদাতা কৃষকদের মধ্যে অধিকাংশই আজও সরকারী ব্যাঙ্কগুলির থেকে ঋণ পান না এবং এর ফলে তাঁদের নির্ভর করতে হয় গ্রামের মহাজনদের উপর, যারা সুদের পাহাড় চাপিয়ে কৃষকদের জীবনকে বিষিয়ে তোলে, এমনকি যদিও বা কখনো কোনো সরকারী ব্যাঙ্ক শাসক শ্রেণীর স্বার্থে কৃষকদের ঋণ দেয় তাহলে সেই ঋণের টাকা আদায় করতে তারা কৃষকদের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই দুই ঋণদাতার চাপে দেশের কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে চলেছে ফি বছর। কিন্তু বড় বড় পুঁজিপতি, ধনী ব্যবসায়ী, দেশী - বিদেশী পুঁজির দ্বারা চালিত বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশন গুলি কোটি কোটি টাকা বকেয়া ঋণ ও সুদ মেরে চুপ চাপ দেশ থেকে সাধারণ মানুষের টাকা গায়েব করে নিজেদের লাভের পাহাড় উঁচু করে চলেছে।
নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দৌড়ে এই সমস্ত বড় বড় কর্পোরেশনগুলি হলো দেশের প্রভু। সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা এদের নুন খান এবং বিশ্বস্ত দারোয়ানের মতন এই বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের দেশী সহযোগী দালাল পুঁজিপতিদের স্বার্থ কে রক্ষা করে চলছে। সমস্ত সরকার, তা বিজেপি বা কংগ্রেসের হোক অথবা সিপিএম বা তৃণমূলের, তারা সকলেই আদা জল খেয়ে দেশের মাটি, জল, জঙ্গল, পাহাড় ও খনিজ সম্পদ আজ এই বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির কাছে পাইকারী দরে বিক্রি করে চলেছে। দেশের বৃহৎ এক অঞ্চল থেকে আদিবাসী জনগণ কে, কৃষকদের উচ্ছেদ করে পরিবেশ ধ্বংসকারী বিদেশী পুঁজির শিল্প গড়ার প্রক্রিয়া কে ত্বরান্বিত করেছে। যেহেতু আজ ভারতের অভ্যন্তরে এক বিশাল অংশে জনগণ, বিশেষ করে দেশের মুলনিবাসী ও আদিবাসী সমাজ আজ এই ভাবে দেশ বিক্রি ও কর্পোরেট শক্তির তোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, তাই আজ দেশের সরকার জনগণের করের টাকায় বিদেশী বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে দেশের আদিবাসী সমাজের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদে সোচ্চার কৃষকদের বিরুদ্ধে, এবং দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে এক খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক নাম "অপারেশন গ্রীন হান্ট" হলেও এর আসল উদ্দেশ্য হলো "রেড হান্ট" বা কমিউনিস্ট বিদ্রোহ কে খতম করা। ভারতের সেনাবাহিনী যে perception ম্যানেজমেন্ট এর doctrine তৈরি করেছে তার লক্ষ্য হচ্ছে দেশের জনগণের একটা বড় অংশের উপলব্ধি ও মতবাদের উপর প্রভাব ফেলা এবং শাসক শ্রেণীর স্বার্থ কে প্রতিষ্ঠা করা যাতে করে যুদ্ধে kinetic force বা মারণাস্ত্রের প্রয়োগ কম করতে হয়। এই doctrine দেশের সেনাবাহিনী এমনি এমনি তৈরি করেনি কারণ এই রকম doctrine বানানো কোনো অফিসে বসা লেখকের কাজ নয় বরং দেশের আর্থ-সামাজিক ও সামরিক সমস্যাগুলিকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে দেশের সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের পাকা মাথারা এই doctrine বানিয়েছেন শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের সুরক্ষার স্বার্থে। একটা বড় স্তরের perception ম্যানেজমেন্ট বলতে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে যে দেশের শহরে বাস করা কয়েক কোটি মানুষের উপর শাসক শ্রেণীর প্রভাব বিস্তার করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে যাতে তাঁদের কে, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের, দেশের প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের থেকে সরিয়ে রাখা যায়, এবং conflict zone এর বাইরে থাকা জনতাকে দেশের ভিতরে চলতে থাকা লুটপাটের যুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখা যায়। এই অজ্ঞ করে রাখার জন্যে কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা জনতার মতামতের উপর প্রভাব ফেলা ও তাঁদের মতামতকে শাসক শ্রেণীর স্বার্থে চালাবার জন্যে প্রচার চালানোর কাজ চালানো হচ্ছে, এর সাথেই চলছে বৃহৎ আকারে দেশের জনগণের উপর উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ কে প্রসার করার স্বার্থে হিন্দির সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।
বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তার দেশী কর্পোরেট দালালদের বিরুদ্ধে শুধুই প্রচার মাধ্যম আর সিনেমা থিয়েটার উপন্যাসের প্রচারেই যে কাজ হবে না সে কথা ভারতের শাসক শ্রেণী খুব ভালো করেই জানে এবং তাই ওদের দরকার হয় আধ্যাত্মিক শক্তির, যারা উপাসনা ও দৈব শক্তির নামে দেশের জনগণ কে বিশেষ করে conflict zone এর বাইরে থাকা মানুষদের দেশের ভিতর চলতে থাকা লড়াইয়ের থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে, যাতে conflict zone এর বাইরে থাকা জনগণের বড় অংশের সমর্থন শাসক শ্রেণী নিজের পক্ষে জিতে নিতে পারে। এই জন্যেই আজ শাসকশ্রেণীর দরকার শ্রীশ্রী রবিশংকর থেকে শুরু করে রামদেব, আশারাম বাপু, নিত্যানন্দ থেকে জাকির নায়েক ইত্যাদীর, যাতে এদের মাধ্যমে মানুষকে ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চিন্তার জগতে আটকে রাখা যায় এবং দেশের সম্পদ ও জমি বেহায়ার মতন বিদেশী কর্পোরেটদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া যায়।
বিশ্বজুড়ে এক বৃহৎ সংকটের ফলে শ্বাস কষ্টে ভোগা বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নিপুঁজির আজ ভারতের মতন নয়া উপনিবেশই বাঁচিয়ে রাখার অক্সিজেন যোগান দিতে পারে আর তাই ভারতের উপর রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক প্রভুত্বই নয় আজ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির দরকার ভারতের সামন্তবাদী ধ্যানধারণার উপর গড়ে ওঠা ধর্ম ও সামাজিক কুসংস্কারগুলি কে তীব্র করে জনগণের রগে রগে ঢুকিয়ে মানুষকে ধর্মভীরু এবং বিদ্রোহ - বিপ্লব বিমুখ করে তোলা যাতে এই দেশের লুটের রাস্তা সুগম হয়।
তাই কোটি কোটি টাকা খরচা করে ভারতবর্ষের মতন গরিব দেশে এক ভন্ড সাধুবাবা সাংস্কৃতিক উৎসব করতে পারে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে বিদেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনে। তাই এই দেশের সরকার এক সাধুর সপ্নে দেখা সোনা খুঁজতে কোটি কোটি টাকা খরচা করে পুরাতত্ব বিভাগ কে দিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে ভগ্নস্তূপে খোঁড়াখুঁড়ি করে সময় ও অর্থ পন্ড করতে পারে, এরা পারে না শুধু গরিবের পেটে দু বেলা ভাত দিতে, এরা পারে না গরিবের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, শিশুদের পুষ্টি ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে। এরা পারে শুধু মানুষ কে খুন করতে আর না হয় কোনো না কোনো ভাবে দাস বানিয়ে রাখতে। আজ এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গোটা দেশের খেটে খাওয়া মানুষের রুখে দাঁড়াবার সময় এসেছে, দেশ বিক্রি করে দেশপ্রেমের ভন্ডামি করা শক্তির বিরুদ্ধে গোটা দেশ কে রুখে দাঁড়াতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে দেশের জনগণের উপর শোষনের রোলার চালিয়ে বিজয় মালয়ার মতন পুঁজিপতিদের সিন্দুক ভরার বিরুদ্ধে, আর রুখে দাঁড়াতে হবে একসাথে, একজুট হয়ে, প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি রাজপথে, শক্ত হাতে পাঞ্জা কষে দেশদ্রোহী শক্তিদের পরাজিত করার জন্যে।
যতদিন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে পারবো না, লেপের তলায় তৈরি করা আরামের দুনিয়ার থেকে বেরিয়ে জনগণের স্বার্থে লড়বো না ততদিন শুধু আশাই করবো যে ভগবানের কৃপায় দৈব পুরুষ শ্রীশ্রী রবিশংকরের মঞ্চ শিলা বৃষ্টি আর ঝড় জলে ধুয়ে মুছে যাক। আর সেই আশা হবে গুড়ে বালি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি রিপোর্ট অনুসারে ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ১১৪,০০০ কোটি টাকার ঋণ সরকারি ব্যাংকগুলোর খাতায় মওকুফ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো অবশ্য জানায়নি যে কত শতাংশ ঋণ ব্যবসায়িক আর কত শতাংশ ব্যক্তিগত, আর এটাও জানা যায়নি যে ব্যক্তিগত ঋণের কতটা কোটিপতি লোকেদের আর কতটা সাধারণ মানুষের। তবে একটা দৈব সত্য জানা গেছে যে যদিও ভারতের অন্নদাতা কৃষকদের মধ্যে অধিকাংশই আজও সরকারী ব্যাঙ্কগুলির থেকে ঋণ পান না এবং এর ফলে তাঁদের নির্ভর করতে হয় গ্রামের মহাজনদের উপর, যারা সুদের পাহাড় চাপিয়ে কৃষকদের জীবনকে বিষিয়ে তোলে, এমনকি যদিও বা কখনো কোনো সরকারী ব্যাঙ্ক শাসক শ্রেণীর স্বার্থে কৃষকদের ঋণ দেয় তাহলে সেই ঋণের টাকা আদায় করতে তারা কৃষকদের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই দুই ঋণদাতার চাপে দেশের কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে চলেছে ফি বছর। কিন্তু বড় বড় পুঁজিপতি, ধনী ব্যবসায়ী, দেশী - বিদেশী পুঁজির দ্বারা চালিত বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেশন গুলি কোটি কোটি টাকা বকেয়া ঋণ ও সুদ মেরে চুপ চাপ দেশ থেকে সাধারণ মানুষের টাকা গায়েব করে নিজেদের লাভের পাহাড় উঁচু করে চলেছে।
নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দৌড়ে এই সমস্ত বড় বড় কর্পোরেশনগুলি হলো দেশের প্রভু। সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা এদের নুন খান এবং বিশ্বস্ত দারোয়ানের মতন এই বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তাদের দেশী সহযোগী দালাল পুঁজিপতিদের স্বার্থ কে রক্ষা করে চলছে। সমস্ত সরকার, তা বিজেপি বা কংগ্রেসের হোক অথবা সিপিএম বা তৃণমূলের, তারা সকলেই আদা জল খেয়ে দেশের মাটি, জল, জঙ্গল, পাহাড় ও খনিজ সম্পদ আজ এই বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির কাছে পাইকারী দরে বিক্রি করে চলেছে। দেশের বৃহৎ এক অঞ্চল থেকে আদিবাসী জনগণ কে, কৃষকদের উচ্ছেদ করে পরিবেশ ধ্বংসকারী বিদেশী পুঁজির শিল্প গড়ার প্রক্রিয়া কে ত্বরান্বিত করেছে। যেহেতু আজ ভারতের অভ্যন্তরে এক বিশাল অংশে জনগণ, বিশেষ করে দেশের মুলনিবাসী ও আদিবাসী সমাজ আজ এই ভাবে দেশ বিক্রি ও কর্পোরেট শক্তির তোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, তাই আজ দেশের সরকার জনগণের করের টাকায় বিদেশী বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে দেশের আদিবাসী সমাজের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদে সোচ্চার কৃষকদের বিরুদ্ধে, এবং দেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে এক খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক নাম "অপারেশন গ্রীন হান্ট" হলেও এর আসল উদ্দেশ্য হলো "রেড হান্ট" বা কমিউনিস্ট বিদ্রোহ কে খতম করা। ভারতের সেনাবাহিনী যে perception ম্যানেজমেন্ট এর doctrine তৈরি করেছে তার লক্ষ্য হচ্ছে দেশের জনগণের একটা বড় অংশের উপলব্ধি ও মতবাদের উপর প্রভাব ফেলা এবং শাসক শ্রেণীর স্বার্থ কে প্রতিষ্ঠা করা যাতে করে যুদ্ধে kinetic force বা মারণাস্ত্রের প্রয়োগ কম করতে হয়। এই doctrine দেশের সেনাবাহিনী এমনি এমনি তৈরি করেনি কারণ এই রকম doctrine বানানো কোনো অফিসে বসা লেখকের কাজ নয় বরং দেশের আর্থ-সামাজিক ও সামরিক সমস্যাগুলিকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে দেশের সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের পাকা মাথারা এই doctrine বানিয়েছেন শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের সুরক্ষার স্বার্থে। একটা বড় স্তরের perception ম্যানেজমেন্ট বলতে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে যে দেশের শহরে বাস করা কয়েক কোটি মানুষের উপর শাসক শ্রেণীর প্রভাব বিস্তার করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে যাতে তাঁদের কে, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের, দেশের প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের থেকে সরিয়ে রাখা যায়, এবং conflict zone এর বাইরে থাকা জনতাকে দেশের ভিতরে চলতে থাকা লুটপাটের যুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখা যায়। এই অজ্ঞ করে রাখার জন্যে কর্পোরেট সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা জনতার মতামতের উপর প্রভাব ফেলা ও তাঁদের মতামতকে শাসক শ্রেণীর স্বার্থে চালাবার জন্যে প্রচার চালানোর কাজ চালানো হচ্ছে, এর সাথেই চলছে বৃহৎ আকারে দেশের জনগণের উপর উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ কে প্রসার করার স্বার্থে হিন্দির সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।
বিদেশী একচেটিয়া পুঁজি ও তার দেশী কর্পোরেট দালালদের বিরুদ্ধে শুধুই প্রচার মাধ্যম আর সিনেমা থিয়েটার উপন্যাসের প্রচারেই যে কাজ হবে না সে কথা ভারতের শাসক শ্রেণী খুব ভালো করেই জানে এবং তাই ওদের দরকার হয় আধ্যাত্মিক শক্তির, যারা উপাসনা ও দৈব শক্তির নামে দেশের জনগণ কে বিশেষ করে conflict zone এর বাইরে থাকা মানুষদের দেশের ভিতর চলতে থাকা লড়াইয়ের থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে, যাতে conflict zone এর বাইরে থাকা জনগণের বড় অংশের সমর্থন শাসক শ্রেণী নিজের পক্ষে জিতে নিতে পারে। এই জন্যেই আজ শাসকশ্রেণীর দরকার শ্রীশ্রী রবিশংকর থেকে শুরু করে রামদেব, আশারাম বাপু, নিত্যানন্দ থেকে জাকির নায়েক ইত্যাদীর, যাতে এদের মাধ্যমে মানুষকে ধর্ম ও আধ্যাত্মিক চিন্তার জগতে আটকে রাখা যায় এবং দেশের সম্পদ ও জমি বেহায়ার মতন বিদেশী কর্পোরেটদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া যায়।
বিশ্বজুড়ে এক বৃহৎ সংকটের ফলে শ্বাস কষ্টে ভোগা বৃহৎ একচেটিয়া ও লগ্নিপুঁজির আজ ভারতের মতন নয়া উপনিবেশই বাঁচিয়ে রাখার অক্সিজেন যোগান দিতে পারে আর তাই ভারতের উপর রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক প্রভুত্বই নয় আজ বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির দরকার ভারতের সামন্তবাদী ধ্যানধারণার উপর গড়ে ওঠা ধর্ম ও সামাজিক কুসংস্কারগুলি কে তীব্র করে জনগণের রগে রগে ঢুকিয়ে মানুষকে ধর্মভীরু এবং বিদ্রোহ - বিপ্লব বিমুখ করে তোলা যাতে এই দেশের লুটের রাস্তা সুগম হয়।
তাই কোটি কোটি টাকা খরচা করে ভারতবর্ষের মতন গরিব দেশে এক ভন্ড সাধুবাবা সাংস্কৃতিক উৎসব করতে পারে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে বিদেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনে। তাই এই দেশের সরকার এক সাধুর সপ্নে দেখা সোনা খুঁজতে কোটি কোটি টাকা খরচা করে পুরাতত্ব বিভাগ কে দিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে ভগ্নস্তূপে খোঁড়াখুঁড়ি করে সময় ও অর্থ পন্ড করতে পারে, এরা পারে না শুধু গরিবের পেটে দু বেলা ভাত দিতে, এরা পারে না গরিবের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, শিশুদের পুষ্টি ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে। এরা পারে শুধু মানুষ কে খুন করতে আর না হয় কোনো না কোনো ভাবে দাস বানিয়ে রাখতে। আজ এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গোটা দেশের খেটে খাওয়া মানুষের রুখে দাঁড়াবার সময় এসেছে, দেশ বিক্রি করে দেশপ্রেমের ভন্ডামি করা শক্তির বিরুদ্ধে গোটা দেশ কে রুখে দাঁড়াতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে দেশের জনগণের উপর শোষনের রোলার চালিয়ে বিজয় মালয়ার মতন পুঁজিপতিদের সিন্দুক ভরার বিরুদ্ধে, আর রুখে দাঁড়াতে হবে একসাথে, একজুট হয়ে, প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি রাজপথে, শক্ত হাতে পাঞ্জা কষে দেশদ্রোহী শক্তিদের পরাজিত করার জন্যে।
যতদিন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে পারবো না, লেপের তলায় তৈরি করা আরামের দুনিয়ার থেকে বেরিয়ে জনগণের স্বার্থে লড়বো না ততদিন শুধু আশাই করবো যে ভগবানের কৃপায় দৈব পুরুষ শ্রীশ্রী রবিশংকরের মঞ্চ শিলা বৃষ্টি আর ঝড় জলে ধুয়ে মুছে যাক। আর সেই আশা হবে গুড়ে বালি।