উত্তর প্রদেশের বিজয়ে উৎফুল্ল বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে থাবা মারার প্রচেষ্টায় রত - এখন সময় রুখে দাঁড়ানোর
উত্তর প্রদেশে গৈরিক ঝড় দেখে, মোদী ভক্তদের উল্লাস দেখে আমাদের রাজ্যে দুই ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একদিকে দিলীপ ঘোষ - তপন ঘোষের বাছুর সেনার দল উল্লাস করছে, বুক বাজিয়ে বলছে আগামী বার রাজ্যে মমতার সরকার কে ছুড়ে ফেলে, বামপন্থীদের কবর দিয়ে গেরুয়া ঝান্ডা ওড়ানো হবেই, আর অন্যদিকে সরকারি বাম আর তথাকথিত উদারনৈতিক রাজনীতিবিদেরা, আঁতেলরা, সমাজ-গণতন্ত্রীরা আতঙ্কিত হচ্ছেন যে এবার কি হবে? কি করে ঠেকানো সম্ভব নরেন্দ্র মোদীর এই অশ্বমেধের পাগলা ঘোড়া কে, যার উৎপাতে গ্রাম থেকে শহর উজাড় হতে চলেছে রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায়?
আজ থেকে পাঁচ-দশ বছর আগেও বলা যেত যে উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক উথ্বান পতনের সাথে পশ্চিমবঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই, বা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি গো-বলয়ে চললেও পশ্চিমবঙ্গের মতন তথা কথিত প্রগতিশীল আর বাম আন্দোলনের ঘাঁটিতে কাজ করবে না। হয়তো ২০০০ সাল নাগাদ যোগী আদিত্যনাথ কে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে দেখলে বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ, সবজান্তা আঁতেলরা বলতেন যে উত্তর প্রদেশের জনগণের চেতনা প্রচন্ড নিম্নস্তরের আর ঢুকে যেতেন সেই আলোচনায় যে কেন বাংলা ভারত তথা বিশ্বশ্রেষ্ঠ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায়।
কিন্তু সালটা ২০১৭ আর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহাওয়া কে বিষাক্ত করে তোলা হয়েছে সুচারু ভাবে এক গূঢ় অভিসন্ধি কে কার্যকর করার জন্যে। আজ বাংলার গ্রামে গঞ্জে, মফঃস্বলে বার বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বালিয়ে তুলছে বিজেপি, আরএসএস ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থী সংগঠনগুলি। আর এই সংগঠনগুলোকে পশ্চিমবঙ্গে খাল কেটে কুমির আনার মতন প্রবেশ পথ গড়ে দিয়েছে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূল সরকার। ২০০৮ সাল থেকে সিপিএমের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়ে নিজের দিকে টেনে আনার জন্যে মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেস শুরু করে নগ্ন মৌলবাদী তোষণ। সরকারে এসেই তৃণমূল কংগ্রেস চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ মুসলমান মোল্লা - হুজুরদের হাত করে সাধারণ খেটে খাওয়া মুসলমানদের উপর নিজেদের প্রতিপত্তি স্থাপন করার রাস্তা খুঁজতে থাকে।
তৃণমূল কংগ্রেসের নিম্ন ও মাঝারি স্তরের বহু নেতা ও কর্মীরা বিজেপি ও আরএসএস এর সাথে গোপনে গোপনে তালমিল করে চলছে এবং দিনে তৃণমূলের মিছিলে মিটিঙে হেঁটে তাঁরা একদিকে রংবাজি করছে এলাকায় এলাকায় আর অন্যদিকে রাতের আঁধারে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড়ালে দাঙ্গার আগুন ছড়ানো আরএসএস, হিন্দু সংহতি ও বজরং দলের ঝান্ডা নিয়ে এই নেতা কর্মীরাই এলাকায় এলাকায় মুসলমান বিরোধী বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর সাবর্ণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের সাথে সাথে দলিত ও পশ্চাৎপদ জাতির গরিব শ্রমিক ও কৃষকদের কে ক্ষেপিয়ে তুলে নিজেদের লুম্পেন বাহিনীতে ভর্তি করছে। আর এই সকল ষড়যন্ত্র কে দেখেও না দেখার ভান করে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার বহাল তবিয়তে বিড়াল তপস্বী সেজে বসে নেহরুর আমলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ন্যাকা কান্না কাঁদছে।
যে বামফ্রন্ট এককালে মিছিল মিটিং করে সাম্প্রদায়িক শক্তির কালো হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার গর্জন করতো, সেই নন্দীগ্রামের কৃষক হত্যাকারীরা আজ রাজ্য জুড়ে জ্বলে ওঠা সাম্প্রদায়িক আগুনের তাপে নিজেদের হাত সেঁকে নিচ্ছে আর তলে তলে বিজেপির সাথে বিরোধী ঐক্য বজায় রাখছে কারণ ভোট আর জোট দুইয়ের বড় বালাই আর শিলিগুড়ি লাইন যেহেতু এদের কাছে নীতি নির্ধারক তাত্বিক ভিত্তি। এহেন সরকারি বামেদের যে মানুষে আর পোছে না তার অন্যতম কারণ হলো লড়াই করে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তি কে হারানোর ক্ষেত্রে এদের ব্যর্থতা। ভোটের বালাই বামফ্রন্ট কে বিজেপির সাথে বারবার এক করেছে রাজ্য রাজনীতির সমীকরণে আর এখন দুই দলের মধ্যে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে উঠেছে। আর এই প্রতিযোগিতার ময়দানে বুড়ো ঘোড়া সিপিএমের উপর কেউই আর বাজি রাখার সাহস পাচ্ছে না।
উত্তর প্রদেশে বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের কাজ শুরু করে ২০১২ সালের আগস্ট মাসের আসে পাশে, সেই সময়ে আলীগড় সহ বেশ কিছু শহরে দাঙ্গার আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করে আরএসএস এর লোকেরা আর প্রচেষ্টা তীব্র হয় ২০১৩ তে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী হয়ে উঠে আসার পর থেকেই। রিলায়েন্স, টাটা, আদানি, বেদান্ত, পস্কো, ইত্যাদী দেশি মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিদের টাকায় আর বিদেশী কর্পোরেশনগুলোর উদার হস্তে করা দানে বলীয়ান হয়ে নরেন্দ্র মোদী যখন দেশের মাটিতে উচ্চ জাতির হিন্দুদের সাথে পশ্চাৎপদ জাতির আর দলিতদের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ছাতার তলায় মেরুকরণের মাধ্যমে একত্রিত করার জন্যে তীব্র মুসলমান বিদ্বেষী প্রচার শুরু করে ঠিক সেই সময়ে ২০১৩ সালের আগস্ট - সেপ্টেম্বর মাসে জ্বলে ওঠে মুজ্জাফারনগরের মুসলমান বিরোধী সরকারি মদতপুষ্ট দাঙ্গার আগুন। অসংখ্য হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ, ও রাহাজানি সয়ে মুজ্জাফারনগরের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের গরিব কৃষিজীবি ও নিম্নবিত্ত মুসলমানেরা পালিয়ে আসেন শরণার্থী শিবিরে, যেখানে তাঁদের জন্যে অপেক্ষা করছিল এক দুর্বিষহ জীবন।
সেইদিন কিন্তু মুসলিম দরদী সাজা অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বে চলা সমাজবাদী পার্টির সরকার কিন্তু আরএসএস ও বজরং দলের দাঙ্গাবাজদের রুখতে এবং সংখ্যালঘু মানুষের প্রাণ ও সম্পত্তি বাঁচাতে কোন পদক্ষেপ নেয়নি, সংগীত সোম ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী বদমাশদের ধরে গারদে পোরেনি বরং অসহায় মুসলমানদের পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিল বিজেপি কে গোপনে সাহায্য করতে।তীব্র মেরুকরণের খেলায় মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে গ্রামে-গঞ্জে দাঙ্গা বাঁধাবার কাজটা ভীষণ সুচারু ভাবে করে সমাজবাদী পার্টি এবং ঠিক ভোটের আগে তাঁরা ডুবন্ত আর দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়ে বিজেপির জন্যে আরও সুবিধা করে দিয়েছিল।
অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের প্রধান বিরোধী দল বহুজন সমাজ পার্টি কিন্তু তলে তলে বিজেপি কে প্রধান বিরোধী দলের স্থানটা ছেড়ে দিতে কোন কসুর করেনি। মায়াবতীর সেই পুরানো ঘি’র গন্ধ শুঁকিয়ে দলিত ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারেনি ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত। সমগ্র উত্তর প্রদেশ জুড়ে যখন হিন্দুত্ববাদীরা ফণা তুলে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখন নিজের অহঙ্কার আর দর্পের প্রাসাদ থেকে নিচে নেমে তৃণমূল স্তরে গিয়ে গরিব দলিত ও শোষিত মানুষের কথা শোনেনি মায়াবতী, বরং রাজ্য জুড়ে বেড়ে চলা দলিত ও মুসলমানদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ণের সময়ে মায়াবতী ও তার দল অন্য্ কারুর লিখে দেওয়া বিবৃতি পড়া ছাড়া কোন ভাবেই মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি।
যদিও মায়াবতীর দলিত ও মুসলমান ভোট কে এক জায়গায় করার রণনীতি হিন্দুত্ববাদী শক্তির পক্ষে এক মোক্ষম চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারতো, কিন্তু সেই সমীকরণে নিজের বস্তাপঁচা সামাজিক-ইঞ্জিনিয়ারিং এর তত্ব অনুসারে উচ্চ জাতির হিন্দুদের, ব্রাক্ষণদের সামিল করে এবং বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি ঘৃণার বিষ ঢেলে দিয়ে মায়াবতী তাঁর নিজের এবং বিএসপির কবর খুঁড়ে দিলেন। আর তাই গৈরিক ঝড়ের সামনে যেমন করে হাতি আর হাতির পিঠে চাপা স্বঘোষিত দলিত নেত্রী ২০১৪ সালে ভেসে গেছিল, ২০১৭ তে সেই ভাবে না হলেও অনেক বিশ্রী ভাবে তাঁর দল কে হারতে হয় এবং উত্তর প্রদেশের তিন নম্বর দল হতে হয়।
মোদী ঝড়ের নাম দিয়ে কর্পোরেট সংস্থার টাকা, জোতদার-জমিদার ও গুন্ডাদের বন্দুক, ও হিন্দুত্ববাদী ঠগদের দাঙ্গা-হিংসা কে পুঁজি করে যেভাবে বিজেপি নিজেকে ইন্দিরা কংগ্রেসের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে এবং উত্তর প্রদেশে নিজের ভোট ব্যাঙ্ক কে মাত্র দুই শতাংশ কমতে দিয়েছে তিন বছরে, তাতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে উত্তর প্রদেশের মডেল এবার ওরা রাজ্যে রাজ্যে প্রয়োগ করবে, বিশেষ করে সেই সব রাজ্যে যেখানে বিজেপির কোনদিন কোন অস্তিত্ব ছিল না। আর এই মিশনে বিজেপির পাখির চোখ এখন পশ্চিমবঙ্গ, অমিত শাহ নির্বাচনের ফলাফলে উৎফুল্ল হয়ে শাসক শ্রেণীর খাস সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার কে জানিয়েছে যে এবার কর্পোরেট সংস্থার দেওয়া কোটি কোটি টাকায় বলীয়ান বিজেপি প্রতিটি পঞ্চায়েতের একেবারে বুথ স্তরে আরএসএস এর সাহায্যে নিজের সংগঠন গড়ে তুলতে চাইছে। ২০২১ এর মধ্যে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের জায়গাটা বিজেপি করায়ত্ত করতে চাইছে, যা আজ বিপদ কে বাড়ির উঠোনে এনে ফেলেছে।
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছিল মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের কাঁধে চেপে আর সেই নব্বইয়ের দশকের শেষে বামফ্রন্ট সরকারও হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে, গো-বলয়ের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ও জাতি বিদ্বেষী রাজনীতির বিরুদ্ধে কোন লড়াই গড়ে তুলতে চায়নি, কারণ ওদেরও লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে বিজেপি ভীতির সুযোগ নিয়ে নিজের ভোট ব্যাঙ্ক কে কেন্দ্রীভূত করা। আর আজ মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজের “ধর্ম নিরপেক্ষ” ইমেজ রক্ষার নামে সর্ব ধর্ম সমন্বয় করার এক উদ্ভট কংগ্রেসী লাইনে চলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের, বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।
মমতা বন্দোপাধ্যায়ের মূল শত্রু হলো বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তি এবং সিপিএম কে যেহেতু বাজারি সংবাদ মাধ্যমগুলো ভারতীয় কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলনের একমাত্র সুযোগ্য প্রতিনিধি মনে করে, তাই সিপিএমের পরাজয় এই সব সংবাদ মাধ্যমগুলো ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত করে উল্লাস করে। মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রতি পদে সিপিএম কে পরাস্ত করে বাজারি সংবাদ মাধ্যমগুলো কে কমিউনিস্ট নিঃশেষ হওয়ার উল্লাস করার সুযোগ করে দেয় এবং দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া সিপিএম তথা বামফ্রন্ট মমতা বন্দোপাধ্যায়’ কে দেশের কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে। এই লক্ষ্যে মমতা বন্দোপাধ্যায় সিপিএম কে রাজ্য থেকে মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছে এবং ভাঙাচোরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কে নিখিল ভারত তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধী হিসেবে খাড়া করেছে।
বিজেপির সাথে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সখ্যতা আজও বজায় আছে এবং এই ব্লগে এর আগেও এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি মনিপুরে বিজেপির সরকার কে তৃণমূলের সমর্থন দেওয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে যে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা শুধু বাংলার মাটিতেই, অন্য্ রাজ্যে বিজেপির সাথে সরকারের দোলনায় দোল খেতে মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু যেহেতু মমতা কে নিজের সেই ধর্ম নিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে নিজের ব্রাক্ষণত্ববাদী ও মুসলমান-খ্রীস্টান-দলিত-আদিবাসী বিদ্বেষী চরিত্র কে লুকিয়ে রাখতে হয় তাই হঠাৎ বিজেপির গেরুয়া ঝড় দেখে মমতা বন্দোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের পঞ্চায়েত ভোটের আগের থেকে বুথ স্তরে নিজেদের সংগঠন কে শক্তিশালী করতে বলেছে, যার মানে হলো এলাকার কুখ্যাত গুন্ডা, বদমাশ, নারী পাচারকারী, চোলাই মদের কারবারি, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী, ও প্রোমোটারদের নিজেদের দলের কব্জায় রাখতে টোপ দেওয়া এবং ওদের সেবা করা।
তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য কে বাম মুক্ত করে ডান যুক্ত করার রাজনীতির ফলে আজ প্রতিটি গ্রামের হিন্দু পাড়ায়, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে, বন্ধ কলকারখানার শ্রমিক বস্তিতে আরএসএস এর সংগঠন মজবুত হচ্ছে। আজ আর শুধু বড়বাজারের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী কেন্দ্রিক দল হয়ে না থেকে বিজেপি ও আরএসএস নিজেদের হিন্দুত্ববাদের দর্শন কে ছড়িয়ে দিচ্ছে শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, শিক্ষা, সহ এমন সকল ক্ষেত্রে যেখান থেকে জনগণের উপর প্রভাব খাটানো সহজ হবে। এই সুযোগে বিবেকানন্দ মিশনের নামে আরএসএস এর দাঙ্গাবাজেরা সারা রাজ্যে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকারের দয়ায় একের পর এক স্কুল খুলে ফেলেছে, প্রায় ৭৫,০০০ ছেলে মেয়েদের হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজে পরিণত করার জন্যে তাঁদের শিশু মনে ঘৃণার বীজ রোপণ করা চলছে এই সকল বিদ্যালয় নামক সন্ত্রাসবাদী তৈরির কারখানায়।
অন্যদিকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ ধন্য বিপুল সংখ্যক প্রতিক্রিয়াশীল মুসলমান মৌলবীরা, মুসলমান এলাকায় স্কুল - কলেজের অভাব কে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলছে সালাফি জঙ্গী বানাবার মাদ্রাসা। এই ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠা বেসরকারি মাদ্রাসাগুলোয় মুসলমান প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীরা শিশু মনে হিন্দু বিরোধী বিদ্বেষের বীজ রোপণ করছে বিজেপি ও আরএসএস এর স্বার্থে, যাতে আগামীকাল আরএসএস এর স্কুলগুলোর দিকে আঙ্গুল তোলার কোন চেষ্টা করা হলেই সেটাকে মুসলমান তোষণ বলে চালিয়ে নিজেদের পক্ষে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ করতে সফল হয় গেরুয়া বাহিনী। সম্প্রতি নবী উৎসব নিয়ে যেভাবে গন্ডগোল করে সরস্বতী পূজা বন্ধ করিয়ে হাওড়ায় দাঙ্গা বাঁধাবার প্রচেষ্টা করে কিছু তৃণমূল সমর্থিত জামাত জঙ্গীরা তাতে স্পষ্ট করেই রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিস্থিতি কে খারাপ করার পিছনে তৃণমূল আর বিজেপির হাত মেলানো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
যোগী আদিত্যনাথ যদি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারে শুধু মাত্র সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়ে, তাহলে আমরা তাঁর একটা মিনি সংস্করণ বাংলার বুকে দেখতে পাই হিন্দু সংহতি নেতা তথা আরএসএস কর্মী তপন ঘোষের মধ্যে। হিন্দু সংহতি বকলমে আরএসএস এর “fringe” সংগঠনগুলোর মধ্যে একটা অন্যতম সংগঠন। যোগী আদিত্যনাথের হিটলারের জীবনীর থেকে বের করে ভারতের রাজনীতিতে প্রয়োগ করা লাভ জেহাদের থিয়োরি হোক বা বল প্রয়োগ করে ধর্মান্তকরণের (ঘর ওয়াপসি) প্রয়োগ হোক, তৃণমূলের গোপন ও বিজেপির খোলাখুলি সমর্থনে বলীয়ান হয়ে আজ হিন্দু সংহতি এই ঘৃণ্য রাজনীতির প্রয়োগ বাংলার মাটিতে করে নিজের ভিত মজবুত করছে, বাংলার মাটিতে সংগঠিত ঘৃণ্য ১৯৪৬ এর দাঙ্গার আর দাঙ্গাকারীদের “মহত্ব” প্রচার করছে, এবং সর্বোপরি আরএসএস ও বিজেপির আইটি সেলের সাহায্যে হিন্দু সংহতি আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তে প্রান্তে ভুঁয়ো খবর ছড়িয়ে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে।
খড়্গপুর, ধুলাগড়, চন্দননগর, ঢোলাহাট থেকে হাজীনগরের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে আগুন লাগাবার কাজে হিন্দু সংহতি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ যে তৃণমূল নেত্রী সংখ্যালঘুদের হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন থেকে বাঁচাবার প্রতিশ্রুতি দেয়, যে তৃণমূল সরকারের পুলিশ জেলে মহিলা আন্দোলনকারীদের বিবস্ত্র করে, ছাত্রদের ক্যাম্পাসে লাঠি পেটা করে, গুলি করে গণআন্দোলনে সামিল গ্রামবাসীদের হত্যা করে, সেই সরকার রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে চরম বিপদজনক এই উগ্রপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো সম্পর্কে যে রূপ নির্বিকার তা দেখে সহজেই উপলব্ধি হয় যে পর্দার পিছন থেকে কলকাঠি নাড়া হচ্ছে যাতে পশ্চিমবঙ্গে গেরুয়া বাহিনীর ২০২১ না হোক অন্তত ২০২৬ এ ক্ষমতায় আসা যেন সুনিশ্চিত করা যায়।
এ কথা সত্যিই মানা দরকার যে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ আজ সত্যিই মুর্মুর্ষু; যদিও সেই ধুলাগড়ের মাটিতেই হিন্দু-মুসলিম-শিখ-খ্রিস্টান মিলে ভগৎ সিংয়ের শহীদ দিবস ২৩শে মার্চেই একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে, যদিও গ্রামাঞ্চলে আজও হিন্দু ও মুসলমান কৃষকেরা একসাথে লড়াই করছেন, সিক্ত করছেন ভাঙড়ের মাটি নিজ বুকের রক্ত দিয়ে, তবুও আজ আকাশে হিন্দুত্ববাদের বিষাক্ত কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। ভদ্রলোক বাঙালি আজ “কাটা” মুসলমানদের শায়েস্তা করার জব্বর উপায় দেখছে যোগী আদিত্যনাথের উথ্বানে। গোঁড়া বামুনদের দল আরএসএস এর তীব্র প্রচারের আক্রমণে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গের ছা পোষা মধ্যবিত্ত হিন্দু আজ নিজেকে আক্রান্ত মনে করছে, বিশ্বাস করছে যে মুসলমানরা নাকি তাঁদের মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে আর তাই বিজেপির ভোট ব্যাঙ্কে বিপুল হারে বৃদ্ধি হচ্ছে জন সমর্থনের।
বিজেপির এই উথ্বানে, হিন্দু সংহতির মতন ফ্যাসিস্ট সংগঠনের দাপাদাপিতে আজ গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চেতনা সম্পন্ন বাঙালিদের ভয় পেয়ে কোন লাভ হবে না। সাপ আজ ঘরে ঢুকেছে আর তাই ঘর কে আজ রক্ষা করতেই হবে এই বিষাক্ত উদ্ধত ফণা নিয়ে বসে থাকা কেউটের কবল থেকে। সাপের বিরুদ্ধে লড়াই না করে পালিয়ে গেলে সেই সাপ পিছনে আসবে আর অল্প অল্প করে সমস্ত বাড়ির উপর তার দখল কায়েম হবে। এই সর্প বিনাশ অভিযানে আজ গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন সকল মানুষ কে, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, সকলকে এক সাথে রুখে দাঁড়াতে হবে। হিন্দুত্ববাদের বিষাক্ত সাপ কে ও তার দোসর জামাতিদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে চিরকালের জন্যে আর এর জন্যে দরকার বৃহৎ গণ আন্দোলনের। আজ যাঁরা বিজেপিকে বাংলার মাটি থেকে উপড়ে ফেলার কথা বলছেন তাঁদের এই বৃহৎ সংগ্রামে অংশ নিতেই হবে এবং রাজনৈতিক মত-পার্থক্য কে সম্মান জানিয়েই সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তির সাথে মিলে বাংলার মাটি কে রক্ষা করার স্বার্থে এক ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট তৈরি করতে হবেই। ব্যাপক হারে শ্রমিক ও কৃষকদের এই লড়াইয়ে সামিল না করতে পারলে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করা যাবে না।
আজ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের ঝড় তেড়ে আসছে পশ্চিমবঙ্গের দিকে আর তাই রুখে দাঁড়ানো আজ ভীষণ জরুরী। আমাদের বাংলা ও বাঙালি সহ সকল জনজাতির ও সম্প্রদায়ের স্বার্থে আজ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের আগ্রাসন কে রোখা বাংলার সাধারণ মানুষের একটি পবিত্র কর্তব্য। আর এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুধু বিজেপি বা আরএসএস এর বিরুদ্ধেই আটকে থাকতে পারেনা বরং এই লড়াইয়ের নিশানায় সেই সমস্ত রাজনৈতিক দল ও আদর্শ কে রাখা উচিত যেগুলো গোপনে হিন্দুত্ববাদের আঁচে হাওয়া দিচ্ছে। আর এই লড়াইয়ে সামিল না হয়ে যদি আপনি শুধু কথার ফুলঝুড়ি ছুটিয়ে নিজের দায় সারতে চান তাহলে ইতিহাস আপনাকে কখনোই ক্ষমা করবে না। আপনার-আমার সকলের উচিত আজ পথে নেমে, গ্রাম-গঞ্জ, শহরতলীর অলিতে গলিতে বেড়ে চলা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার। সময় এখন বিলাসিতার অপর নাম, তাই সময় অপচয় করা ক্ষতিকারকই নয় বরং বিলম্ব মানেই মৃত্যু। তাই রুখে দাঁড়ান, ঘুরে দাঁড়ান, আর সকল ধরণের ফ্যাসিবাদ কে, বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কে পরাস্ত করার জন্যে লড়াই করুন ও বিজয়ী হোন।