টাকা কালো - টাকা সাদা - মোদী ম্যাজিকে চাপা পড়ে গেল অনেক কথা

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১০, ২০১৬ 0 Comments A+ a-

কালো টাকা’র নাকি অন্তর্জলি যাত্রা শুরু হয়েছে কারণ নরেন্দ্র মোদী ৮ নভেম্বর রাতে হঠাৎ ঘোষণা করলো যে সরকার পুরানো পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোট নাকি বাতিল করছে এবং জনগণের কাছে যে পরিমাণ নগদ টাকা আছে তা তাঁরা হয় ব্যাঙ্কে জমা করতে পারেন অথবা ব্যাঙ্কে এসে নিজের সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রতিদিন ₹ ৪০০০ পর্যন্ত বদলে নিয়ে যেতে পারেন। দয়ালু সরকার জনগণ কে ৩০শে ডিসেম্বর অবধি সময় দিয়েছে আর বলেছে “দেশের স্বার্থে একটু কষ্ট সহ্য” করতে। মোটামুটি গোটা দেশে একটা হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে, এতই তীব্র হট্টগোল যে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এত সহজে মার্কিন নির্বাচন জিতে রাষ্ট্রপতি পদের ৪৫তম দাবিদার হয়ে গেল সে কথা কারুর মাথায় থাকলো না। সব তর্ক-বিতর্ক হঠাৎ গায়েব হয়ে গিয়ে শুধু পাঁচশো আর হাজার টাকার নোটের গল্প আর মোদী সরকারের জয়ধ্বনি কানে বাজছে। কালো টাকা তোমার দিন বুঝি সত্যিই শেষ। কিন্তু এই নোট বাতিল করে কি সত্যিই কালো টাকাকে জব্দ করা যাবে ?

কালো টাকা নির্মূলের মোদীর গিমিক চাপা দিচ্ছে সত্যকে


কালো টাকা মানে হলো যে টাকা কর না দিয়ে আয় করা হয়েছে; সেই টাকার সিংহভাগের মালিক হলো বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো, গ্রামের বড় বড় জোতদার ও ধনী কৃষকরা, আর শহরে বাস করা জমি-বাড়ির দালালরা, ফোঁড়েরা, মাফিয়ারা, সিনেমা অভিনেতারা, ক্রিকেট খেলোয়াড়রা, সরকারি আমলাতন্ত্রের উঁচু সিংহাসনে বসা লোকেরা, রাজনৈতিক নেতারা, মন্ত্রী আর পুলিশ কর্তারা। এই কালো টাকার অধিকাংশই নগদের রূপে থাকে না বরং দ্রুত জমি, বাড়ি, সোনা, বা শেয়ার-স্টকে বদলে যায়। ভারতবর্ষে কালো টাকার বড় অংশটা কর্পোরেট সংস্থাগুলোর। যারা শুধু কর ফাঁকিই দেয় না বরং যাদের আবার সরকার কর ছাড় দিয়ে বেশি করে চুরি করার রাস্তা করে দেয়, আর করে দেয় এই বলে যে দেশের উন্নয়নে নাকি এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো শরিক। এই কর্পোরেটদের আর আমলা-মাফিয়া-মন্ত্রী-নেতা-অভিনেতাদের কালো টাকা নানা কায়দায় ভারত থেকে বিদেশে চলে যায়, গচ্ছিত হয়ে যায় বিদেশী ব্যাঙ্কে বা বড় বড় কর্পোরেশনের শেয়ারে বা বৃহৎ লগ্নি পুঁজির কারখানা ব্যাঙ্কগুলোর বন্ডে। আবার বিদেশ থেকে এই টাকার একাংশ যখন প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ হিসেবে ভারতে ফিরে আসে তখন এই আগমনী পুঁজি কে ভারত সরকারই আবার কর ছাড় দেয় দেশের “অর্থনৈতিক উন্নয়নের” স্বার্থে। নিজেদের মুনাফার লক্ষ লক্ষ কোটি টাকাকে আবার কর মুক্ত করে ভারতবর্ষে বিনিয়োগ করে সেই টাকার থেকে উৎপন্ন লাভের একটা বড় অংশ কে জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে নিজেদের জনপ্রিয় করে তুলতে নানা রকমের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটির বা সিএসআর কার্যকলাপের মাধ্যমে এই সব কর্পোরেট সংস্থাগুলোই আবার কালো টাকার একটা বড় অংশ কে লোক দেখানো সমাজ সেবার নামে সাদা করে। তাইতো নানা ধরণের ব্যবসায়িক প্রকল্প কে চরিতার্থ করার স্বার্থে এই সকল কর্পোরেট সংস্থাগুলোর দরকার জনমত সৃষ্টি ও মানুষের চৈতন্য কে দখলে নেওয়া এবং এই কাজে এদের সিএসআর আর থিঙ্ক ট্যাংক সংস্থাগুলো প্রচন্ড কাজে আসে। তাই আজ খেলাধুলো থেকে সিনেমা, পরিবেশ থেকে অর্থনীতি, সব ব্যাপারেই নীতা আম্বানি কে দেখা যায়, তাই আজ আদানি সাহেবের সমস্ত কুকীর্তি ও ছলে বলে কৌশলে জনগণের থেকে জমি-জল ও প্রাকৃতিক সম্পদ কেড়ে নেওয়ার ঘটনাগুলো কোনদিন “দেশপ্রেমিক” নরেন্দ্র মোদী সরকারের রোষানলে পড়ে না।কালো টাকার বলেই ভোটের প্রচারে হেলিকপ্টার থেকে প্রাইভেট জেট ব্যবহার করে আর পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচা করে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারে। যেহেতু তেরঙ্গা ঝান্ডা নাড়িয়ে গেরুয়া বসন পড়ে যে কোন আরএসএস সমর্থকের কালো টাকা সাদা হয়ে যায় তাই এই পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিলে কি সত্যিই এই নেকড়েদের কোন রকমের ক্ষতি হতে পারে?

সারা দেশ জুড়ে যখন নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত কে নিয়ে সাধুবাদ দেওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে আর তথাকথিত “দেশভক্ত” ও “জাতীয়তাবাদী” সংবাদ মাধ্যমগুলি বারবার এই সিদ্ধান্তের ফলে কালো টাকা শেষ হয়ে যাবার মতন মিথ্যা প্রচারের বন্যা ছুটিয়ে চলেছে তখন বুঝতে হবে যে ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়। ভারতবর্ষের অর্থনীতির মূল উৎপাদক শক্তি হলো কৃষক, যদিও ভারতের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির দরুন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে আর দরিদ্র-ভূমিহীন ও মধ্য কৃষকদের পক্ষে চাষের খরচ মিটিয়ে ঘরে দুই পয়সা তোলা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলার কথা নতুন করে বলার কোন দরকার নেই। সেই কৃষকদের অধিকাংশের হাতে, গ্রামের খেটে খাওয়া জনগণ যাঁদের কাছে এনরেগা প্রকল্পের জব কার্ড নেই, তাঁদের হাতে, অর্থ বা তাঁদের ঘরোয়া সঞ্চয়ের অর্থ কিন্তু নগদেই থাকে আর তার মধ্যে পাঁচশো বা হাজার টাকার নোট থাকা আশ্চর্যজনক নয়। শহরের শ্রমিকদের, বিশেষ করে সমস্ত ঠিকা শ্রমিক ও দিনমজুরদের মজুরি কিন্তু আজও নগদেই হয়। বেশির ভাগ মাড়োয়ারি ফার্মে আজও নগদ টাকায় কেরানীদের বেতন দেওয়া হয়। আর ঠিক এই ৭-৮ তারিখ নাগাদ অনেক ছোট কোম্পানির কর্মীদের বেতন হয়, বেশিরভাগই নগদে। শহরে কাজ করতে আসা বেশির ভাগ দিন মজুরদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই, তাঁদের সিংহভাগ আজও  বাড়িতে টাকা পাঠান মানি অর্ডার করে না হয় নিজে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসেন। তাঁদের সঞ্চিত অর্থ মোটামুটি গ্রামের বাড়িতে বা শহরের বস্তির ঘরে জমানো থাকে কৌঁটো বা বাক্সে, বিয়ে বা চিকিৎসার জন্যে, অথবা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার থেকে বাঁচার জন্যে। পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ার ফলে এরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন কারণ এদের পক্ষে মাইলের পর মাইল হেঁটে নগদ টাকা নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে তা বদলে আবার নগদ টাকা নিয়ে গ্রামে নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসা ভীষণ মুশকিল ও বিপদজনক।কলকাতা সহ অন্যান্য শহরের ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে ফুটপাতের হকারের কথা ভাবুন, অনেক মানুষের ঘর চালাবার সম্বল বোধহয় গুটিকয়েক পাঁচশো টাকার নোটেই রয়েছিল আর তাঁদের পক্ষে দুই দিন ঘরে বসে থেকে তৃতীয় দিন ব্যাঙ্কে বা পোস্ট অফিসে গিয়ে নিজেদের টাকার নোট বদলিয়ে তবে বাজার করে দু মুঠো চাল-ডাল নিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে কত কষ্ট আর বেদনা আছে তা কি নরেন্দ্র মোদী সাহেব তার বাংলো বাড়িতে বসে দেশের গরিব মানুষ কে দেশের স্বার্থে কষ্ট করার ভাষণ দিয়ে বুঝতে পারবে? মোদীর গিমিকের চক্করে হয়তো ওর সাবর্ণ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ভোটব্যাঙ্ক আনন্দে আপ্লুত হবে, হয়তো কর্পোরেট সংস্থাগুলো মিটিমিটি করে হাসবে তবে জনগণ কিন্তু একেবারেই খুশি হবেন না।

জনগণের এই দুর্ভোগের সময়ে একমাত্র রেহাইয়ের পথ হলো ব্যাঙ্কে গিয়ে পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বদল করা। আর নোট বদল করে এক লপ্তে শুধুমাত্র ₹৪০০০ অবধি পাওয়া যাবে আর এর ফলে গরিব মানুষের, যাঁরা নিজেরা বাড়িতে স্বল্প অর্থ সঞ্চয় করে রেখেছিলেন ভবিষ্যতের জন্যে বা যাঁদের সমস্ত মাসের খরচা তাঁদের শ্রমের বদলে পাওয়া মজুরির নগদ টাকায় চলে, তাঁদের পড়তে হবে প্রচন্ড অসুবিধায়। আর এই সুযোগে নেপোয় মারে দই করবে দেশী মুৎসুদ্দি পুঁজি ও বৃহৎ বিদেশী লগ্নি পুঁজির মালিকানাধীন সরকারি ব্যাঙ্কগুলো। কোটি কোটি লোকের ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলানোর মাধ্যমে এরা মালিক হয়ে উঠবে লক্ষ কোটি টাকার যা এরা কায়দা করে বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে ঋণ দেবে, যে ঋণের টাকা নির্দ্বিধায় সাফ করে বসে থাকবে আম্বানি আর আদানি গোষ্ঠী। এই কয়েক মাস আগেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত হয়েছিল যে প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার কোটি টাকার ঋণ সরকারি ব্যাঙ্কগুলো নিজেদের খাতায় বাজে ঋণ হিসেবে নথিভুক্ত করে মকুব করে দিয়েছে। এর লাভ বলা বাহুল্য বড় বড় কর্পোরেশন ও পুঁজিপতিরাই উঠিয়েছে কারণ সাধারণ কৃষকেরা ব্যাঙ্কের ঋণ আদায়কারীদের চাপে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। একদিকে যেমন এই গরিব মানুষদের টাকা জমা করে নিজেদের পুঁজির পাহাড় আরও উঁচু করবে এই ব্যাঙ্কগুলো ঠিক তেমনি আবার ছোট খাটো দালাল-ফোঁড়ে-অপরাধীদের কালো টাকা সাদা করার জন্যে বিপুল পরিমানের ঘুষের খেলাও চলবে আর নানা কায়দায় ব্যাঙ্কের বড় বড় কর্তারা সেই ঘুষের কালো টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠবে। পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল করার সাথে সাথে হঠাৎ আবার মোদী সরকার নতুন পাঁচশো টাকার নোটের সাথে সাথে একেবারে দুই হাজার টাকার নোট ছাপতে চলেছে যা কালো নগদ টাকা কে ভবিষ্যতে আরও সহজে রাখার বন্দোবস্ত করে দিল।  তাই মোদী সরকারের সিদ্ধান্তে যে বৃহৎ লগ্নি পুঁজির আর আমলাতন্ত্রের পোয়াবারো হয়েছে সে কথা আলাদা করে বলার দরকার হবে না।    
 

এত বীভৎস চিৎকার করে যে ভাবে মোদী সরকারের নোট খারিজ করার সিদ্ধান্ত কে কিছু ঘোড়েল সমর্থন করছে আর যে ভাবে ওদের যুক্তিহীন সমর্থন কে পুঁজি করে মোদী ভক্তকূল সমগ্র ইন্টারনেট ও সংবাদ মাধ্যমে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বলে যে মোদী সরকার ভারতবর্ষ থেকে কালো টাকা কে চিরতরে মুছে ফেলছে - তাতে মনে হচ্ছে যে আর কিছু হোক না হোক অন্য সমস্ত পদক্ষেপের মতন এই সরকারি সিদ্ধান্তটাও বৃহৎ আকারে বাজারজাত করবে আরএসএস ও তার গৌরী সেনেরা। ফলে যুক্তি ও তথ্যের চেয়ে উপরে স্থান পাবে প্রচন্ড আবেগ মাখানো, তেরেঙ্গায় মোড়া এই পলিটিক্যাল গিমিকটা, যা উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের আগে নিজের পোর্টফোলিও শক্তিশালী করার জন্যে খুব মাথা খাটিয়ে বিজেপি’র নেতারা বের করেছিল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে নরেন্দ্র মোদী যদিও ৮ নভেম্বর সন্ধ্যা আটটায় এই নোট বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত টিভিতে নানা ধরণের ভাঁট বকে জানান দিল, বিজেপির ছোট বড় নেতারা আর উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের টিকিটের  প্রত্যাশায় বসে থাকা আরএসএস কর্মীরা কিন্তু আধ ঘন্টার মধ্যে নিজেদের ফেসবুক ও টুইটারে মোদী সরকারের সিদ্ধান্ত কে সাধুবাদ দিয়ে পোস্ট দিল। এই পোস্টগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই গ্রাফিক্স সহ, যা মোটামুটি ফটোশপ বা ভেক্টর গ্রাফিক্স সফটওয়্যার ব্যবহার করে বানাতে গেলে ১ ঘণ্টা লেগেই যায়, যদি না সেই নেতার ব্যক্তিগত কোন কর্মী এই কাজের জন্যে ঠাঁয় দিয়ে বসে না থাকে। সোজা কথায় মানে দাঁড়াচ্ছে যে আরএসএস ও বিজেপির সকল স্তরের কর্মীদের কাছে এই খবর আগেই চলে এসেছিল, যার অর্থ দাঁড়ায় যে এই আরএসএস ও বিজেপির কর্মীদের ছাড়াও এদের অনেক ঘনিষ্ঠ লোকেদের পক্ষে সরকারের এই পদক্ষেপের ব্যাপারে জেনে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া অসম্ভব ছিল না। ঠিক যেমন অসম্ভব নয় কলকাতার  বড়বাজার ও তার আশেপাশে বসা বড় বড় মাড়োয়ারি বেনিয়াদের পক্ষে এই সময়ের মধ্যে কোটি কোটি টাকা জমি, বাড়ি, দোকান, শেয়ার, বন্ড, অথবা সোনার গয়নায় বদলে ফেলা। দু-চারটে স্টক ব্রোকারের অফিসে গেলে বা দুই একটা গদিতে গেলে আপনি দেখবেন কি ভাবে প্রতিদিন নিত্য নতুন কোম্পানি তৈরি হচ্ছে, কি ভাবে সেই কোম্পানির প্রায় দশ বছরের পুরানো এন্ট্রি তৈরি হচ্ছে আর কি ভাবে সন্ধ্যে বেলার মধ্যে সেই কোম্পানি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আর শেয়ারের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা হয়ে যাচ্ছে। ইনকাম ট্যাক্সের অফিসারদের সাথে এই মাড়োয়াড়িদের ওঠা বসা সেই ১৯৬০ এর দশকের থেকে। ইনকাম ট্যাক্সের অফিসাররা দুর্গাপূজার আগে ৫০ লক্ষ থেকে দুই কোটি টাকা অবধি ঘুষ নেয় এক একটা রেইড থেকে আর তার আগে ৪০-৫০ লক্ষের মধ্যেই আটকে থাকে অঙ্কটা। মে আর জুন মাসের থেকেই সমস্ত মাড়োয়ারি কারবারীদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ইনকাম ট্যাক্স অফিসারদের জন্যে মদ-মাংস আর মেয়েমানুষের জোগাড়ের। ইনকাম ট্যাক্স ছাড়াও সেবি, সেলস ট্যাক্স ও অন্য সমস্ত বিভাগেই টাকার উপঢৌকনের অঙ্কটা স্থির থাকে। টাকা পাঠাতে থাকলে আর কোন গন্ডগোল হয়না। তাই এই সব লোকেরা, যাদের সিংহভাগের সাথে বিজেপি-আরএসএসের শুধু যে সুদৃঢ় যোগাযোগ আছে তাই নয় বরং পশ্চিমবঙ্গে এরাই গেরুয়া বাহিনীর মূল পৃষ্টপোষক, যে এই খবর সময় থাকতে পায়নি বা পেয়ে নিজেদের সিংহ ভাগ নগদ টাকা নানা কায়দায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাদা করে নেয়নি সে কথা কে হলফ করে বলতে পারবে?   



নানা ভড়ং বাজি করে সরকার আজ মানুষের, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তদের টোপ দেওয়ার কাজে ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। কালো টাকা দমনের নামে পুরানো নোট বাতিল করে নতুন নোট চালু করার ঘটনা কিন্তু চাপা দিয়ে দিল কি ভাবে এবিভিপি’র নেতা ও কর্মীরা জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাজিব নামক ছাত্র কে গত মাসে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পরেও আজ অবধি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ দিল্লি পুলিশ তাঁকে খোঁজার কোন প্রচেষ্টা তো করেইনি বরং পুলিশ ও সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ করার দাবিতে আন্দোলনরত নাজিবের মা সহ জেএনইউ’র ছাত্র ছাত্রীদের উপর আক্রমণ করে তাঁদের গ্রেফতার করার ঘটনাকে। যে ঘটনা কে কেন্দ্র করে মোদী সরকারের নিন্দায় সরব হয়েছিলেন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। কালো টাকার নামে লোককে ঢপ দেওয়ার মোদীর এই চালে চাপা পড়ে গেল কি ভাবে এনডিটিভি কে একদিনের জন্যে নিষিদ্ধ করার প্রয়াস করে মোদী সরকার ও পরবর্তীকালে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক করতে সেই সিদ্ধান্ত কে স্থগিত করে বিজেপি ও আরএসএস।  পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিলের ঘোষণায় চাপা পড়ে গেল কি ভাবে দেশের শিল্প ও বাণিজ্যে সঙ্কটের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে সেই তথ্য, হারিয়ে গেল আলীগড় সহ উত্তরপ্রদেশের নানা প্রান্তে দাঙ্গা লাগিয়ে মানুষ মারার কাজে কি ভাবে এগিয়ে চলেছে সংঘ পরিবারের বানর সেনা সেই কাহিনী, আর চাপা পড়ে গেল কি ভাবে হিন্দুত্ব প্রীতিতে বাজি ফাটিয়ে সমগ্র দিল্লি শহর কে বিষাক্ত ধুঁয়ার কবলে ঠেলে দিয়েছিল উচ্চবিত্ত সাবর্ণ সমাজ। কালো টাকা উদ্ধারের এই ঢপের কীর্তন শুনে যদিও মোসাহেবের দল বাহবা দিচ্ছে তবুও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন মানুষেরা, গরিব ও খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণ, রাস্তায় ঘাটে ভিড়ে মিশে থাকা আমার আর আপনার মতন লোকেরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে এই সিদ্ধান্তে আপাতত গরিব মানুষের চরম ভোগান্তি বাদে,  কয়েকদিনের মজুরির ক্ষতি বাদে আর কিছুই নেই।  লোকে তবুও মোদী পূজা করবে কারণ মোদী ভারতবর্ষের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ১৬ কোটি সাবর্ণ উচ্চবিত্তদের কাছে চিরকালই একজন দেবতা হিসেবে চিহ্নিত হবে, যাকে প্রশ্ন করা যায়না, যার উদ্দেশ্য কে মন্দ বলা যায়না, যার কথা শুধু নাকি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয় ও সুবোধ বালকের ন্যায় তার গুণগান করে নিজেদের দেশভক্তির পরিচয় দিতে হয়। আজ কালো টাকা বহু সংবাদ কে ঢেকে দিল, গতকাল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক আর পাকিস্তান ঢেকে  দিয়েছিল আর আগামী কাল উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন ঢেকে দেবে অনেক অপ্রিয় সত্য কে। কিন্তু সত্যিই কি হাত দিয়ে সূর্যের আলো কে রোখা যায় ? বা শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় ?

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে