লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কু'র (বাস্কে) রক্তে স্নাত কামালপুর ভারতের শ্রেণী সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

বুধবার, জুন ১২, ২০১৯ 0 Comments A+ a-



আমাদের ইতিহাস চিরকালই যুদ্ধে বা শ্রেণী সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া শ্রেণীগুলি রচনা করে, নিজের মতন করে, আর সেই ভাবে তৈরি হয় মূলধারার ইতিহাস। অবশ্যই বস্তুর দুইটি দিক হয়, ইতিহাসেরও, মিথোলজিরও। এক দিকে যখন বিজিতের মূল ধারার ইতিহাস মানুষ কে এক ভাবে ঘটনার বিবৃতি দেয়, ঠিক তখনই, বিপরীত দিকে সাবল্টার্ন বা সমাজের নিম্ন শ্রেণীর ইতিহাস সেই ঘটনার অন্য মূল্যায়ন করে, অন্য কাহিনী বলে। শোষক যা কালো করে দেখায়, শোষিত তাকে সাদা করে, আর শোষক যা সাদা করে দেখায়, শোষিত তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা নোংরার রেশগুলো তুলে ধরে তাঁদের সাবল্টার্ন ইতিহাসের পাতায় পাতায়, অলিখিত বাণীতে।

ব্রিটিশ শাসনকালে যদিও ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রিটিশ-বিরোধী সকল বিদ্রোহ কে, যেমন সাঁওতাল বিদ্রোহ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহ , ইত্যাদি কে চিরকালই সবচেয়ে কুৎসিত ভাবে চিত্রিতকরা হলেও কিন্তু তৎকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের চেতনায় এই সব লড়াই ও সংগ্রামের কাহিনী অনেক সম্মানজনক স্থান গ্রহণ করে রেখেছিল। ব্রিটিশ শাসকদের রক্তচক্ষু কে কাঁচকলা দেখিয়েই তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় বিখ্যাত হয়ে ওঠে দীনবন্ধু মিত্রের নীল বিদ্রোহ নাটক। মানুষের মন থেকে নীল বিদ্রোহের চেতনা কে কোন ভাবেই ব্রিটিশ শাসকদের ঢক্কানিনাদ কিন্তু দূর করতে পারেনি।

এই মূলধারার ইতিহাস ও সাধারণ মানুষের, শোষিত মানুষের সযত্নে লালন করা, রক্ষা করা ও প্রচার করা সাবল্টার্ন ইতিহাসের চরম দ্বন্দ্ব কিন্তু আজও বিদ্যমান। এর সাথে সাথে আবার শোষিত শ্রেণীর বন্ধু সেজে যে সুবিধাবাদী মেকি বিপ্লবীরা মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস কে বিকৃত করতে, চেপে যেতে বা মোছার চেষ্টা করে হতাশা ছড়াতে ও মানুষ কে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতে, তাঁদের ষড়যন্ত্রও সামিল হয়। এই সবের মাঝেও চরম হতাশার অন্ধকারে আলোর হাতছানির মতন সুস্পষ্ট হয়ে এগিয়ে আসে সাবল্টার্ন ইতিহাসের বীর গাঁথা, যার নায়ক সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ, কৃষক, সেই খালি পায়ে চলা, কালো চামড়ার রুক্ষ চেহারার কৃষক ও কৃষক রমণী। তাঁদের কাহিনী কে ভুলিয়ে দিতে চাইলেও সহজে ভোলা যায় না, যেমন ভোলা যায়না ১৯৭৪ সালের ঐতিহাসিক কামালপুরের বিপ্লবী সংগ্রাম কে।

কামালপুর এক অদ্বিতীয় বিপ্লবী সংগ্রামের জন্যে চিরকাল পশ্চিমবঙ্গের ও ভারত উপমহাদেশের বিপ্লবীদের কাছে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে, যে সংগ্রামের ফলে ভারতের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লড়াই ভিয়েতনামের স্তরে উঠতে পেরেছিল, অর্থাৎ যে স্তরে একটি ক্ষুদ্র শক্তি একটি বৃহৎ শক্তি কে অচিরেই পরাজিত করতে পারে শুধু মাও সেতুঙের চিন্তাধারার উপর নির্ভর করে জনযুদ্ধের বিস্তৃতি করে, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কে যুদ্ধে সামিল করে। এই বিদ্রোহের গল্প মূলধারার কমিউনিস্ট ইতিহাস থেকে সযত্নে বাদ দেওয়া হয়ে থাকলেও বর্ধমান ও হুগলির গরিব আদিবাসী জনগণের হৃদয়ে যেহেতু এই বিদ্রোহের কাহিনী আজও প্রোথিত আছে তাই হয়তো ৪৫ বছর পরেও এর ইতিহাস কে এত সহজে গায়েব করতে অক্ষম শাসকশ্রেণী ও তাঁদের পদলেহী সংশোধনবাদীদের দল।

কী হয়েছিল এই অখ্যাত কামালপুরে? কেন কামালপুরের লড়াই কে মনে রাখা দরকার? কামালপুরের সংগ্রামের থেকে আজকের যুগে গরিব মানুষের, কৃষকের, আদিবাসীর কী শেখার থাকতে পারে? কেন কামালপুরের কথা কেউ কোনদিন আর উচ্চারণ করে না?

আসলে কামালপুরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত আছে একটি বিশেষ রাজনীতি আর সেই রাজনীতি কে মানুষের চোখের আড়ালে রাখতে শাসক শ্রেণী চিরকালই বদ্ধপরিকর আর বদ্ধপরিকর শাসকশ্রেণীর তল্পিবাহক নানা রঙের সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীরা। তবুও কামালপুরের যুদ্ধের কথা, কামালপুরের ইতিহাসের কথা, কামালপুরের ঐতিহাসিক ১২ই জুনের সংগ্রামের কথা মানুষ কে জানানো সমস্ত বিপ্লবী কমিউনিস্টদের একটি একান্ত জরুরী কর্তব্য এবং এই কর্তব্য কে পালন না করলে অনেক সমস্যা হবে আগামী প্রজন্ম কে রাজনীতির ময়দানে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে।

১৯৭৪ সালের ১২ই জুন, অর্থাৎ এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার দিনে, হুগলী ও বর্ধমানের সীমান্তে অবস্থিত কামালপুর গ্রামে  ভারত রাষ্ট্রের পুলিশ ও আধা সেনার সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন তিন বীর আদিবাসী বিপ্লবী — লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কু (বাস্কে)। এদের শহীদ হওয়ার আগে এবং পরে সমস্ত কামালপুরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন এক সত্যিকারের জনযুদ্ধ। পরাস্ত হয়েছিল ভারত রাষ্ট্র কৃষক জনগণের সশস্ত্র গণফৌজের কাছে আর তার নেতৃত্বে তখন চারু মজুমদার ও মাও সেতুঙের বিপ্লবী নীতিতে চালিত সিপিআই (এম-এল), যে দলের দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এই কামালপুর গ্রামেই, ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে।

আসলে কামালপুরের এই জনযুদ্ধের সাথে এই পার্টি কংগ্রেসের ও সিপিআই (এম-এল) দলের সম্পর্ক ভীষণ নিবিড়। ১৯৭২ সালের ২৮শে জুলাই চারু মজুমদার কলকাতা পুলিশের অত্যাচারে শহীদ হওয়ার সাথে সাথে যে নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছেদ পড়ে, সেই গল্প চিরকালই মানুষ মূলধারার ইতিহাসে, এমনকি অনেক তথাকথিত বিপ্লবীদের স্মৃতিকথায় শোনেন। নকশালবাড়ির লড়াই যে সাতের দশকের শুরুতেই শেষ হয়নি সেই সত্যের সাক্ষী হলো কামালপুর। নকশালবাড়ি’র সংগ্রাম যে ১৯৭২ সালে চারু মজুমদারের শহীদ হওয়ার সাথে শেষ হয়নি তা জানান দিল কামালপুর। ট্রাক ট্রাক সৈন্য কে হারিয়ে, সেদিন কামালপুরের সাধারণ আদিবাসী ও কৃষক জনগণ দেখিয়েছিলেন চারু মজুমদারের রাজনীতির শক্তি এবং তার সাথে সাথে একটি লাইনের বলিষ্ঠতা, যে লাইন বলে “লেগে পড়ে থাকার নাম বিজয়”, যে লাইন বলে যে মানুষ অস্ত্রের চেয়ে বড় আর জনযুদ্ধ হচ্ছে জনগণের যুদ্ধ এবং একমাত্র ব্যাপক জনগণ কে সমবেত করেই এই যুদ্ধ চালনা করা সম্ভব।

১৯৭২ সালের জুলাই মাসের ১৬ তারিখে চারু মজুমদারের ধরা পড়ার পরে সিপিআই (এম-এল) এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবস্থা তথৈবচ হয়। একদিকে চারু মজুমদার কে কলকাতা পুলিশের কবল থেকে বের করে আনার পরিকল্পনা দেবী রায়ের নেতৃত্বাধীন গোয়েন্দা বাহিনী জানতে পেরে যাওয়ায় ২০শে জুলাই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দিবসের মিছিলের মাধ্যমে লাল বাজার থেকে তাঁকে মুক্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, অন্যদিকে তার ঠিক কিছুদিন পরেই তাঁকে হত্যা করে ইন্দিরা গান্ধীর ফ্যাসিস্ট কংগ্রেস সরকার। এর পরে পার্টির নেতৃত্বে লুকিয়ে থাকা নানা রঙের সংশোধনবাদ নানা ভাবে পার্টির সংগঠনে ছোবল মারতে থাকে। নভেম্বর মাসে কানু সান্যালের বেইমানির খতিয়ান হিসেবে প্রকাশিত জেল থেকে লেখা চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে কুৎসার  দলিল ও অন্যদিকে কংগ্রেসের দালাল হয়ে যাওয়া সৌরেন বোসের বার বার করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাং শেন ও চৌ এনলাই গোষ্ঠীর দ্বারা করা চারু মজুমদারের সমালোচনা কে শিখন্ডি করে দলে দলে মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদীরা চারু মজুমদারের লাইন কে খন্ডন করে সংশোধনবাদের পঙ্কিল স্রোতে গা ভাসতে শুরু করেন।

এহেন পরিস্থিতিতে পাঞ্জাব প্রদেশে সিপিআই(এম-এল) দলের সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির অতিরিক্ত সদস্য জগজিৎ সিংহ জোহাল, ওরফে শর্মার সাথে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির চারু মজুমদার-পন্থী নেতা মহাদেব মুখার্জির দুই দূত, ভবানী রায়চৌধুরী ও গৌতম ঘোষ দেখা করেন ও চারু মজুমদারের লাইন কে ও কতৃত্ব কে রক্ষা করা সম্পর্কে মহাদেব মুখার্জির বক্তব্য ব্যক্ত করেন। তাঁরা অনেকগুলো বিষয়ে একমত হন এবং এর ফলে ১৯৭২ সালের ৫-৬ ডিসেম্বর, পাঞ্জাবের রোপার জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে সশস্ত্র কৃষকদের পাহারায় শর্মা মহাদেব মুখার্জি কে নিজ ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোঅপ্ট করেন এবং পার্টির নতুন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। মুখার্জি-শর্মা নেতৃত্বাধীন চারু মজুমদারপন্থী কেন্দ্র চারু মজুমদারের বিপ্লবী কতৃত্ব কে উর্দ্ধে তুলে ধরার শপথ নেয়, পার্টির থেকে বিশ্বাসঘাতকদের বিতাড়িত করে এবং চারু মজুমদারের পথেই বিপ্লবী সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রাখে। উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, দিল্লি, অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও অবিভক্ত বিহারের বিপ্লবীরা এই কেন্দ্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, যদিও উত্তর প্রদেশের শ্যাম চোপড়া, বাংলার সুনীতি ঘোষ, প্রভৃতি নেতারা দলের ভিতর ও বাইরের থেকে ভাঙ্গনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এদের ফাঁদে পড়ে শর্মা নিজের বিপ্লবী অবস্থান ত্যাগ করে মধ্যপন্থী ও চারু মজুমদার বিরোধী হয়ে যান।

যদিও বাকি পার্টি মহাদেব মুখার্জি কে সম্পাদক করে চালিত হতে থাকে, কিন্তু ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসের লিন পিয়াও বিরোধী কুৎসার বন্যা বইয়ে যখন চৌ এনলাই’ এর নেতৃত্বাধীন সংশোধনবাদী চক্র মাও সেতুঙ  কে ঘেরাও করে যে নবম জাতীয় কংগ্রেস কে মাও সেতুঙ নিজে বলেছিলেন “বিজয়ের ও ঐক্যের কংগ্রেস” তার সিদ্ধান্তগুলো কে নাকচ করে দেয়, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মাও সেতুঙের চিন্তাধারায় বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে যে বিশ্ব বিপ্লবের ময়দানে এক গুণগত পরিবর্তন এসেছে, লেনিনের যুগ থেকে যে মাও সেতুঙের যুগে উত্তীর্ণ হয়েছে মানব জাতি, সাম্রাজ্যবাদ, যা কে লেনিন বলেছিলেন মুর্মুর্ষু পুঁজিবাদ, সে যে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে সঙ্কটগ্রস্ত হয়েছে ও বিপ্লবের ভরকেন্দ্র যে এশিয়া-আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় সরে এসেছে, এই সব সত্য কে অস্বীকার করে, তখন কিন্তু সিপিআই(এম-এল) দলের অভ্যন্তরে এক বিরাট ভাঙ্গন ধরে। যদিও আগের ভাঙ্গনগুলো ছিল চারু মজুমদার-পন্থী ও বিরোধীদের, এই বার হয় লিন পিয়াও-পন্থী, অর্থাৎ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেসের সঠিক মাওপন্থী লাইনের পক্ষে যাঁরা দাঁড়ালেন, চারু মজুমদারের রাজনীতির পক্ষে যাঁরা দাঁড়ালেন তাঁদের সাথে চারু মজুমদারের নাম নিয়ে যাঁরা চারু মজুমদারের লিন পিয়াও, মাও সেতুঙ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম কংগ্রেসের লাইন কে মানা নিয়ে ঘোষিত লাইনের বিরোধিতা করলেন তাঁদের ভাঙ্গন দেখা দিল।

এই সময়ে, পার্টির ভাঙ্গনের মুখে বাংলা, উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও বিহারে ভাঙ্গন ধরলেও মহাদেব মুখার্জি’র নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের প্রতি পার্টির একটি বড় অংশের সমর্থন ছিল আর তাঁদের নিয়ে অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হিসেবে মহাদেব মুখার্জি পার্টির দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেস করার সিদ্ধান্ত নেন আর এই কংগ্রেসের জন্যে বেছে নেওয়া হয় কামালপুর কে। আর এই বেছে নেওয়ার পিছনে ছিলেন তৎকালীন সংগঠক জীতেন কুন্ডু (কাবুল), যিনি কামালপুরের কৃষকদের রাজনীতি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেন কৃষি বিপ্লবে যোগ দিতে। পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় গণফৌজের অতন্দ্র পাহারায় ও এই কংগ্রেসে সিপিআই (এমএল) এর প্রথম কংগ্রেসে গৃহীত চারু মজুমদারের রাজনীতির ভিত্তিতে প্রস্তুত কর্মসূচি কে পুনঃগ্রহণ করা হয়। চীনা পার্টির লাইন কে যখন বাকি সব সিপিআই (এম-এল) দলের নেতৃত্ব চোখ বন্ধ করে মেনে নিচ্ছেন তখন মহাদেব মুখার্জির নেতৃত্বাধীন সিপিআই (এম-এল) চীন পার্টির সাথে মতাদর্শগত দুইলাইন শুরু করে। আর এই সবের মুলে ছিল কামালপুর। বিশ্বের বুকে একমাত্র সিপিআই (এম-এল) ১৯৭৩-৭৪ সালেই চীনের ভিতরে সংশোধনবাদের উথ্বান কে anticipate করে জনগণ কে সাবধান করা শুরু করে চেয়ারম্যান মাও সেতুঙের উপস্থিতি কে সম্মান জানিয়েই। আর এই কাজেও কামালপুর ওতপ্রোত ভাবে জড়িত কারণ এখানেই সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় চীনা পার্টির নতুন লাইন কে সমালোচনা করার ও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে সেই বিপ্লবী ঔদ্ধত্য দেখানোর যা তৎকালীন সময়ে blasphemous ছিল।

পার্টি কংগ্রেসের শেষেই ভারতবর্ষ ও বাংলার নানা প্রান্তের মতন কামালপুর ও কালীনগরে কৃষকের বিকল্প সরকার বিপ্লবী কমিটি গড়ার সংগ্রাম শুরু হয় এবং জোতদারদের নেতৃত্বাধীন আধা-সামন্ততান্ত্রিক শাসন কে উচ্ছেদ করে কৃষক রাজ প্রতিষ্ঠিত হয় গণ ফৌজের সহায়তায়। গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে চলতে থাকে গেরিলা সংগ্রাম। চারু মজুমদার কে হত্যা করে যে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ভীষণ আপ্লুত হয়েছিল এই ভেবে যে নকশালবাড়ি সংগ্রাম কে কবরে মাটি চাপা দেওয়া গেছে, তাঁরা যখন দেখতে পেল কামালপুরে উদ্ধত শির নিয়ে দাঁড়িয়ে রাইফেল হাতে আদিবাসী কৃষক ও আদিবাসী কৃষক রমণী, তখন বাংলার ওই ছোট ও অখ্যাত গ্রাম কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর জুতো চাটা দালাল সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কলকাতার বাড়ির অন্দরমহল থেকে শুরু করে দিল্লির উত্তর ও দক্ষিণ ব্লককে কাঁপিয়ে তুললো প্রচন্ড আতঙ্কে।

ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পাঠালো শয়ে শয়ে আধা সেনা ও রাজ্য পুলিশ কে কামালপুর ও কালীনগর দমন করতে ও এই সংগ্রামের মাথাদের, অর্থাৎ কাবুল কে হত্যা করতে। সেই আধা সেনা ও পুলিশ বেশ কিছুদিন ধরে সিজ অপারেশন চালিয়ে চতুর্দিক থেকে কামালপুর কে ঘিরে আক্রমণ চালালেও টানেল প্রযুক্তি ও আপামর জনগণ কে লড়াইয়ে সামিল করানোর রাজনীতির সাহায্যে আদিবাসী কৃষক কমিউনিস্টরা গড়ে তুললেন এক অভূতপূর্ব প্রতিরোধ সংগ্রাম ও গেরিলা যুদ্ধ। আধা সেনার কার্বাইন দখল করে চললো যুদ্ধ। ট্রাক ট্রাক ভরে পুলিশ ও আধা সেনার লাশ গেল ত্রিবেণী ঘাটের শ্মশানে আর নানা হাসপাতালে। গরুর পাল কে সামনে রেখে উঁচু জাতের হিন্দু পুলিশ ও আধা সেনার ধর্মীয় গোঁড়ামির সাহায্যে এলাকার নেতৃত্ব কে ঘেরাও ভেঙে বার করে দিতে সক্ষম হলেন আদিবাসী বিপ্লবীরা।

তবে এই সংগ্রামে কামালপুর যেখানে শয়ে শয়ে শাসকশ্রেণীর ভাড়াটে সেনা কে ধরাশায়ী করেছে, ঠিক সেখানেই কিন্তু শত্রুর আক্রমণে কামালপুর হারায় তিন মহাবিপ্লবী কে। লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কু (বাস্কে) তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে কামালপুরের লড়াই কে ভিয়েতনামের স্তরে তুললেন, ক্ষুদ্র অথচ তুচ্ছ নয়, যে বিন্দু বুকে সিন্ধুর চেতনা বয়ে নিয়ে যায়, সেই বিন্দু হিসেবে জ্বলে উঠে শাসকের মনে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করলো কামালপুর। পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রের পরাজয়ের চিহ্ন সেদিন বুক ঠুকে প্রমাণ করলো চারু মজুমদারের রাজনীতি যদি সঠিক ভাবে কৃষককে দেওয়া হয়, মাও সেতুঙের চিন্তাধারা যদি তাঁদের মধ্যে রোপন করা যায়, আর লিন পিয়াও এর জনযুদ্ধের তত্ত্ব কে যদি সত্যিই মানুষ কে উদ্বুদ্ধ করে প্রয়োগ করা যায় তাহলে কোন শক্তি ভারতের কৃষকের, শোষিত মানুষের বিজয়ের পল্টন কে আটকাতে পারবে না।

কামালপুর হওয়ার কিছু সপ্তাহ পরেই যদিও পুলিশের হাতে ধরা পড়েন বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা কাবুল, রামশঙ্কর ব্যানার্জি ও মনোতোষ চক্রবর্তী। রাষ্ট্র কিন্তু বিচারের প্রহসন না করেই হুগলীর ত্রিবেণী ঘাটে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল এই তিন বিপ্লবী কে ইন্দিরা গান্ধী, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, এবং ভারতের শাসকশ্রেণীর রক্ত পিপাসা চরিতার্থ করতে, তবুও কামালপুরের চেতনা কে কিন্তু সেই শাসকের অত্যাচার, হত্যালীলা বা নৃশংস আক্রমণ শেষ করতে পারেনি। সেই চেতনা কিন্তু ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে নানা প্রান্তে, নানা শোষিত মানুষের মধ্যে। কামালপুর তাই শত্রুর আতঙ্কের বস্তু হয়ে আজও অনেক মানুষের হৃদয়ের গভীরে বাস করছে। কামালপুর আজও, অনেক দশক ও প্রজন্ম পরেও বিপ্লবের দিকেই পা বাড়িয়ে রেখেছে কারণ কামালপুর চায় মানবজাতির মুক্তি, শোষিত মানুষের মুক্তি ও নতুন মানুষের জন্ম এক শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থায়।

কামালপুর মরে না, কামালপুর শেষ হয় না। ঠিক যেমন নকশালবাড়ি মরেনি, বরং শ্রীকাকুলাম, মাগুরজানের মধ্যে দিয়ে তা কামালপুরে ভারতের ভিয়েতনামের স্তরে উন্নীত হলো, ঠিক তেমনি কামালপুর গড়ে তোলে ইমার্জেন্সি কে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রেসিডেন্সি জেল ভাঙার সংগ্রাম, গড়ে তোলে বিহারের ঘোঘী-বরিয়ারপুরের সংগ্রাম, গড়ে তোলে অন্ধ্রের রাবিরালা। আজও বিহারের চারু মজুমদার নগর, মহাদেব মুখার্জি নগর, প্রভৃতি বিপ্লবী সরকার গড়ার সংগ্রামে কামালপুর দেয় হিম্মত, আর হিম্মত দেয় চারু মজুমদারের রাজনীতি।

আজ যখন দাঁত নখ বের করে ভারতের শাসক শ্রেণীর সবচেয়ে প্রিয় পোষ্য ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ লাফিয়ে পড়েছে বাংলা কে ছিন্ন ভিন্ন করে নিজের মালিকের লোভ ও লালসা কে চরিতার্থ করতে, যখন এই সংগঠনগুলো চূড়ান্ত ধরনের মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে গরিব হিন্দুদের, গরিব আদিবাসীদের, তাঁদের শ্রেণী মিত্র গরিব মুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কাচ্ছে, ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা ও হিংসার আগুনে হাওয়া দিচ্ছে বাংলায় হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং রাজ্য জুড়ে এক ধরণের অঘোষিত  একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে, তখন কামালপুর কে স্মরণ করা, ১২ই জুনের শপথগুলো কে স্মরণ করা ভীষণ জরুরি।

আজ যখন আদিবাসী মানুষের জল-জঙ্গল-জমির উপর নেমে আসছে কর্পোরেট আগ্রাসনের খাঁড়া, যখন হাসদেও আরোনদের ১৭০,০০০ হেক্টর জঙ্গল তুলে দেওয়া হলো আদানি গোষ্ঠীর হাতে গাছ কেটে মাটির বুক চিরে কয়লা উত্তোলন করে মুনাফার পাহাড় গড়তে, আজ যখন ঝাড়খণ্ডে ও লালগড়ে আদিবাসী জনগণ অনাহারে মরেন, যখন রাষ্ট্র ব্যাপক বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের উপর তখন কামালপুরের লাল তারার থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি হয়ে ওঠে, জরুরি হয়ে ওঠে কামালপুরের থেকে আত্মত্যাগের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার রাজনীতি শেখার ও সেই রাজনীতি কে ফুলকির মতন বারুদস্তূপে, অর্থাৎ শোষিত ও নির্যাতিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।

সেই ১২ই জুনের মহান বিপ্লবীদের স্বার্থে, সেই শহীদ হওয়া লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কু (বাস্কে), আর অন্যদিকে কাবুল, মনোতোষ চক্রবর্তী বা রামশঙ্কর ব্যানার্জি'র অপূর্ণ স্বপ্নের স্বার্থে আজ বাংলার গ্রামে গ্রামে, জনপদে জনপদে, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তুলতে হাজার হাজার কামালপুর গড়ে তুলতে হবে। তার জন্যে যে কমিউনিস্টরা কামালপুরের শহীদদের স্মরণ করে মাথা নত করেন শ্রদ্ধায়, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছুড়ে দেন আগামী কে জানান দিয়ে যে তাঁরা লড়ছেন, তাঁদের আজ পুনরায় রাজনীতি দিয়ে অসংখ্য লদ হেমব্রম, নিরাপদ হেমব্রম ও হলধর কিস্কুদের (বাস্কে) তৈরি করতে হবে, তাঁদের শ্রেণী নেতৃত্বে উন্নীত করতে হবে কারণ একমাত্র সেই শোষিত, নির্যাতিত মানুষের নেতৃত্বেই কমিউনিস্ট আন্দোলন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে পারবে অসংখ্য শহীদের স্বপ্নের লাল টুকটুকে ভোরের দিকে।  

এই ব্লগের সত্বাধিকার সম্বন্ধে