মোদী’র বিজয়ের কারণ জনগণের মূর্খতা নয় বিরোধীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ও সুবিধাবাদী অবস্থান

রবিবার, মে ২৬, ২০১৯ 0 Comments A+ a-

বিরোধীরা কি মোদী’র কোনো বিকল্প হাজির করতে পেরেছিলো?


জনজীবনের মান উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ক্ষেত্রেই ডাহা ফেল করেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এলো নরেন্দ্র মোদী'র নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী সরকার। বিরোধীরা সকলেই ইভিএম আর  নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরব। আম্বানি, আদানি, টাটা, বিড়লার মত শাসক পরিবার গুলো ভোট ব্যবস্থাকে যে ম্যানিপুলেট করে এটা যেন প্রথমবার জানা গেল!  হতবাক বোদ্ধা কুল হতাশ জনগণের সাম্প্রদায়িক মূর্খামি নিয়ে। তাদের অঙ্ক অনুযায়ী বিজেপি জেতার অর্থ জনগণ রুটি-রুজি, কর্মসংস্থান চায় না, শুধুই রাম মন্দির আর পাকিস্তান'কে বোমা মারতে চায়।  

কিছুক্ষণের জন্য ধরে নেওয়া যাক যে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ছিল এবং ইভিএম এ কারচুপি হয়নি। কিন্তু তবুও কি  বিরোধীদের ভোট দেওয়ার মত কোনো কারণ ছিলো? বিরোধীরা কি মোদী’র কোনো বিকল্প হাজির করতে পেরেছিলো?  

কৃষি সংকট আর কৃষক আত্মহত্যার ধারাবাহিকতা কংগ্রেসের শাসন থেকেই প্রবাহমান। আঞ্চলিক দলগুলোর শাসন এর বাইরে নয়। বিজেপি হোক বা কংগ্রেস, কৃষি সংকট সমাধানে ঋণ মকুব আর ন্যূনতম সমর্থন মূল্য বা এমএসপি'র ভাঁওতা ছাড়া কেউ কোনো মৌলিক সমাধানের কথা বলতে পারেনি। 

আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভারতবর্ষের কৃষি সমস্যার সমাধান পরিকাঠামো বিকাশ করে বা সেচ কেটে হবে না, বরং উৎপাদন সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই সম্ভব, যে কাজ কোন ভোটপন্থী পার্টি শাসক শ্রেণীর বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে করবে না। কৃষি সমস্যা মৌলিক ভূমি সংস্কার, কৃষক ও বাজারের মধ্যবর্তি পরজীবি  শ্রেনীর উচ্ছেদ, এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৃষি পরিকল্পনা আর কৃষকদের বৈপ্লবিক রেমৌলডিং বাদে সম্ভব না। মোদী'র বিপরীতে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা কেউই কৃষককে জমি, রুটি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে পারেননি, অথবা চাননি, কারণ এই ক্ষেত্রে তাঁদের সামন্তবাদী রাজনৈতিক অবস্থান মোদী'র চেয়ে আলাদা নয়। 

১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে যাবতীয় সরকারের আমলে একের পর এক বড় কারখানা  বন্ধ হয়ে যাওয়া আর ক্ষমতায় এলে বন্ধ কারখানা খোলার মিথ্যা প্রতিশ্রুতির স্ক্রিপ্ট জনতার মুখস্থ।  ঠিকা প্রথায় নিয়োগের বদলে আত্মমর্যাদা যুক্ত স্থায়ী চাকরির অধিকারের কথা কথা বিরোধীরা বলেনি। মোদী চাকরি খেয়ে নিয়েছে, এ কথা বলেও সরকারি চকরির ক্ষেত্রে পদ বিলোপের বদলে শূন্য পদে নিয়োগের কথা কেউ বললো না। কেউ বললো না মানুষের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব সরকারের আর এই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে শুধু বেসরকারি ক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যে সরকারের কাজ নয় ।

সমস্ত সরকারের আমলে স্বাস্থ্যে সরকারি বিনিয়োগের গ্রাফ দিন দিন নিম্নমুখী হয়েছে। বেসরকারীকরণের ফলে খেটে খাওয়া গরিব মানুষ বঞ্চিত হয়েছে স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জায়গায় এখন শুধু জনগণ কে ঢপের কীর্তন শোনানোর জন্যে স্বাস্থ্য বীমা দিয়ে বড় বড় বীমা কর্পোরেশনের লাভ করিয়ে সরকার এই দায়িত্ব থেকে যে নিষ্কৃতি পেতে পারে না সে কথা কোন ভোটপন্থী পার্টি বা প্রার্থী কিন্তু জোর গলায় বললো না। 

স্বাস্থ্যের মতনই জনগণের স্বার্থে, দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের স্বার্থে জরুরী শিক্ষার খাতে অর্থ বরাদ্দ কম হয়েই চলেছে। সরকারি লগ্নির জায়গায় বৃহৎ একচেটিয়া বিদেশী পুঁজি কে এবং দেশী মুৎসুদ্দি পুঁজি কে শিক্ষা নিয়ে চড়া দামে ব্যবসা করে লাভের গুড় বস্তাবন্দি করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে ব্যাঙের ছাতার মতন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়তে দিয়েছে একের পর এক সরকার। মোদী সরকার সরাসরি শিক্ষার উপর আক্রমণ করে বিগত পাঁচ বছরে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু বরাদ্দ ছাঁটাই হয়নি, বরং স্কলারশিপের টাকায় কোপ মেরে গরিব, বিশেষ করে দলিত, আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া জাতির ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকারের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল এই সরকার। এর বিরুদ্ধে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, সরকারি শিক্ষায় ফী বৃদ্ধি থেকে স্কলারশিপ শেষ করে দেওয়ার চক্রান্তের বিরুদ্ধে, শিক্ষার সার্বিক বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে কোন বিরোধী দল এমন কোন অবস্থান গ্রহণ করেছিল কি যা সত্যিই মানুষের উপকার করতে পারতো?
  
প্রতিরক্ষা খাতে, দেশের সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে, খনিজ সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে, নিজেদের জল-জঙ্গল-জমি'র অধিকার থেকে উচ্ছেদ হওয়ার বিরুদ্ধে লড়াকু মানুষদের দমন করার খাতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্র বরাদ্দ করে তাতে কাটছাঁট করে জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করার কথা কোন মূল ধারার বিরোধী দল কি জোর গলায় ঘোষণা করে মানুষ কে নিজেদের পক্ষে টেনে আনতে পেরেছিল? পারেনি কারণ বিরোধীরা যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন তারাও অন্য কিছু করে দেখাতে পারেনি। 

চৌকিদার চোরই বটে কিন্তু কংগ্রেস তৃণমূল বা অন্যান্য বিরোধীরা যদি আজ হঠাৎ সাধু সাজতে চায় তবে ঘোড়াও কি হাসবে  না? 

সুতরাং বিজেপি সরকার যা করছে সেটাকেই স্বাভাবিক এবং কাঙ্খিত উন্নয়নের মডেল বলে এতদিন জনগণের মনে গেঁথে দিয়েছে বিরোধীরা। আত্মমর্যাদার সাথে রুটি রুজির অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প মডেল হাজির করতে পারেনি বিরোধীরা।  তারাইতো শিখিয়েছে ঋতু পরিবর্তনের মত দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার, জলের দরে সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া আর শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়াটাই কাঙ্খিত অর্থনৈতিক সংস্কার। সুতরাং বিরোধীরা এতদিন যা বলে এসেছে বিজেপিতো সেটাই আরো ভালোভাবে করছে।

কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকার আসার আগে কংগ্রেস কি অন্ধ পাকিস্তান বিরোধী উগ্রতা প্রচার করেনি? অরবিন্দ কেজরিওয়াল, রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দোপাধ্যায় বা মহম্মদ সেলিমদের মতন আমাদের সেকুলার নেতারা কি তীর্থ স্থান ঘুরে ঘুরে রাজনীতির ধর্মীয় বাতাবরণ তৈরি করেনি? বাটলা হাউস এনকাউন্টারের মত গুচ্ছ গুচ্ছ ঘটনা কি ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের বিরুদ্ধে ঘটায়নি কংগ্রেস?

বিরোধীরা যে মতাদর্শবিহীন রাজনীতির চর্চা করেছে, তার বিপরীতে গেরুয়া মতাদর্শ মানুষের মনে জায়গা করে নিতে সফল হয়েছে। “ওটাতো পলিটিকাল ওপিনিয়ান” বলে একটা কথা চালু হয়েছে। যার মোদ্দা কথা রাজনৈতিক নেতারা তো মিথ্যা অভিযোগ করবেই, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবেই। এটা যেন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। যুক্তি বুদ্ধি চর্চার বদলে ব্যাক্তি আনুগত্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অবক্ষয়ের লুম্পেন রাজনীতি ফ্যাসিবাদের ভিত্তি তৈরি  করবে এটা কি স্বাভাবিক নয়? সংঘের প্রচারকরা অবলীলায় সাধারণ মানুষকে বোঝাতে পারে দুর্নীতিতো সবাই করে, কৃষকের উপর গুলিতো সবাই চালায় কিন্তু একমাত্র বিজেপি বিপন্ন হিন্দুদের রক্ষা করতে পারে বিশ্বজুড়ে ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রসারের থেকে। বিরোধী দল গুলো কি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের  সাথে গলা মিলিয়ে  ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ভীতি তৈরি করেনি? ভুয়া ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে সংঘ পরিবার হিন্দুদের মধ্যে তৈরি করেছে এক ফাঁপা পুনঃজাগরণের স্বপ্ন, আর এই রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে, পাল্টা লড়াই গড়ে তুলতে কোন ভোটবাজ পার্টিকে মানুষ উদ্যোগ নিতে দেখেননি।  বলাবাহুল্য, দ্বিতীয় মোদী সরকার কাগুজে গনতন্ত্রটুকুও  লোপাটের দিকে যাবে, দেশে এক নতুন ধরণের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। 

সুতরাং বিরোধীরা যে জমি তৈরি  করেছে তাকে কাজে লাগিয়েই ফসল ঘরে তুলেছে সংঘ পরিবার। ফ্যাসিবাদের উত্থান তখনই হয় যখন জনগণ প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি বিরক্ত হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদ নতুন কিছু করে দেখিয়ে চমক দেয়। জনগণ কখনো ভাবেনি যে লালবাজারের বড় কর্তার কলারে কেউ হাত দিতে পারে বা কালো টাকার কারবারিদের সায়েস্তা করতে সমগ্র দেশে নোটই বাতিল করে দেওয়া যায়! বা ঘরে ঢুকে পাকিস্তানকে মেরে আসা যায়! কিন্তু আদতে ফ্যাসিবাদ উগ্র কায়দায় প্রচলিত শোষণ মূলক ব্যাবস্থাকেই রক্ষা করে। তাই কোনো সমস্যারই সমাধান করতে পারেনা।

ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে কংগ্রেস কত নিষ্পাপ, গান্ধী বা নেহরুর মতন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা কত দেশ প্রেমিক এই সব প্রচার করলে আদতে লুজ বল দেওয়া হয়। ফ্যাসিবাদকে উচ্ছেদ করতে প্রয়োজন বিকল্প মতাদর্শ, বিকল্প সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি, যা বাস্তবিকই কৃষি সমস্যা, শিল্প সমস্যা, কর্মসংস্থানের মত সমস্যাগুলোর মৌলিক সমাধান করবে । আর প্রয়োজন ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ ও উচ্ছেদের যোগ্যপন্থা। যতদিন সেই বিকল্প কে মানুষের সামনে তুলে ধরা না যাবে ততদিন পর্যন্ত ভোটের মেশিনে বোতাম টিপে ফ্যাসিবাদ কে জব্দ করা যাবে এই রকম দিবাস্বপ্নই বিক্রি করা যাবে, ফ্যাসিবাদ কে উচ্ছেদ করা যাবে না। 

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে