মোদী রাজত্বে ক্রোনি কর্পোরেট শাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ হোক বিকল্প গণমাধ্যম

বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ০৫, ২০১৭ 0 Comments A+ a-

নরেন্দ্র মোদী ও গৌতম আদানি ক্রোনি পুঁজিবাদ


বেশ কিছুদিন ধরে  ভারতের হিন্দি ও ইংরাজী ভাষার টিভি চ্যানেলগুলো ও পত্রপত্রিকাগুলো বেশ ঘটা করে গুরমিত রাম রহিম ইনসান নামক ভন্ড বাবাজির তথাকথিত পালিতা কন্যা এবং আদতে গুপ্ত গার্লফ্রেন্ড হানিপ্রীত ইনসান কে নিয়ে ভীষণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী সংবাদ মাধ্যম হয় শারদোৎসব আর না হয় মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচারে ব্যস্ত। কেউ নরেন্দ্র মোদী কে মেপে মেপে সমালোচনা করছে তো কেউ বলছে নরেন্দ্র মোদীর উচিত আরও জোরে তাঁর তথাকথিত সংস্কারের রথ চালানো।
এরই মধ্যে  একটা ভীষণ চাঞ্চল্যজনক ঘটনা ঘটে গেল, যার নৈপথ্যে কিন্তু আবার একটি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় পুঁজির মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যম। অস্ট্রেলিয়ার সরকারি মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যম এবিসি’র ফোর্থ কর্নার অনুষ্ঠানে সম্প্রতি প্রসারিত হলো একটি অনবদ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দ্বারা উত্তোলিত তথ্যে পরিপূর্ণ তথ্যচিত্র, যাঁর মূল বিষয় ছিল ভারতের বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি গৌতম আদানি’র দুর্নীতিপূর্ণ ব্যবসা এবং আদানি গোষ্ঠীর দ্বারা দেশে বিদেশে কালো টাকার চোরাকারবার। উল্লেখনীয় ব্যাপার হলো যে নরেন্দ্র মোদী, তাঁর পার্টি বিজেপি ও তার ভাবাদর্শের উৎস, আরএসএস, কিন্তু আদানি গোষ্ঠীর নিমক খেয়ে তার সেবা করে এবং সমস্ত রকম প্রচলিত আইনের হাত থেকে আদানি গোষ্ঠী’র স্বার্থ কে রক্ষা করে। এহেন মোদী-শাসিত ভারতবর্ষের বুকে আদানি গোষ্ঠীর সমালোচনা করা বা নিন্দা করা বেসরকারি ভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। হঠাৎ সমালোচক কে দিনের আলোয় আততায়ীর হাতে গুলি খেতে হতে পারে বা হঠাৎ আদানির উকিল কোটি কোটি টাকার মানহানির মামলা করার ভয় দেখিয়ে চিঠি পাঠাতে পারে সমালোচনাকারী সংবাদ মাধ্যমের দফতরে। ঠিক যেমন প্রখ্যাত পত্রিকা ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলি কে ধমকানো হয়, যার ফলে চাকরি হারান আদানি গোষ্ঠীর নানা দুর্নীতির তদন্তকারী ও কট্টর সমালোচক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা। এবিসি ভারতে অবস্থিত নয় এবং ভারতের থেকে তাঁদের আয় প্রায় নগন্য ফলে তাঁদের পক্ষে যে ভাবে সাহসিকতার সাথে গৌতম আদানি ও তাঁর আপাদমস্তক দুর্নীতি ও কালো কারবারে ডুবে থাকা আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত করে একটি দুর্দান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা সম্ভব হলো, আদানির বিজ্ঞাপনের থেকে টাকা আয় করা এবং গৌতম আদানির জুতো চাটা দেশি দালাল সংবাদ মাধ্যমগুলোর সেই সাধ্য হতো না।

আদানি গোষ্ঠীর উৎপত্তি গৌতম আদানি ও তাঁর সিঙ্গাপুর স্থিত ভাইয়ের হাত ধরে। আম্বানি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানির মতনই গৌতম আদানি নিরামিষাশী এক গুজরাটি বেনিয়া, যাঁর উত্থান শুরু হয় গুজরাটে বিজেপি শাসন শুরুর সাথে সাথে। কলেজ-ছুট এক বেনিয়া গুজরাটি তাঁর শেষ সম্বল দিয়ে ফাটকা খেলা শুরু করে হিরের ব্যবসায় ও পরবর্তী কালে নয়া-উদার অর্থনৈতিক হাওয়ায় ভেসে প্রবেশ করে গুজরাটের ক্রোনি পুঁজিবাদের শিবিরে। ক্রোনি পুঁজিবাদ আসলে মুৎসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের দেশ ভারতের একটি বহুল প্রচলিত ব্যবস্থা যার মূল হলো শাসক রাজনৈতিক দলগুলি ও প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র কে পকেটস্থ করে নিজের ব্যবসা কে প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি লাভজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা। গৌতম আদানির বন্দর, তাপ বিদ্যুৎ, খনিজ সম্পদ উত্তোলন, বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবসাগুলো বিগত দুই দশকে তীব্র গতিতে বেড়ে দেশের প্রথম সারিতে চলে আসে দুইটি প্রধান কারণে। প্রথমতঃ গৌতম আদানি ঘুষ দিতে কার্পণ্য করেনি আর দ্বিতীয়তঃ নরেন্দ্র মোদী’র মতন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর অকৃত্রিম অনুচর ও তল্পিবাহক হয়ে ওঠে। মোদীর শাসনকালে, গৌতম আদানির ব্যবসা যেমন ফুলে ফেঁপে ওঠে, তেমনি সমস্ত রকমের আইন কে জুতোয় পিষে সমগ্র গুজরাটে বিশাল আয়তনের জমি দখল করা আদানির পক্ষে জলভাত হয়ে যায়। আদানি গোষ্ঠী যত না তাঁদের বাণিজ্যের দ্বারা অর্থ আয় করেছে তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি করেছে দেশের কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করে। দেশের যে দালাল সংবাদ মাধ্যমগুলো নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা ৫০০ ও ১,০০০ টাকার নোট বাতিলের স্বিদ্ধান্তে “কালো টাকা ধ্বংস হলো” বলে বিশ্রী রবে শিয়াল-চিৎকার জুড়েছিল তাদের কেউই কিন্তু আদানির দ্বারা কর ফাঁকি দিয়ে কেইম্যান আইল্যান্ড বা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড এর মতন কর-হীন দেশে নিজেদের জাল কোম্পানির একাউন্টে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা নিয়ে কিন্তু টু শব্দটি করেনি।

ভারতের মতন দেশে গৌতম আদানির আদানি গোষ্ঠী বা ধীরুভাই আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠী (এখন দুই ভাগে বিভক্ত) ইত্যাদির পক্ষে বৃহৎ পুঁজির কারবারি হয়ে ওঠার পিছনে লুকিয়ে থাকে চূড়ান্ত দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর (সকল রঙের) চরম কর্পোরেট দালালি। শুধু মোটা অঙ্কের ঘুষ রাজনৈতিক পার্টিগুলিকে ও আমলাতন্ত্র কে দিয়ে এই ক্রোনি পুঁজিবাদীরা শুধু যে নিজেদের জন্যে সমস্ত আইন শিথিল করিয়ে ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধি এনেছে তাই নয়, এদের বিরামহীন ব্যবসায়িক অভিযানে, বড় তাপ বিদ্যুৎ, পেট্রো-কেমিকেল বা বন্দরের ব্যবসায় দেশের পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও জনগণের, গরিব খেটে খাওয়া জনগণের ব্যাপক আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ঘুষে কুকুর কেও বাপ বলায়। তাই হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েও আদানি গোষ্ঠী ভারতে কলার তুলে ব্যবসা করতে পারে কারণ আরএসএস ও সমগ্র হিন্দুত্ব শিবির এই নিরামিষাশী গুজরাটি মুৎসুদ্দি বেনিয়ার স্বার্থ কে রক্ষা করার পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে। আজ যে গুজরাটের ভুঁয়ো উন্নয়নের ছেলে ভোলানো গল্প শুনিয়ে নরেন্দ্র মোদী কে হিরো সাজানোর চেষ্টা চালায় ভারতের কর্পোরেট টাকায় চলা মূলধারার সংবাদ মাধ্যম, সেই গুজরাটের সিংহভাগ বন্দর ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কিন্তু আদানির, আর আদানি টাকা তুলেছে শেয়ার মার্কেট থেকে, সেই শেয়ার মার্কেটে টাকা এসেছে বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির পুতুল লগ্নিকারী বা এফআইআই’র মাধ্যমে এবং এই সকল প্রকল্পগুলো গড়ে উঠেছে পরিবেশ কে ধ্বংস করে এবং গরিব জনগণের জীবন ও জীবিকা কে লাথি মেরে। এক একটা জায়গায় আদানি গোষ্ঠী ব্যবসা করার ফলে সৃষ্ট হয়েছে অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক সঙ্কট। এবিসির অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা গেল যে কি ভাবে বিজেপি’র সমর্থনে বলীয়ান হয়ে সমস্ত রকমের পরিবেশ সম্পর্কিত আইন কে কাঁচকলা দেখিয়ে এবং বিভিন্ন ধরণের সামাজিক প্রতিরক্ষার আইন উল্লঙ্ঘন করে গৌতম আদানি তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। দেখা গেল গোয়ার ভাস্কো দা গামায় কয়লা উত্তোলনের নামে কি ভাবে পরিবেশ ও জনসাধারণের ক্ষতি করেছে আদানি গোষ্ঠী, দেখা গেলো কর্ণাটকে কি ভাবে লাভের টাকা চুষে নিয়ে একটি এলাকার পরিবেশ ও অর্থনীতি কে বিশ বাঁও পানিতে ফেলে উধাও হয়ে গেল আদানি গোষ্ঠী, দেখানো হলো কি ভাবে গৌতম আদানির পাহারাদার সেজে ক্রাইম ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসাররা নেড়ির মতন তেড়ে এলো অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকদের গুজরাট থেকে তাড়িয়ে দিতে, রীতিমত খুনের হুমকি দিয়ে। যে রাজ্যের প্রাক্তন গৃহমন্ত্রী দলীয় কোন্দলে খুন হয়ে যান আর অন্য এক প্রাক্তন গৃহমন্ত্রী একের পর এক ভুঁয়ো এনকাউন্টারে মুসলমানদের নিজ স্বার্থে ও বিজেপিকে ভোটে জেতানোর স্বার্থে খুন করিয়েও আইন কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহাল তবিয়তে দেশের শাসক দলের প্রধান হয়ে জনগণের করের টাকায় সরকারি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করে, সেই রাজ্যে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের লোকেদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যে আদানি কে বাঁচাতে হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তা বলার জন্যে বিশেষ কোন গবেষণা করার দরকার পরে না। সাহেবের রাজ্যে আদানি’র সাম্রাজ্য অক্ষত রাখতে সদা প্রস্তুত হিন্দুত্ববাদী শিবির ও তার রাষ্ট্র যন্ত্র।

অস্ট্রেলিয়া থেকে এবিসি হঠাৎ এমনি এমনি আদানি গোষ্ঠীর কালো ইতিহাস কে খুঁড়ে বের করতে আসেনি, বরং অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সমস্ত বড় রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় পুঁজিপতিদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে গৌতম আদানি যে বৃহৎ এলাকা জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় কয়লা খনি গড়ে কয়লা উত্তোলন করতে চায় এবং সমস্ত অঞ্চলের ভূ গর্ভস্থ পানি চুষে এলাকাটি কে মানুষ, পশু পাখির বাসের অযোগ্য মরুভূমিতে পরিণত করতে চায় তার বিরুদ্ধে সমগ্র অস্ট্রেলিয়া জুড়ে গড়ে উঠেছে তীব্র গণআন্দোলন এবং সেই আন্দোলনের চাপে পড়ে (মনে রাখতে হবে অস্ট্রেলিয়া সাদা চামড়ার মানুষের দেশ, কালো চামড়ার মানুষের নয়) বড় বড় ব্যাঙ্কগুলি আদানির প্রকল্পে অর্থ লগ্নি করার থেকে পিছু হঠে এবং এর ফলে অস্ট্রেলিয়া’র আদানি দালাল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভীষণ মুশকিলে পড়ে। কারণ তাঁরা এর মধ্যেই কোটি কোটি ডলার উপঢৌকন পেয়েছে গৌতম আদানির থেকে, সেই জন্যে তাঁরা খনন কার্য শুরু হলে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে বলে জনগণের করের টাকা দিয়ে আদানির জন্যে পরিকাঠামো বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে, এটা জেনেও যে তাঁদের এই কর্মকান্ডে অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশ ও জনগণের জীবন ও জীবিকার অভূতপূর্ব ও অপূরণীয় ক্ষতি হবে। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ওয়ানগান ও জাগলিংও জনগণ এই খনির বিরুদ্ধে তাঁদের মত দিয়েছেন এবং জমি দিতে অস্বীকার করেছেন, তবে আদানির থেকে কোটি কোটি ডলার ঘুষ খাওয়া রাজনৈতিক নেতারা সেই জমি কেড়ে নিতে আজ বদ্ধপরিকর। #Stop Adani নামক এই সংগ্রামের সাথী হয়ে জনগণের শত্রু আদানি গোষ্ঠীর স্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপক মানুষের সামনে তুলে ধরতে এবিসি কর্পোরেশনের মতন রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে চলা সংবাদ সংস্থা আদানির বিরুদ্ধে কোমর কষে নেমেছে এবং এক তথ্যসম্পূর্ণ রিপোর্ট জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। রাষ্ট্রীয় পুঁজিতে চলা এই সংবাদ মাধ্যমের এই সমালোচনামূলক রিপোর্টিং সম্ভব হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার শাসক শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্ধের কারণেই। এক মিনিটের জন্যে ভাবুন পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ ধ্বংসকারী ভাঙ্গর প্রকল্প, কৃষি-বিরোধী ন্যানো কারখানা বা নন্দীগ্রামের অদূরে সালেম গোষ্ঠীর প্রকল্পের বিরুদ্ধে কি আনন্দবাজার গোষ্ঠী (যারা একদিকে মোদী বিরোধিতার সুর চড়ায় আনন্দবাজার পত্রিকা বা দি টেলিগ্রাফে আর অন্যদিকে কাঞ্চন গুপ্ত বা জয়ন্ত ঘোষালের মতন হিন্দুত্বের ধ্বজ্জাধারী ইজরায়েলি দালালদের চাকরিতে রাখে) কোনদিন মুখ খুলতে পারতো? আরে আনন্দবাজার বা অন্য বাজারি কাগজ তো দূরের কথা আমাদের সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তির ২০০৭-০৮ এর সংখ্যাগুলো যদি পড়েন তাহলে দেখবেন মনে হবে টাটা বা সালেমের মুখপত্র পড়ছেন। শুধু বিজেপির বিরুদ্ধে কামান দেগে তেমন লাভ হবে না, কারণ বিজেপি বর্তমানে যা করছে তার পিছনে যদি সিপিএম বা কংগ্রেসের মতন দলগুলোর সুপ্ত সমর্থন না থাকতো তাহলে ভারতবর্ষ কর্পোরেট লুঠের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতে পারতো না। ভারতের রাজনীতি ও সংবাদ মাধ্যমের দুনিয়ার তাবড় সব খেলোয়াড় বর্তমানে আদানি আর আম্বানিদের হয়ে খেপ খেলছে এবং তাই আপনি এদের আক্রমণের নিশানায় কখনো কর্পোরেট পুঁজি কে পড়তে দেখবেন না, বরং এদের কাছে শুনবেন আদানি বা আম্বানিদের স্তুতি, তাঁদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি  (সিএসআর) প্রকল্পগুলি কি ভাবে সমাজের উন্নয়ন (বা সমাজের উন্নয়নের নামে কর ফাঁকি দেওয়ার ভাঁওতাবাজি) করছে, তার ফিরিস্তি। স্বাধীন দেশের বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যম ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশের বুর্জোয়া সংবাদ মাধ্যমের মধ্যে এই হলো ফারাক।

ভারতের সমস্যার দুটো বড় দিক হলো, এক, এই দেশে কখনো পুঁজিবাদী বিপ্লব সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসন কে উৎখাত করেনি, এবং দুই, এই দেশের বৃহৎ পুঁজির মালিকদের কেউই জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি নন, বরং মুৎসুদ্দি বেনিয়া সম্প্রদায়ের লোক যাঁরা বিদেশী পুঁজির কাছে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা রেখেছে নিজেদের, কখনো পুঁজির জন্যে তো কখনো প্রযুক্তির জন্যে। বিদেশী পুঁজি কে পরাস্ত করে নিজের শক্তিতে একটি শক্তিশালী বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তি হয়ে ওঠার কোন প্রবণতা ভারতের পুঁজিপতিরা দেখায়নি, বরং উদার অর্থনীতির সাহায্যে, বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ও বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক লগ্নিকারীদের অর্থে বলীয়ান হয়ে নিজেদের কর্পোরেট সংস্থাগুলোর বিদেশে সম্প্রসারণ ঘটানো শুরু করে টাটা-আম্বানি-আদানি জাতীয় সকল মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিকেরা। এরা চরম ভাবে বিদেশী পুঁজির দালাল এবং এরা কোন ভাবেই বিশ্বের কোথাও নিজেদের অস্তিত্ব বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির সাহায্য বাদে টিকিয়ে রাখতে পারবে না, এবং মূলত বেনিয়া পুঁজির মালিক এই সংস্থাগুলো ভারতকে শিল্পে স্বনির্ভর করে তুলতে চিরকালই অপারগ থাকবে। ভারতের এই বৃহৎ মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিকদের ঢাল করে বৃহৎ বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির মালিকেরা প্রায় দেশের সকল ক্ষেত্রে বিপুল পরিমানের অর্থ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লগ্নি করেছে এবং কোটি কোটি ডলার প্রতিদিন দেশের মাটির থেকে শুষে নিংড়ে নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। আদানি আর আম্বানির মতন দালাল পুঁজির মালিকেরা নিজেদের কমিশন কামিয়ে অট্টালিকা বানিয়ে নিজেদের ধন বৃদ্ধি জাহির করছে এবং রাষ্ট্র যন্ত্রের একটি সামান্য আলপিন থেকে সিংহাসনে আসীন মহারাজ কে কিনে পকেটে ভরে রেখেছে। যেহেতু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল থেকে ভারতের সংবাদ মাধ্যমের উপর একচেটিয়া মালিকানা কায়েম করেছে এই মুৎসুদ্দি বেনিয়া পুঁজিপতিরা এবং যেহেতু এদের পুঁজি ও রাষ্ট্রের সাথে দহরম মহরমের ফলে এরা ছোট এবং মাঝারি সংবাদ মাধ্যমগুলো কে গ্রাস করে ফেলে, তাই এই দেশে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতার লেশমাত্র উপস্থিত, এই কল্পনা করাও ঘোর অন্যায় হবে। বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজি আজ আম্বানি বা আদানিদের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে ভারতের শ্রম, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুঠ করছে এবং তার সাথে সাথে এই দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের একটা বড় অংশ কে কিনে নিয়ে নিজেদের কর্মকান্ড কে সাধুবাদ দিয়ে জনগণ কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই আম্বানি-আদানিরা আবার বিশাল টাকা দিয়ে, ব্যক্তিগত বিমান দিয়ে, জমি আর শেয়ার দিয়ে নরেন্দ্র মোদী ও আরএসএস এর মতন ঘৃণ্য হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের নিজেদের দারোয়ান হিসেবে পুষছে, তাদের দিয়ে দেশের কোনায় কোনায় জনগণের ঐক্য ভাঙতে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার আগুন জ্বালাচ্ছে।  এই চরম ঘৃণ্য ব্যবস্থার স্বরূপটি জনগণের চোখের সামনে তুলে ধরতে আমাদের দেশের তথাকথিত স্বাধীন মিডিয়া অপারগ, কারণ বিজ্ঞাপনের বড় বালাই। তাই তারা মেতে আছে হানিপ্রীত সিংহে ও যৌবন ধরে রাখার টিপস দেওয়ায়।  

এখন আর খবরের উপর ভিত্তি করে সংবাদপত্র বিক্রি হয় না, বরং কাগজ ছাপার খরচ থেকে লাভের টাকা সবটাই আসে শুধু মাত্র বিজ্ঞাপন থেকে অর্জিত অর্থ থেকে। সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলগুলো এখন শুধু বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে এবং তার সাথে বিজ্ঞাপনদাতার স্বার্থ বিঘ্নিত হয়না এমন নিরীহ কাঁচি চালানো খবর বিনামূল্যে পাঠক বা দর্শকদের কাছে পরিবেশিত করে। তাই এই মূলধারার কর্পোরেট-মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমগুলি ভারতের মানুষের কোন কল্যাণে আর আসতে পারবে না, ফলে আজ জনগণের কাছে সত্য সংবাদ ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ তুলে ধরতে পারে শুধু মাত্র গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বিকল্প সংবাদ মাধ্যমগুলি, যেগুলি জনগণের চাঁদার টাকায় বা ছোট ব্যবসায়ীদের বিজ্ঞাপনের টাকায় নিজেদের প্রকাশনা চালায়। বিকল্প গণমাধ্যমআজ ভারতের দরকার, এই কঠিন পরিস্থিতিতে জনগণের একটি বিশেষ প্রয়োজন। শুধু আদানির মতন দেশের অর্থ বিদেশে পাচারকারী মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের বিরুদ্ধেই নয়, বরং সামগ্রিক ভাবে ভারতের সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদের ঘৃণ্য শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং বিদেশী একচেটিয়া ও লগ্নি পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের অংশীদার হিসেবে আজ বিকল্প মিডিয়ার প্রয়োজন প্রচন্ড। সকল ধরণের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল জনগণ কে ঐক্যবদ্ধ করে, বিদেশী পুঁজি ও দেশি মুৎসুদ্দি পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক বিরাট দেশপ্রেমী প্রচার মাধ্যম গড়ে তোলার জন্যে আজ সমস্ত ফ্যাসিবিরোধী ও গণতান্ত্রিক সাংবাদিকদের আজ একসাথে আসতে হবে, শুধু পয়সা রোজগারের আকঙ্ক্ষা থেকে নয়, বরং দেশের জনগণের সামনে দেশের আসল শত্রু, আদানি-আম্বানি-টাটা ইত্যাদির, মোদী আর আরএসএস এর মুখোশ খুলে দেওয়ার জন্যে। আজ সময় হয়েছে আমাদের কলমগুলিকে তলোয়ারের ন্যায় ব্যবহার করার, মূলধারার কর্পোরেট-মালিকানাধীন সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বিকল্প গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার এবং এই সংগ্রামে আমরা যদি পিছিয়ে পড়ি, তাহলে ইতিহাস আমাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না।
 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে